০৯. সামান্যের জগৎ

৯. সামান্যের জগৎ

পূর্ববর্তী অধ্যায়ের শেষে আমরা দেখলাম যে সম্বন্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর এমন সত্তা রয়েছে যা বাহ্য বস্তুর থেকে কিছু আলাদা এবং মন ও ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকেও আলাদা। এই অধ্যায়ের আমরা দেখব এই সত্তার স্বভাব কি এবং কোন বস্তুতে এই সত্তা প্রয়োগ করা সম্ভব। আমরা শেষোক্ত প্রশ্নটি দিয়ে শুরু করছি।

যে সমস্যা নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব তা অতি প্রাচীন, কারণ এটি দর্শনের জগতে নিয়ে এসেছিলেন প্লেটো। প্লেটোর ধারণার তত্ত্ব হল এই সমস্যাটি সমাধানেরই প্রচেষ্টা এবং আমার মতে এটি এখনও পর্যন্ত করা সব থেকে সাফল্যজনক প্রচেষ্টাগুলোর অন্যতম। এখানে যে মতবাদ দেয়া হবে তা মূলতই প্লেটোর, শুধু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেটুকু আবশ্যক সেইটুকু পরিবর্তন করব আমরা।

যেভাবে এই সমস্যা প্লেটোর কাছে দেখা দিয়েছিল তা অনেকটা নিম্নরূপ। আসুন, ন্যায় এই ধারণাটি দিয়ে আরম্ভ করা যাক। যদি আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি ন্যায় কি, তাহলে এটা, ওটা এবং অন্যান্য সঠিক কাজ দিয়ে আরম্ভ করা খুবই স্বাভাবিক, সেইসঙ্গে এই উদ্দেশ্য মনে রাখা যে এদের মধ্যে সাধারণ বিষয় কি আছে তা আবিষ্কার করতে হবে। এরা প্রত্যেকে কিছু অর্থে অবশ্যই একই স্বভাবের অন্তর্গত হবে, যা শুধুমাত্র যেটি সঠিক তারই মধ্যে থাকবে এবং অন্য কিছুতে নয়। যে একই স্বভাবের কারণে এরা সবাই সঠিক তা হল ন্যায় নিজেই, এটি হল শুদ্ধ সত্তা যা সাধারণ জীবনের ঘটনার সঙ্গে মিশ্রিত করে বহু ন্যায়বিচার প্রতিপাদন করেছে। একইভাবে অন্য যে কোন শব্দের সঙ্গেও মিশ্রিত হয় যা একই ঘটনায় প্রয়োগ করা যাবে, যেমন–শ্বেতত্ব। এই শব্দটি অনেক বিশেষ বস্তুতে প্রয়োগ করা যায়, কেননা এদের প্রত্যেকেরই একটি সাধারণ স্বভার বা শুদ্ধ সত্তা রয়েছে। প্লেটোর কাছে এই শুদ্ধ সত্তা হল ধারণা বা আকার। (ধরে নেয়া উচিত নয় যে তার অর্থে ধারণা মনের মধ্যে থাকে, যদিও তারা মনের দ্বারা গৃহীত হয়।) ন্যায়ের ধারণা যা কিছু সঠিক তার সঙ্গে সমার্থক নয়, এটি বিশেষ বস্তুর থেকে আলাদা, যা বিশেষ বস্তুর মধ্যে থাকে। বিশেষ না হবার জন্য এটি নিজে ইন্দ্রিয়-জগতে থাকতে পারে না। তাছাড়াও এটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের মতো পরিবর্তনশীল বা ক্ষণস্থায়ী নয়; এটি নিজে শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং ধ্বংসযোগ্য নয়।

এভাবে প্লেটো এক অতীন্দ্রিয় জগতে উপনীত হন, যা সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের চেয়ে বেশি সত্য, অপরিবর্তনীয় ধারণার জগৎ, যা একমাত্র ইন্দ্রিয় জগৎকে দেয় সত্তার অনুদীপ্ত প্রতিফলন। প্লেটোর কাছে প্রকৃত বাস্তব জগৎ হল ধারণার জগৎ, কেননা আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে যা-ই বলতে চাই তাতে আমরা এটুকু বলতেই সাফল্য অর্জন করি যে এরা অমুক-অমুক ধরনের ধারণার অন্তর্গত যা তাদের চরিত্রকে গঠন করে। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদে পৌঁছানো খুব সহজে হয়। আমরা অতীন্দ্রিয়ের আলোকে ধারণাগুলোকে সেভাবে দেখার আশা করি যেভাবে আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়কে দেখি, এবং আমরা কল্পনা করতে পারি যে স্বর্গে এই ধারণাগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। এই অতীন্দ্রিয়বাদ খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তি রয়েছে যুক্তিবিজ্ঞানে এবং যুক্তিবিজ্ঞানের ভিত্তিতেই এটি আমাদের আলোচনা করতে হবে।

ধারণা শব্দটি কালের প্রবাহে বিভিন্ন মানে অর্জন করেছে যেগুলো প্লেটোর ধারণায় প্রয়োগ করা হলে বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। এই কারণে আমরা প্লেটোর ক্ষেত্রে ধারণা বর্ণনা করার জন্য ধারণা শব্দের পরিবর্তে সামান্য শব্দটি ব্যবহার করব। প্লেটো এই বিষয়ের সত্তা বলতে যা বুঝেছেন তা ইন্দ্রিয়-মাধ্যমের থেকে পাওয়া বিশেষ বিষয়ের বিপরীত। আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা পাই তার সম্পর্কে বলি বা যা ইন্দ্রিয়-মাধ্যমে পাই তার স্বভাব একই; এর বিপরীতে সামান্য হল এমন কিছু যা বহু বিশেষের অন্তর্গত এবং তার মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে যা আমরা দেখেছি ন্যায় এবং শ্বেতত্বের সঙ্গে সঠিক কাজ ও শ্বেত বস্তুর পার্থক্য সৃষ্টি করে।

সাধারণ বাক্য পরীক্ষা করার সময় আমরা দেখি, সাধারণভাবে বলতে গেলে, ব্যক্তি-নাম বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অপরদিকে অন্য বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ সামান্যকে বোঝায়। সর্বনামও বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু এরা দ্ব্যর্থবোধক ও শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্র বা সেই অবস্থার সাহায্যেই আমরা বুঝতে পারি এগুলো কোন বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন এই শব্দটি বিশেষের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য, অর্থাৎ বর্তমান মুহূর্ত; কিন্তু সর্বনামের মত এটি দ্ব্যর্থবোধক বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কেননা বর্তমান সবসময়ই পরিবর্তনশীল।

এটা দেখা যাবে যে সামান্যকে বোঝায় এমন অন্তত একটি শব্দ ব্যবহার না করে কোন বাক্যই তৈরি করা সম্ভব নয়। সব থেকে কাছাকাছি পদ্ধতি হল এই রকম কোন বাক্য, যেমন আমি এটা পছন্দ করি। কিন্তু এখানেও পছন্দ শব্দটি একটি সামান্যকে বোঝায়, কেননা আমি অন্য বিষয় পছন্দ করতে পারি এবং অন্য ব্যক্তিরাও নানান বিষয় পছন্দ করতে পারে। এভাবে সমস্ত সত্যই সামান্যকে জড়িয়ে আছে, এবং সমস্ত জ্ঞানের সত্যতা সামান্যের সঙ্গে পরিচিতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়।

অভিধানে প্রায় সমস্ত শব্দই সামান্যকে বোঝায় এটা দেখার পর ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে দর্শনের ছাত্র ছাড়া আর কেউই কখনও বুঝতে পারে না যে সামান্য বলে কোন বিষয় আছে। আমরা সাধারণত একটি বাক্যের মধ্যে এরকম শব্দকে বোঝাই না যা বিশেষকে বোঝায়; এবং যদি আমরা এরকম কোন শব্দের উপর দাঁড়াতে বাধ্য হই যা সামান্যকে বোঝায়, তাহলে আমরা স্বভাবতই তাকে বোঝাই যা কোন একটি বিশেষ বলে সামান্যের অন্তর্গত। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমা এরকম একটি বাক্য শুনি প্রথম চার্লসের মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল, তখন আমরা স্বভাবতই এটাই প্রথম চার্লস সম্বন্ধে চিন্তা করি, প্রথম চার্লসের মাথা এবং তার মাথা কেটে ফেলার পদ্ধতি, যার সমস্ত কিছুই হল বিশেষ; কিন্তু আমরা সাধারণত মাথা শব্দটি কি বোঝায় বা কাটা শব্দটি কি বোঝায় তা নিয়ে আলোচনা করি না, যা হল সামান্য। আমরা মনে করি এই ধরনের শব্দ হল অসম্পূর্ণ ও অবাস্তব, এদের নিয়ে কিছু করার আগে এরা যেন একটি প্রেক্ষাপট দাবি করে। এবাবে আমরা সামান্যর উপর নজর না দেয়াতে সাফল্য লাভ করি, যতক্ষণ পর্যন্ত দর্শনের আলোচনা আমাদের এই আকর্ষণ দাবি না করে।

আমরা একথাও বলতে পারি যে দার্শনিকদের মধ্যেও সেই সমস্ত সামান্যই দৃষ্টি আকর্ষণ করে যারা বিশেষণ বা বিশেষ্য নামে পরিচিত, অন্যদিকে ক্রিয়াপদ এবং পদান্বয়ী অব্যয় নামে পরিচিতদের দিকে সাধারণ দৃষ্টি দেয়া হয় না। দর্শনের উপর এই ধরনের বাদ দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ ফল দেখা যায়; এটা বললে ভুল হবে না যে স্পিনোজার সময় থেকে প্রায় সব অধিবিদ্যাই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। যেভাবে এই ঘটনা ঘটেছিল তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ : সাধারণভাবে বলতে গেলে বিশেষণ এবং নামবাচক বিশেষ্য গুণ বা ধর্ম প্রকাশ কর, অপরপক্ষে পদান্বয়ী অব্যয় এবং ক্রিয়াপদ দুই বা ততোধিক বিষয়ের মধ্যে সম্বন্ধ প্রকাশ করতে চায়। এভাবে পদান্বয়ী অব্যয় এবং ক্রিয়াপদের উপেক্ষা এই বিশ্বাসে উপনীত করায় যে প্রত্যেক বচনকে কোন একক বিষয়ের গুণ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়, দুই বা ততোধিক বিষয়ের সম্বন্ধ প্রকাশ করার চেয়ে। এভাবে ধরে নেয়া হয় যে শেষ পর্যন্ত বিষয়ের মধ্যে সম্বন্ধ নামক কোন বিষয়ই থাকবে না। এভাবে হয় পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটি বিষয় থাকবে বা যদি বহু বিষয় থাকে তারা কখনই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না, যেহেতু যে কোন পারস্পরিক ক্রিয়া একটি সম্বন্ধ বলে বিবেচিত হবে এবং এই সম্বন্ধগুলো হল অসম্ভব।

এই ধরনের প্রথম মতটি, যা স্পিনোজা প্রচার করেছিলেন এবং আমাদের সময় ব্রাডলে এবং অন্য অনেক দার্শনিক যা সমর্থন করেন, তা একত্ববাদ নামে পরিচিত; দ্বিতীয় মতটি লাইবনিজ প্রচার করেছিলেন কিন্তু বর্তমানে সেটি তেমন প্রচলিত নয়তো চিৎপরামাণুবাদ নামে পরিচিত, কেননা প্রত্যেক বিচ্ছিন্ন বস্তু চিৎপরামাণু নামে পরিচিত। আমার মতে এই দুই বিরুদ্ধ দর্শনের জন্ম হয়েছিল শুধু এক ধরনের সামান্যের উপর অপ্রয়োজনীয় নজর দেয়ার জন্য, বিশেষত সেই ধরনের বস্তু যা বিশেষণ ও বিশেষ্যের দ্বারা উপস্থাপিত হয় ক্রিয়াপদ এবং পদান্বয়ী অব্যয়ের দ্বারা উপস্থাপিত হওয়ার থেকে।

আসলে কেউ যদি সামান্য বলে যে বিষয় আছে তাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করতে চায়, তাহলে আমরা দেখব যে আমরা গুণজাত বিষয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারব না, অর্থাৎ সামান্য যা বিশেষণ ও গুণ দ্বারা উপস্থাপিত; অন্যক্ষেত্রে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে অবশ্যই সম্বন্ধ রয়েছে, অর্থাৎ সেই ধরনের সামান্য যা ক্রিয়াপদ ও পদান্বয়ী অব্যয়ের উপস্থাপিত হয়। আসুন আমরা শ্বেতত্ব এই ধরনের সাফল্য রয়েছে। তাহলে আমরা বলব শ্বেত বস্তু আছে কারণ তাদের মধ্যে শ্বেতত্বের গুণ রয়েছে। তব এই মতটি বার্কলে ও হিউমের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, যাদেরকে এই ব্যাপারে পরবর্তী অভিজ্ঞতাবাদীরা অনুসরণ করেছেন। তাদের প্রত্যাখ্যানের রূপ হল এই মত অস্বীকার করা যে বিমূর্ত ধারণা বলে কোন বস্তু আছে। তারা বলেন যে যখন আমরা শ্বেতত্ব সম্পর্কে চিন্তা করতে চাই, তখন আমরা কোন বিশেষ সাদা বস্তুর প্রতিচ্ছবি তৈরি করি এবং এই বিশেষের কারণ দেখাই, আমরা যত্নবান হই এমন কিছু নিঃসৃত না করতে যা আমরা অন্য যে কোন শ্বেত বিষয়ে সর্বদা সত্য বল অনুধাবন করতে না পারি। আমাদের বাস্তব মানসিক ঘটনাবলি সম্পর্কে এই ব্যাপারটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে সত্য। উদাহরণস্বরূপ, জ্যামিতির ক্ষেত্রে যখন আমরা সমস্ত ত্রিভুজ সম্পর্কে কোন কিছু প্রমাণ করতে চাই, তখন আমরা একটি বিশেষ ত্রিভুজ এঁকে তার সম্পর্কে যুক্তি দেখাই, এমন কোন বৈশিষ্ট্য ব্যবহার না করতে যত্নবান হই যে ব্যাপারে এটি অন্য ত্রিভুজের অংশীদার নয়। যারা নতুন তারা ভ্রান্ত না হবার জন্য বিভিন্ন ত্রিভুজ এঁকে প্রয়োজন সাধন করে, যেগুলো প্রত্যেক একে অপরের থেকে আলাদা, এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে যে তার যুক্তি সমভাবে সমস্ত ত্রিভুজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। কিন্তু যখনই আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি কিভাবে আমরা জানি যে একটি বস্তু সাদা বা ত্রিভুজ, তখনই একটি সমস্যা দেখা দেয়। যদি আমরা শ্বেতত্ব বা ত্রিভুজত্বকে বাদ দিতে চাই, তাহলে আমাদের কিছু বিশেষ সাদা অংশ বা কোন বিশেষ ত্রিভুজ গ্রহণ করতে হবে এবং বলতে হবে যে কোন কিছু হল সাদা বা ত্রিভুজ-যদি আমাদের গৃহীত বিশেষের সঙ্গে তার মিল থাকে। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় সাদৃশ্যটি সামান্য হতে হবে। যেহেতু বহু সাদা বস্তু রয়েছে, সেহেতু এই সাদৃশ্যটি বিভিন্ন বিশেষ সাদা বস্তুর জুড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, এবং এটাই হল সামান্যের বৈশিষ্ট্য। এটা বলা অপ্রয়োজনীয় যে প্রত্যেক। জুড়ির জন্য ভিন্ন সাদৃশ্য রয়েছে, কেননা তখন আমাদের বলতে হবে যে এই সাদৃশ্যগুলো একে অপরের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে, এবং অবশেষে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হব যে সাদৃশ্য হল একটি সামান্য। সুতরাং সাদৃশ্যের সম্বন্ধ অবশ্যই একটি সত্য সামান্য এবং এই সামান্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে আমরা দেখব যে দুরূহ ও অযৌক্তিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে এই ধরনের সামান্যকে, যেমন শ্বেতত্ব ও ত্রিভুজত্বকে, বাদ দেয়া আর প্রয়োজনীয় হবে না।

বার্কলে এবং হিউম তাঁদের বিমূর্ত ধারণার খন্ডনের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে অসমর্থ হয়েছিলেন, কেননা তাঁদের প্রতিবাদীদের মতই তাঁরাও শুধুমাত্র গুণের কথাই ভেবেছিলেন এবং সামান্যকে সম্বন্ধরূপে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন। সুতরাং আমরা এখানে আরেকদিক থেকে অভিজ্ঞতাবাদীদের তুলনায় বুদ্ধিবাদদের সঠিক বলতে পারি, যদিও সম্বন্ধের অগ্রাহ্যতা বা বাদ দেয়ার জন্য, বুদ্ধিবাদীদের দ্বারা অনুসৃত অবরোহ অভিজ্ঞতাবাদীদের থেকে আরও বেশি ভ্রান্তিমূলক।

সামান্যের মত বিষয় অবশ্যই থাকবে, এটি পর্যবেক্ষণ করার পর পরবর্তী বিষয় হল এটি প্রমাণ করা যে এদের সত্তা শুধুমাত্র মানসিক নয়। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, যে সত্তাই এদের মধ্যে থাকুক না কেন, এদের সত্তা চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন বা মনের দ্বারা যে কোন ভাবে গ্রহণযোগ্য। পূর্ববতী অধ্যায়ে আমরা এই বিষয় সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি, কিন্তু এখন আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব কি ধরনের সত্তা সামানো থাকে।

এই ধরনের বচন নেয়া যাক, যেমন–এডিনবার্গ হল লন্ডনের উত্তরে। এখানে আমরা দুটি জায়গার মধ্যে একটি সম্বন্ধ দেখছি, এবং মনে হয় এটা স্পষ্ট যে এই সম্বন্ধ আমাদের জ্ঞান-নিরপেক্ষভাবে স্বাধীনভাবে থাকবে। যখন আমরা জানতে পারি যে এডিনবার্গ হল লন্ডনের উত্তরে, তখন আমরা এমন কিছু অবগত হই যা শুধুমাত্র এডিনবার্গ এবং লন্ডনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; অপরপক্ষে আমরা শুধুমাত্র বিষয়টি জানি যা আমাদের জানার পূর্বেও ছিল। পৃথিবীর যে অংশে এডিনবার্গ অবস্থিত তাহল লন্ডনের অংশের উত্তরে; যদি এমন হত যে কোন মানুষই ব্যক্তি উত্তর এবং দক্ষিণ সম্বন্ধে জানে না, এমনকি পৃথিবীতে যদি কোন জ্ঞাতা না-ও থাকত, তাহলেও এটি সত্য থাকত। এই ব্যাপারটি অবশ্য বহু। দার্শনিক দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, হয় বার্কলের কারণে নয়তো কান্টের কারণে। কিন্তু আমরা এই কারণগুলো আগেই আলোচনা করেছি এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এই কারণগুলো যুক্তিযুক্ত নয়। সুতরাং আমরা এখন এটি সত্য বলে মনে করতে পারি যে এডিনবার্গ লন্ডনের উত্তরে এই ব্যাপারে কোন মানসিক বিষয় ধরে নেয়া হচ্ছে না। কিন্তু এই বিষয়টি উত্তরে থাকা এরকম একটি সম্বন্ধকে ধরে নিচ্ছে। যেটি হল সামান্য, এবং পুরো বিষয়টার মধ্যে মানসিক কিছু না থাকা অসম্ভব, যদি উত্তরে থাক এই সম্বন্ধটি, যেটি বিষয়ের একটি অংশ, তা কোন মানসিক বিষয়ে জড়িয়ে থাকে। সুতরাং আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে এই সম্বন্ধটি এদের সম্বন্ধের মতো চিন্তার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং স্বাধীন জগতে থাকে যা চিন্তা গ্রহণ করে কিন্তু তৈরি করে না।

তবে এই ধরনের সিদ্ধান্ত এই অসুবিধা সম্মুখীন হয় যে উত্তরে থাকা এই সম্বন্ধটি সেই অর্থে থাকে না যে অর্থে এডিনবার্গ এবং লন্ডন আছে। যদি আমরা প্রশ্ন করি, কোথায় এবং কখন এই সম্বন্ধ থাকে? তাহলে উত্তরটি অবশ্যই হবে, কোথাও নয়, কোনখানে নয়। এরকম কোন স্থান বা কাল নেই যেখানে আমরা উত্তরে থাকা এই সম্বন্ধটি খুঁজে পেতে পারি। এটি এডিনবার্গ বা লন্ডনেও নেই, কেননা এটি দুটোকে সংযুক্ত করে এবং এদের মথ্যে নিরপেক্ষভাবে থাকে। যা কিছু ইন্দ্রিয় দিয়ে বা অন্তর্দর্শন গ্রহণ করা যায় তা কোন বিশেষ কালে থাকে। এই কারণে উত্তরে থাকা এই ধরনের সম্বন্ধ এই ধরনের বিষয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি দেশেও নেই কালেও নেই, বস্তুগতও নয় মানসিকও নয়; তবু এটি হল কিছু একটা।

এটি হল সেই অদ্ভুত সত্তা যা সামান্যে থাকে, যাকে অনেক ব্যক্তি ধরে নেয় যে এরা হল প্রকৃতই মানসিক। আমরা সামান্য সম্বন্ধে চিন্তা করতে পারি এবং আমাদের চিন্তা তখন সাধারণ অর্থেই যে কোন মানসিক কাজের মতো অস্তিত্বসূচক হবে। উদাহরণস্বরূপ ধরে নেয়া যাক যে আমরা শ্বেতত্ব সম্পর্কে ভাবছি। এক্ষেত্রে এক অর্থে বলা যায় যে শ্বেতত্ব আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে। আমরা এখানে সেই একই দ্ব্যর্থবোধকতা দেখছি যা আমরা চতুর্থ অধ্যায়ের বার্কলের মত আলোচনার সময় দেখেছি। সঠিক অর্থে এটি শ্বেতত্ব নয় যা আমাদের মনে রয়েছে, বরং শ্বেতত্ব সম্পর্কে চিন্তা সম্বন্ধীয় কাজ। ধারণা শব্দের দ্ব্যর্থবোধকতা, যা আমরা একই সময়ে দেখেছিলাম, তা এখানকার বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণ। শব্দের এক অর্থে অর্থাৎ সেই অর্থে যাতে এটি বিষয়কে চিন্তার কাজ বলে প্রতিপন্ন করে, সেখানে শ্বেতত্ব হল একটি ধারণা। সেক্ষেত্রে যদি এই দ্ব্যর্থবোধকতাকে আটকানো না যায়, তাহলে আমরা ভাবতে পারি যে শ্বেতত্ব অন্য অর্থে একটি ধারণা অর্থাৎ চিন্তার কাজ, এবং এভাবে আমরা চিন্তা করি যে শ্বেতত্ব হল মানসিক। কিন্তু এভাবে ভেবে আমরা এর আবশ্যকীয় সামান্যে গুণকে হরণ করি। একজন মানুষের চিন্তা আবশ্যিকভাবে অন্য মানুষের থেকে আলাদা, একজন মানুষের একসময়ের চিন্তাধারা আবশ্যকীয়ভাবে অন্য মানুষের অন্য সময়ের চিন্তার থেকে আলাদা। এভাবে যদি শ্বেতত্বের চিন্তা তার বিষয়ের থেকে বিপরীত হয়, তাহলে কোন দুজন ভিন্ন ব্যক্তি এর সম্বন্ধে চিন্তা করতে পারবে না এবং কোন একজন মানুষ এ সম্বন্ধে দুবার চিন্তা করতে পারবে না। বিভিন্ন শ্বেতত্বের চিন্তার মধ্যে যা এক রয়েছে তাহল বিষয় এবং এই বিষয় সবার থেকে আলাদা। এভাবে সামান্যগুলো চিন্তা নয়, যদিও জানার পর তারা চিন্তার বিষয় হয়।

আমরা অস্তিত্ববাচক বস্তুর সম্পর্কে কথা বলা সুবিধাজনক মনে করি যখন তারা কালে থাকে, অর্থাৎ বলতে গেলে আমরা কোন সময়ের দিকে নির্দেশ করতে পারি যেখানে তারা থাকে (এই ধররেন সম্ভাবনাকে বাদ না দিয়ে যে তারা সবসময় থাকে)। এভাবে চিন্তা ও অনুভূতি, মন ও বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সামান্য এই অর্থে অস্তিত্বসূচক নয়। আমরা বলি যে তারা আছে বা তাদের সত্তা আছে, যেক্ষেত্রে সত্তা অস্তিত্বের বিপরীত কারণ তা অনন্ত। সুতরাং সামান্যের জগৎকে সত্তার জগৎ বলে বর্ণনা করা যায়। সত্তার জগৎ হল অপরিবর্তনীয়, কঠোর, নির্ভুল, গণিতজ্ঞ, যুক্তিবিজ্ঞানী এবং অধিবিদ্যার সমর্থকের কাছে আনন্দময়, এবং তাদের কাছেও যারা জীবনের থেকেও পূর্ণতাকে ভালবাসে। অস্তিত্বের জগৎ হল চঞ্চল, অস্পষ্ট, কোন সঠিক সীমাহীন, কোন সঠিক নক্সা বা বিন্যাসহীন, কিন্তু এটি সমস্ত চিন্তা ও অনুভূতি, সমস্ত ইন্দ্রিয় সম্পর্কীয় উপাত্ত এবং সমস্ত বাহ্য বস্তু, যা কিছু ভাল খারাপ করতে পারে, যা কিছু জগতের ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে পার্থক্য ঘটাতে পারে-তার সবটুকুকে ধারণ করে। আমাদের মানসিকতা অনুযায়ী আমরা কোন একটি বা অপরটিতে মনোযোগী হব। আমরা যাকে অপছন্দ করব তা হয়তো যাকে আমরা পছন্দ করব তার থেকে অস্পষ্ট ছায়াময় এবং কোন অর্থেই একে সত্য বলে উপযুক্ত মনে করা হবে না। কিন্তু সত্যতা হল এই যে দুটোই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে, দুটোই সত্য এবং দুই-ই অধিবিদ্যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই দুই জগতের মধ্যে পার্থক্য করছি। এদের সম্বন্ধও বিবেচনা করা আবশ্যক। কিন্তু প্রথমত, আমরা অবশ্যই আমাদের সামান্যের জ্ঞানকে পরীক্ষা করব। পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়ে আলোচনা করব আমরা, যেখানে আমরা পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের সমস্যার সমাধান দেখব-যেখান থেকেই আমরা সামান্যকে বিবেচনার দিক প্রথম অগ্রসর হয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *