০৫. পরিচিতির দ্বারা জ্ঞান এবং বর্ণনার দ্বারা জ্ঞান

৫. পরিচিতির দ্বারা জ্ঞান এবং বর্ণনার দ্বারা জ্ঞান

 পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে দুরকমের জ্ঞান আছে-বস্তুর জ্ঞান এবং সত্যের জ্ঞান। এই অধ্যয়ে আমরা শুধুমাত্র বস্তুর জ্ঞান নিয়েই আলোচনা করবো, যার দুই প্রকারের পার্থক্য পরে আলোচনা করা হবে। বস্তুর জ্ঞান যখন পরিচিতির দ্বার জ্ঞানের গোত্রভুক্ত হয়, তখন সেই জ্ঞান সত্যের যে কোন জ্ঞানের থেকে সরল হয় এবং যৌক্তিকভাবে সত্যের জ্ঞান-নিরপেক্ষ হয়, যদিও এটা মনে করা অনুচিত হবে যে মানুষেরা কখনও বস্তুর জ্ঞান পেতে পারে একই সঙ্গে সেই বস্তু সম্পর্কে কিছু সত্য না জেনে। অপরপক্ষে, বস্তুর বর্ণনামূলক জ্ঞানের উৎস এবং ভিত্তি হিসেবে কিছু সত্যের জ্ঞানও সর্বদাই থাকে যা আমরা এই অধ্যায়ের আলোচনায় দেখতে পাব। কিন্তু সবার আগে আমাদের পরিষ্কার করে বুঝা দরকার যে পরিচিতি এবং বর্ণনা বলতে আমরা কি বুঝি।

আমরা বলব যা কিছু আমরা প্রত্যক্ষভাবে জানি তার সঙ্গেই আমরা পরিচিত কোন অনুমান অর্থাৎ প্রক্রিয়ার মাধ্যম বা কোন সত্যের জ্ঞান ছাড়াই যা আমরা জানি। এভাবে আমার টেবিলের উপস্থিতি আমি ইন্দ্রিয়-উপাত্ত দ্বারা জানি যা আমার টেবিলের দৃশ্যমান সত্তা তৈরি করছে-এর রঙ, আকার, কাঠিন্য, মসৃণতা ইত্যাদি। এ সমস্ত বিষয়গুলো আমি তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞাত যখনই আমি আমার টেবিলকে দেখি এবং স্পর্শ করি। যে বিশেষ রঙের ছায়া আমি দেখছি তার সম্বন্ধে কিছুই বলা যায়-আমি বলতে পারি যে এটি হল বাদামি, এটি অপেক্ষাকৃত কালো ইত্যাদি। কিন্তু এই ধরনের মন্তব্যগুলো আমাকে রঙ সম্পর্কে সত্যতা জানালেও রঙের স্বরূপ সম্পর্কে যা আমি আগে জানতাম তার থেকে বেশি কিছু জানায় না। আমি রঙ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানি যখন আমি রঙ দেখি এবং তত্ত্বগতভাবে এর বেশি জ্ঞান এর সম্পর্কে পাওয়া সম্ভব নয়। রঙের স্বরূপের জ্ঞান সম্পর্কে যতদূর বলা যায়, সত্যের জ্ঞানের বিপরীতে। এবাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত যা আমার টেবিলের দৃশ্যমান সত্তা তৈরি করে তা হল এমন বিষয় যার সঙ্গে আমার পরিচিতি আছে, এমন বিষয় আমি তাৎক্ষণিকভাবে জানি যেরকম তারা আছে।

অপরদিকে, বাহ্য বস্তু হিসেবে টেবিল সম্পর্কে আমার জ্ঞান সরাসরি জ্ঞান নয়। এটি যেরকম আছে, তা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত দ্বারা জানা যায়, যা টেবিলের দৃশ্যমান সত্ত্বা তৈরি করে। আমরা দেখেছি যে কোন অবাস্তবতা ছাড়াই সন্দেহ করা সম্ভব যে আদৌ কোন টেবিল আছে কিনা, কিন্তু ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কে সন্দেহ করা সম্ভব নয়। টেবিল সম্পর্কে আমার জ্ঞান হল সেই প্রকারের যাকে আমরা বলতে পারি বর্ণনামূলক জ্ঞান। টেবিলটি হল বাহ্য বস্তু যা বিভিন্ন ইন্দ্রিয় উপাত্তের কারণ। এভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সাহায্যে টেবিলটির বর্ণনা করা যায়। টেবিলটি সম্পর্কে কোন কিছু জানার জন্য আমাদের টেবিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সত্যতা অবশ্যই জানতে হবে, যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। আমাদের অবশ্যই জানতে হবে যে এই-এই ইন্দ্রিয়-উপাত্ত একটি বাহ্য বস্তুর দ্বারা গড়ে ওঠে। এরকম কোন মানসিক অবস্থা নেই যার সাহায্যে আমরা টেবিলটি সম্বন্ধে সরাসরিভাবে জানতে পারি। টেবিল সম্পর্কে আমাদের সমস্ত জ্ঞান হল আসলে সত্যের জ্ঞান এবং আসলে যা টেবিল বলে পরিচিত তাকে আমরা কখনই যথাযথভাবে জানতে পারি না। আমরা একটি বর্ণনার সঙ্গে পরিচিত এবং আমরা জানি যে একটাই বিষয় আছে যাতে এই বর্ণনা প্রয়োগ করা যায়, যদিও বস্তুটি নিজের কখনও সরাসরিভাবে আমাদের কাছে জ্ঞাত হয় না। এ সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা বলি যে বস্তু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হল বর্ণনামূলক জ্ঞান।

আমাদের সমস্ত জ্ঞান-বিষয়ের এবং সত্যের জ্ঞান-নির্ভর করে উপর। এ কারণে এটি বিবেচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের পরিচিত কি কি বিষয় আছে।

আমরা পূর্বেই দেখেছি যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল সেই বিষয়গুলোর অন্যতম যার রঙ্গে আমাদের পরিচিতি রয়েছে। বস্তুত এগুলো পরিচিতির দ্বারা জ্ঞানের সব থেকে সুস্পষ্ট উদারহরণ। কিন্তু এগুলোই যদি একমাত্র উদাহরণ হত তাহলে আমাদের জ্ঞান যতটা আছে তার থেকে অনেক কম থাকত। আমরা তাহলে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সামনে যা উপস্থিত আছে শুধুমাত্র তাকেই জানতাম-অতীত সম্পর্কে কোন কিছু জানতে সক্ষম হতাম না, এমনকি আদৌ কোন অতীত ছিল কিনা তাও জানতে পারতাম না, ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কেও কোন সত্য জানতে পারতাম না, কেননা সমস্ত সত্যের জ্ঞানই সেসব বিষয় সম্পর্কে পরিচিতি দাবি করে যেগুলোর চরিত্র ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যেগুলোকে কখনও কখনও বিমূর্ত ধারণা বলা হয় কিছু আমরা যাকে চিহ্নিত করব সামান্য বলে। সুতরাং ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়া আমাদের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও পরিচিত থাকতে হবে, যদি আমাদের জ্ঞান সম্পর্কে সঠিক বিশ্লেষণ করতে হয়।

ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়া যা আমাদের প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে তা হল স্মৃতির দ্বারা পরিচিতি। এটি স্পষ্ট যে আমরা যা দেখেছি, শুনেছি বা অন্য কোনভাবে যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সামনে এসেছে, তা আমরা প্রায়শই মনে রাখি এবং এ সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা যা মনে রাখি সে সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি-এটা জানা সত্ত্বেও যে যা আমাদের সামনে আসছে তা হল অতীত, বর্তমান নয়। আমাদের অতীত সংক্রান্ত সমস্ত জ্ঞানের উৎস হল এই স্মৃতির সাহায্যে তাৎক্ষণিক জ্ঞান। এটি ছাড়া অতীত সম্পর্কে কোন অনুমানও সম্ভব নয়, কেননা সেক্ষেত্রে আমরা জানতে সক্ষম হই না যে অনুমানযোগ্য কোন অতীত আদৌ ছিল কি না।

পরবর্তী বিষয়টি হল অন্তদর্শনের সাহায্যে সাহাযে পরিচিতি। আমরা শুধুমাত্র বিষয় সম্পর্কেই জানি না, বরং প্রায়শই এদের সম্পর্কে জানাকেও জানি। যখন আমি সূর্যকে দেখি তখন আমি আমার দেখাকেও জানি। এভাবে আমার সূর্য দেখা হল এমন একটি বিষয় যার সম্পর্কে আমার পরিচিতি আছে। যখন আমি খাবারের ইচ্ছা করি, তখন খাবারের প্রতি এই ইচ্ছাকেও জানি, এভাবে আমার খাবার ইচ্ছা হল এমন একটা বিষয় যার সঙ্গে আমার পরিচিতি আছে। এভাবে আমরা সুখ বা দুঃখের অনুভূতি সম্পর্কেও যা আমাদের মনের মধ্যে ঘটে। আমাদের সমস্ত মানসিক জ্ঞানের উৎস হল এই ধরনের পরিচিতি, যাকে আত্মসচেতনতা বলা যায়। এটা স্পষ্ট যে যা আমাদের মনের মধ্যে ঘটে সেই সমস্ত বিষয়গুলোই তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়। অন্যদের মনে কি ঘটছে তা আমরা তাদের দৈহিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারি, অর্থাৎ আমাদের সেই সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্ত দ্বারা যা তাদের দেহের সঙ্গেও জড়িত। কিন্তু আমাদের নিজের মনের বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও অন্যের মন সম্পর্কে কল্পনা করতে আমরা অক্ষম, ফলত তাদেরও যে মন আছে এই জ্ঞানে আমরা কখনওই পৌঁছাতে পারি না। মনে করা স্বাভাবিক যে আত্মসচেতনতা হল সেসব বিষয়ের মধ্যে একটি মানুষকে পশুর থেকে স্বতন্ত্র করে। আমরা ধরে নিতে পারি যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কে পশুদের পরিচিতি থাকলেও তারা এই পরিচিতি সম্পর্কে সচেতন নয়। আমি একথা বলতে চাইছি না যে তারা তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান, কিন্তু তারা আদৌ সচেতন নয় যে তাদের সংবেদন ও অনুভূতি আছে এবং এই সংবেদন ও অনুভূতির অভাবের ফলেই তারা নিজেদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও সচেতন নয়।

আমদের মনের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিতিকে আমরা আত্ম-সচেতনতা নামে অভিহিত করেছি,তবে তার অর্থ কিন্তু আমাদের আত্ম সম্বন্ধে সচেতনতা নয়। এর অর্থ হল নির্দিস্ট চিন্তা ও অনুভূতি সম্বন্ধে সচেতনতা। নির্দিষ্ট চিন্তা ও অনুভূতির বিপরীতে আমরা আমাদের নিজস্ব আত্মনের সঙ্গেও পরিচিত কি না, তা এক দুরূহ প্রশ্ন এবং এ সম্পর্কে ইতিবাচকভাবে কিছু বলা উচিত নয়। যখন আমরা নিজেদের গভীরে তাকানোর চেষ্টা করি তখন সর্বদাই আমরা কোন নির্দিষ্ট চিন্তা বা অনুভূতির সম্মুখীন হই এবং কখনোই সেই আমি কে পাই না যার মধ্যে এই চিন্তা বা অনূভূতি রয়েছে। তথাপি বিশ্বাস করার মতো কিছু কারণ আছে যে এই আমির সঙ্গে আমরা পরিচিত-যদিও এই পরিচিতিকে অন্যান্য বিষয়ের থেকে আলাদা করা খুবই কঠিন। কারণগুলো কি ধরনের তা নির্ণয় করার জন্য, নির্দিষ্ট চিন্তার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি বলতে ঠিক কি বোঝায় তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

যখন আমি আমার সূর্য দেখার সঙ্গে পরিচিত হই, তখন আসলে আমি দুটি ভিন্ন বিষয়কে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত করেই তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। একদিকে থাকে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত যা সূর্যকে আমার কাছে উপস্থিত করে, অন্যদিকে থাকে সেই বিষয়টি যা এই ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে দেখে। যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সূর্যকে আমার কাছে উপস্থিত করে তার সঙ্গে আমার পরিচিতির মতো যাবতীয় পরিচিতিই হচ্ছে যে ব্যক্তিটি পরিচিত হচ্ছে এবং যে বস্তুটির সঙ্গে সে পরিচিত হচ্ছে এই দুয়ের মধ্যকার একটা সম্পর্ক যখন কোন পরিচিতির ঘটনা এমন হয় যার সঙ্গে আমি পরিচিত হতে পারি (যেমন যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সূর্যকে উপস্থাপিত করে তার সঙ্গে আমার পরিচিতির সঙ্গে আমি পরিচিত), তখন এটা একান্তই স্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি পরিচিত হচ্ছে সে আসলে আমি নিজেই। অতএব যখন আমি আমার সূর্য দেখার সঙ্গে পরিচিত হই, তখন যে সমগ্র বিষয়টির সঙ্গে আমি পরিচিত হই তা হল ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে আত্মপরিচিতি।

উপরন্তু আমরা এই সত্যও জানি যে এই ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে আমি পরিচিত। এই সত্য আমরা কিভাবে জানি তা বুঝে ওঠা, এমনকি এর অর্থটুকু বুঝে ওঠাও ততক্ষণ রীতিমতো দুরূহ থাকে, যতক্ষণ না আমরা আমি বলতে যা বুঝায় তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। এটা ধরে নেয়া প্রয়োজনীয় নয় যে আমরা কমবেশি সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত যে গতকাল যেমন ছিল আজও ঠিক তেমনই রয়েছে, কিন্তু যে বস্তুটি সূর্যকে দেখে এবং ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে যার পরিচয় আছে, তার প্রকৃত যেমনই হোক না কেন তার সঙ্গে আমাদের পরিচিত হতেই হবে। সুতরাং কোন কোন অর্থে আমাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার বিপরীতে নিজেদের আত্মনের সঙ্গেও পরিচিত হতে হবে আমাদের। তবে বিষয়টি অত্যন্ত দুরূহ এবং এর উভয় পক্ষেই বিভিন্ন জটিল যুক্তি খাড়া করা যায়। অতএব যদিও আমাদের নিজেদের সঙ্গে পরিচিতি সম্ভবত ঘটে থাকে, তথাটি এমনটা জোর দিয়ে বলা উচিত হবে না যে তা নিঃসন্দেহেই ঘটে থাকে।

অতএব অস্তিত্বশীল বস্তুর সঙ্গে পরিচিতি সম্পর্কে এতক্ষণ আমরা যা বলেছি, তার সারসংক্ষেপ করা যায় এভাবে। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের উপাত্তের সাহায্যে সংবেদনে এবং আন্তরিন্দ্রিয়ের অর্থাৎ চিন্তা, অনুভূতি, আকাক্ষা ইত্যাদির উপাত্তের সাহায্যে অন্তর্দর্শনে পরিচিত ঘটে আমাদের। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের অথবা আন্তরিন্দ্রিয়ের উপাত্তস্বরূপ বিভিন্ন বস্তুর সাহায্যে স্মৃতিতে পরিচিতি লাভ করি আমরা। সে সঙ্গে পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও একটি সম্ভাব্য বিষয় হল-আত্মনের সঙ্গেও পরিচিত হই আমরা, যে আত্মা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সচেতন অথবা বিভিন্ন বস্তুর প্রতি যার আকাঙ্খ থাকে।

অস্তিত্বশীল সুর্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি ছাড়া আমান্যের (Universal) সঙ্গেও পরিচিতি ঘটে আমাদের, অর্থাৎ ধারনার সঙ্গে, যেমন শুভ্রতা, বিভিন্নতা, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি। প্রতিটি পূর্ণ বাক্যে অবশ্যই অন্তত একটি শব্দ থাকতে হবে যা সামান্যকে সূচিত করে, কেননা প্রতিটি ক্রিয়াপদেরই একটি অর্থ থাকে যা সামান্য। সামান্য প্রসঙ্গে নবম অধ্যায়ে আলোচনা করব আমরা। আপাতত শুধু এই ধারনার বিরুদ্ধেই সতর্ক থাকা দরকার যে যা কিছুর সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে পারি তাকে অবশ্যই নির্দিস্ট ও অস্তিত্বশীল হতে হবে। সামান্য সম্পর্কে সচেতনতাকে বলা হয় ধারণা করা এবং যে-সামান্য সম্পর্কে আমরা সচেতন তাকে বলে ধারণা।

যে বিষয়গুলোর সঙ্গে আমরা পরিচিত তার মধ্যে বাহ্য বস্তুও নেই (ইন্দ্রিয় উপাত্তের বিপরীতে) অন্য ব্যক্তিদের মনও নেই। আমি যাকে বর্ণনামূলক জ্ঞান বলছি তার সাহায্যেই এসব বিষয়গুলো জানতে পারি আমরা। এই বর্ণনামূলক জ্ঞান নিয়েই এবার আলোচনা করব আমরা।

বর্ণনা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি এই সেই বস্তু বা অমুক ব্যক্তি–এই জাতীয় যে কোনও বিবৃতিকে। এই সেই বস্তু জাতীয় বিবৃতিকে আমি অনিদিষ্ট বিবৃতি বলব, কিন্তু অমুক ব্যক্তি (একবচনে) একটি সুনির্দিষ্ট বিবৃতি। এভাবে একজন মানুষ। একটি অনির্দিষ্ট বর্ণনা এবং লৌহমুখোশধারী মানুষটি হল একটি সুনির্দিষ্ট বর্ণনা। অনির্দিষ্ট বর্ণনার সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্ন জড়িত থাকে, কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয় বলে সেগুলো আমি এড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের বর্তমান আলোচ্য হল সেসব ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের প্রকৃতি, যেসব ক্ষেত্রে আমরা জানি যে একটি সুনির্দিষ্ট বর্ণনার ব্যাপারে প্রযোজ্য বিষয়বস্তু আছে-যদিও সেসব বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। এই বিষয়টি একমাত্র সুনির্দিষ্ট বর্ণনার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। এজন্য এর পর থেকে সুনির্দিষ্ট বর্ণনা বুঝাতে শুধুমাত্র বর্ণনা শব্দটিই ব্যবহার করব আমরা। অতএব বর্ণনা বলতে বুঝানো হবে একবচনে অমুক ব্যক্তি ধরনের যে-কোনও বিবৃতিকে।

কোনও বস্তুকে বর্ণনার দ্বারা জ্ঞাত বলা যায় একমাত্র তখনই যখন আমরা জানি যে এটি হচ্ছে অমুক বস্তু, অর্থাৎ যখন আমরা জানি যে সেই নির্দিষ্ট ধরনের চরিত্র সম্পন্ন বস্তু মাত্র একটিই আছে, তার বেশি নেই। আর সেক্ষেত্রে ধরেই নেয়া যায় যে সেই বস্তুটি সম্বন্ধে আমাদের পরিচিতি মারফত কোনও জ্ঞান নেই। লৌহমুখোশধারী মানুষটির যে অস্তিত্ব ছিল তা আমরা জানি, তাঁর সম্বন্ধে নানান কথাও আমাদের জানা আছে, কিন্তু তিনি কে ছিলেন তা আমাদের জানা নেই। আমরা জানি যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন এবং এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রার্থীটির সঙ্গে আমরা পরিচিতও থাকি (একমাত্র যে অর্থে অন্য কারুর সঙ্গে আমরা পরিচিত থাকতে পারি, সেই অর্থে), কিন্তু প্রার্থীদের মধ্যে তিনি ঠিক কোন জন তা আমরা জানি না অর্থাৎ অ-বাবুই সর্বাধিক ভোট পাবেন এই জাতীয় কোনও বিবৃতি আমাদের সামনে থাকে না–যেখানে অনেক প্রার্থীর মধ্যে অ-বাবু হলেন একজন। আমরা বলতে পারি যে অমুক ব্যক্তিটির সম্বন্ধে আমাদের শুধুমাত্র বর্ণনামূলক জ্ঞানই আছে-যদিও আমরা জানি যে সেই ব্যক্তিটির অস্তিত্ব আছে এবং সম্ভবত সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে আমরা পরিচিতও, তথাপি এমন কোনও বিবৃতি আমাদের জানা নেই যে অ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যেখানে এই অ হচ্ছেন এমন একজন যার সঙ্গে আমরা পরিচিত।

যখন আমরা বলি অমুক ব্যক্তির বা বস্তুর অস্তিত্ব আছে, তখন তার অর্থ হল এই যে সেই বস্তু বা ব্যক্তি বলতে কেবলমাত্র একটি জিনিস বা একজন ব্যক্তিই আছে। অ হচ্ছে সেই বস্তু বা ব্যক্তি বলতে বোঝায় যে সেই বস্তু বা ব্যক্তির গুণধর্ম একমাত্র অ-এরই আছে, অন্য কারুর নেই। অ-বাবু হচ্ছেন এই এলাকার ইউনিয়নপন্থী প্রার্থী বলতে বুঝায়-অ-বাবুই হচ্ছেন এই এলাকার ইউনিয়নপন্থী প্রার্থী, অন্য কেউ নন। এই এলাকার ইউনিয়নপন্থী প্রার্থীটি অস্তিত্বশীল বলতে বোঝায় এই এলাকার ইউনিয়নপন্থী প্রার্থী একজনই আছেন, অন্য কেউ নেই। এভাবে যখন আমরা কোনও নির্দিষ্ট বিষয়টি সঙ্গে পরিচিত হই তখনও আমরা জানি যে সেই বিষয়টি অস্তিত্বশীল। কিন্তু যখন আমরা সেই নির্দিষ্ট বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত নই তখনও আমাদের জানা থাকতে পারে যে সেই নির্দিষ্ট বিষয়টি অস্তিত্বশীল।

সাধারণ শব্দসমূহ, এমনকি বিশেষ নামগুলোও, সাধারণত শুধুই বর্ণনামাত্র। অর্থাৎ, কোনও বিশেষ নামকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সময় একজন ব্যক্তির মনের ভাবনাকে যথাযথভাবে অভিব্যক্ত করা যায় সেই বিশেষ নামটির জায়গায় একটি বর্ণনাকে প্রতিস্থাপন করলে। তাছাড়া সেই ভাবনাকে অভিব্যক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় বর্ণনাটি বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হবে, এমনকি একই ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হবে। একমাত্র স্থির বিষয় (যতক্ষণ পর্যন্ত নামটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে) হল সেই বস্তুটি যার সম্বন্ধে নামটি প্রযোজ্য। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এটি স্থির থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যে বিবৃতিতে নামটি প্রযুক্ত হয়েছে তার সত্য বা মিথ্যার ব্যাপারে নির্দিষ্ট বর্ণনাটি কোনও পার্থক্য সূচিত করে না।

কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মনে করুন বিসমার্ক সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করা হল। নিজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচিতির মতো একটি বিষয় আছে বলে ধরে নিলে, বিসমার্ক নিজেই হয়তো তার নামটি প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করতেন সেই বিশেষ ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করার জন্য যার সঙ্গে তার পরিচিত ছিল। এক্ষেত্রে, তিনি যদি নিজের সম্বন্ধে কোনও রায় দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি নিজেই সেই রায়ের একটি অংশ হতে পারেন। এখানে বিশেষ্যবাচক নামটির প্রত্যক্ষ ব্যবহার রয়েছে যা এই ধরনের ক্ষেত্রে সর্বদাই থাকে– অর্থাৎ কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়কেই হাজির করে এটি, বিষয়বস্তুটির বর্ণনাকে নয়। কিন্তু বিসমার্কের সঙ্গে পরিচিত কোনও ব্যক্তি তার সম্বন্ধে কোনও রায় দিলে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিত। ওই ব্যক্তিটির যা কিছুর সঙ্গে পরিচিত তা হল কিছু ইন্দ্রিয়-উপাত্ত যেগুলোকে তিনি বিসমার্কের শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন (এবং আমরা ধরে নেব যে সঠিকভাবেই করেছেন)। বাহ্য বস্তু হিসেবে তার শরীর এবং আর বেশি করে তার মন ওই ব্যক্তিটির জানা ছিল এসব ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে সংযুক্ত শরীর ও মন হিসেবেই। অর্থাৎ, এগুলোকে তিনি জানতেন বর্ণনার মাধ্যমে। কোনও ব্যক্তির কথা ভাবার সময় তার চেহারার কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলো তার কোনও বন্ধুর মনে ফুটে উঠবে, সেটা অবশ্য নিতান্তই একটা আকস্মিক ব্যাপার। অতএব বন্ধুটির মনে ওই ব্যক্তিটির বর্ণনা একটা আকস্মিক ব্যাপার হিসেবেই থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল এই যে, সে জানে সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনাগুলো একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এমনকি উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির সঙ্গে তার পরিচিত না থাকলেও প্রযোজ্য।

আমরা, যারা বিসমার্ককে চিনতাম না, তারা যখন তার সম্বন্ধে কোনও রায় দিই তখন আমাদের মনের মধ্যে তার বর্ণনাটি ঐতিহাসিক জ্ঞান থেকেই গড়ে ওঠে–তাকে চিহ্নিত করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই জ্ঞান তার থেকে বেশিই হয়। কিন্তু উদাহরণের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক আমরা তাঁকে জার্মান সাম্রাজের প্রথম চ্যান্সেলর বলে মনে করছি। এখানে একমাত্র জার্মান শব্দটি ছাড়া বাকি সবকটি শব্দই বিমূর্ত। আবার এই জার্মান শব্দটির অর্থও বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকম হবে। শব্দটি শুনলে কারুর মনে পড়বে জার্মানিতে ভ্রমণের কথা, কারুর মনে পড়বে মানচিত্রে জার্মানির অবস্থানের কথা ইত্যাদি। কিন্তু প্রয়োগযোগ্য কোনও বর্ণনা পেতে হলে এক সময় কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উল্লেখ করতে হবে, যেটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। সেটি অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের (নির্দিষ্ট তারিখ ব্যতিরেকে) কোনও উল্লেখ হতে পারে, অথবা ইতস্তত কোনও উল্লেখ কিংবা অন্যদের কাছ থেকে শোনা কোনও বিষয়ে উল্লেখও হতে পারে। অর্থাৎ, কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে কোনও বর্ণনার মধ্যে আমাদের পরিচিত কোনও বিষয়ের যেকোনও ধরনের উল্লেখ কোনও না কোনওভাবে অবশ্যই থাকতে হবে যদি না বর্ণিত বিষয়টির সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান ওই বর্ণনার থেকে যৌক্তিকভাবে উদ্ভূত হয়ে থাকে। যেমন সব থেকে দীর্ঘজীবী মানুষ এই বর্ণনাটির মধ্যে শুধুমাত্র সামান্যই (Universal) জড়িত যা অবশ্যই কোনও একজন মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু ওই মানুষটির সম্বন্ধে আমরা কোন রায় দিতে পারি না, কারণ রায় দিতে গেলে এই বর্ণনাটুকু ছাড়া তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানা থাকা দরকার। তবে, যদি বলা হয় জার্মান সাম্রাজ্যের চ্যান্সেলর ছিলেন একজন ধূর্ত কূটনীতিবিদ, তাহলে এক্ষেত্রে আমরা আমাদের বক্তব্যের সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারি এমন কিছুর সাহায্যে যার সঙ্গে আমরা পরিচিত সাধারণত শোনা বা পড়া কোনও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যের সাহায্যে। অন্যদেরকে আমরা যে তথ্য দিচ্ছি বা বাদে, প্রকৃত বিসমার্ক সম্পর্কে প্রদত্ত তথ্য বাদে–যেগুলো আমাদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে আমাদের মধ্যে যা কিছু চিন্তা থাকে তা এক বা একাধিক বিশেষের সঙ্গে জড়িত এবং অন্যথায় শুধুমাত্র ধারণার দ্বারাই গঠিত হয়।

লন্ডন, ইংল্যান্ড, ইউরোপ, পৃথিবী, সৌরজগৎ–এককথায়, যে কোনও স্থানের নাম ব্যবহার করায় সময় তার সঙ্গে একইভাবে কোনও না কোনও বর্ণনা জড়িত থাকে, যে বর্ণনার সূচনা হয় আমাদের পরিচিত এক বা একাধিক বিশেষ থেকে। আমার ধারণা এমনকি সমগ্র মহাবিশ্বের (অধিবিদ্যা যেভাবে তাকে ধারণা করেছে) মধ্যও বিশেষের সঙ্গে এরকম একটি সম্পর্ক জড়িত থাকে। পক্ষান্তরে তর্কবিদ্যার ক্ষেত্রে, যেখানে আমরা যা কিছু অস্তিত্বশীল তার কথা তো জানি বটেই, এমনকি যা কিছু অস্তিত্বশীল হতে পারত বা হতে পারে সেসব বিষয়ের কথাও ভেবে থাকি সেক্ষেত্রে কোনও প্রকৃত বিশেষের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না।

যখন আমরা কেবলমাত্র বর্ণনার দ্বারা জ্ঞাত কোনও কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করি, তখন প্রায়শই আমরা আমাদের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে চাই বর্ণিত প্রকৃত বিষয়টি সম্পর্কে, ওই বর্ণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বক্তব্যের আকারে নয়। অর্থাৎ, যখন আমরা বিসমার্ক সম্পর্কে কিছু বলি, তখন আসলে আমরা এমনকিছু বলতে চাই যা একমাত্র বিসমার্ক নিজেই বলতে পারতেন–অর্থাৎ এমন একটি সিদ্ধান্ত যার একটি অংশ তিনি নিজেই। এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হতে আমরা বাধ্য, কারণ আসল বিসমার্ককে আমরা জানি না। কিন্তু আমরা জানি যে, বি একটি বিষয়, যার নাম ছিল বিসমার্ক এবং বি একজন ধূর্ত কূটনীতিবিদ ছিলেন। অতএব বক্তব্যটিকে আমরা আমাদের মনমতো করে এভাবে উপস্থাপন করতে পারি যে বি ছিলেন একজন ধূর্ত কূটনীতিবিদ, যেখানে বি হচ্ছে সেই বিষয় যিনি বিসমার্ক নামে পরিচিত ছিলেন। যদি আমরা বিসমার্ককে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রথম চ্যান্সেলের হিসেবে বর্ণনা করি, তাহলে যে প্রতিপাদ্যটি আমরা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব তা এরকম দাঁড়ায় জার্মান সাম্রাজ্যের প্রথম চ্যান্সেলর ছিলেন যে-প্রকৃত ব্যক্তিটি, তার সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য হল যে তিনি ছিলেন একজন। ধূর্ত কূটনীতিবিদ। বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা ব্যবহার করা সত্ত্বেও আমরা যে, আমাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারছি তার কারণ হল এই যে, জানি প্রকৃত বিসমার্ক সম্পর্কে একটি সত্য বিবৃতি আছে এবং বর্ণনাটিকে আমরা যতই পাল্টাই না কেন (যতক্ষণ পর্যন্ত বর্ণনাটি সত্য) বর্ণিত বিবৃতিকে একই থেকে যাবে। বর্ণিত এবং সত্য বলে জ্ঞান এই বিবৃত্তিটিই আমাদের আগ্রান্বিত করে। কিন্তু খোদ বিবৃতিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত নই এবং সেটি আমরা জানিও না, যদিও আমরা জানি যে সেটি সত্য।

দেখা যাবে যে বিশেষের পরিচিতি থেকে সরে আসার বিভিন্ন ধাপ আছেঃ এমন লোক রয়েছে যারা বিসমার্ককে জানত; ইতিহাসের মাধ্যমে কিছু লোক বিসমার্ককে জানে; লৌহমুখোশধারী ব্যক্তি; সব থেকে দীর্ঘজীবী মানুষরা। এই সমস্ত ধাপগুলো বিশেষের পরিচিতি থেকে ক্রমশ সরে আসছেঃ প্রথম ক্ষেত্রে অন্য ব্যক্তির পরিচিতির ক্ষেত্রে যা সম্ভব; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমরা জানতে চাইতে পারি বিসমার্ক কে ছিলেন; তৃতীয় ক্ষেত্রে লৌহমুখোশধারী ব্যক্তিটি কে ছিলেন তা আমরা জানি না, যদিও আমরা তাঁর সম্পর্কে বহু বচনই জানি যা এই তথ্য থেকে যৌক্তিকভাবে নিঃসৃত হয় না যে তিনি লৌহমুখশ পরতেন; চতুর্থ এবং সর্বশেষ ক্ষেত্রে আমরা মানুষের সংজ্ঞা থেকে যৌক্তিকভাবে যা নিঃসৃত হয় তার থেকে বেশি কিছু জানি না। একই ধরনের পরস্পরা রয়েছে সামান্যের ক্ষেত্রেও। অনেক সামান্যই অনেক বিশেষের মতোই বর্ণনার সাহায্যে আমাদের কাছে জ্ঞাত হয়। কিন্তু এখানে, বিশেষের ক্ষেত্রের মতোই, বর্ণনার দ্বারা যে জ্ঞান আমরা পাই তা শেষ পর্যন্ত পরিচিতির জ্ঞানেই পর্যবসিত হয়।

বচনের বর্ণনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মূল সূত্র হল : যে সমস্ত বচন আমার বুঝতে পারি তা এমন অংশ নিয়ে গঠিত হওয়া উচিত যার সম্পর্কে আমাদের পরিচিতি আছে।

আমরা এই অবস্থায় সেই সমস্ত আপত্তির উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব না যে আপত্তিগুলো এই মূল সূত্রের বিরুদ্ধে তোলা যায়। এখনকার জন্য আমরা শুধু এটুকুই বলব যে কোন না কোন উপায়ে এসমস্ত আপত্তির উত্তর দেয়া যায়, কেননা এটা মনে করা যায় না যে আমরা কোন বিধান বা মত গ্রহণ করছি সেই বিষয়টি সম্পর্কে কিছু না জেনেই, অর্থাৎ কি আমরা বিচার করছি বা কি বিষয়ে মত প্রকাশ করছি তা না জেনেই। আমরা অবশ্যই যেসব শব্দ ব্যবহার করি তাতে কিছু অর্থ যুক্ত করব যদি আমরা বিষয়টিকে ফাঁকা আওয়াজে পর্যবসিত না করে অর্থবহ করে তুলতে চাই এবং যে সমস্ত অর্থ আমরা ওই শব্দে যুক্ত করেছি তার সম্বন্ধে অবশ্যই আমাদের পরিচিত থাকা প্রয়োজন। যেমন, যখন আমরা জুলিয়াস সীজার সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখি, তখন এটা একান্তই স্পষ্ট যে জুলিয়াস সীজার নিজে আমাদের মনের সামনে উপস্থিত নেই, যেহেতু আমরা তাঁর সঙ্গে পরিচিত নই। আমাদের মনে জুনিয়াস সীজার সম্পর্কে কিছু বর্ণনা আছে : সেই ব্যক্তি যিনি মার্চ মাসের পনেরো তারিখে নিহত হয়েছিলেন, রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, বা হয়তো শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি যার নাম ছিল জুলিয়াস সীজার (এই শেষ বর্ণনাটিতে জুলিয়াস সীজার হল একটি ধ্বনি বা আকার যার সঙ্গে আমরা পরিচিত)। এভাবে আমাদের বক্তব্য ঠিক তা বোঝাচ্ছে না যা সে বোঝাতে চায়, বরং এমনকিছু বোঝাচ্ছে যা জুলিয়াস সীজারের পরিবর্তে তাঁর সম্পর্কে কিছু বর্ণনা তুলে ধরে যেগুলো সম্পূর্ণভাবে বিশেষ এবং সামান্যের দ্বারা গঠিত যার সঙ্গে আমরা পরিচিত।

বর্ণনামূলক জ্ঞানের প্রধান গুরুত্ব হল এই যে এটি আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে সাহায্যে করে। আমরা সত্য সম্পর্কে শুধুমাত্র তাই জানি যা সেই সমস্ত পদ দিয়ে গঠিত যার সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিচিতি আছে– এই তথ্যটি মনে রেখেও চলা যায় যে আমাদের বিষয়ের বর্ণনামূলক জ্ঞানও হতে পারে যার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতার খুব স্বল্প পরিধি থাকার জন্য, এই ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বোঝা না যায় ততক্ষণ আমাদের বেশিরভাগ জ্ঞানই রহস্যপূর্ণ তথা সন্দেহজনক থেকে যাবে।

যেসব শব্দ আমরা ব্যবহার করছি তার অর্থও বুঝতে হবে, যদি আমরা বিষয়টিকে ফাঁকা আওয়াজে পর্যবসিত না করে অর্থবহ করে তুলতে চাই এবং যে সমস্ত অর্থ আমরা ওই শব্দে প্রয়োগ করছি তার সম্বন্ধে অবশ্যই আমাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এভাবে, উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা জুলিয়াস সীজার সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখি, তখন এটা স্বাভাবিক যে জুলিয়াস সীজার আমাদের মনের সামনে উপস্থিত নেই, যেহেতু আমরা তাঁর সম্বন্ধে জানি না। আমাদের মনে জুলিয়াস সীজার সম্পর্কে কিছু বর্ণনা আছে, যেমন–সেই ব্যক্তি যিনি মার্চ মাসে দন্ডিত হয়েছিলেন, রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বা হয়তো শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি যার নাম জুলিয়াস সবজার (এই শেষ বর্ণনাতে জুলিয়াস সীজার হল একটি আওয়াজ বা আকার যার সঙ্গে আমরা পরিচিত)। এভাবে আমাদের বক্তব্য তা বুঝাচ্ছে না যা সে বুঝতে চায়, বরং জুলিয়াস সীজারের পরিবর্তে তার সম্পর্কে কিছু বর্ণনাকে বুঝাচ্ছে যা সম্পূর্ণভাবে বিশেষ এবং সামানে দ্বারা গঠিত, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত।

বর্ণনামূলক জ্ঞানের প্রধান গুরুত্ব হল এই যে এটি আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে সাহায্য করে। আমরা সত্য সম্পর্কে শুধুমাত্র তা-ই জানি যা সেই সমস্ত পদ দিয়ে গঠিত যার সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিচিতি আছে–এই ঘটনা আমাদের বিষয়ের বর্ণনামূলক জ্ঞানও হতে পারে যার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতার খুব স্বল্প পরিধি থাকার জন্য, এই ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বুঝা যাচ্ছে ততক্ষণ আমাদের বেশিরভাগ জ্ঞানই রহস্যপূর্ণ তথা সন্দেহজনক থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *