১৪. পরিবার এবং রাষ্ট্র

১৪. পরিবার এবং রাষ্ট্র

যদিও পরিবারে অন্তরালে জৈবিক কারণ বিদ্যমান, কিন্তু সুসভ্য সমাজব্যবস্থায় পরিবার হলো আইনসিদ্ধ ফলশ্রুতি। এখানে বিবাহ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরুপিত। বিবাহ ব্যতিরেকে পিতার অধিকার সর্বমাত্রায় খর্ব করা হয় এবং সন্তান সম্পূর্ণভাবে মাতার সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়। আইনবিশারদদের ঐকান্তিক ইচ্ছার পরিপন্থী হয়ে বর্তমান সমাজব্যবস্থা পরিবার প্রথার উৎসে আঘাত করেছে। বিশেষ করে অতি দরিদ্র পরিবারে রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সন্তান শ্রমিকদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে এই বলে ধিকৃত করা হয়েছিল যে, তা পিতৃত্বের ভিত্তিমূলকে দুর্বল করবে। যদিও প্রাচীন রোমান আইনের মতো ইংল্যান্ডের আইন সন্তানকে হত্যা করার সম্মতি দেয় নি, কিন্তু তা সন্তানের জীবনকে দুর্বিসহ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি করতে সাহায্য করেছিল। এই পবিত্র অধিকারের সপক্ষে সওয়াল করে গেছেন পিতামাতারা, মালিকপক্ষ ও অর্থনীতিবিদরা।

যদিও সামাজিক বিক্ষোভের অনিবার্য পরিণতিতে এই সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়েছিল তথাপি অবশ্যম্ভাবী শিক্ষা ব্যতিরেকে এর যথার্থ নিরুপণ সহজসাধ্য ছিল না। এর দ্বারাই পিতামাতার কর্তব্যবোধের ওপর প্রথম আঘাত সূচিত হয়। ছুটির দিন ভিন্ন অন্যান্য দিনে শিশুরা গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করতো বিদ্যালয়ে এবং শিক্ষিত হতো সেই শিক্ষাধারায় যা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত। এর ফলে তারা তাদের পিতামাতার চিন্তাধারাকে অনৈতিক ও বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারতো। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিশুদের ওপর রাষ্ট্রের প্রভাব বাড়তে থাকে। এমনকি যদি কোনো শিশু পিতামাতা কর্তৃক শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতো তাহলে তার প্রতি আরোপিত হতো কঠিন শাস্তি।

এমনভাবেই ধীরে ধীরে রাষ্ট্র পিতার স্থান অধিকার করলো। সোভিয়েত রাশিয়ার মতো যেসব দেশে সমাজতন্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণ অভিধায় চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে এই রূপান্তরের হার অত্যন্ত দ্রুত। সেখানে শিক্ষা এক সার্বজনীন স্বয়ংক্রিয় অধিকার হিসবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু ইংল্যান্ডে এখনও এর প্রভাব অবাধ হতে পারেনি।

শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা সারা বিশ্বেরই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বেতনভোগী সমাজে এর প্রভাব অপরিসীম। লন্ডনের দরিদ্র কবলিত অঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তরের শিল্প সমৃদ্ধ নগরীতে বইছে একই পরিবর্তনের হাওয়া। শৈশবকে দারিদ্র্যের কুটিল বেত্রাঘাতে পঙ্গু করার মধ্যে এমন কোনো উচ্ছ্বাস লুকিয়ে নেই যা একে মহিমাদীপ্ত করতে পারে।

তবে ধনী সমাজ চিরদিনই এর বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে এই ভেবে যে রাষ্ট্র যদি পিতার স্থান অধিকার করে তাহলে সন্তানকে কোনোভাবেই আর লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হবে না। অসহায়তার বছরগুলিতে শিশুরা পিতার কাছ থেকে যে আকাঙ্খিত নিরাপত্তা পেতে উন্মুখ তা যদি রাষ্ট্র দিতে পারে তাহলে পিতা তার সমস্ত গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে।

এই ঘটনার সফল প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে সোভিয়েত রাশিয়াতে কিন্তু যেহেতু উক্ত দেশের মোট জনসংখ্যার আশি শতাংশ কৃষক শ্রেণিভূক্ত। যাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা মধ্যযুগির পশ্চিম ইউরোপের মতো, তাই সমাজবাদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে সংখ্যালঘু মুষ্টিমেয় শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী।

দ্বিতীয় যে কারণ পিতার সর্বব্যাপী কর্তৃত্বকে ক্রম হ্রাসমান করেছে তা হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি মহিলাদের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা।

এই মুহূর্তে বিবাহিত মহিলাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি অবিবাহিত মহিলাদের ত্রুটি বিচ্যুতি অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষক বিবাহ করেছে এবং যে স্বাধীন অবস্থার মধ্যে বাস করে,তাদের উভয়কে একইভাবে মূল্যায়িত করা হয়। এমনকি চিকিৎসকরা যদি মহিলা হয় তবে তাদের অবিবাহিতা হতে হবে। এই সব ঘটনার অন্তরালে যে উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল তা কিন্তু মনে করে না যে, বিবাহিতা রমণিরা এই ধরনের কাজের পক্ষে অচল অথবা তাদের কর্ম নিয়োগের ওপর আইন প্রবর্তিত হয়েছে যা স্বচ্ছ ভাষায় ঘোষণা করছে: কোনো মহিলা যেন বিবাহ দ্বারা কোনো অসুবিধা ভোগ না করে।

.

বিবাহিতা মহিলাদের কোনো চাকরি না দেবার উদ্দেশ্যের অন্তরালে তাদের ওপর অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব করার গোপন আকাঙ্খ সুপ্ত আছে। এমন মনে করার কোনো যুক্তি নেই যে, রমণিরা নির্দিষ্টকাল ধরে এই অব্যবস্থার কাছে মাথা নত করবে। অবশ্য তাদের সমস্যা সম্পর্কে আন্তরিক চিন্তাশীল, এমন কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব নিরুপণ করা শক্ত কাজ। কেননা রক্ষণশীলেরা গৃহকে ভালোবাসে এবং শ্রমিক দল কর্মরত পুরুষদের ভালোবাসে।

একথা মনে রাখা উচিত যে, বর্তমান নির্বাচকমন্ডলীর গরিষ্ঠ অংশ হলো রমণিরা। তাই তারা চিরদিন যে অন্তরালে থাকবে, তেমন মনে করার কোনো যুক্তি নেই। স্বীকৃতি পেলে তাদের অভিযোগগুলি পরিবারের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

বিবাহিতা রমণিরা দুটি পৃথক উপায়ে অর্থনৈতিক স্বতন্ত্রতা অর্জন করতে পারে। এর একটি হলো, বিবাহের পূর্বে তারা যে ধরনের কাজ করত সেই ধরনের কাজে আত্মনিয়োগ করা। এর ফলে তাদের সন্তানরা অন্যের পরিচর্যার ওপর স্থাপিত হবে এবং তার ফলে শিশুসদন ও নার্সারী বিদ্যালয়গুলির ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। এই ঘটনার তাত্ত্বিক ফলস্বরূপ শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিচারে বাবা ও মায়ের গুরুত্বের অবলুপ্তি ঘটবে। আরেকটি পদ্ধতি অনুসারে শিশু সহ রমণিরা শিশুপরিচর্যার কাজে আত্মনিবেদনের শর্তসাপেক্ষে রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন পাবে। অবশ্য এই পদ্ধতিটি এককভাবে যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে এমন ধারা সংযোজিত হওয়া উচিত যার ফলে শিশুপরিচর্যার কাজ শেষ হলে রমণিরা তাদের সাধারণ কাজে ফিরতে পারে।

এর ফলে নারীরা তাদের সন্তান-সন্ততিদের পরিচর্যা করার বাড়তি সুবিধা পাবে এবং তাদের আর স্বতন্ত্র পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এই ব্যবস্থা নতুন একটি স্বীকৃতি দেবে। বর্তমানে চিন্তা করা হয় যে, শিশু হলো যৌন বাসনা নিবৃত্তির সাধারণ ফলশ্রুতি মাত্র। তার লালন পালনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাবন্দী প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তার মধ্যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত অনুপ্রবেশে পিতা ও মাতার ওপর ন্যস্ত অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা অপসারিত হবে।

পারিবারিক অনুদানের স্বপক্ষে এই শেষ সূত্রটিকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কিন্তু এই সূত্র ঘোষণা করে না যে, জননী একাই বেতন অর্জন করবে। আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে বেতনভোগী শ্রেণির নারীত্ব বর্জিত হতে পারে এবং স্বীকৃত হলে এই ব্যবস্থা। আইনগত সম্মতি লাভে সমর্থ হতে পারে।

এখন ধরে নেওয়া যাক, এই ধরনের একটি আইন প্রণয়ন করা হলো। পারিবারিক নৈতিকতার ওপর এর প্রভাবগুলি নির্ভর করবে আইনটি কিভাবে প্রণীত হলো তার ওপর। এখন এমন শর্ত থাকতে পারে যে, যদি কোনো রমণি অবৈধ সন্তান প্রসব করে তাহলে সে অনুদান পাবে না। অথবা এমন কথা বলা হতে পারে, যদি সেই নারীর বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে তার পরিবর্তে তার স্বামী ঐ অর্থ গ্রহণ করবে।

যদি এমন কোনো আইনগত শর্ত আরোপিত হয় তাহলে স্থানীয় রক্ষিবাহিনীর কর্তব্য হবে প্রতিটি বিবাহিত মহিলার সঙ্গে দেখা করে তার নৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা। এর প্রভাব সুদূর প্রসারী হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি যে, প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এর বাস্তব দিকটি প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার মনে হয় বর্তমানে এমন একটা দাবি উঠতে পারে: রক্ষিবাহিনী যেন এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ না করে। অনেকে বলবে অবৈধ সন্তানদের জননীরাও যেন ই অনুদান পায়। যদি এই ব্যবস্থাগুলি প্রবর্তিত হয় তাহলে বেতনভোগী শ্রেণিতে পিতার অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে। এবং কিছুদিন বাদে পারিবারিক গঠন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, কুকুর বিড়ালদের মধ্যে যে বাবার গুরুত্ব, মানব সমাজে তার সেই পরিণতি হবে।

বর্তমান যুগের কথা চিন্তা করা যাক। এখন একক নারীরা তাদের গৃহস্থানের মধ্যে আতঙ্ক সহকারে বাস করে। তাই আমার মনে হয়,অধিকাংশ রমণীরা তাদের প্রাক-বিবাহ সময়ের কাজে যোগ দিতে রাজি হবে। কিন্তু তাদের নিজেদের সন্তাদের পরিচর্যার জন্যে বেতন গ্রহণ করতে চাইবে না। নিজেদের বাড়ি পরিত্যাগ করে শিশুসদনে যোগদানকারী যথেষ্ট সংখ্যক রমণি পাওয়া যেতে পারে। এটি হবে এক পেশাদারী কাজ। কিন্তু আমি মনে করি, যদি কর্মরতা রমণিদের কাছে পাশাপাশি দুটি প্রস্তাব রাখা যায়: তারা স্বগৃহে অবস্থান করে সন্তান প্রতিপালনের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করবে অথবা প্রাক-বিবাহ যুগের কাজে আত্মনিয়োগ করে অর্থ উপার্জন করবে, তাহলে তার শেষের ব্যবস্থটিতে অধিকতর সুখি হবে।

অবশ্য এই সিদ্ধান্তটি একবারেই ব্যক্তিগত মনোভাবাপন্ন, আমি বলছি না যে, এটিই হলো শেষ সিদ্ধান্ত। যেকোনো পরিণতিই হোক না কেন,এখানে একটা সহজ সত্যকে উপলদ্ধি করা উচিত। বিবাহিত রমণির মধ্যে নারীত্ব বোধটি ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে। তাই মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে পুঁজিবাদী সমাজের কাঠামোর মধ্যেও শিশুপরিচর্যায় বাবা-মায়ের মধ্যে একজন অথবা দুজনের অবলুপ্তি ঘটবে। বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণিতে এই প্রভাব দেখা দিতে পারে।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করে ঘোষণা করা যায়, পুরুষদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নারীজাতির অভ্যুত্থান আন্দোলনের সমাপ্তি হয়েছে কিন্তু প্রসারিত দৃষ্টিকোণে তা এখনো তার শৈশবের মধ্যে অবস্থান করছে। ক্রমে ক্রমে এই স্পন্দনের নিভৃততম প্রভাবগুলি স্ব-নিঃশোষিত হবে। রমণিরা যে সমস্ত আবেগে উজ্জীবিত হয় বলে। তাদের বিশ্বাস,সেগুলি আজও পুরুষদের ইচ্ছা ও অনুভূতির প্রতিফলন মাত্র। পুরুষ উপন্যাসিকদের রচনায় হয়তো আপনি এমন কথা পড়ে থাকবেন যে, শিশু কর্তৃক স্তন্যপানে রমণিরা শারীরিক সুখানুভূতি লাভ করে। কিন্তু আপনি আপনার পরিচিতা কোনো জননীকে প্রশ্ন করে জানবেন যে, এটি সঠিক ঘটনা নয়। কিন্তু রমণি জাতির স্বীকৃতি ব্যতিরেকে কোনো পুরুষ এমন করতে পারে না।

মাতৃকেন্দ্রিক অনুভূতিগুলিকে পুরুষ তার অবচেতনার মধ্যে সুদীর্ঘ সঞ্জাত আবেগ আপুত অনুভূতি দ্বারা এমনভাবে রঞ্জিত করেছে, এই ব্যাপারে কোনো কিছুর উপলব্ধি করতে হলে রমণিরা পুরুষদের কর্তৃত্বের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ নির্ভর করবে। কিছুদিন আগে অবধি সুন্দরি রমণিরা সন্তান আকাঙ্ক্ষা করতো কিন্তু যৌনতাকে ঘৃণা করতো। এমনকি এখনো পুরুষরা যখন কোনো রমণির মুখ থেকে সন্তান উৎপাদনের বিপক্ষে দ্বিধাহীন সংলাপ শুনতে পায় তখন তারা ব্যথিত হয়। অবশ্য অনেক সময় পুরুষরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এই জাতীয় রমণিদের সন্তান প্রদান করে।

যতদিন অবধি রমণিরা পুরুষদের ইচ্ছাবন্দী ছিল ততদিন তারা সৎভাবে তাদের নিজস্ব অনুভূতিগুলিকে ব্যক্ত করতে পারে নি। তারা পুরুষদের সুখ অন্বেষণে অভিনয় করে এসেছে। তাই আমরা সন্তান সংক্রান্ত ব্যাপারে রমণির সুপ্রাচীন সাধারণ মনোবৃত্তিকে সার্বিক স্বীকৃতি দিতে পারি না। কেননা আমরা ক্রমেই দেখছি যে, নারীরা যতই তাদের আপন আবেগগুলিকে পরিস্ফুটিত করছে ততই তাদের সম্পর্কে আমাদের যুগবাহিত ধ্যান ধারণাগুলি বদলে যাচ্ছে।

আমার মনে হয় বর্তমানে অস্তিত্বশীল সভ্যতা, রমণি জাতির জননী কেন্দ্রিক অনুভূতিগুলি হ্রাস করছে। হয়তো অনতিকালে সুউচ্চ সভ্যতায় এমন ঘটনা ঘটবে যার ফলে নারীরা সন্তান পরিচর্যাকে অর্থ আহরণকারী জীবিকারূপে বিবেচনা করতে পারে। তবে তারা যেন শিশুপরিচর্যার বিনিময়ে সকলে অথবা গরিষ্ঠ অংশ যে এই জীবিকা অর্জন করতে পারবে তার কোনো স্থিরতা নেই। এটি হবে অন্যান্য জীবিকার মধ্যে একটি এবং জীবিকাসুলভ মনোবৃত্তি সহকারে এটি বিবেচিত হবে।

অবশ্য এই সবই হলো ভবিষ্যতে কল্পনা মাত্র। একটি মাত্র ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি নারীত্ব তার সর্বশেষ বিকাশের ধারায় পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে ভেঙে ফেলার মতো সর্বব্যাপী প্রভাব অধিকার করতে পারে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পুরুষ নারীর উপর তার বিজয়কে ঘোষিত করতে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছিল।

পশ্চিমা সমাজে এখনো অবধি যে অগ্রগতি হয়েছে, তার দিকে চোখ রেখে বলা যায়, রাষ্ট্র কর্তৃক পিতার বিকল্পকরণের ব্যাপারটি যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। এই ঘটনা জাতীয় স্বাস্থ্য মনের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে এবং শিক্ষার সাধারণ স্তরকে উন্নত করেছে। শিশুদের প্রতি প্রযোজ্য নিষ্ঠুরতাকে হ্রাস করা হয়েছে এবং ডেভিড কপারফিল্ড যুগের যন্ত্রণাকে অসম্ভব করা হয়েছে। মনে হয় এই ব্যবস্থা শারীরিক স্বাস্থ্যের সাধারণ স্তর এবং বুদ্ধিজীবী সুলভ পরিণতির উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত থাকবে। বিশেষ করে এই ব্যবস্থা অসৎ পরিবার হতে উদ্ভূত কারণগুলিকে প্রতিরোধ করবে।

অবশ্য রাষ্ট্রকর্তৃক পরিবারের বিকল্পকরণের কয়েকটি অসুবিধা আছে। সাধারণ নিয়ম অনুসারে পিতামাতারা তাদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসে এবং তারা তাদেরকে রাজনৈতিক পদ্ধতির বস্তু হিসেবে মনে করে না। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন মনোবৃত্তি আশা করা অনুচিত। বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো যেসব ব্যক্তি বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করে শিশুদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসে এবং যদি তারা অতিরিক্ত ভারাক্রান্ত অথবা কাজের তুলনায় কম বেতন না পায়, তাহলে তার পিতা-মাতাসুলভ একান্ত অনুভূতির মতো আবেগকে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু শিক্ষকদের হাতে বিশেষ ক্ষমতা থাকে না। ক্ষমতা প্রশাসকদের উপর কেন্দ্রিভূত হয়। প্রশাসকরা কখনো শিশুদের দেখে না কিন্তু তাদের জীবন তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু তাদের চরিত্রের মধ্যে প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকটভাবে বিদ্যমান (কেননা অন্যভাবে তারা তাদের অধিকৃত পদগুলি লাভ করতে সমর্থ হতো না) তাই তারা মানব সত্তাকে বস্তুকেন্দ্রিক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করার অদ্ভুত মনোবৃত্তির পরিচয় প্রদান করে।

সর্বোপরি, প্রশাসকরা ঐক্য দাবি করে। রাশি-বিজ্ঞান অথবা পায়রা খোপের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য যেখানে এক অর্থে কোনো মানুষের খেয়ালখুশিসাপেক্ষ অনুভূতির প্লাবন সে বিপুল সংখ্যক মানব সত্তার ওপর তা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। তাই যে সমস্ত শিশুরা সংগঠনে দয়ার ওপর নিক্ষিপ্ত হয় তারা এক রকম হতে বাধ্য হয়। কিন্তু যারা স্বীকৃত ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল না হয়, স্বতন্ত্রতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে, তাদেরকে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে। তারা যে শুধু তাদের সহগামীদের কাছ থেকে যন্ত্রণা পায় তাই নয়, কর্তৃপক্ষ তাদের নানাভাবে লাঞ্ছনা করে।

তার মানে, যেসব শিশুর মনে বৃহত্তম ক্ষমতা আছে তাদেরকে এমনভাবে অবদমিত করা হয় যে, তাদের আত্মার উদ্দীপনা ধ্বংস হয়ে যায়। তার ফলে শিশুদের বিরাট অংশ শাস্তি ভোগের দ্বারা অভ্যস্ত হয়ে ধৈর্য সহকারে কোনো নতুন কথা শোনার মতো অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া যত দিন অবধি বর্তমান পৃথিবী পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতারত সামরিক কেন্দ্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জে বিভক্ত থাকবে, ততদিন যদি বিদ্যালয় প্রশাসক দ্বারা পিতামাতার বিকল্পকরণ সাধিত হয় তাহলে স্বদেশ প্রেমের উদ্দীপনার মতো বোধের উন্মেষ হবে। অর্থাৎ সরকার যখনই ডাক দেবে তখনই তাকে ইতঃস্তত না করে সেই ডাকে সাড়া দিতে হবে।

একটা কথা মনে রাখা উচিত যে, তথাকথিত স্বজাত্যবোধ বর্তমান সভ্যতার ঘৃণ্যতম বিপদরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এবং যে সমস্ত ব্যবস্থা এই সর্বনাশা অনুভূতির প্রাবল্যকে বৃদ্ধি করতে পারে, সেই সমস্ত বিষয়কে প্লেগ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের চেয়ে অধিকতর ক্ষতিসাধনকারীরূপে বিবেচনা করা উচিত।

বর্তমান যুব সমাজের আনুগত্য দ্বিধাবিভক্ত, একদিকে তারা পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অন্যদিকে তারা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাশীল। যদি এমনটি ঘটে, তারা তাদের সার্বিক আনুগত্য রাষ্ট্রের উপর স্থাপন করবে, তাহলে এই পৃথিবী বর্তমান অপেক্ষা অধিকতর রক্ততৃষিত হয়ে উঠবে, সেই আশঙ্কা করার কারণ বিদ্যমান।

সেই কারণে আমি বিশ্বাস করি, যতদিন অবধি আন্তর্জাতিকতাবাদের সমস্যাটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় থাকবে ততদিন শিশুর পরিচর্যা ও শিক্ষণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের বিষয়টি তার সর্বস্বীকৃত সুবিধাগুলিকে বাতিল করে বিপদ সঞ্চার করবে।

অপরপক্ষে যদি যুদ্ধরত দেশগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল আইন প্রণয়নের উপযোগী আন্তর্জাতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে এই পরিবেশ একেবারে বদলে যেত। এই জাতীয় সরকার ঘোষণা করতো যে, জাতীয়তাবোধ যেন তার চরম উন্মাদ অবস্থাতেও কোনো দেশের শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার অংশবিশেষ না হয়। সেই সরকার জোরের সঙ্গে বলতো যে, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদানের ব্যাপারটি যেন সর্বত্র শেখানো হয় এবং জাতীয় পতাকার প্রতি বর্তমান প্রযোজ্য শ্রদ্ধার পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতাবাদে উদ্বুদ্ধ অনুভূতির সঞ্চার হয়।

সে ক্ষেত্রে, যদিও অতিরিক্ত এককত্বের বিপদ সূচিত হতে পারে এবং অতি মাত্রায় ক্ষতিসাধনকারী উচ্ছলতার অস্তিত্ব থাকতে পারে, তবু যুদ্ধসংক্রান্ত বিপদ অবলুপ্ত হবে। তখন শিক্ষার ওপর মহারাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে যুদ্ধবিরোধী বাস্তব প্রতিরোধরূপে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে।

এই সমস্ত আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, রাষ্ট্র দ্বারা পিতার বিকল্পকরণের বিষয়টি সভ্যতাকে সেবা করবে। যদি রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক হয়। কিন্তু যতদিন রাষ্ট্র হবে জাতীয়তাবাদী ও সমরকেন্দ্রিক, ততদিন এই ব্যবস্থা সভ্যতাকে যুদ্ধ পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে। পরিবার দ্রুত অবলুপ্ত হবে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ মন্থর গতিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। এই অবস্থা এমন পরিণতির সৃষ্টি করবে যা সাংঘাতিক কল্পনার পরিপূরক। অবশ্য এমন আশা করা যায় যে আন্তর্জাতিকতাবাদের গতি অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতে দ্রুততর হতে পারে।

যেহেতু সৌভাগ্যবশত আমরা ভবিষ্যদ্রষ্টা নই, তাই এমন আশা করার অধিকার আমাদের কাছে হয়তো, এটি হবে বর্তমানের এক বিকশিত অবস্থা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *