০৬. আরোহ প্রসঙ্গে

. আরোহ প্রসঙ্গে

পূর্ববর্তি প্রায় সমস্ত আলোচনায় অস্তিত্বশীলতার জ্ঞানের পরিষ্কার চিত্র পেতেই ব্যাপৃত ছিলাম আমরা। পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু আছে যার অস্তিত্বশীলতা আমরা জ্ঞাত হই তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচিতির সূত্র ধরে? এই পর্যন্ত আমাদের উত্তর ছিল যে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে পরিচিত হই এবং সম্ভবত নিজেদের সঙ্গেও পরিচিত হই। আমরা জানি এদের অস্তিত্ব রয়েছে। অতীতের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত যা স্মৃতির সাহায্যে জ্ঞাত হয় তা অতীতেই রয়েছে। এই জ্ঞান আমাদের উপাত্ত সরবরাহ করে।

কিন্তু যদি আমরা এই সমস্ত উপাত্ত থেকে অনুমান করতে সক্ষম হই-যদি আমাদের জড়ের অস্তিত্ব, অন্য লোকেদের অস্তিত্ব, আমাদের স্মৃতি শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী অতীতের অস্তিত্ব অথবা ভবিষ্যতের অস্তিত্ব জানতে হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই কিছু সাধারণ সূত্র জানতে হবে যার মাধ্যমে অনুমান করা যায়। এটা আমাদের কাছে অবশ্যই জ্ঞাত হতে হবে যে কোন একটি বিষয়ের অস্তিত্ব, যেমন ক হল খ নামক অন্য একটি বিষয়ের অস্তিত্বের চিহ্ন, হয় ক-র সঙ্গে এই সময়ে খ-এর উপস্থিতি অথবা তার কিছু পূর্বে বা পরের সময়ে– যেমন বজ্রপাত হল পূর্বের বিদ্যুৎ ঝলকানির অস্তিত্বের চিহ্ন। এগুলো আমাদের কাছে জ্ঞাত না হলে আমরা আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে কখনই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে প্রসারিত করতে পারবো না, এবং এই পরিধিটি, যেমন আমরা আগেই দেখেছি, অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। এখন আমাদের যে প্রশ্নটি আলোচনা করতে হবে তাহলে–এই ধরনের প্রসারণ সম্ভব কিনা, এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে কিভাবে সেটা করা সম্ভব।

আসুন এমন একটি উদাহরণ নেয়া যাক, যে ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কেউই বিন্দুমাত্রও সন্দেহ অনুভব করবে না। আমরা প্রত্যেকেই নিশ্চিত যে সূর্য আগামীকাল উঠবে। কেন? এই বিশ্বাস অতীত অভিজ্ঞতার অন্ধ ফলশ্রুতি, নাকি একে যৌক্তিক বিশ্বাসের দ্বারা প্রমাণ করা যায়? এক্ষেত্রে কোন পরীক্ষার দ্বারা এই ধরনের বিশ্বাস যৌক্তিক কিনা তা বিচার করা মোটেই সহজ নয়, কিন্তু আমরা অন্তত এইটুকু নির্ধারণ করতে পারি যে আগামীকাল সূর্য উঠবে এবং এই ধরনের অন্যান্য বক্তব্য যার উপর আমাদের কাজ নির্ভর করে সেগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে সেগুলোকে সমর্থনযোগ্য করার জন্য কি ধরনের সাধারণ বিশ্বাস প্রয়োজন।

এটা স্পষ্ট যে যদি আমাদের প্রশ্ন করা হয় কেন আমরা বিশ্বাস করি সূর্য আগামীকাল উঠবে, তাহলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেব, কারণ এটি বরাবরই প্রতিদিন উঠেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে এটি ভবিষ্যতেও উঠবে, যেহেতু এটি অতীতেও উঠেছে। যদি আমাদের প্রশ্ন করা হয় কেন আমরা বিশ্বাস করি যে এটি সবসময়ই উঠবে, তাহলে আমরা গতিসূত্রের সাহায্য নিতে পারি। আমরা বলব-পৃথিবী হল একটি স্বাধীন ঘূর্ণায়মান বস্তু এবং বাইরের কিছু বাধা না দিলে এই ধরনের বস্তু তার ঘোরা বন্ধ করে না এবং বাইরে এমন কিছুই নেই পৃথিবীকে আজ ও আগামীকালের মধ্যে বাধা দিতে পারে। এটা অবশ্যই সন্দেহ করা যায় যে আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত কিনা যে বাইরে এই ধরনের বাধা দেয়ার মতো কিছু নেই, কিন্তু এটি কোন গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহটি হল–গতিসূত্র তার কাজ আগামীকালও করে চলবে কিনা। এই ধরনের সন্দেহ তোলা হলে আমরা সেই একই অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াব, যে অবস্থাটা ছিল সূর্যোদয় প্রসঙ্গে প্রথম সন্দেহ উত্থিত হওয়ার সময়।

গতিসূত্র যে কাজ করে চলবে তাতে বিশ্বাসের একমাত্র কারণ হল যে এই নিয়ম এতদিন কাজ করছে-অন্তত অতীতে জ্ঞান আমাদের যতদূর বিচারের ক্ষমতা দিয়েছে সেই অনুযায়ী। এটা সত্যি যে আমাদের হাতে সূর্য ওঠার তুলনায় গতিসূত্রের পক্ষে অতীতের সাক্ষ্যপ্রমাণ অনেক বেশি আছে, কেননা সূর্য ওঠা হল গতিসূত্রের একটি বিশেষ ঘটনামাত্র এবং এরকম অসংখ্য বিশেষ ঘটনা রয়েছে। কিন্তু আসল প্রশ্নটি হল-এটি কি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট যে এই সূত্রের স্বপক্ষে অতীতে এই রকমের বহু ঘটনা রয়েছে বলেই ভবিষ্যতেও তা ঘটবে? যদি তা না হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট যে আগামীকালও সূর্য উঠবে অথবা এর পরের বার যে রুটি আমরা খাবো তা বিষমুক্ত হবে না। কিংবা অন্য যে কোন সচেতন প্রত্যাশা যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো প্রত্যাশা করার কোন ভিত্তি আমাদের থাকে না। দেখা যাবে যে এই সব প্রত্যাশাগুলোই হল সম্ভাব্য। অতএব এই আশাগুলোর অবশ্যই পূর্ণতা লাভের জন্য আমাদের কোন প্রমাণ খোঁজার প্রয়োজন নেই, কিন্তু এর স্বপক্ষে কিছু কারণ দর্শানো প্রয়োজন যে এগুলো হয়তো পূর্ণতা লাভ করবে।

এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করার সময় আমরা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দিয়ে শুরু করব, যেটি আলোচনা না করলে খুব শীঘ্রই বিভ্রান্তিতে পড়ব আমরা। অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়েছে যে বাববার একই বিষয়ের সমরূপ পরম্পরা বা সহাবস্থান আমাদের পরবর্তী ক্ষেত্রে এই একই পরম্পরা বা সহাবস্থানের আশা করতে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট আকারবিশিষ্ট খাদ্যের সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্বাদও থাকে এবং এটা আমাদের কাছে এটি অভাবনীয় বেদনা হিসেবে দেখা দেয় যখন আমরা কোন পরিচিত বিষয়ের অপরিচিত স্বাদ পাই। যে বিষয়গুলো আমরা দেখি তা অভ্যাসবশত নির্দিষ্ট স্পর্শ-সংবেদনের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়, যা আমার বিষয়টি স্পর্শ করার সময় আশা করি। ভূতের ভয়ের মধ্যে একটি হল (অনেক ভূতের গল্পে যেমনটা দেখা যায়)-এটি আমাদের কোন স্পর্শ-সংবেদন দিতে পারে না। যেসব অশিক্ষিত ব্যক্তিরা প্রথম বিদেশযাত্রা করে তারা অত্যন্ত অবাক হয় যখন তারা দেখে যে তাদের দেশিয় ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না।

এই ধরনের অনুষঙ্গ শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, পশুদের ক্ষেত্রেও এটি রীতিমতো প্রবল। যে ঘোড়াটি একটি নির্দিষ্ট পথে চলে অভ্যস্ত, সেই ঘোড়াটিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া হলে সে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। গৃহপাতি পশুদেরকে খাদ্য দেয় যে-ব্যক্তিটি তাকে দেখলেই তারা খাদ্য পাওয়ার আশা করে। আমরা জানি এই ধরনের সমরূপতার অপরিণত আশা ভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তিটি মুরগির বাচ্চাকে সারা জীবন ধরে খাইয়ে এসেছে, সে যখন অবশেষে তার গলা কেটে নেয়, তখন বোঝা যায় যে স্বভাবের সমরূপতার ব্যাপারে আরো পরিণত ধারণা মুরগির বাচ্চার ক্ষেত্রে লাভজনক হবে।

কিন্তু এসব আশার ভ্রান্তিযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এগুলোর অস্তিত্ব আছেই। কোন কিছু যখন বারবার সংঘটিত হয়েছে, তখন মানুষ ও পশু উভয়েই আশা করে যে এটি আবারও ঘটবে। এভাবে আমাদের প্রবৃত্তি বিশ্বাস জাগায় যে সূর্য আগামীকাল আবার উঠবে, কিন্তু যে মুরগির বাচ্চাটির গলা অপ্রত্যাশিতভাবে কেটে নেয়া হয়েছে, তার থেকে আমরা কোনও অংশেই ভাল অবস্থায় নেই। সুতরাং অতীতের একরূপতা ভবিষ্যতের আশার কারণ হবে, এই বিষয়টির থেকে এই প্রশ্নটিকে আমাদের পৃথক করা প্রয়োজন যে এই বিষয়টির থেকে এই প্রশ্নটিকে আমাদের পৃথক করা প্রয়োজন যে এই ধরনের আশার বৈধতা সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠার পর, এগুলোর আর কোনও যুক্তিপূর্ণ ভিত্তি থাকে কি না।

আমাদের এই সমস্যা আলোচনা করতে হবে যে যাকে প্রকৃতির একরূপতা বলা হয় তাতে বিশ্বাস করার মত কোন কারণ আছে কিনা। প্রকৃতির একরূপতার উপর বিশ্বাসের অর্থ হল-যা কিছু ঘটেছে বা ঘটবে তা কোন সাধারণ নিয়মের উদাহরণ যার কোন ব্যতিক্রম হয় না। যেসব স্থূল আশা সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি তা সবই ব্যতিক্রমের আওতায় পড়ে এবং এগুলো তাদের আশাহত করে যারা এই ধরনের আশা পোষণ করে। কিন্তু বিজ্ঞান স্বভাবতই ধরে নেয়, অন্তত কার্যকরি প্রকল্প হিসেবে, যে ব্যতিক্রমবিশিষ্ট সাধারণ নিয়মগুলোর পরিবর্তে ব্যতিক্রমহীন সাধারণ নিয়মগুলোকে প্রতিস্থাপিত করা যায়। শূন্যে রাখা অসংরক্ষিত বস্তুগুলো পড়ে যাবে–এটি একটি সাধারণ নিয়ম যার কেন ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু গতির নিয়ম ও মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম, যা বলে যে বেশিরভাগ বস্তুই পড়ে যাবে, সেগুলো এ-ও বলে যে বেলুন ও উড়োজাহাজ উড়তে পারে। অতএব গতির নিয়ম ও মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম এসব ব্যতিক্রমের আওতায় পড়ে না।

সূর্য আগামীকাল উঠবে, এই বিশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে যদি পৃথিবী হঠাৎ একটি বৃহৎ বস্তুর সংস্পর্শে আসে যা এর গতিকে নষ্ট করতে পারে, কিন্তু গতির নিয়মাবলি ও মাধ্যাকর্ষণ নীতি এই ঘটনার দ্বারা রুদ্ধ হবে না। বিজ্ঞানের কাজ হল একরূপতা খোঁজ, যেমন গতির নিয়মাবলি ও মাধ্যাকর্ষণ নিয়ম, যেগুলোর, অন্তত আমাদের অভিজ্ঞতার সীমায়, কোন ব্যতিক্রম নেই। এই অনুসন্ধানে বিজ্ঞান বিশেষভাবে সফল হয়েছে এবং বলা যায় যে এই ধরনের একরূপতা মানা হয়েছে। এই বিষয়টি আমাদের এই প্রশ্নে ফিরিয়ে আনে। আমাদের কি ধরে নেওয়ার কোন কারণ আছে যে এগুলো অতীতে সর্বদা সফল হয়েছে বলেই ভবিষ্যতেও সফলতা পাবে?

বলা হয় যে ভবিষ্যৎ অতীতের অনুরূপ হবে বলে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে আমাদের, কেননা যা ভবিষ্যৎ ছিল তা সর্বদা অতীতে পরিণত হচ্ছে এবং সর্বদাই তাকে অতীতের অনুরূপ হতে দেখা গেছে, অতএব আমাদের সত্যই ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতা আছে, অর্থাৎ সেই সমেয়র যা পূর্বে ভবিষ্যৎ ছিল, যাকে আমরা অতীতের ভবিষ্যৎ বলতে পারি। কিন্তু এই ধরনের যুক্তি আসলে যে প্রশ্নের জন্য করা হয়েছে তারই সাহায্য চাওয়া। আমাদের অতীতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই, এবং প্রশ্নটি হল ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ কি অতীতের ভবিষ্যতের সদৃশ হবে? এই প্রশ্নটির উত্তর শুধুমাত্র সেই যুক্তি দিয়ে দেয়া সম্ভব নয় যা অতীতের ভবিষ্যৎ দিয়ে শুরু হচ্ছে। সুতরাং আমাদের এমন কিছু নীতি অন্বেষণ করতে হবে যা আমাদের জানতে সাহায্য করবে যে ভবিষ্যৎ অতীতের মতো একই নিয়ম অনুসরণ করবে।

এই প্রশ্নে ভবিষ্যতের উল্লেখ প্রয়োজনীয় নয়। এই একই প্রশ্ন ওঠে যখন আমরা অতীতের যে-সব বিষয় সম্বন্ধে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই সেগুলোর ক্ষেত্রে নিয়মগুলো প্রয়োগ করি-দৃষ্টান্তস্বরূপ, ভূবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অথবা সৌরজগতের উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বের ক্ষেত্রে। যে প্রশ্নটি আমাদের প্রকৃতই জিজ্ঞাসা করা উচিত তা হল যখন দুটি বিষয়কে প্রায়শই একত্রিত থাকতে দেখা যায় এবং এমন কোন ঘটনার কথা জানা যায় না। যেখানে একটি অপরটিকে ছাড়া ঘটে, তখন কোন নতুন দৃষ্টান্তে দুটির মধ্যে একটির থাকাটাই কি অপরটিকে আশা করার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর আমাদের ভবিষ্যতের সমস্ত আশার সত্যতা নির্ভর করছে, আরোহের সমস্ত ফল নির্ভর করছে, বলতে গেলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় বিশ্বাসই নির্ভর করছে।

এটা অবশ্যই বলতে হবে যে দুটি বিষয়কে প্রায়শই একত্রে দেখা গেলে এবং কখনই আলাদা দেখা না গেলে প্রমাণিত হয় না যে পরবর্তী ক্ষেত্রেও তাদেরকে একত্রে দেখা যাবে। যা আমরা আশা করতে পারি তা হল, যত বেশি করে বিষয়গুলোকে একত্রে দেখা যাবে, ততই পরবর্তী সময়ে তাদের একত্রিত থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এবং যদি তাদের প্রায়শই একত্রে দেখা যায়, তাহলে সম্ভাবনাটি প্রায় নিশ্চয়তায় পর্যবসিত হবে। এটি কখনই পুরোপুরি নিশ্চয়তায় পৌঁছতে পারবে না, কেননা আমরা জানি বহুবার পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও শেষে অসফলতা আসতে পারে, যেমনটা মুরগির গলা কেটে নেবার ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। সুতরাং সম্ভাবনাই হল শেষ কথা যা আমাদের চাওয়া উচিত।

আমাদের মতের বিরুদ্ধে বলা যায় যে আমরা জানি সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনাই নিয়মেই অনুশাসনে আবদ্ধ এবং কখনও কখনও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমরা দেখি যে কোন একটি নিয়মই সেই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। এখন এই মতের দুটি উত্তর দেয়া যেতে পারে। প্রথমটি হল- কোন ব্যতিক্রমহীন নিয়ম আমাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাস্তবে আমরা কখনই নিশ্চিত হতে পারি

যে আমরা সেই নিয়মটি আবিষ্কার করতে পেরেছি এবং ব্যতিক্রমবিশিষ্ট নিয়মটি আবিষ্কার করতে পারিনি। দ্বিতীয়টি হল-নিয়মের রাজত্ব হল শুধুই সম্ভাব্য এবং এটি ভবিষ্যতেও প্রযোজ্য হবে বা অতীতে অপরীক্ষিত ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সংক্রান্ত আমাদের বিশ্বাসটি নিজেই সেই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যা আমরা পরীক্ষা করছি।

যে নীতিটি আমরা পরীক্ষা করছি তাকে আরোহের নীতি বলা যেতে পারে এবং এর দুটি অংশকে নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে?

(ক) যখন কোন একটি বিষয় ক- কে আর একটি বিষয় খ-র সঙ্গে একত্রিত দেখা যায় এবং কখনও খ-এর থেকে আলাদা দেখা যায় না, তখন যত বেশি ক্ষেত্রে ক ও খ- কে একসঙ্গে দেখা যায়, ততই কোন নতুন ক্ষেত্রে তাদের একত্রিত থাকার বেশি সম্ভাবনা থাকবে যেখানে দুটির মধ্যে একটিকে উপস্থিত থাকতে দেখা যাবে।

(খ) একই অবস্থায় পর্যাপ্ত সংখ্যক একত্রিত থাকার ঘটনা, একত্রিত থাকার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে প্রায় নিশ্চয়তার পর্যায়ে পৌঁছে দেয় এবং এ ব্যাপারে সীমাহীন নিশ্চয়তা দেয়।

আমরা এখনই বলেছি, এই নীতিটি শুধুমাত্র কোন নতুন দৃষ্টান্তে আমাদের আশার সত্যতা প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু আমরা আরও জানতে চাই যে সাধারণ নিয়মটির সপক্ষে সম্ভাব্যতা রয়েছে যে ক-এর মত বিষয় সবসময় খ-এর মত বিষয়ের সঙ্গে একত্রিত থাকে। যদি এরকম একত্রিত থাকার ঘটনা পর্যাপ্ত সংখ্যায় জানা যায় এবং একত্রিত না থাকার কোন ঘটনা জানা না যায়। সাধারণ নিয়মের সম্ভাব্যতা খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ নিয়মের সম্ভাব্যতার থেকে কম, যেহেতু সাধারণ নিয়ম সত্য হলে বিশেষ ক্ষেত্রেও তা অবশ্যই সত্য হবে। আবার সাধারণ নিয়ম সত্য না হলেও বিশেষ ক্ষেত্র (Case) সত্য হতে পারে। অবশ্য সাধারণ নিয়মের সম্ভাব্যতা পুনরাবৃত্তি করে বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষ ক্ষেত্রের সম্ভাব্যতার মতই। সুতরাং আমরা আবার আমাদের নিয়মের দুটো অংশের পুনরাবৃত্তি করছি যা সাধারণ নিয়মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

(ক) যত বেশি সংখ্যক ক্ষেত্র জানা যায় যেখানে ক-এর বিষয় খ-এর মত বিষয়ের সঙ্গে একত্রিত থাকে, ততই বেশি সম্ভাবনা বাড়ে যে ক সর্বদা খ-এর সঙ্গে একত্রিত থাকে (যদি একত্রিত থাকার কোন ক্ষেত্রের কথা জানা না যায়)।

(খ) একই অবস্থায় ক ও খ-এর পর্যাপ্ত সংখ্যক একত্রিত থাকার ক্ষেত্র এই বিষয়টিকে প্রায় নিশ্চিত করে যে ক সর্বদা খ-এর সঙ্গে একত্রিত থাকে এবং এই বিষয়টি সাধারণ নিয়মের নিশ্চয়তাকে প্রায় সীমাহীন পর্যায়ে নিয়ে যায়।

মনে রাখা দরকার যে সম্ভাব্যতা সবসময় বিশেষ উপাত্তের উপর নির্ভরশীল। আমাদের ক্ষেত্রে উপাত্তগুলো হল ক ও খ-এর সহাবস্থানের নিছক জ্ঞাত ক্ষেত্রগুলো। অন্য উপাত্তও থাকতে পারে, যা বিবেচনা করা যেতে পারে এবং যা সম্ভাব্যতাকে ভীষণভাবে বদলে দিতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমাদের নীতি অনুযায়ী, এক ব্যক্তি যে বহু সংখ্যক সাদা হাঁস দেখেছে সে তর্ক করতে পারে যে এই উপাত্তের ভিত্তিতে এটি সম্ভাব্য যে সমস্ত হাঁসই হল সাদা এবং এটি একটি সম্পূর্ণ সঠিক যুক্তি হতে পারে। এই যুক্তিটি এই ঘটনার দ্বারা অপ্রমাণিত হয় না যে কিছু হাঁস হল কালো, কেননা কোন বিষয় অনায়াসেই ঘটতে পারে এই ঘটনা সত্ত্বেও যে কিছু উপাত্ত একে অসম্ভাবনাময় করে তুলেছে। হাঁসগুলোর ক্ষেত্রে, এক ব্যক্তি জানতে পারে যে রঙ হল এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে বদলে যেতে পারে এবং সেই কারণে রঙ সম্পর্কে কোন আরোহ অনুমানে উপনীত হওয়া ভ্রমে দুষ্ট হতে বাধ্য। কিন্তু এই জ্ঞানটি হবে একটি নতুন উপাত্ত যা কোনভাবেই প্রমাণ করে না যে আমাদের পূর্ববর্তি উপাত্তে সম্ভাবনাকে ভুলভাবে বিচার করা হয়েছিল। সুতরাং বিষয়গুলো প্রায়শই আমাদের আশা পূরণ করতে অসমর্থ হয়–এই ঘটনা কখনই এই বিষয়ের সাক্ষ্য বহন করে না যে আমাদের আশা সম্ভবত কখনই কোন একটি বিশেষ ক্ষেত্রে বা বিশেষ শ্রেণির ক্ষেত্রে সফল হবে না। এভাবে অভিজ্ঞতার সাহায্য চেয়েও আমাদের আরোহ নীতিকে কোনভাবেই অ-প্রমাণিত করা সম্ভব হয় না।

একইভাবে এই আরোহের নীতিকে অভিজ্ঞতার সাহায্যে প্রমাণ করাও সম্ভব নয়। যে সমস্ত ক্ষেত্রগুলোকে আগেই পরীক্ষা করা হয়েছে, অভিজ্ঞতা সেসব ক্ষেত্রের আরোহনীতিকে বড়জোর মেনে নিতে পারে। কিন্তু অপরীক্ষিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আরোহনীতিই কোন অনুমানকে সমর্থন করতে পারে পরীক্ষিত ও অপরীক্ষিত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে। সমস্ত যুক্তি, যেগুলো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচার করে, সেগুলো অতীত ও বর্তমানের যেসব ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা হয়নি সেগুলোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আরোহনীতিকে ধরে নেয়। এভাবে আমরা কখনই প্রশ্নটির সাহায্য না চেয়ে (Begging the question) অভিজ্ঞতার আরোহনীতি প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার করতে পারি না। অতএব আমরা অবশ্যই হয় আরোহনীতিকে গ্রহণ করব এর অন্তর্নিহিত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে, নয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সমস্ত আশা আত্মপক্ষ সমর্থনকে পরিত্যাগ করব। যদি নীতিটি বেঠিক হয় তাহলে আমাদের আশা করার কোন কারণ নেই সূর্য আগামীকাল ওঠার, পাথরের থেকে রুটিকে বেশি পুষ্টিকর মনে করার বা এই আশা করার যে ছাদ থেকে নিজেদের ফেলে দিলে আমরা পড়ে যাবো। যখন আমরা দেখি যে যাকে আমরা সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মনে করি সে আমাদের কাছে আসছে, তখন আমাদের মনে করার কোন কারণ নেই যে তার দেহে আমাদের সবচেয়ে খারাপ শত্রুর বা কোন সম্পূর্ণ অচেনা ব্যক্তির মন বাস করছে না। আমাদের যাবতীয় ব্যবহার অতীতের অনুষঙ্গের উপর নির্ভর করে, যেগুলো ভবিষ্যতেও একই ধরনের কাজ করবে বলে আমরা মনে করি এবং এই সম্ভাবনা তার সত্যতার জন্য আরোহনীতির উপর নির্ভর করে।

বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলো, যেমন নিয়মের শৃঙ্খলায় বিশ্বাস এবং এই বিশ্বাস যে সমস্ত ঘটনার অবশ্যই কোন কারণ আছে, তা সম্পূর্ণভাবে আরোহনীতির উপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বিশ্বাসের মত, এসব সাধারণ নিয়মগুলোকে বিশ্বাস করা হয় কেননা মানবজাতি এগুলোর সত্যতা সম্পর্কে অগণিত দৃষ্টান্ত পেয়েছে এবং এদের অসত্যতা সম্পর্কে কোন দৃষ্টান্ত পায়নি। কিন্তু এটি এদের ভবিষ্যতের সভ্যতা সম্পর্কে কোন সাক্ষ্য বহন করে না–যতক্ষণ না আরোহনীতিকে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

এভাবে সব জ্ঞানই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের এমন কিছু বলে, যার কোন অভিজ্ঞতা আমাদের নেই এবং তা এই বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত যাকে অভিজ্ঞতা অনুমোদন বা অসমর্থন কিছুই করতে পারে না। কিন্তু এই বিশ্বাস অন্তত বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ঘটনাবলির মতই আমাদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে রয়েছে। এই ধরনের বিশ্বাসগুলির অস্তিত্ব ও সমর্থনযোগ্যতা আরোহনীতির ক্ষেত্রে আমরা দেখব যে এটিই একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়-দর্শনশাস্ত্রের অত্যন্ত দুরূহ ও বির্তকিত কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করব এই ধরনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে কি বলা যায় এবং এর পরিধি ও নিশ্চয়তার মাত্রা কি হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *