১৭. ক্ষমতার নীতি

ক্ষমতার নীতি

আমরা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অশুভ ব্যাপারগুলো নিয়ে পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে এতই নিমগ্ন ছিলাম যে, একটা তপস্বীরূপ উপসংহার টানা এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভালো জীবনযাপনের জন্য অপরাপর ব্যক্তিদের প্রভাবিত করার সব প্রচেষ্টা পরিহারে উৎসাহ দান করা স্বাভাবিক বলে মনে হয়। লাওসির সময় থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা বাগী ও বিচক্ষণ ছিলেন। অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী অনেকেই শান্তিবাদী ও ব্যক্তিগত পবিত্রতায় মূল্যদানকারী ব্যক্তিরা মনে করেছেন যে তা কার্যকারিতা নয়, বরং মানসিক অবস্থা। আমি এই মানুষের সঙ্গে একমত হতে পারি না, যদিও আমি স্বীকার করি যে তাদের কেউ কেউ পরোপকারী ছিলেন। তারা এ ধরনের ছিলেন কারণ, যদিও তারা বিশ্বাস করতেন যে তারা ক্ষমতা পরিহার করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুধু বিশেষরূপেই তা পরিহার করতে পেরেছিলেন; যদি তারা পুরোপুরিভাবে তা পরিহার করতে পারতেন তবে তাদের মতবাদের ঘোষণা দিতে পারতেন না এবং পরোপকারী হতেন না। তারা দমনমূলক ক্ষমতা পরিহার করেছিলেন বটে, কিন্তু পরিত্যাগ করতে পারেনি যুক্তি-পরামর্শের উপর নির্ভরশীল ক্ষমতা।

ব্যাপক অর্থে ক্ষমতাপ্রীতি হচ্ছে মানুষ অথবা অন্যান্য জাতি নিয়ে গঠিত বহির্বিশ্বে অভিপ্রেত ফলাফল সৃষ্টির সামর্থ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা মানব প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ এবং একজন কর্মচঞ্চল মানুষের ভেতর তা গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক। তাৎক্ষণিকভাবে চরিতার্থ করা না গেলেও প্রত্যেক আকাঙ্ক্ষাই একে চরিতার্থ করা না গেলেও প্রত্যেক আকাঙ্ক্ষাই একে চরিতার্থ করার সামর্থ্যলাভের জন্য সহায়ক আকাক্ষার জন্ম দেয়। তাই তা এক প্রকার ক্ষমতাপ্রীতি। তা যেমন সবচেয়ে ভালো আকাক্ষার বেলায় সত্য তেমনি সবচেয়ে খারাপ আকাক্ষার বেলায়ও সত্য। যদি আপনি আপনার প্রতিবেশিকে ভালোবাসেন, আপনি তাদের সুখি করার জন্য ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা পোষণ করেন। তাই ক্ষমতাপ্রীতির সার্বিক নিন্দাবাদ প্রকারান্তরে আপনার প্রতিবেশিকে ভালোবাসারই নিন্দাবাদ।

যা হোক, উপায়মূলক ক্ষমতা ও উদ্দেশ্যমূলক ক্ষমতার ভেতর পার্থক্য বিস্তর। উপায়মূলক ক্ষমতার আশাবাদী ব্যক্তি প্রথমত অন্য কিছু আশা করেন এবং পরে এমন বিশ্বাসে উপনীত হন যে তিনি যেন তা অর্জন করতে সমর্থ। উদ্দেশ্যমূলক ক্ষমতার আশাবাদী ব্যক্তি তা অর্জনের সম্ভাব্যতার দ্বারা তার উদ্দেশ্য ঠিক করে নেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজনীতিতে কোনো মানুষ বিশেষ কার্যক্রম বিধিবদ্ধ দেখতে চান এবং এভাবে তিনি সরকারি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। অপরদিকে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যে আশাবাদী ব্যক্তি এমন কার্যক্রম হাতে নেন যা তাকে পৌঁছে দেয় ঈপ্সিত লক্ষ্যে।

এই পার্থক্যের ব্যাখ্যা রয়েছে নির্জন স্থানে ক্রিস্টের তৃতীয় পরীক্ষায়। তিনি নেমে এলে এবং পূজা করলে পৃথিবীর সব কটা রাজ্যই অর্পণ করা হবে। অর্থাৎ বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে; কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অর্পণ করার জন্য নয়। এই পরীক্ষা এমন যে স্পষ্টভাবে হোক বা অস্পষ্টভাবে হোক প্রায় প্রতিটি মানুষই এর অধীন। সমাজতন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি রক্ষণশীল পত্রিকার কোনো পদ গ্রহণ করতে পারেন–তুলনামূলকভাবে এটিই হচ্ছে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্র অর্জনে তিনি নিরাশ হতে পারেন এবং সাম্যবাদী হয়ে যেতে পারেন। এর কারণ এই নয় যে, তিনি যা চান তা এই পথে অর্জন করা যাবে। তবে তিনি যা চান এর কিছু কিছু এই পথে অর্জন করা সম্ভব। তিনি যা চান বিফলতার সঙ্গে তার সমর্থন, তিনি যা চান না সফলতার সঙ্গে তার সমর্থন অপেক্ষা অধিক তুচ্ছ বলে মনে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত সফলতা ভিন্ন অন্য কিছুর প্রভাব জোরালো ও সুনির্দিষ্ট হলে ওইসব প্রভাব মেটানো না গেলে তার ক্ষমতানুভূতিতে কোনোরূপ আত্মতুষ্টি আসবে না। সফলতার জন্য উদ্দেশ্যের পরিবর্তন তার কাছে স্বধর্ম ত্যাগের মতোই, যা বর্ণিত হতে পারে শয়তানের পূজা হিসেবেই।

হিতকর ক্ষমতাপ্রীতি অবশ্যই ক্ষমতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে। আমি বলছি না যে ক্ষমতাপ্রীতি এর নিজের জন্য অবশ্যই হবে না, কারণ সক্রিয় বৃত্তির কোনো এক পর্যায়ে তা নিশ্চিতভাবেই আবির্ভূত হবে। আমি বলছি যে অন্য উদ্দেশ্যের সহায়ক না হলে তা অপূর্ণ থেকে যায়।

এটাই যথেষ্ট নয় যে, ক্ষমতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য থাকা উচিত; উদ্দেশ্য এমন হবে যে তা অর্জিত হলে লোকের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সাহায্য করবে। যদি আপনি আবিষ্কার অথবা শৈল্পিক সৃষ্টি অথবা সাশ্রয়ী মেশিন আবিষ্কার অথবা এ পর্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন বিভিন্ন দলগুলোর ভেতর আপস মীমাংসার লক্ষ্য স্থির করেন তবে আপনি সফল হলে তা আপনার পাশাপাশি অন্য লোকের আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপায় হয়ে দাঁড়াবে। দ্বিতীয় শর্তটি এই যে, উপকারী বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য ক্ষমতাপ্রীতি অবশ্যই পূর্ণতা অর্জন করবে; সাধারণভাবে বলতে গেলে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হলে প্রভাবিত ব্যক্তিদের আকাক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু উদ্দেশ্যের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কযুক্ত হবে।

তৃতীয় শর্তটির স্পষ্ট রূপদান অপেক্ষাকৃত কঠিন। আপনার উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় অবশ্যই এমন হবে না যে, ঘটনাক্রমে এর খারাপ প্রভাবগুলো অর্জিততব্য উদ্দেশ্যের শ্রেষ্ঠত্বকে অতিক্রম করে যায়। কর্ম ও ভোগের ফলস্বরূপ প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য এবং আকাক্ষা অবিরাম পরিবর্তনশীল। যারা এগুলো করে এবং যারা এগুলোর শিকার তাদের উভয়ের ক্ষেত্রে সহিংসতা ও অন্যায়ের জন্ম দেয়। পরাজয় পূর্ণ না হলে তা ক্রোধ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। অপরপক্ষে তা পূর্ণ হলে অনীহা ও নিষ্ক্রিয়তার জন্ম দেয়। যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যের প্রতি যতই ঔৎসুক্য থাকুক না কেন শক্তি বলে বিজয়লাভের ফলে নিষ্ঠুরতা ও পরাজিতদের প্রতি ঘৃণার জন্ম হয়। এসব আলোচনা থেকে যদিও এটা প্রমাণিত নয় যে, কোনো ভালো উদ্দেশ্যই শক্তি বলে অর্জন করা যায় না, তথাপি আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে শক্তি খুবই বিপজ্জনক এবং এর অতিশয় আধিক্যের ফলে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তির আগেই যে কোনো ভালো উদ্দেশ্য দৃষ্টির অগোচর হয়ে যেতে পারে।

যা হোক, শক্তি ছাড়া সভ্য সমাজের অস্তিত্ব অসম্ভব। কারণ, সমাজে অসৎ ও সমাজবিরোধী স্বার্থান্বেষী মানুষ রয়েছে যারা নিয়ন্ত্রিত না হলে শিগগিরই অরাজকতায় ও বর্বরতায় প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করে তুলবে। যেখানে শক্তি এড়ানো যাবে না সেখানে অপরাধ আইন অনুসারে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরোপিত হবে। যা হোক, এ ক্ষেত্রে দুটো অসুবিধা রয়েছে: প্রথমটি হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রে শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারের মধ্যে। কারণ এ ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ সরকার নেই, স্বীকৃত কোনো কার্যকরি আইন বা বিচার বিভাগীয় কর্তৃত্ব নেই; দ্বিতীয়টি এই যে, সরকারের হাতে শক্তি কেন্দ্রীভূত হলে সরকার সমাজের বাকি অংশের উপর স্বেচ্ছাচার চালানোর সামর্থ্যলাভ করবে। আমি পরবর্তী পরিচ্ছেদে এই অসুবিধাগুলো আলোচনা করব। এই পরিচ্ছেদে আমি ব্যক্তিগত নৈতিকতা সাপেক্ষে ক্ষমতার আলোচনা করব-সরকারের সাপেক্ষে নয়।

অভিলাসের মতো ক্ষমতাপ্রীতি এমন একটি শক্তিশালী প্রেরণা যে অধিকাংশ মানুষের কার্যকলাপের উপর এর প্রভাব তাদের অনুমিত প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং যুক্তি প্রদর্শন করা যেতে পারে যে, সবচেয়ে বেশি সুফল প্রদানকারী নীতিই ক্ষমতাপ্রীতির প্রতি যুক্তি-পরামর্শের চেয়ে বেশি শত্রুভাবাপন্ন। কারণ ক্ষমতান্বেষণের ক্ষেত্রে নিচের নীতিবিরুদ্ধ পাপের প্রতি মানুষের প্রবণতা রয়েছে। তবে বিধিগুলো কঠোর হলে তাদের কার্যকলাপ সঠিক হতে পারে। নীতিশাস্ত্রীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠাকারী খুব কমই এ ধরনের বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হবেন। কারণ প্রভাবিত হলে তিনি সদগুণের স্বার্থে সচেতনভাবে মিথ্যা ভাষণে বাধ্য হবেন। সত্যনিষ্ঠ হওয়ার চেয়ে নৈতিক উন্নয়নের আকাক্ষা প্রচারক ও শিক্ষাবিদের জন্য মৃত্যুবিশেষ এবং তত্ত্বগতভাবে এর বিরুদ্ধে যাই বলা হোক না কেন বাস্তবে তা ক্ষতিকর। আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ক্ষমতাপ্রীতির জন্যেই মানুষ খারাপ কাজ করছে এবং করে যাবে। তথাপি বলা উচিত নয় যে, ক্ষমতাপ্রীতি অনাকাক্ষিত ওইসব ক্ষেত্রেও যেখানে রয়েছে এর কল্যাণধর্মী প্রয়োগ।

বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতাপ্রীতি মানুষের মেজাজ, সুযোগ-সুবিধা ও তার দক্ষতার উপর নির্ভরশীল; অধিকন্তু মেজাজ পরিবেশ দ্বারা গঠিত হয়। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতাপ্রীতি বিশেষ খাতে চালনা করতে হলে তার জন্য সঠিক পরিবেশ, সঠিক সুযোগ-সুবিধা ও যথাযথ দক্ষতার ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে চিকিৎসা সাপেক্ষে সুপ্রজননের অন্তর্ভুক্ত জন্মগত স্বভাব প্রশ্নাতীত হয়ে পড়ে। কিন্তু শুধু অল্প সংখ্যক লোকের উপরোক্ত উপায় অবলম্বনে প্রয়োজনীয় কার্যকলাপ বেছে নেয়া যাবে না।

এবার আলোচনা করা যাক মেজাজ প্রভাবিত করার পরিবেশ নিয়ে : নিষ্ঠুর তাড়নাগুলোর উৎস অভাগা শিশুকালে অথবা গৃহযুদ্ধের মতো অভিজ্ঞতার ভেতর দৃষ্ট হয়, যেখানে যন্ত্রণা এবং মৃত্যু প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। কৈশোরে এবং যৌবনের প্রাথমিক অবস্থায় শক্তির বৈধ নির্গমনের অভাবে একই জাতীয় প্রভাব থাকতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে পান্ডিত্যপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা পেলে, সহিংসতাপূর্ণ পরিবেশে বসবাস না করলে এবং জীবন গঠনে অযৌক্তিক অসুবিধার সম্মুখীন না হলে অল্প মানুষই নিষ্ঠুর হতো। এসব শর্ত সাপেক্ষে অধিকাংশ লোকের ক্ষমতাপ্রীতি হিতকর অথবা নিদেনপক্ষে নির্দোষ নির্গমনের পথ বেছে নেয়।

ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিক রয়েছে সুযোগ প্রশ্নটির : এটা গুরুত্বপূর্ণ। যে দস্যু, রাহাজানি অথবা স্বেচ্ছাচারী জীবন গঠনের সুযোগ থাকবে না। তবে অপেক্ষাকৃত কম ধ্বংসশীল পেশার সুযোগ থাকা উচিত। পশ্চাৎপদ সমাজের চেয়ে ক্রম অগ্রসরমান সমাজে তা অনেক বেশি সহজ। সম্পদের সঙ্গে নৈতিক স্তরের কোনো সম্পর্ক নেই যে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে নৈতিক স্তরের পরিবর্তন হবে। আজকাল রাইন থেকে প্রশান্ত অঞ্চল পর্যন্ত সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির কঠোরতার প্রধান কারণ এই যে, বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে

দক্ষতার গুরুত্ব অনেক ক্ষমতাপ্রীতির স্বরূপ নির্ধারণে। সাধারণভাবে বলতে গেলে বিশেষ ধরনের আধুনিক যুদ্ধ ছাড়া ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দক্ষতার প্রয়োজন খুবই কম। কিন্তু গঠনমূলক কাজে সবসময়ই এর প্রয়োজন রয়েছে এবং উচ্চ পর্যায়ে এর প্রয়োজন অনেক বেশি। কঠিন দক্ষতা অর্জন করেছেন এমন অধিকাংশ মানুষ এর অনুশীলনে আনন্দ পান এবং সহজগুলোর চেয়ে এগুলোর অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারণ অন্যান্য দিক একই হলে এই কঠিন দক্ষতা ক্ষমতাপ্রীতির জন্য অধিকতর তৃপ্তিদায়ক। যিনি উড়োজাহাজ থেকে বোমা নিক্ষেপের কৌশল শিখেছেন তিনি শান্তির সময়ে উন্মুক্ত নীরস পেশার চেয়ে এর অধিক গুরুত্ব দেবেন। কিন্তু যিনি সংক্রামক জ্বরের চিকিৎসা শিখেছেন তিনি যুদ্ধকালীন সার্জনের কাজের চেয়ে এর গুরুত্ব বেশি দেবেন। আধুনিক যুদ্ধে বড় রকমের দক্ষতার প্রয়োজন হয় এবং তা দক্ষ মানুষের কাছে যুদ্ধকে আকর্ষণীয় করে তোলে। শান্তি ও যুদ্ধকালীন অনেক বৈজ্ঞানিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়; কোনো বৈজ্ঞানিক শান্তিবাদী ব্যক্তি এ কথার নিশ্চয়তা দিতে পারেন না যে, তার আবিষ্কার পরবর্তী যুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞ সহজতর করে তুলবে না। তা সত্ত্বেও শান্তির সময়ে এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত দক্ষতার পার্থক্য রয়েছে। এ ধরনের পার্থক্য বজায় থাকলে কোনো মানুষের ক্ষমতাপ্রীতি অর্জিত দক্ষতার ক্ষেত্র অনুযায়ী তাকে শান্তিপ্রবণ করে তুলবে অথবা তাকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করবে। এমন বলা যাবে যে, ক্ষমতাপ্রীতি কোন পথে চালিত হবে তা নির্ধারণে কৌশলগত প্রশিক্ষণের ভূমিকা অনেক।

এ কথা সর্বতোভাবে সত্য নয় যে, যুক্তি-পরামর্শ এক জিনিস এবং শক্তি প্রয়োগ অন্য জিনিস। অনেক যুক্তি-পরামর্শ প্রত্যেকে অনুমোদন করলেও ওইগুলো প্রকৃতপক্ষে একপ্রকার শক্তিপ্রয়োগ। ধরুন আমরা আমাদের সন্তানদের বেলায় কি করি? আমরা তাদের বলি না যে কিছু মানুষ মনে করে পৃথিবী গোলাকার; কিন্তু অন্যান্য মানুষ মনে করে তা চেপ্টা; তুমি যখন বড় হবে তখন পারলে তুমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তোমার সিদ্ধান্ত ঠিক করে নেবে। এর পরিবর্তে আমরা তাদের বলি পৃথিবী গোলাকার যে বয়সে আমদের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা প্রমাণের উপযুক্ত হয় সে বয়সে আমরা তাদের মুক্ত চিন্তার দ্বার বন্ধ করে দেই। ফলে পৃথিবী চেপ্টা মতবাদের পক্ষে জোরালো যুক্তি পরামর্শ কোনোরূপ আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না। নৈতিক শিক্ষার বেলাও তা প্রযোজ্য। নাকের শ্লেষা ফেলো না বা ছুরি ব্যবহার করে মটরশুটি খাবে না ইত্যাদি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি যতটুকু জানি ছুরি ব্যবহার করে মটরশুটি খাবার পেছনে প্রশংসাসূচক যুক্তি রয়েছে, কিন্তু প্রাথমিক সম্মোহক প্রভাব আমাকে পুরোপুরিভাবে অসর্মথ করে দিয়েছে এগুলোর গুণাগুণ বিচারে।

বৈধ ও অবৈধ ক্ষমতার পার্থক্য নিরূপণে ক্ষমতার নীতিবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত নয়। এই মাত্র আমরা দেখেছি যে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের যুক্তি-পরামর্শ শক্তি প্রয়োগের শামিল। প্রায় প্রত্যেকেই কায়িক প্রচন্ডতা ও এমনকি সহজবোধ্য শর্তে হত্যাও অনুমোদন করে থাকেন। ধরুন ট্রেনে গুলি চালানোর সময় আপনি মি. হকসের সম্মুখীন হলেন এবং ধরুন, শুধু তাকেই গুলি করে আপনি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তাকে প্রতিহত করতে পারতেন; অধিকাংশ শান্তিবাদী ব্যক্তিই স্বীকার করবেন যে, আপনি গুলি করে ঠিক কাজটিই করতেন। বিমূর্ত সাধারণ নীতির সাহায্যে এই প্রশ্নের বিচার তুচ্ছ; অবশ্যই এর ফলাফল দ্বারা ক্ষমতানুশীলনের বিচার করতে হবে এবং তাই আমাদের অবশ্যই স্থির করতে হবে যে আমরা কি ফলাফল আশা করতে পারি।

আমার বেলা আমি মনে করি কোনো কিছু ভালো অথবা মন্দ যাই হোক না কেন তা প্রথমে ব্যক্তি জীবনে ও পরে সমাজ জীবনে বাস্তবায়িত হয়। যৌথ রাষ্ট্রের সমর্থনদানে ব্যবহার্য কিছু দর্শন, বিশেষভাবে হেগেলের দর্শন মনে করে যে, নীতিশাস্ত্রীয় সদ্‌গুণ সম্প্রদায়েরই অংশবিশেষ এবং তা এমনই যে একটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকলেও প্রশংসিত হতে পারে। আমি মনে করি ক্ষমতাসীনদের সুযোগ-সুবিধা যুক্তিযুক্ত করে তোলার জন্য এগুলো কৌশল মাত্র। আমাদের রাজনীতি যাই হোক না কেন অগণতান্ত্রিক নীতির কোনো বৈধ যুক্তি থাকতে পারে না। অগণতান্ত্রিক নীতি বলতে আমি এমন এক নীতি বুঝি যা মানবজাতির একটা অংশকে আলাদা করে ফেলে এবং বলে, এই ভালো লোকগুলো উপভোগ করবে এবং অন্যরা তাদের সমর্থন দিয়ে যাবে। যে কোনো ক্ষেত্রে আমার উচিত এমন নীতি অগ্রাহ্য করা। কিন্তু আমরা এ ধরনের নীতির আপনা আপনি খন্ডন হয়ে যাওয়ার অসুবিধা প্রত্যক্ষ করেছি। কারণ এটা খুবই অসম্ভব যে বাস্তবে শ্রেষ্ঠ মানুষ অভিজাত তাত্ত্বিকদের কল্পিত জীবনযাপন করতে সমর্থ হবেন।

আকাক্ষার কিছু উদ্দেশ্য এমনই যে যুক্তিযুক্তভাবে সবাই তা উপভোগ করতে পারে। কিন্তু অন্যগুলো প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী সমাজের এক অংশের ভেতর আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যৌক্তিক সহযোগিতার মাধ্যমে সবাই মোটামুটিভাবে ভালো থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিবেশি মানুষের চেয়ে ধনী হওয়ার আনন্দ উপভোগ সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু মাত্রায় স্বাধিকার সবাই ভোগ করতে পারে, কিন্তু সবার পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়া অসম্ভব। হয়তো কালক্রমে জনগণ এমন হবে যে, সবাই মোটামুটিভাবে বুদ্ধি সম্পন্ন হবে কিন্তু সবার পক্ষে ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিবৃত্তির জন্য পুরস্কৃত হওয়া অসম্ভব।

বাস্তব মঙ্গল, স্বাস্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিশ্বজনীন হতে সমর্থ্য ভালো জিনিসের জন্য সামাজিক সহযোগিতা সম্ভব। কিন্তু প্রতিযোগিতায় বিজয়ের আনন্দ বিশ্বজনীন হতে পারে না। পূর্বোক্ত সুখ বন্ধুত্বপূর্ণ ও শেষোক্তটি বন্ধুত্বহীন অনুভূতির মাধ্যমে উন্নীত হতে পারে। বন্ধুত্বহীন অনুভূতির ফলে সুখের যৌক্তির অন্বেষণ সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হয়; বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা কার্যকর। কোনো জনগোষ্ঠীর ভেতর বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতি তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে বিভিন্ন ব্যক্তি বা দলের মধ্যকার স্বার্থগত কোনো সংঘাত দেখা দেবে না। আধুনিক সমাজে বিদ্যমান সংঘাতের কারণ বন্ধুত্বহীন অনুভূতি, যা পালাক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অবশেষে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দুর্ঘটনার ফলে একই রাজার অধীন হলে যুদ্ধের অবসান ঘটে। পরিণামে সবাই সুখি হয়; এমনকি ড, জনসনের Zest তাকে এত আনন্দ দেয় যে, তা ছিল যুদ্ধে বিজয়ের আনন্দের চেয়েও বেশি।

নীতি-বিজ্ঞানের ক্ষমতা বিষয়ের উপর আমরা কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।

ক্ষমতাসীনদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা একটি দলের সঙ্গে অন্য দলের নয়, বরং মানবজাতির ভেতর সহযোগিতা। বর্তমানে এই লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে বন্ধুত্বহীন অনুভূতি এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম অথবা নৈতিকতার মাধ্যমে এই অনুভূতি হ্রাস করা যেতে পারে। পরোক্ষভাবে ক্ষমতার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্পদের জন্য বিশাল জাতীয় শিল্পের মধ্যকার সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতা দূর করে তা হ্রাস করা যেতে পারে। উভয় পদ্ধতিই প্রয়োজনীয়। এগুলো পরস্পরের বিকল্প নয়, বরং পরিপূরক।

অনেকেই মহাযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর মিলিটারি এবং সরকারের ক্ষমতা ছাড়া অন্য সব ক্ষমতার কম গুরুত্ব দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। তা হচ্ছে অদুরদর্শী ও অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। সবচেয়ে ক্ষমতাবান চার ব্যক্তির মনোনয়নের ভার আমার উপর অর্পিত হলে আমি বুদ্ধ, খ্রিস্ট, পিথঅগোরাস ও গ্যালিলিওর নাম উল্লেখ করতাম। তাদের কেউ প্রচারণায় সাফল্যলাভের আগে রাষ্ট্রীয় সমর্থন পাননি। জীবিত থাকাকালে কেউই উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেননি। ক্ষমতা প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও তারা মানবজীবনকে যেভাবে প্রভাবিত করতে পারতেন, কেউই তেমন করেননি। অন্য কাউকে দাস বানানোর উদ্দেশ্যে তারা ক্ষমতা অন্বেষণ করেননি, বরং দাসমুক্তির জন্য তা করেছেন। প্রথম দুজন বিবাদ বিসম্বাদে সক্ষম ইচ্ছাশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং দাসত্ব মোচনে সক্ষম হয়েছেন। অপর দুজন প্রাকৃতিক শক্তির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে অর্জন করেন ঈপ্সিত লক্ষ্য। পরিশেষে বলা যায় যে, সহিংসতার মাধ্যমে মানুষ শাসিত হচ্ছে না, বরং মানুষ শাসিত হচ্ছে সুখ-শান্তির জন্য মানুষের সহানুভূতি সৃষ্টিতে সক্ষম ব্যক্তিদের জ্ঞানের দ্বারাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *