১৪. বিদ্যালয়-জীবনের শেষ কয়েক বৎসর

ষোড়শ অধ্যায় — বিদ্যালয়-জীবনের শেষ কয়েক বৎসর

 আমি ধরিয়া লইয়াছি যে, পঞ্চদশ বৎসরের গ্রীষ্মের ছুটির পর যে সকল বালক-বালিকা কোনো বিষয়ে উন্নতির বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করে তাহাদিগকে ওইরূপ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হইবে। ইহাও ধরিয়া লওয়া যায় যে, এইরূপ শিক্ষার্থীর সংখ্যা হইবে অনেক। যদি কোনো শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ের প্রতি ঝোঁক বা কোন বিষয়ের উপযুক্ত মানসিক শক্তি আছে তাহা এই সময়ের মধ্যে নিরূপণ করা সম্ভবপর না হয় তবে তাহাকে আরও কিছুদিন সাধারণ-শিক্ষাই দিতে হইবে। বিশেষ প্রতিভাবান ছাত্রের ক্ষেত্রে উন্নততর শিক্ষা পনেরো বৎসর বয়সের আগেও আরম্ভ করা যাইতে পারে। বিশেষ কারণ থাকিলে শিক্ষা ব্যাপারে এই নিয়মগুলির ব্যতিক্রম করা চলে। কিন্তু আমার মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তিতে যাহারা সাধারণ বা মাঝারি প্রকৃতির বালক-বালিকার তুলনায় উপরের স্তরে তাহাদের চৌদ্দ বৎসর বয়সের কাছাকাছি সময়ে উন্নততর বিশেষ শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হওয়া উচিত। যাহারা মাঝারির নিচে তাহাদের হাতের কাজ ছাড়া স্কুলে অন্য কোনো বিষয়ে উন্নততর শিক্ষা না দেওয়াই ভালো। হাতের কাজ বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে এখানে কিছু বলিব না। আমার মনে হয় চৌদ্দ বৎসর বয়সের পূর্বে ইহা আরম্ভ করা উচিত নহে এবং তখনও স্কুলে সর্বক্ষণ কেবল এই কাজেই ছাত্রকে নিয়োজিত রাখা সমীচীন নয়। ইহার জন্য কতখানি সময় দিতে হইবে, সকল ছাত্রকেই এইরূপ বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া উচিত কি না কিংবা কেবল অল্প সংখ্যককেই দিতে হইবে এই সকল প্রশ্ন এখানে আলোচনা করিতে চাহি না। ইহা করিতে গেলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা ওঠে, সংক্ষেপে ইহা বিশদভাবে আলোচনা করা চলে না। তাহা ছাড়া শিক্ষার সঙ্গে ইহা কেবল পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। কাজেই চৌদ্দ বৎসর বয়সের পর ছাত্রের বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রেই আমার বর্তমান আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখিব।

স্কুলের পাঠ্য বিষয়গুলিকে আমি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করিতে চাই: (১) প্রাচীন সাহিত্য, (২) অঙ্ক ও বিজ্ঞান, (৩) আধুনিক সংস্কৃতিমূলক বিষয়। আধুনিক ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য এই তৃতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত। আমি অনুমান করিয়া লইয়াছি যে, আঠারো বৎসর বয়সের পূর্বে ছাত্রগণ বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিবে না। ইতোমধ্যে এই তিনটি বিভাগের প্রত্যেকটি বেশ খানিকটা উন্নততর বিশেষ শিক্ষাদান করা সম্ভব। যাহারা প্রাচীন সাহিত্য পড়িবে তাহারা নিশ্চয়ই লাতিন ও গ্রিক দুই ভাষাই শিখিবে। তবে কেহ হয়তো একটিতে, অপর কেহ বা অন্যটিতে বেশি অগ্রসর হইতে পারে। প্রথমে অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা একই সঙ্গে চলিবে কিন্তু বিজ্ঞানের কতক শাখায় খুব বেশি অঙ্ক ছাড়াও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভবপর। বস্তুত এমন কতকজন উঁচু দরের বৈজ্ঞানিক আছেন যাঁহারা অঙ্কে বিশেষ পারদর্শী নন। কাজেই ষোলো বৎসর বয়সে আমি কোনো বালক বা বালিকাকে অঙ্কে কিংবা কোনো বিজ্ঞানে বিশেষ উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করিতে উৎসাহিত করিব, তবে সে যাহাতে অন্য বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করে সেইদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আধুনিক সংস্কৃতিকমূলক বিষয়গুলি সম্পর্কেও এই অভিমত প্রযোজ্য।

কতকগুলি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় আছে তাহা প্রত্যেকের জানা উচিত। শারীরস্থান [Anatomy], শারীরবৃত্ত [Physiology] এবং স্বাস্থ্যবিদ্যা [Hygiene] বয়স্ক ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে যে পরিমাণে কাজে লাগে তাহা অবশ্য শিক্ষণীয়। এই বিষয়গুলি যৌনশিক্ষারও সঙ্গে সংযুক্ত, কাজেই হয়তো ছাত্ররা এই শিক্ষা মোটামুটিভাবে আগেই পাইয়াছে, কারণ যৌবনাগমের পূর্বেই যৌনশিক্ষা দেওয়া উচিত। খুব বেশি বা কম বয়সে যৌন শিক্ষাদানের বিরুদ্ধে যুক্তি এই যে, যখন এই সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন তাহার পূর্বেই ছাত্র যাহাতে ইহা ভুলিয়া না যায়। আমার মনে হয় এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হইল দুইবার এই শিক্ষা দেওয়া একবার যৌবনাগমের পূর্বে খুব সরল এবং মোটামুটিভাবে এবং পুনর্বার স্বাস্থ্য এবং রোগ সংক্রান্ত আলোচনার সময়। ইহা ছাড়া প্রত্যেক ছাত্রেরই পার্লামেন্ট এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে কিছু কিছু জানা আবশ্যক; কিন্তু লক্ষ্য রাখিতে হইবে এই সম্পর্কে শিক্ষাদান যেন রাজনৈতিক প্রচারকার্য হইয়া না দাঁড়ায়।

পাঠ্যক্রমের তুলনায় শিক্ষাদান-রীতি এবং শিক্ষকের আন্তরিকতার প্রশ্নই প্রধান। শিক্ষাগ্রহণ কাজ খুব সহজ না করিয়াও কিভাবে আনন্দদায়ক করা যায় তাহাই হইল প্রধান সমস্যা। ছাত্রদিগকে উন্নততর শিক্ষা অর্জন করিতে কঠোর পরিশ্রম করিতেই হইবে। তবে এইরূপ পরিশ্রম লাঘব করিবার জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন পুস্তক পাঠ ও বৃক্ততার আয়োজন করা চলে। যেমন কোনো গ্রিক ভাষার নাটক পড়িতে আরম্ভ করার আগে গিলবাট মারে কিংবা অন্য কোনো কবিত্ব শক্তি সম্পন্ন অনুবাদক কর্তৃক অনূদিত গ্রিক নাটক ছাত্রদিগকে পড়িতে দেওয়া উচিত। অঙ্ক শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনই অঙ্ক আবিষ্কারের ইতিহাস, বিভিন্ন বিজ্ঞান এবং দৈনন্দিন জীবনের উপর অঙ্কের প্রভাব আলোচনা করা যায়। উচ্চতর ধরনের অঙ্কের মধ্যে যে অনেক আনন্দের উপাদান আছে তাহার ইঙ্গিতও দেওয়া উচিত। অনুরূপভাবে ইতিহাস শিক্ষাও ছাত্রদের নিকট প্রীতিপদ করা চলে। মাঝে মাঝে ইতিহাস প্রসঙ্গ আলোচনা করিয়া ছাত্রদিগকে বিস্তৃততর পাঠে উদ্বুদ্ধ করা চলে, যেমন ইতিহাসের কোনো ঘটনা বা গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কোনো ব্যাপক মন্তব্য করিয়া তাহা সত্য কি না প্রমাণ করিবার জন্য ছাত্রদিগকে অধিকার পাঠে উৎসাহিত করা যায়। বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ যে সকল সহজ পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশিত হয় সেইগুলি পাঠ করিয়া ছাত্রগণ বিজ্ঞানের যে দিকটা পাঠ করিতেছে তাহা বর্তমানে কোন্ পথে চলিতেছে, তাহার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাই বা কিরূপ ইহাও ছাত্রগণ বুঝিতে পারিবে।

এখানে যে প্রণালীর উল্লেখ করা হইল তাহা কেবল শিক্ষার্থীদিগকে গভীরতর পাঠে এবং কঠোরতম অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত করিবার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা উচতি; বিস্তৃততর পাঠে আত্মনিয়োগ না করিয়া ছাত্রগণ যদি এইরূপ আলোচনা বা বহিরঙ্গকেই উন্নততর পর্যায়ের পাঠ বলিয়া গ্রহণ করে তবে ইহা ক্ষতিকর হইবে। জ্ঞানার্জনের সহজ পন্থা আছে ছাত্রদের মনে এই ধরনের ভাবগড়িয়া উঠিতে দেওয়া কখনই সমীচীন নয়। পূর্বে শিক্ষার্থীকে পাঠ অনুশীলনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে হইত; তাহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বর্তমান পাঠ্যানুশীলকে অত্যন্ত লঘু এবং আরামের কাজ করিবার ঝোঁক দেখা দিয়াছে। এইখানেই আধুনিক শিক্ষার প্রকৃত বিপদ নিহিত। প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতিতে পাঠ্য অনুশীলনের জন্য কঠোর মানসিক পরিশ্রম সত্যই উপকারী ছিল। কিন্তু এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর বুদ্ধিদীপ্ত অনুরাগ নষ্ট করিয়া ফেলিত, ইহাই ছিল তখনকার শিক্ষাপ্রণালীর প্রধান দোষ। জ্ঞানার্জনের জন্য মানসিক পরিশ্রমের একান্ত প্রয়োজন আছে কিন্তু পূর্বের শিক্ষাবিগণ ইহাকে যেমন নীরস যান্ত্রিক পর্যায়ে ফেলিয়াছিলেন তেমন না করিয়া অন্য উপায়ে আমাদিগকে ইহার অভ্যাস প্রবর্তন করিতে হইবে। ইহা অসম্ভব বলিয়া আমি মনে করি না। আমেরিকায় এমন দেখা গিয়াছে যাহারা স্কুলের পড়াশুনায় অলস ছিল তাহারাই আইন বা ডাক্তারি পড়িবার সময় কঠোর পরিশ্রমের কাজে স্বেচ্ছায় ব্রতী হয়। তাহার কারণ শেষোক্ত কাজে তাঁহারা গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। মূল কথা এইখানেই : স্কুলের কাজ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ছাত্রের মনে এই বোধ জাগাইয়া দিন, তবেই তাহারা ইহার জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে কুণ্ঠিত হইবে না। কিন্তু আপনি যদি কাজটি খুবই সহজ করিয়া দেন তবে তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিবে আপনি তাহাদিগকে এমন কিছু দিতেছেন না যাহা বিশেষ মূল্যবান ও যাহা আয়ত্ত করা পরিশ্রম সাপেক্ষ। হরিণ যেমন কলাগাছে শিং ঠুকিয়া আনন্দ পায় না, শক্ত গাছের সঙ্গে শিং ঘষিতে চায় তেমনই বুদ্ধিসম্পন্ন বালক-বালিকা কঠিন বিষয় আয়ত্ত করিতে আনন্দ বোধ করে। উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ভিতর দিয়া ছাত্রদের ভীতি দূর করিতে পারিলে অনেক বালক-বালিকা, যাহাদিগকে এখন বোকা এবং অলস বলিয়া মনে হয়, তাহারাই রীতিমত বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে।

শিক্ষার সকল স্তরেই শিক্ষার জন্য আগ্রহ ও উদ্যম ছাত্রদের মধ্য হইতেই প্রকাশ হওয়া উচিত। শিশুদের মধ্যে কিভাবে এই উদ্যম ও শিক্ষালাভের প্রয়াস সৃষ্টি করা যায় তাহা মাদাম মন্তেসরি দেখাইয়াছেন। অধিক বয়স্ক শিশুদের বেলায় ভিন্ন প্রণালী অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। প্রগতিশীল সকল শিক্ষাবিদই এখন স্বীকার করেন যে, একই শ্রেণিতে অনেক ছাত্র বা ছাত্রী একত্রে কাজ করিতে থাকিলেও ছাত্রের ব্যক্তিগত কাজের উপরই বেশি জোর দেওয়া উচিত। গ্রন্থাগার এবং বিজ্ঞানশালা [Laboratory] সুসজ্জিত এবং প্রশস্ত হওয়া উচিত। দিনের বেশ কিছুটা সময় ছাত্র নিজের ইচ্ছামত স্বাধীনভাবে কাজ করিবার সুযোগ পাইবে; সে কোন বিষয় পড়িতেছে এবং সে সম্বন্ধে কতটুকু জ্ঞাতব্য বিষয় সংগ্রহ করিয়াছে তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখিয়া রাখিবে। ইহার ফলে পঠিত বিষয় তাহার স্মৃতিতে স্পষ্টতর হইবে, উদ্দেশ্যবিহীন এলোমেলো পাঠের পরিবর্তে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছিবার জন্য পাঠ হইবে উদ্দেশ্যযুক্ত শিক্ষক ও ছাত্রকে যখন যেটুকু সাহায্য করা প্রয়োজন তাহা করিয়া তাহাকে ঠিক পথে নিয়ন্ত্রিত করিবার সুযোগ পাইবেন। ছাত্র যত বেশি বুদ্ধিমান হইবে তত কম নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক হইবে। কমবুদ্ধি ছাত্রদিগকে অধিকতর সাহায্য ও পরিচালনার প্রয়োজন হইবে; কিন্তু এইরূপ ক্ষেত্রেও পরিচালনার অর্থ ছাত্রকে কোনো নির্দিষ্ট কার্য করিতে আদেশ করা নয় অভিভাবন [Suggestion], অনুসন্ধান ও উৎসাহ দ্বারা তাহাকে আত্মচেষ্টায় জয়যুক্ত হইতে অনুপ্রাণিত করা। ছাত্রদের জন্য কতকগুলি বিষয় নির্ধারিত করিয়া দিতে হইবে এবং প্রথমে সহজ হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমশ কঠিনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কতকগুলি অনুশীলনী তাহাদিগকে আয়ত্ত করাইতে হইবে। এইভাবে তাহার স্বচেষ্টায় সাফল্য লাভের সম্ভাবনা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস অর্জন করিতে পারিবে।

যুক্তিতর্ক শিক্ষা : নিয়মিত অধ্যয়ন ও তৎসংক্রান্ত অন্যান্য কাজ ছাড়াও বালক-বালিকাদিগকে বর্তমানকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় বিতর্কমূলক প্রশ্নগুলির সহিত পরিচিত করাইতে হইবে। এই প্রশ্নগুলির শুধু একদিকে নয়, সকল দিকের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিতর্ক জানিবার জন্য তাহাদিগকে রীতিমত পড়াশুনা করিতে হইবে। কেহ যদি কোনও এক পক্ষ সমর্থনযোগ্য মনে করে তবে তাহার বিপরীত মত পোষণকারীকে যুক্তিতর্ক দ্বারা তাহা বুঝাইতে হইবে। এইভাবে বিতর্কসভার পরিচালনা করা উচিত। সত্য নির্ধারণের জন্য যথার্থ বিতর্কের যথেষ্ট মূল্য আছে। এইসকল বিতর্কসংকুল প্রশ্নের কোনো বিশেষ দিকের প্রতি শিক্ষকের গভীর আস্থা থাকিলেও তাঁহার কোনো পক্ষ গ্রহণ করা উচতি হইবে না। যদি প্রায় সকল ছাত্রই এক পক্ষ গ্রহণ করে তখন আলোচনা চালাইবার জন্য কেবল তর্কের খাতিরেই এক পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করিতেছেন এইকথা বলিয়া তিনি যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হইতে পারেন। তাহা না হইলে তাহার কর্তব্য হইবে ছাত্রদের যুক্তি বিষয়বস্তুতে ভুল থাকিলে তাহা সংশোধন করিয়া দেওয়া। এইভাবে বিতর্ক ও আলোচনার দ্বারা ছাত্রগণ সত্য নির্ধারণ করিতে শিখিবে; কথার জাল বুনিয়া বাকযুদ্ধে জয়ী হওয়া তর্ক বা বিতর্কের উদ্দেশ্য নয়।

আমি যদি বয়স্ক বালক-বালিকাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হইতাম তবে বর্তমান যুগের সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াইয়া চলা এবং ইহাদের সম্বন্ধে প্রোপাগান্ডা করা মোটেই বাঞ্ছনীয় মনে করিতাম না। জগৎ সংসারে সকল লোকের নিকট যে-সমস্যা প্রধান বলিয়া মনে হয় তাহা যদি শিক্ষায়তনেও স্বীকৃত ও আলোচিত হয় তবে শিক্ষার্থীরা অনুভব করে যে, তাহারা জগৎ হইতে পিছাইয়া পড়িয়া নাই এবং তাহাদের শিক্ষা তাহাদিগকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করিতেছে। তাহারা বুঝিতে পারে যে, পুঁথিগত শিক্ষা তাহাদিগকে বাস্তব জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন। করে না। কিন্তু আমি আমার নিজের অভিমত ছাত্রদের উপর চাপাইতে চাহি না। বাস্তব প্রশ্নের বিশ্লেষণ করিয়া সত্য নির্ধারণ করিতে কিভাবে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে যুক্তিপ্রবণ মনোভাব গ্রহণ করিতে হয় তাহারই আদর্শ আমি ছাত্রদের সম্মুখে স্থাপন করিব। আমি আশা করিব ছাত্রগণ বাজে তর্ক, হইচই করার পরিবর্তে সুযুক্তি প্রয়োগ করিতে শিখিবে। রাজনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ করিয়া এই অভ্যাস খুব মূল্যবান কিন্তু খুবই বিরল। প্রত্যেক উগ্র রাজনৈতিক দল গুটিপোকার মতো কতকগুলি ভ্রান্ত ধারণার আবরণের আড়লে মানসিক দিক দিয়া নিশ্চিন্তে নিষ্ক্রিয় হইয়া থাকে। উত্তেজনা অনেক সময় বুদ্ধিনাশ করে; পক্ষান্তরে বুদ্ধিপ্রধান ব্যক্তিগণের জীবনে দেখা যায় বিচার-বুদ্ধি তাহাদের ভাবের আবেগ নাশ করিয়া তাহাদিগকে শুষ্ক নীরস ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই দুই অবস্থার কোনোটিই কাম্য নয়; এই দুই অবস্থাই এড়াইতে পারিলেই ভালো। ভাবাবেগ বাঞ্ছনীয় যদি ইহা ধ্বংসমুখি না হয়; বুদ্ধির বেলাতেও সেই কথা খাটে। আমি আশা করিব রাজনৈতিক ভাবাবেগ হইবে গঠনমূলক এবং বুদ্ধি এই আবেগ সফল করিয়া তুলিতে সাহায্য করিবে। বুদ্ধির কাজ হইবে কতকগুলি অলীক কল্পনার রাজ্য ভাবাবেগকে চালিত না করিয়া বাস্তব এবং প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলজনক কার্যে ইহাকে নিয়োগ করা। বাস্তব জগতে আমরা যখন কোনো বাঞ্ছিত বিষয়লাভে অসমর্থ হই, তখন আমরা কল্পনার আশ্রয় লই যথায় চেষ্টা ব্যতিরেকেই আমাদের কামনা তৃপ্তি লাভ করে; বাস্তবের রূঢ় আঘাত মনকে কোমল কল্পনার জগতে ঠেলিয়া দেয়। ইহাই হিস্টিরিয়া রোগের মূল কারণ। ইহা উগ্র জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত, ধর্মতত্ত্বগত ও শ্রেণিগত ভ্রান্ত ধারণাও মূল কারণ। ইহা চরিত্রের দুর্বলতার পরিচায়ক; এইরূপ দুর্বলতা বর্তমান যুগে প্রায় সর্বজনীন হইয়া পড়িয়াছে। চরিত্রের এই দুর্বলতা জয় করা বয়স্ক ছাত্রদিগকে শিক্ষাদানের সময় আদর্শ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। এই চারিত্রিক দুর্বলতা দূর করিবার দুইটি উপায় আছে, যদিও ইহাদিগকে পরস্পরবিরোধী মনে হইতে পারে। প্রথমত, এই বাস্তব জগতে কতখানি কাজ আমাদের সাধ্যায়ত্ত সেই সম্বন্ধে ধারণা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, রূঢ় বাস্তবতা কেমন করিয়া আমাদের স্বপ্ন কল্পনা ভাঙিয়া দিতে পারে সেই সম্বন্ধে অধিকতর সচেতন হওয়া। ওই উভয় প্রক্রিয়ারই মূলনীতি এক অলস কল্পনার রাজ্যে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে বাস না করিয়া আমাদিগকে বলিষ্ঠচিত্ত ও বস্তুনিষ্ঠ হইতে হইবে।

আত্মমুখিতার একটি প্রধান উদাহরণ ডন কুইকজোট। প্রথমে সে যখন একটি শিরস্ত্রাণ তৈয়ার করে, ইহার আঘাত সহ্য করিবার পক্ষে যথেষ্ট শক্ত হইয়াছে কি না পরীক্ষা করিতে গিয়া সে শিরস্ত্রাণটিকে পিটিয়া বিকৃত করিয়া ফেলে। পরে যখন অন্য একটি তৈয়ার করিল সে আর পরীক্ষা করিয়া দেখিল না, মনে করিল সেইটি চমৎকার হইয়াছে। এইরূপ মনে করিবার অভ্যাস তাহার সমগ্র জীবন প্রভাবিত করিয়াছে। অপ্রীতিকর কোনো অবস্থার সম্মুখিন না হওয়াও এই একইরূপ মনোভাবের ফল; আমরা সকলেই কমবেশি রকমের ডন কুইকজোট। ডনকুইকজোট যদি স্কুলে ভাল শিরস্ত্রাণ নির্মাণ করিতে শিখিত এবং তাহার সঙ্গীরা যদি সে যাহা ভাল বলিয়া মনে করে তাহাই বিনা প্রতিবাদে ভালো বলিয়া মানিয়া না লইত তবে সে এইরূপ আচরণ করিত না। শিশুরা যখন দুর্বল থাকে এবং মনের বাসনাকে কার্যে পরিণত করিতে পারে না তখন তাহাদের পক্ষে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করা শোভন এবং স্বাভাবিক। এইরূপ মনোবিলাস তাহাদের মানসিক রোগের পরিচায়ক নয়। কিন্তু বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের ইহা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে কল্পনা কেবল অবাস্তব কল্পনারূপে মনে বাসা বাঁধিয়া থাকিলে কোনো লাভ নাই। আগে হউক আর পরেই হউক কল্পনাকে যতখানি বাস্তবে পরিণত করা যায় ততখানিই ইহার সার্থকতা। বালকেরা যেমন অন্য বালকদিগের ব্যক্তিগত অহমিকা দূর করিতে পারে এমন আর কেহ পারে না। সঙ্গীদের সঙ্গে মিশিয়া কোনো বালকের পক্ষে নিজের অসাধারণ ক্ষমতার বড়াই করা সম্ভবপর হয় না, কেননা তাহাদের নিকট তাহার দোষগুণ বিশেষ ঢাকা থাকে না। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষকদিগের সহযোগিতায় নূতন ধরনের দন্ড ছাত্রদের মনে দানা বাঁধিয়া ওঠে। যেমন: নিজের স্কুল সকল স্কুলের অপেক্ষা ভালো, নিজের দেশ সকল দেশের সেরা, নিজের সামাজিক শ্রেণি (ছাত্র যদি অভিজাত বংশসস্তৃত হয়) অন্য যে-কোনো শ্রেণি হইতে শ্রেষ্ঠ। এ সমস্তই অবাঞ্ছনীয় মনোভাব। ইহা আমাদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে, আমাদের শিরস্ত্রাণ খুব মজবুত কিন্তু কার্যত হয়তো অন্যের তরবারি ইহা দুই খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিতে পারে। এইভাবে নিজের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা আলস্য উৎপাদনের সাহায্য করে এবং শেষ পর্যন্ত অলস কল্পনাবিলাসী লোকদিগকে বাস্তব বিপদের দিকে ঠেলিয়া লইয়া যায়।

মনের এই অভ্যাস দূর করিবার উপায় হইল–বিপদ আসিতে পারে ভাবিয়া তাহার জন্য মনে মনে প্রস্তুত থাকা এবং ভয়কে সম্পূর্ণরূপে মনে স্থান না দেওয়া। ভয়ের জন্যই মানুষ বিপদের সম্মুখীন হইতে ইচ্ছা করে না। যে ব্যক্তি নিজের বিপদের কথা চিন্তা করিতেই সাহস পায় না সে যদি হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকার শুনিয়া ঘুম হইতে জাগিয়া ওঠে, তবে প্রথমেই সে ভাবিবে অন্য কাহারও বাড়িতে আগুন লাগিয়াছে; এবং আগুন যদি তাহার নিজের বাড়িতেই হয় তবে হয়তো যে সময়ে চেষ্টা করিলে নিরাপদ বাহিরে আসিতে পারিত। তাহার পরে সচেতন হইয়া বাহির হইবার পথ পর্যন্ত পাইবে না। অবশ্য কেবল মনোরোগীর ক্ষেত্রে এইরূপ ঘটিতে পারে। কিন্তু রাজনীতিতে এইরূপ আচরণ খুবই স্বাভাবিক। যে সকল ক্ষেত্রে চিন্তা দ্বারা যথার্থ পন্থা বাছিয়া লইতে হয় তথায় ভয় মানসিক আলোড়ন সৃষ্টি করিয়া তাহাকে বিঘ্ন উৎপাদন করে এবং বিপদের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই ভীত না হইয়া আমরা বিপদের সম্ভাবনা সম্বন্ধে অবহিত হইতে চাহি। আর সেই সঙ্গে যাহা অনিবার্য নয়, বুদ্ধি এইরূপ বিপদের হাত হইতে অব্যাহিত পাইতে চাই। যে বিপদ সত্যই অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য, সাহসের সঙ্গে তাহা গ্রহণ করাই সমীচীন। এইরূপ বিপদের ক্ষেত্রে কি করা উচিত তাহা এখানে আলোচ্য বিষয় নহে।

পূর্বের এক অধ্যায়ে ভয় সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি তাহার পুনরুল্লেখ করিতে চাহি না। বুদ্ধির ক্ষেত্রে ভয় কিভাবে যথার্থ প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায় এইস্থানে শুধু তাহা বলা হইতেছে। এইরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তী বয়স অপেক্ষা প্রথম জীবনেই ইহা জয় করা সহজ, কেননা কোনো বালক বা বালিকা যদি মতের পরিবর্তন করে তবে তাহাতে এমন কোনো গুরুতর বিপদপাত ঘটে না কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তির জীবন ও কর্মধারা কতকগুলি নীতি ও অভিমতের উপর গড়িয়া ওঠে; অকস্মাৎ তাহার পরিবর্তন করিলে বিপর্যয় ঘটা সম্ভব। এইজন্য কিছু অধিক বয়স্ক বালক বালিকাকে আমি স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও বিতর্ক করার সুযোগ দিতে চাই। তাহার যদি আমি যাহা একান্ত সত্য বলিয়া মানি তাহার সত্যতা সম্বন্ধেও প্রশ্ন করে আমি তাহাতে বাধা দিব না। আমি তাহাদিগকে চিন্তা করিতে শিখাইতে চাই। প্রচলিত গোঁড়া মতবাদ কিংবা তাহার বিরুদ্ধে অভিমত–কোনোটিই তাহাদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিবা না; তাহারা নিজেরাই আলোচনা ও বিতর্কের ভিতর দিয়া সত্যের সন্ধান করুক, ইহা চাই। কল্পিত নীতির [Moral] নামে বুদ্ধির বলিদান আমি কখনই সমর্থন করিব না। সাধারণত লোকের ধারণা এই যে, উপদেশ দান কালেই কিছুটা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়। রাজনীতিতে আমরা আপন দলের খ্যাতনামা রাজনীতিকদের দোষগুলি গোপন করি। ধর্মনীতিতে ক্যাথলিকরা গোপদের এবং প্রোটেস্ট্যান্টরা লুথার ও ক্যালভিনের পাপ গোপন করে। যৌন ব্যাপারে আমরা কিশোরদের কাছে এই ভান করি যে, সংযম প্রভৃতি গুণ আয়ত্ত করা খুব কঠিন নয়। সকল দেশে পুলিশ যাহা অবাঞ্ছনীয় মনে করে তাহা বয়স্ক ব্যক্তিদিগকেও জানিতে দেওয়া হয় না এবং ইংল্যান্ডে সেন্সর মনে করেন যে মানবসমাজের বাস্তব অবস্থা নাটকের মারফত নাট্যমঞ্চে অভিনীত হইতে দেওয়া উচিত নহে, বাস্তব চিত্র দেখাইয়ে নয়, ফাঁকিতে ভুলাইয়া রাখিয়াই মানুষকে ধার্মিক ও গুণবান করিয়া তোলা যায় ইহাই তাহার ধারণা। এই সমস্তই দুর্বল মনের পরিচায়ক। সত্যের স্বরূপ যাহাই হউক না কেন আসল সত্যই আমাদের জানা উচিত; তাহা হইলেই আমরা যথাযথ বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া কাজ করিতে পারিব। কৃতদাসগণ যাহাতে নিজেদের স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন হইয়া উঠিতে না পারে সেইজন্য শক্তিমান ব্যক্তি তাহাদের নিকট হইতে সত্য গোপন রাখিবে। ইহার উদ্দেশ্য বোঝা যায় কিন্তু যেখানে গণতন্ত্র বিরাজিত তথাও লোকে স্বেচ্ছায় এমন আইন রচনা করিবে যাহাতে সত্য তাহারা জানিতে না পারে। এই বিষয়টি দুর্বোধ্য! দেশের সব লোকই যেন ডনকুইকজোটে পরিণত হইয়াছে। তাহারা যেন শুনিতে চাহে না যে, তাহাদের শিরস্ত্রাণ তাহারা যেইরূপ মনে করে ততখানি শক্ত নয়। এইরূপ হীন ভীতি স্বাধীন নরনারীর পক্ষে শোভা পায় না। আমার স্কুলে জ্ঞানের প্রতিবন্ধক কোনো কিছু থাকিবে না। মিথ্যা ও ভাওতা দ্বারা নয়, ছাত্রদের প্রবৃত্তি ও আবেগ যথোপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়া আমি তাহাদের সাহস ও অন্যান্য গুণ বিকাশের সহায়তা করিব। এইরূপ গুণবিকাশের ক্ষেত্রে ভীতিরহিত হইয়া জ্ঞান এবং সত্যের অনুশীলন একান্ত আবশ্যক, নতুবা গুণগুলির বিশেষ কোনো মূল্য থাকে না।

বৈজ্ঞানিক মনোভাবের উন্মেষ : আমি যাহা বলিতে চাই তাহা এই যে; ছাত্রদের মধ্যে আমি বৈজ্ঞানিকসুলভ মনোভাব গড়িয়া তুলিব। অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী নিজেদের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রের বাহিরে এই মনোভাব প্রয়োগ করেন না। বৈজ্ঞানিক মনোভাবের প্রথম প্রয়াস হইল সত্য নির্ধারণের বাসনা। এই বাসনা যত প্রবল হয় ততই ভালো, ইহার সঙ্গে বুদ্ধি বৃত্তিজাত কতকগুলি গুণও জড়িত। কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রথমে অনিশ্চয়তার ভাব থাকিবে, পরে প্রমাণ দ্বারা তাহার সত্যাসত্যর নির্ধারণ করিতে হইবে। সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখিয়া কি জানা যাইবে তাহা আমরা আগেই জানি, এই ধরনের মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়, কিংবা সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা কিছুই হইবে না–এই ধরনের আলস্যপ্রসূত সংশয় মনে স্থান দেওয়াও অনুচিত। ইহা আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের বিশ্বাসগুলিরও হয়তো কিছু কিছু সংশোধন আবশ্যক হইতে পারে। যে-কোনো বিষয়ে চরম সত্য জানা গিয়াছে এইরূপ মনে করার কোনো কারণ নাই। বিভিন্ন যুগে মানুষের অধিগত জ্ঞানের মাত্রা কমবেশি হইয়াছে। পদার্থবিদ্যা সম্বন্ধে মানুষের বিশ্বাস গ্যালিলিওর সময়ের পূর্বে যেমন ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা আমাদের ধারণা অনেক বেশি সত্য। এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই পূর্ব নির্ধারিত অভিমত একান্ত সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিয়া এই সম্বন্ধে পর্যবেক্ষণ করার ফলেই নূতন তথ্য জানা গিয়াছে। এইজন্যই প্রাথমিক অনিশ্চয়তার অর্থাৎ পূর্ব হইতেই কোনো বিষয় চরম সত্য বলিয়া গ্রহণ না করার একান্ত আবশ্যকতা আছে। ছাত্রদিগকে এই শিক্ষা দিতে হইবে এবং এই সঙ্গে প্রমাণ প্রয়োগের কৌশলও শিখাইতে হইবে। জগতে যখন নানা অভিসন্ধিপূর্ণ নানা লোক মিথ্যা প্রচার করিয়া সকলকে বিভ্রান্ত করিতে চেষ্টা করিতেছে তখন সত্য-মিথ্যা যাচাই করিয়া লইবার মানসিক অভ্যাস গড়িয়া তোলা বিশেষ প্রয়োজন। বারংবার একটি মিথ্যা শুনিতে শুনিতে তাহাকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করার প্রবণতা বর্তমান যুগের এটি অভিসম্পাতস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। স্কুলের শিক্ষার ভিতর দিয়া ইহা প্রতিরোধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে।

শিক্ষার্থী জীবনের সমগ্র কালটিই বুদ্ধিগত অভিযানের সময় বলিয়া ছাত্রদের মনে সজীব তারুণ্যের ভাব জাগাইয়া রাখিতে হইবে। নিজেদের নির্দিষ্ট পাঠ আয়ত্ত করার পর ছাত্রগণ যাহাতে স্বচেষ্টায় নূতন নূতন তথ্য উঘাটন করিতে পারে সে বিষয়ে তাহাদিগকে উৎসাহিত করিতে হইবে এইজন্য তাহাদের প্রতিদিনকার পাঠ খুব গুরুভার হওয়া উচিত নহে। ছাত্রের কাজ প্রশংসা করিতে হইবে; ভুল হইলে তাহা সংশোধন করিতে হইবে। কিন্তু ভুলের জন্য তাহাকে নিন্দা করা সঙ্গত হইবে না; বোকামি দেখাইলেও ছাত্রগণ যেন লজ্জা অনুভব না করে। চেষ্টা দ্বারা যে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভবপর এই ধারণা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় প্রেরণা। যে জ্ঞান নীরস, শিক্ষার্থী যাহা লাভে আনন্দ অনুভব করে না তাহার মূল্য বিশেষ কিছু নাই। সানন্দে সে যাহা নিজস্ব করিয়া লয় তাহাই হয় স্থায়ী এবং কার্যকরি। ছাত্রদিগকে জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্বন্ধ বুঝিতে দিন, জ্ঞানের ভিতর দিয়া কিীবে জগতের পরিবর্তন সাধন সম্ভবপর তাহাও তাহারা উপলব্ধি করুক। শিক্ষক যেন ছাত্রগণ কর্তৃক সহায়রূপে বিবেচিত হন, স্বাভাবিক শত্রুরূপে নয়। প্রথম কয়েক বৎসর উপযুক্ত শিক্ষা পাইলে অধিকাংশ বালক-বালিকাই অধিকতর জ্ঞান অর্জনের কাজ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *