১১. সংগঠনের ইতিবৃত্ত

সংগঠনের ইতিবৃত্ত

এ পর্যন্ত আমরা আলোচনা করেছি ক্ষমতার মনস্তত্ত্বগত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস সম্পর্কে : প্রথা, বিশেষত যাজক বা রাজার প্রতি সম্মানরূপে, ভয় এবং ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যা নগ্ন ক্ষমতার উৎস, পুরনো বিশ্বাসের স্থলে নতুন বিশ্বাস যা বিপ্লবী ক্ষমতার উৎস এর ধর্ম বিশ্বাস ও অন্যান্য ক্ষমতার উৎসের ভেতর ঘাত-প্রতিঘাত। এখন আমরা আমাদের আলোচনার নতুন বিভাগে আসছি : ক্ষমতার চর্চার মাধ্যমে সংগঠনগুলোর আলোচনা। প্রথমত জীবনীশক্তিসম্পন্ন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে, পরে বিভিন্ন প্রকার ব্যবস্থাপনা সাপেক্ষে এবং পরিশেষে এগুলোর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের জীবনের উপর এগুলোর প্রভাব সম্পর্কে। আমাদের আলোচনার এই পর্বে সংস্থাগুলোকে যতদূর সম্ভব তাদের উদ্দেশ্য ছাড়া বিবেচনা করতে হবে, যেভাবে মানুষ বিবেচিত হয়ে থাকে অস্থিবিদ্যা ও জীব রসায়নে।

সংগঠনগুলোর ইতিবৃত্ত নামক এই পর্বে যা আলোচনা করা হবে তা নির্ভর করছে এই সত্যের উপর যে, সংগঠন হচ্ছে একটি কর্মশীল সংস্থা (Organism), যার জিন আছে এবং ক্ষয় ও বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের ভেতর প্রতিযোগিতা বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের ভেতর প্রতিযোগিতার মতোই এবং তা মোটামুটিভাবে ডারউইনের পদ্ধতির অনুরূপ দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের সাদৃশ্যে অন্যান্য জিনিসের মতো অধিক গুরুত্ব দেয়া যাবে না। তা ধারণা দিতে পারে, কিন্তু প্রদর্শিত করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ আমরা ধরে নিতে পারি না যে, সামাজিক সংগঠনগুলোতে অনিবার্য ক্ষয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের।

সামগ্রিকভাবে না হলেও ক্ষমতা প্রধানত নির্ভরশীল সংগঠনের উপর। তা টিকে থাকতে পারে প্লেটো ও গ্যালিলিওর খাঁটি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতার অনুরূপ সামাজিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াই। কিন্তু সাধারণভাবে এ ধরনের ক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না চার্চ, রাজনৈতিক দল বা অনুরূপ কোনো সামাজিক সংস্থার দ্বারা প্রচার ও প্রসার না ঘটলে। এ মুহূর্তে আমি বিবেচনার বাইরে রাখব সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কহীন ক্ষমতা।

একই লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীই সংগঠন। তা স্বেচছামূলক হতে পারে একটি ক্লাবের মতো, পরিবার বা ক্লোনের মতো তা স্বাভাবিক জৈবিক গোষ্ঠীভুক্ত হতে পারে, হতে পারে তা রাষ্ট্রের মতো বাধ্যতামূলক। সংগঠনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট বা অস্পষ্ট, চেতনাসম্পন্ন বা অচেতন হতে পারে, তা হতে পারে সামরিক বা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয়, শিক্ষা বা ক্রীড়া সংক্রান্ত। বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন প্রত্যেক সংগঠনে রয়েছে ক্ষমতার বিভাজন। অবশ্যই এর একটি সরকার থাকবে এবং তা সিদ্ধান্ত নেবে সারা সংগঠনের নামে। যে উদ্দেশ্যে সংগঠন টিকে থাকে তার সঙ্গে সঙ্গতিশীল যে কোনোভাবে এর ক্ষমতা সংগঠনের একক সদস্যের চেয়ে হয়ে থাকে বেশি। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে মানব সভ্যতার কৌশলের জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুবিধাগুলো। কিন্তু সবসময়ই কিছুটা স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় সংঘবদ্ধতার ফলে। আমরা অন্যদের উপর অর্জন করতে পারি বৈধ ক্ষমতা আবার অন্যরাও আমাদের উপর অর্জন করতে পারি বৈধ ক্ষমতা আবার অন্যরাও আমাদের উপর অর্জন করতে পারে ক্ষমতা। ক্রমাগত অধিক ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সংগঠনগুলোর-ব্যক্তি বিশেষের নয়। সদস্য সংখ্যা কম না হলেও সংগঠনের সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরি করতে হয় সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে। শিল্প-পূর্ব সমাজের চেয়ে আধুনিক সভ্য সমাজের জীবনধারায় সরকার আবশ্যিকভাবে পালন করে থাকে অনেক ভূমিকা।

বাস্তবে একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভব হলেও তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ক্ষমতার বিভাজন। যৌথ সিদ্ধান্তে প্রত্যেকের সমান ভূমিকা থাকলে এবং সদস্য সংখ্যা এক লাখ (ধরা যাক) হলে, নিঃসঙ্গ বন্য জীবের মতো অন্যের উপর মোট ক্ষমতার লক্ষতম ভাগ ক্ষমতা থাকে। তা জন্ম দেয় অরাজকতাপূর্ণ জনগোষ্ঠী মনস্তত্ত্ব থেকে ভিন্ন রকম মনস্তত্ত্বের। যেখানে সরকার পুরোপুরিভাবে গণতান্ত্রিক নয় সেখানে বৃদ্ধি পায় মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হলেও সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণকারী সদস্যের চেয়ে বেশি। একই কথা প্রযোজ্য গণতান্ত্রিক সরকারের নিযুক্ত অফিসিয়ালদের বেলা। সংগঠন যত বড় হবে নির্বাহীদের ক্ষমতা হবে তত বেশি। সুতরাং সংগঠনের পরিবৃদ্ধির প্রত্যেক ধাপে ক্ষমতার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায় অসমতা। পাশাপাশি সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব হয় ও বৃদ্ধি পায় সরকারের স্বাধীনতা। সাধারণ মানুষ তা মেনে নেয়, কারণ, একক প্রচেষ্টার চেয়ে যৌথ প্রচেষ্টায় অর্জিত হয় বেশি কিছু, ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষমতালোভী ব্যক্তিরা আনন্দ করে, কারণ, তা এনে দেয় সুযোগ। সরকার বংশগত অথবা ক্ষমতালোভী ব্যক্তিটি বিশেষ গোষ্ঠীভূক্ত হলেও দেখা দেয় ব্যতিক্রম।

দুধরনের প্রতিযোগিতা ক্ষমতালাভের: একটি আন্তঃসাংগঠনিক প্রতিযোগিতা; অন্যটি একটি সংগঠনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যকার প্রতিযোগিতা। আন্তঃসাংগঠনিক প্রতিযোগিতা শুধু তখনই দেখা যায়, যখন এগুলোর উদ্দেশ্য মোটামুটি একই অথচ বেমানান। তা হতে পারে অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রচারণা বা এর যে কোনো দুটো বা তিনটিরই সমন্বয়। তৃতীয় নেপোলিয়ান যখন সম্রাট হচ্ছিলেন তখন তার-ই স্বার্থে নিয়োজিত একটি সংগঠন সৃষ্টি ও পরে অর্জন করতে হয়েছিল এর শ্রেষ্ঠত্ব। এই উদ্দেশ্যে কিছু মানুষকে তিনি সিগার দেন-তা ছিল অর্থনৈতিক অন্যান্য মানুষের কাছে তিনি নিজেকে চাচার ভাজিতা বলে পরিচয় দেন তা ছিল প্রচারণা। পরিশেষে তিনি কিছু সংখ্যক বিরোধীকে গুলি করে হত্যা করেন–তা ছিল সামরিক। ইতিমধ্যে তার বিরোধীরা স্থির সিদ্ধান্ত নেয় গণতান্ত্রিক ধরনের সরকারের প্রশংসায় এবং নিন্দা করে সিগার ও বুলেটের। গ্রিকদের সময় থেকেই পরিচিত গণতন্ত্রের উপর একনায়কতন্ত্র অর্জনের কৌশল। সবসময়ই তাতে অন্তর্ভুক্ত ঘুষ, প্রতারণা ও হিংস্রতার একই মিশ্রণ। যাক আমাদের বর্তমান বিষয়বস্তু ঘুষ, প্রতারণা ও ও হিংস্রতার একই মিশ্রণ। যাক আমাদের বর্তমান বিষয়বস্তু এটা নয়। সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক ইতিবৃত্ত হলো আমাদের বর্তমান বিষয়বস্তু।

সংগঠনগুলো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভিন্ন হয়ে পড়ে : একটি হচ্ছে আকার; অন্যটি বলা যায় ক্ষমতার তীব্রতা, যার অর্থ আমি মনে করি সদস্যদের উপর এগুলোর নিয়ন্ত্রণে মাত্রা। সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ক্ষমতাপ্রীতির জন্যেই প্রতিটি সংগঠনে বিরোধী শক্তির অবর্তমানে রয়েছে এর আকার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা। সহজাত কারণে এ উভয় প্রকার বৃদ্ধি রদ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি আন্তর্জাতিক দাবা ক্লাব যথেষ্ট কৃতিত্বের অধিকারী সফল দাবা খেলোয়াড়দের করতে পারে অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত ক্লাব সদস্যদের দাবা খেলার সঙ্গে সম্পর্কহীন কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। একজন শক্তিমান সম্পাদকের অধীনে থেকে তা আরও অধিক সংখ্যক লোককে দাবা সচেতন করে তোলার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তা অসম্ভব হয়ে পড়বে সম্পাদক দাবাড় না হলে। এতে দাবা ক্লাব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ভালো খেলোয়াড়দের দল ত্যাগের ফলে। কিন্তু এ ধরনের বিষয় ব্যতিক্রমধর্মী। সম্পদ বা রাজনৈতিক আধিপত্য সংগঠনের উদ্দেশ্য হলে শুধু অন্যান্য সংগঠনের চাপের মাধ্যমে অথবা সংগঠনটি বিশ্বব্যাপী হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এর বৃদ্ধি ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বাধীনতা প্রীতি খুব প্রবল হলেই শুধু সম্ভব তীব্রতা ঠেকানো।

রাষ্ট্র হচ্ছে এর সবচেয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। কোনো রাষ্ট্র রাজ্যজয়ের লক্ষ্য স্থির করে যথেষ্ট শক্তিশালী হলে। কিন্তু যদি অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারে যে এর প্রকৃত ক্ষমতা অনুভূত ক্ষমতা থেকে কম অথবা অনভিজ্ঞতাবশত অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর (এর প্রকৃত ক্ষমতার চেয়ে) বলে বিশ্বাস করে তাহলে সে বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখায়। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, কোনো রাষ্ট্র পারলে জয় করে নেয় রাজ্য। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে শুধু সমান শক্তিশালী অন্য রাষ্ট্রের মোকাবেলায় থেমে যায়। গ্রেট ব্রিটেন আফগানিস্তান জয় করেনি কারণ রাশিয়া সেখানে ব্রিটিশের মতোই শক্তিশালী। নেপোলিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লুসিয়ানা বিক্রি করে দেন কারণ তার পক্ষে সম্ভব ছিল না লুসিয়ানার প্রতিরক্ষা। শুধু অভ্যন্তরীণ শক্তির বিবেচনায় প্রতিটি দেশই বিশ্বব্যাপী হতে চায়। কিন্তু একটি দেশের ক্ষমতা কমবেশি ভৌগোলিক : সাধারণত এ ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে উত্থিত হয় এবং কেন্দ্র থেকে দূরত্বের সঙ্গে হ্রাস পায়। পরিণামে কেন্দ্র থেকে বিশেষ দূরত্বে এর ক্ষমতা ভারসাম্য সৃষ্টি করে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে এবং প্রথাগত শক্তির হস্তক্ষেপ না ঘটলে সেখানে গঠিত হয় সীমান্ত।

এ পর্যন্ত কথিত সব কিছুই গুণগত পরিবর্তন ছাড়া সত্যে পরিণত হওয়ার জন্য অতিশয় বিমূর্ত। ছোট রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ক্ষমতা বলে নয় বরং বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক ঈর্ষামূলক মনোবৃত্তির জন্যেই টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব। বেলজিয়াম টিকে আছে কারণ এর অস্তিত্ব সুবিধাজনক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের জন্য। পর্তুগালের অনেক উপনিবেশ রয়েছে কারণ বৃহৎ শক্তিগুলো একমত হতে পারেনি এগুলোর বিভক্তির ব্যাপারে। যুদ্ধ মারাত্মক বিধায় কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে রাজ্যাংশ বজায় রাখা কিছুকাল সম্ভব, কিন্তু তা সে হারাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রের নজরে পড়লে। এসব বিবেচনা আমাদের সাধারণ নীতির ক্ষতি করে না। এগুলো শুধু কার্যকরি শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটায়, যা বিলম্বিত করে অপরিণত শক্তিগুলোর ক্রিয়াকলাপ।

বলা যেতে পারে যে, পারলে কোনো রাষ্ট্র দখল করে নেয়–এ নীতির ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্র। এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মারাত্মক অসুবিধা সৃষ্টি হতো না মেক্সিকো এবং প্রকৃতপক্ষে লাতিন আমেরিকার সব রাষ্ট্র দখল করে নেয়ার কার্যক্রম হাতে নিলে। যা হোক রাজনৈতিক বিজয়ের স্বাভাবিক উদ্দেশ্য বর্তমানে বিরোধী শক্তির দ্বারা এ ক্ষেত্রে হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। গৃহযুদ্ধের আগে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর ছিল সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা। মেক্সিকোর যুদ্ধে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং বিশাল এলাকা সন্নিবেশিত হয়। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী বসতি স্থাপন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম সবচেয়ে শক্তিমান নাগরিকের কর্মশক্তি আত্তীকরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই কার্যক্রম এক প্রকার শেষ হয়ে আসতেই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেন-আমেরিকার যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের সজীব তাড়না প্রকাশ পেতে দেয়। কিন্তু আমেরিকার সংবিধানে নতুন এলাকার সন্নিবেশ অসুবিধাজনক। এর অন্তর্ভুক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন ভোটারদের অনুপ্রবেশ। তাছাড়া এর ফলে অভ্যন্তরীণ মুক্ত বাণিজ্যিক এলাকা বিস্তার লাভ করে এবং তাই তা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থের পক্ষের ক্ষতিকারক। লাতিন আমেরিকার উপর-আপাতত অভিভাবকত্ব সংবলিত মনরো মতবাদ তাই প্রভাবশালী স্বার্থের ক্ষেত্রে সন্নিবেশের চেয়ে অধিকতর সন্তোষজনক। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে রাজনৈতিক বিজয় সুবিধাজনক হলে শিগগিরই তা ঘটত।

সবসময়ই শাসকদের কাম্য ছিল রাজনৈতিক বলয়ে ক্ষমতার কেন্দ্ৰায়ন এবং সবসময় শাসিতরা এর বাধা প্রদান করেনি। আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় একনায়ক দেশের চেয়েও প্রাচীন বড় সাম্রাজ্যগুলোতে তা অধিকতর পূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু কার্যত কৌশলগতভাবে সম্ভব ক্ষেত্রগুলোতে তা সীমাবদ্ধ ছিল। যাতায়তই সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল প্রাচীন রাজপুরুষদের জন্য। মিসর ও ব্যাবিলনে বড় বড় নদীও এ সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কিন্তু পারস্য শাসন নির্ভরশীল ছিল সড়ক পথ যোগাযোগের উপর। হেরোডেটাস সার্দিন্স থেকে সোসা পর্যন্ত বৃহৎ রাজকীয় রাস্তার বর্ণনা দিয়েছে। ১৫০০ মাইল দীর্ঘ রাস্তার উপর দিয়ে শান্তির সময়ে রাজকীয় বার্তাবাহক এবং যুদ্ধকালীন সৈন্য চলাচল করত। তিনি বলেন-রাস্তার প্রকৃত বর্ণনা হচ্ছে নিম্নরূপ : পুরো রাস্তাব্যাপী রাজকীয় স্টেশন ও চমৎকার পান্থশালা বিরাজমান; রাস্তাটি আগাগোড়া জনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে এবং তাই তা বিপদমুক্ত-প্রাইজেরিয়া ত্যাগ করে হেলিস অতিক্রম করতে হয়; ফটক রয়েছে, এগুলোর মধ্য দিয়ে জনস্রোত অতিক্রমের আগে আপনাকে অবশ্যই নিতে হবে অনুমতি (ছাড়পত্র)। একটি শক্তিশালী বাহিনী এই স্থান পাহারা দিয়ে থাকে। … সিসিলিয়া ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত হচ্ছে ইউফ্রেটিস নদী। তাই পার হতে হয় নৌকাযোগে। আর্মেনিয়াতে পনেরোটি বিশ্রামের স্থান রয়েছে। এর দুরত্ব ৫৬.প্যারাসংস (প্রায় ১৮০ মাইল)। এক জায়গায় পাহারারত আছে একজন দেহরক্ষী। চারটি বড় নদী এই জেলাকে ছেদ করেছে, এর প্রতিটি পার হতে হয় নৌকাযোগে…. পুরো স্টেশনের সংখ্যা উন্নীত হয়েছে ১১১টিতে, প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্রামস্থল সার্দিস ও সোসার মধ্যবর্তী দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ ফার্লং গতিতে চললে (প্রায় সৈনিকদের গতি সমান) ভ্রমণ সম্পন্ন করতে সঠিকভাবে লেগে যায় নব্বই দিন।

এ ধরনের রাস্তা যদিও সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্ভব করে তুলেছিল তারপরও তা রাজাকে সামর্থ্য যোগায়নি দূরবর্তী প্রদেশগুলো পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। একুজন ঘোড়সওয়ার বার্তাবাহক এক মাসে সার্দিস থেকে সোসাতে সংবাদ নিয়ে আসত, কিন্তু সার্দিস থেকে সোসাতে যেতে সৈন্যদের লেগে যেত তিন মাস। যখন আওনিয়া পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল তখন এশিয়া মাইনরে ইতিমধ্যে কোনো সৈন্য না থাকায় বিদ্রোহের মোকাবেলা করতে তাদের লেগে যায় কয়েক মাস। সব সাম্রাজ্য প্রায়ই প্রাদেশিক গভর্নদের দ্বারা পরিচালিত বিদ্রোহ দেখেছে; এমনকি প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ না হলে সবে মাত্র বিজয় ছাড়া স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রায় অনিবার্য ছিল এবং কালক্রমে তা সমর্থ ছিল স্বাধীনতার রূপলাভে। প্রাচীন কোনো বড় রাষ্ট্রই বর্তমান যুগের মতো একই মাত্রায় কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো না। এর প্রধান কারণই ছিল দ্রুত চলাচলের সুবিধার অভাব।

মেসিডোনিয়াবাসীদের মাধ্যমে রোমানরা পারসিকদের কাছ থেকে শিখেছিলেন কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বারা শক্তিশালী করা যায় কেন্দ্রীয় সরকারকে। রাজকীয় বার্তাবাহক পুরো পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়াব্যাপী দিনরাত ঘন্টায় ভ্রমণ করতে পারত গড়ে দশ মাইল। কিন্তু প্রতিটি প্রদেশেই রাজকীয় পদ সামরিক কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যিনি তাদের সৈন্যদলের অগ্রগমন পথে কেউ নেই এমন কিছু না জেনেই পরিচালনা করতে পারতেন সৈন্য। সৈন্যদের ক্ষিপ্রগতি ও সংবাদ প্রেরণে ধীরগতি প্রায়ই রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ইতালি আক্রমণের জন্য গোলের উত্তর থেকে কনস্টেন্টাইনের অভিযান সম্পর্কিত গিবনের বর্নণা কনস্টেন্টাইনের আরামপ্রদ ও হেনিবলের কষ্টসাধ্য গমনের ভেতর প্রদর্শন করে স্পষ্ট পার্থক্য।

গোল থেকে ইতালি অভিযানকালে হেনিবল পর্বতের উপর নিয়ে বর্বর জনপদের মধ্য দিয়ে প্রথমে একটি রাস্তা আবিষ্কার করেন ও পরে তা খুলে দিতে ব্যর্থ হন। বর্বররা এর আগে কখনও নিয়মিত সৈন্য চলাচলের জন্য এ ধরনের রাস্তা মেনে নেয়নি। আল্পস পর্বতমালা তখন প্রকৃতিগতভাবেই শক্তি প্রদত্ত। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যেসব জেনারেল পথের জন্য চেষ্টা করেছিলেন তারা হঠাত্র অসুবিধায় পড়েন বা বাধার সম্মুখীন হন। কনস্টেন্টাইনের যুগে সভ্য ও বাধ্য ছিল পাহাড়ি কৃষকরা। দেশে প্রচুর সম্পদ মজুদ ছিল এবং রোমানরা বহু জনপথ আল্পস পর্বতমালার উপর দিয়ে নিয়ে যায় যা যোগাযোগ স্থাপন করে গোল ও ইতালির ভেতর। কনস্টেন্টাইন কটিয়ান আল্পসের রাস্তাটি (যা বর্তমানে সেনিস পর্বতমালা) অধিক গুরুত্ব দিতে এবং এত সক্রিয় অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তার সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন যে, রাইনের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে তার প্রস্থান সম্পর্কে সেক্রেনসিয়াম কোর্টে (রোমে) কোনো কিছু বোধগম্য হওয়ার আগে তিনি প্রবেশ করেন পিডমন্টের সমতল ভূমিতে।

ফলাফল দাঁড়াল এই যে, মেক্সেনসিয়াস পরাজিত হন এবং ধর্মের মর্যাদা লাভ করে ক্রিশ্চিয়ানিটি রাষ্ট্র। যদি রোমানদের রাস্তাঘাট অধিকতর শোচনীয় না হতো এবং সংবাদ প্রেরণের ত্বরিত ব্যবস্থা থাকত তবে ভিন্নরূপে আবির্ভূত হতো বিশ্ব ইতিহাস।

দূরবর্তী স্থানগুলোতে সরকারি ক্ষমতার ব্যবহার সম্ভব করে তোলে বাষ্পচালিত জাহাজ, রেলপথ ও সর্বশেষে উড়োজাহাজ। সাহারা অথবা মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ হলে আজকাল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা দমন করা যায়। কিন্তু একশো বছর আগেও সৈন্য পাঠাতে কয়েক মাস সময় লেগে যেত এবং তা খুব কষ্টকর হতো বেলুচিস্তানে আলেকজান্ডারের সৈন্যদের মতো তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ থেকেও।

সংবাদ প্রেরণও মানুষ ও দ্রব্যসামগ্রীর ত্বরিত চলাচল ব্যবস্থার মতো সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮১২ সালের যুদ্ধের শান্তি স্থাপন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পর নিউ ওলিন্স যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যদিও পরস্পরবিরোধী কোনো পক্ষই জানত না প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে। সপ্ত বর্ষের যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সৈন্যরা কিউবা বা ফিলিপাইন দখল করে নেয়, কিন্তু শান্তি চুক্তিতে সই করার আগ পর্যন্ত ইউরোপে তা জানা ছিল না। টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের আগে শান্তি কালীন দূতদের ও যুদ্ধকালীন জেনারেলদের অনেক স্বাধীনতা ছিল, কারণ নির্দেশগুলো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রতিফলিত হতো না। দূরবর্তী সরকার তাদের প্রতিনিধিদের প্রায়ই নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভর করে কাজ করার জন্য আহ্বান করত এবং এভাবেই কেন্দ্র নির্দেশিত মামুলি নীতিমালার প্রেরকের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ যে সংবাদ মানুষের চেয়েও দ্রুততর। একশো বছর আগেও সংবাদ দ্রুততর ছিল না ঘোড়ার চেয়ে। অপরাধের সংবাদ প্রকাশের আগেই পার্শ্ববর্তী শহরে পালাতে পারত একজন ডাকাত। আজকাল সংবাদ প্রথমেই পৌঁছে বলে পলায়ন অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের সময় সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সব আদান-প্রদানের দ্রুত উপায়গুলো। ফলে বেড়ে যায় তাদের ক্ষমতা।

আধুনিক কলাকৌশল শুধু সংবাদ আদান-প্রদানের দ্রুততার মাধ্যমেই নয় বরং রেল, টেলিগ্রাফ, মোটর ট্রাফিক এবং সরকারি প্রচারণার দ্বারাও বিশাল সাম্রাজ্যগুলোকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল করে তুলেছে। বিদ্রোহ সহজ করার জন্য প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক শাসন এবং রোমান প্রকনসুলের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সাম্রাজ্য। এটিলা ও চেঙ্গিস খাঁর সাম্রাজ্যগুলো ক্ষণস্থায়ী ছিল এবং ইউরোপীয় জাতিগুলো নতুন জগতে তাদের দখল হারাল। কিন্তু বাহ্যিক আক্রমণ ছাড়া অধিকাংশ সাম্রাজ্যই আধুনিক সুবাদে মোটামুটি নিরাপদ। বিপ্লব দেখা দিতে পারে শুধু যুদ্ধে পরাজিত হলেই।

সর্বতোভাবে এ কথা বলা যাবে না যে, দূরবর্তী এলাকাগুলোতে ক্ষমতার ব্যবহার সহজ হয়ে কলাকৌশলের উন্নতির ফলে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো লাভ করেছে বিপরীত ফল। হেনিবলের সৈন্যরা যোগাযোগ ছাড়াই বহু বছর বেঁচে ছিল। অপরপক্ষ আজকাল বিশাল সৈন্যবাহিনী অনুরূপ পরিবেশে দুই অথবা তিন দিনের বেশি টিকে থাকতে পারে না। পালের জাহাজের উপর নির্ভরশীল নৌকাবাহিনী চলাচল ছিল বিশ্বব্যাপী, এখন তাদের ঘন ঘন জ্বালানি নিতে হয় বলে কোনো কেন্দ্র থেকে তারা বেশি দূর যেতে পারে না। নেলসনের সময় ব্রিটিশরা সমুদ্রে কোথাও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে তা বলবৎ হতো সর্বত্রই। অধুনা নিজস্ব জলসীমায় তাদের আধিপত্য থাকলেও দুরপ্রাচ্যে তারা দুর্বল ও বাল্টিক সাগরে প্রবেশাধিকার নেই তাদের।

সাধারণভাবে বলা যায় যে, আজকাল কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী স্থানগুলোতে ক্ষমতা প্রয়োগ করা অধিকতর সহজ। এর ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতা বেড়ে যায় এবং বিজয় অধিকতর নিরঙ্কুশ হয়, কারণ দক্ষতার কোনোরূপ ক্ষতি হয় না আয়তন বৃদ্ধির ফলে। একটি বিশ্বরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কোনো মারাত্মক যুদ্ধে বিজয়ী ব্যক্তি অথবা নিরপেক্ষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তির দ্বারা।

ক্ষমতার তীব্রতা ও সংগঠনের শক্তি সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো জটিল ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি জনপদে গঠিত রাষ্ট্র আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি কর্মতৎপর। এর হাত রয়েছে রাশিয়া, জার্মানি ও ইতালিতে প্রায় সব মানবীয় বিষয়ে। মানুষের ক্ষমতাপ্রীতি রয়েছে, কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ক্ষমতার মোহে বেশি আচ্ছন্ন অন্যান্য মানুষের চেয়ে। ফলে আশা করা যায় যে, যিনি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে পেয়েছেন তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে বৃদ্ধি করবেন তার অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ। জোরালো যুক্তি রয়েছে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ জোরদার করার পেছনে। সুতরাং সাধারণ নাগরিকের নীরব সমর্থন থাকবে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে সরকারের ইচ্ছার প্রতি। যা হোক কিছু স্বাধীনতাপ্রীতিও থাকবে নাগরিকদের ভেতর। এক পর্যায়ে এই স্বাধীনতাপ্রীতি এত প্রবল হবে যে, তা অস্থায়ীভাবে হলেও আরও অধিক বৃদ্ধি হতে দেবে না সংগঠনের শক্তি। পরিণামে সংগঠনের শক্তি একটি বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছলে জনসাধারণের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেলে স্বাধীনতা প্রীতি প্রবল হবে আবার সংগঠন হ্রাস পেলে প্রবল হবে অফিসিয়াল ক্ষমতাপ্রীতি।

স্বাধীনতাপ্রীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাহ্যিক হস্তক্ষেপের অবাস্তব বিরোধী নয় বরং নিষিদ্ধকরণ, বাধ্যতামূলক সৈন্যদলে নিযুক্তি, ধর্মীয় আনুগত্য ইত্যাদির মতো একপ্রকার সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরোধী। কখনও কখনও এ ধরনের অনুভূতি দমিত হতে পারে ক্রমাগত প্রচারণা ও শিক্ষার দ্বারা। এর ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়ে স্বাধীনতাপ্রীতি। অনেক শক্তিই আধুনিক সম্প্রদায়গুলোর ভেতর সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন–স্কুল, সংবাদপত্র, ড্রিল ইত্যাদি। একই প্রভাব রয়েছে জনসংখ্যার ঘনত্বেরও। স্বাধীনতাপ্রীতি ও ক্ষমতাপ্রীতির মধ্যকার অস্থায়ী ভারসাম্য তাই আধুনিক অবস্থায় ক্রমাগতভাবে ক্ষমতার দিকে সরে পড়ে। এইভাবে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় ও প্রশস্ত হয় এর সফলতার পথ। শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রীতি কতটুকু হ্রাস করা সম্ভব বর্তমানে তা জ্ঞাত নয়। বিদ্রোহের উদ্রেক না করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা ক্রমাগতভাবে কতটুকু বাড়ানো যেতে পারে বলা অসম্ভব। কিন্তু এ রকম সন্দেহের কারণ নেই যে, বর্তমান যুগে তা অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে স্বৈরশাসনের চেয়ে।

এ পর্যন্ত আমাদের আলোচিত সংগঠনগুলোর মতো রাষ্ট্র ছাড়া সব সংগঠনই একই প্রকার আইনের অধীন, শুধু ব্যতিক্রম এই যে, এগুলো প্রয়োগ করতে পারে না শক্তি। আমি আলোচনার বাইরে রাখছি ক্ষমতা তাড়নার অবদানে অক্ষম ক্লাবের অনুরূপ সংগঠনগুলোকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক দল, চার্চ এবং ব্যবসায় কর্পোরেশনগুলো। লক্ষ্য অর্জনে যত কম সফল হোক না কেন বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করতে চায় অধিকাংশ চার্চই। অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সদস্যদের কিছু গুরুত্ববহ অভ্যন্তরীণ বিষয়। যেমন-বিবাহ ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা। সম্ভাব্যতা প্রমাণিত হলে চার্চগুলো রাষ্ট্রীয় কাজে জোরপূর্বক হস্তক্ষেপ করে। তিব্বতে পিটারসের পিতৃত্বে এবং কিছু মাত্রায় সংস্কার আন্দোলন পর্যন্ত পুরো পশ্চিম ইউরোপে তা ঘটেছে। কিছু ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও চার্চের ক্ষমতা তাড়না সীমিত হয়ে পড়েছে শুধু সুযোগ-সুবিধার অভাবে এবং ভিন্নমত বা অনৈক্যরূপে বিদ্রোহের ভয়ে। যা হোক অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদ তাদের ক্ষমতা খর্ব করে দিয়েছে এবং আগেকার ধর্মীয় তাড়নাগুলো রাষ্ট্রীয় তাড়নায় পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় শক্তি হ্রাস পায় এবং জাতীয় রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি পায় জাতীয়তাবাদের ফলে।

রাজনৈতিক দলগুলো অতি সাম্প্রতিককালেও অতি ঠিলেঢালা সংগঠন ছিল এবং অতি অল্প চেষ্টাই করেছে সদস্যদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী সংসদ সদস্যরা প্রায়ই দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে তাদের ভোটাধিকার। ফলে দলীয় বিভক্তির পূর্বাভাস বর্তমানের চেয়ে বেশি অনিশ্চিত ছিল। ওয়ালপল নর্থ এবং পিট একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত তাদের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করতেন দুর্নীতির মাধ্যমে। দুর্নীতি হ্রাসের পরও রাজনীতি অভিজাত নিয়ন্ত্রিত ছিল। ফলে সরকার ও দলীয় নেতাদের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কোনো পথ ছিল না। আজকাল বিশেষত শ্রমিক দলের সদস্যরা ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং প্রতিজ্ঞা বিফল হলে সাধারণত তাদের রাজনৈতিক মৃত্যু ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। দাবি করা হয় দুধরনের আনুগত্য : কর্মসূচিতে মতামত ঘোষণায় এবং নেতাদের প্রতি দৈনন্দিন কার্যকলাপে। নামমাত্র গণতান্ত্রিক উপায়ে কর্মসূচি স্থির হলেও কিছু সংখ্যক তোষামোদকারীর দ্বারা তা খুব বেশি প্রভাবিত হয়। সংসদ বা সরকারি কার্যকলাপে কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে কি-না স্থির করার দায়িত্ব নেতাদের উপর পরিত্যক্ত। তারা এমন না করার সিদ্ধান্ত নিলে বিশ্বাসভঙ্গের সমর্থনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা অনুসারীদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু বিবৃতিতে এ ধরনের কিছু অস্বীকার করা হয়। এই পদ্ধতির ফলেই ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ সমর্থন লাভ। এগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়াই নেতারা ওকালতি করেছেন সরকারের পক্ষে।

ওইদিকে সব রাজনৈতিক দলেল সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরও এখনও তা কমিউনিস্ট, ফ্যাসিস্ট ও নাজিদের তুলনায় অপরিমিতভাবে কম গণতান্ত্রিক দলগুলোতে। ঐতিহাসিক ও মনোগত দিক দিয়ে শেষোক্তগুলো গোপন সংস্থার বিকাশ-রাজনৈতিক দলের নয়। স্বেচ্ছাচারী সরকারের অধীন যেসব মানুষ মৌলিক পরিবর্তন চায় তারা গোপনীয়তার দিকে ধাবিত হয় এবং যখন তারা একত্রিত হয় তখন বিশ্বাসঘাতকতার ভয় তাদের কঠোর শৃঙ্খলার দিকে পরিচালিত করে। গুপ্তচর-মুক্ত বিশেষ নিরাপদ জীবন পদ্ধতিই স্বাভাবিক। ঝুঁকি, গোপনীয়তা, বর্তমান দুঃখভোগ এবং ভবিষ্যৎ বিজয়ের আশা এক প্রকার ধর্মীয় আনন্দানুভূতি এবং যাদের মধ্যে এই ভাব সহজেই উদিত হয় শুধু তারাই আকর্ষিত হয়ে থাকে। একটি বিপ্লবী গোপন সংস্থার লক্ষ্য অরাজকতা হলেও এর ভেতর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যকলাপের ঊর্ধ্বে বহু বিস্তৃত পরিদর্শন সংবলিত একটি কঠোর স্বৈরাচারী শাসনের সম্ভাবনা দেখা যায়। নেপোলিয়ানের মৃত্যুর পর ইতালি গোপন সংস্থার পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে, যেগুলোর প্রতি কিছু মানুষ আকর্ষিত হয় বিপ্লবী তত্ত্বের দ্বারা ও অন্যান্য মানুষ অপরাধমূলক কাজের দ্বারা। রাশিয়ায় একই ব্যাপার ঘটে সন্ত্রাসবাদের সাথে সাথে। রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা ও ইতালিতে ফ্যাসিস্টরা গোপন সংস্থার মানসিকতায় গভীরভাবে উচ্ছ্বসিত ছিল এবং এগুলোর উপর নির্ভর করে রচিত হয় নাজিদের কাঠামো। তাদের কিছু নেতা সরকার গঠন করলে তারা দল পরিচালনার একই যুক্তি সাহায্যে রাষ্ট্র শাসন করে। বিশ্বব্যাপী তাদের অনুসারীদের ভেতর অধীনতামূলক আপেক্ষিক স্পিরিট কাম্য।

অর্থনৈতিক সংগঠন আকারে বৃদ্ধি পেলে জন্ম দেয় ক্ষমতার গতিবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির। এ বিষয়ের উপর তিনি যা বলেছেন তার অনেকটাই পরিণত হয়েছে সত্যে। কিন্তু এগুলো ক্ষমতা তাড়নার অবদানে সক্ষম সব সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য-অর্থ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেই নয় শুধু। উৎপাদনের এই প্রবণতা ট্রাস্টের জন্ম দেয় যা বৃহৎ রাষ্ট্র এবং এর উপরাষ্ট্রের সঙ্গে সমভাবে বিস্তৃত; কিন্তু কদাচই অস্ত্র কারখানা ছাড়া বিশ্বব্যাপী ট্রাস্ট গঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। টারিফ ও কলোনিগুলো রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী করে তুলেছে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। অথনৈতিক পরিমন্ডলে বৈদেশিক বিজয় ট্রাস্টভুক্ত রাষ্ট্রের জাতীয় সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র ছাড়া আজকাল তা আর পুরনো পদ্ধতির খাঁটি ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার দ্বারা পরিচালিত নয়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে ইতালি ও জার্মানিতে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আরও গভীর এবং স্পষ্ট। কিন্তু এ কথা মনে করা ভুল হবে যে, ফ্যাসিবাদের অধীন বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ড, ফ্রান্স অথবা আমেরিকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে রাষ্ট্রকে অধিক নিয়ন্ত্রণ করে। অপরপক্ষে ইতালি ও জার্মানিতে বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অন্য সব কিছুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিস্ট ভীতির ব্যবহার করছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ইতালিতে বাধ্যতামূলক মূলধন সংগ্রহের সূচনা হচ্ছে, কিন্তু পক্ষান্তরে ব্রিটিশ শ্রমিক দল কর্তৃক একই জাতীয় অপেক্ষাকৃত মৃদু প্রস্তাব জন্ম দেয় পুঁজিপতিদের হৈচৈয়ের এবং সফল হয় পুরোপুরিভাবে।

এর শক্তি আগের যে কোনো একটি অথবা একত্রে উভয়টি শক্তির চেয়ে বেশি হয়ে তাকে মানানসই ভিন্ন উদ্দেশ্যের দুটো সংগঠন একত্রীভূত হলে। যুদ্ধের আগে মহান উত্তরাঞ্চলীয় লন্ডন থেকে ইয়র্ক, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়রা ইয়র্ক থেকে নিউকেসল এবং উত্তর অঞ্চলে ব্রিটিশরা নিউকেসল থেকে এডিনবার্গ গিয়েছেন। আজকাল LNER-রা সব দিকে যায় এবং স্পষ্টত তিনটি কোম্পানির চেয়ে শক্তিশালী। অনুরূপভাবে একটি ইস্পাত কারখানা খনিজ নিষ্কাশন থেকে শুরু করে জাহাজ নির্মাণ পর্যন্ত একই কর্পোরেশন কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ হওয়া সুবিধাজনক। এই কারণে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে একত্রীকরণের। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই তা সত্য নয়। এ পদ্ধতির যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন রাষ্ট্র অন্য সব সংগঠনকে আত্তীকৃত করে ফেলে। সংগঠন বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সংগঠন হলে একই ধরনের প্রবণতা কালের প্রবাহে এক সময় বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পরিচালিত হবে। যদি বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সংগঠন হলে একই ধরনের প্রবণতা কালের প্রবাহে এক সময় বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পরিচালিত হবে। যদি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পদ, স্বাস্থ্য, বুদ্ধিমত্তা অথবা নাগরিকদের সুখ অর্জন হয় তবে তা অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু হবে না। তবে এগুলোকে জাতীয় ক্ষমতার চেয়ে মনে করা হয় কম গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের ভেতর সংঘাত দেখা দেয় এবং একত্রীকরণের পরিণাম ভালো হয় না। পরিণামে একটি বিশ্বরাষ্ট্র শুধু সম্ভব যদি একটি জাতীয় রাষ্ট্র পুরো পৃথিবী জয় করে অথবা জাতীয়তাবাদের গন্ডি অতিক্রম করে একটি ধর্মমত বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে।

জাতীয়তাবোধের জন্য রাষ্ট্রীয় পরিবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে দলীয় রাজনীতি বা ধর্মে দৃষ্ট সীমাবদ্ধতার মতোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। আমি এই পরিচ্ছেদে উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত জীবনপ্রাপ্ত সংগঠনগুলোর আলোচনা করব। এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি যে, তা সম্ভব বিশেষ সীমা পর্যন্ত। আলোচনা প্রয়োজন এই সীমানার বাইরে আবেগ-উচ্ছ্বাসে সংগঠনের যে আবদেন রয়েছে তার।

বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ব্যক্তি বিশেষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে প্রতিটি শ্রেণিই হচ্ছে অনুভূতির এবং কিছু সংখ্যক মনোবিজ্ঞানী একে অভিহিত করেছেন অনুভূতি আশ্রিত অভিমত নামে। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনুরাগের পর্যায়ে রয়েছে দেশপ্রেম, পরিবারপ্রেম, ক্ষমতাপ্রীতি, উপভোগপ্রীতি এবং আরও কিছু। আবার বিরাগ মনোভাবের পর্যায়ে রয়েছে বেদনাপ্রীতি, বিদেশিদের প্রতি ঘৃণা ইত্যাদি। কোনো এক বিশেষ সময়ের একটি মানুষের আবেগ মিশ্রিত অনুভূতি হচ্ছে তার স্বভাব, তার বিগত ইতিহাস এবং বর্তমান পরিবেশের জটিল সৃষ্টি। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাক পারিবারিক অনুভূতি। তা গৃহায়ন, শিক্ষা বা জীবন বীমার মতো যেসব বিষয়ে বিভিন্ন পরিবারের সিল রয়েছে ওই সব বিষয়ের জন্য সংগঠন সৃষ্টি করেছে। বর্তমানের চেয়ে বেশি পরিমাণে অতীতে তা জন্ম দিয়েছে অনেকগুলো পরিবারের স্বার্থরক্ষার জন্য বিশেষ পরিবারের। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় মন্টেগু ও ক্যাপুলেট স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠনের। এমন একটি সংগঠন হলো রাজবংশোদ্ভূত রাষ্ট্র। অভিজাত সরকার হচ্ছে বিশেষ পরিবারগুলোর সমন্বয়ে গঠিত, যা সমাজের অবশিষ্টাংশের স্বার্থের বিনিময়ে সমন্বয়কারী পরিবারগুলোর সুবিধাদির উদ্দেশ্যে গঠিত। এ ধরনের সংগঠন সবসময়ই কমবেশি পরিবারগুলোর সুবিধাদির সংবলিত। বিরাগ অনুভূতিগুলো হচ্ছে ভয়, ঘৃণা, অবমাননা ইত্যাদি। এ ধরনের অনুভূতি তীব্রভাবে অনুভূত হলে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সংগঠনের পরিবৃদ্ধির সাথে।

এই সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্মতত্ত্ব। খ্রিস্টীয় যুগের প্রথম দিকে কয়েক শতাব্দী ছাড়া অন্য কোনো সময়েই ইহুদিদের উদ্দেশ্য ছিল না। জেন্টাইলদের ধর্মান্তরিত করার। তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতির দ্বারা সন্তুষ্ট ছিল। জাপান অবশিষ্ট দুনিয়ার আগে সৃষ্টি হয়েছিল–সিন্টের এই শিক্ষা জাপানি ছাড়া কারো অনুভূতিতে নাড়া দেবে এমন আশা করা যায় না। প্রত্যেকেই এই গল্প জানে যে, ওল্ড লিকট স্বর্গে উপস্থিত হয়ে অন্য মানুষের উপস্থিতি আবিষ্কারে বাধাপ্রাপ্ত হন, কারণ ভয় ছিল যে এতে নষ্ট হবে তাদের স্বর্গীয় সুখভোগ। একই ধরনের অনুভূতি নিতে পারে আরও অশুভ রূপ। অত্যাচারীদের কাছে অত্যাচার এত আনন্দের নয় যে, ভিন্ন মতাবলম্বী শূন্য পৃথিবী তার কাছে অসহনীয় হবে। অনুরূপভাবে হিটলার ও মুসোলিনি যেহেতু মনে করেন যে, যুদ্ধ মানবীয় কার্যাবলির ভেতর সবচেয়ে মহৎ কাজ সুতরাং পুরো পৃথিবী জয়ের পর যুদ্ধ করার মতো কোনো শত্রু অবশিষ্ট না থাকলে তারা সুখি হতে পারবে না। দলীয় রাজনীতিতে একটি দলের প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হলে তা দাঁড়ায় নিরানন্দের কারণ হয়ে।

যে সংগঠন এভাবে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি এর আবেদন, গর্ব, হিংসা, ঘৃণা, : অবমাননা অথবা প্রতিযোগিতায় আনন্দের মধ্য থেকে পেয়ে থাকে তা বিশ্বব্যাপী হয়ে পড়লে পূর্ণ করতে পারে না এর উদ্দেশ্য। যে বিশ্বে এ ধরনের ভাবাবেগ খুব বেশি শক্তিশালী সেখানে কোনো সংগঠন বিশ্বব্যাপী হয়ে পড়লে তা নিশ্চিতভাবে ভেঙে পড়বে চালিকাশক্তির অভাবে।

এ পর্যন্ত আমরা যা আলোচনা করেছি তাতে দেখা যাবে যে নেতৃত্বের চেয়ে আমরা সংগঠনের সাধারণ সদস্যদের অনুভূতি নিয়েই আলোচনা করেছি বেশি। যাই হোক না কেন সংগঠনের উদ্দেশ্য, এর নেতৃত্ব ক্ষমতা থেকে তৃপ্তি পেয়ে থাকে। তাই তাদের স্বার্থ হয় না সাধারণ সদস্যদের স্বার্থের মতো। তাই নেতৃত্বের ভেতর বিশ্বজয়ের আকাক্ষা যতটা প্রবল ততটা নয় সদস্যদের ভেতর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *