১. সত্যপথের সৈনিক

অপারেশন আলেপ্পো – গাজী সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবীর ফিলিস্তিন অভিযান-১ / মূল : ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ / অনুবাদ : শহীদুল ইসলাম / প্রকাশকালঃ অক্টোবর, ২০০৩

.

সেইসব মুজাহিদদের মাগফিরাত ও সাফল্য কামনায় যারা নব্য ক্রুসেডারদের আগ্রাসন থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে জীবনোৎসর্গ করেছেন এবং আযাদীর লড়াই অব্যাহত রেখেছেন।

.

লেখক, সম্পাদক ও চিন্তাবিদ মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নাদভীর প্রসঙ্গ কথা

আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে বিদ্বেষী ইহুদী-খৃস্ট শক্তির পাঞ্জা থেকে মুসলমানের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্তকরণের লক্ষ্যে যে নজিরবিহীন যুদ্ধ-জিহাদ চালিয়েছিলেন ইসলাম জগতের প্রাতঃস্মরণীয় বীর মুজাহিদ সুলতান গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী (রহ.) তা মুসলিম জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। হযরত আইয়ূবী (রহ.)-এর তাকওয়া, বুদ্ধি, সাহস, যোগ্যতা ও প্রতিভা মুসলিম মনীষার ইতিহাসে সারাজনম ধরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তার গৌরবগাঁথা গীত হবে যুগে যুগে ইতিহাসবিদদের কণ্ঠে। আর ইসলামের চিরশত্রু সমাজও রোজ-কিয়ামত পর্যন্ত বিস্মৃত হবে না এই ক্ষণজন্মা বীরপুরুষের শৌর্য-বীর্য ও গৌরবময় বিজয়াভিযানের কথা।

হযরত সুলতানের ঐতিহাসিক রাজনীতি ও সমরাভিযানের উপর ইতিহাসাশ্রিত ও বস্তুনিষ্ঠ বহু উপন্যাস মুসলিম বিশ্বের নানা স্থানে নানাভাষায় রচিত হয়েছে। এ সবের মধ্যে মশহুর একটি উপন্যাসের বাংলা তর্জমা এটি। বহুখণ্ডে প্রকাশিত এ বিশাল সাহিত্যকর্মের একটি খণ্ড কিতাব কেন্দ্র তার সম্মানিত পাঠকগণের সমীপে পেশ করতে পেরে খুবই খুশী। মহান রাব্বল আলামীনের শুকরিয়া জ্ঞাপনের পাশাপাশি কিতাব কেন্দ্র পাঠকগণের দোয়া ও সহযোগিতাও কামনা করছে, যেন আরও মূল্যবান ঐতিহাসিক কিছু বইপত্র বাংলাভাষী পাঠকের হাতে তুলে দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। আল্লাহ্ পাক যেন তাদের এ কষ্ট-সাধনা কবুল করেন।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশের বই প্রকাশের ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। কিন্তু তর্জমাকৃত পাণ্ডুলিপি হাতে না পাওয়ায় সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এ যাত্রা বিশিষ্ট আলেম-কলমসৈনিক, লেখক, অনুবাদক ও সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম তার বহু কষ্টের ফসল এই গ্রন্থটি কিতাব কেন্দ্রকে সাথে নিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। অপারেশন আলেপ্পো শিরোনামে এটি প্রকাশিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে এর পরবর্তী খণ্ডগুলো তৈরী হতে থাকবে এবং নতুন প্রজন্মের জাগ্রতহৃদয় ও সতর্কৰ্মনা পাঠকবর্গের হাতে পৌঁছুবে ইনশাআল্লাহু তাআলা।

কোনো প্রকাশনা সংস্থার জন্যে সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হচ্ছে তার প্রিয় পাঠকবর্গের সামনে নতুন গ্রন্থ পরিবেশনের ক্ষণটি। অপারেশন আলেপ্পোর মোড়ক উন্মোচনের সময়টি সামনে রেখে আমরা এর মাঝে লুক্কায়িত প্রশংসিত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো, সমরাভিযানের নায়কগণ, ঔপন্যাসিক, অনুবাদকসহ মুদ্রণ ও প্রকাশনার প্রতিটি অংশে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মাগফিরাত ও দ্বীন-দুনিয়ার মঙ্গলের দোয়া করছি। আল্লাহ কিতাব। কেন্দ্র এবং তার কমী, লেখক ও শুভার্থীগণকে ইসলামী চেতনা বিকাশের জন্যে। বিশেষভাবে কবুল করুন গোটা পৃথিবীর বুকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করার বিপ্লবী কাফেলার সাথে তাদের নামও যুক্ত থাকুক। আল্লাহুম্মা আমীন!

উবায়দুর রহমান খান নাদভী
ঢাকা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৩

.

গ্রন্থকারের কথা

আপনি একথা ভালোভাবেই জানেন না, বর্তমানে আমাদের নতুন প্রজন্মের গতি, রুচি ও লক্ষ্য বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। আমাদের জাতীয় চেতনা, ঐতিহ্য সংস্কৃতিও মারাত্মক দূষণের শিকার। যদি এ সম্পর্কে আপনার ধারণা না থেকে থাকে তবে শুনুন আমরা আপনাকে বলছি।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিস্মৃতির ও বিকৃতির প্রধান কারণ হলো; তারা আমাদের পূর্বসূরীদের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে না। তারা জানে না, তাদের পূর্ব পুরুষদের জীবন-কর্ম, বীরত্ব, সাহসিকতা, সাফল্য ও বিজয়ের কীর্তিগাথা। আমাদের শিশু কিশোর ও যুবক যুবতীরা তাদের পাঠ্য পুস্তকে মুসলিম ইতিহাস নামের যে বিকৃত একপেশে কাহিনী ও জীবনী পড়ে, এগুলোর পাতায় পাতায় আমাদের পূর্বপুরুষদের চরিত্র ও কর্মকে বিকৃত ও অসম্পূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর একাজগুলো আমাদের বন্ধুবেশী বিজাতীয় লেখক ও স্বজাতীয় কতিপয় অসতর্ক ও অধীনতাসুলভ মানসিকতাধারী পরজীবী লেখক করেছে; যাদের দৃষ্টি, রুচি ও বোধ আমাদের শত্রুদের কাছে বিক্রিত বন্ধকীকৃত। আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন ও কর্মের প্রকৃত চিত্র মুসলিম ইতিহাস নামের ওইসব পুস্তকে নেই।

অপর কারণ হলো শিশু, কিশোর ও যুবক-যুবতীরা বিনোদনমূলক গল্প ও লোমহর্ষক বিস্ময়কর কাহিনী, দুর্জয় সাহসিকতা, রোমাঞ্চকর উপাখ্যান, প্রেম, ভালোবাসা, ইত্যাকার গল্প-উপন্যাস পছন্দ করে যেগুলো মানুষের আবেগকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিমোহিত করে। মারদাঙ্গা, সংঘর্ষ, মোকাবেলায় সত্যের জয়। ও মিথ্যার পরাজয় দেখতেও নবীন মন পছন্দ করে। নবীনরা স্বভাবতই সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। স্বভাবতই তারা প্রেম ভালোবাসা ও মানবিক আবেগ উদ্বেগের প্রতি আকৃষ্ট।

আমাদের প্রতিপক্ষ ইহুদী খৃস্টান ও পৌত্তলিকরা মানবিক চাহিদাগুলোকে বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে শিশু কিশোর, তরুণ তরুণীদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিনষ্ট করে দেয়ার জন্য অশ্লীল নাটক, নোবেল, পর্ণো সিনেমা, গল্প-উপন্যাসের আশ্রয় নিয়েছে। সারা দুনিয়াব্যাপী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স প্রচার মাধ্যমে এসব কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য অপসংস্কৃতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার ষোলকলা পূর্ণ করেছে।

আমাদের স্বজাতীয় ব্যবসায়ীরা অর্থের লোভে মানবতা ও নৈতিকতা পরিপন্থী এসব সাহিত্য সংস্কৃতিকে প্রচার করছে।

নতুন প্রজন্ম ও ভবিষ্যতকে সুস্থ রাখার জন্যে, তাদের নীতি-নৈতিকতার বিকাশ এবং সুরুচি ও জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে আমরা সত্যাশ্রয়ী গল্প প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব গল্প উপন্যাস আপনি ও আপনার সন্তানদের চাহিদাকে পূরণ করার পাশাপাশি সবার আবেগকেও নাড়া দেবে। যেগুলোতে রয়েছে বিস্ময়কর উত্তেজনা, রোমাঞ্চ ও ভালোবাসার সার্বিক উপাদান। কিন্তু এগুলো পাঠক পাঠিকাদেরকে বিকৃতির দিকে নয় ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ ও সত্যাশ্রয়ী করবে, দিক-নির্দেশনা দিবে ভবিষ্যত কর্মে। দেখাবে ইতিহাসের আলোকে ভবিষ্যতের পথ। অশ্লীল বেহায়াপন্না ও নগ্নতার বিপরীতে এসব উপাখ্যান যথার্থ বিকল্প বলে আমাদের বিশ্বাস।

ক্রুসেডারদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ, গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর যুদ্ধ জিহাদ সম্পর্কে আমরা কম-বেশী জানি। জানি তিনি ইহুদী ও খৃষ্ট সম্মিলিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফিলিস্তিন ও বাইতুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করে ছিলেন কিন্তু মুখোমুখি যুদ্ধের আড়ালে দৃষ্টির বাইরেও তাকে লড়াই করতে হয়েছিল গোপন চক্রান্তের বিরুদ্ধে। গোয়েন্দাগিরি, চক্রান্তের জাল, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও গুপ্ত হামলার সেই নীরবযুদ্ধ ছিল সম্মুখ লড়াইয়ের চেয়ে আরো বেশী ভয়ঙ্কর।

গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর ফিলিস্তিন অভিযান ও বাইতুল মোকাদ্দাস মুক্ত করণের প্রারম্ভে তাকে ইহুদী, খৃস্টান ও অভ্যন্তরীণ কুচক্রীদের কি ভয়ানক চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এখানে তাই আমরা উপস্থাপন করেছি। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুরা কী ভয়ানক চক্রান্ত করেছিল, কতো নগ্ন ও অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নারীদের ব্যবহার করে মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল, যার ফলে ভয়াবহ সংঘাতে বহু রক্ত ঝরাতে হয়েছে মুসলমানদের, সেই কাহিনীই এই পুস্তকের উপজীব্য। আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই আপনার সন্তানদেরকে নোংরা, কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য থেকে দূরে রাখতে চান; তবে আমাদের সত্যাশ্রয়ী গল্প নির্ভর এই সিরিজ নির্দ্বিধায় তাদের হাতে তুলে দিতে পারেন।

–আলতামাশ

.

অনুবাদকের নিবেদন

বর্তমানে সারা বিশ্বে চলছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ক্রুসেড, যে ক্রুসেড এখন আর শুধু বাইতুল মোকাদ্দাসে সীমাবদ্ধ নয়। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন ও নিবীর্য করতে ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বে ইহুদী, খৃস্টান ও পৌত্তলিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কার্যত জোটবদ্ধ হয়ে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন চালাচ্ছে।

আর প্রথম সারির মুসলিম নেতৃবর্গ নিজেদের ক্ষমতা ও বিলাসিতা রক্ষায় শত্রুদের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে মুসলমানদের দুঃসহ যন্ত্রণা আরো তীব্রতর করছে।

বাইতুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের সংগ্রামী কাফেলা ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা এখন কোণঠাসা। ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে বাইতুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের প্রত্যাশা। এই প্রেক্ষিতে বেশী করে স্মরণযোগ্য মুসলিম মিল্লাতের গর্ব, ক্রুসেড বিজয়ী গাজী সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম। ইহুদী খৃস্টান ও অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের বিরুদ্ধে কোন যাদু বলে তিনি পদানত করেছিলেন ক্রসেডারদের?

আমরা জানি, ক্রসেডারদের পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী (রহ.)। কিন্তু কিভাবে? তাঁর জীবন ও কর্মের বাঁকে বাঁকে স্বার্থান্বেষী স্বজন, স্বজাতি গাদ্দার, হিংসুটে আমীর উমারা ও কর্তাব্যক্তিদের হঠকারিতা, প্রতারণা, বিদ্রোহ, শত্রুদের চরিত্রহনন ও মিথ্যা প্রচারণা, চতুপার্শ্বে বিছিয়ে দেয়া চক্রান্তের জাল, ইহুদী-খৃস্টানদের পাতা সুন্দরী নারী গোয়েন্দাদের ফাঁদ, শত্রুপক্ষের নাশকতা ও গুপ্ত হত্যার অক্টোপাস তাকে হতোদ্যম করতে পারেনি। শত্রুদের সকল চক্রান্ত ষড়যন্ত্র ও গাদ্দারদের হিংসাকে পদদলিত করে কিভাবে তিনি জয়ের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাই ইতিহাসের নিরীখে বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে।

সময়ের প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের ঐতিহ্য সচেতন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ-এর দাস্তানে ঈমান ফুরুশো কী সিরিজের চতুর্থ খণ্ড অবলম্বনে ফিলিস্তিন অভিযানের পূর্বাপর কাহিনীটুকুকে সত্যপথের সৈনিক শিরোনামে মাসিক আল-আশরাফ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকি। পাঠক মহলে এই ধারাবাহিক পর্বগুলো খুবই আদৃত ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রকাশিত পর্বগুলোকে বই আকারে প্রকাশের জন্য অনেকের পক্ষ থেকে অনুরোধ আসতে থাকে। সেই ধারাবাহিক পর্বগুলোই এখন গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর ফিলিস্তিন অভিযান-১ অপারেশন আলেপ্পো নামে মলাটাবদ্ধ হলো। কিতাব কেন্দ্রের সহযোগিতা এই বই প্রকাশের কাজটি সুগম হয়েছে।

আমাদের পাঠক মহল ও তরুণ প্রজন্ম যদি এই গল্প পাঠে মিত্র নির্বাচনে সতর্ক হন, শাণিত হয় তাদের আত্মউপলব্ধি তবে আমাদের এ প্রয়াস সার্থক হবে।

শহীদুল ইসলাম
২০.০৯.০৩ ইং

.

১. সত্যপথের সৈনিক

১১৭৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল। ৫৭০ হিজরী সনের রমযান মাস। নূরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর সালতানাতের গুরুদায়িত্ব সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন, কিন্তু নূরুদ্দীন জঙ্গীর ছেলে মালিক আস্-সালেহ, গোমতগীন ও গাজী সাইফুদ্দীন যৌথভাবে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। খ্রিস্টশক্তি তাদের অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। খ্রিস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে শক্তিবৃদ্ধির জন্য যৌথ বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া, উট, অগ্নিবোমা ছাড়াও রকমারী যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। খ্রিস্টানরা চাচ্ছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে। সেই সুযোগটাই তাদের হাতে এসে গেল, যখন খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের ইন্ধনে তিন ক্ষমতাধর আইয়ূবীর বিরুদ্ধে আঁতাত গড়ে তুলল, খ্রিস্টানরা হিসেব কষে দেখল সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সাথে যুদ্ধে পেরে উঠা যাবে না। এর চেয়ে যদি তার মিত্রদের বিরোধ উস্কে দিয়ে পরস্পর বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়া যায়, তবে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী ও তার মিত্র উভয় গ্রুপ দুর্বল হয়ে যাবে। এই সুযোগে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত করে প্রথম কিবলা বাইতুল মোকাদ্দাসের উপর খ্রিস্ট নিয়ন্ত্রণ পাকাঁপোক্ত করা সহজ হবে। এরপর কাবাকেও দখলে আনা সম্ভব হবে। ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে।

কিন্তু ওরা বুঝেনি, ইসলাম এমন কোন বৃক্ষ নয় যে, শিকড় কেটে দিলে শুকিয়ে মরে যাবে। ইসলাম কতগুলো কিতাব আর কিতাবের স্তূপ নয় যে, জ্বালিয়ে দিলে ছাই ভষ্ম হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে। ইসলাম একটি জীবন দর্শন। যে জীবন দর্শন কতগুলো মৌলিক বিশ্বাস ও কার্যক্রমের সমষ্টি। এসব বিশ্বাস মানুষের হৃদয় রাজ্যে বিরাজ করে, আর সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার কাজ-কর্মে। মুসলমানের অন্তঃস্থিত বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে তার কাজ-কর্ম, জীবন-যাপন। হাজার, লাখ, কোটি মানুষকে হত্যা করেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ইসলামের দর্শন, চেতনা ও বিপ্লবী ধারাকে ব্যাহত করা। ইসলামকে ধ্বংস করে দেয়ার একটিই পথ তা হলো, ইসলামের সৈনিকদেরকে জীবনদর্শন থেকে বিচ্যুত করা। মুসলমানকে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতায় অভ্যস্ত করে ফেলা। মদ, নারী আর আনন্দ সূর্তিতে মজিয়ে রাখা। তাহলে মুসলমানদের জীবন দর্শনে ঘুণ ধরবে। ধর্মের বন্ধন ও শরীয়তের বিধি-নিষেধ শিথিল হতে থাকবে। মুসলমান ধীরে ধীরে আদর্শ বিস্মৃত হয়ে ভোগবাদিতায় লিপ্ত হয়ে যাবে।

সম্মুখ সমরের চেয়ে খ্রিস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও কালচারাল যুদ্ধকে গুরুত্ব দিল। গড়ে তুলল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। অসংখ্য রূপসী তরুণীকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে কৌশলী গোয়েন্দা হিসেবে গড়ে তুলল। বিশাল বিস্তৃত নারীর ফাঁদ তৈরী করে খ্রিস্টানরা আরব বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মিশরে জালের মতো ছড়িয়ে দিল প্রশিক্ষিত নারী গোয়েন্দা। ধীরে ধীরে মুসলিম ক্ষমতাসীনদের উঁচুস্তরের কর্তা ব্যক্তিরা খ্রিস্টানদের তৈরী নারী ফাঁদে ধরা দিতে শুরু করল।

সম্ভবত মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক এটাই যে, যুগে যুগে শাসক শ্রেণীর কর্তা ব্যক্তিরাই শত্রুদের তৈরী নারীর ফাঁদে ধরা দিয়ে নিজেদের পতনকে তরান্বিত করেছে।

নূরুদ্দীন জঙ্গী ও সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর শাসনামলে ইহুদী-খ্রিস্টান শক্তির তৈরী এই সর্বনাশা মরণবিষ মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ও কর্তা ব্যক্তিদের নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছিল। এই কূটকৌশল প্রয়োগ করে খ্রিস্টানরা দখল করে নিয়েছিল অধিকাংশ মুসলিম রাজ্য। দৃশ্যত মুসলিম শাসন থাকলেও অন্তরালে খ্রিস্টানরা ওইসব রাজ্যের কর্তাব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদেরকে পুতুলে পরিণত করেছিল। মুসলমান হলেও তাদের মধ্যে ইসলামী ভাবাদর্শের লেশমাত্র ছিল না। মদ, নারী ও আরাম-আয়েশে আকণ্ঠ ডুবে থাকত। ইহুদী খ্রিস্টানদের সাথেই গোপনে গড়ে তুলেছিল বন্ধুত্ব। এদেরকে কোন অবস্থাতেই ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক ও কর্মকর্তা বলার উপায় ছিল না। নূরুদ্দীন জঙ্গী ও আইয়ূবীর জন্যে এসব গাদ্দার ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা।

১৯৭৫ সালে সুলতান আইয়ূবীর সাথে এসব অপরিণামদর্শী মুসলিম শাসকদের বিরোধ চরমে পৌঁছে। ইসলামী শাসনের পক্ষে এরা কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। খ্রিস্টানরা দূরে বসে মুসলমান শাসকদের আত্মঘাতী সংঘাতের তামাশা দেখছিল।

সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী যখন রণাঙ্গনে একের পর এক খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করছিলেন, খ্রিস্টানরা তখন সম্মুখ সমরে পেরে উঠতে না পেরে মুসলমান নেতাদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছিল এই যে, নূরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তার পুত্র মালিক আস-সালেহ ইসমাঈল আইয়ূবীর বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়ে বসে।

নূরুদ্দীন তনয় মালিক আস-সালেহ ইসমাঈল, গোমশতগীন ও সাইফুদ্দীনের যৌথ বাহিনী আইয়ূবীর হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করলে তিন কুচক্রীই রণাঙ্গন থেকে জীবন নিয়ে পলায়ন করে। নূরুদ্দীন জঙ্গীর অধীনস্থ গোমশতগীন ছিল হিরন দুর্গের অধিপতি। জঙ্গীর মৃত্যুর পর সে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সৈন্যসামন্ত রেখেও আইয়ূবীর পশ্চাৎ আক্রমণের ভয়ে হিরন যেতে সাহস পায়নি গোমশতগীন। সে গিয়ে আশ্রয় নেয় ইসমাঈলের স্বঘোষিত রাজধানী আলেপ্পোয়। আলেপ্পোকে ইসমাঈল রাজধানী ঘোষণা করেছিল।

সাইফুদ্দীন ছিল মৌসুল শহর ও তদঞ্চলের গভর্নর। একটি সামরিক ইউনিটের সেনাধ্যক্ষও ছিল সে। রণকৌশলে তার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। কিন্তু সাইফুদ্দীন ছিল স্বভাবে উগ্র, হাঙ্গামা প্রিয়, ক্ষমতা লিলু। ক্ষমতার মোহে ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিল খ্রিস্টানদের কাছে। যে ঈমান শুধু মুসলমানদের বিশ্বাসগত বিষয় নয়, যুদ্ধের ময়দানে ঈমানের শক্তিই মুজাহিদদের ঢাল তরবারীর মূল রক্ষাকবচ।

যুদ্ধের ময়দানেও সাইফুদ্দীন বিলাস-ব্যসন ত্যাগ করতে পারেনি। হেরেমের সুন্দরী নারী, সেবিকা, দাসী ও নর্তকীদের নিয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে কাড়ি কাড়ি মদের মটকি, নাচ-গানের সরঞ্জামাদি আর বাহারী পাখি। কিন্তু হতভাগা সবকিছু রণাঙ্গনে ফেলেই জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল। যাওয়ার কথা ছিল মৌসুল কিন্তু আইয়ূবীর পশ্চাদ্ধাবনের ভয়ে বিক্ষিপ্ত পলায়নপর সৈনিকদের মতো সে মৌসুলের পথে না গিয়ে বিজন এলাকা দিয়ে তার ডিপুটি ও এক কমান্ডারকে সাথে নিয়ে অন্যদিকে রওয়ানা হল।

পলায়নপর সাইফুদ্দীন ও সাথীরা হয়তো সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কমান্ডোদের দেখতে পেয়েছিল, তাই তারা মৌসুলের পথ ছেড়ে বিপথে রওয়ানা হল। সে সময়কার পরিবেশ ছিল পলায়ন ও লুকিয়ে থাকার উপযোগী। অসংখ্য, মরুটিলা, বালিয়াড়ী, ঝোঁপঝাড়, গাছপালা আর বিজন প্রান্তর ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। এরা এসব অনাবাদী পথেই ঘোড়া হাঁকাল। রাতের আঁধারে পালাতে পালাতে মৌসুলের কাছেই পৌঁছে গেল সাইফুদ্দীন। ক্লান্ত, শ্রান্ত, ভীত সাইফুদ্দীন ও সাথীরা চাঁদনী রাতের আলোতে একটি পল্লী দেখতে পেল। পল্লীর প্রথম বাড়িতে গিয়ে একটি ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল। সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। আরোহীরা হাঁপাচ্ছিল। বৃদ্ধ তাদের দেখে বললেন, মনে হয় তোমরা মৌসুলের সৈনিক। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছ। দুদিন ধরেই দেখছি সৈনিকেরা পালিয়ে আসছে। এখানে এসে তারা ঘোড়া থামিয়ে পানি পান করে মৌসুলের দিকে চলে যাচ্ছে।

এখান থেকে মৌসুল কত দূর? জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।

তোমাদের ঘোড়া যদি চলতে পারে তবে সকাল পর্যন্ত তোমরা মৌসুল পৌঁছে যেতে পারবে। এ গ্রামটি মৌসুলের অধীনে পড়েছে।

তোমার এখানে যদি জায়গা থাকে তবে কি আমরা রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি? অনুরোধের স্বরে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।

জায়গা শুধু থাকলেই হয় না, পথিকের আশ্রয় করে দেয়া হৃদয়ের ব্যাপার। তোমরা ঘোড়া থেকে নেমে ভিতরে এসো।

বৃদ্ধ একটি ঘরে নিয়ে বসাল তাদের। বাতির আলোতে বৃদ্ধ পরখ করল তাদের পোষাক।

তুমি কি আমাদের চেনার চেষ্টা করছো? জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।

দেখে মনে হচ্ছে তোমরা সাধারণ সৈনিক নও। তোমাদের মর্যাদা হয়তো সেনাপতি পর্যায়ের হতে পারে। বলল বৃদ্ধ।

ইনি মৌসুলের গভর্নর গাজী সাইফুদ্দীন। বলল সাইফুদ্দীনের ডিপুটি। তুমি কোন সাধারণ মানুষকে আশ্রয় দাওনি। এজন্য তুমি অনেক পুরস্কার পাবে। আর আমি ডিপুটি গভর্নর। সে একজন কমান্ডার।

একটা কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুন বুড়ো। বলল সাইফুদ্দীন। তোমার বাড়িতে আমাদের একাধিক দিনও থাকতে হতে পারে। আমরা দিনের বেলায় ঘর থেকে বের হব না। আমরা যে এখানে আছি একথা কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। একথা যদি বাইরে প্রকাশ পায় তবে কিন্তু তোমাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর আমাদের অবস্থানের ব্যাপারটি চেপে রাখলে তোমাকে বহু। ইনাম দেয়া হবে। তুমি যা চাইবে তাই দেয়া হবে।

আমি মৌসুলের গভর্নরকে আশ্রয় দিচ্ছি না। তোমরা হয়তো ভুলে গেছো যে, তোমরা এখন আমার এখানে বিপদগ্রস্ত আশ্রয়প্রার্থী। আশ্রয়প্রার্থী যেই হোক, তাকে আশ্রয় দেয়া আমার কর্তব্য। তোমাদের যতদিন ইচ্ছা থাকো, সাধ্যমতো আমি তোমাদের খেদমত করার চেষ্টা করব। তোমরা লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করলে লুকিয়েই রাখব। তোমাদের প্রতি আমার বেশী আগ্রহের কারণ হলো, আমার ছেলে মৌসুল সেনাবাহিনীতে চাকরী করে।

আমরা তাকে প্রমোশন দিয়ে দেবো। বলল ডিপুটি।

তোমরা যদি তাকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করো সেটিই হবে আমার জন্য বড় পুরস্কার।

এ্যাঁ! একি বললে বুড়ো? প্রত্যেক বাবাই চায় তার ছেলের পদোন্নতি হোক। বলল সাইফুদ্দীন।

না। আমি তার বেঁচে থাকার আশাও কখনো করিনি। আমি জাতীয় সেনাবাহিনীতে তাকে পাঠিয়ে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছিলাম। আমিও একদিন সৈনিক ছিলাম। তখন হয়তো তোমাদের জন্মই হয়নি। আমি তোমাদের বাবা কুতুবুদ্দীনের অধীনে যুদ্ধ করেছি। আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাত নসীব করুন। আমরা যুদ্ধ করেছি কাফেরদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তোমরা আমার ছেলেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। আমি তার মৃত্যু নয় শাহাদত কামনা করেছিলাম।

সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী নামে মুসলমান। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয। শুধু জায়েয বললে যথার্থ হয় না বরঞ্চ ফরয। বলল সাইফুদ্দীন।

বুড়ো, তুমি এসব বুঝবে না। কে মুসলমান আর কে কাফের এসব ব্যাপার আমরা বুঝি। বলল ডিপুটি।

মিয়ারা! তোমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ। আমার বয়স এখন পঁচাত্তর। আমার বাবা নব্বই বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। তার বাবা পঞ্চাশ বছর বয়সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। দাদা জিহাদের কাহিনী আমার বাবাকে শোনাতেন। আমরা বাবার কাছ থেকে শুনেছি। এর উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি, আমি যা জানি তোমরা তা জান না। ক্ষমতা আর রাজত্বের লোভে যারাই ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে, তাদেরকে একদিন না একদিন আমার মতো গরীবের পর্ণকুঠিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তোমাদের আগে যারা পালিয়ে এসেছে, তাদের অবস্থাও তোমাদের মতোই। তোমাদেরকে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর একজন মাত্র সৈনিক তাড়িয়ে এনেছে। দুদিন ধরে আমি এই তামাশাই দেখছি। তোমরা দশজন হলেও ওই একজনের ভয়ে এভাবেই পালাতে। সত্যের উপর যারা থাকে তাদের আত্মবল এমনি হয়। ওরা একা দশজনকে ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে নিতে পারে। আর সত্যের সৈনিক কখনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালায় না। রণাঙ্গন থেকে তার লাশ উঠিয়ে আনতে হয়।

তোমাকে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সমর্থক মনে হচ্ছে। তোমার উপর আমাদের ভরসা করা ঠিক হবে না। উম্মামাখা কণ্ঠে বলল সাইফুদ্দীন।

আমি তোমাদেরও সমর্থক। মূলত আমি ইসলামের সমর্থক, সত্যের পক্ষে। আমি তোমাকে বলতে চাচ্ছি যে, তুমি তোমার ধর্মীয় ভাইয়ের শত্রুকে বন্ধু মনে করছে। এ বিষয়টি মোটেও চিন্তা করোনি যে, এরা বন্ধু বেশে ইসলামের দুশমন, তোমার আমার সবার শত্রু। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈনিকরা অতর্কিতে এখানে আক্রমণ করলেও তোমাদের আমি লুকিয়ে রাখতে পারব।

ইত্যবসরে একটি কিশোরী খাবার নিয়ে এলো। তার পিছনে আসল এক যুবতী। কিছুটা বয়স্কা হলেও রূপ-লাবণ্য দৃষ্টি কাড়ার মতো। সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি কিশোরীর শরীরে আটকে গেল। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল সে।

কিশোরী খানা রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কিশোরী চলে যেতেই সাইফুদ্দীন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি কে?

মেয়েটি আমার কন্যা। আর যুবতী আমার পুত্রবধূ। আমার যে ছেলে মৌসুল সেনাবাহিনীতে চাকরী করে তার স্ত্রী। আমার মনে হয় যে, আমার এই পুত্রবধূটি বিধবা হয়ে গেছে। বলল বৃদ্ধ।

তোমার ছেলে মারা গিয়ে থাকলে আমরা তোমাকে অনেক টাকা দেব। বলল, সাইফুদ্দীন। আর মেয়ের ব্যাপারেও তোমাকে ভাবতে হবে না। একে কোন সিপাহীর বউ হয়ে কুড়ে ঘরে থাকতে হবে না। একে বিয়ের জন্য আমরাই পছন্দ করে নিয়েছি।

আমি আমার ছেলেকে বিক্রি করিনি, কন্যাকেও বিক্রি করতে চাই না। বলল বৃদ্ধ। কুড়ে ঘরে লালিত-পালিত কোন মেয়ের জন্যে সিপাহীর বউ হয়ে কুড়ে ঘরে থাকাই মানায়। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, আমাকে কোন লোভ দেখানোর দরকার নেই। মেহমানের মর্যাদা নিয়ে তোমরা থাক। আমাকে সেবা করার সুযোগ দাও।

তুমি শুয়ে পড়। তোমার উপর আমাদের আস্থা আছে। আমাদের দেশে এখনও তোমার মতো নীতিবান লোক রয়েছে, তা জেনে খুশী হলাম।

বৃদ্ধ চলে গেলে সাইফুদ্দীন সাথীদের বলল, এ ধরনের ব্যক্তিরা ধোকা দেয়। তোমরা কি বুড়োর মেয়েটিকে ভালভাবে দেখেছ?

একটা হিরের টুকরো। বলল ডেপুটি।

পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়ে এলেই এই টুকরো আমার প্রাসাদেই থাকবে। স্মিত হেসে বলল সাইফুদ্দীন।

এবার ডিপুটির দিকে ঝুঁকে বলল, তুমি তাড়াতাড়ি মৌসুলের খবর নাও। সৈনিকদের একত্রিত করে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে আমাকে শীঘ্রই সংবাদ দাও, আমি মৌসুল আসবো না এখানে আরো কিছুদিন থাকবো, জানাও।… আর তুমি, কমান্ডারের দিকে ঝুঁকে, শীঘ্রই আলেপ্পো যাও। ওখানে গিয়ে বলো, আমি কোথায় আছি। নিজে যাও, না হয় নির্ভরযোগ্য কাউকে পাঠাও।

ডিপুটি ও কমান্ডার তখনই রওয়ানা হয়ে গেল। যে সাইফুদ্দীন মদ, নারী ও মহলের ফরাশ ছাড়া ঘুমাতেপারে না, সে কাঁচা ঘরের চাটাইয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল।

একদিন আগের ঘটনা। রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে মৌসুলের দিকে যাচ্ছিল এক সৈনিক। কখনও সে ঘোড়া খুব দ্রুত দৌড়াত। কখনও থেমে পড়ত। পিছন দিকে তাকাতো। আর কখনো ধীরে ধীরে চালাত। বারবার বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতো পিছনের দিকে। এদিক ওদিক দেখতে এই বুঝি পিছনে কেউ ধাওয়া করছে ভেবে ভয়ে থমকে যেতো। রাস্তা ছেড়ে এবড়ো থেবড়ো পথে যাচ্ছিল সে। দেখে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন। ভীত আতংকিত। কি করবে, কোন দিকে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এক জায়গায় এসে ঘোড়া থামিয়ে কেবলার দিকে ফিরে দুরাকাত নামায পড়ল সৈনিক। নামায শেষে দুআর জন্য হাত উঠিয়ে অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। হাত উঠাল তো উঠালো। আর নামানোর নাম নেই। আকাশের দিকে মুখ করে ঠাই বসে রইল।

স্বজাতি গাদ্দার সম্মিলিত তিন কুচক্রীর সৈনিকেরা যখন আইয়ূবীর কাছে পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করেছিল তখন এদের পোশাকেই আইয়ূবীর চৌকস গোয়েন্দারা পলায়নপর সৈনিকদের সহগামী হয়ে গেল। এটা ছিল আইয়ূবীর একটি গোয়েন্দা কৌশল। পরাজিত পলায়নপর সৈনিকদের পিছনে তার কিছু সংখ্যক গোয়েন্দা মিশে যেত। এরা এদের সাথে চলে যেতো তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এবং বহুরূপী বেশ ধারণ করে পর্যটকের মতো শত্রুদের অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে প্রতিপক্ষের পরবর্তী তৎপরতা এবং সাধারণ মানুষের মনোভাব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতো। দামেস্ক থেকে মালিক আস-সালেহ পলায়নের সময় আইয়ূবীর বহু গোয়েন্দা সাধারণ মানুষের বেশ ধরে ওদের পিছনে চলে গিয়েছিল। এসব গোয়েন্দা খুব মেধাবী, সাহসী, দৃঢ়চেতা, দুরবস্থার মধ্যেও লক্ষ্যে অবিচল থাকার মতো করে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা হতো। যুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমেই আইয়ূবী বিজয়ের অর্ধেক অর্জন করে ফেলতেন, বাকী অর্ধেক বিজয়ের জন্যে তাকে ময়দানে লড়তে হতো।

১১৭৫ সালের এপ্রিলে সম্মিলিত কুচক্রী বাহিনীর পরাজয়ের সাথে সাথেই আইয়ূবীর সেনাপতি হাসান আব্দুল্লাহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দাদের পলায়নপর সৈনিকদের পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ওদের পোশাকে সজ্জিত করে। এরা হিরন ও মৌসুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। তন্মধ্যে অনেকেই গ্রাম্য মানুষের পোশাকেও ছিল।

তিন কুচক্রীর মধ্যে পরস্পর সদ্ভাব মোটেও ছিল না। তিনজনই ছিল ক্ষমতা লোভী এবং একে অন্যের শত্রু। কিন্তু বিশাল সাম্রাজ্যের লোভে এরা আইয়ূবীকেই শত্রু ভাবতে থাকে এবং আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যৌথ যুদ্ধের আয়োজন করে বসে। তাই আশঙ্কা ছিল এরা লজ্জাজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সৈন্যদের সংগঠিত করে আবার প্রতি আক্রমণ চালাতে পারে। এজন্য এদের তথ্য নেয়ার বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আইয়ূবী জানতেন, ভোগবিলাসে লিপ্ত নীতিহীনরা যুদ্ধ ময়দানে টিকতে পারে। কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার ছিল, আইয়ূবী জানতেন ওদের পিছনে রয়েছে ইহুদী, খ্রিস্টানদের অবারিত সাহায্য সহযোগিতা এবং পরামর্শদাতা। তাছাড়া আইয়ূবীর উঁচু পর্যায়ের কতিপয় সেনা কর্মকর্তাও লোভে পড়ে শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছিল, যারা আইয়ূবীর যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে জানত। এরা এবং ইহুদী খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের সম্মিলনে আইয়ূবীর জন্যে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

দাউদ। আইউবীর বিশেষ গোয়েন্দাদের একজন। সেও মৌসুল পলায়নপর সৈনিকদের পিছনে সাধারণ গ্রাম্য মানুষের পোশাকে বেরিয়ে পড়েছিল।

দাউদ দুআরত সৈনিকের কাছে ঘোড়া থামিয়ে দিল। সৈনিক এতোই ভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে, আরেকটি অশ্বারোহীর আগমন মোটেও টের পেল না। দাউদ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলে সৈনিক হকচকিয়ে উঠল। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পিছনের দিকে তাকাল। দাউদ তার পাশে বসতে বসতে বলল, আমি বলতে পারি, তুমি যুদ্ধ ময়দান থেকে পালিয়ে এসেছো। তো ভাই! তোমার এই অবস্থা কেন? আহত কিংবা অসুস্থ হলে আমি তোমার সেবা করতে পারি।

না ভাই! আমার শরীরে কোন জখম নেই। আমি আহতও হইনি। কিন্তু আমার বুক ভেঙ্গে গেছে। দুঃখ সহ্য করতে পারছি না। আমি সৈনিক খান্দানের ছেলে। পেশাগতভাবে আমার বাবা ও দাদা সৈনিক ছিলেন। কিন্তু আমরা আল্লাহর পথের সৈনিক। ইসলামের জন্যে আমরা যুদ্ধ করি। পেশা হিসেবে নিলেও সত্যের পথে যুদ্ধ করা আমাদের হৃদয়ের খোরাক। আমি জানি খ্রিস্টান আমাদের শত্রু, আমাদের প্রথম কিবলা খ্রিস্টানদের কজায়। শত্রু-মিত্রের পার্থক্য আমি আমার সৈনিক বাবার কাছ থেকে শিখেছি। পারিবারিক ঐতিহ্য ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষার্থে মৌসুল সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। কিন্তু কিছুদিন পরই আমাকে বলা হলো সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী ইসলামের দুশমন, খ্রিস্টানদের মিত্র। খুব খারাপ লোক। অথচ আমরা জানতাম, আইয়ূবী খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাইতুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন।

মৌসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীন আমাদেরকে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠালো। রণাঙ্গনে পৌঁছে আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদেরকে ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে ঠেলে দিয়ে সাইফুদ্দীন নিজেকে সুলতান বানাতে চাচ্ছে। আইয়ূবীর সৈন্যরা চিৎকার করে আমাদের বলছিল, ভাইসব! আমরা সবাই মুসলমান। আমরা তোমাদের শত্রু নই, খ্রিস্টানরা আমাদের শত্রু। ক্ষমতালোভীদের প্ররোচণায় ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করো না। আমাদের সাথে এসো, এসো প্রথম কেবলাকে শত্রু মুক্ত করি। আমি তাদের পতাকা দেখেছি। কি সুন্দর কলেমা খচিত। দোস্ত! আমি আইয়ূবীর সৈনিকদের যেভাবে যুদ্ধ করতে দেখেছি, তাতেই আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে যে, তারাই সত্য পথে, আল্লাহর সাহায্য তাদের উপর রয়েছে। তাদের পরাজিত করার ক্ষমতা কারো নেই।

সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈনিকদের তৎপরতা দেখে আমার হৃদয় আল্লাহর ভয়ে কেঁপে উঠল। আমি রণাঙ্গন থেকে পলায়নের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার পাশেই ছিল একটি টিলা, আমি এর আড়ালে চলে গেলাম। আমার হৃদয়ে মৃত্যু নয় আল্লাহর ভয় তীব্র হয়ে উঠল। আমার বাহু শিথিল হয়ে গেল। তরবারীর ভার বহন করতে পারছিলাম না। ঘোড়ার লাগাম সামলাতে অক্ষম হয়ে গেলাম। ঘোড়াটিকে আমি টিলার আড়ালে নিয়ে গেলাম। আমি কাপুরুষ নই, কিন্তু কাপুরুষোচিত মৃত্যু আমাকে তাড়া করছিল। সারা শরীর অবশ হয়ে পড়ছিল। টিলার ওপাশে শোনা যাচ্ছিল তরবারির ঝনঝনানি, অশ্বের হ্রেষারব, সৈনিকের গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনি। আইয়ূবী বাহিনীর সৈনিকেরা বলছিল, ভাইয়েরা! পবিত্র রমযানে ভাইদের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ করো না।

তাদের আহ্বান শুনে আমার হৃদয় রাজ্যে ভেসে উঠল, যুদ্ধে তো রোযা মাফ হয়ে যায়, কিন্তু সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈনিকেরা ছিল রোযাদার। ইতিমধ্যে আমি প্রতিপক্ষের তিন সৈনিককে শহীদ করেছি। তাদের তপ্ত খুন আমার তরবারীতে লেগে জমে রয়েছে। যোদ্ধা তরবারীতে রক্ত দেখে উল্লসিত হয়, কিন্তু আমি তরবারীতে রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেলাম। কেননা, আমার তরবারীতে ছিল ভ্রাতৃহত্যার খুন…!

এমতাবস্থায় যুদ্ধ করার সাহস আমি হারিয়ে ফেললাম। বের হয়ে যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। আমি টিলার আড়ালেই দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনায় ধুকছিলাম। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর এক সৈনিক আমাকে দেখে ফেলল এবং আমাকে শাসাচ্ছিল। সে আমার দিকে বর্শা উত্তোলন করল, আমি তার ঘোড়ার পায়ে তরবারী ফেলে দিয়ে বললাম, আমি তোমাদেরই ভাই, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা আমার নেই। অদূরেই চলছিল প্রচণ্ড লড়াই। সম্ভবত সৈনিকটি ছিল আইয়ূবীর গেরিলা বাহিনীর সদস্য। সে লুকিয়ে থাকা শত্রু সৈনিকদের খুঁজছিল। সে অগ্রসর হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বুঝতে পেরেছ যে তোমার অবস্থান সত্যের বিরুদ্ধে? আমি আমার অপরাধ স্বীকার করলাম। বললাম, এ অপরাধ আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে, আমাকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। সে আমার কাছ থেকে বর্শা নিয়ে নিল, তরবারী তো আমি আগেই সমর্পণ করেছিলাম। সে আমাকে ইঙ্গিতে বলল, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা কর। পেছনে তাকাবে না, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি তোমার জীবন ভিক্ষা দিলাম। যাও।

প্রতিপক্ষের উদারতায় আমার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রণক্ষেত্রে শত্রু সৈনিক কখনো জীবন ভিক্ষা দেয় না। আমি ঘোড়া হাঁকিয়ে দিলাম। অনির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হলাম। পথটা ছিল নিরাপদ, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি রণাঙ্গন থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে এলাম। সন্ধ্যা নেমে এল, পথেই একটা ঝোঁপের আড়ালে ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে তিন সৈনিক আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, যারা আমার তরবারীর আঘাতে শহীদ হয়েছে। তাদের শরীর থেকে তখনো টপটপ করে রক্ত ঝরছে। এরা আমার চতুষ্পর্শ্বে ধীরে ধীরে ঘুরছিল, তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। তারা আমাকে কিছু বলছিলও না, কিন্তু ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। শিশুদের মতো আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, প্রচণ্ড শীতের রাতেও আমি ঘেমে নেয়ে উঠলাম। ভীতি, শঙ্কায় আমার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। তায়াম্মুম করে নফল পড়তে দাঁড়ালাম, মনের অজান্তেই অঝোরে কান্না পেল। নামাযের ভিতরেই সশব্দে আমি আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলাম……। লাগাতার তিনচার দিন এভাবে আমার কাঁটল। লোকালয় থেকে অনেক দূরে বিজন কণ্টকাকীর্ণ পথে ঘোড়া হাঁকিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। অনিদ্রা, ক্ষুধা, পিপাসা আমাকে দুর্বল করে ফেলল। কিন্তু ঐ মৃত তিন সৈনিকের আত্মা আমাকে তাড়া করছিল। আমি ঘুমাতে পাড়তাম না। দিনের বেলায়ও এদের অবয়ব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত। আমি তাদের হাঁক শুনতে পেতাম। তাদের তাকবীর ধ্বনি আমার কানে বেজে উঠত। আমি এদিক-ওদিক তাকাতাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেতাম না। মনে হত আমার পেছনে কেউ আসছে, পেছনে তাকাতাম, কেউ নজরে পড়ত না। যে সৈনিক আমার পলায়ন দেখে ফেলেছিল সে যদি আমাকে হত্যা করে ফেলত তাহলে ভালোই হত। এই মরণ-যন্ত্রণায় আমাকে ভুগতে হত না। আমার জীবন ভিক্ষা দিয়ে সে বড় জুলুম করেছে। অবস্থা এমন। হল, আমার হাতে তরবারি থাকলে আমি আত্মহত্যা করতাম। আমার মন আমাকে সারাক্ষণ এই বলে শাসাচ্ছিল, তুই রাসূলের তিন মুজাহিদকে হত্যা করেছিস, তোর মুক্তি নেই…!

তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে বলল দাউদ। এটা আল্লাহর রহমত যে, তুমি আত্মহত্যা করনি অথবা খোদাদ্রোহী সৈনিক হিসেবে নিহত হওনি। রণাঙ্গন থেকে তুমি পালাতে পেরেছ। এ থেকেই বোঝা যায়, আল্লাহ্ তোমার দ্বারা কোন ভাল কাজ নেবেন। আল্লাহ্ তোমাকে সুযোগ দিয়েছেন অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার, অপরাধের কাফফারা দেয়ার।

আচ্ছা বলতো, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সম্পর্কে আমাকে যা বলা হয়েছে এসব কি সত্য না মিথ্যা?

সম্পূর্ণ মিথ্যা, বলল দাউদ। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী খ্রীস্টানদের এখান থেকে বের করে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান আর সাইফুদ্দীন ও তার সহযোগিরা ক্ষমতা লিপ্সায় খ্রীস্টানদের ক্রীড়নক হয়ে ওদের স্বার্থ রক্ষা করছে, ওদের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলছে। বেঈমান কাফেরদের সহযোগিতায় আল্লাহর সৈনিক সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। দাউদ সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তৎপরতা বিস্তারিত বলল। অথচ সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে সাইফুদ্দীন বাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে কত অসত্য কথাই না সে শুনেছে। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী বিলাসী, ক্ষমতা লিন্দু। ওরা আরো বলেছিল, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী রণাঙ্গনেও তার আরাম-আয়েশের সকল সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। অথচ বাস্তবে আইয়ূবীর মধ্যে এসবের নাম-গন্ধও নেই।

আচ্ছা! আমাকে বল, আমি তিন সৈনিক হত্যার প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করব? দাউদকে জিজ্ঞেস করল সৈনিক। এই বোঝা যদি আমার হৃদয় থেকে অপসারণ না করি তবে আমাকে ভয়ঙ্কর পরিণতি বহন করতে হবে। এর প্রায়শ্চিত্তের জন্য যদি সাইফুদ্দীনকেও হত্যা করতে হয় তাও আমি করব। তবুও আমাকে আল্লাহর সৈনিক হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।

না, এমনটার দরকার হবে না, বলল দাউদ। আচ্ছা তোমার সাথে কি আমাকে নেবে?

তুমি কে? জিজ্ঞেস করল সৈনিক। ওহ্! এখন পর্যন্ত আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, কি তোমার নাম, কি তোমার পরিচয়, কোত্থেকে এসেছ, কোথায় যাবে?

কৌশলী পরিচয় দিল দাউদ। আমার নাম দাউদ, আমি মৌসুল যাচ্ছি। আমি ওখানকার বাসিন্দা। যুদ্ধের কারণে রাস্তা ছেড়ে এদিকে এসেছি। তোমার গ্রাম যদি পথে পড়ে তাহলে আমি সেখানে থামব।

আমার গ্রাম বেশি দূরে নয়, বলল সৈনিক। তুমি আমার গ্রামে না থামলেও আমি তোমাকে জোর করে থামাব। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ, অস্থির চিত্তকে স্থির করেছ। এমন সুন্দর কথা জীবনে আমি কখনো শুনিনি। এখন আমি ঘরেই ফিরে যাব, জীবনে আর কোনদিন মৌসুল বাহিনীতে ফিরে যাব না। আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে।

* * *

মৌসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীন বৃদ্ধের কুঁড়ে ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। লাগাতার কয়েক রাত সে ঘুমাতে পারেনি। সে এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল যে, তার ঘরের পাশেই দরজায় কড়া নাড়া এবং দুই আরোহীর আগমন ও অশ্বের হেষারব তার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। তখন প্রায় মধ্য রাত। শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধের ঘুম ভেঙ্গে গেল, তার কন্যা ও পুত্রবধূও জেগে উঠলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বৃদ্ধ বলল, মনে হয় সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তাড়িয়ে দেয়া মৌসুল বাহিনীর কোন কমান্ডার অথবা সৈনিক এসেছে। পথের পাশে বাড়ি থাকাই মুশকিল। বৃদ্ধ দরজা খুলল, বাইরে দুই অশ্বারোহী দাঁড়ানো। তারা ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে। হারেছ সালাম করল, বৃদ্ধ তাকে জড়িয়ে নিল বুকে। কিন্তু মুখে আবেগের কিছুই প্রকাশ করল না। শুধু বলল, বাবা! আমি বড্ড আনন্দিত যে, তুমি হারাম মৃত্যু থেকে বেঁচে এসেছ। অন্যথায় যতদিন আমি বেঁচে থাকতাম, আমাকে শুনতে হতো তোমার ছেলে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঈমানী মৃত্যুবরণ করেছে। সে দাউদের সাথেও মুসাফাহ্ করল। দাউদ কি যেন বলতে চাচ্ছিল, বৃদ্ধ ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে কানে কানে বলল, তোমাদের গভর্নর সাইফুদ্দীন ভিতরে ঘুমিয়ে আছে। আস্তে করে ঘোড়াদুটো ওপাশে বেঁধে রেখে ভিতরে এসো।

সাইফুদ্দীন! বিস্ময়ে অভিভূত কণ্ঠে বলল হারেস। সে এখানে কোত্থেকে এল?

পরাজিত হয়ে। কানে কানে বলল বৃদ্ধ। এসো বাবা! আগে ভিতরে এসে স্থির হও। তারপরে সব বলা যাবে। ঘোড়া দুটো বেঁধে রেখে দাউদ ও হারেস ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। হারেসই ছিল বৃদ্ধের সেই ছেলে; যার কথা সে সাইফুদ্দীনকে বলেছিল। দাউদকে হারেস তার শয়ন কক্ষে নিয়ে গেল এবং পরিচয় দিতে দিতে বলল, এর নাম দাউদ। তার মত বন্ধু আর হতে পারে না।

তুমিও কি পালিয়ে এসেছ? জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধ।

না আমি সৈনিক নই, জবাব দিল দাউদ। মৌসুল যাচ্ছিলাম, যুদ্ধ আমাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। পথে হারেছের সাথে দেখা। তার সাথে এখানে এলাম।

আব্বা! আমাকে বলুন তো, মৌসুলের গভর্নর এখানে কি করে এল? তীর্যক ভাষায় জানতে চাইল হারেস।

পিতা বললেন, আজ রাতেই এরা এসেছে। সাথে ডিপুটি ও এক কমান্ডার ছিল। ওদেরকে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি শুধু এতটুকু শুনতে পেয়েছিলাম, সাইফুদ্দীন ডিপুটিকে বলছিল, বিক্ষিপ্ত সৈনিকদেরকে একত্রিত করে আমাকে বল আমি কবে নাগাদ মৌসুল আসব এবং কতদিন পর্যন্ত এখানে লুকিয়ে থাকব…। এতটুকুই আমি দরজার এপাশ থেকে শুনতে পেয়েছিলাম।

আপনি কি এদের কথায় মনে করেন যে, এরা আবার সৈনিকদের পুনর্গঠিত করে প্রতি আক্রমণ করবে? বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল দাউদ।

এ মুহূর্তে এরা খুব ভীতু। আমাকে সাইফুদ্দীন অনুরোধ করেছিল, কেউ যেন তাদের অবস্থান জানতে না পারে। বৃদ্ধ আরো বলল, আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা এদের আছে। এই উদ্দেশেই কোন অজানা গন্তব্যে কমান্ডারকে পাঠিয়েছে।

আমি একে হত্যা করব, বলল হারেস। মুসলমানকে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে ঠেলে দিয়েছে। আল্লাহু আকবার তাকবীর বলে ভাই ভাইকে হত্যা করছে। ও আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলেছে। হারেস খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠল, দেয়ালে ঝুলন্ত তার বাবার তরবারি হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্ধত হল।

তার বাবা পিছন থেকে ঝাঁপটে ধরল তাকে। দাউদ তার বাজু ধরল। অসহায় হয়ে পড়ল হারেস। পিতা তাকে বলল, আগে আমার কথা শোন। দাউদও তাকে বলল, আগে মাথা ঠাণ্ডা করে কি করতে হবে ভেবে নাও। আমরা তাকে হত্যা করেই স্বস্তি নেব কিন্তু এর আগে আমাদের ভাবতে হবে একে হত্যা করা যতটুকু সহজ, ধকল সামলানো অত সহজ নয় হারেস পিতা ও দাউদের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেল বটে কিন্তু রাগে ক্ষোভে ফোঁসতে লাগল। তার চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

একে হত্যা করা কোন কঠিন কাজ নয়। হারেসের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল তার পিতা। সে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ওকে তো আমার এ দুর্বল হাতেও হত্যা করা সম্ভব। ওর লাশ গুম করে ফেলাও তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এর যে দুই সাথী চলে গেছে, ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে না। ওরা সন্দেহ বশত আমাদেরকে গ্রেপ্তার করবে। তোমার যুবতী স্ত্রী ও কিশোরী বোনের সাথে দুর্ব্যবহার করবে। আমরা যদি বলি গভর্নর এখান থেকে চলে গেছে তাহলে ওরা তা বিশ্বাস করবে না। কেননা গভর্নর তাদেরকে এখানেই ফিরে আসতে বলেছে।

মনে হয় আপনি সাইফুদ্দীনকে সত্য মনে করেন, একটু সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল হারেস। মুসলমানদের ভ্রাতৃঘাতী লড়াইকে কি আপনি ঠিক মনে করেন?

এটা ঠিক যে, আমার ঘরে আমি একে হত্যা করতে চাই না। বলল বৃদ্ধ। তবে আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি, তাকে আমি সঠিক মনে করি না। সে বলেছিল, তোমাকে তো সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সমর্থক মনে হয়। সে আমাকে এই লোভও দেখিয়েছে যে, তোমার ছেলে যুদ্ধে মারা গেলে অনেক টাকা-পয়সা দেব। আমি উত্তরে তাকে বলেছি, আমি ছেলের শাহাদাত প্রত্যাশা করি, পুত্রের অপমৃত্যু বা পয়সার লোভ কখনো করি না। সাইফুদ্দীনের সাথীরা আমাদের মানসিক অবস্থা জানে। আমরা যদি তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলি তাহলে তার ডিপুটি আমাদের নিষ্কৃতি দেবে না। তারা বলবে, তুমি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সহযোগী। এজন্যই মৌসুলের গভর্নরকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছ।

দাউদ ভাই! তুমি বলতে আমি এখন কি করব? তুমি আমার আবেগ দেখেছ, তুমি তো বলেছিলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ পাপিষ্ঠকে হত্যা করার চেয়ে ভাল কাজ আর কি হতে পারে? যে হাজারো মুসলমান সৈনিককে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। অনেক সন্তানকে এতিম, স্ত্রীকে বিধবা, মায়ের কোল খালি করেছে। নাগালে পেয়েও একে হত্যা না করা আর একটি অপরাধ নয় কি? বল! তুমি জ্ঞানী মানুষ, আমাকে পথ দেখাও।

একটা মানুষকে হত্যা করলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। বলল দাউদ। তার অনেক সহযোগী ও সহকর্মী আলেপ্পো ও হিরনে রয়ে গেছে। এদের মধ্যে অনেক সাধারণ সৈনিক, কমান্ডার, সেনাপতি রয়েছে। শুধু সাইফুদ্দীনকে হত্যা করলে এরা সবাই সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সামনে হাতিয়ার ফেলে দেবে না। হাতিয়ার সমর্পণ করানোর কৌশল ভিন্ন। এজন্য প্রয়োজন এদেরকে সুকৌশলে রণাঙ্গনে নিয়ে এভাবে বিপন্ন করা যাতে এরা আত্মসমর্পণ করে এবং আইয়ূবীর দেয়া শর্ত মানতে বাধ্য হয়।

এ কাজ আইয়ূবী ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব? আমার বুকের মধ্যে যে আগুন জ্বলছে এটা কিভাবে নিভবে? এতিম মুজাহিদ সন্তানেরা কি আমাকে ক্ষমা করবে?

মনে মনে দাউদ খুব উৎফুল্ল। শিকার তার হাতের নাগালে। হারেস ও তার পিতাকে তার স্বরূপ জানাতে দ্বিধা করছিল সে। গোয়েন্দা কখনো আবেগের কাছে হার মানতে পারে না এবং নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে না।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে দাউদ নিজের স্বরূপ প্রকাশ না করে কিছুই করতে পারছিল না। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, সাইফুদ্দীন যেখানে যাবে সেও তার অনুগামী হবে এবং সে সাইফুদ্দীনের সকল তৎপরতা প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু হারেসের ঘরে তার দীর্ঘদিন অবস্থান অসুবিধাজনক মনে হচ্ছিল না। এইজন্য প্রয়োজন ছিল তার স্বরূপ হারেস পরিবারের কাছে প্রকাশ করে দেয়া। বস্তুত তাদেরকে সম্পূর্ণ আস্থায় নিয়েই সে গোয়েন্দাসুলভ কৌশলে তাদের সাথে কথা বলা শুরু করে দিল। সে দেখল, সাইফুদ্দীনকে হত্যার জন্য হারেস অগ্নিশর্মা হয়ে রয়েছে। তার পিতাও আইয়ূবীর দুশমনদের ঘৃণার চোখে দেখে, প্রচণ্ড অবজ্ঞা করে।

যদি আমি তোমাকে এরকম কৌশলের কথা বলি যদ্বারা সাইফুদ্দীন আর কখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না, তাহলে কি আমার কথা মানবে? হারেসকে জিজ্ঞেস করল দাউদ।

আমার ছেলের মত তুমি যদি আবেগে উত্তেজিত হয়ে না থাক, তবে আমি তোমার সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। বলল হারেসের পিতা।

আমি ওকে হত্যা করা ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবতে পারি না। বলল হারেস।

তুমি যদি তোমার বিবেক ও আবেগের লাগাম আমার হাতে দিয়ে দাও, তাহলে তোমার দ্বারা আমি এমন কাজ করাব যা তোমার হৃদয়কে শান্তি এবং মনকে করবে স্থির। দাউদ গভীরভাবে পিতা-পুত্রকে নিরীক্ষা করল। অদূরেই বসে ছিল হারেসের স্ত্রী ও বোন। তারাও শুনছিল তাদের কথাবার্তা। দাউদ তাদের দিকে লক্ষ্য করে বলল, আমাকে একটি কুরআন শরীফ দিন। হারেসের বোন উঠে একটি কুরআন শরীফ চোখে লাগাল, চুমু দিল এবং বুকে স্পর্শ করে দাউদের কাছে এনে দিল। দাউদও কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে স্পর্শ করে চুমু দিল এবং চোখে লাগাল। সে কুরআন শরীফ খুলে পড়তে লাগল, শয়তান তাদেরকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে, আল্লাহর স্মরণ তাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে, এরা শয়তানের দল। জেনে রেখ, শয়তানের দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এরা লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়। আয়াতটি ছিল সূরা হাশরের ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াত। দাউদ কুরআন শরীফ খুলতেই কাকতালীয়ভাবে এ আয়াতটি তার চোখে আটকে গেল। তেলাওয়াতের পর বলল, এটি আল্লাহর পবিত্র কালাম। আমি এটিকে খুঁজে বের করিনি। আকস্মিকভাবে এই আয়াতগুলোই আমার চোখে ভেসে উঠেছে। এখানে রয়েছে আল্লাহ্ পাকের সতর্ক বাণী ও সুসংবাদ। কুরআন পরিষ্কার বলে দিয়েছে, যারা শয়তানের দলভুক্ত হবে তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে, যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ধ্বংস ও পদদলিত হবে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা অপমানিত ও লজ্জিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের ধ্বংসের ব্যবস্থা না করতে পারি। এটা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। শয়তানের দলভুক্তদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনার ব্যবস্থা করা।

সে দুহাতে কুরআন মেলে ধরে সবার উদ্দেশে বলল, সবাই নিজেদের ডান হাত আল্লাহর পবিত্র কালামের উপর রাখ এবং প্রতিজ্ঞা কর এই রহস্য কখনো ভেদ করবে না এবং শত্রুকে পরাজিত করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে।

ঘরের সবাই কুরআন শরীফের উপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল, তারা কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না। কুরআন শরীফের মর্যাদা ও মহিমান্বিত প্রভাবে সারা ঘরের মধ্যে পিনপতন নিরবতা নেমে এল। ভারি হয়ে এল সবার নিঃশ্বাস। অপার বিস্ময়ে সবাই তাকিয়ে রইলো দাউদের দিকে।

তোমরা সবাই কুরআন শরীফের উপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছ, বলল দাউদ। আল্লাহ তাআলা তোমাদের মাতৃভাষায় কুরআন নাযিল করেছেন, কুরআনের প্রতিটি শব্দের অর্থ তোমরা জান এবং বোঝ। তোমরা যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কর এর শাস্তি কুরআনে কি তাও তোমরা জান। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে তোমাদেরও পরিণতি হবে শয়তানের দোসরদের মত।

তুমি কে বাবা? এসব কি বলছ! বিচলিত কণ্ঠে দাউদকে জিজ্ঞেস করল হারেসের পিতা। মনে তো হয় তুমি অনেক বড় আলেম অথবা কোন কামেল ব্যক্তির মুরিদ।

না, আমি তেমন কোন আলেম নই। তবে আলেমদের নির্দেশিত পথেই আমি চলি। আমি কুরআনের নির্দেশে জীবন বাজি রেখে এখানে এসেছি। আমি এ শিক্ষা সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কাছ থেকে পেয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আমি মৌসুলের বাসিন্দা নই, দামেস্কের অধিবাসী। আমি কোন যাযাবর নই। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর একজন। এটাই হল সেই রহস্য যা প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতি তোমাদের কাছ থেকে নিয়েছি। তোমাদের সকলের সহযোগিতা আমার দরকার। আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দাও; আমি যা বলব তাই তোমরা করবে।

আমরা তো প্রতিজ্ঞা করেই বসেছি, তোমার যা বলার তা বলবে তো। বলল বৃদ্ধ।

আমার লক্ষ্য আল্লাহ্র সন্তুষ্টি, বলল দাউদ। আমি যার হৃদয়ের কূট-কৌশল, চক্রান্ত বের করে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কাছে পৌঁছাতে চাই, সেই ব্যক্তি ছাদের নিচেই ঘুমিয়ে আছে। আল্লাহ্ তাআলা আমাকে এখানে পৌঁছাতে অলৌকিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমাকে জানতে হবে সাইফুদ্দীন ও তার সহযোগিরা কি করতে চায়, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? যদি এরা পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় তাহলে এদের যুদ্ধের প্রস্তুতি চলাকালীন সময়ে অথবা এর আগেই সব অপতৎপরতা ভণ্ডুল করে দিতে হবে। তাদের পরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নের আগেই আমাদের জানতে হবে। এমনও তো হতে পারে যে, সুলতান আইয়ূবী যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত আর এ সুযোগে শত্রু বাহিনী আকস্মিক হামলা করে বসল। আপনি কি বুঝতে পারেন তখন এর পরিণতি কি হবে?

তুমি কি আমাকে অনুমতি দেবে বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে ধোকা দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করাচ্ছে একে আমি এখানেই হত্যা করে ফেলি? বলল হারেস।

সময় হলে আমি তোমাকে বলব, বলল দাউদ। কোন কোন সময় হত্যা না করাও উপকারী। তোমাকে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। সাইফুদ্দীনের প্রতি আমাদের গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তার পশ্চাদ্ভাবন করতে হবে। সাইফুদ্দীন যেভাবে এখানে লুকিয়ে রয়েছে আমি এবং হারেসও তার দৃষ্টির আড়ালে থাকব এবং তার যাবতীয় তৎপরতা প্রত্যক্ষ করব।

* * *

সাইফুদ্দীন এই বাড়ির একটি ঘরে গভীর ঘুমে অচেতন। ভোর বেলায় বৃদ্ধ উঁকি দিয়ে দেখল, সে তখনো ঘুমাচ্ছে। বেলা অনেক হওয়ার পর তার ঘুম ভাঙ্গলো। হারেসের বোন ও স্ত্রী তার জন্য নাস্তা নিয়ে এল। সাইফুদ্দীন হারেসের বোনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা আমার যে সেবা করছ এর পরিবর্তে এমন পুরস্কার তোমাদের দেব যা তোমরা কল্পনাও করতে পার না। তোমাকে আমি আমার শাহী মহলে রাখব।

আপনাকে যদি আমরা এই কুঁড়ে ঘরেই রেখে দেই তাহলে কি আপনি নারাজ হবেন, অসন্তুষ্ট হবেন? স্মিত হেসে বলল কিশোরী।

আমরা তো মরুভূমিতেও থাকতে পারি। বলল সাইফুদ্দীন। কিন্তু তোমরা তো ফুলের মতো সাজিয়ে রাখার জিনিস।

আপনি কি মনে করেন যে, শাহী মহলে আবার ফিরে যেতে পারবেন? বলল কিশোরী।

তুমি এ কথা বলছ কেন?

আপনার অবস্থা দেখে। বলল কিশোরী।

কুঁড়ে ঘরে লুকিয়ে থাকাই প্রমাণ করে বাদশাহর রাজত্ব হাত ছাড়া হয়ে গেছে এবং তার সৈন্যসামন্ত তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

সৈন্যরা আমাকে ছেড়ে যায়নি, বলল সাইফুদ্দীন। আমি একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য এখানে এসেছি। রাজমহলে ফিরে যাওয়া শুধু আমার ভাগ্যে নয়, তোমার ভাগ্যেও লেখা হয়ে গেছে। তুমি কি আমার সাথে যাওয়া পছন্দ কর না?

হারেসের স্ত্রী কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিশোরী সাইফুদ্দীনের অদূরে বসে গেল এবং বলল, যদি আপনার জায়গায় আমি হতাম তাহলে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত না করে ঘরে ফেরার নাম নিতাম না। যদি আপনি আমাকে পছন্দ করে থাকেন তাহলে আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি আপনার এই পালিয়ে আসা এবং লুকিয়ে থাকা আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। যুদ্ধ কৌশলী শাসকদের মত আপনি ময়দানে বেরিয়ে যান, বিচ্ছিন্ন সৈনিকদেরকে একত্রিত করুন এবং সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর উপর আক্রমণ করুন।

কিশোরীটি ছিল একেবারেই সাদাসিদে। তার বক্তব্যে কোন প্রতারণা ছিল না। সাইফুদ্দীন তাকে খুব তন্ময় হয়ে দেখছিল এবং তার ঠোঁটে খেলা করছিল পৈশাচিক হাসি ও পাশবিক লিপ্সা।

আমি তো শাহাজাদী নই, বলল কিশোরী। এই মরুভূমি এবং উপত্যকাতেই জন্ম নিয়েছি, এখানেই বেড়ে উঠেছি। আমি সৈনিকের মেয়ে এবং সৈনিকের বোন। আপনার সাথে রাজপ্রাসাদে নয় রণাঙ্গনে যেতে আমি প্রস্তুত। আপনার সাথে আমি তরবারি নিয়ে খেলা করব। আমাকে পেতে হলে মরুভূমিতে, পাহাড়ের ঢালে, টিলার উপরে আপনাকে ঘোড়া ছুটাতে হবে।

তুমি শুধু সুন্দরীই নও, লড়াকুও বটে। সাইফুদ্দীন তার চুল হাতে নিয়ে বলল, এত সুন্দর রেশমী চুল জীবনে আর কখনো দেখিনি।

কিশোরী সলজ্জ বিনয়ে সাইফুদ্দীনের হাতটি সরিয়ে দিল এবং বলল, রেশমী চুল নয় এ মুহূর্তে আপনার দরকার আমার বাহু, আমার শক্তি। আপনি আমাকে বলুন তো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

তোমার বাবা একজন বিপজ্জনক লোক। বলল সাইফুদ্দীন। মনে হয় সে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সহযোগী। আমাকে হয়ত অপছন্দ করে। আমার ভয় হয় সে আমাকে আবার থোকা না দেয়।

খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল কিশোরী। বলল, তিনি বুড়ো মানুষ। জানি না আপনার সাথে কি কথা বলেছেন। তিনি রাত থেকেই আমাদের কাছে আপনার প্রশংসা করছেন। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর নাম শুনেছেন মাত্র। তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এজন্য আপনি ভয় করবেন না। বৃদ্ধ মানুষ আর আপনার কি ক্ষতি করতে পারবেন? আমাকে পরীক্ষা করুন।

সাইফুদ্দীন কিশোরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিশোরী দূরে সরে গিয়ে বলল, আপনার সব আশা পূর্ণ হবে। আপনি আমাকে পেতে পারেন তবে এর জন্য আপনাকে শর্ত পালন করতে হবে। তখনি আপনি আমাকে পাবেন যখন সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত করে ফিরে আসবেন। আপনি এখন সঙ্কটে রয়েছেন, এ মুহূর্তে…। আচ্ছা আপনি আমাকে বলুন তো, ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?

সাইফুদ্দীন ছিল আরামপ্রিয়, বিলাসী, ভোগবাদী ও নারীলিন্দু। সুন্দরী যুবতী নারী তার জন্য মোটেও দুর্লভ ছিল না। কিন্তু এই পল্লীর সরলা মায়াবী মেয়েটির নির্মল অভিব্যক্তি ও বুদ্ধিমত্তা তাকে বিমোহিত করে ফেলেছে। সবচেয়ে আকর্ষণের ব্যাপারটি এই ছিল যে, মেয়েটি তার আকাঙ্ক্ষাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। অথচ এর চেয়েও সুন্দরী, অভিজাত যুবতী মাত্রই তার ঈশারায় নাচতে শুরু করে। বস্তুত এই অবলা মেয়েটি তার পৌরুষকে এইভাবে আঘাত করেছিল যে, তার আভিজাত্য ও অহংবোধে মারাত্মক ঘা লেগেছিল।

শোন মেয়ে! বলল সাইফুদ্দীন। তুমি আমার পৌরুষের পরীক্ষা নিতে চাও। ঠিক আছে, সেইদিনই তোমাকে আমি তুলে নেব যেদিন সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তরবারী আমার মুষ্ঠিবদ্ধ থাকবে। আইয়ূবীর ঘোড়ায় আমি সওয়ার থাকব। আমাকে কথা দাও, সেদিন তুমি আমার কাছে আসবে তো?

আমাকে কি আপনার সাথে যুদ্ধে নিয়ে যাবেন? অতি সরল কণ্ঠে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল কিশোরী।

না, তা হতে পারে না। বলল সাইফুদ্দীন। আগে আমার সৈন্যদের সংগঠিত করতে হবে। এক কমান্ডারকে আমি মৌসুল পাঠিয়েছি। তাকে আমি বলে দিয়েছি বিচ্ছিন্ন সৈন্যদের একত্রিত করে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতি নিতে। যাতে সে আমাদের শহরগুলোকে ঘেরাও করতে না পারে। আজ সন্ধ্যার মধ্যে উভয়েই ফিরে আসলে জানা যাবে আলেপ্পো ও হিরনের সৈনিকদের অবস্থা ও পরিস্থিতি কি? আমরা পরাজয়কে মেনে নিচ্ছি না। শীঘ্রই প্রতিআক্রমণ করব, অবশ্যই করব।

সাইফুদ্দীনের ব্যক্তিত্ব ছিল এমনি। ক্ষমতা ও নারী লিপ্সা তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সে এক সরলা গেঁয়ো মেয়ের কৌশলের কাছে নিজের রণকৌশল প্রকাশ করে দিল। সাইফুদ্দীনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আত্মস্থ করার পর কিশোরী তাকে অভিবাদন জানিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এল।

সাইফুদ্দীনের সাথে যে দুজন সৈনিক এসেছিল এদের একজন মৌসুল আর অপরজনকে আলেপ্পো পাঠিয়েছে। হারেসের বোন পিতা, ভাই ও দাউদকে বলল, তার চাতুর্যপূর্ণ কৌশলের কথা। সে আরো বলল, গভর্নর চাচ্ছে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী যাতে তাদের শহর ঘেরাও করতে না পারেন এজন্য তিন বাহিনীকে আবার একত্রিত করে সালাহ উদ্দীনের উপর আক্রমণ করবে। যে দুজনকে সে পাঠিয়েছে এরা ওখানকার সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধ করার মতো সাহস রাখে কি-না তা জানার জন্যে গিয়েছে। সাইফুদ্দীন হারেসের বোনকে যা বলেছিল তা সে পিতা, ভাই ও দাউদকে বলল।

এতক্ষণ আমরা যে মেয়েটির কথা বললাম, সেই কিশোরী মেয়েটির নাম ফৌজী। ফৌজী বেদুঈন মেয়ে। লেখাপড়া তেমন নেই। কুরআন শরীফ ও আনুসঙ্গিক সামান্য কিছু পড়া লেখা করেছে মাত্র। তেমন চালাক চতুরও নয়। কিন্তু একটা ন্যায়নিষ্ঠা পারিবারিক ঐতিহ্য ও আরব বেদুঈন হিসেবে লালন করে ফৌজী। ইসলামী চেতনা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চতুর না হলেও সচেতন। দাউদ তাকে কিছুটা কৌশলী হওয়ার তালীম দিল। বলল, সাইফুদ্দীন দীন ও ইসলামের দুশমন। সে ক্ষমতার লোভে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর জিহাদকে বেঈমান বিধর্মীদের সহায়তায় নস্যাৎ করে দিতে তৎপর। সে জাতির ঘোরতর শত্রু। জাতীয় স্বার্থে তুমি কিছুটা অভিনয় করে ওর মনের খবর নিতে চেষ্টা করবে। তবে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে। ও খুবই ধূর্ত এবং নারী লিন্দু। নিজের মান-সম্ভ্রমের প্রতি খেয়াল রেখো। কখনও ওর দেয়া লোভে ভুলে যেও না নিজের আদর্শ।

ফৌজী ধারণার চেয়েও বেশী কৌশলে সাইফুদ্দীনের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা কথা বের করে এনেছে। দাউদ ভাবতেও পারেনি এই বেদুঈন মেয়েটি এতোটা দক্ষতার সাথে পাকা গোয়েন্দার মতো কাজ করতে পারবে। ফৌজীর কাছে সাইফুদ্দীনের পরিকল্পনা জানার পর দাউদ সিদ্ধান্ত নিল, কুচক্রীদের চক্রান্ত ভণ্ডুল করতে হলে সাইফুদ্দীনের অনুসরণ করার বিকল্প নেই। ওর তৎপরতা জানতে হবে এবং সে কোথায় কি করতে যাচ্ছে এসব বুঝতে হবে।

প্রায় মাঝ রাতে বৃদ্ধের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি শুনতে পেলেন বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। অশ্বের হেষারবও শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ বিছানা ছেড়ে দরজা খুললেন। বাইরে সাইফুদ্দীনের ডিপুটি দাঁড়িয়ে।

বৃদ্ধ তার ঘোড়া বেঁধে রাখার জন্যে আস্তাবলের দিকে পা বাড়ালেন। ডিপুটি গেট পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল, যে ঘরে সাইফুদ্দীন ঘুমিয়ে ছিল। ঘোড়া বেঁধে রেখে ফিরে এসে ডিপুটিকে খাবারের আবেদন করলেন বৃদ্ধ। ডিপুটি খাবার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাল। বৃদ্ধ দাসের মতো বিনয় নম্রভাবে তাকে আবারো খানার জন্যে অনুরোধ করলেন কিন্তু ডিপুটি তার অনুরোধে পাত্তা দিল না। সাইফুদ্দীন বৃদ্ধকে বলল, তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ওর খাবারের প্রয়োজন নেই। বৃদ্ধ একজন নগণ্য প্রজার মতো খুবই কাচুমাচু করে তাদের অভিবাদন জানিয়ে কামরা ত্যাগ করলেন। ঘরে এসে তিনি দাউদকে জাগিয়ে সাইফুদ্দীনের ডিপুটির আগমন বার্তা জানালেন। দাউদ বৃদ্ধকে নিয়ে সাইফুদ্দীনের ঘরের দেয়ালে কান লাগিলে ওদের কথাবার্তা শোনার জন্য ওঁৎ পেতে রইল।

গোমশতগীন এখন মালিক আস-সালেহ এর আশ্রয়ে আলেপ্পোয় রয়েছে বলে জানা গেছে। বলল সাইফুদ্দীনের ডিপুটি। মৌসুলে আমি যে পরিস্থিতি দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধের উপযুক্ত। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী তুর্কমানে অবস্থান করছে। খ্রিস্টান গোয়েন্দারা বলেছে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আলজেরিয়া, দিয়ার ও বকরা ইত্যাদি এলাকা থেকে তার বাহিনীতে লোক ভর্তি করছে। তার তৎপরতা থেকে মনে হচ্ছে, খুব শীঘ্রই সে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আরো অগ্রসর হবে হয়তো তবে বিগত দিনের মরু ঝড়ে তার তাঁবু ও রসদপত্র বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এসব না গুছিয়ে হয়তো সে আর অগ্রসর হবে না। তাছাড়া সে হয়তো ভাবছে, আমাদের সৈন্যদের হয়তো যুদ্ধ করার মতো অবস্থা নেই। মৌসুলে আমাদের সেনাবাহিনীর যেসব সৈন্য ফিরে এসেছে সংখ্যায় এরা এক তৃতীয়াংশেরও কম হবে। অধিকাংশ সৈন্যই মারা গেছে, নয়তো হারিয়ে গেছে।

এতো অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর উপর আবার হামলা করা কি সম্ভব? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল সাইফুদ্দীন।

শুধু আমাদের বাহিনী আক্রমণের জন্যে যথেষ্ট হবে না। মালিক ও গোমতগীনের সৈন্যদেরও আমাদের সাথে একত্রিত করতে হবে। বলল ডিপুটি।

আমি কোথায় অবস্থান করছি, একথা কি তুমি সৈন্যদের বলেছো?

আপনি এখানে লুকিয়ে রয়েছেন একথা আমি বলিনি। আমি মিত্রদের এবং আমাদের সৈন্যদেরকে বলেছি, গভর্নর তুরকমান এলাকায় ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তৎপরতা নিজ চোখে দেখার চেষ্টা করছেন। যাতে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়নে সুবিধা হয়। আমার মনে হয় আর তিন চার দিনের মধ্যে আপনার মৌসুল পৌঁছা উচিত। বলল ডিপুটি।

মৌসুল যাওয়ার আগে আমাকে আলেপ্পোর সংবাদ নিতে হবে। আশা করি কমান্ডার আগামীকালের মধ্যে পৌঁছে যাবে। তুমি কি জানো, গোমশতগীন শয়তানের মতো ধূর্ত। সে তো তার কেল্লা হিরনে যাওয়ার কথা। ওখানে না গিয়ে সে আলেপ্পোতে কি করছে? মৌসুল যাওয়ার আগে আমাকে আলেপ্পো যেতে হবে। গোমশতগীন আমাদের মিত্র বটে কিন্তু তাকে আমি কখনও বন্ধু মনে করি। মালিক আস্-সালেহ-এর কমান্ডারদেরকে সম্মত করাতে হবে যে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর প্রস্তুতির সুযোগে তারা যেন পুনর্বার আক্রমণে আমাদের সহযোগিতা করে। তাদের একথাও বোঝাতে চেষ্টা করব যে, তিন বাহিনীর যৌথ কমান্ডের বদলে একক কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করা উচিত। আর কমান্ড আমার হাতে আনার চেষ্টা করব। তাদের বোঝাতে হবে, বিগত যুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন কমান্ড হওয়ার কারণে আমরা একে অন্যের কৌশল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলাম; যার ফলে আমাদের পরাজিত হতে হয়েছে। তা না হলে মুজাফফর উদ্দীন, আইয়ূবী বাহিনীর উপর যে তীব্র আক্রমণ করেছিল তা কখনও ব্যর্থ হতো না।

কেন্দ্রীয় কমান্ড আপনার হাতে থাকা উচিত। বলল ডিপুটি।

মিত্রদের সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বলল সাইফুদ্দীন। আচ্ছা তুমি কি বলতে পারো, খ্রিস্টানরা কি আমাদের সহযোগিতা করবে?

ওরা সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করবে না; তবে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং উট-ঘোড়া দিয়ে সহযোগিতা করবে। মহামান্য গভর্নর! আপনি এখানে কোনরূপ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন না তো? জিজ্ঞেস করলো ডিপুটি।

না। বুড়োকে বিশ্বস্তই মনে হয়। আর ওই মেয়েটিও আমার জালে ধরা দিয়েছে। তবে মেয়েটি খুব আবেগ প্রবণ। বলে কি জানো! আপনি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত করে, তার তরবারী হাতে নিয়ে, তার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসেন, তাহলে আমি আপনার সাথে চলে যাবো।

সাইফুদ্দীনের কথা শুনে ডিপুটি অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল। বৃদ্ধ ও দাউদ দেয়ালে কান লাগিয়ে ওদের সব কথাই শুনছিল। সাইফুদ্দীন ও তার ডিপুটি মোটেও জানে না যে, বৃদ্ধের ঘরে বুড়ো ও দুটি মেয়ে ছাড়া আরো দুজন যুবকও রয়েছে যারা সুযোগ পেলে সাইফুদ্দীনকে হত্যাও করতে পারে। সাইফুদ্দীন ঘুর্ণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি, সে ফৌজীকে তার ফাঁদে আটকায়নি বরং সে নিজেই ফৌজীর পাতা জালে আটকে গেছে।

* * *

দাউদ ও হারেস ঘরের ভিতরেই অবস্থান করল। পরদিন ফৌজী কয়েকবার গেল সাইফুদ্দীনের ঘরে। ফৌজী সাইফুদ্দীন থেকে নিরাপদ দূরে দূরে থেকে কথা বলত। ফৌজীর দূরত্ব বজায় রাখার কারণে নারী লিন্দু সাইফুদ্দীন ফৌজীকে বাহুবদ্ধ করতে, ওকে কাছে টানতে উদগ্রীব হয়ে পড়ল। ফৌজীকে আকৃষ্ট করতে সে বলল, তোমার ভাই আমার সেনাবাহিনীতে একজন সাধারণ সৈনিক মাত্র, এবার তাকে আমি কমান্ডার বানিয়ে দেব।

আমরা তো এটাই জানি না যে, ভাই জীবিত আছে না মারা গেছে। সে মারা গেলে আমরা খুবই অসহায় হয়ে যাবো। বলল ফৌজী।

ফৌজীর বৃদ্ধ পিতাও দিনের বেলায় সাইফুদ্দীনের থাকার ঘরে কয়েকবার গিয়ে তাদের সেবাযত্নের খোঁজ খবর নিলেন। কোন কিছুর প্রয়োজন, অসুখ-অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চাইলেন অতি বিনয়ের সাথে। তিনি সাইফুদ্দীনকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, প্রথম রাতে কিছুটা বিরূপ কথা বললেও সাইফুদ্দীনের প্রতি বিশ্বস্ত তিনি।

রাতে আবার সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বৃদ্ধ দরজা খুললেন। সাইফুদ্দীনের কমান্ডার আলেপ্পো থেকে ফিরে এলো। বৃদ্ধ কমান্ডারকে সাইফুদ্দীনের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আস্তাবলে ঘোড়া বেঁধে কমান্ডারের খাবারের আয়োজন করতে হবে কি-না জানতে গেলেন। কমান্ডার ছিল ক্ষুধার্ত, পথিমধ্যে সে কোথাও বিশ্রাম-আহারের ফুরসত পায়নি। বৃদ্ধ কমান্ডারের জন্যে খাবার আনতে ঘরে গেলে ফৌজী আবদার করল, সে নিজে খাবার নিয়ে যাবে, যাতে তাদের কথাবার্তা শুনতে পায়।

ফৌজী খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই কমান্ডার কথা বলা বন্ধ করে দিল। সাইফুদ্দীন বলল, বল, ও আমাদেরই মেয়ে। ফৌজী কমান্ডারের সামনে খাবার রেখে সাইফুদ্দীনের সামনে গিয়ে বসল। অন্যদিনের চেয়ে ফৌজী একটু কাছে বসল সাইফুদ্দীনের। সাইফুদ্দীন ফৌজীর হাত নিজের হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। ফৌজী অনুভব করল এ মুহূর্তে সাইফুদ্দীনের হাত থেকে হাত সরিয়ে নিলে সে অপমানবোধ করে তার প্রতি বিরাগ হবে এবং ওর কাছ থেকে আর কোন গোপন কথা বের করা সম্ভব হবে না। তাই বৃহত্তম স্বার্থে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে হাত ছাড়িয়ে নেয়া থেকে বিরত রইল। কান পেতে থাকল ওদের কথা শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।

আলেপ্পোর সৈন্যরা এখনও যথেষ্ট উজ্জীবিত। বলে কথা পুনরায় শুরু করল কমান্ডার। ফৌজী সাইফুদ্দীনের আঙ্গুল থেকে হিরের আংটি খুলে নিয়ে নিজের আঙ্গুলে পুরে হিরেটিকে শিশুদের মতো বিস্ময়ভরে দেখতে লাগল। ভাবটা এমন যে কমান্ডারের কথার প্রতি তার মোটেও কোন আগ্রহ নেই। অথচ সে উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে কমান্ডারের কথার প্রতি।

মালিক আস্-সালেহ সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

সন্ধি প্রস্তাব! গর্জে উঠল সাইফুদ্দীন।

জ্বী হ্যাঁ! সন্ধি প্রস্তাব। বলল কমান্ডার। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি তিনি সন্ধি প্রস্তাবের নামে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে ধোকা দেয়ার জন্যই সন্ধিপ্রস্তাব পাঠিয়েছেন। খ্রিস্টান মিত্ররা তার সৈন্যদের রসদ সামগ্রীর ঘাটতি পূরণ করে দিচ্ছে এবং তাকে উস্কানি দিচ্ছে মৌসুল ও হিরনের সৈন্যদেরকে একত্রিত করে সকল সৈন্যের কমান্ড নিজের হাতে নিয়ে পুনরায় আইয়ূবীর উপর ঝটিকা আক্রমণ করতে। তারা আরো বলছে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী যদি বিশ্রাম নিতে পারে আর বিভিন্ন এলাকা থেকে নতুন সৈন্য ভর্তি করে তার লোকবলের ঘাটতি পূরণ করে নিতে পারে তবে তাকে পরাজিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। গোয়েন্দারা খবর দিয়েছে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী তুর্কমানের উর্বর এলাকায় দীর্ঘমেয়াদী তাঁবু ফেলেছে এবং খুব দ্রুত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মালিকের সেনাপতিও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন আইয়ূবীর উপর শীঘ্রই আক্রমণ করা উচিত।

আমি আলেপ্পো বাহিনীর এক খ্রিস্টান উপদেষ্টার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি পরিচয় আড়াল করে বললাম, আমরা এখনই হামলা করার উপযুক্ত নই। তখন সে বলল, এটা হবে তোমাদের বড় ভুল। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর উপর আক্রমণের অর্থ এই নয় যে, তাকে পরাজিত করতে হবে বরং দ্রুত আক্রমণের লক্ষ্য হলো সে যেন প্রস্তুতির অবকাশ না পায়। তাকে তুকমান অঞ্চলে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখতে হবে এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে হবে। তাকে তার। কৌশলেই মোকাবেলা করতে হবে। মুখোমুখি সংঘর্ষে না গিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। গুপ্ত হামলা করতে হবে এবং সরে আসতে হবে। মোটকথা, তুর্কমানের সবুজ শ্যামল উর্বর অঞ্চল থেকে তাকে সরিয়ে দিতে হবে যাতে তার বাহিনী পানি ও ঘাস সমৃদ্ধ অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং তার বাহিনী ও জীবজন্তুগুলো পানাহারের সঙ্কটে নিপতিত হয়।

খুবই সুন্দর পরিকল্পনা। বলল সাইফুদ্দীন। এ ধরনের যুদ্ধ আমার সিংহ সেনাপতি মুজাফফরই করতে পারে। সে বহুদিন সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বাহিনীতে ছিল। আমি চেষ্টা করব তিন বাহিনীর কমান্ড আমার হাতে নিয়ে নিতে। আমি মরু শিয়ালের মতো ধোঁকা দিয়ে দিয়ে আইয়ূবীকে মরুভূমিতে শুকিয়ে মারব।

ফৌজী সাইফুদ্দীনের তরবারী কোষমুক্ত করে সেটিতে হাত বুলিয়ে দেখছিল। সে তন্ময় হয়ে দেখছিল তরবারীটি উল্টে পাল্টে।

মালিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে আমি বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেনা কর্মকর্তা ও অফিসারগণ তাকে এভাবে ঘিরে রেখেছে যে, তার সাথে মোলাকাতের সুযোগ আর হলো না। এসব বিষয় আমি তার কমান্ডার ও সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জেনেছি।

তোমাকে আবার আলেপ্পো যেতে হবে। বলল সাইফুদ্দীন।

মালিক আস্-সালেহকে এ পয়গাম দিতে হবে যে, তুমি আইয়ূবীর কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়ে আমাদের ধোঁকা দিয়েছ এবং তার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছ। সে আমাদের কাউকেই ক্ষমা করবে না। তুমি এখনও অনেক ছোট্ট। তুমি হয়তো হতাশ হয়ে গেছো, অথবা যুদ্ধ বিমুখ তোমার সেনা কর্মকর্তারা তোমাকে যুদ্ধে নিরুৎসাহিত করছে।

সাইফুদ্দীন পয়গাম সম্পর্কে দীর্ঘ দিক-নির্দেশনা দিয়ে বলল, ভোরের অন্ধকারেই তোমাকে চলে যেতে হবে। সকালে যাতে তোমাকে এ গ্রামের কেউ দেখতে না পায়।

কমান্ডার রাতের কিছু অংশ বিশ্রাম করে রাতের অন্ধকার থাকতেই গ্রাম ছেড়ে আলেপ্পোর উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেল।

ফৌজী যা কিছু শুনল সবই এসে হারেস ও দাউদকে জানাল। ফৌজীর এ তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হারেস ও তার পিতা শুয়ে পড়লে দাউদ কি জন্য যেন বাইরে বের হল। পা টিপে টিপে দাউদের অনুসরণ করল ফৌজী। দাউদ সোজা আস্তাবলে তার ঘোড়ার কাছে গিয়ে থামল। ফৌজীও নীরবে অতি সন্তর্পণে দাউদের কাছে চলে এল।

এর চেয়েও আমাকে আরো বড় কোন কাজ দাও দাউদ ভাই! বলল ফৌজী। আমি তোমার জন্য জীবন দিয়ে দেব।

আমার জন্যে নয়, জাতির জন্যে এবং ইসলামের জন্যে জীবন দাও। যে কাজ তুমি করছ সেটি অনেক বড় কাজ ফৌজী! আমি যে কাজ করছি সেটি জীবন দেয়া নেয়ার কাজ। আর সেটিই করছ তোমরা। আমি তোমাদেরকে বিপদে ফেলে দিয়েছি ফৌজী! বলল দাউদ।

বিপদের আবার কি?

তুমি এতোটা বুঝবে না। সাইফুদ্দীন বাদশা। ঝুপড়িতে থাকলেও সে বাদশাই বটে। তুমি তার চালাকি বুঝবে না ফৌজী!

হু। বাদশা কি আমাকে গিলে ফেলবে ভাবছো! আমি চালাক না হতে পারি, তোমরা যতোটা বোকা মনে কর অতটা বোকা আমি নই। আচ্ছা তোমার বাড়ি কোথায়?

আমার কোন ঠিকানা নেই। আমি গোয়েন্দা, গুপ্ত সেনা। যেখানেই দুশমনদের হাতে মারা যাবো সেটিই হবে আমার ঠিকানা, সেটিই হবে আমার বাসস্থান। শহীদানের রক্ত যে যমীনের উপর পড়ে সেটি কোন না কোন একদিন ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হবেই হবে। এ যমীনকে কুফরী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। আমাদের মা-বোনেরা আমাদের লালন-পালন করে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছে। তারা বুকে পাথর বেঁধে সেই আশা ছেড়েই আমাদের বিদায় করেছে যে, আমরা পুনর্বার তাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাবো।

নিজের বাড়ি ফেরার, নিজের মা-বোনকে দেখার আগ্রহতো তোমার মধ্যে অবশ্যই আছে। আবেগমাখা কণ্ঠে বলল ফৌজী।

মানুষ যখন স্বপ্ন আর আকাক্ষার পূজারীতে পরিণত হয় তখন কর্তব্য অবহেলিত হয়ে পড়ে। এ পথে জীবন ত্যাগের আগে আবেগকে কুরবানী করতে হয়। এ পথে অগ্রসর হতে হলে তোমাকেও আবেগকে কুরবান করতে হবে ফৌজী।

ফৌজী দাউদের গা ঘেঁষে বলল, দয়া করে আমাকেও কি তোমার সাথে নেবে দাউদ ভাই!

না।

কিছুদিন কি তুমি আমাদের সাথে থাকতে পারবে না?

যদি প্রয়োজন মনে হয় তবে থাকতে পারি। বলল দাউদ। আমাকে তোমার কাছে রেখে কি করবে ফৌজী?

তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে। যেদিন থেকে তুমি এসেছো, আর আমি তোমার কথা শুনেছি। এমন সুন্দর কথা জীবনে আর কখনও শুনিনি। আমার মন চায় বাকী জীবন তোমার সাথে থাকতে…।

আমার পায়ে শিকল দিও না ফৌজী! নিজেকেও আবেগের শিকলমুক্ত রাখ। সামনে আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। অবশ্য পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের দরকার হবে। আমরা এক সাথে থাকবো বটে কিন্তু একজন অপরজনকে মায়ার বাঁধনে বাঁধবো না।… কিছুক্ষণ নীরব থেকে দাউদ বলল, ফৌজী! তুমি বেশী সময় আমার সঙ্গী হতে পারবে না। তোমার সম্ভ্রম আমার কাছে পবিত্র আমানত। যে কাজ পুরুষের সেটি পুরুষকেই করতে হবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফৌজী উদাস হয়ে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কী যেন খুঁজে ফিরল দাউদের মধ্যে। ঘরে ফিরে যেতে উদ্যত হল সে। এ সময় দাউদ হাত বাড়িয়ে ফৌজীর বাজু টেনে ধরল। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফৌজী দাউদের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। দাউদ তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। ফৌজী আবেগে কম্পমান কণ্ঠে বলল, পুরুষের কাজ মেয়েরাও করতে পারে। আমার সম্ভ্রম এমন কোন ঠুনকো কাগজের টুকরো নয় যে, আগুনের ধোঁয়ায় পুড়ে যাবে। আমি তোমাকে আমার সম্ভ্রম অর্পণ করতে আসিনি। তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমার কথা আমাকে নতুন জীবনের দিশা দিয়েছে। যে পথ তুমি আমাকে দেখিয়েছ সেটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি তোমার সান্নিধ্যে এজন্য এসেছি যে, এতে হয়তো তুমি তোমার বোনের পরশ পাবে। তুমি তো ক্লান্ত, তাই না দাউদ ভাই? আমাকে ভাবি বলেছে–পুরুষ যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে তখন নারী সান্নিধ্য ছাড়া পুরুষের ক্লান্তি আর কোন কিছু দূর করতে পারে না। নারী না থাকলে পুরুষের পৌরুষ থাকে না। জীবনীশক্তি মরে যায়। আমি তোমার প্রাণকে বাঁচাতে চাই, তোমাকে সাহসী ও উজ্জীবিত রাখতে চাই। তুমি যদি নিষ্প্রাণ হয়ে যাও, তাহলে কি হবে দাউদ?

দাউদ হেসে ফেলল। ফৌজীর থুতনীতে চিমটি কেটে বলল, সত্যিই ফৌজী তোমার আন্তরিক মমতা, অকৃত্রিম কথাগুলো আমার প্রাণকে সজীব করে দিয়েছে।

আমার কোন কথা তোমাকে কষ্ট দেয়নি তো? আমার ভাইকে তো বলে দেবে না যে, আমি একাকী তোমার কাছে আস্তাবলে এসেছিলাম?

না। তোমার ভাইকে কখনো তোমার এখানে আসার কথা বলব না। আর তোমার কোন কথাই আমাকে কষ্ট দেয়নি।

মনে হয় তোমার আর আমার পথ একই পথ, দাউদ ভাই! আমি অশিক্ষিত। মনের সব কথা বলতেও জানি না।

মনের কথা তুমি বলে ফেলেছ ফৌজী। তুমি ঠিকই বলেছ, আমার আর তোমার পথ অভিন্ন। আমি ঠিকই তোমার হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছি। তবে একথা ভুলে যেও না। আমাদের গমন পথে বিশাল রক্ত ফোরাত। যেখানে কোন সেতু নেই, পুল নেই। তুমি যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকে পেতে চাও, তবে আমাদের পরিণয় লেখা হবে রক্ত দিয়ে। আল্লাহর পথের সৈনিকদের শাদী আসমানে হয়ে থাকে, আর আসমানের পথে পথে তাদের মিলন হয়। আকাশের তারকারাজী তাদের শাদীতে আলোকসজ্জা করে।

ঘরে ফিরে এল ফৌজী। অজানা পথে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল দাউদ। ফৌজী ফিরে এলো মনে একরাশ সুখানুভূতি নিয়ে। তার ঠোঁটে ঈষৎ হাসির আভা, আর হৃদয়ের গহীনে একটা কিছু করার কঠিন সংকল্প।

পলাতক সাইফুদ্দীন এর পয়গাম নিয়ে মালিক আস্-সালেহ এর কাছে যে কমান্ডার গিয়েছিল সে একদিন পর ফিরে এল। কমান্ডার মালিকের সাক্ষাৎ পায়নি। তবে সাইফুদ্দীনের পয়গাম তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সাইফুদ্দীন পয়গামে বলেছিল, তাকে যেন লিখিত জবাব দেয়া হয়।

কমান্ডার মালিককে বলে এল সাইফুদ্দীন কোথায় লুকিয়ে রয়েছে এবং সেই বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার পথের দিক নির্দেশনাও সে বলে এলো।

কিন্তু তিন চার দিন পর্যন্ত মালিক আস্-সালেহ এর পক্ষ থেকে সাইফুদ্দীনের কাছে কোন প্রতিউত্তর এলো না। চতুর্থ দিনে সাইফুদ্দীন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল।

আমারই এখন আলেপ্পো পৌঁছানো উচিত। ডিপুটিকে বলল সাইফুদ্দীন। আলেপ্পোয় সৈন্যরা যদি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সাথে মৈত্রী করে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চক্রান্ত করে তবে আমাদের অনেক কিছু ভাবতে হবে। হিরনের গভর্নর গোমশতগীনের উপর নির্ভর করা যায় না। সে যে ধরনের ধূর্ত লোক, কোন সময় কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুশকিল। প্রয়োজনে খ্রিস্টানদের সাথে নিয়ে আমাদের টিকে থাকার কথা ভাবতে হবে। কারণ শুধু আমাদের একার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব নয়।

এও তো হতে পারে যে, মালিক আস্-সালেহ এর সন্ধি প্রস্তাবই আসল কৌশল মাত্র। তিনি যে কোন সময় মৈত্রী চুক্তি ভঙ্গওতো করতে পারেন। বলল ডিপুটি।

এটা খুব সম্ভব। বলল কমান্ডার। আমাকে মালিকের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছে, মালিক সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এটা না হলেও সেনা কর্মকর্তারা বেশী দিন মৈত্রী টিকে থাকতে দিবে না। তাদের খ্রিস্টান উপদেষ্টারাতো এক্ষুণি আক্রমণের পরামর্শ দিচ্ছে।

আপনার আবার আলেপ্পো যাওয়া উচিত। কমান্ডারের উদ্দেশে বলল ডিপুটি। আমি মৌসুল যাচ্ছি।

তুমি আবারও আলেপ্পো যাও। গিয়ে মালিক আস্-সালেহকে বলো আমি আসছি। কমান্ডারকে বলল সাইফুদ্দীন। তুমি আজ রওয়ানা হলে আগামীকাল রাতেই আমি রওয়ানা হবো। সে হয়তো আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজী হবে না। বলবে শহরের বাইরে আল-মোবারক নদীর তীরে আমি থাকবো। সেখানে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে। যদি সে সাক্ষাতে রাজী না হয় তবে তুমি এসে আমাকে খবর বলো।

আপনার একাকী যাওয়া কি ঠিক হবে? বলল ডিপুটি।

এ অঞ্চলে কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। তা ছাড়া আমি যাবো রাতের বেলায়। তখন কে জানবে মুসৌলের গভর্নর যাচ্ছে?

সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর গোয়েন্দা আর গুপ্তচর আমাদের এলাকায় চষে বেড়ায়। কখন কি থেকে কি ঘটে যায় বলা যায় না। বলল ডিপুটি।

বিপদের আশঙ্কা থাকলেও আমাকে যেতে হবে। ঝুঁকি তো কিছুটা নিতেই হবে। তুমি আজ মৌসুল চলে যাও। আমি আগামী রাতেই রওয়ানা হবো।

ওরা যখন এসব কথাবার্তা বলছিল, তখন দাউদ ও হারেছ দরজায় কান লাগিয়ে শুনছিল ওদের কথাবার্তা। এতটুকু শুনেই উভয়ে ঘরে ফিরে এল। দাউদ গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। ভাবল যে করেই হোক সাইফুদ্দীনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব এই ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছিল না দাউদ। অবশেষে দাউদের মাথায় একটা পরিকল্পনা এল।

আমরা সাইফুদ্দীনের দেহরক্ষী হিসেবে তার সঙ্গী হব। হারেসকে বলল দাউদ। হঠাৎ আমরা তার মুখোমুখি হয়ে বলব, আমরা মৌসুলের সৈনিক।

সে যদি বলে বসে, আমার সাথে তোমাদের যেতে হবে না, তোমরা মৌসুল চলে যাও। তখন কি করবে?

তখন আমি আমার কথার যাদু চালিয়ে পরিস্থিতি বাগে আনার চেষ্টা করব। বলল দাউদ।

তোমার সেই কৌশলেও যদি কাজ না হয়?

যদি দেখি কোন মতেই সে আমাদের সাথে নিতে রাজী হচ্ছে না তবে তাকেও যেতে দেয়া হবে না। কারণ সাইফুদ্দীন যাবে মালিক আস্-সালেহ-এর কৃত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করাতে। দাউদ হারেসকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তখন সে কি করবে।

সে রাতে সাইফুদ্দীন কমান্ডার ও ডিপুটিকে শেষ পরামর্শ দিচ্ছিল। রাতের প্রথম প্রহরে কমান্ডার বাইরে চলে গেল। হারেসের পিতা তার ঘোড়া আস্তাবল থেকে এনে দিলেন। মধ্যরাতে ডিপুটিও বেরিয়ে গেল। একাকী সাইফুদ্দীন ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের প্রায় শেষ প্রহরে হঠাৎ করে বিকট আওয়াজে দরজা খোলার শব্দে জেগে উঠল সাইফুদ্দীন। আঁতকে উঠল সে। ফৌজী পরম আনন্দে তাকে জানাল তার ভাই ফিরেছে। ফৌজী খুশীতে সাইফুদ্দীনের হাত ধরে বলল, আমার ভাইয়া এসে পড়েছে। তার সাথে এক বন্ধুও এসেছে।

তুমি কি আমার কথা তাকে বলেছো? জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।

হ্যাঁ। বলবো না? সে তো আপনার কথা শুনে ভীষণ খুশী হয়েছে। সে আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি চাচ্ছে।

তাদের নিয়ে এসো।

* * *

দাউদ ও হারেস সাইফুদ্দীনের কামরায় ঢুকল। ফৌজী তাদের অভিবাদন জানাল। সাইফুদ্দীনের ইঙ্গিতে তারা বসল। সাইফুদ্দীনের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য জামা কাপড়ে ধুলোবালি মেখে নিয়েছিল এবং তারা এভাবে শ্বাস নিচ্ছিল যে, তারা উভয়েই খুব ক্লান্ত। সাইফুদ্দীন তাদের জিজ্ঞেস করল, মৌসুল বাহিনীর কোন ডিভিশনে ছিল তারা এবং এতদিন কোথায় ছিল, এখন কোত্থেকে এসেছে।

হারেস যেহেতু সাইফুদ্দীনের সেনা বাহিনীরই লোক তাই সে সব ঠিক মতো জবাব দিল। দাউদের কিছুই জানা ছিল না। তাই সে বেশী ক্লান্ত ভাব ধরে নীরব রইল।

দাউদ বলল, বলতে লজ্জা লাগে, আমাদের বাহিনী কি লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করেছে। আমাদেরও পলায়ন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, কিন্তু ওকে নিয়ে আমি একটি টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলাম। আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বাহিনী আমাদের পশ্চাদ্বাবন করে, না-কি ওখানে শিবির স্থাপন করে। আমার খুব কৌতূহল হলো এ ব্যাপারটা জানার জন্যে। আপনার মনে হয় স্মরণ আছে, একবার খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শে আপনি একদল সৈন্যকে বিশেষ ট্রেনিং-এর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যারা গুপ্তচর ও ঝটিকা আক্রমণের ট্রেনিং নিয়েছিল। আমিও সেই ট্রেনিং-এ একজন ছিলাম। খুব ভালো করেছিলাম ট্রেনিং-এ। সে ট্রেনিং এবার আমার কাজে লেগেছে। আমি চিন্তা করলাম, পালিয়ে গেলেও আমার বাহিনীর জন্যে শত্রুপক্ষের কিছুটা হলেও খবর নিয়ে যাব আমি। তখন হারেসকে পেয়ে গেলাম আমি। তাকে বললাম, আমার সঙ্গে থাকতে। সেও থাকতে রাজী হল। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যরা আরো অগ্রসর হতে লাগল। আমার সাথে আর যদি মাত্র দশজন সৈন্য থাকতো, তাহলে গুপ্ত হামলা করে আমি ওদের বহু ক্ষতি সাধন করতে পারতাম।

আমরা দেখে এসেছি, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যরা তুর্কমান এলাকায় শিবির স্থাপন করেছে। আইয়ূবীর সৈন্যরা যেভাবে তাঁবু গেড়েছে তা থেকে বুঝা যায়, দীর্ঘ সময় তারা এ অঞ্চলে থাকবে। আফসোস! আমাদের সৈন্যরা পালিয়ে এসেছে। না হয়তো ওর কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন! শত্রু বাহিনীর যে পরিমাণ মৃতদেহ আমরা দেখেছি এর সংখ্যা কয়েকশ নয় কয়েক হাজার হবে। আহত ও জখমীও অসংখ্য। রাতের অন্ধকারে আমরা ওদের তাঁবুর একেবারে কাছে গিয়ে দেখেছি, আহতের সংখ্যা যে কতো তা নিরূপণ করা কঠিন। গোটা তাঁবুতেই আহতদের চিৎকার। উহ্! আহ! এদের আর্তচিৎকারে ওখানে দাঁড়ানোই কষ্টকর। আমার তো মনে হয় ওদের অর্ধেক সৈন্যই আহত হয়ে গেছে।

আমীরে মুহতারাম! আল্লাহ্ আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। আপনিই ভালো জানেন এখন কি করতে হবে। আমরা আপনার হুকুমের গোলাম মাত্র। যা হুকুম করবেন তাই শিরোধার্য করে নেবো। তবে অধমের খেয়াল এই যে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যদের যুদ্ধের সাহস নেই। আপনি যদি সৈন্যদের একত্রিত করে এখনই হামলা করেন, তবে আইয়ূবীকে আপনি দামেস্ক পৌঁছে দিতে পারেন।

সাইফুদ্দীন দাউদের বক্তব্য তন্ময় হয়ে শুনছিল। কারণ সে ছিল পরাজিত। বিজয়ের আশ্বাসবাণী শোনার জন্যে উদগ্রীব ছিল সাইফুদ্দীন। সে শুনতে চাচ্ছিল তার পরাজয় হয়নি। তার সৈন্যরাও পালিয়ে আসেনি। জোটের শরীকরা ভড়কে গিয়ে তাকে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। দাউদ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। দাউদ পাকা গোয়েন্দা। সে বুঝতে পেরেছিল সাইফুদ্দীন কোন্ ধরনের কথায় মুগ্ধ হবে।

আমরা মৌসুল যাচ্ছিলাম। হারেস বলল, পাশের গ্রামেই আমার বাড়ি। সে বাড়ির লোকদের সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করল। তাই ওর সাথে এখানে এলাম। এখানে এলে হারেসের আব্বা বললেন, আপনি এখানে। আছেন। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আপনাকে দেখেও প্রথমে আমি বিশ্বাস। করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কোন ভুল দেখছি না তো? আল্লাহ্ আমাদের উপর বড় দয়া করেছেন। এ কথাগুলো আপনার কাছে পৌঁছানো জরুরী ছিল। আল্লাহ মেহেরবানী করে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

তোমাদের কথা শুনে আমি খুবই প্রীত হলাম। রাজকীয় রীতিতে বলল সাইফুদ্দীন। তোমাদের এই বীরত্বের জন্যে পুরস্কার দেয়া হবে।

আমাদের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কি পুরস্কার হতে পারে, আমরা আপনার পাশাপাশি বসে আপনার সাথে কথা বলতে পারছি। বলল হারেস। আমরা আপনার সেবায় জীবন দিয়ে আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করতে প্রস্তুত।

শুনলাম আপনার সাথে আরো কারা নাকি আছে? জিজ্ঞেস করল দাউদ।

ওরা দুজন চলে গেছে। আমিও একটু পরেই এখান থেকে রওয়ানা হবো। বলল সাইফুদ্দীন।

আপনাকে জিজ্ঞেস করা ধৃষ্টতা হবে যে, আপনি এখানে কেনই বা যাত্রা বিরতি করলেন, আর এখন কোথায় যাবেন? আমি খুব লজ্জিত যে, আপনাকে আমার লোকেরা এই পুঁতিগন্ধময় ঘরে এ বিছানায় রেখেছে। বলল হারেস।

আমি নিজেই এ ঘরটি বেছে নিয়েছি। এখানে কয়েকদিন থাকার দরকার ছিল আমার। তোমরা আমার এখানে অবস্থানের কথা কাউকে বলো না।

এখন আপনি কোথায় যাবেন? জিজ্ঞেস করল দাউদ।

আগে আমি আলেপ্পো যাবে। এরপর ওখান থেকে মৌসুল চলে যাবো। বলল সাইফুদ্দীন।

কিন্তু আপনি যে একাকী। আপনার সাথে কোন দেহরক্ষী নেই তো? বলল দাউদ।

এ অঞ্চলে কোন ভয় নেই। একাকীই চলে যেতে পারব। বলল সাইফুদ্দীন।

অপরাধ ক্ষমা করবেন। বলল দাউদ। এ অঞ্চলকে দুশমন শূন্য মনে করবেন না। আমি যতটুকু জানি, আপনি হয়তো অতোটা জানেন না। আইয়ূবীর গুপ্তবাহিনী এ অঞ্চলেও রয়েছে। হঠাৎ কেউ যদি আপনাকে চিনে ফেলে তবে সারাজীবন আমরা দুজন আফসোস করে মরব, কেন আপনার নিরাপত্তার জন্যে সঙ্গী হলাম না আমরা। ঘটনাক্রমে আমরা যেহেতু এসে গেছি, আর আমাদের সাথে ঘোড়াও আছে, হাতিয়ারও রয়েছে, আমরা আপনার সাথে যাবো। আপনার মতো কোন শাসক নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া একাকী যাওয়া ভালা দেখায় না।

দেহরক্ষীর প্রয়োজন অনুভব করছিল সাইফুদ্দীন। কেননা এমনিতেই যে ভীতু ছিল, দাউদ তাকে আরো ভয় পাইয়ে দিল। সে তাদের বলল, তোমরা কাপড় চোপড় ধুয়ে নাও এবং আগামী রাতে রওয়ানা হওয়ার জন্যে তৈরী হও। ওরা বিদায় নিয়ে ঘরে চলে গেলে সাইফুদ্দীন ফৌজীর আগমন প্রত্যাশায় অধীর হয়ে রইল। কিন্তু সে রাতে ফৌজী আর সাইফুদ্দীনের ঘরে পা বাড়াল। দিনের বেলায় দাউদ ও হারেস সাইফুদ্দীনের জন্য খাবার নিয়ে গেল। এভাবেই ফৌজীর দেখা না পেয়েই কেটে গেল দিন।

* * *

জাতিদ্রোহী তিন শাসক সাইফুদ্দীন, গোমশতগীন ও মালিক যখন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে পুনর্বার যৌথ আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল, ঠিক সে সময় ওদের থেকে কিছু দূরে খ্রিস্টান সেনা অফিসার, কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের কনফারেন্স চলছে। সেখানে পর্যালোচনা হচ্ছে, তিন বাহিনীর পরাজয়ের কারণ। মূলত এরা সবাই ছিল পরাজিত। পরাজয় পর্যালোচনা এবং এর কারণ অনুসন্ধানই ছিল কনফারেন্সের মূল লক্ষ্য।

তিন বাহিনীর পরাজয় প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরাজয়। বলল রিমান্ড। আমি যতদূর জানি, তিন বাহিনীর মোকাবেলায় আইয়ূবীর সৈন্যসংখ্যা বেশী ছিল না।

আপনার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। বলল ফরাসী শাসক রেনাল্ট। আমাদের উদ্দেশ্য ওদের জয় পরাজয় নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হলো, মুসলিমরা পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত থাকুক আর একটি পক্ষ আমাদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করুক। আমাদের প্রধান শত্রু আইয়ূবী। আমরা চাই, ওর মুসলিম ভাইয়েরা ওর বিপক্ষে লড়াই করে ওর শক্তি বিনষ্ট করুক। আইয়ূবীর প্রতিপক্ষ মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ে আমাদের কোন ক্ষতি নেই। এমনও হতে পারে যে, আইয়ূবীকে পরাজিত করতে পারলে ওর প্রতিপক্ষ মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে পড়বে।

আমি আপনাকে মুসলিম বাহিনী ও এ অঞ্চলের বিস্তারিত রিপোর্ট দিচ্ছি। আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দারা এ রিপোর্ট পাঠিয়েছে। বলল এক ইহুদী কর্মকর্তা। তারা লিখেছে–সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর প্রতিপক্ষ তিন বাহিনীর সৈন্যদের অবস্থা এমন যে, সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ করার সাহস মোটেও নেই। ওরা সাহস হারিয়ে ফেলেছে। রণাঙ্গনে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্রও ফেলে পালিয়েছে। এক্ষুণি এরা পুনর্বার যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুত নয়। আমাদের যেসব উপদেষ্টা তিনবাহিনীতে কাজ করছে বহু কষ্ট করে তাদেরকে আইয়ূবী বিরোধী যুদ্ধে সম্মত করিয়েছিল। বর্তমানে আইয়ূবী তুর্কমান অঞ্চলের সবচেয়ে উর্বর ময়দানে তাঁবু গেড়েছে। এক্ষুণি অগ্রাভিযানের অভিপ্রায় তার নেই বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের উপদেষ্টাগণ চেষ্টা করছে মৌসুল, হিরন ও আলেপ্পোর বাহিনীর অবস্থা যাই থাকুক যাতে তড়িৎ আক্রমণে ওদের সম্মত করানো যায়। আমার বিশ্বাস, এক্ষুণি হামলা করতে সক্ষম হলে আইয়ূবীর অজ্ঞাতে আকস্মিক হামলা করে তাকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে। আইয়ূবীকে পরাজিত করার এটা একটা মোক্ষম সুযোগ।

এ কৌশলে কোনই কাজ হবে না। বলল অগাস্টার। কারণ আইয়ূবী কখনও অপ্রস্তুত নির্বিকার হয়ে বসে থাকে না। তার গোয়েন্দারা সব সময়ই জাগ্রত, তৎপর। প্রতিপক্ষের যে কোন আক্রমণের সংবাদ দুদিন আগেই তার কাছে পৌঁছে যায়। আমাদের যে সব উপদেষ্টা মুসলমানদের মধ্যে কাজ করছে, তাদের নির্দেশ দিয়ে দিন, তারা যেন গোয়েন্দা তৎপরতা আরো জোরদার করে। গোয়েন্দা কাজে আরো লোকবল বাড়াতে বলুন। তাদেরকে বলে দিন, তাদের গোটা এলাকায় গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিতে। সন্দেহজনক কোন লোককে পেলেই পাকড়াও করতে। যখন তারা যুদ্ধের জন্য বের হয় তখন বহু দূর পর্যন্ত যাতে গোয়েন্দারা সক্রিয় থাকে, যে কোন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পেলেই যেন আটক করে। ভ্রমণকারী, তীর্থযাত্রী, বণিক পথে যাদেরই পাবে সবাইকে তল্লাশী করবে। যাতে তিনবাহিনীর সৈন্যরা আইয়ূবীর শিবিরে আক্রমণের আগে তার কাছে কোন সংবাদ পৌঁছাতে না পারে।

আমরা আরো সংবাদ পেয়েছি, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী অধিকৃত অঞ্চল থেকে তার বাহিনীতে সৈন্য ভর্তি করছে। বলল আরেক অফিসার।

অন্য এক অফিসার বলল, আইয়ূবীর এসব কার্যক্রম রুখা দরকার।

সেনা ভর্তি রোধ করতে হলে আমাদের পরিকল্পনা মতো দ্রুত আক্রমণ করা দরকার। এ ছাড়া ভিন্ন একটা কৌশলও হতে পারে। মিশরে আমরা সেটি প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছিলাম। যেসব এলাকায় আইয়ূবী সেনা ভর্তি করছে, ওসব অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে নৈতিক ও চারিত্রিক দুষ্কর্ম ছড়িয়ে দিতে হবে আইয়ূবীর সেনাবাহিনীর বেশ ধরে। তাতে আইয়ূবীর বাহিনীর প্রতি মানুষ ক্ষেপে উঠবে।

অবশ্য মিশরে আমাদের কার্যক্রম পুরোপুরি সফল হয়নি, আইয়ূবী সেখানে তার অবস্থান সংহত করেছে, আর আমরা বহু অভিজ্ঞ গোয়েন্দাকর্মী ও প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা মেয়েকে হারিয়েছি। বেশ কিছু সংখ্যক মেয়ে আইয়ূবীর গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছে এবং নিহত হয়েছে। তদুপরি আমাদের একথা স্মরণ রাখতে হবে যে; আজ হোক, কাল হোক আমাদের প্রত্যেকের একদিন না একদিন মরতে হবে। তাই সেই মৃত্যু যীশু খ্রিস্টের জন্যে হোক সেটাই আমাদের জন্যে উত্তম। খ্রিস্টের মান রক্ষা ও ধর্মের খাতিরে নিজেদের জীবন যেমন কুরবানী করতে হবে অনুরূপ প্রয়োজনে আমাদের সন্তানদেরও উৎসর্গ করতে হবে।

সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বড় শক্তি সাধারণ নেতা। সে তার বাহিনী ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ভাবধারা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম জাতীয়তা ও ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সৈন্যরা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে। তাই তার সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে জীবন বাজী রেখে আমাদের সৈন্যদের উপর গেরিলা হামলা করে, তাদের এই ধর্মীয় চেতনা ও জাতীয়তাবোধে চির ধরাতে হবে।

সব সময়ই আমরা বিদ্রোহ ও নারী লিপ্সার টোপ ব্যবহার করে সুফল পেয়েছি। বলল অগাস্টাস। মুসলমানদের মধ্যে যারা বিত্তশালী তারা সব সময়ই ক্ষমতা লিলু, এ সুযোগ আমরা সব সময়ই ব্যবহার করেছি। তেমন নতুন কিছু পরিকল্পনার প্রয়োজন নেই আমাদের। তবে একটা ব্যাপার আমাদের বুঝতে হবে যে, আইয়ূবীর বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ধিক্কার ও ঘৃণা জন্মাতে পারলে আমাদের তৎপরতা বেশী কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কাজটা হলো, আইয়ূবীর নামে জঘন্য অপবাদ রটাতে হবে। কাজটা আমাদের করলে হবে না, করাতে হবে মুসলমানদের দ্বারা। প্রতিপক্ষও শত্রুদের বিরুদ্ধে অপবাদ প্রচারে নিজেদের মর্যাদা আত্মসম্মান নিয়ে ভাবলে হবে না, নিয়ম হলো, তোমার শত্রু তোমার তুলনায় যে মানের উঁচু ও শক্তিশালী তার বিরুদ্ধে তত শক্তিশালী ও জোড়ালো অপবাদ প্রচার করতে হবে। যাতে তোমাদের সৃষ্ট অভিযোগ মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকে। বিশ্বাসযোগ্য ভাষায়, অত্যন্ত ঘৃণ্য বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করতে হবে। মনে রাখবে, যখন একটা বিষয় হাজারো মুখে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও কানাঘুষা হবে তখন শয়ের মধ্যে পাঁচজন হলেও বিশ্বাস করতে শুরু করবে।

এ মুহূর্তে সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখা খুব জরুরী। বলল এক কর্মকর্তা। আমরা ধারণার চেয়ে অনেক বেশী অবকাশ পেয়েছি। অগাস্টাসের ভূমিকা খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, মুসলমান নেতৃবর্গের মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত মহামান্য অগাস্টাসের কৌশলের ফল। এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে এতদিনে আইয়ূবী ফিলিস্তিন দখল করে নিতো। অথচ এখন ওর মুসলমান ভাইয়েরাই ওর যাত্রা পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি করছে।

একটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলছে, বললো রিমান্ড। এসব মুসলিম যোদ্ধা আইয়ূবীর বাহিনীতে মোকাবেলা করতে সাহস পায়। আর আইয়ূবীর বাহিনীর সেই সৈনিকেরাই যখন তার প্রতিপক্ষে যুদ্ধে নেমেছে, তখন এদের বীরত্ব গেল কোথায়? এতো বিপুল সংখ্যক সৈন্য রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে এলো!

এটাতো বিশ্বাস ও আকীদার ব্যাপার। মুসলমানরা যাকে বলে ঈমান। বলল রেনাল্ট। যে সেনাপতি বা সৈনিক ঈমান খুইয়ে বসে সে আর যুদ্ধ করার সাহস পায় না। তখন তার কাছে জীবন আর সম্পদই হয়ে উঠে মুখ্য। এজন্যই তো আমরা গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি। যে কোনভাবে মুসলিম সৈনিক ও কর্মকর্তাদেরকে মদ-নারী, ভোগ-বিলাসিতায় আসক্ত করে ফেলো, তাহলে দেখবে অযথা তোমাদের ঘোড়া আর জীবনহানি ঘটবে না, বিনা যুদ্ধে বিজয় তোমাদের পা চুমু দেবে।

সেই কনফারেন্সেই সিদ্ধান্ত হলো, যে করেই হোক তিন বাহিনীকে আলেপ্পোয় একত্রিত করে এক কমান্ডের অধীনে পুনর্বার যুদ্ধে পাঠাতে হবে এবং সেই সাথে তিনবাহিনীর মধ্যে প্রয়োজনে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির সুযোগও রাখতে হবে।

* * *

রাতের দ্বিপ্রহর। আস্তাবল থেকে বের করা হলো তিনটি ঘোড়া। একটিতে সওয়ার হলো সাইফুদ্দীন, একটিতে হারেস ও অপরটিতে দাউদ। দাউদ ও হারেসের হাতে বর্শা। সৈনিকসুলভ সতর্কতা তাদের মধ্যে। ফৌজী, তার ভাবী ও বৃদ্ধ পিতা তাদের বিদায় জানাতে গেটের বাইরে দাঁড়ানো। হারেসের হাতে মশাল। সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি নিবদ্ধ ফৌজীর দিকে। আর ফৌজী দাউদের ঘোড়ার পাদানী বেঁধে দেয়ার কাজে মগ্ন। বিদায়লগ্নে ফৌজী দাউদের প্রতি নিজের মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ভাই ও সাইফুদ্দীনের উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করল না। একটু পরে আল্লাহ্ হাফেয়, আল্লাহ হাফেয ধ্বনি উচ্চারিত হলো সবার মুখে। অশ্বারোহী তিনজন নিমিষের মধ্যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

দীর্ঘক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ফৌজী ও তার ভাবী। যতক্ষণ অশ্বক্ষুরের আওয়াজ কানে ভেসে আসছিল ততক্ষণ তারা কান পেতে রইল সেদিকে।

অশ্বের আওয়াজ যত ক্ষীণ হতে থাকল ফৌজীর হৃদয় মন ততই বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তার কানে কেবল ধ্বনিত হলো দাউদের কণ্ঠস্বর। সত্যপথের সৈনিকদের শাদী আসমানে হয়ে থাকে। তাদের বাসর হয় আকাশের গ্রহে গ্রহে। তারকারা তাদের বিয়েতে আলোজসজ্জা করে ……….

আনমনে ননদ-ভাবী ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল কিন্তু ফৌজীর কানে আরো উচ্চকিত হতে থাকল দাউদের সেই কণ্ঠ…….. হঠাৎ ফৌজীর মনে উঁকি দিল একটা প্রশ্ন। আমি কি দাউদকে বিয়ে করতে চাই? মনে হতেই লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল, অন্ধকারের মধ্যেও উড়নায় মুখ ঢেকে ফেলল ফৌজী। পরক্ষণেই তার স্মরণ হলো দাউদের আরেকটি কথা–আমাদের সামনে এখন বিশাল রক্ত ফোরাত, সেখানে নেই কোন পুল, কোন সাঁকো। একথা স্মরণ হতেই দেহের রক্ত টগবগিয়ে উঠল ফৌজীর। বিয়ে ও বাসরসজ্জার স্বপ্ন কর্পূরের মতো উবে গেল, ফৌজীর সারা শরীর কঠিন হয়ে উঠল।

সারারাত সাইফুদ্দীন, হারেস ও দাউদ ঘোড়া হাঁকাল। বেলা উঠার পর দাউদ ও হারেস থেকে কিছুটা আগে আগে চলল সাইফুদ্দীন। দাউদ ও হারেস ইচ্ছে করেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগল আর পরস্পর কথা বলতে লাগল। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ও দূরত্বের কারণে সাইফুদ্দীন তাদের কথা শুনতে পাচ্ছিল না।

আমি বুঝতে পারছি না, তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন? ক্ষুব্ধ স্বরে বলল হারেস। এখানে ওকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেললে কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।

ওকে জীবিত রেখে ওর গোটা বাহিনীকেই আমি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। বলল দাউদ। শুধু একে হত্যা করলে কি হবে তার বাহিনীর কমান্ড আর কেউ নিশ্চয়ই হাতে নেবে। তাই আমার ইচ্ছা এর উদ্দেশ্য অবগত হয়ে ওদের সম্পূর্ণ শিকড় সমূলে উৎখাত করা। শুধু খোঁচা দিয়ে সতর্ক করা নয়। তুমি দয়া করে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখ। দেখ না আমি কি করি।

দুপুরের আগেই ওদের গোচরিভূত হলো আলেপ্পো শহরের সুউচ্চ মিনার। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল আল-মোবারক হ্রদের তীরবর্তী সুশোভিত উদ্যান। হ্রদের কাছে পৌঁছলে সাইফুদ্দীনের প্রেরিত কমান্ডার দৌড়ে এসে জানাল, মালিক আস্-সালেহ সাইফুদ্দীনের সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করছেন। আল মোবারক উদ্যানে পৌঁছালে মালিকের দুজন অফিসার সাইফুদ্দীনকে অভিবাদন করল। সাইফুদ্দীন বলল, সে এখন প্রাসাদে যাওয়ার চেয়ে এ হ্রদের পাশেই অবস্থান করতে আগ্রহী। অতএব, তাকে যদি এখানে তাঁবু খাঁটিয়ে দেয়া হয় সেটিই হবে তার পছন্দনীয়। সাইফুদ্দীনের আগ্রহে হ্রদের তীরবর্তী উদ্যানে প্রাসাদ সদৃশ তাঁবু খাঁটিয়ে দিতে অল্প সময়ের মধ্যে রাজ কর্মচারীরা লেগে গেল। রাজ প্রাসাদ থেকে সকল আরাম-আয়াশের সরঞ্জামাদির ও সেবার আয়োজনও করা হল। সাইফুদ্দীন দাউদ ও হারেসকে নিজের সাথেই রাখল। রাতে মালিকের পক্ষ থেকে প্রাসাদে নৈশভোজের দাওয়াত করা হল সাইফুদ্দীনকে এবং বলা হল সেই দাওয়াত ও মোলাকাত পর্বে উভয়ের মধ্যে কথা হবে।

* * *

সন্ধ্যায় মালিক আস-সালেহ ও সাইফুদ্দীনের বৈঠক হল। আল-মালিক সাইফুদ্দীনকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানাল। সাইফুদ্দীন কিশোর মালিকের হাতে চুমু দিয়ে কেঁদে ফেলল। বৈঠকে আলোচনা ও নৈশভোজের পর সাইফুদ্দীন তার জন্যে তৈরী বিশেষ তাবুতে ফিরে গেল এবং ওখানেই অবস্থান করল।

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, সাক্ষাতে সাইফুদ্দীন মালিককে আইয়ূবীর সাথে কৃত চুক্তি সম্পর্কে তার উদ্বেগ ও প্রেরিত পয়গামের প্রতিউত্তর না দেয়ার কথা উত্থাপন করলে মালিক বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, না! আমি পরদিনই দূত মারফত লিখিত জবাব দিয়েছি। কিন্তু আপনার কাছে না পৌঁছার ব্যাপারটি আমার মোটেও জানা নেই। আমি সেখানে লিখেও দিয়েছি, আপনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন না, চুক্তির ব্যাপারটি সম্পূর্ণই একটি সময়ক্ষেপণের কৌশলমাত্র।

আপনার কোন পয়গাম আমার কাছে পৌঁছেনি। বলল সাইফুদ্দীন। আমিতো এ নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম এই ভেবে যে, আপনি আইয়ূবীর সাথে সন্ধিচুক্তি করে আমাদের ধোকা দিয়েছেন এবং এটা আপনার জন্যে হবে মারাত্মক ভুল। বৈঠকে মালিকের দুজন সেনা অফিসারও ছিল। পয়গাম না পৌঁছার খবরে তাৎক্ষণিক তারা খোঁজ খবর শুরু করল দূতের। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যে দূতকে পয়গাম দিয়ে পাঠানো হয়েছিল সেদিন রওয়ানা হওয়ার পর আর তাকে এখানে দেখা যায়নি। এরপর বহু তালাশ করেও দূতের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। জানা গেল পয়গামবাহী দূত কখনও সেনা শিবিরে থাকতো না। সে একাকী দূরে থাকতো। কোথায় থাকতো তা কেউ জানতো না। এটা কেউ ধারণা করতে পারেনি যে, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়গাম আইয়ূবীর কাছে পৌঁছে যেতে পারে।

এ সংবাদ যখন মালিকের খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের কানে গেল তখন তারা এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিল, হয়তো প্রেরিত দূত নিজেই ছিল আইয়ূবীর গোয়েন্দা, নয়তো দূত আইয়ূবীর গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে নিহত হয়েছে। এই ঘটনার পরিণতি এই হতে পারে যে, আইয়ূবী প্রস্তুতি দ্রুত করছে, অথবা দ্রুত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তোমাদের প্রয়োজন তিনবাহিনী একত্রিত করে এখনই আইয়ূবীর উপর আক্রমণ করা।

খ্রিস্টানরা চাচ্ছিল মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি লড়াই অব্যাহত থাকুক। সে লক্ষ্যে পরদিন হিরনে ও মৌসুলে পয়গাম পাঠানো হল, সৈন্যরা যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থাতেই আলেপ্পো পৌঁছাতে। হিরনের গভর্নর গোমশতগীন এক্ষুণই আক্রমণে সম্মত ছিল না, নানাভাবে সে তাৎক্ষণিক আক্রমণে তার বাহিনীকে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছিল না, কিন্তু যৌথ বৈঠকে বসে তার পক্ষে আর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রম করা সম্ভব হলো না। বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হলো যে, তিনবাহিনী একক হাই কমান্ডের অধীনে থাকবে। আর সুপ্রীম কমান্ডার থাকবে সাইফুদ্দীন। গোমশতগীন তার সৈন্যবাহিনী দিল বটে কিন্তু নিজে আলেপ্পোতেই অবস্থান করল। সাইফুদ্দীনের অধীনে যুদ্ধ করতে সে যে মোটেও ইচ্ছুক নয় তা পরিষ্কার হয়ে উঠল।

তিন দিনের মধ্যে আলেপ্পো, হিরন ও মৌসুলের সৈন্যরা একত্রিত হয়ে গেল। খ্রিস্টানরা পূর্ব থেকেই যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য রসদের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তদুপরি আরো বেশী রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সৈন্যদের অভিযানে পাঠিয়ে দিল।

ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরী হল। আরো বলা হল, তিন বাহিনীর অগ্রাভিযানের খবর যাতে আইয়ূবী না পেতে পারে সে জন্য শুধু রাতের বেলায় সৈন্যরা অগ্রসর হবে আর দিনের বেলায় যাত্রা বিরত রাখবে। তা ছাড়াও ডানে বামে অগ্রভাগে গোয়েন্দা দল ও গুপ্তবাহিনীকে নির্দেশ দিল, পথের আশেপাশে কোন মুসাফের পাওয়া গেলেও তাকে গ্রেফতার করে আলেপ্পোয় পাঠিয়ে দিতে, যাতে কোন অবস্থাতেই প্রতিপক্ষ তিন বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে অবহিত হতে না পারে।

অভিযান শুরুর আগে সাইফুদ্দীন দাউদ ও হারেসকে ডেকে সাধুবাদ দিয়ে বলল, তোমরা কঠিন সময়ে আমাকে সঙ্গ দিয়েছো, এজন্য তোমাদেরকে ধন্যবাদ। অবশ্যই যুদ্ধের পরে তোমাদের পদায়ন করা হবে এবং পুরস্কৃত করা হবে। সাইফুদ্দীন হারেসকে বলল, তোমার বোনের একটি ঋণ আছে আমার উপর। আমি তার সামনে সেদিনই যাব যেদিন তার সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করতে পারব। হারেসের বিস্ময়ে সাইফুদ্দীন বলল, ফৌজী আমাকে বলেছিল, আইয়ূবীকে পরাজিত করে তার তরবারী নিয়ে যেতে পারলে সে আমার সাথে চলে আসবে। হারেস! আমি বিজয়ী বেশে ফিরে এলে তোমার বোন মৌসুলের রাণী হবে।

ইনশাআল্লাহ্! আল্লাহ্ আপনার আশা পূরণ করবেন। আচ্ছা তিন বাহিনী কি এক সঙ্গে যাচ্ছে?

হ্যাঁ। আমিই তিন বাহিনীর চীফ কমান্ডার।

জিন্দাবাদ। এবার হয়তো আইয়ূবীর পালানোর পালা। বলল দাউদ।

দাউদ ও হারেস চরম আনুগত্যের অভিনয় করে এবং ফৌজীর কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে নারীলোভী সাইফুদ্দীনের কাছ থেকে তিন বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা জেনে নিল।

এরপর সাইফুদ্দীন বলল, তোমরা দুজন এখন নিজ নিজ বাহিনীতে চলে যাও। আমার দেহরক্ষী এসে পড়েছে। তোমাদের কথা আমি স্মরণ রাখব। এদিকে তিনবাহিনী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে তার অজ্ঞাতসারে পরাজিত করতে এগিয়ে চলল আলেপ্পোয়।

রাতের বেলায় শুরু হল তিন বাহিনীর যৌথ অভিযান। দাউদ ও হারেস মৌসুলের সেনাবাহিনীর সাথে মিশে গেল। হারেস মৌসুল সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈনিক হওয়ার কারণে অনেকেই তাকে চিনতো। কিন্তু দাউদ ছিল অপরিচিত মুখ। সন্দেহ নিরসনের জন্যে হারেস নিজেই দাউদ সম্পর্কে সৈনিকদের বলল, সে গভর্নরের প্রেরিত লোক। চলার পথে দাউদ সম্পর্কে কেউ আর তেমন ঘাটাঘাটি করল না। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন বাহিনীর সৈন্য অগ্রসর হতে লাগল। অধরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর বাহিনী পাহাড়ী উঁচু-নীচু গিরিখাদ অতিক্রম করতে গিয়ে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ল। এই সুযোগে দাউদ হারেসকে বলল, পালানোর এই তো সুযোগ, সুযোগ বুঝে দল থেকে কেটে পড়তে হবে। রাতের আঁধার ও দুর্গম পথের বন্ধুরতার সুযোগে উভয়েই তাদের ঘোড়া দল থেকে পিছু হটিয়ে আড়াল হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। দাউদের ইচ্ছা ছিল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই উধশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। দিনের বেলায় যখন তিন বাহিনীর অগ্রাভিযান থেমে যাবে ইত্যবসরে তারা এদের খবর নিয়ে তুর্কমান পৌঁছে যেতে পারবে। একদিন আগেই সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী আক্রমণের সংবাদ পেয়ে মোকাবেলার আগাম প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবেন।

দাউদ মনে করেছিল তার পরিকল্পনায় ত্রুটি নেই। কিন্তু শত্রুবাহিনীর উপদেষ্টাদের অতিরিক্ত সতর্কতা ও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে দাউদের কোন ধারণা ছিল না। দ্রুপ এই অঞ্চলের ভৌগোলিক দুর্গমতা সম্পর্কেও দাউদ অবগত ছিল না। শত্রু বাহিনী তাদের আশপাশের তিন মাইল পর্যন্ত গুপ্ত বাহিনী ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। দুর্গম পথের ঝোঁপ ঝাড়ে ঘাতকবাহিনী সন্দেহভাজনদের গতিবিধি ওঁৎ পেতে থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল। এ বিষয়টি ঘুণাক্ষরেও দাউদের জানা ছিল না।

দাউদ ও হারেস উন্মুক্ত ময়দানের দিকে বেরিয়ে এল। তারা যখন ভাবল যৌথ বাহিনী থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে গেছে; তখন তাদের ঘোড়াকে তুকমানের পথে ঘুরিয়ে দিল এবং ঘোড়া তীব্র বেগে ছুটানোর পরিবর্তে ধীরে ধীরে চালাতে লাগল।

তারা খুব দ্রুতবেগে ঘোড়া না ছুটিয়ে ধীরে সুস্থে যেতে লাগল, যাতে বিরতিহীনভাবে এক নাগাড়ে যেতে পারে। রাত শেষে ভোরের আলো যখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল, তখন দাউদ ঘোড়া থেকে নেমে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে যৌথ বাহিনীর গমন পথ দেখতে লাগল। কিন্তু দাউদের দৃষ্টিতে যৌথ বাহিনীর গমন পথের ধূলো ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে দাউদ ভাবল, তারা দুশমন থেকে নিরাপদ।

নিরাপদ ভাবাটাই ছিল দাউদের বড় ভুল। টিলার উপর দাঁড়ানো অবস্থায় দুশমনদের দৃষ্টি পড়ল তাদের উপর। কারণ এলাকাটি ছিল ঘন বালিয়াড়ী আর টিলায় ভরা। টিলা থেকে নেমে দাউদ ও হারেস তীব্র বেগে ঘোড়া হাঁকাল। কয়েকটি টিলা পেরিয়ে একটি সংকীর্ণ গিরিপথে বাঁক নিতে গেল দাউদ ও হারেস। ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের পথ আগলে দাঁড়াল চারজন অশ্বারোহী। হাতে তাদের উন্মুক্ত তরবারী, উত্তোলিত বর্শা। অশ্বারোহীরা ঘিরে ফেলল দাউদ ও হারেসকে। ধমকের স্বরে বলল, ঘোড়া থেকে নেমে তরবারী ফেলে দাও। পালানোর চেষ্টা করলে বাঁচতে পারবে না।

আমরা মুসাফের, আমাদের পথ আগলে দাঁড়ালে কেন? বলল দাউদ।

মুসাফের মৌসুল সেনাবাহিনীর উর্দি পরিহিত থাকে না বলল এক অশ্বারোহী। মুসাফেরদের সাথে এমন অস্ত্র ও থাকে না, যে অস্ত্র তোমাদের কাছে রয়েছে। তোমরা যেই হও না কেন, তোমাদের আলেপ্পো যেতে হবে, ঘোড়া ঘুরিয়ে ফেল।

এরা ছিল আলেপ্পো বাহিনীর গুপ্তচর। এরা সন্দেহভাজন লোকদের গ্রেফতার করে কর্তাদের নির্দেশ মতো আলেপ্পো নিয়ে যেতো। বিগত যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবীর গোয়েন্দা তৎপরতা নস্যাৎ করে দিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে খ্রীস্টান উপদেষ্টারা।

দাউদ হারেসকে অনুচ্চকণ্ঠে বলল, ভাই! সময় এসে গেছে, শেষ চেষ্টা করতে হবে। হারেস নিজ ঘোড়ার লাগাম ধরে হেচকা টান দিলে ঘোড়া সামনে দুপা উঁচু করে দাঁড়াল, আর হারেস সম্মুখের অশ্বারোহীকে বর্শা বিদ্ধ করল কিন্তু ইতিমধ্যে পাশের অশ্বারোহীর বর্শা এসে হারেসের কাঁধে পড়ল। দাউদ ছিল গুপ্ত ও ঝটিকা আক্রমণে পারদর্শী। সে হঠাৎ ঘোড়াকে ঘুরিয়ে এক অশ্বারোহীকে হত্যা করে ফেলল। কিন্তু শত্রু চারজন আর এরা মাত্র দুজন। তাছাড়া জায়গাটি ছিল সংকীর্ণ। অশ্বযুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অনুপোযোগী। তদুপরি দাউদ এদের তিনজনের মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হল। দীর্ঘক্ষণ চলল বর্শা ও তরবারীর ঝনঝনানি আর ঘোড়ার লম্ফ ঝম্ফ। হারেসের আঘাত ছিল খুবই গভীর। বেশী রক্তক্ষরণে সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল। তিনজনের মোকাবেলা করতে গিয়ে দাউদও আহত হলো মারাত্মকভাবে। তারপরও সে বোধ ও চিন্তাশক্তি স্থির রাখতে সক্ষম হল। এক পর্যায়ে সব শত্রুই দাউদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো। দাউদের আঘাতে আঘাতে নিস্তেজ ও নীরব হয়ে গেল সব ঘাতক। দাউদ যখন দেখল যুদ্ধ খতম তখন হারেসের গ্রামের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। যদিও ঘোড়া হাঁকানোর মতো শক্তি তার গায়ে ছিল না, তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে হারেসের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে শত্রু বাহিনী আক্রমণের আগে সংবাদটা আইয়ূবীর কাছে পৌঁছানোর কর্তব্য পালনে ব্রতী হল দাউদ।

হারেসের প্রতি তাকানোর অবকাশ রইল না তার। কেননা হারেসের শরীর নিথর হয়ে পড়েছিল, সে ধারণা করেছিল হারেস ইতিমধ্যেই প্রাণ ত্যাগ করে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেছে। দাউদের নিজের প্রাণও ওষ্ঠাগত। বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। তবুও চাচ্ছিল কোন মতে হারেসের বাবার কাছে পৌঁছে বলবে, শহীদ সন্তানের মর্যাদা রক্ষায় তিনি যেন আইয়ূবীর কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হন। তুর্কমান ছিল অনেক দূর। তদপেক্ষা হারেসের গ্রাম কাছে; তাই হারেসের গ্রামের উদ্দেশেই ঘোড়া ছুটাল আহত দাউদ।

দাউদের শরীর শত্রুদের বর্শার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ঘোড়ার জীন ও পিঠ রক্তে লাল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। তবুও শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাবুক হানল দাউদ। ঘোড়া যতো তীব্র ছুটতে লাগল ঝাঁকুনি খেয়ে দাউদের শরীর থেকে ততই বেশী রক্ত বেরিয়ে যেতে লাগল। রক্তক্ষরণের কারণে তার মাথা চক্কর দিতে লাগল। বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। চোখে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করল। ঘোড়ার পিঠে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে চেষ্টা করল দাউদ। কিন্তু প্রাণবায়ু যেন উড়ে যেতে উদ্যত। আর ঘোড়ার পিঠে বসে থাকার শক্তি পাচ্ছে না সে। আসমানের দিকে তাকিয়ে বারবার। কালেমা তাইয়্যেবা পড়ছিল আর বলছিল, হে আসমান ও যমীনের মালিক! তোমার রাসূলের দোহাই! আমাকে আরেকটু সময় জীবন ভিক্ষা দাও, আমার কর্তব্য পালনের সুযোগ দাও! ঘোড়া উধশ্বাসে হারেসের বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। এক সময় মাথা ঘুরে পড়েই গিয়েছিল প্রায়, কোন মতে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অশ্বপিঠের উপর পড়ে রইল দাউদ।

পুনর্বার ঘোড়ার পিঠ থেকে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ল শরীর। ঘোড়ার শরীর জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা করল দাউদ, কিন্তু পারল না। দ্রুত ধাবমান অশ্বপিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ল নীচে। অনুধাবন করল তার শরীর মাটি স্পর্শ করেছে। দুচোখে নেমে এল অন্ধকার।

কতোক্ষণ এমন অবচেতন অবস্থায় ছিল বলতে পারবে না সে। কিছুটা হুঁশ ফিরে এলে অনুভব করল মানুষের স্পর্শ। তাকে ধরে রেখেছে কোন মানুষ। শত্রু কবলিত ভেবে মুক্তির আশায় উঠে দাঁড়াতে চাইল দাউদ। কিন্তু তাকে শুইয়ে দিয়ে কানে কানে কে যেন বলল, দাউদ! তুমি এখন ঘরে রয়েছ, ভয় পেয়ো না। মুমূর্ষ অবস্থায়ও ফৌজীর কণ্ঠ নির্ণয় করতে পারল দাউদ। বেহুশ অবস্থায়ই হেঁচড়ে হেঁচড়ে দাউদ ফৌজীদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল। ফৌজী ও তার ভাবী অবচেতন দাউদকে সেবা শুশ্রষা ও ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিয়ে গায়ের রক্ত পরিষ্কার করে শুইয়ে রেখেছিল। দীর্ঘক্ষণ পরে হুঁশ ফেরার পর দাউদ বুঝল, ফৌজী তার কাছে, তখনই জিজ্ঞেস করল তোমার বাবা কোথায়?

উত্তরে বলল ফৌজী, তিনি এক জায়গায় গেছেন, আগামীকাল হয়তো ফিরবেন। পানি পানি………অতি কষ্টে বলল দাউদ।

ফৌজী একটি পানপাত্র ভরে পানি এনে ধরল দাউদের মুখে। ধীরে ধীরে সবটুকু পানি পান করল দাউদ। ফৌজীর হাতের পানি পান করে যেন প্রাণ ফিরে এলো দাউদের। সে বলতে লাগল ফৌজী! তুমি বলেছিলে পুরুষের কাজ মেয়েরাও করতে পারে। দাউদের কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল, কথা বেরুচ্ছিল না। অনেক কষ্টে সেবারত ফৌজী ও দাউদের ভাবীকে নিবৃত্ত করতে দাউদ বলল, আমার সেবা করা অর্থহীন। আমার গায়ের রক্ত সব নিঃশেষ হয়ে গেছে, আমাকে তোমরা বাঁচাতে পারবে না। আমার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব হলে তোমাদেরকে ঘরের বাইরে পাঠানোর কল্পনাও করতে পারতাম না। কিন্তু এখন বিষয়টি তোমার আমার জীবন ও মর্যাদার নয়, বিষয়টি মিল্লাতের। রাসূল (স.)-এর পবিত্র আমানতের ব্যাপার এখানে জড়িত। দাউদ তুর্কমানের পথটি ফৌজীকে যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলল, আলেপ্পো, মৌসুল ও হিরনের যৌথ বাহিনী রাতের অন্ধকারে আইয়ূবীর সৈন্যবাহিনীর উপর আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু আইয়ূবীর কাছে এর কোন সংবাদ নেই। তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং আশংকামুক্ত মনোভাবে রয়েছেন। তোমাকে তার কাছে গিয়ে এ সংবাদ পৌঁছাতে হবে, তোমার ভাই এপথে শহীদ হয়ে গেছে।

দাউদের কথা শুনে ফৌজী তখনই তৈরী হয়ে গেল। কিন্তু তার ভাবী দাউদকে এ অবস্থায় রেখে যেতে ইতস্তত করছিল, এমতাস্থায় খুব ক্ষীণকণ্ঠে ফৌজীকে কাছে ডাকল দাউদ। ফৌজী কাছে এলে তার হাত ধরে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ফৌজী! সত্যের পথের সৈনিকদের বিয়ে আসমানে হয়ে থাকে, আসমানের পথে হয় তাদের বরযাত্রা, তাদের বিয়েতে তারকারাজী আলোকসজ্জা করে…। আমাদের বিয়েতে ফেরেশতারা বরযাত্রী হবে……! এই বলে দাউদের মাথা একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল, নিথর হয়ে গেল তার দেহ। দাউদের অর্পিত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে, এই অবস্থায়ই আল্লাহর উপর বাড়িঘর ছেড়ে দাউদের ঘোড়া ও আস্তাবল থেকে অপর একটি ঘোড়া এনে ননদ-ভাবী রওয়ানা হল। গমন পথ জানা ছিল না ফৌজীর। দাউদের কথার ভিত্তিতে রাতের আঁধারে আল্লাহর উপর ভরসা করে বাড়ি থেকে দুটি অবলা মেয়ে দুটি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দাউদ ফৌজীকে পথের নির্দেশনা দিয়েছিল একটি তারা দেখিয়ে। সেই নির্দিষ্ট তারা লক্ষ্য করে পথ চলল ফৌজী ও তার ভাবী। যে মেয়ে কোনদিন বাড়ির বাইরে যায়নি, সেই কিশোরীই আজ রাতের আঁধারে নির্বিক, নিঃশঙ্ক।

ওদিকে যৌথবাহিনী সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে রাতের আঁধারে আবারো অগ্রসর হতে লাগল। তুকমান তেমন বেশী দূরে নয়। কিন্তু আইয়ূবী আসন্ন আগ্রাসন সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। তিনি গোয়েন্দা ব্যবস্থা বহাল রেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু শত্রু পক্ষ এবার তার গোয়েন্দা তৎপরতাকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। এদিকে তিনি সেনা অফিসারদের কাছেও বলছিলেন, মনে হয় না সাইফুদ্দীনরা পুনর্বার তাড়াতাড়ি আক্রমণের সাহস পাবে। অথচ তিনি সাইফুদ্দীনের উদ্দেশে পাঠানো মালিক আস-সালেহ এর চিঠি ঠিকই পেয়েছিলেন। তবুও তার মনে হচ্ছিল এরা এতো তাড়াতাড়ি আক্রমণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে না। এজন্য সালাহ্ উদ্দীন সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিলেন প্রতিপক্ষের আক্রমণ আশংকা থেকে। যার ফলে যৌথবাহিনী তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে ও অপ্রস্তুতিতে রাতের আঁধারে আক্রমণ করে তাকে বেহাল করে দিতে সক্ষম হতো।

* * *

ফৌজী ও তার ভাবী দাউদের অর্পিত কর্তব্য পালনে এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল যে, তারা যে নারী, পথে তাদের পদে পদে বিপদ, শংকা, আর সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হতে পারে একথা ভুলেই গিয়েছিল। রাত পেরিয়ে সূর্যের আলো উঠা পর্যন্ত তারা দেখে দেখে অবিরাম পথ অতিক্রম করল ফৌজী। সকালের সূর্য যখন চারদিকে আলোকিত করে উদিত হল, তখন তারা পৌঁছে গেল সেই বালিয়াড়ী, টিলা ও ঝোঁপঝাড়ের এলাকায় যেখানে দাউদ ও হারেস আক্রান্ত হয়েছিল শত্রু বাহিনীর দ্বারা। ফৌজী দেখতে পেল একটি টিলার পাদদেশে একজন লোক যেন বসে রয়েছে। ফৌজী তার ভাবীকে বলল, মনে হয় কোন আহত জখমী ব্যক্তি। কিন্তু জানাতো নেই কে, কাজেই কাছে যাবো না। তাদের গমন পথ ছিল লোকটির পাশ ঘেঁষে, কিন্তু তারা ঘোড়া কিছুটা দূর দিয়ে নিতে সচেষ্ট হল। এমতাবস্থায় আহত লোকটি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল সে দাঁড়াতে পারছে না, তার শরীর রক্তে রঞ্জিত। তারপরও লোকটিকে পরখ করে নেয়ার জন্য গতি বাড়িয়ে কিছুটা কাছ দিয়েই যেতে লাগল ফৌজী। লোকটার চেহারার দিকে তাকিয়ে ফৌজী চিৎকার দিয়ে উঠল, হায় আল্লাহ্! ভাইয়া! এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে এল ফৌজী।

আহত লোকটিই ছিল হারেস। দাউদ মৃত মনে করে চলে গেলেও আকস্মিক কঠিন আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল হারেস। ফৌজী ও তার ভাবী কয়েকটি ছোট পাত্রে পানি ভরে সাথে এনেছিল। পাত্র থেকে পানি পান করিয়ে হারেসের মুখে পানি ঝাঁপটা দিল ফৌজী। হারেস কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়ে বলতে লাগল, আমিতো ঘরে এসে পড়লাম, দাউদ কোথায়?

ফৌজী তাকে বলল, ভাইয়া, তুমি ঘরে নও, এখনো তুর্কমানের পথে, পাহাড়ে।

ফৌজী সংক্ষেপে দাউদের মৃত্যু ও তার উপর অর্পিত দায়িত্বের কথা ভাইকে জানাল এবং বলল, আমরা এখন তুর্কমানের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছি।

হারেস ফৌজীর কথা শুনে বলল, তোমরা আমাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দ্রুত তুর্কমানের দিকে ঘোড়া হাঁকাও। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

দুজনে মিলে হারেসকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিল। ফৌজী একই ঘোড়ায় হারেসের পিছনে সওয়ার হয়ে ওকে এক হাতে ধরে অন্যহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরল।

হারেসের বেঁচে থাকাটা ছিল বিস্ময়কর। গভীর ক্ষত থেকে যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছে, এতে হারেসের বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু তবুও আল্লাহর বিশেষ রহমতে সে বেঁচে ছিল। ফৌজীর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে ঘোড়ার উপরে বসেছিল হারেস। ফৌজী ভাইকে একহাতে ধরে রেখে অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখল। ক্ষীণ আওয়াজে তাদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল হারেস।

সুলতান আইয়ূবীর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে তার শত্রুবাহিনী সাইফুদ্দীনের কমান্ডে দুর্বার গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল, আর এদিকে নিরাপদ পথ ধরে ভয়ানক আক্রমণের সংবাদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল ফৌজী ও তার ভাই-ভাবীর তিনজনের ছোট্ট কাফেলা।

এমন সময় আকাশ অন্ধকার করে ধূলি উড়তে শুরু করল। চারদিকে নেমে এলো অন্ধকার, আকাশে ঘনকালো মেঘের আবরণ। আকাশের অবস্থা দেখে ভড়কে গেল ফৌজীর ভাবী। ভীতকণ্ঠে ফৌজীকে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলল, দেখেছ, এটা কি? আকাশের অবস্থা দেখে ফৌজীও কিছুটা ভীত হয়ে পড়ল। হারেস জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ফৌজী?

মরুঝড়! আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ওই অঞ্চলের মানুষ হিসেবে ফৌজী মরুঝড়ের সাথে পরিচিত। মরু ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কেও জ্ঞাত সে। এজন্য আকাশের অবস্থা ও ধূলিঝড়ের আশংকায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেল ফৌজী। কেননা এলাকাটি ছিল বালুকাময় ও টিলাযুক্ত। এসব জায়গায় মরু ঝড়ে এক জায়গার বালিয়াড়ী অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। ধূলি আর বালু চাপা পড়ে মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি কোথায় যে হারিয়ে যায় কোন পাত্তাই থাকে না।

সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী জানতেন না, এই মরু ঝড়ের চেয়েও প্রচণ্ড ঝড় ধেয়ে আসছে তার অজ্ঞাতে কোন জানান না দিয়ে।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সম্মিলিত বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছিল, ঝড় থেমে গেলে তারা সবকিছু ঠিকঠাক করে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখতে পারবে, কিন্তু বিধি বাম! ঝড়ের তাণ্ডবে সাইফুদ্দীন বাহিনীর সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। দিনের বেলায় বিশ্রামের জন্য তৈরী তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল ঝড়। সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল, অনেকে আহতও হলো। যে যেভাবে পারে পাহাড়ের টিলার আড়ালে জীবন বাঁচাতে ঠাই নিল। আর মালবাহী উট ও বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলো দড়ি ছিঁড়ে দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পালাতে লাগল। এদিকে ফৌজী ঝড় উপেক্ষা করেই পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে গন্তব্যে চলছে, মৃত্যুপথযাত্রী ভাইয়ের প্রতি খেয়াল নেই তার।

* * *

সুলতান আইয়ূবীর সেনা শিবিরও ঝড়ের তাণ্ডবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমান্ডারগণ ঝড়ের মধ্যেই সিপাহীদেরকে চিৎকার করে রদসপত্র বাঁচানোর জন্যে তাকিদ দিচ্ছে। ঝড়ে উড়ে আসা কাঁকর ও বালিতে সিপাহীদের গায়ে ধূলোর মোটা আস্তরণ পড়ে যাচ্ছে, উড়ে আসা কাকরগুলো যেন তীরের মতো বিদ্ধ হচ্ছে শরীরে। তবুও তারা নিজেদের রসদপত্র বাঁচাতে তৎপর। এই তীব্র প্রলয়ংকরী ঝড়ের মধ্যে একটি ঘোড়া কজন সিপাহীর উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। আরোহী ঘোড়াকে সামলাতে পারছে না। অবস্থা দেখে এক সিপাহী আরোহীকে চিৎকার দিয়ে বলল, আরে হতভাগা ঘোড়া থামাও! কোন্ আড়ালে যাও! ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে! ঘোড়া থামল। এক সিপাহী আরোহীকে দেখে সাথীদের বলল, আরে এ যে মহিলা! সাবধান! কিছু বলো না! অন্য সিপাহী বলল, একজন নয়। মহিলাতো দুজন দেখা যাচ্ছে।

সিপাহীরা ভাবল, ঝড়ের ধাক্কায় হয়তো পথ হারিয়ে এরা এদিকে এসেছে। তাই দুজন দুটি ঘোড়ার বাগ ধরে তাদেরকে একটু আড়ালে নেয়ার জন্য চেষ্টা করল–

সিপাহীদের তৎপরতা দেখে ঝড়ের বিকট আওয়াজকে ছাড়িয়ে গলা চড়িয়ে ফৌজী বলল, আমাদেরকে সুলতান আইয়ূবীর কাছে নিয়ে যাও, আমরা খুব জরুরী বার্তা নিয়ে এসেছি। জলদি আমাদেরকে সুলতানের কাছে নিয়ে চল; না হয় তোমরা সবাই মারা পড়বে!

কয়েকজন সিপাহী বহু কষ্টে তাদেরকে সুলতানের তাঁবুর কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু হায়! সেখানে তাঁবুর নাম-গন্ধও নেই। সব ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সুলতানের এক দেহরক্ষী এদের দেখে সুলতানের কাছে নিয়ে গেল। তবু উড়ে যাওয়ার পর সুলতান একটি স্থাপনার আড়ালে আশ্রয় নিলেন। দুজন মহিলা আরোহী এদিকে আসতে দেখে সুলতান নিজেও এগিয়ে এলেন।

সবার আগে হারেসকে ঘোড়া থেকে নামানো হল। এরপর নেমে এল ফৌজী ও তার ভাবী। তখনও জীবিত হারেস। ফৌজী অতি সংক্ষেপে সুলতানকে বলল, দাউদের বার্তা এবং শত্রুবাহিনীর আগমনের সংবাদ। হারেস ক্ষীণ কণ্ঠে সুলতানকে জানাল, দাউদ ও তার মিশনের কথা। খুব কষ্টে কথা শেষ হতে না হতেই হিমশীতল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল হারেস।

কিছুক্ষণ পর মরু ঝড়ের তীব্রতা কমতে শুরু করল। ঝড় কিছুটা থেমে এলেই কমান্ডারদের ডাকালেন সুলতান। তিনি কমান্ডারদের বললেন, তাঁবু ঠিক করার দরকার নেই, খুব তাড়াতাড়ি সৈনিকদের যুদ্ধের জন্যে তৈরী কর। গুপ্ত বাহিনীকে এখনই ডেকে পাঠাও। আইয়ূবী কমান্ডার ও সেনাকর্তাদের জানালেন, তাদের বিরুদ্ধে কি আগ্রাসন আসছে। এখন তাদের কি কি করতে হবে, মোকাবেলার ধরণ ও কৌশল কি হবে।

এক সময় ঝড় থেমে গেল বটে, কিন্তু নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল যেন দুনিয়া। আকাশে একটি তারা পর্যন্ত দেখা যায় না, আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের পর্দা।

সাইফুদ্দীনের নেতৃত্বে তিনবাহিনীর সৈন্যরা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া রসদপত্র ও তাঁবু গোছানোর কাজে লিপ্ত। সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে রাতের আক্রমণ স্থগিত ঘোষণা করল সাইফুদ্দীন। অধিকাংশ সৈন্য ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বেশীরভাগ রসদপত্র তখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অগোছালো।

কিন্তু সুলতান আইয়ূবীর শিবির কর্মমুখর। তাদের কারো চোখে ঘুম নেই। রাতের আঁধারেই আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী সাইফুদ্দীনের শিবির থেকে তিন মাইল ঘুরপথ অতিক্রম করে তাদের পিছনে অবস্থান নিল, সাইফুদ্দীন ঘুর্ণাক্ষরেও জানে না যাদের সে চিরতরে নিঃশেষ করতে বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছে, তারাই অগ্র-পশ্চাতে ঘিরে ফেলেছে তাদের।

* * *

সূর্য উঠল। দেখা গেল, সাইফুদ্দীনের বাহিনীর রসদপত্র এলোমেলো হয়ে গেছে। তাঁবুগুলো ঝড়ে উড়িয়ে কোথায় নিয়ে গেছে খোঁজ নেই। ভীত-সন্ত্রস্ত উট ও ঘোড়াগুলো ঘুমন্ত সৈন্যদের পায়ে পিষে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে শুরু করেছে। দ্রুততার সাথে সাইফুদ্দীন সৈন্যদের নির্দেশ দিল সবকিছু গুছাতে। কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্র গোছাতেই তাদের দিনের অর্ধেক কেটে গেল।

সাইফুদ্দীন তিনবাহিনীর সেনা কমান্ডারদের নির্দেশ দিল যেহেতু আইয়ূবী বে-খবর তাই দিনের আলোতে মুখোমুখি আক্রমণ করেই ওদের পরাস্ত করা সম্ভব হবে।

দিনের শেষ প্রহরে সাইফুদ্দীনের নির্দেশে সুলতানের শিবিরে আঘাত হানল যৌথবাহিনী। তিনবাহিনীর সৈন্যদের অবস্থানের ডানে বামে অসংখ্য টিলা, বালিয়াড়ী ঝোঁপ-ঝাড়, ঘন বৃক্ষাদি। যেমনি সাইফুদ্দীনের নির্দেশে যৌথবাহিনী সুলতানের শিবিরে আক্রমণ করল অমনি দুপাশের টিলার ঘন গাছ-গাছালীর আড়াল থেকে তাদের উপর তীর বর্ষণ শুরু করল সুলতানের গুপ্তবাহিনী। আর সম্মুখ থেকে সুলতানের সৈন্যরা ছুঁড়তে শুরু করল অগ্নিগোলা। মিনজানিক থেকে নিক্ষেপ করলো ছোট ছোট অগ্নিযুক্ত মটকা। যা উপর থেকে মাটিতে পড়ে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সাইফুদ্দীন বাহিনীকে পশ্চাদপসারণে নির্দেশ দিল। সাইফুদ্দীনের নির্দেশে যৌথবাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করল অমনি পিছন দিকে সুলতানের ঝটিকা বাহিনী বিদ্যুৎগতিতে হামলে পড়ল। সাইফুদ্দীনের যৌথবাহিনী চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে প্রমাদ গুণতে শুরু করল। যে যেভাবে পারে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। সেনা কমান্ড ভেঙ্গে পড়ল, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দিল তিনবাহিনীর মধ্যে। সাইফুদ্দীনের নিরাপত্তা বাহিনীও আক্রান্ত হল। ইত্যবসরে চারদিক আঁধার করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, রাতের আঁধারেও অব্যাহত থাকল সুলতানের সিংহ শার্দুলদের আক্রমণ।

প্রত্যূষে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে সুলতান আইয়ূবী যুদ্ধের পরিস্থিতি সচক্ষে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি পদাতিক বাহিনীর কমান্ডারের কাছে দূত পাঠালেন। নির্দেশ পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে চতুর্দিক ঘিরে ফেলল অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যরা। সাইফুদ্দীনের সৈন্যরা তখন সুলতান বাহিনীর দ্বারা বেষ্টিত। গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হল, একসাথে সুলতানের সৈন্যরা শত্রুদের উপর হামলে পড়ল।

সাইফুদ্দীনের রণক্লান্ত সৈন্যরা সুলতানের সৈন্যদের প্রতিআক্রমণের দখল সামলাতে মোটেও সক্ষম হলো না। সাইফুদ্দীন নিজেও হয়ে পড়ল শঙ্কিত।

তার আহত সৈন্যরা নিজ বাহিনীর অশ্বখুরেই পিষ্ট হয়ে নিহত হচ্ছিল। আহত ঘোড়া, উট ও খচ্চরগুলো উল্টো তার বাহিনীকেই পিষ্ট করতে শুরু করল। সাইফুদ্দীন দেখল তার সৈন্যদের প্রত্যাঘাততো দূরে থাক আত্মরক্ষার শক্তিও নেই। সৈন্যদের অনেকেই অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। সুলতানের ঝটিকা বাহিনী পিছন থেকে শত্রু নিধন করে তকবির ধ্বনি তুলে সম্মুখ বাহিনীর সাথে মিলিত হচ্ছে। বস্তুত সাইফুদ্দীনের সৈন্যরা তখন একটি অনতিক্রম্য বেষ্টনিতে আটকে কচু কাটা হচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিপক্ষের করুণার উপর সহযোদ্ধাদের ছেড়ে সাইফুদ্দীন জীবন নিয়ে পালাল।

সুলতানের সৈন্যরা যখন সাইফুদ্দীনের কেন্দ্রীয় কমান্ড আঘাত করে পদানত করল, তখন সেখানে পাওয়া গেল অসংখ্য মদের মটকা। সেখান থেকে যাদের গ্রেফতার করা হলো, তারা জানাল, সকালের দিকে চীফ কমান্ডারকে একটি টিলার আড়ালে দেখা গিয়েছিল, এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। ধুরন্ধর সাইফুদ্দীন যুদ্ধের পরিস্থিতি আঁচ করেই জীবন নিয়ে পালাল। যুদ্ধ শেষ হল, বিজয় হল সুলতান বাহিনীর। অবশ্যম্ভাবী একটি পরাজয় ও নিমূল আগ্রাসন থেকে সুলতানের বাহিনী রক্ষা পেল। শত্রুবাহিনী হল কুপোকাত।

রাতের বেলায় বিশেষভাবে তৈরী একটি তাঁবুতে আপন ভাইয়ের লাশের পাশে বসে ফৌজী বলছিল –আমি রক্ত নদী পার হয়ে তোমার অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি দাউদ! ভাইয়ের মৃতদেহ আমার কর্তব্য পালনের সাক্ষী হয়ে আমার চোখের সামনেই পড়ে রয়েছে। দাউদ! আমি সেই রক্ত ফোরাত পেরিয়ে এসেছি যেখানে কোন পুল নেই, সেতু নেই…।

ইত্যবসরে সুলতান আইয়ূবী সেই তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। ফৌজী সুলতানকে জিজ্ঞেস করল, মাননীয় সুলতান! আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যায়নি তো? যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে?

আল্লাহ্ তাআলা শত্রুদের পরাজিত করেছেন। তোমরা বিজয়ী, হে-মা! তোমরা বিজয়ী। মা তোমাদের… সুলতান কথা শেষ করতে পারলেন না, তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল, দুচোখ গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোর অশ্রুধারা….।

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *