০৯. জনমত সংগঠনের ক্ষমতার প্রভাব

জনমত সংগঠনের ক্ষমতার প্রভাব

এমন দৃষ্টিভঙ্গির সহায়ক যুক্তি খুঁজে বের করা সহজ যে, মতামতই সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং অন্যসব ক্ষমতা এ থেকেই উদ্ভুত। সৈন্যরা অকেজো হয়ে পড়ে যুদ্ধের যৌক্তিকতা সম্পর্কে যুদ্ধরত সৈন্যদের আস্থার অভাব হলে অথবা ভাড়াটে সৈন্যদের বেলা বিজয়লাভে সেনাপতির যোগ্যতায় আস্থা না থাকলে। আইন অর্থহীন হয়ে পড়ে সমাজে সাধারণ স্বীকৃতির অভাব হলে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভরশীল আইনের প্রতি শ্রদ্ধার উপর। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, জালিয়াতির বিরুদ্ধে নাগরিকদের আপত্তি না থাকলে ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে কি ঘটত? প্রায়ই রাষ্ট্রের চেয়ে ধর্মীয় মতামত বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত। কোনো দেশের অধিকাংশ জনগণ সমাজতন্ত্রের পক্ষ অবলম্বন করলে সে দেশে ধনতন্ত্র অচল হয়ে পড়ে। এমন ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, মতামতই হচ্ছে সামাজিক কার্যকলাপে সর্বোচ্চ ক্ষমতা।

কিন্তু মতামত গঠনকারী কারণগুলো অবহেলিত হলে অর্ধেকে এসে দাঁড়ায় এর সত্যতা। জনমত সামরিক শক্তির জন্য অপরিহার্য–এ কথা যেমন সত্য তেমনি সমভাবে সত্য যে সামরিক শক্তি জনমত গঠন করতে পারে। এ মুহূর্তে ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশে একটি করে ধর্ম রয়েছে যা ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে ওই দেশগুলো রাষ্ট্রধর্ম ছিল সেনাশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্যাতন ও প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করত কোনো কোনো দেশ। এ কথা মনে করা হয় যে মনোগত কারণেই মতামত গঠিত হয়। কিন্তু তা শুধু সত্য অব্যবহিত কারণের বেলা। পটভূমিতে ধর্মমতের সেবায় স্বভাবতই শক্তির ভূমিকা বিদ্যমান।

বিপরীত দিক থেকে বলা যায় যে, সূচনালগ্নে ধর্মমতের অধীন কোনো শক্তি থাকে না এবং প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোতে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হয় শুধু যুক্তি-পরামর্শের মাধ্যমে।

সুতরাং আমি সন্ধান পাই এক প্রকার ঊর্ধ্ব-নিম্নমুখী গতির : প্রথমত অল্প মানুষের দীক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে বিশুদ্ধ যুক্তি-পরামর্শের ব্যবহার, তারপর অবশিষ্ট মানুষের সঠিক প্রচারণার প্রভাবাধীন করার লক্ষ্যে শক্তি প্রয়োগ এবং পরিশেষে বৃহৎ অংশের অকৃত্রিম বিশ্বাস, যা আবারও শক্তির ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় করে দেয়। কিছু মানুষ মতামতের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায় ছাড়িয়ে যায় না, কিছু দ্বিতীয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে তারপর ব্যর্থ হয় এবং অন্যান্য মানুষ তিনটির সব কটিতে সফল হয়। বন্ধু সমাজ কখনও যুক্তি-পরামর্শের বাইরে যায়নি। অন্যান্য গির্জা অমান্যকারীরা ক্রমওয়েলের সময় অর্জন করে রাষ্ট্রশক্তি। কিন্তু ব্যর্থ হয় ক্ষমতা দখলের পর প্রচারণায়। তিন শতাব্দী ধরে যুক্তি-পরামর্শ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চ অর্জন করে কনস্টান্টাইনে সময় রাষ্ট্রশক্তি। তারপর শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি প্রচারণা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে, যার ফলশ্রুতিস্বরূপ প্রায় সব পৌত্তলিক খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়। বর্বরদের আক্রমণের পরও খ্রিস্ট ধর্ম বেঁচে থাকে। রাশিয়ার মার্কসীয় ধর্মমত দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, কিন্তু অন্যত্র তা সীমাবদ্ধ প্রথম পর্যায়েই।

যা হোক, কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত রয়েছে যে কোনো স্তরে বল প্রয়োগ ছাড়া জনমত গঠনকারী প্রভাবের। বিজ্ঞানের অভ্যুদয় হচ্ছে এগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য। অধুনা সভ্য দেশগুলোতে বিজ্ঞান রাষ্ট্র কর্তৃক উৎসাহিত হচ্ছে। কিন্তু এর সূচনালগ্নে অবস্থা এ রকম ছিল না। গ্যালিলিওকে তার বিশ্বাস পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। নিউটনকে মিন্টোর প্রভু বানানোর মাধ্যমে থামিয়ে দেয়া হয়। ক্রিস্ট ও এরিস্টটলসহ ইতিহাসে জ্ঞাত অন্যান্য ব্যক্তিত্বের চেয়ে তাদের প্রভাব অনেক বেশি। অন্য একমাত্র ব্যক্তিত্ব যার প্রভাব তুলনামূলকভাবে গুরুত্বের অধিকারী তিনি হচ্ছেন পিথাগোরাস। সন্দেহজনক তার অস্তিত্ব।

আজ প্রথাগত হয়ে পড়েছে মানবীয় কার্যাবলির সহায়ক শক্তি হিসেবে যুক্তি পরামর্শ রহিতকরণ। তারপরও বিজ্ঞানের অভ্যুদয় হচ্ছে অন্য দিকে এক অদম্য শক্তি। বিজ্ঞানজগতের ব্যক্তিরা অপেশাদার বুদ্ধিমান মানুষের কাছে এ কথা প্রমাণ করেন যে, একটি বিশেষ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি সামরিক শৌর্য-বীর্যের সহায়ক। ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুরাগ ও চার্চের রাজত্ব এবং প্রথাজনিত শক্তি সত্ত্বেও এসব লক্ষ্য এত আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষিত হচ্ছিল যে নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে যাবে। সূর্যকে স্থির থাকতে বাধ্য করেছিল যশোয়া-এ জাতীয় বিশ্বাস বিশ্ববাণী পরিত্যাগ করেছে। নৌ চলাচলের জন্য উপকারী কোপারনিকাসের জোতির্বিদ্যা। এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যা পরিত্যক্ত হলো। কারণ, পড়ন্ত বস্তু সম্পৰ্কীয় গ্যালিলিওর তত্ত্বের দ্বারা ক্যানন বলের গতিপথ বের করা সম্ভব হলো। বন্যার কাহিনী প্রত্যাখ্যান করা হলো, কারণ ভূতত্ত্ববিদ্যা খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য উপযোগী। এখন সাধারণভাবে স্বীকৃত হচ্ছে যে, যুদ্ধ এবং শান্তিকালীন শিল্পের জন্য বিজ্ঞান অপরিহার্য এবং বিজ্ঞান ছাড়া কোনো জাতি সম্পদশালী বা ক্ষমতাশালী হতে পারে না।

এসব প্রভাব শুধু মতামতের উপর বিজ্ঞানের বদৌলতে বাস্তবধর্মী আবেদনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে সাধারণ তত্ত্বের মাধ্যমে বিজ্ঞান যা বলতে চায় তা প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু কৌশলের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল সবার জন্য উন্মুক্ত। বিজ্ঞান শ্বেতকায় মানুষের এ পৃথিবীর প্রভুত্ব দান করেছিল, কিন্তু তা হারাতে বসে জাপানিরা তাদের কৌশল শিখে ফেললে।

যুক্তি-পরামর্শের ক্ষমতা সম্পর্কে এই দৃষ্টান্ত থেকে কিছু জানা যেতে পারে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তি-পরামর্শ কুসংস্কারের উপর জয়যুক্ত হয়, কারণ তা চলমান উদ্দেশ্য উপলব্ধি পথ প্রদর্শন করে। অধিকন্তু এ ধরনের কাজের পক্ষে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। যারা বলতে চান যে মানবীয় কার্যাবলিতে যুক্তির কোনো ক্ষমতা নেই, তারা এ দুটো যুক্তি অবহেলার চোখে দেখেন। যদি শুধু যুক্তি-পরামর্শের নামে আপনি কোনো লোককে তার মৌলিক উদ্দেশ্য পরিবর্তন করার আহ্বান জানান তাহলে আপনি ব্যর্থ হবেন এবং আপনি ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ, শুধু যুক্তি পরার্মশই জীবনের লক্ষ্য নিরূপণ করতে পারে না। প্রোথিতমূল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপনার আক্রমণ একইভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে যদি আপনারা যুক্তিগুলো প্রশ্নাতীত না হয় অথবা এত কঠিন না হয় যে শুধু বিজ্ঞানের ছাত্ররাই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তির কাছে বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টান্ত দ্বারা আপনি প্রমাণ করতে পারেন যে, আপনি বিদ্যমান আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে সক্ষম, তবে আপনি আশা করতে পারেন যে আপনি যা বলবেন মানুষ তা বিশ্বাস করবে। অবশ্য এতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে যে, আপনি যেসব আশা পূর্ণ করতে সক্ষম তা যারা ক্ষমতালাভে সক্ষম তাদের।

মানবীয় কার্যাবলির ক্ষেত্রে এগুলো হচ্ছে বিচার-বুদ্ধিজাত ক্ষমতা। আমি এখন আলোচনা করব অন্য এক প্রকার বলহীন যুক্তি-পরামর্শ সম্পর্কে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ধর্ম প্রচারকদের যুক্তি-পরামর্শ সম্বন্ধে। মামুলি ফর্মুলায় পর্যবসিত পদ্ধতি হচ্ছে : যদি বিশেষ উপপাদ্য সত্য হয় তবে আমি আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণে সমর্থ হব। আমি আশা করি যে, এই উপপাদ্যটি সত্য হবে; সুতরাং আমার ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণ না থাকলে আমি একে সত্য বলে বিশ্বাস করব। আমাকে বলা হয়েছে যে, গোঁড়ামি ও ধর্মীয় জীবনযাপন মৃত্যুর পর আমাকে স্বর্গে যাওয়ার সামর্থ্য যোগাবে। এ রকম বিশ্বাসের পেছনে আনন্দ রয়েছে এবং সম্ভবত আমি তা বিশ্বাস করব যদি জোরেশোরে তা আমার কাছে উপস্থাপন করা হয়। এই বিশ্বাসের কারণ বিজ্ঞানের সত্য তথ্যের মতো নয়, বরং বিশ্বাস থেকে প্রাপ্ত আনন্দানুভূতি ও তৎসমেত বিশ্বাস জন্মানোর নিমিত্ত প্রাণশক্তি, যা অবিশ্বাসযোগ্য করে তোলে না ওই পরিবেশে।

প্রচারাভিযানের ক্ষমতা এই শিরোনামে ধরা পড়ে। এমন দিলে বিশ্বাস করা আনন্দদায়ক, কারণ তা আপনাকে আশা প্রদান করে ভালো স্বাস্থ্যের। এগুলো বিশ্বাস করা সম্ভব যদি আপনি দেখতে পান যে এগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জোরেশোরে ঘন ঘন ঘোষণা করা হচ্ছে। সঙ্গত প্রচারণার মতো অসঙ্গত প্রচারণা ও অবশ্য মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। কিন্তু সত্যের প্রতি আবেদনের পুনর্ব্যক্ততার প্রতিকল্প স্বরূপ এগুলো।

বাস্তব ক্ষেত্রে এত পরিষ্কার নয় উপরোল্লিখিত বিশ্লেষণের মতো যৌক্তিক ও অযৌক্তিক আবেদনের ভেতর পার্থক্য। চূড়ান্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট না হলেও স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান কিছু যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ। অযৌক্তিক অবস্থা বিরাজ করে কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের ভেতর। প্রথাগত না হলে বিশ্বাস আকাঙ্ক্ষা, প্রমাণ ও পুনর্ব্যক্ততার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়ে থাকে। আকাক্ষা ও প্রমাণের অভাব হলে বিশ্বাস অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে গুরুত্ব আরোপিত না হলে বিশ্বাস ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। ধর্মের প্রবর্তক, বিজ্ঞান আবিষ্কর্তা ও পাগলের বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ এইগুলো।

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা অর্জন করেন পুনর্ব্যক্ততার শক্তি বলে বিশ্বাস প্রভাবিত করার সামর্থ্য। অফিসিয়াল প্রচারণার রয়েছে নতুন ও পুরনো রূপ। চার্চের কৌশল অনেক দিক দিয়েই প্রশংসার যোগ্য; কিন্তু তা ছাপাখানা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত উন্নতি লাভ করে। এ কারণে আগের মতো ফলপ্রদ নয়। বহু শতাব্দী ধরে রাষ্ট্র বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে : মুদ্রার উপর রাজার মাথা, রাজ্যাভিষেক এবং জুবিলি, পদাতিক ও নৌবাহিনীর প্রদর্শনমূলক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো শিক্ষা, সংবাদ মাধ্যম, সিনেমা, রেডিও ইত্যাদির মতো আধুনিক পদ্ধতিগুলোর চেয়ে অনেক কম শক্তিসম্পন্ন। সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রগুলোতে এগুলো চরমভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এত শিগগির এগুলো .মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

আমি বলেছিলাম, আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে হৃদয়বৃত্তিতে নাড়া দিতে পারে না প্রচারণা। তা প্রমাণ করা যেতে পারে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রচারণা ব্যর্থতার দ্বারা। দৃষ্টান্ত স্বরূপ যুদ্ধপূর্ব অস্টিয়া, হাঙ্গেরির বৃহদংশ, ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আয়ারল্যান্ড এবং বর্তমান যুগ পর্যন্ত ভারতে সংঘটিত ঘটনাবলি উল্লেখ করা যায়। প্রচারণা সফল হয় রোগীর হৃদয়ানুভূতির সঙ্গে ঐকতান সৃষ্টি করলেই। মৌন সম্মতির এ ধরনের কোনো মৌল কারণ না থাকলে কর্তৃপক্ষের দাবি নিন্দার চোখে দেখা হয়। সরকারি দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের সুবিধা হচ্ছে, এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করা সহজ; কারণ, তারা গণতান্ত্রিক সরকারকে নিজের সরকার মনে করে। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ অন্যান্য শাসন পদ্ধতির চেয়ে গণতন্ত্রে কম। গণতন্ত্রে অধিকাংশ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে কঠিন ও নীরস নেতা নির্বাচনের জন্য নিজেদের ভুল স্বীকারের মাধ্যমে।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পদ্ধতিগত ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা বর্তমানকালে চার্চ, ব্যবসা, রাজনৈতিক দল, প্রটোক্র্যাসি এবং রাষ্ট্রের ভেতর হয়ে পড়েছে বিভক্ত। বিরোধী রাজনৈতিক দল ছাড়া এসব শক্তি একই পক্ষে থাকে। বিরোধী দলগুলোও ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পেলে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা মৌল বিষয়গুলোর বিরোধিতা করে না। সর্বগ্রাসী দেশগুলোতে রাষ্ট্রই একমাত্র প্রচারক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না আধুনিক প্রচারণার সর্বপ্রকার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর অফিসিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে গৃহীত হবে। জাতীয় অনুভূতি বিরোধী সরকারের মতোই এ ধরনের অবস্থার ফলে জন্ম নেয় সরকারের ব্যর্থতাবোধ। যুদ্ধোন্মদনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যত বেশি জয়ের ভরসা দেয়া হয় জয়ের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় হলে প্রতিক্রিয়া তত বেশি হয়। সুতরাং আশঙ্কা করা হয় যে, বিগত যুদ্ধের মতো পরবর্তী যুদ্ধ বিপ্লবের বীজ ছাড়ানোর মাধ্যমে সমাপ্ত হবে। যুদ্ধ আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হবে বিধায় ১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে বিপ্লবের চেয়েও বেশি ভয়ানক হবে। শাসকরা উচ্ছঙ্খল জনতার হাতে মৃত্যুর ঝুঁকি সম্পর্কে বুঝতে পারেন, যা শত্রুর হাতে সৈন্যদের মৃত্যুর ঝুঁকির সমান।

ক্ষমতার উচ্চ মূল্যায়ন সহজ অফিসিয়াল প্রচারণায়, বিশেষত যখন কোনো প্রতিযোগিতামূলক প্রচারণা থাকে না। সময়মতো যেসব উপপাদ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায় ওইসব মিথ্যা উপপাদ্যে বিশ্বাস জন্মানোর লক্ষ্যে অফিসিয়াল প্রচারণা নিবেদিত হলে এর অবস্থান গ্যালিলিওর বিরুদ্ধবাদী এরিস্টটলের অনুসারীদের মতোই খারাপ হয়। বিরোধী দুটো রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যেক পক্ষই যদি মানুষের মনে নিশ্চিত যুদ্ধ জয়ের প্রচারণা চালায় তবে উভয় পক্ষ না হলেও একপক্ষ অবশ্যই নাটকীয়ভাবে অফিসিয়াল বিবৃতি খন্ডনের অভিজ্ঞতা লাভ করবে। যখন সব বিরোধী প্রচারণা নিষিদ্ধ থাকে তখন শাসকদের মনে করা স্বাভাবিক যে, তা সৃষ্টি করতে পারে যে কোনো ধরনের বিশ্বাস। সুতরাং অসতর্ক হয়ে পড়ে অতিমাত্রায় ধারণা পোষণ করে। শক্তি বজায় রাখতে হলে প্রয়োজন মিথ্যাগুলোর ভেতর প্রতিযোগিতা।

ক্ষমতা রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকারভুক্ত হয় মতামতের উপর একীভূত ও ঘনীভূত হয়ে। কিন্তু এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত হবে না যে, যুদ্ধ ছাড়া অন্য সময়েও রাষ্ট্রের একচেটিয়া প্রচারের ফলে সরকার অজেয় হবে। লুথারীয় যুগের পোপদের মতো পরিণামে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা সাধারণ লোকের স্বার্থের প্রতি অতিশয় উদাসীন হয়ে পড়তে পারেন। শিগগির অথবা বিলম্বে কোনো নতুন লুথার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবেন এবং তার পূর্বসূরিদের মতো এত দ্রুত সফল হবেন যে তাকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ রকম হবে কারণ, শাসকরা মনে করেন যে এ রকম কিছু ঘটতে পারে না। কিন্তু এ রকম পূর্বাভাস পাওয়া অসম্ভব যে মঙ্গলের জন্য পরিবর্তনটি।

অন্য কিছুর মতো বিপ্লব বিলম্বিত হয়ে প্রচারণার ব্যাপারে সংগঠন ও একত্রীকরণের প্রভাবে, কিন্তু যখন তা ঘটে তখন তা অধিকতর প্রচন্ড হয়ে থাকে। শুধু একটি মতবাদ অফিসিয়াল অনুমোদন পেলে বিকল্প মতবাদের চিন্তা ও তার তুলনামূলক গুরুত্ব নিরূপণের সুযোগ পায় না। শুধু আবেগপ্রসূত বিদ্রোহের মহাজোয়ার গোঁড়ামি দূর করতে পারে। মনে হয় সফলতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সরকারি মতবাদের মধ্যেও সত্য জিনিসটি অগ্রাহ্য করা প্রয়োজন বিরোধিতাকে যথেষ্ট একাগ্র ও প্রচন্ড করে তোলার জন্যে। শুধু যে জিনিসটি অগ্রাহ্য করা যাবে

তা হচ্ছে কোনো অব্যাহত গোঁড়ামি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব, কারণ বিজয়ের জন্য তা মনে করা হয় প্রয়োজনীয়। যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তাই সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে বিপ্লবের সম্ভাব্যতা আনন্দের অপরিহার্য ভিত্তি নয়। এর অধিক যা আশা করতে হয় তা হচ্ছে নিরাপত্তা অপরিহার্য ভিত্তি নয়। এর অধিক যা আশা করতে হয় তা হচ্ছে নিরাপত্তা বোধের ক্রমবৃদ্ধি। এটি উৎসাহ কমিয়ে দেবে এবং উন্মুক্ত করবে অলসতার দ্বার। সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *