অনুরক্ত বন্ধু

অনুরক্ত বন্ধু
The Devoted Friend

একদিন সকালে একটা বুড়ো ভলো ইঁদুর গর্ত থেকে তার মাথাটা বার করে দিল। তার ছোটো ছোটো চোখ দুটো চকচকে, শক্ত গোঁফ জোড়া ধূসর রঙের আর ন্যাজটা হচ্ছে কালো ভারতীয় রবারের মতো। ছোটো-ছোটো হাঁসগুলো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল পুকুরে দেখতে তাদের হলদে ক্যানারি পাখির মতো। তাদের মার পা দুটো সত্যিকার লাল। কেমন করে জলে। মাথার ওপরে দাঁড়াতে হয় মা তাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছিল। সে তার বাচ্চাদের বারবার সাবধান করে দিচ্ছিল—’মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে না শিখলে কোনো উঁচু সমাজে তোমরা কলকে পাবে না।’ কিন্তু বাচ্চারা সেকথা গ্রাহ্যই করছে না। বাচ্চা বলেই বোধ হয় সভ্য সমাজে ঢুকতে পারার সুবিধে কত তা তারা জানত না।

জলের ইঁদুর চিৎকার করে উঠল-বেয়াদপ ছোকরা সব বটে! ওদের ডুবে মরাই ভালো। মা-হাঁসটা বলল–মোটেই না। প্রত্যেককেই শেখার সুযোগ দিতে হয়। তাছাড়া, মাদের কোনো বিষযেই ধৈর্য হারালে চলে না।

জলের ইঁদুর বলল–তাই নাকি! তা, বাপ-মাযের অনুভূতির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সংসার বলতে কি নেই আমার। আসল কথাটা হচ্ছে, আমি কোনো দিন বিয়ে করিনি ভবিষ্যতে বিয়ে করার ইচ্ছেও আমার নেই। একদিক থেকে প্রেম জিনিসটা ভালোই; তবে অনুগত বন্ধুত্ব তার চেয়েও ভালো।

কাছাকাছি একটা উইলো গাছের ডালে একটা সবুজ রঙের লিনেট পাখি বসেছিল। ওদের আলোচনা শুনে সে বলল–তাই বুঝি! কিন্তু জিজ্ঞাসা করি অনুগত বন্ধুর দায়-দায়িত্ব কী?

মা-হাঁসটা বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ওই কথাটা আমিও জানতে চাই। এই বলে সে সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের আর একপাশে গিয়ে কেমন করে মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয় সেইটাই তার বাচ্চাদের দেখাতে লাগল।

জলের ইঁদুর বলল–কী বোকার মতো যে প্রশ্ন কর! আমার অনুগত বন্ধু যে হবে সে আমার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে এটা অবশ্যই আমি চাই।

ছোটো-ছোটো পাখনা উড়িয়ে আকাশে ভাসতে-ভাসতে বাচ্চা পাখিটা ডিজ্ঞাসা করল–আর প্রতিদানে কী করতে হবে তোমাকে?

জলের উঁদুর বলল–কী যে ছাই-ভস্ম সব বল আমার তা মাথায় ঢোকে না।

লিনেট বলল–একটা গল্প শোন।

আমার সম্বন্ধে! তাহলে শুনব। গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।

লিনেট বলল–এ গল্প তোমার সম্বন্ধেও খাটবে। এই বলে সে উড়ে গিয়ে পুকুরের ধারে বসে গল্প শুরু করল। এক সময় হ্যানস নামে একটা সৎ জীব বাস করত।

বেশ সম্ভ্রান্ত গোছের?–জিজ্ঞাসা করল জলের ইঁদুর।

লিনেট বলল–না। সদ্য হৃদ্য আর পরিচ্ছন্ন হাসিখুশি ছাড়া তার মধ্যে আর কিছু সম্ভ্রান্ত । ছিল বলে আমার মনে হয় না। একা-একা সে ছোটো একটা ঘরে থাকত; আর প্রতিটি দিনই সে বাগানে কাজ করত। সারা দেশে তার বাগানের মতো সুন্দর বাগান আর কারও ছিল না। সব ঋতুতেই তার বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে থাকত।

অনেক বন্ধু ছিল মানুষটির; কিন্তু তার সবচেয়ে অনুরক্ত বন্ধু ছিল মিলার হিউ। সত্যি কথা বলতে কি এই ধনী হিউ তার এতই অনুরক্ত ছিল যে এমন কোনো দিন সে বাগানের পাশ দিযে যায়নি যেদিন যে বাগানের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো একটা সুন্দর ফুলের গুচ্ছ অথবা পকেট ভর্তি করে প্লাম আর চেরি তুলে নিয়ে যায়নি–অবশ্য বাগানে সেগুলি থাকলে।

মিলার হিউ বলত–সত্যিকার বন্ধু তারা যারা একজনের জিনিস সবাই মিলে ভাগ করে নেয়।

এই কথা শুনে হ্যানস হাসত আর ভাবত এত উঁচু আদর্শবাদী বন্ধু আর কার রয়েছে?

মাঝে-মাঝে অনেকেই অবাক হয়ে ভাবত ওই ধনী হিউ, যার কলে একশ বস্তা ময়দা সব সময় মত হয়ে থাকে, যার রয়েছে দু’টা দুধওয়ালা গরু আর লম্বা-লম্বা সুন্দর লোমশ অজস্র ভেড়া–সেই মানুষটি হ্যানসকে প্রতিদানে কখনো কিছু দেয় না কেন। কিন্তু এসবু। ছোটোখাটো ব্যাপার নিযে হ্যানস কোনো দিন মাথা ঘামাত না। বন্ধুদের নিঃস্বার্থপর দানের সম্বন্ধে মিলার হিউ যে সমস্ত লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দিত, হ্যানস সেই সব বক্তৃতা খুব মন দিযে শুনত আর উপভোগ করত।

বাগান থেকে হ্যানস যে বিশেষ কিছু পেত তা নয়। শরৎ, গ্রীম আর বসন্তে সে মোটামুটি খুশিই থাকত; কিন্তু শীতকালটাই ছিল তার কাছে মারাত্মক; কারণ, ওই সময়ে তার বাগানে কিছুই ফলত না; অনেকদিন এমনও হয়েছে যে সে কিছু শুকনো ফল মুখে দিয়ে ঘুমোতে গিয়েছে। তা ছাড়া, এই সময়টা সে বড়ো নিঃসঙ্গও বোধ করত, কারণ গোটা শীতকালটা। মিলার হিউও পথ দিয়ে হাঁটত না।

মিলার তার স্ত্রীকে বলত–যতদিন শীত থাকবে ততদিন হ্যানসকে না দেখতে যাওয়াই ভালো। কারণ, মানুষ যখন দুঃখে পড়ে তখন তার কাছে কারও যাওয়া উচিত নয। তাতে তাকে বিব্রত করা হয়। অন্তত, প্রকৃত বন্ধুত্ব বলতে এইটাই আমি বুঝি। আর এ বিষয়ে আমি যে ঠিক সে-সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। সুতরাং বসন্তকাল না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব; তারপরে আমি দেখা করব তার সঙ্গে। সে তখন আমাকে এক বাক্স প্রিমরোজ উপহার দিয়ে যথেষ্ট আনন্দ পাবে।

প্রচুর পাইন কাঠের আগুনের ধারে মেভাজি একটা আরাম কেদারায় বসে তার স্ত্রী বলল–অন্য লোকের সম্বন্ধে তুমি বেশ চিন্তাশীল দেখছি। বন্ধুত্বের সম্বন্ধে তোমার এই ধরনের। কথা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগছে যদিও পাদরি বাবা বিরাট তিনতলা বাড়িতে থাকেন। এবং কড়ে আঙুলে সোনার আংটি পরেন তবুও আমি নিশ্চিত যে তিনিও এইরকম সুন্দর কথা বলতে পারবেন না।

মিলারের সবচেয়ে ছোটো ছেলেটা বলল–কিন্তু তাঁকে কি আমরা এখানে আনতে পারি নে? যদি তিনি সত্যিকার দারিদ্রে পড়ে থাকেন আমি তাহলে তাঁকে আমার অর্ধেকটা খাবার দিতে পারি–আর দেখাতে পারি আমার সাদা খরগোসগুলি।

মিলার বেশ উঁচু স্বরে বলল–আচ্ছা বোকা ছেলে তো! তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে যে কী সুরাহা হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না কিছুই শিখছ বলে তো মনে হচ্ছে না। হ্যানস যদি এখানে এসে আমাদের এই ভালো-ভালো খাবার, ভালো-ভালো লাল মুদ, আর এমন আরামের গৃহস্থালী দেখে তাহলে তার মনে হিংসার উদ্য হতে পারে, এই হিংসাটাই হচ্ছে বন্ধুত্বের পহেল্ক বড়োই বিপজ্জনক। এতে মানুষের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। আমি কিছুতেই হ্যানসকে তার চরিত্র নষ্ট করতে দেব না। তার সবচেয়ে প্রিয়ে বন্ধু আমি। সব সময় আমি তার ওপরে নডরে রাখব। দেখব সে যাতে লোভের পথে পা না বাড়ায। তাছাড়া সে যদি এখানে আসে তাহলে আমার কাছ থেকে ধারে কিছু ময়দা নেওয়ার প্রস্তাব সে দিতে পারে। কিন্তু আমি তাকে ধার দিতে পারি নে। মযদা আর বন্ধুত্ব এক জিনিস নয। দুটো জিনিসের বানাই। আলাদা। তাদের অর্থও যে আলাদা সেকথা সবাই জানে।

বিরাট একটা পাত্রে মদ ঢেলে তার স্ত্রী বলল–বা! কী সুন্দর কথা! মনে হচ্ছে, আমি গির্জায় রয়েছি।

মিলার বলল–অনেক মানুষই ভালো অভিনয় করতে পারে। কিন্তু ভালো কথার শক্তি কম মানুষেরই রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় দুটোর মধ্যে ভালো কথা বলাটাই বেশি শক্ত-আর সেই সঙ্গে সূতর।

এই বলে ছেলের দিকে এমন রুষ্টভাবে সে তাকিয়ে রইল যে বেচারা লজ্জায় মাথা নীচু করল। যাই হোক, তার ব্যস এত কম যা তাকে হমা করা যেতে পারে।

জলের ইঁদুর জিজ্ঞাসা করল–তোমার গল্প শেষ?

লিনেট বলল–মাত্র শুরু।

জলের ইঁদুর বলল–তুমি তো তাহলে দেখছি সেকেলে হয়ে গিয়েচ্ছ। আজকাল প্রতিটি দক্ষ। কথকই শেষ থেকে শুরু করে, তারপরে চলে যায় প্রথমে, শেষ করে মাঝখানে। এইটিই হচ্ছে নতুন রীতি। সেদিন একজন সমালোচক একটি যুবককে সঙ্গে নিয়ে পুকুরের ধারে বেড়াতে বেড়াতে এই কথা বলছিলেন। আমি তা শুনেছি। কথাটা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে আমার। কারণ ভদ্রলোকের চোখে নীল চশমা, মাথায় টাক আর যখনই যুবকটি কিছু বলতে চাইছিল তখনই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল একটিমাত্র ধ্বনি-পুঃ। কিন্তু গল্পটা শুরু কর ভাই। তোমার এই মিলারটিকে আমার বেশ ভালো লাগছে। অনেক সৎগুণ তার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।

লিনেট বলল–বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে মিলার তার স্ত্রীর কাছে ঘোষণা করল যে খুদে হ্যালস-এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।

তার স্ত্রী সানন্দেই বলল–সত্যিই তোমার হৃদয় কত উদার। তুমি সব সময় অন্য লোকের কথা ভাবা যাই হোক, ফুল আনার জন্যে সেই বড়ো ঝুড়িটা নিয়ে যেতে ভুলো না যেন।

যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করে মিলার হ্যানস-এর সঙ্গে দেখা করতে গেল।

গুডমর্নিং হ্যানসা শীতকালটা কাটল কেমন?

হ্যানস বলল–প্রশ্নটা করে তোমার হৃদ্যতারই পরিচয় দিযে। না, খুব কষ্টেই গিয়েছে। কিন্তু বসন্তকাল এসে গিয়েছে। আমি এখন খুশিই। আমার ফুল সব ভালোই কাটছে।

মিলার বলল–সারা শীতকালটাই আমরা তোমার কথা ভেবেছি। তুমি যে কেমন করে কাটাচ্ছ তাই ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম আমরা।

ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা আমাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছ।

তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি হ্যানসা বন্ধুত্ব কাউকে ভুলতে দেয় না। এর সম্বন্ধে ওইটাই হল সবচেয়ে আশ্চর্য কথা মনে হচ্ছে, জীবন-কাব্য বলতে কী বোঝায় তা তুমি জান না। ভালো। কথা! তোমার ওই প্রিমরোভগুলি সত্যিই কী সুন্দর।

হ্যানস বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার ভাগ্য ভালো যে অতগলো সন্দর প্রিমরোজ ফল আমার বাগানে ফুটেছে। আমি ওগুলি বাজারে নিয়ে গিয়ে বার্গোমাস্টারের মেযেকে বিক্রি করব; আর সেই টাকায় আমার একচাকার ঠেলাগাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে আসব।

ফিরিয়ে আনবে? তুমি কি সেটা বিক্রি করে দিয়েছিলে?

বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বুঝতেই পাচ্ছ শীতকালটাই হচ্ছে আমার দুঃসময়। তখন রুটি কেনার মতো পয়সাও আমার হাতে থাকে না। প্রথমে বিক্রি করলাম রুপোর বোতাম, তারপরে কুপোর চেন, তারপরে সেই বড়ো পাইপ, তারপরে ঠেলাগাড়ি, এখন আমি সব কটাই ফিরিয়ে আনব।

মিলার বলল–হ্যানস, আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দেব। গাড়িটা অবশ্য খুব একটা ভালো অবস্থায় যে নেই সেকথা অবশ্য মিথ্যে নয়। তবু সেটা আমি তোমাকে দেব। আমি জানি এ থেকে আমার হৃদযটা যে কতটা দরাজ তাই প্রমাণিত হবে; আর ওটা বিলিয়ে। দেওয়ার জন্যে অনেকে যে আমাকে মূর্খ বলবে সেদিক থেকেও আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বিশ্বের আর দশটা মানুষের মতো নই। আমি জানি উদারতাই হচ্ছে বন্ধুত্বের মূল কথা। আর তা ছাড়া, আমার একটা নতুন ঠেলাগাড়ি রয়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত হও। আমি ওটা তোমাকে দেব।

খুদে চেহারার হ্যানস-এর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; সে বলল–সত্যিই বড়ো উদার তুমি। বাড়িতে আমার কিছু কাঠের তক্তা রয়েছে। ওগুলি দিয়ে কম খরচেই আমি ওটা সারিয়ে নিতে পারব।

মিলার বলল–কী বললে! কাঠের তক্তা। আরে, আমার গোলার ছাদের জন্য ঠিক ওইগুলিই তো আমার চাই। ছাদে একটা বিরাট গর্ত হয়েছে সেই গর্তটা বোজাতে না পারলে বৃষ্টির জলে আমার সব শস্য নষ্ট হয়ে যাবে। কী সৌভাগ্য যে তুমি খবরটা দিলে! একটা সৎকাজের ইঙ্গিত আর একটা সৎকাডের সংবাদ কী করে দেয় এইটাই হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়ি দিয়েছি; তুমি আমাকে তোমার তক্তা দাও। অবশ্য তক্তার চেয়ে ঠেলাগাড়ির দাম অনেক বেশি। কিন্তু সত্যিকার বন্ধুত্ব কোনোদিন দর কষাকষি করে না। অনুগ্রহ করে ওগুলি আমাকে দাও; আমি এখনই কাজ শুরু করে দিই।

নিশ্চয়-নিশ্চয়-এই বলে হ্যানস দৌড়ে গিয়ে তক্তাগুলি টেনে আনল।

সেই দিকে তাকিয়ে মিলার বলল–তা তো বেশ বড়ো নয় হে। ভয় হচ্ছে আমার চাল সারানোর পরে এমন কিছু তক্তা বাঁচবে না যা দিয়ে তোমার ঠেলাগাড়ি সারানো চলবে। অবশ্য তার জন্যে আমি দায়ী নই। এখন আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিয়ে দিলাম। তারই প্রতিদানে নিশ্চয় তুমি আমাকে কিছু ফুল দেবে। এই নাও ঝুডি, ওটা ভর্তি করে দিতে ভুলো না যেন।

একটু দুঃখিত হয়ে হ্যানস জিজ্ঞাসা করল–ভর্তি?

সে জানত অতবড়ো ঝুড়ি ভর্তি করতে গেলে বাগানে তার আর কোনো ফুলই থাকবে না; অথচ তার রুপোর বোতামটা ফিরিয়ে আনার জন্যে ফুল নিয়ে তখনই বাজারে যাওয়া চাই।

মিলার বলল–তোমাকে আমি ঠেলাগাড়িটা দিয়ে দিলাম। তার বদলে কযেকটা ফুল চাওয়াটা এমন কিছু বেশি নয়। আমার হয়তো ভুল হয়েছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম সত্যিকার বন্ধুত্বের মধ্যে দেনা-পাওনার ব্যাপারটা একেবারেই গৌণ।

খুদে হ্যানস বলল–প্রিয় বন্ধু নিয়ে যাও আমার বাগানের সব ফুল। আমার রুপোর বোতামের। চেয়ে তোমার উপদেশ অনেক বেশি মূল্যবান।

এই বলে সে সেই বিরাট ঝুড়ি নিয়ে ফুলে সেটা বোঝাই করে দিল।

বিদায় হ্যানস–এক কাঁধে তক্তা আর এক হাতে ঝুড়িটা নিয়ে মিলার বিদায় নিল।

পরের দিন সে যখন বাগানে কাজ করছিল এমন সময় পিঠে বিরাট একটা ময়দার বোঝা নিযে মিলার তার বাগানের ধারে এসে হাজির হল, বলল–প্রিয় হ্যানস, এই বোঝাটা আমার হয়ে তুমি একটু বাজারে বয়ে নিয়ে যাবে?

হ্যানস বলল–সত্যিই আমি খুব দুঃখিত। আজ আমার অনেক কাজ রয়েছে বাগানে।

মিলার বলল–সত্যিই আমাকে অবাক করলো তোমায় ঠেলাগাড়িটা দেব এই কথা শুনেও কি এটুকু কাজ না করাটা তোমার পহেষ্ক অবন্ধুর কাজ করা হবে না?

হ্যানস চিৎকার করে বলল–আর ওকথা বলো না। সমস্ত পৃথিবীর বিনিমযেও আমি অবন্ধুর মতো কাজ করব না। চল।

দিনটা সত্যিই গরম ছিল। শুধু যে ভীষণ গরম তাই নয় একেবারে ধুলোতে ভর্তি। কিছুটা গিয়েই সে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে বিশ্রামের জন্য তাকে বসে পড়তে হল। তা সত্ত্বেও সে বীরত্বের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে একসময় বাজারে পৌঁছল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে বেশ ভালো দামে সে ময়দা বিক্রি করে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল; কারণ তার ভয় হল রাত হয়ে গেলে পথে সে দস্যুদের কবলে পড়তে পারে।

ঘুমোতে যাওয়ার সময় খুদে হ্যানস নিজের মনে-মনেই বলল–আডং সারা দিনটাই খুব পরিশ্রম হয়েছে। কিন্তু মিলারের কাজ করতে আমি যে অস্বীকার করিনি সেটা ভালোই হয়েছে, কারণ, মিলারই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তাছাড়া সে আমাকে তার ঠেলাগাড়িটা দেবে বলেছে।

পরের দিন খুব ভোরেই ময়দার দাম নেওয়ার জন্য মিলার তার বাড়িতে এসে হাজির হল কিন্তু ক্লান্ত হ্যানস তখনো বিছানা থেকে ওঠেনি।

মিলার বলল–তুমি বড়োই অলস হয়ে উঠচ্ছা সত্যি বলতে কি, তোমায় আমি আমার ঠেলাগাড়িটা দেব বলেছি। বিশেষ করে সেই জন্যেই তোমার কঠোর পরিশ্রম করা উচিত। আলস্য হচ্ছে মহা পাপ। আমার বন্ধুরা কেউ অলস হোক তা আমি চাই নে। সম্পষ্ট কথা বলছি বলে কিছু মনে করো না। তোমাকে যদি বন্ধু বলে না ভাবতাম তাহলে এসব কথা বলার চিন্তাও আমি করতাম না। কিক্তি মনের কথাটা প্রকাশ করে যদি বলতেই না পারলাম তাহলে বন্ধু হয়ে আর কী লাভ আমার? ইত্যাদি ইত্যাদি।

চোখ রগড়াতে খদে হ্যানস বিছানায় উঠে বসে বলল–সত্যিই বড়ো দঃখিত: কিন্তু গতকাল আমি এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে ভাবলাম আজ একটু বেশিক্ষণ শুয়ে থেকে পাখির গান শুনব। পাখির গান শোনার পরে আমার কাজ করার শক্তি অনেক বেড়ে যায় তা কি তুমি জান?

খুদে হ্যানস-এর পিঠে চাপড় দিযে মিলার বলল–তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে আমার মিল-এ এস। ছাতাটা সারিয়ে দিতে হবে।

ফুলগাছ দু’দিন জল পায়নি; বেচারা হ্যানস-এর তাড়াতাড়ি বাগানে যাওয়া দরকার, যে এমন সৎ বন্ধু যে মিলারকে নিরাশ করতে তার ইচ্ছে যাচ্ছিল না।

একটু লজ্জিতভাবে সে বলল–আজ আমি ব্যস্ত রয়েছি। না গেলে কি কিছু মনে করবে?

মিলার বলল–এ কী বলছ! তোমাকে আমি ঠেলাগাড়িটা দেব বলছি। তারপরে একাজটা করে দেওয়ার জন্যে তোমাকে কিছু বলারই আমার দরকার রয়েছে বলে ভাবিনি। কিন্তু যদি তুমি। যেতে অস্বীকার কর তাহলে অগত্যা নিজেই করে নেব।

হ্যানস তাড়াতাড়ি বলল–না, না। আমি এখনই যাচ্ছি।

এই বলেই সে লাফিয়ে উঠে জামাকাপড় পরতে এগিয়ে গেল।

মিলার উৎসাহিত হয়ে বলল–অপরের কাজ করে দেওযার মতো নযুলাভিরাম কাজ আর নেই।

সারাদিন কাজ করার পর সন্ধের সময় বিশ্রাম নিতে-নিতে আর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হানস বলল–তুমি যা বল তা শোনা পরম উপাদ্যে। কিন্তু তোমার এই সুন্দর আদর্শের কথা কোনোদিনই যে আমার মাথায় আসবে আমি ভাবতে পারিনি।

মিলার সাহস দিয়ে বলল–আসবে, আসবে, কিন্তু আরো কষ্ট করতে হবে তোমাকে। বন্ধুত্ব কাকে বলে তা শিখতে এইতো সবে শুরু করে। একদিন আসবে যখন সব বুঝতে পারবে তুমি।

পারব? সত্যি বলছ?

নিঃসন্দেহে। কিন্তু আজ তুমি বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করা কাল সকালে আমার মেষগুলোকে চরাতে নিয়ে যেতে হবে।

বেচারা হ্যানস এর প্রতিবাদ করতে ভয় পেল। পরের দিন সকালেই মিলার তার একপাল মেষ নিয়ে হাজির হল তার বাগানের ধারে। সেই পাল নিযে হ্যানস ছুটল পাহাড়ের ওপরে। সারাদিন মেষ চরিয়ে ফিরে এল সন্ধেবেলায়; কিন্তু তখন সে এত ক্লান্ত যে চেয়ারে বসেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল হওয়ার আগে আর তার ঘুম ভাঙেনি।

আজ বাগানে কাজ করে আমি বেশ আনন্দ পাব–এই কথা বলে সে তক্ষুনি বাগানে বেরিয়ে গেল।

কিন্তু তার বন্ধু মিলার প্রায়ই তার বাগানে এসে নানা কাজে তাকে ডেকে নিয়ে যেতে লাগল। ফলে মন দিয়ে সে বাগানে কাজ করার সময় পেল না। এই জন্যে মাঝে মাঝে সে মনে বড়ো কষ্ট পেত; কিন্তু এই ভেবে নিজেকে সে সান্ত্বনা দিতে চাইত যে মিলার তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। মিলারের সব ভালো-ভালো কথাগুলি সে একটা খাতায় টুকে নিয়ে প্রতিদিন রাত্রিতে সে সেগুলি পড়ত।

একদিন সন্ধেবেলায় খুদে হ্যানস ঘরের মধ্যে বসে-বসে আরাম করে আগুন পোহাচ্ছিল এমন সময় দরজায় বেশ জোরে-ডোরে কে যেন আঘাত করল। রাত্রিটা ছিল ঝড়ো; বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়ের দাপাদাপি চলেছে। সে ভাবল ওই ঝড়ই তার কপাটে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু তারপরেই আবার একটা ধাক্কা এল, তারপরে আবার, আবার। আর প্রতিটি ধাক্কাই আগের ধাক্কার চেয়ে বেশি ডোরাল।

নিশ্চয় কোনো হতভাগ্য পথিক–এই মনে করে সে দৌড়ে এসে খিল খুলে দিল। দেখল একটা লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে মিলার দাঁড়িয়ে রয়েছে।

চেঁচিয়ে বলল মিলার–প্রিয় হ্যানস, আমি বড়োই বিপদে পড়েছি। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আমার বাচ্চা ছেলেটা খুব চোট খেয়েছে। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি এত দূরে থাকেন, আর রাত্রিটা এত খারাপ যে হঠাৎ আমার মনে হল তোমাকে ডাক্তারের বাড়ি পাঠানোটাই সব দিক থেকে ভালো হবে। তুমি জান তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দান। করছি। সেই দিক থেকে এটাই সঙ্গত যে প্রতিদানে তুমি আমার এই কাজটা করে দেবে।

হ্যানস উৎসাহিত হয়ে বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। তুমি যে এসেছ এতে নিজেকে আমি ভাগ্যবান বলেই মনে করছি। আমি এখনই যাচ্ছি। কিন্তু তোমার ওই লণ্ঠনটা দাও-কারণ রাত্রিটা বড়ো অন্ধকার-আলোর অভাবে আমি হয়তো খানায় পড়ে যেতে পারি।

মিলার বলল–খুবই দুঃখিত। এটা এইমাত্র কিনেছি কিনা! এটার কিছু হলে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি অন্ধকারেই বেরিয়ে যাচ্ছি।

এই বলেই সে ঝড়ের রাতে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।

ওঃ! কী ভীষণ রাত! এত অন্ধকার যে তার পষ্কে পথ চেনা দায় হয়ে উঠল, এত ঝড়ের দাপাদাপি যে রাস্তায় পা ফেলাই দায়। যাই হোক, দুঃসাহসী ছিল বলেই হয়তো প্রায় ঘন্টা। তিলেক ঝড় আর অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে সে ডাক্তারের বাসায় এসে হাজির হল এবং দরজায় করাঘাত করল।

শোওয়ার ঘরের জানালার ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন–কে?

খুদে হ্যানস, ডাক্তার।

কী চাই?

মিলারের ছোটো ছেলেটা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চোট খেয়েছে, সে আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলেছে।

‘ঠিক আছে’–এই বলে ডাক্তার সাজপোশাক করে লণ্ঠন নিয়ে গাড়িতে চেপে তক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন মিলারের বাড়ির দিকে। আর তারই পিছু পিছু বেচারা হ্যানস চলতে লাগল হেঁটে-হেঁটে।

কিন্তু ঝড়ের দাপাদাপি বাড়তে লাগল; শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। কোন দিকে যাচ্ছে হ্যানস-এর পক্ষে তা বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল; গাড়ির সঙ্গেও আর সে তাল দিয়ে চলতে পারল না। তারপরে একসময় সে পথ হারিয়ে ফেলে সোডা জনবিরল মাঠের চারপাশে ঘুরতে লাগল। ডায়গাটা ছিল বিপজ্জনক। খানাখোঁদল আর গভীর জলাশয়ে ভর্তি ছিল জায়গাটা। তাদেরই একটা জায়গায় বেচারা হ্যানস ডুবে মারা গেল। পরের দিন বিরাট একটা জলাশয়ে তার মৃতদেহটাকে ভাসতে দেখল মেষপালকরা। তারপরে তার দেহটাকে তার বাড়িতে বয়ে আনা হল।

খুদে হ্যানসকে ভালোবাসত সবাই; সেই জন্যে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সবাই যোগ দিতে এল। মিলারই হল সেই ক্রিয়ার প্রধান পাণ্ডা।

মিলার বলল–আমিই ছিলাম তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু; তাই আমারই উচিত এই সভার সবচেয়ে ভালো স্থানটি দখল করা।

এই বলে গায়ে কালো পোশাক চডিযে, কালো রুমালে মাঝে মাঝে চোখের জল মুছতে মুছতে সে শোকযাত্রার পুরোভাগে চলতে শুরু করল।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শেষে সরাইখানায় আরামের সঙ্গে বসে মশলা দেওয়া মদ আর মিষ্টি কেক খেতে-খেতে কামার বলল–খুদে হ্যানস-এর মৃত্যু প্রত্যেকের কাছে একটা ক্ষতি।

মিলার বলল–অন্য কারো কথা জানি নে, কিন্তু তার মৃত্যু আমার কাছে নিঃসংশয়ে বিরাট একটা ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়। সে আমার এত প্রিয় বন্ধ ছিল যে তাকে আমার ঠেলাগাড়ি আর একটু হলে দানই করে ফেলতাম। এখন সেটাকে নিয়ে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। সেটা বাড়িতে ফেলে রাখতে আমার অসুবিধে হচ্ছে। তার অবস্থা এতই খারাপ যে এমন অবস্থায় বিক্রি করেও বিশেষ কিছু ঘরে আসবে না। এর পরে আর কাউকে যাতে কিছু দেওযার বাসনা আমার না হয় সেদিক থেকে খুব সতর্ক হতে হবে। উদার হতে গেলে মানুষকে দুঃখ পেতেই হয়।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জলের ইঁদুর বলল–মানে?

লিনেট বলল–মানে, এইখানেই আমার গল্প শেষ।

জলের ইঁদুর জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু মিলারের শেষ পর্যন্ত কী হল?

লিনেট বলল–তা আমি জানি নে; আর জানারও ইচ্ছে নেই।

জলের ইঁদুর বলল–এতেই বোঝা যাচ্ছে তোমার চরিত্রে সহানুভূতি বলে কোনো পদার্থ নেই।

লিনেট বলল–এই গল্পের নীতিটা কী তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ না।

জলের ইঁদুর প্রায় গোঙিয়ে উঠল–কী-কী বললে!

নীতি।

তুমি বলতে চাও গল্পটার একটা নীতি রয়েছে?

নিশ্চয়।

রাগে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে করতে ইঁদুর বলল–বটে, বটে! সেকথা শুরু করার আগে তুমি আমাকে বলনি কেন? তা যদি বলতে তাহলে তোমার এ গল্প আমি শুনতামই না। সত্যি কথা বলতে কি সেই সমালোচকের মতো আমি শুধু বলতাম-পুঃ।

এই বলে গভীর বীতশ্রদ্ধায় ল্যাজ নাড়িয়ে একটা চকিত শব্দ করে সে তার গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল।

কয়েক মিনিট পরে সাঁতার কাটতে কাটতে ফিরে এসে হাঁসটা জিজ্ঞাসা করল জলের ইঁদুরকে–কেমন লাগল তোমার? ওর সত্যিই কি ভালো বক্তব্য রয়েছে; কিন্তু আমি হচ্ছি মা; মা-এর অনুভূতি রয়েছে আমার মধ্যে যারা চিরকুমার তাদের দিকে চোখের জল না ফেলে আমি তাকাতে পারি নে।

লিনেট বলল–মনে হচ্ছে আমি তাকে বিরক্ত করেছি। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে আমি তাকে এমন। একটি গল্প বলেছিলাম যার মধ্যে একটা নীতি রয়েছে।

হাঁসটা বলল–তাই বুঝি! ওটাই সর্বক্ষেত্রে বিপজ্জনক। এবং তার সঙ্গে আমিও একমত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *