০৬. নগ্ন ক্ষমতা

নগ্ন ক্ষমতা

প্রথাগত ক্ষমতার সহায়ক বিশ্বাস ও অভ্যাস হ্রাস পেলে ক্রমে নতুন বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল ক্ষমতা অথবা প্রজাদের সম্মতির পরোয়া করে না–এ ধলনের নগ্ন ক্ষমতার পথ সুগম হয়। এর পর্যায়ভুক্ত হলো মেষের উপর কসাইয়ের, পরাভূত জাতির প্রতি আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর এবং বন্দি ষড়যন্ত্রকারীর উপর পুলিশের ক্ষমতা প্রয়োগ। ক্যাথলিকদের উপর ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতা ঐতিহ্যগত; কিন্তু নগ্ন এর ক্ষমতা অত্যাচারিত মতাবলম্বীদের উপর। সাধারণ তিনটি পর্যায় অতিক্রম কের দীর্ঘদিনব্যাপী ক্ষমতাসীন সংগঠন। প্রথমটি বিজয়ের পথে অতি-উৎসাহের, কিন্তু প্রথাগত বিশ্বাসের নয়; পরে নতুন ক্ষমতার প্রতি সাধারণ সম্মতির যা শিগগিরই প্রথাগত হয়ে পড়ে; অবশেষে প্রথা অগ্রাহ্যকারী লোকের উপর ক্ষমতার ব্যবহার, যা আবারও নগ্ন ক্ষমতায় পর্যবসিত হয়। সংগঠনের বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এই পর্যায়গুলো অতিক্রমকালে।

এশিয়া ও আফ্রিকার খ্রিস্টান দেশগুলো প্রায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও নতুন শাসকদের (মুসলমান) বশ্যতা স্বীকার করে নেয় বিজিত হওয়ার পর। ওয়েলস কালক্রমে ইংরেজদের শাসন মেনে নেয়, যদিও আয়ারল্যান্ড তা করেনি। আলবিজেন বিরুদ্ধবাদীদের সামরিক শক্তি দ্বারা দমন করা হলে তাদের নতুন প্রজন্ম ভেতরে ও বাইরে চার্চের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়। ইংল্যান্ডে এক রাজকীয় পরিবারের জন্ম দেয় নরমেন বিজয়। পরে এমন মনে করা হতো যে তাদের স্বর্গীয় অধিকার প্রতিষ্ঠিত সিংহাসনে। মনোগত বিজয়ের ফলে শুধু সামরিক বিজয় স্থিতিশীল হয়। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে তা ঘটেছে সেগুলো সংখ্যার দিক দিয়ে অনেক।

দুটো ভিন্ন পরিবেশের জন্ম দেয় বিদেশি শক্তির কাছে পরাজয়ের পর বশ্যতা স্বীকার করেনি এমন সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ সরকার ব্যবস্থার নগ্ন ক্ষমতা। প্রথমত, দুই বা ততোধিক ধর্মমতের অতি-উৎসাহী বিশ্বাসীরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় প্রভুত্ব অর্জনের জন্য। দ্বিতীয়ত, প্রথাগত বিশ্বাস স্থলবর্তী বিশ্বাস ছাড়া লোপ পেয়ে থাকে যেখানে ব্যক্তিগত অভিলাষ সীমাহীন। প্রথমোক্তটি বিশুদ্ধ নয়, কারণ শক্তিশালী ধর্মমতের অনুসারীরা অনুগত হয় নগ্ন ক্ষমতার। আমি পরবর্তী অধ্যায়ে বিপ্লবী ক্ষমতা শিরোনামে তা আলোচনা করব। এখনকার আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু দ্বিতীয় বিষয়ের উপর।

নগ্ন ক্ষমতার সংজ্ঞা মনোগত। একটি সরকার নগ্ন হতে পারে কিছু সংখ্যক প্রজার সাপেক্ষে, কিন্তু অন্যদের সাপেক্ষে নয়। বিদেশি আক্রমণ ছাড়া গ্রিকদের নিষ্ঠুর শাসনের শেষ অধ্যায় এবং রেনেসাঁ ইতালির কয়েকটি প্রদেশ হচ্ছে আমার জানা মতে এর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত।

রাজনৈতিক ক্ষমতার ছাত্রদের গ্রিক ইতিহাস পরীক্ষাগারের মতো ছোট ছোট পরীক্ষা উপহার দেয়। হোমারের যুগে বংশগত রাজতন্ত্র ইতিহাস যুগের আগেই লুপ্ত হয় এবং এর স্থলে জন্মলাভ করে বংশানুক্রমিক অভিজাততন্ত্র। অভিজাত ও অত্যাচারিতদের ভেতর সংঘঠিত সংঘর্ষের ইতিহাস হলো গ্রিক শহরগুলোর ইতিহাস। স্পার্টা ছাড়া সর্বত্রই একবার অত্যাচারী বিজয়ী হয়, কিন্তু পরে এর স্থলাভিষিক্ত হয় গণতন্ত্র অথবা অল্প লোকের শাসনের রূপে আভিজাত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। খ্রিঃ পূঃ সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর অধিকাংশ সময়ব্যাপী ছিল নিষ্ঠুরতার এই প্রথম যুগ। কিন্তু পরবর্তী যে যুগ সম্বন্ধে আমি আলোচনা করতে চাই তা নগ্ন ক্ষমতার যুগ ছিল না। কিন্তু এ সত্ত্বেও তা পথ তৈরি করে দেয় পরবর্তী সময়ের আইনহীনতা ও অবমাননাকর পরিস্থিতির।

অত্যাচারী শব্দটি মূলত শাসকের কোনো খারাপ বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত বহন করত না, বরং তা বুঝাত শুধু আইনগত ও প্রথাগত গুণাগুণের অনুপস্থিতি। প্রাচীনকালে অনেক অত্যাচারীই বিজ্ঞের মতো শাসন করে গেছেন। অধিকাংশ প্রজার সম্মতি নিয়েই তারা শাসন করেছেন। সাধারণত তাদের অভিজাত শ্রেণি ছিল অপশম্য শত্রু। প্রাচীন অত্যাচারীদের ভেতর অধিকাংশই ছিলেন বিত্তবান। অর্থের বিনিময়ে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি করে নিত এবং তা বজায় রাখার জন্য সামরিক ক্ষমতার চেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতার উপর বেশি নির্ভর করত। তাদেরকে আমাদের যুগের স্বেচ্ছাচারীদের পরিবর্তে মধ্যযুগের স্বেচ্ছাচারীদের সাথে তুলনা করা যায়।

মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় অত্যাচারীদের প্রথম যুগেই। ঋণ ও কাগজি মুদ্রা যেমন আজকাল ধনীদের ক্ষমতা বৃদ্ধির উপর প্রভাব রাখে, তখনকার দিনে তা তেমনই প্রভাব রাখত। উল্লেখ আছে যে, মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কযুক্ত ছিল অত্যাচারী শাসকের উত্থানের সাথে। কিন্তু তা কতটুকু সত্য তা বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, রৌপ্য খনির মালিকানা একটি লোকের অত্যাচারী শাসক হওয়ার পক্ষে সহায়ক ছিল। ইউরোপের নিয়ন্ত্রণাধীন আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে যেমন দেখা গেছে, নতুন অবস্থায় মুদ্রার ব্যবহার প্রাচীন প্রথাগুলোর ক্ষতিসাধন করে। খ্রিঃ পূঃ সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যবসায়ীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং আঞ্চলিক অভিজাত শ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস পায়। পারসিকরা এশিয়া মাইনরের অধিকার লাভ করা পর্যন্ত যুদ্ধবিগ্রহ কম ছিল গ্রিসীয় বিশ্বে এবং এগুলো ছিল গুরুত্বহীন। উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কম কাজই দাসদের দ্বারা সম্পন্ন। হতো। এই অবস্থানগুলো অর্থনৈতিক ক্ষমতার জন্য আদর্শস্বরূপ ছিল এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের মতো তা প্রথাগুলোর প্রভাব দুর্বল করেছিল।

প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে উন্নতি লাভ করা যতদিন পর্যন্ত সম্ভব ছিল প্রথাশক্তি হ্রাসের পরিণতি ভালো বই মন্দ ছিল না। এর ফলে বিগত চার শতাব্দী ছাড়া অন্য সব সময় গ্রিক সভ্যতা লাভ করে দ্রুত অগ্রগতি। গ্রিক শিল্প, বিজ্ঞান ও দর্শনের স্বাধীনতা ছিল কুসংস্কার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন উন্নত যুগের অবদান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রোধ করার মতো সমাজের গঠনশৈলী তত উন্নত ছিল না। অভাব ছিল সমাজে ধ্বংসাত্মক অপরাধ এড়ানোর উপযোগী প্রয়োজনীয় নৈতিকতা বোধের। কোনো সদ্গুণ দ্বারা সফলতা অর্জন করা ওই সময় সম্ভব ছিল না। দীর্ঘদিন যুদ্ধের ফলে স্বাধীনচেতা মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেল এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেল দাস-দাসীর সংখ্যা। ফলে খোদ গ্রিসই মেসিডোনিয়ার অঙ্গরাজ্যে পরিণত হলো। ক্রমবর্ধমান হিংসাত্মক বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ এবং অত্যাচার সত্ত্বেও গ্রিসীয় সিসিলি প্রথমে কার্তেজ ও পরে রোমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত ছিল। এ উভয় কারণে সাইরেকিউসের অত্যাচারী শাসন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রথমত আমাদের কাছে নগ্ন ক্ষমতার একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়ত, বৃদ্ধ ডায়ানোসিয়াসের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত এবং তা প্রভাবিত করতে পেরেছিল যুবকদের জন্য সমাজ গঠনের চেষ্টায় রত প্লেটোকে। পরবর্তী সব যুগের গ্রিক অত্যাচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয় বৃদ্ধ ডায়ানোসিয়াস ও সাইরেকিউসের কুশাসনে নিযুক্ত তার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক যোগাযোগের মাধ্যমে।

গ্রেট প্রতারণামূলক সংগঠন সম্পর্কে বলেন, বল প্রয়োগকারী সংগঠনগুলোর সূচনালগ্নে জনসাধারণকে প্রতারণাপূর্বক বশ্যতা স্বীকার করানো হতো এর মাধ্যমে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন বশ্যতা স্বীকার করানো হতো যা ছিল গ্রিক শক্তি প্রয়োগকারীদের ব্যবসায়িক পুঁজি। প্রাচীন অত্যাচারী শাসন জনগণের সমর্থন ছাড়া কতটুকু টিকে ছিল তা সন্দেহজনক। কিন্তু সামরিক বৈশিষ্ট্যের চেয়ে অধিকতর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পরবর্তী অত্যাচারী শাসনের বেলায় তা নিশ্চিত সত্য। গ্রেটের বর্ণনা দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায় ডায়াডোরাসের উপর নির্ভরশীল ডায়ানোসিয়ামের উত্থানের মুহূর্তগুলো সম্পর্কে। সাইরেকিউস পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করতে বাধ্য হলো কমবেশি গণতান্ত্রিক শাসন বর্তমান থাকা সত্ত্বেও। পরাজিত জেনারেলদের শাস্তি দাবি করলেন মহাযুদ্ধে বিজয়ীদের নেতা ডায়ানোসিয়াস।

শান্ত ও অশান্ত পরিবেশের ভেতর বিরাজমান সাইরেকিউস সভায় ডায়ানোসিয়াসই একমাত্র প্রথম ব্যক্তি, যিনি তাদেরকে সম্বোধন করে কিছু বলছেন। তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের মেজাজের উপযোগী প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপর। তিনি তীব্র সমালোচনা করেন কার্তেজদের হাতে সাইরেকিউসের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ব্যাপারে জেনারেলদের বিশ্বাসঘাতকতা ও এগ্রিজেন্টাম ধ্বংস এবং সেই সঙ্গে চতুপার্শ্বস্থ প্রত্যেকটি ব্যক্তির আসন্ন বিপদের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের। তিনি শুধু রুক্ষভাবে পূর্ণতার সঙ্গে তাদের প্রকৃত ও অভিযোগে আনীত দুষ্কর্মের কথাই তুলে ধরেননি, তার প্রচণ্ড হিংস্রতা সব সঙ্গত বিতর্কের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। অধুনা তিনি বেআইনিভাবে মৃত্যুদন্ড দিতে মনস্থ করেন এগ্রিজেন্টামে গঠিত জেনারেলদের। ওখানে বিশ্বাসঘাতকতা বসে আছে। আইনানুগ বিচারের অপেক্ষা করো না, বরং সহসা তাদের উপর হস্ত চালনা করো এবং সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্রিয়া প্রয়োগ করো। আইন ও পার্লামেন্টারি আদর্শের পরিপন্থি এমন বর্বরোচিত প্রেরণাদান। আইনানুগ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটরা ডায়নোসিয়াসকে একজন শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী। হিসেবে অভিযুক্ত করে তার জরিমানা করেন। কিন্তু সমর্থকরা তার সমর্থনে উচ্ছ্বসিত ছিল। শুধু ফিলিস্টাস ঘটনাস্থলে তার জরিমানা অর্থই প্রদান করেননি, বরং তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে, তিনি সারাদিন এ ধরনের সম্ভাব্য জরিমানার অর্থ প্রদান করে যাবেন। তিনি এভাবে ডায়নোসিয়াসকে প্রয়োগ করে যেতে বলেন তার ভাষা। যা বেআইনি হিসেবে শুরু হয়েছিল এখন তা খোলাখুলিভাবে আইন অমান্য করার প্রবণতায় পর্যবসিত হলো। ম্যাজিস্ট্রেটদের কর্তৃত্ব এতই নিষ্প্রভ এবং তাদের বিরুদ্ধে হট্টগোল এতই তীব্র ছিল যে, বক্তাকে শাস্তি প্রদান করা তো দূরের কথা, তাকে দমিয়ে রাখাও ছিল তাদের ক্ষমতার বাইরে। আরও উচ্চকণ্ঠে ডায়নোসিয়াস তার ভাষা প্রয়োগ করে চললেন। তিনি শুধু এগ্রিজেন্টামে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য জেনারেলদের অভিযুক্ত করেননি, বরং নিন্দা করেন সম্পদশালী ব্যক্তিদেরও, কারণ অলিগার্কদের মতো তারা জনসাধারণের উপর অত্যাচারী শাসন বজায় রাখত এবং হেয় প্রতিপন্ন করত অনেককেই। তাছাড়া তাদের স্বার্থ হাসিল করত শহরের দুর্ভাগ্য থেকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের লোককে কর্তৃত্বে না বসালে সাইরেকিউসকে রক্ষা করা যাবে না। সম্পদের ভিত্তিতে তাদের নির্বাচিত করা যাবে না, বরং জন্মগতভাবে নীচ এবং নিজেদের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন থাকায় যারা আচরণে বিনয়ী ও মার্জিত তাদেরকে নির্বাচিত করতে হবে।

তিনি এর জন্যেই হতে পেরেছিলেন অত্যাচারী। তিনি পরিমাণসূচক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব ও নীচদের সঙ্গে। এ কথা সত্য যে, তিনি ধনীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন, কিন্তু তা বিতরণ করে দেন তার দেহরক্ষীদের। তার জনপ্রিয়তা শিগগিরই হ্রাস পেল, কিন্তু অক্ষুণ্ণ থেকে গেল ক্ষমতা। গ্রেটের বর্ণনায় পরবর্তী কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী আমরা দেখতে পাব :

আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ ধরনের অনুভূতি এতই অধিক ছিল যে, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল সাইরেকিউবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এবং তা নির্ভরশীল ছিল একমাত্র নগ্ন ক্ষমতার উপর। সম্ভবত অন্য যে কোনো স্বেচ্ছাচারীর চেয়ে অধিকতর সতর্ক অবস্থায় থাকতেন তিনি।

এজন্য গ্রিক ইতিহাস বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যে, স্পার্টা ছাড়া গ্রিসের সর্বত্রই ঐতিহ্যগত প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। তার ওপর প্রায় নীতিবিবর্জিত ছিল রাজনীতি। হেরোডেটাসের বর্ণনা পাওয়া যায় যে, কোনো স্পার্টাবাসী ঘুষ প্রতিরোধ করতে পারত না। অর্থহীন ছিল গ্রিসব্যাপী রাজনীতিকদের পারস্য রাজের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণে আপত্তি। কারণ প্রতিপক্ষ যথেষ্ট ক্ষমতাবান হলেও তিনি তাই করতেন। ফলস্বরূপ সার্বজনীন লড়াই শুরু হয়ে যায় ব্যক্তিগত ক্ষমতা লাভের জন্যে। পাপ, রাজপথ যুদ্ধ ও হত্যা বিরাজ করছিল এর পেছনে। এ ব্যাপারে অগ্রগামী ছিল সক্রেটিস ও প্লেটোর শিষ্যরা। বিদেশি শক্তির অধীনস্থ হওয়াই ছিল এর পরিণতি যার পূর্বাভাস অনুভূত হয় আগেই।

গ্রিসের স্বাধীনতাহানির জন্য বিলাপ করা এবং গ্রিকদের জ্ঞানী ও সক্রেটেসীয় ভাবাটা ছিল প্রথাগত। গ্রিসীয় সিসিলির ইতিহাসে দৃষ্ট রোমের বিজয়ে পরিতাপ করার কারণ কত ক্ষীণ ছিল। আমার জানা নেই এগথোসলের জীবনধারার চেয়ে নগ্ন ক্ষমতার ভালো দৃষ্টান্ত। আলেকজান্ডারের সমসাময়িক ছিলেন এগথোসল। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৬১ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৮৯ অব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং তিনি তার জীবনের শেষ আটশ বছর সাইরেকিউসের একজন অত্যাচারী ছিলেন।

শুধু গ্রিক শহরগুলোর মধ্যেই সাইরেকিউস সবচেয়ে বড় ছিল না, সম্ভবত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যেও বড় ছিল। একমাত্র প্রতিপক্ষ ছিল কার্তেজ, যার সঙ্গে যুদ্ধে উভয় পক্ষের শোচনীয় পরাজয়ের পর অল্পকাল বিরতি ছাড়া সব সময় যুদ্ধ চলছিল। সিসিলির অন্যান্য শহর দলীয় রাজনীতির পালাবদল অনুযায়ী পক্ষ অবলম্বন করে কখনও সাইরেকিউসের আবার কখনও কার্তেজের। প্রত্যেক শহরেই ধনীরা অলিগার্কি এবং গরিব জনসাধারণ গণতন্ত্র সমর্থন করত। গণতন্ত্রের অনুগামীরা জয় লাভ করলে এর নেতারা হয়ে যেত অত্যাচারী। পরাজিত দলের অনেকেই নির্বাসিত হতো। তাদের দল যেসব শহরে ক্ষমতাশালী সেসব শহরে তারা সেনাবাহিনীতে যোগদান করত। কিন্তু সেনাবাহিনীর অধিকাংশই ছিল বণিক দলের, যারা গ্রিসীয় ছিল না।

নীচ বংশোদ্ভূত কুমারের ছেলে ছিলেন এগথোসল। তার সৌন্দর্যের জন্য তিনি সাইরেকিউসের ডোমাস নামে এক ধনী ব্যক্তির প্রিয় হয়ে ওঠেন। মৃত্যুকালে এই ধনাঢ্য ব্যক্তি সব সম্পত্তি রেখে যান এগগোসলের জন্যে। ধনাঢ্য ব্যক্তির বিধবাকে বিয়ে করেন এগথোসল। এ কথা মনে করা হতো যে,তিনি যুদ্ধে বৈশিষ্ট্য অর্জন করার পর নিষ্ঠুর শাসক হওয়ার উচ্চাভিলাষ পোষন করতেন। তাই তিনি প্রেরিত হন নির্বাসনে। পথিমধ্যে তাকে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু পূর্বাভাস পেয়ে তিনি এক গরিব লোকের সঙ্গে তার পোশাক পাল্টে নেন। ফলে ভাড়াটে ঘাতক কর্তৃক নিহত হয় গরিব লোকটি। তিনি একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন সিসিলির অভ্যন্তরে। এর ফলে সাইরেকিউসানরা ভীত হয়ে তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। তিনি আবার প্রবেশ করেন এবং সেরেসে শপথ নেন যে, তিনি কিছু করবেন না গণতন্ত্রের পূর্ব ধারণার উপর।

সাইরেকিউস সরকার এই সময় ছিল গণতন্ত্র ও অলিগার্কির মিশ্রণ। ছয়শ লোকের একটি পরিষদ ছিল ধনী মানুষের সমন্বয়ে। এগথোসল ওইসব অলিগার্কের বিরুদ্ধে গরিবের স্বার্থ আদায়ের দায়িত্ব নিলেন। তাদের চল্লিশ জনের সঙ্গে কনফারেন্স চলাকালে তিনি তাদের উপর সৈন্যদের চড়াও হওয়ার নির্দেশ দেন। তাতে নিহত হয় চল্লিশ জনের সবাই। তিনি তাদের বিরুদ্ধে অজুহাত দেখান যে ওরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তিনি সৈন্যদের শহরের দিকে পরিচালিত করেন এবং লুণ্ঠন করার নির্দেশ দেন ছয়শ জনের সবাইকে।

যেমন ডায়াডোরাস বলেন, না তাদেরও নিরাপত্তা ছিল না যারা পালিয়ে গির্জায় ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস চূর্ণ করে দেয় মানুষের নিষ্ঠুরতা। নিজেদের দেশে এক গ্রিকের বিরুদ্ধে অন্য গ্রিকের শান্তিকালীন সময়ে এগুলো ঘটেছে, যারা পরস্পরের আত্মীয় ছিল, তাদের একের বিরুদ্ধে অন্যের। এ সময় মোটেই শ্রদ্ধাবোধ ছিল না ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণে প্রকৃতি বা লীগের নিয়ম বা ঈশ্বরের প্রতি। শুধু এমন বর্ণনা নয়, প্রত্যেক শত্রু ও মিথ্যাচারী ব্যক্তিই এসব দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির করুণ অবস্থায় বিচলিত না হয়ে পারেন না।

দিনের বেলা গণহত্যায় লিপ্ত থাকত এগতোসলের মানুষ এবং রাতে চড়াও হতো মহিলাদের উপর। দুদিনের ধ্বংসযজ্ঞের পর এগথোসল সব বন্দিকে বের করে আনেন এবং তার বন্ধু ডায়ানোক্র্যাট ছাড়া সবাইকে হত্যা করেন। তিনি পরিষদ ডেকে অলিগার্কদের অভিযুক্ত করেন। তিনি শহরকে রাজতন্ত্রমুক্ত করে ছাড়বেন বলেন এবং নিজে ব্যক্তিগত জীবনযাপন করবেন। সুতরাং তিনি পোশাক ছেড়ে মুক্তির বেশ ধারণ করেন। কিন্তু যারা তার নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে লুণ্ঠন করেছিল তারা তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। তিনি নির্বাচিত হলেন একমাত্র জেনারেল। ঋণগ্রস্ত গরিবদের ভেতর অনেকেই এই বিপ্লবে আনন্দিত হলো। কারণ এগথোসল প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ঋণ মওকুফ ও গরিবদের ভেতর জমি বন্টনের। এরপর তিনি শান্ত ছিলেন কিছুকাল।

এগথোসল যুদ্ধের সময় সম্পদশালী এবং সাহসী কিন্তু হঠকারী ছিলেন। এমন সময় এলো যখন অনুভূত হলো যে কার্তেজদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী, তখন কার্তেজরা সাইরেকিউস অবরোধ করল এবং পোতাশ্রয় দখল করে নিল তাদের নৌবাহিনী। এগথোসল আফ্রিকা চলে যান বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে। সেখানে তিনি জাহাজ পুড়িয়ে ফেলেন, যাতে এগুলো কার্তেজদের হাতে না পড়ে। তার অবর্তমানে বিদ্রোহ হতে পারে এই ভয়ে তিনি প্রতিভূ হিসেবে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে যান। এক সময় প্রতিনিধিত্বকারী তার ভ্রাতা কার্তেজদের বন্ধুভাবাপন্ন আট হাজার রাজপ্রতিনিধির সবাইকে নির্বাসনে পাঠান। তিনি বিস্ময়করভাবে আফ্রিকায় সফল হন। তিনি তিউনিস দখল করে নেন এবং কার্তেজ অবরোধ করেন, যেখানে সরকার ভীত হয়ে দেবতাকে শান্ত করতে বসেছিলেন। দেখা গেল যে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলিদানের জন্য উপযুক্ত ছেলেমেয়েদের পিতামাতা তাদের পরিবর্তে গরিব ছেলেমেয়েদের ধরে নিতে অভ্যস্ত। তীব্রভাবে প্রতিরোধ করা হলো এই অভ্যাস। কারণ জানা গেল যে, মলক দেবতা অধিকতর সন্তুষ্ট অভিজাত ছেলেমেয়েদের বলিদানে। এই সংস্কারের পর আবার পরিবর্তিত হয় কার্তেজদের ভাগ্য।

এগথোসল সিরিনে দূত পাঠান অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন মনে করে। অপেলার কর্তৃত্বাধীন টলেমির অধীন ছিল সিরিন আলেকজান্ডারের একজন ক্যাপ্টেন। দূতরা এমন বলতে আদিষ্ট হয়েছিল যে, অপেলার সাহায্যে কার্তেজদের ধ্বংস করা সম্ভব এবং শুধু সিসিলিতেই এগথোসল নিরাপদ হতে চেয়েছিলেন। তার কোনো অভিলাষ নেই আফ্রিকায়। তাছাড়া অপেলার অংশ থাকবে আফ্রিকায় তাদের যুক্ত বিজয়ে। অপেলা এ ধরনের কষ্টের পর মিলিত হলেন এগথোসলের সঙ্গে। অবিলম্বে এগোসল তাকে হত্যা করেন এবং সৈন্যদের বলে দেন, তাদের মৃত নেতার হত্যাকারীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করা তাদের নিরাপত্তার একমাত্র পথ।

এরপর ইউটিকা অবরোধ করেন এগথোসল এবং অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে বন্দি করে ফেলেন মঠের ভেতর তিনশ লোকের সবাইকে। তিনি তাদেরকে অবরোধ কৌশলের পুরোভাগে রাখেন, যাতে ইউটিকানরা তাদের নিজেদের মানুষ ধ্বংস হবে এমন আশংকায় আক্রমণ করতে না পারে। সফল হলেও এই অভিযান অবস্থান কঠিন ছিল। আরও কঠিন এ কারণে ছিল যে, তার ছেলে আরচাগেথাচ সেনাবাহিনীর ভেতর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। এজন্য তিনি গোপনে সিসিলিতে পলায়ন করেন। তার পলায়নে ক্রুদ্ধ হয়ে সৈন্যরা তার এক ছেলের সহায়তায় আরচাগেথাচকে হত্যা করে। এতে তিনি এত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, সাইরেকিউসে তিনি এসব সৈন্যর আত্মীয় প্রত্যেক শিশু, মহিলা ও পুরুষকে হত্যা করেন।

কিছুদিনের জন্য সিসিলিতে তার ক্ষমতা স্বাভাবিক উত্থাপন-পতনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি এজেস্টা অধিকার করেন এবং শহরের প্রত্যেক পুরুষকে হত্যা করেন। ধনীরা সম্পদ উন্মোচন করে না দেয়া পর্যন্ত তাদের অত্যাচার করেন। যুবতী এবং শিশুদের তিনি দাস হিসেবে বিক্রি করে দেন প্রধান ভূমিতে অবস্থিত ত্রুটিতে।

বলতে আমার দুঃখ হয় যে, সুখের ছিল না তার পারিবারিক জীবন। গোপন সম্পর্ক ছিল তার এক পুত্রের সঙ্গে তার এক স্ত্রীর। তার দুই নাতি অপর এক নাতিকে হত্যা করে এবং পরে এক পুরনো ভৃত্যকে উদ্বুদ্ধ করে দাঁতের খড়গে বিষ প্রয়োগে। এগথোসল যখন দেখলেন যে তিনি নিশ্চিত মারা যাবেন তখন তিনি সিন্টে সভা ডাকলেন এবং দাবি করলেন নাতির উপর হত্যার প্রতিশোধ। কিন্তু বিষক্রিয়ায় তার মাড়ি এত ক্ষত হয়েছিল যে তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। নাগরিকরা উঠে পড়ল। মৃত্যুর আগে তড়িঘড়ি চিতায় চলে গেলেন তিনি। তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো এবং বলা হলো যে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে গণতন্ত্র।

প্রাচীন গ্রিসের অনুরূপ রেনেসাঁ ইতালির ঘটনাবলি, কিন্তু আরও ঘনীভূত ছিল সন্দেহ। অলিগার্কিক বাণিজ্যিক প্রজাতন্ত্র, অত্যাচারী শাসন ও প্রাচীন আদর্শ অনুসরণে সমাজতান্ত্রিক রাজ্যশাসন এবং আরও ছিল চার্চ। পোপ ইতালি ছাড়া সব জায়গাতেই সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন, কিন্তু তার পুত্র সম্মানিত এ ধরনের বিবেচনা করা হতো না। বর্গীয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করতেন সিজার।

শুধু নিজের বর্ণনামতেই নয়, বরং সিজার বর্গীয় ও তার পিতা ষষ্ঠ আলেকজান্ডার গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন মেকিয়াভেলিকে অনুপ্রাণিত করার জন্যে। ওই যুগের বর্ণনায় তাদের একটি ঘটনা ক্রেইটনের মন্তব্য সহকারে সহায়তা করবে। শতাব্দীব্যাপী পোপের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কলোনা এবং অরসিনি। ইতিমধ্যে অরসিনি টিকে থাকলেও কলোনার ঘটেছিল পতন। ষষ্ঠ আলেকজান্ডার তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং সিজার বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক দুটি গুরুত্বপূর্ণ অরসিনি দখল করেছেন শুনে তিনি তাদের প্রধান কার্ডিনাল অরসিনিকে ভেটিকানে আমন্ত্রণ করেন। কার্ডিনাল অরসিনি পোপের কাছে আসা মাত্রই বন্দি হলেন। তাকে খাদ্য সরবরাহ করার জন্য তার মা পোপকে দুহাজার ডুকাট প্রদান করেন এবং পোপকে লোভনীয় মুল্যবান পার্ল দান করেন তার স্ত্রী। তা সত্ত্বেও কার্ডিনাল অরসিনি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে যে, ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের আদেশে তাকে বিষাক্ত মদ সরবরাহ করা হয়। এই ঘটনায় এ যুগের নগ্ন ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে ক্রেইটনের মন্তব্যেই।

এমন বিশ্বাসঘাতকাপূর্ণ কাজে আশ্চর্যজনকভাবে কোনোরূপ আপত্তি থাকার কথা ছিল না এবং সফল হওয়ার কথা ছিল পরিপূর্ণভাবে। কিন্তু ইতালির কৃত্রিম রাজনীতিতে সবকিছু নির্ভর করত খেলোয়াড়ের দক্ষতার উপর। কনডেটরি শুধু তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং যে কোনো উপায়ে তাদের বিতাড়িত করার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। অরসিনি ওভিটেলজদের পরাজয়ের পর কোনো দল বা স্বার্থ অবশিষ্ট ছিল না, যার ক্ষতিসাধন করা যেত। জেনারেলদের অনুগত থাকাকালীন কনডেটরির সৈন্যরা দুর্দমনীয় ছিল। যখন জেনারেলরা অপসারিত হলেন তখন সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে অন্য কাজে ঢুকে পড়ল। এবং….অনেকেই এ ব্যাপারে সিজারের দুশ্চিন্তাহীন শান্ত মেজাজের প্রশংসা করেন … প্রচলিত নৈতিকতায় কোনো প্রকার ক্ষতি সাধন করা হলো না। …. মেকিয়াভেলির প্রতি সিজারের মন্তব্য যথেষ্ট মনে করে গ্রহণ করেছে ইতালির অধিকাংশ মানুষই : যারা নিজেদের পটু প্রতারক হিসেবে প্রদর্শন করে তাদের প্রতারণা করাই শ্রেয়। সফলতার দ্বারাই সিজারের আচরণ বিচার্য।

প্রাচীন গ্রিসের মতোই রেনেসাঁ ইতালিতে সংমিশ্রণ ঘটেছিল উচ্চতর সভ্যতার সঙ্গে নিম্নতর নৈতিকতার। উভয় যুগেই প্রদর্শিত হয় শীর্ষস্থানীয় প্রতিভা ও সর্বনিম্ন নীতিহীনতা। কোনোরূপ শত্রুতা ছিল না প্রতিভাধর ও নীতিবিবর্জিত ব্যক্তিদের মধ্যে। সিজার বর্গীয়ার জন্য দুর্গ তৈরি করেছিলেন লিওনাদ। সক্রেটিসের কিছু ছাত্র ত্রিশ অত্যাচারীর ভেতর সবচেয়ে খারাপ ছিল। প্লেটোর ছাত্ররা সাইরেকিউসে লজ্জাজনক কাজে যুক্ত ছিল এবং এরিস্টটল বিয়ে করেছিলেন এক অত্যাচারীর ভগিনীকে। উভয় যুগেই শিল্পের চর্চা হয় এবং পরে দেড়শ বছরব্যাপী সাহিত্য ও হত্যা পাশাপাশি উৎকর্ষ লাভ করে। উত্তর পশ্চিমের কম সভ্য অথচ অধিক সঙ্গতিপূর্ণ জাতীয়তার দ্বারা সব নিঃশেষ হয়ে যায়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লুপ্ত হওয়ার সাথে উভয় ক্ষেত্রেই শুধু সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ই জড়িত ছিল না, বরং জড়িত ছিল বাণিজ্যিক প্রভুত্বের অবলুপ্তি ও সর্বনাশা দারিদ্র্যও।

নগ্ন ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। সাধারণত এগুলো বিলুপ্ত হয় তিনটির যে কোনো একটি পন্থায়। প্রথমত বিদেশিদের বিজয়ের মাধ্যমে; গ্রিস ও ইতালির ঘটনাবলি, দ্বিতীয়ত একটি স্থিতিশীল একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যা প্রথাগত হয়ে পড়ে শিগগিরই। মেরিয়াস থেকে এন্তনির পরাজয় পর্যন্ত স্থায়ী গৃহযুদ্ধের পর অগাস্টাসের সাম্রাজ্য হচ্ছে এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। তৃতীয়ত হচ্ছে একটি ধর্মের উত্থান। এর স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যে পন্থায় মোহাম্মদ (সাঃ) পূর্ববর্তী বিবদমান আরব সম্প্রদায়গুলোকে একত্রিত করেছিলেন। রাশিয়ায় রফতানিযোগ্য খাদ্য পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মহাযুদ্ধের পর ইউরোপব্যাপী কমিউনিজম গ্রহণের মাধ্যমে নগ্ন ক্ষমতার রাজত্ব শেষ হয়ে যেত।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই নয় শুধু, বরং সরকার পরিচালনায় একটি রাষ্ট্রের যেখানে নগ্ন ক্ষমতা বিরাজমান, সেখানে ক্ষমতা অর্জন অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে নিষ্ঠুর। মেকিয়াভেলি এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ নেয়া যেতে পারে ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সময় সিজার বর্গীয়ার প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার প্রশংসাসূচক বর্ণনা।

তিনি কাজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন চারটি পন্থায়। প্রথমত, তাদের দ্বারা লুণ্ঠিত প্রভুদের পরিবারবর্গেল শোষণের মাধ্যমে যাতে পোপের কাছ থেকে এ যুক্তি নেয়া যায়। দ্বিতীয়ত, রোমের ভদ্রলোকদের সমর্থন আদায় করে তাতে তাদের সাহায্য নিয়ে পোপকে দমন করা যায়। তৃতীয়ত, কলেজকে নিজের সুবিধায় এনে। চতুর্থত, পোপের মৃত্যুর আগে প্রভূত ক্ষমতা অর্জন করে যাতে তিনি ক্ষমতাবলে প্রথমত আঘাত রোধ করতে পারেন-এ চারটির তিনটি তিনি পূর্ণ করেন আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগে। কারণ তিনি হত্যা করেছিলেন তার নাগালের ভেতর বেদখলকৃত জমিদারদের। পালাতে সক্ষম হয়েছিল শুধু অল্প কয়েকজন।

যে কোনো সময় অনুসরণ করা যায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পন্থা। কিন্তু প্রথমটি জনমতকে ব্যথিত করে প্রতিষ্ঠিত সরকার থাকাকালীন। একজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার বিরোধী নেতাকে হত্যা করে নিজের অবস্থান সংহত করতে পারবেন না। কিন্তু যেখানে নগ্ন ক্ষমতা বিদ্যমান সেখানে নিষ্ক্রিয় এ রকম নৈতিক বাধা।

জনসাধারণ যখন কোনো ক্ষমতার প্রতি ক্ষমতার কারণেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তখন তা-ই নগ্ন ক্ষমতায় পরিণত হয়। এভাবে চলে আসা ঐতিহ্যগত ক্ষমতার ঐতিহ্য গ্রহণযোগ্য না হলে তা নগ্ন ক্ষমতায় পরিণত হয়। এভাবে নগ্ন ক্ষমতায় পরিণত হয় যুক্ত চিন্তা ও তীব্র সমালোচনা। গ্রিস ও রেনেসাঁ ইতালিতে তা ঘটে থাকে। প্লেটো নগ্ন ক্ষমতার যথাযথ উপস্থাপন করেন রিপাবলিকের প্রথম বইয়ে। থ্রাসিমেকাস ন্যায়-নীতিগত সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টায়রত সক্রেটিসের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছেন, আমার মতে ন্যায়ের অর্থ হচ্ছে শক্তিমানের স্বার্থ রক্ষা করা।

প্রত্যেক সরকারই আইন রচনা করে তার স্বার্থ রক্ষার্থে। গণতান্ত্রিক আইন রচনা করে একটি গণতান্ত্রিক সরকার। একটি স্বৈরশাসক স্বৈরতান্ত্রিক আইন রচনা করে। অন্যান্য আইনও অনুরূপভাবেই রচিত হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে এখনকার সরকারগুলো ঘোষণা করেছে যে, তাদের স্বার্থই প্রজাদের স্বার্থ এবং যে-ই তা থেকে বিচ্যুত হয় সে-ই অবৈধ বা অন্যায় আচরণের জন্য অভিযুক্ত হয়ে বেত্রাঘাতপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং হে মহাশয়, আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, প্রত্যেক শহরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের স্বার্থ রক্ষাই ন্যায়। আমি মনে করি উন্নত যুক্তি পাওয়া যাবে সরকারের পক্ষে। সুতরাং সঠিক যুক্তির সিদ্ধান্ত একই জিনিস যে, সর্বত্র শক্তিমানের স্বার্থ রক্ষাই ন্যায়।

সাধারণভাবে যখন এমন দৃষ্টিভঙ্গি গৃহীত হয় তখন শাসক তার নৈতিক বিপত্তির অধীনে থাকে না। কারণ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য তারা যা কিছু করে তাতে অত্যাচারিত ছাড়া কেউই ব্যথিত হয় না। বিদ্রোহীদের দমনে উৎসাহ যোগায় শুধু অকৃতকার্য হওয়ার ভয়ই। নির্মম উপায়ে সফলতার সম্ভাবনা থাকলে তাদের ভয় করার প্রয়োজন নেই যে, এই নির্মমতাই তাদের অপ্রিয় করে তোলে।

থ্রাসিমেকাসের মতবাদ যেখানে সাধারণভাবে গৃহীত হয়, সেখানে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল সরকারের ইচ্ছাধীন শক্তির উপর। এভাবে তা অপরিহার্য করে তোলে সামরিক শাসন। সমাজে বিরাজমান বিশ্বাস যদি বিদ্যমান ক্ষমতা বন্টনের প্রতি জনমনে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করে তবেই সেখানকার সরকার স্থিতিশীলতা পেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সব বিশ্বাস স্বাভাবিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনার মুখে টিকে থাকতে পারে না। সাধারণের সম্পত্তিসহ বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল রাজকীয় পরিবার, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, ধনিকশ্রেণি, স্ত্রীলোকদের বিপরীতে পুরুষদের এবং অন্যান্য জাতির বিপরীতে শ্বেতকায় জাতির মানুষের হাতে। কিন্তু এ জাতীয় সীমাবদ্ধতা বুদ্ধিবৃত্তি প্রসারের ফলে অগ্রাহ্য করা হয়ে থাকে এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা হয় ক্ষমতা ছেড়ে দেন নতুবা বাধ্য হন নগ্ন ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে। সাধারণের সম্পত্তি লাভের জন্য সুশৃঙ্খলভাবে সরকারকে অবশ্যই যুক্তি-পরামর্শের একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে, যাতে মানবজাতির অধিকাংশ লোকই একমত হতে পারে গ্রাসিমেকাসের মতবাদ ছাড়া অন্য মতবাদের উপর।

পরবর্তী অধ্যায় পর্যন্ত আমি মূলতবি রাখব সরকার গঠনের জন্য সাধারণের সম্মতি আদায় সংক্রান্ত কুসংস্কার ছাড়া অন্যান্য পন্থার আলোচনা। কিন্তু এ পর্যায়ে কিছু প্রাথমিক মন্তব্য যথাযথ হবে। প্রথমত, সমস্যা সমাধানের অযোগ্য নয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে তা সমাধান করা হয়েছে। (ব্রিটেনে তা সমাধান করা হয়েছে বলা মুশকিল, কারণ ব্রিটিশ স্থিতিশীলতায় রাজসিংহাসনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি অপরিহার্য উপাদান।) দ্বিতীয়ত, বুঝতে হবে সুশৃঙ্খল সামজের সুবিধাদি। সাংবিধানিক উপায়ে তা তেজোদীপ্ত ব্যক্তিদের ধনী ও ক্ষমতাশীল হওয়ার সুযোগ দেবে। যে সমাজে তেজোদীপ্ত ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ শ্রেণি আশানুরূপ বৃত্তিলাভে বঞ্চিত হয়, সে সমাজের অস্থিতিশীলতায় একটি উপাদান বিদ্যমান। ফলে সে সমাজে বিদ্রোহ দেখা দেয় যে কোনো সময়। তৃতীয়ত, শৃঙ্খলার স্বার্থে কতক সামাজিক রীতিনীতি উদ্দেশ্য মূলকভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন; কিন্তু তা ব্যাপক বিরোধিতা সৃষ্টির মতো এত নিদারুণ অন্যায়মূলক হবে না। এ রীতি একবার সফল হলে শিগগিরই ঐতিহ্যগত হয়ে পড়ে এবং লাভ করে ঐতিহ্যগত সর্বপ্রকার শক্তি।

সামাজিক চুক্তি নামক রুশোর বইটি আধুনিক পাঠকের কাছে তত বৈপ্লবিক মনে হয় না। কিন্তু তা সরকারের কাছে কেন এত বেদনাদায়ক বোঝা মুশকিল। আমার মতে এর প্রধান কারণ হলো তা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে গৃহীত রীতির উপর সরকারি ক্ষমতার ভিত্তি অন্বেষণ করে–তবে রাজার প্রতি কুসংস্কারমূলক শ্রদ্ধার উপর নয়। বিশ্বব্যাপী রুশোর মতবাদের প্রভাব থেকে দেখা যায় যে, সরকারের সংস্কারমুলক ভিত্তির ব্যাপারে মানুষকে একমত হতে উদ্বুদ্ধ করা কঠিন। হয়তো তা সম্ভব নয় কুসংস্কার সহসা দূরীভূত হলে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হিসেবে স্বেচ্ছাকৃত সহযোগিতার জন্য কিছু অনুশীলন দরকার হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণ সমর্থন হারিয়ে ফেললে ঐতিহ্যগত শাসনের অধীন তা অসম্ভব এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে বিপ্লবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। সুশৃঙ্খল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব মুক্তবুদ্ধিচর্চার সঙ্গে সুসঙ্গত হলেও তা সমাধান করতে হবে সমস্যাটি কঠিন হওয়া সত্ত্বেও।

কখনও কখনও ভুল অর্থে এ সমস্যার প্রকৃতি গৃহীত হয়ে থাকে। এ ধরনের একটি সরকার কল্পনা করা যথেষ্ট নয় যা একজন তাত্ত্বিকের কাছে বিদ্রোহাত্মক মনোভাব সৃষ্টিতে সহায়ক বলে মনে হয় না। বাস্তবে একটি সরকার গঠন করা জরুরি এবং গঠিত হলে বিপ্লব রোধকল্পে প্রয়োজনীয় আনুগত্য লাভে সমর্থ হবে। তা হচ্ছে, বাস্তব রাষ্ট্র শাসনমূলক সমস্যা এবং এতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জনসাধারণের সর্বপ্রকার বিশ্বাস ও পূর্ব ধারণা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এমন অনেকে বিশ্বাস করে যে, কোনো জনসমষ্টি একবার রাষ্ট্রীয় সংগঠন যন্ত্র দখল করতে পারলে প্রচারণার মাধ্যমে জনসমর্থন লাভ করতে পারবে। যা হোক, এ মতবাদের রয়েছে স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা। জাতীয় অনুভূতির বিরোধী হওয়ার জন্য অধুনা রাষ্ট্রীয় প্রচারণা ভারতে এবং (১৯২১ সালের আগে) আয়ারল্যান্ডে অচল প্রমাণিত হয়েছে। প্রবল ধর্মীয় অনুভূতির বিরোধী হওয়ার জন্য অধুনা রাষ্ট্রীয় প্রচারণা ভারতে এবং (১৯২১ সালের আগে) আয়ারল্যান্ডে অচল প্রমাণিত হয়েছে। প্রবল ধর্মীয় অনুভূতির বিরোধী হয়ে টিকে থাকা কঠিন। এখনও এ ব্যাপারটি সন্দেহজনক যে, তা কত দূর অধিকাংশ লোকের ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে। স্বীকার করতেই হবে যে, ক্রমাগতভাবে অধিকতর ফলপ্রসূ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা। সুতরাং সরকারের পক্ষে সহজ হচ্ছে সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করা। পরবর্তী পর্যায়ে আরও পূর্ণতার সাথে আমাদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো আলোচিত হবে। এখন শুধু এগুলো মনে রাখা দরকার।

আমি এ পর্যন্ত আলোচনা করেছি রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্ক। কিন্তু অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নগ্ন ক্ষমতা সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসমনে করেন ভবিষ্যতে সমাজতান্ত্রিক সম্প্রদায় ছাড়া সর্বত্রই সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে নগ্ন ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। ঐতিহাসিক হেলভি বেনথেইজমে একদা বলেছেন যে, যে ব্যক্তি তার কাজের মূল্য যতটুকু ধারণা করে তা-ই পেয়ে থাকে। আমি নিশ্চিত এটি সত্য নয় গ্রন্থাকারদের বেলায়। আমার বেলা আমি দেখেছি যে, যে বই আমার কাছে যত বেশি মূল্যবান মনে হয়েছে তার জন্য আমাকে তত কম মূল্য দেয়া হয়েছে। যদি সফল ব্যবসায়ী প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করেন যে, তাদের কাজ উপার্জিত অর্থের সমমূল্যমানের তাহলে তারা অবশ্যই অনুমিত স্তর অপেক্ষাও নিম্নস্তরের মূর্খ হবেন। তা সত্ত্বেও সত্যের উপাদান রয়েছে হেলভির তত্ত্বে। একটি স্থিতিশীল সমাজে তীব্র অন্যায় অনুভূতিসম্পন্ন বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ থাকতে পারে না। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে, যে সমাজে অসন্তুষ্টি ব্যাপক নয় সে সমাজে অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে তারা পাইকারিভাবে বিনা বেতনে রয়েছে। যে অনুন্নত সমাজে চুক্তি নয় বরং মর্যাদার উপরই জীবিকা নির্ভর করে সে সমাজে প্রথাগত সবকিছুই তিনি ন্যায়সঙ্গত মনে করেন। কিন্তু তখনও হেলভির ফর্মুলা কার্যকারণকে উল্টিয়ে দেয়। ন্যায়সঙ্গত অনুভূতিই প্রথার কারণ, কিন্তু প্রযোজ্য নয় বিপরীতটি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রথাগত যখন পুরনো প্রথাগুলো পুরোপুরি বদলে যায় শুধু তখনই তা নগ্ন ক্ষমতায় পর্যবসিত হয় অথবা, কোনো কারণে পরিণত হয়। সমালোচনায়।

মজুরি নির্ধারণের কোনো রীতি প্রচলিত ছিল না। শিল্পায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে এবং চাকরিজীবীরা সংগঠিত হয়নি তখনও। ফলে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সীমারেখার ভেতর শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নগ্ন হয়ে পড়ে। গোঁড়া অর্থনীতিবিদরা মনে করতেন, অদক্ষ শ্রমিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে রাখাই যে এর কারণ তা তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।

কিছুক্ষেত্রে তা স্পষ্ট। দস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত দ্রব্য অথবা বিজিত জাতির কাছ থেকে বিজয়ীদের দ্বারা দখল করা সম্পদ নগ্ন ক্ষমতার বিষয়। এভাবে দাসত্ব ও নগ্ন ক্ষমতার বিষয় দাস অভ্যাস সত্ত্বেও তা নীরবে মেনে নেয় না। মাকর্স দেখতে পান যে, প্রশ্নটি ক্ষমতা সম্পর্কিত। কিন্তু আমি মনে করি যে, তিনি গৌণ করে দেখেছেন অর্থনৈতিক ক্ষমতার সাপেক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা। ট্রেড ইউনিয়নগুলো যথেষ্ট অবদান রাখতে পারত শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। কিন্তু কার্যত ক্ষমতা ছাড়া এগুলো অচল হয়ে পড়ে। এক রাশ আইন অচল হয়ে যেত ইংল্যান্ডে, কিন্তু তা ঘটেনি, কারণ ১৯৬৮ সালে ভোটাধিকার লাভ করে শহরে শ্রমিকরা। ট্রেড ইউনিয়ন (সংগঠন) থাকায় মজুরি আর নগ্ন ক্ষমতার দ্বারা নয় বরং পণ্য কেনা-বেচার মতো দর কষাকষির দ্বারা স্থির হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মার্কসের প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়ার আগে নগ্ন ক্ষমতার ভূমিকা ধারণাতীতভাবে বেশি ছিল। দস্যু কর্তৃক ভাগ্যহতের কাছ থেকে জোরপূর্বক দখল করা দ্রব্য অথবা বিজিত জাতির কাছ থেকে বিজয়ী কর্তৃক সম্পদ অর্জনের মতো তা নগ্ন ক্ষমতার বিষয়। এভাবে দাসত্বের বিষয়টি, যখন দাস কর্তৃক অভ্যাস সত্ত্বেও তা নীরবে মেনে নেয় না। আদায়কারীর প্রতি ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও যদি অর্থ সংগ্রহ জরুরি হয়ে পড়ে তবে নগ্ন ক্ষমতার মাধ্যমেই তা জোরপূর্বক আদায় করা হয়। দুটো ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘৃণা বিদ্যমান : একটি হচ্ছে যেখানে অর্থ প্রদান প্রথাগত নয় এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে প্রথাগত ব্যাপার অন্যায় বলে গৃহীত হয়। আগের দিনগুলোতে পুরুষরা স্ত্রীর সম্পত্তির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকার রাখত, কিন্তু নারী আন্দোলন এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উদ্রেক এবং পরিবর্তন ঘটায় আইনের ক্ষেত্রে। আগে শ্রমিকের দুর্ঘটনার দায়িত্ব বহন করত না মালিক। কিন্তু এখানেও পরিবর্তন ঘটেছে দৃষ্টিভঙ্গির এবং প্রবর্তিত হয়েছে এ সম্পর্কিত আইনও। এ ধরনের দৃষ্টান্ত সংখ্যায় অনেক।

একজন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক মনে করতে পারে যে মালিকের চেয়ে তার আয় কম হওয়া অন্যায়। নগ্ন ক্ষমতাই এ ধরনের ক্ষেত্রে তাকে মেনে নিতে বাধ্য করে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পুরনো পদ্ধতি প্রথাগত এবং তাতে আপনা আপনি ঘৃণার উদ্রেক হয় না। ব্যতিক্রম শুধু তাদের ক্ষেত্রে, যারা প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে রত। সমাজতান্ত্রিক মনোভাব বৃদ্ধি পেলে পুঁজিবাদী শক্তি আরও বেশি নগ্ন হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারটি ক্যাথলিক চার্চ এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের সম্পর্কের অনুরূপ। আমরা দেখেছি যে, নগ্ন ক্ষমতার কিছু অশুভ দিক রয়েছে সর্মথন লাভকারীর ক্ষমতার বিপরীতে : পরিণামে ভয়ের মাধ্যমে নির্মমতা প্রশমিত না হলে সমাজতান্ত্রিক মনোভাব বৃদ্ধির ফলে পুঁজিবাদী শক্তি আরও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। মার্কসীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সমাজে যদি শ্রমিকই সমাজতন্ত্রী হয় এবং বাকি সবাই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারক হয় তারপরও বিজয়ী যে কোনো দল তাদের বিরোধীদের উপর নগ্ন ক্ষমতা প্রয়োগ না করে পারে না। মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী অবস্থা বড়ই নাজুক। যে পর্যন্ত তার শিষ্যদের প্রচার সফল হয়েছে তাতে তা ঘটবেই।

মানব ইতিহাসের জঘন্য বিষয়গুলোর অধিকাংশই নগ্ন ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত-শুধু যুদ্ধের বিষয়গুলোই নয়, বরং অন্যগুলো কম দৃষ্টিগোচর হলেও সমভাবে ভয়ংকর। দাসত্ব ও দাস বেচা-কেনা, কংগোর শোষণ, প্রাথমিক শিল্পায়নের ভয়াবহতা, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, বিচারবিভাগীয় অনাচার অপরাধ আইন, জেল, কর্মশালা, ধর্মীয় অত্যাচার, ইহুদিদের নির্দয় চপলতা, বর্তমানে জার্মান ও রাশিয়ায় অবিশ্বাস্য রকম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অন্যায় আচরণ–এগুলো হচ্ছে অসহায়দের প্রতি নগ্ন ক্ষমতা।

এক সময় নগ্ন হতে বাধ্য ঐতিহ্যের অভ্যন্তরে প্রোথিত অনেক অন্যায় ক্ষমতা। খ্রিস্টান স্ত্রীরা অনেক শতাব্দী ধরে তাদের স্বামীদের মেনে চলত, কারণ সেন্ট পল বলেছিলেন, তা-ই করা উচিত। কিন্তু সেন্ট পলের মতবাদ সাধারণভাবে মহিলা সমাজে গৃহীত হওয়ার আগে পুরুষদের অসুবিধাগুলোর কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জেনস ও মেডিয়ার গল্পে।

ক্ষমতা থাকবে সরকার অথবা অরাজক দুঃসাহসিকদের। সমাজে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী অথবা সাধারণ অপরাধী থাকলে নগ্ন ক্ষমতা অবশ্যই থাকবে। বাধাগ্রস্ত একঘেয়ে দুঃখের চেয়ে ভালো কিছু পেতে হলে মানবজাতিকে সম্ভাব্য ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হবে নগ্ন ক্ষমতা। আইন ও প্রথার মাধ্যমে ক্ষমতার লালন একান্ত প্রয়োজন অনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রণাদানের চেয়ে ভালো কিছু পেতে হলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *