১৮. ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ

ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ

কনফিউসিয়াস থাই পর্বতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কবরের পাশে দেখতে পেলেন ক্রন্দনরত এক মহিলাকে। তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করার জন্য জুলুকে পাঠালেন। জুলু বললেন, আপনার কান্না দুঃখের পর দুঃখ ভোগকারী মানুষের মতো। মহিলা উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, তা-ই। আমার শ্বশুর একবার এখানে বাঘের শিকারে পতিত হন। আমার স্বামীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছিল। এখানে একই পথে মারা গিয়েছে আমার ছেলে। প্রভু বললেন, তুমি এই জায়গা ত্যাগ করছ না কেন? উত্তরটি ছিল, এখানে কোনো অত্যাচারী সরকারের অস্তিত্ব নেই। প্রভু তখন বললেন, ওহে আমার সন্তানেরা-স্মরণ করো, বাঘের চেয়েও ভয়ানক অত্যাচারী সরকার।

সরকার বাঘের চেয়ে কম ভয়ানক হবে-এ ধরনের নিরাপত্তা বিধানই হচ্ছে এই পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু।

ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা উপরোক্ত উদ্ধৃতি অনুসারে প্রাচীন। টাওবাদীরা মনে করতেন এটা সমাধানযোগ্য নয়, তাই তারা ওকালতি করতেন নৈরাজ্যের পক্ষে। কনফিউসিওরা কিছু নৈতিকতা ও সরকারি প্রশিক্ষণের বিশ্বাস করতেন, যা ক্ষমতাসীনদের ভেতর পরিবর্তন এনে তাদের বিচক্ষণতা দান করে এবং আত্মসংযম ও পরোপকারী গুণে গুণান্বিত করে দেয়। একই সময় গ্রিসে গণতন্ত্রী, অলিগার্ক ও অত্যাচারী শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রতিযোগিতা করে; ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে গণতন্ত্র লক্ষ্য স্থির করে, কিন্তু তা কিছু নেতার অস্থায়ী জনপ্রিয়তায় পতিত হয়ে বারবার পরাজিত হচ্ছিল। কনফিউসিয়াসের মতো প্লেটো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জ্ঞানী মানুষদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের ভেতর সমাধান খুঁজেছিলেন। মি. ও মিসেস সিডনে ওয়েভস এই দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্জাগরিত করেন এবং অলিগার্ক পদ্ধতির প্রশংসা করেন। এই পদ্ধতি অনুসারে ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকে নেতৃত্বের গুণাগুণসমৃদ্ধ ব্যক্তিত্বের মধ্যে। প্লেটো ও ওয়েভসের মধ্যবর্তী সময়ে পৃথিবীতে সামরিক স্বেচ্ছাচার, ধর্মতত্ত্ব, বংশগত, রাজতন্ত্র, অলিগার্ক পদ্ধতি, গণতন্ত্র ও দিব্যতন্ত্রের পরীক্ষা হয়ে গেছে। ক্রমওয়েরেলর ইঙ্গিত করেছে সর্বশেষ পদ্ধতিটি যে, এখনও আমাদের সমস্যার সমাধান হয়নি।

ইতিহাস ও মানব প্রকৃতির উপর পড়াশোনা করেছেন এমন ব্যক্তি স্পষ্টই জানেন যে, গণতন্ত্রে পূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা না থাকলেও তা সমাধানের অপরিহার্য অংশ। রাজনৈতিক শর্তাধীনে থেকে পূর্ণ সমাধান পাওয়া যাবে না। আমাদের অবশ্যই শিক্ষা ও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত অর্থনীতি, প্রচারণা ও মনোবিজ্ঞানের প্রভাব বিবেচনা করতে হবে। আমাদের বিষয়টি তাই চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে: (১) রাজনৈতিক অবস্থা, (২) অর্থনৈতিক অবস্থা, (৩) প্রচারণা এবং (৪) মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষাগত অবস্থা। এগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা যাক।

(১) নেতিবাচক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। ভালো সরকারের নিশ্চয়তা বিধান করে না তা, তবে নিয়ন্ত্রণ করে কিছু অশুভ দিক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের আগে বিবাহিত মহিলাদের আপন সম্পত্তি, এমনকি তাদের উপার্জনের উপরও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দিনমজুর মহিলার মদ্যপ স্বামী তার মজুরির অর্থ ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করার ব্যাপারে বাধা প্রদান করলেও এর প্রতিকারের উপায় ছিল না। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অলিগার্ক সংসদীয় আইন প্রবর্তন করে গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমিকদের অবস্থা অবনতি ঘটায় এবং ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে। শুধু গণতন্ত্রই ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধকরণ আইন প্রতিহত করেছে। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব না থাকলে আমেরিকার পশ্চিমাংশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে শ্বেতকায় অভিজাত শাসিত প্রায়-দাসত্বের মনোভাব সম্পন্ন পীতবর্ণের মানুষের সমন্বয়ে বসতি গড়ে উঠত। দাসত্বের অশুভ দিক পরিচিত এবং যেখানেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করেছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ আজ হোক কাল হোক দাসত্বের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবেই। ইতিহাসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সংখ্যালঘুকে বিশ্বাস করা যায় না সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষায়।

এখনও আগের মতো একটা জোরালো ধারণা বিদ্যমান আছে যে ভালো মানুষের সমন্বয়ে গঠিত অলিগার্ক পদ্ধতি প্রশংসনীয়। কনস্টান্টাইন পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য খারাপ ছিল, পরে তা ভালো হয়ে যায়। রাজাদের বইয়ে এ রকম মানুষ রয়েছেন যারা প্রভুর দৃষ্টিতে ভালো কাজ করতেন। ইংরেজদের ইতিহাসে শিশুদের দেয়া শিক্ষা অনুসারে ভালো রাজা ও খারাপ রাজা রয়েছেন। ইহুদিদের সমন্বয়ে গঠিত অলিগার্ক পদ্ধতি খারাপ কিন্তু নাজিদের অলিগার্ক পদ্ধতি ভালো। আর কমিউনিস্টদের অলিগার্ক পদ্ধতি ভালো কিন্তু অভিজাতদের অলিগার্ক পদ্ধতি খারাপ।

এ ধরনের ধারণা অর্থহীন বয়স্ক মানুষদের সম্পর্কে। আদেশ পালনকারী শিশু ভালো এবং অমান্যকারী খারাপ। যখন সে বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হয় তখনও তার শিশুশালার ধারণা থেকে যায় এবং মনে করে যে আদেশ পালনকারীরাই ভালো এবং অমান্যকারীরা খারাপ। ফলস্বরূপ আমাদের পার্টি কর্মীরা ভালো এবং বিরোধী দলের কর্মীরা খারাপ। আমাদের দলেল সমন্বয়ে গঠিত সরকারই ভালো সরকার এবং অন্য দলের গঠিত সরকার খারাপ। মন্টেগুরা ভালো, কিন্তু ক্যাপুলেটরা খারাপ।

এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বসহকারে পোষণ করলে সামাজিক জীবন অসম্ভব হয়ে পড়ে। শুধু শক্তির মাপকাঠিতে বিভিন্ন দলের ভালো-মন্দ বিবেচনায় স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তা যে কোনো মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে। বিদ্রোহের ভয় না থাকলে কোনো দলই ক্ষমতা অর্জনের পর অন্য দলের স্বার্থের প্রতি যত্নশীল হতো না। নিষ্ঠুরতার চেয়ে ভালো কিছু অর্জন করতে হলে সমাজ জীবনে বিশেষ নিরপেক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সমন্বিত কার্যকলাপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাই এসব ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হচ্ছে নিরপেক্ষতার বাস্তব রূপ।

যা হোক প্রয়োজন হলেও গণতন্ত্র কোনো অবস্থায়ই তা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র রাজনৈতিক শর্ত নয়। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের নৃশংসা ও সম্পূর্ণত অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতা অনুশীলন করা সম্ভব। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সরকার (মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি ছাড়াই) গণতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আয়ারল্যান্ডের উপর অত্যাচার ব্যাহত করতে পারেনি। শুধু জাতিগত নয়, বরং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ নির্যাতিত হতে পারেন। সুশৃঙ্খল সরকারের সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠের নিরাপত্তা বিধান সঙ্গতিপূর্ণ হলে তা পরিণত হয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের অংশবিশেষ।

একতাবদ্ধ যেসব বিষয়ের জন্য হয়ে কাজ করতে হয় এবং যেসব বিষয়ের জন্য জরুরি নয় সমতা, ওইগুলোর আলোচনা প্রয়োজন। যেসব স্পষ্ট বিষয় সম্বন্ধে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ওইগুলো মূলত ভৌগোলিক। জনপথ, রেলপথ, ড্রেন, গ্যাস ইত্যাদি আবশ্যিকভাবে একই পন্থা অবলম্বন করে। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কতা (প্লেগ অথবা রাবির বিরুদ্ধে) ভৌগোলিক। এটা খ্রিস্টান বিজ্ঞানীদের জন্য প্রচারের উপযোগী নয় যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। কারণ অন্যদেরও এগুলো সংক্রমিত করতে পারে। গৃহযুদ্ধ ছাড়া যুদ্ধ একটি ভৌগোলিক ব্যাপার। তারপরও শিগগিরই এই অঞ্চল এক পক্ষ দ্বারা এবং অন্য অঞ্চল অন্য পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।

১৯২২ সালের আগে আইরিশদের অনুরূপ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়ে বসবাস করলে তাদের অনেক সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে। কিন্তু এই পদ্ধতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে প্রযোজ্য হয় না। এটা সত্য যে পাশাপাশি বসবাসরাত খ্রিস্টান ও মুসলমান জনগণের পৃথক বিবাহ আইন রয়েছে; কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপার ছাড়া অন্য সব বিষয়ে তারা একই সরকারের অধীনতা মেনে নেয়। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যাপারে ধর্মীয় সমতা জরুরি নয়। প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক জনগণ একই সরকারের অধীন শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু সংস্কারের পর ১৩০ বছর পর্যন্ত অবস্থা এমন ছিল না।

তত্ত্বগতভাবে সমাধান করা যাবে না শৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ স্বাধীনতার মাত্রা বিষয়ক প্রশ্নটি। তত্ত্বগতভাবে যে জিনিসটি বলা যাবে না তা হলো, যেখানে যৌথ সিদ্ধান্তের অনুকূলে কৌশলগত কারণ নেই, সেখানে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে হলে জনস্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শক্তিশালী ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। এটা আশ্চর্যের ছিল না যে এলিজাবেথের রাজত্বকালে রোমান ক্যাথলিকরা যখন তাকে সিংহাসনচ্যুত করতে চায় তখন সরকার তাদেরকে বিরাগ দৃষ্টিতে দেখে। অনুরূপভাবে নিম্ন দেশগুলোর যেসব জায়গায় প্রটেস্ট্যান্টরা স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহরত ছিল সেখানে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে স্পনীয়রা তাদের অত্যাচার করত। আজকাল ধর্মতত্ত্বের রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই; এমনকি পার্থক্য খুব গভীর না হলে তা নির্যাতনের কারণ হতে পারে না। রক্ষণশীল, উদারপন্থি ও শ্রমিক পাশাপাশি থেকে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে, কারণ তারা কেউ শক্তি প্রয়োগে সংবিধান পরিবর্তন করতে চায় না। কিন্তু একত্রিত করা কঠিন কমিউনিস্ট ও ফ্যাসিবাদীদের। গণতান্ত্রিক সমাজে শক্তি বলে ক্ষমতা দখল এবং এ ধরনের প্রচেষ্টায় উদ্দীপনা যোগানো যুক্তিসঙ্গত ভাবেই নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। কারণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল জনগণের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। আইনভঙ্গের উদ্দীপনা ছাড়া সব ধরনের প্রচারণার প্রতি সহনশীলতা প্রয়োজন এবং কৌশলগত দক্ষতা ও শৃঙ্খলার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আইনের প্রতি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। আমি এ বিষয়ে প্রত্যাবর্তন করছি মনোবিজ্ঞান শিরোনামে।

ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিকোণ থেকে কঠিন প্রশ্ন দেখা দেয় শাসন সংক্রান্ত ইউনিটের আকার সম্বন্ধে। গণতান্ত্রিক হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোতে সাধারণ নাগরিকদের রাজনৈতিক চেতনাবোধ কম। তাদের মাথাব্যথা নেই নির্বাচনের বিচার্য বিষয় কি হবে এ সম্পর্কে। সম্ভবত দৈনন্দিন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়গুলো নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করেন। তাদের কাছে এমন মনে হয় যে, পুরো বিষয়ের তুলনায় তাদের ব্যক্তিগত ভোটের অবদান খুবই নগণ্য। প্রাচীন নগর রাষ্ট্রগুলোতে এসব অশুভ ব্যাপারগুলোর প্রভাব কম ছিল। আজকাল স্থানীয় সরকারগুলোতে অনুরূপ প্রভাব অনুপস্থিত। আশা করা যায় যে, জনসাধারণ জাতীয় সমস্যার চেয়ে স্থানীয় প্রশ্নে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করবেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এমন নয়। এলাকা যত বড় হবে ভোটদানে মানুষ তত বেশি অংশগ্রহণ করবে। এর আংশিক কারণ এই যে, গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে প্রচারণার জন্য অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়। তাছাড়া নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এমনি অধিক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে থাকে। সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ বিষয়গুলোর ভেতর রয়েছে যুদ্ধ ও সম্ভাব্য শত্রুর সঙ্গে সম্পর্ক। আমার মনে পড়ে, এক বৃদ্ধ ইত্তকেল ১৯১০ সালের জানুয়ারি মাসে আমাকে বলেছিলেন, তিনি রক্ষণশীলদের সমর্থনে ভোট প্রদান করবেন (যা তার অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধী ছিল)। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছিল যে, যদি লিবারেলরা জয়ী হয় তবে এক সপ্তাহের ভেতর জার্মানরা আমাদের দেশে ঢুকে পড়বে। এটা আশা করা যাবে না যে, তিনি কখনও প্যারিস কাউন্সিল নির্বাচনের ভোট দিয়েছিলেন, যদিও এ বিষয় সম্পর্কে কিছুটা উপলব্ধি ছিল তার। এসব বিষয় তাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়, কারণ এগুলো সমর্থ হয়নি গণহিস্টরিয়া সৃষ্টিতে।

সুতরাং সমস্যাটি উভয়বিধ। গণতন্ত্র মানুষকে এমন অনুভূতির জন্ম দেয় যে দল ছোট হলে রাজনৈতিক ক্ষমতার তার কার্যকরী অংশ থাকে, কিন্তু দল বড় হলে নয়। অপরদিকে দল বড় হলে বিচার্য বিষয়টি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু ছোট হলে নয়।

এই অসুবিধা আংশিকভাবে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নির্বাচনী এলাকা ভৌগোলিক না হয়ে পেশাগত হলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ট্রেড ইউনিয়নে কার্যকরীভাবে গণতন্ত্র সম্ভব। বিরক্তিকর নীতি সম্পৰ্কীয় প্রশ্নে প্রত্যেক শাখাই আলোচনায় বসতে পারে। সদস্যদের আগ্রহ ও অভিজ্ঞতায় সাদৃশ্য বিদ্যমান, তাই ফলপ্রসূ আলোচনা সম্ভব। অধিকাংশ সদস্যই অনুভব করবে যে এতে তাদের ভূমিকা ছিল-পুরো সংঘের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এমন হতে পারে।

যা হোক, স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে এ পদ্ধতির। অনেক সমস্যাই ভৌগোলিকভাবে এত অপরিহার্য যে ভৌগোলিক নির্বাচনী এলাকা পরিহারযোগ্য নয়। সরকারি বিভাগগুলো নানা দিক দিয়ে আমাদের জীবন এতই প্রভাবিত করে যে, রাজনীতিবিদ নন এমন একজন ব্যস্ত মানুষ তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অধিকাংশ। আঞ্চলিক ও জাতীয় প্রশ্নে পদক্ষেপ নিতে পারেন না। সবচেয়ে ভালো সমাধান। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নির্বাচিত ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তার পদ্ধতির প্রসার। অনেক পেশারই আজকাল এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব নেই। মনোগত ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক দরকষাকষির ক্ষেত্রে এই সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্ব ভোটারদের সংখ্যা তাদের উৎসাহ দ্বারা বিচার্য। আমি বলছি না যে সংসদের বিকল্প হবে এইরূপ প্রতিনিধিত্ব, তবে তা কাজ করবে বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংসদকে অবহিত করার মাধ্যম হিসেবে।

ফেডারেশন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উদ্দেশ্য ও অনুভূতি অপেক্ষা নির্বাচনী এলাকাগুলোর স্থানীয় উদ্দেশ্য ও অনুভূতি জোরালো হলেই। আন্তর্জাতিক সরকারের অস্তিত্বের জন্য স্পষ্টত যথাযথ ক্ষমতার অধিকারী জাতীয় সরকারগুলোর ভেতর ফেডারেশন প্রয়োজন হয়। ইতিমধ্যে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য সংবলিত আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ বিরাজমান রয়েছে। যেমন ডাকমাশুল সম্পর্কিত। কিন্তু এসব উদ্দেশ্য জনগণের ভেতর জাতীয় সরকারের চেয়ে বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করে না। এই শর্তের অভাব দেখা দিলে ফেডারেল সরকার ক্ষমতা লঙ্ঘন করে কতগুলো ইউনিট সমন্বয়ে গঠিত সরকার ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান বিধিবদ্ধ হওয়ার পর ফেডারেল সরকার রাজ্যগুলোর বিনিময়ে লাভবান হয়। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে একই প্রবণতা বিরাজ করে। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত গৃহযুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়লে এবং বিজয়ী হলে বিশ্ব ফেডারেল সরকার জাতীয় সরকারের চেয়ে অমিত শক্তির অধিকার হয়ে ওঠে। সুতরাং পদ্ধতি হিসেবে ফেডারেশনের ফলপ্রদতা অত্যন্ত সীমিত; তবে তা কাম্য ও গুরুত্বপূর্ণ এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে।

আধুনিক বিশ্বে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা অনেক বড় হওয়া অপরিহার্য বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে শান্তি ও যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বব্যাপী এলাকাই একমাত্র সমাধানযোগ্য বলে বিবেচিত। বড় এলাকাগুলোর মনোগত অসুবিধা বিশেষত ভোটারদের ভেতর ব্যর্থতাবোধ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। আংশিকভাবে পৃথক উদ্দেশ্য সংবলিত সংগঠনের মাধ্যমে এবং আংশিকভাবে ফেডারেশন বা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তা কমাতে হবে। সামাজিক সংগঠন পরিবৃদ্ধির অপরিহার্য পরিণতি হচ্ছে ব্যক্তি বিশেষের অধীনতা। কিন্তু যুদ্ধের বিপদ দূর করতে হলে যেসব সমস্যা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে ওইগুলোর চেয়ে স্থানীয় সমস্যাগুলো অনেক বেশি বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ যুদ্ধের ভয় অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে দূরবর্তী দেশগুলো ও সরকারের বাহ্যিক কাজকর্মের দিকে মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে বেশি।

এখনও অত্যাচারীর হাত থেকে ব্যক্তি মানুষ ও সংখ্যালঘু জনগণের নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজন রয়েছে গণতান্ত্রিক সমাজে। আইন প্রশাসন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পক্ষে মন্টেস্কুর ওকালতি, দমন ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ইংরেজদের চিরাচরিত বিশ্বাস, বেনথেসের রাজনৈতিক মতবাদ এবং উদারনৈতিকতা-এ সবই ছিল স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতা অনুসরণের পথে বাধাস্বরূপ। কিন্তু এ ধরনের পদ্ধতি দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নিঃসন্দেহে যুদ্ধ বিষয়ক অফিস ও অশ্বারোহী প্রহরীদের পৃথকীকরণ সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। কিন্তু এর ফলাফল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ছিল ভয়াবহ। আগেকার দিনগুলোতে বিপজ্জনক অচলাবস্থা সৃষ্টি হতো আইন পরিষদ ও নির্বাহীদের ভেতর মতানৈক্য দেখা দিলে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে মন্ত্রী পরিষদের হাতে উভয় ক্ষমতা অর্পণ করে দক্ষতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রতিবিধানের পদ্ধতি বর্তমান পরিবেশের উপযোগী নয়। তাছাড়া এ ধরনের পদ্ধতি ফলপ্রসূও নয়। স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান ও তৃরিত সমালোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা অপব্যবহারকারী অফিসিয়াল, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের উপর প্রভাব সৃষ্টির জন্য সমিতির প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি কর্মের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ শাখায় বিশেষ রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণতন্ত্র এ কারণে বিপদাপন্ন যে সারাদেশে বিরাজমান জনমতের চেয়ে ঢের বেশি প্রতিক্রিয়াশীল পুলিশ ও বিমানবাহিনীতে বিরাজমান সাধারণ মতামত।

গণতন্ত্র যে ধরনের হোক না কেন নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণহীন হলে ব্যক্তিবিশেষ ও সংগঠনগুলো অবাঞ্ছিত ক্ষমতা অর্জন করে। পুলিশের বেলা তা বিশেষভাবে সত্য। সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী ও আমাদের শৃঙ্খলাবিবর্জিত পুলিশ বাহিনী থেকে উদ্ভূত পাপগুলোর বিবরণ আরনেস্ট জেরন হপকিনস জোরের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ের সারসংক্ষেপ হচ্ছে যে, অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে পুলিশকে উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং অপরাধের স্বীকারোক্তি কোর্ট গ্রহণ করে থাকে। ফলে অপরাধ স্বীকার না করা পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির উপর নির্যাতন চালিয়ে যেতে পুলিশের আগ্রহ খেয়াল করা যায়। এই পাপ প্রতিটি দেশেই কমবেশি বিদ্যমান। ভারতে তা যত্রতত্র রয়েছে। স্বীকৃতি আদায়ের অভিলাষই হচ্ছে তদন্ত কাজে গৃহীত নির্যাতনের ভিত্তি। পুরনো চীনে সন্দেহভাজন ব্যক্তির উপর নির্যাতন করা অভ্যাসগত হয়ে পড়েছে। কারণ, অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন কোনো সম্রাট রায় প্রদান করেন যে, কাউকে নিন্দা করা যাবে না স্বীকারোক্তি আদায় না করে। পুলিশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য এটা অপরিহার্য যে, কোনো অবস্থায়ই প্রমাণ। হিসেবে স্বীকারোক্তি গণ্য করা যাবে না।

যা হোক, প্রয়োজনীয় হলেও এই সংস্কার যথেষ্ট নয়। প্রতিটি দেশের পুলিশি ব্যবস্থা নির্ভরশীল এই ধারণার উপর যে, সন্দেহভাজন অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো জনগণের আগ্রহের ব্যাপারে। কিন্তু তার পক্ষের প্রমাণগুলো তার ব্যক্তিগত আগ্রহের ব্যাপার। সচরাচর বলা হয়ে থাকে যে, দোষী ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করার চেয়ে নির্দোষ ব্যক্তিকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবসময়ই অপরাধের প্রমাণ খুঁজে বের করা পুলিশের কর্তব্য-নির্দোষ ব্যক্তির দোষহীনতায় প্রমাণ খুঁজে বের করা পুলিশের কাজ নয়। দরুন আপনি অন্যায়ভাবে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত এবং আপনার বিরুদ্ধে প্রথম লব্ধ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত অনেক যুক্তিই রয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রমাণাদি খুঁজে বের করার জন্য সব ধরনের রাষ্ট্রীয় তৎপরতা চালানো হবে এবং জুরিদের মনে। আপনার বিরুদ্ধে ধারণা সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সবচেয়ে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করা হবে। ইতিমধ্যে সরকারি সাহায্য ছাড়া নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন। করার জন্য আপনাকে অবশ্যই ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যয় করতে হবে। দারিদ্যের ওজর দেখালে আপনাকে পরামর্শদাতার ব্যবস্থা দেয়া হবে। তবে তিনি অধিক দক্ষ হবেন না সরকারি অভিশংসকের চেয়ে। নির্দোষ প্রতিপন্ন হলে আপনি শুধু রোববার সংবাদ অথবা সিনেমার মাধ্যমে দেউলিয়াপনা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু অন্যায়ভাবে আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করার সম্ভাবনাই বেশি।

পুলিশের অন্যায় অভিযোগ থেকে আইন পালনকারী নাগরিকদের রক্ষা করতে হলে দুধরনের পুলিশ বাহিনী ও দুধরনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রয়োজন। এর একটি পরিকল্পিত হবে দোষ প্রমাণ করার জন্য এবং অন্যটি নির্দোষ প্রতিপন্ন করার জন্য। সরকারি অভিশংসকের অতিরিক্ত সমমানের গণপ্রতিরক্ষাকারী থাকবে। দোষী ব্যক্তির দোষ প্রমাণের চেয়ে নির্দোষ ব্যক্তির বেকসুর খালাস কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অধিকন্তু প্রতিরক্ষাকারী পুলিশ দোষ প্রমাণকারী পুলিশ শক্তিতে পরিণত হতে বাধ্য, যেখানে দোষ প্রমাণকারী পুলিশ দায়িত্ব পালনকালে অপরাধ করে বসে। শুধু এভাবেই প্রশমন করা যেতে পারে পুলিশের নির্যাতন স্পৃহা।

(২) আমি এখন আলোচনা করব স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের অর্থনৈতিক সম্পর্কে। আপন বৈশিষ্ট্যের জন্য এবং এর সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে বলে এই বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক গণতন্ত্র আংশিকভাবে সমস্যার সমাধান দিলেও কোনোক্রমেই তা দিতে পারে না পূর্ণ সমাধান। মার্কস দেখিয়েছেন যে, অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাজতান্ত্রিক বা অলিগার্কিক থেকে গেলে শুধু রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুতরাং অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকবে এবং রাষ্ট্র অবশ্যই গণতান্ত্রিক হবে। আজকাল যারা মার্কসের অনুসারী বলে দাবি করেন তারা শুধু তার মতবাদের অর্ধেক ধারণা করে আছেন এবং রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের দাবি ছুঁড়ে ফেলেছেন। এভাবে অলিগার্কের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা। ফলে অলিগার্ক সামর্থ্য লাভ করেছেন আরও শক্তিশালী এবং আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি অত্যাচার চালিয়ে যাওয়ার।

ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে পুরনো গণতন্ত্র ও নতুন মার্কসবাদ উভয়ের লক্ষ্য। পূর্বোক্তটি ব্যর্থ হয়েছে কারণ তা শুধু রাজনৈতিক ছিল এবং শেষোক্তটি শুধু অর্থনৈতিক হওয়ার জন্য ব্যর্থ হয়েছে। উভয়টি সংমিশ্রণ ছাড়া সমাধান সম্ভব। নয়।

জমি ও বৃহদাকার অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর রাষ্ট্রীয় মালিকানার পক্ষে যুক্তি আংশিকভাবে কৌশলগত এবং আংশিকভাবে রাজনৈতিক। ফেবিয়ান সমাজ ছাড়া অন্য কোথাও কৌশলগত যুক্তির উপর গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। টিনিসি ভেলি কর্তৃপক্ষের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে আমেরিকাতে কিছু গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই যুক্তিগুলো বিশেষত বিদ্যুৎ ও পানির শক্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তা রক্ষণশীল সরকারগুলোকে ওইসব পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করে যা কৌশলগত দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক। আমরা দেখেছি কিভাবে আধুনিক কৌশলের ফলে সংগঠনগুলোর কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকগুলো একত্রিত হচ্ছে, ফলে সুবিধা বাড়ছে। পরিণামস্বরূপ রাজনৈতিক রাষ্ট্র অধিকহারে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হস্তগত করবে অথবা বাধা প্রদান বা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম যথেষ্ট শক্তিশালী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে আংশিকভাবে তা ছেড়ে দেবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর রাষ্ট্র শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে না পারলে এগুলো ক্রীড়নকে পরিণত হবে। যেখানেই আধুনিক কৌশল বর্তমান সেখানে যেভাবেই হোক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সমন্বিত হবেই। সমন্বয় সাধনের দিকে এই গতির অপ্রতিরোধ্য নৈর্ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মার্কস একে তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পরিবর্তনের পরিণতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর কোনো সম্পর্ক নেই শ্রেণি সংগ্রাম বা প্রলেতারীয়দের অন্যায়ের সঙ্গে।

সমাজতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলনে শিল্প শ্রমিকদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য লক্ষ্য স্থির করেছে; এর কৌশলগত সুবিধাগুলো তুলনামূলকভাবে পটভূমিতে লিখিত রয়েছে। এ রকম বিশ্বাসও রয়েছে যে, বেসরকারি পুঁজিপতির অর্থনৈতিক ক্ষমতা সাধারণ শ্রমিকদের নির্যাতন করার জন্য তাকে সামর্থ্য যোগায় এবং যেহেতু প্রাচীন হস্তশিল্পীদের মতো সাধারণ শ্রমিকরা ব্যক্তিগতভাবে উৎপাদনের উপকরণের মালিক হতে পারে না, তাই মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সব শ্রমিকের সমন্বয়ে গঠিত সমিতির সামগ্রিক মালিকানা। এ রকম যুক্তি দাঁড় করানো হয় যে, বেসরকারি পুঁজিপতিরা দখলচ্যুত হলে শ্রমিক সমাজ রাষ্ট্র গঠন করবে। জমি ও পুঁজির রাষ্ট্রীয় মালিকানা পুরোপুরিভাবে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটি অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রস্তাব এবং তাই তা আসছে আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের অধীনে।

এই যুক্তি পরীক্ষা করে দেখার আগে স্পষ্ট বলার ইচ্ছা রাখি যে, নিরাপত্তা বিধান করা হলে এবং বিবর্ধিত করা হলে তা আমার বিবেচনায় বৈধ। অন্যথায় নিরাপত্তা ও বিবর্ধনের অভাবে তা বিপজ্জনক এবং এর ফলে অর্থনৈতিক উৎপীড়ন থেকে মুক্তি অনুসন্ধানীদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা এই মুক্তিকে অতিমাত্রায় পূর্ণতা দিতে চায় এবং দেখতে পায় যে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর কঠোর ও ভয়ানক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উৎপীড়ন।

প্রথমত, এক জিনিস নয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ। ধরা যাক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় একটি রেল কোম্পানি রয়েছে এবং রাষ্ট্র হচ্ছে সব নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রেল কোম্পানির উপর সাধারণ নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ-তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। আসুন এক মুহূর্তের জন্য আমরা আমেরিকার বৃহৎ কর্পোরেশনের মালিকানা সম্পর্কে মেসার্স বার্লে ও মিনসের বক্তব্যে ফিরে যাই। তারা দেখান যে, এ ধরনের অধিকাংশ কর্পোরেশনে সব পরিচালকের সামগ্রিক মালিকানা এক অথবা দুই শতাংশে। তারপরও কার্যত তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত কর্পোরেশনগুলোর উপর।

সাধারণভাবে স্টক মালিকদের বোর্ড নির্বাচনে তিনটি বিকল্প রয়েছে। তিনি ভোটদানে বিরত থাকতে পারেন অথবা তার ভোটদান ক্ষমতা কর্পোরেশন ব্যবস্থাপনায় প্রক্সি কমিটির নির্ধারিত ব্যক্তিদের হাতে হস্তান্তরিত করার জন্য প্রক্সি কমিটিতে দরখাস্ত করতে পারেন। স্টক খুব বিশাল না হলে সভায় ব্যক্তিগত ভোটের মূল্য নেই বললেই চলে। বাস্তবে তাই স্টক মালিক ভোট না দেয়ার বিকল্প পথ বেচে নিতে বাধ্য হন অথবা তার ভোটদান ক্ষমতা এমন ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, যাদের উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা যাদের নির্বাচনের সময় তিনি অংশগ্রহণ করেননি। বরং প্রক্সি কমিটির মনোনয়নদানকারীদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে–যেহেতু প্রক্সি কমিটি বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক নিয়োজিত। তাই শেষোক্তটি নির্বাচন করতে পারে তাদের পরবর্তী কমিটি।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উপরে বর্ণিত অসহায় ব্যক্তিরা প্রলেতারীয় নয়, পুঁজিপতি। সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশনে তাদের মালিকানা রয়েছে, আইনগত অধিকারের ফলে তারা ভাগ্যক্রমে এর থেকে কিছু আয় করে থাকেন। কিন্তু তাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই আয় দৈবাধীন হয়ে পড়ে। ১৮৯৬ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যাই, তখন অসংখ্য রেল কোম্পানির দেউলিয়াপনা দেখে আমি মর্মাহত হই; তদন্ত করে জানতে পারি যে দেউলিয়াপনার কারণ পরিচালকদের অযোগ্যতা নয় বরং অদক্ষতা। অন্যান্য কোম্পানিতে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল অসাধারণ শেয়ার মালিকদের নিয়োজিত মূলধন, ফলে পরিচালকদের বেশ কিছু মুনাফা অর্জিত হয়। এটা অপরিপক্ক পদ্ধতি, কিন্তু আজকাল আরও সুন্দরভাবে তার ব্যবস্থা হয়ে থাকে, যদিও অপরিবর্তিত রয়েছে এর প্রকৃতি।

মালিকানার চেয়ে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম বিকীর্ণকর কর্পোরেশনগুলোতে। এর ফলে আনীত সুবিধাগুলো প্রথম দিকে রাজনৈতিক হলেও পরে অপরিমিত সম্পদের উৎসে পরিণত হয়। বিনীত বিনিয়োগকারীদের ভদ্রভাবে লুণ্ঠন করা যায়; একমাত্র সীমাবদ্ধতা এই যে, তিনি অবশ্যই এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাবেন না যে, তিনি ভবিষ্যৎ সঞ্চয় অন্য কোথাও জমা রাখতে পারেন। রাষ্ট্র কর্পোরেশনের স্থলাভিষিক্ত হলে মূলত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় না; প্রকৃতপক্ষে কর্পোরেশনের বিশালত্বই শেয়ার মালিকদের অসহায় করে তোলে। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের কাছে শেয়ার মালিকরা আরও বেশি অসহায়। একটি যুদ্ধ জাহাজ হচ্ছে সরকারি সম্পদ। কিন্তু এই সুবাদে যদি আপনি আপনার স্বত্বাধিকারের অনুশীলন করেন তবে শিগগিরই আপনাকে অনেক নিচু অবস্থানে যেতে বাধ্য করা হবে। এটা সত্য যে আপনার সামনে একটি পথ খোলা আছে। নৌবাহিনীর বাজেট সংকোচনের কোনো প্রার্থীকে আপনি পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন অথবা আপনি পত্রিকায় লিখতে পারেন যে দর্শনার্থীদের প্রতি নাবিকদের নম্র হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি পারবেন না এর অতিরিক্ত কিছু করতে।

আলোচিত যুদ্ধ জাহাজটি পুঁজিবাদী দেশের। কিন্তু সব কিছু ভিন্নরূপ ধারণ করে এর মালিকানা সমাজতান্ত্রিক দেশের হলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে এই সত্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বলে মনে হয় যে, এখন অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিষয়টি ব্যবস্থাপনার, মালিকানার নয়। ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল কর্পোরেশনের জাতীয়করণ করল। তারপরও এর ব্যবস্থাপনার জন্য মানুষের প্রয়োজন হবে; বর্তমান ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা অথবা অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ভিন্ন মানুষ থাকতে পারে। শেয়ার মালিকদের প্রতি তারা বর্তমানে যে মনোভাব দেখাচ্ছে ভবিষ্যতে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি তারা একই মনোভাব দেখাবে। এটা সত্য যে, তারা থাকবে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু এর দৃষ্টিভঙ্গি অফিসিয়ালদের দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি থেকে সরে যাবে যদি সরকার গণতান্ত্রিক এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক না হলে।

মার্কসবাদীরা বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের ধ্যান-ধারণাই ধারণ করে আছে মার্ক্স-এঙ্গেলসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তারা এখনও মনে করেন যে ব্যবসা ব্যক্তি পুঁজিপতির মালিকানাধীন। তারা কোনো শিক্ষা লাভ করতে পারেননি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের বিভাজন থেকে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিরাই গুরুত্বপূর্ণ-নামমাত্র স্বত্বাধিকারী নন। বিশপ প্রাসাদের স্বত্বাধিকারী নন, তারপরও এমন মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে, নির্বাসন সংক্রান্ত অবস্থার দিক দিয়ে তারা সাধারণ আয়ের মানুষের চেয়ে ভালো নন। অগণতন্ত্রী যে কোনো প্রকার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অধীন এমন অর্থ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিরা কোনো কিছুর মালিক না হলেও রাজকীয় সরকারি বাসভবন, বিলসাবহুল গাড়ি, রাজোচিত আপ্যায়ন ভাতা, সরকারি খরচে ছুটি কাটানোর জন্য সরকারি ছুটির আশ্রয় এবং এ রকম আরও কত কিছু ভোগ করে থাকেন। কেন সাধারণ শ্রমিকদের জন্য তাদের চিন্তা এখনকার অর্থ নিয়ন্ত্রণকারীদের চেয়ে বেশি হবে? সাধারণ শ্রমিকরা যদি বর্তমান অবস্থান থেকে সরকার ক্ষমতা না রাখে তবে শ্রমিকদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। অধিকন্তু বর্তমান কর্পোরেশনগুলোতে ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের অধীনতামুলক মনোভাব থেকে এটা স্পষ্ট যে, গণতন্ত্রের উপর অফিসিয়ালদের ক্ষমতা অর্জন করত সহজ হয় গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের সমন্বয়ে গঠিত হলে।

সুতরাং, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবহার জনকল্যাণমূলক কাজে নিশ্চিত করতে হলে গণতন্ত্র শুধু অপরিহার্য নয় বরং প্রয়োজন গণতন্ত্রের কার্যকরী ভূমিকা থাকা। কিন্তু একে অর্জন করা বর্তমান অবস্থার চেয়ে কঠিন। কারণ, সতর্কতার সঙ্গে তত্ত্বাবধান করা না হলে অফিসিয়াল শ্রেণি একত্রে কুক্ষিগত করে ফেলে সরকার এবং শিল্প ও অর্থ নিয়ন্ত্রণকারীদের ক্ষমতা। তাছাড়া হল, পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের নিরঙ্কুশ মালিকানা রাষ্ট্রের অধিকারে থাকায় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের উপকরণ সরবরাহ করতে হয় সরকারকেই।

তাই বৃহদাকার শিল্প প্রতিষ্ঠান অর্থ সংস্থাগুলোর সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হলেও তা যথেষ্ট নয়। এ পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বিশুদ্ধ রাজনৈতিক গণতন্ত্রের চেয়ে অফিসিয়াল উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে অধিকতর নিরাপদ ও স্বাধীন প্রচারণার জন্য অধিকতর উপযোগী ব্যবস্থা সংবলিত ব্যাপকতর গণতন্ত্রের সংযোজন জরুরি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাপ্রবাহ থেকেই বোঝা যায় গণতন্ত্র থেকে পরিত্যক্ত সমাজতন্ত্রের বিপদ। রাশিয়ার প্রতি কিছু মানুষের মনোভাব ধর্ম বিশ্বাসের মতো। তাদের মতে, সে দেশের সব কিছু ভালো নয় এমন পরীক্ষা নিরীক্ষা করাও অসৎ কাজ। কিন্তু যুক্তিবাদী মানুষের মনে প্রাচীন উদ্যমপূর্ণ ব্যক্তির প্রমাণ দিন দিন এই বিষয়ের উপর প্রত্যয় সৃষ্টি করেছে। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে ইতিহাস ও মনোবিজ্ঞানের যুক্তিগুলো থেকে বোঝা যাবে যে দায়িত্বহীন ক্ষমতার দ্বারা মঙ্গলের আশা করা নিরর্থক। ক্ষমতার প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে ENGENE LYONE-এর নিম্নোক্ত কথাগুলো থেকে

নিরঙ্কুশতা থেকে এটা বোঝা যায় যে রাষ্ট্র একচেটিয়াভাবে অধিকার করে নেয় শতসহস্র এমনকি লক্ষাধিক ছোট-বড় স্বেচছাচারীর জীবন ও এর প্রকাশ কাজ ও আনন্দ, পুরস্কার ও শাস্তির উপকরণ। পিরামিডসদৃশ স্তর বিশিষ্ট অফিস ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় শাসন অবশ্যই কাজ করবে। বৈধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কঠোর আইন কানুনের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্ষমতা নামক যন্ত্রটি অত্যাচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়। যেখানে নিয়োগকর্তা হিসেবে শুধু রাষ্ট্রই রয়েছে ভদ্রতা সেখানে অর্থনৈতিক উধ্বতনের প্রথম ও প্রধান রীতি। যেখানে একই অফিসিয়াল দল গোপন গ্রেফতার ও শাস্তি, ভোটাধিকার হরণ, রেশন, নিবাস ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে শুধু তাদের সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয় মূর্খ ও শহীদত্বের বিকৃত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি।

চরম স্বৈরাচারী শাসনের অশুভ প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যদি রাষ্ট্রের মতো একক সংগঠনের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্ৰায়ন না হয়ে থাকে তবে ওই সংগঠনের ভেতরে ক্ষমতার ব্যাপক বিস্তৃতি আবশ্যক এবং অধীন দলগুলোর ব্যাপক হারে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করা উচিত। গণতন্ত্র বিকেন্দ্রীকরণ ও আইনবহির্ভূত শাস্তি থেকে নিরাপদ না হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার একীভূতকরণ নতুন এক প্রকার আতঙ্কজনক নির্যাতন অস্ত্র বই কিছুই নয়। রাশিয়ায় যৌথ খামারে একজন উৎপাদনকারী কৃষক যে কোনো অনুপাতে শস্য গ্রহণ করলে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়। যখন দুর্ভিক্ষের ফলে ক্ষুধা ও তৎসমেত রোগে লাখ লাখ কৃষক মারা যায় তখন এই আইন গঠন করা হয় এবং সরকার এর নিরসনে বিরত থাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই।

(৩) ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে এখন আমি সংক্ষিপ্ত প্রচারণার শর্তে আসছি। এটা স্পষ্ট যে উৎপীড়নের প্রচার অবশ্যই হবে; আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা স্পষ্ট না হলে স্বাধীনতার আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আন্দোলনে; পদ্ধতি থাকতে হবে। ক্ষমতা অপব্যবহারকারী অফিসিয়ালদের অভিযুক্ত করার। বর্তমান সরকার এর স্থায়িত্ব নিরাপদ করতে পারবে না ভয় দেখানোর মাধ্যমে ভোটারদের মিথ্যা তালিকাভুক্তি এবং এ রকম কাজের মাধ্যমে। বিখ্যাত মানুষের যুক্তিনির্ভর সমালোচনার জন্য কোনোরকম শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বর্তমানকালে দলীয় সরকার এর অনেক কিছুই করেছে। ফলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর হিংসাত্মক সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয়েছে। পরিণতিস্বরূপ তাদের পক্ষে অনেক অপরাধই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষমতায় রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে ঐগুলোর গুরুত্ব আরও অনেক বেড়ে যায়। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত মহিলাদের কথা একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যাক। তাদের দুঃখ এ জন্য যে বর্তমানকালে তাদের বেতন পুরুষের তুলনায় কম। তারা বৈধ পন্থায় তাদের দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন। এজন্য নিরাপদ হবে না শাস্তি দেয়া। এ রকম মনে করার কোনো যুক্তি নেই যে সমাজতন্ত্র করলে সাথে সাথে বর্তমান অসমতা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে ত্বরিত ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনের উপায় বন্ধ হয়ে যাবে। খবরের কাগজ এবং ছাপাখানা সরকারের অধীন থাকবে এবং শুধু সরকারি নির্দেশ অনুযায়ীই খবর ছাপাবে। সরকারি নীতির সমালোচনামূলক কোনো খবর ছাপাবে বলে কি মনে হয়? যদি না হয় তবে কোনো উপায় থাকবে না খবরের কাগজের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের। পাবলিক হলগুলো সরকারের অধীন হওয়ার ফলে জনসভা অনুষ্ঠান সহজ নয়। পরিণামে দুঃখ প্রকাশের কোনো পথই থাকবে না রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিধানে তুরিত উদ্দেশ্য সংবলিত সতর্ক ব্যবস্থার অভাবে। একবার সরকার নির্বাচিত হলে হিটলারের মতো অমিত শক্তির অধিকারী হয়ে পড়ে এবং মেয়াদ শেষে সহজেই ব্যবস্থা করতে পারে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার। এক বিশেষ অবস্থায় গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে। কিন্তু তা অধিক বাস্তবতা অর্জন করতে পারে না জনপ্রিয় সরকারের চেয়ে, যা স্থায়িত্ব লাভ করেছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীন।

আগেকার সব স্বৈরাচারী ক্ষমতায় অশুভ বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে বিস্ময়করভাবে দায়িত্বহীন ক্ষমতার মুক্তি আশা করা শুধু বালসুলভ শিশুমালা মনোবিজ্ঞান : ভালো প্রিন্স কর্তৃক দুষ্ট প্রিন্স বিতাড়িত এবং সবই ভালো। কোনো একজন প্রিন্স বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কারণ এই নয় যে তিনি ভালো এবং এজন্যে যে খারাপ হওয়া তার স্বার্থের প্রতিকূলে। এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে অনুপকারী করে তুলতে হবে ক্ষমতাকে। কিন্তু অনুপকারী করা যায় না একজন ভালো মানুষকে দায়িত্বহীন উৎপীড়কে পরিণত করে।

ডববিসি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বুঝে নেয়া যেতে পারে সরকারের একচেটিয়া অধিকারের সঙ্গে প্রচারণায় স্বাধীনতা মিলনের সম্ভাব্যতা। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তা নিরপেক্ষ থাকতে পারে না সাধারণ ধর্মঘটের সময়; কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় তা গুরুত্বসহকারে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রয়োজন সভা-সমিতির জন্য হল ভাড়া এবং বিতর্কিত সাহিত্য ছাপার জন্য অনুরূপ নিরপেক্ষ ব্যবস্থার। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যঞ্জনায় বিভিন্ন পত্রিকার পরিবর্তে একটি পত্রিকাই কাম্য। পত্রিকার ভিন্ন ভিন্ন। পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকবে ভিন্ন ভিন্ন দলের জন্য। এর সুবিধা এই যে, সব মতামতই দেখতে পাবে পাঠকরা। বর্তমানে যেসব পাঠক পত্রিকায় নিজেদের মতামতের বিরুদ্ধে কিছুই দেখতে পায় না তাদের চেয়ে কম পক্ষপাত দুষ্ট হবে ওই পত্রিকার পাঠকরা।

সমতা জরুরি নয় শিল্প, বিজ্ঞান এবং দলীয় রাজনীতির মতো বিষয়গুলোতে। এগুলো বৈধ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। এসব বিষয়ের উপর মতপার্থক্য মেনে নেয়া জরুরি। সহনশীল মনোভাব সৃষ্টি করা প্রয়োজন গণতন্ত্রের সফলতা এবং স্থায়িত্বের জন্য; এটি আমাদের নিয়ে আসবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি। বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মনোগত শর্তগুলো কঠিন। আমরা ক্ষমতার মনোগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখেছি ভয়, রোষ এবং উত্তেজনা মানুষকে বাধ্য করে নেতার অনুসরণে। অনেক ক্ষেত্রেই যিনি তাদের আস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন উৎপীড়ক হিসেবে। সুতরাং গণতন্ত্রের সংরক্ষণ করতে হলে এড়াতে হবে সমবেত উত্তেজনার জন্ম দেয় এমন পরিস্থিতি এবং জনগণের মনে এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যেন অনুরূপ মনোভাব গড়ে না ওঠে। যে সমাজে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ মতবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সেখানে জনগণের পছন্দ নয় এমন মতামত শান্তি ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলছাত্ররা খারাপ আচরণ করে বেমানান মতামত পোষণকারী কোনো ছেলের প্রতি। স্কুলছাত্রের মানসিক বয়সসীমা অতিক্রম করতে পারেননি অনেক বয়স্ক মানুষ। সংশয়বাদের রঙে রঞ্জিত বিকীর্ণ উদারনৈতিক মনোভাব সামাজিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অসুবিধা অনেকটা কমিয়ে দেয় এবং অনুরূপভাবে বৃদ্ধি করে স্বাধীনতার সম্ভাবনা।

অনেকের মনে পুনঃভ্যুদ্বয়জনিত উৎসাহ দ্বারা সঞ্চারিত শক্তি ও আপাত আত্মোৎসর্গের ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। ইতিহাসে এমন যৌথ উত্তেজনা অসাধারণ নয় যে এর ফলে ব্যথা ও মৃত্যুর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে উত্তেজিত মানুষ। এর অস্তিত্বের জন্য স্বাধীনতা অসম্ভব। শুধু শক্তিবলে প্রতিহত করা যায় উৎসাহী ব্যক্তিদের। কিন্তু যদি তাদের প্রতিহত করা না যায় তবে তারা অন্যদের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করবে। আমার মনে পড়ে ১৯২০ সালে আমি পিকিংয়ে এক বলশেভিকের সাক্ষাৎ পাই যে কক্ষের ভেতর অগ্র-পশ্চাৎ হাঁটছিল এবং বলছিল, If we do not kill zem, Zey will kill us.ঃ অবশ্য এই মনোভাব এক পক্ষে জন্ম নিলে অন্য পক্ষের মনেও জন্ম হয় একই রকম মনোভাবের। পরিণামে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সূচনা হয়, যেখানে সব কিছুই বিজয়ের অধীন। যুদ্ধকালীন সামরিক কারণে সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জন করে। বিজয় অর্জিতহলে সরকার তার ক্ষমতা প্রথমে শত্রুর অবিশিষ্টাংশ ধ্বংস করার কাজে এবং পরে তার সমর্থকদের উপর ক্ষমতা স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। উৎসাহী মানুষ যে কারণে যুদ্ধ করেছিল ফলাফল ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতিউৎসাহের ফলে কিছু কিছু অর্জিত হলেও আশানুরূপ ফল লাভ করা যায় না। বুদ্ধিজাত নয় যৌথ উৎসাহের প্রশংসা, তা বহন করে দায়িত্বহীনতার পরিচয়। কারণ বর্বরতা, যুদ্ধ, মৃত্যু ও দাসত্ব এর ফলাফল।

যুদ্ধ হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ। দায়িত্বহীন ক্ষমতা এড়িয়ে চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা যুদ্ধ। তাই আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য যুদ্ধ প্রতিহত করা। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবী থেকে যুদ্ধভীতি দূর করতে পারলে সময়মত শাসকদের হিংস্রতা প্রতিহত করার পথ বেরিয়ে আসত। কিন্তু সব যুদ্ধই বিশেষত আধুনিক যুদ্ধ ভীরু ব্যক্তিদেরকে নেতার অন্বেষণে বাধ্য করে এবং সাহসী ব্যক্তিদের সম্মুখবর্তী করে দেয়। এভাবে সুগম হয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথ।

যুদ্ধভীতি জন্ম দেয় বিশেষ ধরনের গণমনোবিজ্ঞানের। আবার এই গণমনোবিজ্ঞান যুদ্ধের ঝুঁকি ও স্বৈরাচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। সুতরাং আমাদের এমন শিক্ষার প্রয়োজন যার ফলে গণহিস্টরিয়ার দিকে সমাজের ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে চলে আসে এবং সম্ভব হয় গণতন্ত্রের সফল অনুশীলন।

এর দুটো গুণের বিস্তৃতির জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের সফলতার। প্রথম দৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয় এ দুয়ের প্রবণতা। কিন্তু মানুষ অবশ্যই কিছুটা স্বনির্ভর হবে এবং নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করবে। বিপরীতমুখী রাজনৈতিক প্রচারণা থাকবে বহুলোকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের সিদ্ধান্ত অবশ্যই মেনে নিতে হবে। এই শর্তগুলোর যে কোনোটি ব্যর্থ হলে জনগণ অতিমাত্রায় অধীনতাপরায়ণ হয়ে একনায়কত্বের পথ সুগম করে দিতে পারে কোনো শক্তিশালী নেতাকে অনুসরণ করে। অথবা অতিশয় আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে জাতিকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিতে পারে প্রত্যেক দলই।

এ বিষয়ে দুটো শিরোনামে শিক্ষার কার্যকারিতা আলোচিত হতে পারে; প্রথমত আবেগ ও বৈশিষ্ট্যসাপেক্ষ; দ্বিতীয়ত শিক্ষাদানসাপেক্ষ। আরম্ভ করা যাক পূর্বোক্তটি দিয়েই।

জনসাধারণকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ও ধ্বংস থেকে মুক্ত হতে হবে কার্যকরি গণতন্ত্রের জন্য। তাদেরকে হতে হবে ভয় ও অধীনতামুক্ত। এসব অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু আমি আলোচনা করব যেসব অনুভূতি সৃষ্টিতে শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে ওইগুলো।

ছেলেমেয়েদের পরিপূর্ণ বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কিছু স্কুল ও কিছু পিতামাতা প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এই প্রচেষ্টা দাস অথবা বিদ্রোহী সৃষ্টি করতে বাধ্য। এর কোনোটিই কাম্য নয় গণতন্ত্রে। কঠোর শৃঙ্খলাভিত্তিক শিক্ষার পরিণতি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ইউরোপের সব একনায়কের অনুরূপ। যুদ্ধের পর ইউরোপের প্রায় সব দেশেই গড়ে ওঠে কিছু সংখ্যক মুক্ত স্কুল। ওইসব স্কুলে অস্তিত্ব নেই কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসমেত সব সামরিক স্বৈরতন্ত্র স্কুলের স্বাধীনতা হরণ করে এবং পুরনো কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় ফিরে যা। এভাবে শিক্ষকদের দেখতে শুরু করে ক্ষুদ্রে ফুয়েরার বা ডুচ হিসেবে। আমরা ধরে নিতে পারি যে, সব একনায়কই স্কুলের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে মনে করে। তারা আরও মনে করে যে, রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের ভূমিকা স্বরূপ স্কুলের স্বৈরতন্ত্র।

দাস বা বিদ্রোহী হওয়া উচিত নয় গণতন্ত্রের প্রতিটি পুরুষ বা নারী কারোই। তারা প্রত্যেকই নাগরিক অর্থাৎ এমন একজন মানুষ যিনি নিজে যেমন মানসিকতা পোষণ করেন অন্যকেও একই মানসিকতা পোষণ করার সুযোগ দান করেন। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই যেখানে সেখানে সরকার অবতীর্ণ হন প্রভুর ভূমিকায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে সবার ভেতর সহযোগিতা বিদ্যমান। প্রত্যেকেই এখানে নিজের মতামতের গুরুত্ব আরোপ করে বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত, কিন্তু তার চেয়ে বেশি নয়।

এর ফলে আমরা গণতন্ত্রীদের কাছে পৌঁছে যাই নীতি নামক একটি অসুবিধার উৎসের কাছাকাছি। অনেকেই সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি, আত্মত্যাগ ইত্যাদির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত বলে থাকেন। অল্প মাত্রার মনোসমীক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হবে যে, এই সুন্দর সুন্দর শব্দ দ্বারা যা বোঝা যায় প্রকৃত ব্যাপার এর থেকে ভিন্ন। আদর্শবাদের মহান রূপে মূর্ত হয়ে উঠেছে অহংকার, ঘৃণা অথবা প্রতিশোধস্পৃহা। একজন যুদ্ধবাজ দেশপ্রেমিক দেশের জন্য যুদ্ধ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারেন বটে, কিন্তু তিনি নরহত্যায় বিশেষ আনন্দ পেলে তাকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই সন্দেহ করা যেতে পারে। ওই বিশেষ ধরনের আদর্শবাদী দেশপ্রেম বা শ্রেণি সগ্রামের মনোবৃত্তি জন্ম নেবে না শিশুকালে কৃপাপ্রাপ্ত সুখি ও যৌবনে বিশ্বের বন্ধুত্বপ্রাপ্ত সদাশয় জনগণের ভেতর। আমি মনে। করি নিষ্ঠুর প্রকৃতির আদর্শবাদের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় বাল্য অশান্তির মাধ্যমে। তবে তা প্রশমিত হতে পারে আবেগপ্রবণ প্রাথমিক শিক্ষার দ্বারা। অতি-উৎসাহ আংশিক আবেগ এবং আংশিক বুদ্ধির সমন্বয়ে গঠিত একটি ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা। একে প্রতিহত করতে হবে মানুষের সদাশয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ার সহায়ক সুখ ও বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রয়োজনীয় বৃদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে।

বাস্তব জীবনে গণতান্ত্রিক সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় মনোভাব বুদ্ধিবৃত্তির জীবনে বিজ্ঞানসম্মত মনোভাবেরই অনুরূপ। এটি ধর্মীয় মতবাদ ও সংশয়বাদের মধ্যবর্তী আশ্রয়স্থল স্বরূপ। এর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বলা যায় যে, সত্য যেমন পুরোপুরিভাবে অর্জন করা যায় না, তেমনি তা অনার্জিতও নয়; শুধু তা অর্জন করা সম্ভব কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত।

স্বৈরাচারের আধুনিকরূপ সবসময় সম্পর্কযুক্ত ধর্মের সঙ্গে। এক্ষেত্রে দেয়া যায় হিটলার, মুসোলিনি ও স্ট্যালিনের স্বৈরাচারীর উদাহরণ। যে সমাজে স্বৈরাচার রয়েছে সেখানে স্বকীয়তাবোধ সৃষ্টির আগেই যুবকদের মনে এক শ্রেণির বিশ্বাস সঞ্চার করা হয়। এই বিশ্বাসগুলো শিক্ষা দেয়া হয় অবিরত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

এই শিক্ষার প্রভাব এমনই যে, আংশকা করা যায় ছাত্ররা পরবর্তী জীবনে কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না এর ঐন্দ্রজালিক প্রভাব থেকে। এগুলো সঞ্চার করা হয় প্রমাণের মাধ্যমে নয় বরং যুক্তির দ্বারা তোতা পাখির মতো বারংবার পুনরানুষ্ঠানের মাধ্যমে, গণহিস্টরিয়া ও গণসম্মোহনের মাধ্যমে। এমন উপায়ে দুটো ধর্মমত শিক্ষা দেয়ার ফলে দু-দল সৈন্যের সৃষ্টি হয়, যার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, কিন্তু আলোচনা করতে পারে না। সম্মোহিত প্রত্যেকটি ব্যক্তিই মনে করে যে, তার পক্ষের বিজয়ই পবিত্রতম অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আতঙ্কজনক সব কিছুই অপর পক্ষের সৃষ্টি। সংসদে বসে এইসব বিরোধী উন্মাদরা চলতে পারে না চলো দেখি অধিকাংশের মতামত কোন পক্ষে। প্রত্যেক দলই বলে মনে করে পবিত্র উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছে। তাই তারা মাত্রাধিক নীরস। একনায়কত্ব এড়াতে হলে এই ধরনের ধর্মীয় মতবাদ অবশ্যই রদ করা প্রয়োজন এবং শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত রদকরণ প্রক্রিয়া।

শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে থাকলে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সব দিকের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বাকপটু সমর্থকদের বক্তব্য বিবিসির মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিগোচর করতাম। শিক্ষকদের উচিত ছেলেমেয়েদের আমন্ত্রণ জানানো ব্যবহৃত যুক্তিগুলোর সংক্ষিপ্তসার উঘাটনে এবং ভদ্রভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে সমর্থন লাভ করা যে, যুক্তির সঙ্গে বাকপটুতা ব্যস্ত আনুপাতিক। নাগরিকদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্রেরর বাকপটুতা থেকে মুক্তি অর্জন করা।

আধুনিক প্রচারকরা অন্ধ বিশ্বাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে পটু ব্যক্তিদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। শিক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত অশিক্ষত মানুষের বিশ্বাসপ্রবণতা ও অবিশ্বাস প্রবণতা ব্যাহত করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ যুক্তিহীন জোরালো বক্তব্যে বিশ্বাস ও যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বল বক্তব্যে অবিশ্বাস প্রবণতা ব্যাহত করা প্রয়োজন। শিশু স্কুল দিয়ে শুরু করি আমি, যেখানে শিশুরা চেষ্টা করবে দুটি বিকল্প মিষ্টির ভেতর উত্তমটি বেছে নেয়ার একটি অতি ভালো এবং উপাদান সম্পর্কিত যথাযথ বর্ণনার দ্বারা অনুমোদিত; অপরটি অপরিচ্ছন্ন, কিন্তু দক্ষ ঘোষকের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রশংসিত। পরে ছুটি কাটানোর জন্য দুটো জায়গার ভেতর উত্তমটি বেছে নেয়ার জন্য বলি : কন্টোর মানচিত্রে বর্ণিত একটি ভালো জায়গা এবং অপরটি সুন্দর পোস্টারে বর্ণিত একটি বিশ্রী জায়গা।

এই আঙ্গিকে হওয়া উচিত ইতিহাসের শিক্ষাদান। অতীতে প্রসিদ্ধ বাগ্মী বক্তা ও লেখকরা বিষয়গুলোর সমর্থন দিতেন যাদুকরের বাস্তবতা ও দাসত্বের উপকারিতার মতো। আমি যুবকদের বলব এই বাগ্মী বক্তাদের জেনে নিতে এবং তাদের ভ্রমাত্মক অগ্রযাত্রা বুঝে নিতে। তারপর ক্রমে আমি প্রবৃত্ত হব বর্তমান সমস্যাগুলো আলোচনায়। এই পর্যায়ে আমি তাদের প্রথমে ডেইলি মেইল ও পরে ডেইলি ওয়ার্কার পত্রিকায় স্পেন সম্পর্কে কি বলা হয়েছে তা পড়ে শুনাব। তারপর তাদের প্রকৃত ঘটনা জেনে নিতে বলব। কারণ গণতান্ত্রিক জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো পত্রিকায় প্রচারিত মিথ্যাচার সম্পর্কে জেনে নেয়া। এই উদ্দেশ্যে পরামর্শ দেয়া যায় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পত্রিকাগুলোর সঙ্গে পরবর্তীকালে লিখিত ইতিহাসের তুলনা করে দেখার জন্য। সহজেই বোধগম্য হবে যুদ্ধকালীন পত্রিকাগুলোতে দৃষ্ট যুদ্ধোন্মাদনার সৃষ্টির প্রয়াস। তাই আপনারা কর্তব্য হবে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়া যে, যদি তারা ভারসাম্যপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ বিচার করতে ব্যর্থ হয় তবে প্রথম স্পর্শেই তারা পতিত হবে সরকারের সৃষ্ট অনুরূপ ভীতিপ্রদ ও রক্তপিপাসু উন্মাদনায়।

যা হোক, আমার সম্পূর্ণ বিরাগ মনোভাব প্রচারের উদ্দেশ্য নেই; আমার পরামর্শ এই নয় যে, ধ্বংসাত্মক বিশ্লেষণের অধীনে আনতে হবে সব তীব্র অনুভূতিই। সামগ্রিক উত্তেজনার ভিত্তিমূল ওইসব আবেগের সাপেক্ষে আমি এই মনোভাব সমর্থন করছি কারণ সামগ্রিক হিস্টরিয়াই যুদ্ধ ও একনায়কত্বের সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু প্রজ্ঞা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিই নয়। বুদ্ধিবৃত্তি পথনির্দেশ দিতে পারে, কিন্তু কোনো কিছু বাস্তবায়নের প্রেরণা যোগাতে পারে না। অবশ্যই আবেগ থেকে জন্ম লাভ করবে প্রেরণা। সামাজিক পরিণতিজনিত আবেগ সহজে জন্ম দেয় না ঘৃণা ও ভয়ের। এগুলোর সৃষ্টি অনেকাংশেই নির্ভর করে মানুষের শৈশবকাল ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। সু-আবেগ সৃষ্টির উপযোগী উপাদান যোগানো ও উৎকৃষ্ট মানবজীবন গঠনের সহায়ক উপলব্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু করা যেতে পারে।

অনুরূপ উদ্দেশ্য ছিল অতীত ধর্মের। যা হোক, চার্চগুলোর অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে সমস্যা সৃষ্টি করে এগুলোর ধর্মীয় মতবাদ। যাদের কাছে গতানুগতিক ধর্মের মূল্য নেই তাদের জন্য অন্য পথ খোলা রয়েছে। তাদের প্রয়োজন মিটাতে পারে কিছু কবিতা ও কিছু সঙ্গীত। কিছু লোকের বেলা জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুরূপ উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক। আমরা যখন বিশ্বব্রহ্মান্ডের আকার ও এর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ভাবি তখন গুরুত্বহীন গ্রহের উপর বিতর্ক হয়ে যায় এবং হাস্যকর মনে হয় বিতর্কটি। যখন আমরা নেতিবাচক আবেগতাড়িত হয়ে মুক্তি লাভ করি তখন আমরা ইতিহাস অথবা বিজ্ঞান, সুন্দর অথবা বেদনা, সঙ্গীত অথবা কবিতার মাধ্যমে আরও পরিপূর্ণরূপে বুঝতে সক্ষম হই যে, মানবজীবনের মূল্যবান জিনিসগুলো ব্যক্তিগত-যুদ্ধক্ষেত্র, রাজনৈতিক সংঘাত ও আরোপিত লক্ষ্যের দিকে গণঅগ্রযাত্রায় ঘটিত জিনিসের অনুরূপ নয়। প্রয়োজন সম্প্রদায়ের ভেতর সংঘটিত জীবনযাপন। মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়গুলো মহান ধর্মীয় শিক্ষকদের কথিত বিষয়গুলোর অনুরূপ। সংঘবদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ব্যক্তিরা বলে থাকেন যে, আমাদের উচ্চমান কাজগুলো অর্জন করা সম্ভব যৌথ প্রচেষ্টায়। আমি বলি যে, আমরা সবাই অগ্রসর হই ওই লক্ষ্যগুলো অর্জনে ভিন্ন ভিন্ন পথে। কিন্তু আবেগপ্রবণ একতাবদ্ধ জনগণ সক্ষম শুধু নিম্নমান কাজ।

তা-ই বিদ্যমান পার্থক্য উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সর্বধ্বংসী দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর। এ কথা পূর্বোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মনে করা হয় যে ব্যক্তি মানুষের মঙ্গলসাধনই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কল্যাণের ভিত্তিমূল। কিন্তু শেষোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কল্যাণই চরম লক্ষ্য, জনগণ এর অপরিহার্য উপাদানমাত্র। ব্যক্তিগত কল্যাণ সামগ্রিক কল্যাণের অধীন হবে, কিন্তু ব্যক্তিগত কল্যাণ শাসকদের স্বার্থের পরিপন্থি। রাষ্ট্রীয় উপাসনা মতবাদের ধারক ছিল প্রাচীন রোম, কিন্তু খ্রিস্টবাদ ম্রাটের পাশে দাঁড়ায় এবং পরিনামে জয়ী হয়। জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে উদারনৈতিক মতবাদ। কিছু খ্রিস্টপূর্ব মতবাদ এর বিরোধী ছিল। প্রথম থেকেই শিক্ষাকে সফলতার উপায় মনে করত রাষ্ট্রীয় উপাসকরা। জার্মান জাতির উদ্দেশ্যে ফিকটের ভাষণ শিক্ষা সম্পৰ্কীয় বিস্তারিত বর্ণনা। নিচে উল্লিখিত উক্তিতে ফিকট যা আশা করেন তা দেয়া হলো :

কেউ যদি বলতে পারত কিভাবে একজন মানুষ ভালো কিছু আশা করতে পারেন শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্রদের জন্য সঠিক পথপ্রদর্শনের চেয়ে এবং তার জন্য করতে পারেন জোর অনুমোদন। ছাত্ররা তা অনুসরণ করবে কি না সেইটা তাদের ব্যাপার। ছাত্রদের ইচ্ছার স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না কোনো শিক্ষাই। আমি যে শিক্ষা সম্পর্কে ভাবছি, এর বৈশিষ্ট্য নিরূপণের জন্য আমার বলা উচিত যে, স্বাধীনতা ইচ্ছার স্বীকৃতি এবং এর উপর নির্ভরশীলতার মধ্যেই এর নিষ্ক্রিয়তা ও শূন্যতা স্পষ্ট এবং এতে নিহিত আছে এ পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান ত্রুটিগুলোর প্রথমটি। কারণ স্বাধীন ইচ্ছার অর্থ হলো ভালো ও মন্দের ভেতর সিদ্ধান্তহীনভাবে দোদুল্যমানতা। সুতরাং তা নিতে অপারগ সঠিক সিদ্ধান্ত। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা তাই পুরোপুরিভাবে বিলুপ্তি ঘটিয়েছে ইচ্ছার।

ভালো মানুষ তৈরি করার জন্য তার আকাঙ্ক্ষার কারণ এই নয় যে, তারা আপনা থেকে খারাপ মানুষগুলোর চেয়ে ভালো; তার কারণ এই যে, জার্মান জাতি টিকে থাকতে পারে শুধু ভালো মানুষগুলো নিয়েই। কিন্তু জার্মান রাষ্ট্র খারাপ মানুষগুলোর মাধ্যমে বিদেশি শক্তিগুলোর সঙ্গে মিশে যাবে স্বাভাবিকভাবে।

উদারনৈতিক শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত তত্ত্ব এর সবই। স্বাধীন ইচ্ছার বিলুপ্তির পরিবর্তে তিনি লক্ষ্য স্থির করবেন ব্যক্তিগত বিচার-বুদ্ধি শক্তিশালী করার জন্য। জ্ঞান অন্বেষণের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করবেন বিজ্ঞানসম্মত মনোভাব। তিনি চেষ্টা করবেন বাস্তবভিত্তিক বিশ্বাস সৃষ্টির। তিনি ছাত্রদের সম্মুখে এমন কিছু করবেন না যার ফলে মনে হবে যে তিনি ক্ষমতা অর্জন করতে চান সর্বজ্ঞ অথবা পরম মঙ্গল সাধনের লক্ষ্যেই। রাজনীতিকের মতো শিক্ষাবিদের প্রধান বিপদ হচ্ছে ক্ষমতামোহ। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ব্যক্তি যত্নশীল হবেন ছাত্রদের প্রতি। ফিকট ও তার আদর্শের উত্তরাধিকারীরা মনে করেন, আমি নিজ সুবিধায় এখানকার বিষয়গুলো কাজে লাগাতে পারি, আমি তাদের যন্ত্রসুলভ আচরণে পরামর্শ দিতে পারি আমার উদ্দেশ্যের উন্নতি বিধানকল্পে। এ মুহূর্তে আমি দমিত হতে পারি জীবনের আনন্দ, খেলাধুলার তাড়না, স্বতঃস্ফূর্ততা, উদ্দেশ্যমূলক জীবনযাপনের আকাক্ষার দ্বারা। কিন্তু এ সবই অকার্যকর হয়ে পড়বে কয়েক বছরের স্কুল জীবনের পর। কল্পনা, শিল্প ও চিন্তাশক্তির ধ্বংস হয়ে যাবে অধীনতার ফলে। উন্মাদনা জন্ম নেবে আনন্দানুভূতি ধ্বংস হলে। পরিশেষে আমি দেখতে পাব যে, খনিজ, কয়লা বা অট্টালিকায় ব্যবহৃত পাথরের মতোই নিষ্প্রাণ আমার মানব সম্পদ। যে যুদ্ধে আমি তাদের পরিচালনা করব তাতে কেউ মারা যাবে আবার কেউ থাকবে বেঁচে। যারা মারা যাবে তারা বীরের মতোই আনন্দচিত্তে মারা যাবে, কিন্তু যারা বাঁচবে তারা থাকবে আমার দাস হয়ে। স্বাভাবিক স্নেহবৎসল মানুষের কাছে এগুলো ভয়ংকর। মোটরগাড়ির নিচে চাপা পড়া থেকে সমভাবে জরুরি বাঁচার মতোই উন্মাদনার আঁতাকলে পিষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে থাকা। এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজন মুক্তচিন্তায় উৎসাহ প্রদান। এই মুক্তিচিন্তা কিছুটা সংশয়াপন্ন, কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত হবে। এটাই উদারনৈতিক শিক্ষার কাজ : আধিপত্য নয় বরং মূল্যায়নের অনুভূতি প্রদান, মানুষের সামর্থ্য সৃষ্টি করতে হবে মুক্ত সমাজের জন্য জ্ঞানী নাগরিক সৃষ্টিতে সহায়তাদান এবং নাগরিকত্বের সঙ্গে স্বাধীনতার সমন্বয়ে মানবজীবনে উৎকর্ষতা অর্জনে। খুব কম মানুষই এই উৎকর্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *