প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

০৮. আনুগত্য

৮. আনুগত্য

ডাক-গাড়িটা যত জোরে সম্ভব, ঘণ্টায় তিরিশ মাইল হিসেবে ছুটছিল। স্থানটি আমার পরিচিত। নতুন-ওঠা সূর্য মাইলের পর মাইল ধরে খেতের উপর ঝকঝক করছিল। মাঠে-মাঠে লোকরা সোনালী গমের ফসল কাটছিল।

সেটা এপ্রিল মাস। ট্রেন চলছিল গাঙ্গেয়-উপত্যকার মধ্য দিয়ে। ভারতের উর্বরতম অঞ্চল এটাই। গত বছর ভারতে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আমি দেখেছি যে গ্রামকে-গ্রাম গাছের ছাল খেয়ে জীবন ধারণ করছে। পোড়া মাঠের বুক থেকে অসীম কষ্টে অতি ছোট-ছোট ঘাসের বিচি খুঁটে তুলে, কিংবা ফসল ফলাতে পারে না এমন পোড়া জমিতে বুনো কুল সংগ্রহ করে বাঁচবার চেষ্টা করছে।

তারপর আবহাওয়া দয়া করে বদলে গিয়েছিল। শীতকালে ভাল বৃষ্টি হওয়ায় জমিতে আবার উর্বরতা ফিরে এল। এক বছরের উপবাসী মানুষেরা সাগ্রহে প্রচুর ফসল কাটতে লেগে গেল। বেলা তখনও খুবই কম, তবু কর্ম তৎপরতার এক দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। গ্রাম-সমাজের প্রতিটি স্ত্রী-পুরুষের সেই কাজে একটি নির্দিষ্ট অংশ ছিল। মেয়েরাই ফসল কাটছিল। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ভূমিহীন খেত-মজুর। ফসল পাকবার সঙ্গে-সঙ্গে তারা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে আসে। এদের কাজ শুরু হয় ভোরবেলা, আর শেষ হয় যখন কাজ করবার মত আলো আর থাকে না। এই মেহনতের জন্যে এরা পায় সারা দিনে ফসলের বার কিংবা মোল ভাগের এক ভাগ।

খেতে-ঘেরা কোনো বেড়া ছিল না বলে দৃষ্টি বাধা পাচ্ছিল না। গাড়ির জানলা দিয়ে কোনোরকম কোনো যন্ত্রও চোখে পড়ছিল না। চাষ করা হয়েছিল বলদ দিয়ে–হাল-পিছু একজোড়া বলদ। ফসল কাটা হচ্ছিল এক হাত লম্বা আর বাঁকা ফলাওয়ালা কাস্তে দিয়ে। খড় পাকিয়ে তা দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা ফসলের আঁটিগুলিকে খামারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কাঠের চাকাওয়ালা বলদে টানা গাড়িতে করে।

খামারের মেঝেটা গোবর দিয়ে লেপা, সেখানে বলদেরা মাড়িয়ে শস্যগুলিকে আলাদা করছে। তারা সবাই লম্বা একটা দড়িতে বাঁধা। মাটিতে শক্ত করে পোঁতা একটা খুঁটিতে সে দড়ির আর-এক মাথা বাঁধা রয়েছে। এক-একটা খেত থেকে আঁটিগুলি তুলে নিয়ে যাওয়া হলেই ছোট ছেলেরা সেখানে গাছের গোড়াগুলো খাওয়াবার জন্যে গরু-মহিষদের নিয়ে আসছিল। আবার সেই গরুগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে বৃদ্ধ আর অক্ষম স্ত্রীলোকেরা জমি ঝট দিচ্ছিল। ফসল কাটবার সময় শিষ থেকে যে-সব দানা ঝরে পড়েছিল সেগুলো তারা সংগ্রহ করছিল। এরা খেটেখুটে যতটা যোগাড় করবে, তার অর্ধেক নেবে খেতের মালিক। বাকি অর্ধেক তারা রাখতে পাবে। জমি যদি রোদে বেশী ফেটে গিয়ে না থাকে তাহলে তার পরিমাণে হবে আধসের কি সেরখানেক।

আমার পথ ছত্রিশ ঘণ্টার পথ। কামরায় আমি একা। সকালের, দুপুরের আর রাত্রির খাওয়ার সময় ট্রেন থামবে। গাড়িটা যেখান দিয়ে যাচ্ছিল, তার প্রতিটি মাইল কৌতূহলোদ্দীপক। তবু আমার মনে সুখ ছিল না। কেননা আমার বসবার জায়গার নিচে একটা ইস্পাতের তোরঙ্গের মধ্যে একটা সুতোর থলিতে যে দুশো টাকা ছিল, তা আমার নয়।

যে রেল-পথে আমি এখন ভ্রমণ করছিলুম তাতেই আমি আঠার মাস আগে জ্বালানী কঠের ইনসপেক্টরের চাকরি নিয়েছিলুম। স্কুলের পড়া শেষ করেই আমি সোজা এই কাজে যাই। এই আঠার মাস ধরে আমি বনে বাস করে এই জ্বালানির জন্যে পাঁচলক্ষ ঘনফুট কাঠ কাটিয়েছি।

গাছ কেটে মাটিতে ফেলে তাকে কেটে রলা করা হত, আর প্রতিটি ঠিক ছত্রিশ ইঞ্চি লম্বা-কমও নয়, বেশিও নয়। তারপর সেগুলোকে গরুগাড়ি করে দশমাইল দূরে সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে সেগুলোকে গোছ করে সাজিয়ে, মাপ নিয়ে, জ্বালানির ট্রেনে তুলে দিয়ে যে-যে স্টেশনে দরকার সেখানে-সেখানে নিয়ে যাওয়া হত।

বনে এই আঠার মাস বেশ খাটুনি গিয়েছিল। কিন্তু আমি ভালই ছিলুম, কাজটাও আমার ভালই লাগত। বনে চিতল হরিণ, চৌশিঙা হরিণ, শুয়োর, ময়ুর ইত্যাদি শিকার ছিল প্রচুর। আর বনের এক সীমানায় যে-নদীটা, তাতে কয়েক রকমের মাছ আর অনেক কুমির এবং ময়াল সাপ ছিল। দিনের বেলা কাজের চাপে শিকার করতে পারতুম না। কাজেই, খাদ্য-সংগ্রহের জন্যে শিকার-করা আর মাছ-ধরা রাত্তিরেই সারতে হত।

চাঁদের আলোয় শিকার আর দিনের আলোয় শিকারে অনেক তফাত। কেননা, রাত্রিবেলা চুপে-চুপে হরিণের, কিংবা দাঁত দিয়ে কন্দ খুঁড়ে তুলছে এমন শুয়োরের কাছাকাছি যাওয়াটা সোজা হলেও ঠিক করে গুলি চালানো শক্ত। চাঁদের আলোটা একেবারে বন্দুকের মাছিতে পড়ে চকচক করবে, এমনভাবে বন্দুক না ধরলে হবে না। ময়ুরদের মারতে হত ঘুমন্ত অবস্থাতেই।

বলতে লজ্জা নেই যে আমি কখনও-কখনও এ ধরনের হত্যাও করেছি। কেননা, এই দেড় বছরে আমি চাঁদের আলোয় যা শিকার করতে পেরেছি, শুধু সেটুকু মাংসই খেতে পেয়েছি। কৃষ্ণপক্ষে আমাকে বাধ্য হয়ে নিরামিষাশী হতে হয়েছে।

বন কাটার ফলে বনের প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। অনেকগুলি নিরাশ্রয় আর অনাথের ভার আমার উপর এসে পড়ল। তারা সবাই এসে আমার ছোট তাবুটিতে আমার সঙ্গে বাস করতে লাগল।

কয়েকটা করে গৌরতিত্তির আর কালতিত্তিরের বাচ্চা, চারটি ময়ুরছানা, দুটি খরগোশের বাচ্চা, আর দুটি চৌশিঙা হরিণশিশু (যারা মোটে তাদের নলীর মত পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখছে)–এতগুলি প্রার্থীর ভিড় যখন জমে উঠেছে, সেই সময় একটি ময়াল সাপ–তার নাম রেক্স–একদিন এসে তাঁবুতে আড্ডা গাড়ল।

সেদিন আমি রাত হবার একঘণ্টা পরে তাঁবুতে ফিরে এসে চারপেয়ে পুষ্যিগুলিকে দুধ খাওয়াচ্ছি, এমন সময় দেখি যে হরিণছানাদের খড়ের বিছানার উপর রেক্স কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে গুণে দেখি যে তাঁবু থেকে কোনো পুষ্যিই খোয়া যায় নি। কাজেই রেক্সকে তার নির্বাচিত কোণটি ছেড়ে দিলুম। তারপর দু-মাস ধরে রে রোজ-রোজই রোদ পোয়াবার জন্যে তাঁবুর বাইরে যেত, আর সূর্যাস্ত হলেই ফিরে আসত। এই সময়টার মধ্যে সে তাঁবুতে তার প্রতিবেশীদের মধ্যে কারও কোনো ক্ষতি করে নি।

নিরাশ্রয় আর অনাথ জীবগুলিকে তাঁবুতে রেখে প্রতিপালন করে ক্রমে তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে শিখলে তাদের বনে ফিরিয়ে দেওয়া হত। তাদের মধ্যে শুধু একটি চৌশিঙা–তার নাম টিলি-ডি-উইস–আমাকে ছেড়ে যেতে চাইল না।

যখন জ্বালানী কাঠ ট্রেনে তোলা হচ্ছিল তখন আমি সেই কাজটার দেখাশোনা করবার জন্যে তাঁবু তুলে নিয়ে রেল-লাইনের কাছাকাছি চলে গেলুম, সেও আমার সঙ্গে গেল। সেখানে গিয়ে সে তার প্রাণটি হারিয়েছিল আর কি! মানুষের হাতে প্রতিপালিত হওয়ায় তার মনে মানুষের ভয় ছিল না। আমার আসার পরের দিনই সে একজন লোকের কাছে গিয়ে পড়ে। বন্য জীব মনে করে লোকটি তাকে মারতে চেষ্টা করে।

সন্ধ্যেবেলা তাঁবুতে ফিরে দেখি যে সে আমার ক্যাম্পখাটের পাশে পড়ে রয়েছে। তাকে তুলে দেখি যে তার সামনের দু-খানা পা-ই ভেঙে গিয়েছে, ভাঙা হাড়গুলোর মাথা চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আমি তার গলায় একটু-একটু দুধ ঢেলে দিচ্ছি এবং যা করতেই হবে বলে জানি তা করবার জন্যে সাহস সঞ্চয় করছি, এমন সময় আমার চাকরটা একটি লোককে নিয়ে এল।

লোকটি স্বীকার করল যে সে-ই এই বেচারাকে মারতে চেষ্টা করেছিল। শুনলুম যে লোকটি তার খেতে কাজ করছিল, এমন সময় হরিণীটা তার কাছে গিয়ে পড়ে। এটা কাছের বন থেকে ছিটকে এসে পড়েছে, এই মনে করে সে তাকে লাঠির এক বাড়ি মেরে তাকে তাড়া করে। তারপর হরিণীটা আমার তাবুতে ঢুকে পড়লে সে বুঝতে পারে যে ওটা একটা পোয্য প্রাণী।

আমার চাকর তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল যে আমি ফিরে আসবার আগেই সে যেন সরে পড়ে, কিন্তু সে তা করতে চায় নি। তার কথাটা বলে সে বলল যে পরদিন ভোরবেলাই সে তার গ্রাম থেকে একজন হাড়-জোড়া দেবার লোক নিয়ে আসবে। আহত প্রাণীটির জন্যে আমার কিছুই করবার ছিল না। শুধু তাকে একটি নরম বিছানা করে দিলুম, আর ঘন-ঘন তাকে দুধ খাওয়াতে লাগলুম। তারপর, পরদিন ভোর হতেই সেই লোকটি একজন হাড়-জোড়বার লোক নিয়ে এল।

ভারতবর্ষে কাউকে চেহারা দিয়ে বিচার করতে যাওয়াটা বোকামি। এই হাড্ডি-জোড়নেওয়ালাটি ছিল একজন দুর্বল বৃদ্ধ লোক। তার চেহারায় আর ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে দারিদ্র্যের সব চিহ্ন ফুটে উঠেছে। কিন্তু তা হলেও সে একজন গুণী লোক। লোকটি কথা বলে কম।

সে আমাকে আহত জীবটিকে তুলে ধরতে বলে কয়েক মিনিট ধরে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে ঘুরে তাবু থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে বলে গেল যে সে দু-ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবে।

আমি মাসের পর মাস ধরে প্রতিদিন কাজ করে আসছিলুম। তাই ভাবলুম একবেলা ছুটি নিলে অন্যায় হবে না। বুড়ো ফিরে আসবার আগে আমি কাছের জঙ্গল থেকে কয়েকটা খুঁটি কেটে নিয়ে এসে তাঁবুর এক কোণে ছোট খোঁয়াড় তৈরি করলুম। লোকটি যখন ফিরে এল তখন সঙ্গে নিয়ে এল ছাল-ছাড়ানো কয়েকটা পাটের কাঠি, সবুজ রঙের খানিকটা কাই, থালার মত বড়-বড় কয়েকটা রেড়ির পাতা আর এক গুলি সরু পাটের সুতো।

টিডলি-ডি-উইকে আমার হাঁটুর উপর ফেলে আমি আমার ক্যাম্পখাটের কিনারায় বসলুম। তার দেহের ভারের কতকটা তার পিছনের দুই পায়ের উপর, আর কতকটা আমার হাঁটুর উপর রইল। তার সামনে মাটিতে সেই বুড়ো তার সব সরঞ্জাম হাতের কাছে নিয়ে বসল।

সামনের দু-পায়ের হাড়ই হাঁটুর আর ছোট্ট খুরের মাঝামাঝি জায়গায় কেটে গিয়েছিল, আর দু-পায়েরই আলগা অংশ মুচড়ে পাকিয়ে গিয়েছিল। বুড়ো খুব সন্তর্পণে পাকগুলি খুলে হাঁটু থেকে খুর পর্যন্ত সবটাতেই সেই সবুজ রঙের ঘন কাইটা লেপে, সেটাকে ধরে রাখবার জন্যে তার উপর ফালিফালি রেড়ির পাতা বিছিয়ে, পাটের সুতা দিয়ে সেগুলোকে পায়ের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে গেল।

পরদিন সকালবেলা পাঠকাঠি বেঁধে তৈরি-করা বন্ধ ফলক নিয়ে সে ফিরে এল। সেগুলো পায়ে লাগানো হয়ে গেলে টিডলি-ডি-উইঙ্কস্ তার হাঁটু মুড়ে খুর মাটিতে ঠেকাতে পারল। বন্ধ ফলক থেকে খুরদুটি ইঞ্চিখানেক বেরিয়ে ছিল।

হাড় জোড়বার জন্যে পারিশ্রমিক হল এক টাকা, আর ওষুধটার মাল-মসলার এবং সুতোর গুলি বাজারে কিনতে গিয়েছিল দু-আনা। যতদিন না বন্ধ-ফলকগুলো ভোলা হল এবং হরিণশিশুটি আবার লাফিয়ে বেড়াতে পারল, ততদিন ঐ বৃদ্ধ তার পারিশ্রমিকও নেয় নি, আমি কৃতজ্ঞ হয়ে তাকে যে সামান্য উপহার দিতে চাইলুম তাও নেয় নি।

আমার কাজের প্রতিটি দিন আমার ভাল লাগত। সে কাজ এখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। যে-টাকা আমি খরচ করেছিলুম তার হিসেব দিতে আমি সদর-দপ্তরে যাচ্ছিলুম। নতুন চাকরি খুঁজতে হবে, এই ভয়ও ছিল। কেননা সব ইঞ্জিনগুলিকেই কয়লা-পোড়ানো ইঞ্জিনে পরিণত করা হয়ে গিয়েছিল বলে জ্বালানী কাঠের আর দরকার ছিল না।

আমার খাতাপত্র সব একেবারে ঠিকঠাক ছিল, এবং আমি বুঝতে পারছিলুম যে আমি ভালভাবেই কাজটি করেছি, কেননা যে-কাজে দু-বছর লাগবে বলে ধরা হয়েছিল, তা আমি আঠার মাসে শেষ করেছিলুম। তবু যে স্বস্তি পাচ্ছিলুম না, তার কারণ হল তোরঙ্গের ঐ টাকার থলিটা।

আমার গন্তব্য স্থান সমস্তিপুরে পৌঁছলাম সকাল ন-টার সময়। মালপত্র ওয়েটিং-রুমে রেখে আমি খাতাপত্র আর দুশো টাকার থলিটা নিয়ে আমার ডিপার্টমেন্টের কর্তার অফিসে গেলুম। সেখানে একটি জাঁকালো চেহারার দারোয়ান বললে যে তার মনিব ব্যস্ত আছেন, আমাকে বসতে হবে।

খোলা বারান্দাটা তখন তেতে উঠেছে। যতই সময় যেতে লাগল, আমার মন ততই চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। রেলের একজন পুরনোলোক আমাকে খাতাগুলি লিখতে সাহায্য করেছিল। সে বলেছিল যে আমি যদি সীল-করা হিসেব দাখিল করেও স্বীকার করি যে আমার হাতে বাড়তি দুশো টাকা আছে (সেটা স্বীকার করবার ইচ্ছে আমার পুরোপুরিই ছিল), তাহলে আমি ভয়ানক মুশকিলে পড়ে যাব।

শেষে দরজাটা খুলে গেল, এবং অত্যন্ত বিব্রত চেহারার একটি লোক বেরিয়ে এল। দারোয়ান দরজাটা বন্ধ করতে পারার আগেই ঘরের ভিতর থেকে একটা গলা হুঙ্কার দিয়ে আমাকে ভিতরে আসতে বলল। বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের লোকোমোটিভ ডিপার্টমেন্টের কর্তা রাইস্ সাহেবের ওজনখানা ছিল পৌনে তিন মণেরও বেশি, গলার আওয়াজখানা ছিল তাঁর অধীন লোকেদের বুক-কাঁপানো, আর হৃদয়টি ছিল অতি উঁচুদরের।

আমাকে বসতে হুকুম করে, আমার খাতাপত্র টেনে নিয়ে একজন কেরানীকে ডেকে আনিয়ে তিনি যত্ন সহকারে আমার হিসেবের সঙ্গে যে-যে স্টেশনে কাঠ পাঠানো হয়েছিল তাদের হিসেব মিলিয়ে দেখলেন। তারপর তিনি বললেন আমার চাকরি আর থাকবে না বলে তিনি দুঃখিত, আর আজই কিছুক্ষণ বাদে আমাকে ছাঁটাইয়ের হুকুমটা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই ভাবেই তিনি জানালেন যে সাক্ষাৎকারের শেষ হয়েছে। টুপিটা তুলে আমি চলে আসবার উপক্রম করতেই তিনি আমাকে ডেকে বললেন যে টেবিলে রাখা একটা টাকার থলি সঙ্গে নিয়ে যেতে আমি ভুলে গিয়েছি।

টাকার থলিটা রেখে বেশ বেরিয়ে আসতে পারব, এ কথাটা ভাবা আমার একটা বোকামিই হয়েছিল, কিন্তু রাই যখন আমাকে ডাকলেন তখন আমি ঠিক তাই করবার চেষ্টাই করছিলুম।

আমি টেবিলে ফিরে গিয়ে তাকে বললুম যে টাকাটা রেল-কোম্পানিরই টাকা, আর আমার খাতায় ওটাকে কিভাবে দেখাব তা ঠিক করতে না পেরে আমি টাকাটা নিয়ে তার কাছে এসেছি।

রাইল্‌স্‌ বললেন, আপনার খাতা-পত্ৰ তত মিল করা আছে। যদি সেগুলো জাল না হয়, তাহলে এর মানে কি, তা আমি জানতে চাই?

হেডক্লার্ক তেওয়ারি এক ট্রে-ভরতি কাগজপত্র নিয়ে ঘরে এসে পড়েছিলেন। আমি যখন রাইকে নিম্নলিখিত কৈফিয়ত দিচ্ছিলুম, তখন তিনি রাইসের চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে তার সহানুভূতি-ভরা চোখদুটি দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করতে লাগলেন।

আমার কাজ যখন শেষ হয়ে আসছিল তখন এক রাত্রিতে পনের জন গাড়োয়ান আমার কাছে এল। তারা বন থেকে কাঠ নিয়ে রেল-লাইনের কাছে পৌঁছে দেবার কাজ করছিল। তারা বলল যে ফসল কাটবার জন্যে এক্ষুনি তাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে বলে জোর তাগাদা এসেছে। তাদের গাড়িতে করে নেওয়া কাঠ নানা জায়গায় ছড়ানো ছিল, সে-সব গাদা করে মাপ নিতে কয়েকটা দিন কেটে যাবে। তাই তারা আমাকে তাদের পাওনার মোটামুটি হিসেব করে দিতে বলল, কেননা সেই রাত্রেই তাদের রওনা হয়ে যাওয়াটা একান্ত দরকার।

রাত ছিল অন্ধকার। আমার পক্ষে কাঠের মাপ হিসেব করা তখন নিতান্তই অসম্ভব। তাই বললুম যে আমি তাদের দেওয়া হিসাবই মেনে নেব। দু-ঘন্টার মধ্যে তারা ফিরে এল। টাকা দেবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাত্রির অন্ধকারে তাদের গাড়ি চলে যাবার কাঁচ-কোঁচ শব্দ শুনতে পেলুম। আমার কাছে তারা তাদের ঠিকানা রেখে যায় নি। কয়েক সপ্তাহ বাদে কাঠগুলো গাদা করে সাজিয়ে মেপে দেখা গেল যে তাদের পাওনার হিসেব দুশো টাকা কম ধরে ছিল।

কাহিনীটা বলা হয়ে গেলে রাইস আমাকে জানালেন যে রেলের এজেন্ট আইজাট সাহেব পরদিনই সমস্তিপুরে আসবেন বলে আশা আছে। তার উপরেই রাইলস্ আমার ব্যাপারটা ছেড়ে দেবেন।

ভারতের সবচেয়ে উন্নতিশীল তিনটি রেলপথের সর্বময় কর্তা আইজাট পরদিন সকালবেলা এসে পৌঁছলেন। দুপুরবেলা রাইসের অফিসে আমার ডাক পড়ল।

আমি যখন ঘরে ঢুকলুম তখন আইজাট একাই সেখানে বসে ছিলেন। ছোটখাট ফিটফাট মানুষটি, দুই চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। নির্দিষ্ট সময়ের ছ-মাস আগেই কাজ শেষ করেছি বলে প্রথমেই আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি আমাকে বললেন যে রাইলস্ তাকে আমার খাতা-পত্র দেখিয়ে একটা খবর দিয়েছেন। তিনি শুধু একটি কথা জানতে চান: কেন আমি ঐ দুশো টাকা আত্মসাৎ করে এ কথাটা চেপে যায় নি? তার উত্তরে যা বললুম তা বোধহয় তার কাছে সন্তোষজনক হয়েছিল।

সেইদিনই সন্ধেবেলা যখন আমি স্টেশনে বসে অনিশ্চয়তার মধ্যে দোল খাচ্ছি, তখন আমি দুখানা চিঠি পেলুম। একখানাতে ‘রেলকর্মিগণের বিধবা ও অনাথ শিশুদের ভাণ্ডার’-এ আমি দুশো টাকা দান করেছি বলে তেওয়ারিজী ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কেননা তিনিই সেই ভাণ্ডারের অবৈতনিক সম্পাদক। অপর চিঠিখানা লিখেছেন আইজাট। তাতে তিনি জানিয়েছেন যে আমাকে চাকরিতে রাখা হল, আমি যেন কাজের নির্দেশের জন্যে রাইসের কাছে হাজির হই।

এরপর একটি বছর ধরে ঐ রেলপথের এদিকে-ওদিকে নানা ধরনের কাজে ঘুরে বেড়ালুম। কখনও বা কয়লার খরচ সম্বন্ধে এত্তেলা দেওয়ার জন্যে ইঞ্জিনের পাদানিতে চেপে ঘুরেছি–সে কাজটা আমার পছন্দ ছিল, কেননা তখন আমাকে ইঞ্জিন চালাতে দেওয়া হত। কখনও বা মালগাড়ির গার্ডগিরি করেছি–সেটা একটা বিরক্তিকর কাজ, কেননা তখন কর্মচারীদের সংখ্যা কম ছিল বলে এক-একবার আমাকে এক নাগাড়ে আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেও হয়েছে। আবার কখনও বা সহকারী স্টোর-কীপার অথবা সহকারী স্টেশন-মাস্টারের কাজও করেছি।

তারপর একদিন হুকুম এল যে আমি যেন মোকামা ঘাটে ফেরিসুপারিন্টেন্টে স্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। বেঙ্গল অ্যাণ্ড নর্থওয়েস্টার্ন রেলওয়েটি গঙ্গা থেকে কম-বেশি দূরে-দূরে গাঙ্গেয়-উপত্যকার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে। তার কয়েক জায়গায় মূল রেলপথ থেকে শাখা-রেলপথ বেরিয়ে গঙ্গা-তীর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সেখান থেকে ফেরি-স্টীমার দিয়ে অপর পারের বড় লাইনের রেলপথগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গঙ্গার ডান পারে মোকামা ঘাট হচ্ছে এই সংযোগগুলির মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

সকালবেলাই আমি সমস্তিপুর থেকে রওনা হয়ে শাখা-লাইনের প্রান্তে সামারিয়া ঘাটে এসে গোরখপুর স্টীমারে চড়লুম। আমার আসার কথা স্টরারকে আগেই জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাকেও আর কিছু বলা হয় নি, আমিও জানতুম না আমাকে কেন মোকামা ঘাটে আসতে বলা হয়েছে। তাই দিনের খানিকটা তার বাড়িতে কাটানো গেল, আর বাকিটা কাটল বিরাট-বিরাট মাল-গুদামগুলি ঘুরে দেখে-দেখে।

দেখলুম যে সেগুলিতে মালের বড় গাদাগাদি। দু-দিন বাদে আমাকে গোরখপুরে ডাকা হল। সেটাই ঐ রেলপথের সদর-দপ্তর। সেখানে জানতে পেলুম যে আমাকে মোকামা ঘাটে ট্রেন আর স্টীমার থেকে মাল নামিয়ে, তা স্টীমারে আর ট্রেনে তুলে দেবার কাজ দেখাশোনা করতে হবে। আবার মাইনেও বাড়িয়ে একশো থেকে দেড়শো টাকা করে দেওয়া হল। তাছাড়া, এক সপ্তাহ বাদেই আমাকে মাল চালাচালি করবার ঠিকে নিতে হবে।

কাজেই ফিরে আবার মোকামা ঘাটেই এলুম। এবার এসে পৌঁছলুম রাত্রিবেলা। এমন কাজ নিতে হবে যার আমি কিছুই জানি না, এমন ঠিকাদারি করতে হবে যার জন্যে তোক পাব কি না তাও জানি না। আর, সবচাইতে গুরুতর কথা এই যে, আমার পুঁজি মোটে দেড়শোটি টাকা–যা আমি আড়াই বছর চাকরি করে জমিয়েছিলুম।

স্টার এবার আমার আসবার আশায় ছিলেন না, কিন্তু তিনি আমাকে খেতে দিলেন। কেন ফিরে এসেছি সে কথা তাকে বললুম। নদী থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে বারান্দায় বইছিল। সেখানে চেয়ার নিয়ে গিয়ে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলুম।

স্টরারের বয়স আমার দ্বিগুণ, আর তিনি মোকামায় ছিলেনও কয়েক বছর। ছোট-লাইন-বিশিষ্ট বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ-ওয়েস্টার্ন রেলপথে যত দূরপাল্লার যাত্রী ও মাল চলাচল করে, তার শতকরা আশি ভাগই মোকামা ঘাট যায়। প্রতি বৎসর মার্চ থেকে রেল-কোম্পানির গুরুতর ক্ষতি হয়।

মোকামা ঘাটে দুই রেলপথের মাপের তফাতের জন্যে এক রেলপথের মাল নামিয়ে অন্যটাতে তুলে দিতে হত। যে কোম্পানি এ-কাজটা করত সেই কোম্পানিই বড়-লাইনের আগাগোড়া সমস্ত মাল তোলাইয়ের কাজের ঠিকাদার ছিল।

স্টরারের মতে প্রতি বছর মাল জমে যাবার কারণ হল দুটো : মিটারগেজ রেলপথের স্বার্থ সম্বন্ধে এই কোম্পানির উদাসীনতা, এবং গাঙ্গেয়-উপত্যকায় ফসল কাটবার সময়ে অন্য কাজের জন্যে মজুরের অভাব হওয়া। এই খবরটি আমাকে দিয়ে তিনি অতি সমীচীনভাবেই আমাকে জিগ্যেস করলেন যে, কোম্পানি তাদের প্রচুর সংগতি সত্ত্বেও যে-কাজ করতে পারে নি, আমি এ অঞ্চলে একেবারে নতুন লোক হয়ে এবং বিনা সম্বলে কি করে সে-কাজ করব বলে ঠিক করেছি?

আমার কষ্টার্জিত সঞ্চয়টুকুর কথা তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই নিলেন না। তিনি এও বললেন যে মোকামা ঘাটের মালগুদামগুলো ছাদ পর্যন্ত মালে ঠাসা হয়ে রয়েছে, স্টেশন-ইয়ার্ডে চারশো মালগাড়ি খালাস হবার জন্যে পড়ে রয়েছে, এবং নদীর ওপারে আরও হাজারখানা অপেক্ষা করে রয়েছে কবে তাদের এপারে নিয়ে আসা হবে।

তিনি এই বলে উপসংহার করলেন, আপনাকে আমার উপদেশ এই যে, ভোরের স্টীমার ধরে সামারিয়া ঘাট হয়ে সোজা গোরখপুর ফিরে গিয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে বলুন যে এই মাল-চালাচালির কাজের মধ্যে আপনি নেই।

পরদিন আমি ভোরেই উঠলুম। কিন্তু সামারিয়া ঘাটের স্টীমার না ধরে আমি গুদামগুলি আর স্টেশন-ইয়ার্ডটা দেখতে গেলুম। স্টরার অতিরঞ্জন করেন নি। বলতে গেলে তিনি যা বলেছিলেন, অবস্থা আসলে তার চাইতেও খারাপ। কেননা চারশো মিটারগেজ ছোট লাইনের মালগাড়ি ছাড়া আরও শ-চারেক ব্রডগেজ (বড় লাইনের) মালগাড়িও খালাস হবার অপেক্ষায় ছিল। আন্দাজ করলুম যে পনের হাজার টন মাল মোকামা ঘাটে পড়ে রয়েছে, আর এই বিপুল বিশৃঙ্খলার ব্যবস্থা করতে পাঠানো হয়েছে আমাকে।

আমার তখন বয়স পুরো একুশও হয় নি, আর গ্রীষ্মকালও এসে পড়ছিল, যে সময়টা সবাই একটু-আধটু খেপে যায়। যতক্ষণে রামশরণজীর সঙ্গে দেখা হল, ততক্ষণে আমি ঠিক করে ফেলেছি যে, ফল যাই হক এ কাজ আমি নেব।

রামশরণ ছিলেন মোকামা ঘাটের স্টেশন মাস্টার। সেই পদে তিনি তখন দু-বছর যাবৎ আছেন। তিনি আমার চাইতে কুড়ি বছরের বড় এবং পাঁচটি সন্তানের পিতা। তাঁর প্রকাণ্ড মিশকালো এক দাড়ি ছিল। আমার আসার কথা তাকে টেলিগ্রামে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি জানতেন না যে মাল-চালাচালি করবার ঠিকাটা আমি নেব। আমি তাকে এই খবরটা দিতে তার মুখখানা হাসিতে ভরে গেল।

তিনি বললেন, ‘ভালই হল, স্যার, খুব ভাল হল। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব। ওই ‘আমরা’ শব্দটি শুনে আমি তাকে ভালবেসে ফেললুম। চৌত্রিশ বছর ধরে, তার মৃত্যু পর্যন্ত এই ভালবাসা অটুট ছিল।

সেদিন ছোটহাজরি খেতে খেতে আমি স্টরারকে বললুম যে, আমি ঠিকাদারিটা নেওয়াই ঠিক করেছি। তিনি বললেন যে মূর্খরা কখনও ভাল কথা নেয় না। কিন্তু তিনি এ-ও বললেন যে তিনি যতদূর সাধ্য আমাকে সাহায্য করবেন। এ প্রতিজ্ঞা তিনি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছিলেন। এর পর কয়েক মাস ধরে তিনি আমাকে মালগাড়ি যোগান দেবার জন্যে দিনরাত তার খেয়া (ফেরি) চালু রেখেছিলেন।

গোরখপুর থেকে আসতে দুটো দিন লেগে গিয়েছিল। কাজেই, যখন মোকামা ঘাটে এলুম তখন আমার কাজ বুঝে নিতে আর ঠিকাদারিটা নেবার সব ব্যবস্থা করতে হবে আর পাঁচটি দিনের মধ্যে।

প্রথম দু-দিন কাটল আমার কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হতে। তাদের মধ্যে রামশরণ ছাড়া একজন চমৎকার বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার। তার নাম চ্যাটার্জি বয়সে আমার ঠাকুরদা হবার যোগ্য। এ ছাড়া পঁয়ষট্টি জন কেরানী, আর শান্টার, পয়েন্টসম্যান এবং পাহারাওয়ালা মিলিয়ে শ-খানেক।

আমার কার্যক্ষেত্রটি নদীর উপরে সামারিয়া ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেখানেই কেরানীতে আর অন্য সবে মিলিয়ে পুরো শ-খানেক লোক থাকত। এই দু-জায়গায় কর্মচারীদের দেখাশোনা করা ও চলাচলের সময় মালের তদারক করাই এক ভয়ঙ্কর কাজ, তার উপর আবার এসে পড়েছিল আর একটা দায়িত্ব-মোকামা ঘাট দিয়ে প্রতি বছর যে পাঁচ লক্ষ টন মাল-চলাচল করে, তা নিঝঞ্ঝাটে যাবার ব্যবস্থা করবার জন্যে যথেষ্ট-সংখ্যক মজুরের যোগান দেওয়া।

কোম্পানির লোকেরা কাজ হিসেবে মজুরি পেত। মোকামা ঘাটে সব কাজ বন্ধ হয়ে ছিল বলে শ-কয়েক ক্ষুব্ধ লোক গুদামগুলোর এদিক-ওদিকে বসে থাকত। ছোট লাইনের রেলপথের হয়ে আমি মাল-চালাচালির কাজটা করব শুনে তারা অনেকে আমার কাছে কাজ করতে চাইল।

কোম্পানির পুরনো মজুরদের নিযুক্ত করব না বলে কোনো চুক্তি না থাকলেও আমি সেটা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভাবলুম। কিন্তু তাদের আত্মীয়দের কেন নিযুক্ত করব না তার কোনো কারণ পেলুম না বলে যে তিনটি দিন হাতে ছিল তার প্রথম দিনটিতেই আমি বারজন লোক ঠিক করে নিয়ে তাদের সর্দার নিযুক্ত করলুম। এদের মধ্যে এগার জন প্রত্যেকে দশ জন করে মজুর এনে দেবে বলে কথা দিল।

গোড়ার দিকে এরাই মাল-তোলাইয়ের কাজটা করবে। বাকি এক জন কয়লা বইবার জন্যে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে ষাটজন লোক দেবার ভার নিল। যে-সব মাল নিয়ে কাজ তার মধ্যে নানা ধরনের দ্রব্য থাকত বলে ভিন্ন-ভিন্ন দ্রব্যের জন্যে নানা জাতের লোক নিযুক্ত করতে হল। তাই বারজন সর্দারের মধ্যে আটজন হল হিন্দু, দু-জন মুসলমান এবং বাকি দু-জন অনুন্নত জাতের। বারজনের মধ্যে এক জনেরই মাত্র অক্ষর পরিচয় ছিল বলে আমি তাদের হিসেব লেখবার জন্যে একজন হিন্দু আর একজন মুসলমান কেরানী নিযুক্ত করলুম।

যখন এক কোম্পানীই দুই রেলপথের কাজ করছিল তখন মাল-চালাচালি হত ওয়াগন থেকে ওয়াগনে। এখন থেকে প্রত্যেক রেলপথকেই নিজের মাল খালাস করে গুদামে রাখতে হত, তারপর আবার গুদাম থেকে ওয়াগনে বোঝাই দিতে হত।

ভারি যন্ত্রপাতি আর কয়লা ছাড়া সব শ্রেণীর মালের জন্যই আমি প্রতি হাজার মণ মাল নামাবার কিংবা ওঠাবার জন্যে এক টাকা সাত আনা হিসেবে পেতুম। ভারি যন্ত্রপাতি আর কয়লা শুধু একদিকেই যেত। এই দুটি জিনিসকে সরাসরি ওয়াগন থেকে ওয়াগনে নিতে হত বলে শুধু একজন ঠিকাদারকে এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করা হত। আমাকেই এ কাজটা দেওয়া হল। তার জন্যে পেতুম প্রতি হাজার মণ খালাস কিংবা বোঝাইয়ের জন্যে এক টাকা চার আনা হিসেবে। আশি পাউণ্ডে এক মণ হয়, কাজেই হাজার মণে হয় ৩৫ টনেরও বেশি। এই নিরিখ অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু দুই রেলপথের নথিপত্র দেখে এ কথার সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

শেষদিন সন্ধ্যেবেলা নাম ডেকে জানা গেল যে আমার এগার জন সর্দার আছে, যাদের প্রত্যেকের দশ জন করে মজুর আছে। এবং অন্য একটি সর্দারের অধীনে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে আছে ষাট জন। এদের, আর দু-জন কেরানীকে নিয়েই আমার বাহিনী সম্পূর্ণ হল। পরদিন ভোর হতেই আমি গোরখপুরে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলুম যে আমি ট্র্যানশিপমেন্ট-ইনপেক্টর হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছি এবং মাল-তোলাইয়ের কাজের ঠিকাদারিও নিয়েছি।

বড় লাইনে রামশরণের সমপদস্থ ছিলেন টম কেলি নামে একজন আইরিশ-ম্যান। তার তখন মোকামা ঘাটে কয়েক বছর থাকা হয়ে গিয়েছে। আমি কাজটা পারব বলে তার কিছুমাত্র ভরসা ছিল না। তবু তিনি উদারভাবে আমাকে যথাসাধ্য সবরকমে সাহায্য করতে চাইলেন।

মালে গুদাম সব ঠাসা-বোঝাই, ওদিকে প্রতি রেলওয়ের চারপোখানা করে ওয়াগন খালাস হবার জন্যে বসে আছে–এ অবস্তায় গুদামে জায়গা খালি করে মাল চলাচল ব্যবস্থা করতে হলে গুরুতর কিছু একটা করতেই হয়। তাই কেলির সঙ্গে ব্যবস্থা করলুম যে ঝুঁকি নিয়ে গুদামের বাইরে খোলা জায়গায় এক হাজার মণ গম মাটিতে নামিয়ে রাখব। খালি-করা ওয়াগনগুলোকে সরিয়ে দিয়ে গুদামে খানিকটা জায়গা করে দিলে কেলি সেখানে হাজার মণ লবণ আর চিনি খালাস করে দেবেন। তখন খালি ওয়াগনগুলো সরিয়ে নিয়ে কেলি আমার জন্যে গুদামে খানিক জায়গা করে দেবেন।

এই বুদ্ধিতে চমৎকার কাজ হল। হাজার মণ গম খোলাভাবে পড়ে থাকার সময় আমার সৌভাগ্যক্রমে বৃষ্টি হল না। দশদিনের মধ্যে আমরা গুদামে জমে থাকা মাল তো সাফ করে ফেললুমই, ওয়াগনের ভিড়ও পরিষ্কার করে ফেললুম। তারপর কেলি আর আমি পরস্পরের সদর দপ্তরে খবর দিয়ে দিলুম যে মালের বুকিং আবার শুরু করা চলতে পারে। পনেরো দিন যাবৎ মালের বুকিং বন্ধ ছিল।

গ্রীষ্মকালের গোড়ার দিকে আমি ঠিকাদারিটা নিই। ভারতের রেলপথগুলিতে মাল-চলাচল এই সময়টাতেই সবচাইতে বেশি হয়। বুকিং খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ-ওয়েস্টার্ণ রেলওয়ে থেকে এবং বড় লাইন থেকে অবিরাম মাল এসে পড়তে লাগল মোকামা ঘাটে।

যে-হারে আমাকে ঠিকা দেওয়া হয়েছিল, ভারতে সেটা ছিল নিম্নতম হার। আমার মজুরদের ঠিক রাখতে হলে তাদের সংখ্যা যতদূর সম্ভব কম রাখতে হবে, আর তাদের দিয়ে কঠিন পরিশ্রম করাতে হবে। তাহলেই এরা এ ধরনের কাজে অন্য মজুররা যা পায়, তার সমান কিংবা হয়তো একটু বেশিও পেতে পারে। মোকামা ঘাটে সব মজুরিই দেওয়া হত কাজের পরিমাণ অনুসারে। প্রথম সপ্তাহের শেষে আমার লোকরা আর আমি মহা আনন্দিত হয়ে দেখলুম যে অন্তত কাগজে-পত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কোম্পানির লোকরা যা পেত, এরা তার দেড়গুণ করে রোজগার করছে।

আমাকে ঠিকাদারি দেবার সময় কথা হয়েছিল যে আমাকে রেল-কোম্পানি হপ্তায় হপ্তায় টাকা দেবে, তাই আমিও মজুরদের সেইভাবে টাকা দেব বলে কথা দিয়েছিলুম। কিন্তু কথা দেবার সময় রেল কোম্পানির খেয়াল ছিল না যে ঠিকাদার বদল হবার দরুন তাদের হিসেব-পরীক্ষা বিভাগে যে-সব জটিলতার সৃষ্টি হবে, তা কাটতে অনেক সময় লাগবে।

রেল-কোম্পানির কাছে এটা তুচ্ছ ব্যাপার, কিন্তু আমার পক্ষে মোটেই তা নয়। মোকামা ঘাটে যখন আসি, তখন আমার মোট পুঁজি ছিল দেড়শোটি টাকা। দুনিয়ায় এমন কেউ ছিল না যার কাছে ধার চাইতে পারি। কাজেই, রেল-কোম্পানি আমাকে টাকা না দিলে, আমিও আমার লোকদের টাকা দিতে পারব না।

এই কাহিনীর নাম দিয়েছি ‘আনুগত্য। মোকামা ঘাটে প্রথম তিন মাসে শুধু আমার মজুরদের থেকে নয়, রেল কর্মচারীদের থেকেও যে-পরিমাণ আনুগত্য পেয়েছিলাম, আমার মনে হয় না যে কখনও তার চাইতে বেশি পাওয়া সম্ভব। মানুষ কখনও এর চাইতে বেশি খেটেছে বলেও আমার মনে হয় না।

সপ্তাহের সাতটা দিনই কাজ শুরু হত ভোর চারটের সময়, আর একটানা চলত রাত আটটা পর্যন্ত। মাল পরীক্ষা করা আর মিলিয়ে দেখার ভার যে কেরানীদের উপরে ছিল তারা বিভিন্ন সময়ে খেতে যেত, যাতে কাজ কখনও থেমে না থাকে। মজুরদের খাবার তাদের বাড়ির স্ত্রীলোকেরা নিয়ে আসত, তারা গুদামে বসেই তা খেয়ে নিত।

সেকালে না ছিল ট্রেড ইউনিয়ন, না ছিল ‘দাসত্ব’, না ছিল ‘দাসদের নির্যাতন। প্রত্যেকেরই ইচ্ছামত যতটুকু কিংবা যত বেশি কাজ করবার স্বাধীনতা ছিল প্রত্যেকই সুখে এবং সানন্দে সে কাজ করত। কেননা, যে-প্রেরণা না থাকলে লোকে ভাল করে কাজ করতে পারে না, তা তাদের থাকতই–তা সেটা পরিবারের জন্যে একটু ভাল খাওয়া আর কাপড় জোটানোই হক, অথবা অকেজো বলদটার বদলে একটা নতুন বলদ কেনাই হক, কিংবা দেনা-শোধই হক।

লোকজনের কাজ থামলেও রামশরণের আর আমার কাজ শেষ হত না। কেননা চিঠিপত্র দেখতে আর লিখতে হত, এবং পরের দিনের কাজের ছক আর ব্যবস্থা করে রাখতে হত। প্রথম তিন মাসে আমরা কেউই রাত্রে চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতে পাই নি। আমার বয়স ছিল একুশ, আর আমি ছিলাম লোহার মত শক্ত। কিন্তু রামশরণ ছিলেন আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়, এবং কমজোরী। তিন মাসে ভঁর সাত সের ওজন কমে গেল, কিন্তু তার স্ফুর্তি কমল না একটুও।

টাকার অভাবের জন্যে সর্বদাই উদ্বেগ ভোগ করতুম। শেষে যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যেতে লাগল, সেই উদ্বেগটা তখন একটানা একটা বীভৎস বিভীষিকায় পরিণত হল।

প্রথমে সর্দাররা, তারপর মজুরেরা তাদের সস্তাদামে আর দেখলে দয়া হয় এমন গয়না একে একে বাঁধা দিল। তারপর তাদের ধার পাওয়াও বন্ধ হল।

ব্যাপারটাকে আরও খারাপ করে তুলল আগেকার কোম্পানির লোকরা। তাদের চাইতে আমার লোকরা বেশি রোজগার করছে বলে তারা হিংসেয় জ্বলছিল। এখন তারা আমার লোকেদের ঠাট্টা করতে লাগল। কয়েকবার খুব অল্পের জন্যেই বিশ্রী ঘটনা হতে-হতে বেঁচে গেল। কেননা, প্রায় না খেয়ে থেকেও আমার লোকরা আনুগত্য হারায় নি। কেউ-কেউ যদি বা এমন একটু সামান্য ইঙ্গিতও করত যে আমি তাদের বোকা বুঝিয়ে আমার কাজে লাগিয়ে দিয়েছি এবং তারা কখনও তাদের রোজগারের একটি পয়সারও মুখ দেখতে পাবে না, তাহলে তারা তার সঙ্গে মারামারি করতে প্রস্তুত ছিল।

সে বছর বর্ষা আসতে দেরি হচ্ছিল। অদৃশ্য কোনো হাপর থেকে হাওয়া পেয়েই বোধহয় আকাশের লাল গোলাটা প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সুদীর্ঘ এক ক্লান্তিকর দিনের শেষে সামারিয়া ঘাট থেকে এক টেলিগ্রাম এল যে একখানা ইঞ্জিন উলটে গিয়েছে। গঙ্গা পার হয়ে মোকামা ঘাটে ওয়াগন নিয়ে আসে যে-সব বড় নৌকো, সেগুলিতে যোগান আসে যে-লাইন দিয়ে সেই লাইনেই এই কাণ্ড হয়েছে।

একখানা লঞ্চ আমাকে ও-পারে নিয়ে গেল। তারপর তিন ঘণ্টার মধ্যে দু-বার, হ্যান্ড-জ্যাকের সাহায্যে ইঞ্জিনখানাকে লাইনে ভোলা হল, দু-বারই সেটা পড়ে গেল। যতক্ষণ না হাওয়া কমল এবং কাঠের স্লীপারগুলোর তলায় গুঁড়ো গুঁড়ো বালি ঠেসে দেওয়া হল, ততক্ষণ ইঞ্জিনখানাকেও আর একবারও বসানো যায় নি, লাইনটাকেও চালু করা যায় নি।

শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে আর বালি আর হাওয়া লেগে চোখদুটো লাল হয়ে আর ফুলে উঠেছে এমন অবস্থায় আমি ফিরে এসে আমার সেদিনকার প্রথম খাওয়া খেতে বসেছি, অমনি আমার বার জন সর্দার লাইন করে ঘরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু আমার চাকর আমার সামনে একখানা প্লেট রাখছে দেখে তারা ভারতীয়দের সহজাত ভদ্রতা দেখিয়ে আবার লাইন করে বেরিয়ে গেল। তারপর আমি আমার বড়হাজরি খেতে-খেতে শুনতে পেলুম যে বারান্দায় এইরকম একটা কথাবার্তা চলছে :

একজন সর্দার–সাহেবের সামনে যে প্লেটটা রাখলে তাতে কী ছিল?

আমার চাকর–একখানা চাপাটি আর একটু ডাল।

একজন সর্দার–শুধু একখানা চাপাটি আর একটু ডাল কেন?

আমার চাকর–আর বেশি কেনবার পয়সা নেই বলে।

একজন সর্দার–সাহেব আর কী খেয়েছেন?

আমার চাকর–কিচ্ছু না।

খানিকক্ষণ সব চুপ। তারপর একজন সর্দারের গলা শোনা গেল। সে সকলের চেয়ে বয়সে বড়, জাতে মুসলমান। তার মস্ত দাড়ি হেনায় রঙানো। সে বললে : ‘বাড়ি যাও। আমি রইলুম, সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।

চাকর খালি প্লেটখানা সরিয়ে নিয়ে গেলে বুড়ো সর্দারটি ঘরে আসবার অনুমতি চাইল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে বললে : “আমরা বলতে এসেছিলুম যে আমাদের পেট অনেকদিন ধরে খালি রয়েছে, কালকের পর আর কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু এই রাত্রেই দেখলুম যে আপনার দশাও আমাদের মতই খারাপ। আমরা তাহলে যতক্ষণ পড়ে না-যাই ততক্ষণ কাজ করে যাব। সাহেব, আমি তাহলে এখন আপনার অনুমতি হলে বিদায় হচ্ছি। আল্লার দোহাই, আমাদের জন্যে আপনি একটা কিছু করুন।”

কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন আমি গোরখপুরে সদরদপ্তরে টাকার জন্যে আবেদন পাঠাচ্ছিলুম। তাতে এইটুকু মাত্র জবাব বের করতে পেরেছিলাম যে আমার বিলগুলির টাকা শিগগিরই দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে।

দাড়িওয়ালা সর্দারটি চলে যাবার পর আমি হেঁটে টেলিগ্রাফ আপিসে গেলুম। আমার সারাদিনের কাজ সম্বন্ধে প্রতি রাত্রিতে যে রিপোর্ট দিতুম, তার-বাবুটি তখন সেটা তার করছিল। তার টেবিল থেকে একখানা ফরম নিয়ে তাকে বললুম, গোরখপুরে একটি জরুরি খবর দেবার জন্যে লাইন পরিষ্কার করতে হবে।

তখন মাঝরাত্রি পার হয়ে কয়েক মিনিট হয়েছে। এই বলে তার করলুম : ‘ভোরের গাড়িতে বার হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে, এ-কথা আগে না-জানানো হলে, কাল ঠিক দুপুরবেলা মোকামা ঘাটে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।’

তারটা পড়ে তার-বাবুটি আমার দিকে মুখ তুলে বললে, আমার যে-ভাই এখন ওখানে ডিউটিতে আছে, আপনি অনুমতি দিলে আমি তাকে বলতে পারি যে, সে যেন সকালবেলা অফিস খোলা পর্যন্ত দেরি না করে এখনই টেলিগ্রামখানা দিয়ে দেয়।

এর দশ ঘণ্টা বাদে, যখন আমার চরম দাবির মেয়াদের আর দু-ঘন্টা বাকি, তখন দেখি যে ফিকে হলুদ রঙের একখানা খাম নিয়ে একজন তার-পিয়ন আমার দিকে হনহন করে আসছে। সে মজুরদের যে-দলেরই পাশ দিয়ে আসে, তারাই কাজ ফেলে তার পিছনে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে, কেননা রাত দুপুরে যে তার পাঠিয়েছিলুম তার মর্ম সবাই জানে।

পিয়নটি আমার আপিসের বেয়ারার ছেলে। আমার টেলিগ্রাম পড়া হয়ে গেলে সে জিগ্যেস করল খবর ভাল কি না। খবর ভাল, একথা আমি বলতেই সে তীরবেগে ছুটল। আর গুদামগুলির পাশ দিয়ে তার যাবার সঙ্গে-সঙ্গে আনন্দের কোলাহল উঠতে লাগল। পরদিন সকালের আগে টাকা এসে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু সুদীর্ঘ মাসের পর মাস যারা অপেক্ষা করেছে, এই কয়েক ঘণ্টায় কি আর এসে যাবে!,

পরদিন এক বখশী আমার আপিসে এসে দেখা দিলেন। তার সঙ্গে আমারই কয়েকজন লোক বাঁশে ঝুলিয়ে আর দু-জন পুলিসের পাহারায় একটি টাকার সিন্দুক নিয়ে এল।

লোকটি হিন্দু, খুব ফুর্তিবাজ। তাঁর দেহটি যতখানি লম্বা, ততখানিই চওড়া, আর তা থেকে ঘাম আর মজাদার কথা সমান তালে বেরুচ্ছে। লাল ফিতে দিয়ে তার কপালে একজোড়া চশমা বাঁধা নেই–এমন অবস্থায় আমি তাকে কখনও দেখি নি।

আমার আপিসের মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে তিনি গলায় পরানো একটি সুতোয় টান দিয়ে দেহের কোনো গভীর অংশ থেকে একটি চাবি তুলে আনলেন। তা দিয়ে টাকার সিন্দুকটি খোলা হল। তিনি তার ভিতর থেকে বারোটি থলি তুলে বাইরে আনলেন, তার প্রতিটিতে আনকোরা নতুন এক হাজারটি টাকা।

একখানা টিকিট কেটে তিনি আমার দেওয়া রসিদটিতে সেটা এঁটে দিলেন। তারপর, দুটি খরগোশ আরামে থাকতে পারে এমন একটি পকেটে হাত ডুবিয়ে তিনি একখানা খাম তুলে আনলেন। তাতে আমার তিনমাসের বাকি মাইনে বাবদ সাড়ে চারশো টাকার নোট ছিল।

যখন বারজন সর্দারের প্রত্যেকের হাতে এক হাজার টাকার এক একটি তোড়া দিলুম, তখন যা আনন্দ পেলুম, টাকা দিয়ে এত আনন্দ আর কেউ কখনও পেয়েছে বলে মনে হয় না। আর এও মনে হয় যে টাকা পেয়ে তাদের মত আনন্দও কেউ কখনও পায় নি। যে-উৎকণ্ঠা প্রায় অসহনীয় হয়ে উঠেছিল, মোটা লোকটির আবির্ভাবে তা কেটে গেল।

এমন একটা উপলক্ষে কিছু একটা করা উচিত। তাই বাকি দিনটা ছুটি বলে ঘোষণা করা হল। পঁচানব্বই দিনের মধ্যে আমার লোকরা আর আমি এই প্রথম ছুটি উপভোগ করলুম। অন্যরা যে কি আরামে ছুটির কয়েক ঘন্টা কাটাল, তা আমি জানি না। আমার বলতে লজ্জা নেই, গভীর আর শান্তিপূর্ণ নিদ্রায় তা কাটিয়ে দিলুম। একুশ বছর ধরে আমার লোকরা আর আমি মোকামা ঘাটে এই ঠিকাদারি করেছিলুম। এই সারা সময়টার মধ্যে–এমনকি, ১৯১৪-১৮ সালের প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আমি যখন এখানে অনুপস্থিত থেকে ফ্রান্সে এবং ওয়াজিরিস্থানে ছিলুম, তখনও–বেঙ্গল অ্যাণ্ড নর্থ-ওয়েস্টার্ন রেলপথের প্রধান নির্গমস্থল মোকামা ঘাটের মধ্য দিয়ে মালের প্রবাহ অবাধে চলেছিল। যখন আমরা ঠিকাদারিটা নিই তখন মোকামা ঘাট দিয়ে চার থেকে পাঁচ লক্ষ টন যেত, আর যখন আমি কাজটা রামশরণজীকে ছেড়ে দিয়ে আসি তখন মাল চলাচল বেড়ে দশ লক্ষ টনে দাঁড়িয়েছিল।