৫. রবার্ট বেলামির মুখটা

৪১.

রবার্ট বেলামির মুখটা যখন টেলিভিশনের পর্দায় পিয়েরে দেখেছিল, সে জানতে পেরেছিল, সে কীভাবে আরও বেশি অর্থ হাতে পাবে। ইন্টারপোল রবার্টকে কুকুরের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই তার জন্য অনেক টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। পিয়েরে জানে, রবার্ট কোথায় আছে। আহা, পুরস্কারের টাকাটা এখন আমার। তাকে আমি নেপলসে নিয়ে যাব। তার ওপর কড়া নজর রাখব।

একজন মানুষের কণ্ঠস্বর- ইন্টারপোল, আমি কীভাবে সাহায্য করব?

পিয়েরের বুকে কাঁপন আপনারা কমান্ডার রবার্ট বেলামি নামে এক মানুষের সন্ধান করছেন?

-আপনি কে বলছেন?

তাতে কিছু এসে যায় না। বলুন, আমার কথা সত্যি কি মিথ্যে?

 –ঠিক আছে, অন্য এক জায়গায় কথা বলতে হবে। লাইনটা ধরবেন কি?

তিরিশ সেকেন্ড কেটে গেছে, একজন সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে পিয়েরে কথা বলছে- কীভাবে সাহায্য করব?

কমান্ডার রবার্ট বেলামি আমার সঙ্গে আছেন। তাকে কি আপনারা চাইছেন?

–হ্যাঁ, সিরিয়া, তাকে আমরা চাইছি। সত্যি কথা বলছেন?

–হ্যাঁ, উনি আমার পাশেই আছেন। কত টাকা পাব?

–পুরস্কার?

–হ্যাঁ, পুরস্কার।

ভদ্রলোক তার সহকারীর দিকে তাকালেন।

এখনও মাথার দাম ধার্য করা হয়নি।

–ঠিক আছে, আমার খুব তাড়া আছে কিন্তু।

কত টাকা আপনি চাইছেন?

–পঞ্চাশ হাজার ডলার?

–পঞ্চাশ হাজার ডলার! অনেক। কোথায় গিয়ে কথা বলা যায়?

–না, টাকাটার ব্যাপারে সব ঠিক না হলে আমি কিন্তু কথা বলব না।

পিয়েরে দেখল রবার্ট সেদিকে এগিয়ে আসছেন। সে বলল তাড়াতাড়ি বলুন। হা অথবা না।

-ঠিক আছে সিনরিয়া। হ্যাঁ, আমরা ওই টাকাটাই দেব।

 রবার্ট দরজার কাছে এসে গেছেন। পিয়েরে টেলিফোনে বলল- আমরা ডিনারের আগেই পৌঁছে যাব। ওকে তোমার ভীষণ ভালো লাগবে। ও খুব ভালো। তোমার সঙ্গে দেখা হবে, কেমন?

পিয়েরে রিসিভারটা নামিয়ে রবার্টের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল- মা, তোমাকে দেখার জন্য মরে যাচ্ছে বোধহয়!

.

৪২.

ইন্টারপোল হেডকোয়ার্টার। একজন অফিসার বললেন- কোথা থেকে ফোনটা এসেছে ধরা গেল?

ওরা সোল থেকে ফোন করেছে। তার মানে বেলামি এখন নেপলসের দিকে এগিয়ে চলেছেন।

.

কর্নেল ফ্রানসেসকো সিজার এবং কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন সিজারের অফিসের একটা ম্যাপের দিকে তাকিয়ে আছেন।

কর্নেল সিজার বললেন- নেপলস একটা মস্ত বড়ো শহর। এক হাজার জায়গায় মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে।

মেয়েটি কে?

 এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।

–মেয়েটিকে খুঁজে বের করলে কেমন হয়?

 সিজার অবাক কী করে?

-বেলামি যদি এক নারীসঙ্গ প্রার্থনা করেন তা হলে তিনি কোথায় যাবেন?

উনি এক বেশ্যাকে খুঁজবেন।

–তাহলে আমরা সেখান থেকেই শুরু করব।

 –ঠিক বলেছেন, বেশ্যাপট্টিতে যাব।

তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই অঞ্চলে চলে গেলেন। সঙ্গে ক্যাপটেন বেলানিকে নেওয়া হল। ওই অঞ্চলের পুলিশ সুপারভাইজার।

বেলানি বললেন, অত সহজে কথা বের করা যাবে না। তাদের মধ্যে খেয়োখেয়ির শেষ নেই। পুলিশ এলেই তারা এককাট্টা হয়ে যায়। তারা কথা বলতে চায় না।

এই সেই অঞ্চল। কুখ্যাত অঞ্চল। একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার বললেন- শুভ সন্ধ্যা, মারিয়া, ব্যবসা কেমন চলছে।

–আপনি চলে গেলেই ব্যবসা ভালো চলবে।

–আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে আসিনি। আমরা এক আমেরিকান খদ্দেরের সন্ধানে এসেছি। যে একটা মেয়েকে কালরাতে তুলে নিয়ে গেছে। তারা বোধহয় এখন একসঙ্গে ভ্রমণ করছে। মেয়েটি কে? তুমি কিছু জানো?

রবার্টের একটা ছবি অফিসারের হাতে ছিল। উনি ছবিটা দেখালেন।

কয়েকটা বেশ্যা কথা বলতে শুরু করছে।

মারিয়া বলল- না, আমি কিছুই জানি না। তবে, আমি একজনের কথা জানি, যে এ বিষয়ে খবর দিতে পারে।

মারিয়া রাস্তার উল্টোদিকে তাকাল। লেখা আছে– জ্যোতিষী মাদাম লুসিয়া।

মেয়েরা হো-হো করে হেসে উঠেছে।

ক্যাপটেন বেলানি বললেন- ও, ঠাট্টা ইয়ারকি? ঠিক আছে পরে আবার দেখা হবে। এই আমেরিকান ভদ্রলোকের তল্লাশি করতেই হবে। সত্যি তুমি জানো না?

না, আমি কিছুই জানি না।

এক ঘণ্টা কেটে গেল। না, কোনো খবরই পাওয়া যায়নি। ছেলেরা খদ্দের ধরতে ব্যস্ত। মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

–এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তো পুলিশের টাকা দিয়েছি।

–ঠিক আছে, আমি পাঁচ বছর ধরে এই কাজ করছি।

আরও অনেক কথা হল।

শেষ অব্দি সিজার এবং কর্নেল জনসন ক্যাপটেন বেলানির অফিসে ফিরে এলেন।

 বেলানি বললেন- নাঃ, এই ব্যাবসাটা বন্ধ করা যায় না?

কখনওই সম্ভব নয়, তাহলে পর্যটকরা আসবে কেন?

কর্নেল জনসন বললেন- এত চিন্তা করে কী লাভ? মেয়েটা নিশ্চয়ই আবার ফোন করবে।

পরের দিন বিকেলবেলা, ক্যাপটেন বেলানি জানতে পারলেন মি. লরেঞ্জো নামে একটি লোক দেখা করতে এসেছে।

তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।

 লরেঞ্জোর পরনে দামী পোশাক, হাতে হিরের আংটি। লরেঞ্জো এক দালাল।

বেলানি বললেন- কী করতে পারি?

-আমি ওই ভদ্রলোককে দেখেছি। আপনারা এক বেশ্যা মেয়ের খবর চাইছেন যে, এক আমেরিকানের সাথে পালিয়ে গেছে। তাই তো? আমি সবসময় আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি। আমি তার নাম বলব?

কর্নেল জনসন বললেন– ও কে?

লরেঞ্জো বলল- তাহলে কী হবে? আমার বন্ধুদের ওপর কোনো অত্যাচার হবে না তো? তাদের ওপর আঘাত হবে না তো?

কর্নেল সিজার বললেন- আমরা কোনো মেয়েকেই আঘাত করব না। মেয়েটির নাম কী?

-বাঃ, খবরটা খুবই ভালো, আপনাদের মতো লোকেদের সাথে কথা বলতেই ভালো লাগে।

-নাম কী লরেঞ্জো?

–ওর নাম পিয়েরে, আমেরিকানটা পিয়েরের সাথে সারারাত কাটিয়েছে তার হোটেলে। আজ সকালে তারা চলে গেছে। সে আমার মেয়ে নয়, আমার মেয়ে হলে আমি কখনওই খবর দিতাম না।

বেলানি ফোনের কাছে পৌঁছে গেছেন পিয়েরের খোঁজ করো।

–ঠিক আছে, এবার আপনি আসতে পারেন।

বেলানির ডেস্কে পিয়েরের পুরো খবরটা চলে এল। পনেরো বছর বয়স থেকে সে রাস্তায় খদ্দের ধরছে। বার দশেক তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

–কোন জায়গা থেকে সে এসেছে? কর্নেল জনসন জানতে চাইলেন।

–নেপলস, মা আর ভাই আছে।

–আমরা সেখানে খবর পাঠাব?

–এখনই এটা করতে হবে।

.

৪৩.

নেপলসের প্রান্তসীমা। ছোটো ছোটো রাস্তা। প্রত্যেক জানলাতে কাপড় শুকোচ্ছে।

 পিয়েরে জানতে চাইল- তুমি কখনও নেপলসে এসেছ?

–একবার, রবার্ট বললেন, সুশান তখন পাশে বসেছিল, হাসছিল। নেপলস সম্পর্কে আমার ধারণা মোটেই ভালো নয়। আমি শুনেছিলাম, এখানে অনেক দুষ্টু ঘটনা ঘটে থাকে।

পিয়েরের কথা মতো রবার্ট গাড়িটা থামালেন।

একদল তরুণী কন্যা হৈ-হৈ করতে করতে বেরিয়ে এসেছে। তাদের সকলের চোখে পিয়েরে এখন এক জলপরি। তারা সকলেই পিয়েরের মরকত অলংকারের প্রশংসা করতে লাগল। পিয়েরের চোখ টিপে রবার্টের দিকে তাকিয়ে আছে। আহা, রবার্ট এখন বুঝি এক দেবদূত।

রবার্ট ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।

রবার্ট জানতে চাইলেন। এবার আমরা কোথায় যাব?

পিয়েরে বলল- আমার মায়ের বাড়িতে।

 ছোটো একটা ফার্মহাউস। এখান থেকে আধ ঘন্টা যেতে লাগবে।

.

নেপলসের দক্ষিণ প্রান্তসীমায় এই ফার্ম হাউসটা অবস্থিত। একটা পুরোনো পাথরের বাড়ি। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পিয়েরে বলল– এটা কি সুন্দর নয়?

-হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দর। এখানে থাকলে কেউ আমাকে ধরতে পারবে না।

তারা সামনের দরজার দিয়ে এগিয়ে গেল। পিয়েরের মা দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে হাসি। মেয়ের মতোই তার চেহারা, চেহারটা অনেক পাতলা হয়ে এসেছে। মাথায় ধূসর চুল। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

-তোমাকে কতদিন দেখিনি বলো তো?

–এই ভদ্রলোকের কথাই আমি বলছিলাম ফোনে।

–হ্যাঁ, এসো-এসো। তোমার নাম কী?

 রবার্ট বললেন– আমি জোনস।

বিরাট লিভিংরুম। ভালো এবং আরামদায়ক। পুরোনো ফার্নিচারে ভরতি।

বছর কুড়ির একটা ছেলে বেরিয়ে এসেছে। রোগা এবং পাতলা, চোখের তারায় বিস্ময়, জিনস পরেছে। জ্যাকেট পরেছে। নাম লেখা আছে। বোনকে দেখে সে আনন্দিত–পিয়েরে?

হালো কারলো?

ওরা একে অন্যকে আদর করল।

–এখানে কেন এসেছ?

 –আমরা কদিন থাকব। এ আমার ভাই কারলো। আর ইনি মি. জোনস।

–হ্যালো কারলো।

 মা বললেন তোমরা দুজন ওই সুন্দর বেডরুমে থাকবে, কেমন?

 রবার্ট বললেন– না, যদি একটা আলাদা বেডরুম থাকে, তা হলে ভালো হয়।

কিছুক্ষণের নীরবতা।

রবার্ট দাঁড়িয়ে আছেন।

 মা বললেন কেন? পিয়েরে মাথা নাড়ল। কিন্তু পিয়েরে জানে, রবার্ট সমকামী নন।

মা রবার্টের দিকে তাকালেন- তোমার যা ইচ্ছে। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। এসো, কিচেনে এসো। কফি তৈরি করা যাক।

কিচেনে গিয়ে মা জিজ্ঞাসা করলেন হারে ছেলেটাকে কোথায় পেলি? মনে হচ্ছে খুব বড়োলোক। তোকে কী সুন্দর ব্রেসলেট দিয়েছে। আঃ, আমি আজ রাতে ভালো রান্না করব। পাড়াপড়শীকে ডাকব। তারা সকলে তোর ভাবী বরের সঙ্গে দেখা করবে।

মা, ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করছ কেন?

–সে কী রে? তোর সৌভাগ্যের কথা সকলকে বলবি না?

 –মা, মি. জোনস, এখানে কদিন বিশ্রাম করবেন। পার্টি দিও না।

 মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন- যা তুই বলবি তাই হবে।

.

কারলো ব্রেসলটটা দেখল–এগুলো আসল মরকত? তুমি আমার বোনের জন্য কিনেছ?

রবার্ট বললেন- হা, জিজ্ঞাসা করো।

 পিয়েরে এবং মা কিচেন থেকে বেরিয়ে গেছে। মা রবার্টের দিকে তাকালেন সত্যি তুমি পিয়েরের সাথে শোবে না?

পিয়েরের মুখে লজ্জা– না, পিয়েরে বলল– চলো, তোমার বেডরুমটা দেখিয়ে দিই।

তারা বাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। মস্ত বড়ো একটা বেডরুম। দুটো খাট আছে।

রবার্ট, তুমি কেন চিন্তা করছ? আমরা একসঙ্গে শুতে পারি। আমি মাকে সব কথা বলেছি।

না, এখন এভাবে করা উচিত হবে না।

পিয়েরের কণ্ঠস্বরে শীতলতা- ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে।

 দু-দুবার এই ঘটনা ঘটল- কেন বোঝা যাচ্ছে না। এমন এক মানুষকে আমি পুলিশের হাতে তুলে দেব? অনুশোচনা। পঞ্চাশ হাজার ডলার। টাকার অঙ্কটা খুব একটা কম নয়।

ডিনারের আসর। মা বড্ড বেশি কথা বলছেন। পিয়েরে, রবার্ট এবং কারলো শান্ত শ্রোতা।

রবার্ট ভাবছেন, কী করে এখান থেকে পালাবেন। আজ রাতে ওকে চলে যেতে হবে। একটা জাহাজ খুঁজতে হবে।

পিয়েরে ভাবছে, কখন ইন্টারপোলের লোকেরা আসবে। আবার তাদের ফোন করতে হবে। শহরে গিয়ে ফোন করব। পুলিশ তাহলে জায়গাটা খুঁজে পাবে না।

কারলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এই অতিথির দিকে।

ডিনার শেষ হয়ে গেল। মা এবং মেয়ে কিচেনে চলে গেল। রবার্ট কারলোর সঙ্গে গল্প করছে।

কারলো বলল- তুমি ছাড়া আর কাউকে আমার বোন কিন্তু বাড়িতে আনেনি। ও নিশ্চয়ই তোমাকে খুব ভালোবাসে।

–আমিও ওকে ভালোবাসি।

–তুমি কি ওর দায়িত্ব নেবে?

–তোমার বোন নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারে।

কারলো হাসল, হ্যাঁ, আমি জানি।

এই মানুষটা নিশ্চয়ই খুব বড়োলোক। ও একটা হোটেলে থাকতে পারত। কেন এখানে এসেছে? মানুষটা বোধহয় লুকিয়ে থাকতে চাইছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। একটা ধনী মানুষ লুকোতে চাইছে কেন? তার মানে? নিশ্চয়ই টাকার আদান-প্রদান আছে।

কারলো জানতে চাইল- তুমি কোথা থেকে আসছ?

–সেভাবে বলতে পারব না। আমি নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই।

কারলো এবার তার পরিকল্পনা ঠিক করছে। পিয়েরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বুঝতে পারা যাচ্ছে, এই লোকটাকে ধরতে পারলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আমি আর পিয়েরে সেই টাকাটা ভাগ করব।

কারলো জানতে চাইল তুমি কী করো?

এখন আমি ব্যবসা থেকে ছুটি নিয়েছি।

 এই লোকটার পেট থেকে কথা বার করা সহজ নয়– কারলো ভাবল। লুক্কার সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়?

-তুমি এখানে কতদিন থাকবে?

–এখনই ঠিক বলতে পারছি না। ছেলেটির কৌতূহল রবার্টকে অবাক করেছে।

 পিয়েরে এবং তার মা কিচেন থেকে বেরিয়ে এল। মা জানতে চাইলেন- কফি খাবে?

না, মাসিমা, ডিনারটা সাংঘাতিক।

 মার মুখে হাসি। এটা তো কিছুই নয়। আমি কাল সকালে তোমার জন্য নিজের হাতে রান্না করব। ঠিক আছে?

রবার্ট ভাবলেন, তারই মধ্যে তিনি চলে যাবেন।

–ঠিক আছে, এবার খুব ক্লান্তি লাগছে। আমি শুতে যাব কি?

মা বললেন– শুভ রাত্রি।

 রবার্ট ধীরে ধীরে বেডরুমে পৌঁছে গেলেন।

 কারলো হাসল। সে বলল- হারে, তোর সঙ্গে লোকটা শুতে চাইল না কেন বল তো?

 কথাটা শুনে পিয়েরে অবাক হয়ে গেছে। পিয়েরে বুঝতে পেরেছে, কারলো এখন অনেক অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। রবার্ট কিন্তু সমকামী নয়, তাহলে সুশানকে এতখানি ভালোবাসতে পারত না।

রবার্ট বিছানাতে শুয়ে আছেন, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করছেন। না, এখানে আর থাকাটা উচিত হবে না। কীভাবে এই জাল কেটে বেরিয়ে আসবেন।

বেডরুমের দরজায় শব্দ হয়েছে।

–কে? এগিয়ে আসছে। সুন্দর প্রসাধনের গন্ধ। পিয়েরে, তুমি কেন এসেছ?

 পিয়েরে সম্পূর্ণ নগ্ন– আমার ভীষণ ভয় করছে। পিয়েরে কাছে সরে এল।

–পিয়েরে, আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না।

পিয়েরে অবাক কেন বলো তো?

–আমি এক ভবঘুরে। জানি না আমার জীবনটা কী হবে।

 রবার্টের কণ্ঠে হতাশা।

রবার্ট, আমার শরীরটা ভালো নয়?

–হ্যাঁ, অবশ্যই।

 পিয়েরে এগিয়ে এসে তার নগ্ন শরীরটা রবার্টের বুকের সাথে ঠেলে দিল। রবার্টের শরীরের এখানে সেখানে সে ধাক্কা দিতে থাকল। কখনও তার বুক, কখনও তার পুংদণ্ড।

রবার্ট এই খেলাটা বন্ধ করতে বললেন। তিনি বললেন– পিয়েরে আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারছি না। অনেক দিন ধরে আমি কোনো মহিলার সংসর্গে আসিনি।

-রবার্ট, তোমায় কিছু করতে হবে না, আমি শুধু খেলা করব। তুমি কি আমার সাথে অসভ্য খেলা খেলবে না?

সুশানের কথা মনে পড়ে গেল। সুশান আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমার পৌরুষের শেষ অহংকার।

পিয়েরে বলল- তুমি উল্টে শোও।

–পিয়েরে, এতে কোনো লাভ নেই।

পিয়েরে তার শরীরটা রবার্টের বুকের ওপর ঠেলে দিল। রবার্ট বুঝতে পারলেন, পিয়েরের মুখ এখন তার সর্বত্র খেলা করছে। ক্রমশ নীচে নেমে আসছে। আঃ, তার শরীরের সবখানে পিয়েরের আঙুলের কারুকাজ।

–পিয়েরে?

স-স-স?

রবার্ট বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা এখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। জিভটা ক্রমশ নীচে নামছে।

আঃ, জিভটা বড্ড ঠাণ্ডা এবং নরম। তিনি বুঝতে পারলেন, দুটি স্তন তার শরীরের সঙ্গে লেপটে রয়েছে। হৃৎস্পনের গতি দ্রুত হচ্ছে। ওঃ, আমি এখন কী করব? সেটা শক্ত হয়ে উঠেছে।

শেষ অব্দি রবার্ট ঘুরে দাঁড়ালেন। পিয়েরেকে বুকের ওপর নিলেন।

পিয়েরে বলল- হায় ঈশ্বর, তোমারটা মস্ত বড়ো। তুমি কি ওটা ঢোকাবে না?

রবার্ট শেষ পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিলেন। একবার নয়, দুবার নয়, অনেকবার। পিয়েরে বন্য ভালোবাসার সন্ধানী। তাদের দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত খেলা শুরু হয়ে গেল। সেই রাতে তারা তিনবার মিলিত হয়েছিল। তারপর তারা ঘুমিয়ে পড়ল।

.

অষ্টাদশ দিবস, নেপলস, ইতালি।

সকাল হয়েছে। সূর্যের বিবর্ণ আলো জানলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। রবার্টের ঘুম ভেঙেছে। তখনও পিয়েরে তার সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ।

রবার্ট বললেন– তোমাকে ধন্যবাদ।

পিয়েরের চোখে দুষ্ট হাসি কেমন লাগল?

–অসাধারণ।

পিয়েরে আবার হাসছে- তুমি একটা বুনো জন্তু।

রবার্ট বললেন- তুমি আমার উন্মাদনা সামাল দিতে পারবে।

 পিয়েরে এবার জানতে চাইল- সত্যি সত্যি তুমি ড্রাগ স্মাগলার?

না।

ইন্টারপোল তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাই না?

–হ্যাঁ।

 –আমি জানি, তুমি একজন স্পাই, তাই না?

 পিয়েরের মুখে শিশুর সারল্য। রবার্টের মুখে হাসি হয়তো তাই হবে।

 পিয়েরে বলল- সত্যিটা স্বীকার করো না বাবা। তুমি একজন স্পাই?

–হ্যাঁ, তুমি যখন বলছ।

 –আমায় কতগুলো গল্প শোনাবে।

কী ধরনের গল্প?

–আমি বইতে পড়েছি, এগুলো বানানো গল্প। আমি এই প্রথম চোখের সামনে একটা জীবন্ত স্পাইকে দেখতে পেলাম।

–ঠিক আছে, তোমাকে শোনাব।

 রবার্ট ভাবলেন, কোন্ গল্প বলবেন? সত্যি গল্পটা কেউ কি শুনতে চাইবে?

রবার্ট দুটো একটা গল্প বললেন। পিয়েরে অবাক হয়ে গেছে। ভাবতে পারা যাচ্ছে না, কীভাবে খবর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো হয়।

শেষ পর্যন্ত রবার্ট বললেন– আর নয়, বেশি শুনলে তোমার মাথা ঝিমঝিম করবে।

 পিয়েরে এগিয়ে এল। বলল- তোমাকে আরও অনেক ভালোবাসা দেব। বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?

পিয়েরে আবার বলল- তুমি কি এখন চান করবে?

-হ্যাঁ, চান করতে পারলে ভালোই হত।

 গরম জল। তারা একে অন্যকে আদর করছে। দুজনে এক সঙ্গে স্নান করছে।

সেই শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে তারা ভালোবাসা বিনিময় করল।

রবার্ট পোশাক পরে নিল। পিয়েরেও পোশাক পরে বলল ব্রেকফাস্টের পর আবার আমরা গল্প করতে বসব।

.

কারলো ডাইনিং রুমে অপেক্ষা করছে। সে বলল- দিদি, তোর বন্ধু সম্পর্কে সবকিছু গুছিয়ে বল দেখি।

কী জানতে চাইছিস?

 –কোথায় তোদের দেখা হয়েছে?

–রোমে।

–লোকটা খুব বড়োলোক। তা না হলে তোকে এত দামী গয়না দেবে কেন?

কাঁধে ঝাঁকুনি ও আমাকে ভালোবাসে।

–মনে হচ্ছে, তোর বন্ধুটা কোনো ব্যাপারে ভয় পেয়েছে। ঠিক জায়গায় খবরটা পৌঁছে দেব? তা হলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে।

পিয়েরে রেগে গিয়ে বলল– কারলো, তুই এ ব্যাপারে নাক গলাতে আসিস না।

-তা হলে আমার ধারণা ঠিক, তাই তো? লোকটা ভয়ে পালিয়ে এসেছে, তাই না?

–শোন কারলো, আমি শেষবারের মতো তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, নিজের চরকায় তেল দে।

পিয়েরে তার প্রাপ্য টাকাটা অন্য কারও সাথে ভাগ করতে চাইছে না।

কারলো বলল– তাহলে ছোট্ট বোন আমার, সব টাকা তুই একাই মেরে দিবি?

কারলো, তুই কেন কথা বলছিস? পিয়েরে আরও বলল, তোকে আমি সত্যিটা বলব, মি. জোনস তার বউয়ের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে। বউটা এক গোয়েন্দাকে ভাড়া করেছে। এর মধ্যে আর কিছু নেই।

কারলো হাসছে ব্যাপারটা আমাকে আগে বলিসনি কেন? অনেক টাকার কারবার? তাই তো?

কারলো ভাবছে, সত্যিটা বার কাতেই হবে।

.

জানুস টেলিফোনে আর কোনো খবর আছে?

–আমরা শুনেছি কমান্ডার বেলামি এখন নেপলসে আছেন।

–আর কোনো সংবাদ?

-হ্যাঁ, আমরা চেষ্টা করছি। উনি একজন বেশ্যার সাথে ঘুরছিলেন। নেপলসে ওই মেয়েটার বাড়ি। আমরা যে করেই হোক সেখানে পৌঁছে যাব।

–আমাকে সর্বশেষ সংবাদ জানাবেন।

.

নেপলস, মিউনিসিপ্যাল হাউসিং, পিয়েরের মায়ের সম্পর্কে খবর নেওয়া হচ্ছে।

সিকিউরিটি এজেন্টরা পৌঁছে গেছে। নেপলসের পুলিশ ফোর্সকে জানানো হয়েছে।

কারলো তার নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। পিয়েরে আবার ইন্টারপোলকে ফোন করবে।

.

৪৪.

বাতাসের মধ্যে বিপদের গন্ধ। রবার্ট বুঝতে পারছেন। জলের ধারে জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে পালানো যাবে কি? চারপাশে পুলিশের গাড়ি। ইউনিফর্ম পরা পুলিশরা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। তার মানে? পুলিশের কাছে খবর কী করে পৌঁছোল? আমি যে এখন নেপলস-এ আছি, এটা তো কেউ জানে না। একমাত্র কে জানে? বিদ্যুৎ চমকে মতো রবার্টের মনে হল, তা হলে? পিয়েরে কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?

সুশানের কথা মনে পড়ল। সুশান বলেছিল, ওরা এখন জিব্রাল্টারের কাছাকাছি আছে। আমাকে তুলে নেবার কথাও বলেছে।

সুশানকে এই ঝামেলায় জড়িয়ে কী লাভ? কিন্তু এখন আর বিকল্প কী আছে? একটা ব্যক্তিগত প্রমোদ তরণীতে লুকিয়ে থাকা যাবে। একটা ফোন করলে কেমন হয়।

রবার্ট একটা ছোটো কাফের সামনে গাড়িটা দাঁড় করালেন। ভেতরে চলে গেলেন। পাঁচ মিনিট বাদে ওই প্রমোদ তরণীর সঙ্গে কথা হল।

–মিসেস বাঙ্কস আছেন কি?

–কে কথা বলছেন জানতে পারি কি?

বলুন আমি একজন বন্ধু।

এক মুহূর্তবাদে সুশানের কণ্ঠস্বর- রবার্ট? তুমি কেমন আছো?

–আমি ভালো নেই।

–তুমি সাবধানে আছে তো?

সুশান, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?

কখন?

–আজ রাতে নেপলসে আসতে পারবে?

একটুখানি ধরো, আমি কথা বলছি।

 রবার্ট রিসিভারটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।

সুশান বললেন- মন্টে বলছে ইনজিনে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দুদিন লাগবে নেপলস-এ পৌঁছোতে।

সমস্যা বেড়ে যাবে। তবুও রবার্ট বললেন- ঠিক আছে, তা হলেও চলবে।

কীভাবে তোমায় যোগাযোগ করব?

–আমি জানিয়ে দেব।

রবার্ট, নিজের দেখাশোনা করো।

 –চেষ্টা করছি।

–তোমাকে ওরা ধরতে পারবে না তো?

না, এ বিষয়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

সুশান রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। তিনি তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন হা, অবশেষে ও আসছে।

.

এক ঘণ্টা কেটে গেছে। রোম শহর। ফ্রানসেসকো সিজার একটা টেলিগ্রাম কর্নেল জনসনের হাতে তুলে দিলেন। এটা এসেছে একটা প্রমোদ তরণী থেকে। লেখা আছে– বেলামি এখানে আসছেন, আমরা আবার জানাব।

তলায় কোনো সই নেই।

সিজার বললেন- বেলামি ওখানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে ফেলতে হবে।

.

৪৫.

 কারলো ভ্যালি নানা বিষয়ে চিন্তা করেছে। কীভাবে আসল খবরটা পাওয়া যাবে। মি. জোনসকে কখনোই ছাড়া হবে না। অনেক টাকার কারবার। শেষ পর্যন্ত সে মারিও লুক্কার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। রাস্তার মস্তান।

সকালবেলা, কারলো তার মোটর স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অতি দ্রুত ছুটে গেল। লুক্কার কাছে পৌঁছে গেল।

–কে? কারলো?

লুক্কা, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

–ভেতরে এসো।

 মারিও লুক্কা নগ্ন হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার বিছানার কাছে একটা মেয়েকে দেখা গেল।

-কী হয়েছে? এত সকালে কেন?

–মারিও, আমি ঘুমোতে পারছি না, উত্তেজনায় ছটফট করছি। বিরাট একটা মুরগি পাকড়েছি।

-সত্যি বন্ধু, ভেতরে এসো।

 কারলো ওই ছোট্ট ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল।

–গতরাতে আমার বোন একটা শাঁসালো মক্কেল পাকড়েছে।

–কে? পিয়েরে? ওই বেশ্যাটা?

–হ্যাঁ, কিন্তু এই লোকটা সত্যিই বড়োলোক। সে লুকিয়ে আছে।

–কেন?

–আমি জানি না, ব্যাপারটা বের করতে হবে। মনে হচ্ছে, ভালো দাঁও মারা যাবে।

–বোনকে জিজ্ঞাসা করলে না কেন?

-না, পিয়েরে সব ব্যাপারটা নিজের মধ্যে রাখতে চাইছে। ওই লোকটা আমার বোনকে দামী ব্রেসলেট দিয়েছে।

কত দাম হবে?

জানি না। ওটা বেচতে হবে।

 লুক্কা দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর বলল– কারলো, লোকটার সাথে কথা বললে কী হয়? তাকে ক্লাবে নিয়ে আসতে পারবে না?

ক্লাব মানে একটা ফাঁকা ওয়্যার হাউস। সেখানে এমন একটা ঘর অছে, যেখান থেকে শব্দ বাইরে বেরোয় না।

কারলো হাসল, আমি আনতে পারব।

লুক্কা বলল- ঠিক আছে, আমরা অপেক্ষা করছি। লোকটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মনে হয়, তার গলাটা ভালোই হবে। কারণ সে তো এবার আমাদের জন্য গান গাইবে।

.

কারলো বাড়িতে ফিরে এসেছে। মি. জোনস নেই। কারলোর মনে হয়।

সে পিয়েরেকে প্রশ্ন করল- বন্ধু কোথায় গেল।

–সে শহরে চলে গেছে, এক্ষুনি চলে আসবে। কেন?

না, এমনি আর কী। কারলো অপেক্ষা করছে। মা আর বোন কিচেনে রান্না করছে। লাঞ্চের প্রস্তুতি। সে পিয়েরের ঘরে ঢুকে পড়ল। দেখল, ব্রেসটেলটা একটা পোশাকের তলায় লুকোনো আছে। সে চট করে ব্রেসলেট পকেটে পুরে নিল। মায়ের কাছে ফিরে এল।

কারলো, লাঞ্চ খাবি না?

না, মা, আমি একটু পরে আসব।

 আবার সে তার ভেসপোতে চড়ে বসল। এবার এটা বেচতে হবে। কিন্তু এটা কি নকল? মোটর বাইকটা একটা জুয়েলারি দোকানের সামনে রাখল। মালিক, গামবিনো, বুড়ো মানুষ, কালো পরচুল মাথায়। বাধানো দাঁত। উনি কারলোর দিকে তাকালেন।

কারলো, এত সকাল-সকাল? আজ আমার জন্য কী এনেছ?

কারলো ওই ব্রৈসলেটটা কাউন্টারের কাঁচের ওপর রাখল। গামবিনো দেখলেন, আবাক হয়ে গেলেন কোথায় পেলে?

–আমার এক কাকিমা মারা গেছে। এটা আমাকে দিয়ে গেছে। কত দাম?

–অনেক হবে।

বাজে কথা বলার চেষ্টা করো না।

–আমি কি কখনও তোমায় ঠকিয়েছি।

সব সময় তুমি আমাকে ঠকাও।

–তোমরা, ওই ছেলেছোকরার দল, বড্ড ঝামেলা করো। কারলো, আমি জানি না, এটা অত্যন্ত দামী।

কারলোর মস্তিষ্ক আনন্দে ভরপুর। হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে সত্যি?

-হ্যাঁ, আমি আজ রাতে তোমাকে জানাব।

–ঠিক আছে। কারলো বলল। সে ব্রেসলেটটা নিয়ে নিল। এটা আমার কাছেই থাকবে। কারলো দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। ঠিক আছে, লোকটার হাতে অনেক পয়সা আছে।

গামবিনো কারলোকে যেতে দেখল। সে ভাবল, এ মালটা এল কোথা থেকে। সে একটা সারকুলার হাতে নিল। এই সারকুলারটা সব দোকানে পাঠানো হয়েছে। যে ব্রেসলেটটা আছে তার বর্ণনা দেওয়া আছে। হ্যাঁ, কোথায় ফোন করা হবে? বলা আছে, এই ব্রেসলেট দেখলে সঙ্গে সঙ্গে যেন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হয়।

অন্য সময় হলে গামবিনো ওই সারকুলারটা দেখতেই পেত না। কিন্তু এখন সে ওটা দেখতে পেয়েছে। কিন্তু ফোন করাটা কি ঠিক হবে? তা হলে? দাঁওটা নষ্ট হয়ে যাবে। না, লাভ নেই। শেষ পর্যন্ত সে টেলিফোনটা তুলে নিল। সারকুলারে যে নাম্বারটা দেওয়াছিল সেখানে ফোন করল।

.

৪৬.

ভয়ের মুহূর্ত। অন্ধকারের আবরণ। রবার্টকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। একটা জঙ্গলে। তাকে থাকতে হয়েছিল। অক্টোবর মাস, আকাশ জোড়া বৃষ্টি। জঙ্গলের ভেতর প্রাণ সংশয়। রবার্ট জানতেন না, শেষ পর্যন্ত ওই অন্ধকার থেকে আবার আলোর জগতে আসতে পারবেন কিনা।

শহরের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন। শেষ পর্যন্ত দেখলেন, পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।

কী হয়েছে? বুঝতে পারছেন না। চারপাশে এত মানুষজন কেন?

একটা বুদ্ধি তার মাথায় এল। যে সমস্ত জাহাজগুলো ইতালি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না, সেখানে লুকিয়ে থাকলে কেমন হয়? রবার্ট আবার বন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

.

জুয়েলারি দোকানের ছোট্ট ঘণ্টাটা বেজে উঠেছে। কালো পোশাক পরা দুজন মানুষ প্রবেশ করেছে। না, এরা কিন্তু খদ্দের নয়।

বলুন কী করব?

–মি. গামবিনো?

 ফোকলা দাঁতে নকল হাসি-হা, একটা মরকত ব্রেসলেটের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।

পুলিশ এসে গেছে তা হলে?

–ঠিক আছে, আমার এটা কর্তব্য, তাই আমি জানিয়েছি।

–কে নিয়ে এসেছে?

কারলো নামের একটা ছোটো ছেলে।

–ও কি ব্রেসলটটা রেখে গেছে?

–না, ও নিয়ে গেছে।

কারলোর পুরো নাম কী?

 গামবিনোর চোখে অসহায়তা জানি না। রাস্তার ছেলে। লুক্কা নামে এক মস্তান দলটা চালায়।

লুক্কাকে কোথায় পাওয়া যাবে?

 লুক্কার জায়গাটা বলা উচিত হবে কি? বলে দিলে হয়তো জীবন সংশয়। না বললেও সমস্যা। শেষ পর্যন্ত আমতা আমতা করে গামবিনো বলল- সে পিজার পাশে থাকে।

ধন্যবাদ, গামবিনো। আপনাকে আমরা মনে রাখব।

লোক দুজন চলে গেল।

.

লুক্কা তার মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে খুনসুটি করছিল। দুজন লোক তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়েছে।

লুক্কা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল- তোমরা কে? অসময়ে বিরক্ত করছ কেন?

একজন তার পরিচয় পত্রটা দেখাল। পুলিশের লোক। লুক্কা ভয় পেয়ে গেছে।

-না, আমি একজন ভালো নাগরিক। আমি তো খারাপ কাজ করিনি।

-লুক্কা সে খবরটা আমাদের জানা আছে। আমরা কারলো নামে একটা ছেলের সন্ধান করছি।

কারলো? তাহলে; ওই ব্রেসলেট নিয়ে ঝঞ্ঝাট। কারলো কীভাবে এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল? পুলিশ নিশ্চয়ই চোরাই মালের জন্য এত ব্যস্ত হবে না।

-ঠিক করে বলো, ও কোথায় থাকে?

কারলো, মানে কোন কারেলো? কারলো ভ্যালি?

 হ্যাঁ, তার সঙ্গে এখনই কথা বলতে হবে।

কিন্তু এখানকার সকলে রক্ত দিয়ে শপথ নেয়। একে অন্যের জন্য জীবন দেবে। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। এই ভাবেই দলটা এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা একসঙ্গে সব কাজ করে।

–ডাউন টাউন যেতে হবে।

–কেন?

 লুক্কা হাসতে হাসতে বলল- এই হল কারলোর ঠিকানা।

.

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। পিয়েরে দরজাটা খুলে দিল। দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

সিরিয়া ভ্যালি?

–হ্যাঁ।

–আমরা কি ভেতরে আসব?

 –আপনারা কে?

একজন ওয়ালেট খুলল। তার পরিচয় পত্রটা লেখা আছে।

আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব?

বলুন। আমার লুকোবার কিছু নেই। পিয়েরে ভাবল, রবার্ট বেরিয়ে গেছে। আমি এখন দর কষাকষি করতে পারব।

–আপনি রোম থেকে গতকাল রাতে এসেছেন? তাই তো?

–হ্যাঁ, এটা কি আইন বিরুদ্ধ কাজ?

 লোকটার মুখে হাসি। আপনার সাথে এক মানুষ ছিল?

-হ্যাঁ।

–সে কে?

রাস্তায় তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। সে নেপলস পর্যন্ত আসতে চেয়েছিল। দ্বি

তীয় মানুষটি প্রশ্ন করল- সে কি এখানে আছে?

–আমি জানি না। আমি তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছি। সে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে।

–এই লোকটার নাম কি রবার্ট বেলামি?

–বেলামি? আমি জানি না। ও আমাকে নাম দেয়নি।

 –ঠিক আছে। আমরা আবার দেখছি। লোকটি আপনাকে তলডিয়েতে তুলেছিল। আপনারা সারারাত একটা হোটেলে ছিলেন। পরের দিন সকালে ও আপনাকে একটা দামী ব্রেসলেট কিনে দিয়েছিল। ও আপনাকে একটা হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এয়ারলাইনস এবং প্লেনের টিকিট ছিল। আপনি একটা গাড়ি ভাড়া করেছিলেন। নেপলসে এসেছেন।

পিয়েরে অবাক হয়ে গেছে। তার চোখে এবার ভয়ের আবরণ। তার মানে এই লোক দুটো সব জানে।

লোকটা কি চলে গেছে? নাকি ফিরে আসবে?

পিয়েরে এবার ভাবছে, কী বলা যেতে পারে? যদি সে বলে, রবার্ট চলে গেছে, তাহলে এরা বিশ্বাস করবে না। ওরা এখানে বসে থাকবে। রবার্ট ফিরে এলে তাকে ধরে ফেলবে। বলবে, তুমি কেন এই লোকটাকে সাহায্য করেছ।

শেষ পর্যন্ত পিয়েরে বলল- হ্যাঁ, ও ফিরে আসবে।

-কখন?

–আমি ঠিক জানি না।

–আচ্ছা, আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা কি চারপাশটা একটু ঘুরে দেখব?

তারা এবার বন্দুক বের করল। না, বন্দুকটা দেখা যাচ্ছে।

 তারা বাড়ির চারদিকে গেল মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কে রে?

মি. জোনস-এর বন্ধু। তারা জোনসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

 মা বললেন– এত সুন্দর মানুষ। ওরাও কি আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খাবে নাকি?

 একজন বলল হা মা, কী আছে আজকের খাবারের তালিকায়?

.

পিয়েরের মনে নানা প্রশ্ন– আমি কি ইন্টারপোলকে আবার ডাকব? ইন্টারপোল পঞ্চাশ হাজার ডলার দেবে। রবার্টকে এই বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সকালের কথাবার্তা। দুজন মানুষকে ডাইনিং রুমে বসানো হয়েছে। তারা খাবার খাচ্ছে।

পিয়েরে বলল- এখানে বড্ড গরম। সে লিভিং রুমের দিকে হেঁটে গেল। সকালবেলা কথায় কথায় রবার্টের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছিল।

রবার্ট বলেছিল– বিপদের সম্ভাবনা থাকলে যেন জানলাটা আধখোলা করে রাখা হয়।

পিয়েরে তাই করল। তারপর টেবিলের দিকে এল। না, সে জানে না, রবার্ট কি ওই সংকেতটা মনে রাখবে?

রবার্ট বাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছেন। এবার পালাতে হবে। অন্য একটা পরিকল্পনা। শেষ পর্যন্ত সফল হবে তো?

রবার্ট দেখতে পেলেন, সবকিছু সাধারণ মনে হচ্ছে। পিয়েরে কি এখন বাড়িতে আছে? ঝড়ির সামনে এসে হঠাৎ রবার্টের মনে হল, হা, ওই তো জানলাটা আর্ধেক খোলা। তার মানে? একটা বিপদের সম্ভাবনা। সঙ্কেত চিহ্ন কি?

তার মানে এখানে আর থাকা উচিত নয়।

রবার্ট আবার গাড়িটা চালিয়ে দিলেন। কোনো সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।

তারা ডাইনিং রুমে বসে আছে।

 টেলিফোনটা বেজে উঠল।

–বেলামি কি ফোন করতে পারেন?

 পিয়েরে বলল- হ্যাঁ, করতে পারেন? কিন্তু কেন?

রবার্ট টেলিফোনের দিকে চলে গেলেন। বললেন– হ্যালো পিয়েরে? আমি দেখলাম জানলাটা আধখোলা আছে।

এখন পিয়েরে কী করে কথা বলবে? রবার্টের কথা তার মনে পড়ে গেল পুলিশ আমাকে পেলে মেরে ফেলবে।

দুজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা সব কথা বোধহয় শুনতে পাচ্ছে। আহা, পঞ্চাশ হাজার ডলার, কত ভালো জামাকাপড় আমি কিনতে পারব। রোম শহরে একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট। রবার্ট মরে যাবে তাতে কী হয়েছে? পুলিশকে সে ঘেন্না করে। পিয়েরে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখল। বলল- রং নাম্বার।

রবার্ট শব্দটা শুনতে পেলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝতে পারলেন, হয়তো এভাবেই পিয়েরে আমার জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে।

রবার্ট আবার গাড়িতে চড়ে বসলেন। বাড়িটার থেকে আরও দূরে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায়? প্রধান বন্দরে যাওয়া উচিত হবে না। তিনি অন্য দিকে চলে গেলেন। সানটা লুসিয়া থেকে আরও দূরে। এখানে একটা কিয়সকে লেখা আছে- কিছুটা সময় এখানে কাটানো যাবে।

জিজ্ঞাসা করলেন পরবর্তী জাহাজটা কখন ছাড়বে? যেটা ইসূচিয়া যাবে?

–তিরিশ মিনিট।

ক্যাপ্রির জাহাজটা?

–পাঁচ মিনিট।

আমাকে একটা টিকিট দেবেন? আপনারা কেন অন্যদের মতো ইংরাজি বলেন না?

 এই লোকটার চোখে কেমন একটা ভাব।

 রবার্ট টিকিট নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ক্যাপ্রিতে পৌঁছে যাবেন।

নৌকোটা এবার যাত্রা শুরু করবে। জলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাবে। কেউ রবার্টের দিকে তাকিয়ে দেখছে না। কিন্তু ব্যাপারটা পাল্টে ফেলতে হবে। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সকলে রবার্টকে চিনে রাখতে পারে।

রবার্ট বারটেনডারের সাথে অযথা ঝগড়া শুরু করে দিলেন। ওদের মান খুব খারাপ এই বলে গালাগাল দিলেন।

বিশ্রী শব্দ উচ্চারণ করতে থাকলেন। ম্যানেজার ছুটে এসে বললেন-কী করছেন?

এখানে অনেক মহিলা যাত্রী আছেন, তাদের কথা ভেবে অন্তত চুপ করে থাকুন।

রবার্ট আরও চিৎকার করে বললেন– আপনি কার সাথে কথা বলছেন জানেন? আমি কমান্ডার রবার্ট বেলামি।

নৌকোটা ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেছে। রবার্ট তড়াক করে নৌকো থেকে নামলেন। এবার হোটেলের দিকে হেঁটে চললেন। এখানে অনেক স্মৃতি ছড়ানো আছে। একদা সুশানের সঙ্গে এখানে এসেছিলেন। রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলেন। পথে হেঁটেছিলেন- সে সব স্মৃতি কি ভোলা যায়?

স্যাঁতসেঁতে একটা হোটেল। রিসেপশনিস্ট প্রথমে কিছুতেই ঘর দেবে না।

রবার্ট ঘুষি মেরে বললেন আমি কমান্ডার রবার্ট বেলামি। একটা ঘর আমাকে দিতেই হবে।

–ঠিক আছে, আপনি কতদিন থাকবেন কমান্ডার?

–এক সপ্তাহ।

–আপনার পাশপোর্ট কোথায়?

 –পাশপোর্ট আমার লাগেজে আছে। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে আসছি।

রবার্ট বাইরে বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় চলে গেলেন। হা, উদ্দেশ্যটা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে হয়তো।

রবার্ট আবার একটা বারে এসে বসলেন। নিখুঁত ইতালিয় ভাষায় কথা বলছেন। রবার্ট জানেন, এবার ওদের অনুসন্ধান শুরু হবে। মদ খেতে খেতে তিনি ইউরোপের মানচিত্রটা মনে মনে ভেবে নিলেন। কোথায় যাওয়া যায়? ইংল্যান্ডে গেলে কেমন হয়? সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? না, ফ্রান্সে ফিরে আর লাভ নেই। রবার্ট ভাবলেন। ইতালি থেকে কীভাবে– বেরিয়ে পড়ব?

আবার সুশানের কথা মনে পড়ল। তিনি বারের মালিকের সাথে কথা বললেন। তার ফোনটা ব্যবহার করলেন। দশমিনিট সময় লাগল। সুশানকে পাওয়া গেল।

–তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ব্যাপারটা খুবই ভালো লাগবে। ইনজিনটা তৈরি হয়েছে। আমরা নেপলসে পৌঁছে যাব সকালবেলা। কোথায় তোমাকে পাব?

-না, ওই প্রমোদ তরণী এখানে এলে বিপদের আশঙ্কা। রবার্ট বললেন, প্যালিংজুম জায়গাটা মনে আছে, যেখানে আমরা হনিমুন কাটাতে গিয়েছিলাম।

কী বললে?

–আমি ভুল করে বলে ফেলেছি।

অন্যদিক থেকে আবার শোনো গেল- হ্যাঁ, মনে পড়েছে।

তোমার জাহাজটা কি ওখানে আসবে?

 একটুখানি ধরো আমি বলছি।

 রবার্ট অপেক্ষা করলেন, সুশান টেলিফোনে ফিরে এলেন। তিনি বললেন–হ্যাঁ, ওখানে আমরা পৌঁছে যাব।

রবার্ট বললেন– ঠিক আছে।

 মনে পড়ে গেল, ওই নিষ্পাপ মানুষদের মুখগুলির কথা। আঃ, এত বড়ো সমস্যায় আমাকে জড়িয়ে পড়তে হল।

সুশান মন্টে বাঙ্কসের দিকে তাকিয়ে বললেন- অবশেষে রবার্ট আসছে।

.

রোম শহর, পুলিশের হেডকোয়ার্টার। অনেকগুলো সংকেত ভেসে আসছে। চারজন মানুষ বসে কথা বলছেন।

রেডিও অপারেটর বললেন- আমরা সব কটা কণ্ঠস্বর রেকর্ড করেছি। আবার বাজিয়ে শোনাব?

কর্নেল সিজার তাকিয়ে আছেন ফ্রাঙ্ক জনসনের দিকে।

হ্যাঁ, আমি সেই অংশটা আবার শুনব, যেখানে দেখা করার কথা বলা আছে। মনে হচ্ছে, রবার্ট বোধহয় প্যালিংজুমের কথা বলেছে। এই জায়গাটা কি ইতালিতে?

কর্নেল সিজার মাথা নাড়লেন না, আমি কখনও ওই নামটাই শুনিনি। দেখতে হবে। ম্যাপের দিকে তাকাতে হবে।

.

নেপলসের ফার্ম হাউস, ফোনটা বেজে চলেছে। পিয়েরে উঠে গেল। একজন লোক বলল- এটাকে ধরতে হবে। সে ফোনের কাছে গিয়ে বলল- হ্যালো।

কণ্ঠস্বরটা শোনার চেষ্টা করল। তারপর তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল- বেলামি ক্যাপ্রির দিকে চলে গেছে। চলো, আমরা ক্যাপ্লিতে যাই।

পিয়েরে দেখল, দুজন অত্যন্ত দ্রুত দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিয়েরে ভাবল, না, ভগবান আমাকে কখনও এত টাকা দেবে না। আঃ, লোকটা বোধহয় পালিয়ে গেল।

ইস্টিয়া এসে গেছে, রবার্ট মানুষের মধ্যে মিশে গেলেন। কারও সাথে যোগাযোগ করা উচিত নয়। তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। এবার আসল জায়গা। রবার্ট টিকিট বুথের কাছে। চলে গেলেন। বুথের গায়ে একটা কথা লেখা আছে।

রবার্ট বললেন আমি সারা দিন ঘুরে বেড়াব, টিকিট লাগবে।

এটা হল মেন লাইন। এবার?

 কোথায় যাব আমি? ভাগ্যের সহায়তা পাব কি?

.

রাস্তাঘাটে অনেক মানুষের ভিড়। চাষীরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। দুপাশে গোরুর মাংসের দোকান। রবার্ট একটা মোটা মানুষের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন– আমাকে ক্ষমা করবেন মঁসিয়ে। ফরাসি উচ্চারণে কথা বলছেন। আমি একটা জায়গায় যেতে চাইছি, সিটিভেসিয়াতে। কীভাবে যাব বলবেন কি?

লোকটা একটা ট্রাকের দিকে তাকিয়ে বলল– ওইখানে যান, উনি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।

রবার্ট পরর্বতী ট্রাকের কাছে গিয়ে বললেন- মঁসিয়ে, সিটিভেসিয়ায় যাবার কোনো উপায় আছে?

লোকটা বলল- হতে পারে। আমি কী সুযোগ পাব। কত টাকা দেবেন?

 রবার্ট লোকটার হাতে এক হাজার লিরা তুলে দিলেন।

–এত টাকাতে আপনি নিজে একটা প্লেনের টিকিট কিনতে পারেন।

রবার্টের মনে পড়ল, হ্যাঁ, ভুল হয়ে গেছে। তিনি বললেন আমার কয়েকজন পাওনাদার আছে, এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে, আমি ট্রাকে চড়ে যাব।

-ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি। আমরা এক্ষুনি ছাড়ব।

রবার্টের মনের উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেল।

কী ভাবব এখন আমি? রবার্ট বললেন আমি কি একটু শোবার জায়গা পাব?

 –হ্যাঁ, যদি শুতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।

 বাক্সে পরিপূর্ণ, লোকটা রবার্টের দিকে তাকাল। তারপর ভেতরে চলে গেল। রবার্ট বাক্সের আড়ালে শরীরটাকে লুকিয়ে রাখলেন। বড্ড ক্লান্ত। কখন থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছে। ঘুমোবার সময় পাননি।

ট্রাক এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভার তার এই নতুন প্যাসেঞ্জার সম্পর্কে অনেক কিছু ভাবছে। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, লোকটা মার্কিন দেশের বাসিন্দা। নিশ্চয়ই কেউ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ফরাসি উচ্চারণে কথা বলছে। কিন্তু, না, আমেরিকানের মতো তার পোশাক পরিচ্ছদ। তার ওপর নজর রাখলে কী হয়? ভালো একটা পুরস্কার পাওয়া যেতে পারে।

এক ঘন্টা কেটে গেছে। ট্রাকটা হাইওয়ে দিয়ে চলেছে। ড্রাইভার গ্যাস পাম্পের সামনে দাঁড়াল। বলল, পেট্রল ভরে দাও তো। সে পেছন দিকে চলে গেল। দেখল, হ্যাঁ, লোকটা ঘুমিয়ে আছে।

ড্রাইভার রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল। পুলিশ স্টেশনে ফোন করল।

.

৪৭.

কর্নেল সিজার, ইয়েস, ড্রাইভারকে বললেন- হ্যাঁ, মনে হচ্ছে ও-ই বোধহয় হয় আমাদের হারানো মানিক। ভালো করে শোনো, লোকটা সাংঘাতিক। আমি কী বলছি, বুঝতে পারছ?

–হ্যাঁ, স্যার।

–তুমি এখন কোথায়?

–সিটিভেসিয়ার কাছে একটা পেট্রল পাম্পে। হাইওয়েতে।

–লোকটা কি এখনও তোমার ট্রাকে আছে?

–হ্যাঁ। কথাগুলো ড্রাইভারকে অবাক করে দিয়েছে।

আহা, আমি কেন আমার ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম না।

–এমন কাজ করো না, যাতে লোকটা সন্দেহ করতে পারে। ট্রাকে চলে যাও। সিটি ভেসিয়ার দিকে এগিয়ে চলল। তোমার লাইসেন্স নম্বরটা আমাকে দাও। ট্রাকটা কেমন দেখতে।

ড্রাইভার সবকিছু বলল।

-ঠিক আছে, দেখা হবে।

কর্নেল সিজার কর্নেল জনসনের দিকে তাকিয়ে বললেন- অবশেষে পাওয়া গেছে। রাস্তা বন্ধ করে দাও। তিরিশ মিনিটের মধ্যে আমরা হেলিকপ্টারে করে সেখানে পৌঁছে যাব।

ড্রাইভার রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। সে বুঝতে পারল, তার হাত ঘামে ভিজে গেছে। ট্রাকের কাছে এগিয়ে এল। সে ভাবল, লোকটা কি আমাকে গুলি করবে? না, তা কেন হবে? অনেক টাকা পুরস্কার পাব। ট্রাকটাকে সে এগিয়ে নিয়ে গেল।

পঁয়ত্রিশ মিনিট কেটে গেছে। হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা গেছে। লোকটা ওপর দিকে তাকাল। হ্যাঁ, পুলিশের হেলিকপ্টার। হাইওয়ের ওপর উঠে আসছে। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। একের পর এক গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। পুলিশের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। হেলিকপ্টারটা রাস্তার একধারে থামল। সিজার এবং কর্নেল ফ্রাঙ্ক নেমে এলেন।

ড্রাইভার ট্রাকটার গতি আস্তে করে দিয়েছে। বলল– লোকটা ওখানে শুয়ে আছে।

 সিজার চিৎকার করলেন– খুলে দাও।

 ট্রাকটা খোলা হল।

কর্নেল জনসন বললেন- তোমরা কেউ গুলি করবে না। আমি নিজেই দেখব।

 তিনি ট্রাকের পেছন দিকে চলে গেলেন।

রবার্ট বেরিয়ে আসুন। খেলাটা শেষ হয়ে গেছে।

না, কোনো উত্তর নেই।

রবার্ট, আমি পাঁচ সেকেন্ড সময় দেব।

নীরবতা, কোনো উত্তর নেই।

সিজার তার লোকদের দিকে তাকলেন।

কর্নেল জনসন বললেন– না, কিছু বুঝতে পারছি না।

অনেক দেরি হয়ে গেছে কি?

 পুলিশ গুলি করতে শুরু করেছে। অটোমেটিক পিস্তলের শব্দ। স্পিংটা ছিটকে পড়ছে। দশ সেকেন্ড হয়ে গেছে। গুলি থেমে গেল, কর্নেল ফ্রাঙ্ক জনসন ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর? বাক্সগুলো সরিয়ে দিলেন।

সিজারের দিকে তাকিয়ে উনি বললেন- না, পাখি উড়ে গেছে।

.

উনিশতম দিন, সিভিটাভেচিয়া, ইতালি।

এটা একটা পুরোনো সমুদ্র বন্দর। রোমের জন্যই করা হয়েছিল। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এখানে একটা সুন্দর পোর্ট দেখেছিলেন, ১৫৩৭ সালে। একসময় এই শহরের বন্দর ছিল ইউরোপের ব্যস্ততম বন্দর। রোম থেকে সার্ডিনিয়া পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলে ব্যবসা এর মাধ্যমেই হত।

প্রমোদ তরণী অপেক্ষা করছে। ঠিক জায়গাতে। আহা, হনিমুনের কথা মনে পড়ছে। এই হল সেই এলবা হোটেল। তিনদিন তিনরাত, সুশান ভাবলেন। সুশান বলেছিলেন, প্রিয়, তুমি কি সাঁতার কাটবে?

রবার্ট বলেছিলেন– না, আমি নড়তে চড়তে পারছি না।

 আবার সুশানের মুখে হাসি। সেসব দিন কোথায় হারিয়ে গেছে।

এখন কী করতে হবে? এলবাতে পৌঁছোত হবে।

শেষ পর্যন্ত রবার্ট আমার হাতের মুঠোয়, ফেরিবোটের সাহায্য নিতে হবে।

সুশান ভাবছিলেন, রবার্ট ফেরিবোটের ল্যান্ডিং-এর দিকে এগিয়ে চলেছেন। মনে হল, একটা সেডান দাঁড়িয়ে আছে, কিছুটা দূরে। তিনি থেমে গেলেন। হ্যাঁ, তাতে লাইসেন্স প্লেট লাগানো আছে। তার মানে? অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। চারপাশে ট্যুরিস্টদের ভিড়। বুঝতে পারলেন, সাদা পোশাকের ডিটেকটিভরা তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। এখন কী হবে? বিপদের গন্ধ পেয়েছেন। আমি কি ট্রাক ড্রাইভারকে বলেছিলাম, আমি কোথায় যাচ্ছি?

আঃ, ব্যাপারাটা না বললেই ভালো হত।

ট্রাকে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ট্রাকটা কেন থেমে গেল? দেখলাম, ড্রাইভারটা গ্যাস স্টেশনে ঢুকে পড়েছে। ফোন করছে। আমি বুঝতে পেরেছি, এখনই আমাকে পালাতে হবে। আমি আর একটা ট্রাকে চড়ে বসি। অবশেষে এই শহরে এসে পৌঁছেছি।

তার মানে? আমি নিজেই নিজের ফঁদে ধরা পড়তে চলেছি। ওরা আমাকে এখানেও ধাওয়া করেছে। হ্যাঁ, কোনো একটা নৌকোয় পা দিতে হবে।

আর দেরী করলে চলবে না।

রবার্ট সেখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর? একটা বিরাট বাড়ির সামনে এসে পড়লেন। লেখা আছে- ফেয়ার গ্রাউন্ডে চলে আসুন, সবকিছু পাবেন। খাবার, আনন্দ, খেলাধুলো- সবকিছু।

রবার্ট বুঝতে পারলেন, এবার পালাবার পথ পাওয়া গেছে।

.

৪৮.

ফেয়ার গ্রাউন্ড শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে। বেলুন উড়ছে, মানুষজন আনন্দ করছে। আকাশে রামধনু রং।

রবার্ট একজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য সামনে এগিয়ে গেলেন।

-এবার কি রেস শুরু হবে?

–হ্যাঁ, কখনও বেলুনে চড়েছেন?

না।

আহা, লেক কোমোর ওপর দিয়ে সেই বেলুন চড়ে যাওয়ার দিন। বেলুনটা পড়ে গিয়েছিল। লেকের জল স্পর্শ করতে হয়েছিল।

সুশান চিৎকার করে বলেছিল– আমরা মরে যাব।

রবার্টের মুখে হাসি, আমরা কখনও মরব না।

লোকটা তখনও বলে চলেছে– এটা এক দারুণ খেলা।

কখন এই রেসটা শুরু হবে? এটা কোথায় শেষ হবে?

যুগোশ্লোভিয়া। আজ আবহাওয়াটা ভালোই আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেলুনগুলো ছেড়ে দেবে। সকালবেলা বেলুনে চড়াটা ভালো। তখনই চড়তে ভালো লাগে।

রবার্ট শান্তভাবে বললেন- তাই নাকি? যুগোশ্লোভিয়াতে একবার তিনি গিয়েছিলেন।

রবার্ট দেখলেন আরও বেলুন এসে গেছে। আঃ, এমন লড়াই?

রবার্ট জানতে চাইলেন- আমি কি একটা বেলুন দেখতে পারি?

 –হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেখুন?

রবার্ট একটা হলদে-লাল বেলুনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এর ভেতর প্রোপেন গ্যাস পুরে দেওয়া হয়েছে। দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে।

যারা কাজ করছিলেন তাদের সাথে রবার্ট কথা বলার চেষ্টা করলেন। তিনি বাসকেটের ওপর হেঁটে গেলেন। বেলুনে ঢুকে পড়লেন। এক্ষুনি বেলুনটা যাত্রা করতে শুরু করবে কি? তিনি সব কিছু দেখলেন। আলটোমিটার, চার্ট, পাইরোমিটার, মনিটর- সব কিছু। হ্যাঁ, এখানে চড়লে কোনো অসুবিধা হবে না তার।

রবার্ট বললেন আমাকে নীচে নামিয়ে দেবে?

যে লোকটা বেলুন তৈরি করছিল, সে বলল, ভয় পাবেন না। এখানে আলটোমিটার আছে। আমরা এক হাজার ফুট উঁচুতে আসতে পারব। যুগোশ্লোভিয়ায় দেখা হবে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

-শুনতে পাচ্ছি।

বেলুনটা ক্রমশ ওপর থেকে আরও ওপরে চলে যাচ্ছে। এলবাকে দূরে রেখে আরও পশ্চিমদিকে। রবার্ট এখানে তাকিয়ে দেখছেন না। যে কোনো সময় বাতাসের গতি পরিবর্তন হতে পারে। অন্য বেলুনগুলো এখনও যাত্রা শুরু করোনি। কিন্তু রবার্টকে এখনই পালাতে হবে। কত দূরে? দুশো ফুট সাতশো ফুট- নশো ফুট এগারোশো ফুট…

পনেরো শ ফুট উচ্চতায় পৌঁছোবার পর বাতাস একটু শান্ত হয়েছে। বেলুনটা এখন শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রবার্ট আরও কতগুলো ব্যালাস নামিয়ে দিলেন। এবার বাতাসের গতিপথ পরীক্ষা করতে হবে।

দু-হাজার ফুট উঁচুতে গিয়ে রবার্ট বুঝতে পারলেন যে, বাতাস আবার এলোমেলো বইতে শুরু করেছে। ঝড় এলো বোধহয়।

অনেক দূরে রবার্ট অন্য বেলুনগুলো দেখতে পেলেন। সেগুলো যুগোশ্লোভিয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। কোনো শব্দ নেই, বাতাসের সামান্য শব্দ ছাড়া। সবকিছু শান্ত। তা হলে? শেষ পর্যন্ত আমি কি পালাতে পারলাম?

বেলুনে বসে তুমি কখনও কাউকে ভালোবেসেছ? সুশান জানতে চেয়েছিল। রবার্টের মনে হল, এসো চেষ্টা করা যাক।

পৃথিবীর কেউ এভাবে ভালোবাসা দেয়নি ডার্লিং, আমি বলতে পারি। রবার্ট বলেছিলেন।

রবার্ট এখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছেন। তাসকানির দিকে পৌঁছে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। এটা কি এলবা?

নেপোলিয়ানকে একসময় এখানে আটকে রাখা হয়েছিল। রবার্ট ভাবলেন। আর আমি? এক নতুন নেপোলিয়ান?

অনেক দূরে দেখা গেল কালো মেঘের দল। রবার্ট বেলুনটার গতি পরিবর্তন করলেন। নীচে সবুজ ঘাস দেখা যাচ্ছে। তাসখন্দ বাড়িও দেখা যাচ্ছে। গ্রানাইটের তৈরি দু-একটা পাথর। তিনি আস্তে আস্তে বেলুনটাকে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে এলেন। শহর থেকে একটু দূরে। না, কারও চোখে পড়ার সামান্য সম্ভাবনা নেই। এখান থেকে রাস্তা শহরের দিকে চলে গেছে।  

রবার্ট বললেন- আমাকে শহরে নিয়ে যাবেন?

-হ্যাঁ, এক্ষুনি আসুন।

ড্রাইভারকে দেখে মনে হল, অনেক বয়স হয়েছে, আশির কোঠা পার হয়েছে। মুখে সময়ের ছাপ।

-একটু আগে একটা বেলুন দেখলাম। এর মধ্যে আপনি ছিলেন?

না, রবার্ট বললেন।

বেড়াতে এসেছেন?

 না, আমি রোমে যাব। এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।

আমি একবার রোমে গিয়েছিলাম।

 কেউ কোনো কথা বলেননি।

শেষ পর্যন্ত তারা কোরভোফেরারিওতে পৌঁছে গেলেন। এবার একমাত্র শহর। রবার্ট গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।

দিনটা ভালোভাবে কাটুক। ভদ্রলোক ইংরাজিতে বললেন।

হায় ঈশ্বর, ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দারা এখানে এসে গেছে।

রবার্ট এগিয়ে গেলেন। প্রধান রাস্তা ধরে। ট্যুরিস্টদের ভিড়। বেশির ভাগই পরিবার নিয়ে এসেছেন। কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। খালি আমি সুশানকে হারিয়ে ফেলেছি, আর ছটা দেশের সরকার আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে দিয়েছে।

  তিনি একটা বাইনোকুলার কিমলেন। জলের ধারে চলে গেলেন। মেরিনা রেস্টুরেন্টে বসলেন। বন্দরের পরিষ্কার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। না, এখানে পুলিশের কোনো বোট নেই। পুলিশের লোককে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে, এখান থেকে আমি যদি ওই প্রমোদ তরণীতে যাই? যেখানে সুসান আমার জন্য অপেক্ষা করছে? তাহলে কেমন হয়?

.

সাদা মদ খেতে ব্যস্ত এখন তিনি। কখন হ্যালিকন আসবে, তারই অপেক্ষা করছেন। পরিকল্পনাটা আবার ভালোভাবে ভাবতে হবে। কোথায় যাওয়া যেতে পারে? মারসেইল? সেখান থেকে প্যারিস? প্যারিসে আমার এক বন্ধু আছে- লিপো। লিপো আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

ফ্রানসেসকো সিজারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আপনি কি চিনাদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন?

–না, লিপো ছাড়া আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না।

লিপো, একসময় চিনাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। গুপ্তচরবৃত্তির কাজ।

রবার্ট ভাবলেন, কীভাবে এই ফাঁদ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসব।

অপেক্ষার প্রহর ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। হ্যালিকন কি এই পোর্টে আসবে? না, যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়। নাকি আমিই সমুদ্রে চলে যাব।

.

ফরাসি সামুদ্রিক মন্ত্রক অফিস। কর্নেল সিজার এবং কর্নেল জনসন কথা বলছেন। তাঁরা মেন অপারেটরকে বললেন- তাইসিওয়ানের হ্যালিকনের সঙ্গে আর কথা বলা সম্ভব হয়েছে?

–না, স্যার। শেষ যা কথা সে রিপোর্ট তো আমি দিয়েছি।

কথা চালাতে থাকুন। কর্নেল সিজার কর্নেল জনসনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন যে সময় কমান্ডার বেলামি হ্যাঁলিকনে উঠবেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরা হবে।

–আমি চাইছি আগেই ধরে ফেলতে।

না,

 আমরা ঠিক জায়গায় ধরব।

কর্নেল সিজার এবং কর্নেল জনসন লিস্টের দিকে তাকালেন শব্দ হচ্ছে। একটির পর একটি নাম ভেসে আসছে। কিন্তু আসল লোকটা কোথায়? বুঝতে পারা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কে যেন বলল, তাকে শেষবারের মতো দেখা গেছে এলবাতে।

কর্নেল সিজার এবং কর্নেল জনসন অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। এলবা? হায় যিশু, এ জায়গাটা আবার কোথায়?

.

কুড়ি নম্বর দিন, এলবা দ্বীপ।

প্রথমে, মনে হয়েছিল, দূর আকাশে একটুকরো স্মৃতির ছবি। তারপর তা সকালের উজ্জ্বল আলোতে ভাস্বর হয়ে উঠল। বাইনোকুলার দিয়ে তাকিয়ে আছেন রবার্ট, দেখতে পাচ্ছেন, হ্যালিকন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে। না, এবার আর কোনো ভুল নেই। কারণ এর মতো দেখতে আর একটা জাহাজও বোধহয় নেই।

রবার্ট অত্যন্ত দ্রুত সাগরসৈকতে চলে এলেন। একটা মোটরবোট ভাড়া করতে হবে।

-শুভ প্রভাত।

মোটরবোটের মালিক বললেন- আপনি কি এখনই যাবেন?

-হ্যাঁ।

কতক্ষণ সময় লাগবে?

দু-তিন ঘণ্টার বেশি লাগবে না।

 রবার্ট টাকা তুলে দিলেন। বোটে গিয়ে বসলেন।

 লোকটি বলল- সাবধানে চালাবেন কিন্তু।

রবার্ট বললেন- হ্যাঁ, কোনো চিন্তা নেই।

বোটটা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কিছুটা সময় লাগবে। দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সুশান এবং মন্টে বাঙ্কস ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন। সুশান হাত নাড়লেন। রবার্ট তার মুখে উদ্বিগ্নতার চিহ্ন দেখতে পেলেন। ছোট্ট বোটটা এবার প্রমোদ তরণীর কাছে এসে গেছে।

একটা মই নেমে এসেছে।

সত্যি এক অসাধারণ প্রমোদ তরণী। ২৮০ ফুট লম্বা, ভালো ভালো কেবিন আছে। অতিথিদের জন্য আটটা ডবল সেট। ষোলো জন ক্রু থাকার জন্য আলাদা কেবিন। ড্রয়িং রুম আছে, ডাইনিং রুম, অফিস, সেলুন, সুইমিং পুল।

ভারী সুন্দর আধুনিক ইনজিন।

সুশান বললেন- তোমাকে শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছি।

রবার্টের চোখে মুখে হাসি। কিন্তু এখনও মনে দুর্ভাবনা।

আহা, সুশান আগের মতোই সুন্দরী, রবার্ট ভাবলেন। কিন্তু, সুশান এমন হল কী করে? এখন তো তার দুঃখ-দুঃখ মুখে দাঁড়িয়ে থাকার কথা।

রবার্ট মন্টের দিকে তাকালেন ভালো লাগল, শেষ পর্যন্ত আমি আসতে পেরেছি।

মন্টে হাসছেন- হ্যাঁ, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম। আহা, এই মানুষটি যেন এক সন্ন্যাসী? আপনার পরিকল্পনা কী?

মারসেইলের দিকে যেতে চাইছি। সেখানে আমায় ছেড়ে দিলেই হবে।

সাদা ইউনিফর্ম পরা একটা মানুষ এগিয়ে এসেছে। বছর পঞ্চাশ বয়স। ছোটো দাড়ি আছে।

–ইনি ক্যাপটেন সিমসন। আর ইনি.. মন্টে বাঙ্কস রবার্টের দিকে তাকালেন।

–স্মিথ, স্মিথ।

মন্টে বললেন আমরা মারসেইলের দিকে যাব, ক্যাপটেন।

–আমরা এলবার দিকে যাব না?

না।

ক্যাপটেন সিমসন বললেন- ঠিক আছে। কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতা।

রবার্ট বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

 মন্টে বাঙ্কস বললেন– আমরা নীচে যাব।

 তারা সেলুনে এসে বসলেন।

মন্টে বললেন– কীভাবে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করা যায়?

রবার্ট বললেন–হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু না জানাই ভালো। আমি একটা কথাই বলতে পারি, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি একটা রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। তাই আমাকে তাড়া করা হচ্ছে। যদি ওরা আমাকে খুঁজে পায়, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।

সুশান এবং মন্টে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

–কিন্তু ওরা নিশ্চয়ই এই প্রমোদ তরণীতে আসবে না, রবার্ট বললেন, আমাকে বিশ্বাস করুন মন্টে, যদি অন্য কোনো উপায় থাকত, আমি আপনাকে বিব্রত করতাম না।

রবার্ট সেই সব মানুষগুলোর কথা ভাবলেন। যাদের মৃত্যু হয়েছে, অথবা যাদের খুন করা হয়েছে। না, সুশানের ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনা ঘটুক তা তিনি কখনও চাইছেন না। তিনি বললেন-হা, আপনারা যেভাবে আমায় সাহায্য করেছেন, আমি ভাবতেই পারছি না।

মন্টে বললেন– না-না, এত কিছু বলার দরকার নেই।

এবার প্রমোদ তরণী পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করছে।

–আমি ক্যাপটেনের সাথে একটা কথা বলব, কেমন?

.

ডিনার শেষ হল। রবার্ট দুটো ব্যাপার বুঝতে পারছেন না, একটা টেনশন থাকা দরকার। কিন্তু তা নেই কেন? রবার্ট শেষ পর্যন্ত মনে করলেন, দুজনের মধ্যে একটা গোপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে নাকি? এখান থেকে আমাকে অতি দ্রুত পালাতে হবে।

.

তারা দুজনে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে ড্রিঙ্ক নিয়ে। ক্যাপ্টেন সিমসন এসেছেন।

 রবার্ট বললেন- আমরা কখন মাইসেইলে পৌঁছোব?

-কাল বিকেলের মধ্যে।

ক্যাপটেন সিমসনের কথার মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার আছে, রবার্ট অবাক হয়েছেন। ক্যাপটেন কি ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথা বলছেন? রবার্টের মনে হল।

রাত্রি এগারোটা। মন্টে ঘড়ির দিকে তাকালেন। সুশানকে বললেন– এবার যেতে হবে।

 সুশান রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- হ্যাঁ।

 তারা উঠলেন।

 মন্টে বললেন- কেবিনে যান। সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন।

ধন্যবাদ।

–শুভরাত্রি রবার্ট।

শুভরাত্রি, সুশান।

রবার্ট দাঁড়িয়ে থাকলেন। কী আশ্চর্য, ভালোবাসার মেয়েটি এখন অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী। না, প্রতিদ্বন্দ্বী তো নয়, আমি হেরে গেছি। উনি জিতে নিয়েছেন গোটা বিশ্ব।

ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত কতগুলি স্বপ্ন। রবার্ট বুঝতে পারছেন, দেওয়ালের ওধারে কী লেখা আছে। ভালোবাসার মেয়েটি এখন এক পুরুষের সাথে প্রেমের খেলায় মত্ত। সুশান সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বিছানাতে শুয়ে আছে। সে কখনও নাইট গাউন পরতে ভালোবাসাত না। রবার্ট বুঝতে পারলেন, তার দণ্ড আজ শক্ত হতে শুরু করেছে। মন্টেকে এখন পাগলের মতো সুশান ভালোবাসছে। না, সুশান এখন একা আছে? সুশানের কথা বারবার মনে পড়ছে। কেন? না, এখন নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে হবে। আমি আর কখনও সুশানকে দেখতে পাব না।

সকাল হবার একটু আগে ঘুমের আশ্রয়ে রবার্ট পৌঁছে গেলেন।

.

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কমিনিউকেশন রুম। র‍্যাডারের শব্দ হচ্ছে। কর্নেল সিজার কর্নেল জ্যাকসনের দিকে তাকিয়ে বললেন- হ্যাঁ, এরপর আমরা এলবার দিকে এগিয়ে যাব। আর বেশিক্ষণ নয়, হ্যাঁলিকনে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে।

.

একুশ নম্বর দিন।

সকালবেলা, রবার্ট ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন। শান্ত সমুদ্র। ক্যাপ্টেন সিমসন বললেন শুভ সকাল। আবহাওয়া ভালোই আছে মি. স্মিথ। আমরা তিনটের মধ্যে মারসেইলে পৌঁছে যাব। সেখানে কি বেশিক্ষণ থাকব?

রবার্ট বললেন– আমি ঠিক জানি না। রবার্ট আবার সিমসনের দিকে তাকালেন। লোকটার মধ্যে এমন একটা আচরণ কেন? রবার্ট প্রমোদ তরণীর এককোণে চলে গেলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। কিছু দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, এর আগে অনেকবার ভবিষ্যৎ দৃষ্টি তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু কোথাও একটা বিপদের ঘণ্টা বাজছে।

.

আকাশের সবকিছু হারিয়ে গেল। ইতালিয় নেভি এবার খুব কাছাকাছি এসে গেছে।

.

সুশান ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে আছেন। সমস্ত শরীরে বিবর্ণতা।

 মন্টে জানতে চাইলেন- সুশান, তোমার ভালো ঘুম হয়নি?

তার মানে? ওঁরা এক কেবিনে শুয়ে থাকেননি কেন? রবার্টের মনে হল, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা আছে। আমি আর সুশান সবসময় এক জায়গায় শুতাম। তার নগ্ন দেহটা আমাকে জড়িয়ে থাকত। নাঃ, এ ব্যাপার নিয়ে ভাবনা করব না।

হ্যালিকনের পাশে একটা ফিশিং বোট এগিয়ে চলেছে। সেখানে টাটকা মাছ আছে।

সুশান জিজ্ঞাসা করলেন– লাঞ্চে ফিশ ভালো লাগবে?

 দুজনেই মাথা নাড়লেন– হ্যাঁ।

তারা ফিশিং বোটের কাছে পৌঁছে গেলেন।

 ক্যাপটেন সিমসন এগিয়ে এলেন।

রবার্ট জানতে চাইলেন- আমরা কখন পৌঁছোব?

দু-ঘন্টার মধ্যে মি. স্মিথ, মারসেইল খুব সুন্দর বন্দর। সেখানে আগে কখনও গেছেন?

রবার্ট জবাব দিলেন- হ্যাঁ, আমি শুনেছি বন্দরটা খুবই ভালো।

.

কমিউনিকেশন রুম, পুলিশ হেডকোয়ার্টার। দুজন কর্নেল, এবার শেষ মেসেজটা পড়ছেন হ্যাঁলিকনে পৌঁছোত হবে।

কর্নেল সিজার জানতে চাইলেন হ্যালিকন এখন কোথায়?

মারসেইল থেকে দূরে, দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে।

–আমাদের জাহাজটাকে অর্ডার করো, এখনই যেন এগিয়ে যায়।

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। ইতালিয়ান নেভি জাহাজ স্টাম্বলি এগিয়ে চলেছে, হ্যালিকনের কাছে এসে গেছে। সুশান এবং মন্টে কেবিনে বসে আছেন। তারা দেখতে পাচ্ছেন ওই জাহাজটাকে।

লাউডস্পিকারে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল- হ্যালিকনে আমরা আসছি।

সুশান এবং মন্টে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

 ক্যাপটেন সিমসন ছুটে এসেছেন মি. বাঙ্কস?

হা, ইনজিন বন্ধ করে দিন।

–ঠিক আছে।

 এক মিনিট, ইনজিন বন্ধ হয়ে গেল। প্রমোদ তরণী এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

 সুশান এবং তার স্বামী তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।

দশ মিনিট কেটে গেছে। হ্যালিকনের কাছে অনেক নাবিক পৌঁছে গেছেন।

নেভাল অফিসার সবার আগে আসছেন। তিনি এক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। তিনি বললেন- আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত, মি. বাঙ্কস। ইতালিয় সরকার বিশ্বাস করে যে, আপনি এমন কিছু কাজ করেছেন, যার ভেতর সন্দেহ আছে। আপনার এই জাহাজটা একবার অনুসন্ধান করব।

সুশান দাঁড়িয়ে আছেন। নাবিকরা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ ডেকে চলে গেছেন। কেউ কেবিনের তলায়।

-কেউ কোনো কথা বলবেন না।

 তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। বিশ মিনিট কেটে গেছে। আবার সকলে মেন গেটে এসেছেন।

একজন বললেন- কমান্ডার, তার কোনো চিহ্ন নেই।

–ঠিক বলছেন?

 –এখানে কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। আমরা সব ক্রু-কে পরীক্ষা করেছি।

কমান্ডার হতাশ এখন কীভাবে জবাবদিহি করবেন।

উনি মন্টে এবং সুশানের দিকে তাকালেন– ক্যাপটেন সিমসনও দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, না, আপনাকে দুঃখ দিলাম, এর জন্য আমরা দুঃখিত।

কমান্ডার?

–হ্যাঁ?

–যে মানুষটিকে আপনারা খুঁজছেন, সে একটা ফিশিং বোটে চেপে চলে গেছে। মনে হয়, অতি সহজে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। সরকারী জাহাজ এখন মারসেইল-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না। কীভাবে জবাব দিহি করবেন? কমান্ডার রবার্ট বেলামিকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

ব্রিজের ওপর থেকে নেভিগেশন অফিসার বললেন-কমান্ডার, আপনি এখানে আসবেন কি?

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার অতি দ্রুত চলে গেলেন।

অনেক দূরে মারসেইলের বন্দর দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো মাছ ধরার জাহাজ এগিয়ে চলেছে। একই রকম, অন্তত একশোটা হবে। এর মধ্যে কমান্ডার বেলামি কোনটাতে আছেন!

.

৪৯.

 একটা গাড়ি নেওয়া হল, মারসেইলে। তারপর? সামনের দিকে এগিয়ে চলা। শেষ পর্যন্ত রবার্ট কি সফল হতে পারবেন?

লিপোর সঙ্গে দেখা করত হবে। লিপোকে আগেই ফোন করা ছিল। কথাবার্তা বলতে হবে। রবার্ট জানেন, ফোনের লাইনটাকে ধরে ফেলা হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে এই ফোন কলটা আসবে, লিপো এমনই সুনিশ্চিত।– রবার্ট হেঁটে চলে গেলেন। এর আগে এই পথে সুশানের সঙ্গে এসেছিলেন। সুশান একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিছু জিনিসপত্র কিনতে চেয়েছিলেন। পোশাক পরিচ্ছদ।

মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথা।

অল্পবয়সী একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বলল– পঞ্চাশ ফ্রাঙ্ক পেলে তোমার কেমন লাগে?

কী করতে হবে?

 রবার্ট কাগজে কী যেন লিখলেন। ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন, সঙ্গে পঞ্চাশ ফ্রাঙ্ক।

–এটা লা মার্টিনে নিয়ে যাও।

–আমি যাচ্ছি।

রবার্ট দেখলেন, ছেলেটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে। কাল সকালের সংবাদপত্রে। বলা হবে, চিলি, বাবা খুব অসুস্থ, এসো মা।

এখন অপেক্ষা করতে হবে। কোনো হোটেলে থাকা উচিত হবে না। সব হোটেলকে, নিশ্চয়ই সতর্ক করা হয়েছে।

রবার্ট একটা ট্যুর বাসে উঠে বসলেন। একদম কোণে বসে থাকলেন চুপচাপ। অনেকে লাক্সেনবার্গ গার্ডেন বেড়াতে যাবে। লুভারেতে, নেপোলিয়ানের সমাধি। আরও কত কী? কত স্মারকচিহ্ন।

রবার্ট মাঝরাতে হোটেলে ঢুকে পড়লেন। আর একটা দলের সঙ্গে। রাত দুটোতে এক অনুষ্ঠান শুরু হবে। অনুষ্ঠানটা শেষ হল। রবার্ট বুঝতে পারলেন, এবার তাকে মনটি কালোতে আসতে হবে। একটা ছোেটা বারের ভেতর।

.

বাইশ নম্বর দিন, প্যারিস, ফ্রান্স।

সকালের কাগজেই সংবাদটা বেরিয়েছে। সকাল পাঁচটা কয়েক মিনিট আগে রবার্ট নিউজপেপার স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন। লাল রঙের একটা ট্রাক আসছে। একটা ছেলে একবাণ্ডিল কাগজ ফেলে দিয়েছে। রবার্ট কাগজটা তুললেন। হা, বিজ্ঞাপন আছে, কিন্তু এখনও অপেক্ষা করা।

দুপুর হয়েছে। রবার্ট একটা দোকানের ভেতর ঢুকে বসলেন। এখানে বোর্ডের ওপর ব্যক্তিগত খবর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কতরকম সংবাদ।

লিপোকে পাওয়া গেল, মেসেজটা ওখানে ছিল। ..

শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, সুমের অ্যাপার্টমেন্টে দেখা হবে, লীর গার্লফ্রেন্ড।

আধঘণ্টার মধ্যে রবার্ট সেখানে পৌঁছে যাবেন।

.

অ্যাপার্টমেন্টটা রুয়েতে অবস্থিত। প্যারিসের উপকণ্ঠে। রবার্ট যখন সেখানে পৌঁছোলেন, আকাশে বৃষ্টি ঝরা মেঘের চাউনি। বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেল। উনি লবিতে ঢুকে পড়লেন। ডোরবেলে হাত দিলেন, লিপো দরজা খুলে দিয়েছেন।

লিপো বললেন তাড়াতাড়ি ভেতরে এসো।

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। একই রকম আছেন ওই ভদ্রলোক। লম্বা এবং পাতলা। যার বয়স কখনও বাড়ে না।

দুজন হাতে হাত দিলেন- আপনি কি জানেন, আমার ভাগ্যে কী ঘটেছে?

বসো, বসো বাবা, এত চিন্তা করছ কেন?

রবার্ট বসলেন।

তিনি তাকালেন- অপারেশন ডুমস ডে-র নাম শুনেছ?

না, উড়ান চাকির সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

উড়ন চাকির সঙ্গেই এর সম্পর্ক আছে। সারা পৃথিবী জুড়ে এখন এই অপারেশন ছড়িয়ে পড়েছে, রবার্ট।

লিপো বলতে শুরু করেছেন অন্য গ্রহের মানুষেরা পৃথিবী জয় করার জন্য মরিয়া। তিনবছর আগে বিশ্বের সমস্ত শিল্পকে কবজা করতে চেয়েছিল। এমন কি তারা বলেছিল যে, পরমাণু শক্তিকেন্দ্রগুলি উড়িয়ে দেবে। এমন কি তারা জ্বালানি ধ্বংস করতে দেবে না।

রবার্ট অবাক হয়ে শুনছেন, তিনি হাঁ, হয়ে গেছেন।

তারা পেট্রোল, কেমিক্যাল, রবার, প্ল্যাস্টিক সব কিছুর ওপর দখলদারি কায়েম করতে চেয়েছিল। সারা পৃথিবীতে অন্তত এক হাজার ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যেত। অটোমোবাইল আর তৈরি হত না। কী হত বলো তো? পৃথিবীর অর্থনীতি ভেঙে পড়ত।

–তারা এমন কেন করছে?

–তারা বলছে, আমরা নাকি গোটা বিশ্বকে দূষিত করে তুলেছি। পৃথিবীতে ধ্বংস করছি। সাগরকে বিষিয়ে দিচ্ছি। তারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেয়েছিল।

–লী?

-সেই জন্য অন্তত বারোটি দেশের শক্তিশালী মানুষেরা একসঙ্গে বৈঠকে বসে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চিন সবদেশের শিল্পপতিরা ছিলেন। একজন মানুষের ছদ্মনাম হল জানুস। তিনি বিভিন্ন দেশের ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলিকে এক করেছিলেন। শুরু হল অপারেশন ডুমস ডে। ওই ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য।

উনি রবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন- তুমি এস. ডি. ও. আই. নাম শুনেছ?

-হ্যাঁ, স্টার ওয়ার, নক্ষত্র যুদ্ধ। সোভিয়েত ইন্টার কনটিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিশাইল। তাই তো?

লী মাথা নাড়লেন না, এটা ওপরে বলা হয়। এস ডি ওয়াইকে তৈরি করা হয়েছে। রাশিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য নয়। ইউ এফ ও দেখলেই গুলি করে নামাতে হবে। এভাবেই হয়তো ওদের আগ্রাসন বন্ধ করা যায়।

রবার্ট অবাক হয়ে গেছেন। সমস্ত শরীরে বিরাজ করছে একটা অদ্ভুত নিরাপত্তা সত্তা। লিপো যে কথাগুলো বলছেন, সেগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। বাইরে বাজের শব্দ।

তার মানে, আপনি বলছেন, সরকার সাহায্য করছে?

-হ্যাঁ, প্রত্যেক সরকারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। অপারেশন ডুমস ডে-কে যদিও ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, কিন্তু এর অন্তরালে সরকারের মদত আছে, আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ।

হায় ঈশ্বর, সরকার ব্যাপারটা সম্পর্কে অবহিত নয়? উনি লীর দিকে তাকালেন–আপনি কী করে এ ব্যাপার জানলেন?

 লী হাসলেন। এর অর্থটা বুঝতে পারলে না? আমি হলাম ওই অপারেশনের চিনা প্রতিনিধি।

রবার্ট অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন লিপোর দিকে। লীর হাতে একটা ছোট্ট বন্দুক।

লী ট্রিগারটা টিপলেন। একটা শব্দ হল। বাজ পড়েছে বুঝি। দেখা গেল, এক টুকরো আগুন। জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে।

.

৫০.

বৃষ্টি-বৃষ্টি- শুধু বৃষ্টি। তার ঘুম পেয়েছে। সে একটা পার্কের বেঞ্চের ওপর শুয়ে আছে। নড়তে চড়তে পারছে না। গত দু-দিন ধরে সে ভেবেছে, আমি আবার জীবনের মধ্যে ফিরে এসেছি। না, এই গ্রহে থাকলে আমি আর বাঁচব না। এটা বোধহয় আমার শেষ ঘুম। তারপর বৃষ্টি এল। সেই ঈশ্বরের আশীবাদপূর্ণ বৃষ্টি। সে বিশ্বাস করতে পারেনি, সে মাথা তুলল। আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টিকণা শান্ত শীতল, তাকে আরও সিক্তা করছে। সে দাঁড়িয়ে থাকল, হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে দিল। বৃষ্টি এসে আমার শরীরের প্রত্যেকটি কোশকে সিঞ্চিত করবে। আমাকে জীবনের উন্মাদনায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সমস্ত শরীরে আমি জলকণা ভরে রাখব। আমি আমার অস্তিত্বকে আবার খুঁজে পাব। আমার উদ্বিগ্নতা হারিয়ে যাবে। সে ভাবল, আমি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠব। হ্যাঁ, আমি এখন সবকিছু করতে পারি। সে একটা ছোট্ট ট্রানমিটার হাতে নিল। চোখ বন্ধ করল। এবার তাকে কাজ করতে হবে।