১৭. উপসংহার

ঊনবিংশ অধ্যায় উপসংহার

আমাদের ভ্রমণ শেষে পিছন দিকে তাকাইয়া বিহগ-দৃষ্টিতে আলোচিত বিষয়গুলির উপর এক চোখ বুলাইয়া লই।

শিক্ষকের থাকা উচিত স্নেহ-ধৃত এবং প্রীতিপুষ্ট জ্ঞান; এই জ্ঞান তাঁহার নিকট হইতে ছাত্রগণ অর্জন করিবে। শিক্ষার্থীর বাল্যকালে শিক্ষক তাহার প্রতি প্রীতি প্রদর্শন করিবেন; পরে শিক্ষার্থীর বয়স কিছু বেশি হইলে, শিক্ষায় কাজে লাগিবে যে জ্ঞান তাহার মধ্যে শারীরবৃত্ত [Physiology) স্বাস্থ্যতত্ত্ব [Hygiene] এবং মনস্তত্ত্ব [Psychology] প্রধান; শেষোক্তটি অর্থাৎ মনোবিদ্যার সহিত শিক্ষকের বিশেষ পরিচয় থাকা উচিত। শিশু যেইরূপ প্রবৃত্তি ও প্রতিবর্তী [Reflex] লইয়া জন্মগ্রহণ করে পরিবেশের প্রভাবে তাহা হইতে নানারূপ অভ্যাস গড়িয়া তোলা যায় এবং এইভাবে তাহাদের চরিত্রের বৈচিত্র্য সম্পাদন করাও সম্ভবপর। অতি শিশুকালই এইরূপ শিক্ষার প্রকৃষ্টসমত্ম; কাজেই এই বয়সে আমাদিগকে বিশেষ যত্নের সহিত শিশুর চরিত্রগঠনের কাজে ব্রতী হইতে হইবে। যাহারা বর্তমান জগতের অন্যায় অনাচার জিয়াইয়া রাখিতে চাহে তাহারাই বলিবে মানুষের প্রকৃতিকে বদলানো সম্ভবপর নয়। তাহারা যদি বলে যে, শিশুর বয়স ছয় বৎসর হওয়ার পর তাহার স্বভাব বদলানো সম্ভবপর নয় তবে তাহাদের কথায় কিছুটা সত্য আছে বলিতে হইবে। যদি তাহারা বলে যে, শিশু যে প্রবৃত্তি ও প্রতিবর্তী লইয়া জন্মে তাহার পরিবর্তন সাধন অসম্ভব তবে তাহাতেও কিছুটা সত্য আছে স্বীকার করিতে হইবে; যদিও সুপ্রজনন [Eugenics] দ্বারা হয়তো এইক্ষেত্রে সুফল লাভের আশা করা যায়। কিন্তু তাহারা যখন বলে যে, বর্তমান যুগের সাধারণ মানুষ যেইরূপ জীবন ও যেইরূপ অভ্যাসে অভ্যস্ত হইয়াছে তাহা হইতে অন্য ধরনের আচরণে অভ্যস্ত মানুষ গড়িয়া তোলা অসম্ভব, তখন তাহারা আধুনিক মনোবিজ্ঞানকেই উপেক্ষা করিতেছে। দুইটি শিশু যদি একই রকম চরিত্র অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও প্রতিবর্তী এবং অন্যান্য শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে, ভিন্ন রকম পরিবেশে লালিত-পালিত করিয়া তাহাদিগকে সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকম অভ্যাসে অভ্যস্ত বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত করা যায়। বাল্যকালীন শিক্ষার কর্তব্য হইল শিশুর প্রবৃত্তিগুলিকে এমনভাবে শিক্ষা দিয়া বিকশিত করা যাহার ফলে শিশুর চরিত্রের প্রয়োজনীয় গুণগুলি সুসমঞ্জস্যভাবে বর্ধিত হইতে পারে। এইরূপ শিক্ষার ফলে শিশুর মনোভাব ধ্বংসশীল না হইয়া হইবে সৃজনশীল; গোপনস্বভাব না হইয়া সে হইবে স্নেহশীল, সে হইবে সাহসী, সরল এবং বুদ্ধিমান। বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই এইরূপ শিক্ষা দেওয়া সম্ভবপর, যথায় শিশুর উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা আছে তথায়ই প্রকৃতই এইরূপ ফল পাওয়া যাইতেছে। যদি শিশুশিক্ষা সম্পর্কিত আধুনিক জ্ঞান এবং পরীক্ষিত প্রণালী প্রয়োগ করা যায় তবে এক পুরুষকালের মধ্যেই আমরা এমন সমাজ গড়িয়া তুলিতে পারি যাহা হইবে প্রায় সম্পূর্ণ রোগমুক্ত, বিদ্বেষমুক্ত এবং মূর্খতামুক্ত। আমরা এইরূপ করি না, কারণ আমরা অত্যাচার ও যুদ্ধেরই বেশি পক্ষপাতী।

শিশু যে প্রবৃত্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে তাহা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঞ্ছিত এবং অবাঞ্ছিত উভয় কার্যের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে পারে। পূর্বে লোকে প্রবৃত্তিকে শিক্ষার ভিতর দিয়া সুসংস্কৃত করিয়া তুলিবার কৌশল জানিত না। তাহারা দমননীতির আশ্রয় লইত। শাস্তি দিয়া এবং ভয় দেখাইয়া শিশুর গুণগুলির বিকাশের চেষ্টা করা হইত। আমরা এখন জানি যে, দমন প্রণালী একান্ত ভ্রান্ত, ইহা কখনো সফল হয় না, তাহা ছাড়া ইহা মানসিক বিফলতা সৃষ্টি করে। প্রবৃত্তিকে বাঞ্ছিত পথে চালিত করার জন্য নূতন পন্থা অবলম্বন করিতে হয়। অভ্যাস এবং কৌশল যেন শিশুর প্রবৃত্তিগুলির আত্মপ্রকাশের পথ; পথের গতি যেই দিকে প্রবৃত্তিও জলধারার মতো সেইদিকে প্রবাহিত হয়। শিশুকে উপযুক্ত অভ্যাস এবং উপযুক্ত কৌশল আয়ত্ত করাইয়া তাহার প্রবৃত্তিকে বাঞ্ছিত কাজে উদ্দীপ্ত করা যায়। শিশুর লোভ দমনের কোনও প্রয়োজন হয় না। কাজেই জোর জবরদস্তিরও কোনো আবশ্যকতা নাই। নিষেধ করিয়া শিশুকে কোনো কাজ হইতে নিবৃত্তি করায় তাহার মনে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি তাহা উৎপাদনের কোনো কারণ ঘটে না, সকল কাজেই শিশু স্বতঃপ্রবৃত্ততা ও স্বাধীনতা বোধ করে। শিশুর শিক্ষা সম্বন্ধে যে প্রণালী উল্লিখিত হইয়াছে সকল ক্ষেত্রেই যে তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে হইবে এমন কথা নাই। অদৃষ্টপূর্ব এমন কারণ ঘটিতে পারে যাহার ফলে হয়তো প্রাচীন প্রণালী প্রয়োগ করার আবশ্যকতা দেখা দিবে। কিন্তু শিশু মনোবিদ্যা যতই পরীক্ষিত হইয়া বৈজ্ঞানিক সত্যরূপে প্রতিপন্ন হইতে থাকিবে এবং নার্সারি স্কুলের অভিজ্ঞতা যতই সঞ্চিত হইতে থাকিবে শিশুর চরিত্রগঠনে নূতন প্রণালী ততই যথার্থভাবে প্রয়োগ করা সহজ হইয়া আসিবে।

আমাদের সম্মুখে যে বিস্ময়কর সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত আছে তাহারই কথা পাঠকের নিকট উপস্থাপিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি। চিন্তা করিয়া দেখুন ইহার ফল কীরূপ সুদূরপ্রসারী হইতে পারে; স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা, সুখ, সহৃদয়তা, বুদ্ধি সবই প্রায় সর্বজনীন। আমরা ইচ্ছা করিলে এক পুরুষকালের মধ্যেই পৃথিবীতে নূতন মানব-সমাজের সৃষ্টি করিতে পারি।

কিন্তু স্নেহপ্রীতি ব্যতীত ইহার কিছুই সম্ভবপর নহে। জ্ঞান বিদ্যমান আছে; কিন্তু প্রীতির অভাবের কথা চিন্তা করিয়া আমি নিরাশ হইয়া পড়ি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যৌনব্যাধিসহ শিশুর জন্ম নিরোধ করার জন্য বিশেষ কোনো চেষ্টা হয় না; প্রায় সকল নৈতিক নেতাই এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়। ইহা সত্ত্বেও শিশুদের প্রতি আমদের স্বাভাবিক যে প্রীতিবোধ আছে তাহা ক্রমশ প্রসার লাভ করিতেছে। সাধারণ নরনারীর অন্তরে শিশুর প্রতি যে মমতা ও সহানুভূতির প্রকাশ দেখা যায় কয়েক যুগের নিষ্ঠুরতা তাহা আবৃত করিয়া রাখিয়াছে। ধর্মে দীক্ষিত না হইলে শিশু যে মহাপাতকি হয় এইরূপ প্রচারকার্য হইতে ধর্ম প্রচারকগণ অল্প কিছুকাল আগে মাত্র নিবৃত্ত হইয়াছেন। উগ্র জাতীয়তাবোধের উত্তাপে মানবতাবোধ শুকাইয়া যায়; যুদ্ধের সময় আমরা এমন অবস্থা সৃষ্টি করিয়াছিলাম যাহার ফলে জার্মানির সকল শিশু রিকেট রোগগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। আমাদের স্বাভাবিক মমত্ববোধকে মুক্তি দিতে হইবে; যদি কোনোনীতির ফলে শিশুদের উপর অত্যাচার বা দুর্ভোগ প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয় তবে আমাদের নিকট প্রিয় যতই হোক না কেন সে নীতি বর্জন করিতে হইবে। প্রায় সকল ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিষ্ঠুর নীতির মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি হইল ভীতি; এইজন্যই বাল্যকালে ভয় দূর করার প্রতি আমি এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করিয়াছি। আমাদের মনের অন্ধকার গুহায় যে-ভয় দূর করার প্রতি আমি এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করিয়াছি। আমাদের মনের অন্ধকার গুহায় যে-ভয় লুকাইয়া আছে তাহাকে নির্মূল করিতে হইবে। আধুনিক শিক্ষাধারা যে সুখপূর্ণ জগতের সম্ভাবনা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছে তাহা লাভ করিতে কিছুটা ব্যক্তিগত বিপদ বরণ করিতে হইলেও তাহার জন্য চেষ্টা করা উচিত।

আমরা যদি কিশোর-কিশোরীদিগকে ভয় ও দমন হইতে মুক্ত রাখিতে পারি, আমরা যদি তাহাদিগকে বিদ্রোহী এবং প্রতিহত প্রবৃত্তিগুলির আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে পারি তবে আমরা তাহাদের নিকট জ্ঞানের রাজ্য সম্পূর্ণ অবারিত করিয়া দিতে পারিব। বিজ্ঞতার সহিত শিক্ষা দিলে তখন শিক্ষাগ্রহণকার্য শাস্তির মতো মনে না হইয়া শিশুর নিকট আনন্দদায়ক হইয়া দাঁড়াইবে। শিশুকে এখন যে পরিমাণ শিক্ষণীয় বিষয় শিখানো হয় তাহা অপেক্ষা বেশি শিখানো প্রয়োজন হইবে না। শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ ব্যাপারে মনোভাবের পরিবর্তন সাধনই বিশেষ প্রয়োজন শিক্ষা ব্যাপারটিকে ছাত্র যেন স্বাধীনতার ভিতর দিয়া নূতন বিষয় আবিষ্কারের জন্য আনন্দপ্রদ অভিযান বলিয়া মনে করে। শিক্ষাক্ষেত্রে এইরূপ ভাবধারা প্রবর্তিত হইলে বুদ্ধিমান ছাত্রগণ নিজেদের চেষ্টায় তাহাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াইতে চেষ্টা করিবে এই বিষয়ে তাহাদিগকে সাহায্য করিবার জন্য সকল রকম সুযোগ-সুবিধা দিতে হইবে। জ্ঞান মানুষকে ধ্বংসকারী প্রবৃত্ত ও আবেগ হইতে রক্ষা করে, জ্ঞান বিনা আমাদের আশার জগৎ গড়িয়া তোলা সম্ভব হইবে না। আমাদের নির্জন মনের গোপনস্তরে কুসংস্কারের ভয় লুকাইয়া থাকে কিন্তু সকল বালক-বালিকা যদি নির্ভীক স্বাধীনতার মধ্যে শিক্ষালাভের সুযোগ পায় তবে এক পুরুষকালের মধ্যেই তাহারা আমাদের অপেক্ষা ব্যাপকতর এবং বলবত্তর আশার অধিকারী হইবে। আমরা দেখিতে পাইব না কিন্তু আমরা যে মুক্ত নরনারী নূতন শিক্ষাব্যবস্থার ভিতর দিয়া গড়িয়া তুলিব তাহারাই নূতন জগৎ দেখিতে পাইবে প্রথমে দেখিবে তাহাদের আশার স্বপ্নে; পরে দেখিবে বাস্তবের পরিপূর্ণ মহিমায়।

পথ পরিষ্কার। যেইরূপ সন্তানপ্রীতি থাকিলে এই পথ গ্রহণ করিতে বাসনা জাগে তাহা কি আমাদের আছে? কিংবা আমরা নিজেরা যেইরূপ দুর্ভোগ ভুগিয়াছি আমাদের শিশুদিগকেও সেইরূপ ভুগিতে দিব? আমরা কি তাহাদিগকে নির্যাতন ও নিপীড়নের ভিতর দিয়া বাল্যকাল কাটাইতে দিয়া যৌবনে নিরর্থক প্রতিরোধ্য যুদ্ধে নিহত হইতে দিব? সুখসমৃদ্ধি ও মুক্তির পথে তাহার রকমের ভয় ও বাধা বিঘ্ন আসিয়া উপস্থিত হয় কিন্তু প্রেমপ্রীতির শক্তি সব রকম ভয় জয় করিতে পারে; আমরা যদি আমাদের সন্তানদের প্রকৃতই ভালোবাসি জগতে কিছুই আমাদিগকে এই কল্যাণকর কার্য হইতে নিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *