৩. চোখে দেখা নিজের লাশ

চোখে দেখা নিজের লাশ

নাসেরের মনের মধ্যে জিনের ভীতি ছিল প্রকট। অথচ টগবগে যৌবনের অধিকারী আইয়ূবীর স্পেশাল ফোর্সের এই কমান্ডার মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে অভ্যস্ত। খৃস্টানরা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী সম্পর্কে বলতো, ওদের দেখে মৃত্যুও ভয় করে। মরুভূমির যাতনা, সাগরের কষ্ট এবং দীর্ঘ মরু যাত্রাকেও এরা পরওয়া করতো না। এরা অনায়াসে আগুনে ঝাঁপ দিতে পারতো। শত্রু বাহিনীর রসদে আগুন লাগিয়ে ওদের কেউ কেউ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যেতেও পরোয়া করতো না কিন্তু জিন পরী সম্পর্কে এদের মধ্যে ছিল ভয়ানক ভীতি। ওরা সব সময় জিন-পরীর কাল্পনিক দানবীয় ত্রাসে-সন্ত্রস্থ থাকতো। অথচ কোন দিন তাদের কেউ জিন-পরী দেখেনি।

নাসের যদি জ্ঞাতসারে, স্বজ্ঞানে ঈসিয়াত দুর্গে নীত হতো তাহলে অতোটা ভয় পেতো না। বন্দী হয়ে এখানে নীত হলেও অতোটা ভয় হতো না তাদের। ফেরার হওয়ার বিষয় নিয়ে ভাবতো নির্ভিক চিত্তে। হাশীশ নেশা খাইয়ে অবচেতন করে, তাদের দেমাগে জিন-পরীর কল্পচিত্রের মায়াজাল সৃষ্টি করে ঈসিয়াত দুর্গ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তাদের। নেশার প্রভাব মুক্ত হলে সে বুঝতে পারলো মাইলের পর মাইল পর্যন্ত একই ধরনের মনোরম দৃশ্য থাকতে পারে না।

তরুণী নাসেরের গায়ের সাথে মিশে বসে যখন তাকে বলল, আমি জিন নই, তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার, এতে আরো ভড়কে গেল নাসের। তরুণী তার কাছে কল্পনার চেয়েও বেশী সুন্দরী। নাসের তাকে মানুষ ভাবতে পারছে না। সে জানতো, জিনরা মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য ছলনা করে থাকে। তার কাছে এই দুর্গটিকে মনে হলো জিন-পরীদের আবাস স্থল। তার সাথীরা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে মনে সাহস সঞ্চয় করে বলল, তোমার উপরে কিসের ভিত্তিতে আস্থা রাখবো, আমাদের প্রতি কেন তুমি এতোটা দরদী হয়ে উঠলে? কোথায় আমাদের নিয়ে এসেছো তোমরা? কেন এখানে এনেছো, জায়গাটির নাম কি?

আমাকে বিশ্বাস না করলে তোমাদের ভাইদের রক্তে রঞ্জিত হবে তোমাদের হাত, আপন সহকর্মীকে খুন করে আত্মতুষ্টি লাভ করবে তোমরা। হ্যাঁ। আমি একথা বলতে পারবো না; কেন তোমাদের প্রতি এতোটা দয়াবান হয়ে উঠলাম আমি। এই জায়গার নাম ঈসিয়াত। আর এটা ফেদাঈদের দুর্গ। ফেদাঈ নেতা শেখ সিনান এই দুর্গের অধিপতি। ফেদাঈদের সম্পর্কে তোমার তো জানার কথা?

হ্যাঁ, ফেদাঈদের সম্পর্কে জানি আমি। এখন বুঝতে পারছি তোমরাও ফেদাঈ। একথাও জানতাম ফেদাঈদের কাছে সুন্দরী তরুণী রয়েছে, যাদেরকে দুষ্কৃতকর্মে ব্যবহার করা হয়।

ওদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার নাম লিজা।

তোমার সাথে তো আরেকজন ছিল?

তার নাম তেরেসা। বলল লিজা। সেই তো তোমাদেরকে হাশীশে নেশাগ্রস্ত করে এখানে নিয়ে এসেছে।

লিজা এর বেশী কিছু বলতে পারল না। হঠাৎ দরজার পাশে এসে দাঁড়াল তেরেসা। তেরেসা চোখের ইশারায় লিজাকে বেরিয়ে আসতে বললে, লিজা বাইরে গেল।

এখানে কি করছ? লিজাকে জিজ্ঞেস করল তেরেসা। এই লোকটির সাথে মিশে বসতে তোমার এতটুকু ঘৃণা লাগেনি? তুমি কি জানো না মুসলমানরা ঘৃণিত? তুমি কি বেঈমানীর শাস্তি ভোগ করতে চাও?

তেরেসার কথায় লিজা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কোন কথাই বেরুল না তার মুখ থেকে। আবেগের বশীভূত হয়ে মুসলমান কর্তাব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করার কাজের প্রতি তার অনীহা জন্মে ছিল। তার মনে নিজ পেশার প্রতি ঘৃণা এতো প্রকট হয়ে পড়েছিল যে, তার পক্ষে আর নিজ পেশা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমিও তোমার মতই যুবতী। মুসলিম সৈনিক নাসেরকে আমারও ভাল লাগে। এমন সুদর্শন সুঠাম যুবককে কার না ভাল লাগবে। তুমি যদি বল যে, আমি এই যুবকের প্রেমে পড়ে গেছি; তাতেও আশ্চর্য বোধ করব না আমি। আমি বুঝি, এইসব মুসলিম উমারা, আর বয়স্ক মুসলিম দুর্নীতিবাজ আমলাদের প্রতি তোমার মনে প্রচণ্ড ঘৃণা, এদের হাতের পুতুল হতে তোমার মোটেও ইচ্ছে করে না, সব ঠিক কিন্তু তোমার মিশন ক্রুশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা আর প্রত্যেক মুসলমান তোমার জাতশত্রু। এদিকটি তুমি সামনে রাখো; তাহলে আর অসুবিধা হবে না। বলল তেরেসা।

না, না, তেরেসা। ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই, তুমি ভুল বুঝছো, আতংকিত কণ্ঠে বলল লিজা।

যদি আকর্ষণই না থাকবে তাহলে ওর কাছে এভাবে গা জড়িয়ে বসেছিলে কেন?

কথা জড়িয়ে গেল লিজার। জড়ানো কণ্ঠে বলল, আমি ব্যাপারটি তোমাকে বুঝাতে পারব না, কি মনে করে যে ওর কাছে এভাবে বসলাম!

কি কথা বলেছে ওর সাথে?

না! তেমন বিশেষ কোন কথা হয়নি।

কর্তব্য কাজে অবহেলা করছো তুমি। এটা পরিষ্কার বেঈমানী। যার অনিবার্য শাস্তি মৃত্যু। বলল তেরেসা।

তেরেসা শোন! ওই বুড়োটার কাছে আমি একাকী যেতে পারব না। ও যদি আমার সাথে জোড়াজুড়ি করে তবে ওকে মারব না হয় নিজেই আত্মহত্যা করব।

তেরেসা একটি সুদৃশ্য পাথরের মতো। তার দেহ সৌন্দর্য আকর্ষণ করতো সবাইকে, সবাইকে কাছে টানতো সে; কিন্তু কাউকেই নিজের করে নিতো না। তার নিজের মধ্যে কারো প্রতি অনুরাগ-বিরাগ ছিল না। লিজা এখনও সেই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তেরেসা মানসিক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয় না। রাগ-অনুরাগ, আবেগ-বিরাগ তার নিয়ন্ত্রণে।

আমি বুঝতেই পারিনি তুমি এতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠবে। এমনটি জানলে তোমাকে নিয়ে আসতাম না। কিন্তু এখানে আসা ছাড়া আমার কোন উপায়ও ছিল না। এই দুরবস্থার মধ্যে ত্রিপলী পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না বলে সবচেয়ে নিকটবর্তী এই মিত্রদুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। লিজা! আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবো এবং শেখ সিনানের দ্বারা তুমি যাতে পীড়িত না হও সে চেষ্টায়ও ত্রুটি করবো না। আমার অনুরোধ, এই দুঃসময়ে তুমি নিজের মর্যাদার ব্যাপারে এতোটা আবেগ প্রবণ হয়ো না।

তেরেসা! তোমাকে আমি মনের কথাটা বলেই ফেলি। বলল লিজা। আমি চাচ্ছি এই গোয়েন্দাদেরকে ব্যবহার করে এখান থেকে তুমিসহ পালিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে। এদের যা সাহস এবং এদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আমি যা শুনেছি, তাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছে, এদেরকে একটু সুযোগ করে দিলে ওরা আমাদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। এপথ ছাড়া এখান থেকে মুক্তির আর কোন পথ দেখছি না।

এদের যোগ্যতা ও সাহসকে আমি সম্মান করি। বলল তেরেসা। কিন্তু তুমি কি একথা ভেবেছো, আমরা উভয়েই বা তুমি একা যদি এদের সাথে চলে যাও তবে এরা আমাদেরকে গন্তব্যে যেতে না দিয়ে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। লিজা! মিথ্যা আশায় বুক বেঁধো না…… শোন! এখন তুমি গোসল করে কাপড় বদলে নাও। আমাদেরকে নৈশভোজে দাওয়াত করেছেন শেখ সিনান। তার সাথে তোমাকে কি করতে হবে তা আমি বলে দেবো। দৃশ্যতঃ হাবভাবে বুঝাবে, তুমি তার প্রতি বিরাগ নও এবং এখান থেকে পালানোর চিন্তাও তুমি করছো না। এই মাত্র আমি জানতে পেরেছি, হিরনের শাসক গোমশতগীন এখানে এসেছেন। গোমশতগীন কে তা তুমি জানো, এটাও জানো, আইয়ূবীর সবচেয়ে বড় স্বজাত শত্রু গোমশতগীন। এসব মুসলিম নেতাকে বহু কষ্টে আমরা হাত করেছি, তাকে তুমি নিজেদের লোক মনে করো।

* * *

লিজাকে তেরেসা এসে নিয়ে যাওয়ায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেল নাসের। নিশ্চিত হলো সে, তরুণী দুজন জিন নয়, মানুষ। কিন্তু এটা বুঝে উঠতে পারছিল না, লিজা তাদের প্রতি এতোটা দয়ার্দ্র হয়ে উঠলো কেন? লিজা যখন তাকে বলল, হাশীশ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে তারা, তখন সে বুঝল, ফিদাঈ সম্পর্কে ট্রেনিংকালেই অবগত করা হয়েছে তাদেরকে। তারা জানে ফেদাঈনরা সুন্দরী মেয়েদেরকে ব্যবহার করে। এই মেয়ে দুটোকে ব্যবহার করে হয়তো এরা চাচ্ছে তাদেরকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে।

সাথীদের জাগিয়ে দিল নাসের। ঘুম থেকে জেগে ওরা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখতে লাগল চারপাশ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবাই নাসেরের দিকে তাকাল।

বন্ধুগণ! আমরা ফেদাঈদের জালে আটকা পড়েছি। এটি ফেদাঈদের দুর্গ। এখানে ফেদাঈ নেতা শেখ সিনান ও তার বাহিনী থাকে। যে দুই তরুণীকে আমরা জিন মনে করেছিলাম এরা জিন নয় ফেদাঈন তরুণী। আমি এখনও জানি না, আমাদের ভাগ্যে কি ঘটবে। তোমরা জানো ফিদাঈ গোষ্ঠী খুবই ভয়ানক। ওদের কাছে যথাসম্ভব কম কথা বলতে চেষ্টা করবে। যদি বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পাই তবে ফেরার হওয়ার কথা ভাববো।

এরা কি আমাদেরকে জেলখানায় বন্দী করে ফেলবে? জানতে চাইল এক সাথী।

জেলখানায় বন্দী করে রাখলে তা আমাদের জন্যে সৌভাগ্যের কারণ হতো, কিন্তু ফেদাঈনরা হাশীশ ও নারী ব্যবহার করে আমাদের দেমাগ বিগড়ে ফেলবে, তখন আমরা আমাদের ধর্ম, কর্ম ও কর্তব্য সব ভুলে যাবো।

ফেরার হওয়া ছাড়া মনে হয় আর কোন পথ নেই। বলল নাসেরের অপর এক সাথী।

ঈমান হারা হওয়ার চেয়ে আমাদের মৃত্যুবরণ করাও ভাল। বলল অপর একজন।

নিজেরা সচেতন থেকো, আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, বলল নাসের। এতো সহজে আমাদেরকে এরা কাবু করতে পারবে না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এক লোক দুটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে গেল ঘরের মেঝেতে। তারা আগন্তুকের সাথে কোন কথা বললো না। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে সবার। কক্ষ থেকে অদূরে অন্য একটি ঘরে শেখ সিনানের নৈশভোজ চলছে। সেখানে জমজমাট আসর। বাহারী ভোজ আয়োজন, সুরা ও নারীর সম্মিলন। খাবারের ঘ্রাণ ও শরীরে ব্যবহৃত খুশবুতে গোটা দুর্গ মোহিত। শেখ সিনান খাবার মজলিসে রাজকীয় আসনে উপবিষ্ট, তার একপাশে লিজা অপর পাশে তেরেসা আর মুখোমুখি সামনে গোমশতগীন বসে আহার করছে।

সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গীর সময়ে গোমশতগীন ছিল হিরনের গভর্নর। জঙ্গীর মৃত্যুর পর সে নিজেকে হিরন এলাকার স্বাধীন খলিফা ঘোষণা করে। এভাবে কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাইফুদ্দীন ও মালিক আস সালেহ। এই তিন বিদ্রোহী একত্রিত হয়ে জোট বাঁধে কেন্দ্রীয় শাসক আইয়ূবীর বিরুদ্ধে। খৃস্টানদের সাথে গড়ে তোলে সখ্যতা। খৃস্টানরা গোমশতগীনকে সরাসরি সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি বটে, কিন্তু গুপ্ত ঘাতক, সন্ত্রাসী এবং মদ-নারী ও প্রচুর নগদ অর্থ সাহায্য করে।

গোমশতগীন ছিল কুচক্রী। ময়দানের ভূমিকার চেয়ে ওর কূটবুদ্ধির জোর ছিল বেশী। শত্রুকে সে মাটির নীচ দিয়ে আঘাত হানতো, মিত্রদেরকেও সুযোগ মতো শায়েস্তা করতে ত্রুটি করতো না। মিত্রদের ঘাড়ে চড়ে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এবং রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর থাকতো। মিত্রদেরকে কখনই সুনজরে দেখতো না গোমশতগীন। বন্ধুদের প্রতিও সে থাকতো সন্দিহান। যৌথ বাহিনীর কমান্ড সাইফুদ্দীনের কজায় চলে যাওয়ার পর তুর্কমানে যাওয়ার পথে শেখ সিনানের দুর্গে চলে এলো। সে বুঝতে পেরেছিল সম্মুখ যুদ্ধে আইয়ূবীকে পরাস্ত করা কঠিন। সাইফুদ্দীন যতোই শক্তি নিয়ে যাক না কেন তাকে নিরাশ হয়েই ফিরে আসতে হতে পারে। গোমশতগীন জানতো ক্ষমতালিম্পু ব্যক্তিদের কর্তৃত্বের হুমকি সেনাবাহিনী। তার সামনে আইয়ূবী ছাড়া আর কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। কয়েকবার গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা আইয়ূবীকে হত্যার চেষ্টাও সে করেছে কিন্তু সবগুলো চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে, তাই শেখ সিনানের দুর্গে এসেছে আইয়ূবীকে যাতে নিশ্চিত অব্যর্থ আঘাত হানার ব্যবস্থা করা যায়। ভবিষ্যৎ চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্যে গোমশতগীন ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছে লিজা-তেরেসা আসার একদিন আগে। সাইফুদ্দীনের নেতৃত্বে জোট বাহিনীর পরিণতি সংবাদ জানতো না সে।

* * *

গোমশতগীন ভাই! তোমার বন্ধু তো তুর্কমান থেকে পালিয়েছে। আহার চলাকালীন সময়ে গোমশতগীনের উদ্দেশ্যে বলল শেখ সিনান। তেরেসার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, তাকে খবরটি শুনিয়ে দাও না! যৌথ বাহিনীর পরাজয় ও সাইফুদ্দীনের পালিয়ে যাওয়ার সংবাদে গোমশতগীন এতোই হতাশ হলো যে, তার মুখে কোন কথাই ফুটল না। করুণ দৃষ্টিতে তাকাল তেরেসার দিকে। তেরেসা তাকে জানাল, মাত্র অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে কী নাটকীয়ভাবে আইয়ূবী সাইফুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেছে। সাইফুদ্দীন সম্পর্কে তেরেসা বলল, আমরা সেখান থেকে আসার আগেই সাইফুদ্দীন পালিয়ে গিয়েছে।

বন্ধুরা আমাকে বিপদে ফেলেছে, বলল গোমশতগীন। যৌথবাহিনীর কমান্ড সাইফুদ্দীনের হাতে দিতে আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু সহযোগিরা আমার কথা শুনলো না। জানি না এখন আমার বাহিনী কোন অবস্থায় আছে!

ভাল নেই। বলল তেরেসা। আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী আপনার সৈন্যদেরকে নিরাপদে পালিয়ে আসার সুযোগও দেয়নি।

সিনান ভাই! তুমি তো জান, কি জন্যে আসলাম।

হ্যাঁ। জানি, আইয়ূবীকে হত্যার ব্যবস্থা করতে এসেছে।

যা চাও; দেবো। কিন্তু আইয়ূবীকে হত্যা করে দাও।

শোন! বলল শেখ সিনান। খৃস্টান নেতৃবর্গ ও সাইফুদ্দীনের কথায় আমি চার ফেদাঈ আইয়ূবীকে হত্যা করতে পাঠিয়েছি। কিন্তু মনে হয় না তারা সফল হবে।

যৌথ নয়, আমি তোমাকে এককভাবে দায়িত্ব দিলাম। সম্পূর্ণ খরচ আমি একা বহন করব। তুমি আমার কাছে কজন লোক দাও। আমি নিজে তাদের কাজ তদারকি করব।

যে চারজন পাঠিয়েছি, এরা আমার শেষ পুঁজি। আমার কাছে খুনীর অভাব নেই। কিন্তু আইয়ূবীকে হত্যার বেলায় আমি ব্যর্থ। তাকে আমি ভয় করি।

কেন? জানতে চাইলো গোমশতগীন। আইয়ূবী কি তোমাকে কোন দুর্গ দিয়ে দিয়েছে নাকি?

না, জবাব দিল সিনান। আইয়ূবীকে খুন করতে গিয়ে আমি কজন অভিজ্ঞ ফেদাঈ হারিয়েছি, আমার ফেদাঈ ঘুমের মধ্যে তাকে হামলা করেও নিজেরাই খুন হয়ে গেছে। একবার তীর চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। আমার এখন মনে হয় আইয়ূবীর উপরে আল্লাহর হাত রয়েছে। তার কাছে এমন কোন শক্তি আছে, খঞ্জর, তীর কিছুই তাতে কাজ করে না। আমার গোয়েন্দারা বলেছে, যে কয়বার তার উপর আক্রমণ করা হয়েছে, আক্রমণ ভণ্ডুল করে সে ক্লান্ত হয় না, ক্ষুব্ধ হয় না বরং মুচকী হাসে। জীবন হরণকারী ঘটনাকে সে বেমালুম ভুলে যায়।

কত লাগবে বল সিনান? জিজ্ঞেস করল গোমশতগীন। মনে হয় তুমি আনাড়ী খুনী পাঠিয়েছিলে।

না, যাদের পাঠিয়েছিলাম, এরা ছিল এখানকার সেরা। এদের কোন টার্গেট কখনও ব্যর্থ হয়নি। এদের টার্গেট থেকে এ পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি। অবশ্য আমার কাছে উস্তাদেরও উস্তাদ আছে। কিন্তু গোমশতগীন ভাই! তোমরা বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে আইয়ূবীর কিছু করতে পারনি; আর আমি মাত্র তিন চারজন লোক পাঠিয়ে ঝুঁকি নিতে চাই না।

আমার মনে হয় আইয়ূবী হত্যার ব্যাপারে তোমার অনাগ্রহী হওয়ার অন্য কোন কারণ আছে! সংশয় প্রকাশ করল গোমশতগীন।

কারণ একটাই, আইয়ূবীর সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন বিরোধ নেই। হাসান বিন সাবাহ নবী হতে চেয়েছিল, আমি এসবে বিশ্বাস করি না। খুন ও হাশীশ আমার পেশা ও নেশা। আইয়ূবী আমাকে বেশী পারিশ্রমিক দিলে তোমাকেও হত্যা করতে আমার আপত্তি থাকবে না।

আইয়ূবী কাপুরুষের মতো কাউকে হত্যা করে না, এজন্য কোন কাপুরুষ তাকে হত্যা করতে পারবে না। বলল লিজা।

ওহ্! সুন্দরী, অট্টহাসিতে উল্লাসে ফেটে পড়ল সিনান। লিজাকে বেগলদাবা করে বলল, দারুণ কথা বলেছে। কাপুরুষ কখনও সুপুরুষের ক্ষতি করতে পারে না। গোমশতগীন ভাই! মালিক, সাইফুদ্দীন, তুমি আর খৃস্টানরা মিলে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছে আইয়ূবী তোমাদের সবার প্রতিপক্ষ বলে। আসলে তোমাদের মধ্যেওতো বিশ্বাস নেই। আইয়ূবী মারা গেলেতো তোমরাই শুরু করবে পারস্পরিক সংঘাত। একথা জেনে রেখো, আইয়ূবী মরে গেলেও তার রাজত্বের এক হাতও পাবে না তোমরা। তার অনুসারী ও ভাইয়েরা বিশ্বস্ত ও নীতিবান, ওরা তার রাজত্ব আগলে রাখবে। তুমি যদি কাউকে শেষ করে ফায়দা নিতে চাও, তবে সাইফুদ্দীনকে সাফাই করে আলেপ্পো কজা করে ফেল। একাজটা তুমি নিজেই করতে পারবে, কারণ সাইফুদ্দীন এখন তোমার মিত্র।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল গোমশতগীন। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল গোমশতগীন–ঠিক আছে সাইফুদ্দীনকেই খুন করিয়ে দাও, বল-কত লাগবে?

সাইফুদ্দীন হত্যার মূল্য হিরন দুর্গ, বলল সিনান।

হু, তোমার দেমাগ ঠিক নেই সিনান! মুদ্রার হিসেবে পারিশ্রমিক চাও।

পারিশ্রমিক হিসেবে মুদ্রা দিতে চাইলে তোমাকে চারজন লোক দিচ্ছি, এরা আমার ফেদাঈ নয় আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর সদস্য। এই তরুণীরা এদেরকে হাশীশ খাইয়ে পথ ভুলিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। এদের আমি কাউকে দিতে চাচ্ছিলাম না। এমন অভিজ্ঞ লোক পাওয়া কঠিন। গোমশতগীন ভাই! তুমি জানো, হাশীশ আর আমার এই পরীরা যে কোন মানুষকে এভাবে বদলে ফেলে যে নিজের মা-বাপকে সে অবলীলায় হত্যা করতে পারে। তোমাকে আমি হতাশ করতে পারি না। এদেরকে নিয়ে প্রাসাদের রাজকীয় পরিবেশে রাখো, হারেমের আরাম-আয়েশ দেখাও, আমার পরীরা এদেরকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলবে। হাশীশ, শরাব আর সুন্দরীভোগে অভ্যস্ত করে ফেলো, দেখবে, তোমার কথায় জীবন দিয়ে দেবে।

আইয়ূবীর সৈনিকরা তোমার কথা মতো অতো কাঁচা লোক নয়, সিনান!

গোমশতগীন ভাই! সে কথা আমি জানি। কিন্তু তুমি তো জানো, আমরা ফেদাঈ, মানুষের দেমাগ নিয়েই আমাদের খেলা। আমরা মানুষের মনে এমন কল্পনা ঢুকিয়ে দেই যে, কল্পনাকেই সে বাস্তব মনে করতে থাকে। কোন পুরুষের সামনে সুন্দরীদের অনুভূতি দিতে থাক, আর মদ, নেশা ও নারী সহজলভ্য করে দাও, সে কল্পনা ও অনুভূতির দাসে পরিণত হবে, মদ নারী ও ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত করে কট্টর লোকের ঈমানও তুমি সহজে কিনে নিতে পারবে।

এদের নিয়ে যাও তুমি। এদের ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। একটু বক্র হাসি দিয়ে শেখ সিনান বলল, ভাই! ভেবে দেখ, মদ নারী ভোগবিলাস তোমাকেই কোথা থেকে কোথায় নামিয়েছে! মুসলিম খেলাফতের রক্ষক হয়েও তুমি এখন খেলাফতের সবচেয়ে বড় শত্রু।

শেখ সিনান গোমশতগীনকে জানাল, কত মূল্য দিতে হবে তাকে……..। কথা পাকা হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো, গোমশতগীন চার যোদ্ধাকে নিয়ে যাবে। সিনান বলল, এদের বন্দী না রেখে হারেমে শাহজাদাদের মতো আযাদ করে দেবে। তাতেই রাজী হল। অবশেষে দুদিন পর এসে এদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সিনানের দুর্গ ত্যাগ করল গোমশতগীন।

শেখ সিনানের কক্ষ থেকে গোমশতগীন বেরিয়ে যাওয়ার পর এক শান্ত্রী কক্ষে প্রবেশ করল। শান্ত্রী জানতে চাইল, আজ যে চারজন লোককে আনা হয়েছে এদের ব্যাপারে হুকুম কি?

হিরনের গভর্নর গোমশতগীন এসেছেন। তিনি এদের নিয়ে যাবেন। এদের খাওয়া-দাওয়া, আরাম আয়েশের ব্যবস্থা কর। তাদেরকে কোথায় পাঠানো হচ্ছে, এটা যেন তারা জানতে না পারে।

শান্ত্রী কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সে নাসের ও তার সাথীদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করল। খেতে অস্বীকার করল নাসের। ভাবল, খাবারে হয়ত আবারো হাশীশ দেয়া হয়েছে। তাকে খুব কষ্টে বুঝানো হল যে, এই খাবারে কোন নেশাদ্রব্য দেয়া হয়নি। নাসের ও তার সাথীরা ছিল খুবই ক্ষুধার্ত। লোভনীয় খাবার সামনে দেখে তাদের পেটের ক্ষুধাটা আরো তীব্র হয়ে উঠল। পেটের জ্বালা মেটাতে খাবারে নেশা মেশানোর আশঙ্কা মেনে নিয়েই আহারে প্রবৃত্ত হল তারা।

শেখ সিনান তেরেসাকে বলল, তুমি চলে যাও, লিজাকে আমার কাছে রেখে যাও।

তেরেসা বলল, তিন চার দিন আমরা বিরামহীনভাবে সফর করেছি। উভয়েই খুব ক্লান্ত। এখন আমাদের বিশ্রাম দরকার। আগে বিশ্রাম করতে দিন। তারপর লিজা খুশী হয়েই আপনার কাছে চলে আসবে।

কিন্তু সিনান মানুষ নামের একটা পাষণ্ড। মানবিক মূল্যবোধ সিনানের মধ্যে ছিল না। লিজার ক্লান্তি শ্রান্তি ও দেহ মনের প্রফুল্লতার দিকে নজর দেয়ার মেজাজ সিনানের থাকবে কেন। সে প্রথমে লিজাকে উত্যক্ত করতে শুরু করল। সিনানের মানসিক অত্যাচার সে মুখ বুজে সহ্য করল তেরেসার কথায়। সিনানের কজা মুক্ত হওয়ার চিন্তাও করতে লাগল লিজা। কিন্তু সিনান আরো ভয়ংকর হয়ে উঠল। উন্মত্ত পশুর মতো লিজাকে খুবলে খেয়ে ফেলার মতো শুরু করল উন্মাদনা। এমন সময় হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল খাস প্রহরী। বলল, আপনার সাথে এক লোক দেখা করতে চায়। গর্জে উঠল সিনান। বলল, এখন কারো দেখা করার অনুমতি নেই। বল, এখন দেখা করা যাবে না।

কিন্তু নিষেধাজ্ঞা আর অনুমতির তোয়াক্কা না করে খাস প্রহরীকে ঠেলে কক্ষে ঢুকে পড়ল আগন্তুক।

লোকটি এক উঁচু পদের খৃস্টান। তাকে দেখে স্মীত হেসে নাম ধরে ডাকল সিনান। বলল, বেশ বেশ, তুমি এসেছ, ভালই হলো। তবে আজ রাতে আর কথা নয়, সকালে কথা বলব। এখন মেহমান খানায় গিয়ে আরাম কর।

হ্যাঁ, আগামী সকালেই আপনার সাথে আমি দেখা করতাম। কিন্তু এখানে এসেই শুনেছি, লিজা ও তেরেসা আপনার এখানে। এদের সাথে এক্ষুণি কথা বলা দরকার। আমি এদের নিয়ে গেলাম।

তেরেসার কাঁধে হাত রেখে বলল সিনান, ওকে নিয়ে যাও, আর লিজাকে নিজের কোলের দিকে টেনে বলল, ওকে আমি এখানেই রেখে দিচ্ছি।

চোখ লাল হয়ে উঠল খৃস্টান কর্মকর্তারা বলল, শেখ সিনান! আপনি জানেন, আমি কেন এসেছি। এই তরুণীদের কাজ সম্পর্কেও আপনি অবগত। আপনার বাহুবন্দী হয়ে থাকা এদের কাজ নয়, উভয়কেই আমি নিয়ে যাচ্ছি। খৃস্টান কর্মকর্তা লিজা ও তেরেসার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আমার সাথে চল।

লাফিয়ে উঠল দুই তরুণী। উভয়েই গিয়ে দাঁড়াল খৃস্টান কর্মকর্তার পাশে।

তুমি কি আমার শত্রু সেজে মোকাবেলায় নামতে চাও? ক্ষোভে অপমানে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল সিনানের। জান, মেহমানের মর্যাদা থেকে তোমাকে আমি কয়েদী বানাতে পারি। ভুলে গেছো, এখন তুমি আমার দুর্গে অবস্থান করছো? আমি তোমাকে বলছি–এই মেয়েটিকে রেখে কক্ষত্যাগ করতে পার।

শেখ সিনান তখন নেশাগ্রস্ত। তাছাড়া সে ফেদাঈ সম্রাট। এ অঞ্চলের যে কোন রাজা বাদশাহকে সে যে কোন মুহূর্তে খুন করাতে পারে। কেউ জানতে পারবে না যে, এ হত্যাকাণ্ড শেখ সিনানের লোকেরা ঘটিয়েছে। ইতিমধ্যে সে বহু খৃস্টান অফিসার হত্যা করিয়েছে। খৃস্টানরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট শত্রুতার কারণে প্রতিপক্ষকে হত্যা করাতে শেখ সিনানের স্মরণাপন্ন হতো।

ঈসিয়াত দুর্গে থাকতো মানুষরূপী দৈত্য। দুর্গের অভ্যন্তরে মানুষ প্রবেশ করে হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফেদাঈরা উন্মাদের মতো মানুষ হত্যা করে উল্লাস করে। মানুষ খুন করা ওদের কাছে মুখের থুথু ফেলার মতো। শেখ সিনানের বালাখানাটি ছিল রঙ-বেরঙের বাহারী ফানুস দ্বারা সাজানো। মহলের ছাদ ও দেয়ালে সীসা, তামা ইত্যাদি দিয়ে কারুকার্য করা। মহলের সৌন্দর্য দেখে কেউ মনে করতে পারবে না যে, এই দুর্গের চারপাশ দুর্ধর্ষ পাশবিকতার জালে ঘেরা। দুর্গের অভ্যন্তরভাগ দেখে কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয় এর বাইরে প্রাণঘাতি রুক্ষ মরু আর পাথুরে পাহাড়, পর্বত, টিলার সমাহার।

নিজের এই দুর্গে শেখ সিনান ছিল রাজা। দুর্গ রাজ্যে সে ছিল ইচ্ছাপতি। তার বিরুদ্ধাচরণ করার মতো চারপাশে কেউ ছিল না। এ কারণে দুর্গরাজ্যে শেখ সিনান নিজের সাধ-আহ্লাদ মিটাতে হেন কোন অমানবিকতা নেই যা সে অপহরণকৃত তরুণীদের উপর প্রয়োগ করতো না। তার শিষ্যরা প্রভুকে খুশী রাখার জন্যে সুকৌশলে সুন্দরী মেয়েদেরকে অপহরণ করতো। এছাড়া খৃস্টানরা ইচ্ছে করেও সুন্দরী মেয়েদেরকে পাঠাতো শেখ সিনানের মনোরঞ্জন করে তাকে বাগে রাখার জন্যে। লিজার মতো অপরূপা সুন্দরী তরুণী দেখে সিনানের ভোগবাদী পাশবিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সিনানের মতো পাকা শিকারী লিজাকে বাগে পেয়েও হাতছাড়া করার কথা ভাবতে পারে না। তার প্রমোদে বাধ সাধায় সে খৃস্টান কর্মকর্তার উপর ভীষণ ক্ষেপে গেল। খৃস্টানের উদ্দেশে বলল, তোমাকে আমি ভেবে দেখার অবকাশ দিচ্ছি। তুমি আমার সাথে বিরোধে যেতে চাওয়ার আগে ভেবে দেখো, আমার এই দুর্গে জিনও যদি গায়েব করে ফেলা হয় তবে শয়তানও এর পাত্তা পাবে না। এই তরণীকে কিছুতেই দুর্গের বাইরে যেতে দেবো না আমি। ইচ্ছে করলে তোমাকেও দুর্গের ভিতরে লাপাত্তা করে দিতে পারি।

শেখ সিনান! আপনি চালে ভুল করছেন। আমার এক সাথী আগে চলে গেছে, সে জানে আমি লিজা ও তেরেসার খোঁজে এখানে এসেছি। দুই/তিন দিন এখানে থেকে পরে চলে যাবো। আপনি জানেন, আপনার সাথে সহযোগিতামূলক চুক্তির অধীনে আমরা এই দুর্ভেদ্য দুর্গ আপনাকে উপহার দিয়েছি। এটি আমাদের বিশ্রামাগার এবং বিকল্প আশ্রয় স্থল। আপনি আমার হাড়গোড় নিশ্চিহ্ন করে দিলেও আপনার কাছে জিজ্ঞেস করা হবে আমাদের দুটি মেয়ে ও কর্মকর্তা কোথায়?

আপনি যদি আইয়ূবীকে হত্যা করাতে পারেন, তবে এমন এক ডজন মেয়ে আপনাকে দেয়া হবে। আপনি তো দীর্ঘ দিন যাবত আমাদের টাকা হজম করছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারছেন না। আমরা জানি, আপনি আইয়ূবীকে হত্যা করতে চার ফেদাঈ পাঠিয়েছেন কিন্তু আমাদের কাছে সবই ধোকাবাজী মনে হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আইয়ূবী এখনও জীবিত এবং সে একের পর এক বিজয় অর্জন করছে।

ধোঁকা নয়, আমি ঠিকই চার ফেদাঈ পাঠিয়ে দিয়েছি, দেখবে অল্প দিনের মধ্যেই আইয়ূবী খুন হয়ে যাবে। রাগে ক্ষোভে জড়ানো গলায় বলল সিনান।

তাই যদি হয়, তবে শুনে রাখুন, আমি নিজ থেকে আপনাকে এই লিজার চেয়েও বেশী সুন্দরী দুই তরুণী উপহার দেবো। তা ছাড়া আমাদের কর্তাদের কাছ থেকে তো আপনি বেহিসাব উপহার উপঢৌকন পাবেনই।

সেটা পরে দেখা যাবে। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, এই মেয়েটিকে তুমি এখন আমার কক্ষ থেকে নিয়ে যেতে পারো কিন্তু দুর্গের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। এখন তুমি একে তোমাদের জন্যে সংরক্ষিত অতিথিশালায় নিয়ে যাও। সেখানে খাও দাও, আরাম-আয়েশ কর এবং চিন্তা কর এই মেয়েকে আমার কাছে আবার ফিরিয়ে দেবে কি-না?

কর্মকর্তা উভয় তরুণীকে নিয়ে বাইরে চলে এল। লোকটি ছিল খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষ অফিসার। আইয়ূবী শাসিত অঞ্চলের খোঁজ খবর নিয়ে দফতরে পৌঁছার পথে সে শেখ সিনানের দুর্গে এসেছিল। দুর্গে পৌঁছার সাথে সাথেই এক প্রহরী তাকে বলে দিয়েছিল এখানে দুই খৃস্টান তরুণী কয়েকজন শত্রু পক্ষের যোদ্ধাকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে। তারা এখন শেখ সিনানের কক্ষে রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা খৃস্টান মেয়েদের কথা শুনে তাদের সাথে দেখা করার জন্যে সিনানের কক্ষে ঢুকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিরূপতার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। অতঃপর পরিস্থিতি তাকে সিনানের কজা থেকে তরুণীদের উদ্ধারে বৈরী আচরণে বাধ্য করে। যার ফলে তরুণীদের নিয়ে সে সিনানের কক্ষ ত্যাগ করে অতিথিশালায় চলে আসে।

খৃস্টান কর্মকর্তা তরুণীদের নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর শেখ সিনান তার বিশ্বস্ত প্রহরীকে ডেকে নির্দেশ দিল, এই দুই তরুণী ও খৃস্টান পুরুষ আমাদের বন্দী নয়, তবে তাদের ইচ্ছে মতো যখন তখন দুর্গের বাইরে যেতে দেবে না। ওদের প্রতি এখন থেকে কড়া নজর রাখবে। আর গোমশতগীন পুনর্বার ফিরে এলে বন্দী চারজনকে নিয়ে যেতে দিবে। গোমশতগীন যখন ইচ্ছা আসতে পারবে যেতে পারবে, তার উপর কোন বিধি-নিষেধ নেই।

তরুণীদ্বয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে জানাল, শেখ সিনানের কাছে হিরনের গভর্নর গোমশতগীন এসেছিল। সে এখন বাইরে গেছে। গোমশতগীন সাইফুদ্দীনকে হত্যা করানোর পরিকল্পনা করেছে।

* * *

সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী মোজাফফর উদ্দীনের আক্রমণ প্রতিরোধে সফল ও প্রতিআক্রমণে অব্যর্থ হওয়ায় মোজাফফর উদ্দীন ময়দান ত্যাগ করে চলে গেল। কিন্তু বহু সংখ্যক শত্রুসেনার সাথে ধরা পড়ল সাইফুদ্দীনের ডান হাত ও প্রধান উজীর ফখরুদ্দীন। সুলতান অন্যান্য বন্দীদের থেকে ফখরুদ্দীনকে আলাদা করে নিজের কক্ষে এনে পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদায় রাখলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গনীমতের সম্পদ বণ্টন করার আগেই তিনি ঘোষণা করলেন, শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ভাবন করার প্রয়োজন নেই। অধিকাংশ ঐতিহাসিক, আইয়ূবীর এই সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কিন্তু গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আইয়ূবী যদি সেদিন শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ভাবনের নির্দেশ দিতেন তবে তার গোটা বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হতো, শত্রুবাহিনী তার অস্তিত্বে চরম আঘাত হানতো, হতে পারতো তার ইতিহাস সেখানেই থেমে যেতো।

মোজাফফর উদ্দীনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সুলতানের সৈন্য বাহিনীর ব্যাপক শক্তি ক্ষয় হয়। মোজাফফর উদ্দীনের মোকাবেলায় বিজয়ের জন্যে সুলতানকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শত্রুবাহিনীকে তাড়া করতে হলে তাকে একান্ত নিরাপত্তা ইউনিটকে ব্যবহার করতে হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, একান্ত নিরাপত্তা বাহিনীকে পাঠালে শত্রুবাহিনী এই সুযোগে তার অস্তিত্ব বিনাশে মরণ আঘাত হানতো। তা ছাড়া মুসলমানদের ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে সব সময়ই তিনি চাইতেন যাতে লোকক্ষয় কম হয়। যেহেতু বিজয় তার হয়েছে; পিছু তাড়া করে বিভ্রান্ত মুসলিম সৈন্যদের হত্যা করে খুনাখুনির সংখ্যা বৃদ্ধি করা থেকে বিরত থেকেছেন তিনি।

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ূবী নিজের তাঁবুতে দাঁড়িয়ে সাইফুদ্দীনের আপন ভাতিজা সেনাপতি আযুদ্দীন ফররাখ শাহকে ডেকে পাঠালেন। আযুদ্দীন ছিলেন সুলতানের সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপতি। সে সময়ের পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক। আপন ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে, চাচা ভাতিজার বিরুদ্ধে, মামা ভাগ্নের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। আযুদ্দীনকে ডেকে সুলতান মুচকি হেসে বললেন, এই তাঁবু তোমার চাচার। সব কিছুতো বণ্টন হয়ে গেল, চাচার উত্তরাধিকারী হিসেবে তুমি এই তাবু ও সমুদয় সম্পদের অধিকারী। তুমি এসব নিয়ে যেতে পার। এটি তোমারই প্রাপ্য। সুলতানের কথায় সেনাপতি আযুদ্দীনের চোখে পানি এসে গেল।

ঐতিহাসিক কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর স্মৃতিচারণ গ্রন্থে লিখেছেন, সেনাপতি আযুদ্দীনের চোখে পানি দেখে সুলতান বললেন, আযুদ্দীন! জানি আমার প্রস্তাব ও তোমার চাচার করুণ পরিস্থিতিতে তুমি দুঃখ পেয়েছে। চাচার জন্যে তোমার দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভুলে যেয়ো না, আমরা আল্লাহর নির্দেশ পালন করছি মাত্র। আজ যদি আমার বিপক্ষে আমার ছেলেও দাঁড়াতো আমি তাকে রেহাই দিতাম না। জিহাদের পথে আমার আপন সন্তান বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমার তরবারী তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। জেনে রেখো, চাচার করুণ পরিণতি দেখে তোমার চোখে পানি এসে গেছে, কিন্তু এমনটা হলে আমার পুত্রের মাথা দ্বিখণ্ডিত করেও আমার চোখে পানি আসবে না।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটু সরে গিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্যে শিবির স্থাপন করলেন সুলতান। সুলতান যেখানে শিবির স্থাপন করলেন সেখান থেকে মাত্র পনের মাইল দুরে আলেপ্পোর অবস্থান। আলেপ্পো তখন মালিক আস্-সালেহ্-এর দখলে। মালিক সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে সাইফুদ্দীন ও গোমশতগীনের সাথে জোট বেঁধেছে। জোট বাহিনীর হেড কোয়ার্টার আলেপ্পো। আলেপ্পো শহর রক্ষা প্রাচীর খুবই মজবুত। আর অধিবাসীরা লড়াকু। ইতিপূর্বে দীর্ঘ সময় অবরোধ করেও সুলতান আলেপ্পাকে দখলে নিতে পারেননি। আর এখন আলেপ্পো দখলের আগে তার নিজের বাহিনীকে মজবুত করার প্রয়োজনীয়তা বেশী। এদিকেই নজর দিলেন সুলতান।

শিবিরে থাকাকালীন সময়ে বোজা ও নবজ এর শাসকদের নামে সুলতান দুটি চিঠি পাঠালেন। বোজায় পাঠালেন সেনাপতি আযুদ্দীনকে। আর ফখরুদ্দীনকে সুলতানের বিশেষ দূত হিসেবে নবজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এ কয়দিনের ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও উন্নত মানবিকতা দিয়ে সুলতান ফখরুদ্দীনকে জয় করে নিয়েছিলেন। তিনি ফখরুদ্দীনকে নবজ-এ বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানোর প্রস্তাব করলেন। ফখরুদ্দীন একথা শুনে চোখ বড় বড় করে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুলতান ফখরুদ্দীনের বিস্ময়ভরা চাহনী দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, আপনি এমন করে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না? নিজেকে কি আপনি মুসলমান মনে করেন না? না নিজের ঈমানের প্রতি বিশ্বাস নেই আপনার। শুনুন, নবজ দুর্গের নিয়ন্ত্রণ আমার দরকার। এজন্য আপনাকে আমার বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানোর চিন্তা করেছি, আমি খুনোখুনি চাই না। আপনি গিয়ে নবজ এর গভর্নরকে বলবেন, খুনখারাবী না করে দুর্গ আমাদের হাতে হস্তান্তর করুক এবং তার সেনাবাহিনীকে আমাদের বাহিনীতে লীন করে দিক।

আযুদ্দীন ও ফখরুদ্দীন বিশেষ দূত হিসেবে নবজ ও বোজায় চলে গেলেন।

বাজার শাসক আযুদ্দীনকে তোপধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাল। সে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ূবীর পয়গাম পড়ল। আইয়ূবী লিখেছেন, প্রিয় ভাই! আমরা সবাই এক আল্লাহ্, এক রাসূল ও এক কুরআনের পূজারী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা সবাই ছিন্নভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছি। বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কি কখনও কিছু করতে পারে? বিচ্ছিন্ন কোন অঙ্গ কি কোন উপকারে আসতে পারে? অথচ রাসূলের ভাষায় আমরা সবাই একই দেহের অভিন্ন অংশ ছিলাম। অভিন্নতা আমরা রক্ষা না করে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় আমাদেরকে খৃস্টানরা শকুনের মতো টুকরো টুকরো করে চিরে খাচ্ছে। উম্মতে মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই একত্রিত হতে হবে। অন্যথায় শত্রুরা কাউকেই অক্ষত থাকতে দিবে না। আমি আপনাকে উম্মতে মুসলিমার অংশ হিসেবে ঐক্য স্থাপনের জন্যে দাওয়াত দিচ্ছি। কুরআনে কারীমের আহ্বান আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। আমার আহ্বান বুঝার চেষ্টা করুন এবং তদনুযায়ী কাজ করার প্রস্তুতি নিন।

আপনার প্রথম কাজ হবে ইসলামী সালতানাতের কাছে আপনার দুর্গের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে আমার আনুগত্য স্বীকার করে নেয়া। তা করলে আপনার সেনা বাহিনী আমার বাহিনীতে একীভূত করা হবে এবং আপনাকে দুর্গের অধিপতি করে দুর্গে আমাদের পতাকা উড়িয়ে দেয়া হবে। এই প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানালে আমার সেনাদের অবরোধ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিন। আলেপ্পো, হিরন ও মৌসুলের গভর্নর ও যৌথ বাহিনীর করুণ পরিণতি গভীরভাবে দেখলে আপনার সিদ্ধান্তে পৌঁছা সহজ হবে। আমি আশা করি, আমার প্রস্তাব আপনি সাগ্রহে গ্রহণ করবেন এবং আপনার সাথে সদ্ব্যবহারের সুযোগ দিবেন। মনে রাখবেন, আপনার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন বিরোধ নেই, আমি যা করছি সবই আল্লাহর হুকুম ও শরীয়তের নির্দেশ পালনার্থে করছি।

বোজার শাসক সুলতানের পত্র পাঠান্তে আযুদ্দীনের দিকে তাকালে আযুদ্দীন বললেন, সম্মানীত আমীর! আপনার দুর্গ অতোটা মজবুত নয়, তাছাড়া আপনার সেনাবাহিনীও ছোট, আমি আশা করি আমাদের মোকাবেলায় যুদ্ধে নেমে আপনি আমাদের সৈন্যদের হাতে আপনার সৈন্যদের হতাহতের দিকে ঠেলে দিবেন না।

বোজার শাসক সুলতানের প্রস্তাব মেনে নিয়ে সুলতানকে লিখিত আমন্ত্রণে দুর্গের অধিকার নেয়ার আহ্বান জানালেন।

নবজ এর শাসকও সুলতানের প্রস্তাব কবুল করে নিল। ফখরুদ্দীন তাকে দিয়ে জবাবী পয়গাম লিখিয়ে নিয়ে সুলতানের কাছে ফিরে এলেন।

সুলতান নিজে উভয় দুর্গে গিয়ে দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে দুর্গাভ্যন্তরের সৈন্যদেরকে তার সেনা শিবিরে পাঠিয়ে দিলেন আর নিজস্ব সৈন্যদের একটি দলকে দুর্গাভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিলেন। সুলতান সৈন্যদেরকে দুর্গবন্দী করলেন না। আলেপ্পোর কাছেই ছিল ইজাজ নামে অপর একটি দুর্গ। ইজাজ দুর্গের অধিপতি ছিল আলেপ্পো শাসক মালিক আস-সালেহ্-এর অনুগত। সুলতান আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়ার আগে ইজাজ দুর্গের কর্তৃত্ব নিজ হাতে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আল হামীরী নামের এক সেনাপতিকে পয়গাম দিয়ে ইজাজ দুর্গপতির কাছে পাঠালেন।

বোজা ও নবজ দুর্গপতির কাছে যে ভাষায় পয়গাম লিখা হয়েছিল, সে ভাষায়ই পয়গাম পাঠানো হয়েছিল ইজাজ দুর্গপতির কাছে। ইজাজ দুর্গপতি সুলতানের পয়গাম পাঠ করে দূত আল-হামীরীর দিকে ছুঁড়ে মারল এবং বলল, তোমার সুলতান আলেপ্পো অবরোধ করে একবার মজা দেখেছে, এবার গিয়ে বল, সাধ থাকলে ইজাজ অবরোধ করে মজা দেখুক।

আপনি কি মুসলমানদের খুনোখুনি পছন্দ করবেন? আমরা পরস্পর ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে হতাহত হই আর খৃস্টানরা তা দেখে মজা করুক, আপনি কি তাই পছন্দ করেন?

তোমার সুলতানকে গিয়ে বল খৃস্টানদের সাথে যুদ্ধ করতে, আমাদের পক্ষে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।

দূত আল হামীরী বললেন, আপনি কি খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চান না? আপনি কি খৃস্টানদের শত্রু মনে করেন না?

এ মুহূর্তে আমরা আইয়ূবীকেই শত্রু মনে করি। সে আমাদের হুমকি দিচ্ছে এবং তরবারীর জোরে আমাদের দুর্গ ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে বলল দুর্গপতি। আল আমীরী বহু যুক্তিপূর্ণ কথা বলেও ইজাজ দুর্গপতিকে দুর্গ হস্তান্তরে সম্মত করাতে পারেননি। দুর্গপতি তাকে অসম্মান করে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিল।

* * *

ঈসিয়াত দুর্গে খৃস্টান কর্মকর্তা গোমশতগীনের মুখোমুখি উপবিষ্ট। তেরেসা ও লিজাও পাশে বসা। কর্মকর্তা ও গোমশতগীন পূর্ব পরিচিত। খৃস্টান কর্মকর্তা বলল, শুনলাম, আপনি আইয়ূবীকে হত্যা করতে করতে এখন সাইফুদ্দীনকে খুন করার কথা ভাবছেন?

আপনি কি শুনেননি, সাইফুদ্দীন কেমন কাপুরুষের পরিচয় দিয়েছে? বলল গোমশতগীন। এই মেয়েরাই তো বলেছে, সাইফুদ্দীন আমাদের যৌথ বাহিনীকে এমন বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে যে, আমাদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য পুনর্বার তৈরী করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। আমি বিক্ষিপ্ত সৈন্যদেরকে একত্রিত করে আলেপ্পোর বাইরেই আইয়ূবীকে রুখে দিতে চাই, কিন্তু সাইফুদ্দীন পরাজয়ের গ্লানি দূর করতে আবারো সেনাকমান্ড নিজের হাতে নিতে মরিয়া হয়ে উঠবে আর আমাদেরকে আরেকটি বিপর্যয়কর পরাজয় বরণ করতে হবে। এর চেয়ে কি তাকে ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া দুষণীয় হবে?

আপনি যেভাবে দেখছেন সাইফুদ্দীন আসলে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নয়। বলল খৃস্টান কর্মকর্তা। আমরা যা জানি, আপনি ততোটা জানেন না। আমরা আপনার প্রত্যেকটি বন্ধু ও শত্রুকে আপনার চেয়ে বেশী জানি। এজন্যই আমরা আপনাকে উপদেষ্টা দিয়ে রেখেছি। আইয়ূবীর এলাকায় বেশভূষা বদল করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি আপনার সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি ও আপনার শাসন সংহত করার জন্যে। আমি নিজে প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে যা দেখে এসেছি, তার মর্ম কথা হলো–আপনার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি আইয়ূবী। পারলে আইয়ূবীকে আপনি খুন করিয়ে ফেলুন। নুরুদ্দীন জঙ্গী নিহত হওয়ার ফলে আপনি দুর্গপতি থেকে স্বাধীন আমীর হয়েছেন, আইয়ূবী মারা গেলে আপনার রাজ্যের সীমানা আরো বহুগুণে বেড়ে যাবে, তখন আর আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ থাকবে না। আমি শীঘ্রই ত্রিপলী যাচ্ছি। সৈন্য ও রসদের ঘাটতি যথা শীঘ্রই আমি মিটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব। প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্রের ব্যবস্থাও আমি করব, আপনি সাহস হারাবেন না। আইয়ূবী মরে গেলে আমরা আপনাকে অতটুকু সহযোগিতা করব যে, মালিক, সাইফুদ্দীন আপনার ধারে কাছেও ঘেষতে পারবে না। বর্তমানে আইয়ূবী যে অবস্থানে রয়েছে আপনি সেই অবস্থানে পৌঁছে যাবেন।

ক্ষমতার মোহ আর বিলাসী জীবনের হাতছানী গোমশতগীনকে এতোটাই বিগড়ে দিয়েছিল যে, খৃস্টান কর্মকর্তা যে খৃস্টানদের স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করে এই মোটা বিষয়টি অনুধাবন করার ক্ষমতাও তার ছিল না। এই কর্মকর্তা ছিল খৃস্টান গোয়েন্দা সংস্থার অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তি। সে অবস্থা সরেযমিনে প্রত্যক্ষ করে আইয়ূবীকে কিভাবে পরাস্ত ও ধ্বংস করা যায় এর কৌশল বের করার জন্যে পর্যবেক্ষণে বেরিয়েছিল। প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে পরাজিত হয়ে অবশেষে খৃস্টানরা এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছিল যে, আইয়ূবীকে খুন করানো ছাড়া তার অগ্রাভিযান রোধ করা অসম্ভব। এ জন্য মুসলিম নেতৃবর্গের মধ্যে বিদ্বেষ ও বিরোধ তৈরী করা ছিল খৃস্টানদের অন্যতম কৌশল। খৃস্টানরা চাচ্ছিল, মুসলিম ক্ষমতালোভী নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ। আত্মকলহে লিপ্ত করে ওদের মৌল শক্তি ক্ষয়ে দিতে। এভাবে এরা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠলে আইয়ূবীর মৃত্যুর পর গোটা আরব জাহানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা খৃস্টানদের জন্যে সহজ হবে।

আইয়ূবীকে হত্যার ব্যাপারে শেখ সিনানও তো নিরাশ হয়ে পড়েছে। সে বলেছে, আরো চারজন ফেদাঈ সে আইয়ূবীকে খুন করার জন্য নিয়োগ করেছে। কিন্তু তাকে আশাবাদী মনে হলো না। বলল গোমশতগীন।

এত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর শেখ সিনানের তো হতাশ হওয়ারই কথা। বলল খৃস্টান কর্মকর্তা। ফেদাঈরা হাশীশে নেশাগ্রস্ত হয়ে আইয়ূবী হত্যা মিশনে বের হয়। এজন্য তাদের ব্যর্থ হতে হয়। তাদেরকে বুঝতে হবে, আইয়ূবীকে হত্যা করা কোন মাতাল কিংবা অসচেতন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। আইয়ূবীকে হত্যা করতে হলে তার মতো বিচক্ষণ দূরদর্শী ও ধর্মানুরাগের লেবাস ধারণ করতে হবে। আপনি হয়তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে বেশী বুঝেন না। আইয়ূবীকে নেশাগ্রস্ত হয়ে যারা হত্যা করতে যায় তারা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, যখন তাদের সামনে কোন অঘটন ঘটতে শুরু করে তখন তাদের নেশা উবে যায়, আক্রমণকারীরা নিজের জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে। এর বিপরীতে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে উত্তেজিত ও আবেগপ্রবণ করে নেশাছাড়া কাউকে পাঠান, সে অবশ্যই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সফল হবে।

শেখ সিনান আমাকে আইয়ূবীর চার যোদ্ধা দিয়েছে। বলেছে, এদেরকে তৈরী করে সাইফুদ্দীনকে হত্যা করিয়ে ফেল। কারণ এরা সাইফুদ্দীনকে শত্রু মনে করে, এজন্য এরা সাইফুদ্দীনের হত্যা মিশনে সফল হবে।

সাইফুদ্দীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে এদেরকে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে তৈরী করা যায় না কি? বলল খৃস্টান কর্মকর্তা। এদের উপর হাশীশ বা এ জাতীয় মাদক প্রয়োগ না করে আবেগের নেশা দিয়ে তৈরী করতে হবে।

এ ধরনের নেশা আপনিই তৈরী করতে পারবেন। বলল গোমশতগীন।

খৃস্টান কর্মকর্তা তেরেসা ও লিজার দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসল।

লিজা বলল, আমি আইয়ূবীর গোয়েন্দা দলের কমান্ডারকে তৈরী করতে পারব, আপনি অন্যদের দায়িত্ব নিন।

ঠিক আছে, তুমি কমান্ডারকেই সামলাও। আর অন্যদেরকে তাদের অবস্থার উপরেই ছেড়ে দাও। বলল খৃস্টান কর্মকর্তা। মানুষের স্বভাব সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, নাসের নিজেই অন্যদেরকে সামলাবে।

কর্মকর্তা বলল, ওরা কোথায়? এদেরকে এখানে নিয়ে এসো। নাসেরকে এবং অন্যদের কক্ষ ভিন্ন করে দাও। আর তোমরাও একটু সচেতন থেকো। সিনান লিজার উপর শ্যেনদৃষ্টি রাখছে, লিজাকে সিনানের এতোই ভাল লেগেছে যে, ওকে কাছে পেতে লোকটি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, লিজাকে তার কাছে ছেড়ে না দিলে সে আমাকে বন্দী করে ফেলবে। লিজাকে তার কাছে ছেড়ে দেব কি দেবো না এজন্য ভাবতে আমাকে একরাত অবকাশ দিয়েছে সিনান।

এ ব্যাপারে আপনি চিন্তা করবেন না। শেখ সিনানের সম্মতি নিয়েই চার গোয়েন্দাকে আমি সাথে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি এবং এই তরুণীও আমার সাথে যাবেন। বলল গোমশতগীন।

* * *

নাসেরকে খৃস্টান কর্মকর্তার জন্যে সংরক্ষিত কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। নাসের সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে অস্বীকৃতি জানাল। খৃস্টান কর্মকর্তা চাচ্ছিল, নাসেরকে আলাদা করে তেরেসা ও লিজাকে দিয়ে তার ব্রেইনওয়াশ করে ফেলবে।

তুমি তো এদের কমান্ডার। তোমার তো এদের থেকে ভিন্ন থাকা দরকার। বলল খৃস্টান কর্মকর্তা।

আমাদের মধ্যে উঁচু নীচুর বিভেদ নেই। আমাদের সুলতান আমাদের সাথেই থাকেন। আমি তো সামান্য একজন কমান্ডার মাত্র। আমি সাথীদের থেকে আলাদা হয়ে অহংকারের অপরাধী হতে পারব না। বলল নাসের।

আমরা তোমাদের সম্মান করতে চাই। তোমাদের ওখানে গিয়ে তোমরা যা ইচ্ছা তাই করো, কিন্তু এখানে আমাদেরকে আমাদের রীতি পালন করতে দাও। বলল খৃস্টান কর্মকর্তা।

আমাদের গোয়েন্দা ও গুপ্তবাহিনীর কমান্ডারগণ জীবিত মৃত সর্বাবস্থায়ই সহকর্মীদের সাথে থাকে। আমরা আপনাদের এখানে বন্দী এবং মৃত্যুপথযাত্রী না হলে আপনার কথা মানা যেতো। মৃত্যুমুখে আমরা সকল কষ্ট যাতনায় একে অন্যের অংশীদার হয়ে মরতে চাই। আমরা ইচ্ছা করলে একজনের জীবন বাঁচাতে তিনজনের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারি। বলল নাসের।

তোমরা কি বন্দী দশা থেকে ফেরার হওয়ার চেষ্টা করবে? মুচকী হেসে বলল গোমশতগীন।

মুক্ত হওয়ার চেষ্টা আমরা অবশ্যই করব। কারণ এটা আমাদের কর্তব্য। হয়তো আমরা মৃত্যুবরণ করে মুক্ত হবে, নয়তো তোমাদের হত্যা করে। আমাদেরকে যদি বন্দী করেই রাখতে চাও তবে পায়ে বেড়ী পরিয়ে দাও। দোহাই! আমাদের সাথে প্রতারণা করো না। আমরা যুদ্ধের সৈনিক, সাইফুদ্দীন ও গোমতগীনের মতো ঈমান বিক্রেতা নই।

আমিই গোমশতগীন, হিরনের স্বাধীন শাসক! তোমরা আমাকে ঈমান বিক্রেতা বললে!

হ্যাঁ! আপনাকে আবারো আমি ঈমান বিক্রেতা বলছি। শুধু ঈমান বিক্রেতা নন, আপনি একজন বেঈমান, গাদ্দারও বটে!

এখন আমি ঈমান বিক্রেতাও নই, বিশ্বাসঘাতকও নই। দেখো, যুদ্ধ হচ্ছে। তুর্কমানে। সেখানে সাইফুদ্দীন যুদ্ধ করছে, আর আমি এখানে তোমাদেরকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্যে এসেছি। আমি এখন ওদের সাথে নেই। থাকলে তোমাদেরকে এভাবে মুক্ত রাখা হতো না। আমি তোমাদেরকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তোমাদের ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করব।

নাসেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য অপমান হজম করে কৌশলের আশ্রয় নিল গোমশতগীন।

বেশ, তুমি সাধারণ কমান্ডার হলেও আইয়ূবীর মতো বুকের পাটা তোমার।

সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবো না। দয়া করে আমাকে এই অপরাধ করতে বাধ্য করবেন না।

না দোস্ত! তুমি সাথীদের সাথেই থাকো। তোমাকে আলাদা করা হবে না। বলল খৃস্টান কর্মকর্তা।

নাসেরের সাথে গোমশতগীন ও খৃস্টান অফিসার যখন কথা বলছিল, তখন নাসেরের সাথীরা একটি বৃহদাকার কক্ষের আরামদায়ক বিছানায় বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। সেখানকার এক সেবকের কাছ থেকে নাসেরের সাথীরা জেনে নিয়েছিল দুর্গের ভিতরে এই কক্ষটির অবস্থান কোথায় এবং দুর্গের কোথায় কি রয়েছে। সেবক তাদের বলল, এটি একটি অতিথিশালা। বিশেষ মেহমানরা এখানে থাকে। তিন গুপ্তসৈনিক অনুভব করছিল, তাদের সাথে প্রকৃতপক্ষে বন্দীদের ব্যবহার নয় সম্মানিত অতিথিসুলভ ব্যবহারই করা হচ্ছে।

খৃস্টান কর্মকর্তা ও গোমশতগীন দীর্ঘসময় নাসেরকে বসিয়ে রেখে নানা কথার অবতারণা করল। নাসেরকে তারা যথোপযুক্ত সমীহ ও সম্মান দেখাচ্ছিল। ফলে এদের প্রতি বিতৃষ্ণা ও ক্ষোভ আনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল নাসেরের মনে।

অপরদিকে লিজা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। দীর্ঘ আলাপচারিতার পর নাসের যখন খৃস্টান কর্মকর্তা ও গোমশতগীনের কক্ষ ত্যাগ করে তার জন্যে বরাদ্দকৃত কক্ষের দিকে এগুচ্ছে তখনও কক্ষে প্রবেশ করেনি। একটি করিডোর পেরিয়ে যাওয়ার পথে ক্ষীণ আওয়াজের একটি নারী কণ্ঠের আহ্বান ভেসে এলো তার কানে। জায়গাটি ছিল আবছা অন্ধকার। সুনির্দিষ্ট আহ্বানে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল নাসের। একটি ছায়ামূর্তির মতো এগিয়ে এলো নাসেরের দিকে। তার বাজু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এখন তো বিশ্বাস হলো, আমি জিন নই মানুষ। ছায়ামূর্তিটি আর কেউ নয় লিজা।

আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না আসলে কি সব ঘটছে।

তোমার উদ্বেগ যথার্থ। বলল লিজা। তুমি ব্যাপারটিকে গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা কর। গোমশতগীন তোমাকে বলেই দিয়েছে, সে আইয়ূবীর বিরোধিতা ত্যাগ করেছে। এখন সে আইয়ূবীর কোন সৈনিককে বাগে পেলেও বন্দী করবে না। তুমি ও তোমার বন্ধুদের সৌভাগ্য যে, তোমরা এখানে এসে গোমশতগীনকে পেয়ে গেছো। তোমার জন্যে দ্বিতীয় সৌভাগ্য আমি। তুমি হয়তো আমাকে চরিত্রহীনা মেয়ে ভাবছো, মনে করছো আমি জাগতিক মোহে আমীর শেরিফদের মনোরঞ্জনে শরীর বৃত্তে জড়িত। আসলে তোমার এ ধারণা ভিত্তিহীন। লিজা নাসেরের হাত ধরে বলল, এসো, একটু নিরিবিলি বসে কথা বলি। এসো না…., আমি তোমার ভ্রান্ত ধারণা দূর করার চেষ্টা করব। আগে আমার কথা শোন। এরপর তোমার যা ইচ্ছা তা ভেবো। সে ব্যাপারে তুমি স্বাধীন।

দুর্গের এ অংশটি ছিল জনশূন্য এবং নিরিবিলি। নানা গাছ-গাছালী ও ফুল-পুষ্পে সজ্জিত ছিল এ পাশটি। লিজা নানা কথাচ্ছলে নাসেরকে নিয়ে যখন আড়ালে যাচ্ছিল, খৃস্টান কর্মকর্তা ও তেরেসা তখন একটি দেয়ালের আড়াল থেকে লিজার ও নাসেরের গোপন অভিসার প্রত্যক্ষ করছিল।

লিজা ওকে কজা করে ফেলেছে। বলল কর্মকর্তা।

মেয়েটি অতি মাত্রায় আবেগ প্রবণ। নিজের কর্তব্য ভুলে গিয়ে ওই যোদ্ধার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছিল সে। আমি তাকে সতর্ক করে দিয়েছি। অবশ্য সে এতোটা কাঁচাও নয়।

আসলে এতো অল্প বয়সে ওকে কঠিন মিশনে পাঠানো উচিৎ হয়নি। আমাদের উপস্থিতিতে সে কোন উল্টা-পাল্টা করবে না এই বিশ্বাস আমার আছে। বলল কর্মকর্তা।

লিজা নাসেরকে বলল, তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, কেন আমি তোমার প্রতি এতোটা দয়ার্দ্র হয়ে উঠেছি। অবশ্য আমি তোমাকে একথা বুঝাতে পারিনি যে, তোমার আমার মধ্যে বিরোধের দেয়াল আমাদের শাসকদের সৃষ্ট এবং জাতিগত, মূলতঃ তোমার আর আমার মধ্যে কোন শত্রুতা নেই।

শত্রুতা নেই বটে তবে বন্ধুত্বেরই বা কি ভিত্তি আছে? বলল নাসের।

লিজা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাসেরের কাঁধে হাত রেখে বলল, তুমি একটা পাথর। আমি জানতাম, মুসলমানের হৃদয় নাকি খুব নরম হয় কিন্তু তুমি এর ব্যতিক্রম। একটু সময়ের জন্যে এসব ধর্মানুরাগ রেখে দাও, ভুলে যাও, তুমি আর আমি ভিন্ন দুটি গোত্রের নারী ও পুরুষ। একটু ভেবে দেখো, তুমি আর আমি মানুষ। তুমি পুরুষ আর আমি নারী। আচ্ছা, তোমার মধ্যে কি দয়ামায়া, প্রেমপ্রীতি, কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ, কারো প্রতি অনুরাগ নেই? অবশ্যই আছে। কেননা, তুমি একজন সুঠাম পুরুষ। তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পার, কিন্তু আমি নিজেকে এতোটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমি অনিয়ন্ত্রিত। তোমার মহব্বত আমার হৃদয়ে শিকড় গেড়ে বসেছে।

তোমাদেরকে হাশিশ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে যেদিন সিনানের দুর্গে নিয়ে এসেছিলাম, সেদিন সিনান তোমাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল, এই বদমাশ বুড়োটার সাথে তেরেসা ও আমাকে অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্ক করতে হয়েছে, তোমাদেরকে কয়েদখানার লৌহ প্রাচীরের বাইরে রাখতে। তোমাদেরকে জেলখানায় বন্দী করে ফেললে আর জীবন্ত বের হওয়া সম্ভব ছিল না। এমতাবস্থায় তোমার মতো সুন্দর যুবকের সান্নিধ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত হতে হতো। তুমি জেলখানায় ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করো এটা আমি কিছুতেই বরদাশত করতে পারছিলাম না। বুড়োটা আমাকে প্রস্তাব করল, তুমি যদি এদেরকে জেলখানায় বন্দী করা থেকে বাঁচাতে চাও; তবে আমার শয্যাসঙ্গী হতে হবে। একথায় বুড়োটার প্রতি আমার মনে প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মে গেল। আমি ওকে মুখের উপর কিছু শুনিয়ে দিলাম। এতে সে আরো ক্ষেপে গেল। বলল, হয় এরা জেলখানায় থাকবে নয়তো তুমি আমার সয্যাসঙ্গী হবে এর অন্যথা হবে না।

আমার তখন মনে হতে লাগল, যুগ যুগ ধরে তোমাকে ভালোবাসি আমি। তোমার জন্যে আমার জীবন, ইজ্জত-আব্রু সব কুরবান করে দিতেও আমার কুণ্ঠা নেই।

সত্যই কি আব্রু কুরবান করে দিয়েছো? উল্কণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করল নাসের।

না, তাকে আমি নানা বাহানায় ভুলিয়ে রেখেছি। তবে সে বলেছে, তোমরা সবাই আমার দুর্গে আজাদ থাকবে বটে তবে নজরবন্দী, কখনও ইচ্ছে মতো বেরিয়ে যেতে পারবে না।

আমি তোমার ইজ্জত রক্ষা করবো লিজা!

তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করেছো?

একথায় নাসের কোন জবাব দিল না। নাসেরকে ট্রেনিংকালে বলা হয়েছিল, ইহুদী-খৃস্টানরা মুসলিম সেনা ও উমারাদের কজা করতে রূপসী তরুণীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলতে লেলিয়ে দেয়। বস্তুতঃ নাসেরের কাছে ট্রেনিংকালের সেই কথা এখন তিক্ত উপদেশবাণীর মতোই রূঢ় বলে মনে হতে লাগল। কারণ, এই ধরনের নারীর ফাঁদ থেকে বাঁচার কোন বাস্তব ট্রেনিং তো আর তাকে দেয়া হয়নি এবং তা দেয়া সম্ভবও ছিল না। এখন খৃস্টান তরুণীর পাতা ফাঁদে সে ধীরে ধীরে আটকে যেতে লাগল। তার মধ্যে জেগে উঠতে শুরু করল পৌরুষিক সত্তা। তরুণীর প্রতি তার মোহ সৃষ্টি হতে লাগল। লিজার তপ্ত নিঃশ্বাস, শরীরের গন্ধ আর রেশমী চুল ও ত্বকের মোহনীয় স্পর্শ ওকে ভুলিয়ে দিতে শুরু করল সে যে একজন তেজস্বী কমান্ডার। রুক্ষ মরু, কঠিন রণক্ষেত্রে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে অভ্যস্ত সে। কিন্তু লিজার কোমল স্পর্শ, বিগলিত নিবেদন আর ডাগর চোখের কাতর চাহনী লৌহ মানব নাসেরের মধ্যেও জন্ম দিতে শুরু করল আদিম উন্মাদনা। সে অনুভব করল, শরীরের মধ্যে পৌরুষিক শিহরণ। অন্য রকম এক অনুভূতি।

বহুবার এমন হয়েছে যে, শত্রুবাহিনীর তীর ওর গা ঘেঁষে চলে গেছে। শত্রুদের বর্শার আঘাতে আহত হয়েছে অসংখ্য বার। শত্রু বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর বৃষ্টি, বর্শার শত আঘাতে কখনও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভয়ের উদ্রেক করেনি। কিন্তু বিধর্মী তরণীর স্পর্শ, কমনীয়তা ও যাদুমাখা কণ্ঠের মায়াবী আবেদন নাসেরের হৃদয় রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিল।

পেশাগত বহু অপারেশনে জ্বলন্ত আগুন থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে নাসের, এতটুকু দ্বিধা ও ভয় করেনি। হৃদয়ে জাগেনি সামান্যতম উৎকণ্ঠা। কিন্তু এই তরুণীর কোমল স্পর্শ তার মধ্যে যে কম্পন সৃষ্টি করেছে, তাতে তার পৌরুষিক সত্তা উতলে উঠেছে। এই কম্পন ও শিহরণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে না নাসের। অথচ যে কোন বিপদাশংকায় তার চেতনা বিদ্যুতের চেয়ে আরো দ্রুতগতিতে কাজ করে। লিজা যতোই নাসেরের ঘনিষ্ঠ হতে লাগল, নাসের ততই অনুভব করতে লাগল লিজার দূরত্ব তার মন বলছে ও যদি আরো ঘনিষ্ঠ হতো।

লিজা ছিল প্রশিক্ষিত। প্রতিপক্ষকে কিভাবে জব্দ করতে হবে দীর্ঘদিন ধরে তাকে সেই ট্রেনিং দেয়া হয়েছে।

মরুর তৃষ্ণা নাসেরকে যতোটুকু না দুর্বল ও অবচেতন করেছিল, তরুণীর সন্নিধ্য ও স্পর্শ তার চেয়ে অনেক বেশী অবচেতন করে দিল নাসেরকে। রাত যতই বেড়ে যাচ্ছিল লিজাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে তীব্র হয়ে উঠছিল, নাসেরের যোদ্ধাসত্তা বিলীন হয়ে সেখানে স্থান করে নিচ্ছিল এক আদিমতা। শুরুতে নাসেরের অন্তরাত্মা লিজার স্পর্শে কেঁপে উঠেছিল, নিষিদ্ধ নারীর স্পর্শে তার মধ্যে জেগে উঠেছিল ঈমানী চেতনা। কিন্তু এক্ষণে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অন্য এক অনুভূতি, ভিন্নতর এক শিহরণ।

হ্যাঁ, আমি তোমার ভালবাসাকে গ্রহণ করে নিয়েছি, আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল নাসের। কিন্তু এই ভালবাসার পরিণতি কি হবে? তুমি কি আমাকে একথা বলবে যে, আমি তোমার সাথে চলে যাবো? আমাকে কি একথাও বলবে যে, তুমি ধর্ম ত্যাগ করে আমাকে বিয়ে করে আমার দেশে চল?

এমন কোন কথা আমি এখনও ভাবিনি। বলল লিজা। তবে তুমি যদি আমাকে জীবনের জন্য বরণ কর তাহলে আমি ধর্ম ত্যাগ করে তোমার সাথে চলে যেতে দ্বিধা করব না। তুমি আমার কাছে যতো ইচ্ছা কঠিন ত্যাগ প্রত্যাশা করতে পারো কিন্তু আমার অনুরোধ, তুমি আমাকে নিখাদ ভালোবাসা দিবে সে কথা দাও। কৃত্রিম ভালোবাসা আমি যে কারো কাছ থেকে পেতে পারি কিন্তু তোমাকে আমার মনের মতো করে পেতে চাই।

ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে গেল নাসের। এদিকে তখন রাত অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। তবুও নাসের লিজার সান্নিধ্য থেকে উঠার কথা ভাবতে পারছে না। লিজা তাকে স্মরণ করিয়ে দিল, তুমি কক্ষে চলে যাও, এ অবস্থায় ধরা পড়লে পরিণতি ভাল হবে না।

* * *

নাসের যখন কক্ষে প্রবেশ করল তখন তার সাথীরা ঘুমে অচেতন। শুয়ে পড়ল নাসের। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। লিজা যখন শোয়ার কক্ষে প্রবেশ করল তখন

তেরেসার চোখ খুলে গেল।

এতো দেরী! লিজাকে প্রশ্ন করল তেরেসা।

কি বল, পাথর কি এক ফুৎকারেই মোম বানানো যায়? বলল লিজা।

পাথর বটে, কিন্তু তেমন শক্ত তো নয়। বলল তেরেসা।

ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা আমারও ছিল না, তবে শেষ অস্ত্রটাও আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে, অবশ্য এখন সে আমার গোলাম। বলল লিজা।

এটা বলার দরকার নেই। তবে নিজেই মোম হয়ে গলে যেয়ো না কিন্তু। লিজার উদ্দেশে বলল তেরেসা।

লোক খুব সুন্দর। হাসতে হাসতে বলল লিজা। খুবই সাদামাটা লোক। আমার এমন লোককে খুব ভালো লাগে। তাই বলে আমাকে এতোটা বোকা মনে করো না তুমি। সাদাসিধে মানুষদের আমার ভাল লাগে। হতে পারে আমার এই ভাললাগা ধুরন্ধর, প্রতারক ও বিলাসী সাইফুদ্দীনের মতো কপট লোকদের সংস্পর্শে থেকে জন্ম নিয়েছে। বিলাসীদের প্রতি আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি।

শেষ পর্যন্ত ওর প্রতিও বীতশ্রদ্ধই থাকা উচিত। বলল তেরেসা। ভালবাসার যাদুটিকে আরো মোহনীয় ও ধারালো করে নিও। মনে রাখবে, ওকে দিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু আইয়ূবীকে খুন করাতে হবে। এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

লিজাকে আরো অনেক পরামর্শ দিল তেরেসা। দু চারটি অভিনব কৌশল প্রয়োগের কথাও বলল। এরপর উভয়েই শুয়ে পড়ল।

নাসেরও শুয়ে পড়েছিল কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছিল না। একাকী লিজার প্রেম নিবেদনের ব্যাপারটিকে বিস্ময়াভিভূত হয়ে ভাবছিল, এ নিয়ে তার মনে জন্ম নিল দুটি ধারা। ট্রেনিংকালের সতর্কবাণী মনে পড়ল তার, সাথে সাথে মনে হলো লিজা একটি আলেয়া। খৃস্টান মেয়েরা শত্রুর যাদুর কাঠি। এভাবে মায়াবী আচরণ ও প্রেমের ফাঁদ তৈরী করেই এরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। পাশাপাশি তার মনে একথা আরো প্রবল হতে থাকল, প্রেমের ফাঁদের আশংকা যথার্থ হলেও লিজা সেই ফঁদ নয়। লিজার প্রেম ও ভালোবাসা নিখাদ। সুন্দর সুঠাম দেহের যুবক নাসের। চেহারা অবয়বে হাজার যুবকের চেয়ে সে আকর্ষণীয়। নিজের এই সৌন্দর্যের অনুভূতি বুঝতো নাসের। নিজের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা আর লিজার মতো রূপসী তরুণীর যাদুকরী সান্নিধ্য ও অকৃত্রিম প্রেম নিবেদন নাসেরের হৃদয়কে দুভাগ করে ফেলল। সে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না, লিজাকে প্রত্যাখ্যান করবে, না জীবনের মতো করে ভালবাসবে। এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল নাসের।

ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে এক লোক জাগিয়ে দিল নাসেরকে। লোকটি বলল, তেরেসা তোমাকে ডাকছে।

নাসের উঠে লোকটির সাথে তেরেসার কক্ষে গিয়ে তার সামনে বসল। তেরেসা বলল, গতরাত তুমি লিজাকে নিয়ে গিয়েছিলে, না লিজা তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল, আমি সেকথা জিজ্ঞেস করব না। আমি শুধু বলতে চাই, মেয়েটি খুবই সরল সহজ। সে তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। কিন্তু আমি চাই না, তুমি লিজাকে নিয়ে রাতের পর রাত বাইরে কাটিয়ে দাও, আমি চাই লিজাকে তুমি প্রেমের

অভিনয় করে বিভ্রান্ত করবে না।

আমি এমনটি কখনও করিনি। জবাব দিল নাসের। কথা বলতে বলতে অবশ্য একটু দূরে চলে গিয়ে ছিলাম।

আমি লিজাকে একথা বলতে পারছি না যে, তোমার প্রেমে যেন সে ডুবে ডুবে পানি না খায়। তোমাকে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি, মেয়েটির সারল্যপনার সুযোগ নিয়ে তুমি কোন অপচেষ্টা করো না।

লিজাও তোমার মতই রাজকন্যা। আর আমি তোমাদের বন্দী। রাজকন্যা যদি কোন বন্দীকে মন দিয়ে বসে, তাহলে বন্দীকেই শাহজাদা মনে করে নিজেকে বন্দীর কয়েদী ভাবতে থাকে। আমি তোমাদের বন্দী। বন্দী আর শাহজাদীর মধ্যে কি প্রেম হতে পারে?

নারীর চরিত্র সম্পর্কে হয়তো তুমি এতোটা জানো না। শাহজাদী প্রেমের টানে গোলামের কাছে নিজেকে সোপর্দ করে সকল খান্দানী সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। লিজার সাথে কথা বলেছি আমি। সে বলেছে, আমার জীবন-মরণ সবকিছু নাসেরের জন্যে। সে যদি আমাকে ধর্ম ত্যাগ করতে বলে তবে গলা থেকে ক্রুশ ছুঁড়ে ফেলে দেবো আমি। তুমি জানো না নাসের! তোমার প্রেমে পড়ে লিজা দুর্গপতি শেখ সিনানকে পাত্তা দেয়নি। তাকে অপমান করে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। শেখ সিনান, তোমাকে ও তোমাদের সাথীদেরকে কয়েদখানায় বন্দী করতে চেয়েছিল, কিন্তু লিজা সিনানের প্রতিপক্ষ সেজে তোমাদেরকে জেলখানায় পাঠাতে দেয়নি। শেখ সিনান লিজাকে এমন কঠিন শর্ত দিয়েছে যা একজন প্রেমিকের জন্যে খুবই অবমাননাকর। ঘটনাক্রমে আমরা যদি এই দুর্গ থেকে বের না হতে পারি তবে মহা বিপদে পড়তে হবে। আমার মনে হয় তোমাকে বাঁচাতে লিজা শেখ সিনানের শর্ত মানতেও রাজী হবে।

না। এমনটি হতে দেবো না আমি। প্রয়োজনে লিজার ইজ্জতের জন্যে আমি জীবন দিয়ে দেবো।

লিজা তোমাকে যেভাবে ভালোবাসে, তুমিও কি তাকে ততটাই ভালোবাসো?

মেয়ে হয়ে সে যদি তার ভালোলাগার কথা প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ না করে তবে আমি অস্বীকার করবো কেন। আমি পুরুষ, লিজাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।

আমি শুধু এতটুকুই প্রত্যাশা করি যে তুমি মেয়েটিকে ধোঁকা দিবে না। বলল তেরেসা। আর মনে রেখো, এখন তোমরা এখানে বন্দী নও, তোমরা স্বাধীন। এছাড়া হিরনের দুর্গপতি গোমশতগীন তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে তার মেহমান মনে করেন।

নাসেরের মনের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তেরেসার কথায় দূরে সরে গেল। তাতে লিজার প্রতি আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল। উদগ্রীব হয়ে উঠলো সে লিজার জন্যে, লিজাকে দেখতে। তেরেসার কাছেই সে জিজ্ঞেস করে বসল, লিজা কোথায়? তেরেসা জামাল, সারারাত জেগে ছিল এখন পাশের কক্ষে ঘুমাচ্ছে। তেরেসার নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভেদী প্রমাণিত হলো। সে কৌশল করে নাসেরের মনে লিজার প্রেমকে আরো তীব্র করে দিল। তেরেসা দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ শিকারী। পুরুষের দুর্বল মানবিক ব্যাপারগুলো তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার, সে মানুষের মানবিক দুর্বল জায়গাগুলোকে নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত। নাসের যখন তেরেসার কক্ষ ত্যাগ করে নিজ কক্ষের দিকে যাচ্ছিল, তখন প্রেমের হাওয়াই রথে সে ঊর্ধ্বগামী। নিজেদের কক্ষে গেলে সাথীরা তাকে জিজ্ঞেস করল, এতোক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে? সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল, সব ঠিকই আছে, শীঘ্রই মুক্তির ব্যবস্থা হয়ে যাবে তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পার। প্রকৃতপক্ষে কমান্ডার নাসের তার কর্তব্য ভুলে লিজার প্রেমে ডুবে যেতে শুরু করল।

* * *

গোমশতগীন আর খৃস্টান কর্মকর্তা মুখোমুখি উপবিষ্ট। গোমশতগীন বলল, আমি এই তরুণীদ্বয় ও যোদ্ধাদের দু এক দিনের মধ্যেই হিরন নিয়ে যেতে চাই। ইতোমধ্যে তাদের কক্ষে প্রবেশ করল তেরেসা। তেরেসা জানাল, এবার কমান্ডার আমাদের জালে ধরা দিয়েছে। লিজা কিভাবে এই কমান্ডারকে জয় করে নিয়েছে সবিস্তারে সব জানাল তেরেসা। তেরেসা আরো বলল, এদেরকে আইয়ূবী হত্যায় ব্যবহার করতে হবে। এখন দেখার ব্যাপার হলো আইয়ূবীর প্রশিক্ষণ বিস্মৃত হতে কত সময় লাগে।

আমি দুএক দিনের মধ্যেই চারজনকে হিরন নিয়ে যেতে চাই, তোমরা দুজন কিংবা লিজা একাকী কি আমার সাথে যাবে? তেরেসার উদ্দেশ্যে বলল গোমশতগীন। আইয়ূবীকে হত্যা করতে এদের তৈরী করতে লিজার প্রয়োজন।

মেয়েদেরকে আমি সাথে নিয়ে যাচ্ছি। বলল কর্মকর্তা। আমি এখানে বেশীদিন থাকতে পারছি না। শীঘ্রই কর্তাদের কাছে আমার সংবাদ গৌছাতে হবে যে, আলেপ্পো, হিরন ও মৌসুলের যৌথ বাহিনী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যৌথ বাহিনীর কমান্ডার সাইফুদ্দীন পালানো ছাড়া আর কিছুই করতে জানে না। আমি কর্তাদেরকে বর্তমান কৌশল পাল্টিয়ে আইয়ূবী হত্যায় নতুন কৌশলের প্রস্তাব করব। এতে এমনও হতে পারে যে, আমাদের পক্ষ থেকে আপনারা যেসব সহযোগিতা পাচ্ছেন, এখন থেকে সব বন্ধ হয়ে যাবে।

না, এমনটি বলবেন না। অনুরোধের স্বরে গোমশতগীন বলল-আমাকে আরেকটু সময় দিন। আমি অল্পদিনের মধ্যেই আইয়ূবীকে খতম করে দিব। এরপর দেখবেন, কেমন বিজয়ীবেশে দামেস্কে প্রবেশ করি আমি। এই দুই তরুণী না হয় অন্ততঃ লিজাকে আমার কাছে রেখে যান। কারণ লিজাই পারবে এদেরকে আইয়ূবী হত্যায় প্ররোচিত করতে। কেননা, নাসের আইয়ূবীর প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। সে অনায়াসে আইয়ূবীর কাছে যেতে সক্ষম হবে। তারপক্ষেই আইয়ূবীকে হত্যা করা সম্ভব। এ ব্যাপারটিও বুঝতে হবে, লিজা ছাড়া এরা আমার কোন কাজে আসবে না।

অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর খৃস্টান কর্মকর্তা বলল, হিরন যাওয়ার পরিবর্তে আমরা কদিন এখানেই অপেক্ষা করব, এখানে থেকেই মেয়েরা ওদের তৈরী করে ফেলতে পারবে। এমনও হতে পারে যে, এর মধ্যে এরা তার তিন সাথীকেও তৈরী করে ফেলবে এবং এদের মনে আইয়ূবীর ঘৃণা জন্ম দেবে।

নাসেরকে আমার কাছে খুব আনাড়ীই মনে হলো। লিজা তাকে এমনই কজা করে ফেলেছে যে, আর হয়তো দুই তিনবার সাক্ষাৎ করলে সে লিজার ইশারায় নাচতে শুরু করবে।

আজ এদেরকে একসাথে বসিয়ে ভোজের ব্যবস্থা করো।

খাবারের সময় হলে নাসেরও সাথীদেরকেও খাবার কক্ষে নিয়ে আসা হলো।

সাদর অভ্যর্থনা জানাল এরা নাসের ও তার সাথীদের। খাবার তাদের সামনে রাখা হয়েছে মাত্র ঠিক সেই সময়ে সিনানের বিশেষ শাস্ত্রী এসে খৃস্টান কর্মকর্তাকে খবর দিল, শেখ সিনান আপনাকে জরুরী তলব করেছে। খবর পেয়ে কর্মকর্তা চলে গেল।

সেই মেয়েটি সম্পর্কে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?

আমি চলে যাওয়ার সময় ওদেরকে সাথে নিয়ে যাবো।

তুমি যাওয়া পর্যন্ত মেয়ে আমার কাছে থাকবে। বলল সিনান।

আজই চলে যাচ্ছি আমি।

যাও! তবে মেয়েটিকে এখানে রেখে যেতে হবে, ওকে তুমি বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না।

শেখ সিনান। তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো। তুমি কি জানো, আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করার কারণে এই দুর্গের প্রতিটি ইট খুলে ফেলা হতে পারে। আমাকে শাসানোর ধৃষ্টতা দেখানোর জন্যে তোমার ভয়ংকর পরিণতি বরণ করতে হবে।

হু! মনে হয় তোমার দেমাগ ঠিক নেই। আজ রাতে তুমি নিজে মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, তুমি চলে যাও বা থাকো, তাতে আমার নির্দেশের অন্যথা হতে পারবে না। শোন, আমার কথার ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে তোমার ঠিকানা হবে জিন্দান খানায় আর মেয়ে থাকবে আমার কাছে। যাও! কি করবে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। বলল সিনান।

খৃস্টান কর্মকর্তা খাবার ঘরে প্রবেশ করল। সবাই তার অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন। কর্মকর্তা রাগে ক্ষোভে ফুঁসছিল। ঘরে ঢুকেই সে বলল, বন্ধুরা শোন! সিনান আমাকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, আজ রাতে লিজা যে কোন মূল্যে তার কাছে থাকবে। সে আমাকে একথাও বলে দিয়েছে, আমি নিজে যাতে লিজাকে তার ঘরে পৌঁছে দিই। যদি আমি এর ব্যতিক্রম করি তবে আমাদেরকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিয়ে লিজাকে কজা করবে সে।

আপনি জেলখানায় বন্দী হলেও আমরা তো আর মরে যাইনি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সে লিজাকে নিয়ে যেতে পারবে না।

কিন্তু এই মেয়ের সাথে তোমার কি সম্পর্ক নাসের? একে রক্ষার জন্যে তুমি ফ্যাসাদে জড়িয়ে যাচ্ছ কেন? নাসেরকে জিজ্ঞেস করল তার এক সাথী।

তোমরা নিজেদেরকে আমাদের বন্দী মনে করো না। এই বিপদ আমাদের সবার জন্যে। বলল গোমশতগীন।

তোমরা আমাদের নও শেখ সিনানের কয়েদী। তোমরা আমাদের সঙ্গ দাও, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা কর। বেরিয়ে যেতে পারলে আমরা তোমাদের মুক্ত করে দেবো।

আমাকে শেখ সিনান এই চারজনকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, আমি আজই রওয়ানা হয়ে যাবো, তোমরা তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নাও। সন্ধ্যার আগেই আমি রওয়ানা হয়ে যাবো। বলল গোমশতগীন।

গোমশতগীনের মাথা ছিল কূটচালের ভাণ্ডার। আহার পর্বেই সে সবাইকে বলে দিলো এখান থেকে সবাইকে নিয়ে যাওয়ার কি পরিকল্পনা এঁটেছে সে। আহার শেষ করে তার দেহরক্ষীদের তলব করল গোমশতগীন। ওদের জানাল, সন্ধ্যার আগেই আমরা রওয়ানা হয়ে যাবো। তোমরা মালপত্র সবই বেঁধে তৈরী হয়ে নাও। গোমশতগীনের নিজের ঘোড়া ছাড়াও দীর্ঘ সফরের সামান পত্র, পানি, আহার সামগ্রী ও তাঁবু বহনের জন্যে চারটি উটও সাথে এনেছিল গোমশতগীন। ওইসব সামানপত্রের সাথে দুই তরুণী ও খৃস্টান কর্মকর্তাকেও কাপড়ে মুড়িয়ে উটের পিঠে তুলে দিল।

সবকিছু গুছিয়ে গোমশতগীন শেখ সিনানের কাছে গেল বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে। বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় চলে যাচ্ছি। ওই চারবন্দীকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। সিনানের সাথে বন্দীদের ব্যাপারে মণি-মুক্তা ও সোনা-দানার বিনিময় আগেই সুরাহা করে রেখেছিল গোমশতগীন।

সিনান বলল, আমি যে চার ফেদাঈকে আইয়ূবী হত্যার জন্যে পাঠিয়েছি, মনে হয় তারা কাজ সেরে তবেই ফিরবে। তুমি এই চারজনকে দিয়ে সাইফুদ্দীনকে খতম করিয়ে দিও। তোমরা মুখোমুখি যুদ্ধে পেরে উঠতে পারবে না। যতটুকু পারো গুপ্ত হত্যার আশ্রয় নিয়ে কার্য উদ্ধার কর। আচ্ছা, তোমার খৃস্টান বন্ধু, আর ওই মেয়ে দুটো কোথায়?

ওরা তাদের কক্ষে আছে। জবাব দিল গোমশতগীন।

ওই মেয়ে দুটি সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলেনি তো?

হ্যাঁ, ওই অফিসার মেয়ে দুটিকে বলছিল, আজ রাত সিনানের কক্ষে যেতে হবে। ওরা আপনাকে খুব ভয় করছে মনে হলো।

হু, বড় বড় বীর বাহাদুরও এখানে এসে কেঁপে উঠে। হতভাগা মেয়েটিকে নিয়ে এমন করছে যে এটি যেন তার নিজের সন্তান। বলল সিনান।

সিনানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পড়ল গোমশতগীন। পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হয়েই ছিল তার কাফেলা। সে অশ্বারোহণ করার সাথে সাথেই তার অগ্র-পশ্চাতে দুজন করে দেহরক্ষী অশ্বারোহণ করল। তাদের হাতে উদ্যত বর্শা। নাসের ও তার সাথীরা দেহরক্ষীদের পিছনে, তাদের পিছনে মালপত্র বোঝাই করা উট। দুর্গের প্রধান ফটক খুলে গেল। গোমশতগীনের কাফেলা বেরিয়ে এলো দুর্গ থেকে।

ঈসিয়াত দুর্গ থেকে বেরিয়ে গোমশতগীনের কাফেলা এগিয়ে চলল আর এদিকে দিবাকর দিনের শেষ আলো বিকিরণ করে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অল্প সময়ের মধ্যে সূর্য ডুবে গিয়ে কাফেলা ও ঈসিয়াত দুর্গের মধ্যে আঁধারের প্রাচীর টেনে দিল, এখন আর কারো চোখে ঈসিয়াত দুর্গের উঁচু খিলানগুলো নজরে পড়ছে না। বেলা ডোবার সাথে সাথেই দুর্গে সব ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হল। সীমানা প্রাচীরের ভিতরেও জায়গায় জায়গায় জ্বলে উঠল ফানুস। আঁধার ঘনিয়ে আসার পর শেখ সিনান একান্ত শান্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ঐ খ্রিস্টান বেটা মেয়েটিকে নিয়ে এখনো আসেনি?

শান্ত্রী বলল, না আসেনি। কয়েকবার শান্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল সিনান, প্রত্যেকবারই নেতিবাচক উত্তর পেল সে। অবশেষে একান্ত সেবককে ডেকে বলল, যাও, খ্রিস্টান বেটাকে গিয়ে বল, মেয়েটিকে নিয়ে এখনই আমার ঘরে আসতে।

সিনানের একান্ত প্রহরী খৃস্টান কর্মকর্তা যে ঘরে থাকতো সেই ঘরে প্রবেশ করে দেখল কেউ নেই। সেখানে খৃস্টান কর্মকর্তা, দুই তরুণী কারো চিহ্ন নেই, পুরো ঘর ফাঁকা। ঘর জনশূন্য দেখে ঘরের আশে-পাশে আনাচে-কানাচে, বাগানের ঝোঁপঝাড় পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু খ্রিস্টান কর্মকর্তা ও তরুণী কাউকেই খুঁজে পেল না। খ্রিস্টান কর্মকর্তা ও মেয়ে দুটোর গায়েব হওয়ার সংবাদ শুনে সিনান রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। প্রধান সেনাপতিকে ডেকে সিনান বলল, দুর্গের প্রতিটি কোণায় কোণায় খুঁজে দেখ, যে করেই হোক মেয়ে দুটো ও খ্রিস্টান বেটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

খ্রিস্টান কর্মকর্তা ও দুই তরুণী লাপাত্তা হওয়ার সংবাদে গোটা দুর্গে হৈ চৈ পড়ে গেল। সবাই উদ্বিগ্ন। বেটা মেয়ে দুটো নিয়ে গেল কোথায়? রাতের অন্ধকারে শত শত মশাল দুর্গের দালান কোঠা, গলি ঘুপছি, ঝোঁপ-ঝাড় সব জায়গা তন্ন তন্ন করে তালাশ করল, কিন্তু তরুণী ও খ্রিস্টান কর্মকর্তার কোন চিহ্নও পাওয়া গেল না। শেখ সিনান দুর্গের প্রধান গেটের দ্বাররক্ষীদের ডেকে পাঠালো, ওদের কাছে জিজ্ঞেস করল, গোমশতগীনের কাফেলা ছাড়া আর কেউ কি গত দুএকদিনের মধ্যে দুর্গ থেকে বেরিয়েছে? দ্বাররক্ষীরা জানাল-গোমশতগীনের কাফেলা ছাড়া আর কেউ এ সময়ের মধ্যে দুর্গ থেকে বের হয়নি। দ্বাররক্ষীরা গোমশতগীনের কাফেলার লোক ও বহরের বিস্তারিত বর্ণনাও জানাল।

শেখ সিনান নিজের কক্ষে রাগে ক্ষোভে ফুঁসছিল। তখন প্রায় রাতের এক প্রহর পেরিয়ে গেছে, এদিকে গোমশতগীনের কাফেলাও এগিয়ে চলছে। গোমশতগীন উট চালকদের উট থামাতে নির্দেশ দিলেন। বললেন, উটগুলো বসিয়ে ওদের বের করে ফেল, দেখো আবার মরে গেছে কি-না। উটগুলো বসিয়ে পিঠে বোঝাই করা তাঁবু খুলে বের করে আনা হলো খ্রিস্টান কর্মকর্তা, লিজা ও তেরেসাকে। ঘামে নেয়ে গেছে সবাই। ওদেরকে তাঁবু দিয়ে পেঁচিয়ে গোমশতগীন অন্যান্য মালপত্রের সাথে বেঁধে ঈসিয়াত দুর্গ থেকে লুকিয়ে নিয়ে এলো। এ মুহূর্তে ওরা ঈসিয়াত দুর্গ থেকে অনেক দূরে। তাদের ধারণা, ফেদাঈদের এ পর্যন্ত পশ্চাদ্ভাবন করার আশংকা নেই। কারণ ফেদাঈরা মুখোমুখি সংঘর্ষে অনুৎসাহী। তবুও ঝুঁকি এড়াতে গোমশতগীন কাফেলার যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। তরুণীদ্বয়কে উটের উপরে চড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তাকে ঝটিকা বাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে পায়দুল চলতে বলা হল। দুই তরুণী ও খ্রিস্টান কর্মকর্তার ঘোড়া ঈসিয়াত দুর্গেই ছেড়ে আসতে হয়েছে। খ্রিস্টান কর্মকর্তা ছিল মুসলিম এলাকার ভাষায় দক্ষ। সে মাতৃভাষাভাষীর মতোই নাসের ও অন্যান্যদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। এতে নাসেরের মন থেকে শঙ্কা আরো দূরে সরে গেল, সেই সাথে লিজার প্রতি টান আরো তীব্রতা পেল। নাসের চাচ্ছিল লিজার কাছাকাছি থাকতে, কিন্তু রাতের দ্বি-প্রহরের আগে আর লিজার পাশ ঘেঁষতে পারল না নাসের।

রাতের দ্বি-প্রহরে যাত্রা বিরতির নির্দেশ দিলেন গোমশতগীন। থেমে গেল কাফেলা। গোমতগীনের জন্যে স্পেশাল তাঁবু টানানো হল। আর অন্যান্যদের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু টানানো হল। ঝটিকা বাহিনীর যোদ্ধা ও গোমশতগীনের দেহরক্ষীরা খোলা আকাশের নীচেই শুয়ে পড়ল। সবাই ছিল ক্লান্ত। শোয়ার সাথে সাথেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু নাসেরের চোখে ঘুম নেই। লিজাকে সে তাঁবু থেকে জাগিয়ে আনবে, না লিজা নিজেই তার কাছে চলে আসবে, এটা চিন্তা। করছিল নাসের।

নাসের ভুলে গেল যে, সে আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর একজন কমান্ডার। এ মুহূর্তে হয়ত তার সহযোদ্ধারা কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে, তাকেও নিজ সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে এ মুহূর্তটি পালানোর জন্যে সুবর্ণ সুযোগ। তার সাথীরা ছিল কমান্ডারের অনুগত। তারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে, যখন প্রয়োজন বোধ করবে কমান্ডারই বলবে আমাদের কি করণীয়। পালানোর জন্যে এখানে ছিল পর্যাপ্ত আহার, পানীয়, সওয়ারীর জন্যে ঘোড়া এবং অন্যান্য আসবাব। খুব সহজেই এগুলো হাতিয়ে সাথীদের নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে নাসের কিন্তু সেদিকে নাসেরের বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। তার সাথীরা জানে না তাদের দলনেতা খ্রিস্টান এক তরুণীর প্রেমে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে। স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে পড়েছে সে। তারুণ্য, নারীর রূপ-জৌলুস, মোহমায়া ও প্রতারণা-প্রবঞ্চনার সর্বময় দোষণীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই তরুণী নাসেরের হৃদয় দখল করে নিয়েছে।

হঠাৎ নাসেরের কাছে একটি ছায়ামূর্তির আবির্ভাব মনে হলো। ছায়ামূর্তি সন্দেহাতীতভাবে নারীর। নাসের ছায়ামূর্তির আগমন অনুভব করে শয়ন থেকে উঠে বসল এবং ধীরে ধীরে তার সাথীদের থেকে একটু দূরে সরে গেল। ছায়াটি নাসেরের কাছে এসে থেমে গেল। কাঙ্ক্ষিত শিকারকে হাত করে ছায়ামূর্তি একটু দূরে একটি টিলার আড়ালে চলে গেল। ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, লিজা। দুজন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে বসে আবেগময় কথা বলতে শুরু করল। লিজাকে কাছে পেয়ে নাসের ভাবাবেগে উত্তাল। তার মুখে কথার ফুলঝুড়ি। কিন্তু লিজার মুখে কথা কম সে আবেগ প্রকাশ করছিল তার অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। তার মুখের চেয়ে শরীরের অঙ্গই বেশী ব্যাকুলতা প্রকাশ করছিল। এক পর্যায়ে লিজা নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে গম্ভীরভাবে নাসেরকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বলতো! তোমার জীবনে কি কখনও কোন নারী আসেনি?

আমার মা ও বোন ছাড়া জীবনে কখনও আমি কোন নারীকে স্পর্শ করিনি। বলল নাসের। তুমি যদি আমার জীবনের খোঁজ নাও, তবে দেখতে পাবে, যৌবনের প্রথম দিকেই আমি নূরুদ্দীন জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে ভর্তি হই, যতটুকু আমার অতীত মনে পড়ে, যৌবনের উচ্ছল দিনগুলোতে আমি যুদ্ধ, মরুভূমি, ঝটিকা আক্রমণ আর চিতাবাঘের মতো শত্ৰু শিকারের খোঁজে বন-বাদার, মাঠ-ঘাট চষে বেড়িয়েছি। যখন যেখানে থেকেছি কখনও স্বীয় কর্তব্য কাজে সামান্যতম অবহেলা করিনি। কর্তব্য পালনই আমার ঈমান। একথা বলে নাসের হঠাৎ কেঁপে উঠল, কিছুক্ষণ আনমনে কি ভেবে বলল, লিজা! সত্যি করে বলো তো, তোমরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমার মনে হয় তুমি আমার ঈমানকে নষ্ট করে দিচ্ছ।

নাসেরের কথার জবাব না দিয়ে লিজা জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে বলো! আমার প্রতি কি তোমার হৃদয়ে সামান্যতম ভালোবাসা আছে? না আমার রূপ দেখে তোমার মধ্যে পাশবিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে? লিজার কণ্ঠ ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার কণ্ঠে প্রেমভালোবাসা কিংবা ছেলেমীর কোন আভাস ছিল না। তার খুবই ভারী কণ্ঠ যেন নাসেরের কলিজা চিরে ভিতরের কথাটিও বের করে আনতে চায়।

তুমি আমাকে বলেছিলে, তোমার ভালোবাসাকে যেন আমি অপবিত্র না করি। এজন্য আমি তোমার কাছে এটা প্রমাণ করে দেখাব, নারীসঙ্গ জীবনে না পেলেও তোমাকে পেয়ে আমি উন্মত্ত পশু হয়ে যাইনি, আমি যথার্থই তোমাকে ভালোবাসি, এ ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। লিজা! তুমি আমাকে বলল, তোমাদের সমাজে কত শত দীপ্তপৌরুষ, বড় বড় ক্ষমতাবান, দাপটি অফিসার রয়েছে, আমার তো মনে হয় তোমার যে রূপ-জৌলুস, যে কোন বাদশার সামনে গেলেও তখত থেকে নেমে তোমাকে স্বাগত জানাবে, এরপরও তুমি আমার মধ্যে এমন কি গুণ দেখলে যে আমার কাছে প্রেম নিবেদন করছো?

নাসেরের কথায় নিরুত্তর লিজা। নাসের লিজার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, বল লিজা! আমার কথার জবাব দাও?

দু হাঁটুর মাঝে মাথা লুকিয়ে ফেলল লিজা। নাসের ওকে বারবার বললেও কোন উত্তর দিচ্ছিল না। একটু পরেই কানে ভেসে এলো হেঁচকি। কাঁদছে লিজা। কেন কাঁদছে লিজা। পেরেশান হয়ে পড়ল নাসের। লিজাকে অনুনয় ভরে জিজ্ঞেস করল, লিজা! আমার কথার জবাব দাও, বল, কাঁদছো কেন? নাসের বুঝতে পারছিল না, মানবিক দুর্বলতায় তাকে যেমন কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুত করে একটি বিধর্মী তরুণীর প্রেম অন্ধ করে দিয়েছে, তেমনি ভিন্নধর্মী লিজাকে তার নারীত্ব, প্রেম ও স্বচ্ছ ভালোবাসা নিজেকে নাসেরের বুকে লীন করে দিতে বাধ্য করেছে। এই দুর্বলতা এমন এক কঠিন জিনিস যে, এতে আক্রান্ত হলে রাজরানীও গোলামের পায়ে নিজেকে সঁপে দেয়, সম্পদ ও বিত্তের পাহাড়কেও ছাইভস্মের বাগাড় মনে করে ফকিরের পর্ণ কুটিরকেই রাজপ্রাসাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে রাজকন্যা।

লিজার বাহু ধরে নিজের দিকে টানল নাসের। লিজাকে কোলে তুলে নিল। লিজাও নাসেরের বুকে মাথা রেখে নিজেকে সঁপে দিল। লিজা ছিল উদ্ভিন্ন যৌবনা এক সুন্দরী তরুণী। জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতায় সে বিত্ত-বিলাসের জন্যে মোটেও লালায়িত ছিল না। লিজার জীবনে যেটির অভাব ছিল সেটি হলো, নির্ভরযোগ্য এক সুপুরুষের নিখাদ ভালোবাসা। লিজা ছিল ভালোবাসার ভিখারীনি। ভালোবাসার নামে সে পেয়েছিল কতগুলো নারীলোভী পাষণ্ডের পাশবিকতা, যেখানে হৃদয় বলতে কিছু নেই, সাময়িক ভোগ ও স্ফূর্তিই ছিল ওইসব ক্ষমতাবান বিত্তশালীদের নেশা।

নাসেরকে দেখে ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছার পথিমধ্যেই লিজার হৃদয়ের শূন্যতাটুকু তীব্র হয়ে উঠল। দৈহিক সৌন্দর্য, পৌরুষ, সততা ও অকপট মানসিকতা লিজাকে এতোটাই মুগ্ধ করে ফেলেছিল যে, ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছানোর পর তেরেসাকে না বলেই সে আবেগতাড়িত হয়ে চলে গিয়েছিল নাসেরের কক্ষে এবং বলেছিল, আমার উপর বিশ্বাস রাখো নাসের। লিজার মনে তখন কোন গোয়েন্দাগিরি কাজ করেনি, একান্তই সেটি ছিল তার হৃদয়ের সুপ্ত আকুতি, মনের একান্ত চাওয়া। সেদিন যদি তেরেসা লিজাকে ডেকে না নিয়ে যেতো; তাহলে সে কতক্ষণ নাসেরের কাছে কাটাতো এবং কি বলতো বলা মুশকিল।

তেরেসা এক পর্যায়ে লিজাকে দিয়ে নাসেরকে ফাঁসানোর চিন্তা করল। কিন্তু মনে-প্রাণে লিজা মোটেও নাসেরকে গোয়েন্দা জালে ফাঁসানোর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু কর্তব্যের কারণে নাসেরকে অবশ্যই সে নিজের যাদুমন্ত্রে কজা করতে চাইল। কর্তব্য ও হৃদয়ের টানাপোড়েনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল লিজা। শেষ পর্যন্ত সে হৃদয়ের প্রশান্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে নাসেরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

নাসেরের জানা ছিল না, কাফেলা যখন বিশ্রামের জন্যে যাত্রা বিরতি করে তাঁবু তৈরীতে ব্যস্ত তখন গোমশতগীন লিজার কানে কানে বলেছিল, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন চুপি চুপি তুমি আমার তাঁবুতে এসে পড়ো। কঠিন ফন্দি করে শেখ সিনানের গ্রাস থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে এনেছি। এসো, তোমাদের নেতাদের পাঠানো স্পেশাল সরাব আছে, খুব মজা হবে।

গোমশতগীনের প্রস্তাব শেষ হতেই খ্রিস্টান কর্মকর্তা লিজাকে ডেকে বলল, তেরেসা ঘুমিয়ে পড়লে আমার তাঁবুতে এসে পড়বে। প্রভুর মেহেরবানীতে তুমি বুড়োটার খপ্পর থেকে বাঁচতে পেরেছো, আমার তাবুতে এসো, খুব সুখ দেবো।

এসব প্রস্তাবে নিজের শরীর ও সৌন্দর্যের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল লিজার। সে কারো কথারই কোন জবাব না দিয়ে তাঁবুতে চলে গেল। তেরেসা সহসাই ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু লিজার চোখে ঘুম নেই। সে বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে নাসেরের দিকে রওয়ানা হল। ওদিকে নাসের তার জন্যে তৃষ্ণার্থ চাতকের মতো অধীর অপেক্ষায় নিঘুম প্রহর গুণছিল।

লিজা নাসেরকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় তাকে থামিয়ে দিয়ে নাসের বলল, এই শোন! তুমি কি কোন অশ্বখুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো? মনে হয় কোন ঘোড়া ছুটানোর আওয়াজ?

হ্যাঁ। আওয়াজতো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় শেখ সিনান আমাদের ধাওয়া করতে সৈন্য পাঠিয়েছে, সবাইকে জাগিয়ে দেয়া দরকার।

নাসের দৌড়ে একটি টিলার উপরে উঠে গেল। সে দূরে দেখতে পেল অনেকগুলো মশাল ঘোড়ার দৌড়ের সাথে সাথে একবার উপরে একবার নীচে নামছে। নাসের বুঝতে পারল অশ্বারোহী অনেক। দেখতে দেখতে অশ্বখুরের আওয়াজ বাড়তে লাগল। নাসের দৌড়ে টিলার উপর থেকে নীচে নেমে এল। তাবুর কাছে এসে সবাইকে জাগিয়ে দিল। সে তার সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে টিলার কাছে চলে গেল। লিজাকে নিজের কাছে রাখল নাসের। বিপদের আশংকায় সবাই বর্শা ও তরবারী হাতে নিয়ে মোকাবেলার জন্যে তৈরী হয়ে গেল।

* * *

সিনানের প্রেরিত ফেদাঈ ছিল পনেরো ষোল জন। তন্মধ্যে সাতজনের হাতে মশাল। এরা এসেই সবাইকে ঘিরে ফেলল। ওদের একজন হুংকার ছেড়ে বলল, উভয় মেয়েকে আমাদের হাতে দিয়ে দাও, শেখ সিনানের নির্দেশ–মেয়েদের দিয়ে দিলে সবাইকে নির্বিঘ্নে ছেড়ে দেয়া হবে।

নাসের ছিল অভিজ্ঞ লড়াকু। সহযোদ্ধাদেরকে আগেই টিলার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল সে। ইশারা করল সাথীদের। অমনি সবাই এক সাথে ফেদাঈদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নাসেরের সাথীরা বর্শার আঘাতে কয়েক ফেদাঈকে ধরাশায়ী করে ফেলল। নাসের সাথীদের উদ্দেশে চীৎকার দিয়ে বলল, ওদের ঘোড়র উপর সওয়ার হয়ে যাও। নাসের নিজেও ওদের একটি ঘোড়া ধরে তাতে সওয়ার হয়ে লিজাকে তার পিছনে তুলে নিল। বলল, খুব শক্ত করে আমার কোমড়ে ধরে রাখো, খেয়াল করো পা যাতে আটকে না যায়। সিনানের ফেদাঈরা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা হাতের মশালগুলো ফেলে দিয়েছিল। নাসের ও তার সহযোদ্ধারা মরণপণ মোকাবেলা করল। একটি ঘোড়া দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। পালিয়ে যাওয়া অশ্বারোহী ছিল গোমশতগীন। সে ছিল খুবই ধূর্ত ও চালাক। অবস্থা বেগতিক দেখেই পালিয়ে গেল। ফেদাঈরা নাসেরের ঘোড়ার উপরে লিজাকে দেখে ফেলেছিল। তারা চাচ্ছিল মেয়েটিকে জীবিত কজা করতে। তিন-চারজন অশ্বারোহী নাসেরকে ঘিরে বর্শা দিয়ে তার ঘোড়াকে আহত করার জন্যে আঘাত হানছিল। নাসের রণাঙ্গনের চিতা। সে বেষ্টনীর মধ্যেও নিজের ঘোড়ার দেহ অক্ষত রেখে দুই ফেদাঈকে ধরাশায়ী করল। তাকে বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া দৌড়াতে হলো; সেই সাথে চকিতে মোড় নিতে হলো। লিজা এমতাবস্থায় নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তার পা পাদানী থেকে খসে পড়েছিল, এক পর্যায়ে দ্রুতবেগে ঘোড়ার মোড় নেয়ায় লিজা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল।

লিজাকে পড়ে যেতে দেখে ফেদাইরা ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে ওকে ধরে ফেলল। নাসের খুব দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে ওদের আঘাত করতে চাইলে ওরা নাসেরের আঘাতের মুখে লিজাকে সামনে ধরে দিল। এতে হতোদ্যম হয়ে গেল নাসের। এক পর্যায়ে নাসেরও নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। ঘোড়া থেকে নেমে নাসের দেখল তার আশেপাশে নিজেদের কেউ নেই। ঘেরাও এর মধ্যে নিজের ঘোড়া ও লিজাকে সামলাতে গিয়ে সাথীদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করার সুযোগ পায়নি সে। নাসের কয়েকবার ফেদাঈদের আঘাত হানল কিন্তু প্রতিবারই তার আঘাত রোধ করতে ফেদাঈরা লিজাকে সামনে ধরে দিল। অবশেষে জীবন বাজী রেখে শুরু করল ওদের সাথে বর্শাযুদ্ধ। একাকী চারজনের সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজেও জখম হল কিন্তু ততক্ষণে আরো দুই ফেদাঈ কপোকাত। নাসেরকে আহত হতে দেখে লিজা চীৎকার শুরু করে দিল, নাসের! তুমি চলে যাও, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে, আমার জন্যে তোমার জীবনটা নষ্ট করো না নাসের, প্রভুর দোহাই! তুমি চলে যাও নাসের! তুমি একাকী এদের সাথে পারবে না, চলে যাও। কিন্তু নাসের মরিয়া হয়ে উঠল লিজাকে বাঁচাতে। এদিকে লিজাও সমানতালে চিৎকার করতে থাকল। এক পর্যায়ে নাসের চিৎকার করে বলল, চুপ কর লিজা! ওরা তোমাকে কখনও নিয়ে যেতে পারবে না।

হ্যাঁ। নিজের সংকল্প বাস্তবে প্রমাণ করে দেখাল নাসের। সব ফেদাঈকে মারাত্মকভাবে আহত করে দূরে সরিয়ে দিল নাসের। শেষ পর্যায়ে ওর সামনে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ রইল না। ময়দান ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর একটি ঘোড়াকে ধরে সেটিতে লিজাকে বসিয়ে নাসের চড়ে বসল তার পিছনে। খুব দ্রুত ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। যেখানটায় তাদের তাঁবু ছিল সেখানে এসে দেখে ময়দান একেবারেই ফাঁকা। কেউ নেই, সবই লাশ। কয়েকজন ফেদাঈ মারাত্মক আহত হয়ে মরণযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আর তার সাথীরা লড়াই করে সবাই মৃত্যুবরণ করেছে। খ্রিস্টান কর্মকর্তাও নিহত হয়েছে কিন্তু তেরেসাকে কোথাও দেখা গেল না। সেখানে বেশীক্ষণ না দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল নাসের। রাতের শেষ প্রহরের শুকতারা মিটিমিটি জ্বলছে। দিক ঠিক করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল নাসের। অনেক দূর এসে ঘোড়া থামাল সে।

লিজা! এখন বল, কোথায় যেতে চাও তুমি? তোমাকে একাকী পেয়ে তোমার অসহায়ত্বের সুযোগে আমি তোমার উপর নিজের মত চাপিয়ে দিতে চাই। তুমি যদি বল, তোমার এলাকায় পৌঁছে দিতে, আমি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করব। কারণ তুমি এখন আমার কাছে পবিত্র আমানত। এটা করতে গিয়ে আমি কারাবরণ করতেও দ্বিধা করব না।

তোমার সাথে আমাকে নিয়ে চল নাসের! তোমার আশ্রয়ে আমাকে নিয়ে নাও। বলল লিজা। বাকী রাত একটানা ঘোড়া হাকাল নাসের। ভোরের আলো পূর্বাকাশে উঁকি দিলে অন্ধকার কেটে যেতেই এলাকা পরিচিত মনে হলো। এ এলাকাতেই নাসের একবার তার দল নিয়ে ঝটিকা অভিযানে এসেছিল। এখানে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ী টিলা আর গিরিখাদ রয়েছে। যেতে যেতে নাসের একটি পাহাড়ী ঝর্ণার কাছে চলে এল। ঝর্ণাটি ছিল পাহাড়ের ঢালে। উভয়েই ঘোড়া থেকে নেমে প্রাণ ভরে ঝর্ণার পানি পান করল এবং ঘোড়াকেও পানি পান করাল। নাসেরের পরিধেয় কাপড় রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরে অসংখ্য জখম। কিন্তু ততক্ষণে জখম থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেছে। নাসের ক্ষতস্থানগুলো ধুয়ে দেখল জখমগুলো বেশী গভীর নয়। আবার রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে এই আশংকায় ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করল না। লিজা পানি পান করে টলতে টলতে একটু দূরে টিলার পিছন দিকে চলে গেল। ঝর্ণা থেকে উঠে নাসের ওকে খুঁজে বের করল। দূরে গিয়ে একটি বড় পাথরের উপরে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল লিজা। নাসেরের দিকে তার পিঠ। লিজার সামনে অনেকগুলো মৃত মানুষের হাড়গোড়। মাথা, খুলি, বুকের পাঁজর, হাত পায়ের হাড় যত্রতত্র বিক্ষিপ্ত। গোটা শরীরের কঙ্কালও রয়েছে কয়েকটি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি তরবারী, বর্শাও পড়ে রয়েছে।

মাথার একটি খুলি লিজার সামনে। সম্ভবত কোন মেয়ে মানুষের মাথার খুলি হবে সেটি। মুখের হাড়ের সাথে একটু একটু চামড়াও শুকিয়ে রয়েছে। মাথার খুলির সাথে দীর্ঘ কয়েক গাছি চুল। এটি নিঃসন্দেহে নারীর কঙ্কাল। উরুতে বর্শা বিদ্ধ। গলার সোনার হাড়টি এখনও আটকে রয়েছে। কঙ্কালের চারপাশে রেশমী কাপড়ের ভেঁড়া টুকরো। নাসের পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে লিজার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। লিজা একমনে নারী কঙ্কালে মগ্ন। হঠাৎ দুহাত কানে চেপে বিকট চিৎকার মারল লিজা এবং চকিতে মুখ ঘুরিয়ে উঠে পড়ল। খপ করে ওকে ধরে ফেলল নাসের। জড়িয়ে নিল বুকে। কাঁপতে শুরু করল লিজার শরীর। নাসের ওকে পাঁজাকোলা করে ঝর্ণার ধারে নিয়ে এল।

* * *

মাথায় পানি দিয়ে দীর্ঘ সময় শুইয়ে রাখার পর লিজা যখন স্বাভাবিক হলো তখন নাসের জিজ্ঞেস করল, তুমি চিৎকার করেছিলে কেন?

হায়! আমি আমার জীবনের করুণ পরিণতি দেখতে পাচ্ছিলাম। খুবই বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল লিজা। সম্ভবত তুমি কঙ্কালটি দেখে থাকবে। সেটি আমার মতোই কোন নারীর। সম্ভবত সেও আমার মতো রূপ সৌন্দর্যের যাদু ব্যবহার করতো, হয়তো যে কোন পুরুষকে সে রূপের ফাঁদে ফেলে নাকানী চুবানী দিতে পারতো, হয়তো সেই নারী ভাবতো, তার রূপ জৌলুস কখনও নিঃশেষ হবার নয়, সে চির সজীব হয়ে চিরদিন একইভাবে থাকবে। তুমি কঙ্কালটির উরুতে বিদ্ধ খঞ্জর দেখেছ? গলায় সোনার হার দেখেছো? এই খঞ্জর আর এই সোনার হার যে উপাখ্যানের কথা বলে; সেটি আমারই জীবনালেখ্য। অন্য যে সব কঙ্কাল ও বর্শা তরবারী পড়ে রয়েছে তা শত সহস্রবার শোনা গল্পেরই প্রতিবিম্ব। এসব গল্প কখনও আমি গভীরভাবে অনুধাবন করিনি। কিন্তু আজ এই নারী কঙ্কাল দেখে আমার মনে হয়েছে; এ যেন আমারই মাথার খুলি, আমারই কঙ্কাল। এই শুকনো কঙ্কালে আমার শরীরের রক্ত মাংস সংযোজন করা হলে আমারই রূপ প্রতিফলিত হবে। আমি যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একদল বুনো শকুন খুবলে খুবলে খাওয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি করছে। একটি শকুন যেন আমার অক্ষি কোঠর থেকে চোখের মণি ঠোকর দিয়ে বের করে নিচ্ছে। একটি হায়েনাকে দেখলাম আমার তুলতুলে গোলাপী গণ্ডদ্বয়ের মসৃণ গোশত খুবলে নিচ্ছে, চিবুচ্ছে। জঙ্গলী জীব-জন্তুরা আমার শরীরের সবকিছু লুটে নেয়ার পর কঙ্কালটি পড়ে রয়েছে। আমার মনে হলো, কঙ্কালের বিকশিত ভয়ানক দাঁতগুলো আমাকে ভর্ৎসনা করে বলছে, দেখো, দেখো, এই হবে তোমার পরিণতি। মনে হলো আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন কোন ভয়ঙ্কর জন্তু মুখ গহ্বরে নিয়ে আয়েশে চিবুতে শুরু করেছে।

লিজা! আর কদিন পর ওখানে গিয়ে দেখবে ফিদাঈ, তোমার সাথী ও অন্যান্যদেরও একই অবস্থা। হ্যাঁ, ওখানেও একই দৃশ্যের জন্ম হবে। মরদেহের কঙ্কাল, মাথার খুপরি, বর্শা, তরবারী, সবই ওখানে পাওয়া যাবে। ওখানেও হয়তো তুমি তেরেসার কঙ্কালে খঞ্জর বিদ্ধ দেখতে পারো, এরা যেমন নারীর জন্যে মরেছে, ওরাও নারীর জন্যই ধ্বংস হয়েছে। বলল নাসের।

হ্যাঁ, তাই ঠিক নাসের। বলল লিজা। আমি যদি আমার পেশা ত্যাগ না করি তাহলে আমাকেও এদের মতো করুণ পরিণতির শিকার হতে হবে। এমন মরু প্রান্তরে একদিন আমার এই সোনার দেহ নিয়ে শিয়াল শকুনে কাড়াকাড়ি করবে। আজ আমার দেহ পাওয়ার জন্যে যারা আমাকে আদর-সোহাগ ও মাল-দৌলত পেশ করে ওরাই এক সময় আমাকে হত্যায় প্রবৃত্ত হবে। নাসের! দুঃখের বিষয় মানুষ নিজ চোখে এসব করুণ পরিণতি দেখেও শিক্ষা নেয় না। মানুষ দেখে না, কত লোক বিত্ত, দৌলত, ক্ষমতা আর রূপ-যশের অহংকার অহমিকায় ধ্বংস হয়েছে। নাসের! আমি আত্মপরিচয় জেনে গেছি, আমি দেখে ফেলেছি আমার পরিণতি। নাসের! তুমিও শুনে রাখো, খোদা তোমাকে দিয়েছে সুপৌরুষ ও সুন্দর চেহারা। আমার বিশ্বাস; যে কোন বোদ্ধা নারী তোমাকে দেখলে একান্তে পাওয়ার লোভ করবে। এমতাবস্থায় তোমারও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। ওই বর্শা, তরবারী আর নরকঙ্কালগুলো দেখে নাও। ওগুলোতে দেখতে পাবে তোমার মতো পুরুষেরও করুণ পরিণতি।

লিজা এভাবে কথা বলছিল যেন জিনে ধরেছে তাকে। সে দুনিয়াত্যাগী দরবেশের মতো গুরু-গম্ভীরভাবে এসব কথা বলছিল, যেন জীবনের যাবতীয় চাকচিক্য ধোকা প্রতারণার পরিণতি দিব্য চোখে দেখছে সে, আসলে নিজের জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির স্বরূপ তার চোখে উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল।

নাসের! আমার আসল পরিচয় আজ আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। বলল লিজা। আমি তোমাকে দেখাব আমার রূপ ও জৌলুসের বৈশিষ্ট্য। সে তার বুকে একটা থাপ্পর মেরে নীরব হয়ে গেল। সে তার গলার সোনার হারটি একটানে ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় নিল এবং ঝর্ণার স্রোতে ছুঁড়ে দিল। হাতের আঙুল থেকে হীরার আংটি খুলে পানিতে নিক্ষেপ করল। বলতে লাগল, আমিও এক মহা ধোকা, মায়াবিনী মোহমায়া নাসের। আমিও তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছিলাম।

তোমার প্রতি আমার হৃদয়ের টান থাকলেও আমার কর্তব্যের ভূত আমার ঘাড় থেকে কখনও নামেনি। ফেদাঈদের হামলা আমার চোখ খুলে দিয়েছে এবং এসব নরকঙ্কাল আমার চোখের সামনে কঠোর বাস্তবকে উন্মোচন করে দিয়েছে, আমি নিজের চোখেই আমার মৃত্যু আর লাশ দেখতে পাচ্ছি। এই দৃশ্যের মুখোমুখি না হলে আমি জানতাম না, যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, সেখানে তোমার ভাগ্যে কি জুটতো। আর আমার ভালোবাসা, আমার প্রেমেরই বা কি পরিণতি ঘটতো। নাসের, কঠিন ধোকার শিকার হয়ে পড়েছিলে তুমি। এখন তোমাকে সব সত্য ঘটনা বলে দিচ্ছি, আমি এই আশায় তোমার সাথে প্রেমের ভান করছিলাম যে, তোমাকে আমার প্রেমের ফাঁদে ফেলে তোমাকে দিয়েই আইয়ূবীকে হত্যা করাব। গোমশতগীন আইয়ূবীকে খুন করানোর জন্যে ভাড়াটে খুনী আনার জন্যে শেখ সিনানের দুর্গে গিয়েছিল। সিনান বলেছিল, আইয়ূবীকে হত্যা করার জন্যে খ্রিস্টানদের সাথে কৃত চুক্তি মতো সে চার ফেদাঈ পাঠিয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত সে চারজন আইয়ূবী হত্যা মিশনে কাজ করছে। এরা যদি আবারও ব্যর্থ হয় তবে সে আর কোন ফেদাঈকে আইয়ূবী হত্যার জন্য পাঠাবে না। কারণ সে নাকি আইয়ূবী হত্যা মিশনে অনেক ফেদাঈ হারিয়েছে। এক পর্যায়ে আমাদের কর্মকর্তা সেই দুর্গে এসে পড়ল। গোমশতগীন আইয়ূবী হত্যার জন্যে সহযোগিতা চাইলে সিনান বলল, আইয়ূবীকে হত্যা করতে তোমরা পারবে না, আমরা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর চার যোদ্ধা তোমাকে দিচ্ছি, এদের তৈরী করে সাইফুদ্দীনকে খুন করিয়ে ফেল, তাহলে তোমার একচ্ছত্র আধিপত্য আরো সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু আমাদের অফিসার গোমশতগীনকে বলল, সাইফুদ্দীন কোন জরুরী ব্যাপার নয়, আপনার জন্যে জরুরী হলো আইয়ূবীকে হত্যা করা। এজন্যে আইয়ূবীর চার যোদ্ধাকে আপনি ব্যবহার করতে পারেন। অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো, আমি যাতে তোমাকে আমার প্রেমের ফাঁদে ফেলে আইয়ূবী হত্যায় তৈরী করে নিই।

আমি বেঁচে থাকতে আইয়ূবীর দিকে বক্র দৃষ্টিতে তাকাব তাও আমার পক্ষে অসম্ভব লিজা। বলল নাসের। দুনিয়ার এমন যাদু, এমন কোন শক্তি নেই যে, আমাকে এতোটা বিভ্রান্ত করে ফেলবে।

হাসল লিজা। বলল, আমি মনেপ্রাণে কখনও এ মিশনকে গ্রহণ করিনি। অবশ্য এতে কোন সন্দেহ নেই, আমরা কঠিন পাথরকেও পানি বানাতে পারি। এরপর লিজা তার অতীত জীবনের ইতিবৃত্ত সব জানাল। বলল, সাইফুদ্দীনের কাছে কতদিন কিভাবে কাটিয়েছে সে। সব শেষে নাসেরের কাছে জানতে চাইল, এতো পাপ-পঙ্কিলতা জানার পরও কি তুমি আমাকে গ্রহণ করবে? আমি… আমি এখন খাঁটি মনে ইসলামে দীক্ষিত হতে চাই নাসের!

তুমি যদি খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করে অতীত জীবনের জন্যে তওবা কর তাহলে তোমাকে গ্রহণ না করা হবে আমার জন্যে পাপ। তবে সুলতান আইয়ূবীর অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। বলল নাসের। আরও বলল, অতীতের সব গ্লানি সব দুশ্চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দাও। তুমি যদি ভবিষ্যতে সুন্দর জীবনের আগ্রহী হও, তাহলে আমাদের ধর্মই একমাত্র তোমাকে কাঙ্ক্ষিত সুন্দর পুতঃপবিত্র জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আচ্ছা লিজা! তুমি কি জান, যে চার ফেদাঈ সুলতানকে খুন করতে তৎপর, এরা কোন বেশে গেছে এবং এরা কিভাবে সুলতানকে আক্রমণ করবে?

এর বেশী কিছু আমি জানি না। জবাব দিল লিজা। আমার সামনে এর বেশী কিছু বলা হয়নি।

আমার এখন উড়াল দিয়ে তুকমান পৌঁছা দরকার। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এ ব্যাপারে সুলতানের দেহরক্ষী ও সুলতানকে সতর্ক করা জরুরী।

লিজাকে সামনে বসিয়ে নিজে ওর পিছনে চড়ে ঘোড়া হাঁকাল নাসের। পরীর মতো সুন্দরী রূপসী একটি তরুণীর আগুনঝরা শরীর ওর বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছে, ওর সোনালী রেশমী চুল উড়ে এসে চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু নাসেরের মধ্যে লিজার কোনই প্রভাব নেই। তার মন এখন শুধু সুলতান আইয়ূবীর নিরাপত্তা চিন্তায় বিভোর। যে কোনভাবে তুকমান পৌঁছানোই তার লক্ষ্য। তার দৈহিক উত্তেজনা, শিহরণ সব কিছুই লীন হয়ে গেছে সুলতানের জীবনাশঙ্কায়। কর্তব্যের অনুভূতি নিজের প্রেমকে দূর করে দিয়েছে। সে একজন যোদ্ধা হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করেছে। ফিরে পেয়েছে সে পূর্বের সেই গেরিলা কমান্ডারের সত্তা। শুধু যে নাসেরের এই পরিবর্তন তা নয়, লিজাও বদলে গেছে সম্পূর্ণরূপে। সে আর আগের মতো মায়াবিনী গোয়েন্দা তরুণী যাদুরাণী নয়, সে যে এক সুঠাম যুবকের বাহুবন্ধনে তার ইচ্ছার পুতুল, বিন্দুমাত্র তার মধ্যে সেই অনুভূতি নেই, নেই তারুণ্যের জৈবিক শিহরণ। সে যে এক তরুণী আর নাসেরের মতো এক টগবগে যুবকের বাহু বন্ধনে একই ঘোড়ায় আরোহী সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই লিজার। লিজার দৃঢ় বিশ্বাস, পাপ-পঙ্কিল জীবন ত্যাগ করে পুতঃপবিত্র জীবনের দিকে যাচ্ছি আমি, সেই জীবন দিতে পারে ইসলাম এবং নাসেরের মতো যুবকরাই সেই পবিত্র জীবনের প্রতীক। অতঃপর কদর্য ও অসুন্দরের কোন গন্ধ নেই তাদের স্পর্শ ও অবস্থানে যদিও তারা একই অশ্বপৃষ্ঠের আরোহী।

* * *

বোজা ও নবজ দুর্গের দুর্গপতিরা সুলতানের দূতের কাছে আত্মসমর্পণ করে দুর্গের অধিকার আইয়ূবীর হাতে তুলে দিয়েছিল। আইয়ূবী দুর্গের সৈন্যদেরকে তাঁর সেনাবাহিনীতে আত্মীকরণ করে দুর্গের মধ্যে বিশ্বস্ত একদল সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দুর্গের নিয়ন্ত্রণ কজা করলেন। কিন্তু ইজাজ দুর্গের দুর্গপতির ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ ও ঔদ্ধ্যত্য সুলতানকে আগ্নেয়গিরির মতো ক্ষুব্ধ করে রেখেছিল। তিনি ইজাজ ও আলেপ্পোর দিকে অগ্রাভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন। বরাবরের মতো অগ্রাভিযানের আগেই তিনি অগ্রবর্তী গোয়েন্দা ইউনিট পাঠিয়ে দুর্গের অবস্থান ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি জানার ব্যবস্থা করলেন। গোয়েন্দাদের বলে দিলেন কিভাবে আলেপ্পো ও ইজাজ দুর্গকে কজা করতে হবে এ ব্যাপারে সার্বিক পরিস্থিতি তোমরা ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে আসবে। গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে আলেপ্পো ও ইজাজ দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিপূর্ণ রিপোর্ট সুলতানকে জানিয়ে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সুলতান নিজেই ইপ্সিত লক্ষ্যবস্তুকে জানার জন্যে নিজেই সেখানকার ভৌগোলিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়তেন। এ সময় তিনি বডিগার্ড ও সরকারী পাতাকাবাহীদের সাথে নিতেন না। লাল রঙের মধ্যে সাদা ডোরাকাটা তার একান্ত ঘোড়াও তিনি ব্যবহার করতেন না। কেননা, তার একান্ত ঘোড়াটিকে শত্রুবাহিনীর কমান্ডার চিনতো। বডিগার্ড ও সরকারী ঝাণ্ডাবাহীদের নিয়ে গেলে তো ব্যাপারটি আর গোপন রাখার উপায় ছিল না।

সুলতানকে অনুরোধ করা হয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া তিনি যেন কখনও একাকী কোথাও না যান। কিন্তু তিনি জীবনে কখনও নিজের নিরাপত্তার পরোয়া করতেন না। আর এ মুহূর্তে তার মন মেজাজ ছিল খুবই উত্তপ্ত। শত্রুদেরকে তিনি যেমন নাকানী-চুবানী খাইয়েছেন, শত্রুরাও তাঁর বাহিনীর অপরিমেয় ক্ষতিসাধন করেছে। যার ফলে শত্রুদের চূড়ান্ত আঘাত করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন অতি অল্প সময়ে ঘরের শত্রু বিভীষণদের খতম করে আসল শত্রুদের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হতে।

এ অঞ্চলটি ছিল ঘন টিলা ও ঝোঁপ ঝাড়ে ভরা মাটিও পাথুরে। জায়গায় জায়গায় আবার গভীর গিরিখাদ। এসব এলাকায় একাকী বের হওয়া ছিল সুলতান আইয়ূবীর জন্যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একদিন কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠেই প্রধান সেনাপতি হাসান বিন আব্দুল্লাহ তাকে বললেন, সুলতান মুহতারাম! আল্লাহ না করুন, কোন শত্রুদের প্রাণঘাতি হামলা যদি সফল হয়ে যায়, তবে ইসলামী সালতানাত আপনার মতো দ্বিতীয় কোন সুলতান জন্ম দিতে সক্ষম হবে না। আর জাতির কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্যে আমাদের কবরেও ভর্ৎসনা করে আমাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করবে।

আল্লাহ্ যদি আমার মৃত্যু কোন ফেদাঈ কিংবা খৃস্টান গুপ্তচরের হাতেই লিখে থাকেন তবে তা-কি আমি রুখতে পারব? বাদশা যখন নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন আর সে জাতির ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধানের যোগ্য থাকে না। নিহত হওয়াই যদি আমার বিধিলিপি হয়ে থাকে তাহলে তো আমার কর্তব্য কাজটি সেরে ফেলার জন্যে তোমাদের উচিত আমাকে সুযোগ দেয়া। নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে আমাকে বন্দী করে রেখো না। আমার মনের মধ্যে রাজা বাদশাহের মতো রাজত্বের মোহ সৃষ্টি করো না। তোমরা তো জানো, কতবার আত্মঘাতি আক্রমণ হয়েছে আমার উপর, আল্লাহ্ প্রত্যেকবারই আমাকে হেফাযত করেছেন। এবারও সেই আল্লাহই হেফাযত করবেন। তিনিই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা দাতা!

সুলতান আইয়ূবীর একান্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তা তার নিরাপত্তা নিয়ে সব সময়ই উদ্বিগ্ন। কারণ ইতিপূর্বে সুলতানের উপর অনেকগুলো প্রাণঘাতি আক্রমণ হয়েছে। দেখা গেছে, প্রতি মারণাঘাতের সময়ই সুলতান ছিলেন একাকী এবং তার নিরাপত্তা রক্ষীদের অবস্থান ছিল আশেপাশে। বেশীরভাগ আক্রমণ নিরাপত্তারক্ষীরা দ্রুত পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্বে এনে ঘাতকদের কাবু করতে সক্ষম হয়েছে। এরপর থেকেই সুলতান তাঁর একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের আশেপাশে রেখে নিজে হারিয়ে যেতেন। এদিকে প্রধান সেনাপতি হাসান বিন আব্দুল্লাহ দূর থেকে সব সময় সুলতানকে নজরে রাখার জন্যে একটি চৌকস সেনা ইউনিট গঠন করেছিলেন। যাদের দায়িত্ব ছিল সুলতানের অজ্ঞাতেই তাঁরা সুলতানের নিরাপত্তার স্বার্থে তার উপর নজরদারী রাখবে। যাতে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত না ঘটতে পারে।

কিন্তু কেউ জানতো না, দীর্ঘদিন ধরেই চার ঘাতক ফেদাঈ সুলতানকে হত্যার উদ্দেশে মরুভূমিতে অহর্নিশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য আইয়ূবীকে খুন করা।

এরাই ছিল সেই ফেদাঈ যাদের সম্পর্কে ঈসিয়াত দুর্গপতি শেখ সিনান গোমশতগীনকে বলেছিল। এই চার খুনী ফেদাঈর পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ কবলিত এলাকার বিপন্ন মানুষের বেশে আইয়ূবীর সংস্পর্শে গিয়ে তাকে খুন করবে। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনার কোনই প্রয়োজন হলো না। এরা দেখল সুলতান আইয়ূবী কোন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই মরুভূমিকে একাকী ঘুরে বেড়ান। এটা ছিল ফেদাঈদের জন্যে দারুণ সুযোগ। শিকার না চাইতেই হাতের নাগালে এগিয়ে আসছে। কিন্তু ফেদাঈদের অসুবিধা ছিল তীর ধনুকের অপ্রাপ্তি। মাত্র একটি তীর ও ধনুক থাকলেই তারা দূর থেকেই আইয়ূবীকে নিশানা করতে পারতো, কিন্তু তাদের পক্ষে তীর ধনুক বহন করা সম্ভব ছিল না। কারণ এতে আইয়ূবীর ভ্রাম্যমান গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে বড় ধরনের ছোঁড়া ও খঞ্জরই ছিল ফেদাঈদের প্রধান হাতিয়ার।

* * *

এদিকে লিজাকে ঘোড়ায় বসিয়ে নাসের উল্কার বেগে ঘোড়া দৌড়াল। লিজা তাকে বলে দিয়েছিল চার ফেদাঈ সুলতানকে খুন করার জন্যে অনেক দিন থেকে চেষ্টারত রয়েছে। নাসেরের একমাত্র লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে দ্রুত পৌঁছে সুলতানের বিপদাশঙ্কা সম্পর্কে প্রধান সেনাপতিকে অবহিত করবে। কিন্তু নাসের চাইলেও তার পক্ষে খুব বেশী দ্রুত পৌঁছা সম্ভব ছিল না। একেতো তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অনেক দূর, তাছাড়া একই ঘোড়ায় দুজন আরোহী। তাকে বাধ্য হয়েই পথে থামতে হয়েছে, ঘোড়াকে দানাপানি খাইয়ে বিশ্রাম দিতে হয়েছে।

ঘটনাক্রমে নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব না দিয়ে সুলতান আইয়ূবী একাকী ময়দানে চলে এলেন। চার ফেদাঈ সুলতানকে একাকী ঘুরতে দেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। এই এলাকাটি ছিল সেনাবাহিনীর অবস্থান থেকে অনেক দূরে বিজন প্রান্তরে। আশেপাশে কোথাও লোকালয় ছিল না। এই বিজন প্রান্তরেই মরু-শিয়ালের মতো শিকারের খোঁজে থাকত ফেদারা। ময়দানেই রাত কাটাতো, সুলতানকে সুযোগ মত পাওয়ার অপেক্ষায় ফেদারা সুযোগের জন্যে প্রহরা গুনতো।

এদিকে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর নাসের লিজাকে নিয়ে ঘোড়া হাঁকাচ্ছে। কিন্তু ঘোড়ার চাল বলে দিচ্ছে, তার দ্রুত চলার ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে আসছে। নাসের ঘোড়ার বোঝা হাল্কা করতে এক লাফে মাটিতে নেমে লাগাম হাতে নিয়ে পায়দল চলতে শুরু করল। রাত বাড়তে লাগল নাসেরের সেদিকে খেয়াল নেই। লিজা তাকে বারংবার জানান দিচ্ছে; ঘোড়ার পিঠে আর বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর হাড়গুলোও ব্যথায় চুরচুর হয়ে গেছে। নাসের নিজেও ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। তারও শরীর অবসন্ন কিন্তু তবুও যাত্রা বিরতি করেনি সে। সে লিজাকে বলল, লিজা! তোমার আর আমার জীবনের চেয়ে সুলতানের জীবন অনেক বেশী দামী। আমার বিলম্বের কারণে যদি সুলতানের কিছু হয়ে যায় তবে আমি মনে করব আমিই সুলতানের হন্তারক।

* * *

রাত শেষ হয়ে পূর্বাকাশে সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে নাসের তখন আর হাঁটতে পারছে না। পা টেনে হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগুচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে লিজা। ঘোড়া নিতান্তই ধীরগতিতে হাঁটছিল। এক জায়গায় ঘাস ও পানি দেখে থেমে গেল ঘোড়া। লিজা ঘোড়ার পিঠ থেকে মাথা তুলে বলল, আল্লাহর দোহাই নাসের! এটাকে আর তুমি টানা-হেঁচড়া করো না, একটু ঘাস পানি খেতে দাও।

ঘোড়া পানি পান করে নেয়ার পর নাসের সেটির লাগাম ধরে আবার চলতে শুরু করল। ঘোড়া আর দৌড়াতে পারছিল না। নাসের নিজেও হাঁটতে অক্ষম হওয়ায় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হল। লিজার দুধে-আলতা চেহারা নীল হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।

নাসেরের জানা ছিল না সুলতান এখন কোথায়? সুলতান তখন তুর্কমান ত্যাগ করে আরো অনেক সামনে অগ্রসর হয়েছেন; এমনকি তুকমানের পর কুহে সুলতান পেরিয়ে তিনি আরো সামনে চলে গেছেন। নাসেরের সামনে তখন আদিগন্ত তুর্কমান ময়দান। সে ভেবে কুল পায় না কিভাবে এই বিশাল ময়দান পাড়ি দেবে। সূর্য তখন মাথার উপরে উঠে গেছে।

* * *

সুলতান আইয়ূবী তার একান্ত কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে একটি বিজন পাথুরে টিলাময় প্রান্তরের পরিস্থিতি পরখ করার কাজে ব্যস্ত। একান্ত কর্মকর্তাকে এক জায়গায় রুখে দিয়ে তিনি একাকী হারিয়ে গেলেন। একটি টিলার উপরে উঠে তিনি চারদিক পর্যবেক্ষণ করছেন, সুলতান হয়তো তার সেনাদলের অগ্রাভিযানের কৌশল নির্ধারণের চিন্তায় ছিলেন, আর এদিকে সেই টিলার আড়ালেই লুকিয়ে থেকে সুলতানের গতিবিধি দেখছিল চার ফেদাঈ।

মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগ আর হাত ছাড়া করা যায় না।

নীচে আসতে দাও! সাথীকে এই বলে থামল এক ফেদাঈ।

তার নিরাপত্তা বাহিনী হয়তো কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে।

যাই হোক, আজ আর তাকে যেতে দেবো না। বলল অপর এক ফেদাঈ।

শুধু একজন যাবে। বলল ওদের দলনেতা। পিছন দিক থেকে আঘাত করতে হবে। প্রয়োজন পড়লে অন্যেরাও শরীক হবে।

সুলতান আইয়ূবী টিলার উপর থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে অন্যদিকে রওয়ানা হলেন। ফেদাঈ পিছনে পিছনে এগুতে লাগলো। কারণ সুলতানকে আঘাত করার মতো উপযোগী ছিল না জায়গাটি। সুলতান আবার ঘোড়া থেকে নেমে একটি টিলার উপরে উঠে গেলেন। একটু পড়েই টিলার উপর থেকে নেমে ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলেন। ফেদাঈরা তাঁর কাছেই লুকিয়ে ছিল, এরা এবার সুযোগ মনে করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। সুলতান অশ্বারোহণ করে ময়দানের দিকে যাওয়ার ইচ্ছায় অশ্বপৃষ্ঠে উঠতে যাবেন, ঠিক এ সময় তার কানে কারো দৌড়ানোর পায়ের আওয়াজ ভেসে এল। ঘাড় ফেরাতে ফেরাতে এক ফেদাঈ এক ফুট দীর্ঘ একটি খঞ্জর হাতে নিয়ে সুলতানের অবস্থান থেকে তিনচার হাত কাছাকাছি পৌঁছে গেল। আইয়ূবী তাকে দেখে ফেললেন।

দ্রুত তার খঞ্জর বের করে ফেললেন সুলতান। ফেদাঈ আঘাত হানল সুলতান তার হাতলে নিজের হাতল ঠেকিয়ে আঘাত রুখতে চাইলেন, কিন্তু ফেদাঈ ছিল ভীষণ শক্তিশালী, সে বাধা ঠেকিয়ে পুনরায় আঘাত হানতে উদ্যত হলো, কিন্তু এর আগেই সুলতান ফেদাঈকে আঘাত করলেন কিন্তু আঘাত রুখে দিল সে। টিলার ওপাশ থেকে তখন বেরিয়ে এল আরেক ফেদাঈ। এসে সুলতানকে পিছন দিক থেকে আঘাত করল। সুলতান সেই আঘাতও রুখে দিলেন কিন্তু তার বাজুর চামড়ায় আঁচড় লাগল। একাধিক আক্রমণকারীর আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য সুলতান ঘোড়াকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। এক ফেদাঈ ঘুরে আঘাত করতে গেলে বাম হাতে ওর নাকের উপর দশাসই একটি ঘুষি বসিয়ে দিলে ওর মুখ থুবড়ে রক্ত পড়তে শুরু করল। সুলতান ওর পেটে খঞ্জরটি বসিয়ে দ্রুত বেগে বের করে ফেললেন। সেই সাথে ওকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। এরপর ফেদাঈ ছটফট করতে করতে মারা গেল।

অপর ফেদাঈও সুলতানের পিছন দিক থেকে আঘাত হানল। কিন্তু পূর্বের মতই এই আঘাতও সুলতান রুখে দিলেন। তবে ফেদাঈর খঞ্জরের মাথা সুলতানের উরুতে লেগে উরু কিছুটা কেটে গেল। আঘাতটি তেমন মারাত্মক ছিল বটে কিন্তু ইতিমধ্যে টিলার আড়াল থেকে আরো দুই ফেদাঈ দৃশ্যমান হল। এমন সময় অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। মুহূর্তের মধ্যে ফেদাঈদের ঘিরে ফেলল অশ্বারোহীরা। পালাতে চেষ্টা করল ফেদাঈরা কিন্তু অশ্বারোহীদের ক্ষীপ্ত আক্রমণে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়েই এক ফেদাঈ মরে গেল, আরেকজনকে তরবারীর আঘাতে মাথা উড়িয়ে দিল অশ্বারোহীরা। সুলতান অশ্বারোহীদের চিৎকার করে বললেন, ওদের হত্যা করো না, জীবন্ত ধরতে চেষ্টা কর। সুলতানের নির্দেশে পলায়নপর চতুর্থ ফেদাঈকে জীবন্ত ধরে আনল আবু আব্দুল্লাহর নিয়োগকৃত বিশেষ নিরাপত্তারক্ষীরা।

আল্লাহ্ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে সেদিনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেন সুলতান। সুলতানের নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন অনতিদূরের একটি টিলার উপর থেকে ভাগ্যক্রমে দেখে ফেলেছিল সুলতানের উপর ফেদাঈদের আক্রমণ। সেই সাথে সাথীদের প্রতি ইঙ্গিত করা মাত্র বিদ্যুৎগতিতে তারা এসে রুখে দেয় ফেদাঈদের। অন্যথায় সেদিনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার দৃশ্যতঃ কোন উপায় ছিল না। হয়ত আইয়ূবীর ইতিহাস সেখানেই থেকে যেতো।

১৯৬৭ সালের মে মাস মোতাবেক ৫৭১ হিজরী সনের যিলকদ মাসে সুলতানের উপর ফেদাঈদের এই আক্রমণ হয়েছিল। ধৃত ফেদাঈকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, ঈসিয়াত দুর্গ থেকে আমরা চারজন এসেছিলাম। হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ ফেদাঈকে জেরা করে ঈসিয়াত দুর্গ ও হাশিশ সম্রাট শেখ সিনানের আদ্যোপান্ত জেনে নিয়েছিলেন। হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ ঈসিয়াত দুর্গের অবস্থা, অবস্থান, শক্তি ও সৈন্য সংখ্যার ব্যাপারেও বিস্তারিত তথ্য সগ্রহ করে সুলতানকে অবহিত করলেন।

সুলতান আইয়ূবী শেখ সিনানের অপকর্ম ও ধ্বংসাত্মক অবস্থা জ্ঞাত হওয়ার পর বললেন, আগামী রাতের শেষ প্রহরে আমরা ঈসিয়াত দুর্গের দিকে অভিযান শুরু করব। সকল সেনাধ্যক্ষ ও কমান্ডারদের তলব করে প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন সুলতান। ফেদাঈদের এই আখড়া উৎখাত করা বেশী জরুরী হয়ে পড়েছে। এটাকে কজা করে আমাদের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এক তৃতীয়াংশ সেনাই যথেষ্ট হবে। তিনি সেনাপতিদের অভিযানের কৌশল কি হবে তাও বলে দিলেন।

সেদিন সন্ধ্যায় সুলতানকে খবর দেয়া হলো, নাসের এক ঝটিকা বাহিনীর সদস্য দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যেই হাসান বিন আব্দুল্লাহর কাছে নাসের তার ইতিবৃত্ত জানিয়েছে। দীর্ঘ বিরামহীন সফর, ক্ষুধা তৃষ্ণা ও আগুনে পোড়া মরুতাপে নাসেরের অবস্থা খুবই করুণ, লিজাও তাঁর সাথে। এমতাবস্থায়ই সুলতানের সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন গোয়েন্দা প্রধান। লিজার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। মৃতপ্রায় সে। চোখ কোটরে দেবে গেছে। রোদে পুড়ে সোনালী চেহারা তামাটে হয়ে গেছে। চেষ্টা করেও কথা উচ্চারণ করতে পারছে না। তবুও ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হল সুলতান সকাশে। নাসের সুলতানকে তাদের হারিয়ে যাওয়া থেকে এখানে আসা পর্যন্ত আদিঅন্ত বিস্তারিত জানাল। লিজার আগমন ও তার মনে লিজার প্রেম ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও জানাল সুলতানকে।

সব শুনে সুলতান লিজার উদ্দেশে বললেন, তুমি আযাদ। তোমার ব্যাপারে তোমারই ইচ্ছা কার্যকর করা হবে। লিজা সম্ভবত নিজেকে কয়েদী ভাবছিল। কয়েদখানার পরিণতির জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করছিল লিজা। কিন্তু খোদ সুলতানের মুখে তার স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঘোষণা শুনে সে অবাক হয়ে গেল। ক্ষীণকণ্ঠে বলল, আমি জীবনের জন্যে নাসেরের সেবিকা হিসেবেই থাকতে চাই। লিজাকে জানান হলো, এ মুহূর্তে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর সান্নিধ্যে দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এরপর সময় ও সুযোগ মত নাসের তার সাথে সাক্ষাৎ করবে।

হাসান বিন আব্দুল্লাহ ছিলেন সুলতানের গোয়েন্দা প্রধান। তিনি সব সময় এ ধরনের তরুণীদের পর্যবেক্ষণের জন্যে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার অধীনে রেখে গোপনভাবে ওদের খোঁজ খবর নিতেন। পর্যবেক্ষণের পর তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। নাসেরকে সেদিন সেনা ছাউনীতে চিকিৎসার জন্য বলা হলো। চিকিৎসকদের নির্দেশ দেয়া হলো দ্রুত সুস্থতা লাভের জন্য নাসেরের চিকিৎসার প্রতি সবিশেষ যত্ন গ্রহণ করা হোক।

* * *

গোমশতগীনের প্রতারণা ও ইপ্সিত লিজাকে না পেয়ে শেখ সিনান চরম ক্ষুব্ধ। কেউ তার পাশে ঘেষার সাহস পাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় মাত্র দুজন ফেদাঈ যখন তেরেসাকে বন্দী করে দুর্গে ফিরে গেল তখন শেখ সিনানের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। তার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি বেরুতে শুরু করল। তেরেসাকে জিন্দান খানায় বন্দী করে নির্মম শাস্তি দিতে শুরু করল সিনান। তেরেসাও কম সুন্দরী ছিল না। কিন্তু শেখ সিনানের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল লিজার প্রতি। লিজাকে উদ্ধার করতে পারেনি ফেদাঈরা। নাসের ওকে ওদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে নিয়ে গেল।

এর কদিন পর ঈসিয়াত দুর্গের বহিঃদেয়ালের উপরে পাহারাদার সৈন্যরা দেখতে পেল বিশাল ধুলিঝড়ের মতো কি যেন এগিয়ে আসছে, কিন্তু তখন ধুলি ঝড়ের কোন আলামতই ছিল না। তাদের বুঝতে বাকী রইল না কোন অভিযাত্রীদল আসছে এদিকে। দেখতে দেখতে ধুলিঝড় আরো এগিয়ে এল। দৃশ্যমান হতে লাগল অশ্বারোহী বাহিনী। সম্ভাব্য বিপদাশঙ্কা করে যুদ্ধডঙ্কা বাজিয়ে দিল প্রহরীরা। দ্রুত খবর দেয়া হল শেখ সিনানকে। একটু পরেই দেখা গেল হাজার হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে দুর্গের দিকে।

অবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য দুর্গের উঁচু মিনারে চরে বাইরের দিকে তাকাল সিনান। ততক্ষণে সুলতানের বাহিনী বৃত্তাকারে দুর্গ অবরোধের জন্য ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। মিনার থেকে মোকাবেলার নির্দেশ দিল সিনান। ফেদাঈ তীরন্দাজরা সীমানা প্রাচীরের উপরে উঠে নিজের মতো করে অবস্থান নিল। কিন্তু আক্রমণ শুরু করল না। তারা প্রতিপক্ষের অবস্থা ও আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করল।

সুলতানের বাহিনী দুর্গাভ্যন্তরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত। হাসান বিন আলী ফেদাঈর কাছ থেকেই দুর্গের অবস্থা জেনে নিয়েছিলেন, তদুপরি নাসেরের প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনায় তিনি দুর্গাভ্যন্তর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছিলেন। দুর্গ অবরোধের সময় নাসেরও তাঁদের সাথে এসে যোগ দিল। নাসের তাদের বুঝিয়ে দিল দুর্গের কোথায় কি রয়েছে। নাসেরের কথা মত শেখ সিনানের প্রাসাদে আঘাত হানার জন্যে দুটি মিনজানিক (পাথর উৎক্ষেপণ যন্ত্র, যা সেই যুগের সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল) স্থাপন করা হল। মিনজানিক থেকে শেখ সিনানের প্রাসাদে নিক্ষেপ করা হল ভারী পাথর। প্রথম আঘাতেই প্রাসাদের ছাদের কতটুকু ভেঙে গেল। দুর্গপতির প্রাসাদে শুরু হয়ে গেল আর্তচিৎকার।

মিনজানিকের আক্রমণ শুরু হতেই দুর্গের দিক থেকে শুরু হল তীর বৃষ্টি। মিনজানিক চালকদের কয়েকজনকে ফেদাঈরা ধরাশায়ী করে ফেলল। ফেদাঈদের তীর বৃষ্টিতে মিনজানিক চালানো কঠিন হয়ে উঠলে পরিস্থিতি দ্রুত আয়ত্বে আনতে তেল ভর্তি মাটির পাত্র নিক্ষেপ করা হলো। মাটির তেল ভর্তি পাত্রগুলো মিনজানিকের দ্বারা নিক্ষিপ্ত হয়ে দুর্গের অভ্যন্তরে তেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে শুরু করল। সেই সাথে ছোঁড়া হলো আগুনবাহী তীর। কিন্তু নিক্ষিপ্ত তেলে তীরবাহী আগুন ধরানোর ব্যাপারটি সহজ ছিল না। উঁচু পাচিল টপকে তীর চালাতে না পারায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে অগ্নিবাহী তীর নিক্ষেপ সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল দুর্গের ভিতরে পাচিলের কাছেই এক জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ধোয়ার উৎস লক্ষ্য করে তেলবাহী পাত্র নিক্ষেপ করলে সাথে সাথে সেই তেলে আগুন জ্বলে উঠল। দেখতে দেখতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল সিনানের প্রাসাদে। শুরু হল বিকট চিৎকার চেঁচামেচি। অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে শেখ সিনানের বেশী সময় লাগল না। প্রাসাদে আগুন ধরে গেলে দুর্গের ভিতর থেকে সে সাদা পতাকা উড়িয়ে শান্তির পয়গাম জানাল।

শেখ সিনান জানতো, আইয়ূবী কিংবা খৃস্টান বাহিনীর মতো তার সেনারা সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে অভ্যস্থ নয়। তাছাড়া নেশাকে পেশা হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেরাও নেশাসক্ত হয়ে পড়েছিল। অধিকাংশই নেশায় চুরচুর। এদের দ্বারা আইয়ূবীর বাহিনীর সাথে মোকাবেলা একেবারেই অসম্ভব। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা হবে সমূলে ধ্বংস হওয়ার নামান্তর। এরচেয়ে পরাজয় স্বীকার করে নেয়াই শ্রেয়।

সাদা পতাকা উড়তে দেখে সুলতান যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিলেন। চতুর্দিকে নেমে এল পিনপতন নীরবতা।

কতক্ষণ পর দুর্গের প্রধান ফটক পেরিয়ে কয়েকজন উর্ধতন সেনাকর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে শেখ সিনান বেরিয়ে এল। সুলতান প্রথানুযায়ী শেখ সিনানকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যাননি। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে শেখ সিনান ছিল অমার্জনীয় অপরাধে শাস্তিযোগ্য অপরাধী। সিনান ও তার কর্মকর্তারা যখন সুলতানের কাছে এলো তখন তিনি এদের বসার জন্যও বলেননি, দাঁড়ানো অবস্থায় রেখেই বললেন,

সিনান! তুমি আমার কাছে কি প্রত্যাশা কর?

প্রাণভিক্ষা, মহামান্য সুলতান! পরাজিতের কণ্ঠে বলল সিনান।

দুর্গের কি হবে? জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

আপনার ফয়সালাই আমি মাথা পেতে মেনে নেবো সুলতান।

যত তাড়াতাড়ি পার তোমার সৈন্য সামন্ত লোক লস্কর নিয়ে দুর্গ ত্যাগ কর। শুধু জীবন নিয়ে যাবে তোমরা; তোমার সৈন্যরা কোন অস্ত্র সাথে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কেউই কোন জিনিসপত্র আসবাবপত্র নিয়ে যেতে পারবে না। খালি হাতে দুর্গ ত্যাগ করতে হবে। আর মনে রেখো, ইসলামী সালতানাতের সীমা অতিক্রম করার আগে কোথাও থামবে না। তোমার প্রভু খৃস্টানদের কাছে গিয়ে থামবে। এ কথাও শুনে যাও, যে চার ফেদাঈকে তুমি আমাকে খুন করার জন্যে পাঠিয়ে ছিলে ওরা সবাই নিহত হয়েছে। তবুও তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। শান্তি পতাকা তুমি উড়িয়েছে। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তোমার শান্তি প্রস্তাবকে আমি সম্মান করলাম, কিন্তু তোমাকে আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন কি-না বলা মুশকিল। মনে রেখো, এখন থেকে নিজেদেরকে আর মুসলমান বলে পরিচয় দিবে না। আবারো যদি নিজেদের মুসলমান দাবী করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে জানতে পারি, তবে রোম সাগরে তোমার চেলাপেলাসহ সবাইকে ডুবিয়ে মারব।

বেলা যখন পশ্চিম আকাশের তলদেশে তলিয়ে যেতে উপক্রম তখন দীর্ঘ সারি বেধে ফেদাঈরা পরাজয়ে মাথা নীচু করে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্গ ছেড়ে। শেখ সিনান সেই সারির প্রথম ভাগে। তার শীর্ষ কর্মকর্তা মহলের নারী, নর্তকী, সেবিকা ও পেশাদার খুনীদের নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে।

রিক্ত নিরস্ত্র সিনান ও সিনানের সকল সৈন্য শান্ত্রী। বেলা ডোবার আগেই সুলতানের বাহিনী দুর্গের নিয়ন্ত্রণ কজা করল। জেলখানায় সকল বন্দীকে মুক্ত করে দেয়া হল। দুর্গ থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা-দানা, হিরা-মুক্তা, উট, ঘোড়া ও আসবাবপত্র সুলতানের হস্তগত হল।

* * *

ঈসিয়াত দুর্গের দায়িত্ব একজন সেনাপতির হাতে দিয়ে রাতেই আইয়ূবী সুলতান পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি খুব দ্রুতই ইজাজ দুর্গ দখলে নিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে অভিযান পরিচালনার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। কদিনের মধ্যেই তিনি ইজাজ দুর্গ অবরোধ করলেন। ইজাজ দুর্গকে আলেপ্পোর শাসকরা নানাভাবে আরো বেশী দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেছিল। ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা ছিল অক্লান্ত। সাইফুদ্দীনের যৌথ বাহিনীকে ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা অংশগ্রহণ করেনি।

সুলতান আইয়ূবী ঈসিয়াত দুর্গের মতো এতোটা সহজে ইজাজ দুর্গও দখল করে নিতে পারবেন এমন আশা তার ছিল না। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, ইজাজ দুর্গ অবরোধ করলে আলেপ্পোর সৈন্য পিছন দিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তাই আলেপ্পোর যে কোন আক্রমণ প্রতিরোধের পূর্বপ্রস্তুতির ব্যবস্থাও তিনি নিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য আলেপ্পোর বাহিনী তুর্কমানে পরপর পরাজিত হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলেছিল।

ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সুলতানের বাহিনীকে মোকাবেলা করল। একদিন একরাত পর্যন্ত সুলতানের সৈন্যরা দুর্গের ধারেপাশেই যেতে পারেনি। দুর্গ প্রাচীর ভাঙার জন্যে সুলতানের একটি ইউনিট দিনরাত চেষ্টা করেও প্রাচীরের কাছেই যেতে পারেনি। ইজাজ দুর্গের সৈন্য সুলতানের সৈন্যদের প্রতি অসংখ্য তীর নিক্ষেপ করে প্রাচীর থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছিল।

মিনজানিক থেকে বড় বড় পাথর দুর্গ প্রাচীরের প্রধান ফটকে নিক্ষেপ করা হলো। তেলভর্তি পাত্র নিক্ষেপ করে অগ্নিবাহী তীর দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হল তবুও দুর্গের প্রধান ফটক ভাঙা সম্ভব হচ্ছিল না। ইজাজের সৈন্যরা সুলতানের মিনজানিক ইউনিটের উপর শক্তিশালী ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করে বহু হতাহত করে ফেলল। সুলতানের মিনজানিক ইউনিট তবুও মিনজানিক চালানো অব্যাহত রাখল। অগ্নিবাহী তীর ও তেলভর্তি পাত্র নিক্ষেপে ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য বালু ছিটিয়ে দেয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করে অনেকাংশেই আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল।

অব্যাহত পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিতীর নিক্ষেপে প্রধান ফটকের কাঠে আগুন ধরে পুড়ে গেল কিন্তু প্রধান ফটক ছিল শক্ত লোহার সঁচে তৈরী। কাঠ পুড়ে গেলেও ফটক পেরিয়ে কোন অশ্বারোহীর ভিতরে প্রবেশ সম্ভব ছিল না। কাঠ পুড়ে যে ফাঁক-ফোকর হয়েছে তাতে পদাতিক সৈন্যরা ফটকের ফাঁক দিয়ে ভিতরে যাওয়া সম্ভব মনে হলো। আইয়ূবী পদাতিক বাহিনীর একটি ইউনিটকে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। দ্রুতগতিতে একদল পদাতিক সৈন্য প্রধান ফটকের ফাঁক দিয়ে দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করল বটে কিন্তু প্রবেশ করা মাত্র ইজাজ সৈন্যরা তাদের কচুকাটা করে মাটিতে লুটিয়ে দিল। পিছনের পদাতিক সৈন্যরা তাদের লাশের উপর দিয়েই এগুতে থাকল। দীর্ঘক্ষণের হুড়োহুড়িতে প্রধান ফটকের লোহার ফ্রেম ভেঙে অশ্বারোহী প্রবেশের মত ফাঁক তৈরী হয়ে গেল। সুলতান এবার অশ্বারোহী ইউনিটকে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। অশ্বারোহী ইউনিট ফটকের ফাঁক গলে ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করল কিন্তু গেট দিয়ে এক সাথে দ্রুতগতিতে একাধিক অশ্বারোহী প্রবেশের সুযোগ ছিল না। ইজাজ বাহিনী অশ্বারোহীদেরও ধরাশায়ী করতে শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যে সুলতানের কয়েকশত সৈন্য শাহাদত বরণ করল। ইজাজ দুর্গের সৈন্য এতটাই প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, সুলতানের বাহিনীর পক্ষে দুর্গের ভিতরে নিয়ন্ত্রণ কজা করা দুরূহ হয়ে পড়ল। সুলতান নির্দেশ দিলেন সৈন্যদের বল, ভিতরে গিয়ে যে যেভাবে পারে ছড়িয়ে পড়বে এবং অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করবে। ততক্ষণে প্রধান ফটক অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। অশ্বারোহীর ধাক্কা আর আঘাতে ফটকের লোহা দুমড়ে মুচড়ে ফাঁক হয়ে গেছে। কয়েকশত অশ্বারোহী দ্রুতবেগে দুর্গাভ্যন্তরে ঢুকে বেপরোয়া অগ্নিসংযোগ ও মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হল। ইজাজ বাহিনী সিংহের মতো অটল অবিচল থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে গেল কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হলো না। ততক্ষণে সুলতানের ঝটিকা বাহিনী দুর্গের সব স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ ইজাজ সৈন্যই আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে গেল। সামান্য কিছু শত্রুসেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হল আর বাকী হয় নিহত নয়তো বন্দী হলো।

ইজাজ দুর্গ থেকে আলেপ্পো ছিল মাত্র তিন মাইল দূরে। রাতের আগেই আলেপ্পোয় এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল যে, আইয়ূবী ইজাজ দুর্গ অবরোধ করেছেন। রাতের বেলায় ইজাজ দুর্গ থেকে ধোঁয়া ও আগুনের লেলিহান শিখা আলেপ্পো থেকেও যখন গোচরীভূত হল তখন আলেপ্পোতে অবস্থানকারী গোমশতগীন, সাইফুদ্দীন ও মালিক আস-সালেহ-এর মধ্যে এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিল যে, পিছন দিক থেকে আইয়ূবীর বাহিনীর উপর আক্রমণ করা হবে কি-না। কিন্তু সেনাপতিরা একবাক্যে সবাই জানালো, সেনাদের মধ্যে লড়াই করার হিম্মত নেই। বাধ্য হয়েই আইয়ূবীর বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান স্থগিত করতে হল।

সাইফুদ্দীন ও গোমশতগীনের মধ্যে ইজাজ দুর্গ ও আলেপ্পোর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে মত বিরোধও দেখা দিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে গোমশতগীন সাইফুদ্দীনকে হত্যার হুমকি দিলে সে ঐক্য ভেঙে তার অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে আলেপ্পো থেকে বেরিয়ে গেল। মালিক আস সালেহর বয়স তখন পনের। আইয়ূবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় রাজনীতি সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারণা ছিল না কিন্তু এ দুই বছরে সাইফুদ্দীন, গোমশতগীন ও খৃস্টানদের তৎপরতা দেখে সে অনেকটা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে, সাইফুদ্দীন, গোমশতগীন ও খৃস্টানরা তাকে ব্যবহার করে নুরুদ্দীন জঙ্গীর রেখে যাওয়া সালতানাতকে ধ্বংসের জন্য আইয়ূবীর বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে। তাকে বিশেষ কোন সুবিধা দেয়ার জন্যে নয়।

গোমশতগীনের কার্যক্রম ও তৎপরতায় মালিক বুঝতে পারল যে গোমশতগীন আগাগোড়া একজন ধূর্ত মতলববাজ। সাথে সাথে সে গোমশতগীনকে বন্দী করে জেলখানায় অন্তরীণ করে ফেলল। মালিকের কাছে এই সংবাদও পৌঁছায় যে, গোমশতগীন মালিক আস সালেহকেও হত্যা করানোর ষড়যন্ত্র করে ছিল; তাই বন্দী করার তিনদিনের মাথায় মালিক গোমশতগীনকে জেলখানার ভিতরেই হত্যা করার নির্দেশ দিল।

আইয়ূবী ইজাজ দুর্গের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে রাতেই আলেপ্পো অবরোধ করলেন। আলেপ্পো ছিল ইজাজ থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। ইজাজ দুর্গের আগুন দেখেই আলেপ্পোর বাসিন্দা ও সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আলেপ্পোর সৈন্যরা এতটাই হীনবল হয়ে পড়ে যে আইয়ূবীর মোকাবেলা করার কথা ভাবতেও তাদের গায়ে কাঁটা দেয়। অপরদিকে কিছুদিন আগেও সুলতান আইয়ূবী আলেপ্পো অবরোধ করেছিলেন, কিন্তু আলেপ্পোর অধিবাসীরা সুলতানের বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, সুলতান অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আলেপ্পোবাসীর সেই সাহসিকতা এখন আর নেই। সবাই

ভীত সন্ত্রস্ত। যেন আলেপ্পা শহর একটি মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে।

* * *

অবরোধের দ্বিতীয় দিন মালিক আস সালেহ-এর পক্ষ থেকে সুলতানের কাছে এক দূত এল। দূত কোন শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আসেনি, এসেছে এমন এক মানবিক ও আবেগপূর্ণ পয়গাম নিয়ে যে পয়গাম সুলতানকে আবেগাপ্লুত করে ফেলল। পয়গামে লিখা ছিল, মরহুম নূরুদ্দীন জঙ্গীর কন্যা সুলতান আইয়ূবীর সাথে দেখা করার অনুমতি চায়।

নূরুদ্দীন জঙ্গীর এই কন্যার নাম ছিল শামছুন্নিসা। মালিক আস সালেহ-এর ছোট এই কিশোরীর বয়স তখন দশ/এগার বছর। মালিক যখন দামেস্ক ত্যাগ করে আইয়ূবী বিরোধী শিবিরে যোগ দেয় তখন তার মা মালিকের ভূমিকার বিরোধিতা করেন কিন্তু এই আপন ছোট বোনটিকে মালিক সাথে করে আলেপ্পোয় নিয়ে আসে। অপরদিকে নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী মালিকের মাতা রাজিয়া খাতুন আইয়ূবীর পক্ষাবলম্বন করে দামেস্ক ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।

সুলতান জঙ্গী তনয়াকে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর দুই সেনাকর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে জঙ্গী তনয়া শামসুন্নিসা সুলতান আইয়ূবীর তাঁবুতে হাজির হল। আইয়ূবী জঙ্গী তনয়াকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শামসুন্নিসা আইয়ূবীর উষ্ণতায় খুব কাঁদল, আইয়ূবীও খুব কাঁদলেন। শামসুন্নিসার হাতে ছিল মালিকের লিখা পয়গাম। পয়গামে মালিক পরাজয় স্বীকার করে আইয়ূবীকে সুলতান স্বীকৃতি দিয়ে তার আনুগত্যের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। সেই পয়গামে একথাও লেখা ছিল যে, হিরনের সাবেক গভর্নর গোমশতগীনকে এখানে হত্যা করা হয়েছে, অতএব এখন হিরনও সুলতানের কজায় ধরে নেয়া যায়।

তোমরা এই মেয়েটিকে কেন নিয়ে এলে? সেনাকর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলেন সুলতান। তোমরা কি এই পয়গাম নিয়ে আসতে পারতে না?

সেনাকর্মকর্তারা এ কথার জবাব না দিয়ে তারা জঙ্গী তনয়ার দিকে তাকাল। নূরুদ্দীন তনয়া শামসুন্নিসা সুলতানের উদ্দেশে বলল, মামুজান! আমাকে এরা নিয়ে আসেনি, আমার ভাই আমাকে আপনার এখানে পাঠিয়েছে। আমরা চাই, আপনি আমাদেরকে আলেপ্পোয় থাকার অনুমতি দেবেন এবং ইজাজ দুর্গও আমাদের কজায় দিয়ে দিবেন। আগামীতে কোনদিন আমরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।

সুলতান আইয়ূবী সেনাকর্মকর্তাদের দিকে ক্ষুব্ধ ও তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এই শর্ত আদায়ের জন্যে তোমরা মরহুম সুলতানের এই ছোট মেয়েটিকে নিয়ে এসেছো?

ঠিক আছে মা! ইজাজ দুর্গ ও আলেপ্পোর অধিকার তোমাদের হাতে আমি ছেড়ে দিলাম। সুলতান ইজাজ দুর্গ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।

সেনাকর্মকর্তাদের প্রতি ভর্ৎসনা করে সুলতান বললেন, নিরপরাধ মেয়েকে আমি ইজাজ দুর্গ ও আলেপ্পোর অধিকার দিচ্ছি, তোমাদের মত কাপুরুষ, ভীতু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীরা এই দুর্গও অধিকার পাওয়ার উপযুক্ত নও।

১১৭৬ সালের ২৪ জুন সুলতান আইয়ূবী ও শামসুন্নাহারের মধ্যে এই চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হল। আইয়ূবী ইজাজ দুর্গ ও আলেপ্পোকে সালতানাতে ইসলামিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন এবং মালিক আস সালেহকে আলেপ্পোর স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দিয়ে দিলেন। এর কিছুদিন পর সাইফুদ্দীনও সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিল। যার ফলে দৃশ্যত গৃহযুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেকে মুক্তি পেলেন আইয়ূবী। কিন্তু পর্দার অন্তরালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও গোয়েন্দাদের শত্রুতা অব্যাহত থাকল। নতুন করে ওরা শুরু করল আইয়ূবী বিরোধী ষড়যন্ত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *