১৫. বিবাহ-বিচ্ছেদ

১৫. বিবাহ-বিচ্ছেদ

বিভিন্ন কারণে বিচ্ছেদকে এক স্বীকৃত সংগঠনরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে অধিকাংশ দেশ ও সময়। অবশ্য এই ব্যবস্থা কখনও এক-পত্মীকেন্দ্রিক পরিবারের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এই ব্যবস্থা ক্রমে বিশেষ কারণ সাপেক্ষে অত্যাচারের অবলুপ্তি ঘটানোর প্রয়াস করা হয়েছে মাত্র। বিশেষ করে যেখানে বিবাহ ব্যবস্থাকে অসহনীয় বলে মনে হয়।

বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইনটি নানা দেশে নানা সময় পরস্পরের মধ্যে অসাধারণ বৈসাদৃশ্য প্রকাশ করেছে। এমন কি বর্তমান কালেও ইউনাইটেড স্টেটসে এই বৈপরীত্য দেখা যায়। সাউথ ক্যারোলিনাতে বিচ্ছেদের অস্বীকৃতি জনিত চরম অবস্থা বিদ্যমান এবং নেভাডানোতে বিপরীত অবস্থা। অনেক অ-খ্রিস্টিয় সভ্যতায় পরিলক্ষিত হয়েছে যে, স্বামীর ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের ব্যাপারটি সহজেই প্রাপ্তব্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি স্ত্রীর কাছেও সহজলভ্য।

মোসেইক আইন স্বামীকে বিচ্ছেদ সংক্রান্ত ঘোষণা করার অধিকার দিয়েছে। চীনা আইন এমন নিয়ম প্রণয়ন করেছে যার দ্বারা বিচ্ছেদ প্রাপ্তা স্ত্রী তার বৈবাহিক সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে। যেহেতু ক্যাথলিক চার্চ এই ধারণা পোষণ করে যে, বিবাহ হলো এক পবিত্র অঙ্গীকার, তাই তারা কোনো কারণে বিচ্ছেদের অনুমতি দেয় না। কিন্তু বাস্তবে এই কঠিনত্ব অনেকাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে বিশ্ব জনসমষ্টির অধিকাংশ মানুষের ভাগ্য জড়িত সেখানে আইনের অকার্যকারিতার অনেক কারণ আছে।

নেভাদাতে যে আইন আছে তার দ্বারা স্বেচ্ছাধীন উদাসীনতা, ঘৃণিত অপরাধ, স্বভাব স্বাধীন মদ্যপান, বিবাহের সময় থেকে শুরু করে বিচ্ছেদের সময় অবধি ধারাবাহিক পুরুষত্বহীনতা, অতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা, বছরব্যাপী অত্যাচার, দুবছরের উন্মাদ অবস্থা, ইত্যাদিতে বিচ্ছেদ হতে পারে।

খ্রিস্টান দেশগুলিতে দেখা গেছে যে, প্রোটেস্ট্যানটিজমদের মধ্যে বিচ্ছেদের প্রতি আগ্রহের আধিক্য বেশি। সকলেই অবগত আছে যে মিলটন যেহেতু প্রোটেস্ট্যান্ট ছিলেন তাই তিনি বিচ্ছেদের স্বপক্ষে মতপ্রকাশ করে গেছেন। ইংলিশ চার্চ যে যুগে নিজেকে প্রোটেস্ট্যান্টরূপে বিবেচনা করতো তখন তারা চরিত্রহীনতার অভিযোগে বিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু অন্য কোনো কারণে এর স্বীকৃতি মেলে নি।

বর্তমানে ইংল্যান্ডের গীর্জাসমূহে বসবাসকারি ধর্মযাজকদের অধিকাংশই যেকোনো প্রকার বিচ্ছেদের বিরোধী। স্ক্যানডিনেভিয়াতে অতি সহজ বিচ্ছেদ আইন আছে। আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান্ট অঞ্চলের বিচ্ছেদ আইন অত্যন্ত সাধারণ। ইংল্যান্ডের চেয়ে স্কটল্যান্ড এ ব্যাপারে উদারতা অবলম্বন করেছে। ফরাসি দেশে অ ধর্মীয় মনোভাব সহজ বিচ্ছেদকে স্বীকার করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেকোন পক্ষের অনুরোধে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু চরিত্রহীনতা অথবা অবৈধত্বের সঙ্গে সামাজিক অথবা আইনগত শাস্তি প্রদানের বিষয়গুলি সংযুক্ত হয় নি। যেসব শ্রেণির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় আছে তাদের কথা আলোচনা করে বলা যায় যে, রাশিয়াতে বিবাহ তার গুরুত্ব যতটা হারিয়েছে অন্যত্র ততটা হারায় নি।

বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আলোচনায় যে ব্যাপারটি আমাদের অত্যন্ত চমৎকৃত করে তা হলো আইন ও প্রথার মধ্যে বিদ্যমান বৈসাদৃশ্য। সহজতম বিচ্ছেদ আইনগুলি কিন্তু সর্বদা বৃহত্তম সংখ্যক বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে না। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত চীন দেশে বিচ্ছেদের ঘটনা ছিল প্রায় অজানা। এবং কনফুসিয়াসের উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এই ব্যাপারটিকে যথেষ্ট সম্মানের গণ্য করা হয় নি।

সুইডেন পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রযুক্ত বিচ্ছেদের অনুমতি দিয়েছে, যেটিকে আমেরিকার কোনো রাষ্ট্র স্বীকৃত কারণ রূপে গ্রহণ করে নি।

১৯২৩ সালে আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সুইডেনের মধ্যে বিচ্ছেদের তুলনামূলক পরিসংখ্যান গ্রহণ করেছিলাম। প্রতি এক লক্ষ মানুষ হিসেবে সুইডেনে চব্বিশটি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ইউনাইটেড স্টেটসের ক্ষেত্রে সম জনসংখ্যায় এই সংখ্যা একশো ছত্রিশ। আমার মনে হয় এই বিভিন্নতার অন্তরালে আইন ও প্রথার মধ্যে ক্রিয়াশীল বৈসাদৃশ্য অবস্থান করছে। কখনো আমার মনে হয়েছে যে, এ ব্যাপারে সহজ আইন থাকা উচিত, আবার কখনো আমি ভেবেছি, যেহেতু দ্বিভিত্তিক পরিবারের অবস্থিতিতেই প্রথা বিচ্ছেদকে বিরোধী যুক্তি আহরণে আগ্রহী। অবশ্য কয়েকটি চরম অবস্থায় সে বিচ্ছেদকে সমর্থন করেছি।

আমি যে এই মনোভাব পোষণ করি তার অন্যতম কারণ হলো, বিবাহকে আমি মূলত এক যৌন অংশগ্রহণরূপে বিবেচনা করি না। আমার মনে হয় তা হলো সন্তান উৎপাদন ও সন্তান পরিচর্যার সহানুভূতিসম্পন্ন ব্রত। আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে দেখেছি যে–এমনটি সম্ভব। হয়তো বা সুনিশ্চিত এমনভাবে উপলব্ধ বিবাহ শক্তির প্রভাবে ভেঙ্গে যেতে পারে। যার মধ্যে অর্থনৈতিক কারণটি হলো প্রধান। কিন্তু যদি তা ঘটে, তাহলে বিচ্ছেদও ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। কেননা বিচ্ছেদ হলো এমন এক সংজ্ঞা যা বিবাহের স্থায়িত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং যা বিবাহ ব্যবস্থাকে নিরাপদ আশ্রয়রূপে বিবেচনা করে।

এই কারণে আমাদের বর্তমান আলোচনাকে আমরা দ্বিভিত্তিক পরিবারের গঠনতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো।

প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক উভয়েই, সাধারণভাবে বিচ্ছেদকে পরিবারের জৈবিক কারণকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা না করে তাকে পাপবোধ সংক্রান্ত তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছে, যেহেতু,ক্যাথলিকরা বিবাহকে ঈশ্বরবোধে উদ্বুদ্ধ অচ্ছেদ্য বন্ধনরূপে মনে করে, তাই তাদের ধারণা হলো এই যে, যদি দুই মানব মানবী একবার বিবাহিত হয়, তাহলে তাদের মধ্যে কেউ একজন অন্যের জীবিত অবস্থায়, অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে পাপহীন সহবাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, বিবাহের ওপর এই ঘটনার যেকোনো প্রভাব পড় ক না কেন।

প্রোটেস্ট্যান্টরা যে বিচ্ছেদের স্বপক্ষে মতপ্রকাশ করেছে তার অনেকগুলি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, তারা বিবাহের পবিত্রতা সংক্রান্ত ক্যাথলিক ভাবাদর্শের বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক; দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে,বিবাহের অচ্ছেদ্যতা চরিত্রহীনতার অন্যতম কারণ; এবং তৃতীয়ত,তারা আরো বিশ্বাস করে যে, সহজ বিচ্ছেদ ব্যবস্থা চরিত্রহীনতার ঘটনাকে কমিয়ে দেবে।

একজন সহজেই দেখতে পাবে, যে সমস্ত প্রোটেস্ট্যান্টদের বিবাহকে সহজে ভেঙ্গে ফেলা যায় যেখানে লাম্পট্যকে চরম ঘৃণা সহকারে নিরুপণ করা হয়। কিন্তু যেসব দেশে সহজে বিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দেয় নি সেখানে লাম্পট্যকে ঘৃণিত করা হলেও তাকে উপেক্ষা করা হয়, বিশেষ করে যদি তার মধ্যে পুরুষজাতি জড়িয়ে থাকে।

জারের রাশিয়াতে বিচ্ছেদ ছিল অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। আমরা গোর্কির ব্যক্তিগত জীবনের অসৎ দিনগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত, অবশ্য তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন অভিমত থাকতে পারে। বিপরীত পক্ষে আমেরিকার কেউ তাঁর রাষ্ট্রভাবনাকে আঘাত করে নি কিন্তু নৈতিকতার বিচারে তাঁকে ধিকৃত করা হয়েছিল; এবং কোনো পান্থনিবাস তাঁকে একটি রাত্রির জন্যেও থাকতে দেয় নি। প্রোটেস্ট্যান্ট অথবা ক্যাথলিক ধ্যানধারণাকে যুক্তিসঙ্গত কারণে অস্বীকার করা অসম্ভব। আমরা ক্যাথলিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করবো। ধরাযাক, বিবাহের পরে স্বামী অথবা স্ত্রী উন্মাদ হয়ে গেল। এই অবস্থায় যাতে আর সন্তান উৎপাদন না হয় তা দেখা উচিত। আরো নজর রাখতে হবে যে, ইতিপূর্বে জাত শিশু যেন উন্মাদনার সংস্পর্শে না আসে। সন্তানদের কথা বিবেচনা করে পিতামাতার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ সাধন করা অবশ্য কর্তব্য। এমনকি যদিও উন্মাদ অবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী অথবা ক্ষণস্থায়ীভাবে সুস্থ হতে দেখা যায় তাহলেও এই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধি সম্পন্ন বৈবাহিক অংশীদার যেন ভবিষ্যতে আর কোনো আইন স্বীকৃত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে। তা হলে সেটি হবে এক চরম নিষ্ঠুর শাস্তি। তার সার্বজনীন কারণ যতই মহান হোক না কেন সল্লুদ্ধিসম্পন্ন অংশীদারকে বিষাদপূর্ণ নির্বাসনের মধ্যে রাখা হয়। সে হয়তো সংযমের স্বপক্ষে মতপ্রকাশ করবে, একে সমর্থন করবে আইন এবং সাধারণ নৈতিকতা অথবা সে হয়তো সহজাত সম্পর্ক স্থাপন করবে যার ফলে সন্তান উৎপাদিত হবে না। সে মুক্ত পাপে লিপ্ত হবে। এর ফলে সন্তানের জন্ম হোক, অথবা না হোক, তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।

এই তিনটি পদ্ধতির প্রতিটিতে সর্বনাশা বিরোধিতার বীজ সুপ্ত আছে। যে ব্যক্তি একবার বিবাহ দ্বারা যৌন অভিজ্ঞতায় অভ্যস্ত হয়েছে, তাকে যদি যৌন সহবাস থেকে সম্পূর্ণ নিবৃত্ত করা হয়, তাহলে তা হবে অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত পরিণতি। এই ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ অথবা নারীকে অকালে বৃদ্ধে পরিণত করে। অনেক সময় এর থেকে স্নায়বিক বিকৃতি দেখা দেয় এবং উভয় ক্ষেত্রে অসংযমী, উগ্র, বেপরোয়া মনোভাবাপন্ন চরিত্রের উৎপত্তি ঘটে।

পুরুষের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশি। কেননা এর ফলে পুরুষ তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হারিয়ে নিষ্ঠুরতাব্যঞ্জক কাজ করতে পারে। যদি সত্যিই তাকে এই কথা বলা হয় যে, বিবাহ ব্যতিত সকল প্রকার সহবাস ঘৃণিত, তাহলে সে সহবাসের অন্বেষণে মনুষ্যতের প্রাণীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে সমস্ত নৈতিক বিধিনিষেধকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করবে।

দ্বিতীয় বিকল্প ব্যবস্থাটি হলো গোপনীয় সন্তানহীন সম্পর্ক স্থাপন করা। এই ঘটনার প্রাবল্য দেখা যায় এবং এখন আমরা এটি আলোচনা করতে চলেছি। এর বিরুদ্ধেও অনেক সাংঘাতিক অভিযোগ আছে।

যা কিছু অসামাজিক, অবাঞ্ছিত এবং সন্তান উৎপাদনবিহীন তা সহজ সুন্দর জীবনের প্রতি আস্থাহীন। এ জাতীয় যৌন সম্পর্ককে সমর্থন করা অনুচিত। সর্বোপরি কোনো নারী অথবা পুরুষ তরুণ যদি বীর্যবান হয় তাহলে জাতীয় স্বার্থে তাকে বলা উচিত নয়– তোমায় আর সন্তান উৎপাদন করতে দেওয়া হবে না। অবশ্য জাতীয় স্বার্থে এমন কিছু বলা উচিত নয় যদিও বাস্তবে আইন সেই ঘোষণাই করছে) যতক্ষণ অবধি তুমি তোমার সন্তানদের জনক অথবা জননীরূপে এক উন্মাদকে নির্বাচন না করছো ততক্ষণ তুমি কোনো সন্তান উৎপাদনক করতে পারবে না।

তৃতীয় বিকল্পটি বেপরোয়া পাপের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করা। যদিও অর্থনৈতিক কারণে এই ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবসম্ভব, কিন্তু যদি সম্ভব হয়, তাহলে ব্যক্তিগত ও জাতিগত নিরাপত্তার কথা মনে রেখে একে সর্বাপেক্ষা কম ক্ষতিসাধনকারী ব্যবস্থারূপে অভিহিত করা যায়। যদি কোনো চিকিৎসক অথবা আইনজীবী মুক্তি পাপের মধ্যে জীবন কাটাতে চান তাহলে তিনি তাঁর সমস্ত রোগী অথবা খদ্দের হারাবেন। শিক্ষাদানের কাজে নিযুক্ত কোনো মানুষ যদি এ ব্যাপারে প্রবৃত্ত হন তাহলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর পদটি হারাবেন। যদি অর্থনৈতিক অবস্থাসমূহ মুক্ত পাপকে অসম্ভব না করে তাহলে অধিকাংশ মানুষ সামাজিক শাস্তির কথা মনে রেখে এ ব্যাপারে উৎসাহী হবে না। পুরুষরা সমষ্টিগতভাবে বাঁচতে ভালোবাসে এবং রমণিরা অন্য নারীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সান্নিধ্য পেতে চায়।

এই সমস্ত সুখানুভূতি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারে আপাতত চরম কঠিন কাজ রূপে মনে হয়। এর ফলে বিত্তবান, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং অন্যান্য মানুষ, যাদের জীবিকা যাদের জীবনকে কম-বেশি বোহেমিয়ান করেছে, তাছাড়া অন্য কেউ মুক্ত পাপের মধ্যে জীবন কাটাতে পারে না।

তাই দেখা গেছে, ইংল্যান্ডের মতো যে সমস্ত দেশ উন্মাদ অবস্থার পরিণতি স্বরূপ বিবাহ বিচ্ছেদকে অস্বীকার করে, সে দেশের যে নরনারী অথবা পুরুষের স্ত্রী অথবা স্বামী উন্মাদ হয়ে যায় তাকে অসহনীয় অবস্থায় রাখা হয়। তথাকথিত কুসংস্কার ছাড়া এর স্বপক্ষে আর কোনো যুক্তি নেই। উন্মাদ অবস্থার ক্ষেত্রে যে সত্যতা আছে, যৌন রোগ, স্বভাব সঞ্জাত অপরাধ এবং ধারাবাহিক মদ্যাসক্তির মধ্যে সেই একই সত্য বিদ্যমান। এইকারণগুলি বিবাহকে তার প্রতিটি অবস্থানে ধবংস করে। তারা সখ্যতাকে অসম্ভাব্য করে, উৎপাদনকে করে অবাঞ্ছিত, ইচ্ছা এবং অভিযুক্ত পিতামাতার সঙ্গে শিশুর সাহচর্যকে করে অনভিপ্রেত। এই সকল ক্ষেত্রে সেই কারণে বিচ্ছেদই হলো একমাত্র উপায়,যার সাহায্যে বিবাহ নামক ফাঁদটিকে অপসারিত করা যায়, যাকে বেদনা দ্বারা বিশুদ্ধ করার প্রবণতা ইদানিং প্রবল হয়ে উঠেছে।

সত্যের সঙ্গে সংযুক্তি থাকলে বিচ্ছিন্ন মনোভাবকে অবশ্যই বিচ্ছেদের অন্যতম কারণরূপে বিবেচিত করা যেতে পারে। এ রকম ক্ষেত্রে আইন বিচ্ছেদের অনুমতি দেয়। অবশ্য বিবাহ যে সমাপ্তিতে পরিণত হয়েছে তেমন প্রমাণ থাকা প্রয়োজন। আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বলা যায় যে, বিচ্ছিন্ন বোধটির সঙ্গে বিরক্তিসূচক সাযুজ্য সংযুক্ত, যদি একে বিচ্ছেদের কারণরূপে চিহ্নিত করা হয়,তাহলে এটি সেই কারণে পুনঃ প্রযুক্ত হবে এবং এর উপস্থিতির আধিক্য বেড়ে যাবে। এমনকি যখন এটিকে এই জাতীয় কারণরূপে বিবেচিত না করা হত, তখনকার চেয়ে এর উপস্থিতির হার বেশি হবে।

যে সমস্ত কারণসমূহ নিজেরাই বাস্তব, তাদের আলোচনার ক্ষেত্রে একই ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হয়। বহু বিবাহিত দম্পতির হৃদয়ে এমন কামনাময় আকাঙ্ক্ষা থাকে যার সাহায্যে তারা আইন দ্বারা অনুমোদিত যে কোনো বিষয় গ্রহণ করতে পারবে। পূর্বে ইংল্যান্ডে এই নিয়ম ছিল যে, একজন পুরুষের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও চরিত্রহীনতার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন মঞ্জুর করা হত। এমনকি স্বামী পরিচালকদের সামনে তার স্ত্রীকে যদি আঘাত করতো, তবে সেই আঘাতকে বিচ্ছেদের যথেষ্ট কারণরূপে বিবেচিত করা হত।

অবশ্য যেখানে উভয় পক্ষই বিচ্ছিন্ন হবার জন্য উদগ্র বাসনা পোষণ করে সেখানে আইনের সাহায্য নিয়ে পরস্পরের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটানো উচিত কাজ। কিন্তু আমরা যেন বাস্তব বুদ্ধি দ্বারা বিচ্ছেদের কারণগুলিকে বিশ্লেষিত করি এবং তার সাহায্যে সর্বাধিক বিবেচিত কারণটি অন্বেষণ করি। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মানুষ কি অবস্থায় এইসব কারণকে সৃষ্টি করেছে সেই অবস্থাগুলি নিরুপণ করতে হবে। আমরা এখন আইনগত অসুবিধাগুলিকে উপেক্ষা করে আমাদের আলোচনাকে শুধু সেই সব অবস্থাগত সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ করতে পারি যার দ্বারা আমরা বিবাহকে অবাঞ্ছিত করেছে এমন উৎসগুলির অন্বেষণ করতে পারবো।

আমার মনে হয়,একইভাবে চরিত্রহীনতাকে বিচ্ছেদের কারণরূপে চিহ্নিত করা অনুচিত। যদি আমাদের জীবনযাত্রাকে সুউচ্চ নৈতিক ভাবাদর্শ অথবা সুদীর্ঘ সাধনা অর্জিত সংযম দ্বারা সুচারুরূপে নিয়ন্ত্রিত না করি তবে উচ্ছলতার প্রতি আসক্ত না হয়ে জীবন অতিবাহিত করা নিঃসন্দেহে দুরুহ কাজ। কিন্তু এইসব প্রবণতা যেন কোনো অবস্থাতেই এমন শক্তিশালী না হয় যাতে বিবাহ তার উদ্দেশ্য হারায়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রবাহিত স্নেহস্রোত অক্ষুণ্ণ থাকা প্রয়োজন এবং বিবাহকে নিশ্চিত ধারাবাহিকতায় পরিণত করার বাস্তবসম্মত আকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত।

উদাহরণ স্বরূপ মনে করা যাক, ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে পুরুষকে দীর্ঘ কয়েক মাস বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। যদি সে শারীরিকভাবে সক্ষম হয় তাহলে, তার স্ত্রীর প্রতি সে যতই অনুরক্ত হোকনা কেন, সম্পূর্ণ নিরাসক্তির মধ্যে এই সময়টি অতিবাহিত করা কঠিন কাজ। তার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অবশ্য যদি সে ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতার বিশুদ্ধতার দ্বারা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন না হয়। এসব ক্ষেত্রে চরিত্রহীনতা পরবর্তী আনন্দবোধের ওপর প্রাচীর সৃষ্টি করতে পারে না এবং বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, যদি স্বামী ও স্ত্রী নাটকীয় বিদ্বেষ দ্বারা এই ব্যাপারটি অকারণে রঞ্জিত না করে তাহলে এর কোনো প্রভাব পড়ে না। আমরা আরো এক দাপ এগিয়ে গিয়ে বলতে পারি যে, উভয় পক্ষকে যেন এই জাতীয় ক্ষণস্থায়ী খেয়ালীপনার অনুমতি দেওয়া হয়। কেননা এই ঘটনাগুলি অবশ্যম্ভাবীভাবে সংঘটিত হবে কিন্তু অন্তর্বাহী স্নেহধারাটি যেন আগের মতো অটুট থাকে। ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতাবোধটি চরিত্রহীনতার মনস্তত্ত্বকে অকারণে মিথ্যা গণ্য করেছে। এই বোধ বিশ্বাস করে যে, এক বিবাহকেন্দ্রিক সমাজে একজন মানুষ একই সঙ্গে একজনের প্রতি আকর্ষণ এবং অন্যজনের প্রতি স্নেহবোধ করতে পারে না।

এই ব্যাপারটির অসত্যতা সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। কিন্তু হিংসাবোধের প্রবাহে সকলেই এই মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে ক্ষুদ্র জিনিসকে সুবৃহৎ করে তোলে। সেই কারণে চরিত্রহীনতাকে বিচ্ছেদের যথাযোগ্য কারণরূপে অভিহিত করা অনুচিত, অবশ্য যে ক্ষেত্রে এটি অন্যের ওপর অত্যাচার করে, স্বামী অথবা স্ত্রীর ওপর, তখন এর সম্পর্কে, আলাদা করে ভাবতে হবে।

এই মন্তব্য করার সময় আমি অবশ্যই বলতে চাই যে, অবৈধ সহবাস যেন সন্তান উৎপাদন না করে। যেখানে জারজ শিশুর প্রশ্ন এসে যায় সেখানে বিষয়টির ওপর আরোপিত হয় জটিলতা। বিশেষ করে যখন অবৈধ সন্তানের জন্মের পরও বিবাহ বজায় থাকে এবং এটি হয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান তাহলে স্বামীকে সামাজিক কলঙ্কবোধ কল্পে অন্যের ঔরসজাত পুত্রকে নিজের পুত্ররূপে বিবেচিত করতে হয়। এই ঘটনা বিবাহের জৈবিক ভিত্তির বিরুদ্ধে কাজ করে এবং অসহনীয় দুঃখ-যন্ত্রণার সৃষ্টি করে।

এই কারণে গর্ভনিরোধকের বহুল প্রচলনের পূর্বে চরিত্রহীনতাকে ধীকৃত করা হয়। কিন্তু গর্ভনিরোধকের ব্যাপক ব্যবহার বর্তমানে সন্তানবিহীন যৌনসহবাসকে সহজতর করে এমন অবস্থায় রূপান্তরিত করেছে যে, তার সঙ্গে উৎপাদনশীল মনোভাবাপন্ন বিবাহসঞ্জাত সহবাসের বৈসাদৃশ্য নিরূপণ করা শক্ত। ঐতিহ্যবাহী চেতনা উচ্ছলতাকে যতখানি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতো এখন ততটা গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই।

যে সমস্ত কারণে বিচ্ছেদকে অভিপ্রেত করা হয়েছে তা হলো দ্বিবিধ। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কোনো এক অংশীদারের ত্রুটি। হয়তো না উন্মাদ অবস্থা, স্নায়বিক বিকৃতি অথবা কোনো জঘন্য অপরাধ, অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর এগুলির প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় এমন দেখা গেছে যে, পরস্পরকে দোষারোপ করার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করা হয়েছে অসম্ভব, অবশ্য যদি সুমহান আত্মত্যাগের উদাহরণ দেখা যায় তাহলে এমন ঘটনা ঘটতেও পারে।

এমন দেখা গেছে যে, প্রতিটি বস্তুকেই তার নিজস্ব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করতে হবে, যদিও বিষয়গুলি বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত। এমন ঘটতে পারে যে, তাদের মধ্যে একটি অন্যটিকে ক্ষুণ্ণ না করে অন্য কোনো মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এল, সেই সাহচর্যের তীব্রতা এত বেড়ে গেল যে, বিবাহকে অসহনীয় বন্ধনরূপে মনে করা হলো। সেক্ষেত্রে যদি কোনো আইনগত উপায় না থাকে, তাহলে ঘৃণার অনুপ্রবেশ অনিবার্য। সবাই জানেন যে, এইসব ঘটনা থেকে হত্যা প্রবৃত্তির উদ্ভব হয়।

যখন কোনো এক পক্ষের সমঝোতার অভাব অথবা অতিরিক্ত বাসনায় বিবাহ বন্ধন ভেঙ্গে যায় তখন,যদিও এর উপস্থিতি অর্থহীন, দোষারোপ করার তীব্র প্রবৃত্তি দেখা দেয়। এই কারণে পারস্পরিক অনুমোদনের ভিত্তিতে অর্জিত বিচ্ছেদই হলো গ্রহণযোগ্য পন্থা। অবশ্য যেসব ক্ষেত্রে কোনো এক অংশীদারের সুনির্দিষ্ট ত্রুটির ফলে বিবাহ ব্যর্থতায় পরিণত হয়, সেখানে পারস্পরিক অনুমোদন ছাড়া অন্য বিষয় কাজ করতে পারে।

.

বিবাহ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ব্যাপারটি বেশ জটিল। কেননা যেকোনো আইনই বলবৎ থাকুক না কেন, বিচারকবৃন্দ এবং জুরীরা তাদের অনুভূতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন। এবং স্বামী-স্ত্রীরা সেই সব কাজ করবে যা আইন ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও ইংল্যান্ডের আইন অনুসারে বলা হয় যে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হলে বিচ্ছেদের অনুমতি মিলবে না। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা সকলেই জানি যে, প্রায়শই এমন যুক্তি ক্রিয়াশীল থাকে। নিউইয়র্ক স্টেটে এই ঘটনার পরিব্যাপ্তি আরও সুদূর প্রসারী এবং চরিত্রহীনতার স্বপক্ষে ভাড়া করা সাক্ষী আনার ব্যবস্থা করা হয়।

তাত্ত্বিক দিক থেকে নিষ্ঠুরতা হলো বিচ্ছেদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কারণ। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব অনেক সময়ে অনর্থক হয়ে যায়। যখন চিত্রতারকাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী একজনকে তার স্ত্রী নিষ্ঠুরতার কারণে বিচ্ছিন্ন করলেন তখন সেই নিষ্ঠুরতা প্রসারণের স্বপক্ষে বলা হয়েছিল যে, ঐ চিত্রতারকা নাকি বাড়িতে এমন সব বন্ধুদের ডেকে আনেন যারা কান্ট সম্পর্কে আলোচনা করেন। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না যে, ক্যালিফোর্নিয়ার আইন বিশেষজ্ঞরা কিভাবে এই কারণে এক মহিলার স্বপক্ষে বিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন। এখানে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, স্বামী স্ত্রীর উপস্থিতিতে উচ্চ শ্রেণির আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়।

.

এইসব অসঙ্গতি, বিতর্ক ও অবাস্তবতাকে দূর করতে হলে বিচ্ছেদকে পারস্পরিক অনুমোদন সাপেক্ষ করা উচিত, বিশেষ করে যেখানে সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণদায়ক কারণ নেই। যেমন-ধরুন, উম্মাদনার কথা, অথবা অন্য কোনো সুক্ষ্ম অনুভূতিশীল কারণ। বিচ্ছেদের দুই পক্ষ তাদের আর্থিক বিষয়গুলি নিরুপণ করবে আদালতের বাইরে এবং কোনো এক পক্ষ সুবিবেচক মানুষের পরামর্শ নিয়ে অপর পক্ষের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করবে। এর সঙ্গে আমি আরও যোগ করতে চাই যাকে বর্তমানে একটি বিশিষ্ট কারণরূপে ধরা হয়, যেখানে যৌনসহবাস অসম্ভব। কিন্তু বিবাহ যদি সন্তানশূন্য হয় তবেই এই বিষয়টিকে বিচ্ছেদের যথাযোগ্য কারণরূপে ভাবা যেতে পারে।

একথা বলার অর্থ, যদি সন্তানবিহীন কোনো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন। হতে চায় তাহলে এটি মাত্র দৈহিক ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিচয়পত্র (যাতে লেখা থাকবে, স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা নয়) দ্বারা বিচ্ছেদ লাভ করা যাবে।

এতক্ষণ আমরা বিচ্ছেদের আইনের কথা বললাম, প্রথা কিন্তু আরেকটি বিষয়। আগেই আমরা দেখেছি আইন দ্বারা বিচ্ছেদ অর্জন করা সহজ ব্যাপার কিন্তু প্রথা একে বিরল করে তুলেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যে বিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে তার স্বপক্ষে আমার একটি তথ্য আছে। আমি মনে করি যে, মানুষ বিবাহের কাছ থেকে তার অভিপ্রেত সম্পদগুলি চাইছে না এবং বিকৃত চাহিদা কালক্রমে চরিত্রহীনতাকে অসহনীয় করে তুলছে।

বিবাহ হলো এমন একটি শর্তসাপেক্ষ বন্ধন যার মধ্যে অংশগ্রহণকারী উভয় পক্ষ যেন তাদের সন্তানদের যৌবনের কালসীমা অবধি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারা যেন এটিকে ক্ষণস্থায়ী বাসনার দাক্ষিণ্যে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা বলে মনে না করে। যদি এইসব ক্ষণস্থায়ী বাসনাগুলি জনগণের অনুমোদন পায় অথবা যদি উভয়পক্ষ তাদের চেতনা দ্বারা এক দীর্ঘায়িত করে, তাহলে প্রত্যেকেই বিবাহ থেকে অর্জিত ফল লাভ করতে সক্ষম হবে।

এই ঘটনা চলতে থাকলে দম্পত্তিকেন্দ্রিক পরিবারের ভিত্তি ধ্বংস হবে, কারণ,যদি প্রতি দুবছর অন্তর একজন রমণি নতুন স্বামী গ্রহণ করতে পারে এবং প্রত্যেক স্বামী দ্বারা সন্তান উৎপাদনে সমর্থ হয়, তবে শিশুরা তাদের পিতাদের হারাবে এবং বিবাহ তার অস্তিত্ব হারাবে।

আমরা আবার সেইন্ট পলের যুগে ফিরতে পারি, অথবা আমেরিকার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারি কিংবা করিনথিয়াদের প্রথম সূত্রটি মনে করতে পারি। তখন বািবহকে লাম্পট্যের বিরোধী অস্ত্ররূপে বিবেচনা করা হতো। অর্থাৎ যখন কোনো পুরুষ চরিত্রহীন হয়,তাহলে যদি সে বিচ্ছেদের অনুমতি না পায়, সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুমতি দেওয়া উচিত।

যখন বিবাহকে সন্তানদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় তখন এক পৃথক নৈতিকতা ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। যদি পিতামাতার অন্তর সন্তানদের মঙ্গল কামনায় উদ্বুদ্ধ হয়, তাহলে তারা তাদের চরিত্রকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখবে যাতে তাদের সন্তানরা সুখি ও স্বাস্থ্যসম্মত বিকাশ লাভের সর্বোত্তম পন্থাটি পায়।

.

অনেক সময় এর জন্যে প্রয়োজন অসাধারণ আত্মসংযত এবং উভয়পক্ষ যেন মনে করে যে, তাদের নিজস্ব প্রেমাস্পদের অনুভূতির দাবির চেয়ে সন্তানদের দাবি আরো বেশি। কিন্তু এই সব ব্যাপারগুলি তখনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটবে যেখানে পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্ব নিখাদ। মিথ্যা নৈতিকতা তখন বিদ্বেষকে প্রজ্বলিত করবে না। অনেকে এই অভিমত প্রকাশ করেন যে,যদি স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বাসনাৰ্ছ ভালোবাসায় বেঁধে রাখে, যদি তারা পরস্পরকে বহির্বৈবাহিক যৌন অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা না করে, তাহলে তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযোগ্য সাহায্য করতে পারবে না।

তাই হয়তো মিঃ ওয়ালটার লিফম্যান মন্তব্য করেছেন, যারা প্রেমিক নয় তারা পরস্পরকে সাহায্য করতে অপারগ। যেহেতু মিস্টার বারট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন, সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহজাত প্রবৃত্তি মুক্ত কিন্তু আমার মনে হয় এই সংযুক্তি অসম্পূর্ণ এবং শুধুমাত্র কর্তব্যবোধে পর্যবসতি হয়।

এখানে এক ক্ষুদ্র, সম্ভবত অনিচ্ছাকৃত ভূল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। যারা পরস্পরে প্রেমিক-প্রেমিকা নয় তারা সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে অপারগ। কিন্তু জন্মের পরে সন্তান পরিচর্যায় এই প্রেমের উপস্থিতি অপরিহার্য নয়: যেমনটি মিস্টার ওয়ালটার লিফম্যান মন্তব্য করেছেন। এমন কি সন্তান পরিচর্যার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্যের অন্তরালে যদি কামনাময় ভালোবাসার উপস্থিতি ঘটে তবে তার ফলশ্রুতি সুখসমৃদ্ধ হতে বাধ্য। যদি আমরা পিতা-মাতাকে শুধুমাত্র কর্তব্যবোধের পরিচায়ক হিসেবে তুলনা করি তাহলে সন্তান প্রতিপালনের মধ্যে আরোপিত সেইসব সৎ, শোভন, সুন্দর,শক্তিশালী, সুপ্রাপ্য চেতনাগুলির প্রতি অবিচার করা হবে যা যুগবাহিকতার মাধ্যমে পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্বকে স্বর্গীয় সুষমায় ভূষিত করেছে। এ হলো এমন এক ভিত্তি যার ওপর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বজায় থাকে, এমনকি শারীরের আকৃতির মৃত্যু ঘটলেও।

অনেকে এই অভিমত পোষণ করবেন যে, মিস্টার লিফম্যান হয়তো ফরাসি দেশের কথা শোনেন নি যেখানে অবাধ যৌনাচারের পাশাপাশি সুদৃঢ় পরিবার প্রথা বিদ্যমান এবং পিতামাতারা অতিমাত্রায় কর্তব্যপরায়ণ। কিন্তু আমেরিকার ক্ষেত্রে পারিবারিক চেতনা অত্যন্ত দুর্বল হওয়াতে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাধিক্য ঘটে। যেখানে পারিবারিক চেতনা দৃপ্ত যেখানে আইনের স্বীকৃতি সত্ত্বেও বিচ্ছেদের ঘটনা কম। আমেরিকাতে যে সহজ বিচ্ছেদ প্রণালী চালু আছে তাকে আমরা পিতৃমাতৃতান্ত্রিক পরিবার থেকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে রূপান্তরের মধ্যবর্তী পর্বের দ্যোতক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু এই পর্বে শিশুদের ওপর অসহনীয় দুর্ভাগ্যের বোঝা চাপানো হচ্ছে কেননা শিশুরা সহজাতভাবে পিতা ও মাতা উভয়ের অনুরাগী এবং বিচ্ছেদের পূর্বে পিতাদের প্রতি অধিকতর মাত্রায় অনুরক্ত। তাই যতদিন এই দম্পতি তত্ত্ব বাজায় থাকবে ততদিন বিচ্ছেদকে আমি পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্বের অবমাননা হিসেবে চিহ্নিত করবো। আমি মনে করি না যে, বিবাহকে আমরা আইনের মাধ্যমে বিশ্লিষ্ট করলে এ সমস্যার সমাধান হবে। আমি মনে করি পারস্পরিক স্বাধীনতার স্বতঃফুরণে বিবাহ আরও বেশি সহনশীল হবে দ্বিতীয়ত সেইন্ট পল আর রোমান আন্দোলনের ফলে উদ্ভূত যৌন তাড়নার আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া সন্তানদের গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টার মাধ্যমে তাকে আরও মহত্তর করা যেতে পারে।

উপসংহারে বলা যেতে পারে যে, ইংল্যান্ডের মতো পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ এক অত্যন্ত কঠিন পদ্ধতি। কিন্তু এর সরলীকরণের মাধ্যমে বিবাহ সম্পর্কিত সমস্যাবলির সহজ সমাধান সম্ভব নয়। যদি বিবাহকে ভিত্তি হিসেবে মেনে নিতে হয় তাহলে সন্তানদের সামাজিক নিরাপত্তার বিচারে তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এই স্থায়িত্ব তখনই আসবে যখন আমরা বিবাহ ও উদ্দেশ্যহীন যৌন সম্পর্কের পার্থক্য নিরুপণে সমর্থ হব এবং বিবাহিত প্রণয়ের আবেগ তাড়িত চেতনা অপেক্ষা তার জৈবিক দিকগুলিকে পরিস্ফুট করবো। আমি মনে করি না যে, কর্তব্য ব্যতিরেকে বিবাহের উদ্দেশ্য সফল। পুরুষ যদি তার যৌন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবাধ হয়, বিনিময়ে তাকে হিংসাপরিহারের উপায় নির্ধারণ করতে হবে কেননা আত্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া সৎ জীবন যাপন সম্ভব নয়। কিন্তু অহংকারের মতো অসংযমী ও বৈরীভাবাপন্ন প্রক্ষোভকেই প্রশমিত করা উচিত, ভালোবাসার মতো পবিত্র ও দুর্লভ চেতনাকে নয়।

প্রথাগত নৈতিকতা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অসম অবস্থানে প্রোথিত করে। এই উদ্দেশ্যকে কালিমালিপ্ত করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *