১১. স্নেহ ও মনোবেদনা

একাদশ অধ্যায় স্নেহ ও মনোবেদনা

অনেকে মনে করিতে পারেন অকারণে আমি এ পর্যন্ত এ স্নেহ সম্বন্ধে কোনো কথা উল্লেখ করি নাই, অথচ শিশুর সুচরিত্রের ইহা একটি প্রধান উপাদান। ইহা স্বীকার্য যে, স্নেহ ও জ্ঞান যথাযোগ্য আচরণের জন্য একান্ত আবশ্যক কিন্তু উন্নতির শিক্ষার আলোচনা প্রসঙ্গে আমি স্নেহ বা ভালোবাসা সম্বন্ধে কিছুই বলি নাই, তাহার কারণ আছে। আমার উদ্দেশ্য এই যে শিশুকে যত্নের সঙ্গে উপযুক্ত শিক্ষা দিলে তাহার ফলস্বরূপ স্নেহপ্রীতি আপনা আপনি বিকাশ লাভ করিবে,সচেতন চেষ্টা দ্বারা জোর করিয়া শিশুর কাছ হইতে ইহা আদায় করার কোনো প্রয়োজন নাই। কি ধরনের স্নেহ বাঞ্ছনীয় এবং শিশুর ক্রমবিকাশের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে তাহার মন, প্রকৃতি কেমন থাকে তাহাও জানা দরকার। দশ-বারো বৎসর হইতে যৌবনাগম পর্যন্ত বালকের স্নেহপ্রীতি বিশেষ মোটেই থাকে না এবং প্রকৃতির উপর জোর করিয়াও কোনো লাভ নাই।

বয়স্ক ব্যক্তি সমবেদনা দেখানোর যতখানি সুযোগ পায় তরুণ কিশোর ততখানি পায় না, কারণ ইহা প্রকাশের ক্ষমতা তাহাদের কম; তাহা ব্যতীত অন্যের কথা বাদ দিয়া নিজেদের জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার চেষ্টাতেই তাহারা থাকে বিভোর। এইসব কারণে অল্প বয়সে শিশুর মধ্যে অকালে এই গুণগুলির বিকাশ ঘটাইবার চেষ্টা না করিয়া আমাদের বরং বয়স্ক ব্যক্তিকে সহানুভূতিশীল ও স্নেহপরায়ণ করিয়া গড়িবার চেষ্টা করা উচিত।

বালকের মনে স্নেহবিকাশের সমস্যা চরিত্রের শিক্ষার অন্যান্য সমস্যার মতোই বিজ্ঞানসম্মত; ইহা মনস্তাত্ত্বিক গতিবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। শিশুর কাছে কর্তব্য হিসেবে স্নেহ ভালোবাসার অস্তিত্ব নাই। পিতামাতাকে এবং ভাইবোনকে ভালোবাসা উচিত শিশুকে এ কথা বলা নিরর্থক। আদেশ করিলে বা উপদেশ দিলেই শিশু ভালোবাসিতে শুরু করিবে না। যে পিতামাতা সন্তানের ভালোবাসা চান, তাহাদিগকে নিজেদের আচরণ দ্বারা পুত্রকন্যার অন্তরে ইহার উদ্বোধন করিতে হইবে। সন্তানদিগকে এমন দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য দানের চেষ্টা করিতে হইবে যাহা স্বাভাবিকভাবে তাহাদের মনে জনক-জননীর প্রতি প্রীতির ভাব জাগায়।

.

অপত্য-স্নেহের স্বরূপ

শিশুদিগকে কখনই তাদের পিতামাতাকে ভালোবাসিতে আদেশ করা উচিত হইবে না; শুধু তাহাই নহে, এমন কিছু করা উচিত নহে যাহার উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ অপত্যস্নেহের প্রতিদানে পিতামাতার প্রতি সন্তানের প্রীতির বিকাশ। এইখানে অপত্যস্নেহের সঙ্গে যৌনভালবাসার পার্থক্য। যৌন ভালবাসার ব্যাপারে একপক্ষের আবেদনে (প্রতিদানে) অন্য পক্ষের সাড়া একান্ত আবশ্যক; ইহা স্বাভাবিক, জৈবিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই ইহার প্রয়োজন। কিন্তু অপত্যস্নেহের প্রতিদানে সন্তানের নিকট হইতে সাড়া পাওয়ার কোনো আবশ্যকতা নাই। বিশুদ্ধ অপত্যস্নেহ পিতামাতার মনে এমন একটি ভাব জাগ্রত করে যাহার ফলে তাহার সন্তানকে নিজেদের একটি (বাহ্য) পৃথকৃত অংশ বলিয়া মনে করেন। আপনার পায়ের বুড়া আঙুলের নিকট হইতে প্রতিদানের কৃতজ্ঞতা আশা করেন না। আমার মনে হয় অসভ্য বন্য রমণী তাহার সন্তানের প্রতি ঠিক এমনই ভাব পোষণ করে। সে যেমন নিজের মঙ্গল চায় তেমনি চায় সন্তানের মঙ্গল, বিশেষ করিয়া যতদিন শিশু নিতান্ত ছোট থাকে। নিজ দেহের যত্ন লওয়ার সময় যেমন সে আত্মত্যাগ [self-denial] করিতেছে বলিয়া ভাবে না, তেমনই সন্তানের যত্ন পরিচর্যা করার সময়ও সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ করা হইতেছে বলিয়া তাহার মনে হয় না; কাজেই কোনো প্রতিদানের আশা সে করে না। যতদিন শিশু অসহায় থাকে ততদিন সে যে জননীকে একান্তভাবে চাহে ইহাই জননীর স্নেহের প্রতিদান। পরে, সে যখন ক্রমে বাড়িয়া উঠে, জননীর স্নেহ কমিয়া আসে এবং সন্তানের উপর প্রতিদানে কোনো কিছুর দাবি বাড়িতে থাকে। জীবজন্তুর মধ্যে দেখা যায় সন্তান সাবালক হইলে অপত্যস্নেহ ফুরাইয়া যায়; জনক-জননী সন্তানের উপর কোনো দাবিও রাখে না কিন্তু মানুষের সমাজে, এমনকি আদিম মানুষের মধ্যেও, ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায়। পুত্র যখন সবল বলিষ্ঠ যোদ্ধাতে পরিণত হয় তখনও পিতামাতা কামনা করে যে তাহাদের বার্ধক্যে সে তাহাদিগকে ভরণ-পোষণ করিবে। মানুষের দূরদৃষ্টি বৃদ্ধির ফলে পিতামাতা অপত্যস্নেহ হইতেও কিছু লাভের আশা করিতে শুরু করে। বৃদ্ধ বয়সে তাহারা দুর্বল ও অক্ষম হইয়া পড়ে; সন্তানকে সস্নেহে পালন করার প্রতিদানে তাহারা বার্ধক্যে যত্ন ও সাহায্য আশা করে। ইহা হইতেই জনক-জননীর প্রতি সন্তানের কর্তব্যের মূলনীতির উৎপত্তি; মানুষের ধর্মশাস্ত্রেও এই নীতি স্থান পাইয়াছে। পরে ক্রমে যখন সুশৃঙ্খল শাসন-ব্যবস্থা গড়িয়া ওঠে এবং মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার ও ভোগ করিতে থাকে তখন বৃদ্ধ জনক-জননীর অসহায় ভাব অনেকটা কমিয়া আসে; নিজের সম্পত্তি থাকিলে তাহাদিগকে তো বয়স্ক সন্তানের উপর ভরণপোষণের জন্য নির্ভর করিতে হইবে না। মানুষ যখন ইহা সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে তখন পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যবোধও নীতি হিসাবে ক্রমে লোপ পায়। বর্তমান জগতে পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক লোকও আশি বৎসরের বৃদ্ধ পিতামাতার উপর আর্থিক দিক দিয়া নির্ভরশীল হইতে পারে; কাজেই এখনও পিতার প্রতি সন্তানের ভালবাসার চেয়ে সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহই প্রধান হইয়া রহিয়াছে। ইহা অবশ্য বিত্তশালী লোকদের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। দিনমজুরদের জীবনে পিতাপুত্রের মধ্যে পূর্বের ভাবই এখনও বর্তমান আছে, তবে বৃদ্ধ বয়সে পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা থাকার ফলে এভাবও ক্রমে শিথিল হইয়া আসিতেছে। পিতামাতার প্রতি সন্তানের স্নেহ ক্রমে গুণের তালিকা হইতে বাদ পড়িতেছে কিন্তু সন্তানের প্রতি পিতামাতার স্নেহ শিশুর জীবনে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে।

পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের স্নেহের সম্পর্ক, কিন্তু মনঃসমীক্ষকগণ এ সম্বন্ধে কিছু নূতন তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন। তবে এইগুলি বিচারযোগ্য কি না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। পিতা বা মাতার প্রতি সন্তানের অত্যধিক অনুরক্তিকে ইহারা যৌনবাসনার নবরূপ প্রকাশ বলিয়া মনে করেন।

