২. জিন জযবা ও যোদ্ধা

জিন জযবা ও যোদ্ধা

তুর্কমান রণাঙ্গনের উত্তাপ থেমে গেল। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কমান্ডার ও সহযোদ্ধারা মালিক আস্-সালেহ্, সাইফুদ্দীন ও গোমশতগীনের যৌথ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। বিজয়ী সৈন্যদের সামনে এখন পরাজিতদের মৃতদেহ, আর আহতদের তড়ানোর করুণ দৃশ্য। ক্ষেপা ঘোড়া, উট ও গাধাগুলো নিজেদের বাঁধনমুক্ত করতে আহত সৈন্যদেরকেই পায়ে পায়ে পিষতে শুরু করেছে। যে সব শত্রুসেনা পালাতে সক্ষম হয়নি তারা হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে এক জায়গায় জড়ো হতে শুরু করেছে। বিপুল পরিমাণ ঘোড়া, উট, তীরে ভরা তীরদান, ঢাল, তলোয়ার, বর্ম, সড়কী, তাঁবু, আহার ও সোনাদানার মতো দামী জিনিসপত্র বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোটা এলাকায়।

সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী শত্রুপক্ষের মহানায়ক সাইফুদ্দীনের বিশেষ তাঁবুতে দণ্ডায়মান। নিজ দলের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় ও আইয়ূবীর বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠার লক্ষণ দেখে সাইফুদ্দীন সৈন্য সামন্ত ময়দানে রেখেই জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল। তার সাথে গেল তার কজন বিশেষ প্রশিক্ষিত নর্তকী, বিউটিশিয়ান। সাথে নিল প্রচুর নগদ মুদ্রা, সোনাদানা। যেসব সোনা দানা ও মুদ্রা সৈন্যদের বেতনভাতা হিসেবে তার কাছে ছিল রাষ্ট্রীয় আমানত।

সাইফুদ্দীনের তাঁবুটি খুব দামী শামিয়ানা এবং জড়িদার কাপড়ে তৈরী। চারদিকে কারুকার্যময় রঙ-বেরঙের নকশা। জায়গায় জায়গায় চুমকী ও মোতির দানাদার কাজ। আর তাঁবুতে ছিল বিলাসী রাজন্যবর্গের আরাম-আয়েশের সব আসবাব আয়োজন।

বিলাসী রাজা-বাদশারা যেমন আরাম আয়েশ ও মদ-নারীর আয়োজন ছাড়া এক দণ্ড টিকতে পারে না। সাইফুদ্দীনের ঘর থেকেও অনুরূপ বাহারী রঙ-বেরঙের মদভর্তি মশক বের হলো, পাওয়া গেল নানা বর্ণের ও নানা ধরনের বর্ণিল পানপাত্র।

সুলতান আইয়ূবী মনোমুগ্ধকর তাঁবু দেখছিলেন। তাঁর দৃষ্টি পালংকের উপর পড়তেই চমকে গেলেন, সাইফুদ্দীনের তরবারী পালংকের উপরে পড়ে রয়েছে! সাইফুদ্দীন এমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেল যে তরবারীটি পর্যন্ত নেয়ার অবকাশ পেল না।

আইয়ূবী তরবারীটি উঠিয়ে খাপমুক্ত করলেন। ঝিলমিলে তরবারীটি সূর্যের আলোতে চমকাতে লাগল। আইয়ূবী তরবারীটি পরখ করে দেখলেন। পাশে দাঁড়ানো সেনাপতিদের ইঙ্গিত করে বললেন, মুজাহিদের তরবারীতে যখন মদ ও নারীর ছায়া পড়ে, তখন তরবারী পরিত্যক্ত লোহায় পরিণত হয়। যে তরবারী ফিলিস্তিন বিজয়ের জন্যে কোষমুক্ত হওয়ার কথা ছিল, খ্রীস্টানরা সেটাকে মদ-নারী ও পাপে চুবিয়ে বেকার বানিয়ে ফেলেছে। যে তরবারীতে একবার শরাবের ছোঁয়া লাগে সেই তরবারী শত্রু নিধনে অক্ষম হয়ে পড়ে।

সাইফুদ্দীনের রাজকীয় তাবুর পাশেই আরেকটি বিশাল সুদৃশ্য তাঁবুতে দেখা গেল কিছুসংখ্যক রূপসী যুবতী তরুণী অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। ওরা নিজেদের পরিণতি নিয়ে শংকিত। সাধারণত বিজয়ী সৈন্যরা বিজিতদের নারীদের সাথে যে ব্যবহার করে তা এসব তরুণী জানতো বলেই তাদের এতো ভয়। বিশেষ করে এসব অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণীদের দেখে বিজয়ী যোদ্ধার পক্ষে পাশবিকতার লাগাম টেনে ধরা বড়ই কঠিন। কিন্তু এসব অসহায় বিপন্ন তরুণীদের বিবর্ণ ভবিষ্যতের কালোমেঘের পরিবর্তে যখন সুলতানের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো, তোমরা সবাই মুক্ত আযাদ। তোমরা যে যেখানে। যেতে চাও, বলো। তোমাদেরকে সসম্ভ্রমে, সযত্নে পূর্ণ নিরাপত্তাসহকারে ঠিকানা মতো পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

ঘোষণা শুনে এসব তরুণীদের চোখ ছানাভরা। এই অপ্রত্যাশিত সংবাদে আরো বেশী ভড়কে গেল তরুণীরা। আইয়ূবী তরুণীদেরকে সরাসরি নিজের নিরাপত্তায় নিয়ে নিলেন। তাদের কাছে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের সংখ্যা কতো?

তারা বললো, মাত্র দুজন ছাড়া আর বাকী সবাই এখানেই রয়েছে। যে দুজন নিখোঁজ ওরা ছিল খ্রীস্টান এবং সাইফুদ্দীনের একান্ত সেবিকা। সাইফুদ্দীনের সাথেই ওরা চলে গেছে হয়তো। যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে আসা কখনও বরদাশত করতেন আইয়ূবী।

সাধারণত সেই যুগে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিজয়ী সৈন্যরা পরাজিতদের ফেলে যাওয়া রসদ ও সামগ্রী কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। সৈন্যদের একটা লক্ষ্য থাকতো পরাজিত বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঘরবাড়ি ও তাঁবুগুলো কজা করা। কারণ ওগুলোতে সোনাদানা, টাকা-পয়সা আরাম-আয়েশের বিচিত্র জিনিস পত্রের সমাহার থাকে এবং বেশী প্রাপ্তির আশা থাকে। বস্তুত পরাজিত হওয়ার পর সাধারণত পরাজিত বাহিনীর কর্মকর্তাদের বাসস্থানগুলোতে বিজয়ী সৈনিকদের তাণ্ডব চলে। নারী তরুণীদের জীবন হয় বিজয়ীদের ভোগের সামগ্রী। দামী আসবাব ও তৈজসপত্র নিয়ে চলে দখলে নেয়ার প্রতিযোগিতা। মোদ্দাকথা, পরাজিতের জীবনে পরাজয় বয়ে আনে ভয়ংকর কেয়ামত।

কিন্তু সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিজয়ী বাহিনী এর ব্যতিক্রম। তাঁর কঠোর নির্দেশ– যতো বড় অফিসারই হোক না কেন শত্রু বাহিনীর কোন মালে গনীমতের দিকে হাত বাড়ালে তাকে ক্ষমা করা হবে না। মালে গনীমত জড়ো করা এবং সেগুলোর পরিমাণ নির্ণয় করার জন্যে সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেডকে নির্দেশ দেয়া হতো। শুধু তারাই মালে গনীমত কুঁড়ানোর কাজ করবে। সকল আসবাব ও প্রাপ্ত সম্পদ জড়ো হওয়ার পর সুলতান আইয়ূবী নিজের হাতে মালে গনীমত সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। তুর্কমানের সেই ভয়াবহ যুদ্ধ অবসানের পর আইয়ূবী মালে গনীমত কুঁড়ানোর নির্দেশ কোন ব্রিগেডকে দেননি। তিনি স্বদলীয় ও শত্রুবাহিনীর আহত সৈনিকদের তাঁবুতে তুলে আনা, তাদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজের ব্যবস্থা ও মৃতদের দাফন-কাফনের জন্যে সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন। হুকুম দিলেন আহত কয়েদী ও সুস্থ কয়েদীদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখতে, যাতে কারো অযাচিত কষ্টের মুখোমুখি হতে না হয়।

রণাঙ্গনে আইয়ূবীর রীতি-নীতি ও কৌশল ছিল খুব কঠোর ও অলঙ্ঘনীয়। চূড়ান্ত লড়াইয়ে যৌথবাহিনী অকল্পনীয় আক্রমণে দিকভ্রান্ত হয়ে পালাতে শুরু করে। সুলতান আইয়ূবীর বিশেষ বাহিনী ওদের পশ্চাদ্বাবন করে। সুলতানের ওইসব পশ্চাদ্বাবনকারী বাহিনী শত্রু সেনাদের তাড়িয়ে নেয়ার সময় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং একটা নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হতো। সুলতান পশ্চাদ্বাবনকারীদের ফিরে আসতে নির্দেশ দিলেন এবং ডানে বামের দুই বাহুতে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সেনাদের পূর্বেকার মতো সতর্ক প্রহরা অব্যাহত রাখতে বললেন।

আক্রমণে সুলতান ব্যবহার করেছিলেন ঝটিকা বাহিনী, তীরন্দাজ ইউনিট ও মিনজানিক পরিচালনাকারীদের। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বাহুতে অবস্থানকারী সৈন্যদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ফিরিয়ে আনেননি। হামলা শেষ হওয়ার পর পরই তিনি তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী রিজার্ভ বাহিনীর কমান্ড পুনরায় নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিলেন। শত্রুদের আসবাব, সওয়ার, গাড়ি ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র কি করা হবে? মাননীয় সুলতান! জানতে চাইল এক সেনাপতি। লড়াইয়ে আমাদের বিজয় হয়েছে।

এখনও আমি বিজয়ের আনন্দে বিভোর হতে পারছি না। যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আমার শিক্ষা তোমাদের এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে না। বললেন সুলতান। আমরা শত্রুদের কেন্দ্রীয় কমান্ড তছনছ করে দিয়েছি বটে কিন্তু আমাদের কোন ইউনিট কি তাদের দুবাহুর কোনটিতে আক্রমণ করেছিল? মনে হয় না। তাহলে বুঝতে হবে ওদের দুই বাহু না হোক অন্তত একটি বাহু অক্ষতই রয়ে গেছে। ওদের সেনাপতি ঈমান বিক্রেতা হতে পারে কিন্তু ওদের আনাড়ি ভাবা ঠিক হবে না। তাদের যে সেনা ইউনিট সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে তারা জবাবী আক্রমণ না করে ক্ষান্ত হবে না। এ-ও ত হতে পারে যে, তাদের রিজার্ভ ফোর্সও সম্পূর্ণ বহাল তবিয়তে রয়েছে।

ওদের কেন্দ্রীয় কমান্ড নিঃশেষ হয়ে গেছে সুলতান! তাদের সেনাদের কমান্ড দেয়ার মতো কেউ নেই। বলল এক সেনাপতি।

খ্রীস্টান বাহিনীর প্রতিআক্রমণের আশঙ্কাও করছি আমি। এ অঞ্চল খুবই জটিল। অসংখ্য টিলাপাহাড়ে ভর্তি। হতে পারে খ্রীস্টান বাহিনী কোন টিলার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সুযোগের প্রত্যাশায়। শত্রুবাহিনী আর সাপের উপর কখনও নির্ভর করা ঠিক নয়। মরতে মরতে সাপ যেমন ছোবল মারতে পারে শত্রুবাহিনীও চরম দুরবস্থার মধ্যেও প্রতিআক্রমণ করে বসতে পারে। তাছাড়া সাইফুদ্দীনের কমান্ডার মোজাফফর উদ্দীনের কোন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তোমরা সবাই জানো, মোজাফফর উদ্দীন এতো সহজে পালিয়ে যাওয়ার পাত্র নয়। আমি তার অপেক্ষা করছি। তোমরা সবাই সতর্ক থেকো। সৈন্যদের একত্রিত করো। মোজাফফর। উদ্দীন যদি আমার সবক ভুলে গিয়ে না থাকে তবে দেখবে সে অবশ্যই জবাবী হামলা করবে।

সুলতানের আশংকা ছিল যথার্থ। মোজাফফর উদ্দীন সুলতান আইয়ূবীর সেনাবাহিনীতে উঁচু পদের অফিসার ছিল এবং কেন্দ্রীয় কমান্ড দীর্ঘদিন খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। এক পর্যায়ে স্বার্থের মোহে পড়ে সাইফুদ্দীনের জালে পা দিয়ে সুলতানের শত্রুবাহিনীতে যোগ দেয়। মোজাফফর উদ্দীন ভালোভাবে জানে আইয়ূবী কোন দিকগুলোর প্রতি বেশী গুরুত্ব দিয়ে রণাঙ্গনের পরিকল্পনা তৈরী করেন এবং যুদ্ধ চলাকানীর সময়ে কতো নাটকীয় ও নিপুণভাবে রদবদল করেন। মোজাফফর উদ্দীন ব্যক্তি হিসেবে যেমন সাহসী তেমনি মেধাবী। দীর্ঘদিন সুলতান আইয়ূবীর সান্নিধ্যে থেকে মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের দ্বারা যোদ্ধা হিসেবে তার বিশেষ একটা অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে গোটা মুসলিম বাহিনীতে। মোজাফফর উদ্দীনের মেধা প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা এবং বীরত্ব তাকে রণাঙ্গন থেকে পালানো থেকে বিরত রাখে। গভর্নর সাইফুদ্দীনের চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে শাসন ক্ষমতা ও মসনদের প্রতিও কিছুটা আসক্তি জন্মে মোজাফফর উদ্দীনের মনে। সুলতান মিশর থেকে বাগদাদ পদার্পণ করলে বাগদাদের অধিকাংশ। ক্ষমতাশীন ব্যক্তি ও শীর্ষ আমলাশ্রেণী সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে ঠিক এ সময়ে মোজাফফর উদ্দীনও সুলতানের পক্ষ ত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে শামিল হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়।

মোজাফফর উদ্দীনকে যুদ্ধ বিদ্যায় ও আক্রমণ প্রতিআক্রমণ শামলানোর পারঙ্গমতায় যথেষ্ট সমীহ করেন আইয়ূবী। আইয়ূবীর বিরুদ্ধে কুরানে হুমাতের যুদ্ধে মোজাফফর উদ্দীন যে চাল চেলেছিল সুলতান উভয় বাহুর কমান্ড নিজ হাতে নিয়ে তাকে শামাল দিতে হয়েছিল। তারপরও বহু মূল্য দিতে হয়েছিল সুলতানের।

এবারো অনেক শত্রুসেনাকে মোজাফফর উদ্দীনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন সুলতান। তারা সবাই মোজাফফর উদ্দীনকে দেখেছে বললেও ঠিক কোন ইউনিটে রয়েছে সে সম্পর্কে কেউ বলতে পারেনি। এ থেকে সুলতানের ধারণা আরো দৃঢ় হয়েছে যে, মোজাফফর উদ্দীন হামলা না করে মোটেও ফিরে যাওয়ার লোক নয়।

সুলতান যখন তার বাহিনীকে প্রতিআক্রমণের জন্যে তৈরী থাকতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে আইয়ূবীর শিবির থেকে দুই/তিন মাইল দূরে মোজাফফর উদ্দীন সহযোদ্ধাদের বলছিল, আমি লড়াই না করে যাবো না।

ঠিক সে সময় সাইফুদ্দীনের এক গোয়েন্দা এসে মোজাফফর উদ্দীনকে সাইফুদ্দীনের বার্তা জানাল, অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, আমাদের অভিযান সম্পর্কে আগাম খবর পেয়েছিল আইয়ূবী। এজন্য আমরা আত্মপ্রতারিত হয়ে হেরেছি। তোমাকেও সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফিরে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করা উচিত। কাউকে কিছু না জানিয়ে আমিও অজানা উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছি।

আমরা আপনার সব নির্দেশ মাথা পেতে নেবো। তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয়, যখন আমাদের অধিকাংশ সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছে এবং মাত্র এক-চতুর্থাংশ সৈন্য আমাদের বেঁচে আছে, এমতাবস্থায় আমাদের পক্ষে প্রতি আক্রমণ করা ঠিক হবে না। বলল এক কমান্ডার।

যে পরিমাণ যোদ্ধা আমার কাছে রয়েছে, আমার কাছে এ সংখ্যাই যুদ্ধের জন্যে যথার্থ। কেননা আইয়ূবী এর চেয়েও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেও বিজয়ী হয়ে থাকে। এবার আমি তাকে ডানবাহু দিয়ে আক্রমণ করবো। বিগত কুরানে হুমাতের চাল এবার তাকে আমি চালতে দেব না। বলল মোজাফফর উদ্দীন। তোমরা মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হও।

আলী মাকাম! মৌসুলের গভর্নর তিনবাহিনীর বিশাল সমর আয়োজন ও শক্তি নিয়েও পরাজিত হয়েছেন। এতো অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আপনার প্রতিআক্রমণ করা হবে আত্মহত্যার নামান্তর। আমি আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্যে অনুরোধ করছি। বলল ডিপুটি সেনাপতি।

যে অধিনায়ক যুদ্ধ ময়দানে শরাবের মশক আর হেরেমের নর্তকী নিয়ে আসে ওদের নের্তৃত্বে তিন কেন দশটি সেনাবাহিনী থাকলেও সাইফুদ্দীনের মতোই পরিণতি বরণ করতে হবে। বলল মোজাফফর উদ্দীন।

শরাব আমিও পান করি বটে কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে একটু পানিও যদি না মিলে আমার পরোয়া নেই। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আমাকে বেঈমান, গাদ্দার বলে থাকে, কিন্তু মুসলমান বলে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত হবো না। কেননা, এযুদ্ধ হবে দুই সেনাপতির, দুই কৌশলী সমর নায়কের মোকাবেলা…..।

তোমরা সবাই নিজ নিজ ইউনিটকে তৈরী রাখো, কেননা, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর গোয়েন্দারা মাটির নীচের খবরও বলতে পারে। আজ রাতের অভিযানকে আরো সতর্কতার সাথে পরিচালনা করো। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত প্রহরী ছড়িয়ে দাও। কোন সন্দেহভাজন ব্যক্তি দেখা মাত্রই যেন ধরে নিয়ে আসে। কমান্ডারদের বলল সেনাপতি মোজাফফর উদ্দীন।

শিবির স্থাপনের জন্যে মোজাফফর উদ্দীন এমন একটি জায়গা নির্বাচন করল যেখানে অনায়াসে সৈন্যরা তাবু খাঁটিয়ে থাকতে পারে। দূর থেকে কারো চোখে পড়ার অবকাশ নেই। মোজাফফর উদ্দীন হামলার জন্যে কোন সময় ঠিক করেনি–কমান্ডারদের সে বলল–সুলতান আইয়ূবী শিয়ালের মতো ধূর্ত আর খরগোশের মতো ক্ষীপ্রগতির মানুষ। আমার গোয়েন্দারা খবর দিয়েছে, সে এখনও মালেগনীমত কুড়ায়নি এবং তার দুই প্রান্তের সৈন্যদেরকেও ফিরিয়ে নেয়নি। এর মানে হলো, সে এখনই যুদ্ধ শেষ করতে চাচ্ছে না, সে আশংকা। করছে আমি প্রতিআক্রমণ করব। কিন্তু এবার তাকে আমি অন্য চালে কুপোকাত করবো। সে দুদিনের বেশী প্রতিআক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করবে না। আমি দুদিনের মধ্যে আক্রমণ করবো না। তার সৈন্যরা যখন মালে গনীমত কুঁড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, সেই সুযোগে আক্রমণ করবো আমি। কারণ, আমি তার যুদ্ধ কৌশল জানি, বুঝি কোন ক্ষেত্রে সে কি সিদ্ধান্ত নেবে। আমি আক্রমণ বিলম্বিত করে তাকে এ ধারণা দেব যে, আমরা পালিয়ে গেছি, তার আর প্রতিআক্রমণের আশংকা নেই। দেখো, এবারের মোকাবেলা হবে দুই বাহাদুরের বুদ্ধি ও কৌশলের লড়াই। বাস্তবে মোজাফফর উদ্দীনের এ আক্রমণের আশংকাই করছিলেন আইয়ূবী।

* * *

অকল্পনীয়ভাবে সাইফুদ্দীনের বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে সুলতানের সৈন্যরা। সাইফুদ্দীন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি এমন ঝড়ের মধ্যে আইয়ূবীর বাহিনী তার বিশাল বাহিনীর উপর চতুর্দিক থেকে হামলে পড়বে।

সুলতান ফৌজীর সংবাদ পেয়ে ঝড়ের তাণ্ডব কমার সাথে সাথেই তীরন্দাজ বাহিনীকে সাইফুদ্দীনের বাহিনীর দুই প্রান্ত থেকে আরো নিরাপদ দূরত্ব ঘুরে পিছনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন, সেই সাথে ঝটিকা বাহিনীর বিশেষ কমান্ডোদেরও পাঠিয়ে দেন শত্রুসেনাদের রসদপত্রের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে।

চারজন করে একটি টিমে মোট তিনটি টিমের সমন্বয়ে বারোজনের একটি ইউনিট বিশেষ কমান্ডো বাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠন করা হতো। এসব যোদ্ধা শক্তি সাহস ও বাহাদুরীতে থাকতো অনন্য এবং বুদ্ধি ও কৌশলেও হতে প্রতিপক্ষের জন্যে যমদূত। এমনই একটি ইউনিট পলায়নপর শত্রুসৈন্যদের পশ্চাদ্বাবন করতে করতে বহুদূর পর্যন্ত চলে গিয়ে অসামান্য সাফল্য লাভ করে কিন্তু বারোজনের গোটা ইউনিটে মাত্র তিনজন বেঁচে থাকল; আন্-নাসের এই ইউনিটের কমান্ডার।

তুর্কমান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নপর শত্রু সেনাদের তাড়া করতে করতে মূল দল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল কমান্ডার আন্-নাসের-এর কমান্ডো ইউনিট। তার সহযোদ্ধাদের সবাই অশ্বারোহী, আগুনে তীর ও আধুনিক বর্শা ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সরঞ্জামে সজ্জিত।

আন্-নাসেরের জন্যে সুবিধা এই ছিল যে, তুর্কমান এলাকাটি ঘন বনজঙ্গল আর টিলা ঝোঁপ ঝাড়ের কারণে সহজেই তারা শত্রু বাহিনীর অনতিদূরে লুকিয়ে থাকতে পারতো এবং সুবিধা মতো রাতের আঁধারে শত্রুদের খাদ্য সামগ্রী বোঝাই গাড়ি ও অস্ত্রশস্ত্রবাহী গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দুশমনদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হতো।

এভাবে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্বাবন ও রাতের আঁধারে গেরিলা আক্রমণ করে করে মূল শিবির থেকে বহু দূরে অচেনা জায়গায় চলে আসে তারা। দিনের বেলায় একদিন আন্-নাসের তার সেনা ইউনিট নিয়ে একটি টিলার নীচে তাঁবু খাঁটিয়ে আরাম করছিল, এমন সময় সে দেখতে পেল টিলার আড়াল থেকে শত্রু সেনারা তাদের অবস্থান দেখে ফেলেছে। কমান্ডোদের কজন টিলার উপরে তীর সজ্জিত ছিল, তাই শত্রুসেনারা আক্রমণে সাহস করেনি।

সন্ধ্যা নামতেই আন্-নাসের শত্রু বাহিনীর রসদপত্রের অবস্থান ও শিবিরটি পরখ করে দেখে নিল। ঘোড়াগুলোকে আগের স্থানেই বেঁধে রেখে পায়ে হেঁটে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু সে রাতের অপারেশন এতো সহজ ছিল না।

প্রতিপক্ষ গুপ্ত হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে পদাতিক ও অশ্বারোহী প্রহরা নিযুক্ত করে রেখেছিল। কিন্তু সবকিছু প্রত্যক্ষ করে আন্-নাসের সিদ্ধান্ত নিল, যে করেই হোক সে আজ রাতেই শত্রুবাহিনীর রসদপত্র ধ্বংস করে দেবে। সিদ্ধান্ত মতো সাথীদের তৈরী করে এক সুযোগে ঢুকে পড়ল শত্রুবাহিনীর রসদপত্রের ডিপোতে এবং আগুন ধরিয়ে দিল জ্বালানী ছিটিয়ে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। সাথীদের বলল, তোমরা ছড়িয়ে পড়। জ্বলন্ত আগুনের আলোতে কমান্ডোদেরকে শত্রুবাহিনী তীরের নিশানা বানাতে শুরু করল। অভিযানকারীরা নিজেদের রক্ষায় সফল হতে পারল না। একে একে সবাই শত্রু বাহিনীর তীরের আঘাতে শাহাদাত বরণ করল। বেঁচে রইল আন-নাসের ও তার সাথী তিনজন। বহু কষ্টে তারা চারজন জীবন নিয়ে শত্রু বাহিনীর ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলো।

শক্র বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসে আন্-নাসের আসমানের দিকে তাকাল। কিন্তু কোন তারা গোচরীভূত হলো না। ঝটিকা বাহিনীকে তারা দেখে দিক নির্ণয় করার ট্রেনিংও দেয়া হতো। সেদিন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। শত্রু বাহিনীর তাবুর আগুন দূর থেকেও দেখতে পেল নাসের। অন্য সাথীরা বেঁচে আছে না শহীদ হয়েছে মোটেও জানার সুযোগ ছিল না নাসেরের। সে মনে মনে তাদের মঙ্গলের জন্যে দুআ করল এবং সঙ্গীদের নিয়ে যেখানে তাদের ঘোড়া বাঁধা ছিল সেদিকে আন্দাজে রওয়ানা হল।

কিছুক্ষণ চলার পর শক্রশিবির জ্বলার অগ্নিশিখাও আর দেখা গেল না। আকাশে জ্বলন্ত আগুনের যে লালিমা দেখা যেতো কিছুক্ষণ পর তাও মিলিয়ে গেল। পথ হারিয়ে ফেলল নাসের। আন্দাজের উপর চলতে শুরু করল।

অনেকক্ষণ চলার পর মাটির ধরনের পরিবর্তন মনে হলো। পাথুরে শক্ত যমীনের পরিবর্তে বালুকাময় নরম যমীনে দেবে যেতে লাগল পা। যেখানে কোন গাছ-গাছালী তো দূরে থাক কোন ঘাস লতাগুল্মও ছিল না।

বালুকাময় মাটি নাসের ও সাথীদের পাকে নিঃশ্চল করে ফেলল। আহার ও পানি ছিল তাদের অশ্বপৃষ্ঠে বাঁধা। ঘোড়া কোথায় আর নাসের ও সাথীরা কোথায় তা বলা মুশকিল।

নাসেরের প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেল, ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। তার সাথীরা বারবার তৃষ্ণার কথা বলতে লাগল। নাসের সেখানেই বিশ্রাম করার মনস্থ করল কিন্তু সাথীরা। তাকে এই বলে অগ্রসর হতে বলল যে, সামনে হয়তো কোথাও পানি পাওয়া যেতে পারে।

অবশ্য এলাকাটি পানি শূন্য ছিল না, কিন্তু নাসের ও তার সাথীরা সেই অঞ্চলের সে দিকে অগ্রসর হতে থাকল যেদিকে ধুধু মরু ছাড়া পানির নাম-গন্ধও নেই। তারা পানির আশায় আরো কিছুক্ষণ পথচলার পর শ্রান্ত হয়ে সবাই বসে পড়ল।

ক্লান্ত-শ্রান্ত নাসের ও সহযোদ্ধারা কখন ঘুমের জগতে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল সেই অনুমান করার সামর্থ তাদের নেই। রাত পেরিয়ে পূর্বাকাশে সূর্য যখন চারদিকের মরুর বালু তপ্ত করতে শুরু করল তখন চোখ খুলে গেল নাসেরের। চারদিকে ধু ধু বালি আর বালি। সাথীদের দিকে তাকিয়ে দেখল নাসের, তারা তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ঠিক ঘুম নয় যেন কয়টা অসার নিথর মরদেহ।

হতাশায় অবশিষ্ট মনোবলও উবে গেল তার। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল সাথীদের দিকে তাকিয়ে। মরুভূমি নাসেরের কাছে মোটেও অপরিচিত নয়, মরুতেই তার জন্ম। শৈশব থেকে বড় হয়েছে মরুর পরশেই। কত দুর্গম মরু পেরিয়েছে জীবনে, কতবার কঠিন যুদ্ধ করেছে মরুর বুকে। এই মরুভূমি তার চিরচেনা। কিন্তু এখানে এমন আদিগন্ত সীমাহীন মরুতে পথ হারিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি নাসের। মরুর অসীমতার চেয়ে ক্ষুৎপিপাসায় কাতরতা আর সাথীদের চলৎশক্তি রহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নাসেরকে আরো মারাত্মকভাবে দুর্বল করে ফেলল।

দৃষ্টি সীমায় কোন সবুজের চিহ্ন নেই, নেই কোন তরুলতা। বিগত দিনের কথা মনে হতেই পিপাসায় জ্বলতে শুরু করল কণ্ঠনালী। সাথীদের অবস্থা তো আরো করুণ।

সূর্য যেদিকে উঠেছে সেদিকে তাকিয়ে দেখল, সারিসারি পাহাড়। ওদিকে তার পক্ষে পা বাড়ানো নিরাপদ নয়। কারণ ওদিকে রয়েছে শত্রু বাহিনী। সাথীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল নাসের। ওরা চোখ মেলেই নিরাশার অন্ধকার দেখতে পেল। নিকট কোন স্থানে পানির দেখা মিলবে এ আশা ক্ষীণ হয়ে উঠল সবার কাছে।

বন্ধুগণ! আরো দুদিন ক্ষুধ-পিপাসা সহ্য করতে পারব আমরা। এই দুই দিনে আমরা ঠিকানায় পৌঁছাতে না পারলেও পানির সন্ধান ঠিকই পেয়ে যাবো।

তিন সাথী প্রত্যেকেই নিজের মতো করে করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করল। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এরা মরুভূমির এতোটা গভীরে চলে এসেছে যে, এখান থেকে পায়ে হেঁটে সামনের দিকে হেঁটে কুল-কিনারা পাওয়া খুবই মুশকিল। সে সাথে ঘোড়া থাকলে হয়তো কিছুটা সহজ হতো। তাও তো নেই। অবশ্য রাতের দীর্ঘ ঘুমে তাদের শরীর কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে, দেহে এসেছে সামান্য শক্তি।

নাসের বলল, বন্ধুগণ! আল্লাহ্ তাআলা আমাদের যে পরীক্ষার মুখোমুখী করেছেন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং আল্লাহর প্রতি কোন অভিযোগ না করা আমাদের কর্তব্য।

এখানে বসে থেকে সূর্যের তাপে শুকিয়ে মরা অর্থহীন। এর চেয়ে চলো, আল্লাহ্ তাআলা অবশ্যই কোন পথ বের করে দেবেন। বলল এক সাথী।

চলতে শুরু করল তারা। আন্দাজের উপর দিক নির্ণয় করে নিল। একটু ঘোর পথে অগ্রসর হতে হলো তাদের। কেননা, শত্রু বাহিনীর দৃষ্টি সীমা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাও জরুরী। বেলা বাড়তে থাকল আর মরুর বালুকা রাশি তপ্ত হতে শুরু করল। দৃষ্টি সীমা ছোট থেকে ছোট হতে থাকল। মরুর মরীচিকায় মনে হতে থাকল সামনেই অথৈই পানির দরিয়া। যেন পানি থেকে বাষ্প উড়ছে, কিন্তু সবই ছিল মরীচিকা বাস্তব পানি নয়। এরা সবাই মরু চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞাত, তবুও পিপাসার কাতরতা তাদের হতাশ মনে মরীচিকাকেই পানি ভাবতে প্রতারণা দিচ্ছিল। নাসের অফুরন্ত প্রাণশক্তির বিনিময়ে এসব মরীচিৎকার ধোঁকায় না পড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরগতিতে।

এক পর্যায়ে নাসের সাথীদের বলল, বন্ধুগণ! আমরা ডাকাত নই যে, আল্লাহ্ আমাদের মরুভূমিতে ঘুরে ঘুরে প্রাণত্যাগে শাস্তি দিবেন। আমরা আল্লাহর পথের মুজাহিদ। যদি মরুভূমিতে আমাদের মৃত্যু হয় তবে কিসের চিন্তা? এ মরণ হবে শাহাদত। কোন অপমৃত্যু নয়। সবাই আল্লাহকে স্মরণ কর। আল্লাহ অবশ্যই এ বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন।

যদি এমন কোন মুসাফির পেয়ে যাই যে, তার কাছে পানি রয়েছে, তবে তার পানি ছিনিয়ে নিতে আমি মোটেও দ্বিধা করব না। বলল এক সাথী।

সাথীর কথায় সবাই হেসে উঠল। অবশ্য এই কষ্ট হাসিতে তাদের খরচ করতে হল সঞ্চিত প্রাণশক্তি।

তখন একেবারে মাথার উপর সূর্যের আগুনে বয়লার। আর নীচে তপ্ত বালুতে জ্বলছে পা। শরীরের ঘাম নিঃশেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সূর্যতাপ আর পিপাসায় শরীরের পানির অংশও নিঃশেষ প্রায়। সবাই মিলে মৃত্যুর পূর্বের তাহলিয়া পড়ার মতো ক্ষীণস্বরে আল্লাহ্ আল্লাহ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে লাগল। আর অবশিষ্ট সামর্থ ব্যয় করে করে সামনে এগুতে লাগল। মরুর তপ্ত লু-হাওয়া তাদের পদচিহ্ন মুছে দিচ্ছিল। এই বাতাস বাতাস নয় যেন আগুনের বয়লার উদগিরণ করছে গোশত গলানো বাম্প।

পশ্চিম দিকে হেলে পড়ল সূর্য, তখন নাসেরও সাথীদের চলার গতি একেবারেই ক্ষীণ। একেক জনের একেকটি পা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে, প্রতিটি কদম উঠাতে এবং সামনে ফেলতে হচ্ছে শক্তির সবটুকু প্রয়োগ করে। সবার মুখ শুষ্ক তবু ঠোঁটে আল্লাহর যিকির।

পড়ন্ত বেলায় তাদের শরীরের ছায়া বালিয়াড়িতে একেবেঁকে খেলা করতে শুরু করেছে, তখন এক সাথীর ঠোঁট নড়াও বন্ধ। কিছুক্ষণ পর অপর এক সাথীর ঠোঁটের স্পন্দনও নিঃশেষ। নাসের ও তার তৃতীয় সাথী শুধু ক্ষীণ আওয়াজে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর যিকির অব্যাহত রেখেছে। আর কিছুক্ষণ পর তাদেরও আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল।

নিজেদের আখেরী ওয়াক্ত সমাগত হতে দেখে শরীরের অবশিষ্ট শক্তির সবটুকুই দিয়ে নাসের সাথীদের উদ্দেশ্যে বলল, বন্ধুগণ! আমাদের শরীরের রক্ত ও জলীয় পদার্থ নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে কিন্তু ঈমানের বাষ্প নিঃশেষ হবার নয়। ঈমানী শক্তি আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। নাসের সাথীদের দিকে তাকিয়ে দেখল সবার মুখই শুকিয়ে পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, চেহারায় রক্তের লেশমাত্র নেই।

সূর্য ডুবে গেল। রাত বাড়ার সাথে সাথে মরুর বালু ঠাণ্ডা হতে শুরু করল। সাথীদের চলৎশক্তি বারবার থমকে গেলেও নাসের তাদের থামতে দিল না। রাতের ঠাণ্ডায় কিছুটা দ্রুত চলা সম্ভব। নাসের গতি বাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার নিজের গতিইতো রহিত হওয়ার উপক্রম। যদি সে এবং তার সাথীরা আরব যোদ্ধা না হতো এবং সেনা বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের স্পেশাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত না হয়ে সাধারণ মুসাফির হতো অনেক আগেই মরুভূমিতে চলৎশক্তি হারিয়ে মরুর বুকে শুকিয়ে মরতে হতো তাদের। কিন্তু বিশেষ ট্রেনিং এবং প্রতিকূল পরিবেশে অত্যধিক কষ্ট সহিষ্ণু হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার কারণে আল্লাহর রহমতে এখনও সাথীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে তারা।

নাসের আরো কিছুক্ষণ চলার পর নিজেই দাঁড়িয়ে গেল এবং সাথীদের বলল শুইয়ে পড়তে।

* * *

অতি প্রত্যূষে ঘুম থেকে জাগল নাসের। পরিষ্কার আকাশ। তারা দেখে নাসের আন্দাজ করল রাতের আর কতটুকু বাকি। সাথীদেরও জাগাল। সবাইকে নিয়ে সামনে এগুতে শুরু করল কিন্তু সবার অবস্থাই এমন যে কারো মুখ থেকে কোন কথা বেরুল না। তবে তাদের গতি ছিল গত রাতের চেয়ে কিছুটা তীব্র।

এই মরু প্রান্তর খুব বেশী দীর্ঘ হওয়ার কথা নয়। হয়তো আজ আমরা মরু এলাকা অতিক্রম করতে পারব, আর তা না হলে আশা করি পানি পেয়ে যাবো। বলল নাসের।

যে পানি দিনের আলোতে ছিল মরীচিকা। রাতের অন্ধকারে তা আশার দীপ শিখায় পরিণত হলো। সেই আশার আলোতেই পথ চলতে শুরু করল নাসেরের কাফেলা। ভোর রাতের আঁধার কেটে পূর্বাকাশে যখন সূর্য উঁকি দিল সেই সাথে বিলীন হয়ে গেল তাদের পানি প্রাপ্তির প্রত্যাশা। অবশ্য নতুন এলাকাটি মরু বালিময় ছিল না, এখানকার যমীন শক্ত কিন্তু দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টিতে ফেটে চৌচির। শুধু পাহাড় আর পাহাড়ী টিলা। কোথাও কোন গাছ-গাছালী নেই। মাটি এতো শক্ত যে পায়ের আঘাতে ধূলো বেরিয়ে আসতো। কতো দিন থেকে এ মাটি তৃষ্ণার্থ তার কোন ইয়ত্তা নেই।

আট দশ মাইল দূরে দেখা গেল সারি সারি পাহাড় আর উঁচু টিলার চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছিল মিনার চূড়া। যমীনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যেন শত বছর থেকে এরা তৃষ্ণার্ত, হয়তো এই সৈনিকদের রক্ত পান করে এরা তৃষ্ণা মেটাবে।

সাথীদের চেহারার দিকে তাকিয়ে নাসের বুঝতে পারল তার নিজের অবস্থা কি হয়েছে। তার এক সাথীর জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। খুব ধীরলয়ে নড়ছে ঠোঁট। সার্বিক অবস্থা এতই ভয়ংকর যে পুনর্বার কারো দিকে তাকানোর সাহস হলো না তার। অবস্থা এমনই বেগতিক মনে হলো যে, দৃশ্যত মিনারগুলো পর্যন্ত এদের নিয়ে যাওয়া অসম্ভব মনে হলো নাসেরের কাছে।

নাসের এই ছোট কাফেলার কমান্ডার। নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন নাসের। যদিও তার নিজের অবস্থাও সাথীদের থেকে ভিন্ন নয়। তবুও জীবনের শেষ শক্তি ব্যয় করে সাথীদের উদ্দেশে দুকথা বলার চেষ্টা করল নাসের। কিন্তু সংকল্প সংকল্পতেই রয়ে গেল, চেষ্টা করেও নাসেরের মুখ থেকে আওয়াজ বের হলো না। তখনও বোধশক্তি অন্যদের তুলনায় স্বাভাবিক ছিল তার। বলার শক্তি রহিত হয়ে গিয়েছিল।

সূর্য যতই উপরে উঠতে শুরু করল, মরুর আগুন বাড়তে লাগল। সাথীদের অবস্থা এ পর্যায়ে উপনীত হলো যে, তারা পা আর উঠাতে পারছিল না। পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগুচ্ছিল। যে সিপাহীর জিহ্বা বেরিয়ে এসেছিল তার হাত থেকে বর্শা পড়ে গেল। কোমর থেকে তরবারী খুলে ফেলে দিল সে। সে কি করছিল সেই বোধ ছিল না তার। শরীরকে ভারমুক্ত করতে বোধহীন ভাবেই কাজ করছিল তার দুহাত। সামনে হঠাৎ দ্রুত হাঁটতে লাগল সেই সাথী। মরুর নির্মম যাতনার প্রভাব এমনই যে, পথহারা কোন মুসাফির যখন পথ হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের মতো নিজের অজান্তেই সে ভারমুক্ত হতে শরীর থেকে সব কাপড়-চোপড়, পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাব পত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

মরু মুসাফিররা যখন পথের কোন স্থানে এ ধরনের আসবাব পড়ে থাকতে দেখে তখন তারা ভাবতে থাকে সামনে হয়তো কোন হতভাগার মৃতদেহ দেখতে হবে।

নির্মম মরু নাসেরের এক সাথীকে জীবনের সেই পরিণতিতে পৌঁছে দিল, যে পর্যায়ে পৌঁছালে মানুষ দুনিয়ার আসবাব ও রসদপত্রকে অপ্রয়োজনীয় এবং স্বীয় কর্তব্য ভুলে যায়। নাসের সেই সহযোদ্ধার তরবারী ও বর্শা উঠিয়ে বড় কষ্টে বলল, এতো জলদি হার মেনো না বন্ধু! আল্লাহর পথের সৈনিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে কিন্তু তরবারী ফেলে না। নিজের মর্যাদা ও সম্মানকে বালিতে নিক্ষেপ করো না।

নাসেরের কথায় সাথী তার দিকে তাকিয়ে রইল। নাসেরও অপলকনেত্রে দেখতে লাগল সাথীকে। হঠাৎ সেই সাথী অট্টহাসি শুরু করল এবং গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে বলতে লাগল দেখো–পানি… পানি… বাগান…। এই বলে সামনের দিকে দৌড় মারল। কয়েক কদম এগিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সেই সাথী।

বাস্তবে না সেখানে পানি ছিল, না ছিল মরীচিকা। কারণ সেখানকার যমীনের চরিত্র এমন ছিল যে মরীচিকাও প্রতিফলিত হতো না। কারণ ধু ধু বালির উপরে রোদের কিরণ প্রতিবিম্বিত হয়ে পানিময় যে মরীচিকা দেখা যায় সেই যমীনটি সে ধরনের ছিল না। আসলে নাসেরের সেই সাথীর বোধশক্তি রহিত হয়ে গিয়েছিল তৃষ্ণার যাতনায়। কষ্টে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে প্রত্যাশার কল্পনাই দৃষ্টিভ্রমে পরিণত হয়েছিল বাস্তব কোহেলিকা। কল্পনায় সে পৌঁছে গিয়েছিল সুসজ্জিত ঝর্ণাপাশের মনোরম বাগিচা সদৃশ স্থানে, যেখানে পিপাসার যাতনা নেই, পানির দুর্ভোগ নেই। ধূসর মরুর বুকেরই দৃশ্যমান পাহাড় চূড়াগুলো তার কাছে মনে হচ্ছিল সুসজ্জিত অট্টালিকা, বাতাসের ঢেউ আর ইতস্তত বালিয়াড়ীগুলো তার কাছে মনে হচ্ছিল গমনাগমনরত মুসাফির কাফেলা। মরুর মৃদু বাতাসের উড়ন্ত ধূলোবালিকে মনে হতে লাগল নৃত্যরত গায়িকা।

নির্মম মরু নাসেরের এক সাথীকে পৌঁছে দিয়েছিল বাস্তব রূঢ়তা থেকে কল্পনার আয়েশী জগতে। মরু তার জীবনের আখেরী মুহূর্ত নিয়ে পরিহাসে মেতে উঠল। হয়তো বা এটা নিরস, রুক্ষ মরুর একটা মায়াবী দিক যে, কঠিন যাতনায় কোন মুসাফিরের জীবন হরণের আগে তাকে কল্পনার স্বর্গে প্রতারণার মায়াবীচক্রে নিক্ষেপ করে; যাতে করে যন্ত্রণা থেকে রেহাই পায় হতভাগা মুসাফির।

নাসেরের সাথী নিজ থেকে আবার দৌড় লাগাল। কিন্তু অবসন্ন শরীর তাকে এগুতে দিল না বেশীদূর। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটি পা হেঁচড়ে বহু কষ্টে এগুচ্ছিল, সেই এখন পর পর দুবার পড়ে গিয়ে আবার সামনের দিকে দৌড়াতে লাগল। এটা ছিল নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের জ্বলে উঠার মতো। নাসের এবার দৌড়ে তাকে ধরে ফেলল। তার অন্য সাথীরাও পরিস্থিতির আকস্মিকতায় দৌড়ে ঐ সাথীকে ধরতে চেষ্টা করল। বেসামাল সাথী নাসেরের পাঞ্জা থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে হাত পা ছুঁড়তে লাগল এবং চেঁচিয়ে বলতে লাগল, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, ঐ যে দেখো পানি ভর্তি পুকুর! সেখানে কত সুন্দর সুন্দর হরিণ দল পানি পান করছে। চলো সবাই সেই পুকুরে গিয়ে পানি পান করি।

সাথীরা তাকে দুবাহুতে ধরে রাখল। বেহুশ সাথী পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে সামনে এগুতে শুরু করল। নাসের তার মাথার কাপড় টেনে চেহারা ঢেকে দিল যাতে সে কিছু দেখতে না পারে।

* * *

মাথার ঠিক উপরে দুপুরের সূর্য তখন আগুন ঝরাচ্ছে। শুষ্ক মরুময় মাটি ফেটে তামার মতো আগুনে রূপ ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে আরেক সাথী হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, …ঐ দেখো, কতো সুন্দর বাগান, নর্তকীরা নাচছে। ধিক তোমাদের, পানি…! চলো, নৃত্য দেখি, সুন্দর বাগান দেখি। বন্ধুরা, চলো, ঐ দেখো, সেখানে কতলোক আহার করছে, পানি আছে, অঢেল পানি। আমি ওদের সবাইকে চিনি। কোন অসুবিধা হবে না। চলো!…….। এই বলে সেই সাথীও সামনের দিকে দৌড়াতে লাগল।

যে সাথী কিছুক্ষণ আগে কল্পনায় বেসামাল হয়ে পড়েছিল অনেকক্ষণ ধরে আর কোন কথা বলল না। নিশ্চুপ পথ চলছে। ফলে তাকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিল অন্য সাথীরা। কিন্তু অপর সাথীকে চিৎকার করে দৌড়াতে দেখে ওর পিছনে সেও পুনর্বার দৌড় দিল। আর চিৎকার করে বলতে লাগল, আহ্! ভারী সুন্দর নৃত্য, এই নর্তকীকে আমি চিনি। কায়রোতে আমি ওকে দেখেছিলাম। ও আমাকে চিনে। আমি ওর সাথে নাচবো, গাইবো। শরবত পান করবো….।

নাসেরের মাথা এবার চক্কর মারল। বোধশক্তি তার তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল। দীর্ঘ যাতনা ও কষ্ট তাকে এখন পর্যন্ত বেহাল করতে পারেনি। কিন্তু সাথীদের বেহাল অবস্থা তাকে অসহায় করে তুলল। এদের এই দুরবস্থায় সামলানো তার পক্ষে অসম্ভব। তার নিজের শারীরিক অবস্থাও তো ওদের মতোই…। কিন্তু দুজন সাথীকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করা তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব। মাত্র এক সাথীর বোধশক্তি এখনও ঠিক রয়েছে। কিন্তু শারীরিক দিক থেকে তার অবস্থাও যে শোচনীয়!

যে দুই সাথী কাল্পনিক নৃত্যরত নর্তকী ও বাগানের পিছনে দৌড়াল একটু অগ্রসর হয়ে উভয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নাসের ও তার অপর সাথী এদের উঠিয়ে বসাল এবং কাপড় দিয়ে ওদের চেহারা আড়াল করে দিল। এদের মাথা দুলছে, ঘাড় সোজা করতে পারছে না।

বন্ধুরা! তোমরা আল্লাহ্র পথের সৈনিক। তোমরা প্রথম কেবলা ও খানায়ে কাবার রক্ষী। ইসলামের শত্রুদের কোমর ভেঙে দিয়েছো তোমরা। তোমাদের ভয়ে কম্পমান বেঈমান কাফের শক্তি। আগুন পেরিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার মতো মর্দে মুমিন তোমরা। এই রুক্ষমরু, এই সূর্যতাপ, এই ক্ষুৎপিপাসায় তোমরা এতোটা বেসামাল হয়ে গেলে! তোমরা কি লক্ষ্য করেছো, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। মুমেন পানির শীতলতায় নয় ঈমানের উষ্ণতায় বেঁচে থাকে। ক্ষীণ আওয়াজে সাথীদের উদ্দেশে বলল নাসের।

উভয় সাথী চোখ খুলে নাসেরকে দেখল। নাসের তাদের প্রতি তাকিয়ে শুষ্ক হাসি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল। আবেগের আতিশয্যে নাসের সাথীদের উদ্দেশে বলা কথায় কাজ হলো, উভয় সাথী কল্পনার স্বর্গরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলো এবং উঠে খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগল।

সকাল বেলায় যেসব মিনার তাদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছিল এগুলো এখন কাছে চলে এলো এবং মিনার ও শহরের অট্টালিকার পরিবর্তে উঁচু উঁচু টিলা ও পর্বত হয়ে চোখের ভ্রম দৃষ্টিকে বাস্তবতার নির্মম অবয়বে ভেসে উঠতে লাগল। অবশ্য অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল এখানকার কোথাও না কোথাও পানি পাওয়া যাবে। নাসের সাথীদের বলল, আশা করি আমরা পানির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হয়তো সন্ধ্যার আগেই আমরা পানি পেয়ে যাবো। কিন্তু পাহাড়ী সেই যমীন ও জায়গাটার বাস্তব অবস্থা দেখে পানি প্রাপ্তির আশা ভোরের শিশিরের মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। যেন পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছল তারা। হঠাৎ করে আবার এক সাথী চেঁচিয়ে দৌড়াতে লাগল এই বলে যে, হায়! আমার গ্রামে এসে গেছি, এই তো দেখা যায় বাচ্চারা কূয়া থেকে পানি উঠাচ্ছে। এসো, এসো। তোমাদের জন্যে আমি উমদা খানাপিনার ব্যবস্থা করব।

আকাশের দিকে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে কাতর মিনতি করল নাসের। বলতে লাগল, আয় যুলজালাল! তোমার নামে আমরা যুদ্ধ করতে এবং মরতে এসেছিলাম। আমরাতো চুরি, ডাকাতি করিনি; তোমার নাফরমানিও করিনি। বেঈমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যদি অপরাধ হয় তবে আমাদের তুমি মাফ করে দাও। আমাদের ক্ষমা করে দাও। হে অসহায়দের সাহায্যকারী প্রভু! আমার জীবন নিয়ে নাও, আমার শরীরের অবশিষ্ট রক্তকে পানিতে পরিণত করে হলেও সাথীদের তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করে দাও, তাদের বাঁচিয়ে রাখো। ওরা তো তোমার রাসূলের সম্মানে বেঈমানদের অধিকৃত প্রথম কিবলাকে উদ্ধার করতে জিহাদ করছে, ওরা কোন কসুর করেনি। আমার রক্ত পানি করে ওদের প্রাণ বাঁচাতে পিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা কর প্রভু…! তার সাথীরা উঠে দাঁড়াল এবং দুহাত প্রসারিত করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল যেন তারা কিছু একটা পেয়ে গেছে। নাসের ও তার যে সাথীর এখনও পর্যন্ত মাথা ঠিক ছিল সাথীদের অগ্রসর হতে দেখে সেও পা হেঁচড়ে অগ্রসর হতে লাগল। নাসেরের দুচোখও হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল কিন্তু পরক্ষণেই মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো অন্ধকার কেটে গেল নাসেরের দৃষ্টি থেকে। সে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হলো। নাসের অনুধাবন করল নির্মম মরু সাথীদের মতো তাকেও ধোকা দিতে শুরু করেছে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সবুজ শ্যামলের সমারোহ। অবশ্য বেশী সময় স্থায়ী হলো না দৃষ্টিভ্রম। নাসেরের চোখের সামনে উঁচু টিলা আর পাহাড়ের অবস্থান তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে বাধ্য করল।

* * *

অতি কষ্টে সাথীদের নিয়ে পাহাড়ের নীচুভূমি দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল নাসের। যেন জীবন্ত এক কাফেলা। দুটি সমতল অনুচ্চ টিলার বুক অতিক্রম করছিল তারা। নাসের আগে আগে সাথীরা তার পিছনে। একটু সামনে নাসের দেখতে পেল অনেক পূর্বেকার পানিবাহিত একটি মরা নদীর ছাপ। হয়তো শতবছর আগে এখানে পানি ছিল, পানি প্রবাহের চিহ্ন রুক্ষ মরু এখনও ধরে রেখেছে।

হঠাৎ নাসের মাথা ঝাঁকাল, চোখ দুটি রগলে নিল একটু। নিজের দৃষ্টির উপরে বিশ্বাস করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে পুনরায় চোখ মেলল, কিন্তু পূর্ববৎ সেই দৃশ্যই দেখতে পেল নাসের। সমতল টিলাটি এক জায়গায় গিয়ে কিছুটা নীচে গিয়ে হারিয়ে গেছে, কিন্তু এক পাশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি তাঁবুর মতো বাড়তি টিলার আড়ে অল্প জায়গায় ছায়া পড়েছে, সেই ছায়ার মধ্যে দুটি ঘোড়া দাঁড়ানো। ঘোড়া দুটির পাশেই বসা দুটি অনিন্দ্য সুন্দরী, এরা নাসেরের কাফেলাকে আসতে দেখে চকিত হরিণীর মতো সূক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে উঠে দাঁড়াল।

নাসের এদের দেখে থেমে গেল। সাথীদের জিজ্ঞেস করল, তোমরাও কি ওখানে দুটি ঘোড়া এবং দুজন তরুণী দেখতে পাচ্ছ?

যে দুই সাথী সর্বাগ্রে দৃষ্টিভ্রম ও বোধ বিলুপ্তির শিকার হয়েছিল এদের একজন কোন কথা বলল না। অপরজন বলল, সব ধূয়াশা, আমি কিছুই দেখছি না। যে সাথীর তখনও পর্যন্ত মাথা ঠিক ছিল সে নাসেরের কানে কানে বলল, হ্যাঁ। আমিও তো তাই দেখতে পাচ্ছি।

আল্লাহ আমাদের রহম করুন। আমাদের দেমাগও খারাপ হয়ে গেছে। আমিও মনে হয় তাই দেখছি যা বাস্তব নয়। এই বিরান দোযখে এমন অনিন্দ্য সুন্দরী কোত্থেকে আসবে?

এরা যদি মরু এলাকার যাযাবর হতো তাহলে হয়তো মনে করা যেতো যে আমরা সত্যিই দেখছি। কিন্তু পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তো এমনটি মনে হয় না। আচ্ছা, চলো ছায়ায় বসি। এরা আসলে কোন নারী নয় আমাদের দৃষ্টিভ্রম। বলল নাসেরের সাথী।

আমার কিন্তু বোধশক্তি সম্পূর্ণ ঠিক আছে। বলল নাসের। আমি তোমাদের ঠিক মতোই দেখছি, অনুধাবন করছি তোমাদের কষ্ট। তোমাদের কথাবার্তাও বুঝতে পারছি, আমার কোন বিভ্রম নেই।

দেমাগ আমারও খারাপ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি ভুল না দেখে থাকি তবে মেয়ে দুটি মানুষ নয় জ্বীন হবে। বলল নাসেরের সাথী।

মেয়ে দুটিও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে মূর্তির মতো। নাসের সাহসী যোদ্ধা। কোনকিছুর পরোয়া না করে সে মেয়ে দুটির দিকে অগ্রসর হল। কিন্তু মেয়ে দুটি আগের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য! জ্বীন তো মানুষের উপস্থিতিতে মানুষের অবয়বে থাকে না!

মেয়ে দুটি থেকে নাসের যখন মাত্র পাঁচ/ছয় কদম দূরে তখন এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়স্কাটি ডান হাত নাসেরের দিকে প্রসারিত করে দিল, তবে তার হাত ছিল মুষ্ঠিবদ্ধ। সে শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুল দুটি নাসেরের প্রতি বাড়িয়ে দিল। থেমে গেল নাসের। এমন অনিন্দ্য সুন্দরী নারী জীবনে কখনও দেখেনি নাসের। মেয়েটির ওড়নার ফাঁকে বেরিয়ে থাকা চুলগুলো যেন রেশমের সূতীক্ষ্ণ নরম সূতো। চোখ দুটো তারার মতো উজ্জ্বল। গভীর মনোহর চাহনী, এক কথায় কোন মৃতপ্রায় পুরুষের মধ্যেও পৌরুষ জাগানিয়া অপরূপা তরুণী দুটি।

তোমরা সৈনিক! তাই না? জিজ্ঞেস করল বড় মেয়েটি। কার সৈনিক তোমরা?

সবই বলব, কিন্তু এর আগে আমাকে বল, তোমরা কি মরু বিভ্রম না জান্নাতের হুর?

আমার যাই হই না কেন, আগে তুমি বল, তোমরা কে? কোত্থেকে এদিকে কেন এসেছো? আমরা মরু বিভ্রম নই, তোমরা যেমন আমাদের দেখছো, আমরাও ঠিক তোমাদের দেখছি। বলল বড় মেয়েটি।

আমরা সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর গেরিলা ইউনিটের সৈনিক। তোমরা যদি জান্নাতের হুর হয়ে থাকো, অথবা জ্বীন গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে থাকো, তবে হযরত সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোহাই, আমার সাথীদের পানি পান করিয়ে দাও। প্রয়োজনে এর পরিবর্তে আমার জীবন নিয়ে নাও। কারণ এদের প্রাণ রক্ষা করা এখন আমার জিম্মাদারী।

হাতের অস্ত্র আমাদের সামনে ফেলে দাও। হাত নামাতে নামাতে বলল তরুণী। হযরত সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের আবেদন আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না। তোমার সাথীদের ছায়ায় নিয়ে এসো।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক ধরনের শিহরণ অনুভব করল নাসের। যেন শীতল একটা বাতাস মাথা দিয়ে প্রবেশ করে তার পায়ের পাতা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। তার সারা শরীরকে কেমন যেন বোধহীন করে শীতল করে দিয়েছে, যে অনুভূতি একান্তই অনুভবের, ব্যক্ত করার মতো নয়। কারণ মানুষ শত্রুদের মোকাবেলা করতে অভ্যস্ত সে। তার গেরিলা আক্রমণের ভয়ে প্রতিপক্ষ ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। গোটা মুসলিম বাহিনীতে তার ছিল ঈর্ষণীয় সাফল্য। কিন্তু এই তরুণী দুটির সামনে তার বীরত্ব সাহস সবই কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো। তার মনের গহীনে এমন এক ভয়ের সঞ্চার হলো যা কোনদিন সে অনুভব করেনি। জীবনে জ্বীন-পরীর বহু গল্প শুনেছে সে; কিন্তু জ্বীনের মুখোমুখী হয়নি কখনও। তার বিশ্বাস ছিল, যে কোন সময় এই মেয়ে ও ঘোড়া দুটি অদৃশ্য হয়ে যাবে, অথবা রূপ বদলে ফেলবে। এদের বিরুদ্ধে তার কিছুই করার নেই। তাই মেয়ে দুটির সামনে সে নিজেকে সম্পূর্ণ আসহায় করে ফেলল। সে সাথীদের এসে বলল, চলো ছায়ায় যাই। তার সাথীদের একজন তো ইতিমধ্যেই বেহুশ হয়ে পড়েছিল। তাকে টেনে হেঁচড়ে ছায়ায় নিয়ে গিয়েছিল নাসের।

তোমাদের পরিচয় কি, কোত্থেকে এসেছো? জিজ্ঞেস করল তরুণী।

আগে পানি পান করাও! অনুরোধ করল নাসের। শুনেছি, জ্বিনরা না-কি বলার সাথে সাথে সবকিছু হাজির করতে পারে।

ঘোড়ার পিঠে পানির পাত্র আছে। ওখান থেকে একটি খুলে নিয়ে এসো।

নাসের একটি ঘোড়ার জিন থেকে পানির পাত্র খুলে নিল। এরপর সবার আগে বেহুশ সাথীর চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিল। পানির ঝাঁপটায় সে চোখ খুলে উঠে বসল। নাসের পানির পাত্রটি এগিয়ে দিল ওর মুখে। সে পান করল কয়েক ঢোক। এরপর অন্যদেরকেও অল্প অল্প করে পান করাল। নিজেও পান করল কয়েক ঢোক। পানি পানের পর নাসেরের ঘোর কেটে গেল। সে অনুভব করল এরা জিন্নাত হতে পারে না। জিন হলে আমাদের চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসার সাথে সাথে ওরা উধাও হয়ে যেতো। কিন্তু ওরাতো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আরো অনুভব করল পানিতো তারা কল্পনায় পান করেনি। বাস্তবিকই পান করেছে। শরীরটায় প্রাণ ফিরে এসেছে। এতো জীবন্ত বাস্তবতা। আবারো গভীরভাবে নিরীক্ষা করল তরুণীদের। আগের চেয়ে বেশী সুন্দর লাগছে ওদের। আবারো সৌন্দর্যের মোহে আত্মহারা হলো নাসের। না, এরা মানুষ হতেই পারে না। মানুষ কি এতো সুন্দর হতে পারে? এরা অবশ্যই জিন হবে।

ক্ষুধা-পিপাসা, আবেগ-যাতনায় নাসেরের দেমাগ এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, সে বিষয়টিকে আর বাস্তবতার নিরীখে যাচাই করার শক্তি পেল না। সে অনুভব করল, তার বিবেক বোধ আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। মৃতপ্রায় সাথীদের মধ্যে প্রাণ ফিরে এসেছে। কিন্তু মেয়ে দুটিকে কেন্দ্র করে ওদের মধ্যে দেখা দিল আতংক। তারা যে জায়গাটিতে বসা ওখানে ছায়া ছিল, তাই মরুর আগুন অতোটা তাদের গায়ে পড়ছিল না কিন্তু বাইরের দিকে তাকানোর শক্তি ছিল না কারো। আগুনে লু হাওয়া মাঝে মধ্যেই ওদের জানিয়ে দিল কতো ভয়ংকর যাত্রা তারা পাড়ি দিয়ে এসেছে।

তরুণী দুটি নীরবে দেখছিল ওদের। আর নাসের ও সাথীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। ভিতরে ভিতরে ওদের আতংক। তাদের জানা মতে, জিনরা অনেক শক্তির অধিকারী। ইচ্ছে হলে, পাহাড় উঠিয়ে চাপা দিতে পারে, আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। এমনকি মানুষকে অপহরণও করে ওরা। জানা নেই এরা ওদের সাথে কি ব্যবহার করে।

বড় তরুণীটি ডান হাতের মধ্যমা উঁচু করে হাত প্রসারিত করল নাসেরের দিকে। বলল, ওই পুটলীটা খুলে তোমার সাথীদের দাও।

যন্ত্রচালিতের মতো নাসের ঘোড়ার জিন থেকে পুটলী খুলে আনল। খুলে দেখল ওর মধ্যে কিছু খেজুর ছাড়াও রয়েছে রান্না করা শুকনো গোশত। সাধারণত আমীর ব্যক্তিরা এ ধরনের গোশত খেয়ে থাকে। পুটলী খুলে নাসের তাকাল তরুণীর দিকে।

তরুণী বলল, সাথীদের নিয়ে খাও!

নাসের সাথীদের মধ্যে সবগুলো ভাগ করে দিল। বাহ্যত খাবারের পরিমাণ বেশী ছিল না। স্বাভাবিক অবস্থায় এগুলো একজনের খাবার। কিন্তু সবাই মিলে খেয়েও তারা তৃপ্ত হলো। কারণ কয়েক দিনের টানা অনাহার, অনিদ্রা ও তৃষ্ণায় ওদের পেট-পিঠের সাথে লেগে গেছে। কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। চিবিয়ে খাবার মতো শক্তি পর্যন্ত রহিত হয়ে গেছে। পানি পানের পর তাদের মধ্যে যে প্রাণ ফিরে এসেছে এর ফলে খাবারগুলো চিবুতে পেরেছে তারা। সবাই খাবার গলাধঃকরণ করে যখন পানি পান করল, তখন তাদের কাছে জগতটা মনে হলো অন্য রকম। তরুণীদ্বয় হয়ে উঠেছে আরো সুন্দরী, জান্নাতী হুর যেন।

এখন তোমরা আমাদের সাথে কি আচরণ করবে? বড় তরুণীটিকে প্রশ্ন করল নাসের। কারণ জিন আর মানুষের মধ্যে কোন সমতা নেই। তোমরা আগুনের তৈরী, আমরা মাটির মানুষ। অবশ্য আমরা সবাই আল্লাহর মাখলুক। দয়া করে তোমরা আমাদেরকে তুকমানের পথটি দেখিয়ে দাও। ইচ্ছে করলে মুহূর্তের মধ্যে তোমরা আমাদের পৌঁছে দিতে পার তুর্কমানে।

তোমরা কি কোথাও রাতের বেলায় গুপ্ত হামলা করতে গিয়েছিলে? জিজ্ঞেস করল বড় তরুণী। সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীও জিনের মতো। বল তোমরা কোথা থেকে কি করে এসেছো?

তরুণীর জিজ্ঞাসায় নাসের তার গোটা কার্যক্রম বলে দিল। তার ইউনিট কতো ভয়ংকরভাবে শত্রু বাহিনীর রসদপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে সবিস্তারে বলল সবই। কিভাবে তারা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে তাও বলে দিল নাসের।

মনে হয় তোমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে তোমরা সেরা, বলল তরুণী। তোমরা যে কাজ কর, তোমাদের প্রত্যেক সৈনিকই কি এ ধরনের অপারেশন করতে পারে?

না। যে কোন সৈনিক আমাদের মতো ঝটিকা অপারেশন করতে সক্ষম নয়। আমাদের তুমি সাধারণ মানুষ মনে করো না। আমাদের উস্তাদ আমাদেরকে যে কঠিন প্রশিক্ষণ দিয়েছে সাধারণ সৈনিক তা সহ্য করতে পারবে না। চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র আমাদের গতি, হরিণের মতো মরুভূমিতেও আমরা দৌড়াতে পারি। ঈগলের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আমরা। শারীরিক গঠনের দিক থেকেও আমরা অন্য সাধারণের চেয়ে ভিন্ন। বিরূপ পরিস্থিতিতেও মাথা ঠিক রেখে সঠিক কাজটি আমরা করতে পারি।

আমরা এ ব্যাপারেও প্রশিক্ষণ নিয়েছি, শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে কিভাবে ওদের গোপন তথ্য বের করে আনা যায়। আমরা যে কোন সময় বেশ পাল্টাতে পারি, আওয়াজ বদল করতে পারি। একাধিক ভাষা জানি। প্রয়োজনে অন্ধের ভূমিকা পালন করতে পারি। ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা হলে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করি। গ্রেফতার হওয়া আমাদের জীবনে নেই, আমরা লড়াই করে শাহাদাত বরণ করি কিন্তু কখনও গ্রেফতার বরণ করি না।

আমরা যদি জিন না হতাম, তাহলে তোমরা আমাদের সাথে কি ব্যবহার করতে? বলল তরুণী।

আমরা মানুষরূপী পাথর। নারী সৌন্দর্য আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে না। তোমরা মানুষ হলে যদি জানতে পারতাম যে, রাস্তা ভুলে গেছো, তাহলে আমাদের ঈমানের মতোই পবিত্র আমানত মনে করে তোমাদেরকে আমাদের দায়িত্বে নিয়ে নিতাম। বাস্তবে তো তোমরা মানুষ নও। তোমাদের মতো হুর এমন জাহান্নামে আসতে পারে না। তোমরা অবশ্যই জিন। আমার অনুরোধ, তোমরা আমাদের নিরাপত্তা দান কর!

আমরা মনুষ্য জাতির অন্তর্ভুক্ত নই। বলল বড় তরুণী। আমরা জানতাম তোমরা কি করতে পার। আমরা এটা জানতাম যে, তোমরা পথ হারিয়ে ফেলেছ। তোমরা যে মরুতে পথ হারিয়েছিলে সেখান থেকে কোন মানুষ বেঁচে আসতে পারে না। কোন গোনাহগার এই মরুভূমিতে পথ হারালে সে আর পথ খুঁজে পায় না। মরু তাদের রক্ত শুষে নেয়। তপ্ত বালুকারাশি হাড় গোশত খেয়ে ফেলে। কিন্তু তোমরা পরহেজগার। আমরা তোমাদের সাথেই ছিলাম কিন্তু তোমাদের এজন্য কষ্ট দেয়া হয়েছে যাতে কষ্টযন্ত্রণা সহ্য করে তোমাদের কু-রিপু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। মন বদ খেয়াল মুক্ত হয়। আমাদের আশংকা ছিল, আমাদের মতো সুন্দরী রমণী দেখে তোমরা বেশামাল হয়ে পড়বে।

তোমরা আমাদের সাথে সাথে রইলে কেন? জিজ্ঞেস করল নাসের।

তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন–যিনি পথভোলা মরুযাত্রীদের পথ দেখান। বলল বড় তরুণী।

তোমাদের উপর আল্লাহ্ যে দয়া করেছেন তা হিসাব করে তোমরা শেষ করতে পারবে না। তিনি আমাদের বলেছিলেন, পুরুষ মানুষ মৃত্যুমুখেও নারীলোভ সামলাতে পারে না। তোমাদের অন্তর থেকে কুপ্রবৃত্তি দূর করার জন্যই তিনি তোমাদেরকে ক্ষুধা পিপাসার দুর্ভোগে ফেলেছিলেন। অতঃপর তোমরা যখন একেবারে কষ্টের শেষ ঠিকানা স্পর্শ করেছ, তখন আমাদের নির্দেশ করেছেন, এদেরকে তোমরা আশ্রয়ে নিয়ে নাও। আমরা জানতাম, শত্রুদের কিভাবে তোমরা নাকানী চোবানী খাইয়েছো।

তাহলে আমার কাছ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলে কেন? প্রশ্ন করল নাসের।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কতটুকু সত্য আর কী পরিমাণ মিথ্যা বল তা বোঝার জন্য। তোমরা সত্যবাদী।

মিথ্যা আমরা কখনও বলি না। বলল নাসের। জানো, রাতের ঝটিকা বাহিনী আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কাজ করে। আমরা যখন কাজ করি তখন আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে কোন অধিনায়ক থাকে না। আল্লাহকে হাজির নাজির মনে করে আমরা অপারেশন করি। আমরা মনের মধ্যে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে নিই যে, আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান এবং সর্বদ্রষ্টা। তিনি আমাদের সবকিছু দেখছেন। তাকে ফাঁকি দেয়ার কোন সুযোগ নেই।… থেমে গেল নাসের। আচ্ছা তুমি কিন্তু আমার সেই প্রশ্নের জবাব দাওনি, আমাদের সাথে তোমরা কি ব্যবহার করবে?

আমাদের যা হুকুম করা হয়েছে, এর বরখেলাপ আমরা করতে পারি না। বলল তরুণী। আমাদের আচরণ খারাপ হবে না। আমরা দেখছি, তোমাদের মুখে কথা ফুটছে না। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু তদুপরি ভয়ের কারণে তোমরা ঘুমাতে পারছ না। আমি তোমাদের অভয় দিচ্ছি, কোন ভয় নেই, সাথীদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

তারপর কি হবে? জিজ্ঞেস করল নাসের।

আল্লাহ্র যা নির্দেশ তাই হবে। তবে পালানোর ইচ্ছা করলে এই বালির ঢিবির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। এই যে দেখছো বালির টিলাগুলো! এগুলো আসলে টিলা নয় মানুষ। অপরাধ করার কারণে এগুলোকে এভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আমাদের হুকুম নেই এগুলোর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করার। না হয় তুমি তরবারী দিয়ে আঘাত করলে এগুলো থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হতে দেখতে পেতে।

একথা শুনে নাসের ও সাথীদের চোখ ভয়ে গোল হয়ে গেল। সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল।

এই মরু–যমীনের জাহান্নাম। পাপিষ্ঠ লোক ছাড়া এখানে কেউ পথ হারায় না। যারা এখানকার পথভোলা মুসাফিরদের পথ দেখায়, এরা হয় হরিণের বেশ ধরে আসে, নয়তো আমাদের মতো সুন্দরী নারীর বেশ ধরে আসে। তাদের পানি পান করায়, খাবার দেয় এবং পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু জানো, মানুষ স্বভাবতই অপরাধ প্রবণ। যে হরিণ এদেরকে পথ দেখানোর জন্যে হরিণের বেশ ধরে আসে, ওরা সেটিকেই বিষাক্ত শরাঘাতে হত্যা করে খেতে চায়। আর আমাদের মতো সুন্দরী নারী দেখলে ওদের অসহায় মনে করে সম্ভ্রম লুটে নেয়, হারেমের বউ করার প্রস্তাব করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, এসব কর্মই তাদের জন্য করুণ পরিণতি বয়ে আনবে। ওই যে সব টিলা দেখছো, সবগুলোই তোমাদের মতো পুরুষ ছিল, কিন্তু তোমাদেরকে এমন বানানো হবে না।

তোমরা শুয়ে পড়। আমাদের দেখে যদি তোমাদের মধ্যেও কোন বদখেয়াল মাথাচাড়া দিয়ে থাকে তবে সেই বদখেয়ালটিকেও ঘুম পাড়িয়ে দাও। নইলে কিন্তু তোমাদের পরিণতিও হবে ওদের মতো। যা তোমরা নিজ চোখে দেখছো। আসলে এটা মানুষের একটা চরম দুর্বলতা যে, মানুষ যে সুখের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে সেই সুখানুভূতির জন্যে মানুষ ধ্বংস টেনে আনে, করুণ পরিণতি বরণ করে। মানুষের এই আত্মদুর্বলতা বহু জাতিকে ধ্বংস করেছে।

তরুণীর কথা ছিল যাদুমাখা। ওদের কথা থেকে নাসের ও সাথীরা কল্পনাও করতে পারেনি এরা এই মর্তের নারী। ওদের প্রতিটি কথার মধ্যে অলৌকিকতার আলোকচ্ছটা। তরুণীর কথায় নাসের ও সাথীরা স্বপ্নলোকের ঐশী প্রেরণায় আপুত। ভুলে গেল তারা নিজেদের অস্তিত্বের কথা। ধীরে ধীরে প্রত্যেকের চোখ বুজে এলো ঘুমে। এক এক করে সবাই ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেল। সবাই যখন ঘুমে অচেতন, তখন বড় তরুণীটি ছোট তরুণীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস।

* * *

নাসেরের মিশন যেমন সফল হয়েছিল তার সেনাবাহিনীর মিশনও ছিল সফল। তার জানার কোন উপায় ছিল না, সুলতান আইয়ূবী কৌশলের ফাঁদে ফেলে তিন বাহিনীর কমান্ডার সাইফুদ্দীনকে কতটুকু বিপর্যয়ে ফেলেছিলেন। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে সাইফুদ্দীন সৈন্যসামন্ত ফেলে রেখেই রণাঙ্গন থেকে পালিয়েছিল। সাইফুদ্দীন পালিয়ে যাওয়ার পর আইয়ূবী সাইফুদ্দীনের চীফ কমান্ডার মোজাফফর উদ্দীনের পাল্টা আক্রমণের অপেক্ষায় ছিলেন। আইয়ূবী আশংকা করছিলেন মোজাফফর উদ্দীন যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তবে জবাবী হামলা করা ছাড়া ফিরে যাবে না।

আইয়ূবীর আশংকা ভিত্তিহীন ছিল না। মোজাফফর উদ্দীন ঠিকই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তিনবাহিনীর এক চতুর্থাংশের কমান্ড ছিল তার অধীনে। বাকীরা আইয়ূবী বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। কিন্তু মোজাফফর উদ্দীন পালালো না; কারণ তার অধীনস্থ এক চতুর্থাংশ সৈন্য ছিল রিজার্ভ। ওরা যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার আগেই সাইফুদ্দীনের কমান্ড ভেঙে যায়। তার বাহিনী শোচনীয় মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়।

আইয়ূবী তার অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার আলোকে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, মোজাফফর উদ্দীন অবশ্যই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে এবং সুযোগ মতো সে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাবে! ঐ ছিল আইয়ূবীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি। সাধারণ মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তি পাঁচটি হলেও বিশেষ ব্যক্তিদের এমন ধরনের নিরীক্ষণ ক্ষমতা থাকে যে, এর দ্বারা তারা সাধারণের চেয়ে ভিন্ন কিছু আন্দাজ করতে পারেন। আইয়ূবীর এ ধারণাও ছিল তদ্রূপ।

তিনি গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিলেন বহু দূর পর্যন্ত। সবাইকে নির্দেশ দিলেন কারো চোখে সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব অনুভূত হলেই আমাকে দ্রুত সংবাদ পৌঁছাবে। আইয়ূবীর সৈন্যরা ভেবেছিল, যৌথবাহিনীর কমান্ডার সাইফুদ্দীন পালিয়ে গেছে এবং যুদ্ধ পুরোপুরিই খতম। তাদের মতে শত্রুবাহিনীর আর কোন জীবিত সৈন্য খুঁজে পাওয়া যাবে না রণাঙ্গনে। হয় সবাই পালিয়ে গেছে, অন্যথায় আহত-নিহত হয়েছে।

এলাকাটি ছিল আইয়ূবীর গোয়েন্দাদের জন্যে দুর্গম। ঘন টিলা, ঝোঁপঝাড়, পর্বত সংকুল। যে কোন টিলার আড়ালে ঘন ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে গোটা একটা বাহিনী আড়াল করে রাখা কোন কঠিন ব্যাপার ছিল না। আইয়ূবীর যে গোয়েন্দারা মুক্ত এলাকায় শত্রুবাহিনীর পেটের খবর বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম ছিল, তারা এই দুর্গম অঞ্চলের সব টিলা আর পর্বতের আড়াল খুঁজে দেখার অবকাশ পেল না।

মোজাফফর উদ্দীন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আড়াই মাইল দূরে একটি বড় পর্বতের আড়ালে গুহার মতো জায়গায় নিজের বাহিনীকে আড়াল করে রেখেছিল। সে তার তাঁবুতে বসে আইয়ূবীর উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। খুব তাড়াতাড়িই চাচ্ছিল সে আইয়ূবীর উপর আঘাত হানতে। এমন সময় তার তাঁবুতে প্রবেশ করল তার আর এক ডেপুটি। ডেপুটির সাথে অন্য এক লোক।

নতুন কোন সংবাদ আছে? জিজ্ঞেস করল মোজাফফর উদ্দীন।

সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর সেনাবাহিনী বহাল তবিয়তে রয়েছে। বলল ডেপুটি। ও স্বচক্ষে দেখে এসেছে সবকিছু, ওর মুখ থেকেই শুনুন।

ডেপুটির সাথের লোকটি ছিল মোজাফফর উদ্দীনের গোয়েন্দা। সে বলল, আইয়ূবীর সৈন্যরা আমাদের পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদের রসদপত্রও কুড়ায়নি। শুধু আহতদের উঠিয়ে নিয়েছে। আর ওদের ও আমাদের মৃতদেরকে আলাদাভাবে দাফন করছে।

মৃতদের খবরের কোন দরকার নেই আমার। জীবিতরা কি করছে, ওদের সংবাদ বল। বলল, মোজাফফর উদ্দীন। যারা মরে গেছে তাদেরকে দাফন তো করতেই হবে, আর সেটি তারা করবে, এটা তোমার সংগ্রহের মতো কোন সংবাদ নয়। সেটি বল, আইয়ূবী কি তার সেনাদের অবস্থানে কোন হেরফের করেছে? তার সৈন্যদের ডান বাহু কি আগের অবস্থানেই রয়েছে?

সম্মানিত সেনাপতি! আমি সিপাহী নই, কমান্ডার। যে সংবাদটি পরিবেশন করছি তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝে-শুনে, চিন্তা-ভাবনা করে করছি। আমি আপনাকে খুশী করার জন্যে, আপনার ক্ষোভের ভয় করে কিছু বলছি না। আপনি যেমন আইয়ূবীর জয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করতে চান, আমারও প্রত্যাশা তা-ই। আপনার প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আক্রমণ-আয়োজন দ্রুত করুন তাতে অসুবিধা নেই কিন্তু তাড়াহুড়ো করবেন না। মেহেরবানী করে আমাকে বলতে দিন। আমি বলতে চাই–আপনার দৃষ্টি আইয়ূবীর ডান বাহুর দিকে। কেননা, আপনার জন্যে আইয়ূবীর ডান বাহুতে আক্রমণ শানানো সহজ হবে কিন্তু আমি তার বাম বাহুকেও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, তার ডান বাহু আক্রান্ত হলে বাম বাহুতে অবস্থানরত সৈন্যদের সে খুব তাড়াতাড়ি টেনে এনে আঘাত প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।

তুমি বলতে চাচ্ছো, সে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে তাইনা? বলল মোজাফফর উদ্দীন। তার চাল আমি জানি। আমি এক অবস্থায় স্থির থাকব না। কখনও আমাদের সৈন্যদেরকে ছড়িয়ে দেবো, আবার কখনও সংকুচিত করবো। ওদেরকে খেলিয়ে খেলিয়ে নাস্তানাবুদ করবো আমি। তুমি যা বলবে এসব অগ্রিম আমি বলে দিতে পারি।

আইয়ূবী তার যে রিজার্ভ সৈন্য ব্যবহার করে আমাদের বাহিনীকে পরাজিত করেছে, ওদেরকে সে আবার পিছনের সারিতে সরিয়ে নিয়ে প্রস্তুত রেখেছে। আপনার ধারণা ঠিক, সে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে। আমি কবরের যে কথা বলছিলাম, তা হলো, আইয়ূবীর ডান বাহু যেখানে অবস্থান নিয়েছে, ওখান থেকে এক ক্রোশ দূরে। প্রায় দেড় হাজারের মতো হবে কবরের সংখ্যা। আপনি জানেন, দেড় হাজার কবর খননে কতটুকু জায়গায় গর্ত খোঁড়া হয়েছে। আপনি এভাবে হামলা করবেন, যাতে আইয়ূবীর সৈন্যরা পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়, যাতে তারা খননকৃত কবরের কাছে চলে যায়। আপনি কি ভাবতে পারেন, ওরা যখন সওয়ারী ঘোড়াগুলো নিয়ে গর্তগুলোতে পড়তে থাকবে মৃতদেহ দাফনকৃত কবরগুলোর খোঁড়া মাটিতে ঘোড়ার পা তলিয়ে যাবে তখন অবস্থা কি দাঁড়াবে?

আইয়ূবীর ডান বাহুতে কি পরিমাণ সৈন্য রয়েছে এবং এরা কতটুকু শক্তিশালী মনে হয় তোমার কাছে?

অন্তত এক হাজার অশ্বারোহী আর দেড় হাজার পদাতিক সৈন্য হবে। বলল, গোয়েন্দা কমান্ডার। এরা সম্পূর্ণ আক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুত। এদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করা সম্ভব নয়।

মোজাফফর উদ্দীনের সামনে খোলা নকশার এক জায়গায় সে হাত রেখে বলল, এখানে অবস্থান করছে শত্রু বাহিনীর ডান বাহু। আমার ধারণা, এরা অন্তত আটশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদের সামনের জায়গাটা খুব উঁচু নীচু। ওদের ডানপাশটা পরিষ্কার। আক্রমণের জন্য ডানপাশটাই বেশী উপযুক্ত মনে হয় কিন্তু আক্রমণ সামনের দিক থেকেই করা উচিৎ, তাহলে এরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হবে।

আমার আক্রমণ সামনের দিক থেকেও হবে, ডান দিক থেকেও হবে। ওদের খোঁড়া কবরগুলোকে ব্যবহার করব আমি। ডেপুটিকে বলল মোজাফফর। অপরিচিত কোন ব্যক্তিকে কোথাও পেলে ধরে নিয়ে আসবে, এখানকার গোটা এলাকাই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কোন সাধারণ লোক এ মুহূর্তে এদিকে আসবে না। গোয়েন্দা ছাড়া এদিকে আর কাউকে দেখতে পাবে না তুমি। কাজেই অজ্ঞাত লোক পেলেই তাকে গ্রেফতার করতে হবে।

* * *

অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে দুই অভিযাত্রীর হয়তো জানা ছিল না, এই এলাকাটি যুদ্ধের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। একজন অভিযাত্রী উটে আরোহণ করেছিল। সে ছিল বয়স্ক। দীর্ঘ ধবধবে সাদা দাড়ি। কান্তিময় চেহারা। তার উটে বোঝাই করা কিছু মালপত্র। অপর লোকটি উটের মিহার টেনে আসছিল। উভয়েই ছিল গ্রামীণ পোশাকে সজ্জিত। মোজাফফর উদ্দীনের নিয়ন্ত্রিত এলাকা অতিক্রম করছিল তারা। মোজাফফর উদ্দীনের গোয়েন্দারা জায়গায় জায়গায় ওঁৎ পেতে ছিল সুলতানের গোয়েন্দা শিকারের জন্যে। অভিযাত্রীর নজরে পড়ে গেল মোজাফফর উদ্দীনের সেনাবাহিনী। অমনি এক সৈন্য ওদের থামাতে হাঁক দিল। সেনার হাঁক শুনে ওরা চলার গতি বাড়িয়ে দিল। এক অশ্বারোহী গিয়ে অভিযাত্রীদ্বয়ের পথ আগলে দাঁড়ালে থামল তারা। সৈনিক তাদেরকে বলল, আমার সাথে চল।

আমরা মুসাফির। তোমাদের আমরা কি ক্ষতি করলাম যে আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছ? আমাদের পথ ছেড়ে দাও।

এ পথে যে কাউকে পাওয়া যাবে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। অতএব তোমাদের যেতে দেয়া হবে না। অশ্বারোহী সৈনিক অভিযাত্রীদ্বয়কে তার সাথে ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করল।

তাদেরকে একটি তাঁবুর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল এক কমান্ডার। কমান্ডার উভয়কে নানা কথা জিজ্ঞেস করল। তাদের জবাবে সন্দেহমুক্ত হয়ে গেল কমান্ডার। কিন্তু তাদেরকে জানানো হলো, তোমাদের যেতে দেয়া হবে না। তোমাদের বন্দী নয় মেহমান হিসেবে কদিন এখানেই রাখা হবে। তারা বারবার প্রশ্ন করলেও পরিষ্কারভাবে একথা বলা হয়নি কদিন তাদেরকে এখানে আটকে রাখা হবে। এরাই ছিল প্রথম অভিযাত্রী; যাদেরকে মোজাফফর উদ্দীনের সৈন্যরা তাদের এলাকা থেকে ধরে নজরবন্দী করে রেখেছিল। তাদের আর কোন কথাই শোনা হলো না। দুজন সৈনিকের হাতে ওদের তুলে দিয়ে বলা হলো, ওদেরকে তোমাদের তাঁবুতে রাখবে।

যে দুই সৈনিকের তাঁবুতে অভিযাত্রীদ্বয়কে রাখা হয়েছে ওরা ঘুমিয়ে। উভয়েই নাক ডাকছে। কিন্তু বৃদ্ধের চোখে ঘুম নেই। সে যখন নিশ্চিত হলো, সৈনিক দুজন ঘুমিয়ে অচেতন তখন সাথীকে খোঁচা দিয়ে জাগাল সে। উভয়েই হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর দরজা পর্যন্ত পৌঁছল। দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নিল বাইরের পরিস্থিতি। বাইরে কাউকে না দেখতে পেয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ল দুজন। তাঁবু থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বৃদ্ধ সাথীকে বলল, তুমি আমার কাছ থেকে ভিন্ন হয়ে যাও। যেদিক থেকে পারো ক্যাম্পের সীমানা পেরিয়ে যাও।

ওরা ভেবেছিল ক্যাম্পে হয়তো সবাই ঘুমিয়ে। আসলে কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করে রেখেছিল মোজাফফর উদ্দীন। ছায়ার মতো কিছু একটা নড়তে দেখে ডাক না দিয়ে অনুসরণ করল এক প্রহরী। ছায়াটি ছিল সেই বৃদ্ধ। সে প্রহরীকে দেখে লুকিয়ে পড়ল। প্রহরী এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করল জিনিসপত্রের স্কুপের মধ্যে। কিন্তু বিশাল পণ্যের ফাঁকে বৃদ্ধ লোকটি এভাবে নিজেকে আড়াল করল যে প্রহরী তাকে খুঁজে বের করতে পারল না। প্রহরী চলে যাওয়ার পর বৃদ্ধ লোকটি অন্ধকারে পা টিপে টিপে জায়গা ছেড়ে আরো সরে আসল। একইভাবে অপর এক প্রহরী বৃদ্ধের সাথীকেও দেখে ফেলল। মোজাফফর উদ্দীনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল নিচ্ছিদ্র। সে জানতো আইয়ূবীর গোয়েন্দারা খুবই পারদর্শী। এরা মাটির নীচ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এজন্য সে সেনা ক্যাম্পে রাত্রিকালীন প্রহরার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল যাতে আইয়ূবীর কাছে তার কোন তথ্য পাচার না হতে পারে বা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী তার ক্যাম্পের ক্ষতি করতে সুযোগ না পায়। নির্দেশ মতো প্রহরীরা ছিল পূর্ণ সতর্ক। অপর এক প্রহরীর দৃষ্টি পড়ল বৃদ্ধের সাথীর উপর। কিন্তু সে সন্দেহভাজনকে না ডেকে ওর পিছু নিল। বৃদ্ধের সাথীও প্রহরীর দৃষ্টি এড়াতে লুকিয়ে পড়ল। এদিকে অনুসরণকারী প্রহরীর সাথে কানামাছি খেলায় মেতেছিল বৃদ্ধ। এমতাবস্থায় বৃদ্ধ কিছুক্ষণ পর এমন এক জায়গায় লুকিয়ে পড়ল যে, প্রহরী তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ তার কোমরের খঞ্জর বের করে ফেলল, প্রহরীর খবরদারী থেকে নিষ্কৃতির জন্য সে প্রহরীকে হত্যা করবে। খঞ্জর হাতে নিয়ে প্রহরীর অবস্থান পরখ করছিল বৃদ্ধ আর ভাবছিল কোন দিক দিয়ে সে ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারবে। ঠিক এই মুহূর্তে তার একেবারে পিছনে এসে দাঁড়াল এক লোক। বৃদ্ধ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই সেই লোকের বুকে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল। পরপর দুবার বিদ্ধ করল বুকে ধারাল খঞ্জর। আর্তচিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটি। বৃদ্ধ সেখান থেকে পালানোর দিক ঠিক করছিল, এমন সময় পিছন থেকে একজন তাকে ঝাঁপটে ধরল। বৃদ্ধ এমন তীব্র ঝটকা দিল যে, ঝাঁপটে ধরা লোকটি দূরে ছিটকে পড়ল। ভোঁ দৌড় দিল বৃদ্ধ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বৃদ্ধের পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যে জিনিসটির সাথে সে হোঁচট খেয়েছিল উঠে তাকে ঝাঁপটে ধরল। নিরাপত্তা রক্ষীদেরই কজন গাছের মতো শুয়ে পড়েছিল মাটিতে সম্ভাব্য শত্রুকে ঘায়েল করতে। তাদেরই একজন বৃদ্ধকে ধরতে দৌড় লাগাল পিছে পিছে। দৌড়ে সে ধরে ফেলল বৃদ্ধকে। চিৎকার দিল তার সহযোগিতার জন্য। শত শত মশাল জ্বলে উঠল বিপদ সংকেত পেয়ে। প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি করেও বৃদ্ধ মুক্ত হতে পারল না বহু জনের পাকড়াও থেকে। সবাই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল, দৃশ্যত বৃদ্ধের গায়ে এতো তাকত যে, প্রশিক্ষিত অনেকজনের সাথেও সে যে শক্তির মহড়া করেছে, তা হতবাক করল তাদের। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে বৃদ্ধের সাদা দাড়ি খসে বেড়িয়ে এল কালো দাড়ি। মুখোশের আড়াল খসে বেরিয়ে এলো তাগড়া জোয়ান চেহারা। সবাইতো হতবাক। একি! এযে সেই বৃদ্ধ। কিন্তু ওকে আমরা যেমন দেখেছিলাম সেতো সে রকম নয়! খুব কৌশলে কালো দাড়ির উপরে সাদা দাড়ি প্রতিস্থাপন করে বৃদ্ধ সেজেছিল লোকটি। এবার বুঝতে কারো বাকি রইল না; এ যে পাকা গোয়েন্দার কৌশলী কাজ।

তাকে গ্রেফতার করে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল যেখানে নিহত হয়েছিল অন্য আরেকজন। দেখা গেল নিহত লোকটিও ক্যাম্পের কোন সৈনিক নয় বৃদ্ধেরই সাথী। রাতের আঁধারে শত্রুসেনা মনে করে অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই ওকে হত্যা করেছিল এই ছদ্মবেশী গোয়েন্দা। ওদের উটের মালপত্র তল্লাশী করে দেখা গেল, কোন মালপত্র নেই, সবই ধোকাবাজী।

তাকে ধরে নিয়ে গেল একজন সহ-অধিনায়কের তাঁবুতে। সহ-অধিনায়ক জেগে উঠল। সহ-অধিনায়ক তাকে অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করল কিন্তু তার মুখ থেকে কোন তথ্যই উদ্ধার করতে পারল না, সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করল ধৃত ব্যক্তি। তার মুখোেশ দেখানো হলো অধিনায়ককে। মুখোশের ব্যাপারে পূর্ববৎ নীরব রইল সে। তাকে বলা হলো যে, তোমার এই মুখোশকে তুমি কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না। তোমাকে অবশ্যই স্বীকার কতে হবে যে তুমি আইয়ূবীর সৈনিক, তোমার সহযোগীও আইয়ূবীর গোয়েন্দা। কোন কথাই বলল না অভিযুক্ত। তাকে বহু শাস্তি দেয়া হলো। নির্যাতন করা হলো কিন্তু আইয়ূবীর সাথে সংশ্লিষ্টতার স্বীকৃতি স্বীকার করল না। রাত পেরিয়ে গেল।

সকালে মোজাফফর উদ্দীনের সামনে হাজির করা হল তাকে। বলা হল রাতের সব ঘটনা। তার নকল দাড়ি, মুখোশ ও উটের কৃত্রিম মালপত্রও রাখা হল মোজাফফর উদ্দীনের সামনে।

আলী বিন সুফিয়ানের শিষ্য তুমি, না হাসান বিন আব্দুল্লাহ্র? জিজ্ঞেস করল মোজাফফর।

আলী বিন সুফিয়ান আইয়ূবীর মিলিটারী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আর হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ তার ডিপুটি। অভিযুক্ত ব্যক্তি বলল, আমি এদের কাউকেই চিনি না।

বলল মুজাফফর–তুমি না চিনলেও আমি চিনি তাদের। উস্তাদ সাগরিদকে কখনও ধোকা দিতে পারে না। বুঝলে?

আপনার বা আইয়ূবীর সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই, আপনাদের সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহও নেই আমার।

হতভাগ্য বন্ধু! শোন, অভিযুক্তের কাঁধে হাত রেখে বলল মুজাফফর। তোমার সাথে তর্কে যাবো না আমি। আমি একথাও বলবো না, তুমি অযোগ্য। তুমি নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছো। ধরা পড়ে যাওয়া সৈনিকের জীবনে কোন দূষণীয় ঘটনা নয়। তোমার দুর্ভাগ্য যে তোমার সাথী তোমার হাতেই নিহত হয়েছে। তুমি শুধু আমাকে একথা বলো যে, তোমার কোন সাথী এখানকার পরিস্থিতি অবলোকন করে আইয়ূবীর কাছে পৌঁছে গেছে কি? আর একথা বল, এ মুহূর্তে কোন কোন জায়গায় তোমাদের সৈন্য অবস্থান করছে এবং কোন দল কোথায় আছে? এসব কথার জবাব দিলে আমি কুরআনের শপথ করে বলছি-যুদ্ধ খতম হতেই তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে সম্মানের সাথেই এখানে রাখা হবে।

আপনার কসমের উপর আমার আস্থা নেই। কেননা কুরআনের বিশ্বাস থেকে আপনি বিচ্যুত। বলল অভিযুক্ত।

আমি কি মুসলমান নই? ক্ষোভ হজম করে ধৈর্যের সাথে বলল মোজাফফর। আপনি মুসলমান বটে কিন্তু আপনি কুরআন তো খ্রীস্টানদের সহযোগী।

তুমি আমাকে যে অপবাদই দাও না কেন সবই আমি সহ্য করব, যদি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দাও তুমি। তোমার মনে রাখা উচিত; তোমার জীবন এখন আমার হাতের মুঠোয়।

আল্লাহর কাছ থেকে আপনি আমার জীবন ছিনিয়ে নিতে পারবেন না। আপনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। আপনি জানেন আমাদের প্রতিটি সৈনিক জীবন আল্লাহকে সোপর্দ করেছে। আপনাকে বলে দিচ্ছি–আমি সুলতানের একজন গোয়েন্দা, আমার সাথীও গোয়েন্দা দলের সদস্য। আমি এর বেশী কিছু বলতে পারব না। জীবন্ত অবস্থায় আমার দেহ থেকে চামড়া তুলে নিলেও আমার মুখ থেকে আর কিছু শুনতে পারবেন না আপনি। একথাও আমি আপনাকে বলে দিতে পারি যে, আপনার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

পায়ে রশি বেঁধে ওকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দাও। একটি বৃক্ষের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে তাঁবুতে চলে গেল মোজাফফর উদ্দীন।

* * *

ওরা দুজনতো এখনো ফিরে এলো না। আইয়ূবীর সাথে বলছিল হাসান বিন আলী। ওদের তো গ্রেফতার হওয়ার আশংকা নেই। আমাদের গোয়েন্দা গ্রেফতার করতে পারে এ অঞ্চলে! এমন কে আছে, তাছাড়া বেশী দূর যাওয়ারও কথা নয় এদের।

হয়তো ওরা গ্রেফতার হয়েছে। সকালে যাওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত ফিরে না আসার অর্থ হলো ওরা ধরা পড়েছে। ওদের গ্রেফতার করার লোক রয়েছে এ অঞ্চলেই। আজ রাতে আরো দূর দিয়ে পর্যবেক্ষণ টিম পাঠাও। বললেন সুলতান।

সুলতানও গোয়েন্দা বাহিনীর ডিপুটি ধৃত দুই গোয়েন্দা সম্পর্কেই কথা বলছিলেন। সুলতান আইয়ূবীর প্রধান হাতিয়ার ছিল গোয়েন্দা ব্যবস্থা। তিনি গোয়েন্দাদের অগ্রিম তথ্যের ভিত্তিতেই রণকৌশল নির্ধারণ করতেন। ফলও হতো আশাপ্রদ। কিন্তু মোজাফফর উদ্দীনের কার্যক্রম সম্পর্কে অগ্রীম তথ্য সংগ্রহে আইয়ূবীর গোয়েন্দা সূত্র ব্যর্থ হচ্ছিল। গত পরশু রাতে তুকমানের বিরানভূমিতে সুলতানের এক গোয়েন্দাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পাঁজরে তীর বিদ্ধ। ছিল। মোজাফফর উদ্দীন ছিল সুলতানের বাহিনীর একজন শীর্ষ কমান্ডার। সে তার অধীনস্থদের বলেছিল, আইয়ূবীর গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে যদি বেকার করে দিতে পার তবেই তোমরা আইয়ূবীর বিরুদ্ধে বিজয়ের আশা করতে পার। গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া আইয়ূবী অচল। সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবে। আইয়ূবী দুই গোয়েন্দার ফিরে না আসা এবং একজনকে মৃত পাওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। অন্যেরা এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলেও আইয়ূবী হাসান বিন আলীকে বললেন–তুমি জোর তৎপরতা চালাও। আরো লোক পাঠাও। নিশ্চয়ই আমাদের ধারে পাশে শত্রু অবস্থান নিয়েছে। আইয়ূবীর নির্দেশে হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ ছয়জনের একটি বিশেষ দলকে তথ্য সগ্রহে পাঠিয়ে দিলেন।

ভোর বেলায় আল্লাহু আকবারের তাকবীর ধ্বনিতে ঘুম ভাঙল আইয়ূবীর। তিনি তাঁবুর বাইরে এলে তার একান্ত খাদেম জ্বলন্ত মশাল তার সামনে রাখল। এ সময় এক অশ্বারোহী এসে থামল আইয়ূবীর সামনে। ঘোড়া থেকে নেমে বলল, সুলতানের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক। আমাদের ডানবাহুর কাছেই সৈন্যবাহিনীর আগমন বোঝা যাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে দুজন খবর এনেছে। শত্রুবাহিনী আসছে।

আইয়ূবী শীর্ষ কমান্ডারদের নাম ধরে বললেন, ওদের জলদি ডাকো। সুলতান মাটিতে বসে তৈয়াম্মুম করলেন। পানি আনিয়ে অযু করার সময় নেই। জায়নামায ছাড়াই ঠায় দাঁড়িয়ে দুরাকাত নামায পড়লেন। নামান্তে খুবই সংক্ষিপ্ত দুআ শেষ করে তার ঘোড়া নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন।

মোজাফফর উদ্দীন ছাড়া এ লস্কর আর কারো নয়। অধিনায়কদের উদ্দেশ্যে বললেন আইয়ূবী। আমি নিশ্চিত খ্রীস্টান বাহিনীর সৈন্য নয় এরা। খ্রীস্টানদের অভিযানের ধরণ এমন নয়। যদি এ সংবাদ সঠিক হয় যে, দুশমন আমাদের ডান বাহুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে তবে খেয়াল রাখবে দৃশ্যতঃ দুশমন ডান বাহুতে আত্মপ্রকাশ করলেও হামলা হবে উভয় বাহুতে। উভয় দিকে দুশমনদের প্রতিরোধ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আমাদের কোন বাহিনী যেন পশ্চাৎপসরণ না করে। পিছনে খননকৃত দেড় হাজার কবর আমাদের সৈন্যদের জন্যে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হবে।

সুলতান আইয়ূবী অশ্বারোহণ করলেন। তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর চৌকস বারোজন তার অনুগামী হল। আট দশজন দ্রুতগামী অশ্বারোহীকেও তিনি সাথে নিলেন পয়গাম বহনের জন্য। আরো সাথে নিলেন দুজন অধিনায়ক। ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন তিনি। একটি উঁচু টিলার উপরে গিয়ে দাঁড়ালেন। যেখান থেকে তার ডান বাহুর সৈন্য ও সামনের গোটা এলাকা দৃশ্যমান হয়। তখন ভোরের আঁধার কেটে যাচ্ছে প্রায়। এমন সময় তিনি ডান বাহুর কমান্ডারদের ডেকে নির্দেশ দিলেন, অশ্বারোহীদেরকে সওয়ার করে দাও এবং পদাতিক ইউনিটের তীরন্দাজদের অগ্রসর হয়ে গুহা, গর্ত ও পাহাড়ের ঢালে মরিচাবন্দী হতে নির্দেশ করো।

এখন থেকে ডানবাহুর চীফ কমান্ড থাকবে আমার হাতে। প্রত্যেক অধিনায়ক ও কমান্ডার সংবাদবাহীদের সাথে রাখো। সব সময় আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। আমার সর্বশেষ নির্দেশ পালনে তৎপর থাকবে।

আইয়ূবীর সামরিক ট্রেনিং-এ দ্রুত স্থান বদলের কৌশলকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হতো। রণাঙ্গনে তার যে কোন নির্দেশ অভাবনীয় দ্রুততার সাথে পালিত হতো। মোজাফফর উদ্দীনের বাহিনীর দৃষ্টিসীমায় আসার আগেই আইয়ূবী তাঁর বাহিনীকে তৈরী করে ফেললেন।

* * *

অশ্বারোহী বাহিনী দিয়ে আক্রমণ করল মুজাফফর। যখনই মুজাফফরের অশ্বারোহী বাহিনী সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনীর মুখোমুখি হলো, অমনি টিলার গর্তে, পাহাড়ের ঢালুতে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজেরা তীর বৃষ্টি শুরু করে দিল। তীরের আঘাতে শত্রুবাহিনীর ঘোড়া লুটিয়ে পড়তে লাগল, আহত ঘোড়াগুলো এদিক সেদিক দৌড়াতে শুরু করল। অনাকাক্ষিত প্রতিরোধের মুখে হতভম্ব হয়ে গেল মোজাফফরের অশ্বারোহীরা। মুজাফফরের কাছে হঠাৎ আক্রমণের মুখে পতিত হওয়া বিস্ময়কর ঘটনা ছিল না। কিন্তু সে ভেবেছিল যে, সুলতানের অজ্ঞাতে ইচ্ছে মতো সুবিধাজনক জায়গায় সুলতানকে লড়াবে সে। সে আশা ব্যর্থ হয়ে গেল। ধারণাতীতভাবে সুলতানের প্রতিরোধের মুখে পড়ে গেল মুজাফফর। সুলতানের বহু তীরন্দাজ এ আক্রমণে হতাহত হলো কিন্তু এই লোকসানের বিনিময়ে তিনি স্বস্তি লাভ করলেন। মুজাফফরের আক্রমণের তীব্রতা কমে এলো। প্রতিপক্ষের অশ্বারোহীরা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও জনবল হারাল।

এখন আইয়ূবী স্বাধীনভাবেই তাঁর রণকৌশল বাস্তবায়নের সুযোগ পেলেন। মোজাফফর উদ্দীনের একটি অশ্বারোহী দল বহু সংখ্যক সাথীর লাশ ফেলে এগিয়ে এলো, সামনেই ছিলেন সুলতান নিজে। তিনি আক্রমণকারীদের আগমন দেখে তার বাহিনীকে প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। আক্রমণকারীরা যখন একেবারেই কাছে চলে এলো, তখন সুলতানের বাম বাহুর অশ্বারোহী বাহিনী নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে আরো বামে চলে গেল। অনুরূপ ডানের অশ্বারোহীরাও আরো ডানে সরে পড়ল। প্রতিপক্ষের মুখোমুখি না হয়ে খালি ময়দানে এগিয়ে গেল অধিকাংশ শত্রু সৈন্য। কিছু সৈনিক ডানে বামে মোড় নিয়ে সুলতানের বাহিনীর মুখোমুখি হল। এবার সুলতানের বাহিনী উভয় দিক থেকে শত্রুসেনাদের দুই বাহুতে আক্রমণ করল। তাদের কোন আঘাত আর ব্যর্থ হলো না। প্রতিটি আঘাতেই শত্রুসেনা পড়তে লাগল। শত্রুবাহিনীর মূল অংশটি সোজা সামনে এগিয়ে যাওয়ায় তাদের দুই বাহুর সাহায্যে এগিয়ে আসার সুযোগ রইল না। ওদের জন্যে এখন একটাই পথ সামনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। সামনের ফাঁকা জায়গাটুকুতেই ছিল সদ্যখননকৃত দেড় হাজার কবর। ওরা সেই কবরের উপর দিয়েই যেতে লাগল।

মুজাফফর ভড়কে যাওয়ার পাত্র নয়। সে কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী পাঠিয়ে অবস্থা বুঝে নিতে চাচ্ছিল। যখন দেখল অগ্রগামী দল সুবিধা করতে পারেনি, সাথে সাথে পঙ্গপালের মতো দ্বিতীয় দলকে পাঠালো। ওরা এমন গতিতে এসে সুলতানের বাহিনীর পিছনে আক্রমণ করল যখন সুলতানের বাহিনী শত্রুবাহিনীকে কবরে তাড়া করে নিজেরা কবর থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েছে মাত্র। পিছন থেকে এসে তাদের উপর হামলে পড়ল মুজাফফরের দ্বিতীয় অশ্বারোহী ইউনিট। সুলতানের অশ্বারোহীরা ঘোড়া ঘুরিয়ে ওদের মোকাবেলার অবকাশই পেলো না। প্রতিপক্ষের তাড়া খেয়ে কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী কবরে নিপতিত হতে লাগল। ওদিকে বাম বাহুতেও একই সাথে আক্রমণ করে বসল মুজাফফর বাহিনী।

আইয়ূবীর জন্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি হয়ে উঠল খুব সঙ্গীন। তিনি দূতদেরকে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে, রিজার্ভ বাহিনীকে বলো পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে।

ডানবাহুকে সুলতান যেভাবে ভাগ করে দিয়েছিলেন তা তেমন কোন কাজে আসলো না। কারণ, মোজাফফর উদ্দীন সুলতানের চালকে রোধ করে দিচ্ছিল তারই কৌশলে। মোজাফফর উদ্দীনের দুর্বলতা এতটুকুই ছিল যে, তার সাহায্যকারী সৈন্যবলের ঘাটতি ছিল। সুলতান দূতদের মাধ্যমে ডানবাহুকে বিক্ষিপ্ত হতে নির্দেশ দিলেন। তার রিজার্ভ বাহিনীর পশ্চাতের আক্রমণে মোজাফফর উদ্দীনের রক্ষণভাগ খালি হয়ে গেল। তার নিজের নিরাপত্তাই হুমকির মুখোমুখি হল কিন্তু সে তখনও পালানোর চিন্তা করল না। অটল অবিচল থেকে মরণপণ লড়াই শুরু করল। দিনের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লড়াই এমন তীব্র আকার ধারণ করল যে, উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা জীবিতদের চেয়ে বেড়ে গেল। যুদ্ধে মোজাফফর উদ্দীন এমন কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যে, আইয়ূবী বারবার চাল বদলাতে বাধ্য হচ্ছিলেন। সুলতান আইয়ূবী বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, মোজাফফর উদ্দীনের মতো ব্যক্তিই পারে এমন কঠিন মোকাবেলা করতে। শেষ পর্যন্ত উস্তাদের আখেরী চালে যদিও মোজাফফর উদ্দীন পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু আইয়ূবীকে সেদিন স্মরণীয় প্রতিপক্ষের মুখোমুখি ঘামঝরা লড়াইয়ে বহু প্রাণের বিনিময়ে বিজয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল।

একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আইয়ূবী সুইসাইড স্কোয়াড ব্যবহার করলেন। ওরা জীবনপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার মোজাফফর উদ্দীনের রক্ষণভাগ ভেঙে পড়ল, সে রণে ভঙ্গ দেয়াকেই ভাল মনে করে পশ্চাৎপসারণ করল। বহু সংখ্যক শত্রু সৈন্য গ্রেফতার হলো সুলতানের হাতে। বন্দীদের অন্যতম ছিল মোজাফফর উদ্দীনের উপদেষ্ট ফখরুদ্দীন। ফখরুদ্দীন ছিল সাইফুদ্দীনের উজীর। সাইফুদ্দীনের পরাজয়ের পর সে আশ্রয় নিয়েছিল মোজাফফর উদ্দীনের কাছে। তাকে প্ররোচিত করেছিল সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।

সময়টা ছিল ১১৭৬ সালের পয়লা এপ্রিল। মোজাফফর উদ্দীনের পরাজয়ে আইয়ূবীর জ্ঞাতি শত্রুদের কোমড় ভেঙে গিয়েছিল বটে কিন্তু এ বিজয়ের মূল্য এতো বিপুল রক্ত ও জীবন সম্পদ দিয়ে দিতে হয়েছিল যে, দুমাসের আগে আইয়ূবী তুর্কমান ত্যাগ করতে পারলেন না।

আইয়ূবীর ডানবাহুর অধিকাংশ সৈন্য আহত ও নিহত হয়েছিল। তার প্রধান শক্তিই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেকে পঙ্গু ভাবতে শুরু করেন। খুব তাড়াতাড়ি বাহিনীকে সচল করতে নতুন সৈন্য রিক্রুট করার ঘোষণা দেন। দলে দলে মুসলমান যুবকেরা তার সৈন্যদলে যোগ দিচ্ছিল। এদের বুনিয়াদি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা তিনি তুর্কমানের ময়দানেই শুরু করেন। সৈন্যক্ষয় বিপুল হওয়ায় তিনি দামেশক ও মিশরে দ্রুত দূত পাঠালেন রসদ সামগ্রী পাঠানোর জন্যে। অপরদিকে সামান্য একটু অগ্রসর হলেই জ্ঞাতি শত্রুদের খতম বা পরাজিত করে তিনি মৌসুল, হিরন, আলেপ্পো নিজের অধীনে নিয়ে ফিলিস্তিনের পথ পরিষ্কার করতে পারতেন কিন্তু তার সেনাদের অবস্থা মোটেও অগ্রসর হওয়ার মতো ছিল না।

এটা আমার বিজয় নয়, এ বিজয় খ্রীস্টানদের। কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বিজয়ের পর বলেছিলেন আইয়ূবী। খ্রীস্টানরা চাচ্ছিল আমরা পরস্পর যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে পড়ি; তাদের সে আশা পূরণ হয়েছে। ওরা আমার ফিলিস্তিন অভিযান বিলম্বিত করতে পেরেছে। এই সুযোগে ওরা ফিলিস্তিনের জবর দখল আরো মজবুত করতে পারবে। হায়! স্বজাতি ভাইয়েরা যদি বুঝতো যে, বেঈমানেরা আমাদের কখনও বন্ধু হতে পারে না, ওরা বন্ধুরূপী দুশমন। ওরা আমাদের ক্ষতি ছাড়া কল্যাণ ভাবতেই পারে না। জানিনা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করে, কারণ আমরা ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে অপরিমেয় জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট করে যাচ্ছি।

আইয়ূবী ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না, জ্ঞাতি শত্ৰু পরাজিত করে স্বস্তি লাভ করলেও তাকে হত্যা করে মুসলিম শক্তিকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার নীলনক্সা একই সময়ে চূড়ান্ত হয়ে গেছে ঈসিয়াত দুর্গে। সেখানে তার তৃতীয় শত্রু গোমতগীন হাশিশীনের দলপতি শেখ সিনানের সাথে বসে চুক্তি করে ফেলেছিল। শেখ সিনান খ্রীস্টানদের দেয়া দুর্গে গড়ে তুলেছিল পেশাদার খুনীদের এক বিশাল শক্তি। তা ছাড়া তার নিজস্ব শক্তিশালী সেনা বাহিনীও ছিল দুর্গের অভ্যন্তরে। বিপুল ধন-সম্পদও মজবুত দুর্গের অভ্যন্তরে এই হাশীশ দলপতি গড়ে তুলেছিল স্বতন্ত্র এক মুসলিম বিদ্বেষী রাজত্ব।

ঈসিয়াত ও তুর্কমানের মধ্যবর্তী যে মরুভূমিতে আইয়ূবীর চার গোয়েন্দা সদস্য পথ হারিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, ওরা দুই তরুণীর দেয়া খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেলা যখন প্রায় ডুবুডুবু তখন চোখ মেলল দলপতি নাসের। ঘুম থেকে জেগে উঠে বসল সে। তরুণী দুজন তখনও জাগ্রত, বসে বসে ওদেরকেই পর্যবেক্ষণ করছে। তরুণীদের দেখে পুনরায় ভড়কে গেল নাসের। যদিও বড় তরুণীটি তাদের সাথে যে ব্যবহার করেছিল তাতে বিপদের তেমন আশংকা ছিল না কিন্তু ওদেরকে জিন ভেবে পুরোপুরি আশ্বস্থ হতে পারছিল না নাসের। তার মধ্যে পুনরায় জিনের শক্তিমত্তার কল্পিতরূপ ভেসে উঠল।

* * *

ওদের জাগিয়ে দাও। বলল বড় তরুণী। আমাদের অনেক পথ যেতে হবে।

আমাদেরকে কি পথে ফেলে চলে যাবে? জিজ্ঞেস করল নাসের।

তোমরা আমাদের সাথেই যাবে। আমাদের ছাড়া তোমরা যেতে পারবে না। বলল বড় তরুণী।

সাথীদের জাগাল নাসের। ছোট তরুণীকে কি যেন বলল বড় তরুণী। সে ঘোড়ার পিঠে বাঁধা পুটলী থেকে একটি পুটলীর মতো নিয়ে এলো। মশক খুলে সেখানে ঢেলে দিল পুটলীর বস্তু। কিছুক্ষণ নাড়িয়ে মশকটি বাড়িয়ে দিল বড় তরুণী নাসেরের দিকে। বলল, এই পানিটুকু সবাই মিলে পান করে নাও। পথে হয়তো আর পানি পাওয়া যাবে না।

নাসের ও সাথীরা সাগ্রহে পান করল পানিটুকু। ওদেরকে আবারো কিছু আহার দিল বড় তরুণী। সেই খাবারও খেয়ে নিল নাসের ও তার সাথীরা। কিছুক্ষণ পর মশক ও পুটলী ঘোড়ার পিঠে রাখল তরুণী। তখন সূর্য ডুবে গেছে প্রায়।

হু, তোমরা এ জায়গাটিকে বলছো, জাহান্নাম। আমি তো এখানে সবুজ আর সবুজ দেখছি। এতো অল্প সময়ে এখানে আমাদের তোমরা কিভাবে নিয়ে এলে? উচ্চকণ্ঠে বলল নাসের। নাসেরের সাথীরাও অবাক বিস্ময়ে দেখছিল চতুর্দিক।

তোমরাও কি সবুজের সমারোহ দেখতে পাচ্ছো? নাসেরের সহযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করল তরুণী।

আরে! আমরা তো বসেই আছি সবুজ ঘাসের উপর। বলল অপর একজন।

আচ্ছা, তোমরা আমাদের হত্যা করবে না তো? জিজ্ঞেস করল অপর একজন। কারণ তোমরা তো জিন।

না, তোমাদের হত্যা করব কেন? এর চেয়েও আরো সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাদের।

বড় তরুণী নাসের ও তার এক সাথীকে তার দুপাশে বসিয়ে দুজনের কাঁধে দুহাত প্রসারিত করে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও। অপর তরুণীও বাকী দুইজনকে একই রূপে নিজের পাশে বসিয়ে দুহাত ওদের কাঁধে দিয়ে চোখে চোখ রাখতে বলল। দুর্ধর্ষ এই চার গোয়েন্দার কানে গুঞ্জরিত হল বড় তরুণীর কণ্ঠ–এটাই তোমাদের বেহেশত। দেখো, সুন্দর ফুলের বাগান, সবুজের সমারোহ। তাজা ফুলের সুবাস নাও। দেখো, বাগানে কতো সুন্দর পাখি উড়ছে। এটা তোমাদের পুরস্কার। তোমাদের পায়ের নীচে মখমলের গালিচার মতো নরম কোমল তাজা ঘাস। দেখো! কতো সুন্দর ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে, স্ফটিক স্বচ্ছ ঝর্ণার পানি দারুণ মিষ্টি।

তরুণীর যাদুমাখা কথা চার যোদ্ধার দেহমনকে স্বপ্নিল জগতে ভাসিয়ে দিল। তারা বাস্তবতা ভুলে সম্পূর্ণ কাল্পনিক জগতে হারিয়ে দিল নিজেদের। হাসান বিন আব্দুল্লাহর সাথে সাক্ষাতের পর নাসের বলেছিল, তরুণীদ্বয় যখন ওদের চোখে চোখ রাখতে বলল আমাদের, আমরা সবাই ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বড় তরুণী বলতে লাগল কাল্পনিক দৃশ্য। আর আমরা বাস্তবতা ভুলে তলিয়ে গেলাম স্বপ্নিল জগতে। ওদের রেশমী চুলগুলোকে মনে হচ্ছিল সদ্যফোঁটা ফুলভর্তি লতাগুল্ম। ওদের চোখ দুটোই ছিল প্রবাহিত ঝর্ণা। মনে হচ্ছিল আমরা বসে আছি কার্পেটের মতো ঘন ঘাসের উপর। চতুর্দিকে সবুজ আর সবুজ। সুদৃশ্য বাগান। বাগানে পাখ-পাখালীর উড়াউড়ি কিচির-মিচির, কল-কাকলী। সত্যিই সেই স্বপ্নিল দৃশ্য যে কতো সুন্দর ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

* * *

হাঁটছিল ওরা। হাঁটছিল যেন মখমলের মতো তাজা ঘাসের উপর দিয়ে। অথচ ওখানে ছিল না ঘাসের কোন চিহ্ন, সবুজের অস্তিত্ব। তবুও ওদের কাছে মনে হচ্ছিল; ওরা হেঁটে যাচ্ছে ঘন সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে দারুন সুন্দর বাগানের ভিতরে। অথচ বাস্তবে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল রুক্ষ কঠিন বালিয়াড়ী আর শুষ্ক যমীন পেরিয়ে। ওরা চারজন যাচ্ছিল আগে আগে হেঁটে, আর তরুণীদ্বয় ওদের পিছনে আসছিল অশ্বারোহণ করে। তাদের প্রত্যাশা ছিল সুলতান আইয়ূবীর ছাউনীতে তুর্কমানে পৌঁছা কিন্তু তারা অগ্রসর হচ্ছিল সম্পূর্ণ উল্টো দিকে, হাশীশ সম্রাট শেখ সিনানের দুর্গে। আসলে তাদের তখন কোন বোধ ছিল না, নেশাদ্রব্য খাইয়ে বোধশক্তি লোপ করে ফেলেছিল দুই তরুণী। তারা অবোধের মতো ওদের নির্দেশ মেনে অগ্রসর হচ্ছিল বন্দীশালার দিকে।

তাদের পিছনে দুই তরুণী ওদের মিশন ও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে কথা বলছিল কিন্তু ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিল না এরা। এমতাবস্থায় সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমে এলো।

তুমি বললে রাত কোথাও থামবে না। এরা কি সারা রাত চলতে পারবে? বড় তরুণীকে জিজ্ঞেস করল ওর সাথী।

পানিতে যে পরিমাণ হাশীশ তুমি ওদের গিলিয়েছো, এর প্রভাব আগামীকাল সকাল পর্যন্ত থাকবে। আর আমি যা খাইয়েছি তা তো দেখলেই। ওদের ব্যাপারে নিঃশঙ্ক থাকতে পারো তুমি। আগামী দিনে বেলা উঠার আগেই আমরা ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছে যাব।

ওদের দেখে আমি তো ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। বলল ছোট তরুণী। সত্যিই যাদু জান তুমি। যেভাবে জিনের কথা বলে ওদের কাবু করলে, তা দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। মুসলমানরা কি জিনকে খুব বিশ্বাস করে?

জিন-ভূত কিছুই না। এসব বুদ্ধির খেলা। আমি ওদের বোধকে কজা করেছি। ওদের দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওরা আইয়ূবীর সৈনিক। ওদের চেহারা দেখে আন্দাজ করতেও আমার কষ্ট হয়নি, পথ হারিয়ে মরিয়া হয়ে পড়েছে ওরা। ওদের দৃষ্টিই আমাকে বলছিল, আমাদের চেয়ে ওরা বেশী ভয় পেয়েছে বিজন প্রান্তরে আমাদেরকে দেখে। ওদের দেখে যদি আমরা ভয়ে অবলা নারীদের মতো ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে আত্মসমর্পণ করতাম, তাহলে ওরা আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করতো; তা তুমি সারা জীবনেও ভুলতে পারতে না। এমন বিজন মরুতে আমাদের মতো তরুণী বাগে পেলে কোন পুরুষই কন্যা, ভগ্নির মতো সসম্মানে মাথায় রাখবে না। ওদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এবং জিন সম্পর্কে ওদের ভৌতিক বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েছি আমি। জিন সম্পর্কে ওদের ভৌতিক বিশ্বাস সম্পর্কে আমি জানতাম। সেই সুবাদে নিজেকে জিন বানিয়ে ফেললাম। এমন মরু বিয়াবানে আমাদের মতো সুন্দরী মেয়েদের অস্তিত্ব এরা বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমাদেরকে দেখে ওরা কল্পনা মনে করছিল অথবা ভাবছিল আমরা জিন-পরি। আমি ওদের সাথে এমনভাবেই কথা বলেছি যে, ওরা আমাদেরকে জিন মনে করেছে। ভাই! তুমি এখনও অনেক কাঁচ। আরো অনেক কিছু শেখার আছে এ পথে। দেখনি, সাইফুদ্দীনের মতো সিংহকে আমি আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়ে ছেড়েছি, আর ওরাতো সাধারণ সৈনিক।

বুঝতে পারছি না, এ বিদ্যায় আমি সফল হতে পারছি না কেন? বলল ছোট তরুণী। আমি চেষ্টা করি সবকিছু আত্মস্থ করতে, কিন্তু মন সায় দেয় না। মনে হয় এসব ধোকা-প্রতারণা। বিবেক এসবের প্রতি আমার মনে ঘৃণার উদ্রেক করে।

হু, বুঝেছি। পেশায় উন্নতি করতে ব্যর্থ হলে তোমাকে এসব পুরুষের হাতে খেলনা হয়েই থাকতে হবে। বলল বড় তরুণী। এবারই প্রথম তোমাকে বাইরে পাঠানো হয়েছে। আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি চালে ব্যর্থ হচ্ছে। তোমার দ্বারা ক্রুশের কোন কাজ হবে না। শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে অল্পতেই বুড়িয়ে যাবে তুমি। শরীরের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলে এসব পুরুষ তোমাকে পুরনো কাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিবে। মুসলমান কাপুরুষগুলোর মনোরঞ্জনের উপাদান হওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়, আমাদের লক্ষ্য হলো ওদের চিন্তা ও দেমাগের নিয়ন্ত্রণ লাভ করা। এ চার যোদ্ধাকে তুমি দেখেছো, কিভাবে কথার মায়াজালে ওদের দুর্বলতার ফাঁক দিয়ে আমি কাবু করে ফেলেছি। এসব কৌশল আমাকে ইহুদী ও খৃস্টান প্রশিক্ষকরা শিখিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই আবেগপ্রবণ। আবেগের কাছে প্রত্যেক মানুষই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়; যদি না আবেগকে সে কঠিন সাধনার দ্বারা বাগে আনতে পারো। আমরা মুসলমানদের মধ্যে মানবিক আবেগ ও কাম-রিপুকে উস্কে দিয়ে অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ফেলি। কাম-রিপু মানুষকে ধ্বংসের অতলে নিক্ষেপ করে। তোমার কি সেই রাতের কথা মনে নেই? সাইফুদ্দীন এক জেনারেলের সাথে বলছিল, আমাকে আইয়ূবীর সাথে সন্ধিচুক্তির ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে দাও। আমি কিভাবে তাকে সন্ধিচুক্তি থেকে বিরত রেখেছি।

ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছে এই কৌশলগুলো আমাকে শিখিয়ে দিও। বলল ছোট তরুণী। আমার মনের মধ্যে এসব কাজের প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়ছেই বাড়ছে। আমি ওইসব মুসলমান উমারাদের খেলনার পুতুলে পরিণত হয়েছি অথচ তুমি নিজেকে ওদের আগ্রাসী ক্ষুধা থেকে মুক্ত রাখতে পারছো। মাঝে মধ্যে আমার ইচ্ছে হয় কোথাও পালিয়ে যাই, কিন্তু পালানোর কোন জায়গাই দেখি না।

সবকিছুই শিখতে পারবে। ধীরে ধীরে সবই রপ্ত হয়ে যাবে। চিন্তা করো না। আমার সাথে তোমাকে পাঠানো হয়েছে প্রশিক্ষণের জন্যই। কর্মক্ষেত্রে কতোটা তুমি পারদর্শিতা অর্জন করেছে তা দেখার জন্যে। এই মিশনে তোমার দুর্বলতাগুলো আমি দেখেছি, এসব দূর হয়ে যাবে।

নাসের ও সাথীরা গুনগুনিয়ে একটি কোরাস গেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বালু, পাথুরে যমীন, শুষ্ক মরু সবই তাদের কাছে মনে হচ্ছিল সবুজ ঘাসের গালিচা। তরুণী দুজন তাদের ঘোড়া এদের সামনে নিয়ে এলো যাতে এরা পথ ছেড়ে অন্যদিকে চলে না যায়।

এদেরকে তো ভিন্ন পথে রওয়ানা করিয়ে দেয়া দরকার ছিল। ঈসিয়াত দুর্গে নিয়ে গিয়ে এদের কি করবে, জিজ্ঞেস করল ছোট তরুণী।

আমার উস্তাদ শেখ সিনাদের জন্যে এদের চেয়ে উৎকৃষ্ট উপঢৌকন আর হতে পারে না। বলল বড় তরুণী।

এরা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর সদস্য; সেই সাথে পরীক্ষিত দক্ষ গোয়েন্দা। আমাকে বিশেষভাবে বলা হয়েছিল আইয়ূবীর কোন একজন গোয়েন্দাকে যদি বাগে আনতে পার তাহলে বুঝবো; তুমি অন্তত এক হাজার সৈনিককে বেকার করে দিয়েছে। আইয়ূবী তার গোয়েন্দা ও ঝটিকা বাহিনীকে এমন উঁচু মানের ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে যে, প্রত্যেক গোয়েন্দা সদস্য একজন সাধারণ সৈনিকের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। শারিরীকভাবে প্রত্যেক গোয়েন্দা সাধারণ সৈনিকের চেয়েও অনেক বেশী কষ্ট সহিষ্ণু, শারিরীক শক্তির অধিকারী এবং স্বীয় কর্তব্য পালন ও লক্ষ্য অর্জনে মরিয়া হয়ে থাকে। এরা রাতের আঁধারে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে, মরুভূমিতে পথ হারিয়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্লান্তি অবসাদের যে দুর্ভোগ সহ্য করেছে, আমাদের সৈন্যদের মধ্যে এ সহিষ্ণুতা নেই। এদেরকে আমি শেখ সিনানের হাতে সোপর্দ করে দেবো। এদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সাহস যদি আমাদের যোদ্ধারাও আত্মস্থ করতে পারে তবে খুবই উপকার হবে। তোমার মনে হয় জানা নেই, আইয়ূবীকে হত্যা করার জন্যে এ পর্যন্ত কয়েকটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু প্রত্যেকটি ব্যর্থ হয়েছে। এরা আইয়ূবীর বিশ্বস্ত কর্মী। এদের পক্ষে এনে আইয়ূবী পর্যন্ত পৌঁছা সহজ হবে।

সাইফুদ্দীন গোমশতগীন ও অন্যান্যদের হাত করতে যে কৌশল নেয়া হয়েছে, তা কি সালাউদ্দীন আইয়ূবীর বেলায় প্রয়োগ করা যায় না? বলল ছোট তরুণী।

না। ওদের বেলায় যে কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে তা দিয়ে আইয়ূবীকে ঘায়েল করা সম্ভব নয়। বলল বড় তরুণী। যে ব্যক্তি কোন পবিত্র আদর্শের প্রতি নিজের মন-মস্তিষ্ক, দেহ-আত্মা সম্পূর্ণ নিবেদন করে, যার মধ্যে জাগতিক ও দৈহিক ভোগ-লিপ্সার চর্চা নেই, তাকে আমাদের মতো সুন্দরী আর দিনারের পাহাড় দিয়ে আদর্শচ্যুত করা যায় না। আইয়ূবী এক পত্নীতে বিশ্বাসী। নূর উদ্দীন জঙ্গীর মধ্যেও এই প্রবণতা ছিল। লোকটি এতো বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও মৃত্যু পর্যন্ত এক পত্নীতে জীবন কাটিয়েছে। বহু চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোন সুন্দরী তরুণীই আইয়ূবীকে বাগে আনতে পারেনি। ফিলিস্তিনে খৃস্টান নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার এখন একমাত্র পন্থাই হচ্ছে আইয়ূবীকে হত্যা করা।

যে পুরুষ এক পত্নীতে বিশ্বাসী এবং জীবনভর এক পত্নীর অনুগত থাকে, এসব মানুষ আমার খুব ভাল লাগে। খৃস্ট ধর্মের অনুসারী হওয়ার পরও আমার ইচ্ছে হয় যদি কোন মানুষকে প্রেমে আবদ্ধ করতে পারতাম, সে যদি আমার ভালবাসায় মুগ্ধ ও আমার অনুগত হতো তবে আমি তাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতাম। বলল ছোট তরুণী।

এসব আবেগ সিকেয় তুলে রাখ। ধমকের সুরে বলল বড় তরুণী। এসব ভুলে যে পবিত্র মিশনে এসেছে সেটি মাথায় রাখো। ভুলে যেয়ো না, তুমি কুশ হাতে নিয়ে শপথ করেছো, যতো দিন জীবিত থাকবে ক্রুশের জন্যে নিজেকে উৎসর্গীত রাখবে। জানি, মানুষের মধ্যে আবেগ আছে, আমাদেরকে আদর্শের প্রয়োজনে আবেগ পরিহার করতে হবে। ক্রুশ আমাদের এতটুকু ত্যাগ দাবী করে।

তরুণীদ্বয় কাফেলার আগে আগে যাচ্ছিল। নাসের ও সাথীরা একই কোরাস গুনগুনিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল নির্বিকার চিত্তে। যতোই রাত বাড়তে লাগল, ততই নিকটবর্তী হয়ে আসল তাদের নতুন ঠিকানা।

* * *

এই তরুণী দুটি কে? কি এদের পরিচয়। এ পর্যায়ে এদের পরিচয় জেনে নেয়া দরকার। খৃস্টান ও ইহুদী লোকেরা অতি শৈশবেই সুদর্শন মেয়ে শিশুদেরকে ধর্মের কাজে উৎসর্গ করাকে পুণ্যের কাজ মনে করে। ইহুদী-খৃস্টান পণ্ডিতেরা এদেরকে গীর্জার অধীনে নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা বৃত্তি এবং শাসকদের আদর্শচ্যুত করতে ব্যবহার করে। এদেরকে শৈশব থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়, কিভাবে পুরুষদেরকে হাত করে তার ভিতর থেকে পরিকল্পনাগুলো বের করে আনা যায়। দৈহিক ও মানসিকভাবে এরা যে কোন পুরুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। ইহুদীরাই মেয়েশিশুদের বেশী উৎসর্গ করতো একাজে। অনেক সময় মুসলিম কাফেলা আক্রমণ করে শিশুদের অপহরণ করে ওদেরকে কৌশলে প্রয়োগ করা হতো এসব কাজে। ইহুদী-খৃস্টানদের এ ধারা বহু পুরানো এবং আজো এর প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে।

এই দুটি মেয়ে খৃস্টানরা উপহার দিয়েছিল মৌসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীনকে। মুসলিম মেয়েদের মধ্যে তখন এতোটা সৌন্দর্য চর্চা, ফিগার সচেতনতা ও যাদুকরী কথা বলার ঢং ও নাচ গানের চর্চা ছিল না। কিন্তু এই দুই তরুণী যেমন সুন্দরী, নাচে-গানে বাগ্মীতা ও রূপ ঢংয়ে যে কোন পুরুষের পৌরুষকে প্রথম দর্শনেই নাড়া দেয়ার মতো আকর্ষণীয়। এদেরকে পাঠানো হয়েছিল সুনির্দিষ্ট মিশনের দায়িত্ব দিয়ে। সাইফুদ্দীন যেমন ছিল ক্ষমতা লিন্দু, তেমনই নারী লোভী। আইয়ূবীর সাথে তার ছিল চির বৈরিতা। নূর উদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুতে গভর্নর থেকে নিজেকে স্বাধীন আমীর ঘোষণা করে ক্ষমতার মোহে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সে, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারে না। এই সুবাদে এগিয়ে এলো খৃস্টানরা। ওরা টোপ দিল আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর তাহলে তোমাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করব আমরা। তবুও ওদের আশংকা ছিল; কোন এক বাঁকে সাইফুদ্দীন যদি আইয়ূবীর সাথে সন্ধি করে বসে তবে খৃস্টানদের অনেক চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাবে। কিছুতেই যাতে সাইফুদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতা থেকে ফিরে আসতে না পারে এজন্যই পাঠানো হয়েছে উপঢৌকনের মোড়কে তরুণী গোয়েন্দা।

সাইফুদ্দীন সম্মিলিত তিন বাহিনীর চীপ কমান্ডার হয়ে যখন তুকমান ময়দানে আইয়ূবীর মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে গেল তখন তার হেরেমের সুন্দরী নর্তকী, গায়িকা ও বিউটিশিয়ানদের সাথে নিয়ে গেল। এই তরুণী দুটি নিজের পরিচয় এভাবে আড়াল করে রেখেছিল যে, সাইফুদ্দীন এদেরকে ভেবে ছিল মুসলমান। এদেরও সাথে নিয়ে গেল সাইফুদ্দীন। এরা তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে নাচ, গান, শয্যাসঙ্গিনী হতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করতো না। বরং পুরুষের দুর্বলতম মুহূর্তগুলোতে ওদের গোপন পরিকল্পনা যেমন এরা বের করে আনতো অনুরূপ নিজেদের মিশনের পক্ষে শাসকদের দেমাগকে এরা বদলে দিতে সক্ষম হতো। সবই এরা করতো বাকপটুতায় ও আকর্ষণীয়া রূপে নিজেদের উপস্থাপন করে, ভোগ্যরূপে নিজেরে মেলে ধরে।

বড় তরুণীটি কয়েক দিনের মধ্যেই সাইফুদ্দীনের মন জয় করতে সক্ষম হয়। সাইফুদ্দীন হেরেমের সবার উপরে ওকে গুরুত্ব দেয়। যে কোন জটিল ও গোপন বিষয়েও ওর উপস্থিতিকে সাইফুদ্দীন নিঃশঙ্ক মনে করে। ওর যাদুকরী কথা ও অঙ্গভঙ্গি সাইফুদ্দীনের দিল দেমাগে প্রাধান্য বিস্তার করে নেয়।

সাইফুদ্দীন যুদ্ধ ময়দানকেও তার প্রাসাদে রূপান্তরিত করেছিল। আরাম আয়েশ আমোদ-সূর্তির সব উপাদানই সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। বিশাল সৈন্যবল ও রসদের প্রাচুর্যতার কারণে তার আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। তার বিপুল বাহিনী আইয়ূবীর সৈন্যদেরকে মেষ শাবকের মতো তাড়িয়ে মারবে এটাই ভেবেছিল সাইফুদ্দীন। কিন্তু বিধি বাম। মরু ঝড়ের মধ্য দিয়ে ফৌজি তার ভাবী ও ভাইকে নিয়ে গেল আইয়ূবীর শিবিরে। বলল, তিন বাহিনী আইয়ূবীর বিরুদ্ধে ধেয়ে আসছে। খবর পেয়েই প্রস্তুতি নিলেন আইয়ূবী। সাইফুদ্দীনের অজ্ঞাতে আক্রমণ করে ওদের দর্পচূর্ণ করে দিলেন।

এমতাবস্থায়ও এই দুই তরুণী সর্বক্ষণ থাকতো সাইফুদ্দীনের কাছে। তিন বাহিনীর মধ্যে বহু উঁচু অফিসার ছিল খৃস্টানদের এজেন্ট। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে এরা। তথ্য ও সংবাদ পাচার করলে ওরা ঠিক সময় মতো পৌঁছে দিতো খৃস্টান কর্তাদের কাছে।

সাইফুদ্দীনের পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী তখন ওর রক্ষিতা মেয়েরা হয়ে উঠল বোঝার উপর শাকের আঁটি। সাইফুদ্দীন সব ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। খৃস্টানদের জন্যে এই প্রশিক্ষিত মেয়ে দুটি ছিল দামী অস্ত্র। ওরা এদের উদ্ধার করতে দুটি ঘোড়া, খাবার পানি, আহার এবং তাদের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হাশীশ ও গন্ধহীন নেশাদ্রব্য বেঁধে দিল ঘোড়ার পিঠে। দিয়ে বলল, তোমরা এ পথ ধরে ঈসিয়াত দুর্গে চলে যাবে। খঞ্জর দেয়া হল এদের হাতে। যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে আত্মরক্ষায় ব্যবহার করতে পারে। এসব গোয়েন্দা মেয়েকে অস্ত্র চালনা, অশ্বারোহণ এবং মাদকদ্রব্য খাইয়ে মানুষকে ধোকা দেয়ার কৌশল পুরো মাত্রায় শেখানো হতো। সাইফুদ্দীনের বাহিনী যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, সৈন্যদের মধ্যে আত্মরক্ষা ও পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল তখন দুজন শক্তিশালী যোদ্ধা এদেরকে তুর্কমানের যুদ্ধ এলাকা পার করে দিয়ে ঈসিয়াতের পথ ধরিয়ে দিল। বড় মেয়েটি ছিল দুর্দান্ত সাহসী ও অভিজ্ঞ। দিনের বেলায় সঙ্গীকে নিয়ে ঈসিয়াত দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে থাকল সে। কিন্তু পথ ছিল দুর্গম আর মরুভূমির প্রচণ্ড তাপদাহ। দুপুর পর্যন্ত চলার পর একটি টিলার গায়ে ছায়া দেখে ওখানে ঘোড়া থামিয়ে আহারাদি সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিল এরা। এমন সময় তাদের সামনে এলো নাসেরের কাফেলা।

নাসেরও সাথীদের দেখেই বড় তরুণী বুঝে নিয়ে ছিল এরা কারা হতে পারে। তাই তাদেরকে পানি পান করিয়ে তারপর খাবারের সাথে হাশীশ খাইয়ে দিল। এরপর ওদের সাথে জিনের অভিনয় করে ভড়কে দিল এবং বিশ্বাস জন্মাল সত্যিই তারা জিন। নাসের ও সাথীরা ঘুম থেকে উঠার পর আবার ওদেরকে পানির সাথে গন্ধহীন নেশা ও হাশীশ খাওয়াল। সেই সাথে কৌশলী অভিনয় করে ওদের দেমাগকে এভাবে কজা করল যে ওরা তাদের জিন ভেবে আত্মসমর্পণ করে, পরিত্রাণের আবেদন করে বসল তরুণীদের কাছে। এই সুযোগে ওদেরকে নিরাপত্তা সহযোগী বানিয়ে তরণীদ্বয় নির্ভয়ে চলে গেল ঈসিয়াত দুর্গে।

তরুণীদের মাদক প্রয়োগ ও চার যোদ্ধাকে জিন ও বেহেশতের স্বপ্নচিত্রের মুগ্ধতায় বোধহীন করার কৌশল ছিল শেখ সিনানের শেখানো। শেখ সিনান মানুষদেরকে মাদকদ্রব্য খাইয়ে স্বপ্নময় ভুবনের কল্পনায় ভুলিয়ে দিয়ে নিজের কাজ উদ্ধার করতো। শেখ সিনানের কৌশলের উদ্ভাবক ছিল হাসান বিন সাবাহ। হাসান বিন সাবাহ ইহুদী পণ্ডিতদের শীর্ষ পর্যায়ের একজন। সেই প্রথমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমরাস্ত্রের চেয়ে মাদক, নারী ও স্বপ্নকৌশল প্রয়োগের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। তারই স্থলাভিষিক্ত শেখ সিনান। শেখ সিনান ইহুদী ও খৃস্টানদের সহযোগিতায় ঈসিয়াত দুর্গে একটি শক্তিশালী বাহিনী তৈরী করেছিল। এদেরকে বলা হতো ফিদাঈ। শেখ সিনানের কাছে হাশীশ, মাদক প্রয়োগ ও কল্পচিত্র দিয়ে মানুষকে বাগে আনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বড় তরুণী।

তরুণীদ্বয় প্রথমে নাসের ও সাথীদের উপর মাদক ও কল্পকৌশল প্রয়োগ করে ওদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। যখন দেখল তার কৌশল শতভাগ সফল হচ্ছে; তখন এদেরকে শেখ সিনানের কাছে নিয়ে গেলে ওদের রণকৌশল ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে আইয়ূবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ হতে পারে বলে মনে করল। তরুণী জানতো, ইতোমধ্যে গোমশতগীন আইয়ূবীকে হত্যার জন্য শেখ সিনানের দারস্থ হয়েছে এবং তাকে মোটা মাপের সেলামী দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।

* * *

তুর্কমানে মোজাফফর উদ্দীনের হামলা ব্যর্থ করে দিয়ে আইয়ূবী জেনারেলদের বললেন, এখন যুদ্ধ শেষ। তোমরা মালে গনীমত কুড়িয়ে জড় কর। মোজাফফর উদ্দীন ও সাইফুদ্দীনের যৌথ বাহিনীর ফেলে যাওয়া মালে গনীমত ছিল বিপুল। সাইফুদ্দীনের তাঁবু থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা, অলংকার ও মণিমুক্তা পাওয়া গেল। অনেক অলংকার যোদ্ধাদের সাথেও ছিল। এছাড়া যুদ্ধাস্ত্র, আসবাবপত্রের পরিমাণ অপরিমেয়। আইয়ূবী যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন আর নগদ অর্থ ও অলংকারাদি মিশর ও সিরিয়ার যেসব নতুন এলাকা তার অধীনে যুক্ত হয়েছিল সেসব এলাকার গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এক তৃতীয়াংশ পাঠিয়ে দিলেন বাগদাদের নেজামিয়া মাদরাসায়। যেটি তকালের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ ছিল। আইয়ূবী মাদরাসায়ে নেজামিয়া থেকেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপোলের ভাষায়, একথা প্রমাণিত যে, আইয়ূবী মালে গণীমত থেকে নিজে কিছুই রাখতেন না, সবই সেনাবাহিনী ও জনকল্যাণে খরচ করতেন।

বড় সমস্যা ছিল বহু সংখ্যক বন্দী শত্রুসেনার সুরাহা করা। আইয়ূবী তাদেরকে একত্রিত করে বললেন, তোমাদের শাসকরা ইসলামের চির শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে ওদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। তোমরা মুসলমান হয়েও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এজন্যই তোমাদের পরাজয় হয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাত সবই বরবাদ করে দিয়েছো তোমরা। তোমাদের অপরাধ ও গোনাহ ক্ষমা পাওয়ার একমাত্র পথ। হলো, ইসলামের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করা। এসো, আমরা সবাই মিলে বেঈমানদের কাছ থেকে প্রথম কিবলাকে উদ্ধার করি। আইয়ূবীর এই ভাষণ ছিল আবেগময় ও ঈমানদীপ্ত। বন্দী যোদ্ধারা আইয়ূবীর ভাষণে উদ্দীপ্ত হলো, নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অধিকাংশই তাকবীর দিতে শুরু করল এবং নিজেদেরকে আইয়ূবীর বাহিনীতে ন্যস্ত করার আবেদন করল। আইয়ূবী তাদেরকে সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত করে নিলেন। এতে তার বাহিনীতে প্রশিক্ষিত সৈন্য ও কমান্ডারের সংখ্যা বাড়ল। সৈন্য ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ হল। তদুপরি আইয়ূবী অগ্রাভিযান মুলতবি করে দিলেন। নতুনভাবে সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানোর জন্যে দামেশক ও মিশর থেকে রসদপত্র আসার অপেক্ষা করলেন। মোজাফফর উদ্দীনের আক্রমণ আইয়ূবীর বাহিনীর কাঠামো অনেকটাই নড়বড়ে করে ফেলেছিল।

* * *

ঈসিয়াত দুর্গ ছিল বর্তমান লেবানন সীমান্তে। হাসান বিন সাবাহর উত্তরসূরী শেখ সিনানের রাজত্ব ছিল সেই দুর্গে। এদেরকে দুর্গসহ সামগ্রিক সহযোগিতা দিয়েছিল খৃস্টান শাসকরা। এরা নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করতো, কিন্তু সত্যিকার ইসলামের অনুসারী ছিল না এরা। মূলত মাদক ও নেশার চর্চা করে এরা মানুষকে ধোকা দিত, হত্যা করত। শেষ পর্যায়ে ভাড়াটে খুনী গোষ্ঠীরূপেই পরিণত হয় সাবাহ গোষ্ঠী। অর্থের বিনিময়ে কয়েকজন খৃস্টান নেতাকেও হত্যা করিয়েছিল শেখ সিনান। মুসলমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করা ছিল এদের অন্যতম টার্গেট। এ টার্গেটের জন্য আরো কয়েকটি ছোট ছোট দুর্গও অস্ত্রশস্ত্র শেখ সিনানকে দিয়েছিল খৃস্টানরা। খৃস্টানদের অর্থের লোভে এরা নূর উদ্দীন জঙ্গী ও আইয়ূবী হত্যার চেষ্টায় মেতে উঠে। নূরউদ্দীন জঙ্গীকে শেখ সিনানের লোকেরাই হাশীশ খাইয়ে হত্যা করেছিল বলে মনে করেন কোন কোন ঐতিহাসিক। হাশীশ খাওয়ার কারণেই অসুস্থ হয়ে জঙ্গী কয়েক দিনের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। এরপর শুরু হয় আইয়ূবীকে হত্যার নীলনক্সা। এ নীলনক্সা প্রণীত হয় হাশীশ ও ইহুদী-খৃস্ট গোষ্ঠীর যোগসাজসে। এদেরই ফসল দুই তরুণী যখন নাসের ও তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঈসিয়াত দুর্গের প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছাল তখনও ভোরের সূর্য উঠতে ঢের বাকী। বড় তরুণী ঘোড়া থেকে নেমে সাংকেতিক শব্দে কি যেন বলল দ্বাররক্ষীদের, একটু পরেই খুলে গেল ফটক, তরুণী সবাইকে নিয়ে প্রবেশ করল দুর্গে। নাসের ও সাথীদেরকে এক অফিসারের কাছে সোপর্দ করে শেখ সিনানের কাছে চলে গেল দুই তরুণী।

শেখ সিনান নিজেকে রাজা ভাবতো। রাজা ভাবার মতো সামগ্রিক অবস্থাও ছিল তার। কিন্তু বয়সের আধিক্যে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ও চুল দাড়ি সাদা হয়ে গেলেও নিজেকে বুড়ো ভাবতে পারতো না সিনান। বড় তরুণী যখন শেখ সিনানের কাছে তার দোস্ত সাইফুদ্দীনের পরাজয় এবং তাদের পলায়নের বর্ণনা দিচ্ছিল তখন ছোট তরুণীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিনান।

এদিকে এসো! বড় তরুণী থেকে মনোযোগ সরিয়ে ছোট তরুণীকে আহবান করল সিনান। তুমি প্রয়োজনের চেয়ে বেশী সুন্দরী। আমার কাছে বসো। তরুণীকে বোগলদাবা করে তার রেশমী চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সিনান বলল, তোমরা ক্লান্ত। আজ আমার এখানেই রাত যাপন করবে।

শেখ সিনানকে ইতোপূর্বে দেখেনি ছোট তরুণী। সে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল সিনানের দিকে। এরপর ভেংচি দিয়ে দূরে সরে এলো। এই বুড়োর ন্যাকামী ভাল লাগল না তার।

হেচকা টান দিয়ে তরুণীকে কোলের উপর ফেলে দিল সিনান। ওর বক্র চাউনীতে অপমানিত বোধ করল বুড়ো। বড় তরণীকে বলল, ওকে মনে হয় আমার সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। আমার প্রতি বিদ্রূপ কতটুকু অপরাধ তা বোধ হয় ও জানে না।

আমি আপনার কেনা বাদী নই। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল ছোট তরুণী। আমার কর্তব্যের মধ্যেও এটা পড়ে না যে, যেই আমাকে কোলে টেনে নিবে আমি ওর হাতে নিজেকে সঁপে দেবো। উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল সে। বলল, আমি ক্রুশের দাসী বটে হাশীশদের কেনা বাদী নই।

বড় তরুণী তাকে ধমক দিয়ে চুপ হতে বলল, কিন্তু তরুণী বলতে লাগল, মুসলমানদের হেরেমে এ লোক আমাকে দেখেনি। আমি কর্তব্য পালন ছাড়া ওখানে কোন অপরাধ করিনি। বুড়োর বিনোদনের পাত্রী হওয়া আমার কর্তব্যের মধ্যে গণ্য নয়।

তুমি এতো সুন্দরী না হলে তোমার অপরাধ ক্ষমাযোগ্য ছিল না। বড় তরুণীকে নির্দেশের সুরে বলল, ওকে নিয়ে যাও। ঈসিয়াত দুর্গের আদব ওকে শিখিয়ে দিও।

ছোট তরুণীকে বাইরে রেখে এসে আবার শেখ সিনানের কামরায় ঢুকল বড় তরুণী। বলল–আপনার ক্ষোভ যথার্থ কিন্তু কর্তাদের হুকুম ছাড়া যে কারো আবদার আমরা রক্ষা করতে পারি না। আমি যেহেতু আপনাকে জানি এবং এ দুর্গে ইতোপূর্বেও এসেছি, এজন্য আপনার কাজের প্রয়োজনে চারজনকে ফাঁসিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। এদিকে আপনার দৃষ্টি দেয়া দরকার। সে নাসের ও সাথীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলল।

ঠিক আছে, ওই চারজনকে ব্যবহার করব আমি। এটা একটা ভাল কাজ করেছ। কিন্তু এই মেয়েকে আমার কামরায় অবশ্যই রাখবো।

এ কাজ আমার উপর ছেড়ে দিন। ও তো আর এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না। আমি ওকে আপনার কাছে আসার জন্যে রাজী করাব। সে খুশী মনে আপনার কাছে চলে আসবে। আসবে, অবশ্যই আসবে…..!

* * *

নাসের ও তার সাথীদেরকে শেখ সিনানের দুই লোক একটি কক্ষে নিয়ে গেল। নেশার ঘোরে সারারাত বিরামহীন পথ চলেছে এরা, নেশার ঘোর না কাটলেও তাদের দেহ অবসন্ন। কক্ষের মধ্যে সুসজ্জিত বিছানা। ওরা বিছানায় গা এলিয়ে দিলে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল। অপর দিকে তরুণী দুজনও সারা রাত নিঘুম কাটিয়েছে। তাদের জন্যে বরাদ্দ কক্ষে গিয়ে তারাও ঘুমিয়ে পড়ল…।

দুপুরে চোখ খুলল নাসের। চোখ মেলেই তাকাল চারপাশে। সাথীরা তখনও ঘুমে অচেতন। চারদিক বুঝতে চেষ্টা করল নাসের। চারদিকে শ্যামল সবুজের সমারোহ নেই, নেই ফুলে ফুলে ভরা অনিন্দ বাগান। পাখ-পাখালীর কল-কাকলীও নেই। নেই ভ্রমরের গুঞ্জন। পায়ের নীচে মখমলের মতো নরম ঘাসও নেই। তার মনে পড়ল সেই স্বপ্নময় চিত্র। স্মৃতিতে ভাসতে থাকল জান্নাতি দুই সুন্দরী, ফুল, পাখি ঝর্ণা। মনে পড়ল দীর্ঘ মরু সফর, কষ্ট, ক্ষুধা তৃষ্ণা, মনে পড়ল সবই। সবকিছু তার স্মৃতিতে পরিষ্কার। কিন্তু এখন সে কোথায়? এটাতো একটা সাজানো গোছানো কামরা। এখানে কয়েকটি বিছানা, সাথীরা বিছানায় অঘোরে ঘুমুচ্ছে। স্বপ্নময় চিত্র, মরু কষ্ট ও দুই তরুণীর কথা মনে পড়ল। কিন্তু এখন কোথায় আমি? এ চিন্তা ভাবিয়ে তুলল নাসেরকে।

সাথীদের সে জাগাল না। উঠে দরজার কাছে দাঁড়াল নাসের। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল সৈন্যদের আনাগোনা। ভাবনায় পড়ে গেল, এই সৈন্যরা কারা? এই দুর্গ কাদের? কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক মনে করল না সে। কারণ দুর্গটি কোন শত্রু বাহিনীরও হতে পারে। তাহলে কি সাথীদের নিয়ে বন্দী হয়ে পড়েছে সে? কিন্তু ঘরটিকে দেখে কয়েদখানা মনে হয় না। সে একজন গোয়েন্দা এবং অভিজ্ঞ সৈনিক। কাউকে কিছু না বলে জিজ্ঞেস না করেই নিজে নিজে এই রহস্যের কিনারা করতে ভাবতে লাগল। হাশীশের নেশা এখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সে নিজের প্রকৃত অবস্থায় ফিরে এসেছে। একটা গভীর সংকটের আঁচ করল নাসের। দরজার কাছ থেকে সরে এসে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এমন সময় দুজন লোক প্রবেশ করল কক্ষে। কৃত্রিম নাক ডাকার শব্দ শুরু করে দিল নাসের।

মাত্র শুয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। বলল একজন।

থাক। ওদের ঘুমিয়ে থাকতে দাও। বলল অপরজন। মনে হয় এদেরকে বেশী খাইয়ে ফেলেছে। এদের সম্পর্কে কিছু বলেছে কি?

দুই খৃস্টান তরুণী এদের ফাঁসিয়ে নিয়ে এসেছে। বলল প্রথম জন। এরা সালাউদ্দীন আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর চৌকস গোয়েন্দা। এদেরকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

চলে গেল তারা কক্ষ ছেড়ে। তাদের ভাষা বুঝল নাসের। অবস্থার ভয়াবহতায় শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল তার, কাঁটা দিয়ে উঠল শরীর। সে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, কোন দুর্গে বন্দী হয়ে পড়েছে তারা। ভয়ানক প্রতারণার শিকার হয়েছে সবাই। এখন তার জানা দরকার এই দুর্গ কাদের? এই এলাকাটি কোথায়? কোন উদ্দেশ্যে তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে? কোন উদ্দেশেই বা তাদের তৈরী করতে চায় এরা। সে জানে, কোন দুর্গ থেকে ফেরার হওয়া শুধু কঠিন নয় বরং অসম্ভব।

একটু ঘুমিয়েই জেগে উঠল ছোট তরুণী। জানালা খুলে বসে পড়ল সেখানে। সফরের সময় নিজের আবেগ ও মনের কথা প্রকাশ করে দিয়েছিল বড় তরুণীর কাছে। সে সদ্য যুবতী। অন্যান্য গোয়েন্দা মেয়েদের মতো আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এখনও। এই প্রথম কোন মিশনে প্রশিক্ষণ শিবিরের বাইরে এসেছে। তার সাথী পরীক্ষিত ও অভিজ্ঞ। সেও দেখল আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই এই তরুণীর। এজন্য মিশনে সফল হতে পারছে না। পুরুষকে আঙ্গুলের ঈশারায় নাচানোর কৌশল এখনও রপ্ত করতে পারেনি। আসলে নিজের সত্তা বিকিয়ে গোয়েন্দাগিরির এই নোংরা পেশাকে সে মেনে নিতেই পারছিল না। যদ্দরুন এসব কৌশল রপ্ত করতে পারছিল না। ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন মুসলিম শাসক ও শেরিফদের বিনোদনের খেলনায় পরিণত হয়েছিল তরুণী। এমনিতেই দীর্ঘ বিরামহীন সফরে ক্লান্ত, তদুপরি পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। ক্লান্তিকর সফরের ধকলে শরীরটা নিস্তেজ। এর মধ্যে শেখ সিনানের মতো একটা বুড়োর কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাবে দেমাগ বিগড়ে গেল তরুণীর।

বিদ্রোহ করে বসল তরুণী। এখন কি করবে সে? বড় তরুণী যে কথা দিয়ে এসে সঙ্গিনীকে যে করেই হোক সিনানের কক্ষে পাঠাবে।

ছোট বেলায় গীর্জায় সুরক্ষিত ব্যবস্থায় এই তরুণীকেও দিয়ে ক্রুশের স্বার্থে সব ধরনের অপরাধ কর্ম সম্পাদনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যৌবন স্বভাবজাত তারুণ্যের নীতিবোধ ও অন্যায়ের প্রতি যে দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তা এই তরুণীকেও ভীষণভাবে নাড়া দেয়। অন্যায়ের প্রতি বিদ্রোহ করে বসে তরুণীর যুবা মানস। খৃস্টধর্মের প্রতি তার মনের কোণে জমতে থাকে ঘৃণা। এই ঘৃণা ধ্বসিয়ে দেয় পাদ্রীদের কুসংস্কার ও মিথ্যার ভিত। যে সব পুরুষকে বাগে আনার জন্যে তাকে তৈরী করা হয়েছিল সেইসব দুর্নীতিবাজ কাপুরুষদের প্রতি ঘৃণায় তার হৃদয়ে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। এসব অপকর্মের হোতাদের চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার আগুন জ্বলতে থাকে তার কোমল হৃদয়ে। কিন্তু করার কিছুই নেই তার। সে যে বাধা কুশের অক্টোপাসে। মিথ্যার জাল ছিন্ন করে পাপাচার থেকে নিজেকে বাঁচানোর সামর্থ নেই তার, পাপ জগৎকে সে কিভাবে নির্মূল করবে? জানালার পাশে বসে উথাল-পাতাল চিন্তার কুল-কিনারা পাচ্ছিল না তরুণী। চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। পাপ জগৎ থেকে বাঁচার অথবা পালিয়ে যাওয়ার কোন পথই দেখছিল না সে।

জেগে উঠল বড় তরুণী। সঙ্গিনীকে জানালার পাশে বসা দেখে কাছে গিয়ে বসল। চোখে অশ্রু দেখে বলল, ভাই! প্রাথমিক পর্যায়ে আবেগ-অনুভূতি এমনই হয়ে থাকে। ভেবে দেখো, আমরা যা কিছু করছি, তা আমাদের জীবন সুখের জন্যে নয়, সাধ মিটানোর প্রয়োজনেও নয়, যিশুখৃস্টের মর্যাদা রক্ষার জন্যে করছি। ইসলামকে ধ্বংস করে ক্রুশের আদর্শ প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রাখো, তাহলে আর দুঃখ থাকবে না। দেখো, আমাদের সৈনিক রণাঙ্গনে লড়ছে, আর আমরা রণাঙ্গনের বাইরে প্রাসাদের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করছি, এখানে আমাদের ক্ষেত্র হচ্ছে, মুসলমান নেতাদের প্রাসাদ, আমাদের টার্গেট ওদের মাথা, আর আমাদের অস্ত্র আমাদের দেহ-রূপ। ভাই! দেহের চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলো, এটা কিছু না, তুমি যে মিশন পালন করছে তাতে তোমার অন্তর সম্পূর্ণ পবিত্র।

আমরা ক্রুশের জন্যে আমাদের দেহমন পণ্যে পরিণত করি, কিন্তু মুসলমানরা একাজে তাদের নারীদের ব্যবহার করে না কেন? আমাদের শাসক ও সৈনিকেরা মুসলমান শাসক ও সৈনিকদের মতো রণাঙ্গনে বীরত্ব দেখাতে পারে না কেন? চোরের মতো মুসলিম নেতাদেরকে হত্যা করতে কেন গোপনে চক্রান্ত করে? আইয়ূবীর এই গোয়েন্দাদের মতো আমাদের গোয়েন্দা ও সৈন্যরা কেন সাহসী হতে পারে না? আমাদের শাসক ও সৈন্যরা সাহসী হতে পারে না আত্মদুর্বলতার কারণে। মিথ্যাবাদী ও অন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারীরা কখনও সাহসী হতে পারে না, এরা কাপুরুষ। কাপুরুষ বলেই আড়ালে আবডালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। বলল ছোট তরুণী।

চুপ কর! ধমকে উঠল বড় তরুণী। এসব কথা আর কারো সামনে বললে মরতে হবে। শোন, এ মুহূর্তে আমরা শেখ সিনানের দুর্গে, এটাই রূঢ় বাস্তবতা। শেখ সিনানকে দিয়ে আমাদের অনেক কাজ। তাকে কোন অবস্থাতেই নারাজ করা যাবে না, তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে।

এই লোকটির প্রতি আমাদের ঘৃণা জন্মে গেছে। বলল ছোট তরুণী। এই লোকটি ভাড়াটে ঘাতক দলের নেতা। তাকে আমি আমার শরীরে হাত লাগানোর উপযুক্ত মনে করি না।

বড় তরুণী দীর্ঘ সময় বুঝালো ছোট তরুণীকে। অনেক কথা বলার পর ছোট তরুণীকে সিনানের কক্ষে রাত যাপনে সম্মত করলো বড় তরুণী। তাকে বলল, তুমি আমার ক্ষমতা দেখোনি। শেখ সিনানতো নস্যি, বড় বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদেরকে আঙ্গুলের ফাঁকে নাচাই আমি। সেই তুলনায় শেখ সিনান কিছুই না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সামনে কঠিন সময়। এ মুহূর্তে শেখ সিনানকে আমাদের ব্যবহার করতে হবে। তাই তাকে ক্ষেপাতে চাই না আমরা। আমি তাকে তোমার লোভ দেখিয়েছি, সে কাতরভাবে অপেক্ষা করছে। লক্ষ্মী বোনটি, ওর সাথে তুমি একটু অভিনয় করে সহজেই পরাস্ত করতে পারবে।

তুমি কি এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারো না। বড় তরুণীকে বললো ছোট তরুণী।

হ্যাঁ, যথাশীঘ্রই বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে আমরা যে এখানে আছি, সবার আগে সেই খবরটি কর্তাদের জানাতে হবে।

ঠিক এমন সময় দুজন লোক তাদের কক্ষে প্রবেশ করল। তারা চার কয়েদী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বড় তরুণী তাদের জানাল, এরা কারা, কিভাবে এদেরকে তারা এখানে নিয়ে এসেছে।

ওরা এখন কি করছে? জিজ্ঞেস করল বড় তরুণী।

মাত্রই ঘুমিয়েছে। উত্তর দিল একজন।

এদেরকে কি কয়েদখানায় অন্তরীণ করা হবে? জিজ্ঞেস করল ছোট তরুণী।

কয়েদ খানায় বন্দী করার কোন দরকার নেই। জবাব দিল অপর এক আগন্তুক। এখান থেকে পালাবে কোথায়?

আমরা কি ওদের দেখতে পারি?

কেন পারবে না? তোমাদের শিকার তারা। তাদের কাছে তোমাদেরই তো যাওয়া দরকার। যাতে তোমাদের জালে তাদের আটকে রাখতে পার।

একটু পরে বড় তরুণীর বাধা সত্ত্বেও ছোট তরুণী নাসের যে কক্ষে ঘুমুচ্ছে সেখানে চলে গেল। নাসের ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে ছিল, ছোট তরুণীকে দেখে সে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে এসেছ আমাদের? বল না, তোমরা কে, কোত্থেকে এসেছো, আর আমাদের এখানে কেন নিয়ে এসেছো?

বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে নাসেরকে দেখল ছোট তরুণী। আবেগের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠল তরুণীর মধ্যে, সে কানে কানে নাসেরকে বলল, ফেরার হতে চাও?

আমি কি করব, সেকথা তোমাকে বলব না। যা করা দরকার তা আমি করেই দেখাবো।

নাসেরের ঘনিষ্ট হয়ে গেল তরুণী। ক্ষীণ আওয়াজে বলল, আমি জিন নই, মানুষ। আমাকে ভুল বুঝবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখো।

নাসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তরুণীর দিকে। তরুণী লেপ্টে গেল নাসেরের সাথে।

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *