১৩. জ্ঞান, ভ্রান্তি ও সম্ভাব্য মত

১৩. জ্ঞান, ভ্রান্তি ও সম্ভাব্য মত

সত্যতা ও মিথ্যাত্ব এই প্রশ্নের দ্বারা আমরা কি বুঝি, যা আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, তা এই প্রশ্নের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম চিত্তাকর্ষক যে কিভাবে আমরা জানি কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা। বর্তমান অধ্যায়ে এই প্রশ্নটি নিয়েই আমরা আলোচনা করব। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের কিছু বিশ্বাস হল ভ্রান্ত। অতএব আমরা অনুসন্ধান করতে উদ্যত হই–কি নিশ্চয়তা আমাদের আছে যে এই–এই বিশ্বাস ভ্রান্তিমূলক নয়। অন্য কথায়, আমরা কি কখনও আদৌ কিছু জানতে পারি, নাকি আমরা কখনও কখনও কোন কিছুকে সত্য বলে বিশ্বাস করি? এই প্রশ্নটি আলোচনা করার আগে আমরা অবশ্যই সর্বপ্রথমে স্থির করবো জানা বলতে আমরা কি বুঝি এবং এই প্রশ্নটি তত সহজ নয় যতটা সহজ বলে মনে করা হয়।

প্রথম দর্শনে আমরা কল্পনা করতে পারি যে জ্ঞানকে সত্য বিশ্বাস বলে সংজ্ঞা দেওয়া যায়। যখন যা আমরা বিশ্বাস করি তা সত্য হয়, তখন মনে করা যেতে পারে যে আমরা যা বিশ্বাস করি তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি। কিন্তু যেভাবে শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে এটি মেলে না। এটি অতি তুচ্ছ দৃষ্টান্ত নেয়া যাক : যদি এক ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে স্বৰ্গত প্রধানমন্ত্রীর শেষ নাম বি দিয়ে শুরু হয়েছিল, তাহলে সে যা সত্য তা-ই বিশ্বাস করে, যেহেতু প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার হেনরী ক্যাম্পবেল ব্যানারম্যান। কিন্তু যদি সে বিশ্বাস করে মিঃ বালফোর হলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী, তাহলে সে তখনও বিশ্বাস করত যে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর শেষ নাম বি দিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই বিশ্বাসটি সত্য হলেও এটি জ্ঞানের উপাদান বলে চিহ্নিত হবে না। যদি একটি সংবাদপত্র দক্ষ পূর্বাভাসের মাধ্যমে কোন যুদ্ধের ফলাফল কোন টেলিগ্রামের দ্বারা ফলাফল ঘোষিত হবার আগেই ঘোষণা করে, হয়তো সৌভাগ্যবশত তারা সেটাই ঘোষণা করল যা পরে সঠিক ফলাফল বলে পরিচিত হল এবং এটি এভাবে অনভিজ্ঞ পাঠকের বিশ্বাস উৎপাদন করল। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের সত্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের জ্ঞান হয়েছে বলা যাবে না। এভাবে এটি পরিষ্কার যে মিথ্যা বিশ্বাসের থেকে নিঃসৃত সত্য বিশ্বাস জ্ঞান হতে পারে না।

একইভাবে, একটি সত্য বিশ্বাসকে জ্ঞান বলা যাবে না যখন তা দোষযুক্ত যুক্তির থেকে নিঃসৃত করা হয়, যদিও যে যুক্তিবাক্য থেকে এটি নিঃসৃত হয়েছে তা সত্য। যদি আমি জানি যে সমস্ত গ্রিকরা হল মানুষ এবং সক্রেটিস ছিলেন একজন মানুষ, এবং আমি অনুমান করি সক্রেটিস ছিলেন একজন গ্রিক, তাহলে বলা যাবে না যে আমি জানি সক্রেটিস ছিলেন একজন গ্রিক, কেননা, আমার যুক্তিবাক্য ও সিদ্ধান্ত সত্য হলেও সিদ্ধান্তটি যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হয়নি।

কিন্তু আমরা কি তাহলে বলব যে কোন কিছুই জ্ঞান নয়, শুধুমাত্র যা সত্য যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হচ্ছে সেগুলো ছাড়া? স্বাভাবিকভাবেই আমরা তা বলতে পারি না। এরকম সংজ্ঞা একই সঙ্গে অত্যন্ত ব্যাপক ও অত্যন্ত সংকীর্ণ। প্রথমত, এটি অত্যন্ত ব্যাপক কারণ এটাই যথেষ্ট নয় যে আমাদের যুক্তিবাক্যগুলোকে সত্য হতে হবে, এদের জ্ঞাত হওয়াও প্রয়োজন। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে মিঃ বালফোর হলেন প্রায়ত প্রধানমন্ত্রীর যে সত্য যুক্তিবাক্য থেকে সত্য আরোহ টানতে পারে যে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর নাম বি দিয়ে শুরু হয়েছিল, কিন্তু এই নিঃসরণের দ্বারা যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা তার জানার কথা নয়। এভাবে আমাদের সংজ্ঞাকে পরিবর্তিত করা উচিত এই বলে যে জ্ঞান হল–ই যাকে যুক্তিবাক্য থেকে বৈধভাবে নিঃসৃত করা যায়। এটি অবশ্য একটি চক্রাকার সংজ্ঞা; এটি ধরে নেয় যে আমরা আগেই জানি জ্ঞাত যুক্তিবাক্য বলতে কি বোঝায়। সুতরাং এটি অন্তত এক প্রকার জ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে পারে, যে-প্রকারটিকে আমরা গৌণ বলি, যা স্বজ্ঞাপ্রাপ্ত জ্ঞানের বিপরীত। আমরা বলতে পারি, গৌণ জ্ঞান হল–ই যা। স্বজ্ঞার দ্বারা জ্ঞাত যুক্তিবাক্যগুলোর থেকে বৈধভাবে নিঃসৃত করা হয়। এই বচনে কোন আকারগত দোষ নেই, কিন্তু এটি স্বজ্ঞাপ্রাপ্ত জ্ঞানের সংজ্ঞা খোঁজার রাস্তা রেখে দেয়।

স্বজ্ঞাপ্রাপ্ত জ্ঞানের প্রশ্নটি সরিয়ে রেখে, আপাতত আসুন, উপরিউক্ত গৌণ জ্ঞানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। এর বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি হল যে এটি জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। সবসময় দেখা যায় যে ব্যক্তিরা এমন এক সত্য বিশ্বাস প্রতিপালন করে যা তাদের ভিতরে গড়ে উঠেছে কিছু স্বজ্ঞাজ্ঞানের থেকে যা এটি বৈধভাবে অনুমান করতে সক্ষম, কিন্তু যার থেকে কোন যৌক্তিক পদ্ধতির দ্বারা এটি আসলে অনুমতি হয়নি।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, পড়ার থেকে উৎপন্ন বিশ্বাসের কথা ধরা যাক। যদি সংবাদপত্রগুলো রাজার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করে, আমরা সঠিকভাবে বিশ্বাস করি যে রাজার মৃত্যু হয়েছে, কেননা এটি হল সেই ধরনের ঘোষণা করেছে যে রাজার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এখানে যে স্বজ্ঞাজ্ঞানের উপর আমাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত তাহলে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের অস্তিত্বের জ্ঞান যা আহরিত হচ্ছে ঐ খবর সম্বলিত ছাপা দেখে। এই জ্ঞান কদাচিং চেতনায় উন্নীত হয়, শুধুমাত্র সেই ব্যক্তির কাছে ছাড়া যে সঠিকভাবে পড়তে পারে না। একটি শিশু অক্ষরের আকার সম্বন্ধে জানতে পারে এবং ধীরে ধীরে ও কষ্ট সহকারে তার অর্থে উপনীত হতে পারে। কিন্তু যে পড়তে অভ্যস্ত সে একবার পড়েই অক্ষরের অর্থ বুঝতে পারে এবং গভীরভাবে চিন্তা না করলে সে অবগত হয় না যে সে এই জ্ঞান লাভ করেছে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকে যা ছাপার অক্ষর বলে পরিচিত। এভাবে যদিও অক্ষরের থেকে অর্থে এক বৈধ অনুমানে যাওয়া সম্ভব এবং পাঠকের দ্বারা এই কাজ করা সম্ভবও হতে পারে, কিন্তু এটা আসলে করা হয় না, যেহেতু সে প্রকৃতপক্ষে এমন কোন কাজ করে না যাকে যৌক্তিক অনুমান বলা যায়। তথাপি এটা বলা অবাস্তব হবে যে পাঠক জানে না যে সংবাদপত্র রাজার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেছে।

সুতরাং আমরা গৌণ জ্ঞান তাকেই বলব যা স্বজ্ঞার দ্বারা প্রাপ্ত, এমনকি শুধুমাত্র সংযুক্তির সাহায্যে হলেও যদি কোন বৈধ যৌক্তিক যোগাযোগ থাকে এবং সেই ব্যক্তি এই যোগাযোগ ভাবনাচিন্তার দ্বারা জানতে পারে। যৌক্তিক অনুমান ছাড়াও এমন অনেক রাস্তা আছে যার দ্বারা আমরা এক বিশ্বাস থেকে আর এক বিশ্বাসে উপনীত হই : ছাপার হরফ থেকে তার অর্থে উপনীত হওয়া এই ধরনের রাস্তাকেই দেখায়। এই পথগুলোকে মানসিক অনুমান যা গৌণ জ্ঞান লাভ করার উপায়, যদি সেখানে আবিষ্কারযোগ্য যৌক্তিক অনুমান থাকে যা মানসিক অনুমানের সঙ্গে সমভাবে রয়েছে। এটি আমাদের গৌণ জ্ঞানের সংজ্ঞাকে আমরা যতটা চাই তার থেকে কম যথাযথ করে, যেহেতু আবিষ্কারযোগ্য কথাটি হল অস্পষ্ট; এটি আমাদের বলে না এই আবিষ্কারের জন্য কতটা চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। কিন্তু আসলে জ্ঞান কোন যথার্থ ধারণা নয়; এটি সম্ভাব্য মতের সঙ্গে মিশে যায় যা আমরা পুরোপুরিভাবে দেখবো আমাদের বর্তমান অধ্যায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে। সুতরাং অত্যন্ত যথাযথ সংজ্ঞা চাওয়া উচিত নয়, যেহেতু এই ধরনের যে কোন সংজ্ঞা কম বা বেশি ভ্রান্তিমূলক হতে পারে।

জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রধান অসুবিধা অবশ্য গৌণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ওঠে না, কিন্তু স্বজ্ঞাজ্ঞানের ক্ষেত্রে ওঠে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা গৌণ জ্ঞান নিয়ে চলছি, আমাদের কাছে পরীক্ষার জন্য স্বজ্ঞা রয়েছে, কিন্তু স্ববিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোন নির্ণায়ক আবিষ্কার করা সহজসাধ্য নয় যার দ্বারা আমরা কিছু বিশ্বাসকে সত্য বলে এবং কিছু বিশ্বাসকে ভ্রান্তিমূলক বলে পার্থক্য করতে পারি। এই প্রশ্নে কোন সঠিক ফলাফলে উপনীত ও হওয়া কদাচিৎ সম্ভব; আমাদের সব সত্যতার জ্ঞানই কিছু মাত্রায় সন্দেহে দ্বারা জড়িত এবং যে মতবাদ এই ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তবে এই প্রশ্নের অসুবিধা লাঘব করার জন্য কিছু করা যেতে পারে।

আমাদের সত্যতার মতবাদ কিছু সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ বলে পার্থক্য করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে এই অর্থে, যা অভ্রান্ততাকে নিশ্চিত করে। আমরা বলেছি যখন একটি বিশ্বাস সত্য হয় তখন তার অনুরূপ ঘটনা যাকে যেখানে বিশ্বাসের বিভিন্ন বিষয় একটি সৌধ নির্মাণ করে। বিশ্বাস ঘটনার এই জ্ঞানকে তৈরি করে, এই শর্তসাপেক্ষে যে এটি সেইসব অস্পষ্ট শর্তাবলি পূরণ করতে সক্ষম হবে যা আমরা বর্তমান অধ্যায়ে আলোচনা করছি। কিন্তু কোন ঘটনা সম্বন্ধে, বিশ্বাস দিয়ে গঠিত জ্ঞান ছাড়া, আমাদের এরকম ধরনের জ্ঞান থাকতে পারে যা প্রত্যক্ষ দ্বারা গঠিত (এই কথাটিকে সম্ভাব্য ব্যাপক অর্থে নিয়ে)। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি আপনার সূর্যাস্তের সময় জানা থাকে, তাহলে সেই সময়ে আপনি জানতে পারবেন যে সূর্য অস্ত গেছে। এটি হল সত্যতার জ্ঞানের মাধ্যমে ঘটনার জ্ঞান। কিন্তু আপনি আরও পশ্চিমে তাকাতে পারেন এবং আবহাওয়া ভাল থাকলে সত্যি সত্যিই অস্তগামী সূর্যকে দেখতে পারেন : সেক্ষেত্রে আপনি একই ঘটনাকে বিষয়ের জ্ঞানের মাধ্যমে জানবেন।

এভাবে কোন জটিল ঘটনার ক্ষেত্রে তত্ত্বগতভাবে দুভাবে সেটি জানা যায় : (১) কোন এক বিধানের দ্বারা, যেখানে এর বিভিন্ন অংশ সম্বন্ধযুক্তভাবে বিচার্য, যেহেতু তারা সত্যিই সম্বন্ধযুক্ত; (২) স্বয়ং জটিল ঘটনার পরিদৃশ্যমানতার দ্বারা, যাকে এক অর্থে প্রত্যক্ষ বলা যায় (ব্যাপক অর্থে), যদিও এটা কোনভাবেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে আবদ্ধ নয়। দেখা যাবে যে একটি জটিল ঘটনাকে জ্ঞানের দ্বিতীয় রাস্তায় জানা, অর্থাৎ পরিদৃশ্যমানতার সাহায্য, তখনই সম্ভব যখন সত্যি এরকম ঘটনা থাকবে, সেক্ষেত্রে প্রথম পথটি অন্য সমস্ত বিধানের মতই ভ্রান্তিমূলক হয়। দ্বিতীয় পথটি আমাদের এক সৌধ উপহার দেয়, এবং সেহেতু এটি তখনই সম্ভব যখন এর বিভিন্ন অংশে সত্যই সেই সম্বন্ধ থাকবে যা তাদের এক ধরনের সৌধে সংযুক্ত করতে সাহায্য করেছে। অপরপক্ষে প্রথম পথটি আমাদের অংশগুলো ও সম্বন্ধকে অনেকবার উপস্থাপন করে এবং অংশগুলোও তার সত্যতা দাবি করে : সম্বন্ধ হয়তো ওই অংশগুলোকে ওইভাবে সংযুক্ত করে না, এবং তথাপি হয়তো বিধান তৈরি করা সম্ভবপর হয়।

পাঠকের মনে পড়তে পারে যে একাদশ অধ্যায়ের শেষে আমরা বলেছিলাম দুধরনের স্বস্তঃসিদ্ধতা থাকতে পারে–একটি সত্যের নিশ্চিত নিশ্চয়তা দেয়, অপরটি আংশিক নিশ্চয়তা দেয়। এখন এই দুই প্রকারের পার্থক্য করা যেতে পারে।

প্রথম ও সবচেয়ে নিশ্চিত অর্থে আমরা বলতে পারি যে সত্য হল স্বতঃসিদ্ধ, যখন ঘটনার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি থাকে যা সত্যের অনুরূপ হয়। যখন ওথেলো বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, তখন অনুরূপ ঘটনা, যদি তার বিশ্বাস সত্য হয়, হবে ক্যাসিওর প্রতি ডেসডিমোনার ভালবাসা। এটি হল এমন একটি ঘটনা যার সঙ্গে একমাত্র ডেসডিমোনা ছাড়া আর কারোর পরিচিতি থাকা সম্ভব নয়। এভাবে যে স্বতঃসিদ্ধতার অর্থে আমরা আলোচনা করছি তাতে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে (যদি তা সত্য হয়) শুধুমাত্র ডেসডিমোনার কাছেই স্বতঃসিদ্ধ হবে। সমস্ত মানসিক তথ্য এবং এমন সমস্ত তথ্য যা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত নিয়ে চলে তাদের সবার ক্ষেত্রেই এই একই একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারটি থাকবে : শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির কাছেই আমাদের বর্তমান অর্থে এরা স্বতঃসিদ্ধ হবে, কেননা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির কাছেই আমাদের বর্তমান অর্থে এরা স্বতঃসিদ্ধ হবে, কেননা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিই আছে যে এই মানসিক বিষয়গুলো সম্বন্ধে অবগত হতে পারে বা ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে জানতে পারে। এভাবে কোন তথ্যই কোন বিশেষ অস্তিত্বশীল বিষয় সম্পর্কে একজন ব্যক্তির থেকে বেশি জনের কাছে স্বতঃসিদ্ধ হতে পারে না। অপরপক্ষে, সামান্য সম্পর্কীয় তথ্যে এ ধরনের কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই। একই সামান্যের সঙ্গে অনেক মনের পরিচিত থাকতে পারে। এভাবে সামান্যের মধ্যে একটি সম্বন্ধকে অনেক ভিন্ন ব্যক্তি পরিচিতির সাহায্যে জানি যার কতকগুলো নির্দিষ্ট পদ কোন একটি নির্দিষ্ট সম্বন্ধে রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আমরা বলি যে এসব পদের সত্যতা এমনভাবে সংযুক্ত যে এগুলোর প্রথম বা নিশ্চিত ধরনের স্বতঃসিদ্ধতা রয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে পদগুলো যে ওইভাবে সংযুক্ত রয়েছে সেই বিধান অবশ্যই সত্য হবে। এভাবে এই ধরনের স্বতঃসিদ্ধতা সত্যের নিশ্চিত নিশ্চয়তা দেয়।

কিন্তু এই ধরনের স্বতঃসিদ্ধতা সত্যের নিশ্চিত নিশ্চিয়তা দিলেও কোন নির্দিষ্ট বিধানের ক্ষেত্রে এটি আমাদের নিশ্চিত নিশ্চিয়তা দেয় না যে আলোচিত বিধানটি সত্য বলে পরিগণিত হবেই। মনে করা যাক আমরা প্রথম দেখলাম সূর্য আলো দিচ্ছে, যা একটি জটিল তথ্য, এবং তারপর এই বিধান দিতে অগ্রসর হলাম যে সূর্য আলো দিচ্ছে। প্রত্যক্ষের ক্ষেত্র থেকে বিধানে যাওয়ার সময়, জটিল তথ্যটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজনীয় : আমাদের সূর্য ও আলো দেওয়াকে ঘটনার উপাদান হিসেবে আলাদা করতে হবে। এই পদ্ধতিতে কোন ভুল হওয়া সম্ভব; কারণ যেখানে একটি তথ্যের প্রথম বা নিশ্চিত ধরনের স্বতঃসিদ্ধতা থাকে, সেখানে একটি বিধান যাকে তথ্যের সঙ্গে অনুরূপ বলে বিশ্বাস করা হয় তা সম্পূর্ণভাবে অভ্রান্ত নয়, কেননা এটি তথ্যের সঙ্গে সত্যই অনুরূপ নাও হতে পারে। কিন্তু যদি এটি অনুরূপ হয় (পূর্ববর্তী) অধ্যায়ের অর্থে) তাহলে এটি অবশ্যই সত্য হবে।

দ্বিতীয় প্রকারের স্বতঃসিদ্ধতা হল সেটি যা প্রথম দৃষ্টান্তের বিধানের ক্ষেত্রে থাকে এবং যা তথ্য থেকে সরাসরি প্রত্যক্ষের মাধ্যমে গৃহীত নয়। দ্বিতীয় ধরনের স্বতঃসিদ্ধতার বিভিন্ন মাত্রা থাকে চরম মাত্রা থেকে শুরু করে বিশ্বাসের প্রতি একেবারে কম আগ্রহ পর্যন্ত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমাদের কাছ দূরে গমনশীল থেকে। একটি ঘোড়ার শক্ত রাস্তায় দৌড়ানোর ক্ষেত্র নেয়া যাক। প্রথমে আমরা নিশ্চিত থাকি যে আমরা যে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শুনছি তা হল সম্পূর্ণ; ক্রমশ, আমরা যদি গভীরভাবে শুনি, এরকম এক মুহূর্ত আসবে যখন আমরা মনে করব হয়তো এটি আমাদের কল্পনা বা কোন গোপন ওপরতলা কিংবা আমাদের হৃদস্পন্দন; শেষ পর্যন্ত আমরা সন্দেহ করব আদৌ কোন শব্দ ছিল কিনা; তারপর আমরা চিন্তা করব আমরা কোন কিছু শুনছি না এবং শেষ পর্যন্ত আমরা জানব যে আমরা কোন কিছু শুনছি না। এভাবে স্বতঃসিদ্ধতার একটি ধারাবাহিক মাত্রা পাওয়া যাবে, অত্যন্ত বেশি মাত্রা থেকে একেবারে কম মাত্রা পর্যন্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মধ্যে নয়, বরং এদের উপরে নির্ভরশীল বিধানগুলোর মধ্যে।

অথবা, মনে করা যাক আমরা দুটি রঙের মাত্রার তুলনা করছি, একটি নীল ও একটি সবুজ। আমরা একেবারে নিশ্চিত যে এরা ভিন্ন দুটি রঙের মাত্রা। কিন্তু যদি সবুজ রঙটিকে ধীরে ধীরে নীলের দিকে ক্রমশ পরিবর্তিত করা হয় প্রথমে নীল-সবুজে, তারপর সবুজ নীলে এবং তারপর নীলে, তাহলে এরকম একটি মুহূর্ত আসবে যখন আমাদের সন্দেহ হবে আমরা কোন পার্থক্য দেখছি না, তারপর একটি মুহূর্তে আমরা জানব যে আমরা কোন পার্থক্য দেখছি না। এই একই বিষয় কোন একটি সুরযন্ত্রকে ঠিক করার সময় বা ধারাবাহিক পর্যায়বিশিষ্ট অন্য যে কোন ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এভাবে এই প্রকারের স্বতঃসিদ্ধতা হল মাত্রার বিষয়; এবং এটি স্পষ্ট যে বেশি মাত্রাকে কম মাত্রার থেকে বেশি বিশ্বাস করা উচিত।

গৌণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের শেষ যুক্তিবাক্যগুলোতে অবশ্যই স্বতঃসিদ্ধতার কিছু মাত্রা থাকবে এবং যে সিদ্ধান্ত এদের থেকে নিঃসৃত করা হয়েছে তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রেও অবশ্যই থাকবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, জ্যামিতির একটি অনুমানের ক্ষেত্র নেয়া যাক। এটি যথেষ্ট নয় যে, যে নীতিগুলো দিয়ে শুরু হয়েছে তাদের স্বতঃসিদ্ধ হতে হবে। এটাও অবশ্য প্রয়োজনীয় যে, অনুমানের প্রতিটি স্তরে যুক্তিবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে যোগাযোগ অবশ্যই স্বতঃসিদ্ধ হবে। দুরূহ অনুমানে এই যোগাযোগের খুব কম মাত্রার স্বতঃসিদ্ধতা থাকে; এই কারণে যেখানে অসুবিধা বেশি সেখানে অনুমানের ভ্রান্তি অসম্ভব নয়।

যা বলা হল তার থেকে এটি স্পষ্ট যে স্বজ্ঞার ক্ষেত্রে ও গৌণজ্ঞানের ক্ষেত্রে, যদি আমরা মনে করি যে স্বতঃসিদ্ধতার মাত্রার দিক থেকে স্বজ্ঞা হল বিশ্বাসযোগ্য, তাহলে বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পর্যায় থাকবে বিশেষ ইন্দ্রিয়-উপাত্তের অস্তিত্ব এবং যুক্তিবিজ্ঞান ও পাটিগণিতের সহজবোধ্য সত্যতা থেকে, যা একেবারে নিশ্চিত বলে মেনে নেয়া যায়, সেই বিধানগুলোর ক্ষেত্র পর্যন্ত যা তাদের বিপরীতের থেকে শুধুমাত্র বেশি সম্ভাব্য। যা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি তা সত্য হয়, তাহলে তাকে জ্ঞান বলা হয়-এই শর্তসাপেক্ষে যে এটি স্বজ্ঞাত নয়তো অনুমিত হয় (যৌক্তিকভাবে বা মানসিকভাবে) স্বজ্ঞার থেকে, যা যৌক্তিকভাবে তাকে অনুসরণ করে। যা আমরা বিশ্বাস করি, তা সত্য না হলে তা ভ্রান্ত বলে পরিচিত হয়। যা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি তা জ্ঞান বা ভ্রান্তি না হয়, এবং যা আমরা দ্বিধাগ্রস্তভাবে বিশ্বাস করি কেননা এটি আছে বা এটি গ্রহণ করা হয়েছে এমন কিছু থেকে যার সবচেয়ে বেশি মাত্রায় স্বতঃসিদ্ধতা নেই, তাকে সম্ভাব্য মত বলা যেতে পারে। এইভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জ্ঞান বলে যা পরিচিত তাহলে আসলে কম বা বেশি সম্ভাব্য মতামত। সম্ভাব্য মতের ক্ষেত্রে আমরা সংবদ্ধতার ক্ষেত্র থেকে বেশি সাহায্য পেতে পারি যাকে আমরা সংজ্ঞা হিসেবে বাদ দিয়েছি, কিন্তু নির্ণায়ক হিসেবে প্রায়শই ব্যবহার করা যায়। একগুচ্ছ ব্যক্তিগত সম্ভাব্য মত, যদি তারা একে অপরে সংযুক্ত থাকে, তাহলে বেশি সম্ভাব্য হবে তাদের মধ্যে একটিকে গ্রহণ করার তুলনায়। এভাবে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রকল্প সম্ভাব্যতা লাভ করে। এগুলো সম্ভাব্য মতের সংবদ্ধতন্ত্রে খাপ খেয়ে যায় এবং এভাবে একক থাকার তুলনায় বেশি সম্ভাব্য হয়। এই একই বিষয় সাধারণ দার্শনিক প্রকল্পের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রায়ই কোন একক ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রকল্পগুলো অত্যন্ত সন্দেহজনক হয়, কিন্তু যখন আমরা এদের সংযুক্তভাবে বিবেচনা করি যা তারা সম্ভাব্য মতের ক্ষেত্রে প্রচলন করেছে, তখন এগুলো প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। এটি বিশেষভাবে এই ধরনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, যেমন স্বপ্ন ও জাগরণের পার্থক্যের ক্ষেত্রে। যদি আমাদের স্বপ্ন রাতের পর রাত আমাদের দিনগুলোর মত একে অপরের সঙ্গে সংবদ্ধ থাকে, তাহলে আমরা কদাচিৎ জানতে পারি যে আমরা স্বপ্নে বিরোধিতা করে এবং জাগরিত জীবনকে বিশ্বাস করে। সংবদ্ধতার পরীক্ষা স্বপ্নের বিরোধিতা করে এবং জাগরিত জীবনকে অনুমোদন করে। কিন্তু এই পরীক্ষা, যদিও যেখানে এটি সফল হয় সেখানে এটি সম্ভাব্যতাকে বাড়ায়, কখনও নিশ্চিত নিশ্চয়তা দেয় না যদি সংবদ্ধতন্ত্রের কোন অংশে নিশ্চয়তা না থাকে। এভাবে সম্ভাব্য মতের সংগঠন কখনও নিজে থেকে অভ্রান্ত জ্ঞানে পরিণত হতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *