১. ঝড়ের প্রচণ্ড মাতামাতি

অ্যাক্রস দ্য পিরেনীজ / রাফায়েল সাবাতিনি / রূপান্তর: কাজী শাহনুর হোসেন
প্রকাশ: ২০০২

এক

ঝড়ের প্রচণ্ড মাতামাতি। শোঁ-শোঁ হাওয়া আছড়ে পড়ছে অশ্বারোহী সাভানার ওপর। তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে বিস্কে উপসাগরের বুকে।

মানুষটি সাভানা বলেই রক্ষে। ওর বদলে আর কেউ হলে ভয়ে তার জান নির্ঘাত উড়ে যেত।

অস্বীকার করার উপায় নেই, পরিস্থিতি গুরুতর। এদেশে এই প্রথম এসেছে সাভানা, তার ওপর স্প্যানিশ ভাষা বলতে গেলে জানেই না। আকাদেমি দ্য লিঙ্গুয়া-তে কিছুদিন আগে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে যে ভাষা সে শিখেছে, তা আজ কোন কাজেই আসছে না।

ভাই, এদিক দিয়ে আলমাঞ্জা যাওয়া যাবে? এ প্রশ্ন অনেককে সে করেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু তারা এমন এক ভাষায় জবাব দিয়েছে যার বিন্দু-বিসর্গ সাভানা উদ্ধার করতে পারেনি। সাভানা শিখেছে ভদ্রসমাজে প্রচলিত ভাষা। এখানকার লোকজনের আঞ্চলিক ভাষা সে বুঝবে কি করে? অগত্যা, কিছুক্ষণ ওদের দিকে বোকার মত চেয়ে থেকে তারপর আবার ঘোড়া ছুটিয়েছে পশ্চিমপানে। এই দিগন্ত বিস্তৃত, বন্ধুর, রুক্ষ অঞ্চলের লোকজনদের ওপর সে ভরসা রাখতে পারেনি।

অন্য আর সব দিক ছেড়ে পশ্চিম দিকে কেন? কারণ একটাই। পশ্চিমাকাশে সূর্য এখন অস্তগামী। এই তেপান্তরে চার্লি সেন্ট সাভানার পরিচিত বলতে এমুহূর্তে শুধুমাত্র ওই সূর্যটাই। ওটা যতক্ষণ রয়েছে, চার্লি নিজেকে একা ভাবছে না। নির বালু প্রান্তর, রুক্ষ পাহাড়, বাতাসের হা-হা হাসি, অচেনা পরিবেশ-সব কিছুই ওর বিপক্ষে, কেবলমাত্র পাটে বসা ওই সূর্যটাই যেন খানিকটা আশ্বস্ত করতে পারছে ওকে।

ভয় পেয়ো না, বন্ধু, যেন ভরসা দিচ্ছে সাভানাকে। আমি তো এখনও মরিনি। যতক্ষণ আছি, তারমধ্যে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবে।

এতক্ষণ আসলে এ আশাই করছিল সাভানা। কিন্তু এখন ওর আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিল বৃষ্টির আশঙ্কা। এতক্ষণ শুধু ঝড় ছিল, বৃষ্টি ছিল না। পেছন থেকে আসছিল ঝড়ো হাওয়া। তাতে সাভানা কিংবা তার ঘোড়ার বিশেষ কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বাতাস গেছে থেমে, কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। পশ্চিমাকাশ সামান্য ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে যদিও গোধূলির আলো মরে আসছে দ্রুত। বৃষ্টি নামলে আর দেখতে হবে না। আশপাশে একটা বড় গাছ পর্যন্ত নেই যে তার তলায় দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচানো যায়।

দূরে অবশ্য একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বাঁয়ে, এখান থেকে তিন-চার মাইল হবে। কিন্তু সত্যিকারের পাহাড় কি ওটা? আসলে আন্দাজ দুশো ফুট উঁচু একটা বাঁধ, পুবে-পশ্চিমে প্রায় আধ মাইলটাক লম্বা। নিরেট পাথরে তৈরি, প্রায় খাড়া।

এতদূর থেকে সাভানা বাধটার গায়ে না দেখতে পাচ্ছে কোন লতা-পাতা, না কোন হা-গহ্বর। তারপরও ফাঁকা মাঠের চাইতে বাধটার আশ্রয় ওকে ঝড়-বৃষ্টির সময় অনেক বেশি নিরাপত্তা দেবে। বাধের এ পাশটায় গাছ-পালা কিংবা গুহা না থাক, ওপাশে তো থাকতে পারে। মোটে তো আধ মাইলের মত লম্বা। ওর ঘোড়া রোজালির পক্ষে ওটাকে এক পাক দিয়ে ওপাশে পৌঁছতে কতক্ষণই বা লাগবে?

কালবিলম্ব করল না সাভানা। অস্তগামী সূর্যের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে যেন বিদায় চেয়ে নিল আজকের মত, তারপর ঘোড়া ছোটাল বাঁধের পুব প্রান্ত লক্ষ্য করে। ওখান থেকে বেড় দিয়ে বাঁধের ওপাশের চেহারাটা দেখে নেবে।

ইতোমধ্যে ঝড় কমেছে, কিন্তু একইসঙ্গে বৃষ্টিও নেমেছে।

সাভানা মোড় ঘুরল। বাধ এখানে তেমন একটা খাড়া নয়। ধস নেমেছে। এখানে সেখানে। সে জায়গাগুলোতে সবুজ, সতেজ ঝোঁপ-ঝাড় জন্মে শোভা বাড়িয়েছে রুক্ষ পাথরের।

আরে, সামনে ওটা একটা গুহা না? আল্লাকে হাজার শোকর, যে কোন মুহূর্তে মুষলধারে বৃষ্টি নামবে, জমাট বাধবে ঘন অন্ধকার। তার আগেই বোধহয় একটা মাথা গোঁজার ঠাই মিলে গেল।

দুম! দুম!

সাভানার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল পরপর দুটো বুলেট। সামনের দিক থেকে এসেছে।

ব্যাপারটা কি?

সাভানা চমকে গেলেও বুদ্ধি হারায়নি। রোজালির গতি বাড়িয়ে দিল ও। কে এভাবে কোন কথা নেই বার্তা নেই ওর ওপর গুলি চালাল? শত্রু কে, জানতেই হবে ওকে। তারপর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। আততায়ীর ভয়ে পালাতে শেখেনি ও। সাভানাদের বংশে কেউ কখনও শত্রুর ভয়ে পিঠটান দেয়নি।

দুদুটো গুলি! যে বা যারা গোলমাল করতে চায় তাকে বা তাদের শাস্তি পেতেই হবে। সাভানার ধারণা, দুজনের বন্দুক থেকে দুটো গুলি বেরিয়েছে।

সাভানা জানে, বন্দুক খুব সহজপ্রাপ্য নয় এসব অঞ্চলে-হালে এসেছে। গুণ্ডা বদমাশদের সবার হাতে যে ইতোমধ্যেই দোনলা বন্দুক এসে গেছে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।

দুজন লোক হলে দুটো বন্দুক। দুটোই এখন গুলি ভরার অপেক্ষায়-ফাঁকা। ওরা আবার গুলি ভরে তবে বন্দুক চালাবে। কিন্তু সাভানা ওদেরকে অত সময় দিতে যাবে কেন?

ঘোড়া ছুটছে, তারই ফাঁকে সাভানার হাতে উঠে এসেছে পিস্তল। চোখের নিমেষে হাজির হয়ে গেছে সে গুহামত জায়গাটায়।

গুহা ঠিক বলা যায় না, পাহাড়ের ভিতরে গহ্বর তো নয়, একটা গর্ত মত দেখা যাচ্ছে বাইরের দিকে, পাহাড়ের গায়ে। আর সেই গর্তটার মাথার ওপরে বেরিয়ে আছে একখানা ছাদ। কাঠ, খড় কিংবা টিনের নয়-প্রাকৃতিক। নিরেট পাথরের একটা খণ্ড গর্তটার ওপরে ছাদ রচনা করেছে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই ছাদটির নিচে দুটো লোককে দেখতে পেল সাভানা। বন্দুক রয়েছে দুজনের হাতেই। একজন কাঁধে ঠেকিয়েছে তাক করবে বলে, অন্যজন ত্রস্ত হাতে গুলি ভরছে। কথা বলে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল সাভানা, এবং পরক্ষণে ওর পিস্তল আগুন বর্ষাল।

কাঁধে বন্দুক তুলেছিল যে লোকটি, সে বিকট এক চিৎকার দিয়ে ভূমিশয্যা নিল। অন্য লোকটি কালবিলম্ব না করে বন্দুক ফেলে ছুট দিল।

ফালতু লোকজন দূর হয়ে গেলেই সাভানার জন্যে ভাল। আশ্রয়ের দরকার ছিল ওর, পেয়েছে। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। ঝড়টা কমলেও থামেনি একেবারে। এতক্ষণ ঝড় তাকে ঠেলছিল পেছন থেকে, এখন মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। মুষলধারে বৃষ্টি তেরছাভাবে বিধছে ওর সর্বাঙ্গে। ভাগ্যিস গুহামত জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে ও।

ঘোড়াসহ পাথুরে ছাদটার নিচে সেঁধিয়ে পড়ল সাভানা। ভূপাতিত লোকটিকে টপকে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো রোজালি।.একখানা পা ওর বুকের ওপর পড়ল। এক বিন্দু নড়ল না লোকটা। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে লোকটাকে পরীক্ষা করল সাভানা। মারা গেছে। বুকে ফুটো দেখতে পেল।

কিন্তু দারুণ এক চমক অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। উঠে ঘুরে দাঁড়াতেই এক কোণে একটা মানুষকে লক্ষ করল ও। নড়ছে-চড়ছে না। ওটাও মরা নাকি? তাই হবে। হয়তো এই বদমাশগুলোর হাতেই মারা পড়েছে।

মনে মনে নিজের কপালকে অভিশাপ দিল সাভানা। সারা রাত দুদুটো মড়া আগলে বসে থাকতে হবে নাকি?

সাভানা এবার দ্বিতীয় লাশটার দিকে এগোল। গুহার ভেতর আলো বড়ই কম এমুহূর্তে। কিন্তু ঝুঁকে বসে চোখ সরু করে তাকাতে তৃতীয়বারের মত চমক খেল সাভানা। এবারের চমকটা আগের দুবারের চাইতেও জোরাল।

একমাথা সোনালী চুল এলিয়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে। আর মাথাটার মালিক একজন নারী।

আচ্ছা, মহিলা কি সত্যি সত্যিই মারা গেছে? বেঁচে নেই তো? সাভানা হাঁটু গেড়ে বসল পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে।

মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল ও। মুখের একপাশ থেকে রুমালের একটা কোনা বেরিয়ে রয়েছে। কোনাটা ধরে টানতেই দলামোচা আস্ত একখানা রুমাল বেরিয়ে এল মহিলার মুখ থেকে।

আর পরক্ষণে কাতর স্বর ফুটল অচেতন মহিলার কণ্ঠে। অনুচ্চ গলায় আহ আহ করছে।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল সাভান, যাক, বেঁচে আছে। ওর এবার দৃষ্টি পড়ল মেয়েটির দুহাতের ওপর। জোড় করে বাঁধা। নিশ্চয়ই ওই গুণ্ডাগুলোর কাজ। দুর্বত্তরা মেয়েটির পা দুটোকেও ছাড় দেয়নি, বেঁধে রেখে গেছে।

তুমুল বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, সাভানার কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে। মেয়েটির সব বাধন খোলা হয়ে গেছে। এবার শুশ্রষার পালা। সেই রুমালটি বারবার ভিজিয়ে এনে সাভানা মেয়েটির মুখ-চোখ মুছিয়ে দিতে লাগল।

একটা চামড়ার বোতলে মদ রাখে সাভানা। ওটা ঝোলানো থাকে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে! পানীয়টা খুব কড়া, সাভানার মত যোদ্ধাপুরুষের উপযুক্ত। এই মেয়ে কি পারবে হজম করতে? খানিক ইতস্তত করল সাভানা। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল, প্রয়োজনে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করবে।

মেয়েটির মুখ দেখবে সাভানা সেটুকু আলোও এমুহূর্তে গুহার ভেতর নেই। কিন্তু প্রথম দর্শনে যে সোনালী চুলের গোছা দেখতে পেয়েছিল তাতেই বুঝেছে এ কোন সাধারণ গৃহস্থ ঘরের মেয়ে নয়। কেবল অভিজাত পরিবারের মেয়েদেরই অমন চুল দেখা যায়।

বীরধর্মী ফরাসি জাতির শিক্ষা হচ্ছে, বিপন্ন যে কোন নারীরই সেবা-শুশ্রূষা করা। চার্লি সাভানা সেই ফরাসি জাতিরই সন্তান, এবং একজন অগ্রগণ্য বীরও বটে। মেয়েটিকে গৃহস্থ কিংবা গরীব ঘরের সন্তান বলে মনে হলেও মুখ ফিরিয়ে থাকার কথা ভাবতে পারত না ও তবে একথাও ঠিক, মেয়েটির সোনালী চুল দেখার পর তার প্রতি বিশেষ আগ্রহ বোধ করছে সাভানা। তাকে বাঁচিয়ে তোলাকে পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করছে

অবশ্য এমুহূর্তে ওর ওপর ন্যস্ত আছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সামরিক কাজের দায়িত্ব। ডিউক দ্য অর্লিয়াঁ, ফরাসি অভিযাত্রী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, ওকে পাঠিয়েছেন আলমাঞ্জার দুর্গপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে।

কিন্তু পাঠালে কি হবে, আজ রাতে সে দায়িত্ব পালনে অপারগ সাভানা বীরধর্মের একটা চাহিদা আছে না? এখন ওর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এই অসহায় নারীটিকে সাহায্য করা, তাকে সেবা-যত্ন দিয়ে সুস্থ করে তোলা।

দীর্ঘক্ষণ ধরে চলল সেই সেবা। রোজালি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল এক পাশে। অন্যপাশে পড়ে রয়েছে এক শত্রুর মৃতদেহ। নিরেট অন্ধকার গুহার ভেতর, পাথুরে ছাদে বৃষ্টির অবিরাম দামামা, প্রান্তরের বুকে শো-শো হাওয়ার মাতন। কর্নেলিয়া, অর্থাৎ অসুস্থ মেয়েটির সঙ্গে এই পরিবেশেই প্রথম দেখা সাভানার।

অবশেষে, সাভানার সেবায় সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পেল মেয়েটি। অতিকষ্টে পাশ ফিরল।

আমি কোথায়? কান্নাভেজা, কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল

তা তো বলতে পারছি না, সিনোরিটা, মৃদু স্বরে জবাব দিল সাভানা। আমি এদেশে নতুন। পথ হারিয়ে ফেলেছি। তবে এটুকু বলতে পারি, আপনার আর কোন ভয় নেই। আপনাকে যারা অপহরণ করেছিল তাদের মধ্যে একজন ওই যে মরে পড়ে আছে। আরেকজন জানের ভয়ে পালিয়েছে।

আপনি বুঝি উদ্ধার করেছেন আমাকে? সকত কণ্ঠে বলল মেয়েটি।

আল্লাই উদ্ধার করেছেন, আমার মত সামান্য এক নাইট উপলক্ষ মাত্র। আমার মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ভিড় জমাচ্ছে। আপনি কে, কারা আপনাকে ধরে এনে বেঁধে রাখল, কি তাদের উদ্দেশ্য এসব জানার জন্যে খুব কৌতূহল হচ্ছে। কিন্তু তা হোক, আপনি দয়া করে এখন বেশি কথা বলবেন না। আপনার এখন যতটা সম্ভব বিশ্রাম প্রয়োজন। বৃষ্টিটা থামুক আপনাকে আমি ঘোড়ায় করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব।

মেয়েটি একেবারে চুপ থাকতে পারল না।

আমার বাড়ি আলমাঞ্জায়। এখন বাড়ি থেকে কতদূরে আছি কে জানে।

চমকে উঠল সাভানা।

আমিও তো আলমাঞ্জায় যাব।

বিস্কে উপসাগরের গা ঘেঁষে বিশাল মহাকান্তার। মাঝে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এক একটা টিলা কিংবা বাধ। লম্বায় খানিকটা উঁচু যেগুলো, স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে সেগুলো পাহাড়ের মর্যাদা পায়।

এমনি একটি পাহাড় ক্রিমসন হিল। ওটার পশ্চিম পাশে দুর্ভেদ্য আলমাঞ্জা দুর্গ। দুর্ভেদ্য শুধু নামে নয়, কাজেও। সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সময় থেকে এখন অবধি এ দুর্গ কেউ দখল করতে পারেনি। এমনকি দুর্জয় মুর বিজেতারা পর্যন্ত কজা করতে পারেনি আলমাঞ্জা দুর্গ।

স্পেনে মুর শাসনের অবসান হয়েছে। রাজা ফিলিপ এখন ক্ষমতায়। গোটা দেশে চলছে এক অরাজক অবস্থা। শৃঙ্খলা কিংবা ঐক্য বলতে কিছুই নেই। দুর্গের দেশ বলা যায় স্পেনকে। আর প্রত্যেক দুর্গে একজন করে দুর্গপ্রধান, তারা রাজা ফিলিপের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি নয়। মাথা তারা নত করতে পারে, তবে একটা শর্তে-রাজা নামেই রাজা থাকবেন। দুর্গপ্রধানের কোন কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।

এই স্বাধীনচেতা লোকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে একরোখা আর দুর্দান্ত প্রকৃতির দুর্গপ্রধান হচ্ছেন হোসে ফার্ডিনান্ড। আলমাঞ্জার দুর্গস্বামী।

লোকজন তাকে ব্যারন বলে ডাকলেও নিজেকে তিনি অভিহিত করেন প্রিন্স দ্য আলমাঞ্জা বলে।

মুরদের আমল থেকেই পশ্চিম স্পেনের বিশাল এক ভূখণ্ড দখল করে রয়েছেন তিনি। ইদানীং তিনি রাজার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করতে চাইছেন। স্বায়ত্তশাসন পেলে দরকার কি তার স্বাধীন রাজ্যের?

হোসে ফার্ডিনান্ডের আদর্শ হচ্ছেন ন্যাভার। তিনি স্বতন্ত্র রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, তার আনুগত্য ছিল ফরাসিরাজের প্রতি আর ফার্ডিনান্ডের থাকবে স্পেনের রাজার প্রতি।

থাক সে কথা। এহেন দুর্ধর্ষ হোসে ফার্ডিনান্ড কিন্তু এমুহূর্তে নিদারুণ এক পারিবারিক বিপর্যয়ে পড়ে চোখে আঁধার দেখছেন।

আজ দুর্গে যখন ডিনারের ঘণ্টা বাজল, বিশাল ভোজসভায় উপস্থিত হলো শতাধিক ব্যক্তি। প্রকাও কামরাটির এমাথা-ওমাথা অবধি লম্বালম্বি করে পাতা বিরাট এক টেবিল। টেবিলের দুপাশে সারকে সার চেয়ার। এতটাই মজবুত করে তৈরি যে, চারপুরুষ ধরে দুর্গবাসীরা এসব চেয়ারে বসে তিন বেলা আহার করছেন, তারপরও এতটুকু ক্ষয় হয়নি।

হোসে ফার্ডিনান্ডের আত্মীয়-স্বজনরা টেবিলের মাথায় তাকে ঘিরে বসেছেন। আর কর্মচারীরা বসেছে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে, পদমর্যাদা অনুসারে।

কাজের লোকেরা প্রথম প্রস্থ খাবার পরিবেশন করে গেছে। দুর্গপ্রধানের স্ত্রী অগাস্টা এসময় আবিষ্কার করলেন, তার মেয়ে কর্নেলিয়া টেবিলে অনুপস্থিত।

ওর কি অসুখ করল নাকি, এল না যে! মা উদ্বিগ্ন হলেন। লোক পাঠালেন মেয়ের খবর নিয়ে আসতে।

ওদিকে, হোসে ফার্ডিনান্ড কিন্তু খেপে উঠলেন মেয়ের ওপর। তার ধারণা হলো, কর্নেলিয়া একমনে ডেকামেরন পড়ছে।

ওসব আজেবাজে জিনিস পোড়ো না, হাজার বার মেয়েকে একথা বলেছেন তিনি। কিন্তু সে শুনলে তো? আজ কর্নেলিয়া আসুক না, সব কর্মচারীদের সামনেই তিনি তাকে আচ্ছামত বকাঝকা করবেন। এছাড়া ওর আক্কেল হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু কোথায় কর্নেলিয়া! সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা হলো, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। তার সহচরী মেরিনারও ছায়া দেখা গেল না। দুজনে যেন স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।

এতবড় দুর্গ তন্নতন্ন করে খোঁজা তো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায় গভীর রাতের দিকে মেরিনাকে পাওয়া গেল দুৰ্গসংলগ্ন বাগিচার নির্জন এক কোণে। মৃত। খুন করা হয়েছে তাকে।

কর্নেলিয়ার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।

.

দুই

কর্নেলিয়ার পাত্তা নেই তো নেই! অমন যে প্রতাপশালী দুর্গপ্রধান হোসে ফার্ডিনান্ড তিনি পর্যন্ত অসহায় বোধ করছেন। তার স্ত্রী অগাস্টা ঘন-ঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন।

পরদিন বেলা এক প্রহর পেরিয়ে গেল, কিন্তু কেউ সামান্য খবরটুকু পর্যন্ত দিতে পারল না।

রাতে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। দলে-দলে সৈনিক ও ভত্যরা তা উপেক্ষা করে মনিবকন্যার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু কোন ফল হয়নি। কাকভেজা হয়ে হতাশচিত্তে ফিরে এসেছে সবাই।

প্রিন্স, সিনোরিটাকে কোথাও পাওয়া গেল না, বলেছে তারা। এ দুঃসংবাদ বয়ে না এনে আমরা যদি মরেও যেতাম, সে-ও ভাল হত।

অগত্যা, হোসে ফার্ডিনান্ড নিজে তৈরি হলেন বেরনোর জন্যে। তখন সকাল নটা। তার মেয়েকে জোর করে যে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। মেরিনাকে খুন করেছে যাতে সে চেঁচামেচি করে লোক জড় করতে না পারে। আর কর্নেলিয়াকে হয়তো মুখ বেঁধে নিয়ে গেছে।

রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত পিষছেন দুর্গপ্রধান। কার এতবড় দুঃসাহস? আলমাঞ্জার সীমানার ভেতর থেকে দুর্গপতির মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় এতবড় বুকের পাটা কার?

সে যে-ই হোক না কেন, তাকে ধরবেনই ধরবেন হোসে ফার্ডিনান্ড। তারপর আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবেন।

ফার্ডিনান্ডের সন্দেহ কিন্তু একজনের ওপর গিয়ে পড়ছে। কোয়ামোদো গুইশাম্পো। ওই বদমাশ কোয়ামোদোটাই সম্ভবত নাটের গুরু। বামন হয়ে চাদে হাত বাড়াতে চায় ছোকরা।

সার্ভেরোকে দুর্গ হিসেবে স্বীকার করেন না হোসে ফার্ডিনান্ড, ম্যাজেন্টো গুইশাস্পোকেও তিনি দুর্গপতির স্বীকৃতি দেন না।

এহেন ম্যাজেন্টো গুইশাম্পোর এমনকি বড় ছেলেও নয় কোয়ামোদো। বাবার এই ছোট্ট কেল্লাটুকুর মালিকানাও বাবার অবর্তমানে তার ওপর বর্তাবে না। কেল্লার অধিকার পাবে বড় ভাই জ্যাভেদো। তারপরও কোয়ামোদোর ধৃষ্টতা দেখলে অবাক হতে হয়।

কর্নেলিয়ার কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয় ও। কর্নেলিয়া বাপের বাধ্য মেয়ে। সে যা করা উচিত তাই করেছে।

আমি এসব জানি না, সাফ বলে দিয়েছে। তোমার যা বলার বাবাকে বলোগে যাও।

কিন্তু সে সাহস হয়নি কাপুরুষ কোয়ামোদোর। লোকমুখে প্রস্তাবটা কানে আসে হেসে ফার্ডিনান্ডের। কর্নেলিয়া বলে মেরিনাকে, মেরিনা অগাস্টাকে এবং অগাস্টা বলেন স্বামীকে।

ফার্ডিনান্ড এর পরপরই মনস্থির করেন, কোয়ামাদোকে আবার যেদিন দেখবেন, সেদিনই বলে দেবেন সে যাতে আর তার দুর্গে না আসে।

কিন্তু শয়তানটা তাকে সে সুযোগ দিলে তো? সে চুরি করে আলমাঞ্জা দুর্গে প্রবেশ করে অবলা নারী হত্যা করেছে, তারপর লুটে নিয়ে গেছে দুর্গের সেরা রত্নটিকে। ব্যাটাকে হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলতেন ফার্ডিনান্ড।

কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে আশপাশের টিলাগুলো তালাশ করে আসবেন ভেবে বেরোতে যাচ্ছিলেন ফার্ডিনান্ড, কিন্তু সিদ্ধান্তটা নিজেই বাতিল করে দিলেন।

অপরাধী যদি কোয়ামোদোই হয় তবে এখুনি রওনা দেয়া দরকার সার্ভেরোর উদ্দেশে। কোয়ামোদো ওখানে না গেলে কর্নেলিয়াকে নিয়ে যাবেটা কোথায়?

আলমাঞ্জা থেকে প্রায় বারো মাইলের পথ সার্ভেরো। তাছাড়া এটাও মাথায় রাখতে হবে, যত ছোট আর দুর্বলই হোক না কেন সার্ভেরো একটা দুর্গ তো বটে।

কাজেই, ওদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হলে সৈন্যদের সুসজ্জিত করে তারপর বেরোতে হবে। ঝোঁকের মাথায় হুট করে বেরিয়ে পড়লে বেইজ্জতি কাণ্ড হয়ে যেতে পারে।

তিনি চান বা না চান সময় তাকে ব্যয় করতেই হবে। অগত্যা, সৈন্যসজ্জায় মন দিলেন ফার্ডিনান্ড। তবে সার্ভেনরাতে ইতোমধ্যে একখানা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি দূত মারফত। দুর্গপ্রধান ম্যাজেন্টো গুইশাম্পোর উদ্দেশে চিঠিখানা লিখেছেন। অবশ্যই ভদ্রভাষায়। চিঠিটা এরকম:

প্রিয় ভাই, আমার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণকারীরা যদি আপনার এলাকায় গিয়ে থাকে, তবে আমি নিশ্চয়ই আশা করতে পারি আপনি তাদের গ্রেপ্তার করে আমার মেয়েকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন? খোদা আপনার মঙ্গল করুন।

–ইতি
হোসে ফার্ডিনান্ড দ্য আলমাঞ্জা।

পত্রবাহক সার্ভেরোর দিকে রওনা দেয়ার খানিক পর, কয়েকজন মেষপালক একটা মৃতদেহ কাঁধে করে দুর্গে এসে হাজির। তারা দুর্গস্বামী ফার্ডিনান্ডের সঙ্গে দেখা করতে চায়। তাকে লাশটা দেখাবে।

ফার্ডিনান্ড হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মৃত লোকটিকে কিন্তু তিনি চিনতে পারলেন না। লোকটিকে দেখে ভদ্রলোক মনে হলো। পরনে আধা সামরিক পোশাক, বুকের কাছে বুলেটের ফুটো।

আগ্নেয়াস্ত্র অধুনা এ অঞ্চলে এলেও তার খুঁটিনাটি সম্পর্কে যথাসম্ভব অবগত আছেন হোসে ফার্ডিনান্ড। হাজার হলেও তিনি একজন দুর্গপ্রধান তো।

গুলির ফুটোটা দেখেই ফার্ডিনান্ড বুঝতে পারলেন, লোকটির মৃত্যু ঘটেছে পিস্তলের গুলিতে। আশ্চর্য! বন্দুক কিছু কিছু নজরে পড়লেও এ অঞ্চলে পিস্তল তো মোটেই সহজলভ্য নয়। এ লোকটিকে যে হত্যা করেছে সে নিশ্চয়ই এখানকার কেউ নয়।

ফ্রান্স থেকে ডিউক অর্লিয়াঁ এসে পড়েছেন সসৈন্যে, তবে কি তার দলের কোন সৈনিক?

লেডি অগাস্টা ভেঙে পড়েছেন, কিন্তু তিনি পর্যন্ত দুর্গে লাশ আসার খবর শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন। লাশটা নাকি কোন এক ভদ্রলোকের। তার স্বামী চিনতে পারেননি, কিন্তু তাতে কি? দুর্গে অনেক সময় অনুপস্থিত থাকেন ফার্ডিনান্ড। তখন অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়িত করতে হয় অগাস্টাকে। সুতরাং, এ লোকটি ফার্ডিনান্ডের কাছে অপরিচিত হলেও তিনি চিনলেও চিনতে পারেন।

ভুল ভাবেননি অগাস্টা। মৃতদেহের ওপর একবার নজর বুলিয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

এ তো ডন ফেলিক্স! কোয়ামোদোর বন্ধু। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে এসেছে। এ তারমানে জড়িত ছিল ঘটনার সাথে। কোথায় পাওয়া গেল একে? কর্নেলিয়া-কর্নেলিয়ার কোন খবর পাওয়া গেছে?

কোথায় পেয়েছ একে? ফার্ডিনান্ড এতক্ষণে প্রশ্ন করলেন।

মেষপালকদের মধ্য থেকে একজন জবাব দিল।

ডেভিলস কেভের নাম শুনেছেন তো, হুজুর? ট্রিটন হিলের পশ্চিম মাথায়-সেই গুহাটার ভেতর পাওয়া গেছে একে।

না, কর্নেলিয়ার দেখা ওরা পায়নি। তবে আশপাশে ঘোড়ার খুরের দাগ দেখেছে। কাল রাতে বৃষ্টি হওয়াতে নরম মাটিতে একটা খুরের দাগ দেবে বসে গিয়েছে। স্পষ্ট দেখা যায়।

মাত্র. একটা ঘোড়া? ফার্ডিনান্ডের প্রশ্ন।

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল লোকটা।

ঘোড়াটা কোনদিক থেকে এসেছে, কোনদিকে গেছে পায়ের দাগ দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারোনি?

না, হুজুর। আমরা সামান্য মেষপালক, ঘোড়ার কিইবা বুঝি? অতসব দেখার কথা মাথায়ই আসেনি।

হোসে ফার্ডিনান্ড এবার সেনাপতি রোডারিগকে ডেকে পাঠালেন। তাকে সৈন্যসজ্জার নির্দেশ দিয়ে নিজে ধাবিত হলেন ট্রিটন হিলের উদ্দেশে।

ডন ফেলিক্স যেহেতু ওখানে মারা পড়েছে, তারমানে কোয়ামোদোও তার সঙ্গে ছিল। আর কোয়ামোদো থেকে থাকলে কর্নেলিয়ারও না থাকার কারণ নেই।

আলমাঞ্জা থেকে ছ-সাত মাইলের পথ এই ট্রিটন হিল, অবশ্য যদি মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া হয়। তবে মাঝখানে অ্যাভার্নন রিজ নামে একটা পাহাড় পড়ে। ওটাকে পাক দিয়ে গেলে দূরত্বটা মাইল সাতেকের মত। আর যারা কষ্ট করে অ্যাভার্নন টপকে যাবে তাদের জন্যে চার-সাড়ে চার মাইল।

বিসমিল্লায় ভুল করলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। তার ধারণা হলো, কোয়ানমোদো ও ফেলিক্সের সঙ্গে যেহেতু ঘোড়া ছিল না, ওরা অ্যাভার্নন ডিঙিয়ে ট্রিটনে যায়নি। কেননা, শখ করে কেউ একটা মেয়েকে কাঁধে বয়ে পাহাড়ের চড়াই ভাঙতে যাবে না। আর এ অঞ্চলের পাহাড়গুলোও যেমন, দেয়ালের মত সব খাড়া উঠে গেছে, ওপরদিকে। বিশেষ দক্ষতা না থাকলে ওসব পাহাড়ে ওঠা দুঃসাধ্য, সঙ্গে বোঝা থাকুক বা না থাকুক। কাজেই তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, কোয়ামোদোরা অ্যাভার্ননকে পাক দিয়ে ট্রিটন গেছে।

আর এখানেই ভুলটা করলেন হোসে ফার্ডিনান্ড।

কোয়ামোদোদের পাহাড়ে চড়ার দক্ষতা নেই, এ ধারণাটা কোত্থেকে পেলেন তিনি? ওরা বেপরোয়া ধরনের যুবক। আর সেজন্যেই নানা রকমের শারীরিক কসরতে অভ্যস্ত। পাহাড়ে ওঠা-নামা করার অভ্যাসও ওরা রীতিমত বজায় রেখেছিল। এবং কালরাতে তার সুফলও পেয়েছে। কর্নেলিয়াকে কাধ বদল করে দুজনে দিব্যি পেরিয়ে গেছে অ্যাভার্নন রিজ।

ওরা যখন পাহাড় টপকাচ্ছে তখন ঝড় চলছে, বৃষ্টি আসন্ন। অ্যাভার্নন পাহাড়টা একেবারে সমতল। ওখানে মাথা গোঁজার ঠাই নেই। কাজেই ওরা পাহাড় বেয়ে নেমে সোজা ছুটেছে ট্রিটনের উদ্দেশে। ওদের তো জানাই ছিল, ট্রিটনে রয়েছে ডেভিলস কেভ-শয়তানের গুহা।

হোসে ফার্ডিনান্ড কিন্তু ঘোড়া ছোটাচ্ছেন মহাকান্তারের বুক চিরে। কিন্তু তিনি একবারটি যদি অ্যাভার্ননের চূড়ায় উঠতেন, তবে তার, কর্নেলিয়ার ও সাভানার…সবার জন্যেই ভাল হত।

ওদিকে কি হয়েছে, কর্নেলিয়াকে সুস্থ করে তুলেছে সাভানা। কিন্তু আলমাঞ্জার সঠিক অবস্থান মেয়েটি ওকে জানাতে পারেনি। কর্নেলিয়াকেও দোষ দেয়া যায় না। ট্রিটন হিলের এই ডেভিলস কেভে আগে কখনও আসা তো দূরের কথা, এর নামও কোনদিন শোনেনি সে।

সাভানাকে সে কোনমতেই বলতে পারল না এটা কোন জায়গা। বলাবাহুল্য, আলমাঞ্জা কোনদিকে সে সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারণা দিতে পারেনি।

তবে এটুকু তার মনে আছে, কোয়ামোদোরা তাকে কাঁধে করে একটা পাহাড়ে ওঠে, আবার নেমেও আসে। খুব সম্ভব সে পাহাড়টি কাছেপিঠেই হবে।

এই সামান্য খবরটুকুই কেবল সাভানা উদ্ধার করতে পেরেছে কর্নেলিয়ার কাছ থেকে।

একটা পাহাড় ডিঙিয়ে অপহরণকারীরা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কোথায় সেই পাহাড়?

সকাল হতে না হতেই গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এল সাভানা। আকাশের দিকে নজর বুলাচ্ছে। ওর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা পাহাড়কে। কোথায় সেটা?

বেশিক্ষণ অবশ্য খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। উত্তরদিকে একটা পাহাড় চোখে পড়ল। বড়জোর দুমাইল হবে দূরত্ব। উচ্চতা কম হলে কি হবে, খুবই দুরারোহ-প্ৰায় খাড়া পাহাড়।

খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল সাভানা।

রোজালি কি পারবে দুদুটো সওয়ারী নিয়ে ওই পাহাড়ে উঠতে? মনে মনে বলল ও।

কিন্তু না উঠেই বা উপায় কি? ওই পাহাড়ের ওপর দিয়েই তো আলমাঞ্জা যেতে হবে।

রোজালির পেটে কাল থেকে দানা-পানি কিছু পড়েনি। জিন লাগাম যেমন পরানো ছিল তেমনি আছে। সাভানা ইচ্ছে করেই ওগুলো খোলেনি। শত্রু একটা নিপাত গেলেও আরেকটা পালিয়েছে। সে যদি দলবল নিয়ে ফিরে আসে? আসাটাই স্বাভাবিক। সিনোরিটা কর্নেলিয়ার কথা অনুযায়ী লোকটা তো এক বেপরোয়া ধরনের দস্যুই বটে।

প্রথম সুযোগেই কর্নেলিয়াকে নিয়ে পালাতে হবে সাভানাকে। তাই সে সারারাত প্রিয় ঘোড়াটিকে বন্ধনমুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে পারেনি।

সারাটা রাত খুব কষ্ট পেয়েছে রোজালি। ক্ষুধার্তও সে। কিন্তু ভোর হচ্ছে, এখন আবার ছুটতে হবে তাকে। ওর গতির ওপরই তো দুদুটো মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছে।

রোজালির মনিব নিজের অজান্তেই কোয়ামোদো গুইশাম্পোকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। সে পারে না হেন দুষ্কর্ম নেই। কে জানে, এই মুহূর্তে হয়তো সে গুণ্ডা বদমাশদের নিয়ে দল পাকিয়ে ছুটে আসছে, কর্নেলিয়াকে ফের অপহরণ করতে।

আপনি আমার পেছনে ঘোড়ার পিঠে বসতে পারবেন? সসংকোচে প্রশ্ন করল সাভানা। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস আছে?

কর্নেলিয়া লজ্জা পেলেও কি আর করবে, ঘোড়া যখন একটা আর আরোহী দুজন তখন তো না চেপে উপায় নেই।

অন্যদিকে চেয়ে মাথা নেড়ে সায় দিল ও।

ভোরের আলো তখনও ভাল করে ফোটেনি, অ্যাভার্ননের দিকে ছুটল রোজালি। সামনে লাগাম হাতে সাভানা, আর পেছনে ওর কোমর বেষ্টন করে বসেছে কর্নেলিয়া-দুপা ঝুলিয়ে দিয়েছে একপাশে।

অ্যাভার্ননের মাথায় যখন উঠল রোজালি, ছটা বাজে তখন।

হোসে ফার্ডিনান্ড সদলে ঘোড়া দাবড়ে এলেন সকাল এগারোটা নাগাদ। তিনি যদি নিচে দিয়ে না গিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে যেতেন, তাহলে দেখতে পেতেন পাহাড়চূড়ায় মরে পড়ে আছে রোজালি। আর সাভানার অজ্ঞান দেহ পড়ে আছে তার পাশে।

কর্নেলিয়া ঘটনাস্থলে নেই। তবে তার পায়ের এক পাটি জুতো পড়ে আছে রোজালির দেহের তলায়, আর কাটা গাছে জড়িয়ে আছে তার মাথার ওড়না।

ঘটনাটা এরকম।

আগের রাতে কোয়ামোদো যখন আলমাঞ্জায় প্রবেশ করে তখন সঙ্গে ছিল শুধু ফেলিক্স। অন্যদেরকে সে দুর্গের বাইরে বিশেষ একটি জায়গায় অপেক্ষা করার নির্দেশ দেয়। তার কাজ যদি ভালয়-ভালয় উতরে যেত তবে এসব সহকারীদের সঙ্গে সে আর যোগাযোগের চেষ্টা করত না। কনেলিয়াকে নিয়ে ফেলিক্স: আর সে পগার পার হয়ে যেত দূরের কোন শহরের উদ্দেশে। তার সহকারীরা সারা রাত মশার কামড় খেয়ে ভোরের আগে ফিরে যেত যার যার ঘরে। তবে অবশ্যই কোয়ামোদোকে গালি-গালাজ করতে করতে।

কিন্তু কপাল খারাপ কোয়ামোদোর। ফেলিক্স অপ্রত্যাশিতভাবে মারা পড়েছে আর সে কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সে বুঝে পাচ্ছে না কে এই অচেনা শত্রু।

সে যে-ই হোক, এখন কিন্তু ওর পরিত্যক্ত বন্ধুদের কথা বড্ড মনে পড়ছে। তারা পাঁচ-ছয় মাইল দূরে রয়েছে। ট্রিটন থেকে ছুটতে ছুটতে গিয়ে তাদের খবর দেয়া এবং সঙ্গে করে ছুটতে ছুটতে নিয়ে আসা বেদম পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু উপায় কি, বেপরোয়া লোকের কি কখনও পরিশ্রমের পরোয়া করলে চলে?

ঝড়-বৃষ্টি হওয়াতে একরকম সুবিধাই হয়েছে কোয়ামোদোর। কোন সন্দেহ নেই ওই অচেনা শত্রুটার পক্ষে ট্রিটন ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। একা হলে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু একজন অসহায় নারীকে ফেলে যোদ্ধা লোকটা কখনোই চলে যাবে না।

কাজেই ধরে নেয়া যায়, ওরা দুজন এখনও ওই ডেভিলস কেভের ভেতরই রয়েছে। থাকুক না, কোন অসুবিধা নেই কোয়ামোদোর। সারা রাত দুর্যোগ চলুক, কোয়ামোদো ভোর নাগাদ বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ফিরে আসতে পারবে-কর্নেলিয়াকে ফের পাকড়াও করার জন্যে।

বেপরোয়া কোয়ামোদো রাতের মধ্যে সহচরদের নিয়ে ফিরে আসে অ্যাভার্ননের চূড়ায়। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয় তারা এখানে। ঝড় নেই, অল্প-অল্প বৃষ্টি পড়ছে। পুবাকাশ রাঙা হচ্ছে ধীরে-ধীরে।

ডেভিলস কেভে হানা দেয়ার এখনই সময়।

অবশ্য কর্নেলিয়ারা যদি গুহা ছেড়ে আলমাঞ্জার দিকে রওনা হয়, তাদেরকে তো যেতে হবে এদিক দিয়েই। কাজেই অত চিন্তার কিছু নেই। চোখ এড়িয়ে পালাতে পারবে না। হয় অ্যাভার্ননের চূড়ায়, নয়তো পাদদেশে ঠিক দেখা মিলবে ওদের।

ওদের আটজনের হাতে এখন আটটা বন্দুক। ঘোড়াটাকে আগে খতম করে দেয়া গেলে ওই বিদেশী লোকটা একা কি করতে পারবে এতজনের বিরুদ্ধে?

ওরা লক্ষ করে, ঘোড়াটা পাহাড়টাকে পাক না খেয়ে সোজা উঠে আসছে চূড়ার উদ্দেশে। বাহ, এই তো চেয়েছে ওরা। পাহাড়চূড়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে দলটা। কর্নেলিয়ারা যাতে দেখে না ফেলে।

যা ভেবেছিল তাই ঘটল। নির্দ্বিধায় রোজালিকে নিয়ে পাহাড়ে উঠে আসে সাভানা। এবং পরমুহূর্তে তাকে ও তার ঘোড়াকে লক্ষ্য করে আটটা বন্দুক আগুন ওগরায়।

কাঁচা হাত, ফলে চারটে গুলিই যায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে। দুটো বেঁধে রোজালির গায়ে, আর দুটো সাভানার পায়ে। কর্নেলিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়নি।

আহত হলেও তড়িঘড়ি লাফিয়ে নেমে পড়ে সাভানা। রোজালির আঘাত কতটা গুরুতর বুঝে উঠতে পারেনি ও, কিন্তু যেভাবে টলছিল তাতে ঘাবড়ে যায় সে।

নিজে আগেভাগে নেমে পড়ার কারণ, সে না নামলে কর্নেলিয়াকে নামাবে কি করে? রোজালি যদি পড়েই যায়, তখন সময় থাকতে নেমে না পড়লে কর্নেলিয়ার দেহ তো চাপা পড়বে ঘোড়াটার নিচে।

কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে যায় সাভানার।

গুলি দুটো হৃৎপিণ্ডে লেগেছিল রোজালির। ফলে, কর্নেলিয়াকে নামাতে পারার আগেই ঢলে পড়ে যায় রোজালি। আর তার পেটের নিচে চাপা পড়ে কর্নেলিয়া। আঘাত না পেলেও আতঙ্কে জ্ঞান হারায় সে।

এই সময় কোয়ামোদ আবার গুলি চালায় সাভানাকে লক্ষ্য করে। কাঁধে বুলেট লাগলে চেতনা হারিয়ে পড়ে যায় সাভানা।

দুবৃত্তরা ওর দিকে আর নজর না দিয়ে মনোযোগ দেয় কর্নেলিয়ার প্রতি। মেয়েটির বুকে ক্ষীণ স্পন্দন। বাঁচে না মরে কে জানে। অপেক্ষা করাই ভাল। মরেই যদি যায়, খামোকা তাকে কাঁধে করে বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না। বেঁচে থাকলে তবে না কোয়ামোদো ওকে বিয়ে করতে পারবে!

আট গুণ্ডা পাহাড়চূড়ায় বসে থাকে ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা। কর্নেলিয়া বাঁচে না মরে দেখার জন্যে।

একসময় তারা সচকিত হয়ে ওঠে। লক্ষ করে হেসে ফার্ডিনান্ড পাহাড়ের নিচ দিয়ে সদলবলে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাচ্ছেন।

.

তিন

এখন কি করা?

হোসে ফার্ডিনান্ড যখন এদিকে এসে পড়েছেন, তখন নিশ্চয়ই ডেভিলস কেভে যাবেন। ওখানে গিয়ে আর কাউকে না পেলেও ফেলিক্সের লাশটা ঠিকই পাবেন। কোয়ামোদোর দল এখনও জানে না মেষপালকরা ফেলিক্সের লাশ

আবিষ্কার করেছে, এবং বয়ে নিয়ে গেছে আলমাঞ্জা দুর্গে।

এদের বিশ্বাস, হোসে ফার্ডিনান্ডের অভিজ্ঞ চোখে আরেকটি জিনিস ধরা পড়বে। অচেনা আগন্তুক ওই সৈনিকটির ঘোড়ার খুরের ছাপ। ডেভিলস কেভ থেকে ঘোড়ার পদচিহ্ন চলে এসেছে অ্যাভার্ননের দিকে। একবার ব্যাপারটা চোখে পড়লে এখানে ছুটে আসতে কালবিলম্ব করবেন না হেসে ফার্ডিনান্ড।

কর্নেলিয়ার জ্ঞান ফেরেনি এখনও। তবে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন জোরাল হয়েছে। আর দেরি নয়, এবার যেতে হয়। ওকে তো ফেলে রেখে যাওয়া যায় না কম তো কষ্ট করা হয়নি ওর জন্যে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফেলিক্স মারা পড়ল কেন, ওর কারণেই তো। কর্নেলিয়া হাতে থাকলে হোসে ফার্ডিনান্ড কোয়ামোদোর কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হবেন।

কাজেই, কাঁধে তোলা হলো কর্নেলিয়াকে। স্থির হলো, পথে মারা পড়লে পথেই ফেলে দেয়া হবে মৃতদেহ।

অ্যাভার্নন ত্যাগের আগে কোয়ামোদো সাভানার অচেতন দেহটা একবার। পরখ করে নিল। মরেনি ব্যাটা। আর মরবার মত গুরুতর জখম তো হয়ওমি ওর। রক্তক্ষয়ের কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। হারাবেই তো, তিন তিনটে গুলি বিঁধেছে-রক্ত তো কম ঝরেনি।

সাভানা মরেনি, এবং তাকে মেরে ফেলার কোন ইচ্ছেও নেই কোয়ামোদো কিংবা তার সহচরদের। হাজার হলেও কোয়ামোদো ভদ্র ঘরের সন্তান, স্বভাব দুবৃত্ত নয়। ওর যে অধঃপতন হয়েছে তার কারণ ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। দুর্গ, জমিদারি কিছুই তো পাবে না ও। সব পাবে ওর বড় ভাই। তাহলে ওর চলবে কি করে? জন্ম নিয়েছে জমিদারের ঘরে, মানুষ হয়েছে আরাম-আয়েশে; অথচ তারপরও ভবিষ্যৎ দৈন্য দশার চোখ রাঙানি সইতে হচ্ছে।

শৌর্য-বীর্যে সে কারও চাইতে কম নয়। কিন্তু আলমাঞ্জার উত্তরাধিকারিণীর দিকে হাত বাড়ালে তাকে বামনের সঙ্গে তুলনা করা হয়।

সেই ছোটবেলা থেকেই হীনম্মন্যতায় ভুগছে কোয়ামোদো। একই মায়ের পেটে জন্ম নিলেও তার ভাই করবে জমিদারি, আর তাকে কিনা চিরজীবন তাই চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে। ধিক এই আইনকে। এজন্যেই তো চরম হতাশায় ডুবে গিয়ে অন্যায়ের পথে পা বাড়িয়েছে কোয়ামোদো। আর একবার এ পথে পা বাড়ালে ফিরে আসার কোন উপায় থাকে না। কিভাবে কিভাবে যেন মানুষ পাপের নাগপাশে জড়িয়েই পড়ে। ওর মনের আশা, ফার্ডিনান্ডের একমাত্র সন্তান কর্নেলিয়াকে বিয়ে করে শ্বশুরের জমিদারি ভোগ করবে।

তারপরও এই বিদেশী লোকটিকে হত্যা করার ইচ্ছে কিংবা প্রয়োজন কিছুই বোধ করল না কোয়ামোদো। লোকটির পরনে সেনাবাহিনীর উর্দি। দেখে মনে হয় পদস্থ সৈনিক। স্পেনদেশের সেনাবাহিনী নয়, হয়তো ফ্রান্সের হতে পারে।

ফরাসি সেনাপতি ডিউক অর্লিয়াঁ শখানেক মাইল দূরে সদলবলে তাবু ফেলেছেন। এই লোক তার দূত জাতীয় কেউ হতেও পারে। ভাবনাটা মাথায় আসতে ঢোক গিলল কোয়ামোদো।

সাভানার জামার ভেতর একটা হাত ঢুকিয়ে দিল ও। টেনে বের করে আনল একটা রেশমী থলে। নাড়া পড়তে ভেতরে ঝনঝন করে উঠল কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা।

পেয়েছি! পেয়েছি! সঙ্গীদের কয়েকজন সোল্লাসে চিৎকার ছাড়ল। সবার দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।

কোয়ামোদো নিজের জন্যে দুটো স্বর্ণমুদ্রা তুলে নিয়ে থলেটা ছুঁড়ে দিল সহচরদের উদ্দেশে। অভাব তারও তো কম নয়!

কোয়ামোদো এবার সাভানার জামার ভেতরটা আবার হাতড়াতে শুরু করল; এ লোক ফরাসি সেনা হলে শুধু স্বর্ণমুদ্রা নয় আরও গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু থাকবে সঙ্গে।

পাওয়া গেছে! মোটা একটা খাম।

চোখের পলকে ওটাকে নিজের জামার ভেতর চালান করে দিল কোষামোদো। আর এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। দুজন সঙ্গী কর্নেলিয়াকে কাঁধে তুলে নিয়েছে, তাদের সামনে-পেছনে বাকি ছয়জন।

খাড়া পাহাড়। সাবধান থাকতে হবে যাতে অচেতন দেহটি কাঁধ থেকে খসে পড়ে না যায়। দৈবাৎ যদি পড়ে-উড়ে যায় তাহলে আর দেখতে হবে না, কোয়ামোদোর বিয়ের সাধ মিটে যাবে। ছাতু হয়ে যাওয়া মৃতদেহকে কেউ কোনদিন বিয়ে করতে পারে?

কোয়ামোদোরা পাহাড় থেকে নেমে গেছে। এর আধ ঘণ্টা পরের কথা।

ডেভিলস কেভ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন হোসে ফার্ডিনান্ড। পুব দিক থেকে একটা ঘোড়া এসেছিল। ওটার পায়ের দাগ ধুয়ে-মুছে গেছে বৃষ্টির পানিতে। কিন্তু গুহা থেকে এক সার পদচিহ্ন চলে গেছে পশ্চিমদিকে। স্পষ্ট চোখে পড়ে। এর মানে, ঘোড়াটা কাল রাতে গুহা ত্যাগ করেনি, করেছে আজ সকালে। এবং সেটা মেষপালকরা এখানে আসার আগেই।

অশ্বারোহী লোকটা এখন কোথায়, কত দূরে কে জানে। তার খোঁজ বের করা গেলে হদিস পাওয়া যাবে কর্নেলিয়ারও।

অ্যাভার্নন পাহাড়ের উদ্দেশে সদলে রওনা হলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। কেননা, ঘোড়ার খুরের দাগ ওদিকটাই ইঙ্গিত করছে।

খুরের চিহ্ন অনুসরণ করে অবশেষে পাহাড়ের মাথায় উঠে এলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। আর তার পরমুহূর্তে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।

একটা ঘোড়া ও একজন মানুষ সামনেই মরে পড়ে আছে। লোকটার পরনে ফরাসি সেনাবাহিনীর পোশাক। পদস্থ ফরাসি সৈনিক।

এ লোক এখানে কেন, কিভাবে? কর্নেলিয়ার সঙ্গে নিজেকে জড়াল কি করে?

পিস্তলের গুলিতে মারা পড়েছে ফেলিক্স, তবে কি এর গুলিতে? পিস্তল অবশ্য এমুহূর্তে তার কোমরে দেখা যাচ্ছে না। হত্যাকারী নিশ্চয়ই ওটা চুরি করে নিয়ে গেছে। তরোয়াল, ছোরা, এমনকি বন্দুকও এ অঞ্চলে সবার হাতে হাতে ঘোরে। কিন্তু পিস্তল চাইলেই পাওয়া যায় না।

নিশ্চয়ই কোয়ামোদোরা খুন করেছে একে। এ নোক হয়তো কর্নেলিয়াকে উদ্ধার করে আলমাঞ্জার দিকে যাচ্ছিল, চোরাগোপ্তা হামলা করে একে হত্যা করেছে ওরা-আবারও অপহরণ করেছে কর্নেলিয়াকে।

আফসোসের অন্ত রইল না হোসে ফার্ডিনান্ডের। তিনি যদি একবারটি পাহাড়চূড়ায় উঠতেন তবে হয়তো অপহৃত মেয়েকে উদ্ধার করতে পারতেন, বাঁচাতে পারতেন এই অচেনা বন্ধুটিকে মৃত্যুর হাত থেকে।

হোসে ফার্ডিনান্ড সাভানার দেহ তল্লাশী করতে বসলেন। জানেন, কোয়ামোদো একবার ভালভাবে পরীক্ষা করে গেছে, তবু। ভাগ্যক্রমে যদি কোন কাগজপত্র ওদের নজর এড়িয়ে গিয়ে থাকে এই আশায়।

কাগজ পাওয়া গেল না, কিন্তু একি!

চমকে উঠলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। লোকটা বেঁচে আছে? ক্ষীণ হৃৎস্পন্দন টের পেলেন বলে মনে হলো না?

পানি! পানি!!

পানি আছে হোসে ফার্ডিনান্ডের কাছে।

প্রচুর রক্ত ঝরেছে জখম স্থানগুলো থেকে। রক্তপাত বন্ধ হয়নি এখনও, অল্প অল্প ঝরছে।

অ্যাভার্নন পাহাড়ে এমন কোন গাছপালা নেই যে একটা খাটিয়া মত কিছু বানানো যাবে, মুমূর্ষ মানুষটিকে বয়ে নেবার জন্যে, কিন্তু অত সহজে হাল ছাড়ার লোক হোসে ফার্ডিনান্ড নন। তিনি নির্দেশ দিতে তিন-চারজন সৈনিক তাদের কোট খুলে ফেলল। কোটের সঙ্গে কোটের গিট দিয়ে তৈরি করা হলো একটা কম্বল জাতীয় স্ট্রেচার। তার ওপরে সাভানাকে শুইয়ে চার কোনা ধরল চারজনে।

খুব শক্ত হবে অচেতন এই লোকটিকে খাড়া পাহাড় থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু তা বলে তো পিছপা হলে চলবে না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এই আহত লোকটি। একে তো সে ফরাসি সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ কর্মচারী, তায় আবার সিনোরিটা কর্নেলিয়া অপহরণ ঘটনার একমাত্র সাক্ষী।

হোসে ফার্ডিনান্ডের সঙ্গে জনা কুড়ি লোক। তাদের পাঁচজনকে সাভানার দায়িত্ব দিয়ে আলমাঞ্জার দিকে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। অগাস্টার হতে ওকে তুলে দিলেই নিশ্চিন্ত-শুশ্রষার কোন ত্রুটি হবে না।

কর্নেলিয়ার সন্ধানে বাকি পনেরোজনকে নিয়ে রওনা দেবেন হোসে ফার্ডিনান্ড। সূত্র যখন একটা পেয়েছেন অনুসরণ করবেন না কেন। এই ফরাসি যুবকটির সঙ্গেই ছিল তার মেয়ে। ওই মৃত ঘোড়াটি নিশ্চয়ই বহন করছিল ওদের। তা নাহলে ওটার পেটের নিচে জুতো পড়ে থাকত না কর্নেলিয়ার। কাঁটা ঝোপে পড়ে থাকত না ওড়না।

কোন সন্দেহ নেই, এই আহত যুবকের সঙ্গেই ছিল সে। একে জখম করে কর্নেলিয়াকে ধরে নিয়ে গেছে অপহরণকারীরা।

এ পর্যন্ত বেশ পরিষ্কারই বুঝতে পারছেন হোসে ফার্ডিনান্ড। কিন্তু তারপর কি ঘটেছে?

পরেরটুকু অনুমান করে নিতে হচ্ছে। দুবৃত্তদের সঙ্গে ঘোড়া ছিল এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হয়তো ওরা বেশিদূর যেতে পারেনি। সেক্ষেত্রে অশ্বারোহী ফার্ডিনান্ডবাহিনীর তো ওদের ধরে ফেলতে বেগ পাওয়ার কথা নয়।

ধু-ধু মরুভূমি চারদিকে। প্রশ্ন হচ্ছে, ওরা গেছে কোন পথে?

চারপাশে ট্রিটন পাহাড়ের মত টিলা, পাহাড় কিংবা বাঁধ রয়েছে প্রায় গোটা বারো।

এমুহূর্তে অ্যাভার্ননের চূড়া থেকেও দস্যুদের দেখা যাচ্ছে না। কোন পাহাড়ের আড়ালে হয়তো টাকা পড়ে গেছে দস্যুদলটা। উন্মুক্ত প্রান্তরে বেরিয়ে এলেই চোখে পড়বে।

কিন্তু আর কতক্ষণই বা অপেক্ষা করবেন ফার্ডিনান্ড? অপেক্ষা করা মানে ওদেরকে সার্ভেরো কেল্লার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া

দুর্গপ্রধান গুইশাম্পো কোয়ামোদোকে পছন্দ করেন না, একথা ঠিক। শুধু হোসে ফার্ডিনান্ড নন, এই বিস্কে উপকূলের প্রতিটি মানুষ জানে, পিতা-পুত্রের সদ্ভাব নেই। কিন্তু তারপরও রক্তের সম্পর্ক বলে কথা। বিপন্ন পুত্রের সাহায্যে কোন্ পিতা না এগিয়ে আসেন? বিশেষ করে যেখানে বংশমর্যাদার প্রশ্ন জড়িত।

এ অঞ্চলে এ ধরনের অপহরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বিবাহযোগ্যা তরুণীদের নিজের কিংবা পরিবারের মুরুব্বীদের কারও অসম্মতি থাকলে পাণিপ্রার্থী তরুণরা এ অপকর্মটি করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অপহৃতা তরুণীর বাবা বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দেন, তখন গোলমাল মিটে যায়।

অবশ্য সব সময় এমনটা ঘটে না। মেয়েটি হয়তো একরোখা, জেদী। অপহরণকারীর বাড়িতে গিয়ে হয়তো অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসা। দুটি বংশের মানুষ মারা পড়তে থাকল পাল্টাপাল্টি। এই রীতি ইতালির চাইতে কোন অংশে কম চালু নয় স্পেনে।

কোয়ামোদোর জিম্মায় কর্নেলিয়া যদি আত্মঘাতিনী হয় তবেই বাধবে গোল। জ্বলে উঠবে আগুন। সে আগুন কয়েক শতাব্দীতেও নিভবে না।

কোয়ামোদো যদি মারা পড়ে হোসে ফার্ডিনান্ডের হাতে, ফার্ডিনান্ডকে হত্যা করবেন কোয়ামোদোর বাবা ম্যাজেন্টো বা বড় ভাই জ্যাভেদো। তাকে হত্যা করার দায় বর্তাবে কর্নেলিয়ার কোন জ্ঞাতি ভাইয়ের ওপর, যেহেতু ওর আপন ভাই নেই। সেই ভাই যেমন আলমাঞ্জার জমিদারি পাবে তেমনি পাবে প্রতিশোধ গ্রহণের দায়িত্ব। জীবনে হয়তো সে ম্যাজেন্টো কিংবা জ্যাভেদোকে চোখেও দেখেনি, কিন্তু তবু তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করাটা হয়ে দাঁড়াবে তার জীবনের পবিত্রতম দায়িত্ব।

যাক সে কথা। এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, কোয়ামোদো যদি কোনভাবে তার বাপ-ভাইদের কাছে পৌঁছতে পারে তবে সাহায্য লাভ অবধারিত। সার্ভেরো দুর্গ তার পাশে এসে দাঁড়াবে। আর সেক্ষেত্রে পনেরোজন সৈনিক নিয়ে ফার্ডিনান্ড কিছুই করতে পারবেন না। তিনি জানেন, পনেরো কেন পনেরোশো সৈনিক সঙ্গে থাকলেও সার্ভেনরাকে কজা করা অত সহজ নয়। কেননা, দুৰ্গটা ছোট হলেও দুর্ভেদ্য। এর প্রমাণ রয়েছে স্পেনের ইতিহাসের নানান পাতায়।

কাজেই আর সময় নষ্ট নয়। সাভানাকে নিয়ে বাহকরা পাহাড় থেকে নেমে যেতেই সঙ্গীদের নিয়ে উধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছোটালেন ফার্ডিনান্ড। লক্ষ্য তার মরুভূমির সেই বিশেষ কোণটি-দুবৃত্ত কোয়ামোদোর সম্ভাব্য গন্তব্য সার্ভেরো কেল্লার অবস্থান যেদিকে।

বেলা এখন দুপুর।

গত রাতের ঝড়-বৃষ্টির পর আকাশ এখন পরিষ্কার। রোদের তাপে তেতে উঠেছে পৃথিবী। আকাশ থেকে যেমন আগুনের হলকা ঝরছে তেমনি অগ্নিতপ্ত পায়ের নিচে বালুপ্রান্তর। বাতাসে তাপতরঙ্গের কাপন। সামনের দিকে চাইলে সে কাঁপন স্পষ্ট দেখা যায়।

কর্নেলিয়া অনেকক্ষণ আগেই চেতনা ফিরে পেয়েছে, একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। কোয়ামোদো মাঝে মাঝেই তার চোখে-মুখে পানির ছিটে দিচ্ছে, সযত্নে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে। এ মুহূর্তে এর চাইতে বেশি কিছু করার উপায় নেই তার।

আর বড় জোর দুঘণ্টা। এরমধ্যেই পৌঁছে যাবে সে সার্ভেরো দুর্গে। বাপ ভাই হয়তো ওর অপকীর্তি দেখে মহাখাপ্পা হয়ে উঠবে, কিন্তু ওকে ফেলে দেবে না। একথা মন থেকে বিশ্বাস করে ও।

বাবাকে যে খুশি করতে পারবে এতে কোন সন্দেহ নেই কোয়ামোদোর। না, না, কর্নেলিয়াকে দেখে যে বাবা খুশি হবেন তা নয়। খুশি হবেন একটা দলিল দেখে। অতি মূল্যবান এক দলিল। ফরাসি সেনাপতি ডিউক দ্য অর্লিয়াঁর একটা চিঠি। তিনি ওটা পাঠিয়েছেন আলমাঞ্জার দুর্গপ্রধান হোসে ফার্ডিনান্ডের নামে। ওই আহত ফরাসিটা, মানে সেন্ট সাভানার পকেট হাতড়ে কাগজটা উদ্ধার করে এনেছে কোয়ামোদো।

ম্যাজেন্টো গুইশাম্পোর হাতে চিঠিটা তুলে দেয়া হলে তিনি কি কোয়ামোদোকে বুকে জড়িয়ে না ধরে পারবেন?

.

চার

তিন দিন পর। প্রিন্স রিজেন্ট ফ্রান্সিসের শিবিরে দেখা গেল ম্যাজেন্টো গুইশাস্পোকে।

স্পেনে এমুহূর্তে জটিল রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। গত বছর সাবালক হয়েছেন সিংহাসনের অধিকারী রাজা ফিলিপ। কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষমতা এখনও তার হাতে আসেনি।

তিনি যখন নাবালক ছিলেন তখন রাজ্যশাসনের ভার ছিল তাঁর দূর সম্পর্কের চাচা প্রিন্স ফ্রান্সিসের ওপর। এখন ভাতিজা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার পরও কিন্তু তার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।

প্রিন্স ফ্রান্সিস সব সময় অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রী বজায় রেখে রাজকার্য পরিচালনা করেছেন। অবশ্য তিনি এ নীতির প্রবর্তন করেননি। বংশানুক্রমে স্পেনের রাজারা এ নীতি চালু রেখেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কেননা, স্পেন ও অস্ট্রিয়ার সম্রাটরা মূলত একই আদিরাজবংশের উত্তরাধিকার। এ ছাড়াও কারণ আছে, তা হলো, দুটি দেশই বিশেষ এক শক্রর ভয়ে সর্বদা এস্ত-আতঙ্কিত। ফরাসি রাজাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ওই দুটি দেশের জন্যে চিরকালই ভয়ের কারণ।

যা হোক, ফ্রান্সের রাজা দোর্দণ্ডপ্রতাপ চতুর্দশ লুই এবার কিন্তু স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবার চমৎকার এক সুযোগ পেয়ে গেছেন। সিংহাসনের ন্যায্য দাবীদার সাবালকত্ব লাভ করার পরও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। যে লোকটি রাজদণ্ড আঁকড়ে ধরে আছে, সিংহাসনের ওপর তার কোনই দাবি নেই। অথচ রাজা ফিলিপ অসহায়। শক্তিশালী, কঠোর শাসক ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে তিনি বা তার শুভাকাতক্ষীরা কেউই টু শব্দটি করতে পারছেন না।

চতুর্দশ লুই এমুহূর্তে ইউরোপের সবচাইতে শক্তিশালী শাসক। তিনি প্রথমে এক চরমপত্র পাঠালেন ফ্রান্সিসের কাছে। ওতে লেখা ছিল:

রাজা ফিলিপ এখন সাবালক। আমরা তার হাতে রাজদণ্ড দেখতে চাই।

ফ্রান্সিস তার কথায় কান দিলেন না। তিনি সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে চললেন এবং ইংল্যান্ড, হল্যান্ড এসব দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা চালাতে লাগলেন-বিপদকালে যাতে সাহায্য পেতে পারেন।

এসব খবর কিন্তু চাপা রইল না।

ফ্রান্স রাজদরবার জেনে গেল ফ্রান্সিসের এ সমস্ত কীর্তি-কলাপের কথা। চতুর্দশ লুই খেপে গেলেন। তিনি ঠিক করলেন, এই বেহায়া লোকটিকে আর সুযোগ দেবেন না।

দ্বিতীয়বার আর চরমপত্র পাঠালেন না তিনি, পিরেনীজ পর্বতের ওপর দিয়ে সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন। নিজের ভাতিজা অর্থাৎ প্রখ্যাত সেনাপতি ডিউক অর্লিয়াঁর ওপর দায়িত্ব দিলেন সে সেনাবাহিনীর।

স্পেনের ন্যায্য উত্তরাধিকার রাজা ফিলিপ এখন কোথায়?

তিনি রাজধানী মাদ্রিদেই আছেন। রাজপ্রাসাদে বাস করছেন। সোনার খাঁচায় বন্দী পাখিটি যেন। প্রাসাদের ভেতর তিনিই সর্বেসর্বা। কিন্তু বাইরে আসার তার স্বাধীনতা নেই। কাউকে কোন হুকুমও দিতে পারেন না।

ফ্রান্সিস মহা ধুরন্ধর লোক। ফিলিপের সম্মান তিনি ক্ষুণ্ণ করেননি। কেবল প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে রাজা ফিলিপ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন-রাজ্যশাসনের ক্ষমতা তার নেই। শারীরিক নয়, মানসিক ব্যাধিতে ভুগছেন রাজা, বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও মানসিকভাবে ভয়ানক অসুস্থ তিনি। রাজ্যশাসনের ভার পড়লে শীঘ্রিই বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হবেন।

শুধুমাত্র রাজার স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই না এতবড় গুরুদায়িত্ব পালন করে যেতে বাধ্য হচ্ছেন চাচা ফ্রান্সিস! তা নাহলে এসব ঝামেলার কাজে কেউ সেধে নিজেকে জড়ায়?

রাজা আছেন রাজপ্রাসাদে আর রাজপ্রতিনিধি, অর্থাৎ ফ্রান্সিস আছেন রাজধানীর অদূরে-তাবু ফেলে। রাজার ওপর নজর তো রাখছেনই, তৈরি রয়েছেন বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে। ফরাসি দূত প্রথম চরমপত্র দিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ঘাঁটি গেড়েছেন ওখানে।

সমস্ত অনুগত দুর্গপ্রধান ও সমরনায়কদের সঙ্গে এখানে বসে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তিনি। স্বৈরাচারী শাসকের আশপাশে বদ লোকেরা হীন স্বার্থে ভিড় জমায়। এ ধরনের লোকেরাই এই ক্ষমতালোভী রাজপ্রতিনিধিটিকে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। যাদের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন ফ্রান্সিস, তাদেরকে উদার হাতে লুটপাটেরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

সার্ভেয়োর দুর্গপ্রধান ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো এমনি এক সুবিধাবাদী দেশদ্রোহী। ফ্রান্সিস কিন্তু আলমাঞ্জার দুর্গম্বামী হোসে ফার্ডিনান্ডকে কজা করতে পারেননি। তার দূতকে ফার্ডিনান্ড সদুপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, ফ্রান্সিসের কাছে যেটা ভাল লাগেনি।

ফার্ডিনান্ড বলেছিলেন, তোমার প্রভুকে গিয়ে বলবে তিনি কোন বিবেকসম্পন্ন। মানুষের নৈতিক সমর্থন আশা করতে পারেন না। রাজা এখন আর ছোটটি নন। তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ওঁকে এখন মন্ত্রী হতে বলল, কিংবা নিজের যে সাতটা জমিদারি আছে তার কোনটিতে গিয়ে বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দিতে বলো। গোটা ইউরোপ তাহলে তাকে সম্মান করবে।

তারপর থেকেই রিজেন্ট ফ্রান্সিস দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ, সুযোগ পাওয়া মাত্র আলমাঞ্জাকে ধ্বংস করে ফাঁসিতে চড়াবেন হোসে ফার্ডিনান্ডকে। সুযোগ তিনি পাবেনই, জানেন ফ্রান্সিস। চতুর্দশ লুই জেদী লোক, তিনি সৈন্য পাঠাবেন ধরে নেয়া যায়। আর ঠিক তখনই হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে কোনভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া যাবে ফার্ডিনান্ডকে।

এরকম যখন পরিস্থিতি তখন তেলে বেগুন ছাড়ল একটা চিঠি। সার্ভেরোর দুর্গস্বামী ওটা নিয়ে এসেছেন। চিঠির খামে ডিউক দ্য অর্লিয়াঁর সীলমোহর।

বিশ্বাসঘাতক হোসে ফার্ডিনান্ড এবার যাবে কোথায়?

চিঠিটা খুলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললেন রিজেন্ট। ওতে লেখা:

আলমাঞ্জার মাননীয় দুর্গপ্রধান, সিনর ব্যারন ফার্ডিনান্ড, আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, স্পেনের মহামান্য রাজা ফিলিপকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছেন পিরেনীজের এপারে। রাজা ফিলিপের অনুগত ব্যারন ও সৈন্যদের এ মুহূর্তে কর্তব্য, সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে সিংহাসন ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারীকে ফিরিয়ে দেয়া। আপনি আমার শিবিরে পরামর্শের জন্যে কবে আসছেন আমার দূত মারফত জানিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।

চিঠির নিচে ফরাসি ভাষায় বড় বড় হরফে নাম স্বাক্ষর করা হয়েছে-ফিলিপ দ্য অর্লিয়াঁ, বুর্ভেয়া শিবির।

চিঠি যতক্ষণ পড়লেন আনন্দ ও দুশ্চিন্তার মিশ্র অনুভূতি খেলা করে গেল রিজেন্টের মুখের চেহারায়।

আনন্দ এই জন্যে, হোসে ফার্ডিনান্ডকে ফাঁসানোর সুবর্ণ সুযোগ অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে এসে গেছে। আর দুশ্চিন্তা কেন? তার গুরুতর কারণ আছে। শুধু হোসে ফার্ডিনান্ডকেই নয়, স্পেন দেশের আরও কয়েকশো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে নিশ্চয়ই চিঠি লিখেছেন অর্লিয়াঁ।

মাত্র একটা চিঠি হাতে এসেছে। তারমানে একটা শত্রুকে চেনা গেল। অবশ্য ফার্ডিনান্ডকে তিনি অনেক আগেই শক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছেন। লোকটা আগাগোড়াই বেঈমান। অন্য কারও কাছে পাঠানো অর্লিয়াঁর চিঠি হাতাতে পারলে নতুন খবর জানা যেত। যাকগে, কি আর করা।

এ চিঠি তুমি পেলে কিভাবে? ম্যাজেন্টোকে প্রশ্ন করলেন তিনি।

ম্যাজেন্টো তেমন বলিয়ে কইয়ে মানুষ নন। ভদ্রলোক একে তো তোতলা, তার ওপর একই কথা বারবার বলার বদভ্যাসও আছে। কাজেই তিনি যতটুকু জানেন তা সংক্ষেপে বলতে গেলে এরকম দাঁড়ায়:

মেষপালকদেরকে বিস্কে উপকূলের টেলিগ্রাফ বলা যায়। এক জায়গার ঘটনা তাদের মুখে মুখে পৌঁছে যায় কয়েকশো মাইল দূরে। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি।

যাক সে কথা, একদল মেষপালক ট্রিটন হিলে কোয়ামোদোর বন্ধু ফেলিক্সের লাশ আবিষ্কার করে। মৃতদেহটা তারা কর্তব্যের খাতিরে পৌঁছে দেয় হোসে ফার্ডিনান্ডের দুর্গে। কেননা, এসব অঞ্চলে জমিদাররাই সর্বেসর্বা। তারাই শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখেন, বিচার-আচারও বসান। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করাটাই তাদের দায়িত্ব। অবশ্য সবক্ষেত্রেই যে এমনটি হয় তা বলার জো নেই। অনেকসময় শিষ্টের দমন, দুষ্টের পালনও দেখা যায় আরকি।

ওকথা থাক। ঘটনা যা ঘটেছিল তা এরকম: ট্রিটন হিল থেকে আলমাঞ্জায় লাশ পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি মেষপালকরা। বরঞ্চ ওদের পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে যত মেষপালক ভাই আছে তাদের কানে খবরটা পৌঁছে দিল ওরা। তারা আবার মুখে মুখে জানিয়ে দিল অন্যান্যদেরকে। এভাবে বেলা এগারোটা নাগাদ সার্ভেরোতে খবর পৌঁছে গেল। তিনি নিজস্ব রাখালদের মুখে জানতে পারলেন, তার বেয়াড়া পুত্র কোয়ামোদোর দস্যি ধরনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফেলিক্স মুশমার অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে মারা পড়েছে। এবং তার লাশ এখন রয়েছে আলমাঞ্জা দুর্গে।

ম্যাজেন্টো বিচলিত বোধ করলেন। আর করবেন না-ই বা কেন? ফেলিক্স আর কোয়ামোদো বাল্য বন্ধু। যাকে বলে মানিকজোড়। একজন যেখানে থাকবে অপরজনও সেখানে না থেকে পারে না। ছোটবেলায় ও দুজনকে চাবকেও আলাদা করা সম্ভব হয়নি। কালও দুটোকে দেখা গেছে সার্ভেয়োর ভোজঘরে বসে ঝলসানো শূকরের মাংস চিবোচ্ছে আর কি সব গোপনীয় শলা-পরামর্শ করছে।

এখন ম্যাজেন্টো যদি ধরে নেন, ফেলিক্স যেহেতু পরপারে গেছে তার, পুত্ররত্নটিও তার সঙ্গী হয়েছে, তবে কি তাকে দোষ দেয়া যায়? আলমাঞ্জায় অবশ্য কেবল ফেলিক্সের লাশই পৌঁছে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাই বলে নিশ্চিত হন কি করে যে কোয়ামোদো মারা পড়েনি? কোন পাথর-টাথরের আড়ালে হয়তো লাশ পড়ে আছে।

ম্যাজেন্টো এক্ষেত্রে পিতার কর্তব্য পালন করলেন। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত একদল সৈন্য নিয়ে তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। যত দোষই থাকুক, হাজার হলেও নিজেরই সন্তান তো। সন্তানের সম্ভাব্য বিপদের কথা শুনলে কোন পিতা উতলা না হয়ে পারেন? বড় ছেলে জ্যাভেদোর ওপর দুর্গরক্ষার ভার দিয়ে তিনি পঞ্চাশজন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এদের মধ্যে কিছু সশস্ত্র সৈনিকও ছিল।

ওদিকে কোয়ামোদো তখন মহাবিপদের মুখোমুখি। একদল অশ্বারোহী তাড়া করছে পেছন থেকে। ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এরা আলমাঞ্জার লোকই হবে।

কোয়ামোদোরা, একে পায়ে হেঁটে চলেছে তায় আবার ভার বইছে এক অর্ধসচেতন নারীর। অর্ধসচেতন, কেননা একটু-একটু করে জ্ঞান ফিরে আসছে কর্নেলিয়ার।

কোট দিয়ে তৈরি খাটিয়ায় শুইয়ে বহন করা হচ্ছে মেয়েটিকে। এতক্ষণ সে নিস্পন্দ ছিল, কিন্তু এখন ঘন-ঘন নড়াচড়া-করছে আর অস্ফুট শব্দ করছে মুখ দিয়ে। হঠাৎ করে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলে বিপদ বাড়বে, বলা যায় না, পেছন থেকে শত্রুরা গুলিও চালিয়ে বসতে পারে। .

একটা সময় কিন্তু গুলি চলতে শুরু করল। হোসে ফার্ডিনান্ড ঠিকই অনুমান করেছেন মেয়ে রয়েছে ওই অগ্রগামী পলায়নপর দস্যুদলটির সঙ্গে, যদিও ওরা তখনও নাগালের বাইরে।

গুলি চালাও, দূরত্ব কমতে আদেশ দিলেম উনি।

কেউ একজন আপত্তি তোলার চেষ্টা করল।

ব্যারন, গুলি যদি সিনোরিটার গায়ে লাগে?

কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটল আলমাঞ্জার দুর্গস্বামীর।

লাগলে লাগবে, কোয়ামোদোর স্ত্রী হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।

এরপর আর কথা চলে না।

গুলির জবাব কোয়ামোদোরাও দিচ্ছে। কিন্তু লড়াইটা অসম, ওরা জিতবে কিভাবে? শত্রুপক্ষ একে সংখ্যায় বেশি তায় আবার ঘোড়া দাবড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে কোয়ামোদোর লোকজন হতাহত হতে শুরু করেছে। এভাবে আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে ওরা?

কিন্তু এই চরম বিপদের মুহূর্তে হঠাৎই আশার আলো দেখতে পেল কোয়ামোদোরা। ধুলো উড়ছে সার্ভেরোর দিক থেকে। তাপতরঙ্গে মিশে রোদেলা আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে বালির ঝাঁপটা।

তারমানে সাহায্য, হ্যাঁ, সাহায্য আসছে সার্ভেরো থেকে।

মনে হচ্ছে বড়সড় সেনাবাহিনী। এইবার বুঝরে মজা আলমাঞ্জার শয়তানগুলো। ধুলোয় মিশে যাবে ওদের অল্প কজন লোক। কর্নেলিয়াকে এ যাত্রা বোধহয় তা করতে হলো না। আর তাছাড়া সে সাতেরোতেও আর থাকছে না অ্যাভার্ননের চূড়ায় যে ফরাসি আহত হয়ে পড়ে আছে তার জামার পকেট থেকে তার লেখা চিঠিখানা হাত করছে না কেয়ামোদো? ওটা নিয়ে, কর্নেলিয়াসহ সে সোজা চলে যাবে রিজেন্ট ফ্রান্সিসের কাছে। ফ্রান্সিস কৃতজ্ঞতাবশত নিশ্চয়ই কর্নেলিয়ার বাবার দুর্গ ও জমিদারিটা ওকে দান করবেন। তখন কর্নেলিয়াকে বিয়ে করে ও সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবে।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক।

ঠিক সে মুহূর্তে আলমাঞ্জার লোকেরা আবার গুলি চালিয়েছে। এবং সেটা লেগেছে কোয়ামোদোর মাথায়।

কোয়ামোদোর ছুটন্ত দেহটা ম্যাজেন্টোর চোখের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। গুলি খাওয়ার পরমুহূর্তে প্রাণপাখি উড়ে গেছে তার।

কিন্তু ম্যাজেন্টো যোদ্ধা মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে ধাক্কাটা সামলে নিলেন। ছেলের দিকে একবার দৃষ্টিক্ষেপ করেই আক্রমণ করলেন জাতশত্রু হোসে ফার্ডিনান্ডকে।

এবারও অসম লড়াই। পঞ্চাশজনের বিরুদ্ধে পনেরোজন পারে কি করে? পিছু হটতে বাধ্য হলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। কন্যার অধসচেতন দেহ দেখতে পাচ্ছেন, অথচ করার কিছু নেই। অগত্যা ঘোড়া ছোটালেন তিনি আলমাঞ্জার উদ্দেশে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস কেবল বেরিয়ে এল তার, পারলেন না তিনি। এত কাছে এসেও উদ্ধার করতে পারলেন না একমাত্র সন্তানকে।

হোসে ফার্ডিনান্ড ফিরে যাচ্ছেন, মনে হলো বাবা বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল কর্নেলিয়া। ঠিক নাকি ভুল শুনলেন কে জানে। সে মুহূর্তে, আল্লার কাছে সহ্য করবার শক্তি কামনা করলেন নিরুপায় পিতা।

ওদিকে, পুত্রের মৃতদেহের পাশে এসে বসেছেন ম্যাজেন্টো, উদ্দেশ্য, পকেট হাতড়ে দেখবেন। মূল্যবান কোন কিছু থেকে থাকতে পারে।

ভাগ্যিস বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল তাঁর। নইলে ডিউক অর্লিয়াঁর গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা তিনি পেতেন কিভাবে?

রিজেন্ট ফ্রান্সিসের কাছে সে চিঠিটা নিয়ে এসেছেন ম্যাজেন্টো।

দুই প্রাণের দোস্ত ফেলিক্স আর কোয়ামোদো মারা পড়েছে, সাভানা অর্ধমৃত, কর্নেলিয়া শত্রুপক্ষের হাতে।

কিন্তু এতসবের পরেও রয়ে গেছে চিঠিখানা। যদিও এটা এসে পড়েছে অবাঞ্ছিত হাতে।

.

পাঁচ

রিজেন্ট ফ্রান্সিস বিপদ সঙ্কেতটা ঠিকই টের পেলেন। অর্লিয়াঁ স্পেনের বীর যোদ্ধা ও জমিদারদের আকর্ষণ করতে চাইছে ফিলিপের দিকে, ফিলিপকে সমর্থন করার উছিলায় হানাদার ফরাসি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে বলছে।

কিন্তু স্পেনের অদূরদশী সন্তানরা সেটা বুঝবে কি? তারা রাজভক্ত জাতি। রাজার জন্যে মরতে দ্বিধা করবে না। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে তিলক পরিয়ে দেবে অর্লিয়াঁর কপালে। চতুর্দশ লুইয়ের পদতলে চলে যাবে স্পেন।

পিরেনীজ আর থাকবে না, যুদ্ধযাত্রার শুরুতে গর্ব করে বলেছিলেন ডিউক অর্লিয়াঁ। তার মানে কি স্পেন ও ফ্রান্স এক হয়ে যাবে? দুটোর মাঝে সীমানা বলে কিছু থাকবে না?

তা যদি না থাকে তাহলে খুব সহজেই বলে দেয়া যায়, দেশটির রাজা ফিলিপ হবেন না-হবেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ চতুর্দশ লুই।

কাজেই, অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে অর্লিয়াঁর চক্রান্ত। ও নিশ্চয়ই এমন অসংখ্য চিঠি ছেড়েছে। তারমধ্যে মাত্র একটা ধরা পড়েছে। সেজন্যে ম্যাজেন্টো গুইশাম্পোকে বাহবা দিতেই হয়। বেচারার ছোট ছেলেটা মারা পড়েছে। ফরাসি দূতটাকে ধরতে গিয়ে সামনাসামনি লড়তে হয়েছে তাকে। তাতেই মারা গেছে বীর ছেলেটি।

এই বীর যুবকের স্মৃতি অমর করে রাখার ব্যবস্থা করবেন ফ্রান্সিস। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ওর আত্মত্যাগের কথা। শুধু কি তাই? বীর সন্তানের শোকার্ত পিতাকে তিনি যথোপযুক্ত পুরস্কার দেবেন। যাতে এই গুইশাম্পোদের দেখে অন্যান্যরাও রিজেন্টভক্ত হতে শেখে।

ম্যাজেন্টোকে তখনই পুরস্কৃত করা হলো। রাজসৈন্যের কর্নেল পদে নিয়োগ পেলেন তিনি। তার ওপর বিশেষ এক দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। আলমাঞ্জা দুর্গ দখল করে, হোসে ফার্ডিনান্ডকে বন্দী করে আনতে হবে ফ্রান্সিসের সামনে।

একাজে দশ হাজার সৈন্য নিতে পারেন আপনি, আদেশ দিলেন ফ্রান্সিস। প্রয়োজন পড়লে আরও পাবেন।

গোটা দশেক কামান চাই, আবেদন জানালেন ম্যাজেন্টো। জানেনই তো, আলমাঞ্জা বড় দুর্গম দুর্গ।

কামান নিতে চান নিন, কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে ব্যবহার করতে পারবেন না। যে কোন দুর্গম দুর্গ দেশের সম্পদ। সেটাকে ধ্বংস করে দিলে দুর্গস্বামীর যতটা না ক্ষতি হয়, তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি হয় দেশের।

ক্ষমতালোভী হলেও রাজনীতি জ্ঞান কারও চাইতে কম নয় ফ্রান্সিসের, দেশের কথা ভাবেন তিনিও।

সুতরাং ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো তার সেনাবাহিনী ও দশটা কামানসহ রওনা হলেন আলমাঞ্জার উদ্দেশে। খুব উৎফুল্ল মেজাজে রয়েছেন তিনি। যুদ্ধে রিজেন্ট ফ্রান্সিসের জয় অনিবার্য বলে ধারণা তার। স্পেন দুর্বল রাষ্ট্র নয়। এমনকি ফ্রান্সের অমিতবিক্ৰম রাজা চতুর্দশ লুইয়ের পক্ষেও এত সহজে স্পেন জয় করে নেয়া সম্ভব নয়।

রিজেন্ট জয়ী হবেনই, তিনি সিংহাসনে বসতে পারুন আর না-ই পারুন। সিংহাসন না পেলেও রিজেন্টের পদ থাকবে তার, এবং থাকবে বিশ্বস্ত অনুসারীদের পুরস্কৃত করার ক্ষমতাও। তখন কি তিনি আলমাঞ্জা দুর্গ ও সংলগ্ন জমিদারি ম্যাজেন্টোকে না দিয়ে পারবেন?

কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন ম্যাজেন্টো। সার্ভেয়োর সঙ্গে আলমাঞ্জা যুক্ত হলে দুদিন বাদে কাউন্ট পদবী, চাই কি ডিউক পদবীর দাবি জানাতে পারবেন তিনি।

কর্নেল গুইশাম্পো যখন দ্রুতবেগে আলমাঞ্জার উদ্দেশে ছুটছেন, হোসে ফার্ডিনান্ড তখন নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত। পারিবারিক, রাজনৈতিক, রণনৈতিক সব দিক দিয়ে। তার একমাত্র সন্তান, আলমাঞ্জার উত্তরাধিকারিণী অপহৃতা। তাঁরই কেল্লার ভেতর থেকে সবার অজান্তে শক্ররা তাকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর ছুটেও গেলেন তিনি মেয়েকে উদ্ধার করে আনতে। সফলকামও প্রায় হয়ে গেছিলেন, অল্পের জন্যে পিছু হটে আসতে বাধ্য হলেন। এ যে কী কষ্ট তা একমাত্র অসহায় পিতাই উপলব্ধি করতে পারেন।

ম্যাজেন্টো গুইশাম্পের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব কোনদিনই ছিল না। দুটো প্রতিবেশী দুর্গের জমিদারদের মধ্যে তা থাকেও না কখনও। কিন্তু তাই বলে শুক্রতা ছিল এমনও নয়, সার্ভেরো থেকে যে এমন অপ্রত্যাশিত আক্রমণ আসবে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। অথচ ঘটনাটা ঘটল তো।

কোয়ামোদো গুইশাম্পোর দলবলের পরাজয় যখন সুনিশ্চিত তখন সদলবলে তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো। কাজেই ফার্ডিনান্ডের আর বুঝতে বাকি নেই কোয়ামোদোকে এতবড় দুঃসাহস দেখাতে কে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। বাপের প্ররোচনা না পেলে কোয়ামোদোর সাহস হত না বাঘের খাঁচা থেকে কর্নেলিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

কিন্তু এরা বোধহয় জানে না, এক মাঘে শীত যায় না। প্রতিশোধ নেবেন ফার্ডিনান্ড। কঠোর প্রতিশোধ।

অতর্কিত আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছেন ফার্ডিনান্ড সার্ভেয়রা দুৰ্গটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবেন।

ফার্ডিনান্ড এসব সাত-পাঁচ ভাবছেন এসময় অগাস্টার আগমন।

ফরাসি সৈনিকটি তোমার সাথে কথা বলতে চায়, বললেন স্বামীকে।

খানিকটা বিস্মিত হলেন হোসে ফার্ডিনান্ড।

ও, সে বেঁচে উঠেছে তারমানে? যে রক্ত গেছে, আমি তো ভেবেছিলাম মরেই যাবে। আঘাত তেমন গুরুতর নয়, কিন্তু দশ-বারো ঘণ্টা অজ্ঞান পড়ে থাকাটাও তো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন অগাস্টা।

আঘাতটা হয়তো শরীরের চাইতে মনে বেশি লেগেছে।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ফার্ডিনান্ড।

মনের ওপর? মানে?।

শত চেষ্টা করেও কর্নেলিয়াকে রক্ষা করতে পারেনি যে। যোদ্ধাপুরুষ সে। অসহায় নারীকে রক্ষা করতে না পারলে কেমন লাগতে পারে সেটা আমার চেয়ে তোমারই ভাল জানার কথা। কেননা, তুমিও তো একই ধাতে গড়া, এবং তুমিও মেয়েকে উদ্ধার করে আনতে ব্যর্থ হয়েছ। তার ওপর গুলি খেয়ে ওই পরিমাণ রক্তক্ষরণ হলে কী দশা হত, নিজেই ভেবে দেখো।

থাক সে কথা, বললেন হোসে ফার্ডিনান্ড। ও যে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ওর মুখ থেকে জানা দরকার ও কর্নেলিয়ার ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ল কিভাবে। আর কর্নেলিয়াকে রক্ষা করতে না পারলেও আমাদের কাছে সে কৃতজ্ঞতা আশা করতেই পারে। ও তো জীবন বাজিই রেখেছিল কর্নেলিয়াকে বাঁচাতে।

স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গের অতিথিমহলে প্রবেশ করলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। সেনা ব্যারাক পেরিয়ে অন্দরের দিকে যেতে বা পাশে ছোট-বড় এক সার কামরা। সব কটাই সাজানো-গোছানো। এমনি এক ছোট ঘরে সাভানাকে রাখা হয়েছে।

ছোট ঘর দেয়ার কারণ একটাই-গরম রাখা সহজ। বড় ঘরে জানালা বেশি, ফলে বিস্কে উপকূলের রাশি-রাশি বালি ঘরে ঢোকেও বেশি। তার ওপর ঝড় ঝাপ্টা তো লেগেই আছে।

এঘরে একটা বড় খাট, ছোট একটা টেবিল ও দুটো মাত্র চেয়ার। আসবাব বলতে আর কিছু নেই।

সাভানার চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি, চেহারা উষ্কখুষ্ক। ওকে দেখে মনে হলো ফার্ডিনান্ডের, বেচারা পরিস্থিতি আঁচ করে উঠতে পারছে না।

আপনি এ দুর্গের মালিক? আপনি ব্যারন হোসে ফার্ডিনান্ড? আমি আপনার কাছেই আসছিলাম। ডিউক অর্লিয়াঁ আমাকে পাঠিয়েছিলেন।

কথা কটা বলেই ওপর দিকে চেয়ে রইল সাভানা। বিস্মৃত প্রায় কোন ঘটনা বুঝি মনে করার চেষ্টা করছে।

কেন যে পাঠিয়েছিলেন মনে করতে পারছি না, বলল ধীরে-ধীরে। আপনি জানেন? পরক্ষণে নিজেই বলল, আপনি জানবেন কি করে? আমারই তো মনে পড়ছে না। তবে খুব সম্ভব একটা চিঠি। হ্যাঁ, চিঠি। আপনাকেই পাঠিয়েছিলেন ডিউক। কি লেখা ছিল আমি জানতাম। কিন্তু কোয়ামোদো আছে না-আপনার মেয়েই আমাকে অ্যাভার্ননের মাথায় ওকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন-সে চিঠিটা আমার পকেট থেকে বের করে নিয়েছে। আমি সবই টের পেয়েছি, তখনও জ্ঞান ছিল আমার।

সাভানার কথা-বার্তা অসংলগ্ন, বলতে বলতে মাঝে মাঝেই জড়িয়ে যাচ্ছে। হোসে ফার্ডিনান্ড পুরো দেড়টি ঘণ্টা ধৈর্য ধরে বসে রইলেন।

সব কথা শোনার পর রোগীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে তার চোখজোড়া, দৃষ্টি সাভানার মতই উদভ্রান্ত।

সাভানার দীর্ঘ বক্তব্য থেকে সার কথা তিনি যা বের করতে পেরেছেন তা রীতিমত আতঙ্কজনক।

এটা স্পষ্ট, ডিউক অর্লিয়াঁ স্পেনে প্রবেশ করার পর কয়েকজন বাছাই করা দুর্গপতি ও রণনায়কের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। ফরাসি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার আমন্ত্রণ জানিয়ে।

ফরাসিবাহিনী এদেশে এসেছে রাজাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। প্রতিটি রাজভক্ত স্প্যানিয়ার্ড ভদ্রলোকের উচিত তাদেরকে একাজে সাহায্য করা।

ফরাসি গুপ্তচরদের মুখ থেকে যে কয়েকজন গণ্যমান্য দেশপ্রেমিকের নাম জানতে পেরেছিলেন অর্লিয়াঁ, তাদের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন। বলাবহুল্য, এঁদের মধ্যে প্রথমেই আছে হোসে ফার্ডিনান্ডের নাম।

ডিউক অর্লিয়াঁর পাঠানো সেই চিঠিটি খোয়া গেছে। ওই বদমাশ কোয়ামোদো চিঠিটা লুটে নিয়ে গেছে-এ পর্যন্ত জানা গেছে সাভানার মুখ থেকে।

তারপর?

তারপরের ঘটনা অনুমান করে নিতে হবে।

হোসে ফার্ডিনান্ডের গুলিতে মারা পড়েছে কোয়ামোদো, এ ঘটনা অবশ্য স্বচক্ষে দেখেছেন হোসে ফার্ডিনান্ড। পলায়নপর দলটিকে ধাওয়া করে মেয়েকে উদ্ধার করে আনতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হন সার্ভেয়ো দুর্গের সেনাবাহিনীর আকস্মিক আবির্ভাবে। অগত্যা পিছু হটে আসতে হয় তাকে। নইলে বন্দী হতে পারতেন কিংবা মারা পড়াটাও অস্বাভাবিক ছিল না।

ম্যাজেন্টো নিজের দুর্গে নিয়ে যান বন্দিনী কর্নেলিয়াকে। নিজ পুত্রের মৃতদেহও নিশ্চয়ই ফেলে রেখে যাননি। আর তার জামার পকেট হাতড়াতেও ভোলেননি।

তারপরের ঘটনা কি আর বলে দিতে হয়? চিঠি নিয়ে সোজা রিজেন্ট ফ্রান্সিসের কাছে চলে যাবেন ম্যাজেন্টো এত সহজে প্রিয়পাত্র হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে কোন বোকা?

স্পেনের গোটা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব এখন রিজেন্টের হাতে। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে দীর্ঘদিন সমানে সমানে যুঝে যেতে পারবেন তিনি। ইতোমধ্যে হোসে ফার্ডিনান্ডের ওপর নিশ্চয়ই চরম প্রতিশোধ নিতে চাইবেন রিজেন্ট। তাকে উসকানি দেয়ার জন্যে ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো তো আছেনই।

মনে মনে প্রমাদ গুণলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। ডিউক অর্লিয়াঁ এখনও বহু দূরে, কিন্তু রিজেন্ট ফ্রান্সিস খুব কাছে।

এই যখন অবস্থা তখন কন্যার অপহরণের শোক বুকের গভীরে চাপা দিয়ে রাখলেন ফার্ডিনান্ড। এখন হা-হুঁতাশ করার সময় নয়, আত্মরক্ষার সময়। কেননা, ডিউক অর্লিয়াঁর চিঠি হাতে পাওয়ার পর যে কোন মুহূর্তে আলমাঞ্জা অবরোধ করতে সেনাদল পাঠাতে পারেন রিজেন্ট। কে জানে, এমুহূর্তে হয়তো তাঁর দুর্গের উদ্দেশেই দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সেনাবাহিনী।

হোসে ফার্ডিনান্ডের সৈন্যসংখ্যা মাত্র দুহাজার। এরমধ্যে দুর্গে স্থায়ীভাবে থাকে এক হাজার। বাকি এক হাজার বাস করে যার যার বাসায়। দুর্গ থেকে বিশ পঁচিশ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে। বিপকালে দুর্গের চূড়ায় আগুন জ্বেলে দেয়া হয়। গৃহস্থ সৈনিকরা ঘরে বসেই দেখতে পায় সে আগুন। মুহূর্তে যার যার হাতিয়ার নিয়ে ছুটে আসে আলমাঞ্জার পতাকাতলে জড় হতে।

দুহাজার সৈন্য স্বাভাবিক অবস্থায় অবশ্য কম নয়। আশপাশের দুর্গস্বামীদের দাবিয়ে রাখতে যথেষ্ট। কেননা, ওদের কারও পাঁচশোর বেশি সৈন্য থাকে না।

কিন্তু এখনকার কথা সম্পূর্ণ আলাদা। সার্ভেরের বিরুদ্ধে তো, নয়, লড়তে হবে স্পেনের রাজশক্তির বিরুদ্ধে। প্রয়োজনে যারা লক্ষাধিক সৈন্য পাঠিয়ে দিতে পারে আলমাঞ্জার বিপক্ষে।

কাজেই হোসে ফার্ডিনান্ডের কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। তিনি নিশ্চিত, অবরোধ ও আক্রমণ আসছে। প্রস্তুত হতে লাগলেন ফার্ডিনান্ড। দুর্গশীর্ষে আগুন জ্বলল প্রতি রাতে। দুর্গের গোলায় মজুদ হতে লাগল হাজার হাজার বস্তা গম।

খবর পৌঁছে গেছে, রিজেন্টের সেনাবাহিনী রওনা হয়ে গেছে। অর্ধেক পথ ইতোমধ্যে তারা পাড়িও দিয়ে ফেলেছে।

কে নেতৃত্ব দিচ্ছে দলটির?

এ খবরটি পৌঁছল এক দিন বাদে। নামটা শুনে হা-হা করে হেসে উঠলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। অধিনায়ক আর কেউ নন, কর্নেল ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো-ব্যারন দ্য সার্ভেনরা। যা ভেবেছিলেন তাই।

অর্লিয়াঁর চিঠিটা কিন্তু অঘটন ঘটন পটীয়সী, মনে মনে বললেন হোসে ফার্ডিনান্ড।

চিঠি সাভানার কাছে ছিল, সে হলো গুরুতর আহত। কোয়ামোদো চিঠি হাত করল, সে পড়ল মারা। ম্যাজেন্টো চিঠি হাতিয়ে ফল পেলেন বিপরীতমুখী। রাতারাতি বনে গেলেন কর্নেল।

এখন চিঠি গেছে রিজেন্টের কাছে।

তিনি ও থেকে কি ধরনের ফল পাবেন? ভাল না মন্দ? আরও উন্নতি করবেন, নাকি তলিয়ে যাবেন রসাতলে?

কি হয় দেখাই যাক না।

রিজেন্টের পরিণাম অনেকাংশে নির্ভর করবে হোসে ফার্ডিনান্ড ও তার মত আরও অনেক দেশপ্রেমিক, রাজভক্তের প্রতিরোধক্ষমতার ওপরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *