প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

০৭. ভারতের রবিন হুড : সুলতানা

৭. ভারতের রবিন হুড : সুলতানা

বিশাল এই ভারতবর্ষে বিপুল-বিপুল বনাঞ্চল আছে, যাতায়াতের ও যোগাযোগের সুব্যবস্থা নেই, আর অগণিত মানুষ চিরকাল খাওয়া না-খাওয়ার মাঝখানে থেকে জীবন কাটায়।

এমন দেশে যে মানুষ অপরাধ করে জীবিকা নির্বাহ করতে প্রলুব্ধ হবে, আর গভর্নমেন্টও তাদের ধরতে বেগ পাবে, এ কথা বোঝা, শক্ত নয়। সব দেশেই সাধারণত যে-সব অপরাধী দেখা যায়, তাদের বাইরেও ভারতে এক-একটা গোটা জাতকেই অপরাধপ্রবণ জাত বলে চিহ্নিত করে সরকারের দেওয়া কোনো জায়গায় তাদের বসতি করিয়ে আলাদা করে রাখা হয়। তারা যে অপরাধটিতে বিশেষজ্ঞ, সেইটি অনুসারে তাদের কম-বেশি পাহারায় রাখা হয়।

বিগত মহাযুদ্ধের কালে কিছুদিন আমি জনকল্যাণের কাজ করেছিলাম। তখন আমি এ ধরনের একটা অপরাধীদের বস্তিতেই প্রায়ই যেতাম। সেখানকার লোকদের উপর বাধা-নিষেধ ততটা কড়া ছিল না। তাদের সঙ্গে আর সেখানকার ভারপ্রাপ্ত সরকারী প্রতিনিধির সঙ্গে আমার অনেক মজার মজার কথা হত।

এই জাতটার অপরাধপ্রবণতা দূর করার জন্যে সরকার থেকে তাদের মীরাট জেলায় যমুনা নদীর বাঁ পারে মস্ত একটা পলি জমি নিস্কর দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই উর্বর জমিতে প্রচুর আখ, গম, যব, সরষে ইত্যাদি ফসল ফলত। কিন্তু অপরাধের প্রবৃত্তিটা থেকেই গেল। সরকারী কর্মচারীটি বললেন যে যত দোষ তাদের মেয়েদের। তিনি বললেন যে তারা নাকি করিতকর্মা চোরদের ছাড়া বিয়েই করতে চায় না। এই জাতটা বিশেষ করে চুরি-ডাকাতিই করত। বস্তিতে এমন সব বুড়ো লোক ছিল, যারা বখরাদারির শর্তে ছোটদের বড়-বিদ্যায় তালিম দিত।

এখানকার লোকরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ছুটি নিয়ে বস্তি ছেড়ে যেতে পারত, কিন্তু মেয়েদের বাইরে যেতে দেওয়া হত না। এই জাতের মোড়লরা তিনটি নিয়ম ঠিক রাখত; প্রথমত, সব চুরি-ডাকাতি একা-একা করতে হবে; দ্বিতীয়ত, বস্তি থেকে যত দূরে সম্ভব গিয়ে তা করা চাই; এবং তৃতীয়, তা করবার সময় খুন-জখম করা কোনো ক্ষেত্রেই চলবে না।

তালিম নেওয়া শেষ হলে গেলে যুবকরা সব সময় একই পথ ধরত। কলকাতা, বোম্বাই, কিংবা অন্য কোনো দূরের শহরে গিয়ে তারা কোনো বড়লোকের বাড়িতে চাকরের কাজ নিত। তারপর সুযোগ হলেই মনিবের সোনাদানা, গয়না, দামী পাথর ইত্যাদি যা সহজে লুকিয়ে রাখা যায় এমন জিনিস চুরি করত।

একবার এক আখের খেত থেকে আমার জন্যে কালো তিতির খেদাচ্ছিল কয়েকটা ছোকরা। আমি তাদের যখন পয়সা দিচ্ছি, তখন সরকারী কর্মচারী আমাকে জানালেন, ‘এই যে ছোকরার হাতে এইমাত্র তার মজুরি বাবদ আট আনা আর একটা পাখি কুড়িয়ে আনার জন্যে দু-আনা দিলেন, সে এক বছর বাইরে থাকার পর এই কয়েকদিন আগে ত্রিশ হাজার টাকা দামের একখানা হীরে নিয়ে বস্তিতে ফিরেছে। ওস্তাদরা হীরেখানার দাম নির্ধারণ করবার পর সেখানাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, এবং বস্তির সবচাইতে বেশ বাঞ্ছনীয় মেয়েটি তাকে কথা দিয়েছে যে আসছে বিয়ের মরসুমে তাকে বিয়ে করবে।

আর একটি লোক সামনেই দাঁড়িয়েছিল, সে তিতির খেদানোয় যোগ দেয় নি। সে তার পছন্দের মেয়েটিকে চমৎকৃত করবার জন্যে নতুন একটা ফন্দি বের করেছিল। কলকাতায় চুরি করা নতুন একখানা মোটরগাড়ি চালিয়ে, সাংঘাতিক একটা গরুর-গাড়ি-চলা রাস্তা ধরে সে এসে বস্তিতে হাজির হয়েছিল। এই ফন্দিকে কাজে পরিণত করবার জন্যে তাকে প্রথমে পয়সা খরচ করে গাড়ি চালানো শিখতে হয়েছিল।

যে-সব অপরাধপ্রবণ জাতকে খুব কড়াকড়িভাবে রাখা হয় না, তাদের কেউ-কেউ গিয়ে গৃহস্থের বাড়িতে রাতের পাহারাদারের কাজ নেয়। আমি এমন সব দৃষ্টান্ত জানি যেখানে এরকম মনিবের বাড়ির দোরগোড়ায় সেই পাহারাদার তার জুতোজোড়া রেখে দিলেই আর সে-বাড়িতে চুরি হবে না এ একেবারে নিশ্চিত।

এ ব্যবস্থাটার মধ্যে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের গন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু টাকাটা কমই বলতে হবে। কারণ, ডাকাতটার যত নাম-ডাক, সে হিসেবে মাইনে হত পাঁচ টাকা থেকে তিন টাকার মধ্যে। টাকাটা অবশ্য বিনা কষ্টে রোজগার হত, কেননা শুধু রাত্তিরে তার জুতোজোড়াটা ঠিক জায়গায় রেখে দেওয়া আর সকালে তা সরিয়ে নেওয়া ছাড়া পাহারাদারটিকে আর কিছু করতে হত না।

ভান্টু জাতটা কিন্তু খুনজখম করাই বেশি পছন্দ করত। তাই উত্তরপ্রদেশে অন্য কয়েকটা জাতের মধ্যে ভান্টু জাতটাকেও কড়া বাঁধাবাঁধির ভিতর রাখা হত। সুলতানা বলে যে নামজাদা ডাকাত তিন বছর ধরে সরকারের গ্রেপ্তার করবার সব চেষ্টাকে তুচ্ছ করে দিয়েছিল, সে ছিল এই জাতের লোক। সুলতানার কথাই এই কাহিনীতে লেখা হচ্ছে।

আমি যখন প্রথম দেখি, নয়া গাঁও তখন হিমাচলের পাদ-শৈলীশ্রেণী বরাবর যে ভূ-খণ্ড চলে গিয়েছে সেই তরাই আর ভাবর অঞ্চলের সবচাইতে সমৃদ্ধিশালী গ্রামের অন্যতম ছিল।

অনাহত অরণ্য থেকে জিতে নেওয়া এর প্রতি গজ উর্বর জমিতে গভীরভাবে চাষ হত, এবং ওখানকার একশো জন কি তার বেশি কিছু প্রজা বেশ সমৃদ্ধ, সন্তুষ্ট আর সুখী ছিল। কুমায়ুনের রাজা স্যার হেনরি র‍্যামজে এই কষ্টসহিষ্ণু লোকগুলিকে হিমালয় থেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এক পুরুষ ধরে তারা তাদের কর্মক্ষমতা অটুট রেখে প্রচুর উন্নতি করে নিয়েছিল।

সে সময়ে ম্যালেরিয়ার নাম ছিল ‘ভাবর জ্বর। বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অবস্থায় সামান্য যে ক-জন ডাক্তারের উপর এদের স্বাস্থ্যরক্ষার ভার ছিল, পাদ-শৈলাঞ্চলের এই অভিশাপের সঙ্গে যুঝবার যোগ্যতা অথবা উপকরণ তাদের কিছুই ছিল না। বনভূমির কেন্দ্রস্থলে স্থিত এই নয়া গাঁও প্রথম দিকেই এই রোগে জনহীন হতে আরম্ভ করল।

প্রজারা যেমন-যেমন মরতে থাকল, খেতের পর খেতও তেমন-তেমন অনাবাদী হয়ে যেতে লাগল। শেষে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র টিকে রইল সেই অগ্রণীদের মধ্যে। তারপর যখন আমাদের গ্রামে তাদের জমি দেওয়া হল, নয়া গাঁও তখন আবার অরণ্যে পরিণত হয়ে গেল।

পরবর্তীকালে শুধু আর একবার ওখানে চাষ করবার চেষ্টা হয়েছিল। সেবারকার দুঃসাহসিক উদ্যোক্তা ছিলেন পাঞ্জাব থেকে আসা একজন ডাক্তার। কিন্তু যখন প্রথমে তার মেয়ে, তারপর তার স্ত্রী, এবং সবশেষে নিজেও ম্যালেরিয়ায় মারা গেলেন, তখন নয়া গাঁও আবার সেই জঙ্গল হয়ে গেল।

বহু পরিশ্রমে যে জমি পরিষ্কার করা হয়েছিল, যে-জমিতে আখ, গম, সরষে আর ধানের প্রচুর ফসল ফলত তাতে সতেজ ঘন ঘাস গজিয়ে উঠল। এই সারবান খাদ্যে আকৃষ্ট হয়ে তিন মাইল দূরে আমাদের গ্রাম থেকে গরু মোষেরা নয়া গাঁওয়ের পরিত্যক্ত খেতগুলোকেই তাদের নিয়মিত চারণভূমি করে নিল।

জঙ্গল-ঘেরা ফাঁকা জায়গায় দীর্ঘকাল ধরে গরু-মোষ চরলে তার টানে মাংসাশী প্রাণীরা নিশ্চয় আসবে। তাই, এক বছর নৈনিতালের গ্রীষ্মবাস থেকে আমাদের শীতকালের আবাস কালাধুঙ্গিতে নেমে এসে যখন শুনলাম যে সেই চারণভূমি সংলগ্ন বনে আড্ডা গেড়ে একটা চিতা আমাদের গরু-মোষগুলির উপর বেজায় উৎপাত করছে, তখন আমি অবাক হই নি। ঘাসজমিতে এমন কোনো গাছ ছিল না যাতে উঠে আমি একটা মড়িকে পাহাড়া দিতে পারি।

আমি ঠিক করলুম যে চিতাটাকে মারতে হবে হয় সকালবেলা, যখন সে সারাদিনের জন্যে লুকিয়ে থাকবার জন্যে ঘন জঙ্গলের মধ্যে যেতে থাকবে, নয়তো সন্ধ্যাবেলা, যখন সে মড়ির কাছে ফিরে যাবার জন্যে কিংবা নতুন একটা শিকার ধরতে বের হবে। এই ফন্দি-দুটোর যে-কোনোটাকে কাজে পরিণত করতে হলে আগে জানা দরকার যে চিতাটা চারদিকে-ঘেরা জঙ্গলের কোন্ অংশে তার ডেরা নিয়েছে। তাই একদিন ভোরে রবিন আর আমি এই খবর যোগাড় করতে বেরোলুম।

বহুকাল ধরে অনাবাদী থাকা সত্ত্বেও নয়া গাঁও নামটি আজও থেকে গিয়েছে। এর উত্তর সীমানায় কান্ডি সড়ক নামে একটা রাস্তা আছে। আর এর পুবে হচ্ছে পুরনো ট্রাঙ্ক রোড। রেলপথের আবির্ভাবের আগে এই রাস্তাটা কুমায়ুনের ভিতরকার অংশের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের সমতল ক্ষেত্রের যোগাযোগ রক্ষা করত। দক্ষিণে আর পশ্চিমে নয়া গাঁও-এর সীমানায় নিবিড় অরণ্য।

আজকাল কাণ্ডি সড়ক আর ট্রাঙ্ক রোড দুই খুব কম ব্যবহৃত হয়। আমি ঠিক করলুম যে দক্ষিণে আর পশ্চিমে যে অসুবিধের জায়গা, সেখানে চেষ্টা করবার আগেই ঐ রাস্তা দুটো দেখব। ঐ দুটো রাস্তার সংযোগস্থলে আগেকার দিনে ডাকাতদের হাত থেকে পথিকদের বাঁচাবার জন্যে একজন পাহারাওলা থাকত।

সেখানে এসে রবিন আর আমি একটি মাদী চিতার পায়ের ছাপ দেখতে পেলুম। এই চিতাটা আমাদের দু-জনকারই খুব পরিচিত, কেননা সে আমাদের গ্রামের নিচের প্রান্তে এক ঘন ল্যান্টানা-ঝোপে ভরা জায়গায় গত কয়েক বছর ধরেই বাস করছিল। সে কখনও আমাদের গরু-মোষের উপর উৎপাত তো করতই না, বরং তার জন্যে শুয়োর আর বাঁদরে আমাদের ফসলের ক্ষতি করতে পারত না। তাই আমরা তার পায়ের চিহ্ন ছেড়ে দিয়ে ট্রাঙ্ক রোড ধরে গারুপ্পর দিকে চললুম। গত সন্ধ্যের পর থেকে এ পথে কোনো যানবাহন চলে নি। যে-সব প্রাণী এই পথটি ব্যবহার করেছে অথবা পার হয়ে গিয়েছে, এর ধুলোভরা বুকে তাদের পায়ের দাগ ছাপা হয়ে রয়েছে।

আমার চিরসাথী বুদ্ধিমান কুকুর রবিন আমার বাঁ হাতে রাইফেল দেখেই বুঝে নিয়েছিল যে আমরা পাখি খুঁজছি না। কাজেই যে-সব ময়ূর থেকে থেকে ধড়ফড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছিল, কিংবা যে-সব বনমুরগি পথের ধারে ঝরা পাতার স্তূপ আচড়ে দেখছিল, রবিন তাদের দিকে মনই দিচ্ছিল না।

আমাদের ঘণ্টাখানেক আগে একটি বাঘিনী তার আধ-বয়সী দুটি বাচ্চাকে নিয়ে ঐ পথ দিয়ে গিয়েছিল–রবিন বরং তাদের থাবার ছাপ একাগ্রভাবে লক্ষ করতে লাগল। জায়গায়-জায়গায় রাস্তাটা ছোট-ঘোট দূর্বা ঘাসে ছেয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদুটো এই শিশির-ভেজা ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিয়েছিল আর ডিগবাজি খেয়েছিল। রবিন আশ মিটিয়ে বাঘের সুমিষ্ট ও ভয়াবহ গন্ধে তার বুক ভরিয়ে নিচ্ছিল। বাঘেদের পরিবারটি পথ ধরে-ধরে মাইলখানেক গিয়ে তারপর পূর্বদিকে ঘুরে একটি পশু-চলাচলের পথ ধরে চলে গিয়েছিল।

এই মোড় থেকে তিন মাইল গিয়ে, গারুন্ধুর দু-মাইল আগে, নয়া গাঁওয়ের দিক থেকে আসা একটি অতি-ব্যবহৃত পশু চলাচলের পথ বড় রাস্তাটাকে কোনাকুনিভাবে পার হয়ে গিয়েছে। আর এই পথের উপরেই আমরা একটা মস্ত বড় পুরুষ চিতার টাটকা থাবার ছাপ দেখতে পেলুম। যা খুঁজছিলুম তা পেয়ে গেলুম। এই চিতাটা সেই চারণভূমি থেকে এসে রাস্তা পার হয়েছিল। এ একটা পূর্ণবর্ধিত গাভীকেও মারতে সক্ষম, এবং এই আকারের দু-দুটো চিতা এক এলাকায় থাকা সম্ভব নয়।

রবিনের খুব ইচ্ছে যে এই দাগগুলি অনুসরণ করে। কিন্তু নিবিড় ঝাড়জঙ্গলের দিকে যে চিতাটা গিয়েছিল, তার মত দৃষ্টি ও শ্রবণ-শক্তিসম্পন্ন জীবের অনুসরণ করে তাতে ঢোকা যুক্তিযুক্ত নয়। এটাই সেই জঙ্গল যেখানে কুঁয়ার সিং আর হর সিং কয়েক বছর আগে প্রাণটি খোয়াতে বসেছিল। তা ছাড়া, চিতাটার সঙ্গে যোগাযোগ করবার একটা ভাল আর সহজ ফন্দি এঁটেছিলুম। তাই আমরা ফিরে চললুম, বাড়ি গিয়ে সকালের খাওয়াটা খাব।’

দুপুরের খাওয়ার পর রবিন আর আমি ম্যাগিকে সঙ্গে নিয়ে আবার গারুপ্পর দিকে চললুম। আগের দিন চিতাটা আমাদের কোনো গরু-টরু মারে নি, কিন্তু হয়তো ঐ চারণভূমিতে গরুদের সঙ্গে চরছিল এমন কোনো চিতল হরিণ বা শুয়োরকে মেরে থাকবে। যদি সে কিছু মেরে নাও থাকে, তাহলেও আজ তার নিত্যকার শিকারের জায়গাতে যাবার সম্ভাবনা বেশ ভালরকমই আছে। কাজেই ম্যাগি আর আমি, আর আমাদের মাঝখানে শোয়া অবস্থায় রবিন–চিতাটা সেই সকালবেলা যে পশু চলাচলের পথটি ধরে চলে গিয়েছিল তা থেকে শ-খানেক গজ দূরে, রাস্তার ধারে একটা ঝোঁপের পিছনে জায়গা নিলুম।

সেই অবস্থায় ঘণ্টাখানেক থেকে, হরেকরকম পাখির ডাক শুনতে-শুনতে হঠাৎ দেখি যে একটা পুরো পেখমধারী ময়ূর খুব ঠাটের সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে সেই পশুদের পথটা দিয়ে নেমে গেল। একটু বাদেই দশ-বারোটা চিতল, যে ঘন জঙ্গলে চিতাটা শুয়ে আছে বলে আমরা আশা করেছিলাম সেই দিক থেকেই ডেকে বনের প্রাণীদের একটা চিতার উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিল। মিনিট দশেক বাদে, আমাদের আরও একটু কাছে একটিমাত্র চিতল আবার সতর্কতা জানাল আওয়াজ করে। চিতাটা রওনা, হয়েছে। সে আমাদের দিকেই আসছে। সে নিজেকে গোপন করবার চেষ্টা করছে না, বোধহয় একটি মড়ির দিকে চলেছে।

রবিন তার প্রসারিত থাবাদুটির উপর তার চিবুকটি রেখে নিশ্চল হয়ে শুয়ে-শুয়ে আমাদের মত কান পেতে শুনছিল বনের প্রাণীরা কী বলছে। যখন সে দেখল যে আমি পা গুটিয়ে নিয়ে হাঁটুর উপর রাইফেলটা রাখলুম, আমার বাঁ-পায়ের সঙ্গে ঠেকানো তার শরীরটা থর-থর করে কাঁপতে লাগল।

জঙ্গলের যে পশুকে সে সবচেয়ে বেশি ভয় করে, সেই চাকা-চাকা দাগওয়ালা খুনীটা এখনই ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতর থেকে তার মাথাটা বের করবে। তারপর সেটা রাস্তার এদিক আর ওদিক দেখে নিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকবে। সে তার থাবার ছাপের উপরেই মরে পড়ুক, কিংবা মারাত্মক আঘাত পেয়ে গর্জন করে উল্টে পাল্টেই পড়তে থাকুক, রবিন একেবারে স্থির ও নীরব হয়ে থাকবে। কেননা, সে এমন একটি খেলায় অংশগ্রহণ করছে যার প্রতিটি চাল তার সুপরিচিত। তার পক্ষে সে-খেলা যেমন মনভোলানো তেমনই ভয়ঙ্কর।

পশু-চলাচলের পথটা ধরে খানিকটা গিয়ে ময়ূরটা একটা কূলগাছে উঠে খুব ব্যস্তভাবে পাকা কুল খাচ্ছিল। হঠাৎ সে একটা কর্কশ কেকা-রব করে আকাশে লাফিয়ে উঠে একটা মরা গাছের ডালের উপর গিয়ে নেমে পড়ে চিতলটার সঙ্গে তার সতর্কবাণীও যোগ করে দিল। আর কয়েকটা মিনিট, খুব বেশি হলে পাঁচটা মিনিট, কেননা চিতাটা রাস্তায় আসতে হলে খুবই সন্তর্পণে আসবে। তারপর আমার চোখের এক কোণ দিয়ে দেখলুম–অনেক দূরে পথের উপর একটা কিছু আসছে।

একটা লোক ছুটে আসছে, আর থেকে-থেকে গতিবেগ শিথিল না করেই কাঁধের উপর দিয়ে পিছনদিকে তাকাচ্ছে। সূর্য তখন ডুবু-ডুবু। এমন সময়ে সন্ধ্যের এই আলো-আঁধারে এই রাস্তার উপর মানুষ দেখতে পাওয়া বিশেষ করে তাকে একা দেখতে পাওয়াটা আরও বেশি অস্বাভাবিক। লোকটির প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের চিতাটাকে মারতে পারার সম্ভাবনা কমে আসছে। যাই হক, আর উপায় নেই, কেননা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল যে লোকটি মহা বিপন্ন, এবং হয়তো তার সাহায্যেরও প্রয়োজন।

সে বেশ খানিকটা দূরে থাকতেই আমি তাকে চিনতে পারলুম–সে আমাদের পাশের এক গ্রামেরই প্রজা, শীতের ক-টা মাস সে কাটায় গারুপ্পর তিন মাইল পুবে, একটি গোশালায় রাখালের কাজ করে। আমাদের দেখতে পেয়ে ছুটন্ত লোকটি ভয়ানক হকচকিয়ে গেল, কিন্তু যখন সে আমাকে চিনতে পারল, আমাদের দিকে এসে বেজায় বিচলিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল–পালাও, সাহেব, প্রাণ বাঁচাতে চাও তো পালাও! সুলতানের লোকেরা আমাকে তাড়া করেছে।

তার দম ফুরিয়ে গিয়েছিল, কষ্টও হচ্ছিল সাংঘাতিক। আমি তাকে বসে জিরোতে বললাম। সে তা খেয়াল না করেই তার পা-খানাকে ঘুরিয়ে বললে, “দেখুন, ওরা কী করেছে আমার! একবার ধরতে পারলে আমাকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে ওরা! না পালালে আপনারাও মরবেন! যে পা-টা সে ঘুরিয়ে আমাদের দেখাল, তার হাঁটুর পিছন থেকে গোড়ালি পর্যন্ত কুপিয়ে কাটা, আর সেই বীভৎস ক্ষত থেকে ধুলোর সঙ্গে চাপ-বাঁধা রক্ত বেয়ে পড়ছে।

তাকে বললাম যে সে বিশ্রাম না করে তো না করুক, কিন্তু তার আর দৌড়বার দরকার নেই। এই বলে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে যেখানে থেকে রাস্তাটা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া যায় এমন জায়গায় দাঁড়ালুম, লোকটিও খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার গ্রামের দিকে চলে গেল।

চিতা কিংবা সুলতানার লোকেরা কেউই দেখা দিল না। তারপর যখন আর নিখুঁতভাবে গুলি চালাবার মত আলো রইল না, তখন ম্যাগি আর আমি কালাধুঙ্গিতে আমাদের বাড়িতে ফিরে এলাম। রবিন আমার পিছন পিছন এল, যেন হতাশার প্রতিমূর্তিটি।

পরদিন সকালবেলা লোকটির কাহিনী শোনা গেল। গারুঘ্ন আর সেই গোশালাটির মাঝামাঝি এক জায়গায় সে মোষ চরাচ্ছিল, এমন সময় একটা বন্দুকের আওয়াজ তার কানে এল। সেইদিনই ভোরবেলা তার গাঁয়ের মোড়লের ভাইপো চুরি করে একটা চিতল হরিণ মারবার জন্যে গোশালায় এসেছিল। তাই সে একটি গাছের ছায়ায় বসে ভাবতে লাগল যে, তার গুলি সার্থক হল কি না, আর, যদিই সার্থক হয়ে থাকে, তাহলে খানিকটা হরিণের মাংস তার খাবার জন্যে গোশালায় সন্ধ্যেবেলা অবধি থাকবে কি না।

হঠাৎ পিছনে খসখস শব্দ শুনে সে ফিরে চেয়ে দেখে কি, পাঁচজন লোক তার ঘাড়ের উপর এসে দাঁড়িয়েছে। তারা তাকে উঠে দাঁড়াতে বলে, হুকুম করল যেখানে বন্দুক ছোঁড়া হয়েছে সেইখানে তাদের নিয়ে যেতে হবে। সে বললে, যে সে ঘুমিয়ে থাকায় বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায় নি। তখন তাকে হুকুম করা হল তাদের পথ দেখিয়ে গোশালায় নিতে যেতে হবে। তারা মনে করেছিল যে বন্দুকওয়ালা লোকটি সেখানেই ফিরে আসবে।

দলের কারও হাতে বন্দুক ছিল না, শুধু যাকে তাদের সর্দার বলে মনে হল সেই লোকটির হাতে একটি ভোলা তরৈয়াল ছিল। সে বললে যে, রাখালটি যদি পালাবার কিংবা চেঁচিয়ে অন্য লোকদের সাবধান করে দেবার চেষ্টা করে, তাহলে তার মাথাই কেটে ফেলবে।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে তরোয়ালধারী লোকটা রাখালটাকে বলল যে তারা সুলতানার দলের লোক, আর সুলতানা কাছেই আড্ডা গেড়েছে।

গুলির আওয়াজ শুনে সুলতানা বন্দুকটা নিয়ে যাবার জন্যে তাদের পাঠিয়েছে। এখন যদি গোশালাতে গিয়ে তারা কোনো বাধা পায় তাহলে তারা সেটাকে পুড়িয়ে দেবে আর এই পথপ্রদর্শককে মেরে ফেলবে। এই শাসানিতে আমাদের বন্ধুবর উভয় সংকটে পড়ে গেল। গোশালায় তার সঙ্গীরা একটি দুর্ধর্ষ দল, তারা বাধা দেবেই; এবং দিলে এ বেচারা মারা পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। ওদিকে, যদি তারা প্রতিরোধ না-ও করে, তাহলেও ভয়ঙ্কর সুলতানার দলকে গোশালায় নিয়ে গিয়ে সে যে অপরাধ করবে, তা কেউ কখনও ভুলবে না কিংবা ক্ষমা করবে না।

তার মাথায় যখন এই সব দুর্ভাবনা খেলছিল, হঠাৎ একপাল বনকুত্তার তাড়া খেয়ে একটা চিতল ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে তাদের কয়েক গজ দূর দিয়ে চলে গেল। তার সঙ্গের লোকটি থেমে গিয়ে এই তাড়া দেওয়া দেখছে, এটা লক্ষ। করে রাখালটি পথের ধারের লম্বা ঘাসের ঝেপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরোয়ালধারী তাকে কেটে ফেলবার চেষ্টা করায় সে ভীষণ চোট খেল বটে, কিন্তু সে তার অনুসরণকারীদের হাত ছাড়িয়ে কোনোমতে ট্রাঙ্ক রোডটাতে এসে পৌঁছল, তারপর চিতার জন্যে অপেক্ষমান, আমাদের মধ্যে যথাসময়ে এসে পড়ল।

সুলতানা ছিল অপরাধপ্রবণ ভান্টু উপজাতির লোক। গোটা একটা জাতকে ‘অপরাধপ্রবণ’ শ্রেণীভুক্ত করা এবং তাদের সবসুদ্ধ নাজিরাবাদ ফোর্টে আটক করে রাখাটা ঠিক না ভুল, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, সুলতানা তার যুবতী স্ত্রী, শিশু পুত্র এবং আরও কয়েকশো ভান্টুসহ ঐ কেল্লাতে স্যালভেশন আর্মির জিম্মায় আটক ছিল। এই বন্দী দশা অসহ্য হওয়ায়, যে-কোনো তেজস্বী যুবকের মতই সেও এক রাত্রে কেল্লার মাটির দেওয়াল টপকে পালিয়ে গেল।

এটা হল আমার এই কাহিনীর বছরখানেক আগের ঘটনা। আর এই এক বছরে সহধর্মী শ-খানেক সশস্ত্র লোককে তার সঙ্গে জুটিয়ে নিয়েছিল সুলতানা। ডাকাতি করাই এই জাঁদরেল দলটির উদ্দেশ্য ছিল বলে ঘোষিত হয়েছিল। তরাই আর ভাবরের জঙ্গলে-জঙ্গলে যাযাবরের জীবন যাপন করত এরা। এদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল পূর্বে গোণ্ডা থেকে পশ্চিমে সাহারানপুর পর্যন্ত কয়েকশো মাইল জায়গা জুড়ে। সংলগ্ন-প্রদেশ পাঞ্জাবেও তারা মধ্যেমধ্যে হানা দিত। সুলতানা আর তার দলের কার্যকলাপ সম্বন্ধে সরকারী দপ্তরে অনেক মোটা-মোটা ফাইল আছে। সেগুলোকে আমার নাগালের মধ্যে পাই নি। কিন্তু যেসব ঘটনায় আমি অংশগ্রহণ করেছি, কিংবা যেসব ঘটনা আমার নিজের জানা, আমার কাহিনী সেগুলোকেই নিয়ে। সরকারী নথির সঙ্গে এ কাহিনীর যদি কোথাও তফাৎ বা বিরোধ থাকে, তাহলে, শুধু দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলব যে সে-ক্ষেত্রেও আমার কাহিনীর একটি কথাও আমি ফিরিয়ে নেব না।

আমি যখন প্রথম সুলতানার কথা শুনি, সে তখন আমাদের শীতকালের আবাস কালাধুঙ্গি থেকে কয়েক মাইল দূরে গারুপ্পর জঙ্গলে আড্ডা গেড়েছিল। সে সময়ে পার্সি উইণ্ডহ্যাম ছিলেন কুমায়ুনের কমিশনার। তরাই এবং ভাবর অঞ্চলের যেসব বনে সুলতানা তখন আস্তানা করেছিল সেগুলি উইণ্ডহ্যামের এলাকাভুক্ত বলে তিনি কাজের জন্যে সরকারের কাছ থেকে ফ্রেডি ইয়ংকে চাইলেন।

ফ্রেডি ছিল এক উৎসাহী তরুণ পুলিস অফিসার। সে উত্তরপ্রদেশ সরকারের অধীনে কয়েক বছর কৃতিত্ব সহকারে কাজ করেছিল। সরকার থেকে উইণ্ডহ্যামের অনুরোধ মঞ্জুর করা হল। তিনশোজন বাছাই-করা লোক নিয়ে একটি বিশেষ ডাকাইতি পুলিস বাহিনী সৃষ্টির প্রস্তাবও সরকার থেকে অনুমোদিত হল। ফ্রেডিকে এই বাহিনীর চরম কর্তৃত্ব এবং তার লোক নিযুক্ত করবার ব্যাপারে তাকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হল।

আশপাশের সব জেলাগুলি থেকে সেরা-সেরা লোকগুলিকে নিয়ে তার বাহিনী গঠন করতে গিয়ে সে অনেককে চটিয়ে দিল। কেননা, সুলতানাকে ধরতে পারাটা ছিল অনেকেরই কাছে সাধনার বস্তু। সুলতানাকে ধরবার কাজে সাহায্য করতে পারে এমন সব লোককে সরিয়ে নিলে তাদের উপরওয়ালাদের তাতে ঘোরতর আপত্তি হবার কথা।

ফ্রেডি যখন তার বাহিনী সংগ্রহ করছিল, সুলতানা ততক্ষণ তরাই আর ভাবরের ছোট-ঘোট শহরে হানা দিয়ে হাত পাকাচ্ছিল। সুলতানাকে ধরবার জন্যে ফ্রেডি প্রথম প্রচেষ্টা চালায় রামনগরের পশ্চিম দিকের জঙ্গলে। বন-বিভাগ থেকে ওখানকার জঙ্গলের এক অংশ কাটানো হচ্ছিল, তাতে বহু মজুর খাটছিল।

মজুরদের উপরওয়ালা ঠিকাদারদের মধ্যে একজনকে বলে কয়ে রাজী করানো হল যে সে একটি নাস্তা আর ভোজর আয়োজন করে তাতে সুলতানাকে দলবলসহ নিমন্ত্রণ করবে। জানা গিয়েছিল যে সুলতানা কাছাকাছি কোথাও আছে। সে আর তার আমুদে সঙ্গীরা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল। কিন্তু উৎসব আরম্ভ হবার ঠিক আগে তারা তাদের নিমন্ত্রণকর্তাকে উৎসব-সূচি একটুখানি বদলে দিতে রাজী করাল। সুলতানা বলল যে খালি পেটের চাইতে ভরা-পেটেই নাচ দেখতে তাদের বেশি ভাল লাগবে, তাই খাওয়াটাই আগে হক।

আমার কাহিনীটিকে এখানে একটু বন্ধ রেখে, যাঁরা কখনও পুবদেশে আসেন নি তাঁদের বুঝিয়ে বলবার জন্যে বলে দেওয়া উচিত যে, এদেশের নাচের আসরে অভ্যাগতরা নিজেরা অংশ গ্রহণ করেন না। নাচের ব্যাপারটা শুধু একদল নর্তকী আর তাদের সঙ্গের পুরুষ বাজনাদারদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।

উভয় পক্ষেরই অর্থবল যথেষ্ট। পাশ্চাত্ত্য দেশে যেমন, পূবদেশেও তেমনি খবর কিনতে হলে টাকা জিনিসটা সমানই কাজে লাগে। তাই এই খেলার দুই প্রতিযোগীর প্রথম চালই হল সুদক্ষ গুপ্তচর বাহিনী সংগঠন করা।

এ ব্যাপারে সুলতানার সুবিধেই ছিল বেশি। কেননা, ফ্রেডি শুধু কাজের বিনিময়েই টাকা দিতে পারত, অথচ সুলতানা তা তো পারতই–তার উপর সে যারা খবর না দিত, কিংবা তার খবর পুলিসকে দিত, তাদের শাস্তি দিতেও পারত। কেউ দোষ করলে সে তাকে নিয়ে কী করে এ কথা যখন সকলে জেনে গেল, তখন কেউই সাধ করে তার বিরাগভাজন হতে চাইত না।

গরিব-সত্যিকার গরিব হওয়াটা যে কি, নাজিরাবাদ ফোর্টে সুদীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকার সময়ে সেটা উপলব্ধি করবার ফলে গরিবদের জন্যে সুলতানার খুব দরদ ছিল। লোকে বলে যে ডাকাতি-জীবনে সুলতানা কখনও কোনো গরিবের একটি পয়সাও কেড়ে নেয় নি, কেউ ভিক্ষা চাইলে ‘না’ বলেনি, এবং ছোট-ঘোট দোকানদারদের থেকে জিনিস কিনে তার জন্যে দ্বিগুণ দাম দিয়েছে। এর ফলে, তার গুপ্তচরের সংখ্যা যে শত-শত হবে এবং সেই নাচ আর ভোজের উৎসবে তার নিমন্ত্রণ যে ফ্রেডিরই প্ররোচনার ফল, একথা যে সে জানতে পারবে, তাতে আর আশ্চর্যের কি?

ইতিমধ্যে সেই মহারাত্রির জন্যে আয়োজন হতে লাগল। ঠিকাদারটির বড়লোক বলে খ্যাতি ছিল। সে রামনগরে আর কাশীপুরে তার বন্ধুদের আমন্ত্রণ পাঠাল। ভাল-ভাল নাচওয়ালী আর সংগতের দল ঠিক করা হল। প্রচুর খাদ্য আর পানীয়–শেষেরটি বিশেষ করে ডাকাতের জন্যে কিনে গরুর গাড়িতে করে ঠিকাদারের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হল।

যে রাত্রিতে সুলতানাকে ঘায়েল করা হবে সেই রাত্রিতে যথাসময়ে ঠিকাদারের অতিথিরা এল, ভোজও শুরু হল। সম্ভবত তার বন্ধুরা জানত না তাদের সহ-অতিথিরা কারা। কেননা, এ-সব উপলক্ষে এক-এক জাতের লোক এক-এক দল করে আলাদা বসে, এবং দু-চারটে লণ্ঠনের আলোয় অন্ধকার প্রায় কিছুই দুর হয় না।

সুলতানা আর তার লোকেরা বেশ ভাল করে, অথচ মাথা ঠিক রেখে খেল। তারপর ভোজ শেষ হবার আগেই ডাকাত-সর্দার তার নিমন্ত্রণ-কর্তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে তার আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে বলল যে, এখন তাদের অনেক দূর যেতে হবে বলে নাচ দেখবার জন্যে আর থাকা হবে না। তারা সেজন্যে দুঃখিত। কিন্তু চলে যাবার আগে সে অনুরোধ করে গেল যে উৎসব যেমন চলবার কথা তেমনি যেন চলে। সুলতানার অনুরোধ কখনও উপেক্ষিত হত না।

নাচের আসরে প্রধান বাজনাই হচ্ছে ঢোল। তা বেজে উঠলেই ফ্রেডি যেখানে ছিল সে জায়গাটা ছেড়ে ঐ ক্যাম্পটা ঘিরে ফেলবার জন্যে তার বাহিনী পরিচালনা করতে শুরু করবে, এই ছিল ব্যবস্থা।

এই বাহিনীর এক অংশের নেতা ছিল এক বন-রক্ষী। রাতটা ছিল অন্ধকার, তাই সে পথ হারিয়ে ফেলল। এই দলটারই কাজ ছিল সুলতানার পালাবার পথটা আটকানো। কিন্তু তারাই সারারাতের মত হারিয়ে গেল। বন-রক্ষীটিকে বনে সুলতানার কাছাকাছি থাকতে হত, আর তার একটু বুদ্ধি-বিবেচনাও ছিল। তবু তার কষ্ট করে পথ হারিয়ে ফেলবার কোনো দরকার ছিল না, কারণ, খাওয়াটাকে আগে করিয়ে নিয়ে, সংকেত হবার অনেক আগেই সরে পড়বার ব্যবস্থা করেছিল সুলতানা। সুতরাং আক্রমণকারীর দল গভীর বনের মধ্যে দিয়ে সুদীর্ঘ ও সুকঠিন পথ অতিক্রম করে ক্যাম্পে এসে শুধু একদল ভীত নাচওয়ালী, আর তাদের চেয়ে ভীত বাজনাদারের দল এবং ঠিকাদারের বিস্মিত বন্ধুদের দেখতে পেল।

রামনগরের বন থেকে পালাবার পর সুলতানা গিয়ে পঞ্জাবে দেখা দিল। সেখানে আশ্রয় নেবার যোগ্য বনের অভাব বলে সে যেন ধাতস্থ বোধ করছিল না। তাই সে অল্পদিন মাত্র সেখানে থেকে, লাখ-খানেক টাকার সোনার গহনা সংগ্রহ করে উত্তরপ্রদেশের গহন অরণ্যে ফিরে এল। পঞ্জাব থেকে ফেরবার পথে তাকে গঙ্গার খাল পার হতে হল।

খালটার উপর চার মাইল অন্তর-অন্তর পুল ছিল। তার গতিবিধ জানা গিয়েছিল বলে যে-সব পুলের উপর দিয়ে তার পার হবার সম্ভাবনা সেগুলোতে প্রচুর লোকের পাহারা বসানো হল। এগুলোকে এড়িয়ে যাতে পাহারা নেই বলে খবর এনেছিল তার গুপ্তচরেরা সুলতানা এমন একটা পুলের দিকে চলল। পথে সে একটা বড় গ্রামের কাছে গিয়ে পড়ল। সেখানে বাজনাদাররা দেশী বাজনা বাজাচ্ছিল। তার পথপ্রদর্শকদের কাছে সে জানতে পেল যে এক বড়লোকের ছেলের বিয়ে হচ্ছে। সে তাদের হুকুম করল তাকে ওই গ্রামে নিয়ে যেতে হবে।

গ্রামটির মাঝখানে বিস্তীর্ণ একটি ফাঁকা জায়গায় বিয়ের দলবল এবং হাজারখানেক নিমন্ত্রিত ব্যক্তি সমবেত হয়েছিল। জোরাল বাতির আলোর মধ্যে সুলতানা এসে পড়তেই একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কিন্তু সে সকলকে বসে থাকতে অনুরোধ করে বলল যে, তার কথা মেনে চললে কারও ভয় পাবার কিছু নেই।

তারপর সে গ্রামের মোড়লকে আর বরের বাপকে ডাকিয়ে এনে বলল যে এইরকম উপলক্ষে উপহার দেওয়া আর নেওয়া বড়ই প্রশস্ত। তাই সে নিজের জন্যে শুধু মোড়লমশায়ের নতুন কেনা বন্দুকটা, আর তার সঙ্গীদের জন্যে দশ হাজার টাকা উপহার প্রার্থনা করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্দুক এবং টাকাটা এনে দেওয়া হল। তখন সুলতানা বিদায় নিয়ে সদলে গ্রাম থেকে বেরিয়ে গেল। ভোর না হওয়া পর্যন্ত সে টের পায় নি যে তার প্রধান সহকারী প্যায়লোয়ান বিয়ের কনেটিকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। দলের কেউ কোনো স্ত্রীলোকের উপর উৎপাত করে, সুলতানা সেটা পছন্দ করত না।

প্যায়লোয়ানকে বেজায় ধমক-ধামক করে সে মেয়েটিকে ফেরত পাঠিয়ে দিল, এবং তাকে এরকম অসুবিধেয় ফেলা হয়েছে বলে তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ উপযুক্ত উপহারও তার সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হল।

রাখালের পায়ে কোপ মারবার ঘটনাটার পর সুলতানা কিছুকাল আমাদের কাছে-পিঠে রইল। সে ঘন-ঘন তার আস্তানা বদল করত। আমি শিকারে বেরিয়ে তার পুরনো কয়েকটা থাকার জায়গা দেখতে পেয়েছি।

এই সময় আমার একটা বেজায় উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা হল। একদিন সন্ধ্যেবেলা আমি বাড়ি থেকে মাইল-পাঁচেক দূরে খাসা একটি চিতা মেরেছিলুম। তখন লোজন যোগাড় করে ওটাকে নিয়ে আসবার সময় ছিল না বলে, আমি সেখানেই সেটার ছাল ছাড়িয়ে ছালটা নিয়ে বাড়ি চলে এলুম। কিন্তু পৌঁছে দেখি যে আমার প্রিয় শিকারের ছুরিখানা ফেলে এসেছি।

পরদিন ভোর হতেই ছুরিখানা উদ্ধার করবার জন্যে আমি বেরিয়ে পড়লুম। যেখানে সেটাকে ফেলে এসেছিলুম, তার কাছাকাছি আসতেই পথ থেকে খানিকটা দূরে বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গাতে আগুনের ঝিকিমিকি দেখতে পেলুম। কয়েকদিন ধরেই খবর আসছিল যে সুলতানা এই জঙ্গলেই আছে। তাই ঝোঁকের মাথায় ঠিক করে ফেললুম যে ব্যাপারটা একটু দেখতে হবে। ঝরা পাতার উপর প্রচুর শিশির থাকায় নিঃশব্দে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হল। যেটুকু আড়াল পাওয়া গেল তারই পিছন থেকে আমি আগুন লক্ষ করে চললুম। আগুনটা একটা ছোট কুন্ডের মধ্যে জ্বলছে, আর কুড়ি থেকে পঁচিশ জন লোক সেটাকে ঘিরে বসে আছে। কাছেই একটা গাছের গায়ে খাড়াভাবে গাদাগাদি করে রাখা আছে কতকগুলো বন্দুক, তাদের নলগুলিতে আগুনের আভা ঠিকরোচ্ছে।

সুলতানা সেখানে ছিল না। আমি তাকে দেখি নি বটে, কিন্তু বর্ণনা শুনেছি যে সে অল্পবয়সী, ছোটখাট, ফিটফাট মানুষ, আর সে নাকি সবসময় আধাসামরিক খাকী পোশাক পরে থাকত। যাই হক, এই লোকগুলো নিশ্চয়ই তার দলেরই লোক। কিন্তু এদের নিয়ে আমি এখন করি কি? কালাধুঙ্গিতে যে বুড়ো হেড কনস্টেবল আর তারই সমবয়সী দু-জন কনস্টেবল আছে, তাদের দিয়ে কিছু হবে না। হলদোয়ানিতে একগাদা পুলিস আছে বটে, কিন্তু তা তো পনের মাইল দূরে।

আমার পরের চালটা কি হবে ভাবছি, এমন সময় একটি লোককে বলতে শুনলুম যে যাবার সময় হয়েছে। এখন পিছু হটতে গেলে ওরা আমাকে দেখে ফেলবে এবং তাহলে বিপদ হতে পারে, এই আশঙ্কায় আমি তাড়াতাড়ি কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে লোকগুলি আর তাদের বন্দুকগুলির মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়ালুম। তা করতেই গোল হয়ে বসা লোকগুলি বিস্মিত চোখ তুলে আমার দিকে চাইল, কেননা আমি একটু উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলুম। তারা এখানে কি করছে সেকথা জিগ্যেস করায় তারা এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল।

তারপর যার বিস্মিত ভাবটা আগে কেটে গেল সে উত্তর দিল, ‘কিছুই না। আরও প্রশ্ন করা হলে তার জবাবে আমাকে বলল যে তারা কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানায়, এসেছে বেরিলি থেকে। উপস্থিত, পথ হারিয়ে এখানে বসে আছে। আমি ফিরে গাছটার দিকে চেয়ে দেখি কি, যা দেখে বন্দুকের নল বলে ভেবেছিলুম, সেগুলো হচ্ছে পাঁজা-করা কুড়ুল। সেগুলোর বাঁট দীর্ঘকাল অনবরত ব্যবহারের ফলে পালিশ হয়ে গিয়ে আগুনের আলোয় চকচক করছিল।

আমার পা-দুটো ভিজে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে, এই বলে আমি তাদের দলে গিয়ে যোগ দিলুম। আমার সিগারেট সকলে মিলে খেল, অনেকরকম গল্পগুজব হল, তারপর আমি তাদের কাঠকয়লাওয়ালাদের আড্ডায় যাবার পথটা বুঝিয়ে দিলুম। তারা সেটাই খুঁজছিল। তখন আমি আমার ছুরিখানা উদ্ধার করে বাড়ি ফিরে এলুম।

একটানা উত্তেজিত হয়ে থাকা অবস্থায় মানুষের কল্পনা উদ্ভট-উদ্ভট অবস্থার সৃষ্টি করে। বাঘে-মারা একটা সম্বরের কাছে মাটিতে বসে থাকতে থাকতে আমি শুনেই চলেছি যে বাঘটা আসছেই আর আসছেই, অথচ কাছে এসে পড়ছে না। তারপর উদ্বেগ যখন অসহ্য হয়ে উঠেছিল, তখন আমি বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল রেখে ফিরে দেখি যে আমার মাথার কাছে একটা শুয়োপোকা এক মচমচে পাতা থেকে ছোট ছোট কুচি কেটে-কেটে ফেলছে।

আবার, যখন আলো ক্ষীণ হয়ে আসছিল আর বাঘটার মড়ির কাছে ফিরে আসবার সময় হয়ে এসেছিল, তখন আমি চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলুম যে মস্ত একটা জানোয়ার এসে পড়েছে। কিন্তু যেই আমি বন্দুকটি চেপে ধরে গুলি চালাবার জন্যে তৈরি হয়েছি, অমনি আমার মুখের থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা শুকনো ফেঁকড়িতে একটা পিঁপড়ে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল।

সুলতানার কথা যখন আমার মনকে ছেয়ে ছিল, তখন পালিশ-করা কুড়ুলের বাঁটে আগুনের আলোর ঝকমকিতে সেগুলো বন্দুকের নল বলে মনে হয়েছিল। আর, যতক্ষণ না লোকগুলো আমাকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিল যে তারা কয়লাওয়ালাই, ততক্ষণ আমি আর সেগুলোর দিকে তাকাও নি।

সুদক্ষ সংগঠন-ব্যবস্থা এবং যানবাহনের উৎকৃষ্টতর বন্দোবস্ত থাকার ফলে ফ্রেডি সুলতানার উপর চাপ দিতে শুরু করেছিল। তা এড়াবার জন্যে ডাকাত-সর্দার তার দলবল নিয়ে জেলার পূর্বপ্রান্তে পিলভিতে চলে গেল। দলত্যাগ আর গ্রেপ্তারের ফলে দলটি অনেক ছোট হয়ে এসেছিল।

ওখানে কয়েক মাস থেকে তারা দূর গোরখপুর পর্যন্ত হানা দিয়ে সোনার ভাণ্ডার বাড়িয়ে তুলতে লাগল। তারপর আমাদের অঞ্চলের জঙ্গলে ফিরে এসে সে খবর পেল যে রামপুরের এক অত্যন্ত ধনবতী নর্তকী এসে আমাদের গ্রাম থেকে সাত মাইল দূরের লামাচৌর গ্রামের মোড়ল বাড়িতে বাস করছে। আক্রমণের আশঙ্কায় মোড়ল তার ত্রিশজন প্রজাকে পাহারায় নিযুক্ত করেছিল, কিন্তু তারা সশস্ত্র ছিল না। সুলতানা যখন এসে পড়ল, তখন তার বাড়িটা ঘিরে ফেলবার আগেই নর্তকীটি তার সমস্ত গয়নাপত্র নিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে গেল।

ওদিকে ডাকাতেরা মোড়লকে আর তার প্রজাদের তাড়িয়ে উঠোনে নিয়ে এল। কিন্তু যখন তারা বললে যে নাচওয়ালীর খবর কিছু জানে না, তখন তাদের স্মৃতিশক্তিকে জাগিয়ে তোলবার জন্যে তাদের বেঁধে মার লাগাবার হুকুম হল। একজন প্রজা এই হুকুমের প্রতিবাদ করল। সে বললে যে সুলতানা তাকে আর অন্য প্রজাদের নিয়ে যা চায় তা-ই করতে পারে, কিন্তু মোড়লকে বেঁধে মেরে তার মান-ইজ্জত নষ্ট করবার অধিকার তার নেই। তাকে চুপ করতে বলা হল। কিন্তু যেই একটা ডাকাত একগাছা দড়ি নিয়ে মোড়লের দিকে এগিয়েছে, অমনি এই অসমসাহসী লোকটি একটি একচালা থেকে একগাছা বাঁশ টেনে নিয়ে ডাকাতটার দিকে ধেয়ে গেল।

দলের একজন তার বুকে এক গুলি করল। এই গুলির শব্দ শুনে পাছে আশপাশের গ্রামের সশস্ত্র লোকরা জেগে ওঠে এই ভয়ে সুলতানা তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। যাবার সময় নিয়ে গেল শুধু মোড়লের সম্প্রতি কেনা একটা ঘোড়া।

পরদিন সকালবেলা এই সাহসী প্রজাটির হত্যার খবর আমার কানে এল। মৃত ব্যক্তির পরিবারে কে কে আছে, তার খোঁজ নেবার জন্যে আমি আমার একজন লোককে লামাচৌরে পাঠালুম এবং তার পরিবারের সাহায্যের জন্যে কিছু টাকা তুলতে আশপাশের গ্রামের মোড়লরা রাজী আছে কি না, তা জিগ্যেস করে একখানা খোলা চিঠি দিয়ে মোড়লদের কাছে আর একজন লোককে পাঠিয়ে দিলুম।

যেমনটি আশা করেছিলুম, এতে সবাই মন খুলে সাড়া দিয়েছিল, কারণ গরিবেরা সব সময়েই উদার-হৃদয়। কিন্তু টাকা আর তুলতে হয় নি, কেননা যে লোকটি তার মনিবের জন্যে প্রাণ দিল, সে কুড়ি বছর আগে নেপাল থেকে এসেছিল। সেখানের অনেক খবর নিলুম, তার বন্ধুদের জিগ্যেস করা হল, কিন্তু তার স্ত্রী বা ছেলেপুলে ছিল কি না তা জানা গেল না।

এই ঘটনার পরেই আমি সুলতানাকে ধরবার কাজে অংশ গ্রহণ করবার জন্যে ফ্রেডির কাছ থেকে এক আহ্বান পেলুন। তার মাসখানেক বাদে আমি হরিদ্বারে তার সদর আপিসে এসে তার সঙ্গে যোগ দিলুম। আঠার বছর ধরে মির্জাপুরের কালেকটর থাকার কালে উইন্ডহ্যাম বাঘ-শিকারের ব্যাপারে তাকে সাহায্য করবার জন্যে মির্জাপুরে জঙ্গলের বাসিন্দা জাতগুলির মধ্যে থেকে দশজন কোল আর দশজন ভূঁইয়াকে নিযুক্ত করেছিলেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চার জনকে–তারা সবাই আমার পুরনো বন্ধু–উইণ্ডহ্যাম এখন ফ্রেডির কাজের জন্যে ছেড়ে দিলেন। হরিদ্বারে পৌঁছে দেখি যে তারা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

ফ্রেডির মতলব ছিল এই, যে ঐ চারজন বন্ধু আর আমি প্রথমে সুলতানাকে খুঁজে বের করব। সেটা করা হলে পুলিস-বাহিনী নিয়ে এমন একটা জায়গায় যাব যেখান থেকে আক্রমণ চালাবার সুবিধে হয়। আগে যে সব কারণের উল্লেখ করেছি, সে-সব কারণে এই দুই কাজই রাত্রিতে করতে হবে। কিন্তু সুলতানাও অস্থির হয়ে উঠেছিল। হয়তো শুধুই তার মনের চাঞ্চল্য তার কারণ, অথবা সে ফ্রেডির ফন্দির কথা টের পেয়েও থাকতে পারে। তা যাই হক, সে এক দিনের বেশি কোনো জায়গাতে থাকত না, আর প্রতি রাত্রিতে দলবল নিয়ে বহু দূরে-দূরে সরে যেত।

তখন সাংঘাতিক গরম পড়েছিল। শেষে বেকার হয়ে বসে থেকে-থেকে বিরক্ত হয়ে আমরা পাঁচজনে এক আলোচনা করলাম।

সেইদিন রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়ার পর যখন ফ্রেডি বারান্দার এমন এক শীতল অংশে বেশ আরাম করে বসেছে যেখান থেকে আমাদের কথা অন্য কারও কানে যাবার সম্ভাবনা নেই, সেখানে আমি এই প্রস্তাবটি পেশ করলুম : ফ্রেডি প্রচার করে দেবে যে বাঘ শিকারের জন্যে উইণ্ডহ্যাম তার লোক চারজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন আর আমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। তারপর সে আমাদের জন্যে হলদোয়ানির টিকিট কাটিয়ে নিজে হরিদ্বার স্টেশনে গিয়ে আমাদের রাত্রির গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবে। কিন্তু ট্রেনটা যেই তার পরের স্টেশনে থামবে অমনি ফ্রেডির দেওয়া বন্দুক নিয়ে ওই চারজন, আর আমার রাইফেল নিয়ে আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়ব। তারপর, যেমন সুবিধে হবে, সেই অনুসারে জীবিত বা মৃত অবস্থায় সুলতানাকে নিয়ে আসবার অবাধ স্বাধীনতা থাকবে আমাদের।

আমার প্রস্তাবটা শুনে ফ্রেডি অনেকক্ষণ চোখ বুজে রইল। তার বপুখানার ওজন ছিল পাক্কা সাড়ে তিন মণ, আর রাত্রের খাওয়ার পর একটু ঝিমুবার অভ্যেস ছিল তার। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়ে নি, কেননা সে হঠাৎ খাড়া হয়ে বসে খুব দৃঢ়স্বরে বললে, ‘না। আমি তোমাদের জীবনের জন্যে দায়ী। এই পাগলের পরিকল্পনা আমি সমর্থন করব না। তার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা হল। কাজেই পরদিন সকালবেলা আমরা পাঁচজন যে-যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলুম।

প্রস্তাবটা করা আমার ভুল হয়েছিল, আর ফ্রেডি সেটা নাকচ করে দিয়ে ঠিকই করেছিল। আমাদের পাঁচজনের তো কোনো সরকারী পদ ছিল না; তাই, যদি সুলতানাকে ধরতে গিয়ে কোনো ঝঞ্ঝাট বাধত, তাহলে কৈফিয়ত দেওয়া যেত না। অবশ্য তা-ছাড়া আর কোনো মুশকিল ছিল না, কেন না, সুলতানার কিংবা আমাদের কারও প্রাণ যাবার আশঙ্কা ছিল না। কথাই ছিল যে জ্যান্ত ধরতে না পারলে সুলতানাকে আমরা ধরবই না। আর এদিকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে বেশ সমর্থ ছিলুম।

তিন মাস বাদে, যখন বর্ষা পুরোদমে চলছে, ফ্রেডি বন-বিভাগের হার্বার্টকে, তরাই আর ভাবর অঞ্চলের সুপারিন্টেণ্ডেট ফ্রেড অ্যাণ্ডারসনকে, এবং আমাকে হরিদ্বারে ডেকে পাঠাল। পোঁছে শুনলুম, যে ফ্রেডি নাজিরাবাদের জঙ্গলের মধ্যে সুলতানার স্থায়ী ঘাঁটিটির হদিস পেয়েছে। সেই ঘাঁটি ঘেরাও করতে, এবং সুলতানা যদি সেই বহ থেকে ফসকে বেরিয়ে আসে তাহলে তার পালাবার পথ বন্ধ করবার জন্যে সে আমাদের সাহায্য চাইল।

সুলতানার পালাবার পথ আটকাবার জন্যে পঞ্চাশজন অশ্বারোহীর নেতৃত্ব দেওয়া হল বিখ্যাত পোলো খেলোয়াড় হার্বার্টকে, এবং ফ্রেডিকে চক্রব্যুহ রচনায় সাহায্য করবার জন্যে ফ্রেডির সঙ্গে রইলাম অ্যাণ্ডারসন আর আমি।

এতদিনে সুলতানার গুপ্তচর-বিভাগের দক্ষতা সম্বন্ধে ফ্রেডির মনে আর কোনো ভুল ধারণা ছিল না। ফ্রেডির দুজন সহকারী এবং আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউই এই পরিকল্পিত আক্রমণের কথা জানত না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পুলিস-বাহিনী পুরোপুরি সশস্ত্র অবস্থায় লম্বা এক মার্চ করতে বেরোত, আর আমরা চারজনও একই রকম দীর্ঘ পথ হেঁটে, রাত হয়ে গেলে বাঁধের উপরে যে বাংলোতে আমরা ছিলুম সেখানে ফিরে আসতুম।

নির্দিষ্ট রাত্রিতে কুচকাওয়াজের দলটা রোজকার মত লেভেল ক্রসিং-এর উপর দিয়ে মার্চ করে না গিয়ে হরিদ্বার স্টেশনের গুডস-ইয়ার্ডের ভিতর দিয়ে একটা সাইডিং-এ চলে গেল।

সেখানে ইঞ্জিন আর ব্রেক ভ্যান-সহ একসারি মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, ওয়াগনগুলোর সব দরজা স্টেশন-বাড়ির বিপরীত দিকে খোলা ছিল। আমরা যখন এলুম তখন শেষ দরজাটি বন্ধ করা হচ্ছে, আর আমরা গার্ডের কামরায় উঠেই কোনো সতর্কতা-সূচক হুই না বাজিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিল।

সন্দেহ দূর করবার জন্যে সবকিছুই করা হয়েছিল। এমনকি সিপাইদের বারিকে তাদের খাবার রান্না হচ্ছিল, আর ওদিকে আমাদের খানার টেবিলও সাজানো হয়েছিল।

অন্ধকার হবার একঘণ্টা পরে আমরা রওনা হয়েছিলুম। রাত নটার সময় দুটো স্টেশনের মাঝখানে গভীর জঙ্গলের মধ্যে গাড়িটা থেমে গেল, এবং ওয়াগান থেকে ওয়াগনে হুকুম চলে গেল যে এখানেই সকলকে নামতে হবে। এই হুকুম তামিল হতেই ট্রেন চলে গেল।

ফ্রেডির বাহিনীর ৩০০ জনের ৫০ জনকে নিয়েছিল হার্বার্ট। সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় অশ্বারোহী বাহিনীতে থেকে ফ্রান্সে যুদ্ধ করেছিল। তারা রওনা হয়েছিল আগেকার রাত্রিতেই।

যেখানে তাদের ঘোড়াগুলি ছিল, অনেকটা পথ ঘুরে সেখানে যাবার কথা বলে দেওয়া হয়েছিল তাদের। এদিকে ২৫০ জনের আসল দলটা ফ্রেডি ও অ্যাণ্ডারসনকে সামনে এবং আমাকে পিছনে নিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে চলল। সেটা শুনলুম ২০ মাইল দূরে।

ঘন মেঘ সারাদিন ধরে পূঞ্জীভূত হয়ে উঠছিল, আর যখন আমরা ট্রেন থেকে নামলুম তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের যাবার ছিল উত্তরে এক মাইল, তারপর পূর্বে দু-মাইল, আবার উত্তরে এক মাইল, তারপর পশ্চিমে দু-মাইল, শেষে আবার সোজা উত্তরে।

জানতুম যে এ-ভাবে দিক পরিবর্তন করা হচ্ছে যাতে সুলতানার মাইনে-করা লোক যেখানে-যেখানে আছে এমন সব গ্রামকে এড়িয়ে চলা যায়। এইভাবে বাহিনী-সঞ্চালন যে অত্যন্ত সুকৌশলে সম্পাদিত হল তার প্রমাণ এই যে কোনো গ্রামের একটা নেড়িকুত্তাও আমাদের দেখতে পেয়ে ডাকে নি, অথচ এদের মত ভাল পাহারাদার কুকুর দুনিয়ায় আর নেই।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, অঝোর বৃষ্টির মধ্যে আমি ২৫০ জন লোকের পেছনে-পেছনে চললাম। তাদের ভারি শরীর নরম ভিজে মাটিতে গর্ত করে যেতে লাগল, আর আমি দ্বিতীয় পদক্ষেপে তার মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে গিয়ে টলমল করে চলতে লাগলুম। মাইলের পর মাইল ধরে আমরা আমার মাথার চাইতে উঁচু হোগলার বনের ভিতর দিয়ে চললুম। হোগলার শক্ত ক্ষুরধার পাতার হাত থেকে আমার চোখ দুটিকে বাঁচাবার জন্যে এক হাত তুলে চলতে হচ্ছিল, তাই ঐ পিছল আর খানাখন্দ-ভরা জমিতে টাল ঠিক রেখে চলা আরও শক্ত হল।

আমি ফ্রেডির সাড়ে তিনমণী দেহের কর্ম-তৎপরতা দেখে প্রায়ই চমৎকৃত হতুম বটে, কিন্তু সেই রাত্রে যেমন আশ্চর্য হয়েছিলুম তেমন কোনো দিনই হই নি। এ কথা ঠিক যে সে একটু শক্ত জমিতে হাঁটছিল, আর আমি হাঁটছিলুম পাঁকের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে তাকে আমার চাইতে দেড় মণেরও বেশি দেহভার বইতে হচ্ছিল। তবু একবারও না থেমে আমাদের লোকের লাইনটা চলতেই লাগল।

আমরা রাত নটায় রওনা হয়েছিলুম। রাত দুটোর সময় আমি লাইন বরাবর ফ্রেডির কাছে জিগ্যেস করে পাঠালুম যে আমরা ঠিক দিকে যাচ্ছি কি না। এ-খবরটার জন্যে এই কারণে তোক পাঠাতে হল যে প্রথমে আমরা উত্তর দিকে চলেছিলুম বটে, কিন্তু ঘণ্টাখানেক হল তা ছেড়ে দিয়ে আমরা পূব-মুখে চলছিলুম। অনেকক্ষণ বাদে খবর ফিরে এল যে কাপ্তেন সাহেব বলেছেন যে সব ঠিক আছে।

আবার ঘণ্টা-দুই বাদে, বড় গাছের আর ঝোঁপ-ঝাড়ের আর কোথাও বা উঁচু ঘাসের জঙ্গল ঠেলে আমি খবর পাঠিয়ে ফ্রেডিকে জানালুম যে আমি একটা কথা বলতে তার কাছে আসছি, সে যেন সকলকে থামতে বলে। রওনা হবার আগেই সকলকে নিঃশব্দ থাকতে বলে দেওয়া হয়েছিল। সামনের দিকে যেতে আমি অত্যন্ত নীরব এবং ক্লান্ত এক লাইন লোকের পাশ দিয়ে গেলুম। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ ভিজে মাটিতে বসে পড়েছিল, কেউ-কেউ গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এই সারির আগায় এসে ফ্রেডি, অ্যান্ডারসন আর তাদের চারজন পথ-প্রদর্শককে দেখতে পেলুম। ফ্রেডি জিগ্যেস করল কিছু গোলমাল হয়েছে কি না–তার মানে, কেউ দলছাড়া হয়ে পড়েছে না কি। আমি বললুম যে লোকজন ঠিকই আছে, কিন্তু আর সবই গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছে–আমরা চক্রাকারে ঘুরে মরছি।

আমার জীবনের বেশির ভাগ আমি বনে-জঙ্গলে কাটিয়েছি, এবং সে-সব জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া অতি সহজ। তাই আমার দিক সম্বন্ধে এমন একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল যা দিনে আর রাত্রিতে সমান কাজ দেয়। প্রথম রওনা হবার সময় যে দিক পরিবর্তন করা হয়েছিল সেটাও যেমন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, দু-ঘন্টা আগে উত্তর থেকে পুব-দিকে ঘোরবার সময়ও সে কথাটা তেমনি স্পষ্ট বুঝেছিলুম। তাছাড়া, ঘন্টাখানেক আগে লক্ষ করেছিলুম যে আমরা একটা শিমুল গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছি যাতে একটা শকুনির বাসা রয়েছে, আর যখন আমি ফ্রেডিকে থামতে অনুরোধ করে খবর পাঠাই, তখন আমি আবার সেই গাছের তলায় এসেছি।

পথপ্রদর্শকের চারজনের মধ্যে দু-জন ছিল ভান্টু জাতের লোক, সুলতানার দলের ডাকাত। তারা সম্প্রতি হরিদ্বারের বাজারে গ্রেপ্তার হয়েছিল। এদের দেওয়া খবরের উপরেই এই অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরা বছর দুই ধরে মধ্যে-মধ্যে সুলতানার ঘাঁটিতে বাস করেছিল। এই রাত্রির কাজের পুরস্কার হিসেবে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে কথা দেওয়া হয়েছিল। আর দু-জন হল গোয়ালা। তারা সারা জীবন এই জঙ্গলে তাদের গরু চরিয়েছে, আর প্রতিদিন সুলতানাকে দুধের যোগান দিয়ে এসেছে। চারজনই পথ হারানোর কথা জোর করে অস্বীকার করল। কিন্তু ভাল করে চেপে ধরবার পর আমতা-আমতা করে শেষে স্বীকার করল যে পাহাড়টা দেখতে পেলে তাদের বুঝতে সুবিধে হত এই বাহিনীকে তারা কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এই অন্ধকার রাত্রে যখন ঘন কুয়াশা গাছগুলোর মাথা পর্যন্ত নেমে এসেছে, তখন যে পাহাড় সম্ভবত ত্রিশ মাইল দূরে রয়েছে, তা দেখতে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। কাজেই এখন এমন একটা ব্যাঘাত এসে পড়ল যা ফ্রেডির এত সুন্দরভাবে সাজানো পরিকল্পনাটা তো মাটি করে দেবেই, তাছাড়া–যেটা আরও দুঃখের কথা-সুলতানার কাছে আমাদের উপহাসের পাত্র করে তুলবে।

ঘাঁটিটাতে আচমকা হানা দেওয়াই আমাদের ফন্দি ছিল, আর তা করতে হলে অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাদের এত কাছে গিয়ে পড়া দরকার যেখান থেকে আমরা সেটাকে আঘাত হানতে পারি। পথপ্রদর্শকরা বলেছিল যে দিনের আলোয় ঘাঁটির কাছাকাছি যাওয়া এই দিক থেকে সম্ভব নয়, কেননা ঘাঁটির দক্ষিণে একটা বিস্তীর্ণ তৃণক্ষেত্রের সবটা দেখা যায় এমন একটা উঁচু গাছে মাচানের উপর দু-জন সান্ত্রী দিনরাত পাহারায় থাকে।

আমাদের গাইডরা খোলাখুলি ভাবে স্বীকার করেছে যে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে, এদিকে অন্ধকার আছে আর মোটে ঘণ্টাখানেক। তাছাড়া সবচেয়ে মুশকিল এই যে আমরা বুঝতেও পারছি না যে ঘাঁটিটা কত দূরে এবং কোন্ দিকে–এই অবস্থায় প্রতিটি মিনিট কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আচমকা আক্রমণ করতে পারার সম্ভাবনা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

তখন এই সংকট থেকে বেরোবার একটা উপায় আমার মাথায় এল। আমি তোক চারজনকে জিগ্যেস করলুম যে আমরা যে-মুখো হয়ে প্রথমে রওনা হয়েছিলুম সে-মুখো এমন কোনো নদী বা সুস্পষ্ট গো-পথ আছে কি না যা দেখে তারা দিক ঠিক করে নিতে পারে। তাতে তারা বলল যে ঘাঁটিটার দক্ষিণে মাইলখানে দূর দিয়ে একটা পুরনো কিন্তু স্পষ্ট গাড়ি চলার পথ আছে। ফ্রেডির কাছ থেকে যাবার সময় অনুমতি নিয়ে আমি দ্রুতবেগে এমন একদিকে চললুম যাতে আমার সঙ্গীরা সকলেই নিশ্চয় মনে করেছিল যে, সাত ঘণ্টা আগে যে রেল-লাইন ছেড়ে এসেছিলুম এখন আমরা তারই দিকে ফিরে চলেছি।

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল, জোরাল হাওয়ায় আকাশ থেকে মেঘ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল এবং সবে পূবদিক ফরসা হয়ে আসছিল। এমন সময় আমি গভীর একটা চাকার দাগ হঠাৎ পেয়ে গেলুম। এই তো সেই গাইডদের বলা অব্যবহৃত গাড়ির পথ! এটা দেখে তারা খুব আনন্দিত হল। আমি আগেই সিদ্ধান্ত করেছিলুম যে তারা ইচ্ছে করে জঙ্গলে পথ হারায় নি–এতে সেটা সমর্থিত হল। তারা আবার অগ্রণী হয়ে ওই পথ ধরে আমাদের মাইলখানেক নিয়ে গেল।

এখানে একটা পশু-চলাচলের পথ একে পার হয়ে চলে গিয়েছে। এই পথে আধমাইলটাক এগিয়ে গিয়ে আমরা এসে পড়লুম ফুট ত্রিশেক চওড়া, গভীর এবং ধীরস্রোতা একটি জলপ্রবাহের ধারে। পথটা নদী পার হয়ে যায়নি দেখে খুশি হলুম, কেননা তরাইয়ের এ-সব নদীকে আমার বড় ভয়–এদের তীরে এবং জলের গভীরে আমি প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ময়াল সাপদের লুকিয়ে থাকতে দেখেছি। পথটা নদীটার ডান পাড় ধরে কাঁধ-সমান উঁচু ঘাসের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে।

এই পথ ধরে কয়েকশো গজ এগিয়ে গিয়ে পথ প্রদর্শকরা গতিবেগ কমিয়ে দিল। তারা যেভাবে বাঁ দিকে তাকাতে লাগল তাতে বুঝলুম যে আমরা মাচানটাকে দেখতে পাওয়ার মত জায়গায় এসে পড়েছি। তখন দিনের ভরা আলো দেখা দিয়েছে, রোদ এসে গাছের মাথাগুলি ছুঁয়েছে। শিগগিরই সকলের আগেকার লোকটা গুঁড়ি মেরে বসে পড়ল। অন্য তিনজনও তাই করবার পর সে আমাদের এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল।

লাইন-বাঁধা লোকদের থেমে বসে পড়তে ইশারা করে ফ্রেডি অ্যাণ্ডারসন আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে প্রথম গাইডটির কাছে গেলুম। তার পাশে শুয়ে পড়ে, সে যেদিকে দেখাচ্ছিল সেদিকের ঘাসের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আমরা একটা মস্ত বড় গাছের উপকার ডালগুলির মধ্যে, মাটি থেকে ত্রিশ-চল্লিশ ফুট উঁচুতে তৈরি একটি মাচান দেখতে পেলুম।

সরাসরি তার ওপর সূর্যের আলো পড়েছে। তাতে মাচানের উপর দুটি লোককে দেখলুম। একজন তার ডান-কাঁধটা আমাদের দিকে ফিরিয়ে হুঁকো টানছে, অন্যজন হাঁটু গুটিয়ে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে। মাচানের গাছটা, একটা বড়-বড় গাছ এবং ঘাসে ভরা বনের একেবারে প্রান্তে, এবং তা থেকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা দেখা যায়।

গাইডরা বলল যে সুলতানার আস্তানা ওই বনের শ-তিনেক গজ ভিতরে।

আমরা যেখানে মাটিতে পড়ে ছিলুম, তারই কয়েক ফুট দূরে প্রায় কুড়ি গজ চওড়া একফালি ছোট ঘাস-ভরা জমি আমাদের ডানদিকের নদী থেকে আরম্ভ হয়ে দূরে ফাঁকা জায়গাটা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল যে খানিকটা পিছনে হটে গিয়ে নদী পার হওয়াই কর্তব্য, কিন্তু গাইডরা বলল যে সেটা সম্ভব হবে না। কারণ নদীটা এত গভীর যে হেঁটে পার হওয়া যাবে না, এবং অপর পারে চোরাবালি আছে।

বাকি রইল শুধু সমস্ত দলবল নিয়ে সান্ত্রী দু-জনের অলক্ষ্যে ঘোট ঘাসে ভরা ফালি জমিটা পার হবার অনিশ্চিত সম্ভাবনা। অথচ তারা যে-কেউ যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের দিকে তাকাতে পারে।

ফ্রেডির ছিল একটা মিলিটারি রিভলবার, অ্যান্ডারসন ছিলেন নিরস্ত। সমস্ত দলটার মধ্যে একা আমারই হাতে ছিল একটি রাইফেল। পুলিসদের হাতে ছিল ছিটে গুলি মারবার ১২-বোরের সাধারণ বন্দুক, যার কার্যকরী-পাল্লা হল ষাট থেকে আশি গজ।

কাজেই দলের মধ্যে একমাত্র আমার পক্ষেই আমার তখনকার অবস্থান থেকে ঐ দু-জন সান্ত্রীকে কায়দা করা সম্ভব ছিল। গুলি ছুঁড়লে তার শব্দ অবশ্য সুলতানার ঘাঁটিতে শোনা যাবে, কিন্তু আমাদের সঙ্গের ভান্টু দু-জনের মত হল এই যে, সান্ত্রীরা খবর নিয়ে ঘাঁটিতে না গেলে তাদের খোঁজ-খবর করতে ঘাঁটি থেকে লোক পাঠানো হবে। তারা মনে করছিল যে ততক্ষণে আমাদের পক্ষে ঘাঁটিটা ঘিরে ফেলা সম্ভব হবে।

মাচানের উপরকার লোকদুটো ছিল দস্যু, তার উপর খুব সম্ভবত খুনীও। আমিও আমার হাতের রাইফেলটি দিয়ে একজনের হাত থেকে কোটি আর অন্যজনের জুতো থেকে গোড়ালিটি খসিয়ে দিতে পারতুম, তাদের গায়ে আঁচড়টিও লাগত না। এ সবই ঠিক।

কিন্তু বিনা উত্তেজনায়–অথবা উত্তেজনার যে-কোনো অবস্থাতেই–মানুষকে গুলি করে মারা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমি এই বিকল্প প্রস্তাবটি করলুম; ফ্রেডি আমাকে অনুমতি দিক, আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে লোক দু-জনের কাছে চলে যাই। যাওয়া খুব সহজ হবে, কারণ বড় গাছের আর লম্বা ঘাসের জঙ্গলটা একেবারে মাচানের গাছটা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, আর সারারাত বৃষ্টি হওয়াতে ভিজে সপসপে হয়েছিল। আমি গিয়ে লোকদুটোর সঙ্গে মাচানে থাকব, ততক্ষণে ফ্রেডি তার লোকজন নিয়ে তার কাজ সারবে।

ফ্রেডি প্রথমে আপত্তি তুলেছিল, কেননা মাচানের লোকদুটোর নাগালের মধ্যেই দুটো বন্দুক ছিল। কিন্তু শেষটায় সে মত দিতেই আমি আর কালবিলম্ব না করে ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে চলতে লাগলুম। ভান্টু দু-জন বলেছিল যে সান্ত্রী বদলের সময় হয়ে এসেছে।

গাছটা পর্যন্ত যতটা পথ, তার এক-তৃতীয়াংশ যেতেই পিছনে একটা শব্দ শুনে ফিরে দেখি যে অ্যান্ডারসন তাড়াতাড়ি করে আমার পিছনে আসছেন। তাঁতে আর ফ্রেডিতে কী কথা হয়েছিল, জানি না। দু-জনেই আমার পরম বন্ধু ছিলেন।

সে যাই হক, অ্যাণ্ডারসন আমার সঙ্গে যাবার জন্যে দৃঢ়সঙ্কল্প। তিনি স্বীকার করলেন যে তিনি বনের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে চলতে পারেন না, মাচানের লোকরা খুব সম্ভবত তার শব্দ শুনতে আর তাকে দেখতে পাবে, এবং নিরস্ত্র বলে তার পক্ষে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তবুও এবং তা সত্ত্বেও তিনি আমাকে একা যেতে দেবেনই না।

ক্লাইড নদীর ওপারের মানুষ যখন গোঁ ধরে বসে তখন সে কেননা খচ্চরের চাইতেও একগুঁয়ে হয়। হতাশ হয়ে আমি ফ্রেডির সাহায্য চাইবার জন্যে ফিরে চললুম। কিন্তু ইতিমধ্যেই ভাববার সময় পেয়ে ফ্রেডি আমাকে অনুমতি দেবার জন্যে অনুতপ্ত হয়ে উঠেছিল (পরে শুনেছি যে ভান্টুরা তাকে বলেছিল যে মাচানের লোক দু-জনেরই হাতের তাক খুব ভাল)। আমাদের ফিরতে দেখে সে তার বাহিনীকে অগ্রসর হবার আদেশ দিল।

পঞ্চাশ জন কি তারও বেশি লোক ভোলা জায়গায় ফালিটা পার হয়েছে, আর আমরা যারা এগিয়ে আছি তারা ঘাঁটির দু-শশা গজের মধ্যে এসে পড়েছি, এমন সময় অতি-উৎসাহী একটি ছোকরা কনস্টেবল মাচানটাকে দেখতে পেয়ে বন্দুক ছুঁড়ে বসল। বিদ্যুৎ-চমকের মত লোকদুটো মাচান থেকে নেমে এসে গাছের গোড়ায় বাঁধা ঘোড়ায় চেপে আস্তানার দিকে ছুট লাগাল।

চুপচাপ থাকবার প্রয়োজন রইল না আর। এমন গলায় ফ্রেডি আক্রমণের আদেশ দিল যা মাইকের সাহায্যে বাড়াবার দরকার হয় না। একটুও না ফাঁক রেখে সারি বেঁধে আমরা ঝড়ের মত গিয়ে ঘাঁটির উপর পড়লুম। দেখি, সব ফাঁকা।

ঘাঁটিটা ছিল একটা ঘাসে-ঢাকা ঢিপির উপর। তাতে ছিল তিনটি তাঁবু, আর ঘাস দিয়ে তৈরি একটি রান্নাঘর। তাঁবুগুলির একটি ছিল ভাড়ারঘর। তাতে আটা, চাল, ডাল আর চিনির বস্তা, ঘিয়ের টিন, টোটার বাসের দুটো স্তূপ (যাতে হয়তো কয়েক হাজার ১২-বোরের টোটা ছিল), আর খাপে-ভরা এগারোটা বন্দুক বোঝাই ছিল। অন্য দুটো তাবুতে শোবার জায়গা, তাতে কম্বল আর পরনের নানা জিনিস ছড়ানো ছিল। রান্নাঘরের কাছে একটা গাছের ডালে তিনটে ছাল-ছাড়ানো পাঁঠা ঝুলছিল।

সান্ত্রী দু-জন হঠাৎ আস্তানায় ফিরে আসায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। তার ফলে ডাকাতরা অনেকে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় পালিয়ে গিয়েছিল। ঘাঁটির চারদিকে যে লম্বা-লম্বা ঘাস ছিল তার মধ্যে কিছুসংখ্যক ডাকাতের লুকিয়ে থাকা সম্ভব, এই মনে করে আমাদের লোকদের লম্বা একটা লাইন করে দাঁড়াতে বলা হল। উদ্দেশ্য এই যে, যেদিকে হার্বার্ট তার অশ্বারোহী পুলিসদের নিয়ে পাহারায় রয়েছে, অনেকখানি জায়গা জুড়ে বন ঠেঙিয়ে সেইদিকে যাওয়া হবে।

লাইনটা যতক্ষণ সাজানো হচ্ছিল, ততক্ষণ আমি টিপিটা ঘুরে দেখলুম। ঘাঁটির কাছে একটা নালায় দশ বারজন লোকের খালি পায়ের ছাপ দেখে আমি ফ্রেডির কাছে প্রস্তাব করলুম যে সেগুলো অনুসরণ করে দেখে এলে হয় সেগুলো কোথায় গিয়েছে। নালাটা পনের ফুট চওড়া আর পাঁচ ফুট গভীর। ফ্রেডি, অ্যাণ্ডাসন আর আমি সেটা ধরে শ-দুই গজ গিয়ে খানিকটা নুড়ি-ভরা জায়গা পেলুম, সেখানে পায়ের ছাপ আর দেখা গেল না।

নুড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার ও-ধারে নালাটা ছড়িয়ে গিয়েছে, আর তার বাঁ পাড়ে, আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলুম তার কাছেই, বহুঁকাণ্ডবিশিষ্ট একটি বিশাল বটগাছ রয়েছে। এর কাণ্ডগুলো একটা বন সৃষ্টি করেছিল, শাখা-প্রশাখাগুলো প্রায় মাটি পর্যন্ত ঝুঁকে পড়েছিল।

আমার মনে হল যে লুকিয়ে থাকবার পক্ষে এই গাছটা বড় সুবিধের জায়গা। তাই, কিনারার দিকে গিয়ে আমি উপরে উঠবার চেষ্টা করতে লাগলুম। পাড় এখানে আমার চিবুক সমান। হাতে ধরবার মত সেখানে কিছু ছিল না। যতবার লাথি মেরে দেওয়ালে পা রাখবার জায়গা করলুম, ততবারই সেটা ধসে যেতে লাগল। তারপর আমি সবে ভাবছি যে এগিয়ে গিয়ে যেখানে নালাটা ছড়িয়ে গিয়েছে সে পাড়ে উঠব, এমন সময় গুলিবৃষ্টির আর সেইসঙ্গে চিৎকারের শব্দ হল ঘাঁটির ওখানে।

যে পথে এসেছিলুম, ছুটে সেই পথে ফিরে গিয়ে ঘাঁটির কাছে এসে দেখি যে। একজন হাবিলদারের বুকে গুলি বিঁধেছে এবং তারই কাছে একফালি লেংটি পরনে এক ডাকাত দু-পায়ে গুলি লেগে পড়ে আছে।

হাবিলদারটি একটি গাছে পিঠ দিয়ে বসে ছিল। তার শার্টের বুকটা খোলা, বুকের বাঁ-দিকে একটুখানি রক্ত দেখা যাচ্ছে।

ফ্রেডি একটা ফ্লাস্ক বের করে সেটা হাবিলদারের মুখে ঠেকাল, কিন্তু লোকটি মাথা নেড়ে সেটাকে সরিয়ে দিলে; বললে, এ তো মদ। এ তো আমি খেতে পারি না! পীড়াপীড়ি করায় সে বললে, ‘জীবনভোর আমি মদ খাই নি, এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে যাবার সময় মুখে মদের গন্ধ নিয়ে যেতে পারব না। আমার তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল চাই। তার ভাই কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। একজন টুপি খুলে তাকে দিল, সেটা নিয়ে সে ছুটে সেই নদীতে চলে গেল, যেটা আমাদের চলাচলের বাধা সৃষ্টি করেছিল।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই খানিকটা নোংরা জল নিয়ে সে ফিরে আসতেই আহত ব্যক্তি তা আগ্রহের সঙ্গে পান করল। তার ক্ষতটা হয়েছিল ছিটে গুলিতে। তার চামড়ার নিচে হাতড়ে সেটাকে না পেয়ে আমি বললুম, হাবিলদার সাহেব! মনটাকে চাঙা রাখুন, নাজিরাবাদের ডাক্তারবাবু আপনাকে সারিয়ে তুলবেন। সে হাসিমুখটি তুলে আমাকে বলল, ‘সাহেব, আমি মনকে চাঙ্গা রাখব কিন্তু কোনো ডাক্তার আমাকে সারিয়ে তুলতে পারবে না। . ডাকাতটার কিন্তু মদ খাওয়ায় কোনো বাধা ছিল না। সে কয়েক ঢোকেই ফ্লাস্কটাকে শেষ করে ফেলল। ওটা তার খুব প্রয়োজন ছিল, কেননা তাকে খুব কাছে থেকে একটা ১২-বোর বন্দুক দিয়ে গুলি করা হয়েছিল।

সুলতানার আস্তানা থেকে জিনিস-পত্র নিয়ে দুটো স্ট্রেচার বানানো হল। সকলে স্বেচ্ছায় সে দুটোকে তুলে নিল-উঁচু জাতের হাবিলদার আর নীচজাতীয় ডাকাতদের মধ্যে কোনো প্রভেদ করা হল না। অতিরিক্ত কয়েকজন লোকসহ কয়েকজন বাহক স্ট্রেচার-দুটো নিয়ে বনের মধ্য দিয়ে ছুটল বার মাইল দূরের নাজিরাবাদ হাসপাতালের দিকে। রক্তক্ষয় এবং অভিঘাতের ফলে ডাকাতটা মারা গেল, আর হাবিলদার মরল হাসপাতালে ভর্তি হবার কয়েক মিনিট পরই।

বন হাঁকানো আর হল না। হার্বাটকে কিছু করতে হয় নি, কেননা অশ্বারোহীদের সমাবেশের কথা সুলতানা জানতে পেরে গিয়েছিল, তাই কোনো ডাকাত হার্বাটের পাহারা-দেওয়া জায়গা পার হবার চেষ্টা করে নি। কাজেই আমাদের সযত্ন-পরিকল্পিত আক্রমণ কারও দোষ না থাকলেও পণ্ড হয়ে গেল।

লাভের মধ্যে শুধু কয়েকটা বন্দুক বাদে সুলতানার সম্পূর্ণ আস্তানাটা, আর দু-জন মানুষের মৃত্যু। একজন ছিল একটি গরিব লোক যে বন্দী থেকে-থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে স্বাধীনতা পেতে চেয়েছিল, এবং তার পক্ষে জীবিকার্জনের যে একমাত্র উপায় খোলা ছিল সেইটিই সে অবলম্বন করেছিল।

নাজিরাবাদের দুর্গে একটি বিধবা হয়তো তার জন্যে চোখের জল ফেলবে। অপর লোকটি ছিল উপরওয়ালাদের শ্রদ্ধা এবং আপন লোকদের ভালবাসার পাত্র। তার বিধবার যত্ন নেওয়া হবে। সে একটা নীতির জন্যে বীরের মত প্রাণ দিয়েছে, কারণ যে-মদ স্পর্শ করে সে তার ঠোঁটকে কলুষিত করতে চায় নি, সেই মদ খেলে সে নিশ্চয় অপারেশন টেবিলে ওঠা পর্যন্ত বেঁচে থাকত।

এই অভিযানের তিনদিন বাদে ফ্রেডি ডাকাত সর্দারের কাছ থেকে এক চিঠি পেল। তাকে সুলতানা লিখেছে যে পুলিস বাহিনীর গুলি-বারুদের অভাব হওয়াতেই বোধহয় তার ঘাঁটিতে হানা দেবার দরকার হয়েছিল, এ বড় দুঃখের কথা। যাই হক, ভবিষ্যতে ফ্রেডি যদি এরকম কোনো প্রয়োজনের কথা তাকে জানায়, তাহলে সুলতানা সানন্দে তাকে গুলি-বারুদ সরবরাহ করবে।

সুলতানার বন্দুক আর গুলি-গোলা পাওয়াটা ফ্রেডির পক্ষে একটা মাথার ঘায়ের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ-বিষয়ে খুব কড়া হুকুম প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু যে অঞ্চল সুলতানার কর্মক্ষেত্র, সেখানকার প্রত্যেক লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানদার আর বন্দুকের মালিকই যে সরকারের বিরাগভাজন হবার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক ছিল, সেটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। কেননা সুলতানার দাবি না মেনে নিলে তার বাড়িতে নিশ্চয় ডাকাত পড়বে এবং সম্ভবত তার গলাটিও কাটা যাবে। কাজেই অস্ত্র আর গোলাগুলি দিতে চাওয়াটা সুলতানার পক্ষে মিথ্যে জাঁক মাত্র নয়। ডাকাত-দলের সর্দারটি পুলিশ-বাহিনীর অধিনায়ককে এর চাইতে বেশী আঘাত আর কী হানবে!

সুলতানার গোপন আচ্ছাটি গিয়েছে, তারাই আর ভাবরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তাকে নাকাল করে তোলা হয়েছে, তার দল কমে চল্লিশ জনে দাঁড়িয়েছে। সকলেই অবশ্য সম্পূর্ণ সশস্ত্র, কেননা তারা অবিলম্বেই তাদের অস্ত্র-শস্ত্রের ক্ষতিপূরণ করে নিয়েছিল।

এমন অবস্থায় ফ্রেডির মনে হল যে সুলতানার ধরা দেবার সময় হয়েছে। সে ব্যক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে, এই শর্তে সরকারের অনুমতি নিয়ে সে সুলতানাকে বলে পাঠাল যে সুলতানা যেন তার সুবিধেমত যে-কোনো সময়ে আর যে-কোনো জায়গায় ফ্রেডির সঙ্গে দেখা করে। সুলতানা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সাক্ষাতের স্থান, তারিখ ও সময় জানিয়ে দিল, এবং শর্ত করল যে দু-পক্ষই একা এবং নিরস্ত্র অবস্থায় সাক্ষাৎকারের স্থানে আসবে।

নির্দিষ্ট দিনে যখন ফ্রেডি বনে ঘেরা একটা বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গার মধ্যে পা বাড়িয়ে বেরিয়ে এল, তখনই তার ওধার থেকে সুলতানাও বেরিয়ে এল। ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে একটা বড় গাছ ছিল। বন্ধুভাবেই দুজনের সাক্ষাৎ হল। যাঁরা প্রাচ্য দেশে বাস করেছেন তাঁরা সবাই তাই আশা করবেন। একজন হল কর্মদক্ষ, খোশ মেজাজী, পর্বত-প্রমাণ মানুষ, দেশের সরকার তার পেছনে রয়েছে। অপরজন হল একটি ছিমছাম, ছোটখাট মানুষ, তার মাথার জন্যে একটা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

দু-জনে গিয়ে গাছটির ছায়ায় বসতেই সুলতানা একটি তরমুজ বের করে হেসে বলল যে ফ্রেডি স্বচ্ছন্দে সেটার ভাগ নিতে পারে। যাই হক সাক্ষাৎকারে কোনো ফল হল না, কারণ ফ্রেডির বিনা শর্তে ধরা দেবার প্রস্তাবে সুলতানা রাজী হতে পারল না। এই সাক্ষাৎকারের সময়েই সুলতানা ফ্রেডিকে অনুরোধ করল যে ফ্রেডি যেন অনর্থক ঝুঁকি না নেয়। সে বলল যে সেই ঘাঁটিতে হানার দিন সে দশ জন সম্পূর্ণ সশস্ত্র লোককে নিয়ে একটা বটগাছে লুকিয়ে ছিল। সেখান থেকে সে লক্ষ করছিল যে ফ্রেডি আর দু-জন সাহেব নালা ধরে-ধরে গাছটার দিকে আসছিল। সুলতানা বলল, ‘যে সাহেবটি পাড়ে উঠবার চেষ্টা করছিল, সে তাতে সফল হলে তোমাদের তিনজনকেই গুলি করে মারবার দরকার হত।’

মোটায় আর রোগায় এই লড়াইয়ের শেষ অঙ্ক এবার মঞ্চস্থ করতে হবে বলে ফ্রেডি সেটা দেখবার এবং তাতে অংশ গ্রহণ করবার জন্যে উইণ্ডহ্যামকে আর আমাকে ডেকে পাঠাল। সুলতানা আর তার অবশিষ্ট দলবল তখন ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে নাজিরাবাদ অঞ্চলের এক বনের মাঝখানে এক গোশালায় আড্ডা গেড়েছে। ফ্রেডির ফন্দি হল নৌকো করে তার সমস্ত বাহিনী নিয়ে গঙ্গানদী ধরে গিয়ে সুবিধেমত একটা জায়গায় নেমে গোশালাটা ঘেরাও করা। আগেরকারটার মত এ অভিযানও রাত্রিতেই হবে। তবে, এবার পূর্ণিমার রাতে হানা দেওয়াই ঠিক হল।

নির্বাচিত দিনে, তিনশো জন লোকের গোটা বাহিনীটা এবং ফ্রেডির এক কি-রকম ভাই, উইণ্ডহ্যাম আর আমি রাত হতে-হতেই এসে দশটি দেশী নৌকোয় উঠে বসলুম।

নৌকোগুলি হরিদ্বারের কয়েক মাইল দক্ষিণে গঙ্গার পশ্চিম কুলে একটি নির্জন জায়গায় জড়ো হয়েছিল। আমি প্রথম নৌকোখানায় ছিলুম। সবই বেশ চলছিল। যেতে যেতে আমরা নদী পার হয়ে পূর্ব তীরে গিয়ে একটি খালে ঢুকলুম। শুকনো ডাঙায় ছাড়া অন্য জায়গায় আমার জীবনে যতসব ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছে, এইখানে নৌকো করে যাওয়াটা তার অন্যতম। কয়েকশো গজ পর্যন্ত নৌকোটা চন্দ্রালোকিত এক বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর দিয়ে চলল, তার বুকে এমন একটি ছোট ঢেউও নেই যাতে তীরের গাছের ছায়াকে আঁকা-বাঁকা করে দিতে পারে। ক্রমে খালটা সরু হয়ে আসতে লাগল, নৌকোর গতিবেগও বেড়ে চলল। সঙ্গে-সঙ্গে দুরে জল ছুটে চলবার শব্দও কানে এল।

গঙ্গার পাশের দিকের এ-সব খালে আমি অনেক সময়ই মাছ ধরেছি, কেননা মাছেরা মূল ধারার চাইতে এগুলোকেই বেশী পছন্দ করে। আমরা দ্রুতবেগে কতকগুলি নদী প্রপাতের দিকে এগিয়ে চলেছিলুম। মাঝিরা যে সে-গুলোর মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রাণ এবং নৌকো খোয়াবার ঝুঁকি নিচ্ছে তাতে তাদের সাহসের পরিচয় পেয়ে আমি বিস্মিত হলুম।

অন্য ন-খানা নৌকোর মত এইখানাও মাল-বওয়া ভোলা ভড়, গঙ্গার অবাধ বুকে চলাফেরা করবার পক্ষে খুব উপযুক্ত। কিন্তু এখানে এই সংকীর্ণ খরস্রোতা জল প্রণালীতে এরকম জবড়জং নৌকোকে চালানো শক্ত। জলে ডোবা পাথরের সঙ্গে এর তলাকার তক্তাগুলো অনবরত সজোরে ধাক্কা খেতে লাগল, আর প্রতিবারই ভয় হতে লাগল যে এইবারই নৌকোর দফা-রফা হবে। নদীর পাথুরে কিনারা থেকে দূরে রেখে নদীর মাঝখান দিয়ে নৌকোটাকে নিয়ে না গেলে নৌকা ডুবে যাবে, এই বলে মাঝিটি দাঁড়ীদের সতর্ক করে দিচ্ছিল বটে, কিন্তু তাতে আমার ভয় মোটেই কমল না। কেননা নৌকোটা তখন আড়ভাবে ভেসে চলেছিল, আর যতবার সেটা তলায় ঠেকে যাচ্ছিল ততবারই ডুবে যাবার আশঙ্কা হচ্ছিল।

কিন্তু বিভীষিকাও চিরস্থায়ী হতে পারে না। এটা যে দীর্ঘস্থায়ী হল, এর কারণ আমাদের কুড়ি মাইল এইভাবে যেতে হল, বেশীর ভাগই উঁচু-নিচু জলের উপর দিয়ে। বিভীষিকার শেষ হল যখন একজন দাঁড়ী একটা লম্বা দড়ির এক মাথা হাতে নিয়ে খালের বাঁদিককার পাড়ে লাফিয়ে পড়ল আর সেটাকে একটা গাছে বেঁধে ফেলল। একটার পর একটা নৌকো আমাদের ছাড়িয়ে গিয়ে থামতে লাগল। শেষে দশটা নৌকোই বাঁধা হয়ে গেল।

পুলিস-বাহিনী এক বালুবেলায় নেমে পড়ল। নৌকোর কর্কশ কাঠের খোঁচায় ওদের দেহ কেটে আর ছড়ে গিয়েছিল। তার শুশ্রূষা করা হল। তারপর নৌকোওয়ালাদের আরও পাঁচ মাইল ভাঁটিতে নৌকো নিয়ে গিয়ে পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় থাকতে বলা হল।

এরপর আমরা একজনের পিছনে আর একজন, এইভাবে সারি বেঁধে আধ মাইল লম্বা একটা হোগলা-বন ঠেলে এগোতে লাগলুম। পায়ে হেঁটে এমন ঘন হোগলা-বন ভেদ করবার চেষ্টা আমি আর কখনও করি নি। হোগলাগুলো দশ থেকে বার ফুট উঁচু। নদীর কুয়াশা আর শিশিরের চাপে সেগুলো নুয়ে পড়েছিল। তার ভিতর দিয়ে শ-খানেক গজ যেতেই আমাদের গা পর্যন্ত ভিজে গেল।

শেষে হোগলা-বনের ওধারে পৌঁছে দেখি যে সামনেই এক বিস্তীর্ণ জলরাশি। মনে হল সেটা গঙ্গার কোনও পুরনো খাত হবে। এই বাধা পার হবার সহজ উপায় যে কি, তা খুঁজে দেখবার জন্যে ডান-দিকে আর বাঁ-দিকে নোক পাঠানো হল। ডানদিক থেকে লোকরা আগে ফিরে এসে জানাল যে আমাদের ওখান থেকে সিকি মাইল দূরে এই হ্রদটা সরু হয়ে এসেছে, এবং সেখান থেকে একটি খরস্রোতা নদী বেরিয়ে গিয়ে যে খাল দিয়ে আমরা এসেছি তাতে গিয়ে পড়েছে। শিগগিরই অন্য দলটিও ফিরে এসে খবর দিল যে হ্রদটির অপর প্রান্তে একটি নদী এসে পড়েছে, সেটি হেঁটে পার হওয়া যাবে না। এখন স্পষ্টই বোঝা গেল, দৈবেই হক, বা ওদের ইচ্ছেতেই হক, মাঝিরা আমাদের একটি দ্বীপে ফেলে রেখে চলে গেছে।

আমাদের নৌকোগুলো চলে গিয়েছে, দিনের আলো হতেও বেশী দেরি নেই। এ-অবস্থায় একটা কিছু করা দরকার। তাই আমরা ঐ বিস্তীর্ণ জলরাশির শেষ প্রান্তে দেখতে গেলুম যে সেখান থেকে দুই খালের সংযোগস্থলের মধ্যে কোনো জায়গায় পার হওয়া চলবে কি না। যেখানে জলরাশি সংকীর্ণ হয়ে এসে জলস্রোতটা আরম্ভ হয়েছে, সেখানে পার হওয়া সম্ভব বলে মনে হল। সে জায়গাটার উজানে বিশ ফুট গভীর, আর ভাটির দিকে উন্মত্ত এক জলপ্রবাহ ছুটে চলছে।

আমরা যখন সবাই সেই খরস্রোত জলরাশির দিকে চেয়ে জল্পনা-কল্পনা করছি যে কেউ এটা পার হতে পারবে কি না, ততক্ষণে উইণ্ডহ্যাম তার পোশাক খুলে ফেলেছেন। আমি মন্তব্য করলুম যে এটা করার আর দরকার ছিল না, কেননা এমনিতেই তিনি ভিজে সপসপে হয়ে আছেন। তিনি বললেন যে তিনি ভাবছেন তার প্রাণ বাঁচাবার কথা,-পোশাক বাঁচাবার কথা নয়।

সমস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে, শার্টটা দিয়ে সবটা পুটলি বেঁধে সেটাকে ভাল করে মাথার উপর বসিয়ে তিনি একজন অল্পবয়সী, লম্বা-চওড়া কনস্টেবলকে হাতের কাছে পেয়ে তার হাত ধরে ফেলে বললেন, আমার সঙ্গে এস।

খোদ কমিশনার সাহেবের সঙ্গে ডুবে মরবার সম্মান লাভের জন্যে নির্বাচিত হয়ে ছোকরা হকচকিয়ে গিয়ে আর কিছু বলতে পারল না। দু-জনে হাত-ধরাধরি করে একসঙ্গে জলে নামল।

যতক্ষণ তাদের পার হতে দেখছিলুম, ততক্ষণ আমরা কেউ নিঃশ্বাস ফেলি নি বোধহয়। জল কখনও তাদের কোমর পর্যন্ত, কখনও বা বগল পর্যন্ত উঠছিল। মনে হতে লাগল যে, জলের ধাক্কায় ভেসে যাবে, গিয়ে পড়বেই পড়বে, নিচের মত্ত জলস্রোতের মধ্যে। কোনোমতেই রক্ষে নেই ওদের। আর, নিচে পড়লে কোনো মানুষেরই রক্ষা নেই, তা সে যত বড় সাঁতারুই হক না কেন।

সাহসী লোক দু-জন–একজন হলেন দলের মধ্যে সব চাইতে বয়স্ক, অপর জন বোধহয় সব চাইতে বয়সে ছোট–অটলভাবে যুঝতে-যুঝতে এগিয়ে চললেন। শেষে যখন তারা ধস্তাধস্তি করে ওপারে উঠে পড়লেন, তখন দর্শকদের বুক থেকে স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চুপ করে থাকবার হুকুম ছিল তাই, নয় তো এর জন্যে এমন একটা হর্ষধ্বনি উঠত যা কুড়ি মাইল দূরে হরিদ্বারেও শোনা যেতে পারত। দু-জন যখন পেরেছে, তখন তিনশো জনও যেতে পারবে। কাজেই মানুষের একটা শিকল করা হল। মধ্যে-মধ্যে তার দু-একটা মানুষের পা ফসকে গেলেও গোটা সারিটা মোটের উপর অটুট রইল, এবং সমস্ত দলটা নিরাপদে গিয়ে অপর তীরে উঠল।

এখানে ফ্রেডির বিশ্বস্ততম গোয়েন্দাদের একজন এসে দেখা করল। উদীয়মান সূর্যের দিকে দেখিয়ে সে বলল যে আমরা বড় দেরিতে এসে পৌঁছেছি, কারণ ও অঞ্চলের রাখালদের অগোচরে এত বড় একটা বাহিনীর পক্ষে বন পর্যন্ত বিস্তৃত ফাঁকা জায়গাটা পার হওয়া এখন অসম্ভব। কাজেই আমাদের আবার দ্বীপটিতে ফিরে না গিয়ে উপায় নেই। তা-ই করা হল। তবে, এ-পার থেকে ও-পারে যাওয়াটা, ও-পার থেকে এ-পারে আসার মত অতটা কষ্টকর হল না।

হোগলা-বনে ফিরে এসে প্রথম কাজ হল পোশাক শুকিয়ে নেওয়া। সেটা শিগগিরই হয়ে গেল, কেননা, রোদ ততক্ষণে তেতে উঠেছে। গা আবার যখন শুকনো হল, গরম হল, তখন ফ্রেডি তার পেল্লায় ঝুলি থেকে একটি মুরগি আর একখানা পাউরুটি বের করল। গঙ্গার ঠাণ্ডা জলে চুবুনি খাওয়া সত্ত্বেও সে-সবের কিছুমাত্র ‘অনাদর করা হল না। আমি যখন-তখন যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারি, তাই বালির মধ্যে একটি নিচু জায়গায় শুয়ে পড়লুম। প্রবল হাঁচির শব্দে যখন জেগে উঠলুম, তখন দিন প্রায় কেটে গিয়েছে।

সঙ্গীদের কাছে ফিরে এসে দেখি যে তারা তিনজনই কম-বেশি ‘হে-ফিভার’– “ (Hay fever) রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যে হোগলাবনে আমরা ছিলুম, সে-গুলোর মঞ্জরী হয়। ভোরবেলা আমরা যাবার সময় সেগুলো জলে ভিজে ছিল, কিন্তু তা গরম রোদ পেয়ে শুকিয়ে গিয়ে ফুলে উঠেছিল। আমার সঙ্গীরা যখন তার মধ্যে ঘুরে-ঘুরে বিশ্রামের জন্যে ঠাণ্ডা জায়গা খুঁজছিলেন, তখন তাদের ধাক্কা লেগে পরাগ ঝরে পড়েছিল আর সেই পরাগ নাকে ঢুকে তাদের হে-ফিভার হয়েছিল। ভারতীয়দের এ অসুখ হয় না, আমার নিজেরও কখনও হয় নি। এই রোগে কাউকে ভুগতে এই আমি প্রথম দেখলুম। যা দেখলুম তাতে আমি ভয় পেয়ে গেলুম।

ফ্রেডির আত্মীয়টি একজন চা-কর। ছুটিতে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তার অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। চোখ দুটি দিয়ে জল গড়াচ্ছে, আর তা এমন ফুলে উঠেছে যে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেন না, নাক থেকে জল ঝরছে। ফ্রেডি একটু একটু দেখতে পাচ্ছে বটে, কিন্তু তার হাঁচির আর কামাই নেই। আর, ফ্রেডি যখনই হাঁচে, বসুন্ধরা তখনই কম্পমানা হন। শক্ত-সমর্থ অভিজ্ঞ যোদ্ধা উইণ্ডহ্যাম মুখে বলেছেন যে তার কিচ্ছু হয় নি, কিন্তু রুমালটা চোখে আর নাকে না দিয়ে পারছেন না।

খোলা নৌকোর মধ্যে ধোপার আছাড় খেতে-খেতে এতখানি আসা, তারপর নির্জন এক দ্বীপে পরিত্যক্ত হয়ে থাকা, তার উপর আবার প্রাণ হাতে নিয়ে বারবার গর্জমান খরস্রোত পার হওয়া–এতেও যথেষ্ট হয় নি, এতক্ষণে ষোলকলা পূর্ণ হল। অন্ধ হয়ে যাবার ভয় আছে এমন তিনজন লোক আর তিনশো সিপাইকে নিয়ে হরিদ্বারে ফিরে যেতে হবে এই সম্ভাবনার কথা ভাবতেই আমার গা হিম হয়ে গেল যে গঙ্গার বরফের মত ঠাণ্ডা জল পার হয়ে আসবার সময়ও তেমন হয় নি।

যাই হক, সন্ধে হবার সঙ্গে-সঙ্গেই রোগীদের অবস্থা একটু ভাল দেখে ভারি স্বস্তি পেলুম। তারপর যখন আবার তৃতীয়বার নদী পার হলুম, তখন ফ্রেডি আর উইণ্ডহ্যাম সেরে উঠেছেন, আর অন্য ভদ্রলোকটিও চোখে এতটা দেখতে পাচ্ছেন যে তাঁকে আর বলে দিতে হচ্ছে না যে সামনে পাথর আছে, পা তুলতে হবে।

ফ্রেডির গুপ্তচর একজন গাইডকে নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। তারা আমাদের খানিকটা ফাঁকা জায়গার উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা শ-খানেক গজ চওড়া শুকনো জল-প্রণালীর মুখের কাছে হাজির করল।

তখন সবে চাঁদ উঠেছে, প্রায় দিনের আলোয় যেমন, সেইরকম সব দেখা যাচ্ছে। এমন সময় বাঁক ঘুরতেই আমরা একটা হাতির একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলুম। এই এলাকায় একটা গুণ্ডা হাতি আছে শুনেছিলুম, ইনিই তিনি। গজদন্তদুটি চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে, দুই কান ছড়িয়ে সজোরে চিৎকার করতে-করতে সে আসছে।

পথপ্রদর্শক বলল যে হাতিটা বেজায় বদমেজাজী, অনেক লোককে মেরেছে, আমাদের মধ্যেও কয়েকজনকে নিশ্চয় মারবে–তাতে পরিস্থিতিটা আরও ঘোরালো হয়ে উঠল। প্রথমে মনে হল যে গুণ্ডাটা আমাদের পথ-প্রদর্শকের ভবিষ্যদ্বাণীকে সফল করে তুলবে, কেননা সে শুড় তুলে খানিকটা এগিয়ে এল। তারপর সে ঘুরে গিয়ে তীর ধরে ছুটতে-ছুটতে আর চেঁচাতে-চেঁচাতে জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিল।

নালাটা ধরে আরও মাইল-খানেক এগিয়ে গিয়ে একটা পথের মত পেলুম-পথপ্রদর্শক বললে, জঙ্গলে আগুন লাগার ফলে পথটা সৃষ্ট হয়েছে। এখানে হাঁটতে বেশ আরাম হল, কেননা পায়ের তলায় কচি ছোট-ছোট ঘাস পেলুম। পাতায়-পাতায় চাঁদের আলো ঝিকমিক করছিল, তা আমার মনকে কাজের কথা ভুলিয়ে দিয়ে অরণ্যের সৌন্দর্যে মাতিয়ে দিল। একটা পাতা-ঝরা গাছে খুব উঁচুতে বসে একটা বুড়ো ময়ুর রাতের আকাশে তার সতর্কতাসূচক ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। খানিকটা পোড়া ঘাসের কাছাকাছি আসতেই দেখলুম যে দুটো চিতা পথটার উপর বেরিয়ে এসে আমাদের দেখতে পেয়ে শোভন ভঙ্গীতে লাফ দিয়ে ছায়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

যতক্ষণ খাল দিয়ে আসছিলুম, ততক্ষণ আমি যেন ঠিক আমার নিজস্ব পরিবেশের মধ্যে ছিলাম না। (কিন্তু এখন আমি জানি যে আমাদের ক্ষতি করার মতলব হাতিটার ছিল না, সে শুধু কৌতূহলী হয়েছিল) এবং যে ময়ুরটা বনের প্রাণীদের বিপদের কথা জানিয়ে দিচ্ছিল সেই ময়ুরটাকে আর সবচেয়ে ছায়ায় মিলিয়ে-যাওয়া চিতাদুটোকে দেখে আমি যেন আমার সুপরিচিত পরিবেশের মধ্যে–যে পরিবেশকে আমি ভালবাসি আর আবার সেই পরিবেশে ফিরে এলুম।

পথটা পূর্ব-পশ্চিমে গিয়েছিল। সেটাকে ছেড়ে আমরা পথপ্রদর্শকের পিছনের খাটো গাছ আর বড় গাছের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে মাইলখানে কি তারও বেশী হেঁটে ছোট জলপ্রবাহটার কাছে এলুম–বিশাল এক বট গাছ তার উপর ঝুঁকে রয়েছে। আমাদের এখানে বসে অপেক্ষা করতে বলে আমাদের পথপ্রদর্শক বলে গেল গোশালাতে তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে যাচ্ছে।

সে এক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর প্রতীক্ষা। তার উপর আবার ক্ষিদেয় মরি, কারণ সেই যে মুরগি আর একখানা পাউরুটির ভাগ পেয়েছিলুম, তার পর এই মাঝ-রাত্রি পর্যন্ত পেটে আর কিছু পড়ে নি। আরও বিপদ আমার এই হল যে, দলের মধ্যে একা আমিই তামাক খাই, অথচ আমার সিগারেটের পুঁজি গিয়েছিল শেষ হয়ে।

পথপ্রদর্শকটি শেষ রাত্রের দিকে ফিরে এসে খবর দিল যে সুলতানা আর তার দলের অবশিষ্ট ন-জন ডাকাত আগের দিন সন্ধ্যেবেলাই গোশালা ছেড়ে চলে গিয়েছে হরিদ্বারের ওদিকে এক গ্রামে ডাকাতি করবার জন্যে। আশা করা যায় যে এই রাত্রেই, কিংবা দিনের বেলায় তারা ফিরে আসবে।

তারপর পথপ্রদর্শক আর গোয়েন্দা আমাদের জন্যে খাবার যোগাড় করতে চলে গেল। খাবারের বড্ড দরকার হয়ে উঠেছিল। যাবার আগে আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেল যে আমরা এখন সুলতানার এলাকার মধ্যে আছি, কেউ যেন বটগাছের আশ্রয় ছেড়ে বাইরে না যায়।

আরও একটা ক্লান্তিকর দিন কেটে গেল। উইণ্ডহ্যাম আর থাকতে পারবেন না, এই শেষ দিন। তিনি কুমায়ুনের কমিশনার, তার উপর আবার টিহরি রাজ্যের পোলিটিক্যাল এজেন্ট। দু-দিন পরেই সেখানকার রাজার সঙ্গে নরেন্দ্রনগরে দেখা করতে হবে তাকে।

রাত হলে, ঘাস-বোঝাই একটা গরুর গাড়ি এল। ঘাসগুলো সরিয়ে দেখা গেল যে বস্তা-কয়েক ছোলাভাজা আর আধমণটাক গুড় রয়েছে। কম হলেও খাদ্যটুকু কম লোভনীয় নয়। সিইদের মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়া হল। পথপ্রদর্শকটি সাহেবদের কথাও ভোলে নি। গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যাবার আগে সে ফ্রেডির হাতে একটি কাপড়ের পুঁটলিতে বাঁধা খানকতক চাপাটি দিয়ে গেল। কাপড়টুকুর অবস্থা এককালে ভাল ছিল, কিন্তু এখন তার বড় দুর্দশা।

চিত হয়ে পড়ে থেকে, কথার পুঁজি যখন সব শেষ হয়ে গিয়েছে এবং আমি সুদূর হরিদ্বারের গরম-গরম খাবার আর নরম বিছানার কথা ভাবছি, তখন আমাদের গাছটি থেকে কয়েকশো গজ দূরে একটা চিতার চিতল হরিণ মারবার একটি শব্দ ভেসে এল। পেট ভরে খেতে পাবার এই তো এক সুযোগ এসেছে। চাপাটির ভাগ খেয়ে আমার খিদে কমা দূরে থাকুক, বরং বেড়েই গিয়েছিল।

আমি লাফ দিয়ে উঠে ফ্রেডির কাছে কুকরিখানা চাইলুম। কেন ওটা চাইছি সে কথা সে জানতে চাইলে আমি বললুম যে চিতাটা যে-হরিণটাকে মেরেছে, তার পেছনের পা-খানা কেটে নিয়ে আসবার জন্যে কুকরিটা চাই।

সে বললে, কোন্ চিতা আর কোন্ চিতলের কথা বলছ তুমি? হ্যাঁ চিতলের ডাক শোনা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এ কথা সে কী করে জানবে যে তারা সুলতানার লোকদের দেখে ভয় পায় নি? হয়তো সুলতানার লোকরা আমাদের খুঁজছে। আর যাই হক, যদি আমার কথাই ঠিক হয় যে চিতাটা কিছু মেরেছে-তাতে অবশ্য তার সন্দেহ আছে–তাহলেই বা আমি কী করে তার মুখ থেকে চিতলটাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসব? গোশালার এত কাছে থেকে আমি তো বন্দুক ব্যবহার করতে পারব না নিশ্চয় (কী কাজে লাগতে পারে তা বুঝতে না পেরে আমি আমার রাইফেলটাকে সঙ্গে নিয়ে আসিনি)। না, আমার এই ফন্দিটা অকেজো–এই বলে সে তার বক্তব্য শেষ করল।

কাজেই নিতান্ত দুঃখিত হয়ে আমি খিদে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লুম। যারা বনের প্রাণীদের জানে না, তাদের ভাষা বোঝে না, তাদের আমি কেমন করে বোঝাব যে আমি ঠিকই জানি যে হরিণগুলো মানুষ দেখে ভয় পায় নি, এবং তারা দেখেছে যে চিতায় তাদের একজনকে মেরে ফেলেছে, আর সেই হরিণের সবটুকু, কিংবা তার যতটা চাই ততটা, চিতাটার কাছ থেকে নিয়ে আসার মধ্যে কোনো বিপদই নেই।

রাত্রে আর কিছু ঘটল না। ভোর হতেই উইণ্ডহ্যাম আর আমি হরিদ্বারের দিকে আমাদের দীর্ঘ পদযাত্রায় বেরিয়ে পড়লুম। ভীমগোড়া বাঁধে এসে আমরা গঙ্গা পার হয়ে বাঁধের ডাকবাংলোতে তাড়াতাড়ি খানা খেয়ে নিলুম। তারপর সন্ধের দিকে, বাঁধের উজানে যে বিস্তীর্ণ জলরাশি তাতে মজা করে মাছ ধরলুম। সে আনন্দের কথা অনেক দিন মনে থাকবে।

পরদিন সকালবেলা যখন উইণ্ডহ্যাম তার নরেন্দ্রনগরের কাজের জন্যে রওনা হচ্ছে আর আমি ক্ষুধার্ত সঙ্গীদের জন্যে সঙ্গে নিয়ে যাব বলে কিছু রসদের, যোগাড় করছি, এমন সময় একজন লোক দৌড়ে এসে খবর দিল যে ফ্রেডি সুলতানাদের বন্দী করেছে।

সুলতানা আগের দিন সন্ধেবেলা গোশালায় ফিরে এসেছিল। ফ্রেডির লোকেরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলবার পর ফ্রেডি গোয়ালাদের থাকবার মস্ত বড় কুড়েঘরটাতে হামগুড়ি দিয়ে ঢুকে দেখে যে ঘরে একখানা মাত্র খাঁটিয়া আছে, আর তার উপর চাদর-ঢাকা এক মূর্তি পড়ে আছে। ফ্রেডি গিয়ে স্রেফ তার উপর বসে পড়ল। সেই সাড়ে তিনমণী বপুখানার তলায় চাপা পড়ে গিয়ে সুলতানা না পারল কোনো লড়াই করতে, না পারল তার এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে, যে সে জীবন্ত অবস্থায় ধরা দেবে না। এই হানা দেবার সময় মোট ছ-জন ডাকাত ওখানে ছিল। সুলতানাকে নিয়ে চারজন ধরা পড়ল, অন্য দু-জনবাবু আর প্যায়লোয়ান নামে সুলতানার দুই সহচর–গুলি খেয়েও পুলিসের ব্যুহ ভেদ করে পালিয়ে গেল।

সুলতানা কতগুলো খুনের জন্যে দায়ী ছিল তা জানি না। যখন তার বিচার হল তখন তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল এই যে তার দলের একজন লামাচৌর গ্রামের মোড়লের একজন প্রজাকে হত্যা করেছিল।

ফাঁসির আসামীর কুঠরিতে থাকবার সময় সুলতানা ফ্রেডিকে ডেকে আনিয়ে নাজিরাবাদে ফোর্টের বন্দী তার স্ত্রী এবং পুত্রের, এবং তার অতি প্রিয় কুকুরটির ভার ফ্রেডিকে দিয়ে গেল। ফ্রেডি কুকুরটিকে নিজেই নিল। আর ফ্রেডিকে যাঁরা চেনেন, তাঁদের আর এ কথা বলার কোনো দরকার নেই যে, সুলতানার পরিবারকে দেখা-শোনা করবে বলে সে যে কথা দিয়েছিল, তা সে আন্তরিকতার সঙ্গে রক্ষা করেছিল।

ফ্রেডির চাকরিতে পদোন্নতি হল আর ভারত সম্রাট ভারতীয় পুলিস বিভাগের যত লোককে এ যাবৎ সি, আইই. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছেন, তাদের মধ্যে সে হল সবচাইতে কমবয়সী।

এর কয়েক মাস বাদে সে বার্ষিক পুলিস-সপ্তাহের অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্যে মোরাদাবাদে এল। অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ ছিল একটি ভোজ-উৎসব। তাতে প্রদেশের সব পুলিস-অফিসারই নিমন্ত্রিত হত। যখন খানাপিনা চলছে তখন একজন পরিবেশনকারী ফিসফিস করে ফ্রেডিকে জানাল যে তার আরদালি তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ফ্রেডি যে ক-বছর ধরে সুলতানার পেছনে ছিল, এই আরদালিটি সে সময় ফ্রেডির সঙ্গে ছিল।

এখন হয়েছে কি, সন্ধ্যেবেলা ছুটি থাকায় সে বেড়াতে-বেড়াতে মোরাদাবাদ স্টেশনে গিয়েছিল। সে সেখানে থাকতে থাকতে একখানা ট্রেন এল। সে উদ্দেশ্যহীনভাবে যাত্রীদের নামা-ওঠা দেখতে লাগল। তার কাছাকাছি একটি কামরা থেকে দু-জন যাত্রী নামল। এক জন অন্য জনকে কি বলতেই সে তাড়াতাড়ি একখানা রুমালে তার নিজের মুখ চাপা দিল বটে, কিন্তু আরদালিটি তার আগেই দেখতে পেয়ে গেল যে লোকটির নাকের আগায় একটু তুলো লেগে রয়েছে। আরদালীটি লোক দু-জনের উপর নজর রাখল। তাদের সঙ্গে প্রচুর মালপত্র ছিল। তারা ওয়েটিং রুমে ঢুকে এক কোণে আরাম করে বসবার পর আরদালি একখানা এক্কা ডেকে তাড়াতাড়ি চলে এল ফ্রেডিকে খবর দিতে।

সুলতানার দুই সহকারী, বাবু আর প্যায়লোয়ান যখন গোশালা-ঘেরা পুলিসের ব্যুহ ভেদ করে চলে যায়, তখন তাদের দিকে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। তার অল্প পরেই একজন লোক নাজিরাবাদের একটি ডিপেন্সারিতে এসে বলে যে তার নাকটা দেখতে হবে, নাকে নাকি একটা কুকুরে কামড়েছে। ব্যাপারটা পুলিসকে জানাবার সময় যে কম্পাউণ্ডারটি তার ঘা বেঁধে দিয়েছিল সে বলল যে, ক্ষতটা ছিটে গুলি লেগে হয়েছিল বলেই তার সন্দেহ হয়।

তাই গোটা প্রদেশটার সমস্ত পুলিস-বাহিনী নাকে-জখম-ওলা একজন লোকের সন্ধানে ছিল–আরও বিশেষ করে এইজন্যে যে, সুলতানার দল যে-সব হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী তার অধিকাংশই এই বাবু আর প্যায়লোয়ানই করেছিল বলে লোকে মনে করত।

আরদালির কথা শুনেই ফ্রেডি তার মোটরগাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে অন্ধবেগে স্টেশনের দিকে চলল। অন্ধ-বেগে চলল বলাই ঠিক, কেননা যখন তাড়া পড়ে, তখন ফ্রেডির সামনে শুধু রাস্তাটাই থাকে, যানবাহন বা পথে মোড় ইত্যাদি কিছুই সে দেখে না। স্টেশনে এসে সে ওয়েটিং-রুম থেকে বেরোবার প্রতিটি মুখে পাহারা রেখে তারপর তোক দুজনের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল যে তারা কে। তারা বলল যে তারা ব্যবসায়ী লোক, বেরিলি থেকে পঞ্জাবে চলেছে।

ফ্রেডি প্রশ্ন করল তারা তাহলে কেন এমন ট্রেন ধরল যার পথ ‘মোরাদাবাদে এসে শেষ হয়? তারা বলল যে বেরিলি প্ল্যাটফর্মে দু-খানা ট্রেন ছিল, তার মধ্যে ভুলখানাকেই তাদের দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ফ্রেডি শুনল যে তাদের খাওয়া-দাওয়া হয় নি, এবং ট্রেন ধরবার জন্যে পরের দিন ভোর পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। তখন ফ্রেডি তাদের তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করল এবং তার অতিথি হবার জন্যে আমন্ত্রণ জানাল। লোক দু-জন এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললে, ‘সাহেবের যা ইচ্ছে!’

লোক দু-জনকে গাড়ির পিছনে বসিয়ে ফ্রেডি আস্তে-আস্তে গাড়ি চালাতে চালাতে তাদের খুব খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল, আর সব প্রশ্নেরই সে চটপট জবাব পেতে থাকল।

তারপর লোকদুটি ফ্রেডিকে জিগ্যেস করল যে, রেলওয়ে স্টেশনে রাত্রিবেলা এসে যাত্রীদের ডেকে নিয়ে যাওয়াই আজকাল সাহেব-সুবাদের রেওয়াজ নাকি? মালপত্র এভাবে ফেলে গেলে তো লুট হয়ে যাবে না?

ফ্রেডি জানত যে একটি রীতিমত সই-করা ওয়ারেন্ট না থাকলে এরকম কাজ করাটা যথেচ্ছাচারিতা বলে গণ্য হতে পারে, এবং যদি মোরাদাবাদ জেলে দণ্ডভোগ করছে সুলতানার দলের এমন সব ডাকাতরা তাদের এই দুটি প্রাক্তন সাথীকে শনাক্ত না করে তাহলে তখন গুরুতর মুশকিলে পড়তে হবে। যখন এইসব অপ্রিয় ভাবনা তার মনের মধ্যে খেলে যাচ্ছে, ততক্ষণে পুলিস-সপ্তাহের অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসে যে বাংলোতে উঠেছে, তার গাড়ি এসে সেখানে পৌঁছে গেল।

সব কুকুরই ফ্রেডিকে ভালবাসে, সুলতানার কুকুরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এই কমাসেই টেরিয়ার কুকুরের একছিটে রক্ত-বিশিষ্ট এই নেড়িকুত্তাটা ফ্রেডিকে তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিল। এখন, যেই গাড়িটা এসে থামল আর তার থেকে ফ্রেডিরা তিনজনে নেমে এল, অমনি কুকুরটা বাংলো থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেই অবাক হয়ে থেমে গেল। তারপর, কুকুরের পক্ষে যতভাবে আনন্দ প্রকাশ করা সম্ভব তা করতে-করতে সেই যাত্রী-দুজনের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।

ফ্রেডি আর লোক দু-জন নিঃশব্দে পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর প্যায়লোয়ান তার ভাগ্যে কী আছে তা জেনেও নিচু হয়ে কুকুরটার মাথা চাপড়িয়ে বললে, ‘ইয়ং সাহেব, আপনি আমাদের যা বলে ভেবেছেন আমরা যে সেই লোকই, এ কথা এমন একজন খাঁটি সাক্ষীর সামনে অস্বীকার করে লাভ নেই!’

অপরাধীর হাত থেকে রক্ষা পেতে চায় আমাদের সমাজ, আর সুলতানা একজন অপরাধী ঠিকই। দেশে আইন অনুসারে তার বিচার হল, সে দোষী বলে সাব্যস্ত হল এবং তার ফাঁসি হয়ে গেল। তা সত্ত্বেও ছোট্ট মানুষটি সুদীর্ঘ দিন বছর ধরে সরকারে প্রচণ্ড শক্তিকে উপেক্ষা করে এসেছিল। ফাঁসির আসামীর কক্ষে যারা তাকে পাহারা দিয়েছিল, সাহস-ভরা চালচলনে ও তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। ওকে আমি প্রচুর প্রশংসা না করে থাকতে পারি না।

সুলতানাকে হাতকড়া আর ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে লোকের কাছে দেখানো চাই, এবং সে যখন স্বাধীন ছিল তখন তার শুধু নামটি শুনলে যারা কঁপতে থাকত এমন সব লোকের কাছে তাকে উপহাসের পাত্র করে ভোলা চাই, ন্যায়ের বিধান যদি এরকম হত তাহলে আমি সুখী হতুম। আমি এ কামনাও করেছিলুম যে তাকে যেন আর একটু কম কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তার কারণ আর কিছু নয়, শুধু এই যে, তাকে জন্ম থেকেই দাগী করে দিয়ে তাকে ভাল হবার সুযোগ দেওয়া হয় নি। তার হাতে যখন ক্ষমতা ছিল, তখন সে গরিবদের নির্যাতন করে নি। আমি যখন তার পদচিহ্ন ধরে-ধরে বটগাছটা পর্যন্ত গিয়েছিলুম তখন সে আমার আর আমার দুই বন্ধুকে নাগালের মধ্যে পেয়েও মেরে ফেলে নি। আর, সর্বশেষে, সে যখন ফ্রেডির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তখন সে এসেছিল ছোরা কিংবা রিভলবার নিয়ে নয়–দুই হাতে করে একটি তরমুজ নিয়ে।