১৩. ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বে পরিবারের প্রভাব

১৩. ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বে পরিবারের প্রভাব

এই অধ্যায়ে আমি আলোকপাত করব সেই বিষয়টির ওপর যা ব্যক্তিসত্তার বিকাশে পরিবারের প্রভাব সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করবে। এই বিষয়টির প্রভাব ত্রিমুখি সন্তানের, মাতার ও পিতার ওপর প্রভাব। যেহেতু পরিবার একটি ঘন সন্নিবদ্ধ একক সত্তা, তাই এই তিনটির মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করা দুরূহ কেননা পিতামাতা যদি কোনো ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হন তাহলে সন্তানের ওপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। তবুও আমি আলোচনার সুবিধার্থে এই কাল্পনিক বিভাজন রেখা টেনে সন্তানের ওপর পরিবারের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে এই অধ্যায়ের সূচনা করবো। কারণ পিতা বা মাতা হবার আগে প্রত্যেকেই শৈশব অবস্থা অতিবাহিত করেছে।

ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বে বিশ্বাস রেখে বলতে হয় যে, পরিবারভুক্ত শিশু অন্যান্য সদস্যের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকে। পিতাকে সে মনে করে তার যৌন প্রতিদ্বন্দ্বী। মাতার প্রতি আরোপিত হয় এমন এক প্রক্ষোভ যা যুগবাহিত নৈতিকতার পরিপন্থী। সে ভাইবোনকে ঘৃণা করে এই কারণে যে, তারা পিতামাতার মনোযোগের ভাগীদার। এই সমস্ত বিক্ষুব্ধ কামনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার জীবনে যা সমকামিতা থেকে অকারণ অবসাদের মতো বিস্তৃত প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে।

ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব তার কাঙ্খিত ভয়াবহতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। যদিও খ্রিস্টীয় নন্দনতত্ত্বের প্রভাবে মানুষ ফ্রয়েডের যৌন জিজ্ঞাসা দ্বারা অধিকতর মাত্রায় আলোড়িত হয়েছে, অগ্রাহ্য করেছে শৈশবকালীন বৈরীতাঙ্ককে। শিশুসুলভ প্রক্ষোভের অনুধাবনে ফ্রয়েডীয় মতবাদের বিশ্লেষণে আমরা সংস্কারমুক্ত মনন দ্বারা উদ্ভাসিত হয়ে একথা ঘোষণা করতে পারি যে, সককালীন পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে তার মতবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রথমে আমরা ঈডিপাস প্রক্ষোভ সম্বন্ধে আলোচনা করতে চলেছি। শিশুকালীন যৌনতা হলো এক অত্যন্ত শক্তিশালী চেতনা। এমনকি বিপরীত কামীতা এই অবস্থায় যথেষ্টমাত্রায় ক্রিয়াশীল থাকে। এমনকি এর অন্তরালে মাতার ঐচ্ছিক কিংবা অনৈচ্ছিক চেতনার বহিঃপ্রকাশও ঘটে থাকে। বিশেষ করে যদি মাতা তার যৌনজীবনে অসুখি হয় তাহলে সে তার পিতার কাছ থেকে এমন এক আবেগতাড়িত সুখ অনুভব করতে চায় যা প্রাপ্তবয়স্কের কাছ থেকে প্রাপ্তব্য। এই কারণে সুখি রমণি সুচারু মাতৃত্বের মূর্ত প্রতিমা। যদিও সুখ এক তাৎক্ষণিক প্রক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, সেই জন্যে অসন্তোষের মুহূর্তে রমণি তার হৃদয়কে এমন স্ব-বাঁধনে বেঁধে রাখবে যাতে সে সন্তানের মুখাপেক্ষী না হয়।

সমবয়সি শিশুদের সঙ্গে যৌন আচরণে একটি শিশু স্বাভাবিক, সার্বিক ও পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিতে পারে। তিন-চার বছর বয়সের পর আবেগের উন্নয়নে একটি শিশু সম ও বিপরীত লিঙ্গভুক্ত শিশুর প্রতি আকৃষ্ট হয়। যদিও বর্তমান ক্ষুদ্র পরিবার প্রথা তার মননের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বিকাশশীলতাকে রুদ্ধ করেছে।

শুধু যে মাতারাই শিশুচিত্তে অনাকাঙ্ক্ষিত স্নেহের জন্ম দেয় তা নয়, প্রথম দিকে পরিচারিকা ও শুশ্রূষাকারিণীরা এবং পরবর্তীকালে শিক্ষিকারা যথেষ্ট বিপদের উদ্রেক করে; কারণ সাধারণত তারা যৌন অতৃপ্তির শিকার হয়ে থাকে।

ভাইবোনের প্রতিহিংসা হলো যেকোনো পরিবারের অতি সাধারণ ঘটনা। যদিও ভবিষ্যতে এর থেকে ভয়ঙ্কর স্নায়বিক বৈকল্যের জন্ম হতে পারে। কিন্তু পিতামাতার সার্বিক ও আবেদনশীল নিরীক্ষণের মাধ্যমে এই প্রক্ষোভের প্রশমন সম্ভব। নবজাতকের জন্ম মুহূর্তে শিশুমনে নিরাপত্তাহীনতার উদ্রেক হয়। জন্ম নেয় নির্মম বৈরী মনোভাব। পিতামাতার পক্ষপাতশূন্য আচরণের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

যৌন জীবনের সুখ দ্বারা আহৃত মনত্মাত্ত্বিক সম্পদের মাধ্যমে পিতামাতা পরিবারকে সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে পারে। তিন-চার বছর থেকে শিশুকে বেশ কিছুক্ষণ সময় সমবয়সিদের সাহচর্যে রাখা উচিত। তাহলে ফ্রয়েডীয় কুপ্রভাব থেকে তাকে অনেকাংশে রক্ষা করা যাবে।

বিপরীতক্রমে সদভাবে প্রযুক্ত পিতামাতার ভালোবাসা শিশুর ধারাবাহিক উন্নয়নে বিশিষ্ট ভূমিকা নিতে পারে। এর দ্বারা বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে শিশু নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করে এবং পরিবেশের নিত্য নতুন আবিষ্কারে নির্দ্বিধায় ব্যাপৃত থাকতে পারে। শিশুকে সুখি, নির্ভীক ও সার্বজনীনভাবে গড়ে তুলতে হলে চাই পরিবেশের এমন এক উষ্ণতা যা পিতামাতার স্নেহ বসে অভিষিক্ত হবে।

বর্তমান যুগে শিশুর মনস্তত্ত্বে যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অসীম। যদি শিশু যৌনতাকে তার অস্তিত্বের দ্যোতক হিসেবে মনে করে তাহলে সে এর জৈবিক কারণ সম্পর্কেও অবহিত হতে পারবে।

পারিবারিক জীবনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার আগে এর সম্ভাব্য বিকল্প বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। যে দুটি প্রথা দ্বারা এর সম্পূর্ণ অবলুপ্তি সম্ভব তার একটি হলো মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা এবং দ্বিতীয়টি অনাথ আশ্রমের মতো সার্বজনীন সংস্থার গুরুত্ববৃদ্ধি। যদি তা ঘটে থাকে তাহলে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে তার প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।

আমরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের কথা ভাবতে পারি। এ হলো এক অবস্থা যেখানে শিশু শুধুমাত্র মার সঙ্গে পরিচিত হবে এবং একজন রমণি আপন ইচ্ছা অনুসারে তার সন্তানের পিতা নির্বাচন করবে। এক্ষেত্রে শিশুটি পিতার অবর্তমানে মনস্তাত্ত্বিক অবসাদের শিকার হবে না। শৈশবের প্রথম প্রহর থেকে শিশুমননে পুরুষ ও নারীসত্তার যুগ্মদ্যোতনা ধ্বনিত হয়। যে সমস্ত শিশু শৈশবে পিতৃহারা হয় তারা পিতৃযুক্ত শিশুদের অপেক্ষা নিকৃষ্টভাবে বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু আদর্শ পিতার কোনো বিকল্প নেই। কর্তব্যবোধে পরাজুখ পিতার অনস্তিত্বের অন্তরালে নিহিত আছে সুপ্রসারী প্রভাব।

বিবাহ-বিচ্ছেদ এক নির্মল সামাজিক ঘটনা যা শিশুর মননে মানসিক বিষাদের জন্ম দেয়। যে শিশু পিতা-মাতার স্নেহাচ্ছাদিত সান্নিধ্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে তার পক্ষে এই আকস্মিক বিচ্ছেদকে মেনে নেওয়া কোনো মতেই সম্ভব হয় না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি শৈশব অবস্থায় পিতামাতার কাছ থেকে শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার সপক্ষে প্লেটোর মতবাদের অবতারণা করতে চাইছি। যৌননৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পিতার গ্রহণযোগ্যতাকে নিরুপণ করতে হবে। দু একটি সৌভাগ্যদায়ী পরিবারের পিতা তার সুনির্দিষ্ট সীমায়ীত উপযোগিতা নিয়ে বিদ্যমান, পক্ষান্তরে দুর্ভাগ্যদায়ী পরিবারে পিতা ভয়াবহতা, আগ্রাসী মনোভাব ও বিশৃঙ্খলার প্রতিভূরূপে বিরাজমান থেকে ক্ষতি সাধন করে চলেছে।

বর্তমানে পরিবারে মাতার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সহজসাধ্য নয়। বিশেষ করে গর্ভকালীন অবস্থায় একজন রমণি যে প্রিয়পুরুষের নিরাপত্তামূলক সান্নিধ্যের অভিলাষী হয়, এর অন্তরালে প্রাগৈতিহাসিক বন্য জীবনের পরম্পরা লুকিয়ে আছে। বর্তমান পৃথিবীর সমস্যাসঙ্কুল পরিবেশে গর্ভবতী রমণি স্বভাবতই দুর্বল চিত্তের হয়ে থাকে। তাই রাষ্ট্র যদি তাকে এবং তার ভবিষ্যজাত শিশুকে সুনির্দিষ্ট যত্নে রাখার সার্বিক প্রতিশ্রুতি দেয় তবেই সে এই মনত্মাত্ত্বিক অবদমনের হাত থেকে মুক্তি পাবে। মানবচরিত্র এমনভাবে গঠিত হয়েছে যে, যৌনতা এক অপরিমাপ্য জ্ঞানের উৎস। কিন্তু অতিমাত্রায় কামনা-নির্ভর যৌনসম্পর্ক দ্বারা একে সম্পূর্ণভাবে বোধগম্য করা যায় না।

সন্তান প্রতিপালনের প্রধান স্তম্ভ হলো সখ্যতামূলক সহযোগীতা। যেসব রমণি কেবলমাত্র মাতৃতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছে এবং পুরুষ যার কাছে দুঃস্বপ্নের প্রতীকমাত্র সে কোনোভাবে তার নবজাতককে এমন কোনো চেতনাসমৃদ্ধ শিক্ষাদানে উদ্দীপ্ত করতে পারে না যা সুখি স্বামী-সহবাসে তৃপ্তা বিবাহিতা রমণির পক্ষে সততঃ অভিপ্রেত এবং অসুখি বিবাহ প্রাথমিকভাবে পরিত্যাজ্য।

.

ইতিমধ্যে আমরা পিতৃত্বের গুরুত্ব এবং তার চেতনা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। সুসভ্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পিতার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই কারণেই পুরুষ যৌনতাকে প্রধান উদ্দেশ্য না করেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কেননা বিবাহ ছাড়াও সে যৌনক্ষুধার পরিতৃপ্তি ঘটাতে পারে। সাধারণভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে, সন্তান উৎপাদনের আকাঙ্ক্ষা নারী জাতির মধ্যে অধিকতর মাত্রায় বিদ্যমান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বিপরীত ঘটনা দেখা যায়। অধিকাংশ বর্তমান বিবাহিতা সন্তান হলো পুরুষের ইচ্ছার কাছে নারীর ইচ্ছুক কিংবা অনিচ্ছুক আত্মসমর্পণের ফলশ্রুতি। কারণ সন্তান উৎপাদনকল্পে রমণিকেই শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, যার মধ্যে তার সৌন্দর্যের অবনতির সম্ভাবনা নিহিত থাকে। পক্ষান্তরে পুরুষকে উদ্বেগের প্রহর কাটাতে হয় না।

পুরুষ যে তার পরিবারকে সীমায়িত করতে চায়, এর একমাত্র কারণ অর্থনৈতিক নারীর ক্ষেত্রেও এটি বিদ্যমান। কিন্তু এর অন্তরালে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার স্ফুরণ ঘটে। পুরুষ যে সন্তান উৎপাদনে পরাঙ্মুখ হয় তার অন্যতম কারণ হলো উৎপাদিত সন্তানের সুশিক্ষাকল্পে নিয়োজিত সম্ভাব্য কায়িক শ্রমের মাত্রাধিক্যজনিত ভীতিবিহ্বলতা।

যদি পুরুষকে তার কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভূমিকা থেকে মুক্তি দেওয়া যায় তাহলে কি সে পিতার ভূমিকায় নিষ্ফল অভিনয় করতে আকাক্ষিত হবে? অনেকে বলবেন, সে ক্ষেত্রে সে কোনোভাবেই সন্তান চাইবে না।কিন্তু আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নই কেননা পুরুষ যখন সন্তান আকাঙ্খ করে তখন সে মনে মনে সেই সন্তানের জন্মজনিত দায়িত্ববোধের জন্যেও নিজে প্রস্তুত করে নেয়। বর্তমান যুগের সহজপ্রাপ্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ জননকে আকস্মিক দুর্ঘটনার প্রতীক থেকে মুক্তি দিয়ে আনন্দ ও ইচ্ছার অভিসারী করে তুলেছে।

তবে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকা উচিত যেখানে পিতৃত্ব ব্যতিরেকে নরনারী দীর্ঘকালীন মিলনে আবদ্ধ থাকতে পারবে। যদি সমাজ কেবলমাত্র নারীত্বের সঙ্গে সন্তান উৎপাদনকে একীভূত করে তাহলে তা হবে পুরুষজাতির প্রতি তীব্র অবিচারের পরিচায়ক। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমিপুরুষ মনস্তত্বের ওপর এই ধরনের ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। এই ঘটনা দ্বারা নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব বহুলাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং তা হৃদয়-মন ও শরীরের স্বর্গীয় মিলন হিসেবে পরিগণিত না হয়ে কেবলমাত্র আনন্দলাভের উপায় হিসেবে গণ্য হবে।

ফল হলো সুদূরপ্রসারী। জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক এর দ্বারা এমনভাবে আচ্ছাদিত হবে যে, মানুষ তার উচ্ছ্বাস, দেশপ্রেম, এমনকি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিত্ববিহীণ বিষয়ের উপস্থাপনায় এর প্রভাবমুক্ত হতে পারবে না।

যেহেতু মানুষে মানুষে তুমুল বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান, তাই কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে এর প্রভাব হবে ধ্বংসাত্মক, আবার অন্যের কাছে সৃজনমূলক। পিতৃত্বের অবলুপ্তির ফলে পুরুষের আবেগ সঙ্কুল জীবন তার সমস্ত রহস্যময়তা হারিয়ে ধীরে ধীরে বিরক্তি ও একাকীত্বের এমন এক গহবরে পতিত হবে যে, তা থেকে উদ্ধার অসম্ভব। মাতৃত্বকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। অবশ্য এর জন্যে প্রয়োজন সমকালীন সময়নৈতিক যুক্তিবাদীদের সফল পদচারণা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *