১৫. দর্শনের উপযোগিতা

১৫. দর্শনের উপযোগিতা

 দর্শনের সমস্যা সম্পর্কে আমাদের সংক্ষিপ্ত ও নিতান্তই অসম্পূর্ণ পর্যালোচনার শেষে এসে, সিদ্ধান্ত হিসেবে আলোচনা করলে ভাল হবে যে দর্শনের উপযোগতা কি এবং কেন এটি অধ্যয়ন করা উচিত। এই প্রশ্নটি আলোচনা করা খুবই প্রয়োজনীয় এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বহু ব্যক্তি বিজ্ঞানের বা প্রাত্যহিক ঘটনার সংস্পর্শে এসে সন্দেহ প্রকাশ করার প্রবণতা দেখায় যে নিষ্পাপ অথচ অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ বিষয়, চুল-চেরা পার্থক্য এবং যে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অসম্ভব সেই বিষয়ের দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করে দর্শন আদৌ ভাল কিছু করে কিনা।

দর্শন সম্পর্কে এই মতে আসার কারণ আংশিকভাবে জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে ভুল ধারণা এবং আংশিকভাবে দর্শন যে বিষয়গুলোতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা। পদার্থবিজ্ঞান তার আবিষ্কারের মাধ্যমে এমন অসংখ্য ব্যক্তির কাজে আসছে যারা এর সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই পদার্থবিজ্ঞন পড়ার সুপারিশ করা হয় শুধুমাত্র বা মুখ্যত ছাত্রদের উপর এর প্রভাবের জন্য নয়, বরং সাধারণভাবে মানবজাতির উপরে এর প্রভাব পড়ে বলে। দর্শনের এই ধরনের উপকারিতা নেই। দর্শনের ছাত্রদের উপরে ছাড়া অন্যত্র যদি দর্শনচর্চার কোন মূল্য থাকে, তাহলে তা অবশ্যই শুধুমাত্র অপ্রত্যক্ষভাবে এবং যারা এর চর্চা করে সেই ব্যক্তিদের জীবনে এর প্রভাবের মাধ্যমে। সুতরাং দর্শনের উপযোগিতা যদি কোথাও খুঁজতে হয় তাহলে তা মুখ্যত এই প্রভাবগুলোর মধ্যেই খুঁজতে হয় তাহলে তা মুখ্যত এই প্রভাবগুলোর মধ্যেই খোঁজা উচিত।

কিন্তু যদি আমরা দর্শনের উপযোগিতা নিরূপণ করার চেষ্টা বিফল হতে না চাই, তাহরে আমাদের অবশ্যই ব্যবহারিক ব্যক্তি নামে ভূলভাবে চিহ্নিত কুসংস্কারের হাত থেকে মনকে মুক্ত করতে হবে। ব্যবহারিক ব্যক্তি, এই অভিধানটি প্রায়শই ব্যবহার হয়, হল সে যে শুধুমাত্র পার্থিব প্রয়োজন স্বীকার করে, শরীরের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, কিন্তু মনের খাদ্য যোগানোর প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলে যায়। যদি সমস্ত ব্যক্তি ধনী হয়, যদি দারিদ্র ও অসুখ একেবারে নিম্নসীমায় পৌঁছায়, তাহলেও একটি মূল্যবান সমাজ তৈরি করতে গেলে অনেক কিছুই করতে হবে; এবং বর্তমান পৃথিবীতে দেহের বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার থেকে মনের বিষয়ের প্রয়োজনীয়তায় কম গুরুত্ব দেয়া হয়। একমাত্র মনের বিষয়ের মধ্যেই দর্শনের উপযোগিতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে এবং যারা এই বিষয়গুলোর প্রতি উদাসীন নন একমাত্র তাদেরকেই বলা যায় যে দর্শনচর্চা সময়ের অপচয় নয়।

অন্য সব বিষয়ের মত দর্শনও মূখ্যত জ্ঞানের দিকেই লক্ষ্য রাখে। যে জ্ঞানের প্রতি এর লক্ষ্য তা হল সেই ধরনের জ্ঞান যা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে সংযুক্ত করে এবং সেই ধরনের জ্ঞান যা আমাদের ধারণা, সংস্কার ও বিশ্বাসের বিচারপূর্ণ পরীক্ষার পর আসে। কিন্তু এটা বলা যায় না যে তার প্রশ্নাবলির নিশ্চিত উত্তর খোঁজার চেষ্টায় দর্শনের এক বিরাটা সাফল্য রয়েছে। যদি আপনি কোন গণিতজ্ঞ, কোন খনিতত্ত্ববিদ, কোন ঐতিহাসিক অথবা অন্য কোন বিষেয়ের ব্যক্তিকে প্রশ্ন করেন যে তিনি তার বিজ্ঞানের দ্বারা কোন্ সত্যে পৌঁছাতে পেরেছেন, তাহলে তার উত্তর তত দীর্ঘ হবে যতক্ষণ আপনি শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন। কিন্তু যদি আপনি ওই একই প্রশ্ন কোন দার্শনিককে করেন, তাহলে ভোলা মনে স্বীকার করলে তিনি বলবেন যে তার চর্চা সেরকম কোন সদার্থক ফলে আসতে পারেনি যেরকম অন্য বিজ্ঞানগুলো পেরেছে। এটা সত্যি যে এর জন্য কিছুটা দায়ী করা যায় এই ঘটনাকে যে, যখনই কোন বিষয় সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ সম্ভব হয়েছে, তখনই সেই বিষয়টি দর্শন বলে পরিচিত হওয়া পরিত্যাগ করেছে এবং একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। যাবতীয় মহাকাশ-চর্চা, যা এখন মহাকাশ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত, এককালে দর্শনের অধীনে ছিল। নিউটনের বিখ্যাত কাজ প্রাকৃতিক দর্শনের গাণিতিক নীতি নামে পরিচিত ছিল। একইভাবে মানবমন চর্চা দর্শনের অংশ ছিল, এখন তা দর্শনের থেকে আলাদা হয়ে মনস্তত্ত্ব নামে পরিচিত হয়েছে। এভাবে, দর্শনের অনিশ্চয়তা বহুলাংশেই প্রাতিভাসক, সত্য নয়। যেসব প্রশ্নর নিশ্চিত উত্তর সম্ভব সেগুলোকে বিজ্ঞানের আওতায় আনা হয়েছে এবং শুধুমাত্র যেগুলোর বর্তমানে কোন নিশ্চিত উত্তর দেয়া সম্ভব নয় সেগুলোই অবশিষ্ট হিসেবে দর্শন নামক বিষয়টি তৈরি করেছে।

এটি অবশ্য দর্শনের অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে সত্যের একটি অংশমাত্র এমন অনেক প্রশ্ন আছে-এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি আমাদের ধর্মীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-যা, যতদূর আমরা দেখি, অবশ্যই মানুষের বুদ্ধির পক্ষে অসমাধানযোগ্য রয়ে যাবে, যতক্ষণ না তার শক্তিগুলো বর্তমানের থেকে ভিন্ন বর্গের হয়ে ওঠে। মহাবিশ্বের কোন পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য আছে কি, নাকি এটি পরমাণুর আকস্মিক মিলন? চৈতন্য কি জগতের কোন স্থায়ী অংশ যা জ্ঞানের অনন্ত বৃদ্ধির আমার জোগায়, নাকি এটা একটি ক্ষুদ্র নক্ষত্রে অস্থায়ী অঘটন যেখানে জীবন অবশেষে অবশ্যই অসম্ভব হয়ে পড়বে? পাপ ও পুণ্য কি জগতের কাছে প্রয়োজনীয়, নাকি শুধুমাত্র ব্যক্তির কাছে? এই ধরনের প্রশ্নগুলো দর্শন উত্থাপন করে এবং বিভিন্ন দার্শকিরা এর ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দেন। কিন্তু এটা মনে হয় যে উত্তরগুলো অন্যভাবে আবিষ্কৃতি হোক বা না-ই হোক, দর্শনের দ্বারা প্রস্তাবিত উত্তরগুলোর কোনটিই প্রয়োগবহুলভাবে সত্য নয়। কিন্তু উত্তর আবিষ্কার করার আশা যতই সামান্য হোক না কেন, দর্শনের কাজ হল এই ধরনের প্রশ্নের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, এগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের অবহিত করা, এগুলোর প্রতি সমস্ত মনোভাবকে পরীক্ষা করা এবং জগতের প্রতি সেই চিন্তাশীল ইচ্ছা জাগিয়ে রাখা যা শেষ হয়ে যেতে পারে যদি আমরা নির্দিষ্ট জ্ঞানের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাই।

এটি সত্য যে অনেক দার্শনিক বলেন দর্শন এই ধরনের মূল প্রশ্নগুলোর সত্যতার নিশ্চিত উত্তর দিতে পারে। তারা মনে করেন ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাকে কঠিন প্রয়োগর দ্বারা সত্য বলে প্রমাণ করা যেতে পারে। এইধরনের প্রচেষ্টার বিচার করার জন্য মানব-জ্ঞানের পর্যালোচনা করা এবং এর পদ্ধতি ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে একটি মতবাদ তৈরি করা প্রয়োজন। এই ধরনের বিষয়ে যুক্তিহীনভাবে কিছু বলা নিতান্তই অবিবেচকের কাজ, কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর অনুসন্ধান যদি আমাদের বিপথে চালিত না করে, তাহলে আমরা ধর্মীয় বিশ্বাসের দার্শনিক প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা অবশ্যই ত্যাগ করতে বাধ্য হব। সুতরাং আমরা এই ধরনের প্রশ্নের কোন নির্দিষ্ট উত্তরকে দর্শনের উপযোগিতার অংশ হিসেবে রাখতে পারব না। অতএব আরও একবার বলা দরকার-দর্শনের উপযোগিতা অবশ্যই কোন প্রস্তাবিত নির্দিষ্ট নিরূপণযোগ্য জ্ঞানের উপর নিরূপণযোগ্য জ্ঞানের উপর নির্ভর করবে না যা তাদের দ্বারা আহরিত হবে যারা এর চর্চা করছে।

আসলে দর্শনের মূল্য মূলত খোঁজা উচিত এর অনিশ্চয়তার মধ্যেই। যে ব্যক্তির সঙ্গে দর্শনের কোন সংস্পর্শ নেই সে সারা জীবন সাধারণ জ্ঞান থেকে, তার সময়ের, তার জাতির স্বভাবগত দৃঢ় বিশ্বাসের থেকে এবং তার ইচ্ছাকৃত যুক্তিগত কারণের অনুমোদন বা সহযোগিতা ছাড়াই যেসব দৃঢ় বিশ্বাস তার মনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, তা থেকে আহরিত সংস্কারে আবদ্ধ থাকে। এই ধরনের ব্যক্তির কাছে জগৎ সুনির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ ও স্বাভাবিক, সাধারণ বিষয় তার মধ্যে কোন প্রশ্ন জাগায় না এবং অজানা সম্ভাব্যতাকে সে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করে। অপরপক্ষে, যখনই আমরা দার্শনিকতা শুরু করি, আমরা দেখি, যেমনটা আমরা শুরুর অধ্যায়গুলোতে দেখেছি, যে এমনকি খুব সাধারণ প্রাত্যহিক বিষয়ও সমস্যার দিকে নিয়ে যায়, যার শুধুমাত্র অসম্পূর্ণ উত্তরই দেয়া সম্ভব। দর্শন যদিও আমদের নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে অসমর্থ যে, যে সন্দেহগুলো উত্থাপিত হয়েছে তার সত্য উত্তর কি হবে, কিন্তু সে অনেক সম্ভাবনা উপস্থাপিত করতে পারে যা আমাদের চিন্তাকে বিস্তৃত করে এবং চিন্তাকে প্রথার অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করে। এভাবে, বিষয়গুলো আসলে কি তার নিশ্চয়তার অনুভবকে কমিয়ে আনার পাশাপাশি সে ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানকে অনেক বাড়িয়ে তোলে দর্শন। বিষয়গুলো কি হতে পারে তা সেসব ব্যক্তিদের উদ্ধত যুক্তিহীনতাকে সরিয়ে দেয় যারা কখনও অবাধ সংশয়ের জগতে বিচরণ করেনি এবং জানা বিষয়গুলোকে অজানা দিক থেকে দেখিয়ে এটি আমাদের আশ্চর্যতার ভাবকে তাজা রাখে।

অসন্দেহজনক সম্ভাব্যতার উপযোগিতা দেখানো ছাড়াও দর্শনের অন্য একটি উপযোগিত রয়েছে, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতা–বিষয়ের বিশালতায় মনোযোগী হয়ে এবং ক্ষুদ্র ও নিজস্ব লক্ষ্যের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে যা এই সাধনার মধ্যে দিয়ে পাওয়া গিয়েছে। প্রবৃত্তিনির্ভর মানুষের জীবন তার নিজস্ব স্বার্থের গণিতে আবদ্ধ থাকে; পরিবারও বন্ধুবর্গ হয়তো এর মধ্যে থাকে, কিন্তু বহির্জগৎকে ধরা হয় না শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্র বাদে যেখানে এটি প্রবৃত্তিগত ইচ্ছার গন্ডির মধ্যে আসা বিষয়কে সাহায্য করে বা বাদ দেয়। এই ধরনের জীবন স্বাধীন ও শান্ত দার্শনিক জীবনের তুলনায় কিছুটা আবদ্ধ ও অসুস্থ। প্রবৃত্তিযুক্ত স্বার্থের ব্যক্তিগত জগৎ হল ক্ষুদ্র, বিশাল ও শক্তিময় জগতের মাঝখানে স্থিত, যে জগৎ অবশ্যই আগে বা পরে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেয়। যতক্ষণ না আমরা আমদের স্বার্থকে এমনভাবে বাড়াতে পারি যার মধ্যে সম্পূর্ণ বহির্জগৎ অন্তর্ভুক্ত হয়, ততক্ষণ আমরা কোন এক প্রহরাহীন দুর্গের সৈন্যদল, যারা জানে যে শত্রু পালাতে দেবে না এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করা অবশ্যম্ভাবী। এই ধরনের জীবনে কোন শান্তি নেই, বরং আশার চাপ ও শক্তিহীনতার ইচ্ছার মধ্যে সর্বক্ষণের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আমরা যদি আমাদের জীবনকে মহান ও স্বাধীন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই এই বন্দিশালা ও দ্বন্দ্বের থেকে কোন না কোনভাবে মুক্তি পেতে হবে।

দার্শনিক সাধনা হল মুক্তির একটি পথ। দার্শনিক সাধনা এর বিশাল ক্ষেত্রে জগৎকে দুটি বৈরী গোষ্ঠীতে ভাগ করে না-বন্ধু ও শত্রু, সাহায্যকারী ও অনিষ্টকারী, ভাল ও মন্দ-এটি সমগ্রকে পক্ষপাতহীনভাবে দেখে। দার্শনিক সাধনা, যখন এটি অমিশ্রিত থাকে, এই ধরনের প্রমাণে ব্রতী হয় না যে জগতের অবশিষ্ট অংশ মানুষের উপকারে আসে। যে কোন জ্ঞানেরই আহরণ নিজেকে বড় করে তোলে, কিন্তু এই বড়ত্বে তখনই সবথেকে ভালভাবে পৌঁছানো যায় যখন এটি প্রত্যক্ষভাবে চাওয়া হয় না। এটি পাওয়া যায় যখন একমাত্র জ্ঞানের ইচ্ছাই কাজ করে, এমন চর্চার দ্বারা যা আগে থেকে চায় না যে এর বিষয়ের এই বা ওই চরিত্র হোক, বরং নিজেকে সেসব চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে নেয় যা এটি তার বিষয়গুলোতে পায়। আত্মার এই বড়ত্ব পাওয়া যায় না যখন আত্মাকে যেরকম আছে সেভাবেই নেয়া হয়। আমার দেখানোর চেষ্টা করি যে জগতের সঙ্গে এই আত্মার এতই মিল আছে যে যাকে প্রতিকূল বলে মনে হচ্ছে তাকে প্রবেশাধিকার না দিয়েও এর জ্ঞান সম্ভব। এটি প্রমাণ করার ইচ্ছা হল একধরনের আত্মপক্ষ সমর্থন এবং সমস্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের মতই এটি আত্মবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বাধ্য, যা এটি চায় এবং যা আত্ম জানে যে সে পারবে। অন্যান্য ক্ষেত্রের মত দার্শনিক আত্মসমর্থন চিন্তার ক্ষেত্রেও জগৎকে তার নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে দেখে। এভাবে এটি জগৎকে আত্মার থেকে কম মূল্য দেয় এবং আত্মা তার বিষয়ের বিশালত্বের ক্ষেত্রে গন্ডি কেটে দেয়। অপরপক্ষে, সাধনার ক্ষেত্রে আমরা অনাত্ম (Not-Self) দিয়ে শুরু করি এবং এর মহত্ত্বের দ্বারা আত্মার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করা হয়, জগতের অসীমত্বের মধ্যে দিয়ে সাধনার মাধ্যমে মন এর অসীমত্বের কিছু স্বাদ গ্রহণ করে।

এই কারণে আত্মার মহত্ত্ব সেইসব দর্শনের দ্বারা প্রচারিত হয় না যা জগৎকে মানুষের সঙ্গে এক করে। জ্ঞান হল একধরনের আত্মা ও অনাত্মার মিলন এবং সব মিলনের মতই এটি আধিপত্যের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়, সুতরাং যা আমরা নিজেদের মধ্যে পাচ্ছি তা জোর করে জগতের মধ্যে দেখার কোন চেষ্টাও বাধাপ্রাপ্ত হয়। একধরনের বহুল প্রচলিত দার্শনিক আগ্রহ সেই মতের দিকে দেখা যায় যা আমাদের বলে যে মানুষ হল সবকিছুর পরিমাপক, সত্য হল মানুষের তৈরি, দেশ ও কাল এবং সামান্যের জগৎ হল মনের সম্পত্তি এবং মনের দ্বারা সৃষ্ট কোন কিছু না থাকলে এবং তা আমাদের কোন কাজে না লাগলে তা জানা অসম্ভব। এই মত, যদি আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনা সঠিক হয়, হল অসত্য, কিন্তু অসত্য হবার পাশাপাশি এটি দার্শনিক সাধনাকেও বঞ্চিত করে যা এর মূল্যের কারণ, যেহেতু এটি আত্মার সাধনার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। এটি যাকে জ্ঞান আখ্যা দেয় তা অনাত্মার সঙ্গে কোন মিলন নয়, বরং একগুচ্ছ সংস্কার, অভ্যাস ও ইচ্ছা, যা আমাদের ও জগতের মধ্যে একধরনের অভেদ্য আবরণ সৃষ্টি করে। যে ব্যক্তি এই ধরনের জ্ঞানতত্ত্বে আনন্দ পায় সে হল সেই ব্যক্তির মত যে কখনও সাংসারিক গন্ডি ত্যাগ করেনি এই ভয়ে যে তার কথা আইন হিসেবে গ্রাহ্য হবে না।

অপরপক্ষে, যথার্থ দার্শনিক চিন্তা প্রত্যেক অনাত্মার বৃদ্ধির মধ্যে সন্তোষ খুঁজে পায়, যা কিছু অনুশীলিত বিষয়কে বড় করে দেখায় তার মধ্যে সন্তোষ খুঁজে পায় এবং এভাবে যে বিষয়ে মনোনিবেশ করা হয়েছে তাতেও সন্তোষ খুঁজে পায়। মনোনিবেশের মধ্যে যা কিছু ব্যক্তিগত বা গোপন, যা কিছু অভ্যাস, স্বার্থ বা ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, তা বিষয়কে বিকৃত করে এবং ফলত বুদ্ধি যে মিলন চায় সেই মিলনে বাধার সৃষ্টি করে। এভাবে জ্ঞাতা ও বিষয়ের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, এই ব্যক্তিগত ও গোপন বিষয়গুলো চিন্তাশক্তির বন্দিশালায় পরিণত হয়। স্বাধীন চিন্তাশক্তি ঈশ্বরের মতো করেই প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ, কোন এখানে ও এখন ছাড়াই, কোন আশা ও ভয় ছাড়াই, কোন প্রথাগত বিশ্বাস, ঐতিহ্যগত সংস্কারের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই, শান্তভাবে। আবেগহীনভাবে, শুধুমাত্র জ্ঞান লাভের ইচ্ছায়-নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান, শুদ্ধ চিন্তাশক্তি হিসেবে ব্যক্তির পক্ষে যেভাবে তা লাভ করা সম্ভব। অতএব স্বাধীন চিন্তাশক্তি বিমূর্ত ও সামান্য জ্ঞানকে বেশ গুরুত্ব দেবে যাতে ব্যক্তিগত ঘটনা প্রবেশ করেনি; বেশি গুরুত্ব দেবে সেই জ্ঞানের তুলনায় যা ইন্দিয় দ্বারা পাওয়া যায় ও ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভরশীল, যেহেতু এই ধরনের জ্ঞান অবশ্যই নির্ভর করে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির উপর ও দেহের উপর যার ইন্দ্রিয়গুলো প্রকাশের থেকে বিকৃতই বেশি করে।

যে মন দার্শনিক চিন্তাশক্তির স্বাধীনতা ও পক্ষপাতহীনতায় অভ্যস্ত, তা কর্ম ও অনুভূতির জগতেও একই ধরণের স্বাধীনতা ও পক্ষপাতহীনতাকে ধরে রাখতে চায়। এটি এর উদ্দেশ্য ও ইচ্ছাকে সমগ্রর অংশ হিসেবে দেখে এবং দেখে কোনরকম জোর ছাড়াই যা এদের জগতের অনন্ত অংশের ফল, যে জগতের বাকি সবকিছু একজন ব্যক্তির কাজের দ্বারা বিঘ্নিত হয় না। পক্ষপাতহীনতা, যা চিন্তাশক্তির ক্ষেত্রে সত্যের প্রতি অমিশ্ৰিত ইচ্ছা, তা হল মনের সেই একই গুণ যা কাজে, ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ও অনুভূতির ক্ষেত্রে হল সেই সামান্য প্রেম যা শুধুমাত্র যাদেরকে প্রয়োজনীয় বা প্রশংসনীয় বলে বিচার করা হয় তাদেরই নয়, বরং সবাইকে দেয়া যায়। এভাবে চিন্তাশক্তি শুধুমাত্র চিন্তার বিষয়কেই বৃদ্ধি করে না, বরং আমাদের কর্মের ও অনুভূতির বিষয়কেও বৃদ্ধি করে: এটি আমাদের শুধুমাত্র যুদ্ধের সময়ে অন্যদের সঙ্গে একটি দেয়ালঘেরা শহরের সদস্য করে তোলে না, বরং জগতের সদস্যে পরিণত করে। জগতের এই সদস্যপদেই ব্যক্তির প্রকৃত স্বাধীনতা রয়েছে এবং সংকীর্ণ আশা ও ভয়ের হাত থেকে মুক্তি নিহিত থাকে। . এভাবে আমাদের আলোচ্য দর্শনের উপযোগিতার সংক্ষিপ্তসার হল : দর্শন চর্চা করা উচিত কোন প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তরের জন্য নয়, যেহেতু নিয়ম অনুসারে কোন নির্দিষ্ট উত্তরই সত্য বলে জানা যায় না, বরং প্রশ্নগুলোর নিজস্বতার জন্য, কেননা এই প্রশ্নগুলো আমাদের সম্ভাব্যতার ধারণা বাড়ায়, বৌদ্ধিক কল্পনাকে বৃদ্ধি করে এবং অযৌক্তিক নিশ্চয়তা কমায় যা মনকে বিবেচনার বিরুদ্ধে দাঁড় করায়; কিন্তু সর্বোপরি, দর্শন যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে জগতের সেই বিশালতার মধ্যে, মনও বিশাল হয়ে ওঠে এবং জগতের সঙ্গে যুক্ত হতে সমর্থ হয়-যা সর্বোত্তমকে তৈরি করে।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *