১৫. দিবা স্কুল ও বোর্ডিং স্কুল

সপ্তদশ অধ্যায় — দিবা স্কুল ও বোর্ডিং স্কুল

কোনো বালক বা বালিকা বাড়ি হইতেই স্কুল করিবে, না আবাসিক বিদ্যালয়ের বোর্ডিং-এ থাকিয়া পড়াশুনা করিবে, তাহা অবস্থা এবং মনঃপ্রকৃতি বুঝিয়া নির্ধারণ করা উচিত। উভয় ব্যবস্থারই সুবিধা আছে; কোনো কোনো বিষয়ে দিবা স্কুল বেশি সুবিধাজনক, কোনো বিষয়ে আবার আবাসিক স্কুলের সুবিধা বেশি। আমার নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষার ব্যাপারে আমি কোন্ কোন্ যুক্তি বিবেচনা করিব তাহারই উল্লেখ করিতেছি; বিবেকবান অপর মাতাপিতার নিকটও এইগুলি গ্রহণীয় মনে হইতে পারে।

প্রথম বিবেচ্য বিষয় হইল স্বাস্থ্য। স্কুলের সত্যিকারের অবস্থা যাহাই হউক না কেন, গৃহ হইতে স্কুলে ছাত্রের স্বাস্থ্যরক্ষার বেশি সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর। তথায় সাধারণ চিকিৎসক, দন্তচিকিৎসক এবং শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সর্বাধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন তত্ত্বাবধায়িকা নিযুক্ত করা চলে কিন্তু কর্মব্যস্ত পিতামাতার পক্ষে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা সহজ নহে। ইহা ছাড়া স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিদ্যালয় অবস্থিত হইতে পারে। শহরবাসী পিতামাতার পক্ষে এইরূপ বিদ্যালয়ের প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক। তরুণদের পক্ষে মফস্বল অঞ্চলে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানোই ভালো; তাহাদের পিতামাতাকে। শহরে বাস করিতে হইলে শিক্ষার জন্য তাহারা বোর্ডিং স্কুলে থাকিতে পারে। স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল মনে করিয়া বোর্ডিং স্কুলে পুত্রকন্যা পাঠাইবার যে যুক্তি তাহাও বেশিদিন প্রয়োগ করা যাইবে না, কেননা শহরেও লোকের স্বাস্থ্য ক্রমশ। ভালোর দিকে যাইতেছে। লন্ডনে কৃত্রিম অতিবেগুনি আলো [Ultra violet light] প্রয়োগ করিয়া পল্লি অঞ্চলের অনুরূপ স্বাস্থ্যবিধানের ব্যবস্থা হইতেছে। তবু শহরে রোগের প্রকোপ কমাইতে পারিলেও শিশুদের স্নায়ুর উপর কুফল বিস্তার করিতে পারে এইরূপ বিষয় থাকিবে। অবিরাম শব্দ ও কোলাহল শিশু এবং বয়স্ক সকলের পক্ষেই খারাপ; পল্লির দৃশ্য, ভেজা-মাটির গন্ধ, বাতাস, নক্ষত্র প্রভৃতি প্রত্যেক নরনারীর স্মৃতিতে জমাইয়া রাখা উচিত। কাজেই আমার মনে হয়, শহরে স্বাস্থ্যের উন্নতি হোক না কেন, বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময় কিশোর-কিশোরীদের পল্লি অঞ্চলে বাস করার বিশেষ প্রয়োজন আছে।

আবাসিক বিদ্যালয়ের পক্ষে আর একটি যুক্তি যদিও খুব প্রবলযুক্ত নয়। অনেকেরই বাড়ির কাছাকাছি ভাল স্কুল থাকে না, বাড়ি হইতে স্কুলের দূরত্ব বেশ কিছুটা হইতে পারে। পল্লিবাসীদের পক্ষে এ যুক্তির গুরুত্ব আছে; স্বাস্থ্যের অনুকূল যুক্তিটি শহরবাসীদের প্রতি প্রযোজ্য।

শিক্ষাপ্রণালীতে যখন কোনো নূতন পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, তখন আবাসিক বিদ্যালয় না হইলে চলে না করণ যে সকল পিতামাতা এইরূপ পরীক্ষার পক্ষপাতী তাঁহারা যে একই অঞ্চলে বাস করিবে এবং নিজেদের পুত্রকন্যাদিগকে একই দিবা স্কুলে পাঠাইবেন এইরূপ আশা করা যায় না। শিশুদের বেলায় এইকথা প্রযুক্ত হয় না। তাহারা তখনও শিক্ষা-কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ আওতার মধ্যে আসে না। এইজন্য মাদাম মন্তেসরি এবং শ্রীমতী ম্যাকমিলান অত্যন্ত গরিব শিশুদের উপর তাহাদের শিক্ষাপ্রণালীর পরীক্ষা করার সুযোগ পাইয়াছিলেন। পক্ষান্তরে বালক-বালিকার বিদ্যালয়-জীবন শুরু হইলে কেবল ধনীব্যক্তিরাই তাহাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সম্বন্ধে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে। বেশিরভাগই পুরাতন গতানুগতিক পন্থাই পছন্দ করে। যে সামান্য কতকজন নূনতত্ব চাহে তাহারা দেশর মধ্যে ইতস্তত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বলিয়া তাহাদের ছেলেমেয়েদের একই দিবাস্কুলে পাঠাইতে পারে না। কাজেই এইরূপ ক্ষেত্রে বোর্ডিং স্কুলই গবেষণা ও নূতন প্রণালী পরীক্ষার একমাত্র স্থান হইয়া দাঁড়ায়।

বোর্ডিং স্কুলের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলিও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। স্কুল জীবনের অনেক দিকই অপ্রকাশিত থাকিয়া যায় : স্কুল একটি কৃত্রিম জগৎ। এখানকার সমস্যা আর বহির্জগতের সমস্যা একই জাতীয় নয়। যে বালক বোর্ডিং স্কুলে থাকে, কেবল ছুটির দিনে বাড়িতে আসে এবং তাহার ফলে সকলেই তাহার প্রতি স্নেহের আতিশয্য প্রকাশ করে, সংসার সম্বন্ধে সে যতটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করে সেইসব বালক যাহারা প্রতি সকাল-বিকাল বাড়িতে থাকে। মেয়েদের সম্বন্ধে এইকথা ততখানি সত্য নয় কেননা অনেক বাড়িতেই আজকাল তাহাদিগকে অনেক কিছু করিতে হয়। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষা যতই বালকদের অনুরূপ হইবে ততই তাহাদের গৃহের জীবনও বালকদের মতো হইতে থাকিবে এবং আবাসিক বিদ্যালয়ে বাস করার ফলে গার্হস্থ্য-জীবন সম্বন্ধে তাহাদের জ্ঞান লোপ পাইবে। পনেরো-ষোলো বৎসর বয়সের পর পুত্রকন্যাদের পিতামাতার পেশা ও সাংসারিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংসারে সমস্যা বা অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা বেশি পরিমাণে তাহাদের উপর চাপিলে পড়াশুনার বিঘ্ন হইতে পারে কিন্তু তবু তাহাদের কিছু কিছু উপলব্দি করা উচিত যে, বয়স্ক ব্যক্তিদের নিজেদের জীবন আছে, আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। সংসারের জন্য তাহাদের প্রয়োজনও আছে। স্কুলে কিশোর তরুণ ছাত্রগণই সব; তাহাদের জন্যই সব কিছু করা হয়। ছুটির দিনে, উৎসবের দিনে তরুণদেরই প্রাধান্য। কাজেই আবাসিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্ধতভাবে গড়িয়া উঠার দিকে ঝোঁক দেখা যায়; বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনের সমস্যা সম্বন্ধে তাহারা বিশেষ কোনো খোঁজখবর রাখে না, পিতামাতার সংস্রব হইতেও তাহারা দূরে থাকিয়া যায়।

এই অবস্থা কিশোরদের জীবনে কিছুটা খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। পিতামাতার প্রতি তাহাদের ভালোবাসা কমিয়া যায় এবং যে সকল লোকের রুচি, কর্মজীবন তাহাদের মতো নয় এইরূপ লোকের সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া চলিবার শিক্ষা তাহারা পায় না। ইহার ফলে স্বার্থপরতা এবং অন্য সকলের সংস্রব নিজেকে দূরে পৃথক করিয়া রাখিবার প্রবণতা দেখা দেয়। এইরূপ মনোভাবের প্রধান প্রতিষেধক হইল পারিবারিক জীবন; পরিবারের একসঙ্গে বিভিন্ন বয়সের বালক-বালিকা বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ বাস করে, তাহাদের ভিন্ন ভিন্ন কাজ আছে। কিন্তু ছাত্রাবাসে শুধু একই ধরনের প্রায় একই বয়সের লোক বাস করে। এইজন্য ইহা পরিবারের অভাব পূরণ করিতে পারে না। সন্তানগণ পিতামাতাকে জ্বালাতন করে বলিয়াই প্রধানত তাহারা তাহাদিগকে ভালবাসেন; পিতামাতা যদি সন্তানদের উপর কাজের চাপ না দেন তবে তাহারাও পিতামাতাকে বিশেষ আমল দিতে চায় না। তবে শাসন এবং কাজের চাপ যেন অস্বাভাবিক না হয় সে বিষয়ে অবশ্য লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা তরুণদিগকে শিখিতে হইবে; অন্য যে-কোনো স্থান অপেক্ষা গৃহেই ইহা শিক্ষা করা সহজতর। পুত্রকন্যাগণের ইহা জানা ভাল যে, তাহাদের পিতাকে অনেক সময় নানা ঝামেলায় বিব্রত থাকিতে হয়, তাহাদের জননীরও সংসারের নানা খুঁটিনাটি লইয়া ঝামেলা কম নয়। কৈশোরে, কিশোর-কিশোরীরা যখন বাল্যকাল অতিক্রম করিয়া যৌবনে প্রবেশ করে সেই বয়ঃসন্ধির যুগে তাহাদের মনে পিতামাতার প্রতি প্রতিরোধ থাকা চরিত্রগঠনের পক্ষে উপকারী। পারিবারিক প্রীতি সম্বন্ধ না থাকিলে সংসার হয় মাধুর্যবিহীন ও যান্ত্রিক ভাবাপন্ন; এরূপ সংসারে লোকজন প্রত্যেকেই স্বার্থপরভাবে আত্মপ্রাধান্য লাভের চেষ্টা করে এবং অকৃতকার্য হইলে মুষড়াইয়া পড়ে। স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি অপরের সুখদুঃখের অংশভাগী হইতে পারে না, নিজেদের ব্যর্থতার দুঃখ লাঘব করার জন্য তাহারা অপরের সহানুভূতিও পায় না। গৃহের পরিবেশ হইতে দূরে আবাসিক বিদ্যালয়ে বালক বালিকা শৈশব অতিবাহিত করিলে এই কুফল ফলে। আবাসিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য কতক সুবিধা কিন্তু তাহার সঙ্গে তুলনায় এই কুফলের গুরুত্বই বেশি।

আধুনিক মনোবিজ্ঞানী অবশ্য বলেন, পিতা বা মাতার অত্যধিক প্রভাব শিশুর জীবনে খুবই অপকারী। কিন্তু শিশু যেখানেই দুই বা তিন বৎসর বয়স হইতেই বিদ্যালয়ে যাইতে শুরু করে সেখানে এইরূপ প্রভাবের কোনো কারণ আছে বলিয়া মনে করি না। অল্প বয়স হইতেই দিবা-স্কুলে যাইতে আরম্ভ করিলে পিতামাতার অতিরিক্ত শাসন বা একেবারে সম্পর্ক-শূন্যতা-এই দুই চরম অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভবপর হয়। গৃহের পরিবেশ যদি ভাল হয় তবে বাড়ি হইতে দৈনিক স্কুলে গিয়া পড়াশুনা করাই সর্বোত্তম পন্থা।

বোর্ডিং-এ বাস করার আরও একটি অসুবিধা আছে। ভাবপ্রবণ বালককে সমবয়সীদের সঙ্গে রাখায় অনেক সময় বিপদের কারণ ঘটে। বছর বারো বয়সের বালকগণ সাধারণত দুর্দান্ত ভাবপ্রবণ হয়। কিছুদিন আগেও একটি বড় পাবলিক স্কুলে শ্রমিকদলের সমর্থক বলিয়া একটি ছাত্র অন্য ছাত্রগণ কর্তৃক প্রহৃত হইয়া আহত হইয়াছিল। যে-সকল বালক অভিমত ও রুচিতে বেশিরভাগের মতো হইতে পারে না তাহাদের ভাগ্যেই লাঞ্ছনা ঘটিবার সম্ভাবনা। বুয়র যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে সর্বাধুনিক ও প্রগতিশীল বোর্ডিং স্কুলেও বুয়রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রদের উপর অত্যাচার হইত।

যে বালক বেশি পড়াশুনা করিতে ভালবাসে কিংবা নিজের কাজ অপছন্দ করে না তাহারই অন্য সকলের হাতে লাঞ্ছিত হইবার সম্ভাবনা। ফ্রান্সে বুদ্ধিমান ছাত্রদিগকে পাঠানে হয় ইকোল নর্মাল সুপিরিয়রে অর্থাৎ উচ্চতর ধরনের বিদ্যালয়ে। সেখানে তাহারা মাঝারি ধরনের ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। এই ব্যবস্থার সুবিধা আছে; মেধাবী ছাত্রদিগকে জোর করিয়া সাধারণের পর্যায়ে নামাইয়া রাখা হয় না বা অত্যাচার করিয়া তাহাদিগকে কতকগুলি মাঝারি বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণের স্তাবকে পরিণত করা হয় না। এইরূপ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার ফলে মেধাবী ছাত্রগণ অন্যের অপ্রীতিভাজন হওয়ার হাত হইতে অব্যাহতি পায়। তাহা ছাড়া সকল ছাত্রই তীক্ষ্ণধী হওয়ায় তাহাদের পাঠও দ্রুত অগ্রসর হইতে থাকে, কম বুদ্ধিমান ছাত্র সহপাঠী থাকিলে এত দ্রুত পাঠদান সম্ভবপর হইত না। এইরূপ বিদ্যালয়ের একটি দোষ এই যে, বুদ্ধিমান লোকদিগকে ইহা সমাজের সাধারণ মানুষ হইতে পৃথক করিয়া দেয়; ইহার ফলে ইহাদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে বোঝা একটু কঠিন হয়। ইংল্যান্ডের সমাজে উচ্চশ্রেণির বালকদের জন্য যে বিদ্যালয় রহিয়াছে তথায় ভালরকম খেলাধুলা না জানিলে অসাধারণ প্রতিভাবান বালকের উপরও অত্যাচার করা হইয়া থাকে। ইহার তুলনায় ফ্রান্সের উন্নত বিদ্যালয়গুলিতে কিছু সম্ভাব্য অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেইগুলি আমার নিকট শ্রেয় বলিয়া মনে হয়।

তবে বালকদের বর্বরতা দুরারোগ্য নয়, বস্তুত পূর্বের তুলনায় ইহা এখন অনেক কমিয়াছে। টম ব্রাউনস্ স্কুল ডে [Tom Browns School Day] পুস্তকে যেইরূপ বিবরণ আছে বর্তমানের পাবলিক স্কুল সম্বন্ধে তাহা প্রয়োগ করিলে অতিরঞ্জন বলিয়া মনে হইবে। যে-সকল বালক বাল্যে উপযুক্ত শিক্ষা পাইয়াছে তাহাদের পক্ষে ইহা আরও কম প্রযোজ্য। আমার মনে হয় সহশিক্ষা বালকদিগকে ভদ্র হইতে অভ্যস্ত করে। বালক ও বালিকার মধ্যে যে প্রকৃতিগত কোনোরূপ পার্থক্য আছে তাহা স্বীকার না করিলেও আমি মনে করি যে, বালকেরা নিজেদের সঙ্গে কাহারও মতের গরমিল হইলেই যেমন দৈহিক অত্যাচার করিতে কসুর করে না, বালিকাদের প্রবৃত্তি সেইরূপ নয়। কোনো বালকের বুদ্ধি যদি অন্যান্য সাধারণ বালকের তুলনায় অধিকতর প্রখর হয় কিংবা নীতিজ্ঞান ও ভাবপ্রবণতায় অনন্য সাধারণ হয় অথবা সে যদি রাজনীতিতে রক্ষণশীল ভাবের সমর্থক ও ধর্মমতে গোঁড়া না হয় তবে তাহাকে পাঠানো চলে এমন বোর্ডিং-স্কুল ইংল্যান্ডে খুব কমই আছে। এইরূপ বালকদের পক্ষে বর্তমানের পাবলিক স্কুলের ব্যবস্থা সন্তোষজনক নহে। অথচ অসাধারণ প্রতিভাবান প্রায় সকল ছাত্রই এইরূপ ছাত্রের দলভুক্ত।

বোডিং-স্কুলের স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলি আলোচনা করা হইল তাহার মধ্যে দুইটিই প্রধান এবং অপরিবর্তনীয় একটি স্বপক্ষে, একটি বিপক্ষে। স্বপক্ষে যুক্তি হইল। পল্লির স্বাস্থ্য, ফাঁকা আলোবাতাস, প্রশস্ত জায়গার সুবিধা। বিপক্ষের যুক্তি হইল– পারিবারিক স্নেহপ্রীতি এবং কর্তব্যবোধ শিক্ষার অসুবিধা। যে-সকল পিতামাতা পল্লিতেই বাস করেন তাহাদের পক্ষে বোর্ডিং-স্কুলের স্বপক্ষে অন্য যুক্তি আছে– যেমন, কাছাকাছি কোথাও ভালো দিবা স্কুল না থাকা। বোর্ডিং স্কুলের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে এমন যুক্তি রহিয়াছে যে, কোনটি শ্ৰেয় তাহা নির্ণয় করা সত্যই কঠিন। পুত্রকন্যাদের স্বাস্থ্য যদি খুব ভালো হয় তবে বোর্ডিং স্কুলে থাকিলে স্বাস্থ্য ভালো থাকিবে এ যুক্তির জোর কমিয়া যায়। আবার ছেলেরা যদি পিতামাতার প্রতি অনুরক্ত হয় তবে বাড়িতে থাকিয়া স্কুল না করিলেই যে তাহারা পিতামাতার প্রতি প্রীতিশূন্য হইয়া পড়িবে এ যুক্তিও দুর্বল হইয়া পড়ে। কেননা ছুটির মধ্যে তাহারা বাড়িতে আসার সুযোগ পাইবে এবং পারিবারিক স্নেহ হইতে বঞ্চিত হইবে না। দীর্ঘ ছুটির মধ্যে বাড়িতে থাকিলে স্নেহের বাড়াবাড়িও বেশি থাকিবে না। অসাধারণ প্রতিভাবান বালকের বোর্ডিং স্কুলে না যাওয়াই ভাল, সে যদি অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ হয় তবে তাহাকে স্কুলে না পাঠানোই সমীচীন। অবশ্য ভালো স্কুল খারাপ গৃহ অপেক্ষা শ্রেয় এবং ভালো গৃহ খারাপ স্কুলের তুলনায় বাঞ্ছনীয়। যথায় দুইটিই ভাল তথায় অবস্থা বিবেচনা করিয়া ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত।

ধনশালী অভিভাবকগণ নিজেদের ইচ্ছামত সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারেন; এই পর্যন্ত এইরূপ অভিভাবকের দিক হইতে প্রশ্নটি বিবেচনা করা হইয়াছে। রাজনৈতিক দিক হইতে বিবেচনা করিলে এই প্রসঙ্গে আরও অন্য প্রশ্ন ওঠে। বোর্ডিং-স্কুল পরিচালনার ব্যয়ের কথা আছে, আবার শিশুদিগকে গৃহ হইতে সরাইয়া লইলে বাসগৃহের সমস্যা কতটা সহজ হয় সেই বিষয়ও বিবেচনাযোগ্য। আমার দৃঢ় অভিমত এই যে, খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রকে ব্যতিক্রম স্বরূপ বাদ দিয়া প্রত্যেকের আঠারো বৎসর বয়স পর্যন্ত পুঁথিগত শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, কেবলমাত্র বৃত্তিমূলক শিক্ষা ইহার পরে শুরু করিতে হইবে।

দিবা-স্কুল বোর্ডিং-স্কুলের মধ্যে কোনটি শ্ৰেয় এ প্রশ্নের উত্তরে উভয় পক্ষেই যথেষ্ট বলিবার আছে। তবে টাকার প্রশ্ন বিবেচনা করিলে দিনমজুরদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য দিবা-স্কুল বাঞ্ছনীয় বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *