০৯. বিবাহ

০৯. বিবাহ

এই অধ্যায় আমি সন্তান সম্পর্কে কোনো উদ্ধৃতি না করে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের হিসেবে বিবাহকে বিশ্লেষণ করব। আইন স্বীকৃত প্রথা হিসেবে বিবাহের সামাজিক স্বীকৃত অসামাজিক যৌন সম্পর্ক হতে পৃথক। আমরা বৈবাহিক ঘটনাকে ধার্মিক প্রথা হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এর অন্তরালে বহমান আইনগত দিকটি সম্পর্কে কদাচিৎ মনোনিবেশ করি।

বৈবাহিক প্রথা যে শুধুমাত্র প্রাচীন মানব সমাজের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল তা নয়, এটি বানর জাতি এবং অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও কাজ করছে। জানোয়ারদের মধ্যে এই নিয়ম প্রচলিত আছে যে, তরুণদের লালন-পালনে পুরুষকে সহযোগিতা করতে হবে। সাধারণভাবে জন্তু-জানোয়ারদের বিবাহ পদ্ধতি এক পত্মী প্রথায় বিশ্বাসী এবং কেউ কেউ মনে করেন যে, এই ব্যাপারটি অ্যামন্ত্রো পয়েড প্রজাতির ক্ষেত্রে সবিশেষ গ্রহণযোগ্য। মনে হয়, ঐসব বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত যদি বিশ্বাসযোগ্য হয় তাহলে সৌভাগ্যবান জন্তুর দল মানব সমাজের ক্ষতিকারি সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে।

কেননা একবার বিবাহের পর পুরুষকে আর কোনো নারী আকর্ষণ করবে না এবং বিবাহিত রমণি অন্য কোনো পুরুষ চিত্তের বিভ্রম ঘটাতে সমর্থ হবে না। অ্যামপেভ্রা পয়েড প্রজাতির মধ্যে ধর্মের অনুপস্থিতিতে পাপের অনুপ্রবেশ ঘটে নি কেননা সহজাতভাবে তারা পুণ্য অর্জনের প্রয়াসী। নিম্নতম বর্বর জাতির মধ্যে যে একই ধরনের ঘটনাবলি ঘটতে দেখা যায় তার কিছু কিছু প্রমাণ আছে।

বুশমেনেরা দৃঢ়ভাবে এক বিবাহ তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং আমি অনুধাবন করতে পারি যে, অধুনালুপ্ত টাসমানিয়ানরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি অতি মাত্রায় বিশ্বাসী ছিল। এমনকি সুসভ্য মানবজাতির মধ্যে কখনো কখনো এক বিবাহের ক্ষীণ চিহ্ন দেখা যায়। আচার ব্যবহারে ওপর প্রথা পদ্ধতির প্রবাহের কথা চিন্তা করে আমরা সহজাত প্রবৃত্তির এক বিবাহ কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণে সম্ভব তা বিস্ময়াবিষ্ট হই। কেননা এটি হলো মানব অস্তিত্বের মানবিক বিস্ময়ের উদাহরণ মাত্র, যা থেকে মানুষের পাপ ও বুদ্ধিমত্তার উৎপত্তি হয়েছে।

বলা চলে মানুষ তার নিজস্ব নিয়মনীতি ভেঙে পৃথিবীর পদদলিত করার শক্তি অর্জন করেছে। প্রথম অবস্থায় নৈতিক উদ্দেশ্যেই মানুষ তার এই শক্তির প্রকাশকে সীমাবদ্ধ রেখেচিল। কিন্তু এর অন্তরালে গোপন যৌন অভিব্যক্তির সম্পর্ক আছে, কেননা এটি যৌনতাকে ক্রীতদাস প্রথা অথবা সহজাত প্রবৃত্তির ওপর অবস্থিত ক্রীত সম্পর্ককে বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। প্রাথমিক কৃষিনির্ভর ও পশুপালিত গোষ্ঠীতে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিরা পুরুষের অর্থনৈতিক সম্পত্তিরূপে বিবেচিত হত।

স্ত্রী কাজ করত স্বামীর জন্যে, পাঁচ-ছয় বছর বয়স হলে সন্তানরা চাষের কাজে অথবা প্রাণী পালনের কাজ অংশ নিত। এর ফলে শক্তিশালী পুরুষদের উদ্দেশ্য হলো যত বেশি সম্ভব স্ত্রী অধিকার করা। কিন্তু বহু বিবাহ প্রথাকে কোনো একটি গোষ্ঠীর সাধারণ নিয়মরূপে গণ্য করলে ভুল হবে। কেননা মহিলাদের অতিরিক্ত আধিক্য ঘটে নি। এ হলো গোষ্ঠী প্রধান ও বিত্তশালী পুরুষ চিত্তের প্রতিফলন মাত্র।

বহু পত্নি এবং অসংখ্য সন্তানকে মূল্যবান সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত করার মধ্যে গোষ্ঠী প্রধানের মানসিক বৃত্তি লাভের প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। কারণ, এর দ্বারা সে তার অবস্থাকে উন্নত করতে পারবে। এইভাবে স্ত্রীর প্রথম কাজ হলেঅ নিজেকে লোভনীয় গৃহপালিত পশুরূপে প্রতিপন্ন করা এবং তার যৌন কর্মধারাকে অব-সংযুক্ত করা। সভ্যতার এই পর্বে পুরুষ অতি সহজেই তার স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ আনতে পারত যদিও সেক্ষেত্রে তাকে স্ত্রীর পরিবারকে ফিরিয়ে দিত স্ত্রী কর্তৃক আনিত পণের টাকা। কিন্তু স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারটি ছিল এক অবাস্তবতা।

অধিকাংশ অর্ধ সুসভ্য গোষ্ঠী চরিত্রহীনতা সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করে তার সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গির কিছু কিছু সাদৃশ্য আছে। সভ্যতার আদি পর্বে একে নির্দ্বিধায় সহ্য করা হত। নারীত্বের অবমাননা সম্পর্কে সামাজিক বিধিনিষেধের দণ্ড ছিল মারাত্মক।

আমার যৌবনকালে আমি মুমবো জুমবো সম্পর্কে মুমবো পার্কের বিবরণ পাঠ করি, কিন্তু বর্তমানে আমেরিকানরা মুমবো জুমবোকে কাঙ্গোর দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে উন্নাসিক আনন্দ পাচ্ছে, তাতে আমি দুঃখিত।

প্রকৃতপক্ষে সে দেবতা নয় অথবা কঙ্গোর সঙ্গে সংযুক্ত নয়, সে হলো পাপী নারীদের ভয় দেখানোর জন্যে আপার নাইজার প্রদেশের অধিবাসীদের দ্বারা কল্পিত শয়তান মাত্র।

মুমবো পার্কের বিবরণে অনিবার্যভাবে ধার্মিক উৎপত্তি সংক্রান্ত ভলবারিয়াম মতবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এবং আধুনিক যুগের নৃতত্ত্ববিদেরা ঐ সত্যকে অন্যায়ভাবে অবদমিত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত আছেন। তাঁরা বর্বর জাতির কার্যধারায় ভৌতিক মানসিকতা প্রবর্তনে দুঃখিত হন।

পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সহবাস করাকে নিন্দার চোখে হয়। কিন্তু যদি কোন পুরুষ একজন অবিবাহিত রমণির সঙ্গে যৌনসঙ্গম করে বিবাহের বাজারে তার মূল্য হ্রাস না করে তাহলে সেই পুরুষকে দোষ দেওয়া হয় না।

খ্রিস্টানত্বের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই মনোভাব পরিবর্তিত হলো। বিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত ধার্মিক অনুশাসনগুলির স্বপক্ষে প্রচুর যুক্তি-তত্ত্বের অবতারণা করা যায় এবং বলা যেতে পারে যে, বিবাহকেন্দ্রিক আইনগুলি এসেছে নিষেধের উৎস থেকে; তার কেন্দ্রে সম্পত্তি সম্পর্কিত মনোভাব নেই। পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করা সেই মানুষের বিরুদ্ধে এক পাপ। কিন্তু বিবাহ ব্যতিত যেকোনো সঙ্গম হলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধ উদ্ধত মানুষের ঔদ্ধত্য প্রকাশের স্বাভাবিক ভঙ্গি।

দুর্বিনীতি পুরুষ অতি সহজ শর্তে বিবাহ নামক কঠিন সামাজিক বাধা নিষেধের বেড়াজালে নারীকে শৃঙ্খলিত করতো।

মানবিক আনন্দ দানে এই ব্যবস্থা কি ক্ষতি বৃদ্ধি করেছে? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। কৃষক শ্রেণির মধ্যে বিবাহিত রমণিদের জীবন ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং সামান্য সভ্য জাতিদের মধ্যে ঐ কাঠিন্য সবচেয়ে বেড়ে যেত। বর্বর সমাজে এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, পঁচিশ বছর বয়সে একজন নারী বৃদ্ধা হয়ে যায় এবং সেই বয়সে সে যে সৌন্দর্যের চিহ্ন বহন করতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

নারী জাতিকে গৃহপালিত পশুরূপে গণ্য করার মধ্যে পুরুষ হৃদয়ে আনন্দ সঞ্চারিত হতে পারে, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু নারীদের কাছে এই অবস্থা যন্ত্রণার এক ধারাবাহিক উপাখ্যান মাত্র।

খ্রিস্টানত্ব কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীজাতির অবস্থিতিকে আরো দুর্বিসহ করেছে। কেননা বিশেষ করে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে রমণিরা বড়জোর তাত্ত্বিক সমতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু তাদের স্বামীদের নিজস্ব সম্পত্তিরূপে সার্বিক ব্যবহারের অনুভূতির বিপক্ষে দাঁড়াবার মতো সাহস তাদের নেই। অবশ্য অন্য এক পুরুষের স্বার্থে কোনো নারী তার স্বামীকে ফেলে যাবার অনুমতি পেতে পারে না কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক জীবনের অন্বেষণে সে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারে।

সবদিকে দিয়ে বিচার করে বলা যায় যে, বিশ্বের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের মধ্যে নারীর অবস্থার উন্নতির কাজটি প্রাক খ্রিস্টান যুগ অপেক্ষা বর্তমান খ্রিস্টান যুগে সহজসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা যদি বর্তমান যুগের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে এই প্রশ্ন করি যে, মানুষ কেন ঐশ্বর্য ও বৈভবের মধ্যে অসুখ ও অশান্তির অতলে ধাবিত হচ্ছে, তাহলে তার এই উত্তর পাওয়া যেতে পারে যে, মানুষ যত সুশিক্ষিত ও সুসভ্য হচ্ছে ততই সে একজন মাত্র জীবন সঙ্গীর কাছ থেকে আজীবনের আনন্দ অন্বেষণ করা থেকে বিরত হচ্ছে।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত আইরিশ চাষিরা বাবা-মা পছন্দে বিয়ে করত। তাদের সুখি ও পবিত্র দাম্পত্য জীবনে অতৃপ্তির ছায়া পড়ে নি। সাধারণভাবে বলা যায়, জনগণ যেখানে পরস্পরের মধ্যে সমভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করে সেখানে বিবাহ হয় সহজতম পন্থা। যদি এক পুরুষের সঙ্গে অন্য পুরুষের সামান্য পার্থক্য থাকে এবং এক নারী থেকে আরেক নারীর বিশেষ বৈসাদৃশ্য না থাকে তাহলে আমরা কোনো এক নির্দিষ্ট পুরুষ অথবা নারীকে বিবাহ করতে পারি না বলে দুঃখিত হব না।

কিন্তু বিচিত্র মনোভাবাপন্ন, বিভিন্ন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উদ্ভাসিত মানব চরিত্রে সঙ্গি নির্বাচনের জটিলতা দেখা যায়। তাই আকাক্ষা অনুসারে যদি সঠিক সঙ্গি না পাওয়া যায় তাহলে অতৃপ্তি আসতে পারে। চার্চ বিবাহ ব্যবস্থাকে যৌনতার কেন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার কর্তব্যের প্রয়োসী। তাই সে এই যুক্তিতে বিশ্বাস করে না যে, একজন সঙ্গি কেন অন্য সঙ্গির মতো গ্রহণযোগ্য হবে না। এই কারনে চার্চ বিবাহ থেকে উদ্ভূত কঠিন বিষণ্ণতাকে গ্রহণ না করে বিবাহের অচ্ছেদ্যতা সম্পর্কে মনোনিবেশ করেছে।

আরেকটি অবস্থায় বৈবাহিক আনন্দ লাভ করা যায় না। যখন বিবাহিত পুরুষরা সম্মানীয়া মহিলাদের সাক্ষাতে আসে তখন সামাজিক ঘটনাবলির অনুপস্থিতি ও অনধিকৃত নারীজাতির দুষ্প্রাপ্যতা এই বোধকে জাগিয়ে তোলে। যদি বিবাহিতা রমণি ভিন্ন অন্য কোনো রমণির সঙ্গে বহির্বৈবাহিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কোনো বাসনা দেখা যায় তাহলে একথা মনে রাখতে হবে যে, পুরুষ প্রতিকূল পরিবেশের মদ্যে নিজের অস্তিত্বকে সহনীয় করে তোলার জন্যে এই অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। অবশ্য এর কয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এই ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশেষ করে যদি তারা এই অনুভূতি দ্বারা উজ্জীবিত না হয় যে, বিবাহ অতি অবশ্যই সুখ অম্বেষণ করবে। একথা বলার অর্থ স্বামী ও পুরুষের চোখে বিবাহ ব্যবস্থা তখনই সুখি বলে গণ্য হবে যখন অন্য কেউ এর চেয়ে বেশি আনন্দের উৎসকে গ্রহণ করতে পারবে না।

সামাজিক প্রথার সীমাবদ্ধতা একই কারণে অসুখি বিবাহকে রোধ করতে পারে। যদি বিবাহের বন্ধনকে সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে চরম স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাহলে বহির্গমনের কাল্পনিক স্পন্দন অনুভূত হবে না এবং এই ভাবনা মনের মধ্যে আন্দোলিত হবে যে, শুধুমাত্র স্বর্গীয় আনন্দই অধিকতর সুখ প্রদায়িরূপে বিবেচিত হতে পারে।

মনে এ ধরনের অবস্থান হলে পারিবারিক শান্তি রক্ষা করা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, পুরুষ অথবা নারী সাধারণ স্বীকৃত মানের নিচে পদক্ষেপ করবে না। নান্দনিক অভিব্যক্তি সেই মূল্যায়ণের ভিত্তিকে সেখানেই স্থাপিত করুক না কেন।

আধুনিক পৃথিবীর সুসভ্য মানুষের কাছে এই শর্তগুলির একটিও খাটে না এবং অধিকাংশ বিবাহ প্রথম কয়েক বছরের পর অর্থহীন দৈনন্দিন দীনতায় পর্যবসিত হয়। অতৃপ্তির কয়েকটি কারণ সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। কিন্তু নর-নারী যদি বর্তমান অপেক্ষা আরো বেশি সভ্য হয় তাহলে অন্য কারণগুলি অবলুপ্ত হতে পারে।

শেষোক্ত বিষয়টি আলোচনা করা হোক। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষতিসাধনকারী যৌনশিক্ষা। সাধারণ কৃষক সমাজ অপেক্ষা বিত্তশালী সমাজে এর প্রভাব অধিকতর ক্ষতিকারক। শৈশব অবস্থায় জীবন সত্যের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া মোটেই উচিত নয়। ক্ষতি-উদ্রেকারী যৌন বিষয়ক পুস্তক পাঠ করে শিশুরা মানব-মানবীর চিরন্তন সম্পর্কের অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা অনুধাবন করার চেষ্টা করে।

পক্ষান্তরে বিত্তশালী পরিবারের সযত্নে শিক্ষিত শিশুরা যৌন সংক্রান্ত ব্যবহারিক জ্ঞান লাভে অসমর্থ হয়। এমন কি আধুনিক যুগের পিতা-মাতারা যারা শিশুদের শিক্ষাদানের কর্তব্যে নিয়োজিত, তারা কিন্তু সন্তানদের মধ্যে বাস্তববাদী অভিজ্ঞতার আবেদন সঞ্চারিত করে না, যে চেতনা কৃষকপুত্র অতি শৈশবে অর্জন করে। খ্রিস্টান সভ্যতা এই শিক্ষা দিয়েছে যে, মানব-মানবী যখন বিবাহ করে তখন তাদের মধ্যে পূর্ববর্তী যৌন অভিজ্ঞতা থাকে না। যেখানে এই অবস্থা কার্যকরি তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফল অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক।

যেহেতু যৌন অভিব্যক্তি এক সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি নয়, তাই অনভিজ্ঞ পাত্র ও পাত্রী এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকায় এর মধ্যে লজ্জা ও দুঃখ কষ্টকে বহন করে। যদি পুরুষ গণিকাদের সংস্পর্শে এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করে এবং মহিলা থাকে অসহায় তাহলে সামান্য সুখ সঞ্চিত হতে পারে। অধিকাংশ পুরুষই এই সত্যটাকে স্বীকার করে না যে, বিবাহের পরেও প্রেমের পদ্ধতি প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। অনেক সযত্ন-পালিত যৌবন প্রাপ্তা রমণিরা অনুধাবন করতে পারে না যে, বিবাহের পর আত্মনিয়ন্ত্রিত ও শারীরিকভাবে উদাসীন থেকে তারা কি ক্ষতি করছে।

সার্থক যৌন শিক্ষা দ্বারা এই মনোভাবগুলির পরিবর্তন করা যেতে পারে। তরুণতর প্রজাতির কাছে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু পিতামহদের যুগে এর অনুপ্রবেশ দেখা যায় নি। রমণিদের মধ্যে দীর্ঘসঞ্চারি বিশ্বাস আছে যে, তারা নৈতিকভাবে পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠা, কেননা তারা যৌন সংক্রান্ত বিষয়ে পুরুষ অপেক্ষা অধিকতর জ্ঞানসম্পন্না।

.

 এই মনোভাব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বচ্ছ আবরণ পড়ে তোলে। কেননা যৌন উন্মাদনার অস্থিরতার মধ্যে পবিত্রতা ভঙ্গকারী মনোভাবের চেয়ে বেশি মাত্রায় সংযুক্ত আছে শারীরবৃত্তয় অথবা মনস্তাত্ত্বিক অসম্পূর্ণতা। যেমনভাবে আমরা বুঝতে পারি না যে, একশো বছর আগে অভিজাত রমণিরা স্বল্পাহারে অভ্যস্ত ছিল।

বৈবাহিক নিরানন্দের অন্যান্য আধুনিক কারণগুলি সহজে উন্মোচিত করা যায় না। আমি বিশ্বাস করি যে, সুসভ্য মানুষ, নর-নারী নির্বিশেষে সহজাত ভাবে বহু বিবাহে বিশ্বাসী। হয়তো তারা কোনো একজনকে কিছুদিন ধরে প্রচন্ড ভালোবাসে, তার প্রতি নিজের সমস্ত অনুভুতিকে নিয়োজিত করতে পারে। কিন্তু একদিন না একদিন যৌন অন্তরঙ্গতা কামনার শিখাকে স্নান করবে, তখন শুরু হবে প্রাক্তন উত্তেজনার পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপক অন্বেষণ।

অবশ্য নৈতিকতার দিক থেকে অনেকে এই জাতীয় মনোভঙ্গিকে সংযত করতে পারে। কিন্তু তা হলো দুরুহ কাজ।

নারীমুক্তি আন্দোলন যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নারীরা যতই স্বাধীন হয়ে উঠেছে ততই তারা দাম্পত্য সুখের অধিকতর সুযোগ পাচ্ছে। যে সুযোগ প্রাচীন সমাজে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। সুযোগ কল্পনার জন্মদাতা, কল্পনা আকাঙ্ক্ষাকে লালন করে, এবং ধার্মিক অনুশাসনের অনুপস্থিতিতে ঐ আকাক্ষা কার্যধারায় নিয়োজিত হয়।

নারীজাতির নবমূল্যায়ণ নানাভাবে বিবাহ ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। প্রাচীণ যুগে স্ত্রী তার স্বামীর কাছে আত্মনিবেদন করতে বাধ্য হত কিন্তু স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রতি অনুগতা হবার জন্য তাকে বাধ্য করা হত না। বর্তমান যুগের ব্যক্তিস্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ নারীজাতিকে তাদের অস্তিত্বের সংকট সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবিত করে তুলেছে। যুগযুগান্ত ধরে সঞ্চিত পুরুষ শাসিত সমাজের সার্বিক প্রাধান্যের প্রাচীন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার সময় সমাসন্ন এবং নব্য যুগের রমণিরা যে কোন পুরুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে স্বেচ্ছা-নিবেদিতা হচ্ছে না তা ভেবে পুরুষরা অবাক হয়ে যাচ্ছে।

চারিত্রিক অপবিত্রতার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি সবিশেষ আলোচনার অপেক্ষা রাখে। সে যুগে পুরুষরা সাধারণত আনুগত্য প্রকাশে অক্ষম হত। কিন্তু নিয়ম অনুসারে তার স্ত্রী এ খবরটি জানত। যদি কোনো সময়ে স্বামীর লাম্পট্যের কথা স্ত্রীর কর্ণগোচর হত তাহলে স্বামী তার কাছে স্বীকারোক্তি করত এবং ভবিষ্যতে সে আর চরিত্র স্থলনের পথে পা দেবে না, স্ত্রীর চিত্তে এই বিশ্বাস উৎপাদন করত।

অপরপক্ষে স্ত্রী ছিল সাধারণতভাবে পবিত্র। কোনো কারণে তার চারিত্রিক শুদ্ধতা লঙ্ঘনের কথা স্বামীর কর্ণগোচর হলে বিবাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যেত। আধুনিক যুগে দেখা যায় বিবাহের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আনুগত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা হয় না, ঈর্ষাবোধ জেগে ওঠে এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ দমনকারী অন্তরঙ্গতার অনুসন্ধানে কেউই সচেষ্ট হয় না।

আধুনিক বিবাহের আরেকটি সীমাবদ্ধতা আছে। যারা ভালোবাসার মূল্য সম্পর্কে অতি মাত্রায় সচেতন, তারা এই অবস্থাটি উপলব্ধি করতে পারবে। ভালোবাসা বিস্তার লাভ করে যখন সে থাকে স্বাধীন ও স্বতোৎসারিত। তার মধ্যে কর্তব্যবোধ আরোপিত হলে সে কল্পনার দ্বারা নিহত হয়। তুমি আমায় এই কারণে ভালোবাসবে, আমার প্রতি তোমার এই কর্তব্য আছে ইত্যাদি চিন্তা ভালোবাসাকে ঘৃণায় রূপান্তরিত করে। প্রেমের সঙ্গে আইনগত বন্ধন সমবায়ে বিবাহ দুটি ধারার মধ্যে সংযুক্তি সাধন করে। কবিতার ভাষায় এই ধারণাটির সম্যক রূপায়ণ ঘটেছে এই ভাবে:

আমার অন্তরে কখনো ছিল না সেই ধারণা।
জন্ম হতে সবার, সকলের, সাধারণ নির্বাচনা।
পুরুষ আমার কাছে প্রিয় অথবা সখা
প্রেম ভালোবাসা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা সতত উপেক্ষা করে
শুধুই শাসন
শীতল অভিযোগ, যদিও তা নীতি-ব্যঞ্জক।
আধুনিক নীত এবং ব্যথিত পন্থা।
ঐসব দরিদ্র ক্রীতদাসের ক্লেদাক্ত
পদচিহ্নের ছাপ
 যারা মৃত্যুর পথে ভ্রমণ করেছে।
এসেছেন দৃপ্ত রাজপথে, পৃথিবীর পান্থশালায়
 যারা নিঃস্ব পথিক
এবং বন্দি মানুষের কান্না শোনে,
 দেখে তার ঈর্ষিত শঠতা,
প্রিয়তম ও দীর্ঘতম ভ্রমণ অন্তে।

এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিবাহের বিরুদ্ধবাদী হিসেবে ভালোবাসাকে স্বীকার করে নিতে মানুষ সদা কুণ্ঠিত এবং সম্মান ও সহানুভূতি সহকারে এই বিষয়টির মধ্যে নতুনতর মাত্রা সংযোগ রক্ষার সূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যেতে পারে যে, মানুষ এ ব্যাপারে কিছুমাত্রায় হিংসাশ্রয়ী গ্রহণযোগ্য অথবা স্বকাক্ষিত। অন্য সকল প্রকার নিয়ন্ত্রিত নৈতিকতার মতো এই ব্যবস্থা জীবনের সম্পূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে রক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। অর্থাৎ যে মনোভাব সবকিছুকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ অন্বেষণ করে।

এই সকল কারণে আমরা বিবাহের সবকটি সুদিককে স্মরণে রেখে বলতে পারি যে, বিবাহপ্রথা এক সামাজিক জটিলতা এবং হয়তো এটি হলো সুখের ওপর স্থাপিত অদৃশ্য বাধা যাকে অন্য কোনো নতুন উপায়ে অপসারিত করতে হবে। এই ব্যবস্থার প্রতিষেধক হিসেবে আমেরিকাতে সহজ বিচ্ছেদের বিপুল প্রয়োগ দেখা গেছে। আমার মনে হয়-সকল মানুষ এ ব্যাপারে একমত হবেন যে, ইংলিশ ল-এ বিবাহ বিচ্ছেদের যে কারণগুলি আছে তদপেক্ষা অনেক বেশি কারণ সুপ্ত আছে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে। কিন্তু সহজ বিচ্ছেদ প্রথাকে বৈবাহিক সমস্যার সমাধানরূপে, স্বীকৃতি দিতে আমার প্রবল আপত্তি।

বিবাহ যেখানে সন্তানহীন, বিচ্ছেদ অনেক ক্ষেত্রে সু-উপযুক্ত সমাধান। হয়তো উভয় পক্ষেই সুচারু ব্যবহারের জন্যে অপ্রাণ চেষ্টা করেছে কিন্তু যেখানে সন্তান পালনটি জড়িয়ে আছে সেখানে বিবাহের স্থায়িত্ব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। (পরিবার সংক্রান্ত আলোচনায় আমি এই বিষয়টির ওপর ব্যাপক আলোকপাত করতে চাই) আমার মনে হয়, যেখানে বিবাহ ফলপ্রসু হয়েছে এবং এতে অংশগ্রহণকারী উভয়পক্ষ বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন ও সুন্দর মনোভাবের অধিকারী তখন এই বন্ধনকে জীবনব্যাপী বলে আশা করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিবাহ যে অন্যান্য যৌন সম্পর্ককে বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে, এমন ভাবা অনুচিত।

বিবাহের শুরুতে আছে কর্মক্লান্ত ভালোবাসা এবং সমগ্র ঐচ্ছিক উন্মাদনাকে সন্তান উৎপাদনের প্রতি ধাবিত করা হয়েছে। যখন বহু কষ্টে অর্জিত প্রেমময় বন্ধন দ্বারা দৃঢ় অন্তরঙ্গতাকে নিজেদের সান্নিধ্যের অনত্মবাহী মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত করা হয়ে থাকে। এমনকি যদি যৌন আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটে এবং একজন অথবা উভয়েই অন্য কারোর প্রতি যৌন আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে তাহলেও এই অমূল্য সম্পদটি হারিয়ে যায় না।

বিবাহের এই সুমধুর সঙ্গীতের ছন্দপতন ঘটিয়েছে অসুয়া মনোবৃত্তি। কেননা হিংসা ও ঈর্ষা হলো সহজাত প্রবৃত্তি। যদিও তাকে সংযত কর যেতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র নৈতিক ভাবাদর্শের সত্যবদ্ধ উচ্চারণে তার মৃত্যু ঘটবে না।

যে ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার অন্তরালে দীর্ঘ বছর বাহিত স্থায়িত্ব এবং গভীরভাবে অনুভূত ঘটনারাজির স্মৃতি আছে তা ভালোবাসাকে এতখানি সম্পদে সজ্জিত করে যেটা প্রেমের প্রথম দিনগুলিতে অপ্রাপ্তব্য ছিল– হয়তো সেই মুহূর্তগুলি ছিল অনন্ত আনন্দময়। যেকোনো মানুষ, যে সময়ের উপকারিতায় বিশ্বাস করে, সে জানে নতুন প্রেমের সন্ধানে এই দীর্ঘ অনুভূত ভালোবাসাকে বিদায় দেওয়ার আর এক নাম বোকামি।

এই কারণে সুসভ্য মানব-মানবী বিবাহের মধ্যে সুখ অন্বেষণের সম্ভাবনা দেখতে পায়। কিন্তু এর জন্যে কয়েকটি শর্ত পূরণের দাবি আছে। উভয় পথে সার্বিক সমতার অনুভূতি থাকা প্রয়োজন, পারস্পরিক স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করা হবে না। শারীরিক ও মানসিক অন্তরঙ্গতার নিখাদ সমাবেশ দেখা যাবে এবং মূল্যমাণ সম্পর্কে সাধারণ সাদৃশ্য থাকবে। (যদি একজন অর্থের সন্ধান করে আর অন্যজন ভালো কাজের সম্মান করে তবে তার ফল হয় মারাত্মক)।

.

এই শর্তগুলি পালিত হলে বিবাহকে আমরা দুটি মানব সত্তার মধ্যে গ্রহণযোগ্য ও অস্তিত্ব যোগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এখনো অবধি বিবাহের সম্যক উপলব্ধি হয় নি, এর প্রধান কারণ হলো এই যে, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে অন্যের নিরাপত্তা রক্ষাকারী হিসেবে মনে করে যদি বিবাহকে তার সংবেদনশীলতা অর্জন করতে হয় তাহলে স্বামী স্ত্রীরা অবশ্যই একথা মনে রাখবে যে, আইন যাই বলুক না কেন, ব্যক্তিগত জীবনে তারা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *