১. ইংরেজি আঠারোশো বিরাশি সাল

জগদ্দল  – উপন্যাস – সমরেশ বসু

০১.

ইংরেজি আঠারোশো বিরাশি সাল।

শীতের সকালবেলা, পৌষের শেষ দিক। দিন ছোট, রাত্রি বড়। লেপ-কাঁথায় মুড়ি দিয়ে রাত্রি কেবলি ওম করে। যাব যাব করেও যেতে চায় না। খুলি খুলি করেও খুলতে চায় না চোখের পাতা। আর একটু, আর একটু যাক। একলা হোক, দোকলা হোক, হোক ঘরগুষ্টির সবাই, তবু রাত্রি আর একটু থাকো এ কাঁথার তলায়। ওম কর গরম হও। আহা! ছিটেবেড়ার ছিদ্রটুকু কী সাংঘাতিক। পৌষের জাড় তার লক্ষ ফণা মেলে যেন ছোবলাচ্ছে ওই ছিদ্রপথে। একটু বুঝি সরে গিয়েছে গোলপাতার ছাউনি। টিন কি ফাঁক হয়েছে কোথাও একটু! জাড় আসে বুঝি ইঁদুরের গর্ত দিয়ে।…থাকো রাত্রি, এখনি যেয়ে না। উষ্ণ রক্ত এখন সারা শরীর জুড়ে বসিয়েছে মজলিশ, এখুনি তাকে ছুঁড়ে দিয়ো না শীতের কাঁটার বুকে।

কিন্তু দক্ষিণায়নের শেষ বাঁকা পথে যিনি চলেছেন, তাঁর সময় নেই। উত্তরায়ণের যাত্রা আসন্ন। তাঁর মুকুটের ঝলকানি রক্তরেখায় ছড়িয়েছে পুব আকাশে। আগমন ধ্বনি প্রচার করছে শালিকের শিস, টিয়েপাখির টি টি। আরও কত নাম-না-জানা পাখি প্রাণ ভরে পান করেছে জিরেন কাটের রস। গানে কাকলিতে হয়েছে মত্ত। ঝুটোপুটি খেলা চলেছে সিম-লাউয়ের মাচায়, গঙ্গার ধারে আর পুবের দিগন্তবিসারি ধান কাটা মাঠে, কলাই-মটরের খেতে।

আর নয়, আর নয়, এবার সব উঠেছে লেপ-কাঁথা ছেড়ে। জাগছে সেনপাড়া, আগুরিপাড়া, বাগদিপাড়া, জগদ্দল, মুসলমানপাড়া। কাঁচা সোনার মতো রোদ দিকে দিকে। পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে, সীমা থেকে অসীমে, থই থেকে অথই দূরে। সারা দেশ হতে মহাদেশান্তরে তার ছড়াছড়ি।

ফরাসডাঙা থেকে ভেসে আসছে উড়তিবাজনার শব্দ ঝন ঝন ঝ, ঝন ঝন ঝ..রাজকীয় বাদ্যবাহিনী বেরিয়েছে বড়সাহেবের সঙ্গে। বড়সাহেব অর্থাৎ ফরাসডাঙার গভর্নর বেরিয়েছেন চার ঘোড়ার গাড়িতে দৈনন্দিন ভ্রমণে কিংবা রাজ্যপরিদর্শনে। যে স্থানটিতে কিছুক্ষণ থেমে গাড়ি ফিরে আসে, সেখানটাকে লোকে বলে উড়তিবাজার। বোধ হয় বাজনার জন্যই জায়গাটির এই নামকরণ হয়েছে।

গঙ্গার এপারেও একটি রাজকীয় এক্কা গাড়ি চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। বড়সাহেব না হোক, এক্কার যাত্রীদ্বয় সাহেব, রাজার জাত। না, রাজা নয়, রানির জাত। রাজত্ব মহারানি ভিক্টোরিয়ার। এক্কার কৌচের পিছনে, হেলান-দেওয়া গদির মাথায় নকশাকাটা রুপোর পাতের মাঝে মিনে করা হয়েছে মহারানি ভিক্টোরিয়ার মূর্তি। এক্কার চালক, সাহেবদেরই নিজে একজন।

গারুলিয়ার দিক থেকে এসে, পুবে রেললাইনের ওপারে শ্যামনগরের গড় রেখে উত্তরের পথ ধরল এক্কা। গতি তার মন্থর। চোখে পেতলের ঠুলি-পরানো ঘোড়া কেশর দুলিয়ে লেজের ঝাপটা দিয়ে চলেছে। মাথায় ঝকঝক করছে পালক-লাগানো পেতলের শিরস্ত্রাণ।

কালীবাড়িতে বাজছে কাঁসরঘণ্টা। পাথুরেঘাটার পেসন্ন ঠাকুরের অর্থাৎ প্রসন্ন ঠাকুরের কালীবাড়ি। মেয়ের নামে কালীর নাম রেখেছেন ব্রহ্মময়ী। শ্যামনগরে তাঁদের জমিদারিতে ব্রহ্মময়ী অধিষ্ঠিতা। লোকে বলে বেহ্মময়ী। রেললাইনের ধারে একখানি ঘর, ঘরের বাইরে প্ল্যাটফর্মের শেষ সীমায় একটি ইট-সিমেন্টের পোস্টের গায়ে লেখা আছে SHUMNUGGER। বোধহয় ওটাই শ্যামনগরের ইংরেজি বানান।

সাহেবদের মধ্যে একজন সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে অপরজনকে কী যেন বলল। উভয়ে হেসে উঠে লাগামে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে গাড়ির গতি বাড়াল খানিক।

খানিকটা এসে হঠাৎ এক্কা থেমে গেল। দেখা গেল, অদূরেই কটি ছেলেমেয়ে কী যেন কুড়োচ্ছে মাটি থেকে। কিন্তু গোরার এক্কা আসতে দেখেই চকিতে পড়িমরি করে ছুটে কে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

সাহেব দু জন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল সশব্দে। কাছে এসে দেখল জায়গাটিতে মাটিতে ছড়িয়ে আছে অজস্র সাদা সাদা ফুল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা গাছের কোথাও কচি কচি ছোট ছোট সবুজ পাতা আর সমস্তটা ছেয়ে আছে থোকা থোকা সাদা ফুলে। কী ফুল? কৌতূহলবশত সাহেবরা মুঠো ভরে ফুল ছিঁড়ে নাকের কাছে ধরল। কোনও গন্ধ পেল না। ফুলগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে একজন চাবুকের ঘায়ে ঝরিয়ে দিল গাদা গাদা ফুল। কেঁপে কেঁপে উঠল পলকা ডালপালা।

কিন্তু চাবুকের শিস শুনে বলিষ্ঠ ঘোড়া আচমকা জোর কদমে ছুট দিল। শজনে ফুল কুড়োনোর দল আবার যেন মন্ত্রবলে কোথা থেকে ছুটে এল শজনেতলায়। যত না ফুলচচ্চড়ির শখ, তার চেয়েও বেশি হুতোশ, কে কত কুড়োতে পারে।

এদিকে লাগামে টান পড়তে পড়তে গাড়ি এসে পড়ল জঙ্গলপীরের উত্তর সীমানা বরাবর, পুলিশ স্টেশনের কাছে।

পুবে পশ্চিমে ঘন বন। পুবে কাঠুরেপাড়া। পশ্চিমে জঙ্গল। জঙ্গল খানিকটা সাফ করে রাস্তার ধারে ছিটেবেড়ার ঘর তৈরি হয়েছে। মাথায় টালি। কাঁচা মেঝে। সামনের দাওয়াটা নিকুচ্ছে একটি বউ। দাওয়ার বাঁশের গায়ে কাঠের ফলকে লেখা রয়েছে, AUTHPUR POLICE OUTPOST.

ঘোড়ার গাড়ির শব্দে বউ ওদিকে তাকিয়েই চমকে একেবারে লাফ দিয়ে উঠল। দু হাত ঘোমটা টেনে দিয়ে গোবরজলের হাঁড়ি নিয়ে পড়িমরি করে ঢুকল গিয়ে ঘরে। দুজন সেপাই ঘুমোচ্ছে চাদর মুড়ি দিয়ে। ঘরের এক কোণে একটি চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল। টেবিলে খানকয়েক খাতা। তার উপরে মাথা দিয়ে এলিয়ে পড়ে আছে রাইটার। এ অঞ্চলের শাসনকর্তা।

বউ ভয়ে হামলে উঠল, হেই বাবু, বাবু গো, দুটো গোরা এয়েছে গাড়ি নিয়ে।

রাইটার নিবারণ ঘোষ কুলীন কায়স্থ। বাড়িতে সে বড় সাত্ত্বিক। প্রথম যৌবনে সে দু বছর হুগলি স্কুলে পড়তে গিয়েছিল। তখন তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দু বছরের মধ্যে, এক বছর সে কিছু শেখবার চেষ্টা করেছিল। পরে সরস্বতী আর তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি, ফরাসডাঙার সুরাসুন্দরীকে তুষ্ট করতেই কেটে গিয়েছে। কিন্তু ওই এক বছরের দৌলতেই এই সরকারি চাকরিটি সে পেয়েছে। তবে ডিউটিতে এলে ফরাসডাঙার চোলাই করা দেশি লিকার না খেলে তার কাজে মন বসে না। আচ্ছন্নভাবে সে খেঁকিয়ে উঠল, চুপ কর মাগি। হারামজাদি খালি গোরার স্বপ্ন দেখছে। বউটা রাগ করল না। আরও গভীর ত্রাসে সে হেসে উঠে বলল, এ্যাই মরেছে! ওগো, মিছে লয় আয়টারবাবু, একবার চোখ মেলে তাকে দ্যাকো। মা গো! গোরা দুটো হাসতে নেগেছে এদিকপানে তাকে তাকে।

চোখ মেলবার আগেও রাইটার বললেন, যদি মিছে হয় মাগি, তবে তোকে

বলে চোখ মেলতেই লাল চোখ তার ঘোলাটে হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি গায়ের পশমি চাদর মাটিতে ফেলে সেপাই দুজনের উদ্দেশে সে চাপা গলায় হিসিয়ে উঠল, এ্যাই হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্ছারা, সায়েব এয়েছে রে। ওঠ তাড়াতাড়ি।

বলেই সে লম্বা ঠ্যাং ফেলে, খালি পায়ে ছুটে এল গাড়ির কাছে। গুডমর্নিং সার, গুডমর্নিং।

 সাহেব দুজনেই হেসে বলে উঠল, ভেরি গুড ইনস্পেক্টর, ভেরি গুড।

নিবারণ ঘোষ সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে বলল, নট ইনসপেক্টোর সার। আই নিবারণ ঘোষ, নট মিকম্যান ঘোষ, কায়েত ঘোষ সার। আই রাইটার।

সাহেবরা ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল, ভেরি গুড রাইটার, ভেরি গুড। রাইটারের তখন নজরে পড়েছে কাঠের পুতুলের মতো সন্ত্রস্ত সেপাই দুটোর দিকে। সেদিকে তাকিয়ে সে আবার চাপা গলায় খেঁকিয়ে উঠল, হারামজাদারা সেলাম দে না। শালারা যেন ঠুটো জগন্নাথ।

সেপাইরা সেলাম দিল। নিবারণ ফিরে হেসে বলল, দে আর লিটল কাস্ট সার, ডিসিপ্লিন নট নো।

ন্যাতাটি হাতে করে বউটা ঘরের ভেতর থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখছে। হাসছে আপন মনে আর ভাবছে, আয়টারবাবু কী দিগজ লোক! হড়বড় করে কেমন কথা বলছে সাহেবদের সঙ্গে।

সাহেবরা আবার হেসে বলল, ভেরি গুড রাইটার। হোয়াট ইজ দি নেম অব দি প্লেস? আউথপোর?

ইয়েস সার। এবং দক্ষিণ দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে ভুলল না, দেয়ার ইজ শুমনুগুর সার, রেলওয়ে ইস্টিসান অ্যান্ড বেহ্মময়ী কালী গডেস হাউস সার।

শুমনুগগুর অর্থে শ্যামনগর। SHUMNUGGER এই ইংরেজি বানানটা থেকে নিবারণ শ্যামনগরের এই সাহেবি উচ্চারণটা আয়ত্ত করেছে।

এবার একজন সাহেব বলল, অল রাইট। হোয়ার ইজ সেইন পারহা।

স্যানপাড়া? রাইটার উত্তর দিকের রাস্তা দেখিয়ে বলল, গো ইওর নোজ রাইট সার, ওয়ান মাইল নট (অর্থাৎ নাক বরাবর চলে যান, এক মাইলও নয়)।

সাহেবরা আবার ভেরি গুড দিয়ে লাগামে টান দিল। কিন্তু জোরে নয়, আস্তে। গাড়ি চলল টকাস টকাস করে। দুলছে ঘোড়ার মাথা। লোমছাঁটা মসৃণ গায়ে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। ঝকমক করছে রুপার পাতে মিনে করা ভিক্টোরিয়ার মূর্তি। ঘোড়ার মাথার শিরস্ত্রাণটা যেন উদ্যত তীক্ষ্ণ বর্শাফলকের মতো উঠছে আর নামছে।

পিছন থেকে নিবারণ ঘোষ সেলাম দিল কিন্তু সেটা ঠিকমতো পাত্রস্থ হল না। পুবে গাছগাছালি ডিঙিয়ে সূর্য উঠে এসেছে অনেকখানি। থেকে থেকে একটা কনকনে হাওয়া আসছে উত্তর দিক থেকে।

রাস্তার দু পাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গৃহস্থের আবাস। রাস্তার দিকটা ফাঁকা। বাড়িঘর সবই একটু ভেতর দিকে। লোকজন দেখা যায় না। দু পাশে এলোমেলো গাছের সারি। আম জাম খাঁটাল। ন্যাড়া ন্যাড়া বট অশ্বস্থ। ঘন ঘন শজনে গাছ। পাতা নেই, শুধু সাদা সাদা ফুল। বাঁকা বাঁকা ছুঁচোলো বকফুলগুলো যেন কোনও পাখির ধারালো ঠোঁটের মতো ঝুলে আছে। ইতিমধ্যে বোল ধরেছে কোনও কোনও আম গাছে। সোনা রুপোর মতো মেশানো তার রং। এঁচড়ের চেয়েও ঘোট ঘোট কাঁঠাল দু-চারটে ঝুলছে যেন লোমশ ইঁদুরের মতো।

ঘোড়ার গাড়ির শব্দে উৎকণ্ঠিত কাঠবেড়ালি ব্যস্তত্ৰস্তভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে পাতার আড়াল দিয়ে উঠে যাচ্ছে গাছের আগডালে।

কালো আর লাল ধুলোভরা চওড়া সড়কটা যেন মস্ত বাগানের একটা পথ। কোথাও রোদ, কোথাও ছায়া। পথে শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। তার মড়মড়ানি, গাড়ির ও ঘোড়ার পায়ের শব্দ এই শেষ পৌষের সকালে একটা অদ্ভুত ঐকতানের সৃষ্টি করেছে।

আতপুর। এখানে সেখানে সিম-লাউয়ের মাচা। শসার মাচা আর কলাবাগানে সবুজ পুষ্ট কলার কাঁদির নীচে ঝুলছে বিন্দু বিন্দু শিশিরে ভেজা লাল মোচা। চিতে আর মনসা বেড়ার ঘেরাওয়ের মধ্যে গৃহস্থের ফালি জমিতে শেষ পালং-এর ডাঁটা। শিষ পালং আর মুলো, কিছু বা মটর কলাইয়ের কচি কচি ডগা। বাঁশঝাড় আর গোরুর খুরের মতো বড় বড় আঁশওয়ালা রুক্ষ খেজুর গাছের চাঁছা কপালে ঠিলির নীচে মাটির কেঁড়ে। পাখি, মৌমাছি আর কাঠ-পিঁপড়ের ভিড় সেখানে।

রাস্তার এক পাশে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে রসওয়ালা। বাঁকের দুদিকে চারটে করে আটটা রসের হাঁড়ি। লোকে বলে কেঁড়ে। গাড়ি আর সাহেব দেখে সে একেবারে রাস্তার ধারে চলে গেল। তারপর হাঁ করে তাকিয়ে রইল সাহেবদের দিকে।

সাহেবরাও তাকিয়ে ছিল। একজন বলল, কী নিয়ে যাচ্ছে?

 আর একজন জবাব দিল, ওদের কানট্রি ওয়াইন। গাছের রস একরকম।

খেজুরের রসকে ওরা ওয়াইন বলেই বোধহয় মনে করে।

বাড়ির সামনে রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে একটি বউ। একপাশে জড়ো করছে শুকনো পাতার ডাঁই। শুকনো পাতা পুড়িয়ে রান্না হবে। সাহেব দেখেই ছুটল বাড়ির মধ্যে। কিন্তু কৌতূহল বড় ভীষণ। নারকেল গাছের আড়ালে গিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে বিস্ময়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখল সাহেবদের টাট্ট ঘোড়া আর ঝকঝকে গাড়ি। সাহেব তো নয়, যেন জোড়া গোরা যমদূত।

অদূরেই বসে আছে কয়েকজন লোক সকালের রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে খালি গায়ে, কাপড়ের খুঁট গায়ে দিয়ে, নয়তো শুকনো গামছা কানে মাথায় জড়িয়ে। থেকে থেকে উত্তরে হাওয়াটা কীরকম হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। হাতে হাতে ফিরছে হুঁকো। কনকনে হাতে গরম হুঁকোটা ধরতেও আরাম লাগে।

ঘোড়ার পায়ের শব্দে সবাই চমকে ফিরে তাকাল। গোরা সাহেবের গাড়ি আসছে। গারলের সায়েব, না তেলিনিপাড়ার? এদিকে কোথায়!..রাস্তা ছেড়ে দিল সকলে। দাঁড়াল গিয়ে একেবারে রাস্তার ধারে, ঢালু জংলাতে। ঠিক ভয় নয়। ভয়, বিস্ময়, অবিশ্বাস ও চেনা-অচেনার একটা বিচিত্র ভাব। তা ছাড়া, গোরা সায়েব, রানির জাত শাসনকর্তা।

কাছাকাছি এসে ঘোড়াটারও কোমর-দোলানি বেড়ে উঠল। সাহেবরা হাসতে লাগল বিস্মিত বিমূঢ় লোকগুলির মুখের দিকে তাকিয়ে।

কালো কালো মানুষগুলি। মুখগুলি কোনওটাই কামানো নয়। বাসি মুখ আর উসকো-খুসকো চুল। সাহেবদের হাসির জবাবে হাসা উচিত কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আগুরিপাড়ার তেসুতি কলের পাগলা সাহেবকে আতপুরের লোকেরা কেউ ভয় করে না। খ্যাখ্যাল করে হাসে, যাকে দেখে তার পিঠেই একটা চাপড় মেরে পাগলা সাহেব জিজ্ঞেস করে, কিমিন আছি দুস্ত।

পুবের বাগানের ঝোপ থেকে মেয়েলি গলার খিলখিল হাসি ভেসে এল। কাগজিলেবু গাছের ঝোপের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে একটি মুখ। যুবতীর বাসি মুখ। শক্ত চওড়া কাঁধে বেড় দেওয়া রয়েছে রুপোর হাঁসুলি। লেবুতলায় দেখা যাচ্ছে আলতা-পরা পায়ে মল। কমলি গয়লানির মেয়ে মুক্তা। বিধবা। আতপুরের লোকে বলে, শিরিষ সরকারের রাঁড়। অর্থাৎ রক্ষিতা। মুক্তা নির্ভীক। তার ভয় নেই, তার লজ্জা নেই। তার গলা ভেসে এল, এ যে আমাদের হেঁদোর জোড়া গোলা পায়রা গো।

অর্থাৎ জোড়া সাহেবকে বলছে। পুরুষরাও হেসে উঠল মুখ টিপে। সাহেবরা তাকাল ঝোপের দিকে। কালো মেয়ের হাসি সাদা পুরুষের সোনালি প্রাণে যেন তীর বিঁধিয়ে দিল।

একজন বলে উঠল, এ পাশের সায়েবটাকে তেলিনিপাড়ার অলিক সায়েব বলে মনে হচ্ছে যেন।

অলিক অর্থে ওয়ালিক। ঠিকই বলেছে লোকটা। অনেকদিন পরে ওয়ালিক এসেছে। চলেছে সেনপাড়া। তার বন্ধু নতুন মানুষ। পূর্ববঙ্গের সিরাজগঞ্জে তাদের কারখানা। কিন্তু বন্ধুটি নিজে কোনওদিন সিরাজগঞ্জে যাননি। সে বরাবর কলকাতাতেই ছিল। সম্প্রতি তাদের কোম্পানির একটা কাজ নিয়ে সে এ অঞ্চলে এসেছে। ওয়ালিক আতপুরকে কিছুটা চেনে, কিন্তু বন্ধুটি কৌতূহলভরে নিজেই সব একে তাকে জিজ্ঞেস করছে।

গোরা এয়েছে, ফিটিং গাড়ি এয়েছে।

সবাই মুখ বাড়িয়ে দেখতে আসে। আসে ভীত বিস্মিত ন্যাংটা ছেলের দল। তাদের শীত নেই। খালি গা। ধুলো-মাখা খড়ি-ওঠা গা।

অদ্ভুত এই দেশের কালো মানুষগুলি। ওয়ালিকের বন্ধু এদেশে এসে বরাবর কলকাতাতেই থেকেছে। প্রায় নমাস এসেছে সে এদেশে। পুরনো সাহেবদের ভাষায় গ্রিফিন। অর্থাৎ বিলেত থেকে যারা নতুন আসে, এবং এদেশের সব কিছুতেই নতুন শিক্ষানবিশী করে, পুরনো সাহেবরা তাদের গ্রিফিন বলে। নানান কথা শুনেছে দেশে থাকতে এদেশের লোক সম্পর্কে। তখন থেকেই তার মনে বড় একটা আশা ছিল, জীবনে একবার, তাদের সীমাহীন সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্যময়ী হিন্দুস্তানকে দেখতে হবে। ইয়র্কশায়ারের এক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে সে। লেখাপড়া শিখেছে লন্ডনে। সেই সময়েই শুনেছে এদেশের সতীদাহ এবং ওই শ্রেণীর আরও নানান ধর্মীয় নৃশংস কাহিনী। শুনেছে এদেশের কালো ফৌজের বিদ্রোহের গল্প। তার সারা গায়ের মধ্যে ঘৃণায় কাঁটা দিয়ে উঠেছে যখন শুনেছে কীভাবে ইংরেজ ও শিশুদের হত্যা করেছে। ছবিতে দেখেছে এদেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। জোফানি, বেকন, টমাস-ড্যানিয়েল যুগলের তুলিতে সারা ভারতের বিভিন্ন ছবি ইংলন্ডে অনেকের কৌতূহল কিছু মিটিয়েছিল হিন্দুস্তান সম্পর্কে। মনে আছে একবার টমাস-ড্যানিয়েল উইলিয়মের ওরিয়েন্টাল অ্যানুয়াল বই থেকে সে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মের ছবি নকল করবার চেষ্টা করেছিল। ছবি আঁকার একটা বাতিক ছিল তার। কিন্তু তাদের পরিবারে সেটা খুব সুনজরে দেখা হত না। ভীষণ গোঁড়ামির মধ্যে সে মানুষ হয়েছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের প্রতি একটা করুণা, অবজ্ঞা ও শাসনের অধিকার তার মজ্জায় মজ্জায় মিশে রয়েছে। পূর্বপুরুষদের কীর্তিতে সে গৌরবান্বিত। কিন্তু তার একটু কৌতূহলও ছিল এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে যুক্ত একটা কোম্পানির চাকরি নিয়ে সে এদেশে এসেছে। কলকাতাকে সে দেখেছে। ইংরেজি লেখাপড়া জানা অনেক নেটিভের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। কিন্তু কোনও লোকটাকেই সে প্রায় আলাদা করতে পারেনি। মনে হয় সকলে যেন একই রকম দেখতে, একই রকম কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ, চাউনি, সবই। তবু, গায়ের রং দেখে কাউকে কাউকে সে আলাদা করতে পারে। কিংবা পোশাক দেখে। রাস্তায় বেরুলে তো কথাই নেই। কারুর চেহারা সে আলাদা করে চিনতে পারে না। তার বড় কৌতূহল ছিল ভারতের নবাব-বাদশাদের দেখবার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কীর্তিগুলি এখন প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

তবু এদেশের লোকের সম্পর্কে তার কৌতূহলের অন্ত নেই। সে শুনেছে, তাদের কোম্পানির অনেক অসৎ প্রকৃতির নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী নেটিভ মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এমনকী এই ন মাসের মধ্যেই, শোনার পরিধি পেরিয়ে নিজের চোখেও সে কয়েক বাড়িতে লক্ষ করেছে। এবং এ সব সম্পর্কের অদ্ভুত সব কলাকৌশল দেখে নিজের দেশের লোকদের আর একটা নতুন পরিচয় সে পেয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার যে, এ ব্যাপারে নেটিভের হাতে দু-একজনের খুন হওয়ার কাহিনীও রয়েছে।

অথচ এও সে শুনেছে, এদেশের প্রকৃত বিউটিরা কখনও ঘরের আঙিনা ছেড়ে বাইরে আসে না। অর্থবান ও শিক্ষিত দু-চারটি পরিবারের এ পরিচয়ও সে পেয়েছে। তারা কথাবার্তায় পোলাইট, সবসময় বিগলিত একটা করুণ হাসি তাদের চোখে মুখে। ফিটন অথবা কদাচিৎ মানুষের ঘাড়ে বওয়া পালকি ও পায়ে হেঁটে তারা বেড়াতে বেরোয়। কিন্তু কখনও স্ত্রীকে নিয়ে বেরোয় না। তবু ভাল লাগা ও না লাগার মতো একটা ভাব তার। সেই সঙ্গে কৌতূহল।

আবার দেখা গেল সামনে রাস্তার উপর কতকগুলি লোক বসে আছে। ঘোড়ার পায়ের শব্দ পেয়েই লোকগুলি তাড়াতাড়ি সরতে আরম্ভ করল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কোলের কাছে নিয়ে বসা মালপত্রও সরাতে লাগল।

এটাকে যদি আতপুরের বাজার বলা যায়, তা হলে ক্ষতি নেই। রাস্তার ডানদিক ঘেঁষে একটা অশ্বথতলায় বসেছিল সব। তবে শীতের সকালে এদিক ওদিক ছড়িয়ে একটু রোদে পিঠ দিয়ে। লাউ, মুলো, পালং সব শীতের সবজি আর একজনের কাছে কিছু চুনো মাছ।

এই বাজারের বাঁ দিকে আতপুরের রাজার বাড়ি। আতপুরের রাজা নয়, যশোরের চাষড়ার রাজাদের বাড়ি। রাজার মায়ের গঙ্গার কোলে জীবনের শেষ দিন যাপনের ইচ্ছায় তাঁরা আতপুরে মাটি কিনেছেন। বাড়ির চারপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দোতলার অলিন্দের ছাতের নীচে দেখা যাচ্ছে বেলোয়ারি কাচের ঝাড় ঝুলছে। সূর্যের আলো পড়ে তার গায়ে লেগেছে নানা রং। বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে দুটি মন্দিরের চূড়া।

শব্দ ভেসে আসছে পবনপেয়ারির ঘণ্টার ঠুন ঠুন ধ্বনির। বৃদ্ধা হস্তিনী, পবনপেয়ারির গলার ঘণ্টা এখনও বাজে। আর এক হস্তিনী লক্ষ্মীপেয়ারি। সে আরও বৃদ্ধা হয়েছে। পবনপেয়ারির মতো তার চাঞ্চল্য নেই। তাই তার গলার ঘণ্টা বাজে যেন প্রহরের ধ্বনির মতো, মাঝে মাঝে, কখনও সখনও! রাজারা হাতি বাঁধবেন বলে কামাখ্যা পাহাড় থেকে একরকম গাছের চারা এনেছিলেন। সে গাছ যেমন শক্ত তেমনি দীর্ঘ। আজকে সে গাছ বড় হয়েছে, কিন্তু পবন-লক্ষ্মীকে তাতে বাঁধবার দরকার হয় না। না বাঁধলেও ক্ষতি নেই। আফিম না খেলেও তারা দিনরাত ঝিমোয়।

কিছুক্ষণের জন্য বাজার এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ছেড়ে দিল সাহেবের গাড়ির পথ। নতুন অচেনা সাহেব। এরা আর ওরা, পরস্পরকে তাকিয়ে দেখে। যেন রাজা ও প্রজার চোখাচোখি। না, যেন মানুষের সঙ্গে কোনও আজব জীবের চোখাচোখি।

ওয়ালিক বলল, ভিলেজ মার্কেট।

বলে হেসেই সে মাথার উপর দিয়ে চাবুকের আস্ফালনে শিস তুলে দিল। ঘোড়া মুহূর্তে একবার হকচকিয়ে ছুটল জোর কদমে।

নিঝুম ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাটার কোথাও কোথাও গাছের ডাল এত নীচে নেমে এসেছে যে, চালককে রীতিমতো সন্তর্পণে চোখে ঠুলি বাঁধা ঘোড়ার গতি ঠিক রাখতে হচ্ছে। ঝরাপাতা-ছাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা।

ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শুনে গাঁয়ে ঘরের মানুষ মুখ বাড়াচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ি এ পথে চলে ন মাসে ছ মাসে। তাই কৌতূহল সকলের।

কী গেল? গোরার ফিটিং গাড়ি। সকালবেলা! দে দে, তাড়াতাড়ি একটু গোবরজল ছিটিয়ে দিয়ে আয়, বাড়ির মান্‌ষেরা বেরুবে কী করে ওই পথ দিয়ে।

এরকম কথাও শোনা যাচ্ছে বামুনদের বাড়িতে।

.

০২.

সেনপাড়া। গাড়ি দাঁড়াল। বাঁয়ে গোরস্থান, ডাইনে মুসলমানপাড়া। তারই পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে। থিরপাড়ার ঝোপঝাড়ে-ছাওয়া সরু পথ। পথ হারিয়ে গিয়েছে ঘন জঙ্গলের মাঝে। জঙ্গলের কোল ঘেঁষে দূরে বড় বড় গাছের মাথা উঠেছে। পদ্মপুকুরের পাড় ওটা। সামনে ডাইনে-বাঁয়ে সেনপাড়া। সেনবাড়ি, হালদারবাড়ি, চক্রবর্তীদের বাড়ি, বোসদের বাড়ি। আরও দূর উত্তরে জগদ্দলের কোল ঘেঁষে আগুরিপাড়ার গ্রামের মাথা ছুঁড়ে উঠেছে ফোর্ড গ্লাসটার কোম্পানির তেসুতিকলের চিমনি। এখানকার লোকে বলে কলের চোঙা। সেই চোঙার মুখ থেকে অনর্গল ধোঁয়া বেরুচ্ছে। গাছের মাথায় মাথায় সবুজ বনানীর ঢেউয়ের বুকে হঠাৎ খাপছাড়া ভাবের একটা বিচিত্র জিনিস মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

ওয়ালিকের বন্ধু বলল, দাঁড়ালে যে!

ওয়ালিক চাবুক দিয়ে বাঁ কোণের সামনের দিকটা দেখিয়ে বলল, এটাই সেনপাড়া। দেয়ার ইউ সি মিস্টার লিটলজন, দেয়ার ইজ দি সেন হাউস। ওই ভাঙা বাড়িটা।

লিটলজন ঢাকনা-খোলা গাড়ির উপর উঠে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ বিচারকের চোখের ঔৎসুক্য নিয়ে সে তাকাল সেদিকে।

ইতস্তত কতকগুলি আম কাঁঠালের গাছ। নারকেল গাছও অনেক রয়েছে। তারপর একটা পাঁচিলের এবড়ো-খেবড়ো ভাঙা ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটি পুকুরের অংশবিশেষ। পুকুরের কোল দিয়ে উঠে গিয়েছে ভাঙা সিঁড়ি। চারপাশে তার বাঁধানো শানের গায়ে শেওলা ধরেছে, ভেঙে ফেটে বেরিয়ে পড়েছে ছোট ছোট নোনা ইট আর সুরকির পলেস্তারা। তার ছায়া পড়েছে পুকুরের কালো টলটলে জলে।

পুকুরপাড়ের ধারে ঘন বন পেরিয়ে জেগে রয়েছে সেনবাড়ি। ভাঙা ভাঙা ফাটল ধরা, চিড়-খাওয়া পুবে-পশ্চিমে লম্বমান বাড়ি। সবখানে ভাঙা নয়, মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে ফাটল ধরেছে। কোথাও পলেস্তারা নেই, সর্বত্র লাল ছোট ছোট নোনা ইটগুলি অজস্র ক্ষয়-পাওয়া দাঁতের মতো বেরিয়ে পড়ছে। সামনের দিকে দোতলার একটা খড়খড়িহীন জানালা, তার পাশের দরজার পাল্লা দুটো হাট করে খোলা। চোখের সামনে হঠাৎ অন্ধকার গর্তের মতো। যেন ওই শব্দ নিঝুম কয়েক-মহলা বাড়িটার চাপা-পড়া নিশ্বাস মুক্ত আকাশে মিশে যাবার একটা পথ করে নিয়েছে। দোতলার দক্ষিণ দিকে মানুষের মাথা পরিমাণ ঢাকা অলিন্দের স্বল্পপরিসর ফাঁকে ঘরের দেওয়ালের পুরনো হলদে রং দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে আলো-আঁধারির মধ্যে নকশা শিল্পের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

বাড়িটার উত্তরে আচমকা মাথা উঁচিয়ে রয়েছে একটা আধভাঙা কোঠার কিস্তৃতাকৃতি অংশ। তার বিস্তৃতির লক্ষণটা উত্তর-দক্ষিণে। লাগোয়া আর একটি বাড়ির ইশারার মতো জেগে রয়েছে। ওটা কাছারিবাড়ি ও জেলখানা সংলগ্ন গুদাম ঘরের অংশ।

ঠিক ধ্বংস নয়, ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন বাড়িটা। কোলাহল নেই। দেউড়ি দেখা যায় না এদিক থেকে, তাই দেখা যায় না লোকজনের চলাচল। তবু মনে হয়, বাড়িটা পোড়ো বাড়ি নয়। ঝিমধরা রিক্ততার মাঝে এর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে একটা অভূতপূর্ব গাম্ভীর্য। পাঁচিলের বিরাট পরিধির মধ্যে কতকগুলি বড় বড় গাছের ছায়ায় সমস্ত বাড়িটার গায়ে ফুটে রয়েছে নীরব আভিজাত্যের উদার ভ্রুকুটি।

হালদারবাড়িটা রাস্তার দিকে ঠেলে এসেছে। আরও কতকগুলি ইটের বাড়ি এপাশে ওপাশে মাথা উচিয়ে আছে, উঁকিঝুঁকি মারছে গাছগাছালির ফাঁকে। এ সব কিছুর উপরে উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ফোর্ড গ্লাস্টার কোম্পানির কারখানার কালো চোঙ। যেন সদর্পে আকাশে মাথা তুলে, একক বীরত্বের মহিমায় নির্বাক অহঙ্কারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখ থেকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে আসতে আসতে আবার উত্তরে উধাও হয়ে চলেছে। অর্থাৎ শীতের চাপ ঠেলে থেকে থেকে আসছে দক্ষিণ হাওয়া। তাই থেকে থেকে দুলে দুলে, উঠছে গাছপালার মাথা। ঝরে পড়েছে পাতা। সেনবাড়ির বাগান থেকে খাপছাড়াভাবে ভেসে আসছে একটা পাখির ডাক: কুহু! কুহু! একটু যেন বেসুরো, অসময়ের ডাকের মতো। যেমন নির্বাক বেদনার মাঝে বেসুরো কান্নার শব্দ।

হঠাৎ মনে হয়, এটা একটা পরিত্যক্ত নগর। লোক নেই, জন নেই সব নিস্তব্ধ।

কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকে ভিড় করেছে সাহেবের গাড়ি দেখে। কাছে নয়, দূরে দূরে আড়ালে আবডালে। কয়েকজনের ভিড় হয়েছে ঘোষের মুদি-দোকানের সামনে–আন্দু অর্থাৎ আনন্দ চক্রবর্তীর গাছতলার বৈঠকি বেদির উপরে।

ওয়ালিক বলল, ইট ইজ এ নাইস প্লেস।

লিটলজন বলল, আই থিঙ্ক সো। মি. ওয়ালিক, আই লাইক টু সি দি গ্যাঞ্জেস সাইড ভিউ, হুইচ ইজ ভেরি ইমপর্টেন্ট।

বলে সে গাড়ির তলা থেকে বার করল একটা লম্বা দূরবীন।

 লাগামে টান পড়তে গাড়ি বেঁকে গেল বাঁ দিকের সরু পথে। এ পথে আরও ঘন গাছ। আলো থেকে ছায়াচ্ছন্ন পথটাকে অন্ধকার সুড়ং বলে মনে হয়। গাড়িটা বাঁ দিকে বেঁকতেই হুড়মুড় করে কোথা এক পাল ন্যাংটো আধন্যাংটো ছেলের দল এসে ভিড় করল। তাদের সঙ্গে কৌতূহলী কয়েকজন বয়স্ক লোক। কাপড়ের খুঁট গায়ে দেওয়া গ্রাম্য গরিব মানুষ। এখানেও সেই একই কথা, তাঁবামুখ উটকপালে সায়েবটা তেলিনিপাড়ার অলিক সায়েব না?

ওয়ালিককে চেনে এখানকার অনেকেই। যারা চেনে তারা সায় দিল, অন্যান্যেরা হাঁ করে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্যমান গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে একটা বিতর্ক উঠে গেল দুই সাহেবের এখানে আসার কারণটা নিয়ে। বোঝা গেল বিতর্ক ঝগড়ায় পরিণত হতে চলেছে, আর ছেলের দল বুকে অথবা তলায় হাত চেপে ভ্রু কুঁচকে তাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল।

.

গাড়িটা গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়াল। সরু রাস্তাটা ডাইনে বাঁয়ে, দুদিকে চলে গিয়েছে। সামনে গঙ্গা। মাঘের গঙ্গার ভাঁটা-পড়া স্বচ্ছ জল ছোট ছোট ঢেউয়ের সঙ্গে চকচক করছে। স্থানীয় জেলে-মালারা নৌকা নিয়ে ঘুরছে জাল ফেলে। তারই মাঝে, পাড়ে সাহেবের গাড়ি দেখে, রোদ কপালে হাতের ছায়া দিয়ে হাঁ করে তাকাল। গঙ্গার ধারে চাষের জমিতে মৃদু হাওয়ায় দুলছে মটর-কলাইয়ের কচি কচি ডগা। হলুদ রঙের ছোঁয়া লেগেছে উচ্ছে খেতে। খেত-জমিতে কোথাও মানুষ নেই।

ওপারে ফরাসডাঙা। স্পষ্ট দেখা যায় ফরাসি গভর্নরের একতলা বাড়ি। মাথায় তার তেরঙা পতাকা উড়ছে। সেই বাড়ির পিছনে নতুন ফরাসি গির্জার কালো রঙের ক্রশটা নীল আকাশের গায়ে ঠেকে রয়েছে। গঙ্গার ধারেই, গভর্নরের বাড়ির দক্ষিণে কনভেন্টের হলদে দালান। তারও দক্ষিণে কনভেন্ট-সংলগ্ন একটি ছোট ভজনালয়। উত্তরে পুলিশ বিভাগের অফিস ও জেলখানা। গভর্নরের বাড়ির সামনেই রাজকীয় ঘাট। সাধারণের ব্যবহার নিষিদ্ধ। সুদীর্ঘ ইট-বাঁধানো লাল পথটা এখান থেকেও পরিষ্কার দেখা যায়।

লিটলজন চোখে দূরবীন লাগিয়ে দেখল চন্দননগরকে। তার রক্ত-রেখায়িত ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের বাঁকা রেখা ফুটে উঠল। গভর্নর হাউস দেখে তার হাসি পেয়েছে। তার মনে পড়ে গেল লন্ডনের প্রাচীন সম্পদের মধ্যে তাদের বীর সেনাপতি ওয়াটসনের চন্দননগর অবরোধের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভাস্কর্যের মূর্তিখানি। প্রাচীন রোমান আলগা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন ওয়াটসন। দক্ষিণে তাঁর শিখাধারী একটি বলিষ্ঠ পুরুষ শৃঙ্খলিত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে পড়ে আছে পায়ের কাছে। এই মূর্তি অবরুদ্ধ চন্দননগরের প্রতীক। আর বামে, তাঁর প্রসারিত হাতের মুক্তিপত্র গ্রহণের জন্য আকুলভাবে হাত বাড়িয়ে জানু পেতে বসেছে এক তরুণী। অবগুণ্ঠনহীন আধো উন্মুক্ত পীনপয়োধরা সুন্দরী। এই মূর্তি কলকাতার প্রতীক।

হঠাৎ হেসে উঠে লিটলজন বলে উঠল, এ নাইস ফ্রেঞ্চ ভিলেজ ইজন্ট? হা হা হা..।

কিন্তু ইতিমধ্যে গঙ্গার কিনারে দুলেপাড়ায় একটা সাড়া পড়ে গিয়েছে। মেয়েরা দুড়দাড় করে গঙ্গার ঘাট থেকে ঢুকে পড়ছে গ্রামের মধ্যে। পুরুষরা দূর থেকে সাহেবের ও গাড়ির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। একটা চাপা গুলতানির শব্দ শোনা যাচ্ছে: কে এয়েছে? সায়েব? জোড়া সায়েব! এক্কায় চেপে এয়েছে! কেন? মরণ! তা পেছনের পথ দে কেন? মুখপোড়ারা চোখ খেয়ে বড় সড়কটা দেখতে পায়নি? আ মলো, চোখের যন্তরটা যে এদিক পানেই ফেরাচ্ছে। দেখ কাণ্ড, কানা ঘোড়াটা যে এদিক পানেই আসছে।

সত্যিই ঘোড়া উত্তরে বাঁক ফিরল। সেনবাড়ির পাঁচিলের পাশ দিয়ে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে দুলেপাড়ার মধ্যে। রাস্তাটা চওড়া কম। গাড়িটার বাঁ দিকের চাকাটা আর আধহাত সরে গেলেই, খাড়া পাড়ের নীচে একেবারে গঙ্গায় গিয়ে পড়তে পারে।

পথের উপর বেঁধে রাখা গোরু খুলে সরিয়ে নিতে লাগল পাড়ার লোকেরা। এদিক থেকে সেনবাড়ির আর এক চেহারা। খানিকটা অংশ জুড়ে পুরনোর উপর নতুন সংস্কারের ছাপ। চুনকাম করা সাদা পরিচ্ছন্নতা। দরজা-জানালাগুলি রং মাখানো। মানুষের অবস্থিতি ও ব্যবহারের পরিষ্কার আঁচ পাওয়া যায়।

লিটলজন বলল, কত লম্বা ওয়াল, অ্যাজ ইফ দেয়ার ইজ নট এনড। বলে সে দূরবীনটা ওয়ালিকের হাতে তুলে দিয়ে গদির তলা থেকে চিজ ক্লথের সঙ্গে জড়ানো একটা কাগজ বের করল। চোখের সামনে সেটা খুলে ধরে সে ঝুঁকে পড়ল কাগজটার উপর। কাগজটা হালিশহর পরগনার একটা নকশা। নকশার উপরে লেখা রয়েছে, HAVELI PARGUNNA নতুন নকশার বুকে দক্ষিণের শেষে গাড়ুলিয়ার চটকলের চৌকোনা সীমানা চিহ্নিত। সেখান থেকে দু ইঞ্চি এগিয়ে লিটলজনের আঙুল থেমে পড়ল। তারপর আবার সে মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে দেখল সেনবাড়ি আর দুলেপাড়ার দিকে, দুলেপাড়া থেকে ওপারের ফরাসডাঙার তীরের দিকে।

ঈষৎ বঙ্কিম মিয়াজি পীরের কোল ভেতর দিকে ঢুকে, গোঁদলপাড়ার হুমড়ি-খেয়ে-পড়া উঁচু পাড় অনেকখানি ঠেলে এসেছে গঙ্গার বুকে। তারই গায়ে এসে মিশেছে এপারের গাড়ুলিয়ার ঘনগাছের মাথা। মনে হয় গঙ্গা ওইখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

সমস্ত দিক থেকে দৃষ্টিটা ঘুরে এসে লিটলজনের চোখ আবার ফিরে এল নকশার উপর। প্রথমেই তার চোখে পড়ল ফোর্ড গ্লাস্টারের কারখানার চিহ্ন, তার পরেই কাঁকিনাড়ার জার্ডিনদের সীমানা। জার্ডিনদের জমি ছাড়িয়েই গঙ্গার তীর ঘেঁষে সামান্য জায়গায় ছোট করে লেখা রয়েছে অস্ট্রিয়ান ল্যান্ড।

লিটলজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মি. ওয়ালিক, অস্ট্রিয়ানরাও এখানে ল্যান্ড কিনেছে? আর দে মেকিং এনি ফ্যাক্টরি?

ওয়ালিক দূরবীন দিয়ে তাকিয়েছিল দুলেপাড়ার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। সে দেখতে পাচ্ছে গাছের ও ঝোপের আড়ালে মেয়েপুরুষেরা তাদের দিকে তাকিয়ে জটলা করছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না যে, ওয়ালিকের নজর ছুঁয়ে ফেলেছে তাদের। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, অস্ট্রিয়ান ল্যান্ড? ও, ইয়েস, অস্টিয়ানরা অনেকদিন আগে খানিকটা জমি কিনেছিল খানখানাড়ায় (কাঁকিনাড়ায়। কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। জমি বিক্রি করে দিয়ে ওরা কোথায় চলে গিয়েছে। হয়তো এদেশের বুকেই কোথাও এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের একজনকে আমি দেখেছিলাম, একটা হাফ-ম্যাড ইয়ংম্যান, এই মাত্র কয়েক বছর আগে। একটা নেটিভ বোটে সে গঙ্গার বুকে ঘুরে বেড়াত, আর গান করত। মি. লিটলজন, হি ওয়াজ এ, নাইস ইস্ট ইওরোপিয়ান সিঙ্গার। এক একদিন গভীর রাতে গঙ্গার বুক থেকে তার দরাজ গম্ভীর ও মিষ্টি গলার গান খানখানাড়া থেকে ছুটে যেত বারাকপুর পর্যন্ত। সে গানের কোনও কথা বুঝতাম না, কিন্তু তার গলায় এবং সুরে এমন কিছু ছিল যে, আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠে অন্ধকারে বোবার মতো বসে সে গান শুনতাম। আমাদের রিভারগার্ডরা তাকে অনেকবার চ্যালেঞ্জ করেছে, একবার তিন সপ্তাহের জন্য খালখাটায় কয়েদ পর্যন্ত করেছিল। বাট হি ওয়াজ এ ম্যাড, এবসোলটলি ম্যাড। সেইখানেও সে গান করত, অ্যান্ড হি হেঁটেড আস। ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, আরমেনিয়ান, কারুর সঙ্গে সে মিশত না। তার বন্ধুত্ব ছিল এ দেশের কয়েকজন জেলের সঙ্গে। শুনেছি লোয়ার ক্লাস নেটিভদের অনেকের ঘরে সে যেত, খেত, পান করত। হি লাভড দিস কানট্রি। তার গানের কথার মধ্যে শোনা যেত, গঙ্গা বেনকাল মানে বেঙ্গল আর নেটিভদের দেশীয় নাম, ছিদাম বাকুলবাল্লা।

ওয়ালিকের গলা স্তিমিত স্বাচ্ছন্নের মতো শোনাল শেষের দিকে। যেন মধ্যরাত্রে জেগে উঠে বসেছে সে সেই অষ্ট্রিয়ানের পাগল করা গানের সুরে।

লিটলজনের মুখ দিয়ে খালি বেরিয়ে এল, স্ট্রেঞ্জ!

 একটু থেমে আবার বলল, স্ট্রেঞ্জ, হাউ হি লাভড দিস কানট্রি?

সে কথার কোনও জবাব দিল না ওয়ালিক। সে যেন কী ভাবছিল। হঠাৎ লিটলজন জিজ্ঞেস করল, মি. ওয়ালিক, ডু ইউ লাভ দিস কানট্রি? দিস কানট্রি? একটু বিস্ময়ের সঙ্গে হাসল ওয়ালিক। বলল, নেভার আই থট ইট। কিন্তু আমি এদের কিছু কিছু লোককে পছন্দ করি, র‍্যাদার ভালবাসি। যেমন ধরুন, কেদার মিস্তিরি, হি ইজ ও জায়ান্ট। আশ্চর্য! লোকটা আমাদের চেয়েও করিতকর্মা। লোকটা মেশিনের জাদুকর। ইয়েস, বাড়িয়ে বলছি না, আমরা যখন বেগড়ানো মেশিন নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাই, তখন সে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে তাকে বাগে নিয়ে আসে। ইউ মে সে, দ্যাট মেশিন ইজ লাইক টেমড টাইগার টু হিম আর লাইক গুড ফ্রেন্ড। কেদার মেশিনকে বলে, হোলো বিবি।

ওয়ালিক হা হা করে হেসে উঠল। লিটলজন কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওয়ালিকের মুখের দিকে।

গাড়িটা এসে তখন দাঁড়িয়েছে দুলেপাড়ার গায়ে। এখানে জমি খানিকটা ঢালু হয়ে হঠাৎ খাড়া উঠে গিয়েছে। গাড়িটা ওঠার অসুবিধা আছে। এখান থেকে সেনবাড়ির ভাঙা পাঁচিল ডান দিক দিয়ে বেঁকে পুবে চলে গিয়েছে। পাঁচিলের ধার দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তার উপর কয়েকজন লোককে দেখে লিটলজন হাঁক দিল, হেই, ইউ গুড মেন, কাম হিয়ার।

লোক কটা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। ঠিক বুঝতে পারল না, কাকে ডেকেছে। কালো দুলের বড় ছেলে হরি ছিল তার মধ্যে। কাছে না এসে ওখান থেকেই চিৎকার করে জবাব দিল, ফোট গিলাসটারের কল? হ্যাঁ এ পথেই যেতে হবেন।

লিটলজন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল ওয়ালিকের দিকে। ওয়ালিক হেসে বলল, ওরা ভেবেছে, আমরা ফোর্ট গ্লাস্টারের কারখানা খুঁজছি।

বলে সে গাড়িটা ডান দিকে ঘুরিয়ে খানিকটা ছুটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল হরিদের দলটার কাছে। আস্তে আস্তে দেখা গেল আরও লোক এসে ভিড় করছে সেখানে। বুড়ো জোয়ান আর শিশুর দল। কিছুটা কৌতূহল, বিস্ময় ও ভয় নিয়ে এসে সবাই দাঁড়াচ্ছে। এদিকে ওদিকে থেকে শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে বনজঙ্গলের এপাশ ওপাশ দিয়ে দু-একজন আসছে আগুরিপাড়া, বাগদিপাড়া, জগদ্দল থেকে।

ওয়ালিক হরিকে জিজ্ঞেস করল, টুমার এ গাঁয়ের কী নাম আছে? এইঠো, এ গাঙ্গা কিনারে গাঁও, কী নাম আছে?

হরি বলল, আমাদের এ গেরামটার কথা বলছ? এটা দুলেপাড়া।

ডুলিপাড়া?

লিটলজন ঝুঁকে পড়ে ম্যাপ খুলে, পকেট থেকে পেন্সিল বের করে একটা ছোট চিহ্ন দিল। গঙ্গার কোল ঘেঁষে ইংরেজিতে লিখল, ডুলিপাড়া। একজন জিজ্ঞেস করল হরিকে, কী জন্য এয়েছে সাহেবরা, কী চায়? হরি বলল, তা কি জানি বলো। জিজ্ঞেস করলে ও গাঁয়ের নাম কী, তাই বলে দিলুম।

হরির বলার ধরনেই হোক কিংবা যে কারণেই হোক, আগুরিপাড়ার একজন বলে উঠলে, তবে বলে দাও, আগুরিপাড়া কাছখানেই আছে।

হ্যাঁ, আর একজন বলল, আগুরিপাড়ার গায়ে বাগদিপাড়াটার কথাও জাইনে দিয়ো। খালি তোমাদের পাড়ার কথা বললেই তো হবে না।

যেন কোনও পাড়ার নামটা ফসকে গেলেই সেই পাড়াটাকে কোনও কারণে ঠকে যেতে হবে।

 হরি বলল, নিজেরাই যখন রয়েছ, বলে দাও না। আমাকে যা জিজ্ঞেস করেছে তা বলে দিইচি।

লিটলজন আর ওয়ালিক গাড়ি থেকে নেমে ততক্ষণ এগিয়ে গিয়েছে গঙ্গার জলের কাছে।

.

০৩.

ইতিমধ্যে একজন ছুটে গেল সেনবাড়িতে সংবাদ দিতে। সংবাদ পূর্বেই পৌঁছেছিল এবং সাহেবদের অভ্যর্থনার আয়োজনও চলছিল। ডেকে আনা হয়েছে পুরনো বাগদি সেপাইদের। অবশিষ্ট খান দুয়েক মরচেপড়া গাদা বন্দুক তাদের ঘাড়ে তুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সিংহ দরজার কাছে। খুলে দেওয়া হয়েছে সযত্নে রক্ষিত মজলিশ-ঘর। ঘর নয়, যেন গুমোট অন্ধকারের মধ্যে গুপ্ত নিশাচরের বাসস্থল। এ নববর্ষের বছুরকে ঝাড়পোঁছের দিন নয়, অসময়ে মজলিশ-ঘরের দরজা খোলা হল। অনেকদিন বাদে। অনেক বছর কেটে গিয়েছে। মজলিশ-ঘর খোলার কোনও প্রয়োজন ছিল না। থাকলেও অবস্থায় কুলোয়নি। মজলিশ-ঘর আজ তাই লোকচোখের আড়ালে শুধু বন্ধ জাদুঘর। আচমকা দরজা ককিয়ে ওঠা ও পৌষের উজ্জ্বল আলোয় যেন সেই জাদুঘরের নিশাচর অদৃশ্য জীবেরা চমকে উঠল, কুঁচকে উঠল তাদের জ্ব।

বর্তমান সেনকর্তা দুজন চাকর নিয়ে থমকে দাঁড়ালেন দরজার কাছে। আধো অন্ধকারের মধ্যে কারা যেন ছুটে ছুটে পালাচ্ছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। কাদের জমাটি মজলিশ ভেঙে গিয়েছে, অরসিকের হঠাৎ আগমনে কারা ছত্রভঙ্গ হয়ে সরে যাচ্ছে এদিকে ওদিকে। কারা?

হুস করে একটু হাওয়া ঢুকল ঘরটার মধ্যে। কে যেন হেসে উঠল জলতরঙ্গের স্তিমিত শব্দের মতো। চমকে উঠলেন সেনকর্তা। উপরের দিকে তাকালেন। বেলোয়ারি কাচের ঝাড় দুলছে একটু একটু। রামধনুর রঙের ছোঁয়া লেগেছে তার গায়ে। পুরু ধুলোর আবরণ ফুড়ে বিষণ্ণ হাসির মতো সে আলোর রেশ পড়েছে রেশমি গালিচার শ্বেতপদ্মে।

থিতিয়ে এল অন্ধকার। পুরনো নোনা ইটের ও ধুলোর গন্ধে ভরে গেল বাতাস। গালিচার উপরে ধুলোর আস্তরণ। তাকিয়াগুলিরও সেই অবস্থা। ঘরের একটা পাশ জুড়ে টেবিল ও ইংরেজি ফ্যাশানের গদি-আঁটা, বিলাতি সিলকের কাপড় দিয়ে মোড়া চেয়ার। কোথাও ছড়িয়ে আছে ছাতের ইট-সুরকির গুঁড়ো। চারদিকে ইঁদুর আরশোলার বিষ্ঠা। গালিচার কয়েক জায়গায় বেতাচড়া সাপের মতো এঁকেবেঁকে দাগ ধরিয়ে দিয়েছে পোকায় খেয়ে। একটু লক্ষ করলেই চোখে পড়ে অসংখ্য ছোট ছোট পোকা ছেয়ে আছে সমস্ত ঘরটায়। আর পৌষের এতখানি বেলাতেও কী ভীষণ ঠাণ্ডা ঘরটা যেন। হাড় কাঁপিয়ে দেয়।

দেওয়ালের চারপাশে বিলাতি প্রিন্টের রঙিন ছবি টাঙানো রয়েছে। পাশ্চাত্য সুন্দরী বিলাসিনীদের প্রসাধন, স্নান, মদিরাপান ও দ্রাক্ষাকুঞ্জে ভ্রমণের ছবি। আরও আছে আরবের নর্তকীর নৃত্য-বিলাস। সবই বিবর্ণ অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। সেখানেও পোকার আক্রমণের চিহ্ন।

সেনকর্তা হুকুম দিলেন শুধু টেবিল-চেয়ার পরিষ্কার করবার জন্য। আর জানালা খোলা হবে শুধু টেবিলের ও পাশের দুটো। বাদবাকি যেমন আছে তেমনি থাকবে। তাও অতি সন্তর্পণে, সাবধানে। অন্যত্র কোথাও হাত কিংবা পায়ের চিহ্ন না পড়ে। তাঁর সাহস হল না এ ঘরের সবকিছু ধরে টান দেওয়ার। মনে হল, সর্বত্র হাত পড়লে কোথাও থেকে একটা তীব্র চিৎকার উঠে সমস্ত সেনপাড়ার মধ্যে একটা ভয় ও কলরোলের সৃষ্টি করবে। হয়তো হুড়মুড় করে সমস্ত কিছু ভেঙে পড়বে। নির্দেশ দিলেন আলমারি খুলে বিলাতি গেলাস বাসন মুছে মুছে সাজানো হোক টেবিলের উপর। মোছা হোক ফুলদানি। অন্দরমহল থেকে আসুক গোলাপজলের বোতল। বাগানে খুঁজলে বোধকরি ঝোপে জঙ্গলে পাওয়া যাবে এখনও দু-চারটি গোলাপ নয়তো বিলাতি মরশুমি ফুল।

তারপর তিনি তাকালেন আর একটা বন্ধ দরজার দিকে। ওই দরজা খুলে আর একটা ঘরে যাওয়া যায়। সেই ঘরটার পশ্চিম দিকে প্রশস্ত দালান ও বারান্দা। সেখান থেকে দেখা যায় মাঝগঙ্গার ঢেউ, ওপারে ফরাসি গভর্নরের বাড়ি। ওটা নাচঘর। পিছল পাথরের মেঝের মাঝখানে নাচবার জায়গা নির্দেশ করছে সামান্য উঁচু পাথরের বেদি। সে বেদি প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের নকশা কাটা। পালিশে তার মুখ দেখা যায়। মানুষের পা পিছলে যাওয়ায় ভয় আছে তবুও গজলের তাল ফেরবার দ্রুত তালে নর্তকীর ঘুঙুর বাঁধা পা চকিতে অসংখ্যবার ঘুরে গিয়েছে।…ওই ঘরে আছে বাদ্যযন্ত্র, সেতার, এস্রাজ, পাখোয়াজ, মৃদঙ্গ। সানাই, ইংরেজি স্কুট, বেয়ালা আরও কত কী। তিনি নাম জানেন না।

দরজাটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন সেনকর্তা। না, ওই ঘরের দরজা তিনি খুলতে পারবেন না। খোলেনও না পারতপক্ষে। নিজে কোনওদিন নাচের আসর বসাতে পারেননি, ভাববার অবকাশও বড় একটা আসে না। তবুও ওপাশের বাগানটার দিকে যখন কখনও সখনও বেড়াতে যান, তিনি কেবলি চমকে চমকে ওঠেন। কিছু কি শুনতে পান? তাঁদের মির্জা ওস্তাদের জাদুকর গলার গানের তালে তালে লক্ষৌয়ের বাইজির নূপুরের ধ্বনি। নারী কণ্ঠের চাপা হাসি ও মদমত্ত পুরুষের বাহবা দেওয়ার অস্ফুট গুঞ্জন। কী জানি। কিন্তু কিছু শুনতে পান। হয়তো সেই নাচের ও হাসিরই শব্দ বাজে তাঁর বুকের তালে তালে।

বেরিয়ে এলেন সেনকর্তা মজলিশ-ঘর থেকে। ইনি যুবক। কিছুদিন আগেও নৌকায় চেপে হুগলি স্কুলে পড়তে গিয়েছেন। এখন আর যান না। যেতে ইচ্ছে করে না। অন্দরমহলের টানটা এতই বেড়ে গিয়েছে যে, বাইরে মন টেকে না। অন্দরমহল আসলে একজনকে নিয়ে। আরও আছে কিছু মেয়ে-পুরুষ, কিন্তু চোখে পড়ে মাত্র একজনকে; সেই সঙ্গেই পিতামহীকেও মনে পড়ে। আজকের এই সাহেবদের অভ্যর্থনার নির্দেশও ঠাকুরমাই দিয়েছেন আর তিনিও উৎসাহিত বোধ করেছেন। বুকের মধ্যে চাপা পড়া দেওয়ানি মর্যাদা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অভিজাত রক্তের অন্তঃস্রোতে দোলা লেগেছে। পুরনো দিনের কাল্পনিক মহিমায় নিজেকে অধিষ্ঠিত দেখবার জন্য ছটফট করছে প্রাণ। ডান দিকে তাকিয়ে দেখলেন, হেলে পড়েছে কাছারিবাড়ি। আঁকাবাঁকা অজগরের মতো ফাটল ধরেছে এখানে সেখানে। হয়তো অজগরই লুকিয়ে রয়েছে এর ফাঁকে ফাঁকে। এরই মধ্যে এখনও দুজন হিসাবরক্ষক রয়ে গিয়েছে। আগের আমলের কর্মচারীদেরই বংশধর এরা। হেলে-পড়া কাছারিবাড়িই তাদের বাসস্থান। খাওয়ার ব্যবস্থা এখনও সেনবাড়িতেই। মাসের শেষে কিছু আসে না, বছরে একটা নগণ্য সংখ্যার কিছু পাওয়া যায়।

ভেঙে পড়েছে জেলখানা বাড়ি। মাথা তুলে আছে শুধু এক পাশের পাঁচিল। না, সেখানে কোনও কয়েদির আর্তনাদ বা শেকলের ঝনাৎকার শোনা যায় না–শোনা যায় না বাগদি-সেপাইয়ের হুঙ্কার, কর্মচারীদের ব্যস্ততার গুঞ্জন।

কাছারিবাড়ির একটা জানালা দিয়ে দেখলেন, মরচে পড়া বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন সিংদরজার কাছে। স্বপ্ন নেমে এল চোখে। নিজের বয়স এত কম যে, কিছুই দেখেননি, সবই শুনেছেন। আজ মনে হচ্ছে, দরজায় সেপাই, কাছারিবাড়িতে হিসাবরক্ষক, মজলিশ-ঘরের সাজ, তার মাঝখানে তিনি। সেনবাড়ির দেওয়ানকর্তা। মনে পড়ছে ঠাকুরমার কাছে শোনা আগের কর্তাদের চালচলন ও ব্যবহারের কথা। রক্ত ও রক্ষণের গুণে আজ সেই ভূমিকায় তিনি নিজে। ভাবলেই গায়ে শিহরন লাগে, তোলপাড় করে বুকের রক্ত। চমকে উঠলেন হাসির শব্দে। কে হাসল? না, মজলিশ-ঘরের বেলোয়ারি ঝাড়লণ্ঠনের ঠুনগুন শব্দ। ঠিক যেন হাসির মতে, তাঁরই অন্দরবাসিনী, অষ্টাদশী প্রেয়সী, ঠাকুরমার সোহাগি নাতবউয়ের মিষ্টি চাপা গলার হাসির মতো। সোহাগে রাগে ও ঠাট্টায় নিয়ত ওই হাসি তাঁর কানে বাজে। সেনগিন্নির হাসি।

আজ কি ঠাকুরমা নতুন গিন্নিকে উপযুক্ত দেওয়ান-গিন্নির সাজে সাজাবেন। অবশ্য দেওয়ান-গিন্নি বলতে এ অঞ্চলে আজও তাঁর পিতামহীকেই সকলে জানে। এমন দিন কি আসবে, আর একজনকে এ দেশের লোকেরা দেওয়ান-গিন্নি বলে জানবে! একটা ছোট্ট নিশ্বাস চেপে এগুলেন তিনি। বাঁ দিকের প্রাচীরের ছোট দরজা ঠেলে পরিত্যক্ত দুর্বাঘাসে ছাওয়া চত্বর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে চললেন। হিসাবরক্ষক দুইজন পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করে বসে রইল। স্বাস্থ্যহীন বুভুক্ষু দুটি মধ্যবয়সি লোক। জরাজীর্ণ জামা কাপড়। অকারণ কাগজপত্রে ঠাসা ঘরের মধ্যে বসে আছে। পোকায় কাটা খাতা-খতিয়ানের ছড়াছড়ি। দোয়াতে জল মিশিয়ে মিশিয়ে কালি এখন চোখের জলের মতো সাদা হয়ে গিয়েছে। নিজেরাই চিলের পালক কুড়িয়ে নিয়ে এসে কলম বানিয়ে নেয়। কিন্তু লেখার বিশেষ কিছু নেই। কেন না, সেই পরিমাণে আয় ব্যয় কিছুই নেই।

সমস্ত কাছারিবাড়িটার পোডোভিটায় দুটি ভূতের মতো এই লোক দুটি বসে থাকে। ঘোরাফেরা করে নিঃশব্দে। চান করে গঙ্গায়। তারপর রান্নাবাড়িতে যায় খেতে। আগের থেকে খবর দেওয়ার দরকার হয় না। খবর দেওয়ার লোকও নেই, রান্নাবাড়ির সেদিনও নেই। খেয়ে এসে মান্ধাতার আমলের দুটি তক্তাপোশে দুজনে শুয়ে থাকে, ছারপোকা মারে, নিজেরাই কলকে সাজিয়ে তামাক টানে, ক্কচিৎকখনও পরস্পরে কথা বলে। বলারও বিশেষ কিছুই নেই। তারা দুজনে মিলে একটা হয়ে গিয়েছে। দুজনের কোনও আলাদা অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।

আজ সাহেব আসবে এমনি অভূতপূর্ব সংবাদও তাদের বিচলিত করতে পারেনি। শুনে তারা তেমনি মুখ চাওয়াচায়ি করেছে, ভাবলেশহীন চোখে বন্দুক নিয়ে বাগদিদের দাঁড়াতে দেখেছে, কর্তাকে আসতে দেখেছে, দেখেছে মজলিশ-ঘর খুলতে। কিন্তু একটু আলোড়ন হয়নি তাদের মনে। নিতান্ত আবশ্যকবশত পুরনো জামা দুটি গায়ে দিয়েছে, একটু জল ঢেলেছে দোয়াতে, খাতাপত্রের ধুলো ঝেড়েছে, কোকলকে সরিয়ে রেখেছে চোখের আড়ালে। তারপর চিলের পাঁশুটে পালকের কলম নিয়ে গালে হাত দিয়ে মুখোমুখি বসে রয়েছে। এমনকী, একটু কৌতূহল নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়েও দেখছে না। দেখলে মনে হয় তাদের ভাবনার শেষ নেই কিংবা সব ভাবনা শেষ করে জীবনের সব ওঠানামার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে তারা বোবার মতো। এই কাছারিবাড়িটার মতো।

অনেক শরিকে বিভক্ত সেনবাড়ি। তার মধ্যে অনেকে সব বিক্রি করে দিয়ে চাকুরে ও বিদেশবাসী হয়েছেন। এখন দুই শরিক আছেন। এর মধ্যে এক শরিক এখন একেবারেই সর্বস্বান্ত, দরিদ্র। অন্য শরিকের যুবক কর্তা। দেওয়ানি মহিমাটা এখন তাঁর উপরেই বর্তেছে, তিনিই সব, সব কিছুর মালিক।

তিনি এসে ঢুকলেন অন্দরমহলে। প্রাচীরের পর প্রাচীরে অনেক ভগ্নাংশের এক ভাগের অন্দরে এসে ঢুকলেন। সেখানে জনা তিনেক ঝি, এক বিধবা পিসিমা, ঠাকুরমা আর তাঁর নাতবউ। চাকর আসলে একজন, সে-ই খানসামা এবং আর সব কিছু। দরকার পড়লে তোক ডেকে নিয়ে আসা হয়।

উপরে উঠে দেখলেন, কাশ্মীরি চাদরের উপর একটা করে সাজানো হয়েছে সিল্ক, মুগা, বিলাতি ভয়েলের নানারকম পাঞ্জাবি আর চাদর। বুটিদার, কলিদার, মুড়িদার পাঞ্জাবির বোতাম-পটি ও গলায় সোনালি মুগা ও রেশমের সুচের কাজ। সেই সঙ্গে দেশি মসলিনের পাঞ্জাবিও রয়েছে একটা। আর ফরাসডাঙা ও শান্তিপুরের মিহি তাঁতের ধুতি। ভেলভেটের মতো চওড়া কালো পাড়, ধারে ধারে সোনালি জরির কাজ। এক হাত পরিমাণ জলচুড়ি দেওয়া বাহার। মসলিনের তৈরি দেওয়ানের শিরোভূষণ। দিল্লি থেকে আনা রুপোর গড়গড়া ও রুপোর তারে তৈরি নল।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন বৃদ্ধা দেওয়ান-গিন্নি। ভাবছেন, কী দিয়ে সাজাবেন আজ নাতিকে। সেনপাড়ায় সাহেব ঢুকেছে। এবাড়িতে তারা আসবে দেওয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। দেওয়ানের উপযুক্ত করে পাঠাতে হবে তো। অনেক বয়স হয়েছে দেওয়ান-গিন্নির। গায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে, তবু বোঝা যায়, গায়ের রং ছিল তাঁর ধবধবে ফরসা। ঠোঁট দুটি এখনও লাল টুকটুকে। ঝুলেপড়া চামড়ায় তাঁর টানা-টানা বড় চোখের ফাঁদ এখনও আঁকা রয়েছে।

পৌত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, এসেছিস? একটু তাড়াতাড়ি করে নে দাদা। মজলিশ-ঘর খুলেছিস? বেশ করেছিস। পোস্কার করছে তো? আচ্ছা, এবার তুমি নাও। বেদোকে বলিচি গরম জল করতে, তাড়াতাড়ি নেয়ে এসো। তারপর জামাকাপড় পরো। নাতবউ কোথা গেলি?

তিনি দেখতে পাননি তাই, কিন্তু নাতবউ দাঁড়িয়েছিল কাছেই, আর একটি দরজার পাশে। সে হাসছিল টিপে টিপে, আড়চোখে দেওয়ানবরের দিকে তাকিয়ে। আর দেখছিল দেওয়ানের পোশাক।

দরজার পাশে এ রূপ সেনবাড়িতে অভূতপূর্ব না হলেও কোনওদিক থেকে কম যায় না। সত্যি, রূপের ছটায় আলো হয়ে উঠেছে পাশের ঘরের কোল। কাঁচা সোনার মতো রং। টানা-টানা চোখের শাণিত সাদা ক্ষেত্রে ঈষৎ নীলচে চঞ্চল দুটি মণি। টিকোলো নাক। নাকে নাকছাবির ছোট্ট হিরাখণ্ড জ্বলছে যেন তার নিয়ত হাসি ও অভিমানের মতো। হাসিতে সুন্দর রক্তরেখায়িত ঠোঁট দেখলে বোঝা যায়, তা বিদ্রুপে বঙ্কিম হয়ে উঠতেও পারে।

ঠাকুরমার ডাকের মাঝখানে দুজনে চোখাচোখি করে হাসল। বউ ঠাট্টার ভঙ্গিতে ঠোঁট উলটে হেসে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে। তারপর কাপড়ের খস খস শব্দে এগিয়ে এল।

দেওয়ান-গিন্নি বললেন, নাতবউ এলি? যা তো ভাই, বামুনের মেয়েকে একটু তাড়া দিয়ে তুই খাবার দে নিজের হাতে। বেদোটা কী করছে? তারপর চলল দেওয়ানের সাজবার পালা।

.

০৪.

দুলেপাড়ার আনাচে কানাচে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে মেয়েরা। সাহেব ঢুকেছে পাড়ায়। নালা-খন্দ-জঙ্গল মাড়িয়ে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। কী যেন বলাবলি করছে আর কাগজে দাগ মারছে।

কালো দুলের বিধবা বুড়ির গলার তেজ আজও কমেনি। সে সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, বিষ্টাখেগোর ব্যাটারা গাঁয়ে ঢুকেছে কী করতে? পাড়ার মাগিগুলান যাবে কোন ইয়েতে অ্যাাঁ? আরে ও সায়েব ঢ্যামন মিনসেরা, ডাব-নারকোল খেতে চাস তো, পাড়ার মিনসেদের বললেই তো হয়!

হরি দুলে ছুটল তার মাকে সামাল দিতে। কিন্তু তার আগেই বুড়ির সঙ্গে ঝগড়া লেগেছে অন্য বাড়ির বউয়ের সঙ্গে। তবে সে ছিল বন্ধ ঘরের মধ্যে। ঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলছিল সে, হরি-ই তো পাড়ায় সায়েব ঢুকিয়েছে। সমস্ত দুলেপাড়ার মধ্যে ঝগড়ায় ও আলোচনায় রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল। তারপর কথায় বলে আর আনতে কুড়, তেমনি পরস্পরের মধ্যে ঘরোয়া কলহের লক্ষণ দেখা দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লিটলজন আর ওয়ালিক ফিরে এল জঙ্গল থেকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে তাদের মুখে। তারা আসতেই রাস্তার উপর পুরুষদের আলোচনা গুলতানি বন্ধ হয়ে গেল। সকলেই অবাক দুর্বোধ্য চোখে তাকাল সাহেবদের দিকে, আর কৌতূহলভরে লক্ষ করতে লাগল সাহেবের হাতের নকশা ও দূরবীন।

পৌষের বেলা বেড়ে উঠেছে অনেকখানি। গাছতলার ছায়া সরে গিয়ে রোদ এসে পড়েছে। শীত কেটে গিয়েছে। পৌষের শীত তো! আবার রাত্রে হাড় কাঁপাবে।

ঘাড় ঘুরিয়ে লেজ দুলিয়ে ছটফট করে উঠল ঘোড়া। লিটলজন লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে লাগামে হাত দিল।

হরি বলল ওয়ালিককে, এটুখানিক এগুলে পরেই স্যানবাড়ির সিংদরজা, বুইলে সায়েব!

ওয়ালিক ভ্রূ কুঁচকে বলল, স্যানবারি? ও! ইউ মিনসেন হাউস। ইয়েস, টুমার গাঁয়ের জমির কে আছে? মিস্টার সেন?

সবাই আবার মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল। মিষ্টি স্যান কে? মিষ্টি বলে তো কোনও কর্তার নাম ছিল না। হরি বলল, মিষ্টিবাবু-টাবুর কথা জানিনে সায়েব। আর আমাদের জমিদারের কথা বলছ? খানিক তোমার গে, শ্যামনগরের পদোক ঠাকুর মশাইয়ের (প্রদ্যোৎ ঠাকুর) আছেন, ছিরামপুরের গোঁসাইদেরও আছেন। কেন বলো তো?

কেন? হোয়াই? ওয়ালিক হেসে ফেলল। হেসে সে গাড়ির পা-দানিতে উঠে পড়ল। মসমস শব্দে দুলে উঠল দু চাকার গাড়ি। ঝকঝক করে উঠল মহারানি ভিক্টোরিয়ার মিনেকরা ছবি ও ঘোড়ার শিরস্ত্রাণ। তার পরেই লিটলজন লাগামে হ্যাঁচকা টান দিয়ে শূন্যে চাবুকের ঘা দিল।

চকিতে বলিষ্ঠ ঘোড়া একবার এক পা পিছনে এসে, তীব্র বেগে সামনের দিকে ছুটে চলল। ঘোড়া যেন পক্ষীরাজ। শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে, পাথর ভাঙার মতো খটখট ও চাকার ঘড়ঘড় শব্দে, পৌষের শুকনো পথের ধুলো উড়িয়ে ছুটল জোর কদমে। ধুলো ছড়িয়ে ঝাপসা হয়ে গেল গাড়ির পিছন দিক। তাদের গতিপথের নিশানা উড়ন্ত ধোঁয়ার মতো ধুলোর রেখা পুর থেকে দক্ষিণে শূন্যে উড়ে গেল। পিছনের মানুষগুলি হাঁ করে তাকিয়ে রইল সেদিকে। বিস্ময়ে ভয়ে বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন একদল কালো কালো বোবা জীবের মতো।

ঘোড়ার খুরাঘাতের শব্দে চমকে উঠলেন বৃদ্ধা দেওয়ান-গিন্নি! চাপা উত্তেজিত গলায় ডাকলেন, দাদু!

হ্যাঁ ঠাকমা, এবার আমি যাই মজলিশ-ঘরে।

যুবক সেনকর্তা দেওয়ানি পোশাকে ঝলমল করছেন। নীচে নামবার উদ্যোগ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন দোতলার বারান্দায়। কই, ঘোড়ার পায়ের শব্দ তো থামে না। সেনবাড়ির এই পুরনো ভিত কাঁপিয়ে সেই শব্দ যে নিরন্তর ছুটে চলেছে দূরে। স্তিমিত হয়ে আসছে শব্দ।

ফিরে তাকালেন বাইরের দিকে। খচ করে বুকের কাছে কী একটা আটকে দাঁড়াল তার নিশ্বাস বন্ধ করে। দেখলেন, পুবদিকের পাঁচিলের উপর দিয়ে ধুলো উড়ছে, উড়ে চলেছে, দক্ষিণ দিকে। ঘোড়ার পায়ের মাটি-বিদীর্ণ করা শব্দে সহস্র ঘোড়ার খুরাঘাতের মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেনবাড়ির খিলানে, অলিন্দে ও প্রাচীরে। হ্যাঁ, সেনকর্তার পায়ের তলায় বারান্দাটা খটখট শব্দে কাঁপছে।

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কোমর ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা দেওয়ান-গিন্নি। তাঁর ক্ষয়িষ্ণু বুকের হাড়ে হাড়ে শব্দ তুলে সাহেবের গাড়ি ও ঘোড়র পায়ের ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে। চোখে ঠাওর পান না। কিন্তু বুঝতে পারছেন শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। কান পেতে শুনলেন, দক্ষিণে উধাও হয়ে চলেছে খটখট ঘড়ঘড়ানি। রক্ত ঠেলে এসেছে তাঁর মুখের লোল চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। ফুলে ফুলে উঠছে ঝুলে-পড়া সরু নাক। রুগ্না বাকহীনার মতো জ্বর কাছে ঠেলে উঠেছে চোখ।

যুবক কর্তার স্ত্রী, বালিকা বধূ হতবাক। বিহ্বল হয়ে চেয়ে রয়েছে স্বামীর দিকে। মুখে এখনও লেগে রয়েছে হাসি, চোখে এখনও স্বামীর গৌরবের দীপ্তি ও স্বপ্ন। কিন্তু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে বুকের শ্বাসযন্ত্র। ঘোর নীল শাড়ির সোনালিপাড়ের ঘোমটা গিয়েছে খসে। ঘোড়র পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়া তার কাছে প্রায় অর্থহীন, তবু বুকের মধ্যে ওই শব্দ কাঁপছে থরথর করে। নিশ্বাস আটকে আসছে, জল আসছে চোখ ফেটে। মুখে কিছু বলতে পারল না, তবুও নিরর্থক অপমানে জ্বলতে লাগল তার বুক। মনে হল সামনে যেন যাত্রার দলের সং দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার দেওয়ানবর।

মাথাটা ভারী বোধ হল সেনকর্তার। মসলিনের দেওয়ানি শিরোভূষণ, গায়ে সোনালি কলিদার পাঞ্জাবির সূক্ষ্ম সেলাইয়ের গায়ে গায়ে ফুলের নকশা, সোনালি জলচুড়ি দেওয়া শান্তিপুরি কোঁচানো ধুতি, পায়ে ইংরেজি বুট জুতা। আর সারা ঘরে গাজিপুরি আতরের উগ্র গন্ধ।

হাওয়ায় সে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাইরে। মাঘের দুপুরে চৈত্র হাওয়ার ইশারা। বেলা বাড়ছে।

বন্দুক ঘাড়ে বাগদি সেপাইয়ের চোখের উপর দিয়ে পলকে বেরিয়ে গেল সাহেবের গাড়ি। ধুলো লাগল চোখে। চোখ ঘষে ঘষে লাল করে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে দুই সেপাই।

মজলিশ-ঘরের দুই চাকর বিলাতি কায়দার রুপার বাসন মুছতে মুছতে থমকে গেল। একটু হাওয়ায় আড়-ভেজানো মতো হয়ে গেল ঘরের দরজা। হঠাৎ মেঘ করার মতো অন্ধকার হয়ে এল। আর তারা বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল রুপার বাসনগুলির দিকে। শুনতে পাচ্ছে ঘোড়ার চলে যাওয়ার শব্দ। মজলিশ-ঘরের চার দেওয়ালে তা বাজছে।

কিন্তু নির্লিপ্তের মতো দুই হিসাবরক্ষক তেমনি বসে রইল। তাদেরও কানে যাচ্ছে সেই মিলিয়ে যাওয়া শব্দ। সেই শব্দের সঙ্গে ইলশেগুঁড়ির ছাঁটের মতো ছাতের থেকে ধুলো পড়ছে তাদের গায়ে। কোনও ভারী জিনিস পড়লে বা শব্দ হলেই এমনি পড়ে। সেজন্য তারা ভাবিত নয়। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তারা নামিয়ে রাখল পাখার কলম। সন্তর্পণে খুলল জামা, আড়াল থেকে বার করল হুঁকো কলকে।

.

০৫.

কখন সকলের অলক্ষ্যে লখাই এসে দাঁড়িয়েছে দুলেপাড়ায়। যেখানে সব মানুষগুলি দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে খানিকটা দূরে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে, জ কুঁচকে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে আকাশে ধুলোর রেশ। তারও কানে বাজছে ঘোড়র পায়ে মিলিয়ে যাওয়া শব্দ। কানে নয়, তার বুকে বাজছে। সেই খটখটানি হাড়ে হাড়ে বিষ কেউটের মতো পেঁচিয়ে ধরল ব্যথার কনকনানিতে।

দুলেপাড়ার বুড়ি ও বউয়েরা বেরিয়ে এসেছে আনাচকানাচ কোণঘর ছেড়ে, সদরে পুরুষদের কাছে। ঘেঁষে এসেছে সোয়ামিব্যাটার কাছে। কী জন্যে এয়েছিল ওই মুখপোড়া গোরারা?

সমস্ত সেনপাড়ার বৃহত্তম চৌহদ্দি স্তব্ধ, আড়ষ্ট। যেন ভূমিকম্পের পর বেঁকে দুমড়ে গিয়েছে সারা গ্রামটা।

শুধু আগুরিপাড়ার তেসুতি কলের চোঙা দিয়ে একই গতিতে বেরুচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আর এই গ্রাম্য নিঝুমতার মধ্যে একটা ঝিঁঝির ডাকের মতো শোনা যাচ্ছে তার বয়লারের শোঁশো শব্দ।

ঠিক এই স্তব্ধতার ক্ষণিক মুহূর্তে গঙ্গার বুক থেকে ভেসে এল জোয়ান গলার উচ্চ হাসি। তাকে অট্টহাসি বলাই ভাল।

ডাঙার উপরে ভিড় করা মানুষের দল সবাই একযোগে ফিরে তাকাল সেদিকে। দেখল গঙ্গার জল তোলপাড় করে দুটো মানুষ পাড়ের দিকে সাঁতরে আসছে। সাঁতারের হুড়াহুড়ি খেলা ও তাদের হাসির মতো ছিটকে যাচ্ছে সূর্যের কিরণে।

এই মুহূর্তে এই হাসি অশুভ ছায়ার মতো সকলের মনে যেন একটি ভীতির সঞ্চার করল। সকলেরই মনে হল একটা অমঙ্গলের ভৌতিক ছায়া চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। নইলে ঠিক এসময়েই খ্যাপা হাঙরের মতো দুটি মানুষ কোত্থেকে পাতাল ফুঁড়ে উঠল গঙ্গার বুকে আর কেনই বা এই বুক কাঁপানো হাসি।

গঙ্গার বুক থেকে একজন আগে উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে হাসতে হাসতে বসে পড়ল থপ করে মাটির উপর। আর একজন উঠে এল তার পিছনে। তারপর দুজনেই গলাগলি করে আর একদফা উচ্চহাসিতে ভরে দিল পৌষের নির্মেঘ আকাশ। হাসি ছড়িয়ে গেল গঙ্গার বুকে।

একজনের কৈশোর কেটে গিয়ে যৌবন এসেছে আর একজনের কৈশোর প্রায় অতিক্রান্ত। কিন্তু দুজনেই সবল। তাদের কালো বলিষ্ঠ পেশিবহুল শরীরে পিছলে পড়ছে পৌষের রোদ। চকচক করছে জলে-ভেজা শরীর। বড়টি মধু, শ্যামের ছেলে। আর একজন গোলাম, মৃত গনি মিঞার ছেলে।

আর একজন ছুটে এল গঙ্গার ধারের উত্তর দিকের মনসা চিতের জঙ্গল আন্দোলিত করে। সে শিশু বালক। বাঁ হাত দিয়ে মুঠি করে ধরেছে সে কোমরের খুলে-পড়া কাপড়ের ফালি, ডান হাতে তার পেয়ারা কাঠের হাতুড়ি। লখাইয়ের ছেলে হীরালাল। সে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল দু জনের উপর।

চিৎকার করে বলল, আমি দেখতে পেইচি, মধু দাদা, তুই আগে এইচিস।তারপর তারা তিনজনেই একসঙ্গে এগিয়ে এসে দলটার সামনে বিস্মিত জিজ্ঞাসু চোখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তাদের চাউনির রকম দেখে এক মুহূর্তের জন্য তারা তিনজনেই একটু থমকানো বিস্ময়ে মুখ চাওয়াচায়ি করল পরম্পরে।

গোলাম বলল, কী হল রে মদো?

মধু বলল, কী জানি। আমাদের যেন চিনতেই পারছে না।

হীরালাল বলল ফিসফিস করে, এদের সঙ্গলার শীতলে মা ভর হয়েছে, না?

 মধু বলল খানিকটা আপন মনে, অ! কালো দুলের বুড়িটা মরেছে বুঝিন?

গোলাম কী একটা জবাব দেওয়ার উদ্যোগ করতেই দুলে বুড়ি ভাঙা খরখরে গলায় একেবারে হামলে পড়ল এসে, মরব কেনরে ড্যাকরা! ওই মোষের মতন শরীলটা নে তুই মর না।

নেও ঠ্যালা! মধু, গোলাম অবাক হয়ে আবার মুখ চাওয়াচায়ি করল। মধু বলল, ঘাট হয়েছে বাবা, তা, বলবে তো, এমন ভূতের মতন সব দাঁড়িয়ে আছ কেন?

তা বললে বুড়ি মানবে কেন! কোঁচকানো চামড়া কাঁপিয়ে বুড়ি আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, তোদের সোখের দশা দেখচিরে। তোদের মরণ সোখের দশা!

কে একজন বলে উঠল, সোখ-ই বটে। হাসি শুনে আমার গায়ে কাঁটা দে উঠেছে। ভাবনু কী বলে যে সেই মরাখেগো ভৈরবটা এল নাকি। এবার আরও কয়েকজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মেয়েমানুষের সরু কাঁপানো গলা শোনা গেল, মা…মাগো! অক্ষে করো মা!

অমঙ্গলেরই ছায়া বটে। যখন তখন খ্যাখ্যাল করে হাসি, চলতে ফিরতে হাঁচি কাশি, উঠতে বসতে কান্নার ডুকরানি, সে যে টিকটিকির ট্যাকট্যাকের মতোই শুভ পথের বাধা। সে কি আর মানুষের হাসি কান্না হাঁচি।

অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সের একজনকে জিজ্ঞেস করল মধু, কী হয়েছে র‍্যা বেষ্টা। এ যে শালার বোবার রাজ্যিতে এলাম। তোদের কি পেট ফোলে না? আমি হলে কখন বলে দিতুম।

বিষ্টু দুলেকে এমনিতেও জবাব দিতেই হত। গত দু-তিন বছরের মধ্যে মধু এ অঞ্চলে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে। হাড়ি বাগদি দুলে ডোম, এদের উপর মধুর প্রতিপত্তি আজ অখণ্ড। কথায় বলে লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়। আর ছল বল কৌশল, এই তিন গুণে সে গাঁয়ের সকলের সেরা। এর মধ্যে ঘেন্না বলে বস্তুটা তার নেই কিনা জানি না, কিন্তু এ বয়সেই শক্তিতে সে অদ্বিতীয়। এই সেনপাড়া-জগদ্দলে অতীতে অনেকের লাঠিখেলায় নাম ছিল। শুধু খেলা কেন, জীবিকা ও পেশা হিসাবেও অনেকে লাঠিকেই জীবনের সঙ্গী করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকে, মৃত বা জীবিতরা, আজও সকলের মনে বীর হিসাবেও ভয় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছে।

যুবক মধুও আজ সেই আসনে অধিষ্ঠিত। তবে বুড়োদের শ্রদ্ধা তার প্রতি নেই, একটা ভয় আছে। এটাই বরাবর চলে আসছে। কিন্তু যুবকেরা ভয় ও ভক্তি করে। মধু যখন লাঠি হাতে নিয়ে মাঠে নামে, তখন তার চেহারার দিকে তাকাতেও ভয় করে। তার আগুনে চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, মাথাটা এমনিতেই বোধ হয় দু ফাঁক হয়ে পড়বে। লাঠি তার হাতে অসাধ্য সাধনের জাদুকরের ডাণ্ডা। তা ছাড়া, মধুর দুঃসাহসের কাছে কোনও কিছুই আটকায় না। তার কোনও কিছুতে রাখ-ঢাক নেই, আচার-বিচার নেই। দিনে বলল আর অমাবস্যার অন্ধকার রাতে বলো তার অগম্য স্থান নেই। তার মানামানি জ্ঞান দেবদেবীর দোহাইয়ের সীমারেখার বাইরে। তাদের সমাজের জীবনযাত্রার প্রতি কোথায় তার একটা ঘোরতর অবিশ্বাস নিজের অজান্তে কাজ করে চলেছে। তার কাছে বিশ্বাস ও বিস্ময়ের বিষয় হল ইংরাজের যন্ত্র, তার অভাবনীয় কৌশল। এ বিষয়টি তার আয়ত্তের বাইরে।

আর সব বিষয়ে তার সঙ্গী গোলাম। হীরালাল এখনও নিতান্ত বালক।

কিন্তু লোকে তাকেও বলে, ডাকাবুকোর পুঁচকে দোসর।

 বিষ্টু দুলে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, সায়েব এয়ছেল।

সায়েব! গোলাম আর মধু হা হা করে হেসে উঠল। কোন সায়েব?

তেলিনিপাড়ার সেই অলিক সায়েব, আর এট্টা লতুন ঠেকল চোখে।

গোলাম আর মধু আবার দুলেপাড়া চমকে আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল। মধু বলল, সায়েব এয়ছেল তো কী হল? তোরা অমন ঘেবড়ে কেন গেইচিস? তাদের প্রতি গালাগাল ও অভিশাপের গুলতানি উঠল। বিষ্টু বলল, ঘেবড়ে যাইনি। সায়েব দুটো গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে একেবারে খ্যাপা শোরের মতো এপাশ ওপাশ করে কাগজে কীসের দাগ মেরে নিয়ে গেল।

যাঃ শালা, আমি ভাবলুম কী না জানি ঘটেছে! চল চল।

 বলে তারা আবার হেসে উঠল। সেই সঙ্গে হীরালালের কচি গলার হাসি মিশে, যেন একটা চড়া সুরের ঝংকার সৃষ্টি করল।

হরি দুলের আর সহ্য হল না। সে চেঁচিয়ে উঠল, থাম মাকড়ারা থাম। ভূতের মতো হাসতে হয়, বাঁশঝাড়ে যা।

মধু ফিরে দাঁড়াল। গায়ে তার জল শুকিয়ে গিয়েছে, বোধহয় শীতের শিরশিরানিতেই গায়ের পেশিগুলি তার শক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু চোখ দুটি তার হঠাৎ কুঁচকে ছোট হয়ে এল। তার মায়ের বড় বড় চোখ দুটি বয়সকালে খেপে গেলে এমনি তীক্ষ্ণ ও ভয়ংকর হয়ে উঠত। সে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে হাসলেই বা কে ঠেকায়?

আবহাওয়াটা থমথমিয়ে উঠল। একটা রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত। সকলেরই নজর হরি ও মধুর দিকে। অবশ্য হরির বয়স হয়েছে। শক্তিমান হিসাবেও কোনওকালে তার নাম নেই। সেইজন্য সকলের সন্ত্রস্ত নজরটা মধুর দিকেই বেশি।

হরির মা তাড়াতাড়ি হরির হাত চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল, ফিরে আয় বাবা, ফিরে আয়। মা কালী ওর বিধেন করবে। মা শেতলা ওর ওই ডাকাবুকের পাটা যেন ভাঙে, ভাঙে, ভাঙে।

মা কালীর কাছে বুড়ির এ অভিশাপের উপচারে সাজানো ডালি মধুর আবার চড়া গলার উচ্ছল হাসিতে যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

গোলাম বলল হাসতে হাসতে, শকুনের শাপে গোরুও মরেছে আর মাছিতে যেয়ে খবরও দিয়েছে।

কিন্তু হীরালালের ছোট্ট মুখখানি রাগে ও ঘৃণায় অপরূপ হয়ে উঠেছে। তার শিশুর সরল হৃদয় ও-অভিশাপকে সহজে উড়িয়ে দিতে পারল না। সে মধুর উপযুক্ত সঙ্গীর মতো হিসিয়ে উঠল, হাঁকব এট্টা হাম্বরের ঘা, মাথা ফেটে হাঁ হয়ে থাকবে।

যেন বজ্রাঘাত হল। রাগে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইল সবাই হীরালালের সাহস দেখে। লখাই এতক্ষণ সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করছিল। হীরালালের রাগ দেখে ও কথা শুনে তার রণচণ্ডী কাঞ্চী বউয়ের চেহারা মনে পড়ে গেল। সে ওখান থেকেই হাঁক দিল, হীরা!

সেই গলা শুনেই হীরা এক লাফে পেছনে ফিরে দিক-পাশ না দেখেই ছুট দিল পড়িমরি করে। এমনকী মধুও লখাইকে দেখে মাথা নামিয়ে নিল। এখনও এই লোকটাকে সে মানে। লখাই খুড়োর উপরে আজও কথা বলতে তার বাধে। সে বিনা বাক্যব্যয়ে গোলামকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল সেখান থেকে। সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন অল্পবয়সি জোয়ান।

সকলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। কিন্তু দু-একজন দুঃসাহসিকা যুবতী দুলে ঘরনির তৃষ্ণার্ত প্রশংসমান দৃষ্টি তখনও সমস্ত ভয় ও শাসনের বাধা ডিঙিয়ে অনুসরণ করে চলেছে মধুকে।

লখাইকে দেখে যুগপৎ বিস্ময়ে ও স্বস্তিতে সকলে হাঁফ ছাড়ল বটে। কিন্তু ভুলতে পারল না হীরা মধু গোলামের অসহ্য স্পর্ধার কথা। ভুলে গেল সাহেবের কথা। আপাত মুহূর্তে চাপা পড়ে গেল সমস্ত ভয়, সন্দেহ, সাহেবের আলোচনা। সকলের বিস্ময় ভয় ও রাগ এসে কেন্দ্রীভূত হল বিশেষ করে মধুর উপর। লখাইকে দেখেই তারা আর সব ভুলে গেল। বিদ্রোহী অজেয় মধুর বিরুদ্ধে এই সমস্ত অঞ্চলে অভিযোগ ও শাস্তির দাবি করার একমাত্র মানুষ লখাই। তারা সকলে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল লখাইয়ের দিকে।

তেমনি লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা লখাইয়ের। কিন্তু বলিষ্ঠতার সেই তেজোদৃপ্ত ভাব নেই। সে বৃদ্ধ হয়নি, প্রৌঢ় দেহে তার আজও অমিত শক্তির জেল্লা ফুটে রয়েছে প্রতিটি মাংসপেশিতে। তবু কোথায় যেন একটা ভাঙন ধরেছে। গোপন সর্বনাশের মতো, দৃষ্টির আড়ালে মহামহীরুহের প্রাণকেন্দ্রের শিকড়ে পোকা খাওয়ার মতো সে ভাঙন বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তবু সেই ধ্বংসের চিহ্ন যেন কেমন করে আঁচ করা যায়। অথচ দেখা যায় না।

লখাই এসে দাঁড়াল সকলের মাঝখানে। সকলকে ছাড়িয়ে উঠেছে তার মাথা। মাথার কাঁচা-পাকা চুল বাবরি হয়ে লতিয়ে পড়েছে বলিষ্ঠ ঘাড়ের কাছে। চোখে তার আগুন, দপদপ করে জ্বলছে। সেই অগ্নিদীপ্ত চোখের তীব্র নিষ্পলক দৃষ্টি এখনও দূর দক্ষিণে নিবদ্ধ। না, দক্ষিণের আকাশে আর নেই ধুলোর রেশ। শোনা যাচ্ছে না ঘোড়ার পায়ের কদম ছুটের খটখট শব্দ। তবু চোয়ালের ও চিবুকের সুস্পষ্ট হাড়ে, বাঁকা রেখায় ফুটে রয়েছে চাপা ক্রোধ।

সবাই ভাবল মধু আর হীরালালের প্রতি রাগেই তার চোখমুখের এমন চেহারা হয়েছে। কালো দুলের বুড়ি, কালো দুলেনি-ই প্রথম হেঁকে ডুকরে উঠল, বাবা নখাই, এর এট্টা বিহিত করতে নাগবে তোর। পাঁচজন রইচিস তোরা, তোরা থাকতে গাঁয়ে ওর অত বড় বুকের পাটা! নিজের চোখে তো দেখলি বাবা, তোর ব্যাটা হীরার মাথাটাও কেমন করে খাচ্ছে।

সকলেরই এ কথা। হ্যাঁ, বিহিত একটা করতে হবে। আর দুদিন বাদে তো ওরা ঘরে ঢুকে পড়বে, ঘর থেকে টেনে নিয়ে যাবে গেরস্তি বউ-ঝিদের।

একজন বলল, কলকাঠি সব ওই সায়েবের হাতে, বুয়েচ! ওই কলের পাগলা সায়েবের হাতে। দিনরাত সায়েবের সঙ্গে ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর, হাসি মশকরা। অত বুকের পাটা হয়েছে ওই সায়েবের নাই পেয়ে পেয়ে।

কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই এই অভিযোগের স্বর নেমে গেল, হতাশ হয়ে পড়ল সবাই লখাইয়ের ভাব দেখে। যাকে এত কথা বলা, সে কিছুই শুনছে না। তার মন নেই, তার কান নেই, দৃষ্টি নেই তার এদিকে। সে ডাকল চাপা শান্ত অথচ নির্মম গলায়, হরি ভাই।

কালো দুলের ছেলে হরির বয়স ও অভিজ্ঞতা অনেক। প্রাণে প্রাণে তার বড় মিল, বড় ভক্তি ও ভয় এই অচেনা লখাইয়ের সঙ্গে। অচেনা অর্থে, লখাই আজও সকলের কাছে যেন দুর্বোধ্য। তার সব কথা সবাই বোঝে না। বোঝবার কথাও নয়। সে যে মনসার ছেলে।

সে বলল, কী বলছ?

লখাই বলল, গোরা এয়েছেল কেন জান?

কেন?

অসহ্য যন্ত্রণায় ও রাগে লখাই-এর মুখ বিকৃত হয়ে উঠল, এ গাঁয়ের মানুষদের উচ্ছেদ করবে, কোম্পানির কারখানা খুলবে, তাই এয়েছেল গোরা।

কথাটা দৈব আদেশের মতো যেন আকাশ থেকে কেউ ছুঁড়ে দিল। সকলের মনে পড়ে গেল জমিদারের সেই ঢোল শহরতের কথা। তবু এই মুহূর্তে কথাটা অভাবিত কিন্তু অবিশ্বাস্য বলে মনে হল না কারুর।

মেয়েপুরুষের মিলিত গলার একটা ভীত চাপা ডুকরানি উঠে আবার মিলিয়ে গেল। এই ঘোর দুপুর আড়ষ্ট হয়ে থমকে রইল এক মুহূর্ত।

লখাইয়ের দিকে তাকাল সবাই বড় বড় সন্ত্রস্ত চোখে। যেন সমস্ত অভাবিত সর্বনাশের একটা মুর্তি ধরে দাঁড়িয়ে আছে লখাই। যেন সত্যি তাদের কেউ উচ্ছেদের হুকুমনামাটা সামনে পড়ে শুনিয়েছে।

কোথায় যাবে তারা। কোন দেশে, কোন গাঁয়ে। কেমন করে যাবে। এতদিন শুধু শুনে এসেছে, কাঁকিনাড়া, গারুলিয়ার উচ্ছেদের কথা। চোখে দেখেছে সামান্য। আগুরিপাড়ার ফোর্ট গ্লাস্টারের কারখানার জমি জমিদারে কাঁচা টাকা দিয়ে কিনে নিল নীলু বাগদির কাছ থেকে। সেই নীলু টাকা, ছেলে-বউ নিয়ে দেশান্তরী হল। সে দেশান্তর নীলুর সারাটা জীবনকে পুড়িয়ে ছাই করে দিল। এ জীবনে আর তার কোনও জমিতে খুঁটি পোঁতা হল না।

আজ লখাই তাদের সকলকে তাড়া-খাওয়া জানোয়ার-দলের মতো চারিদিক থেকে তাড়িয়ে এক জায়গায় এনে দাঁড় করাল, যেখানে শুধুনীলুর জীবনেরই ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি হাঁ করে রয়েছে। একদিন দু দিনের নয়, এক-দুই মাস বা বছরের নয়, শত শত বছর পুরুষ থেকে পুরুষান্তরে গড়ে তোলা তাদের এই গ্রাম, তাদের চষা জমি, তাদেরই হাতে ভোলা ঘর, গড়া বাগান।

এ তো শুধু ঘর, গ্রাম, জমি নয়, তাদের হাড় মাংস ও রক্তের সারেরসে পুষ্ট এক বিচিত্র মূর্তি। এখানেই পাশাপাশি তাদের আঁতুড়ঘর ও শ্মশান, মা ষষ্ঠীর বরণ ও মুখাগ্নির শেষকৃত্য সমাপন, হাসি ও কান্নার পালা শুরু ও শেষ, শেষ ও শুরু।

ভাঙা বুকে ভয় ও ত্রাস নিয়ে নিঃশব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সবাই! শুধু লখাইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল দুলেনি বুড়ি আর হরি। কোমর ভেঙে ছানিপড়া চোখে দুলেনি বুড়ি তাকিয়ে রইল মাঝ গঙ্গার দিকে।

ক্ষয়িষ্ণু বুকের পলিতে তার স্মৃতি ভাসিয়ে জোয়ার এসেছে। আজকের বৃদ্ধ প্রাণে, গতদিনের সোহাগি যুবতী দুলেনি বউ চাপা গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। পৌষের বুকে হানা দিচ্ছে যেন চৈত্র। হঠাৎ হাওয়ায় দুলে উঠল গাছপালা। ঝড়তিপড়তি পাতা সড়সড় করে উড়ে গেল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, গঙ্গার বুকে। এই হাওয়াই একদিন ঝড়ের গতিতে কালবৈশাখীর রুদ্ররূপে ছুটে আসবে, মুচড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত কিছু। এ যেন তারই মহড়া, হাওয়ায় তারই সংকেত।

লখাই যেতে উদ্যত হয়ে ফিরে দাঁড়াল। শক্ত শরীরটা নিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, এ কুম্পানি যা চাইবে, তা-ই দিতে লাগবে? আমার সংসার আমার প্রাণটাও? তাই যদি, তবে এ প্রাণ নিয়ে শোরের বাচ্চার মতো আমি কোন গত্তে যেয়ে নুকোব! হরি, তার চেয়ে মরব, তবু এ বেজাতের হাতে একগাছি চুলও বিকব না, না না না।

বলতে বলতে তার জ্বলন্ত লাল চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।

একটা খ্যাপা গরিলার মতো পুবের পথে দুপদাপ শব্দ করে এগিয়ে গেল সে। অনেক দিন পরে আবার তার প্রাণে আগুন লেগেছে।

দুলেনি বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল। এক অজানা ভয়ে দমবন্ধ হয়ে গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ল সে।

.

০৬.

বড় সড়কের উপর এসে পড়ল লখাই। পথে কেউ নেই। পাগলের মতো বড় বড় চোখে তাকাল সে দক্ষিণের দিকে। এখনও যেন আকাশটা ধুলোয় ভরে রয়েছে।

কিছু কি মনে পড়ছে? হ্যাঁ, মনে পড়ছে। তার চোখের সামনে ভাসছে একটা যুদ্ধক্ষেত্রের ঝাপসা ছবি। শত শত ঘোড়া দিকবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে! ঘোড়ার পিঠে ইংরেজ সওয়ার।

কেউ মরিয়া হয়ে সামনে ফিরে পিস্তল বাগিয়ে ধরেছে, কেউ ছুটে চলেছে প্রাণভয়ে। পেছনে তাদের খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে কালা সিপাহির দল। গলায় মুহুর্মুহু হুংকার উঠছে, হর হর ব্যোম ব্যোম! আল্লা-হো-আকবর!

ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, কামানের গোলার কানফাটানো শব্দ, মৃত্যু ও জয়ের রণহুংকার, ধুলো ধোঁয়া আর রক্ত। আতপুরের আকাশে ওই অপসৃয়মাণ ধুলো কি সেই কামানের ধোঁয়া!

আজ সেই স্মৃতি এতই ঝাপসা যে, সে কথা মনে করতে গিয়ে গোপন কথা ফাঁস হওয়ার ভয়ের চিহ্ন মুখে ফুটে ওঠে না। আজ এই ভাবলেশহীন মুখে শুধু ভাবের ঘোরের বিহ্বলতা। ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নের আচ্ছন্নতা। স্মৃতির খাঁচার মধ্যে সেই মন-পাখির সমস্ত উত্তেজনা নিস্তেজ হয়ে এসেছে।

পলাতক সিপাহি ভেসে এল আতপুরের ঘাটে। লোকে তাকে তুলে নিল মনসার বর-পাওয়া ছেলে বলে। রাজপুত সিপাহি হল সেনপাড়ার বাগদি লখাই, হল সেন-দেওয়ানের সেপাই। কিংখাবে লুকিয়ে রাখা একখানি জীবন্ত তীক্ষ্ণ গুপ্তির মতো বাগদিনি কাঞ্চন হল তার বউ, কাঞ্চী বউ। কী সর্বনেশে এই বাংলার মাটি। অথচ কী মধুর, কী মিষ্টি! এ মাটি কর্দমাক্ত নয়, কিন্তু বালিয়াড়ির স্তূপও নয়। এ পাকে পাকে জড়িয়ে বাঁধে না, কিন্তু ছেড়েও দেয় না। তবু এর কোথায় কোন অদৃশ্যে শিরায় শিরায় বইছে তীব্র আকর্ষণের ঘূর্ণিস্রোত। সে স্রোতের অনুক্ষণ ডাক গুনগুন করে ফিরছে হাওয়ায় হাওয়ায়। এ স্রোতে যে ডুববে, সে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকবে। এ ডাকে সাড়া দিয়ে বাঁচতে সুখ মরতে সুখ। আর একবার যে এ মাটির গর্ভে প্রবেশ করেছে, তাকে সে তার নিজের মতনটি করে আবার প্রসব করেছে। তাই পলাতক সেপাইকে সে আজ তৈরি করেছে লখাই বাগদি, আর এক মূর্তিতে বেঁধেছে হৃদয়ের আষ্টেপৃষ্ঠে। কিন্তু ভুলতে দেয়নি সেই যুদ্ধক্ষেত্রকে। হায় বিচিত্র! আহা, সে যে আর সবই ভুলিয়ে নিল, শুধু নিভতে দিল না বুকের আগুন।

 কবে দুলেছিল এক সোনার টিকুলি। দুলে দুলে তৃতীয় নয়নের মতো সে কাচপোকার টিপ হয়ে জ্বলেছে দিবারাত্র। একদিন তাও নিভে গেল। তারপর দুঃখদিনের নিরালা নিঃশব্দ সুখের মতো হাসি ও বেদনা-ভরা দুটি চোখ আজও সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে আছে তার সমস্ত নিরানন্দকে বহনের জন্য। আর তার ছেলে হীরালাল।

কিন্তু সমস্ত সুখ দুঃখ আশা আনন্দ নিয়ে জীবনটা ঠেকে আছে আজ অন্যত্র। এ জীবনের এক মহা অধ্যায় পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু বুকের সেই লুকোনো আগুন নিয়ে আজও আমি ফিরছি। তাকে তো কোথাও প্রকাশ করতে পারিনি। নিজের আগুনে নিজে পুড়ে মরছি, তা আর কাউকে দিতে পারিনি, আগুন জ্বালাতেও পারিনি। তাকে বুকে নিয়ে কেমন করে মরব! আর বাংলার হাওয়া নিভতে দিল না কোনওদিন এ আগুন। আমি মরব, কিন্তু আত্মা যে আগুনের পিণ্ড হয়ে পড়ে থাকবে। সেই পূর্ব জন্মের কথা না পেরেছি বলতে কাঞ্চীবউকে, না পেরেছি শ্যামদাদা বা কালীবউঠানকে, বলতে পারিনি সেজোকর্তাকে, ভাটপাড়ার বনমালী ঠাকুরকে। আশা ছিল, হীরালালকে সে কথা বলে যাবার। মনে হতেই বিস্মৃতির অন্ধকার চোখে আবার আগুন জ্বলে উঠল। না, মিথ্যা প্রতীক্ষা, বৃথা আশা। হীরালাল তার রক্তে এক বিশ্বাসঘাতক হয়ে জন্ম নিয়েছে। সে শয়তান চায় কোম্পানির শোলাম বনতে। ঘরের ছেলে মধু তার ওস্তাদ, তার গুরু। রামের হাতে ধনুকের মতো ও হাতের অস্ত্র করেছে হাতুড়ি নয়, কোম্পানির হাম্বর। হারান বলেছিল, সবাইকে কোম্পানির গোলাম হতে হবে। তার রক্তবীজের মধ্যেই আজ তা, তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেহারায় দেখা দিয়েছে। ঘৃণায় জ্বলে উঠল তার গায়ের মধ্যে। এরা শত্রুকে চিনল না, তার কাজের বাহাদুরি দেখে উল্লসিত গাধার মতো কোম্পানির ভেঁপু বাজাচ্ছে। বাজাচ্ছে সমস্ত জোয়ানের দল। হয়তো সেই দলের কাছে লখাইয়ের শক্তি আজ অনেকখানি পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। নইলে, অন্তস্রোতে মধুর সঙ্গে যে তার একটা বিরোধ দানা পাকিয়ে উঠছে, তাকে তো সে কোনওদিন প্রকাশ পেতে দেয়নি। ছাড়িয়ে আনতে পারেনি তার কাছ থেকে হীরালালকে।

আর আছে সারদা। হ্যাঁ, সেই দুঃখদিনের সইয়ের কাছেই এ প্রাণের আগুন রেখে যাবে সে। এ জীবনে আপসোস থেকে যাবে তবু বুকে পাষাণভার নিয়ে তো মরতে হবে না। আর হীরালালকেও সে রেখে আসবে তার কাছে, পুবের গ্রামে, মধুর আওতার বাইরে।

তবুও প্রাণের অস্থিরতা ঘুচতে চায় না। রক্তের দোলা যত স্তিমিত হয়ে আসে, অস্থিরতা তত বাড়ে। রং রসহীন জীবন আজ শুধু মুক্তি চায়। সে মুক্তি মৃত্যু নয়, মুক্তি সেই প্রাণের আগুনের চিতা থেকে। সে ফিরে তাকাল সেনবাড়ির দিকে, দেখল হালদারবাড়ি, মজুমদারদের বাড়ি। তারপর ফিরে চলল উত্তর দিকে, ঘরের পথে।

.

০৭.

হুগলি আর চব্বিশ পরগনার ভূমিনির্ভর সকল মানুষের কাছে, এ যুগটা দিশাহারার যুগ। তাদের জীবন, বিশ্বাস, নৈতিকতা, সবকিছুই আজ প্রতি মুহূর্তে টলটলায়মান। আশ্চর্য ভয়ংকর সব সংবাদ তারা শুনছে। ভীত হচ্ছে। অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করছে আর এক ভাবে।

একদিন সারা দেশে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল, কলকাতায় হিন্দুর ছেলেরা গোমাংসের সঙ্গে হিন্দুয়ানিকে খেয়ে বসেছে। এ যে ভয়াবহ কলির-ই দৌরাত্ম্য, এ বিষয়ে কারুর সন্দেহ ছিল না। হিন্দুর ছেলে ইংরেজি শিখেছে, সেটাই ছিল এক মস্ত ব্যাপার। সেই শিক্ষার সঙ্গে যখন ইংরেজের পোশাক ও খাদ্য পর্যন্ত সেই সব কেতাদুরস্ত ব্যভিচারীদেরও পোশাক ও খাদ্য হয়ে উঠল, সেইদিন সারা কলকাতা তথা বাংলা ভয়ে ও ঘৃণায় সিঁটিয়ে গিয়েছিল। কলকাতার খবরের কাগজে ও তেমন তেমন বড়লোকের বাড়িতে এ বিষয়ে ধিক্কার ও আলোচনার অন্ত ছিল না।

আজও সে বিষয়ে কলকাতায় আন্দোলন না হয় তা নয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সেই সব কেতাদুরস্ত বাবুদের অনেকেই মহাজন ব্যক্তি। তাঁদের অনেকের চরিত্রের মধ্যেই ছিল অমিত শক্তি ও শিক্ষার ঔজ্জ্বল্য।

এই সেনপাড়া-জগদ্দলের মানুষেরা যে সময় এ সব কথা শুনেছে, তখন বিশ্বাস করতে পারেনি। যেদিন বিশ্বাস করেছে, সেদিন ঘৃণার উদ্রেক হলেও তাদের গায়ে লাগেনি। কারণ আশেপাশে যে সমস্ত কেতাদুরস্ত শিক্ষিত বাবুদের তারা দেখেছে, তাঁরা তাদের চিরকালের নমস্য। কাঁটালপাড়ার চাটুয্যে হাকিমের নামেও এমন বদনাম রটেছিল, কিন্তু প্রমাণপত্রের অভাবেই হোক কি যে কারণেই হোক, তাঁর শ্রদ্ধার আসন কেউ টলাতে পারেনি। মজুমদারদের সেজোবাবুকে কোনওদিন কেউ দেখেনি কোনও বিধর্মীয় আচরণ করতে। তবে শুনেছে, মজুমদার বাবুরাও আরও এক রকমের কেরেস্তান। দেখেছে এবং এখনও দেখে থাকে, হালদারবাড়িতে আজও হিদু-যিশু-ঠাকুরের ভজন-পূজন হয়। তাঁদের বাড়ির ঝি-চাকরের মুখে শোনা যায়, সকলে একসঙ্গে বসে নাকি দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে গান করেন। কীর্তনের মতো একজন গান করেন, বাকি সকলে দোহার টানেন। এমনকী, বাড়ির মেয়ে-বউরাও নাকি চিকের আড়ালে বসে যোগ দেন এ প্রার্থনা সভায়। ভাল কথা। তাতে সেনপাড়া-জগদ্দলের দুলেবাগদি ছোট জাতের মানুষের জাত যায়নি, আর তাদের মা কালী শেতলার মান যায়নি তাতে। বাবুরাও তাদের গাল পাড়েননি। গোমাংস খেয়ে ব্যভিচারও করেননি। অত যাঁদের লিখন-পড়ন, তাঁদের যদি আবার সব বিষয়ে একটু এদিক ওদিক না থাকে, তবে চলবে কেন? দেখা যায়, সে নিয়ে আবার লেখাপড়া-জানা বাবুদের মাথাব্যথা বেশি। সেনপাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ভাটপাড়ার পণ্ডিতেরা গঙ্গাজল মাথায় ছোঁয়ান।

কিন্তু সে কথা নয়। কলকাতার সেই ব্যভিচারের এক ভিন্নতর সংস্করণ যেন আজ এই উপকণ্ঠের গারুলিয়া সেনপাড়া জগদ্দলেও দেখা দিয়েছে। যদিও তার চেহারা ও ঢং সবই অন্য রকমের, অন্য ধরনের।

এই সংস্করণের দলীয়রা কেউ কেতাদুরস্ত নয়, তথাকথিত ভদ্রলোকের ছেলেও নয়, তবু সাহেব, কলের সাহেব। সে সাহেব জানে যন্ত্রের অন্ধিসন্ধি, চেনে যন্ত্রের হাত পা নাক মুখ চোখ। যন্ত্রের নাড়ি ধরতে জানে, হাত দিলে টের পায় কার কোথায় ব্যামো। সাহেব শুধু যন্ত্রের বদ্যি নয়, মাথা থেকে তার যন্ত্র গজায়। সত্য কথা, আজ অনেকে কলে কারখানায় ছুটে চলেছে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, চলেছে রেল ও কোম্পানির অনেক কাজে কুলি হয়ে। তার কারণ অভাব, জমিদারের অত্যাচার।

কিন্তু এ সাহেব-ন্যাওটো দল এক নতুনের নেশায় মেতেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছেড়েছে লাঙল বলদ। ছেড়েছে তারা মাঠের জীবনের মায়া। সেদিকে তাদের কোনও টান নেই। মায়া নেই। যন্ত্র তার বিচিত্র কৌশল ও কৃতিত্ব নিয়ে তাদের ডাক দিয়েছে। তাদের চিরাচরিত বিবর্ণ পুরনো একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নতুন ধরনের কাজে তারা এগিয়ে এসেছে। এদের সবাইকে যে ভূমি থেকে উচ্ছিন্ন দুরবস্থাই একমাত্র ঠেলে দিয়েছে এ পথে, তা নয়। রক্তে তাদের দোলা লেগেছে, যন্ত্রের তারা প্রেমে পড়েছে।

শুধু এইটুকুতে হয়তো কারুর আপত্তি ছিল না। এই দলের চরিত্রও আলাদা। এদের না আছে ঘরের মায়া, না আছে প্রাণের মায়া। চিরাচরিত জীবনে নেই এদের বিশ্বাস, আস্থা নেই সমাজে। মানে না আচার-বিচার। খায় অখাদ্যকুখাদ্য। অনেকে বলে, গোমাংসও নাকি এরা খায়। ওঠবোস করে সাহেবের কথায়।

এ দলেরই পাণ্ডা মধু। দেশের নেতা। আজও সে কারখানায় কাজ নেয়নি বটে, কিন্তু ফাঁক পেলেই, কারখানায় চলে যায়। কাজে ফাঁক না পেলে, কাজে ফাঁকি দিয়ে যায়।

আগুরিপাড়ার পাগলা সাহেবের সঙ্গে মধু লাঠি খেলে। সাহেব শেখে লাঠির প্যাঁচ, মধুকে শেখায় অদ্ভুত সব শরীরচর্চার বিলাতি কায়দা। সে সব চর্চার জন্য অনেক সরঞ্জাম দরকার। সাহেবের তা নেই। সেজন্য কখনও গাছের ডালে উঠতে হয়। দড়ি বাঁধতে হয় গাছের ডালের সঙ্গে। শক্ত সরু দুটি পাশাপাশি ডালে খেলা দেখিয়ে সাহেব বলে, এর নাম বারের খেলা। গাছের দড়ির সঙ্গে লোহার কড়া ঝুলিয়ে বলে, রিঙের খেলা।

তা ছাড়া আছে কুস্তি। সে এক ব্যাপার! সাহেবের সঙ্গে মধুর কুস্তি লড়ার ঘটনা এ অঞ্চলের এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। কুস্তি লড়ে অনেকে কিন্তু সাহেবের সঙ্গে নয়। শুধু মধুর সঙ্গে সাহেব লড়ে। যেদিন তারা দুজনে লড়ে সেদিন আখড়ায় সেনপাড়া-জগদ্দলের মানুষেরা ভেঙে পড়ে। দল বেঁধে আসে কারখানার মেয়ে-পুরুষেরা, লেখাপড়া-জানা বাবুরা। আসে সাহেবরা। তেসুতি কলে মোট তিনজন সাহেব। তার মধ্যে পাগলা সাহেব লড়ে, বাদবাকি দুজনে উত্তেজিত হয়ে সে খেলা দেখে। তারা দুজনেই সাধারণত মধুর পক্ষ নেয়, হাততালি দেয়, চেঁচায়, এমনকী শিসও দেয়। চিল-চেঁচানির মতো কানফাটা সেই শিসের শব্দ।

বেশির ভাগ দিনই পাগলা সাহেবের জয় হয়, মধুর জয় হয় কোনও কোনওদিন। অনেক পরাজয়ের পর একবার জয় বড় আনন্দের, বড় মধুর। সাকরেদরা জানে এ শুধুই খেলার খেলা। আর পাগলা সাহেবের অতবড় শক্ত স্তম্ভবিশেষ মস্ত শরীরের সঙ্গে মধুর এঁটে ওঠা দায়, এও তারা জানে। সেজন্য ওস্তাদের পরাজয়ে তাদের গ্লানি নেই, কিন্তু জয়ের উল্লাসে আকাশ ভরে ওঠে। সাহেবরা আদর করে বখশিশ দেয়। বখশিশের পয়সা দিয়ে হয় বিরাট ভোজের পালা। বলি হয় জোড়া পাঁঠা, আসে গণ্ডা গণ্ডা তাড়ির ভাঁড়।

সেই ভোজের আসরেও কোনও কোনও সময় পাগলা সাহেবের আবির্ভাব হয়। বসে খায়, নিয়ে আসে কলের রুটি। ভারী সুন্দর গন্ধ, নরম আর মিষ্টি রুটি। আরও আনে দু-চার রকম খাবার, ভেতরে তার মশলা মেশানো সিদ্ধ মাংস।

এ আসরে সেনপাড়া-জগদ্দলের মধু-বিদ্বেষী দু-চারজন বয়স্করাও আসে। আনন্দ করতে নয়, খাওয়ার লোভে। কিন্তু পাগলা সাহেবকে দেখলেই সরে পড়ে। সাহেবের ভয়ে নয়, সাহেবের খাবারের ভয়ে। সাহেবের খাবার সবই গো-মাংসে ভরা। কে জানে ওই কলের রুটিতে আছে হয়তো গোরুর চর্বি মাখানো।

তা ছাড়া এ আসরের স্থানকাল নেই। দেবদেবীর স্থানেও নির্বিচারে চলে এই অনাচার। পালাপার্বণের দিনেও কোনও মানামানি নেই।

সারা সংসারে আজ কোথাও নেই আচার-বিচার, তা জানে সেনপাড়া-জগদ্দলের এই মানুষেরা। জানে, নেই আচার-বিচার আজ তাদের গাঁয়ে ঘরে। অসুরকুল যখন বেড়ে ওঠে, তখন তার শক্তি দেখে ভগবানও কাঁপে। সেই অসুরকুলের বলে বলীয়ান আজ মধু ও মধুর দল। এই অনাচারীদের বিরুদ্ধে আজ বলার কেউ নেই, কেউ নেই হাত তোলবার। শোনা যায়, কলকাতার অনাচারী বাবুরা কেউ সাহেব হয়েছে, কেউ কেরেস্তান। এরা জাতের মধ্যে থেকে বেজাতের আচার নিয়ে ফেরে। মা শীতলা মুখে করে না নিলে নিস্তার নেই এদের হাত থেকে।

হ্যাঁ, এক সময়ে লখাই-পবনদের নিয়ে সেনপাড়া-জগদ্দলে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। সে সময়েও সকলে পাপের আশঙ্কায় এদের বিদ্বেষের চোখে দেখত। কিন্তু সে পাপের সঙ্গে এ পাপের চেহারা যেন আজ আকাশপাতাল প্রভেদ বলে মনে হয়।

কথায় বলে, কালে কালে কতই হল। সেকাল আর একাল। সেকালে অনাচার ছিল, কিন্তু তার রূপ একালের মতো সর্বনাশা ও ভয়াবহ ছিল না। সেকালের রোগ শোক ভয়, দয়া ধর্ম দাক্ষিণ্য, খাওয়া পরা শোয়া কোনওটাই আজকের মতো এত কুরূপ কুৎসিত ছিল না। ছিল না পরমায়ু এত কম। জীবন ছিল না এত বিবর্ণ। তাই লখাই ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা আজ তাদের আপন। তারা সেকালের মানুষ!

আর একালের মধুরা কাঁচা রক্তের তেজে সদর্পে মাথা তুলে ওকালের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচায়। হয়তো ভেংচায়ও না, পরম ঔদাস্যে শুধু ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়ে ওঠে হাসি। সেকালের মানুষেরা ভয়ে বিস্ময়ে বেদনায় অপমানে একালের দিকে তাকিয়ে শুধু বৃথা রোষে গজায়।

বিচিত্র বিশ্বের এই কী বিচিত্র নিয়ম! থিরপাড়ার শ্রীশ, কালো দুলেনি আর হরি দুলে, সকল বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা তাই ভগবানের কাছে দিন রাত জোড় হাতে জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করে জঙ্গলপীরের থানের গাছকে আর গঙ্গাকে। সে জিজ্ঞাসার কোনও ভাষা নেই। শুধু চোখের জলে বুক ভেসে যায়। এই সুদীর্ঘ জীবন কাটিয়ে এসে আজ সবকিছু বড় নিরর্থক মনে হয়। আসলে হয়তো এ তাদের হৃত যৌবনের কান্না। যে চলে গিয়েছে, সে আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। রক্তস্রোতে আর বাজবে না জীবনের গান। তাই আজ আর এ জীবন সহ্য হয় না, নিজেদের কোনওক্রমেই খাপ খাওয়ানো যায় না।

কান পাতলে বুঝি মা গঙ্গার কান্নাও শোনা যায়। সমুদ্রের মতো যার বিস্তার ছিল সেই বরুতীর বিল পর্যন্ত, উত্তাল ঢেউ যার হানা দিত মালতীর কোলে, বছরে বছরে তারই সহোদরা ধরিত্রী নবযৌবনে উদ্ভাসিত হয়ে তাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে এই আতপুরের কোলে। শত শত বছরের এই কিংবদন্তি-ই তারা শুনে আসছে। গঙ্গা সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে আর নতুন জনপদ গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছেনতুন গ্রাম, উচ্ছেগড়, রাহুতা, কাউগাছি, কেউটে, নবগ্রাম, আতপুর, সেনপাড়া, জগদ্দল।

এক যায়, এক আসে। যে আসে, সে নাচে গানে হাসিতে দিগবিদিক মাতোয়ারা করে আসে। যে যায়, সে শুধু চোখের জলের উপর রেখে যায় আপনার পদচিহ্ন।

.

০৮.

বড় ঘরের দাওয়ার উপর শ্যামকে খেতে দিয়েছে কালীবউ। শ্যামকে খেতে দিয়ে কালীবউও বসেছে তার পাশেই। শ্যাম খাচ্ছে না। খাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে না কালীবউ। আধ-খাওয়া ভাতের থালা পড়ে রয়েছে। দুজনেই শূন্যদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে।

শ্যাম বৃদ্ধ হয়েছে। কালো শক্ত শরীর তার ভেঙে পড়েছে, কুঁচকে শিথিল হয়ে গিয়েছে গায়ের চামড়া। মাথার সাদা চুল বেয়ে পড়েছে ঘাড়ের কাছে। সারা মুখে ধূসর বর্ণের গোঁফদাড়ি। বসে আছে দুই হাঁটুর উপর হাত মেলে দিয়ে। ভুরুর তলায় কালো চোখ দুটি যেন গলে গিয়েছে, এমনি ভাবলেশহীন ঝাপসা দৃষ্টি সেই চোখে।

তার পাশেই বসে রয়েছে কালী। কালীরও বয়স হয়েছে। মাথায় তার ঘোমটা নেই। জট পাকিয়েছে তার সাদা পাকা চুলে। মুখে অনেকগুলি রেখা পড়েছে। চোখে বোধকরি জ্যোতি নেই, তাই কুঁচকে রয়েছে ভুরু দুটি। কালীর ভুরু দুটি তেমনি কালো টানা টানা রয়েছে। উপর ঠোঁটের উপর ঝুলছে একটি বিন্দুর মতো সোনার নোলক। কপালে অস্পষ্ট মেটে সিঁদুরের টিপ। সিঁদুর লেপে রেখেছে রুক্ষ জট-পাকানো চুলের সিঁথিতে। সিথি চওড়া হয়ে গিয়েছে অনেকখানি। হাতে পুরনো রুপোর চুড়ি আর নোয়া। সেই হাত দুখানি বুকে চেপে অবাক বিস্ময়ে পুব দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে। দুজনেই আনমনা। সাড়া নেই, শব্দ নেই। দুটি শিশুর মতো বসে রয়েছে গায়ে গায়ে। বসে আছে, যেন কেউ তাদের ডাক দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে কোনও সময়েই দেখা দেয় না। অলক্ষ্যে, চোখের আড়ালে এসে সে ডাক দিয়ে যায়। লুকোচুরি খেলার মতো। সে আসে যখন তখন, কাজে ও অকাজের মাঝে। সে কখনও শিশুর মতো খিলখিল করে হাসে, কখনও মহাভৈরবের মতো অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় সমস্ত বুকের ভিতর।

আজকাল এমন হয় প্রায়ই। প্রায়ই তারা এমনি আনমনা বসে থাকে, সময়ে অসময়ে। কেউ ডাকলে চমকে ওঠে, নয়তো নিজেরাই একসময় সংবিৎ ফিরে পায়।

হঠাৎ শ্যাম উঠে দাঁড়াল। খাওয়া শেষ হল না, এঁটো হাতেই দাওয়া থেকে নামবার উপক্রম করল।

কালী চমকে উঠে তাড়াতাড়ি শ্যামের হাত টেনে ধরল। ভয়ে ত্রাসে উৎকণ্ঠায় কান্না ঠেলে এল তার গলায়। বলল, ওগো, যাচ্ছ কমনে? পাতে ভাত পড়ে রইল, খেয়ে নাও।

শ্যাম দাঁড়াল কিন্তু তাতেও তার মুখে কোনও ভাবের বিকাশ নেই। বসে বলল, মধু যে আমাকে ডাকলে মধুর মা, তুই শুনতে পাসনি?

কালীর বুক কেঁপে উঠল। জল এল চোখ ফেটে। কান্নার উচ্ছ্বাসে বেঁকে উঠল ঠোঁট দুটি। চাপা গলায় বলল, না পাইনি গো শুনতে। তুমি খেয়ে নাও, ধরো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

অতি বাধ্য ছেলেটির মতো কালীর হাতেই খেতে লাগল শ্যাম। আর কালী মনে মনে ভাবতে লাগল, মধু যে তার পেটের শত্রু। সে যে আজকে মধুর বেশ ধরেই ডাক দেবে, সে কথা কি জানে না কালীবউ।

সে চোখের জল মুছে ভাত তুলে দিতে লাগল শ্যামের মুখে।

কয়েক গরাস ভাত খেয়ে আবার ডাকল শ্যাম, মধুর মা!

বলো!

আর জবাব নেই শ্যামের। চুপ হয়ে গেল। কোথায় হারিয়ে গেল মন ও চোখের দৃষ্টি। এমনি দিনের মধ্যে হাজার বার ডাকে। হাজার বারই সাড়া দেয় কালীবউ। সাড়া দেয় মনে আনমনে। জবাবের প্রত্যাশা করে না।

কয়েক বছর আগেও শ্যাম তাকে কালীবউ বলে ডেকেছে। তারও আগেই শ্যামের মনে ভর করেছে এই রকম বিভ্রম। তবু কয়েক বছর হল, নিজের মন থেকেই সে কেন জানি না তার কালীবউকে মধুর মা নাম দিয়েছে। শুধু ডেকে তৃপ্তি নেই, শ্যাম তাই বারবার ডাকে। ওই নামটি নিজের কানে শুনতে যেন তার ভাল লাগে। বুঝি প্রাণটাও খানিক জুড়ায়।

এই নামের থেকে এক নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কালীর সঙ্গে শ্যামের। প্রৌঢ় বয়সে যাই যাই করেও যৌবনের শেষ-হয়ে-আসা যে চাঞ্চল্যটুকু কালীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে দেখা দিত, হাসত খিলখিল করে, অভিমান করত, মুখঝামটা দিত, ওই নামে ডাকা থেকে তা কোথায় ভেসে গেল আপাদমস্তক। ভরা কলসি জলে ভাসে না। সে তার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে আবার তলিয়ে যায় জলেই। শ্যামের সঙ্গে যেটুকু একাত্ম হওয়া বাকি ছিল, সেটুকু একাকার হয়ে গেল তার সঙ্গে কালীর। তাই আজ কালীরও বিভ্রম দেখা দেয় থেকে থেকে। তবে সে খুবই কম। মেয়েমানুষের প্রাণ যে! মরণের পূর্ব মুহূর্তেও তার জ্ঞান লোপ পাওয়া চলে না। তখন তাকে সবটুকু দেখেশুনে দিয়ে রেখে যেতে হয়। তাই শ্যাম যখন বারবার মধুর মা বলে ডাকে, তখন উঠোন ঝাঁট দিতে কিংবা গোরুকে জাবর খেতে দিতে দিতে সাড়া দিয়ে কালী মনে মনে বলে, অত করে আর আমাকে ডাকতে হবে না। চিরজীবন তোমার ওই ডাকে পা বাড়িয়েছিলাম, আজও আছি। কিন্তু দোহাই, ওগো মধুর বাপ, আর ডেকো না। তুমি ডাক দিয়ে রাখ বলেই আমি যেতে পারিনে। এবার আমার সমস্ত জ্ঞানগম্যিটুকু রেখে, আমাকে যেতে দাও। এখনও বুঝি আশা আছে, তুমি চোখ মেলে চাইলে আবার ভরে উঠতে পারে এ সংসার, বিপরীত পথ থেকে ফিরে আসতে পারে মধু, অনভিজ্ঞ সংসারী লখাই মন বসাতে পারে সংসারে। আমি আবার দেখে যেতে পারি আমার শ্বশুরের সেই পুরনো সংসার। তোমাদের দুই ভাইয়ের মতোই মধু আর হীরা ভরে তুলবে আবার এই সংসার।

কিন্তু তা হবার না। কালীর বুকে হাড় কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। আবার জল এল চোখে। ভাত তুলে দিল শ্যামের মুখে। স্মৃতি সুখের, কিন্তু স্মৃতি বড় দুঃখেরও। শ্যামের বৃদ্ধ বুকের দিকে তাকিয়ে সেই কথাই মনে হয় কালীর। ওই বুকের সোহাগ কেড়ে চিরকালের সোহাগী কালীবউ। মধুর মা নামে প্রাণ ঠাণ্ডা হয় সত্যি, তবু আবার যদি সে কালীবউ হতে পারত, আবার জ্বলে উঠতে পারত সে। আবার জ্বলে উঠতে চায় সে। আর কি ফিরে পাওয়া যায় না সেই জীবন! এই বিবর্ণতা, নির্জীবতা আর সহ্য করা যায় না। এই তো সেদিনে শুরু হয়েছিল এই জীবন। এই তো সেদিন জোয়ান পুরুষ ঠাট্টা করে সুর করে বলেছে, কালী বলে ডাকব না গো, তুই যে শ্যামের শ্যামা।

কালী ভয় পেয়ে ডুকরে উঠেছে, ছি ছি, মরণ! দেবদেবী নাম নিয়ে অমন মশকরা করতে হবে না বাপু।

শ্যাম বলেছে, অবাক করলি! দেবদেবী কেন গো, আমি তোর নাম দিইচি শ্যামা।

তবু সে ছিল কালীবউ। তারপর এল কাঞ্চন। বাগদির ঘরে সে রূপের ছটা সওয়া যায় না, এত রূপ নিয়ে এল কাঞ্চন, নারায়ণের বউ। তার জা। মনটা একটু খাটো হয়ে গিয়েছিল কালীর, কাঞ্চনের রূপ দেখে। কিন্তু সে বেশিদিনের জন্য নয়। তার বুক ভরা ছিল, কাঞ্চনের বুক ভরা খাঁ খাঁ করত। রূপ থাকলে কী হবে, আসলে ছিল তার ফাঁকি। সোয়ামির আদর সোহাগ কাকে বলে, তা জানত না কাঞ্চন। সেই কাঞ্চীবউকে ভালবেসে কালীর বুকে ব্যথার ও যন্ত্রণার পাথর চেপে বসেছিল। দেবর নারাণ যে মানুষ নয়। এই সময় থেকেই তাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কালীর প্রথম ছেলেকে সাপে কাটল। তারপর এল মনসার ছেলে লখাই। এই লখাইকে নিয়ে গাঁয়ে ঘরে তার নামে দিয়েছে কলঙ্ক। শুধু শ্যামের বুদ্ধি স্থির ছিল বলে সে যাত্রা কালী রক্ষা পেয়েছে। নিজেরই মরণ কামনা করেছে কালীবউ। নারাণকে সে প্রায় ছেলের মতো মানুষ করেছে। লখাইকেও সেই চোখেই দেখেছে সে চিরকাল। আর দশটা বান্ধবের মতো লখাই তার বান্ধব ছিল। সেই লখাইয়ের সঙ্গে পিরিত হল কাঞ্চীর। সে জানে, কোনকালে কোনসময়ে বাঁধা হয়েছিল তাদের পিরিতের গাঁটছড়া। টের পেতে দেরি হয়নি কালীর। টের পেয়ে কালী প্রাণে শান্তি পেয়েছিল। বুক তার ভরে উঠেছিল। নারাণ ঘর ছাড়ল এই ব্যাপারে। ঘর ছাড়ল চিরদিনের জন্য। কালী বুঝেছিল, এ ব্যাপার শ্যামের বুকে দারুণ বেজেছে। তাই সে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু থাকতে পারেনি। শুধু এই সংসারের টানে। তা ছাড়া, লখাই যে তাদের পর ছিল না।

তবু সংসারের সচ্ছল অবস্থার ভাঙন কালী তখনও ভাল ঠাহর করতে পারেনি। মনে হত, এ বিশ্বসংসারে সব আছে, কিছু নেই শুধু তার কোলে। তার কোলশূন্য। পাড়া-ঘরে মেয়ে-পুরুষে বলাবলি করেছে, কালীর গর্ভে আর সন্তান আসবে না। মনসার অভিশাপ আছে। কিন্তু সেই শাপমুক্তি ঘটেছিল তার। এসেছিল সন্তান। আসবে না! মনসার বর পাওয়া মানুষকে ঘরে তুলেছিল শ্যাম, মনসার অভিশাপও ঘুচেছিল। আবার তার ছেলে হয়েছিল। সেই ছেলে এই মধু।

তারপর দিন চলে গিয়েছে। কিন্তু কালীর ভরা বুক কেবলি ভেঙেছে। বিশ্বসংসারের নিয়মে ফাটল ধরেছিল অনেকদিন। জমি তাদের বছরে বছরে নিলামে উঠে চলে গেল জমিদারের খাসে। আজ যেখানে এসে ঠেকেছে, সেটুকুনও ঠেকিয়ে রাখা দায়। মধু সংসারী হল না। লখাই চিরকাল একরকমের মানুষ। ঘরে কোনওদিন মন বসেনি, তবু ঘরেই সে চিরকাল থেকেছে।

কাঞ্চীবউ যেদিন মরল সেদিন থেকে শ্যামের এই বিভ্রম বেড়ে উঠল। জীবনের যে রং রস বারবার যাই যাই করেও যেতে পারেনি, এবার তা বানের মুখে ছুটে চলল। কালী ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। শ্যাম প্রথমে যোবা হয়ে গেল। তারপর চাউনি হয়ে উঠল পাগলের মত। ঝড়ের মুখে নদীর বুকে হাল ছেড়ে দিয়ে শেষ মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মাঝির মতো। সে যে তার সমস্ত জীবনটা দিয়ে দেখেছে শুধু ধ্বংসেরই তাণ্ডব। দেখেছে, আর দেখেছে। আর দেখছে মধুকে, তার শেষ আশা ভরসাস্থলকে। যত দেখছে, ততই বার্ধক্য এসে চেপে ধরছে তাকে। লখাই তার কাছে অতি-মানব। লখাইয়ের জীবনের সুখ, শান্তি ও চিন্তার ধারা সে কোনওদিন ঠিক অনুসরণ করতে পারেনি। তাই কিছু প্রত্যাশা করেনি। কিন্তু প্রত্যক্ষ করেছে তার লখাই ভাইয়ের ভাঙন। বুক থেকে যার কাঞ্চীবউ চিরতরে সরে গিয়েছে, তার ভাঙন কে রোধ করবে। করতে পারেনি।

কিন্তু মধু! কালী বোঝে সে কথা। কোনওদিন মুখ ফুটে একথা শ্যাম বলতে পারেনি, কিন্তু ধনে প্রাণে ভরা এ সংসারের জন্য অষ্টপ্রহর তার প্রাণ কেঁদেছে। সে চোখের জল কেউ দেখতে পায়নি, কিন্তু সে জল যে কালীর প্রাণকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়েছে। পুরুষের বুক-ভাঙা অভিমানও সংসারে কজনা জানতে পারে, কজনা অনুভব করতে পারে তার তিলে ক্ষয়। লোকে বলে মেয়েমানুষের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। হয়তো সে কথা সত্যি। কিন্তু পুরুষের বেলা সেই বুক ফাটা ও মুখ না ফোঁটা যে কত সাংঘাতিক, তা দেখেছে কালীবউ। পুরুষের বুক ফাটে না, মুখ ফোটে না, বুক ফাটলে সে লুকিয়ে কাঁদে। কিন্তু এ যে পুরুষের প্রাণ। সে কাঁদতে পারে না। পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যায়। সে অভিমান ও ক্ষয়ের যন্ত্রণা কালীর বুকে হাতে পায়ে জড়িয়ে ধরেছে। সে বুঝেছে, তার এতদিনের প্রাণসর্বস্ব পুরুষ শেষ হতে বসেছে। তাই সব ছেড়ে আজ সে কনে বউটির মতো সোহাগে আপনাকে মিশিয়ে দিতে চাইছে এই সর্বস্বহারা পুরুষের মধ্যে।

তবু মধুর মা নামে প্রাণ তার থেকে থেকে জ্বলে ওঠে। আর একবার কালীবউ হয়ে, সতেজ দৃপ্ত মহিমায় দাঁড়িয়ে সে যুঝতে চায়, ফিরিয়ে আনতে চায় মধুকে। কিন্তু মধু, পেটের শত্রু মধুকে কি আর ফিরিয়ে আনা যাবে। কালী তো জানে, মধু শুধু সাহেবের কলের নেশায় মাতেনি, সেখানে অন্য নেশাও আছে।

অধরার ছেলে মদন। মদনের বউ কাতুর ফাঁদে পড়ে নারাণ ছেড়েছিল কাঞ্চীবউকে, ছেড়েছিল এ সংসার। কিন্তু গোপন পাপের লালসায় সর্বনাশী অধরা আবার মদনের বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেছে কচি বউ। সংসার ছেড়ে মদন চলে গিয়েছে অনেকদিন। আজ অধরা সেই বউ নিয়ে আগুরিপাড়ার কলে যায় আর বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসে পুরুষ। অধরার নিজের জীবনের কৈশোর শুরু হয়েছিল শাশুড়ির হাতে এমনি করে। যেন সেই শোধ নিতে গিয়ে এ পাপ কাজ আজ তার মজ্জায় মিশে গিয়েছে।

সেই মদনের নতুন বউয়ের ফাঁদে পড়েছে তার মধু। কী বিচিত্র! অধরার সমস্ত সর্বনাশা কীর্তির আঘাত এই পরিবারের উপরই এসে পড়েছে বারবার।

সেই বউয়ের কালো চোখের নেশায় উন্মাদ হয়েছে মধু। নারায়ণের শিক্ষাকে দেখেও সে দেখেনি। নারায়ণের সংসার-ভাঙা সেই পথেই আজ ছুটে চলেছে তার ছেলে। না, এ ব্যথার কথা সে কাউকে জানাতে যাবে না। তবু প্রাণ যে পুড়ে যাচ্ছে। শত হলেও পেটের ছেলে। ভয়ে যে প্রাণ উড়ে যাচ্ছে। তাই এখনও সে মাঝে মাঝে খেপে উঠে, এমনকী লাঠি নিয়ে মারতে যায় মধুকে। কিন্তু আর তো সেদিন নেই।

মাঝে মাঝে ভাবে, মধুর বিয়ে দেবে সে। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতায় নারায়ণের ব্যাপারে শিক্ষা পেয়েছে সে। তারই পুনরাবৃত্তি আর সে করবে না। এ ঘরে ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে প্রাণটা ছটফটিয়ে মরছে। মরুক। তবু আবার এক কাঞ্চীবউকে এনে সে অভিশাপের বোঝা বাড়াতে দেবে না। আবার অঝোরে জল ঝরে পড়ল কালীর চোখ বেয়ে। মন যে মানে না। বিধাতা যে এ সংসারের মতোই কঠিন করে গড়েননি তাকে।

.

০৯.

শ্যামকে খাইয়ে এঁটো পরিষ্কার করে কালী জল হাতে নিয়ে তার মুখ ধুইয়ে দিতে গেল। শ্যামের সংবিৎ নেই। সে হাঁ করল ভাত খাওয়ার জন্য। কালী বলল, খাওয়া হয়েছে, মুখ ধোও।

খাওয়া হয়ে গেছে?আত্মভোলা শিশুর মতো জিজ্ঞাসা করল শ্যাম। কালী বলল, আর দুটি খাবে?

শ্যাম মাথা নেড়ে বলল, না।

উঠোনে পৌষের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। রোদে শুকোচ্ছে বড়ি। আর একদিকে কিছুর মুসুর ডাল। তার পাশে একটা মস্ত ঝুড়িতে রয়েছে গোরুর খইল। কালীর অন্যমনস্কতার সুযোগে কবার এসে পায়রারা ঠুকে ঠুকে ডাল খেয়ে গিয়েছে।

গোরুটা ডাকছে হাম্বা হাম্বা করে। মধুর বিচুলি কেটে রাখার কথা ছিল। জাব দেওয়ার কথা ছিল গোরুটাকে। কিন্তু সেই সকালে বেরিয়েছে, এখনও বাড়ি আসেনি। কালী নিজেই উঠতে যাচ্ছিল।

এমন সময় ত্রস্ত সচকিতভাবে ঢুকল হীরা। প্রথমেই এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল হাতের পেয়ারা কাঠের হাতুড়ি। কোমর থেকে টান মেরে খুলে ফেলল পাঁচহাতি ধুতি। ফেলে একেবারে দাওয়ার উপর এসে দু হাতে জাপটে ধরল কালীকে।

কালীর বুকটা ধড়াস করে উঠল। বলল, কী হয়েছে, অ্যা কী হয়েছে রে? হীরা একবার পিছন ফিরে দেখে ভীত গলায় চুপি চুপি বলল, মা বাপ আসছে পিছে পিছে। আমাকে এটুস নুকে রাখ।

হীরা কালীকে মা বলে ডাকে। কালী বলল, কী হয়েছে, কী করেছিস? কালীর আঁচল ধরে তাকে ঘরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল হীরা, ঘরে চল, সেখানে বলব, নইলে বাপ এসে পড়বে এখুনি।

 কালী ঘরে আসতে, হাঁপাতে হাঁপাতে সব কথা হীরালাল বলে দিল। বলে আবার আঁচল ধরে টানতে লাগল।

কোথাও নুক্কে রাখ আমাকে, তোর পায়ে পড়ি মা।

এখনও নিতান্ত ছেলেমানুষ হীরালাল। মুখে তার কাঞ্চনের আদল, শরীরের গঠন লখাইয়ের মতো। কিন্তু গলার স্বরটা শুনে ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে ওঠে কালীর বুকের মধ্যে। সেই ন বছর বয়সের বালিকা কাঞ্চীবউয়ের গলার স্বর বেজে ওঠে কানের মধ্যে।

কালী বলল, বাপকে অত ভয় তো, হাম্বর দে দুলেনি বুড়ির মাথা ফাঁক করতে গেছলি কেন অ্যা, কেনরে হারামজাদা? মারুক, হাড় ভাঙুক তোর।

হীরার চোখ ফেটে জল আসে প্রায়, তবু রাগে ঠোঁট আরও বেঁকে উঠল। বলল, বুড়িটা যে মধুদাদাকে গাল দিলে, বললে, মা শীতলা ওর বুকের পাটা ভাঙুক ভাঙুক, ভাঙুক।

বুকের মধ্যে শিউরে উঠল কালীর। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে সে দুহাতে হীরাকে বুকে জাপটে স্থির হয়ে রইল। ভয়ে ও কান্নায় উথলে উঠল বুকের মধ্যে। মনে মনে বলল, মা গো, মধুর বুকের পাটা কত বড় হয়েছে, সে জান তুমি। কিন্তুন ঘরে বাইরে এত শাপের বোঝা ও বইবে কেমন করে। ওর বাপের প্রাণের দুঃখু, সেও ওর শাপ। মায়ের চোখের জলেও ব্যাটার অকল্যেণ যদি হয়, তবে সে চোখের জল তুমি শুষে নাও, ডাকাবুকো হোক অধর্মী হোক কিন্তুন ও যে আমার একটাই।

পরমুহূর্তে দপদপ করে জ্বলে উঠল তার চোখ। মধু যা-ই করুক, যত অন্যায়ই করুক, কারুর বাড়া ভাতে তো সে ছাই দেয়নি। তবে দুলেনি বুড়ির ওই বিষাক্ত সাপের জিভ মধুর নামেই অমন লকলকিয়ে ওঠে কেন? হীরা আবার ডাকল ভয়ে ভয়ে, মা!

বাবা!

 আমাকে লুকোবি নে?

কালীর দৃষ্টি নেমে এল হীরার দিকে। শান্ত হয়ে এল চোখ। কিন্তু কান্না সে কিছুতেই রোধ করতে পারল না। হাঁটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে উঠল। ফিসফিস করে বলল, নুকোব। জীবনভর তোদের নুকে রাখতে চেয়েছি। তুই, তোর বাপ, মধু, মধুর বাপ, সব্বাইকে আমি মুক্তে রাখতে চাই বাপ, কিন্তুন ভগমান আমার পাখাটা যে তততখানি বড় করে গড়ে দেয়নি।

সে কথা হীরা মানল না। একেবারে দুহাতে কালীর কাপড় সরিয়ে স্তনে মুখ গুঁজে জেদভরে কেঁদে উঠল, তবুনুকে রাখ। বাপ এসে পড়বে।

কালীর জলভরা অন্ধ চোখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, রাখব রে হারামজাদা, রাখব। সর, এখন আর বুকে মুখ দিসনে। নুকোবি, খাবিনে?

বুকে হাত দেওয়া দেখে কালী বুঝেছে, হীরার খিধে লেগেছে। এই বয়সেও কালীর স্তনে মুখ না দিলে হীরার দিন যায় না। যায় না খিধে তেষ্টা, স্বপ্ন নেমে আসে না গাঢ় নিদ্রাচ্ছন্ন চোখের পাতায়। কোনও কিছু চাইতে হলে, বলতে হলে অমনি সে কালীর বুকে হামলে পড়ে। হীরা তো কাঞ্চীবউকে পুরো পায়নি। বছর ঘুরে যেতেই আবার গর্ভবতী হয়েছিল সে। সে যে শত্রু এসেছিল কাঞ্চীর পেটে। সেই কাল শত্রু পেটে এসে নিয়ে গেল কাঞ্চীকে। খাওয়ার কথা শুনে হীরার ভীত ত্রস্ত চোখে দ্বিধা ফুটে উঠল। বলল, খাব, কিন্তুন বাপ আসবে যে।

কালী বলল, রান্নাঘরে খেতে দেব। শেকল এঁটে রাখবখনি, বাপ টের পাবে না।

একে নুকোনো, তায় খাওয়া। হীরার ভাববার অবকাশ ছিল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তবে তাই দে। খবরদার মা, শেকলটা ঝান খুলিসনে।

না, খুলবে না কালী। সে তো জানে, রাগলে লখাইয়ের জ্ঞানকাণ্ড থাকে না।

হীরাকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে যেতেই কালীর মনে হল গোয়ালঘরে কে রয়েছে। রাঙি ফোঁসফোঁস করছে, গলা দিয়ে শব্দ করছে, ঘোঁৎঘোঁৎ করে। রাঙি গাইয়ের নাম। গেল সনেও আর একটা গাই ছিল। মরে গিয়েছে সেই আবাগি। লক্ষ্মী যখন ছাড়ে, তখন এমনি করেই ছাড়ে। কিন্তু রাঙি ফোঁসফোঁস করছে কেন? সে বেটি কার কাছে অমন করে সোহাগ কাড়াচ্ছে! বাছুরটা ছাড়া পেল নাকি? পরমুহূর্তে মাটির ডাবাতে জল ঢালার শব্দ শুনেই বুঝতে পারল মধু বাড়িতে এসেছে। টের পেয়েই মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল তার। ফুলে ফুলে উঠল বোঁচা নাকের পাটা। চোখের দৃষ্টিতে দেখা দিল ক্রোধ।

কিন্তু কোনও কথা না বলে দুম দাম শব্দে দরজা খুলে, ঘটঘট শব্দে হাঁড়িকুঁড়ি নেড়ে হীরার ভাত বেড়ে দিল। দিয়ে, আরও জোরে শব্দ করে টেনে দরজায় শেকল তুলে দিল।

এতে হীরার বিস্ময়ের কিছু ছিল না। মায়ের যে এটা মধুদাদার উপরেই রাগ, তা সে জানে। খেতে খেতে তার শঙ্কিত চোখ গিয়ে বারবার বেড়ার গায়ে ঝাঁপের উপর গিয়ে ঠেকতে লাগল।

কালী উঠোনে এসে একবার থমকে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়েই একবার দেখে নিল আড় চোখে গোয়ালঘরের দিকে। ক্রোধের মাত্রা তার আর একটু চড়ল। কিন্তু কোনও কথা না বলে দুপদাপ করে দাওয়ায় উঠে কলকে নিয়ে তামাক সাজাল। মালসায় আগুন করা ছিল। সেই আগুন চিমটে দিয়ে কলকেয় তুলে বারকয়েক চড়া ফুয়ের ধাক্কায় তুলে ফেলল একেবারে।

শ্যাম তেমনি বসে রয়েছে। ভাবে বিভোর, তার একটি হাত টেনে কোটি ধরিয়ে দিল কালী। শ্যাম বিনা বাক্যব্যয়ে হুঁকোয় মুখ দিল।

কালী আবার একবার দেখল গোয়ালের দিকে। বেড়ায় গোঁজা তলদা বাঁশের গুলের ডিবা থেকে এক টিপ গুল নিয়ে ঘষঘষ করে দাঁত ঘষে একেবারে উঠোনে নেমে এসে ফিরে দাঁড়াল শ্যামের দিকে। তারপর যেন শ্যামকে লক্ষ্য করেই বলছে এমনিভাবে হঠাৎ চড়া গলায় বলে উঠল, আদিখ্যেতা! মরণ! মুখে আগুন অমন আদিখ্যেতার। কথায় বলে, তোর ধন তোরে খাইয়ে হ্যাঁদ্দেখ মোর কাটা। তা, কোন পিরিতের ইয়ার নোকেরা আছে, সেখেনে গেলেই তো হয়। সায়েব মিনসের ইয়ে খেয়ে আর খেমটা মাগির মুখ দেখে কাটালেই তো হয়। কে আসতে বলেছে, কুটোগাছটি নেড়ে কে আমার বাপ চোদ্দোপুরুষকে উদ্ধার করতে বলেছে, অ্যাঁ? বলি কেন, কীসের জন্য?

শ্যাম তেমনি বসে রইল, কেবল বন্ধ হয়ে গেল হুঁকো টানা। হীরা একবার তাড়াতাড়ি ছিটেবেড়ায় খড়খড়ি দিয়ে উঁকি মেরে ব্যাপারটা দেখে নিল। দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আবার ভাতের গরাস মুখে তুলে দিল।

কালীর গলা আর একটু চড়ল, বলি, আমি মাগি কি কারুর কেনা বাঁদি না জোয়াল জোতা বলদ যে, পিণ্ডি সেদ্ধ করে রাখব আর এসে গিলবে? বলি একি ভূতের সংসার, না কি গুলির আড্ডা? তাই যদি হয়, তবে জ্বেলে পুড়ে দিলেই হয়। মানুষের বাচ্চা হয় তো তাই করুক। বাপ মাকে গলা টিপে সব ভাসিয়ে দিক।

বলতে বলতে কী একটা শব্দ শুনে কালী একটু থামল। শব্দটা আর কিছু নয়। মধু বিচুলি কাটছে গোয়ালে বসে, সেই শব্দই শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পাড়ারও দু-চারজন ভিড় করেছে পথের উপরে।

কালী এক মুহূর্তে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে মুসুর ডালগুলি হাত দিয়ে নেড়ে দিল। খইলের চুবড়িটা নাচিয়ে নাচিয়ে উলটে পালটে দিল খইলের ড্যালা। নিজেকে শান্ত করতে চাইছে সে। এত কথা বলেছে সে, কিন্তু বলতে প্রাণ চায়নি। সে দিবানিশি চুপ করে থাকতেই চায়। পারে না যে! একদিন সয়, দুদিন সয়, রোজ রোজ যে সওয়া যায় না। এখন হয়তো সে চুপ করেই যেত, কিন্তু বেড়ার ফাঁক দিয়ে পথের উপর প্রতিবেশীদের দেখে তার অচেতন মনের মধ্যে অধরার মূর্তিটা ভেসে উঠল। সেই সঙ্গেই অধরার ছেলের বউয়েরও। মনে হতে তার গলার মধ্যে যেন একটা ক্ষুরধার রামদা শানিয়ে উঠল। একেবারে বেড়ার কাছে গিয়ে, অধরার বাড়ির দিকে মুখ করে চিৎকার করে উঠল সে, এখনও মাথার পরে ভগমান আছে। ওই গাঁ-ভাতারি খেমটির ব্যাটার বউ নিয়ে নটঘট করে বেড়ানোর শোধ নেবে ভগমান। ওর ওই পাপের শরীল শকুনে খাবে। এতখানি বলারও দরকার ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে অধরার মদ ও তামাকের নেশাখোর মোটা গলা রনরনিয়ে উঠল তার ঘরের হেঁচকোল থেকে। দুজনেই দুজনকে দেখতে পাচ্ছে দূর থেকে, কিন্তু দু জনেই পিছন ফিরে, পরস্পরের দিকে না তাকিয়ে, প্রতিবেশীদের দিকে লক্ষ্য করে বলছে।

এতক্ষণে হার মানল মধুর নীরবতা। গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কেন মিছিমিছি ওদের পেছুতে লাগছিস। যা বলতে হয় আমাকে বল।

অধরার সঙ্গে কালীর শত্রুতা আজকের নয়। তার উপরে, সে সব ছেড়ে যখন তার আসল শত্রুর বিরুদ্ধেই তার জেহাদ ঘোষণা করতে চলেছে, অধরাকে গাল দিয়ে সে যখন পোড়া মনের সান্ত্বনা খুঁজছে, তখন মধুর কাছ থেকে এরকম বাধা পেয়ে কালী একেবারে নির্মম হয়ে উঠল। ছেলের দিকে প্রায় বাঘিনীর মতো কয়েক পা অগ্রসর হয়ে সে গালাগাল দিয়ে উঠল, তুই তো বলবিই রে মুখপোড়া, তোর পিরিতের হারামজাদিকে যে আমি বলেছি। তোর আঁতে বড় ঘা নেগেছে ওই মিষ্টি মুখের কথা মনে করে। ওরে নষ্ট নচ্ছার, ওরে পেটের শত্তুর–

মধু অনেকক্ষণ থেকে শুনে শুনে এবার চড়া গলায় বেঁকিয়ে উঠল, থাম, অনেক চেঁচিয়েছিস, এবার থাম।

কিন্তু থামা দূরের কথা, এতে ঘৃতাহুতিই পড়ল। কালী আরও অগ্রসর হয়ে বলল, কেন মারবি?

দপদপ করে জ্বলে উঠল কালীর চোখ। চোখ জ্বলছে মধুরও। এখনও তার পরনে সেই ভেজা কাপড়। এতক্ষণে আধ-শুকনো হয়ে এসেছে কাপড়টা।

কথার জবাব না দিয়ে বিচুলিকাটা কাটারিটা গোয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আগল ঠেলে বেরিয়ে গেল সে। পথে দু-চারজন যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা সরে তাড়াতাড়ি মধুর পথ ছেড়ে ছিল। মধু তো নয়, তার কুদ্ধ ক্ষিপ্র গতি দেখে মনে হয় একটা কালো বিষধর শনশন করে ফণা তুলে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে।

কালী পেছন থেকে আরও নির্মম গলায় দিব্যি দিয়ে বলল, যেখেনে যাচ্ছিস, আর আসিসনে আসিসনে আসিসনে। যদি আসিস তবে তোর মা বাপের

তড়িৎগতিতে গলার স্বরকে রাশ টেনে ধরে ডুকরে উঠে থেমে গেল কালী। না বলি না বলি করেও সে এত কথাবলে পারেনি। কিন্তু যার জন্য বলা সে আজ বহুদূরে চলে গিয়েছে। স্নেহ, শাসন, রূঢ়কথা কোনও কিছু দিয়েই আজ আর ছেলের চিত্ত জয় করা যায় না। হৃদয়ের রুদ্ধ যন্ত্রণা বাঁধভাঙা কন্যার মতো হুহু করে ছুটে এল চোখের জলে। অবচেতন মনে এল অনুশোচনা। হয়ত মিষ্টি কথা বললে মধু ফিরে আসত। কিন্তু এ তরফের মিষ্টি ও টক সবই বুঝি আজ মধুর কাছে একাকার হয়ে গিয়েছে।

দু হাতে মুখ ঢেকে মনে মনে বলে উঠল, না না, তোর বাপের নয়রে, বাপের নয়, তোর মার মাথা খাস তুই। তোর এই জমো শত্তুর মাকে যেন গঙ্গা আজ রাতেই মুখে করে নিয়ে যায়।…

ওদিকে অধরাকেও থামতে হয়েছে। তাকে কারখানায় চলে যেতে হয়েছে বউ নিয়ে। তাই সমস্ত কোলাহল আচমকা থেমে গিয়ে সমস্ত পাড়াটা যেন অতিমাত্রায় নিঝুম হয়ে গেল।

শ্যাম বসে রয়েছে পাথরের মূর্তির মতো। ভাবলেশহীন, অনড়, নিশ্চল। হীরা সবই সইতে পারে, মায়ের কান্নাটা সহ্য করতে পারে না। রান্নাঘরের অন্ধকার কোলে উলঙ্গ হয়ে বসে মুখে ভাত নিয়ে চুপ করে বসে আছে সে। ছলছল করছে চোখ দুটি। কেন যে এমনটি হয়, এত বিবাদ বিসম্বাদ ও চিৎকার, তা সে হাজার ভেবে ভেবেও ঠাউরে উঠতে পারে না। মধুদাদার মতো মানুষের প্রতি কেন বা মায়ের, তার নিজের বাপের, আরও নানান লোকের এত রাগ, আর কেন বা তাই নিয়ে মা কেঁদে কেঁদে অমন করে বলে, সে কিছুই বোঝে না।

.

১০.

 সূর্য ঢলে গিয়েছে, পাটে নামার দিকে ঝুঁকেছে সে। ঝিমিয়ে এসেছে পৌষের দুপুর। দুটি সন্ত্রস্ত পায়রা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে খুঁটে খুঁটে ডাল খেতে লাগল। কেউ তাদের তাড়া দিল না। পথের উপর থেকে ডেকে উঠল রাঙির বাছুরটা। রাঙিও গোয়াল থেকে সাড়া দিল।

লখাই ঢুকল বাড়িতে। সে সবই শুনেছে দূর থেকে, ইচ্ছে করেই বাড়িতে ঢোকেনি। নিজেকে যদি সে সামলাতে না পারে, যদি কিছু বলে বসে মধুকে। মধুর সঙ্গে সে কথা বলে না। তার সাহেব-প্রীতির প্রতি এক বিজাতীয় ঘৃণাবশতই সে কোনও কথা বলে না। বলতে গেলে অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যাবে। সে অবস্থা কালীবউঠানের প্রাণে লাগবে, তাই মধুর কথায় সে কখনও থাকে না।

কিন্তু তার সারা মুখে অসহ্য বিরক্তি ও বেদনার গাঢ় ছায়া পড়েছে। কিছুক্ষণ আগেই দুলেপাড়ায় সাহেব আসার ঘটনা নিয়ে ক্রোধে ও তিক্ততায় ভরে উঠেছে তার হৃদয়। দ্বীপে আবদ্ধ বন্দির মতো তার আত্মা আজ নিজের মধ্যে গুমরে মরছে।

উঠোনে ঢুকে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। পরমুহূর্তেই তার নজরে পড়ল পেয়ারাকাঠের হাতুড়িটা। দেখে তার হৃদয়ে ব্যর্থ আক্রোশ ও যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। ওটা হাতুড়ি হলে আপত্তি ছিল না। ওটা হীরার হাম্বর। জেনেও বিরক্ত ও বিদ্বেষবশত কোনওদিন এই সামান্য বস্তুটি সে ছিনিয়ে নেয়নি হীরার হাত থেকে। আজ, এই মুহূর্তে সহ্য করতে পারল না। হাতুড়ি নিয়ে হাতের চাপে টুকরো টুকরো করে ফেলল। দলা পাকিয়ে ফেলে দিল বেড়ার বাইরে। তারপর, বোধহয় হীরার উদ্দেশেই বার কয়েক এদিক ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে শ্যামের কাছে গিয়ে চুপ করে বসে রইল।

হীরা দেখল সমস্ত ব্যাপারটা। লখাইকে দেখে হাত পা শক্ত করে বসে ছিল সে। ধুকধুক করছিল বুকের মধ্যে। প্রতিমুহূর্তে ভাবছিল, এই বুঝি ঝনাত করে শেকলটা খুলে চিলের মতো ছোঁ মেরে তুলে নেবে তাকে লোকটা। কিন্তু তার পরিবর্তে পেয়ারাকাঠের হাম্বরটা ভাঙতে দেখেই চকিতে এ শিশুর সমস্ত ভয়ের ভাব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। দপ করে চোখ দুটি জ্বলে উঠে বেড়ার খড়খড়ির কাছে উদ্যত ফণার মতো মাথাটা তার উঠে গেল। শিশুর অন্ধ রাগে প্রথমে তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল, বেঁকে উঠল ঠোঁট দুটি। ওই বস্তুটি তার পরম ধন, তার শিশুজীবনের সমস্ত আশা ও আকাঙ্ক্ষা। ওটি সঙ্গীর মতো দিনে রাতে তার কোমরে ঝোলে, ওর সঙ্গে সে নিরালায় কত কথা বলে। গারুলিয়ার চটকলের কারখানার বড় মেশিন যেদিন থেকে দেখেছে সে, সেইদিন থেকে নিজের মনে স্বপ্ন রচনা করেছে। নিজেকে দেখেছে, ওই বিরাট ঘরের প্রকাণ্ড মেশিনে সে একলা কাজ করছে। মেশিন কোথাও বিগড়ে গেলে তার ওই কাঠের হাম্বরের এক ঘা খেয়েই সেই মেশিন আবার চলতে শুরু করেছে সুড়সুড় করে। ওটি তার অনেক দিনের সঙ্গী, তৈরি করে দিয়েছিল গোলাম। বলেছিল, হারাসনি, ওতে যন্তরের জিন আছে। ওটা দিয়ে হুকুম করলে আপনি চলবে।

সে বিষয়ে অবশ্য হীরার মনে কিঞ্চিৎ সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বস্তুটিই যে তার ভবিষ্যতে মিস্তিরি হওয়ার যন্ত্র। ওটাকে কেন্দ্র করে তার অন্যান্য সমস্ত দুর্বোধ্য চিন্তার বিচিত্র ও কাঁচা রস উথলে তুলেছিল। সে যে আর কোনওদিনই ফিরে আসবে না। কে জানে, ওর মধ্যে সত্যিই ছিল কিনা যন্ত্রের জিন!

কিন্তু এখান থেকে চেঁচিয়ে ওঠার সাহস তার ছিল না। পাতের ভাত মুঠো মুঠো নিয়ে ছুঁড়ে ছড়িয়ে ফেলে দিল সারা ঘরময়, ঢেলে দিল কাঁচা মেঝেয় ঘটির জল, থুথু করে ফেলে দিল মুখের ভাত। তারপর বেড়ায় মুখ দিয়ে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল কান্নায়।

কালী উঠে এল দাওয়ায়। লখাই তেমনি বসেছিল। আত্মচিন্তায় অস্থির তার চোখের দৃষ্টি শূন্যে নিবদ্ধ। মুখ না ফিরিয়েই ডাকল, বউঠান।

কালী বলল, বল।

 বউঠান, চটকল কোম্পানির সায়েবরা এ গাঁ কিনে নেবে।

অনেক ব্যথা, অনেক যন্ত্রণার পর, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরে স্তব্ধ হয়ে রইল কালী। শ্যামের ভাবলেশহীন পাথরের চোখের সঙ্গে তার চোখে আর কোনও তফাত রইল না।

সারা শরীরের রক্তস্রোত যখন বিষে জরজর হয়ে ওঠে, তখন মানুষ এমনি ভাব ও ভাবনাহীন, নির্বাক ও আড়ষ্ট হয়ে যায়।

লখাই আবার বলল, হীরাকে আমি এখান থেকে সইরে দেব বউঠান, ওকে এখানে আমি থাকতে দেব না।

কালীর ঠোঁট বেঁকল না, কোনও বিকৃতি দেখা দিল না মুখে। ভাঙা ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলল, সে-ই ভাল গো, সেই ভাল। সবাই যাক, কেন কীসের জন্যে বা কিছু থাকা। অনেক ছিল, অনেক গেল, ঠারপো, এই দু চোখ ভরে শুধু যেতে দেখছি।…যেদিনে কাঞ্চী গেল..

অতল নৈঃশব্দ্যে মিলিয়ে গেল কালীর গলার স্বর। পাশাপাশি বসে রইল তারা তিনজন। হীরা তখন রান্নাঘরের চালার লাগোয়া গোয়ালঘরের ফাঁকটা দেখে পালাবার জন্য চেষ্টা করছে খুঁটি বেয়ে ওঠার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *