গল্পগ্রন্থ

তিনের ত্র্যহস্পর্শ

তিনের ত্র্যহস্পর্শ
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য থ্রি গ্যারিডেবস ]

কাহিনিটা কমেডি হতে পারে, ট্র্যাজেডিও হতে পারে। এর জন্যে তিনজনকে দাম দিতে হয়েছে তিন রকমের। একজন দিয়েছে বুদ্ধি, আমি দিয়েছি রক্ত, আর একজনের ঘটেছে শ্রীঘরবাস। তা সত্ত্বেও বলব বিচিত্র এই উপাখ্যানের মধ্যে কোথায় যেন একটা কৌতুকরস, একটা কমেডির সুর প্রচ্ছন্ন রয়েছে। যাকগে, বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম আপনাদের ওপর।

তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে একটা কারণে। ঠিক সেইদিনই নাইট খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিল শার্লক হোমস। যে-কাজের জন্যে এই সম্মান–সে-কাহিনি অন্য কোনো সময়ে বলা যাবেখন। যার গল্প আমি লিখি, তার কাজকর্মের গোপনতা রক্ষা করাও আমার ধর্ম।

সময়টা জুনের শেষ, সাল ১৯০২। দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে। বেশ কিছুদিন বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়েছে হোমসকে–যে-অভ্যেস মাঝেমধ্যেই দেখা যায় ওর মধ্যে।

কিন্তু সেই বিশেষ দিনটিতে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল হাতে একটা লম্বা ফুলক্যাপ কাগজ নিয়ে ধূসর শুষ্ক চোখে দেখলাম কৌতুকের ঝিকিমিকি।

বলল, ভায়া ওয়াটসন, দু-পয়সা করার একটা সুযোগ তোমায় দিচ্ছি। গ্যারিডেব নামটা কখনো শুনেছ?

না।

তাহলে খুঁজে পেতে বার করে ফেলো একটা গ্যারিডেবকে–পয়সা পাবে।

কেন?

সে এক মস্ত কাহিনি। খামখেয়ালের ব্যাপার। মানুষের চরিত্রে কতরকম জটিলতাই যে আছে–এই বিশেষ খামখেয়ালটি নজিরবিহীন। এখুনি আসছে লোকটা তখন জেরা করা যাবেখন। কাজেই এ নিয়ে এখন আর কথা বলব না। নামটা খালি দেখো।

টেলিফোন ডিরেক্টরিটা সামনেই টেবিলে পড়ে ছিল বলে পাতা উলটে দেখতে গিয়েছিলাম নিরাশ হব জেনেও, কিন্তু চমকে উঠলাম অদ্ভুত নামটা হঠাৎ চোখে পড়ায়।

হোমস, এই তো সেই নাম!

হাত থেকে ডিরেক্টরি নিয়ে পড়ে গেল হোমস, এন গ্যারিডেব, ১৩৬ লিটল রাসেল স্ট্রিট, ডব্লিউ। হল না ওয়াটসন, হল না। এ-চিঠি যে লিখেছে, এ-নামটা তারই। আমি চাই আর একজন গ্যারিডেবকে।

এই সময়ে ট্রে-র ওপরে একটা কার্ড নিয়ে ঘরে এল মিসেস হাডসন।

দেখেই বললাম বিষম অবাক হয়ে, পেয়েছি! এই তো আরেক গ্যারিডেব! জন গ্যারিডেব, কাউন্সিলর অ্যাটল, মূরভিল, কানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।

মৃদু হেসে হোমস বললে, ভায়া আবার চেষ্টা করো। এ-প্লটের অন্যতম নায়ক ইনি–যদিও সাতসকালে বাড়ি বয়ে চলে আসবেন আশা করিনি। এসেছেন যখন তখন পেট থেকে কিছু কথা বার করা যাক।

বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন মিস্টার জন গ্যারিডেব। ছোটোখাটো শক্তসমর্থ পুরুষ আমেরিকান ঢংয়ে দাড়িগোঁফ কামাননা গোলগাল পরিচ্ছন্ন মুখ–কীরকম যেন বাচ্চা বাচ্চা মুখশ্রী, দেখনহাসি ঝুলছে ঠোঁটের এ-কোণ থেকে সে-কোণ পর্যন্ত। চোখ দুটো কিন্তু নজর কাড়ার মতো। অন্তর্ভেদী, উজ্জ্বল, সজাগ। উচ্চারণ আমেরিকান কিন্তু উদ্ভট টান নেই।

আমাদের দুজনের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আপনিই মিস্টার হোমসছবিতে যা দেখেছি, ঠিক তাই। আমার নামে নামি মিস্টার নাথন গ্যারিডেবের কাছ থেকে একখানা চিঠি নিশ্চয় পেয়েছেন?

বসুন আপনিই মিস্টার জন গ্যারিডেব–আপনার নামও দেখছিলাম এই কাগজে। ইংলন্ডে বেশ কিছুদিন আছেন দেখছি।

সন্দেহ ঝিলিক দিল জন গ্যারিডেবের চোখে, এ-প্রশ্ন কেন?

ইংলিশ ছাঁটের কোট প্যান্ট পরেছেন বলে।

কাষ্ঠ হেসে ভদ্রলোক বললেন, আপনার এসব কায়দার কথা শুনেছি বটে। শেষ পর্যন্ত আমাকেই তার শিকার হতে হবে ভাবিনি। বুঝলেন কী করে?

কোটের কাঁধ আর বুটের ডগা দেখে।

ধাঁ করে রেগে গিয়ে জন গ্যারিডেব বললেন, কিন্তু জামার ছাঁট কীরকম তা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে আমি আসিনি। আমার সময়ের দাম আছে, মিস্টার হোমস। কাজ নিয়ে বেশ কিছুদিন আগেই লন্ডন এসেছি বলেই লন্ডনের কোট প্যান্ট পরতে হয়েছে।

হোমস চটিয়ে দিয়েছে ভদ্রলোককে চোখ-মুখ বেশ লাল করে ফেললেন কথা বলতে বলতে।

ধৈর্য ধরুন। আমার এই ছোটোখাটো পর্যবেক্ষণ যে তদন্তে সহায় হয় শেষ পর্যন্ত, ওয়াটসন তার সাক্ষী। মিস্টার নাথন গ্যারিডেব আপনার সঙ্গে এলেন না কেন বলুন তো?

আপনাকে এর মধ্যে টেনে আনার কী দরকার ছিল তা বলতে পারেন! আমার পেশা নিয়ে তাঁর কাছে গেছি, তিনি আমাদের মধ্যে বড়ো গোয়েন্দা মোতায়েন করলেন কী আক্কেলে? আজ সকালেই ওঁর মুখে শুনে মেজাজ খিঁচড়ে গেছে আমার। খুব খারাপ! খুব খারাপ! এসব চালাকির দরকার ছিল কি?

চটছেন কেন? আপনাকে বাজিয়ে দেখার জন্যে আমাকে তলব করেননি উনি, করেছেন আপনার লক্ষ্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছোনোর জন্যে। উনি জানেন খর জোগাড় করার ক্ষমতা আমার আছে।

শুনে গ্যারিডেবের রাগী মুখটা যেন একটু ফর্সা হল।

বললে, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। আজ সকালে ওঁর ওখানে গিয়েই শুনলাম ডিটেকটিভ লাগানো হয়েছে। আপনার ঠিকানা নিয়ে সোজা চলে এসেছি শুধু একটা কথা বলতে প্রাইভেট ব্যাপারে পুলিশ আবার কী? তবে হ্যাঁ, আপনি যদি সাহায্য করতে চান, কোনো ক্ষতি নেই।

তাহলে ব্যাপারটা খুলে বলুন। আমার এই বন্ধুটি তো কিছুই জানেন না।

ওঁর জানার কি দরকার আছে?

একসঙ্গেই তদন্ত করি দুজনে।

গোপন করারও দরকার দেখছি না। কানসাসে যদি থাকতেন, তাহলে আলেকজান্ডার হ্যামিলটন গ্যারিডেব যে কে, তা আর খুলে বলতে হত না। জমি কেনাবেচা করে ভদ্রলোক টাকার কুমির হয়ে যান। তারপর শিকাগোয় গমের ব্যাবসা করেন। তারপর আরকানসাস নদীর ধারে যত জমি আছে সব কিনে নেন।

ভদ্রলোকের তিনকুলে কেউ নেই। যেহেতু নিজের পদবি গ্যারিডেব, তাই অন্যান্য গ্যারিডেবদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার শখ ছিল প্রচণ্ড। অদ্ভুত খেয়ালও বলতে পারেন। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে সেই কারণেই। প্রায় বলতেন, আরও একটা গ্যারিডেব বার করুন দিকি! আমি বলতাম, অত সময় আমার নেই, উনি বলতেন, শেষ পর্যন্ত কিন্তু তাই করতে হবে। তখন বুঝিনি কথাটার আসল মানে কী।

বুঝলাম এই কথা বলার এক বছরের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুর পর। একটা অদ্ভুত উইল রেখে গেলেন। সমস্ত ভাগ করে গেছেন তিন ভাগে। এক এক ভাগের পরিমাণ পঞ্চাশ লক্ষ ডলার। পাবে তিনজন গ্যারিডেব। একজন আমি। আরও দুজনকে খুঁজে বার করতে হবে আমাকেই ততদিন সম্পত্তি কেউ পাবে না।

এতবড়ো মওকা পেলে আইনের কাজকারবার সরিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়া যায় গ্যারিডেবের খোঁজে। বেরোলামও। কিন্তু সারাযুক্তরাষ্ট্র চিরুনি আঁচড়ানো করেও পেলাম না একজন গ্যারিডেবকেও। এলাম লন্ডনে। লন্ডন টেলিফোন ডিরেক্টরিতে একজনের নাম দেখে ছুটলাম ভদ্রলোকের কাছে। গিয়ে দেখলাম আমার মতোই একক পুরুষ তিনি আত্মীয় কেউ নেই–উইলে কিন্তু ঠিক সেইরকমটিই চাওয়া হয়েছে। তার মানে দুজন গ্যারিডেব পাওয়া গেছে দরকার আরও একজনকে। আপনি যদি খুঁজে দিতে পারেন–দক্ষিণা পেয়ে যাবেন।

মুচকি হেসে হোমস বললে, কি ওয়াটসন, বলেছিলাম না কেসটা খামখেয়ালের কেস? মিস্টার গ্যারিডেব হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলমে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন?

দিয়েছি। জবাব পাইনি।

বলেন কী! সত্যিই বড়ো অদ্ভুত কেস দেখছি! হাত খালি থাকলে মাথা ঘামানো যাবেখন। ভালো কথা, টোপেকা থেকে কখন এসেছেন, তখন ডাক্তার লাইসান্ডার স্টারকে নিশ্চয় চেনেন? এককালে খুব চিঠিপত্র লিখতেন আমাকে। ১৮৯০ সালে মেয়র ছিলেন। এখন দেহ রেখেছেন।

ডাক্তার স্টার! কে-না চেনে ও-নাম? খুবই নামি পুরুষ ছিলেন। যাই হোক, এখন চলি। আসব দু-একদিনের মধ্যেই। নিশ্চয় খবর পাওয়া যাবে তখন, বলে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলেন আমেরিকান দর্শনার্থী।

অদ্ভুত হাসি ঠোঁটের কোণে ভাসিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে বসে পাইপ টানল হোমস।

অনেকক্ষণ পরে আমিই মুখ খুললাম, কী হয়েছে? কিছু বলো?

পাইপ নামিয়ে হোমস বললে, ভাবছি ওয়াটসন, আকাশ-পাতাল ভেবেই চলেছি।

কী নিয়ে ভাবছ ভায়া?

লোকটা এত ধাপ্পা মেরে গেল কেন। মুখের ওপর তা বলতে গিয়েও বললাম না–ও যে আমাদের বোকা বানিয়ে গেল–এই ধারণা নিয়েই যেতে দিলাম ইচ্ছে করেই। লোকটার হাতের কনুই থেকে সুতো বেরিয়ে এসেছে, প্যান্টের হাঁটু গোল হয়ে গেছে বছরখানেক লন্ডনে চষে না-বেড়ালে এমনি হয় না। অথচ বলছে সবে এসেছে আমেরিকা থেকে। সবে এলে উচ্চারণে মার্কিন টান থাকত–কিন্তু তা নেই। বেশ কিছুদিন এদেশের ঢংয়ে কথা বলায় উচ্চারণ প্রায় এদেশি। টোপেকায় ডাক্তার লাইসান্ডার স্টার বলে কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলমে এই ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন বেরোয়নি–বেরোলে আমার চোখে পড়তই–অপরাধীদের খোঁজখবর নিতে ওই কলমটি আমি আদ্যোপান্ত রোজ পড়ি। তাই ভাবছি লোকটা এত মিথ্যে বলে গেল কেন, নিশ্চয় পাক্কা বদমাশ। গ্যারিডেবদের খুঁজে বার করার ব্যাপারটাও একটা গল্প বানানো। এখন দেখা যাক, চিঠি যিনি লিখেছেন—সেই গ্যারিডেবটি জোচ্চোর কি না। টেলিফোন করো তো ওয়াটসন।

করলাম। অপর প্রান্তে শুনলাম ক্ষীণ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই নাথান গ্যারিডেব। মিস্টার হোমস আছেন? দিন তো, বড্ড দরকার।

হোমস রিসিভার নিয়ে কথা বলে গেল এইভাবে–

হ্যাঁ, এসেছিলেন এখানে। আপনার সঙ্গে খুব একটা পরিচয় নেই দেখেই বুঝেছি… কদ্দিন?… মাত্র দু-দিন!… নিশ্চয়, নিশ্চয়, এত বড়ো মওকা পেলে ছাড়া ঠিক নয়… সন্ধের দিকে বাড়ি থাকবেন? তখন যেন আমেরিকান গ্যারিডেব না থাকেন… ঠিক আছে, তখন আসব… ওঁর সামনে এসব কথা বলতে চাই না… ডাক্তার ওয়াটসন আমার সঙ্গেই আসবেন… চিঠি পড়ে বুঝলাম বাড়ি ছেড়ে বড়ো একটা বেরোন না… ঠিক ছটায় আসছি… আমেরিকান উকিলকে বলবেন না যেন আসছি… ঠিক আছে, গুডবাই!

বসন্তের মনোরম গোধূলি-আলোকে এসে দাঁড়ালাম লিটল রাইডার স্ট্রিটে। পড়ন্ত রোদে সোনালি দেখাচ্ছে পাথুরে রাস্তা। খুঁজে বার করলাম বাড়িটা। বেশ বড়ো বাড়ি। সেকেলে। পুরোনো আমলের জর্জিয়ান অট্টালিকা। সামনের দিকটা ইট দিয়ে তৈরি। দুটো বো-উইন্ডো–অর্থাৎ কুলুঙ্গিযুক্ত জানলা–যার তিনদিক থেকে আলো বাতাস আসতে পারে। যার খোঁজে আসা, তিনি থাকেন একতলাতেই এবং যতক্ষণ জেগে থাকেন, ততক্ষণ কাজ করেন এই দুটো জানলার সামনেই।

ছোটো ছোটো দুটো তামার প্লেট দেখিয়ে হোমস বললে, প্লেটের চেহারা দেখেছ? জরাজীর্ণ। তার মানে নামটা আসল নাম–নকল নয়।

একটাই সিঁড়ি বেয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয় এবং তারপর বিভিন্ন ঘরে যেতে হয় মাঝের হল ঘর থেকে। অনেক চেম্বার আর অফিসের নাম লেখা প্লেট লাগানো রয়েছে হল ঘরের দেওয়ালে। আবাসিক ফ্ল্যাটবাড়ি বলতে যা বোঝায়–এ-বাড়ি তা নয়। বরং বলা যায় বেশ কিছু বাউন্ডুলে ব্যাচেলারদের আস্তানা। মিস্টার নাথান গ্যারিডেব ভদ্রলোক নিজেই দরজা খুলে সমাদর করে নিয়ে গেলেন আমাদের। বয়স প্রায় ষাট। ঢিলেঢালা চেহারা। কৃশ অস্থিসর্বস্ব দীর্ঘকায় টেকো পুরুষ, মুখের চামড়া মড়ার চামড়ার মতো যেন ব্যায়াম কী বস্তু তা কখনো টের পায়নি দেহ মন্দির, একটু ঝুঁকে চলেন, পিঠ বেঁকিয়ে হাঁটেন। সব কিছু যেন খুঁটিয়ে তলিয়ে দেখেন গোল চশমার মধ্যে দিয়ে ছাগুলে দাড়ি নেড়ে। সব মিলিয়ে ভদ্রলোক অমায়িক, কিন্তু ছিটিয়াল।

ঘরটাও ভদ্রলোকের মতোই অদ্ভুত। বিশ্বের সব শাস্ত্রেই যে তাঁর অগাধ কৌতূহল–তার নিদর্শন ঘরময় ছড়ানো। ঘর তো নয় যেন একটা মিউজিয়াম। চওড়া, মোটা, লম্বা, খাটো আলমারি আর দেরাজে ঠাসা ঘরের প্রতি বর্গ ইঞ্চি মেঝে। প্রজাপতি আর মথ পোকা প্রবেশ পথের দু-পাশেই ঝুলছে বোর্ডে। মাঝখানে একটা মস্ত টেবিলে রাশি রাশি আবর্জনার মাঝে চকচক করছে অত্যন্ত শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপের লম্বা তামার নল। কোনো আধারে প্রাচীন মুদ্রার স্তুপ, কোথাও ফ্লিন্ট পাথরের যন্ত্রপাতি, কোথাও জীবাশ্ম শঙ্কু। ওপরে লাইনবন্দি মড়ার মাথার খুলির প্লাস্টার ছাঁচ। তলায় লেখা নিয়ানডারথাল, ক্রোম্যাগ, হাইডেলবার্গ। আমাদের ভেতরে ডেকে নিয়েও স্যাময় চামড়া দিয়ে একটা মুদ্রা ঘষে চকচকে করতে করতে বললেন, সাইরাকুসানদের সেরা সময়ের মুদ্রা পরের দিকে অধঃপতন ঘটেছিল যদিও। মিস্টার হোমস, চেয়ার থেকে হাড়গোড়গুলো সরিয়ে নিয়ে বসে পড়ুন। ডাক্তার ওয়াটসন, জাপানি ফুলদানিটা পাশে রেখে আপনিও বসুন। এইসব নিয়েই মশাই দিব্যি আছি। ডাক্তার বলে বাইরে বেরোই না কেন? বেরোতে কেন যাব বলতে পারেন? জীবনের আকর্ষণ যেখানে, জীবনটা তো সেখানেই কাটাব।

উৎসুক চোখে চারদিক দেখতে দেখতে হোমস বললে, কখনোই বেরোন না?

কদাচিৎ সোদবি অথবা ক্রিস্টিতে১২ যাই গাড়ি নিয়ে, নইলে এ-ঘরের চৌকাঠ পেরোই না। গায়ে শক্তিও তেমন নেই–গবেষণা ছেড়ে নড়বার উপায়ও নেই। খবরটা কিন্তু দারুণ, তাই

মিস্টার হোমস? রাতারাতি কুবের বনে যাচ্ছি। আর একটা গ্যারিডেব কি পাওয়া যাবে না? নিশ্চয় যাবে। আপনি অনেক অদ্ভুত কেস নাড়াচাড়া করেন জেনে আপনাকেই তাই চিঠি লিখে বসলাম। আমেরিকান ভদ্রলোক অবশ্য তা চান না কিন্তু আমি যা ভালো মনে করেছি, তাই করেছি।

খুব ভালো করেছেন, সায় দিল হোমস। কিন্তু সত্যিই কি আমেরিকার জমিদারি আপনি চান?

দূর মশায়, আমার দরকার টাকার। এসব ছেড়ে আমি কোথাও নড়ব না। ওই ভদ্রলোক বলে গেলেন উনিই পাঁচ লাখ ডলার দিয়ে কিনে নেবেন আমার অংশ। ভাবতে পারেন? মাত্র কয়েকশো পাউন্ডের অভাবে অত্যন্ত দরকারি কয়েকটা নমুনা কিনতে পারছি না, পাঁচ লাখ ডলার পেলে তা একালের হান্স স্লোন বনে যাব মশায়।

বলতে বলতে চশমার আড়ালে চোখ জ্বলতে লাগল গ্যারিডেবের।

হোমস বললে, কেস হাতে নিয়ে মক্কেলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে হয় বলেই আমি এসেছি। সব কথা চিঠিতেই লিখেছেন। দু-একটা প্রশ্ন শুধু করব। দু-দিন আগেও নিশ্চয় এই আমেরিকান ভদ্রলোকের খবর রাখতেন না?

ঠিক বলেছেন। রাখলাম মঙ্গলবার–উনি এলেন বলে।

আমাদের আজকের এই দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারে কিছু বলছেন উনি?

রেগে কাঁই হয়ে গেছেন।

কেন?

এতে নাকি তাঁর মাথা কাটা গেল। পরে অবশ্য বেশ খুশি মনেই গেলেন।

কী করবেন কিছু বলেছেন?

না।

টাকাপয়সা চেয়েছেন আপনার কাছে?

না, একদম না!

উদ্দেশ্যটা ধরতে পারছেন?

যা বলে গেলেন তার বেশি কিচ্ছু না।

আজকের এই অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা বলেছেন নাকি?

বলেছি।

চিন্তায় পড়ল হোমস। মুখ দেখে বুঝলাম সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

আপনার এখানে দামি জিনিস কিছু আছে?

না। পয়সাওলা লোক আমি নই, জিনিসপত্র সংগ্রহ করার বাতিক আছে বটে কিন্তু দামি জিনিস কিছু নেই।

চোর ডাকাতের ভয় করেন না?

এক্কেবারেই না!

কদ্দিন আছেন এ-ঘরে?

বছর পাঁচেক।

খটাখট খটাখট শব্দে কে যেন অধীরভাবে দরজা নক করায় বাগড়া পড়ল হোমসের জেরায়। দরজা খুলতেই ঝড়ের মতো ভেতরে ঢুকলেন আমেরিকান উকিল।

এই যে! এসে গেছেন দেখছি! মাথার ওপর একখানা কাগজ নাড়তে নাড়তে উল্লাসে যেন ফেটে পড়লেন ভদ্রলোক, জানতাম থাকবেন এখানে! অভিনন্দন নিন মিস্টার গ্যারিডেব। আজ থেকে আপনি টাকার কুমির হয়ে গেলেন। মিস্টার হোমস, মিছে কষ্ট দেওয়া হল আপনাকে।

বলেই কাগজখানা ধরিয়ে দিলেন নাথান গ্যারিডেবকে। ফ্যালফ্যাল করে কাগজে ছাপা বিজ্ঞাপনটার দিকে তাকিয়ে রইলেন খ্যাপাটে সংগ্রাহক। বিজ্ঞাপনটা এই–

হাওয়ার্ড গ্যারিডেব
কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাতা

বাইন্ডার্স, রীপার্স, স্টিম অ্যান্ড প্লাউস, ড্রিলস, হ্যারোজ, ফার্মাস কার্টস, বাকবোর্ডস এবং যাবতীয় যন্ত্রপাতি। আর্টেজীয় কূপখননের খরচপত্র জানানো হয়। গ্রসভেনর বিল্ডিংস, অ্যাসটন।

প্রায় খাবি খেতে খেতে বললেন নাথান গ্যারিডেব, দারুণ! দারুণ! তিন নম্বর গ্যারিডেব তাহলে এসে গেল!

আমেরিকান গ্যারিডেব বললেন, বার্মিংহ্যামে লোক লাগিয়েছিলাম। ওখানকার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা তারই চোখে পড়ে। লিখে দিয়েছি আপনি যাচ্ছেন।

আমি!

মিস্টার হোমস, আপনি কী বলেন? মিস্টার নাথান গ্যারিডেব ইংলন্ডের মানুষ আমি এসেছি আমেরিকা থেকে। ওকে অনেকে চেনে–আমাকে কেউ চেনে না। উনি গিয়ে যদি পুরো ব্যাপারটা হাওয়ার্ড গ্যারিডেবকে বুঝিয়ে বলেন, তিনি বিশ্বাস করবেনই, তাই না?

কিন্তু আমি যে লন্ডন ছেড়ে বেরোইনি অনেক বছর?

খুব একটা বেশি দূর তো যেতে হচ্ছে না। বারোটায় বেরোবেন–দুটো নাগাদ পৌঁছে যাবেন। রাতের মধ্যেই ফিরে আসবেন। কাজও এমন হাতি-ঘোড়া নয়। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলে তিনিই যে হাওয়ার্ড গ্যারিডেব তার একটা শপথপত্র নিয়ে আসবেন। আরে মশাই, আমি আমেরিকা থেকে ট্যাঙস ট্যাঙস করে এতটা পথ এলাম, আর আপনি এই এক-শো মাইল যেতে পারবেন না?

হোমস বললে, ঠিক বলেছেন।

অত্যন্ত নাচার ভঙ্গিমায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে নাথান গ্যারিডেব বললেন, বেশ, সবাই যখন বলছেন, তখন যাব।

ফিরে এসে খবর দেবেন কিন্তু, বললে হোমস।

সে-ভার আমার,সাততাড়াতাড়ি বললে আমেরিকান গ্যারিডেব। তাহলে ওই কথাই রইল মিস্টার নাথান। কাল আপনাকে রওনা করিয়ে দেব বার্মিংহ্যামে–আমার হাতে বড় কাজ শহর ছেড়ে নড়তে পারব না। আসছেন নাকি মিস্টার হোমস? আচ্ছা, তাহলে চলি। কাল রাত্রে সুসংবাদের আশায় থাকবেন।

আমেরিকান উধাও হতেই চিন্তার ঘোলাটে ভাবটা কেটে গেল হোমসের মুখ থেকে।

বললে, মিস্টার গ্যারিডেব, আপনার সংগ্রহগুলো দেখতে বড়ো ইচ্ছে যাচ্ছে। আমার এই পেশায় অনেক খবরই রাখতে হয় তো।

গোল চশমার আড়ালে চকচক করে উঠল নাথান গ্যারিডেবের দু-চোখ।

দেখবেন? আপনার বুদ্ধিমত্তার অনেক প্রশংসা আমি শুনেছি। যদি সময় থাকে তো বলুন নিজেই দেখাচ্ছি।

সময় এখন নেই কাল হবে। তা ছাড়া আপনি কষ্ট করে দেখাবেন কেন? এমন চমৎকার ভাবে লেবেল লাগিয়ে রেখেছেন যে নিজেই দেখে নিতে পারব। আপত্তি আছে?

এক্কেবারে না। ঘরদোর অবশ্য কাল বন্ধ থাকবে, চাবি থাকবে মিসেস সন্ডার্সের কাছে চারটে পর্যন্ত উনি থাকেন। আপনি চাইলেই চাবি পাবেন।

তাহলে একটু বলে রাখুন মিসেস সন্ডার্সকে। ভালো কথা, আপনার বাড়ির দালাল কে?

অতর্কিত প্রশ্নে অবাক হলেন নাথান গ্যারিডেব।

এজওয়্যার রোডে হলোওয়ে অ্যান্ড স্টিল। কিন্তু কেন বলুন তো?

বাড়িটা কত পুরোনো জানতে ইচ্ছে যাচ্ছে। কুইন অ্যানির আমলের না জর্জিয়ান?

জর্জিয়ান।

আমি অবশ্য আরও একটু পুরোনো ভেবেছিলাম। তাহলে এখন ওঠা যাক। সফল হোক আপনার বার্মিংহ্যাম সফর।

বাড়ির দালালের অফিস কাছেই। কিন্তু অফিস বন্ধ থাকায় ফিরে এলাম বেকার স্ট্রিটে। রাতের খাওয়া না-হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে আর একটা কথাও বলল না হোমস।

ডিনার শেষ হইতে বললে, ওয়াটসন, সমস্যার সমাধান হতে আর দেরি নেই। তুমিও ধরে ফেলেছ নিশ্চয়?

ল্যাজা মুড়ো কিছুই বুঝছি না।

ল্যাজটা কাল পরিষ্কার হয়ে যাবে, মুড়ো বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটায় প্লাউস বানানটা ভুল।

তুমিও দেখেছ? শাবাশ, দিনে দিনে তোমার বুদ্ধি খুলে যাচ্ছে। ছাপাখানায় যেমন বানান পৌঁছেছে, সেইরকমটিই ছাপা হয়েছে। বাকবোের্ডস শব্দটাও আমেরিকান। আর্টেজীয় কূপ আমেরিকায় বেশি চালু। সব মিলিয়ে, বিজ্ঞাপন আমেরিকান–ছাড়া হয়েছে ইংলন্ডের মাটিতে। কী বুঝলে?

আমেরিকান গ্যারিডেব নিজেই ছাপিয়েছে। উদ্দেশ্যটা বুঝছি না।

নাথান গ্যারিডেবকে ঘর থেকে সরানো। কালকে বোঝা যাবে কেন ভদ্রলোককে সরানো হল বার্মিংহ্যামে।

 

পরদিন সকাল সকাল উঠে বেরিয়ে গেল হোমস। ফিরল দুপুরে খাওয়ার সময়ে।

মুখ বেশ গম্ভীর।

বললে, ভায়া, কেসটা সিরিয়াস। বিপদ আছে।

কীরকম বিপদ?

খুন হয়ে যাওয়ার। জন গ্যারিডেবের আসল নাম খুনে ইভ্যান্স।

খুলে বললো।

অপরাধের পাঁজি স্মৃতির মধ্যে রেখে দেখার পক্ষে সম্ভব নয়–কেননা এটা তোমার জীবিকা নয়। আমারও মনে হয়েছিল আমেরিকান গ্যারিডেবের ঠিকুজি কুষ্ঠি জানতে হলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লেসট্রেডের কাছে যাওয়া দরকার; ওদের ঘিলুতে কল্পনা কম থাকতে পারে, কিন্তু খবর-টবরগুলো বেশ গুছিয়ে রাখে। চোর বদমাশ গুন্ডাদের ছবির ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম আমেরিকান গ্যারিডেবের হাসিহাসি গোলগাল মুখখানা। গায়ে অনেক নামের নামাবলি। জেমস উইনটার ওরফে মর্টিমার, ওরফে খুনে ইভ্যান্স। বয়স ছেচল্লিশ। শিকাগোেয় জন্ম। যুক্তরাষ্ট্রে গুলি করে মেরেছে তিনজনকে। সংশোধন কারাগার থেকে সরে পড়ে রাজনৈতিক প্রভাবের দরুন। লন্ডনে আসে ১৮৯৩ সালে। ১৮৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়াটারলু রোডের নাইট ক্লাবে তাসখেলা নিয়ে গুলি করে মারে একজনকে খুন যে হয়, সেই নাকি প্রথম খুন করতে গিয়েছিল খুনে ইভ্যান্সকে–এইরকমভাবে কেসটা দাঁড় করানোয় সে ছাড় পায় ১৯০১ সালে। নিহত ব্যক্তির নাম রোজার প্রেসকোট। শিকাগোর বিখ্যাত জালিয়াত–নকল টাকা তৈরি করতে অদ্বিতীয়। খুনে ইভ্যান্স সেই থেকে পুলিশের নজরবন্দি–সৎ জীবনযাপন করেছে বলেই জানা গেছে ভীষণ বিপজ্জনক লোক, সবসময় পিস্তল থাকে সঙ্গে, গুলি চালাতে একদম আটকায় না। ওয়াটসন, এই লোককেই সামাল দিতে হবে আমাদের।

কিন্তু এ-খেলায় তার লাভ?

বাড়ির দালালের কাছে গিয়ে শুনলাম, নাথান গ্যারিডেব এ-বাড়িতে পাঁচ বছর আছেন। তার আগে এক বছর বাড়ি খালি ছিল। তার আগে ও-ঘরে যে থাকত, তার নাম ওয়াল্ড্রন। বেকার। লম্বা দাড়িওলা, কালচে মুখ! লোকটা হঠাৎ যেন উবে যায়। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে জেনেছি, খুনে ইভ্যান্স যাকে খুন করেছে, সেই প্রেসকোটের চেহারাও অবিকল ওইরকম–লম্বা দাড়িওলা, কালচে মুখ। তাহলে ধরে নিতে পারি, আমেরিকার মহাবদমাশ রোজার প্রেসকোট নাম ভাঁড়িয়ে যে-ঘরে থাকত সেই ঘরেই এখন মিউজিয়াম সাজিয়ে বসেছেন নাথান গ্যারিডেব। এই হল রহস্য শৃঙ্খলের পয়লা নম্বর আংটা।

তার পরের আংটাটা কী?

সেটা গিয়ে দেখব।

বলে, ড্রয়ার খুলে একটা পিস্তল বার করে আমাকে এগিয়ে দিল হোমস।

আমারটা আমার কাছেই আছে! ঘণ্টাখানেক দিবানিদ্রার সময় তুমি পাবে। ওয়াটসন, তারপর বেরিয়ে পড়ব রাউডার স্ট্রিট অ্যাডভেঞ্চারে।

চারটে নাগাদ নাথান গ্যারিডেবের কোঠায় পৌঁছে দেখলাম মিসেস সন্ডার্স যাই-যাই করছেন। চাবিটা আমাদের কাছে গছিয়ে স্প্রিং-লক বাইরে থেকে টেনে দিয়ে তিনি বিদেয় হতেই একতলায় আমরা দুই মূর্তিমান ছাড়া আর কেউ রইলাম না। একটা আলমারি দেওয়াল থেকে একটু তফাতে বসানো ছিল। তার ফাঁকে গুড়ি মেরে ঢুকলাম দুজনে!

ফিসফিস করে হোমস বললে, ভায়া, নাথন গ্যারিডেবকে এ-ঘর থেকে অদ্ভুত অছিলায় সরানো হয়েছে নিশ্চয় একটা মতলব হাসিল করার জন্যে। খুনে ইভ্যান্সের ধড়িবাজির প্রশংসা না -করে পারছি না। তিন গ্যারিডেবের গল্পটা আগাগোড়া বানানো।

কিন্তু কেন?

প্রথমে ভেবেছিলাম নাথান গ্যারিডেবের সংগ্রহ করা জিনিসপত্রের মধ্যে এমন কিছু দামি জিনিস আছে যার দাম নাথান গ্যারিডেব নিজেই জানেন না। তারপর যখন রোজার প্রেসকোটের নাম শুনলাম, এ-ঘরেই এককালে সে থাকত জানলাম এবং ইভ্যান্সের হাতেই প্রেসকোটের নরকগমনের বৃত্তান্ত জ্ঞাত হলাম তখন বুঝলাম ব্যাপারটা আরও গভীরে এবং এই ঘরখানার মধ্যেই প্রেসকাটের কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। নাথান গ্যারিডেব ঘর ছেড়ে একদম বেরোন না বলে তার অদ্ভুত নামের সুযোগ নিয়ে অদ্ভুত গল্প বানিয়ে ঘর থেকে তাঁকে সরানো হয়েছে সেই রহস্য উদ্ধারের জন্যেই। একটু ধৈর্য ধরো–এখুনি জানা যাবে সেটা কী।

জানা গেল খুব তাড়াতাড়ি। আলমারির পেছনে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে থাকতেই শুনলাম সদর দরজা খোলার শব্দ। তারপরেই স্প্রিংলকে চাবি ঘোরানোর আওয়াজ। কড়াৎ করে তালা খুলে পাল্লা ঠেলে ঘরে ঢুকল আমেরিকান ইভ্যান্স। দরজা বন্ধ করে দিয়ে চোরা চাউনি চারদিকে বুলিয়ে নিয়ে হনহন করে এমনভাবে সটান মাঝের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল যেন কী করতে হবে তা নখদর্পণে। টেবিলটা টেনে সরিয়ে তলার কার্পেট চৌকো করে টেনে ছিঁড়ে গুটিয়ে রাখল একপাশে। পকেট থেকে সিধকাঠি বার করে ভীমবেগে মেঝে খুঁড়ে একটু পরেই হ্যাচকা টান মারতেই সড়াৎ করে কাঠের পাটাতন হড়কে সরে যাওয়ার শব্দ পেলাম। একটা চৌকো ফোকর বেরিয়ে পড়েছে মেঝেতে। বেঁটে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে জ্বালিয়ে নিয়ে পাতালে নেমে গেল ইভ্যান্স।

আড়াল থেকে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম দুজনে। মেঝের তক্তা আলগা ছিল বলেই হঠাৎ ক্যাঁচ শব্দ হতেই পাতাল ঘর থেকে সহসা বেরিয়ে এল ইভ্যান্সের মুখ। আমাদের দেখেই ভয়ংকর রাগে কঠিন হয়ে গেল মুখখানা। কিন্তু আবার তা হাসি হাসি হয়ে উঠল জোড়া পিস্তলের নলচে তার দিকেই ফেরানো রয়েছে দেখে। যেন দোষ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে এমনিভাবে কাষ্ঠ হেসে বললে, যাচ্চলে! সবই বুঝে ফেলেছেন দেখছি। খুব একহাত নিলেন তাহলে—

বলেই ফস করে বুক পকেট থেকে পিস্তল বার করে পর পর দু-বার গুলি করে বসল ইভ্যান্স। যেন একটা গরম লোহার শিক আমার উরু ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল টের পেলাম। একই সঙ্গে সশব্দে হোমসের পিস্তলের বাঁট নেমে এল ইভ্যান্সের খুলির ওপর রক্তাক্ত মুখে মুখ থুবড়ে পড়ল ইভ্যান্স। চকিতে তার পকেট হাতড়ে অস্ত্রস্ত্র বার করে নিয়ে আমাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল হোমস।

ওয়াটসন! ওয়াটসন! লেগেছে তোমার?

শুধু এই মুখের কথাটা–বজ্রকঠিন অনুভূতিবিহীন, আবেগহীন একটা মানুষের অন্তরের অন্তস্থল থেকে আকুল এই ক-টি কথা শোনার জন্যে একটা গুলি কেন–আরও গুলি খেয়েও পেছপা হতাম না। শুষ্ক কঠোর দুই চক্ষু উদবেগে নিমীলিত হয়ে গিয়েছে দেখে বুকের ভেতরটা আমার কীরকম যেন করে উঠল।

বললাম, কিছু হয়নি, হোমস। সামান্যই।

পকেট ছুরি বার করে আমার ট্রাউজার্সের খানিকটা ফাঁস করে কেটে ছিঁড়ে ফেলল হোমস। ক্ষতস্থান দেখে বললে হাঁফছাড়া গলায়, যাক চামড়া কেটে বেরিয়ে গেছে। ওহে, এবার তোমার পালা। যার উদ্দেশে বলা হল শেষ কথাটা, সে তখন টলতে টলতে উঠে বসেছে মেঝের ওপর। ওয়াটসন মারা গেলে তোমাকেও আর জ্যান্ত বেরোতে হত না ও-ঘর থেকে।

বেহুঁশের মতো বসে রইল ইভ্যান্স। হোমেসের হাতে ভর দিয়ে পাতাল ঘরের কিনারায় গিয়ে উঁকি দিলাম ভেতরে। ইভ্যান্সের জ্বালানো মোমবাতির আলোয় দেখলাম বিস্তর মরচে ধরা যন্ত্র, রাশিরাশি বোতল আর একপাশে এক টেবিলের ওপর ছোটো ছোটো কাগজের বান্ডিল থরে থরে সাজানো।

হোমস বললে, ছাপাখানা–নোটজালের কারখানা।

আজ্ঞে হ্যাঁ, রোজার প্রেসকোটের নোটজালের কারখানা গোটা লন্ডন শহরে এতবড়ো জালিয়াত আর ছিল না। বলতে বলতে কোনোরকমে উঠে গিয়ে একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল ইভ্যান্স। টেবিলের ওপর দেখছেন দু-লক্ষ পাউন্ডের জাল নোট। আসুন, ভাগ নিন, চেপে যান।

হাসল হোমস।

এদেশে বখরা দিয়ে সটকানো যায় না ইভ্যান্স। প্রেসকোটকে তাহলে তুমিই খতম করেছিলে?

হ্যাঁ, করেছিলাম। করে আপনাদের অনেক উপকারই করেছি। প্রেসকোটের নোটের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অফ ইংলন্ডের নোটের কোনো তফাত নেই–বাজারে বেরোলে টের পেতেন। আমি বাঁচিয়ে দিয়েছি আপনাদের। তারপর না হয় নোটগুলো লুকোনো আছে কোথায় সেই খোঁজেই বেরিয়েছিলাম–দোষটা কোথায়? এখানে এসে দেখি এই মক্কেল ঘর জুড়ে বসে—কস্মিনকালেও বেরোয় না ঘর থেকে জানেও না বসে আছে বিশলাখ পাউন্ডের ওপর। খুন করলেই আপদ মিটে যেত–এত ঝামেলা হত না। আমি আবার শুধু শুধু কাউকে গুলি করি না—গুলি না-করতে এলে গুলি চালাই না। প্রেসকোট ভুল করেছিল। কিন্তু এই মক্কেলকে ভালোয় ভালোয় সরিয়ে দিতে গিয়ে জড়িয়ে পড়লাম জালে। ধরে কিন্তু রাখতে পারবেন না–নোট আমি জাল করিনি।

কিন্তু খুন করতে গিয়েছিলেন। বললে হোমস। যাকগে, সে দেখবার মালিক আমরা নই। ওয়াটসন, দাও তো ভায়া স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে একটা ফোন করে। ওদের পাখি নিয়ে যাক ওরা।

খুনে ইভ্যান্সের কিন্তু মন ভেঙে গেল এই ঘটনায়। স্বপ্নভঙ্গের পরিণামে নার্সিং হোমে কাটাতে হল দীর্ঘদিন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল লন্ডনের সি. আই. ডি. ডিপার্টমেন্ট। অনেকদিন ধরেই তারা খবর রেখেছিল প্রেসকোটের নোট জালের কারখানা লন্ডনেই আছে কিন্তু ঠিক কোথায় আছে সে-হদিশ পাচ্ছিল না কিছুতেই। পাবলিকের এতবড়ো একটা বিপদের অবসান ঘটায় তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগল বটে, কিন্তু খুনে ইভ্যান্সের জেল হয়ে গেল অ্যাটেম্পটেড মার্ডারের চার্জে।

————-

টীকা

তিনের ত্র্যহস্পর্শ : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য থ্রি গ্যারিডেবস ২৫ অক্টোবর ১৯২৪ তারিখের কলিয়ার্স উইকলিতে এবং জানুয়ারি ১৯২৫ সংখ্যার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।

নাইট খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিল শার্লক হোমস : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য গোল্ডেন প্যাশনে গল্পে জানা যায় শার্লক হোমস ফরাসি দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান লিজিয় দ্যনর গ্রহণ করেছেন ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে তার নাইট খেতাব প্রত্যাখ্যানের কারণ অজ্ঞাত থেকে যায়।

টেলিফোন ডিরেক্টরিটা : ডিরেক্টরির উল্লেখ পাওয়া গেলেও বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে টেলিফোনের উল্লেখ পাওয়া যায় শুধুমাত্র দি ইলাসট্রিয়াস ক্লায়েন্ট এবং দ্য রিটায়ার্ড কালারম্যান গল্পে।

মূরভিল : কয়েকজন গবেষক জানিয়েছেন কানস রাজ্যে মুরভিল নামে কোনো জায়গা নেই।

কানসাস : বা কানস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্য।

ছবিতে যা দেখেছি : খবরের কাগজের রিপোর্টে হোমসের ছবি, নাকি পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন ইলাসট্রেটরের আঁকা ছবি, তা কিন্তু বলেননি জন গ্যারিডেব।

পঞ্চাশ লক্ষ ডলার : বর্তমানের সূচকে কিন্তু এক-শো মিলিয়ন ডলারেরও বেশি টাকা।

নিয়ানডারথাল : ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ানডার উপত্যকায় আবিষ্কৃত আদিম গুহাবাসী হোমোস্যাপিয়ান্সের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। মনে করা হয় এই মানুষ ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যে প্লিস্টোসিন যুগের শেষ ভাগে বাস করত।

ক্রোম্যাগ : দশ হাজার থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগেকার মানুষ হোমোস্যাপিয়েন্সের শেষদিকের প্রতিনিধি।

হাইডেলবার্গ : হোমমা ইরেকটাস বা হোমোস্যাপিয়েন্সের অন্তর্গত হাইডেলবার্গ ম্যানের চোয়ালের হাড় ১৯০৭-এ জার্মানির হাইডেলবার্গ শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে। মনে করা হয় এই মানুষ পৃথিবীতে বিচরণ করতেন চার লক্ষ বছর আগে।

সাইরাকুসান : সিসিলির সাইরাকুস বা সাইরাকিউস শহর রোমানরা দখল করে ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

সোদবি অথবা ক্রিস্টি : সোদবিজ এবং ক্রিস্টিজ লন্ডন শহরের দুই প্রতিদ্বন্দী নিলামঘর। ১৭৪৪-এ সোদবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রিস্টিজ হয় ১৭৬৬ সালে।

হান্স স্লোন : স্যার হান্স স্লোন (১৬৬০-১৭৫৩) ছিলেন ধনকুবের এবং সংগ্রাহক। এর সংগ্রহ নিয়েই ব্রিটিশ মিউজিয়ম প্রথম ভোলা হয়।

জর্জিয়ান : ১৭১৪ থেকে ১৮৩০, রাজা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ জর্জের রাজত্বে নির্মিত স্থাপত্য বা তদসম্পর্কিত অন্য কিছু।

চাবি ঘোরানোর আওয়াজ : বাড়ির চাবি খুনে ইভান্স পেল কোথা থেকে? চোরের মতো উপায়ে খুলে থাকলে, এভাবে একবার ঘুরিয়েই তালা খোলা যেত না।