প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

০৬. দুই-ভাই

৬. দুই-ভাই

আরণ্য যুদ্ধে যুবকদের তালিম দেবার দীর্ঘ বছরগুলি শেষ হয়ে যাবার পর একদিন আমরা প্রাতরাশের পর আমাদের কালাধুঙ্গির কুটিরের বারান্দায় বসে ছিলুম। আমার বোন ম্যাগি আমার জন্যে একটা খাকি পুল-ওভার বুনছিল, আর আমি দীর্ঘকাল অব্যবহৃত অতি প্রিয় একটি ছিপকে ঠিকঠাক করছিলুম।

এমন সময় একটি লোক বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। তার পরনে পরিষ্কার অথচ বেজায়-তালি-মারা একপ্রস্থ সূতীর পোশাক, মুখে বিস্তৃত হাসি। সেলাম করে সে জিগ্যেস করল আমাদের তাকে মনে আছে কি না।

ঐ সিঁড়িটি ধরে বহু লোক উপরে এসেছে-পরিচ্ছন্ন, অপরিচ্ছন্ন, ছেলে, বুড়ো, বড়লোক গরিব (অবশ্য, বেশির ভাগই গরিব), হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, সব রকমেরই লোক।

আমাদের কুটিরটা ছিল পাদ-শৈলের একটি চৌমাথার উপরেই, এবং বন আর আবাদী জমির মধ্যের সীমারেখার উপরে। অসুস্থ কিংবা দুঃখী, কিংবা যার একটু সাহায্য করবার লোকের অভাব, কিংবা যার একটু মানুষের সঙ্গ আর এক পেয়ালা চা পেলে ভাল হয়, এমন সব লোকই খুঁজে-পেতে আমাদের কুটিরে চলে আসতো সে আবাদী জমির বাসিন্দাই হক, অথবা বনে-জঙ্গলেই কাজ করুক, কিংবা শুধু এক জায়গা থেকে আর একজায়গায় যাচ্ছে এমন লোকই হোক।

যে-সব রুগ্ন আর আহত লোকদের এখানে চিকিৎসা হয়েছে, এত বছর ধরে তাদের একটা হিসেব রাখলে তাতে হাজার-হাজার নাম রয়েছে দেখা যেত। আর, যত রোগী আমাদের হাত দিয়ে গিয়েছে তার মধ্যে থাকত এমন সব রকমেরই রোগ দুঃখ, যা মানুষের দেহে উত্তরাধিকার-সূত্রে আসে, কিংবা যা অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকার ফলে, অথবা বনে-জঙ্গলে মাঝে-মাঝে যাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এমন সব জন্তুদের মধ্যে বিপজ্জনক কাজ করার ফলে, মানুষকে পেতে হতে পারে।

সেই স্ত্রীলোকটির ব্যাপারটাই ধরুন না কেন। সে একদিন সকালবেলা এসে নালিশ জানাল যে আগের দিন সন্ধ্যেবেলা তার ছেলেকে একটা ফোঁড়ার জন্যে যে তিসির পুলটিসটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা খেতে তার বড্ড অসুবিধে হয়েছিল, তাতে আর কোনো উপকারও হয় নি। তাই সে ওষুধ বদলে দিতে বলল।

আর একদিন সন্ধ্যের পর একটি মুসলমান স্ত্রীলোক এল, তার গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে। তার স্বামী নিউমোনিয়ায় মরমর, তাকে বাঁচিয়ে দেবার জন্যে সে ম্যাগিকে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। এ অ্যাণ্ড বি ৬৯৩ বড়িগুলা দেখে সে সন্দেহভরে তাকিয়ে বলল, একটা অত কঠিন রোগীর জন্যে এইটুকু ছাড়া আর কিছুই কি নেই নাকি! যাই হক, পরদিন সে হাসিমুখে এসে জানাল যে তার স্বামী ভাল আছে, আর, সে তার চারজন বন্ধুকেও নিয়ে এসেছে। তাদের সকলেরই তারমত বুড়ো বর আছে, যাদের যে-কোনো সময়ে নিউমোনিয়ায় ধরতে পারে। তাই সে তাদের জন্যও ঠিক ঐ রকম দাওয়াই চাইল।

এ ছাড়া একটি মেয়ের কথা লিখছি। তার বয়স আট। আমাদের গেটের ছিটকিনিটার নাগাল পেতে তার বেশ অসুবিধে হয়েছিল। তার চাইতে বছর-দুয়েকের ছোট একটি ছেলের হাত শক্ত করে ধরে সে গটগট করে বারান্দা পর্যন্ত এসে ছেলেটার চোখের ঘায়ের জন্যে ওষুধ চাইল। সে নিজে মাটিতে বসে পড়ে, ছেলেটাকে চিত করে ফেলে, তার মাথাটা নিজের দুই হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরে বললে, ‘মিস্ সাহেব এবার আপনি ওকে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। ওই মেয়েটি ছিল ছ-মাইল দূরের এক গ্রামের মোড়লের মেয়ে। তার ক্লাসের বন্ধু চোখে ঘা হয়ে ভুগছে দেখে সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাকে চিকিৎসার জন্যে ম্যাগির কাছে নিয়ে চলে এসেছিল।

তারপর পুরো একটি সপ্তাহ ধরে, যতদিন না ছেলেটির চোখের ঘা একেবারে সেরে গেল, ততদিন সেই পরোপকারিণী শিশুটি রোজ ছেলেটিকে নিয়ে আমাদের ওখানে আসত। যদিও এর জন্যে তাকে রোজ চার মাইল পথ বেশি হাঁটতে হত।

তারপর দিল্লীর সেই করাতির কথা। সে একদিন খোঁড়াতে-খোঁড়াতে আমাদের হাতার মধ্যে এল। একটা শুয়োর দাঁত দিয়ে তার পায়ের পিছনটা গোড়ালি থেকে হাঁটুর পিছন পর্যন্ত চিরে ফাঁক করে দিয়েছিল। যতক্ষণ তার শুশ্রূষা চলেছিল, ততক্ষণ সে, যে-নোংরা জানোয়ারটা তার এই ভয়ানক ক্ষতিটা করেছিল সেটাকে গালাগাল করতে লাগল, কেননা, সে ছিল মুসলমান।

তার কাহিনী হল এই যে, আগের দিন একটা গাছ কেটে ফেলে রেখে সে সেইদিন সকালবেলা সেটাকে করাত দিয়ে কাটতে এসেছিল, এমন সময় একটা শুয়োর ডাল-পালার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে তাকে গুঁতো মেরে তার পা ফেঁড়ে ফেলল। আমি যখন বললুম যে, শুয়োরটার পথ থেকে সরে না দাঁড়ানোটা তারই নিজের দোষ, তখন সে চটে গিয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘তার তো দোর দেবার জন্যে গোটা জঙ্গলটাই ছিল, তবে আমার গায়ে এসে পড়বার দরকারটা কী ছিল? আমি তো তার চটবার মত কিছু করি নি, এমনকি আমি আগে তাকে দেখিও নি পর্যন্ত।

আরও একজন করাতি ছিল। একটা গাছ উলটে দিতে গিয়ে সে হাতে এই ‘এত বড়’ একটা কাঁকড়া বিছের কামড় খায়। চিকিৎসার পর সে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে তারস্বরে তার দুর্ভাগ্যের কথা বলে বিলাপ করতে লাগল, আর বলতে লাগল যে ওষুধে তার কোনোই কাজ হচ্ছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই দেখা গেল যে, সে দু-হাতে তার পেট চেপে ধরে আছে, আর হাসির চোটে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

সেদিনটা ছিল ছেলেমেয়েদের বার্ষিক উৎসবের দিন। তাদের রেস হয়ে যাবার পর। দুশো ছেলেমেয়ে আর তাদের মায়েদের মেঠাই আর ফল খাওয়ানো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সবাই গোল হয়ে বসল। দু-জন লোকে দুটো বাঁশ তুলে ধরল, তাদের মাঝখানে একটা দড়িতে একটা কাগজের ঠোঙা ঝুলিয়ে দেওয়া হল–তার ভিতর নানারকম বাদাম ভরা। একটা ছেলেকে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হল সেই থলিটাকে ফাটাবার জন্যে। যেই লাঠির ঘা থলিতে না পড়ে একজন লোকের মাথায় পড়েছে, অমনি সেই বিচ্ছুতে কামড়ানো রোগীটি সকলের চাইতে জোরে হেসে উঠেছে। তার ব্যথাটা কেমন, জিগ্যেস করায় সে বললে যে এমন তামাশা দেখতে পেলে সে আর বিচ্ছুর কামড়-টামড় গ্রাহ্য করে না।

আমাদের পরিবারের লোকরা যে কতকাল ধরে শখের ডাক্তারি করে আসছে তা আমার মনে নেই। ভারতীয়রা–বিশেষত যারা গরিব তারা–অনেক দিন মনে করে রাখে। যত তুচ্ছ উপকরাই হক, তা কখনও তারা ভোলে না। তাই, যত লোক আমাদের কালাধুঙ্গির বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠত, তারা সবাই যে রোগী এমন নয়।

এমন অনেক লোক ছিল যারা গত বছর, কিংবা হয়তো অনেক বছর আগে সামান্য একটু অনুগ্রহ পেয়েছিল বলে আমাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্যে দুর্গম পথ ধরে যে-কোনো ঋতুতে দিনের পর দিন হেঁটে এসেছে। তাদের মধ্যে একটি ষোল বছরের ছেলে ছিল। সে একবার তার মাকে নিয়ে আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে কিছুদিন থেকে আমার বোনকে দিয়ে তার মায়ের ইনফ্লুয়েঞ্জা আর চক্ষু-প্রদাহের চিকিৎসা করিয়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন সে আমার বোনকে তার মায়ের কৃতজ্ঞতা জানাতে আর মায়ের নিজের হাতে তোলা কয়েকটি ডালিম উপহার দিতে বহু দিনের পথ হেঁটে এসেছিল।

সেইদিনই–তালি দেওয়া পোশাক পরা লোকটি আসবার ঘণ্টাখানেক আগে –একটি বৃদ্ধ সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে শেষে অপছন্দের ভাবে মাথাটা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘সাহেব, শেষবার যখন আপনাকে দেখি, তখনকার চাইতে আপনাকে এখন বুড়ো দেখাচ্ছে।‘

আমি উত্তর দিলুম, তা বটে, দশ বছর বাদে সকলকেই আর একটু বুড়ো দেখায়। সে বললে, ‘না সকলকে নয়, সাহেব! দশ নয়, বার বছর আগে যেবার আমি শেষ এই বারান্দায় বসে গিয়েছিলুম, তখনকার চাইতে এখন আমাকে অন্তত বেশি বুড়ো দেখায় না। আমি নিজেও বুড়ো হয়েছি বলে মনে করি না। সেবার আমি বদ্রীনাথ থেকে তীর্থ করে হেঁটে ফিরছিলুম। তখন আমি ক্লান্ত, আর আমার দশটা টাকার দরকার ছিল। আপনাদের গেট খোলা দেখে আমি এখানে একটু জিরোবার জন্যে অনুমতি এবং কিছু সাহায্য চেয়েছিলুম আপনার কাছে।

এবার আমি আর-এক তীর্থ করে ফিরছি–পবিত্র বারাণসী ধাম থেকে। আমার টাকার দরকার নেই, শুধু আপনাকে আপনার সেবার সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি, আর বলতে এসেছি যে সেবার আমি নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছেছিলুম। এই বিড়িটি খেয়ে, আর একটু জিরিয়ে নিয়ে আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাব। তাদের হলদোয়ানিতে রেখে এসেছি।’ অর্থাৎ এক-এক পিঠে চোদ্দ মাইল। তাছাড়া, বার বছরে সে আর বুড়ো হয় নি, সে একথা বললেও সে যে সত্যিই বুড়ো আর ক্ষীণজীবী হয়ে পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

তালিমারা সুতীর পোশাক পরা যে লোকটি বারন্দায় আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তার মুখটা অস্পষ্টভাবে চেনা-চেনা ঠেকলেও আমরা তার নাম, অথবা কি উপলক্ষে তাকে দেখেছিলুম তা মনে করতে পারলুম না। তাকে চিনতে পারছি না দেখে সে তার কোটটা খুলে ফেলে শার্টের বোতামও খুলল। তাতে তার বুক আর ডান কাঁধ দেখেই তৎক্ষণাই মনে পড়ল যে সে হচ্ছে নরোয়া-ঝুড়িওলা নরোয়া।

তাকে না চিনতে পারার একটা কৈফিয়ত দিতে পারি। ছ-বছর আগে শেষবার তাকে যখন দেখি তখন সে ছিল অস্থিচর্মসার। এক পা ফেলতে হলেও তার মহাকষ্ট হত, আর শরীরের ভার রাখবার জন্যে একখানা লাঠি লাগত। তার কাঁধের ভাঙা হাড়গুলো ঠিক হয়ে না বসে শুধু কড়া হয়ে জোড় লেগে যাওয়াতে তার কাধটা বাঁকাচোরা হয়ে গেছে, আর পিঠের চামড়া কুঁচকে বিবর্ণ হয়ে গেছে, তার ডান হাতটা খানিকটা শুকিয়ে গেছে। তবু তাকে দেখে আমরা–যারা তিন মাস ধরে তাকে মরণের সঙ্গে বীরের মত লড়তে দেখেছি–অবাক হয়ে গেলুম যে সে কঠিন সংকট থেকে কত ভালভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। নরোয়া তার হাতখানা তুলে আর নামিয়ে, আর আঙুলগুলো খুলে আর মুড়ে বললে যে তার হাতখানা দিন-দিন জোরাল হয়ে উঠছে।

আমরা ভয় করেছিলুম যে তার আঙুলগুলো অচল হয়ে যাবে, কিন্তু তা হয় নি। কাজেই সে তার ব্যবসা আবার শুরু করতে পেরেছে। সে বললে যে এখন তার আসার উদ্দেশ্য হল আমাদের দেখিয়ে যাওয়া যে সে ভালই আছে, এবং সে যে-কমাস জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে পড়ে ছিল, ততদিন ধরে তার আর তার স্ত্রীর আর সন্তানের সব প্রয়োজন মেটাবার জন্যে ম্যাগিকে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। বলেই সে তা জানাবার জন্যে ম্যাগির পায়ের উপর তার মাথাটা রেখে উপুড় হয়ে পড়ল।

.

নরোয়ার কঠিন সংকট

নরোয়া আর হরিয়া নিজেদের ভাই বলে পরিচয় দিত বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক কিছু ছিল না। আলমোড়ার কাছে একই গ্রামে তারা জন্মেছিল আর বড় হয়েছিল, এবং যখন কাজ করবার বয়স হল তখন একই পেশা ধরেছিল–তা হচ্ছে ঝুড়ি বানানো। তার মানে এই যে, তারা অচ্ছুৎ ছিল,-উত্তরপ্রদেশে শুধু অচ্ছুত্রাই ঝুড়ি বোনে।

গ্রীষ্মকালে তারা আলমোড়ার কাছে নিজেদের গ্রামে নিজেদের কাজ চালাত, আর শীতকালে কালাধুঙ্গিতে নেমে আসত। আমাদের গ্রামের লোকদের ধান-টান রাখবার জন্যে তারা যেসব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঝুড়ি বানাত তার এক একটার ফাঁদ দশ হাত পর্যন্ত হত। সেগুলোর খুব চাহিদা ছিল। আলমোড়ার পাহাড় গ্রামে তারা ঝুড়ি বানাত রিংগাল দিয়ে। রিংগাল হল এক জাতের সরু বাঁশ, এক ইঞ্চি মোটা, কুড়ি ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সেগুলো চার থেকে দশ হাজার ফুট উঁচু জায়গায় জন্মায়। তা দিয়ে নিখুঁত মাছ ধরবার ছিপও তৈরি হয়। কালাধুঙ্গিতে নরোয়ারা ঝুড়ি বানাত সাধারণ বাঁশ দিয়ে।

কালাধুঙ্গিতে বাঁশ জন্মায় সরকার সংরক্ষিত বনে। সেই বনের কাছে থেকে আমরা যারা চাষবাস পরি, নিজেদের ব্যবহারের জন্যে বৎসরে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় বাঁশ কেটে আনতে পেতুম। কিন্তু যাদের ব্যবসার জন্যে বাঁশের দরকার হত, তার জন্যে দিতে হত বোঝা-পিছু দু’আনা আর লাইসেন্সটা লেখবার মেহনতানা বাবদ বন-রক্ষীটিকে সামান্য কিছু। লাইসেন্স হত মাথাপিছু, আর মাথায় যত বড় বোঝ আনা যায় তার জন্যেই। কাজেই, ধরে নেওয়া যেতে পারে যে একটা মানুষের পক্ষে দু-বছরের পুরনো বাঁশ যতগুলি বয়ে আনা সম্ভব, তা দিয়ে বোঝাটা তৈরি করা হত–কেননা ঐ রকম বাঁশই ঝুড়ি বানাবার পক্ষে সবচেয়ে ভাল।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর ভোর হতেই নরোয়া আর হরিয়া কালাধুঙ্গি বাজারের কাছে তাদের বারোয়ারি আড্ডা থকে বেরিয়ে আট মাইল হেঁটে নানি গ্রামে চলল। সেখানে বন-রক্ষী থেকে একটা লাইসেন্স নিয়ে নানির সংরক্ষিত বনে দুই-বোঝা বাঁশ কেটে সন্ধ্যেবেলা তাদের কালাধুঙ্গিতে ফিরে আসবার কথা।

যখন তারা রওনা হল তখন বেজায় শীত, তাই তারা শীত কাটাবার জন্যে গায়ে মোটা সুতীর চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল। মাইল খানেক ধরে পথটা ক্যানেলের সেচ-খালের কিনার ধরে চলল। তারপর সেচখালের মুখের কাছে তৈরি নানারকম উঁচু দেওয়াল পার হয়ে তারা একটা পাকদণ্ডী ধরল। সেটা একবার খানিকটা ঘন ছোট ঝোঁপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, আবার বোর নদীর ধারে-ধারে খানিকটা পাথর-ছড়ানো জায়গার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে।

এইসব জায়গায় ভোরবেলায় সাধারণত একজোড়া ভোঁদড়কে দেখতে পাওয়া যায়, আর জলে যখন রোদ পড়ে তখন ছিপ দিয়ে দেড় সের দু-সের ওজনের মহাশোল মাছ ধরতে পারা যায়। আরও দুই মাইল উপরে গিয়ে তারা একটা অগভীর জায়গায় বোর নদীর ডান-পার থেকে বাঁ-পারে গিয়ে একটা বড় গাছ আর ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এখানে সকালে আর সন্ধেবেলায় চিতল আর সম্বর হরিণের ছোট-ছোট পাল দেখা যায়, কদাচিৎ এক-আধটা কাকার হরিণ, চিতা বা বাঘও চোখে পড়ে।

এর ভিতর দিয়ে মাইল-খানেক গিয়ে দুটো পাহাড়ের সন্ধিস্থলে তারা এসে পড়ল। এখানেই কয়েক বছর আগে রবিন ‘পওয়ালগড়ের কুমার’-এর পায়ের ছাপ আবার খুঁজে পেয়েছিল। এই জায়গাটা থেকেই উপত্যকাটা চওড়া হয়ে গিয়েছে। সেখানে যারা গরু-মোষ চরায় আর বৈধ বা অবৈধভাবে শিকার করে, তারা সবাই এটাকে বলে সামাল-চৌর। এই উপত্যকায় সাবধানে চলতে ফিরতে হয়, কেননা, পাকদণ্ডীটা মানুষে যত বাঘেও প্রায় ততই ব্যবহার করে।

উপত্যকাটির উপরকার দিকটায় পাকদণ্ডীটা একফালি ঘাস-জমির ভিতর দিয়ে গিয়ে তারপর খাড়া দু-মাইল উঠে গিয়ে নালনি গ্রামে পৌঁছেছে। ঘাসগুলি আট-ফুট উঁচু, ঘাস-জমিটা ত্রিশ গজ চওড়া আর পথটার দুধারেই গজ পঞ্চাশেক পর্যন্ত বিস্তৃত।

নালনি পাহাড়ে এবার খাড়া চড়াই বেয়ে উঠতে হবে বলে ঘাসের কাছে আসবার আগেই নরোয়া তার সুতীর চাদরখানা খুলে, ছোট করে ভাঁজ করে সেটাকে নিজের ডান কাঁধে রেখেছিল। হরিয়া আগে-আগে যাচ্ছিল, তার কয়েক পা পিছনেই নরোয়া। এইভাবে ঘাসের ভিতর তিন কি চারগজ যেতেই হরিয়া একটা বাঘের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে নরোয়ার এক চিৎকার।

হরিয়া ছুটে ফিরে এল। এসে দেখে যে ঘাসের কিনারায় খোলা জায়গায় নরোয়া চিত হয়ে পড়ে রয়েছে, আর একটা বাঘ কোনাকুনিভাবে তার বুকের উপর চেপে রয়েছে–তার পা দুখানা হরিয়ার দিকে। হরিয়া দুই হাতে নরোয়ার দুই পা ধরে বাঘটার তলা থেকে টানতে শুরু করে দিল, যদি বার করতে পারে। তা করতেই বাঘটা উঠে দাঁড়াল, তারপর তার দিকে ফিরে গর্জন করতে লাগল।

চিত অবস্থায় নরোয়াকে খানিকদূর টেনে নিয়ে গিয়ে হরিয়া তাকে জড়িয়ে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু নরোয়া সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছিল আর ঘাবড়ে গিয়েছিল যে, তার আর দাঁড়াবার বা চলবার শক্তি ছিল না। তাই, হরিয়া তাকে জাপটে ধরে তাকে খানিক হেঁচড়াতে-হেঁচড়াতে আর খানিক তুলে নিয়ে ঘাসের কিনারায় খোলা জমিটা দিয়ে চলল, বাঘটাও সারাক্ষণ গর্জন করে চলল।

এইভাবে সে নানি গ্রামে যাবার পথে আবার এসে পড়ল। তারপর অমানুষিক কষ্ট করে হরিয়া নরোয়াকে নিয়ে নানি এসে পৌঁছল। সেখানে দেখা গেল যে ডান কাঁধে ভাঁজ করা চাদরখানা থাকা সত্ত্বেও বাঘটা নরোয়ার কাঁধের হাড়গুলো চূর্ণ করে দিয়েছিল। মাংস ছিঁড়ে বুক-পিঠের ডানদিকের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। নরোয়াকে টেনে আনবার সময় হরিয়া তার চাদর-খানাও কুড়িয়ে পেয়েছিল। বাঘটার চারটে কুকুরে-দাঁতই তার আট-আটটা ভাঁজ ভেদ করে গিয়েছিল। কিন্তু এই বাধাটা না পেলে দাঁতগুলো তার বুকে চেপে বসত এবং আঘাত মারাত্মক হত।

নালনির বন-রক্ষীর আর বাসিন্দাদের নরোয়ার জন্যে কিছু করবার সাধ্য ছিল না। কাজেই হরিয়া দু-টাকা দিয়ে একটা মাল-বওয়া টাট্ট ভাড়া করে, নরোয়াকে তার পিঠে চাপিয়ে কালাধুঙ্গির দিকে রওনা হল।

আগেই বলেছি যে দূরত্বটা আট মাইল। কিন্তু হরিয়ার আবার বাঘের মুখে পড়বার ইচ্ছে ছিল না, তাই সে অনেক ঘুরে মুসাবাঙ্গা গ্রামের ভেতর দিয়ে গেল। তাতে পথ আরও দশ মাইল বেড়ে গেল–নরোয়ার প্রাণান্ত! নালনিতে জিন পাওয়া গেল না, শস্য বইবার জন্যে যে কাঠের পাটা থাকে তারই একটার উপর তাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার উপর আবার প্রথম ন-মাইল রাস্তা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের খাড়া আর এবড়ো-খেবড়ো জমির উপর দিয়ে।

ম্যাগি বাড়ির বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, এমন সময় নবোয়া এসে সিঁড়ির তলায় পৌঁছল। তার শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, হরিয়া তাকে টাটুর উপরে চেপে ধরে রেখেছে। একনজর দেখেই বোঝা গেল যে এ-ক্ষেত্রে কিছু করবার সাধ্য তার নেই। তাই সে নরোয়াকে মূৰ্ছিতপ্রায় দেখে তাড়াতাড়ি তাকে খানিকটা স্মেলিং সল্ট শুকিয়ে, তার হাতখানা একটা কাপড়ে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ব্যাণ্ডেজের জন্যে একখানা চাদর ছিঁড়ে সে কালাধুঙ্গি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারকে একখানা চিঠি লিখে তাকে অনুরোধ করল যেন তখনই নরোয়াকে তিনি দেখেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তার জন্যে। আমাদের খানসামাকে চিঠিটা দিয়ে তাকে ওই লোক দু-জনের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল আমার বোন।

আমার একদল বন্ধু তখন কালাধুঙ্গিতে আমাদের সঙ্গে বড়দিনটা কাটাচ্ছিল। ওই দিন তাদের সঙ্গে পাখি শিকার উপলক্ষে বাইরে ছিলুম। সন্ধ্যের অনেক পরে বাড়ি ফিরে ম্যাগির কাছে নরোয়ার কথা শুনলুম। পরদিন ভোরবেলাই হাসপাতালে গিয়ে একটি নিতান্ত ছেলেমানুষ আর নিতান্ত অনভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে শুনলুম যে তিনি যা পেরেছেন করেছেন, কিন্তু রোগীর সারবার আশা প্রায় নেই। হাসপাতালে রোগী রাখবার কোনো ব্যবস্থাও নেই, তাই তিনি নরোয়ার চিকিৎসা যা করবার তা করে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মস্ত এক বারোয়ারি চালাঘরে অন্তত কুড়িটি পরিবার থাকে, আর তাদের প্রত্যেকেরই বোধহয় ছেলেপুলের সংখ্যা অগুনতি। সেইখানে এক কোণে কতকগুলো বিচালি আর পাতার উপর শুয়ে রয়েছে নরোয়া। তার মত মারাত্মক আহত লোকের পক্ষে এমন জায়গায় থাকা চলে না, কেননা তার ঘা-গুলো দূষিত হয়ে আসবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। সেই অস্বাস্থ্যকর আর গোলমালে ভরা চালাঘরের মধ্যে নরোয়া দিন-সাতেক পড়ে রইল। সে কখনও-কখনও প্রবল জ্বরে প্রলাপ বকত, কখনও বা আচ্ছন্নভাবে পড়ে থাকত। তার পতিব্রতা স্ত্রী, তার অনুগত ‘ভাই’ হরিয়া, এবং কয়েকজন বন্ধু তার সেবাশুশ্রূষা করতে লাগল।

আমি যে কিছু জানি না, আমারও দেখে মনে হতে লাগল যে নরোয়ার পচা ঘা-গুলো চিরে পুঁজ বের করে পরিষ্কার করে না দিলে ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাবে নিশ্চয়। তাই, চিকিৎসার সময় তার সেবা শুশ্রষার ব্যবস্থা করে আমি নরোয়াকে হাসপাতালে নিয়ে এলুম। ছেলেমানুষ ডাক্তারটিকে বাহাদুরি দিতে হয় যে, সে কোনো কাজের ভার নিলে তার আর শেষ রাখত না। তাই নরোয়া তার বুকে পিঠে যে-সব লম্বা-লম্বা কাটা দাগ নিয়ে একসময় শ্মশানে যাবে, তার অনেকগুলিই বাঘের আঁচড়ের নয়, ডাক্তারের ছুরিরই দাগ। ছুরিখানা সে বেপরোয়াভাবে চালিয়েছিল।

পেশাদার ভিখারী ছাড়া, ভারতের গরিবরা শুধু যখন কাজ করে তখনই খেতে পায়। নরোয়ার বউ প্রথমে তাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া নিয়ে, আর তারপর সে যখন বারোয়ারি চালাটায় ফিরে গেল তখন তার সেবাশুশ্রূষা নিয়ে, তারও উপরে আবার তিন বছরের একটি মেয়ে আর ছোট আর-একটি বাচ্চাকে নিয়ে সারাক্ষণ বিব্রত থাকত বলে আমার বোনই নরোয়ার আর তার পরিবারের সব প্রয়োজন মেটাত। (ভারতের ছোট-ছোট হাসপাতালে রোগীদের শুশ্রূষার লোকও দেয় না, খাবারও দেয় না)।

তিন মাস বাদে অস্থিচর্মসার হয়ে নরোয়া কোনোরকমে চালাঘরটি থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে বিদায় নিতে আমাদের বাড়িতে এল। তার ডানহাতখানা দেখে মনে হল না যে সে আর সেখানা ব্যবহার করতে পারবে। পরদিন সে, হরিয়ার আর তাদের দুই পরিবার আলমোড়ার কাছে তাদের গ্রামে ফিরে গেল।

প্রথম দিন সকালবেলা সেই বারোয়ারি চালাঘরে নরোয়াকে দেখে, আর হরিয়ার কাছে ব্যাপারটার একটা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পেয়ে আমার দৃঢ় ধারণা হল যে তাদের সঙ্গে বাঘটার দেখা হয়েছিল নিতান্তই দৈবাৎ।

যাই হক আমার ধারণা ঠিক কি না তা জানবার জন্যে-আর, ঠিক না হলে বাঘটাকে মেরে ফেলবার জন্যে–সেই দুই ভাই আগের দিন নানি গ্রামে যেতে যে-পথে গিয়েছিল আমি পায়ে-পায়ে সেই পথটি ধরে চললুম। কয়েক গজ ধরে সেই পথটি নালনি পাহাড়ের তলাকার উঁচু ঘাসের বনটার ধারে ধারে চলে গিয়ে তারপর সমকোণ ঘুরে ঘাসগুলোর ভিতর চলে গিয়েছিল।

লোক দু-জন এখানে আসবার একটু আগেই বাঘটা একটা মদ্দা সম্বর হরিণ মেরে সেটাকে নিয়ে পথটার ডানদিকে ঘাসের ভিতর ঢুকেছিল। হরিয়া ঘাসবনে ঢোকবার সময় বাঘটা খসখসানি শুনে বেরিয়ে আসতে গিয়ে নরোয়ার উপর এসে পড়ে।

নরোয়া তখন হরিয়ার কয়েক গজ পিছনে, পথের মোড় থেকে দু-চার হাত দূরে ছিল। সংঘর্ষটা দৈবাৎ হয়ে গিয়েছিল, কেননা ঘাসগুলো অত্যন্ত ঘন আর খুব উঁচু বলে গায়ে এসে ধাক্কা লাগবার আগে পর্যন্ত বাঘটা নরোয়াকে দেখতে পায়নি। অধিকন্তু সে নরোয়াকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতেও চেষ্টাও করে নি, এমনকি যে মানুষটার উপর সে শুয়ে পড়েছিল তাকে টেনে নিয়ে যাবার সময় হরিয়াকে বাধাও দেয়নি। কাজেই এই বাঘটাকে বেঁচে থাকতে দিলুম। আমার ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘেরা বইয়ে ‘ন্যায়পরায়ণ বাঘ’ পরিচ্ছেদে যেসব বাঘের কথা আছে, তাদের দলে আমি এই বাঘটিকেও ফেলেছি।

আমার দেখা অথবা শোনা অথবা পড়া যত সাহসের ঘটনার কথা আমি জানি, তার মধ্যে হরিয়ার নরোয়াকে উদ্ধার করবার কাজটাকে আমি সবচাইতে বড় বলে মনে করি। অতি বিস্তীর্ণ এক বনের মধ্যে একা আর নিরস্ত্র হয়েও বিপন্নের আর্তনাদে সাড়া দেওয়া, এবং সেই সঙ্গীটির উপর ক্রুদ্ধ একটা বাঘ শুয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে টেনে বের করে এনে একটা খাড়া পাহাড় বেয়ে দু-মাইল ধরে সেই সাথীকে টেনে আর বয়ে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় আসা–অথচ এ কথা জানা নেই যে বাঘটা তার পিছনে আসছে কি না–এতে যে-পরিমাণ সাহসের দরকার তা খুব কম লোকেরই থাকে, এবং যে-কোনো লোকের পক্ষে ঈর্ষার বস্তু।

যখন আমি হরিয়ার দেওয়া বিবরণ লিখে নিই–পরে তার প্রত্যেকটি কথা নরোয়া সমর্থন করেছিল–তখন তাকে সে কথা না জানালেও আমার উদ্দেশ্য ছিল যে তার এই কাজের কথা যেন লোকে জানতে পারে। সে নিজে সেটাকে কোননা প্রশংসার কাজ বলে মনে করা দূরে থাকুক, বরং আমার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে বলল, ‘সাহেব, আমার ভাইয়ের কিংবা আমার কোনো বিপদ হতে পারে আমি এমন কিছু করে ফেলেছি কি?

কয়েকদিন বাদে, মুমূর্মুর জবানবন্দি নিচ্ছি ভেবে নরোয়ার কথা যখন লিখে নিই, তখন সে মৃদু, যন্ত্রণাক্লিষ্ট স্বরে বললে, ‘সাহেব, আমার ভাইয়া যেন কোনো বিপদে না পড়ে, কেননা বাঘটা যে আমাকে ধরেছিল, তাতে তার দোষ ছিল না–সে বরং আমকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিতে বসেছিল।

হরিয়ার এই অসমসাহসিক কাজ, আর অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যেও নরোয়ার বীরত্বপূর্ণ জীবন-যুদ্ধ সরকারের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছিল, একথা বলে কাহিনীর উপসংহার করতে পারলে সুখী হতুম। একটু প্রশংসাপত্র, কিংবা সামান্য কিছু পুরস্কার হলেও হত, কেননা দু-জনেই ছিল বড় গরিব। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি ‘লাল-ফিতে’র সঙ্গে পেরে উঠলুম না। যেখানে নিঃস্বার্থ নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী শপথ করে একটা ঘটনাকে সত্য বলছে না, সে ক্ষেত্রে নাকি সরকার কোনো কিছু দিতে অনিচ্ছুক।

এইভাবে, শুধু ‘নিঃস্বার্থ নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী’ ছিল না বলে, মহত্তম বীরত্বের একটি কাজ অনাদৃত থেকে গেল। দুই ভাইয়ের মধ্যে হরিয়ারই ক্ষতি হল বেশি, কেননা সে যা করেছিল তার কোনো প্রমাণ তার দেখাবার ছিল না, অথচ নরোয়া তার ক্ষতচিহ্নগুলি এবং তার অনেক ফুটোওয়ালা রক্তমাখা চাদরখানা দেখাতে পারত।

ভারত সম্রাটের কাছে এ নিয়ে একটি আবেদন করার কথা আমি অনেক দিন পর্যন্ত মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করেছিলুম, কিন্তু আসন্ন এক বিশ্বযুদ্ধ এবং তার সব অনুষঙ্গগুলির কথা ভেবে আমি নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে সে বাসনা ত্যাগ করলুম।