2 of 3

০৭৫. পনেরো দিন জ্বরে পড়েছিল বীণা

পনেরো দিন জ্বরে পড়েছিল বীণা। মনে হচ্ছিল জীবন থেকে একটা বিশাল কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে আয়ু, যৌবন, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিভা।

আগাগোড়া কুসুম তার কাছে থেকেছে। মাথা বোয়ানো, গা স্পঞ্জ করা, রান্না করে খাইয়ে দেওয়া। বেডপ্যানও দিতে চেয়েছিল। বীণা ওটা পারেনি, মরে মরেও উঠে উঠোনের ওধারে গেছে।

সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল একজন সঙ্গীর। সেই অভাব কুসুম খুব পুরণ করেছে।

জ্বরের শেষ দিকটায় বীণা একদিন সন্ধেবেলা বলল, হ্যাঁ রে কুসুম, আর জন্মে কি তুই আমার মা ছিলি? মাও তো এত করে না!

কী যে বলো বীণাদি! কী আর করলুম। এটুকু সবাই পারে।

বীণা মাথা নেড়ে বলে, না রে, পারে না। পারলেও করে না। আমি শুধু ভাবি, তোর যদি অসুখ করত। আমি কি যেতাম তোর সেবা করতে? নাকি পারতাম। এতটা? তুই বড্ড ভাল। এই যে এত সেবা করলি, আমার টাকা থাকলে তোকে একছড়া হার গড়িয়ে দিতাম।

কুসুম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসল। বলল, হার দিলে তো শোধবোধ হয়ে যেত। তা হলে আর সেবাটার অন্য কোনও দাম থাকত না।

হ্যাঁ রে, জ্বরের ঘোরে তো মেলা ভুলভাল বকেছি। বেফাঁস কিছু বলে ফেলিনি তো!

কুসুম ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে বলে, একটা জিনিস হল, নিমাইদাদাকে খুব গালমন্দ করেছো। প্রায় রোজ। আর একটা যেন ডলার। আর পাউন্ড নিয়ে কী একটা কথা।

বীণার মুখ শুকিয়ে গেল, ডলার। আর পাউন্ড! সে আবার কী রে?

কুসুম ঠোঁট উল্টে বলে, কী জানি কী! ডলার, পাউন্ড, খুন, পটু এইসব মাঝে মাঝে বলেছে।

বীণার বুক ধকধক করতে লাগল। চোখ বুজে নিজেকে শক্ত করে সে বলল, কত কী মাথায় আসে, কে জানে বাবা! যখন ভুলভাল বকেছি তখন বাইরের কেউ সামনে ছিল না তো!

না। তোমার লজ্জার কিছু নেই।

জ্বর হলেই আমি ভীষণ ভুলভাল বাকি। ছেলেবেলায় আমার তাড়কা হত।

কুসুম খুব হাসছিল। বলল, হ্যাঁ গো বীণাদি, নিমাইদাদার ওপর তোমার খুব রাগ, না?

কেন বল তো!

যখন ভুল বকেছো তখন বুঝতে পারতাম তোমার ভিতরটা খুব জ্বলছে।

বীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, বাইরে থেকে তো কিছুতেই বুঝবি না, লোকটা আমার সঙ্গে কত প্ৰবঞ্চনা করছে!

কিন্তু নিমাইদাদাকে তুমি এখনও মন থেকে মুছে ফেলতে পারোনি।

মুছে ফেলবে কি করে? দাগ দিলে কি ভোলা যায়?

ভুলতে কি চাও?

খুব চাই।

কুসুম কি একটা কাজে উঠে গেল। ঘণ্টাখানেক বাদে যখন এল তখন বীণা বিছানায় বসে আছে।

বীণা বলল, দেখা কুসুম, জ্বরের মধ্যে আমি একটা অলক্ষুণে স্বপ্ন দেখেছি। একবার নয়, কয়েকবার। স্বপ্ন কি সত্যি হয়?

হতে পারে। অনেক সময়ে হয় বলেও তো শুনি। কী দেখেছে?

সে খুব খারাপ স্বপ্ন।

খারাপ স্বপ্ন বলে দিতে হয়। তা হলে আর ফলে না।

সত্যি?

সত্যি কি না কে জানে বাবা! মা খুড়িমার কাছে শুনেছি।

তা হলে তোকে বলে দিই। আমি দেখেছি, ও আবার বিয়ে করেছে। বউটা দেখতে বেশ সুন্দর।

কুসুম একটুও হাসল না। বলল, যাঃ, নিমাইদা সেরকম লোক নয়।

বীণা গম্ভীর হয়ে বলল, পুরুষমানুষকে তুই বিশ্বাস করতে পারিস, আমি একটুও করি না। ওরা সব পারে।

সব পুরুষ কি খারাপ হয়। বীণাদি? নিমাইদাদা তো কখনোই খারাপ লোক নয়। ওর ওপর তোমার রাগ বলে বলছো।

বীণা কাহিল গলায় বলে, একটা কাজ করবি কুসুম? কাউকে কাঁচড়াপাড়ায় পাঠিয়ে একটু খবরটা নিবি?

এবার কুসুম হেসে ফেলল। বলল, পারোও তুমি বটে। কাঁচড়াপাড়া তো আর বিলেত-বিদেশ নয়, হরবখত লোক ফ্ল্যাচ্ছে আসছে। খোঁজ নিলেই হবে। আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি তো কাঁচড়াপাড়ায়। আমারই যাওয়ার কথা ছিল। তোমার অসুখের জন্য আটকে পড়লাম।

খবরটা আমাকে তাড়াতাড়ি আনিয়ে দিতে পারবি?

কবে চাই?

আজ পারলে আজই।

কুসুম হেসে ফেলে বলে, আজ যে রাত হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে?

তা হলে কালই। পারবি না? আমার মনটা বড় অস্থির।

কুসুম বলে, নিমাইদাদাকে নিয়ে অত ভাবছো কেন? সে তোমাকে বড্ড ভালবাসত। হুট করে কিছুতেই বিয়ে করবে না। সে তেমন লোক নয়।

নিমাই একটা ছেড়ে দশটা বিয়ে করলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি শুধু ভাবি, আমার মতো আর কোনও মেয়ের যেন সর্বনাশ না হয়।

কুসুম তার মাথায় হাত রেখে বলে, এখন শুয়ে একটু চোখ বুজে থাকো। জানো তো, অসুখের মধ্যে মনের উত্তেজনা ভাল নয়, বেশি ভাবলে অসুখ বেড়ে যায়।

আচ্ছা।

কিন্তু বিশ্রাম হল না বীণার। মনের মধ্যে জ্বালা আর জ্বালা। বারবার একই স্বপ্ন দেখছে কেন সে, যদি স্বপ্নের মধ্যে কোনও মানেই না থাকে?

আরও তিন-চারদিন বীণা বিছানায় পড়ে রইল। তার মধ্যে কোনও খবর আনিয়ে দিতে পারল না। কুসুম। ষোলো দিনের দিন সকালবেলা জ্বর ছেড়ে গা ঠাণ্ডা হল। শরীর তখন চুপসে গেছে। উঠে বসবার ক্ষমতা নেই। ভীষণ দুর্বল।

আরও দুদিন পর কুসুম বলল, একটা খবর আছে বীণাদি।

কি খবর?

নিমাইদাদা বিয়ে করেনি।

বীণা কুসুমের দিকে একটু চেয়ে থেকে বলে, ঠিক খবর তো!

খুব ঠিক খবর। তবে খুব রমরম করে ব্যবসা করছে।

বীণা চুপ করে রইল। লোকটা ছোট্ট একখানা দোকান করতে চেয়েছিল। হয়-হচ্ছে করে হল না। কেন হল না? তখন বড্ড বীণার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত লোকটাকে। বীণার অন্য দিকে তাকানোর সময় ছিল না। লোকটা যে ভিতরে ভতরে বড় হতাশ হচ্ছে, মনমরা হয়ে যাচ্ছে, এটা দেখেও দেখেনি। বীণা। শেষ অবধি ভেবেছিল ডলার। আর পাউন্ড বেচে একখানা দোকান করে দেবে। তাও হল না। সব ফাঁস হয়ে গেল। ধৰ্মপুতুর নিমাই তো ও পাপের টাকা ছোবেও না। আজ য লোকটা বীণার সাহায্য ছাড়াই দাঁড়িয়ে গেল সেটাও বীণার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, তা বুঝতে পারছে না বীণা। তার ইচ্ছে করে একদিন গিয়ে দোকানটা ভাঙচুর করে দিয়ে আসে।

হ্যাঁ রে কুসুম, আমি খুব স্বার্থপর?

ওকথা কেন বলো বীণাদি?

তোর নিমাইদাদার জন্য কি আমার কিছু করা উচিত ছিল?

ও বাবা, ওসব আমি জানি না। তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার।

ওভাবে পাশ কাটাস কেন? তোর কাছে ভাল ভেবেই জানতে চাইছি। মানুষ তো সব সময়ে নিজেকে বুঝতে পারে না।

আমিও বুঝি না গো বীণাদি। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নিমাইদাদা লোক খারাপ ছিল না।

সবাই তাই বলে।

বীণা চুপ করে ভাবতে লাগল। তার ভাবনা-চিন্তাগুলো কিছু নিমাইয়ের পক্ষে গেল, কিছু বিপক্ষে গেল। তারপর কাটাকুটি হয়ে গেল। শুধু রইল বীণার বুকের জ্বালাটা।

আরও দুদিন পর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল বীণা। সোজা হাজির হল রিহার্সালে।

কাকা অবাক হয়ে বলে, টাইফয়েড খারাপ রোগ বীণা। অনেক সময়ে রিলান্স করে। তুমি এখনও কমজোরি। আরও সাত দিন বিশ্রাম নাও। তারপর রিহার্সাল।

ও বাবা, তা হলে আমি মরেই যাবো। রিহার্সাল ছাড়া আর আমার বাঁচা অসম্ভব। দিম আটকে আসছে।

কাজটা ভাল করছে না। বীণা ।

খুব ভাল করছি। পার্ট করতে করতে যদি মরেও যাই তাতেও সুখ আছে।

তা হলে করে! অনেক সময়ে মানুষ যা ভালবাসে তা করতে করতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

শরীর দুর্বল, মাথা ঝিম ঝিম, তা সত্ত্বেও বীণা কাজে নেমে গেল। প্রাণ ঢেলে অভিনয় করতে লাগল।

রিহার্সাল করতে রাত হয়ে গেলে দলের কেউ বীণাকে এগিয়ে দিয়ে আসে। অনেক সময়ে রিকশাতেও ফেরে। আজ কাকা তার সঙ্গে সজলকে দিল। সজল নতুন এসেছে। ছিপছিপে, লম্বা, শ্যামলা চেহারা! মুখচোখ খুব সুন্দর। দারুণ গাইতেও পারে।

সজল পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, তুমি এত ভাল পার্ট করো কি করে বলো তো বীণা! তোমার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।

বীণা মৃদু একটু হাসল। কিছু বলল না।

এ দলে থেকে তোমার কী হবে? সিনেমায় নামার চেষ্টা করো না কেন?

কে চান্স দেবে? সিনেমাওলারা কি গুণের দাম দেয়? কাকা আমার জন্য অনেক করেছে। এখানেই ভাল আছি।

ওটা কোনও কথা হল না বীণা। পৃথিবীটা যে কত বড় তা এই বনগাঁয়ে পড়ে থেকে কোনও দিন বুঝতে পারবে না। তোমার অনেক ক্ষমতা, তা কি টের পাও?

আগে স্তোকবাক্য শুনলে, প্রশস্তি শুনলে বীণা যত খুশি হত, আজকাল আর তা হয় না। কিন্তু খুশি না হলেও, একটু যেন ভাল লাগে ভিতরটা।

সজল বলল, তোমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে কি ডিভোর্স হয়ে গেছে?

বীণা গম্ভীর হয়ে বলল, না তো!

হবে নাকি?

না, ডিভোর্স হওয়ার মতো অবস্থা এখনও হয়নি। কেন বলো তো!

এমনিই। তোমার জীবনে একটা দুঃখ আছে বলেই বোধ হয় এত ভাল অভিনয় করতে পারো! নইলে এই নাটকটা তো পুরো বুল। এ নাটক যদি দাঁড়ায় তবে তোমার জোরেই দাঁড়াবে।

অত প্ৰশংসা করতে হবে না। যদি আমি অত গুণের মেয়েই হতাম, তা হলে এত দিনে বড় জায়গায় চান্স পেতাম। কলকাতার যাত্রাপাড়ায় ঘুরে এসেছি, কেউ পাত্তা দেয়নি।

আমি বলি কি, তোমার সিনেমায় একটু চেষ্টা করা উচিত। কখনও চেষ্টা করেছো?

না। সিনেমায় কে চান্স দেবে? আমার চেহারা মোটেই সিনেমায় নামার মতো নয়।

সজল অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে বলে, সে কি? তুমি তো রীতিমতো সুন্দরী। খুব ফটোজেনিক ফেস! কে বলল সিনেমার মতো নাও?

আমি জানি।

ভুল জানো। সিনেমায় নামার খুব শখ ছিল আমারও। কিন্তু হল না।

ও মা! তোমার হল না কেন? বেশ তো চেহারাটি।

হল না। কারণ, সিনেমার লাইনে ছেলেদের ভিড় বেশি, তাই চাহিদা কম। একজন ডিরেক্টর আমাকে বলেছিল, ভাই, তোমাকে চান্স দিতে পারব না, কিন্তু বোন-টোন যদি থাকে, নিয়ে এসো, তাকে চান্স দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।

বীণা হেসে ফেলল। তারপর বলল, মেয়েরাই বা কম যাচ্ছে নাকি? সিনেমায় চান্স পেতে কত মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টুডিওপাড়ায়।

সেসব হেঁজিপোঁজি। তোমার মতো গুণী মেয়ে কজন বলো?

বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কি জানো, আমাদের এত পেটের টান যে, কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু থাকে না। এই আমার কথাই ধরো। যদি অভাব না থাকত তা হলে যাত্ৰাদলে আসার কথা কি ভাবতে পারতাম? আমাদের বংশে কখনও কেউ এসব করেনি।

ওটা আবার কুসংস্কার। অভিনয় একটা বড় ব্যাপার।

তা জানি। কিন্তু অধিকাংশই তো আসে পেটের টানে। শিল্প-টিল্প নয়। খানিকটা টাকা, খানিকটা হাততালি আর খ্যাতি, খানিকটা গ্ল্যামার। একটা গুজব আছে, সিনেমালাইনে অনেক পয়সা। কিন্তু পয়সার যে গুনেগার দিতে হয় তা বুঝছে কজন?

আহা, তুমি তো আর অত বোকা নও।

আমিও আমার মতো করে বোকাই।

সত্যি করে বলো তো, তুমি কি অভিনয় করে নাম কিনতে চাও না?

বীণাপাণি মৃদু হেসে বলল, তাও চাই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চাই, প্রাণভরে অভিনয় করতে।

বীণাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে চলে গেল সজল। কিন্তু দুদিন পর আবার বীণাপাণিকে এগিয়ে এল।

বীণা, তোমার একা লাগে না?

লাগে। মাঝে মাঝে লাগে। তবে স্বামীর জন্য নয়। এমনি।

আমি তোমার কথা খুব ভাবি, জানো?

কেন ভাবো?

তা কি করে বলবো? তোমার অভিনয়, হাঁটা-চলা, ফিগার, গলার স্বর, গান সব কিছুই এত ইমপ্রেসিভ।

বানিয়ে বানিয়ে আর মিথ্যে কথাগুলো বোলো না তো!

মিথ্যে? তাও কি হয়?

মিথ্যেই তো।

সজল খুব চিন্তান্বিত হয়ে বলে, আমার মনে হওয়াটা ভুল হতে পারে, হয়তো আমি তোমাকে যতটা মনে করছি, তুমি ততটা নও। কিন্তু তা বলে আমাকে মিথ্যেবাদী ভেবো না।

দুদিন পর আবার দুজনে একা হল। নির্জনতা ছিল, পথ অন্ধকার ছিল, সজল তার একখানা হাত ধরে বলল, বীণা, আমার মাথায় একটা পাগলামি এসেছে। প্রশ্ৰয় দেবে?

নাটক করছো?

আমি একদম বাজে অ্যাকটর। অভিনয় জানিই না।

হয়তো, স্টেজের অভিনয় জানো না। অনেকে স্টেজে পারে না, কিন্তু জীবনে পারে, বাস্তবে পারে।

সজল হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, তা হলে থাক।

বীণা একটু মুচকি হাসল। কতদিনের জনা থাকল, তা কে জানে? সজল যে সহজে হাল ছাড়বে এমনটা তার মনে হল না। অখুশিও হল না সে। পুরুষহীন জীবন একটু আলুনি তো বটেই। এ পর্যন্ত বীণা নিজেকে অনেক আঁটবাঁধ দিয়ে ধরে রেখেছে। কিন্তু এই যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবে কে? টাইফয়েডের পর তার শরীর সেরেছে। একটু কি মোটাও হয়েছে সে? পুরনো অম্বলের অসুখটা আর নেই। এখন তার খুব খিদে পায়। ভাল ঘুম হয়। শরীর এখন অনেক কিছু চায়। মনটা বড় দোল খায় দিনরাত।

 

কাঁচড়াপাড়ায় নিমাইয়ের দম ফেলার ফুরসন্ত নেই। তার দোকান বড় খদেরদের জন্য নয়। ব্যাপারী, মুটে-মজুর, ঠিকাদারদের লোক, ট্রাকওয়ালা এদেরই ভিড় বেশি। দামে সস্তা, খেতে ভাল এমন খাবারের দোকান হলে ভিড় হবেই।

দুপুরবেলাটায় দুটো-আড়াইটের পর একটু ফাঁকা যায়। সে সময়টায় নিমাই একটু খেয়ে জিরিয়ে নেয়। রাতের চৌকিদারি এখনও ছাড়েনি বলে দুপুরের তন্দ্রাটুকু দরকার।

সেই তন্দ্রার মধ্যেই দোকানের ছোকরা এসে ডাকল, একজন আপনাকে খুঁজছেন।

নিমাই বলে, কী চায়?

বনগাঁ থেকে এসেছেন।

বনগাঁ! নিমাই একটু চনমনে হল। উঠে বলল, যা, যাচ্ছি।

চোখে জল-টল দিয়ে এসে যাকে দেখল, তাকে সে চেনে না। ছেলেটা বসে বসে মাংস পরোটা খাচ্ছে।

কিছু বলবেন আমাকে?

ছেলেটা তার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, আপনার দোকানের খুব নাম শুনেছি। বেশ রান্না তো এখানে!

ভগবানের দয়া। আপনি কি বনগাঁর লোক?

আজ্ঞে হ্যাঁ। একটু কথা ছিল।

নিমাই উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বলল, খবর আছে কিছু?

আছে। আমি কাকার দলে অ্যাকটিং করি।

কাকার দল শুনে বুকটা একটু চলকে গেল নিমাইয়ের। তার মানে বীণাকেও চেনে। ছেলেটার চেহারা ভাল। শক্তসমর্থ আছে। মুখখানাও বেশ।

নিমাই বলল, ও।

সজল হাত-মুখ ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এসে ফের চেয়ারে বসল।

একটা কথা বলবেন?

বলুন না!

বীণার সঙ্গে কি আপনার আবার মিল হতে পারে?

এ কথার কি জবাব হয়? নিমাই তো হাত শুনতে জানে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বীণা চাইলে হয়তো হয়। কিন্তু, বীণা আর চাইবে না।

কেন, বলুন তো।

সে অনেক কথা। সব বলা যাবে না।

বীণা না চাইলে হয় না?

না।

আপনি কি চান?

নিমাই মাথা নেড়ে দুঃখিতভাবে বলল, আমার চাওয়ায় কি এসে যায় বলুন! আমি তার চোখে পোকামাকড় বই তো নয়!

ছেলেটা কিছুক্ষণ বাইরের দিকে আনমনে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, ডিভোর্সের কথা ভাবছেন কি?

ডিভোর্স! না, সেসব ভাবব কেন? আমাদের মধ্যে একটা গণ্ডগোল আছে ঠিকই, কিন্তু ডিভোর্সের মতো নয়।

এভাবে আলাদা আলাদাই থাকবেন দুজনে?

উপায় কি?

উপায়! উপায় নিশ্চয়ই আছে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাস না করলে বিয়ে জিনিসটাই তো মিথ্যে হয়ে যায়!

নিমাই হাসল, স্বামী মরে গেলে স্ত্রী বিধবা হয়। বিয়ে মিথ্যে হবে কেন?

আপনি শাস্ত্রের কথা বলছেন, আমি আইনের কথা বলছি।

আইন! আমি তো আইন-টাইন জানি না। শাস্ত্রও জানি না। শুনে যা বুঝেছি। ভুলও বুঝে থাকতে পারি। আপনার নামটা কী আজ্ঞে?

সজল রায়। আমি নতুন এসেছি।

হ্যাঁ। পুরনোদের আমি চিনি।

ছেলেটা মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল।

আপনি কিছু একটা বলতে এসেছেন। সেইটে বলুন।

সজল মুখ তুলে একটু হাসল। বলল, কি ভাবে বলব, তা ভেবে পাচ্ছি না।

সোজা বলে ফেলুন।

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, আপনি রাগ করবেন।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রাগ করব কেন? আমার তার ওপর কোনও রাগ নেই। সে যা ভাল বোঝে করতে পারে, আমার কিছু আপত্তির কারণ দেখি না।

ছেলেটা ফের অধোবদন হল। মুখ না তুলেই বলল, বীণারও কিছু সংস্কার আছে।

নিমাইয়ের বুকে কোনও তোলপাড় হল না। ছেলেটা কী বলতে চাইছে তা সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে। তবু বুকে ঝড় উঠছে না। তার। শুধু যেন তার মনের মধ্যে সব আলো নিবে গেল। হঠাৎ সামান্য ধরাগলায় নিমাই বলল, ডিভোর্স চায় পাবে। কোনও বাধা নেই। তাকে বলবেন।

আপনি কী দাবি ছেড়ে দিচ্ছেন তা হলে?

নিমাই হাসল, দাবির কী আছে? দাবি-দাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। আমি তার উপর্যুক্ত ছিলাম না। কখনও। তাকে বলবেন আমার দিক থেকে বাধা হবে না।

ছেলেটা মাথা নিচু করেই বসে রইল।

নিমাই বলল, খাবারের দামটা দিতে হবে না। আপনি বীণার লোক, কুটুমই একরকম। দামটা দেবেন না।

ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। খুব মৃদুস্বরে বলল, তা হলে আসি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *