গল্পগ্রন্থ

কালাপাহাড়ের কাণ্ড নয়

কালাপাহাড়ের কাণ্ড নয়
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সিক্স নেপোলিয়ন্স ]

প্রায় সন্ধ্যাতেই আমাদের ঘরে আসতেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মি. লেসট্রেড।

সেদিন সন্ধ্যাতেও খবরের কাগজ আর আবহাওয়া সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করার পর চুপচাপ বসে ছিল লেসট্রেড। আনমনা ও চিন্তামগ্ন মুখে সিগার টানছিল অনেকক্ষণ ধরে। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে হোমস জিজ্ঞাসা করে, জবর খবর আছে মনে হচ্ছে?

লেসট্রেড বলল, ধরেছেন ঠিকই মি. হোমস, বাস্তবিকই বড়ো চিন্তায় পড়েছি। আমার মনে হয়, এটা আমাদের আওতায় না-এসে ডক্টর ওয়াটসনের এক্তিয়ারেই আসা উচিত।

অসুখবিসুখ নাকি? শুধোলাম আমি।

উন্মত্ততাই বলতে পারেন। তাও আশ্চর্য রকমের খেপামো। আপনি কি মনে করেন আজও আমাদের সমাজে প্রথম নেপোলিয়নের ওপর তীব্র ঘৃণা নিয়ে লোকে বেঁচে আছে এবং তার যা প্রতিমূর্তি পাচ্ছে, তাই ভেঙে চুরমার করে ফেলছে?

হেলান দিয়ে বসল হোমস। বলল, এসব নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর সময় নেই।

যা বলেছেন। আমার মতও তাই। এ নিয়ে আমিও মোটেই মাথা ঘামাতাম না যদি না লোকটা পরের মূর্তি চুরি করে ভাঙা শুরু করত। চুরিচামারি শুরু হতেই পুলিশের টনক নড়েছে, মানে নড়াতে বাধ্য করেছে।

চুরিচামারি? আবার সিধে হয়ে বসে হোমস। বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে তো! তাহলে সব খুলেই বলো লেসট্রেড।

নোটবুক বার করে স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিলে লেসট্রেড।

তারপর বলল, প্রথম ঘটনাটা ঘটে আজ থেকে ঠিক চারদিন আগে মর্স হাডসনের দোকানে। দোকানটা কেনিংটন রোডে। মূর্তি আর ছবি ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি হয় না সেখানে। সেদিন সামান্যক্ষণের জন্যে সামনের দরজা ছেড়ে ভেতর দিকে গেছল কাউন্টারের কর্মচারী–হঠাৎ দমাস শব্দ শুনে ছুটে এসে দেখে কি নেপোলিয়নের একটা মূর্তি চুরমার হয়ে পড়ে রয়েছে মেঝের ওপর। কাউন্টারের ওপর আরও অনেকগুলো মূর্তির সাথে এ-মূর্তিটাও সাজানো ছিল।

সময় নষ্ট না-করে তৎক্ষণাৎ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল সে। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেল না। কয়েকজন অবশ্য বললে যে একটা লোককে তিরবেগে দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়ে উধাও হয়ে যেতে দেখেছে তারা, সে-লোকটাকে যে কী করে চিনে বার করা যাবে, সে-রকম নিশানা তারা দিতে পারল না।

সবাই ভাবলে নিশ্চয় কোনো নচ্ছার লোকের বিটলেমো। এ-রকম বদমাইশি তো হামেশাই হচ্ছে এ-শহরে। কাজেই এই সামান্য বিষয় নিয়ে আর মাথা না-ঘামিয়ে বীটের কনস্টেবলকে জানানো হল খবরটা। তাদের কর্তব্য শেষ হল ওইখানেই। কেননা, মাত্র কয়েক শিলিং দামের সস্তা একটা প্লাস্টারের ছাঁচ ভাঙা ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছু না। কাজেই, এ নিয়ে আর জোরালো তদন্তের প্রয়োজন কেউ মনে করেনি।

দ্বিতীয় ঘটনাটা কিন্তু আরও আশ্চর্য রকমের এবং এত সহজে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কাল রাতের ব্যাপার।

কেনিংটন রোডে মর্স হাডসনের দোকানের শ-খানেক গজের মধ্যে ডা. বার্নিকট থাকেন।

ডা. বার্নিকট নেপোলিয়নের দারুণ ভক্ত এবং চব্বিশ ঘণ্টা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাড়িতেও তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন রাশি রাশি বই, ছবি আর দুষ্প্রাপ্য জিনিস, বলা বাহুল্য সবই সম্রাট নেপোলিয়ন সংক্রান্ত। কিছুদিন আগে মর্স হাডসনের দোকান থেকে তিনি দুটি প্লাস্টারের ছাঁচ কেনেন। একই ছাঁচ থেকে তৈরি দুটি মূর্তিতে শিল্পী নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল নেপোলিয়নের বিখ্যাত আবক্ষ রূপটুকু। ভাস্কর একজন ফরাসি। নাম–ডিভাইন।

ডা. বার্নিকট একটি মূর্তিকে রেখেছিলেন তাঁর কেনিংটন রোডের হল ঘরে। আর একটি লোয়ার ব্রিক্সটনের সার্জারিতে ম্যান্টলপিসের ওপর।

আজ সকালে নীচের হল ঘরে নেমে এসে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন ডা. বার্নিকট।

দেখলেন, অদ্ভুত এক চোর গত রাতে তার অনধিকার প্রবেশের চিহ্ন রেখে গেছে হল ঘরে।

অদ্ভুত এই কারণে যে রাশি রাশি মূর্তির মধ্যে থেকে চোর শুধু বেছে নিয়েছে নেপোলিয়নের মূর্তিটাই এবং তাও বাগানের দেওয়ালে দারুণ আক্রোশে আছড়ে ভেঙে রেণু রেণু করে রেখে গেছে। সবকটা টুকরোই পাওয়া গেছে দেওয়ালের নীচে।

হাত রগড়াতে রগড়াতে হোমস শুধু বললে, বেশ অভিনবত্ব আছে দেখছি।

আমি জানতাম খুশি হবেন আপনি। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি আমার কাহিনি। সেদিন দুপুর বারোটায় সার্জারিতে আসার পর চক্ষুস্থির হয়ে গেল ডা. বার্নিকটের।

দেখলেন, সেখানেও চোর ঢুকেছিল গত রাত্রে। জানলা খোলা। আর, ঘরময় ছত্রাকার হয়ে পড়ে তার অতিপ্রিয় নেপোলিয়নের অগুনতি ভাঙা টুকরো। এক্ষেত্রে অবশ্য ম্যান্টলপিসের ওপরই আছড়ে গুঁড়ো করা হয়েছে মূর্তিটাকে।

কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই এমন কোনো সূত্র পড়ে নেই যাকে নিয়ে এই পাগলই বলুন, বদমাইশই বলুন, লোকটার কোনো হদিশ খুঁজে বের করতে পারি। এখন বলুন, মি. হোমস, কী করা উচিত আমার!

বাস্তবিকই লেসট্রেড, সবকটা ঘটনাই শুধু অদ্ভুত নয়–কিম্ভুত। যাই হোক, আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে। মর্স হাডসনের দোকানে যে-মূর্তিটা গুঁড়ো হয়েছে, আর ডা. বার্নিকটের যে-মূর্তি দুটো চুরমার হয়েছে, সবগুলোই কি একই ছাঁচ থেকে তৈরি?

হ্যাঁ।

তাহলে তো তোমার থিয়োরিটাই নাকচ হয়ে যাচ্ছে। তোমার ধারণা, নেপোলিয়নের ওপর তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে কেউ সমানে মূর্তি ভেঙে চলেছে। এ-ধারণা ভুল এই কারণে যে, এ-শহরে শক্তিমান সম্রাট নেপোলিয়নের শত শত মূর্তির মধ্যে এই আধখেপা কালাপাহাড়ের পক্ষে একই ছাঁচে তৈরি তিনটি মূর্তি পর পর ভেঙে ফেলা অসম্ভব নয়। এরকম ধরনের কাকতালীয় কল্পনাও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।

লেসট্রেড বললে, আপনার মতো আমিও ভেবেছিলাম মি. হোমস। কিন্তু ভাববার আর একটা দিকও আছে। লন্ডনের ওই অঞ্চলে আবক্ষ মূর্তি কেনাবেচা করে শুধু একজনই এবং মর্স হাড়সন। আর শুধু এই তিনটে মূর্তিই বেশ কয়েক বছর ধরে পড়ে ছিল তার দোকানে। সুতরাং আপনার কথামতো শহরে শত শত মূর্তি থাকলেও শুধু এই তিনটে মূর্তিই ছিল এ-অঞ্চলে। কাজেই কোনো স্থানীয় অতি-উৎসাহীর পক্ষে ওই তিনটে দিয়ে কাজ শুরু করা অসম্ভব নয়। আপনি কি বলেন ডা. ওয়াটসন?

আমি বললাম, Monoman।ac বা বাতিকগ্রস্ত মানুষ যে কত কী করতে পারে, তার কোনো শেষ নেই। এই মানসিক অবস্থাকে আধুনিক ফরাসি মনোবিজ্ঞানীরা ।dee f।xe নাম দিয়েছেন।

মাথা নাড়তে নাড়তে হোমস বললে, মাই ডিয়ার ওয়াটসন! তা হতে পারে না এই কারণে যে ।dee f।xe তে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও কোনো বাতিকগ্রস্তের পক্ষেই মূর্তিগুলোর ঠিকানা খুঁজে বার করা সম্ভব নয়।

বেশ তাই যদি হয়, তবে তোমার বক্তব্যটা শুনি।

আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি শুধু দেখছি যে ভদ্রলোকের খাপছাড়া কার্যকলাপের মধ্যেও বিশেষ একটা পদ্ধতি আছে। যেমন ধর না কেন ডা. বার্নিকটের হল ঘরে। সেখানে সামান্য শব্দ হলেই বাড়ির লোক জেগে উঠতে পারে, কাজেই মূর্তিটাকে না-ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাগানে সেখানে দেওয়ালের ওপর আছাড় মারা সত্ত্বেও কারো ঘুম ভঙেনি। আবার সার্জারিতেও যেখানে এত সাবধান না-হলেও চলবে, সেখানে মূর্তিটাকে তুলে নিয়ে আছাড় মারা হয়েছে যেখানে সেটা ছিল সেই ম্যান্টলপিসের ওপরেই। সেই কারণেই তিনটে মূর্তি ভাঙা গল্প শুনে আমি হাসাহাসি করতে চাই না। এই আশ্চর্য ঘটনাগুলোর পর নতুন কিছু যদি আবার ঘটে আমাকে জানতে ভুলো না লেসট্রেড। আমি তাতে সত্যিই খুব খুশিই হব।

পরের দিন সকালে তখনও আমি শোবার ঘরে সাজগোজ করছি। এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকল হোমস। হাতে তার একটা টেলিগ্রাম। টেলিগ্রামটা সে-ই পড়ে শোনাল : এখুনি চলে আসুন, ১৩১ পিট স্ট্রিট, কেনসিংটন–লেসট্রেড।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পিট স্ট্রিটে। লন্ডনের একটি অতিচঞ্চল জীবনধারার ঠিক পাশেই যেন একটি স্থির জলাশয়। ছোট্ট অথচ শান্ত!

১৩১ নম্বর বাড়িটাকে পেলাম একসারি বাড়ির মাঝখানে। সারির প্রতিটি বাড়িই সাদাসিধে গঠনের। সুন্দর না-হলেও সৌম্য। গাড়ির মধ্যে থেকেই দেখলাম, বাড়ির সামনের রেলিংয়ে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে ছোটোখাটো একটা উৎসুক জনতা।

লেসট্রেড খুব গম্ভীরমুখে আমাদের এগিয়ে নিতে এল। ওর পিছু পিছু বসবার ঘরে এসে দেখলাম, ঘরের এ-মোড় থেকে ও-মোড় পর্যন্ত অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছেন এক প্রৌঢ়। চুল উশকোখুশকো, পরনে ফ্লানেলের ড্রেসিং গাউন।

আলাপ পরিচয় হল। শুনলাম ইনিই সেন্ট্রাল প্রেস সিন্ডিকেটের* মি. হোরেস হার্কার–এ-বাড়ির মালিক। সাংবাদিক।

লেসট্রেড বলল, আবার নেপোলিয়নের মূর্তি, মি. হোমস! গতরাত্রে আপনার খুব আগ্রহ দেখেছিলাম এ-ব্যাপারে, তাই ভাবলাম আপনাকে একবার খবর দিই। কেসটা আর তাচ্ছিল্য করবার মতো নয়, খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যথা?

খুন। মি. হার্কার এঁদের সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলবেন কি? কিছুই বাদ দেবেন না।

বিষণ্ণ মুখে আমাদের পানে তাকালেন মি. হার্কার। বললেন, রীতিমতো তাজ্জব বনে গেছি আমি

মাস চারেক আগে নেপোলিয়নের একটা আবক্ষ মূর্তি কিনেছিলাম এই ঘরে রাখব বলে। যত গণ্ডগোল মনে হচ্ছে ওই মূর্তিকে নিয়েই। স্টেশন থেকে দু-পা গেলেই হার্ডিং ব্রাদার্সের দোকান। মূর্তিটা তাদের দোকান থেকেই কিনেছিলাম।

আমার সাংবাদিকতার বেশির ভাগ কাজই সারতে হয় রাত্রে। লিখতে লিখতে রাত দুটো তিনটে তো হামেশাই বাজে। কাল রাতেও হয়েছে তাই। ওপরতলায় পেছনের দিকে আমার ঘরে একটানা লিখে চলেছি–রাত তখন প্রায় তিনটে।

হঠাৎ মনে হল নীচের তলায় সিঁড়িতে কীসের যেন শব্দ হচ্ছে। কান খাড়া করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ–কিন্তু কিছুই আর শুনতে পেলাম না। শব্দটা যে বাইরের–সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

ঠিক তার মিনিট পাঁচেক পরেই, আচমকা এক ভয়াবহ আর্তনাদ ভেসে এল কানে। মি. হোমস, অনেকরকম চিৎকার সারাজীবনে শুনেছি, কিন্তু এ-রকম রক্ত-হিম-করা শব্দ আর শুনিনি। যতদিন বেঁচে থাকব এ-চিকার আমি ভুলব না।

মিনিট খানেক কি দুয়েক পাথরের মতো বসে ছিলাম। তারপরেই চুল্লি খোঁচাবার লোহার ডান্ডাটা নিয়ে গেলাম নীচে।

ঘরে ঢুকে দেখলাম জানলা দু-হাট করে খোলা এবং পর মুহূর্তেই বুঝলাম ম্যান্টলপিসের ওপর থেকে উধাও হয়েছে নেপোলিয়নের মূর্তিটা। কিন্তু কিছুতেই আমি বুঝে উঠছি না এ-রকম একটা জিনিস চুরি করে কী লাভ! সামান্য একটা প্লাস্টারের ছাঁচ! কতই-বা আর তার দাম।

আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন মি. হোমস, লম্বা একটা লাফ মেরে জানলা থেকে সামনের দরজার ধাপেতে পৌঁছোনো এমন কিছু কঠিন নয়। চোর মহাপ্রভুও নিশ্চয় সেই পথেই উধাও হয়েছেন মনে করে তৎক্ষণাৎ ঘুরে গিয়ে খুলে ফেললাম সামনের দরজা। অন্ধকারের মাঝে পা বাড়িয়েই হোঁচট খেলাম একটা মৃতদেহের ওপর। চৌকাঠের ঠিক সামনেই পড়ে ছিল লাশটা।

দৌড়ে গিয়ে আলো এনে দেখলাম শুধু রক্ত আর রক্ত। রক্তের পুকুরের মধ্যে যেন সাঁতার কাটছে লোকটা। গলাটা ধারালো অস্ত্রের কোপে হাঁ হয়ে রয়েছে। চিত হয়ে পড়ে ছিল দেহটা, হাঁটু দুটো গুটোনো, মুখটা বীভৎসভাবে হাঁ করা। স্বপ্নের মধ্যেও সে-দৃশ্যকে আমি ভুলতে পারব না। আমার কাছেই পুলিশ হুইসেল ছিল। কিন্তু বাজানোর পরেই বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা, এরপর কী হয়েছে আর মনে নেই। চোখ খুলে দেখলাম হল ঘরে আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন পুলিশের লোক।

হোমস জিজ্ঞাসা করে, তাহলে খুন হল কে?

জবাব দেয় লেসট্রেড, চেনার কোনো উপায় নেই। মর্গে গেলেই লাশটা দেখতে পাবেন। কিন্তু এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা এক ইঞ্চিও এগোতে পারিনি। লোকটা বেশ লম্বা, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, রীতিমতো শক্তিমান, বয়স তিরিশের ওদিকে নয়। জামাকাপড় সস্তা দামের। অথচ তাকে দেখলে শ্রমিক বলে মনে হয় না। পাশেই থইথই রক্তের মাঝে শিংয়ের হাতলওলা একটা ছুরি পড়ে ছিল। এই ছুরি দিয়েই কাজ সারা হয়েছে কি না অথবা তা মৃত লোকটার কিনা তা আমি জানি না। জামাকাপড়ের কোনো নাম পাইনি। পকেটে একটা আপেল, কিছু সরু দড়ি, এক শিলিং দামের লন্ডনের একটা ম্যাপ আর একটা ফটোগ্রাফ ছাড়া কিছু ছিল না। এই দেখুন সেই ফটোগ্রাফ।

ছবিটা যে একটা ছোটো ক্যামেরা থেকে নেওয়া স্ন্যাপশট, তা দেখলেই বোঝা যায়। লোকটার চেহারা চোখাচোখা, বানরের মতো চনমনে, মোটা মোটা ভুরু আর অনেকটা বেবুনের চোয়ালের মতো মুখের তলার অংশ খানিকটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।

সতর্ক চোখে ছবিটা দেখে জিজ্ঞেস করে হোমস, মূর্তিটা কী হল?

আপনি আসার ঠিক আগেই খবর পেলাম। ক্যাম্পডেন হাউস রোডে একটা খালি বাড়ির সামনের বাগানে পাওয়া গেছে মূর্তিটাকে। আস্ত অবশ্য নয়, টুকরো টুকরো অবস্থায়। ওইদিকেই যাচ্ছি এখন, আসবেন নাকি?

সে-কথা আর বলতে। তার আগে চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিই। কার্পেট আর জানলা পরীক্ষা করে বলল হোমস, হয় লোকটার বেশ লম্বা লম্বা ঠ্যাং আছে, আর না হয় বেশ করিতকর্মা পুরুষ সে। এতখানি জায়গা টপকে জানলার কিনারায় পৌঁছে জানলা খোেলাটা কম বাহাদুরি নয়। ফিরে আসা বরং অনেক সোজা। মি. হার্কার, আমাদের সাথে আসছেন নাকি? গেলে আপনার মূর্তির চরম পরিণতিটা দেখতে পেতেন।

লেখবার টেবিলে শুকনো মুখে বসে ছিলেন মি. হাকার। বললেন, না মশাই, যা হয় একটা কিছু খাড়া করার চেষ্টা করতে হবে এখন। সবকটা ইভনিং পেপারের প্রথম সংস্করণেই যে আদ্যোপান্ত খবরটা বেরিয়ে গেছে এতক্ষণে সে-বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। ভীষণ দেরি করে ফেলেছি। দোরগোড়ায় দারুণ খুন, আর আমি কিনা—।

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে শুনলাম ফুলস্ক্যাপ কাগজের ওপর জার্নালিস্টের কলম আর্তনাদ করে ছুটে চলেছে।

চূর্ণবিচূর্ণ মূর্তিটাকে পাওয়া গেছে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে। মহাপরাক্রমশীল সম্রাটের এমন শোচনীয় পরিণতি দেখলাম এই প্রথম। আততায়ীর অন্তরে তাঁর প্রতি নিদারুণ ঘৃণা যে কতটা তা রেণু রেণু অংশগুলো দেখলে খানিকটা বুঝতে পারা যায়। ঘরের এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিল শতধা চূর্ণ টুকরোগুলো। হোমস কয়েকটা পরীক্ষা করল। তার নিবিষ্ট চোখ আর হাবভাব দেখে বুঝলাম শেষ পর্যন্ত একটা সূত্রের সন্ধান পেয়েছে সে।

হল? শুধোল লেসট্রেড।

দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে হোমস বললে, তুড়ি মেরে কি আর কুয়াশা কাটানো যায়? এখনও অনেক অনেক পথ মাড়িয়ে যেতে হবে। তবু কি জানো, দু-একটা ঘটনার মধ্যে কিছু কিছু ইশারা পাচ্ছি। আমাদের উচিত এখন এই নিয়েই কাজ শুরু করা। তুচ্ছ মূর্তি দখল করাই মানুষের প্রাণের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করে আমাদের অজ্ঞাত এই ক্রিমিনাল ভদ্রলোকটি। এই হল গিয়ে প্রথম পয়েন্ট। তারপরে সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার যে মূর্তি চুরমার করাই যদি লোকটার মুখ্য উদ্দেশ্য হত, তাহলে প্রতিবারেই দেখা যাচ্ছে মূর্তিটাকে হাতে পেয়েও সে তক্ষুনি বাড়ির বাইরে গিয়ে ভাঙছে না।

আর এক স্যাঙাতের চোখে পড়ে যাওয়ায় নিশ্চয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল সে। তা ছাড়া ধস্তাধস্তিও তো কম হয়নি।

তা খুবই সম্ভব। তবুও আর একটা জিনিসের দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মূর্তিটা চুরমার করা হয়েছে এইখানেই–এই বাগানের মধ্যে। আচ্ছা, ওই বাড়িটার অবস্থানটা লক্ষ করেছ?

চারপাশে দেখে নিল লেসট্রেড।

বাড়িটা খালি দেখেই সে বুঝেছিল বাগানে মূর্তি আছড়ালে কারো ছুটে আসার সম্ভাবনা নেই।

ভালো কথা। কিন্তু মূর্তিটা চুরি করে এই বাগানে আসার পথেই তো আর একটা বাগান পড়ছে। তার পক্ষে সেইটাতেই ঢোকা উচিত ছিল। নয় কি? বিশেষ করে চোরাই মাল হাতে কারো সাথে মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যখন রয়েছে?

আমি হার মানলাম, বলল লেসট্রেড।

মাথার ওপর রাস্তার বাতিটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল হোমস। সে যা করতে চেয়েছিল, তা সে এখানে দেখতে পাবে বলেই এসেছিল। ওদিককার বাগানে সে-সম্ভাবনা ছিল না। এই হল কারণ।

বাইজোভ? ঠিকই তো, লাফিয়ে ওঠে গোয়েন্দা-প্রবর, এখন আমার মনে পড়ছে সব। মি. বার্নিকটের মূর্তিটাও তার লাল আলো থেকে বেশি দূরে ভাঙা হয়নি। মি. হোমস, তা না হয় হল, কিন্তু এ নিয়ে আমরা করব কী?

মনে রাখবে। নোট করে রাখবে। ঘটনাচক্রে কাজে লেগে যেতে পারে। যাই হোক, এখন তুমিই বলো, কীভাবে এগোতে চাও তুমি।

আমার মতো মৃত লোকটাকে শনাক্ত করলেই অনেকটা কাজ এগিয়ে যাবে। আসল কাজ তো এইটাই। খুব কঠিন অবশ্য নয়। লোকটার ঠিকুজি জানা গেলেই আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের হদিশ পাওয়া গেলেই গতরাতে পিট স্ট্রিটে সে কী করতে গিয়েছিল এবং মি. হোরেস হার্কারের বাড়িতে কার সাথে দেখা হওয়ামাত্র অক্কা পেয়েছে তাও জানা যাবে। আপনি কী মনে করেন?

নিঃসন্দেহে তাই। তবে কি জানো, আমার কার্যপদ্ধতি ঠিক তোমার মতো হবে না?

কী করতে চান তবে?

তা বললে তুমি আর নিজের খেয়াল খুশিমতো কাজ করতে পারবে না। আমি বলি কি আমরা যে যার নিজের নিজের পদ্ধতিতে কাজ করে যাই। আমি থাকি আমার লাইনে, তুমি থাক তোমার লাইনে। পরে আমরা একসাথে বসে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারব।

বেশ, তাই হোক। বলল লেসট্রেড।

পিট স্ট্রিট যদি যাও এখন মি. হোরেস হার্কারের সাথে তোমার দেখা হতে পারে। তাকে বল, আমার মন স্থির হয়ে গেছে। গতরাত্রে তাঁর বাড়িতে যে অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রকৃতির একটা খুনে পাগল নেপোলিয়ন বিদ্বেষে আচ্ছন্ন হয়ে খুনখারাপি করে গেছে–সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। এ-খবরটা জানলে তার অনেকটা সুবিধে হবে।

বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল লেসট্রেড।

আপনি কি সত্যি সত্যি তাই বিশ্বাস করেন নাকি?

মুচকি হাসল হোমস।

করি না? বেশ, হয়তো করি না। কিন্তু এ-খবর শুনলে মি. হোরেস হার্কার তো খুশি হবেনই, সেন্ট্রাল প্রেম সিন্ডিকেটের গ্রাহকেরাও হবেন। লেসট্রেড, আজ সন্ধে ছটায় বেকার স্ট্রিটে আমার সাফে তুমি দেখা করলে খুশি হব। ততক্ষণ পর্যন্ত মৃতের পকেটে পাওয়া এই ফটোগ্রাফটা রইল আমার কাছে।

হাঁটতে হাঁটতে আমি আর শার্লক হোমস চলে এলাম হাই স্ট্রিটে হার্ডিং ব্রাদার্সের দোকানের সামনে। মূর্তিটা কেনা হয়েছিল এখান থেকেই।

একজন ছোকরা কর্মচারী ছিল দোকানে। হোমসের প্রশ্ন শুনে বললে যে সে নিজেই নতুন এসেছে দোকানে। মি. হার্ডিংও বিকেলের আগে আসেন না, কাজেই কোনো খবর দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। শুনে হোমসের মুখে ফুটে উঠল যুগপৎ হতাশা আর বিরক্তি।

কিছুক্ষণ পরে অবশ্য বলল, সব কিছুই যে আমাদের অনুকুল হবে এ-রকম আশা করাই উচিত নয়, কি বল ওয়াটসন? মি. হার্ডিং ফিরে এলে পর বিকেলেই আসতে হবে আমাদের। কীভাবে কাজ শুরু করছি, তা নিশ্চয় অনুমান করতে পেরেছ তুমি। মূর্তিগুলো এসেছে যেখান থেকে আমি পৌঁছোতে চাই সেখানেই। বেচারিদের এ-রকম দূরবস্থার মূলে যদি কোনো অদ্ভুত কারণ থাকে, তা জানা যাবে উৎপত্তি স্থানে পৌঁছোতে পারলে। চলো, কেনিংটন রোডে মি. মর্স হাডসনের কাছে যাওয়া যাক। তাকে দিয়েও সমস্যার জট খানিকটা খুলতে পারে।

একটা গাড়ি নিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ছবিওলার দোকানে পৌঁছে গেলাম। ভদ্রলোকের চেহারা ছোটোখাটো হলেও বেশ মজবুত, লাল মুখ, হাবভাব একটু ঝাঁঝাল।

তড়বড় করে কথা বলে চললেন ভদ্রলোক, হ্যাঁ, হা স্যার, আমারই কাউন্টারে। ট্যাক্স-ফ্যাক্সগুলো কেন দিই তা বুঝি না–বদমাশরা এসে আমার জিনিসপত্র যদি ভেঙে তছনছ করেই গেল, তাহলে এসব দিয়ে লাভ কী আমার? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ড, বার্নিকটকে মূর্তি দুটো আমিই বিক্রি করে ছিলাম। কী লজ্জার কথা, ছিঃ ছিঃ। আমি তো বলব, রীতিমতো একটা নিহিলিস্ট প্লট। অ্যানার্কিস্ট ছাড়া আর কেউ এমন করে মুর্তি চুরমার করতে পারে না। আমি তো ওদের রেড রিপাবলিকান বলি। কোত্থেকে পেয়েছি মূর্তিগুলো? তার সঙ্গে এ-ব্যাপারের কী সম্বন্ধ বুঝছি না। বেশ আপনি যদি একান্তই জানতে চান তো শুনুন। স্টেপনিয় চার্চ স্ট্রিটে গেলডার অ্যান্ড কোম্পানি থেকে কিনেছিলাম। বিশ বছর ধরে তারা এই ব্যাবসা করে আসছে এবং নামও খুব। ক-টা কিনেছিলাম? তিনটে–দুটো আর একটা, মোট তিনটে। দুটো ড. বার্নিকট নিয়েছিলেন, আর একটা তো দিনেদুপুরেই গুঁড়ো হল আমার কাউন্টারে। ফটোগ্রাফটা কার? না, না, আমি চিনি না। হ্যাঁ, একটু একটু চিনি মনে হচ্ছে। আরে, আরে, এ তো দেখছি বেপ্পো। লোকটা ইটালিয়ান। ঠিক কাজ করত। আমার অনেক কাজ করে দিত বেপ্পো। খোদাইয়ের কাজ একটু-আধটু জানত, সোনালি রং ধরাতে পারত–আরও টুকিটাকি কাজ করত অনেকরকম। গত হপ্তায় শেষবারের মতো এসেছিল লোকটা। তারপর আর কোনো খোঁজখবর পাইনি ওর। না, কোত্থেকে এসেছে আর কোথায় গেছে–অত খবর আমি রাখি না। ওইখানে থাকার সময় ওর সঙ্গে আমার কোনো খিটিমিটি লাগেনি। ওর বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। মূর্তি চুরমার হওয়ার দিন দুয়েক আগে বেপ্পো শেষবারের মতো এসেছিল।

দোকান থেকে বেরিয়ে এসে হোমস বলল, মন্দ কী, মর্স হাডসনের কাছ থেকে যা যা আশা করেছিলাম, সবই পেয়েছি। কেনিংটন আর কেনসিংটন–দুজায়গাতেই পাচ্ছি বেপ্পোর অস্তিত্ব। দশ মাইল গাড়িতে আসা বৃথা যায়নি দেখছি। ওয়াটসন, এবার যাওয়া যাক স্টেপনিতে গেলডার অ্যান্ড কোম্পানিতে। মূর্তিগুলোর উৎপত্তি এইখান থেকেই যখন, তখন ওখান থেকে কিছু-না–কিছু সাহায্য আমরা পাবই।

দ্রুতবেগে আমরা একে একে পেরিয়ে গেলাম বিলাসী লন্ডন, হোটেল লন্ডন, থিয়েটার লন্ডন, সাহিত্যিক লন্ডন, ব্যবসায়ী লন্ডন এবং সব শেষে সমুদ্রতীরের লন্ডন।

যা খুঁজছিলাম, তা পেলাম এখানেই। খোলামেলা একটা জায়গা। এক সময়ে বোধ হয় এখানে ধনী লন্ডন ব্যবসায়ীদের আস্তানা ছিল। কিন্তু আজ গড়ে উঠেছে হরেকরকম মূর্তি তৈরির কারখানা।

বাইরে বিরাট উঠোনটায় অগুনতি পাথরের স্মৃতিফলক। ভেতরের মস্ত বুড়ো ঘরটায় জনা পঞ্চাশেক কারিগর খুটখাট কাজ করে চলেছে। কেউ খোদাই করছে, কেউ-বা ছাঁচে ঢেলে মূর্তি তৈরি করছে।

ম্যানেজার একজন জার্মান ভদ্রলোক। চেহারাটি বিরাট। আমাদের বেশ খাতির করে বসিয়ে হোমসের সব প্রশ্নেরই পরিষ্কার উত্তর দিলেন।

খাতাপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, ডিভাইনের তৈরি নেপোলিয়নের মার্বেল পাথরের আবক্ষ মূর্তি থেকে এ পর্যন্ত কয়েকশো ছাঁচ নেওয়া হয়েছে। বছরখানেক আগে ছ-টা মূর্তি একসাথে তৈরি করা হয়েছিল। তিনটে পাঠানো হয়েছিল মর্স হাডসনকে, বাকি তিনটে কেনসিংটনের হার্ডিং ব্রাদার্সের দোকানে। অন্যান্য ছাঁচের সঙ্গে এই বিশেষ ছ-টির পার্থক্য থাকার কোনো কারণ নেই। কেনই-বা মূর্তিগুলোকে চুরমার করা হচ্ছে তাও তিনি ভেবে পেলেন না। সব কথা শুনে তো ভদ্রলোক হেসেই অস্থির। মূর্তিগুলোর পাইকারি দাম ছ-শিলিং। খুচরো কিনতে গেলে বারো শিলিংয়ের মতো দাম পড়বে। মুখের দু-পাশ থেকে দুটো ছাঁচ নেওয়া হয়, তারপর প্লাস্টার অফ প্যারিসের ছাঁচ বেমালুম জুড়ে দিলেই সম্পূর্ণ হয় মূর্তিটা। আমরা যে-ঘরে বসেছিলাম, মূর্তিগুলো সাধারণত ওইখানেই হয়। করে ইটালিয়ান কারিগররা। কারিগরদের কাজ শেষ হলেই প্যাসেজের ওপর মূর্তিগুলো রাখা হয় শুকোবার জন্যে। তারপর যায় গুদোমে। এর বেশি আর কিছু বলতে পারলেন না জার্মান ভদ্রলোক।

কিন্তু ফটোগ্রাফটা বার করামাত্র দারুণ পরিবর্তন এল ম্যানেজারের চোখে-মুখে। রাগে লাল হয়ে উঠল তাঁর মুখ, নীল নীল চোখের ওপর দড়ির মতো ফুটে উঠল কপালের শিরাগুলো।

রাসকেল কোথাকার! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ওকে চিনি, বেশ ভালোভাবেই চিনি। এ-প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয়েছিল একদিনই। আর তা এই রাসকেলটার জন্যে যেদিন ওর পেছনে পুলিশ এসে হানা দিয়েছিল এখানে। এক বছরের ওপর হল। রাস্তার একজন ইটালিয়ানকে ছুরি মেরে কারখানায় এসে বসেছিল। পিছু পিছু পুলিশও এসে হাজির। বেপ্পো নামেই ওকে জানতাম, পদবি জানি না। এ-রকম লোককে কাজ দেওয়ার ফলে ভোগান্তি কম হয়নি আমার। অবশ্য কারিগর হিসাবে লোকটা ভালোই ছিল প্রথম শ্রেণির কারিগরই বলব।

কী শাস্তি পেয়েছিল বেপ্পো?

কপালজোরে লোকটা বেঁচে গিয়েছিল মশাই। এক বছর শ্রীঘর বাসের ওপর দিয়েই রেহাই পায় বেপ্পো। আমার তো বিশ্বাস এতদিনে খালাস পেয়েছে সে। অবশ্য এখানে মুখ দেখানোর সাহস আর তার হয়নি। বেপ্পোর এক খুড়তুতো ভাই কাজ করে এখানে। তাকে জিজ্ঞেস করলে ও এখানে আছে কোথায়, তা জানা যেতে পারে।

না, না, চেঁচিয়ে ওঠে হোমস, কোনো কথা নয়, তার সঙ্গে বেপ্পো সম্পর্কে কোনো কথা নয়–আমার একান্ত অনুরোধ। ব্যাপারটার গুরুত্ব যে কতখানি, তা হয়তো আপনি ঠিক উপলব্ধি করতে পারছেন না। কিন্তু আমি যতই দেখছি, শুনছি, ততুই বুঝছি কমা তো দূরের কথা, ধাপে ধাপে বেড়েই চলেছে এর গুরুত্ব। ভালো কথা,খাতাপত্র ঘেঁটে মূর্তিগুলোর বিক্রির খবর দেওয়ার সময় তারিখটা গত বছরের তেসরা জুন বললেন শুনলাম। আচ্ছা, বেপ্পো কবে গ্রেপ্তার হয়েছে সে-তারিখটা দিতে পারেন?

ম্যানেজার বললেন, মাইনের খাতা থেকে মোটামুটি বলতে পারব। কয়েকটা পাতা উলটে আবার বলেন, গত মাসের বিশ তারিখে তাকে শেষবারের মতো মাইনে দিয়েছি আমি।

হোমস বললে, ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে আপনার ধৈর্য পরীক্ষা করার আর দরকার হবে বলে মনে হয় না।

কাকপক্ষীও যেন আমাদের গোপন তদন্তের কথা জানতে না পারে, শেষবারের মতো এই অনুরোধ জানিয়ে আবার রওনা হলাম পশ্চিম দিকে।

দুপুর তখন গড়িয়ে এসেছে। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে নাকেমুখে গুঁজে কোনোরকমে লাঞ্চ শেষ করলাম দুজন। ঢোকবার পথেই খবরের কাগজে দেখি বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা, কেনসিংটনে খুনখারাপি। খুনে পাগলের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। খানিকটা পড়তেই বুঝলাম, মি. হোরেস হার্কার শেষ পর্যন্ত তার সাংবাদিকের কর্তব্য সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করেছেন। ছ-কলম ঠেসে লিখেছেন ভদ্রলোক। চাঞ্চল্যকর হত্যার শাখাপ্রশাখা ছড়ানো বর্ণনা পড়তে পড়তে সত্যি শিহরন জাগে। ভিনিগার, মরিচ, নুন ইত্যাদি রাখার স্ট্যান্ডে কাগজটা ঠেস দিয়ে রেখে দিয়ে খেতে খেতেই আগাগোড়া পড়ে ফেলল হোমস। বার দুয়েক আপন মনে মুখ টিপে নিঃশব্দে হেসে নিল।

তারপর পড়তে পড়তে বললে, ঠিকই আছে ওয়াটসন। শোনো, সবাই শুনে খুশি হবেন যে মি. লেসট্রেড, বিপুল অভিজ্ঞতাবলে পুলিশমহলে যাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত ইনি তাঁদের অন্যতম, আর মি. শার্লক হোমস অপরাধ-বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরূপে তিনি সর্বসাধারণের কাছে সুপরিচিত—এঁরা দুজনেই একই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এই শোচনীয় পরিণতির মূলে পূর্ব পরিকল্পিত হত্যার প্রবৃত্তি নেই। নিছক উন্মত্ততা থেকেই নাকি এই বিচিত্র এবং আশ্চর্য ঘটনাবলির উদ্ভব হয়েছে। মানসিক গোলযোগ ছাড়া আর কিছু দিয়ে এই ঘটনার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ওয়াটসন, সংবাদপত্র হচ্ছে একটি অত্যন্ত মূল্যবান যন্ত্র। নাড়াচাড়া করার কৌশলটুকু শুধু জানলেই হল। তোমার উদরদেব যদি শান্ত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এবার দৌড়ানো যাক কেনসিংটন রোডে। হার্ডিং ব্রাদার্সের ম্যানেজারের বক্তব্য এখনও শোনা হয়নি।

এম্পোরিয়ামটি বিরাট হলেও প্রতিষ্ঠিত ভদ্রলোক দেখতে খুবই ছোটোখাটো। বেশ চটপটে, চনমনে, চালাকচতুর। কথাবার্তায় হাবেভাবে অফুরন্ত প্রাণ রস যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ে। মাথাটি কিন্তু বেশ সাফ।

ইয়েস, স্যার, আজকের ইভনিং পেপারে সব পড়লাম। মি. হোরেস হার্কার আমার খদ্দের। মাস কয়েক আগে একটা মূর্তি তাকে বিক্রি করেছিলাম আমি। স্টেপনির গেলডার অ্যান্ড কোম্পানিতে ও-রকম তিনটে মূর্তির অর্ডার দিয়েছিলাম। সবকটাই বেচে ফেলেছি। কাদেরকে? সেলস বই ঘেঁটে তা না হয় বলে দিচ্ছি। এই যে পেয়েছি। একটা তো জানেনই মি. হার্কারকে, আর একটা যোশিয়া ব্রাউনকে। মি. ব্রাউনের ঠিকানা, লেবারনাম লজ, লেবারনাম ভেল, চিজউইক। আর একটা মি. স্যান্ডি ফোর্ডকে। ঠিকানা, লোয়ার গ্রোভ রোড। না, না, ফটোগ্রাফ তো দুরের কথা, এ-রকম ধরনের লোককে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি। এ-রকম কদাকার লোককে একবার দেখলে কি আর ভোলা যায় স্যার? আপনি কী বলেন? কর্মচারীদের মধ্যে ইটালিয়ান আছে কি না? তা, হ্যাঁ, আছে বই কী। টুকটাক কাজ আর ঝাড়ামোছা করার জন্য কয়েকজন আছে। ইচ্ছে করলে সেলস বুক খুলে তারা দেখতে পারে বই কী। খাতা খুলে দেখলেই-বা ক্ষতি কী? অত আর কে নজর রাখতে যায় বলুন। বাস্তবিকই তাজ্জব কাণ্ডকারখানা বটে! চালিয়ে যান তদন্ত। কোনো জবর খবর পেলে জানাতে ভুলবেন না আশা করি।

মি. হার্ডিংয়ের কথা শুনতে শুনতে কিছু কিছু পয়েন্ট লিখে নিচ্ছিল হোমস। দেখলাম, বেশ খুশি হয়ে উঠেছে ও। ঘটনার স্রোত ভালোর দিকেই চলেছে বলতে হবে। অবশ্য এ-প্রসঙ্গে কোনো মতামত প্রকাশ করলে না সে। শুধু বললে যে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি না-ফিরলে লেসট্রেডকে হয়তো বসে থাকতে হবে।

তাড়াতাড়ি করে বেকার স্ট্রিটে পৌঁছেও অবশ্য দেখলাম লেসট্রেডকে রীতিমতো অসহিষ্ণুভাবে ঘরের এ-কোণ থেকে ও-কোণে পায়চারি করতে। চোখ-মুখের ভাব দেখে বুঝলাম, সারাদিনের কাজ তার একেবারে বৃথা যায়নি।

আমাদের দেখেই থমকে গেল সে, কী খবর, মি. হোমস? বরাত খুলেছে নাকি?

ধীরেসুস্থে বলল হোমস, সারাদিন বড়ো খাটাখাটুনি গেছে। আর, দিনটা একেবারে বাজে যায়নি। খুচরো দোকানদার থেকে শুরু করে পাইকারি হারে মূর্তি তৈরির কারখানা পর্যন্ত সবই ঘুরে এলাম। এখন আমি গোড়া থেকে শুরু করে সবকটা মূর্তিই খুঁজে বের করতে পারি।

মূর্তি! চেঁচিয়ে ওঠে লেসট্রেড। ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনার কাজ করার পদ্ধতি একেবারেই আপনার নিজস্ব এবং আমিও তা নিয়ে আপনাকে কিছু বলতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই যে সারাদিনে আপনার চাইতে খাঁটি কাজ কিছু করতে পেরেছি আমি। মৃত লোকটাকে আমি শনাক্ত করেছি।

বল কী হে!

আর পেয়েছি তার খুন করার আসল কারণ।

চমৎকার।

আমাদের একজন ইনস্পেকটর স্যাফ্রন হিল আবার ইটালিয়ান কোয়ার্টার সম্পর্কে বেশ কিছু জ্ঞান রাখে। নিহত লোকটার গলায় ক্যাথলিক প্রতীক আর তার গায়ের রং দেখে আমার মনে হয়েছিল লোকটা নিশ্চয় দক্ষিণ দেশের। দেখামাত্র এক পলকেই ইনস্পেকটর হিল তাকে চিনে ফেললে। লোকটার নাম পিয়েত্রো ভিনাসসি। জন্ম, নেপলস-এ। লন্ডনের কুখ্যাত গলাকাটাদের অন্যতম সে। মাফিয়ার সাথে জড়িত আছে পিয়েত্রো। মাফিয়া যে গুপ্ত রাজনৈতিক সংঘ তা তো আপনি জানেনই। ডিক্রি জারি করে খুনের পর খুন করে যায় এরা।

এখন তাহলে সমস্ত ব্যাপারটা দেখুন কীরকম পরিষ্কার হয়ে আসছে। খুন করে ফেরার লোকটাও ইটাললিয়ান এবং মাফিয়ার সভ্য। যেকোনো রকমেই হোক, নিশ্চয় সংঘের নিয়ম ভঙ্গ করেছিল সে। পিয়েত্রোকে লাগানো হল তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে। পকেটে ফটোগ্রাফটা দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত এই কারণে যে ভুল করে অন্য কাউকে না ছুরি মেরে বসে সে। লোকটার পিছু নিয়ে পিয়েত্রো দেখলে তাকে একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকতে। কাজেই বাইরে ওত পেতে রইল সে। বেরোনোমাত্র শুরু হল ঝটাপটি। ফলাফল তো দেখতেই পেয়েছি। নিজেই কাবু হয়ে পড়ায় মরণঘা তাকেই খেতে হয়েছে। শুনতে কীরকম লাগছে, মি. হোমস?

তালি বাজিয়ে উৎসাহ দিয়ে সোল্লাসে বলল হোমস, শাবাশ, লেসট্রেড, শাবাশ কিন্তু তোমার ওই মূর্তি চুরমারের ব্যাখ্যাটা তো ঠিক ধরতে পারলাম না।

মূর্তি আর মূর্তি! মাথা থেকে কিছুতেই মূর্তিগুলোকে তাড়াতে পারছেন না। আরে, আসলে ওগুলো কিচ্ছু না। ছিঁচকে চুরি–খুব জোর হয়তো হবে ছ-মাসের জেল। খুনের মামলা নিয়ে মাথা ঘামাতে বসেছি ছিঁচকে চুরি নিয়ে নয়। আবার বলি শুনুন, মি. হোমস, সবকটা সূত্রই আমি জড়ো করে এনেছি আমার মুঠোর ভেতর।

তাহলে তোমার প্রোগ্রাম?

খুব সোজা। হিলকে নিয়ে সোজা যাব ইটালিয়ান কোয়ার্টারে। ফটোগ্রাফের সাথে মিলিয়ে লোকটাকে বার করে গ্রেপ্তার করব খুনের অপরাধে। আপনি আসছেন নাকি?

উঁহু, আমার আসা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, আরও সোজা পথে আমরা পৌঁছোতে পারি আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে। সঠিক কিছু বলা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। কেননা, সব কিছুই নির্ভর করছে এমন একটি বিষয়ের ওপর যা তোমার ইচ্ছার বাইরে। কিন্তু গভীর আশা আছে এবং তা এতই গভীর যে, তোমার সঙ্গেই বাজিও ফেলছি আমি। আজ রাতে যদি আমার সঙ্গে আসো লেসট্রেড, খুনিকে তুমি হাতেনাতে ধরতে পারবে বলেই আমি মনে করি।

ইটালিয়ান কোয়ার্টারে?

না। আমার ধারণা, চিজউইকের একটা ঠিকানায় তাকে পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আজ রাতে যদি আমার সঙ্গে চিজউইক আসসা তুমি, কথা দিচ্ছি কাল তোমার সঙ্গে ইটালিয়ান কোয়ার্টারে আমি যাবই। ওয়াটসন, ইতিমধ্যে তুমি একটা কাজ করো। একটা জরুরি চিঠি লিখে পাঠাতে হবে। ঘণ্টা বাজাও। চটপট কাউকে ডেকে পাঠাবার ব্যবস্থা করো! এখুনি।

বহু অপ্রয়োজনীয় জিনিস বোঝাই কয়েকটি ঘর ছিল আমাদের। হোমস এইখানেই ঢুকে কাগজ ঘাঁটতে বসল। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে যখন সে নেমে এল তার দু-চোখে দেখলাম বিজয় উচ্ছ্বাস। মুখে কিন্তু সে নিজের গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে কোনো কথাই বললে না। আগাগোড়া ওর তদন্ত পদ্ধতি দেখে এইটুকু বুঝেছিলাম যে হোমসের বিশ্বাস, বাকি দুজনে যাঁরা নেপোলিয়ানের ওই একই ছাঁচের মূর্তি কিনে নিশ্চিন্ত মনে বসে রয়েছেন নিজের বাড়িতে, এবার জড়িয়ে পড়বেন রহস্যজালে। এঁদের মধ্যে একজনের বাড়ি চিজউইকে। বিদঘুটে খুনের আবির্ভাব ঘটবে এবার তারই বাড়িতে।

আমাদের চরম উদ্দেশ্য যে তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। কিন্তু কৌশলে খবরের কাগজ মারফত একটা ভুল তথ্য পরিবেশন করার পেছনে হোমস-এর মূল উদ্দেশ্যটুকু অনুমান করে তার চাতুরির তারিফ না-করে পারলাম না। এসব পাগলের কাণ্ডকারখানা ভেবে আমরা যে হাত পা গুটিয়ে বসে আছি–এই ধারণা নিয়ে নির্ভয়ে আমাদের শিকার বেরিয়ে পড়বে তার নৈশ অভিযানে। কাজেই হোমস যখন আমাকে রিভলভার নিতে বললে, মোটেই অবাক হলাম না। সে নিজেও তার প্রিয় হাতিয়ার৩ গুলিভরা হান্টিং ক্রপ তুলে নিয়ে পকেটে চালান করে দিলে।

ঠিক রাত এগারোটার সময় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একটা চার চাকার ঘোড়ার গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হ্যামারস্মিথ ব্রিজের অপর পাশে। গাড়োয়ানকে এখানেই দাঁড়াবার নির্দেশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম জনবিরল একটা রাস্তায়। নির্জন রাস্তা। কিন্তু দু-পাশের সারি সারি বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর। প্রত্যেক বাড়ির সামনে খানিকটা খোলা জমি।

রাস্তার বাতির আলোয় একটা বাড়ির সামনে দেখলাম লেখা রয়েছে, লেবারনাম ভিলা। বাড়ির লোকে নিশ্চয় শুয়ে পড়েছিল, কেননা হলের দরজার সামনে একটা ফ্যানলাইট ছাড়া আর কোনো আলো কোথাও দেখলাম না। আলোটার নিস্তেজ গোলাকার ছটা এসে পড়েছিল বাগানের রাস্তায়। রাস্তা আর লনের মাঝখানে কাঠের বেড়া। ঘন কালো ছায়া পড়েছিল ভেতরের দিকে। এইখানেই গা ঢাকা দিয়ে বসলাম সবাই।

ফিসফিস করে বললে হোমস, আমার তো মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। কপাল ভালো। বৃষ্টি হচ্ছে না এখন। তাহলে তো দুর্ভোগের শেষ থাকত না। দেখাই যাক, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। আমার তো ধারণা, এত কষ্ট আমাদের বৃথা যাবে না।

হোমসের কথা শুনে ভেবেছিলাম, না-জানি কতক্ষণ এভাবে কষ্টেসৃষ্টে গুঁড়ি মেরে বসে থাকতে হবে। কার্যকালে দেখা গেল কিন্তু এ-ভয় একেবারেই অমূলক। কেননা, আচম্বিতে এবং অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে শেষ হল আমাদের প্রতীক্ষা।

চক্ষের পলকে, আমরা কিছু বোঝবার এবং সাবধান হবার আগেই নিঃশব্দে দু-হাট হয়ে খুলে গেল বাগানের দরজা। খর্বকায়, কৃষ্ণবর্ণ একটা মূর্তি বানরের মতো দ্রুত আর ক্ষিপ্র পদক্ষেপে তিরবেগে ছুটে গেল বাগানের পথে। হলের দরজার ওপর থেকে যেটুকু আলো পড়ছিল তারই আবছা আভায় দেখলাম সাঁ করে মূর্তিটাকে সরে যেতে। পর মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল বাড়ির অন্ধকার ছায়ায়।

দীর্ঘ বিরতি। নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম আমরা। তারপরেই খুব মৃদু একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ভেসে এল আমাদের কানে।

জানলার পাল্লা খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

তারপরেই থেমে গেল শব্দটা। আবার বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল চারিদিক। বুঝলাম বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে লোকটা। ঘরের মধ্যে হঠাৎ চোরা লণ্ঠনের ঝলক দেখলাম। ঈপ্সিত বস্তু নিশ্চয় পাওয়া গেল না সে-ঘরে, তাই আলোর চমক সরে গেল পাশের খড়খড়ির পেছনে, সেখান থেকে পরেরটায়।

ফিসফিস করে বললে লেসট্রেড, খোলা জানলাটার নীচে গিয়ে বসা যাক। নীচে নামলেই কাবু করে ফেলব।

কিন্তু আমরা ওঠবার আগেই আবার বেরিয়ে এল লোকটা। নিস্তেজ আলোটার তলায় আসতেই দেখলাম বগলের ফাঁকে সাদা মতো একটা জিনিস। জুলজুল করে চারপাশে দেখতে দেখতে সাবধানে এগিয়ে এল সে। জনহীন রাস্তার শব্দহীনতায় যেন অনেকটা আশ্বস্ত হল। আমাদের দিকে পেছন ফিরে বসে পড়ে বোঝাটা নামালে মাটিতে। পরমুহূর্তেই শুনলাম দমাস শব্দ, আর যেন অসংখ্য টুকরো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

নিজের কাজে এমন তন্ময় হয়ে ছিল সে যে পা টিপে টিপে ঘাসের ওপর দিয়ে আমরা এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোনোরকম পায়ের শব্দ শুনতে পেল না। বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল হোমস তার পিঠের ওপর এবং পর মুহূর্তেই আমি আর লেসট্রেড তার কবজি দুটো চেপে ধরে এঁটে দিলাম হাতকড়া।

হেঁচকা টানে ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম তার মুখ। কুৎসিত, পানসে হলদেটে রং। জিঘাংসা ভরা জ্বলন্ত দৃষ্টি আমাদের ওপর মেলে ধরে ছটফট করছিল সে কঠিন বন্ধনের মধ্যে। এক নজরেই চিনতে পারলাম তাকে। ফটোগ্রাফে দেখা মুখের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় এ-মুখ।

হোমস কিন্তু এত কষ্টে ধরা লোকটার দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দিয়ে দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সতর্ক চোখে যা পরীক্ষা করছিল, তা একটু আগেই এই কুৎসিত লোকটা বয়ে নিয়ে এসেছে বাড়ির মধ্যে থেকে। এটাও নেপোলিয়নের মূর্তি। সকালে যেমনি দেখেছিলাম, ঠিক তেমনি। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছত্রাকার হয়ে পড়ে ছিল চারিদিকে। তন্ময় হয়ে একটার পর একটা টুকরো আলোর সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল হোমস। কিন্তু প্লাস্টারের কোনো টুকরোটাই বোধ হয় তার মনে ধরল না। পরীক্ষা তার সবে শেষ হয়েছে, এমন সময় হল ঘরের আলো জ্বলে উঠল, খুলে গেল দরজা। শার্ট আর ট্রাউজার্স পরনে হাসিখুশি গোলগাল চেহারার বাড়ির মালিক বেরিয়ে এলেন বাইরে।

মি. যোশিয়া ব্রাউন? শুধোল হোমস।

ইয়েস স্যার। আপনি তাহলে মি. শার্লক হোমস? আপনার জরুরি চিঠি আমি পেয়েছিলাম, মি. হোমস। যেমন বলেছিলেন, ঠিক তেমনটি করেছি। ভেতর থেকে প্রতিটি দরজা তালা এঁটে অপেক্ষা করছিলাম কী হয় তা দেখবার জন্যে।

লেসট্রেড কিন্তু রাসকেলটিকে নিরাপদ জায়গায় চালান করবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কাজেই মিনিট কয়েকের মধ্যেই গাড়ি এসে পৌঁছোননার পর চারজনে মিলে রওনা হলাম লন্ডনের দিকে।

মুখ টিপে সমস্ত পথ গেল লোকটা, একটা কথাও বার করা গেল না তার পেট থেকে। ঝকড়া ঝাকড়া চুলের তলা থেকে বাঘের মতো জ্বলন্ত চোখ মেলে আগাগোড়া তাকিয়ে রইল আমাদের পানে। একবার শুধু আমার হাতটা নাগালের মধ্যে আসতেই খ্যাক করে কামড় বসাতে চেষ্টা করলে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো। পুলিশ স্টেশনে বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর জানলাম, লোকটার জামাকাপড় তল্লাশি করে কয়েকটা শিলিং আর দু-মুখো ধারালো একটা ছোরা ছাড়া আর অন্য কিছুই পাওয়া যায়নি। ছোরাটার হাতলে রক্তের চিহ্ন দেখা গেছে এবং সে বেশি পুরোনো নয়।

যাবার সময়ে লেসট্রেড বললে, আর কোনো গোলমাল নেই, মি. হোমস। হিল এদের সম্বন্ধে খবরাখবর কিছু রাখে, কাজেই ওর নামটা তার কাছ থেকেই পাওয়া যাবেখন। আমার মাফিয়া থিয়োরি যে নির্ভুল, তার প্রমাণ আপনি পাবেন। কিন্তু আপনার কাছে আমি সত্যই কৃতজ্ঞ মি. হোমস। বেশ কায়দা করে পাকড়াও করলেন বটে হতভাগাটাকে। কী করে যে করলেন, তা অবশ্য এখনও বুঝে উঠলাম না।

হোমস বললে, এত রাতে সেসব আলোচনা আর নাই-বা করলাম। তা ছাড়া, এখনও দু-একটা ছোটো জিনিস বাকি রয়েছে। তুমি তো জানই লেসট্রেড, কতকগুলো কেসের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ না-করলে মোটেই আনন্দ পাওয়া যায় না–এ-কেসটি সেই ধরনের। তুমি যদি কাল ছ-টায় আর একবার বেড়াতে বেড়াতে চলে আস আমার ওখানে, তোমাকে আমি দেখিয়ে দেব যে এখনও পর্যন্ত এ-ব্যাপারটা আগাগোড়া কোনো অর্থই ধরতে পারনি তুমি।

পরের দিন সন্ধ্যায় লেসট্রেডের কাছে শুনলাম বেপ্পো সম্বন্ধে অনেক খবর জেনে ফেলেছে সে! লোকটার পুরো নাম অবশ্য জনা যায়নি। বেপ্পো নামেই পরিচিত সে। ইটালিয়ান কলোনিতে এক ডাকে সবাই চেনে এবং জানে যে, নিঝঞ্জাট জীবন সে কোনোদিনই কাটায়নি। এক সময়ে কুশলী ভাস্কর হিসেবে সুনাম ছিল তার। সৎপথে রোজগারও করেছে বহুদিন। তারপর এল সে পাপের পথে। ফলে দু-দুবার দাঁড়াতে হল কাঠগড়ায়। একবার ছিঁচকে চুরির জন্যে। দ্বিতীয়বারের কারণটা আমরা আগেই শুনেছি–জাতভাইকে ছুরি মারার অপরাধে। ইংরেজি চমৎকার বলতে পারে সে। কিন্তু বেধড়ক মূর্তি ধ্বংস করার কারণটা কিছুতেই বার করা গেল না তার পেট থেকে। কোনোদিক থেকেই এ-সম্পর্কে শেষ খবর জানা যায়নি এখনও। পুলিশ অবশ্য জেনেছে যে মূর্তিগুলোর সৃষ্টি খুব সম্ভব বেপ্পোর হাতেই। কেননা গেলডার অ্যান্ড কোম্পানিতে এই জাতীয় কাজ তাকেই করতে হলো।

অবশেষে শেষ হল লেসট্রেডের বক্তিমে। চেয়ারে নড়েচড়ে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে হোমস। চিক চিক করে উঠল তার চোখের মণি সদর দরজায় ঘণ্টাধ্বনির শব্দ শুনে। এক মিনিট পরেই পায়ের শব্দ শুনলাম সিঁড়িতে। পরমুহূর্তেই ঘরে ঢুকলেন এক প্রৌঢ়। লাল মুখ। কঁচাপাকা ধোঁয়াটে জুলপি। ডান হাতে পুরানো আমলের কার্পেটের ব্যাগটাকে টেবিলে রেখে শুধোলেন ভদ্রলোক, মি. শার্লক হোমস। এখানে আছেন কি?

মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে হাসিমুখে বললে হোমস, মি. স্যান্ডিফোর্ড? রিডিং থেকে আসছেন?

হ্যাঁ, আপনার চিঠি আমি এনেছি। লিখছেন, ডিভাইনের তৈরি নেপোলিয়নের একটা মূর্তি আমার দরকার। আপনার কাছে যেটা আছে, তার জন্য দশ পাউন্ড দিতে রাজি আমি। ঠিক আছে তো?

নিঃসন্দেহে।

আপনার চিঠি পেয়ে বাস্তবিকই অবাক হয়ে গেলাম। দেখুন, আমি খুবই গরিব হতে পারি, কিন্তু অসাধু নই। আপনার কাছ থেকে দশ পাউন্ড নেওয়ার আগে তাই আমার মনে হয় আপনার জানা দরকার যে মাত্র পনেরো শিলিং দিয়ে মূর্তিটা কিনেছিলাম আমি।

আপনার মতো সৎ লোকের পক্ষেই এমন সংকোচ মানায়, মি. স্যান্ডিফোর্ড। কিন্তু যখন আমি দশ পাউন্ড দেব বলে কথা দিয়েছি, তখন আর তার নড়চড় হবে না।

আপনার উপযুক্ত কথাই আপনি বলেছেন, মি. হোমস। চিঠিতে লেখা মূর্তি আমি সঙ্গে এনেছি। এই দেখুন।

ব্যাগ খোলার পর শেষ পর্যন্ত একটা আস্ত নেপোলিয়নের মূর্তি দেখতে পেলাম চোখের সামনে। এর আগে বার বার দেখেছি রাশি রাশি ভাঙা টুকরো। আভাঙা নমুনা দেখার সৌভাগ্য হল এই প্রথম।

হোমস পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলে। তারপর দশ পাউন্ডের নোট টেবিলে রেখে বললে, মি. স্যান্ডিফোর্ড, কিছু মনে করবেন না। এঁরা সাক্ষী রইলেন, এই কাগজটায় একটা সই দিয়ে দিন। মূর্তির সর্বস্বত্ব যে আমি কিনে নিলাম, এইটুকুই শুধু লেখা আছে কাগজটায়। আমি একটু আটঘাট বেঁধে কাজ করি, মি. স্যান্ডিফোর্ড। সই দিতে বলছি সেই কারণেই। পরে কী ঘটবে-না-ঘটবে তা তো আপনি জানেন না। ধন্যবাদ মি. স্যান্ডিফোর্ড। টাকাটা নিয়ে নিন। আচ্ছা, গুড ইভনিং।

মি. স্যান্ডিফোর্ড অদৃশ্য হওয়ামাত্র হোমসের কাণ্ডকারখানা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। ড্রয়ারের ভেতর থেকে এক টুকরো সাদা কাপড় বার করে প্রথমে সে বিছিয়ে নিলে টেবিলের ওপর। তারপর সযত্নে সদ্য পাওয়া নেপোলিয়নের মূর্তিটাকে বসালে কাপড়ের ঠিক মাঝখানে। সবশেষে হান্টিং ক্রপটা দিয়ে মোক্ষম একটা ঘা মারলে নেপোলিয়নের ঠিক মাথার ওপর।

চুরমার হয়ে গেল মূর্তিটা। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কাপড়টার মধ্যে। হোমস সাগ্রহে ঝুঁকে পড়ল এই ধ্বংসাবশেষের ওপর।

পরমুহূর্তেই, জয়ের আনন্দে তীব্র চিৎকার করে একটা টুকরো তুলে ধরল আমাদের দিকে–পুডিংয়ের মধ্যে কিশমিশের মতো কালো একটা গোলাকার বস্তু আটকে ছিল তাতে।

সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল সে, আসুন, আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই বর্জিয়ার১৩ বিখ্যাত কালো মুক্তোর সাথে।

মুহূর্তের জন্য আমি আর লেসট্রেড বসে রইলাম নিশ্চুপ হয়ে। তারপরেই ঠিক রসঘন নাটকের চরম মুহূর্তের ধাপে ধাপে পৌঁছে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ভেঙে পড়লাম ঘন ঘন হাততালিতে। লাল হয়ে উঠল হোমসের পাণ্ডুর গাল। মাথা নীচু করে আমাদের অভিবাদন জানালে সে।

কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে শুরু করল হোমস, পৃথিবীতে যত নামকরা মুক্তো। বর্তমান আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হল বর্জিয়ার মুক্তো। অনেকদিন আগে ডেকার হোটেলে কোলোন্নার যুবরাজের শোবার ঘরে হারিয়ে গিয়েছিল মুক্তোটা। আমার পরম সৌভাগ্য, সেই হারানো মুক্তোটাই আজ খুঁজে পেলাম স্টেপনির গেলডার অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি ছ-টি নেপোলিয়নের মূর্তির সর্বশেষটির মধ্যে।

লেসট্রেড, তোমার হয়তো মনে থাকতে পারে কীরকম সাড়া পড়ে গেছিল এই মূল্যবান রত্নটি অদৃশ্য হওয়ার পর। লন্ডন পুলিশ বৃথাই চেষ্টা করেছিল এর হদিশ পাওয়ার। আমার কাছ থেকেও পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনোরকম আলোকপাত করতে পারিনি আমি। যুবরানির একজন ইটালিয়ান পরিচারিকা ছিল। সন্দেহ এসে পড়ল তার ওপর। লন্ডনে একজন ভাই ছিল বটে, কিন্তু ভাইবোনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ বার করা সম্ভব হয়নি। পরিচারিকার নাম ছিল লুক্ৰেতিয়া ভেনাসসি। এই লুক্ৰেতিয়ার ভাই পিয়েত্রোই যে দু-দিন আগে খুন হয়েছে, সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। পুরানো কাগজ ঘেঁটে দেখলাম, ছুরি মারার অপরাধে বেপ্পো গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক দুদিন আগে উধাও হয়েছে মুক্তোটা। বেপ্পো গ্রেপ্তার হয়েছে ঠিক তখনই যখন গেলডার অ্যান্ড কোম্পানিতে নেপোলিয়নের ছটা মূর্তি তৈরি হচ্ছিল। বুঝতেই পারছ তারপর যা ঘটেছে। আমাকে অবশ্য উলটো দিক থেকেই সব বুঝতে হয়েছে। মুক্তোটা বেপ্পোর কাছেই ছিল। কী করে তার কাছে এসেছে, তা অবশ্য জানি না। পিয়েত্রোর কাছ থেকে চুরি করতে পারে সে, পিয়েত্রোর সঙ্গী হতে পারে সে, অথবা পিয়েত্রো আর লুক্ৰেতিয়ার মধ্যে সূত্রও হতে পারে। সে যাই হোক না কেন, তা জেনে আসল সমস্যার এতটুকু সমাধান করতে পারব না।

আসল ব্যাপার হচ্ছে এই যে মুক্তটা তার কাছেই ছিল। এবং ঠিক সেই সময় পুলিশ পিছু নেয় তার। যে-কারখানায় সে কাজ করত, তাড়া খেয়ে সেখানে পৌঁছে ঝটপট একটা কিছু ভাবতে বসল বেপ্পো। কয়েক মিনিট মাত্র সময়। এই সময়ের মধ্যে মহা মূল্যবান পাথরটাকে কোথাও লুকোতে না-পারলে চিরকালের মতো তা হারাতে হবে। একবার দেহ তল্লাশ করলেই পুলিশের হাতে চলে যাবে কষ্টে পাওয়া জিনিসটা। ছ-টা নেপোলিয়নের মূর্তি শুকোচ্ছিল। একটা তখনও শক্ত হয়ে যায়নি। চকিতে কুশলী কারিগর বেপ্পো একটা মূর্তির ভিজে প্লাস্টারের মধ্যে ছোট্ট একটা ফুটো করে মুক্তোটাকে চালান করে দিল ভেতরে। হাতের দু-এক টানেই গর্ত বুজে গেল–আর পাঁচটা থেকে কোনো পার্থক্যই রইল না। এত অল্প সময়ে এমন চমৎকার লুকোনোর জায়গা বার করার জন্য তার তারিফ করি আমি। মূর্তি ভেঙে মুক্তো বার করার কল্পনা কারো মাথাতেও আসবে না। কিন্তু বিচারে এক বছরের জেল হয়ে গেল বেপ্পোর। ইতিমধ্যে লন্ডনে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল মূর্তি ছ-টা। ঠিক কোনটার মধ্যে যে মুক্তোটা আছে, তা সে নিজে জানত না। প্রত্যেকটা মূর্তি ভেঙে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঝাঁকানি দিলেও বোঝা সম্ভব নয়, কেননা ভিজে প্লাস্টারের গায়ে মুক্তোটা আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রকৃতপক্ষে, হয়েছেও তাই।

যাই হোক, দমে যাওয়ার পাত্র নয় বেপ্পো। অধ্যবসায় আর সূক্ষ্ম বুদ্ধি নিয়ে শুরু হল তার তল্লাশ পর্ব। গেলডার অ্যান্ড কোম্পানিতে তার এক খুড়তুতো ভাই কাজ করত। তার মারফত সে জানতে পারলে কোন কোন দোকান মূর্তিগুলো কিনে নিয়ে গেছে। মর্স হাডসনের দোকানে একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হল না তার পক্ষে। ফলে তিনটে মূর্তির হদিশ বেরিয়ে গেল। কিন্তু মুক্তো পাওয়া গেল না। তারপর কোন ইটালিয়ান কর্মচারীর সাথে যোগসাজশ করে বাকি তিনটে মূর্তির ঠিকানাও নিলে সে। প্রথমটা ছিল হার্কারের কাছে। সেখানে পিছু নিলে তার কুকাজের সঙ্গী পিয়েত্রো। মুক্তো হারানোর জন্যে বেপ্পোকে দায়ী করতেই বচসা শুরু হল। তারপর হাতাহাতি। সব শেষে বেপ্পোর ছুরিতে পিয়েত্রোর জীবন লীলা সাঙ্গ হল।

প্রশ্ন করলাম, পিয়েত্রো যদি বেপ্পোর কুকাজের সঙ্গীই হয়, তাহলে তার ফটোগ্রাফ নিয়ে ঘুরবে কেন?

তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে বেপ্পোকে খুঁজে বার করার জন্যই ফটোটা রেখেছিল সে। এ ছাড়া আর কোনো কারণই নেই। সে যাই হোক, ভেবেচিন্তে দেখলাম, খুনের পর আর অযথা দেরি না-করে চটপট কাজ সারার চেষ্টা করবে বেপ্পো। পুলিশ গোপন কথা জেনে ফেলতে পারে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার প্ল্যান করলে সে। পুলিশ কিছু জেনে ওঠার আগেই কাজ শেষ করে যাতে গা ঢাকা দিতে পারে। অবশ্য হার্কারের মূর্তির মধ্যে মুক্তোটা পাওয়া গেছে কি না তা জানতাম না আমি। জিনিসটা মুক্তো কিনা সে-বিষয়ে আমি একেবারে নিশ্চিত হতে পারিনি। সে যে মূর্তি চুরমার করছে মূর্তির মধ্যে লুকানো অন্য কিছুর জন্য, সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই ছিল না। মূর্তিটাকে অতটা বয়ে নিয়ে গিয়ে বাগানের মধ্যে বাতির তলায় চুরমার করেছে দেখেই তা বুঝেছিলাম। বাকি তিনটে মূর্তির মধ্যে হার্কারের মূর্তিটা অন্যতম ছিল বলেই সাহস করে বাজি রাখতে পেরেছিলাম তোমার সাথে। দুটো মূর্তি তখনও বাকি। লন্ডনে যেটা আছে, প্রথমেই সেটা চুরমার হবে, তা বুঝেই বাড়ির লোকদের আমি আগে থাকতেই সাবধান করে দিলাম যাতে আবার খুনখারাপির পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তারপর গেলাম। ফলে লেসট্রেড পেল পিয়েত্রোর খুনিকে। আমি কিন্তু ততক্ষণে জেনে গেছি যে বর্জিয়ার মুক্তোর পেছনেই ধাওয়া শুরু হয়েছে আমাদের। নিহত লোকটার নাম জানার ফলেই দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে যোগাযোগ পেয়ে গেলাম। বাকি রইল শুধু একটা মূর্তি–রিডিং-এর মি. স্যান্ডিফোর্ডের মুক্তো সেখানেই আছে জেনে আনবার ব্যবস্থা করলাম। তোমাদের সামনেই তো পৌঁছেছে আমার টেবিলে এবং এই সেই বর্জিয়ার মুক্তো।

নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম সবাই।

———-

টীকা

কালাপাহাড়ের কাণ্ড নয় : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সিক্স নেপোলিয়ন্স স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের মে ১৯০৪ সংখ্যায় এবং কলিয়ার্স উইকলির ৩০ এপ্রিল ১৯০৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

ডিভাইন : গবেষকরা মনে করেন ফ্রান্সে বসবাসকারী বেলজিয়ান ভাস্কর পল ডি ভিন (১৮৪৩-১৯০১) অথবা ইংরেজ ভাস্কর জেমস এস. ডি. ভিল (১৭৭৬-১৮৪৬)-এর আদলে এই নামটি লেখক গল্পে ব্যবহার করেছেন।

idce fixe : কোনো ভাবনা বা চিন্তাধারা মনে গেঁথে যাওয়ার ফরাসি প্রতিশব্দ। মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত সংজ্ঞা।

সেন্ট্রাল প্রেস সিন্ডিকেট : কাল্পনিক নাম। বাস্তবে একটি সংবাদ সংস্থা ছিল সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি নামে।

হার্ডিং ব্রাদার্স : মেট্রোপলিটান অ্যান্ড ডিস্ট্রিক্ট রেলওয়ে স্টেশনের লাগোয়া ১২৩-১২৭, কেনসিংটন হাই স্ট্রিটে এই ধরনের একটি দোকান ছিল, যার নাম পন্টিং ব্রাদার্স।

নিহিলিস্ট : নিহিল শব্দের অর্থ নাই। শব্দটির প্রচলন মধ্যযুগ থেকে, কিন্তু জনপ্রিয় হয় ১৮৬২-তে প্রকাশিত আইভ্যান তুর্গেনিভের উপন্যাস ফাদার্স অ্যান্ড সন্স-এ আলোচিত হওয়ার পর। তথাকথিত উচ্চ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল নিহিলিস্টদের। কোনো সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্কে এদের বিশ্বাস ছিল না।

বেরড রিপাবলিকান : ফরাসি বিপ্লবের র্যাডিক্যাল নেতাদের ব্যবহৃত লাল রঙের জন্য তাদের এই নামে অভিহিত করা হত।

একে একে পেরিয়ে গেলাম : হোমস-গবেষক জেমস এডওয়ার্ড হলরয়েড জানিয়েছেন কেনসিংটন থেকে স্টেপনি যেতে হলে লন্ডনের এই অঞ্চলগুলি পার হওয়ার দরকার পড়ে না। এই জায়গাগুলি টেমস নদীর উত্তরে অবস্থিত। আর হোমসের গন্তব্যের সোজা পথ গিয়েছে নদীর দক্ষিণ দিক ধরে। প্রাচীন লন্ডন শহরের বা হোমসের সমসাময়িক লন্ডন শহরের যে রোড-মাপ পাওয়া যায়, তা থেকে এই যাত্রাপথ বা অন্যান্য কাহিনিতে হোমসের বিচরণ-পথ সামান্য হলেও বোঝানো যেতে পারত। কিন্তু লন্ডন শহরের রাস্তাঘাট স্বচক্ষে দেখা না-থাকলে বর্তমানের সঙ্গে সেই মানচিত্রের যোগাযোগ সাধন করা দুষ্কর।

পদবি জানি না : ম্যানেজার কর্মচারীর পদবী জানে না, অথচ মাইনের খাতায় বেপ্পোর নাম আছে। সেখানে পদবী লেখা নেই, তা অবিশ্বাস্য।

স্যাফ্রন হিল : লন্ডন শহরের প্রধান দুটি ইতালিয়ান অধ্যুষিত এলাকা হল হলবর্ন এবং সোহোএদের মধ্যে প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম হলবর্নকে স্যাফ্রন হিল বলা হত।

মাফিয়া : শেষ মধ্যযুগে ইতালির সিসিলিতে বিদেশি আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে স্থানীয় জমিদারদের গড়ে ভোলা ব্যক্তিগত সেনাবাহিনি পরবর্তীকালে পরিণত হয় সংঘবদ্ধ অপরাধীদের জোট হিসেবে। মাফিয়া শব্দের অর্থ আশ্রয়।

প্রিয় হাতিয়ার : এই গল্প ছাড়া রেড-হেডেড লীগ এবং আ কেস অব আইডেন্টিটি গল্পে হোমসকে এই হাতিয়ার সঙ্গে রাখতে দেখা গিয়েছে।

বর্জিয়া : বর্জিয়া বংশ মূলত স্পেন দেশীয় হলেও এরা বহুকাল ইতালি শাসন করেছে। ভ্যালেন্সিয়ার কার্ডিনাল আর্চবিশপ আলফেসো ডি বোর্জা (১৩৭৮-১৪৫৮) পোপ নির্বাচিত হন ১৪৫৫ সালে। তিনি ছিলেন পোপ তৃতীয় কালিক্সটাস। ১৪৯২-এ তাঁর ভাইপো রডরিগো হন পোপ চতুর্থ আলোকজান্ডার। তার একাধিক অবৈধ সন্তানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সিজার এবং লুক্রেজিয়া। সিজার প্রথম দিকে চার্চে যোগদান করলেও পরে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং ফ্রান্সের দ্বাদশ লুইয়ের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন অঞ্চলের শাসন করায়ত্ত করেন। সিজারের মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল তার ভাই লুক্রেজিয়া-ও।

কোলোম্নর যুবরাজ : এই কাহিনির ঘটনাকালে কোলোন্নার দুজন যুবরাজ জীবিত ছিলেন। তারা হলেন ফ্যাব্রিজিও অব আভেলা এবং প্রসপেরো অব সন্নিনো।