পিতা বা মাতার প্রতি অত্যধিক অনুরাগ : পিতা বা মাতার পক্ষে কোনো বয়স্ক সন্তানকে, এমনকি কিশোরকেও এমনভাবে আবৃত করিয়া রাখা উচিত নহে যাহাতে সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতে বা অনুভব করিতে না পারে। জনক বা জননীর ব্যক্তিত্ব যদি সন্তানের অপেক্ষা প্রবলতর হয় তবে এইরূপ সহজেই ঘটিতে পারে। দুই-একটি মনোবিকারগ্রস্ত রুগ্ন ব্যক্তির কথা বাদ দিলে আমি বিশ্বাস করি না যে, ছেলেদের মায়ের প্রতি এবং মেয়েদের পিতার প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কোনো যৌনগত গূঢ় কারণ আছে। যেই স্থানে পিতামাতার অত্যধিক প্রভাব বিদ্যমান সেই স্থানে পিতা বা মাতা যিনিই সন্তানের ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আসিবেন তাহার প্রভাবই বেশি অনুভূত হইবে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জননীই সন্তানের পড়ে সন্তান পুত্র কি কন্যা তাহা বিচার করিয়া প্রভাবের মাত্রা কমবেশি হয় না। অবশ্য এমন হইতে পারে যে, কোনো মেয়ে তাহার জননীকে পছন্দ করে না এবং পিতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায় না; সে হয়তো মনে মনে পিতাকেই আদর্শরূপে কল্পনা করিয়া লইতে পারে। এইরূপ ক্ষেত্রে পিতা কিন্তু নিজে কন্যার মনে প্রভাব বিস্তার করেন না, কন্যা নিজেই পিতাকে কল্পনার রঙে ও মায়াস্বপ্নের মাধুর্যে মণ্ডিত করিয়া নিজের অন্তরে স্থাপিত করিয়াছে। একটি সুতা অবলম্বন করিয়া যেমন মিছরি দানা বাঁধিয়া উঠে, দেওয়ালের গায়ের একটি গোজার সঙ্গে যেমন জিনিস ঝুলইয়া রাখা যায়, তেমনই কোনো একটি খুঁটি অবলম্বন করিয়া মনের ভাব আদর্শরূপে গড়িয়া উঠে। খুঁটিটি ভাবের আরোপ-ক্ষেত্র মাত্র; ভাব বা আদর্শের প্রকৃতির সহিত ইহার কোনো সম্বন্ধ নাই। এই স্থানে পিতাকে ঘিরিয়া কন্যার মানসিক ভাব পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছে মাত্র কিন্তু পিতা এইজন্য মোটেই দায়ী নহেন। যথায় পিতামাতারা অপরিমিত প্রভাব বিস্তার করিয়া সন্তানকে আচ্ছন্ন রাখেন তাহার অবস্থা স্বতন্ত্র।

কোনো বয়স্ক ব্যক্তি যদি শিশুর নিত্য সঙ্গিরূপে জীবন-বিকাশের প্রথম হইতে প্রভাব বিস্তার করিতে থাকেন তবে পরবর্তীকালেও সেই শিশুকে মানসিক দিক দিয়া দাসরূপে পরিণত করা তাহার পক্ষে সহজ। বয়স্ক ব্যক্তির বুদ্ধি, প্রক্ষোভ অথবা উভয় কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে অভিভূত হইয়া শিশু নিজের বয়স্ক জীবনেও নিজের সত্তাকে হারাইয়া ফেলিতে পারে। এইরূপ অবস্থায় সে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তির মানবদাসে পরিণত হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল এই বিষয়ে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁহার পিতার বুদ্ধিগত প্রভাব তাহার জীবনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন। করিয়াছিল যে, পিতার চিন্তাধারায় যে কোথাও ভুল থাকিতে পারে তাহা তিনি ভাবিতেই পারিতেন না।

শৈশবে শিশুর পক্ষে অন্যের বুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া কতকটা স্বাভাবিক; পিতামাতা বা শিক্ষক যে অভিমত পোষণ করেন ও প্রচার করেন তাহা হইতে মুক্ত থাকা বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষেও কঠিন, অবশ্য যদি অন্য কোনো উৎস হইতে বিরুদ্ধ মতবাদের স্রোত প্রবাহিত হইয়া তাহাদিগকে অন্যদিকে পরিচালিত করে, তাহা স্বতন্ত্র কথা। কাজেই ইহা বলা যাইতে পারে যে, লোকের পক্ষে অন্যের বুদ্ধিগত দাস্যতা বা প্রভাব অনুভব করা অস্বাভাবিক নয়; আমার মনে হয় ইহা নিবারণের উদ্দেশ্যে বিশেষ শিক্ষা দ্বারাই এই প্রভাব মুক্ত হওয়া যাইতে পারে; বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে পূর্বপুরুষদিগের চিন্তা ও ভাবধারাকে আঁকড়াইয়া থাকা বিপজ্জনক, কাজেই শিশুদিগকে পিতামাতার বুদ্ধিগত প্রভাবের দাসত্ব রক্ষা করা উচিত। এ সমস্যা বর্তমান আলোচনার বিষয়ীভূত নহে। বর্তমানে কেবল প্রক্ষোভ ও চিন্তার দাসত্ব আলোচনা করিব।

পিতামাতা সন্তানকে ভালবাসেন; ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু অপত্যস্নেহের প্রতিদানে তাহারা যখন পুত্র বা কন্যার নিকট হইতে প্রক্ষোভগত [Emotion] সাড়া কামনা করেন তখনই অন্যায় অস্বাভাবিকতার সূত্রপাত হয়। মনঃসমীক্ষকগণ এই অবস্থাকে বলেন ইডিপাস্ গুঢ়ৈয়া অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন যৌনবাসনার বিকৃত রূপ। জনক-জননীর সঙ্গে পুত্রকন্যার আচরণের মধ্যে যৌন কামনার কোনোরূপ প্রভাব আছে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না। অল্প কিছুক্ষণ পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে যে, বিশুদ্ধ অপত্যস্নেহ সন্তানের নিকট হইতে প্রক্ষোভগত প্রতিদান বা সাড়া কামনা করে না। সন্তান যদি খাদ্য ও প্রতিপালনের জন্য পিতামাতার উপর নির্ভর করে তবেই স্নেহ তৃপ্ত হয়। সন্তানের এই নির্ভরতা। যখন কমিয়া আসে, পিতামাতার স্নেহও কমিয়া আসে। প্রাণিজগতে ইহাই নিয়ম এবং ইতর প্রাণীর উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে ইহা সম্পূর্ণ সন্তোষজনক। দেখা যায়, ইতর প্রাণীর পিতামাতা সন্তানদিগকে খাওয়ায় ও শত্রুর হাত হইতে রক্ষা করে। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে পিতামাতা উদাসীন হইয়া পড়ে, সন্তানগণ পিতামাতা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নিজেদের আহার সংস্থান ও যৌন সম্বন্ধ স্থাপনে চেষ্টিত হয়। ইতোমধ্যে তাহাদের পিতামাতা আবার সন্তানলাভের আয়োজন করিয়া থাকে। ইতর প্রাণিজগতে অপত্যস্নেহ এই সরল নিয়মের ধারা অনুসরণ করিয়া চলিতেছে। কিন্তু মানুষের এই প্রবৃত্তি এত সরলভাবে প্রকাশ পায় না। অসভ্য বর্বর মানবসমাজে দেখা যায়, পিতামাতা আশা করেন বার্ধক্যে অক্ষম হইলে তাহাদের বলিষ্ঠ সন্তানগণ তাহাদিগকে রক্ষা করিবে। সভ্য মানব সমাজে পিতামাতা কামনা করেন, উপার্জনশীল সন্তানগণ তাহাদের ভরণপোষণ করিবে। এই ভাবের কামনা হইতে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য কি তাহা নির্দিষ্ট হয় এবং তাহা পুত্র কন্যার বাঞ্ছিত গুণ বলিয়া বিবেচিত হইতে থাকে। এখানে অপত্যস্নেহ অপপ্রয়োগের দুইটি মূল মনোবিজ্ঞানসম্মত কারণের আলোচনা করিব।

প্রথম কারণ ঘটে যখন প্রবৃত্তি হইতে কিরূপ আনন্দ লাভ হইবে তাহা বুদ্ধি বুঝিতে পারে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রবৃত্তি এখন সুখকর কাজেই প্রেরণা দেয় যাহার ফল জীবদেহের পক্ষে প্রয়োজনীয়, কিন্তু এ ফল সুখকর না-ও হইতে পারে। খাদ্য গ্রহণ সুখকর, কিন্তু পরিপাক ক্রিয়া সুখকর নহে, বিশেষ করিয়া যদি অজীর্ণ রোগ থাকে। যৌনমিলন সুখকর কিন্তু সন্তান প্রসব সুখকর নয়; ছোট শিশুর নির্ভরতা সুখকর কিন্তু বলিষ্ঠ বয়স্ক পুত্রের স্বাধীনতা সুখকর নয়। অসভ্য আদিম জননীর প্রকৃতিবিশিষ্ট রমণী অসহায় সন্তানকে স্তন্য দিয়া পালন করিতেই সর্বাপেক্ষা বেশি আনন্দ পায়, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর অসহায় ভাব যখন কমিয়া আসে, মায়ের আনন্দও কমিতে থাকে। কাজেই আনন্দলাভের জন্যই সন্তানের অসহায় অবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার প্রবণতা দেখা দেয়; সন্তান যখন পিতামাতার স্নেহ-পরিচর্যা ও নির্দেশের আওতার বাহিরে চলিয়া যাইবে সে সময়কে ঠেকাইয়া রাখার চেষ্টাও স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয়। মায়ের আঁচল-ধরা ছেলে এই ধরনের প্রচলিত কথার মধ্যে মাতৃহৃদয়ের এ কামনার প্রকাশ স্বীকৃত হইয়াছে। পুত্রগণকে বিদ্যালয়ে পাঠানো ব্যতীত তাহাদিগকে এই কু-প্রভাব হইতে মুক্ত রাখা অসম্ভব বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। কন্যার বেলায় ইহাকে কু প্রভাব হইতে বিবেচনা করা হইত না; তাহাদিগকে অসহায় এবং অপরের উপর নির্ভরশীল করিয়া গড়িয়া তোলাই বাঞ্ছনীয় মনে হইত। আশা করা হইত যে, বিবাহের পূর্বে যে কন্যা মায়ের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করিত, বিবাহের পর সে স্বামীকেই একান্ত আশ্রয় বলিয়া মনে করিবে। কিন্তু কার্যত খুব কম ক্ষেত্রেই এইরূপ ঘটে। কেহই বুঝিতে পারে নাই যে, বালিকাকে যদি পরনির্ভরশীল করিয়া গড়িয়া তোলা হয় তবে সে স্বাভাবিকভাবে মাতার উপরই নির্ভর করিবে; ইহার ফলে তাহার পক্ষে কোনো পুরুষকে, একান্ত আপনার জন ও সঙ্গিরূপে গ্রহণ করা সম্ভব হইবে না, অথচ ইহাই সুখি দাম্পত্য-জীবনের মূল উপাদান।

দ্বিতীয় কারণটি ফ্রয়েডীয় মতবাদের কাছাকাছি আসে। যৌন ভালোবাসার কিছু উপাদান যখন অপত্যস্নেহের ভিতর প্রকাশ পায় তখনই ইহার উৎপত্তি। ইহার জন্য দুইজনের যে বিপরীত লিঙ্গ হইতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। এখানে কেবল কতকগুলি বাসনা ক্রিয়া করিতেছে। যৌন মনোবিজ্ঞানের যে অংশের ফলে মানবসমাজে এক বিবাহ সম্ভবপর হইয়াছে তাহা মানুষের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে সে, পৃথিবীতে অন্তত একজন লোকের সুখবিধানের জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় এবং একান্ত বাঞ্ছিত ব্যক্তি। যেখানে দাম্পত্যজীবনে এই ভাবটি প্রবল সেখানে অন্য কতকগুলি বিষয় অনুকূল থাকিলে স্বামী-স্ত্রীর জীবন সুখবহ হয়। কোনো না কোনো কারণে সভ্যজগতে বহু বিবাহিত স্ত্রীলোকের যৌনজীবন অতৃপ্ত থাকে। এরূপ রমণীর পক্ষে নিজের সন্তানদের নিকট হইতে অবৈধ ও কৃত্রিম উপায়ে যৌন কামনা চরিতার্থ করার বাসনা জাগ্রত হইতে পারে, যে কামনা শুধু পুরুষই যথেষ্টভাবে এবং স্বাভাবিকভাবে পরিতৃপ্ত করিতে পারে। আমি স্পষ্টত কিছু বুঝাইতেছি না; সন্তানের প্রতি মাতার আচরণে প্রক্ষোভগত আলোড়ন, কতক ভাবের তীব্রতা, চুম্বন ও আলিঙ্গনে আনন্দলাভের জন্য চুম্বন ও আলিঙ্গনের আতিশয্যের কথা বলিতেছি। স্নেহশীলা জননীর নিকট ইহা ন্যায়সঙ্গত বলিয়াই বিবেচিত হইত। বস্তুত, কি ন্যায়সঙ্গত এবং কি ক্ষতিকর তাহার পার্থক্য বড়ই সূক্ষ্ম। ফ্রয়েডীয় মতবাদের কতক সমর্থক মনে করেন যে পিতামাতার পক্ষে সন্তানকে চুম্বন করা এবং কোলে করিয়া আদর করা উচিত নহে; ইহা মোটেই সমর্থন করা চল না। পিতামাতার আন্তরিক স্নেহ-প্রীতিতে সন্তানের অধিকার আছে : ইহা তাহাদের জীবনের প্রতি আনন্দোজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি দান করে, মনের স্বাস্থ্য বিকাশের পক্ষেও ইহা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু পিতামাতার এই স্নেহ সম্বন্ধে এমন ধারণা হওয়া দরকার যেন সে আকাশ ভরা আলো বাতাসের মতোই ইহা গ্রহণ করিতে শেখে, ইহার জন্য কোনো প্রতিদান দিবার চিন্তা যেন তাহার মনে না আসে। সাড়া দেওয়ার প্রশ্নটিই এই স্থানে আসল। স্নেহের প্রতিদানে শিশুর নিকট হইতে কতকগুলি স্বতঃপ্রবৃত্ত সাড়া পাওয়া যাইবে। ইহা সবই কাম্য। কিন্তু ইহা হইবে বালকবৎ সঙ্গীদের বন্ধুত্বের কামনা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক পিতামাতার বিশুদ্ধ স্নেহ পুষ্ট সন্তান স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া যে সাড়া দেয় তাহা দূষণীয় নয় কিন্তু মানসিক ভেঁপোমির ফলে সে যখন পিতা বা মাতার বন্ধুত্ব কামনা করে তখনই অস্বাভাবিক অবস্থার উদ্ভব হয়। মনস্তত্ত্বের দিক দিয়া পিতামাতা হইবেন শিশুর জীবনচিত্রের পটভূমি; তাহাদিগকে আনন্দ দেওয়ার জন্য শিশুকে সক্রিয়ভাবে কোনো কিছু করিতে উদ্বুদ্ধ বা প্ররোচিত করা উচিত হইবে না। তাহার বুদ্ধি ও উন্নতিতেই পিতামাতার আনন্দ; সে স্বেচ্ছায় কোনো সাড়া দিলে তাহা পিতামাতা অতিরিক্ত বিশুদ্ধ লাভ হিসাবে গ্রহণ করিবেন, যেন বসন্তকালে চমৎকার আবহাওয়া; কিন্তু এইরূপ সাড়া কাম্য প্রাপ্য বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত নয়।

কোনো স্ত্রীলোক যদি যৌন ব্যাপারে পরিতৃপ্ত না হন তবে তাহার পক্ষে আদর্শ জননী হওয়া কিংবা ছোট ছোট শিশুদের আদর্শ শিক্ষিকা হওয়া অত্যন্ত কঠিন। মনঃসমীক্ষকগণ যাহাই বলুন না কেন, অপত্যস্নেহ যৌন প্রবৃত্তি হইতে মূলত পৃথক; যৌন বাসনা-উদ্ভূত প্রক্ষোভ ইহাকে ঘোলাইয়া তোলে। মনস্তত্ত্বের বিচারে কুমারী স্ত্রীলোকদিগকে শিক্ষকতা কার্যে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ ভুল। শিক্ষকদের শিক্ষকতার জন্য এমন মহিলাই যোগ্য যিনি তাহাদের নিকট হইতে নিজের প্রবৃত্তির পরিতৃপ্ত কামনা করিবেন না। বিবাহিত জীবনে সুখি স্ত্রীলোক বিনা চেষ্টাতেই এ পর্যায়ে পড়িবেন কিন্তু অন্য স্ত্রীলোকের পক্ষে এজন্য অসাধারণ আত্মসংযমের প্রয়োজন হইবে। অবশ্য একই অবস্থায় পুরুষের পক্ষেও ঠিক এই কথাই খাটে; কিন্তু পুরুষের বেলায় এরূপ ঘটনার সম্ভাবনা অনেক কম এই জন্য যে, তাহাদের অপত্যস্নেহ সাধারণত খুব বেশি প্রবল নয় এবং খুব কম পুরুষেরই যৌনক্ষুধা অপরিতৃপ্ত থাকে।

পিতামাতার প্রতি সন্তানের আচরণ: শিশুদের নিকট হইতে কিরূপ আচরণ প্রত্যাশা করি সে সম্বন্ধেও আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। সন্তানের প্রতি জনক-জননীর স্নেহ যদি যথাযথ হয় তাহাদের আচরণও অনুরূপ হইবে। পিতামাতাকে দেখিলে সে খুশি হইবে, অন্য কোনো আনন্দপ্রদ খেলা বা কাজে লিপ্ত না থাকিলে তাহাদের অনুপস্থিতিতে দুঃখিত হইবে; দৈহিক বা মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিলে তাহাদের সাহায্য কামনা করিবে; দুঃসাহসিক কাজে তাহাদের উদ্যম আসিবে কেননা তাহারা উপলব্ধি করিবে পিতামাতার অফুরন্ত স্নেহ, এবং তাহাদের রক্ষার জন্য কল্যাণশক্তি সর্বদা তাহাদের জন্য সঞ্চিত রহিয়াছে যদিও প্রকৃত বিপদের সময় ছাড়া শিশুর মনে এ চিন্তা আসিবে না। তাহারা আশা করিবে, পিতামাতা তাহাদের প্রশ্নের উত্তর দিবেন, তাহাদের জটিল সমস্যার সমাধান করিয়া দিবেন এবং কঠিন কাজে সাহায্য করিবেন। সন্তানগণ পিতামাতার নিকট হইতে খাদ্য ও আশ্রয় পায় ইহা চিন্তা করিয়া তাহারা জনক-জননীকে ভালবাসিবেন না; পিতামাতার কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়া এবং সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা শিশুদের স্বভাব নয়। তাহাদের সঙ্গে খেলিলে, তাহাদিগকে নূতন জিনিস দেখাইলে, তাহাদিগকে বিচিত্র পৃথিবীর গল্প শুনাইলে তাহারা পিতামাতাকে বেশি পছন্দ করিবে। তাহারা ক্রমে উপলব্ধি করিবে যে, তাহাদের উপর পিতামাতার স্নেহ বিদ্যমান রহিয়াছে, পৃথিবীর উপর যেমন চন্দ্ৰসূর্যের কিরণ বর্ষিত হয় জনক জননীর স্নেহও দ্রুপ স্বাভাবিকভাবে বর্ষিত হইতেছে এই ধারণা সন্তানদের মনে আসা উচিত। পিতা-মাতার প্রতি তাহাদের ভালোবাসা অপর শিশুদের প্রতি ভালোবাসা হইতে পৃথক প্রকৃতির হইবে। পিতামাতা সন্তানকে পুরোভাগে রাখিয়া তাহার মঙ্গলের জন্য কাজ করিবেন, শিশুর কাজ হইবে আত্মবিকাশ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা। এখানেই আসল পার্থক্য। পিতামাতার প্রতি শিশুর করণীয় বিশেষ কিছু নাই। জ্ঞানে, স্বাস্থ্যে ক্রমে পুষ্ট হইয়া ওঠাই তাহার কাজ এবং ইহা দ্বারাই পিতৃমাতৃহৃদয়ের অপত্যস্নেহ প্রবৃত্তি পরিতৃপ্তি লাভ করে।

কেহ যেন মনে না করেন যে আমি পারিবারিক জীবনে স্নেহ এবং ইহাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কমাইবার পক্ষপাতী। তাহা মোটেই নহে। আমি যাহা বলিতে চাই তাহা এই যে, বিভিন্ন প্রকারের স্নেহ আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্নেহ এক প্রকার, সন্তানের প্রতি পিতামাতার স্নেহ অন্য প্রকার, পিতামাতার প্রতি সন্তানের স্নেহ আবার অন্য আর এক প্রকার। ক্ষতি তখনই সাধিত হয় যখন বিভিন্ন প্রকার স্নেহ তালগোল পাকাইয়া ফেলা হয়। ফ্রয়েডীয়গণ এ সম্বন্ধে যে সত্য সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন তাহা আমি বিশ্বাস করি না, কারণ তাঁহারা বিভিন্ন স্নেহের প্রবৃত্তিগত পার্থক্য স্বীকার করেন না। ইহার ফলে পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে আচরণেও ইহারা বাধা নিষেধের কড়াকড়ি আরোপ করেন। কেননা তাহাদের মতে জনক-জননী ও সন্তানের মধ্যে যে স্নেহ বিদ্যমান তাহা প্রচ্ছন্নভাবে যৌন ভালোবাসারই নামান্তর। বিশেষ কোনো দুর্ভাগ্যসূচক ক্ষেত্র ব্যতীত আমি এরূপ স্নেহচ্ছতার সমর্থক নহি। যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসেন এবং সন্তানদিগকে স্নেহ করেন তাঁহারা নিজেদের হৃদয়বৃত্তির নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করিতে পারিবেন। সন্তানের মঙ্গলের জন্য যথেষ্ট চিন্তা ও জ্ঞানের প্রয়োজন হইবে কিন্তু এইগুলি অপত্যস্নেহের ভিতর দিয়াই তাহারা লাভ করিতে সক্ষম হইবেন। পরস্পরের নিকট হইতে তাহারা যাহা পান, তাহা সন্তানের নিকট হইতে কামনা করা তাঁহাদের পক্ষে কখনই সমীচীন হইবে না; তাঁহারা যদি পরস্পরকে ভালবাসিয়া সুখি হন তবে সন্তানের স্নেহ লাভের আকাঙ্ক্ষা তাহাদের মনে জাগ্রতই হইবে না। আবার পুত্রকন্যা যদি যথোচিত যত্নের সঙ্গে লালিত-পালিত হয়, পিতামাতার প্রতি তাহাদের স্নেহ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রকাশ পাইবে, তাহাদের স্বাধীনতার কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না। সন্তানের প্রতি যথোপযুক্ত আচরণ করিতে পিতামাতার আত্ম-কৃচ্ছতার প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন হইল জ্ঞান বুদ্ধিদীপ্ত অপত্যস্নেহের সম্প্রসারণের।

আমার পুত্রের বয়স যখন দুই বৎসর চার মাস তখন আমি আমেরিকায় যাইয়া তিন মাস ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে সে বেশ সুখিই ছিল কিন্তু ফিরিলে আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠিয়াছিল। আমার জন্য সে অধীরভাবে বাগানের প্রবেশ পথে অপেক্ষা করিতেছিল : আমার হাত ধরিয়া সে ঘুরিয়া এটা-সেটা দেখাইতে লাগিল। আমি তাহার কথা শুনিতে চাহিতেছিলাম, সে-ও বলিতে চাহিতেছিল; আমার কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না, তাহারও শোনার ইচ্ছা ছিল না। আবেগ বিপরীতমুখি হইলেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। যখন গল্প বলার কথা উঠে, সে শুনিতে চায়, আমি বলিতে চাই। এখানেও সামঞ্জস্য রহিয়াছে। শুধু একবার এই অবস্থার ব্যতিক্রম ঘটিয়াছিল। তাহার তিন বৎসর ছয় মাস বয়সের সময় আমার জন্মদিন করিয়াছিল। তাহার মায়ের নিকট সে শুনিয়াছিল যে, সেইদিন আমায় খুশি করার জন্যই সব কিছু করিতে হইবে। গল্প শোনা ছিল তাহার কাছে সবচেয়ে আনন্দদায়ক। সেইদিন উৎসবের সময় সে বলিল যে আমাকে গল্প শুনাইবে। আনন্দের ব্যাপার শুরু হইল। সে কোলে বসিয়া পর পর গোটা বারো গল্প শুনাইল, তাহার পর আজকে আর নয় এই বলিয়া লাফ দিয়া নামিয়া গেল। ইহার পর অনেকদিন পর্যন্ত সে আর গল্প শুনাইতে আসে নাই।

আমি এখন সাধারণভাবে স্নেহ ও সমবেদনা সম্বন্ধে আলোচনা করিব। পিতামাতা ও সন্তানের প্রীতি সম্পর্কের মধ্যে জটিলতার উদ্ভব হইতে পারে; কেননা জনক-জননী কর্তৃক অপত্যস্নেহের অপব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। এইজন্যই প্রথম অপত্যস্নেহের স্বরূপ কি তাহা আলোচনা করা হইল।

সমবেদনা : শিশুকে জোর করিয়া স্নেহ প্রকাশ করা বা সমবেদনা বোধ করা অভ্যাস করানো যায় না। ইহার একমাত্র উপায় হইল কিরূপ অবস্থায় এই ভাবগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগ্রত হয় তাহা লক্ষ্য করা এবং তাহার পর ওইরূপ অবস্থা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করা। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, সমবেদনা কতকটা সহজাত। শিশুগণ তাহাদের ভ্রাতাভগিনীদের কাঁদিতে দেখিয়া উৎকণ্ঠিত হয় এবং নিজেরাও কাঁদিতে শুরু করে। ভ্রাতাভগিনীদের উপর কস্টদায়ক কোনো আচরণ করিতে দেখিলে তাহারা তাহাদের পক্ষ সমর্থন করিয়া বড়দের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আমার পুত্রের কনুইতে ঘা হইয়াছিল। ব্যান্ডেজ করিয়া দেওয়ার সময় সে চিৎকার করিতেছিল। সংলগ্ন ঘর হইতে তাহার কনিষ্ঠ ভগিনী (বয়স আঠারো মাস) কান্না শুনিয়া আকুল হইয়া ওঠে এবং যতক্ষণ কান্না থাকে ততক্ষণ বারংবার বলিতে থাকে খোকন কাঁদছে, খোকন কাঁদছে। অন্য একদিন তাহার পায়ে কাঁটা ফুটিয়াছিল; তাহার মা সূঁচ দিয়া তাহা বাহির করিয়া দিতেছিলেন। খোকন উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এতে লাগে না তো, মা? এইসব ব্যাপারে যে একটু কষ্ট সহ্য করিতে হয়, হইচই করিতে হয় না তাহা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাহার মা বলিলেন, হ্যাঁ লাগেই তো। খোকন বারে বারে জেদ করিতে লাগিল যে, কাঁটা বাহির করিতে ব্যথা লাগে না; তাহার মা বারে বারেই বলিতে লাগিলেন ব্যথা লাগে। অবশেষে খোকন ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল, যেন তাহার নিজের পায়ের কাঁটা বাহির করা হইতেছে। এইরূপ ঘটনা সহজাত দৈহিক সমবেদনাবোধ হইতে ঘটে। ইহাকে ভিত্তি করিয়াই আরও ব্যাপক সমবেদনাবোধ জাগ্রত করা সম্ভবপর। এইজন্য তাহাদিগকে উপলব্ধি করাইতে হইবে যে, মানুষ এবং অপরাপর জীবজন্তুও দুঃখ কষ্ট বোধ করিতে হইবে; শিশু যাঁহাকে শ্রদ্ধা করে তাঁহাকে যেন সে নির্দয় ব্যবহার বা কোনো নিষ্ঠুর কাজ করিতে না দেখে। পিতা যদি গুলি করিয়া পক্ষী হত্যা করেন মারেন এবং মা যদি পরিচারিকার প্রতি রূঢ় ব্যবহার করেন তবে শিশুর মধ্যেও দোষগুলি সংক্রামিত হইবে।

অন্যায় অত্যাচার সম্বন্ধে জ্ঞান : কখন এবং কিভাবে শিশুকে জগতে প্রচলিত অন্যায়, অনাচারের সঙ্গে পরিচিত করানো যায় তাহা একটি কঠিন প্রশ্ন। যুদ্ধ, অত্যাচার, দারিদ্র্য এবং প্রতিষেধক রোগ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকা শিশুদের পক্ষে অসম্ভব। কোনো-না কোনো স্তরে (অবস্থায়) শিশুকে এইসব বিষয় জানিতেই হইবে এবং জ্ঞানের সঙ্গে তাহার দৃঢ় বিশ্বাস গড়িয়া উঠা আবশ্যক যে, যে-দুঃখ হইতে পরিত্রাণ সম্ভবপর তাহা ঘটানো বা ঘটিতে দেওয়া কখনই উচিত নয়। যে সকল লোক স্ত্রীজাতির সতীত্ব রক্ষা করিতে চান তাহাদের যে সমস্যা, শিশুর মনকে অন্যায়, অত্যাচার, দুঃখদহনের বিরুদ্ধে জাগ্রত করিতে চান যাহারা তাহাদের সমস্যাও একইরূপ। পূর্বে স্ত্রীলোকের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ মনে করিতেন বালিকাদিগকে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত যৌন বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রাখাই ইহার প্রধান উপায়; কিন্তু এখন অজ্ঞতা জিয়াইয়া রাখার পরিবর্তে উপযুক্ত জ্ঞানদানের পন্থা গ্রহণ করা হয়।

আমি কতক শান্তিবাদী লোকের কথা জানি, তাহারা মনে করেন যুদ্ধের কথা বাদ দিয়া ইতিহাস পড়ানো উচিত; যতদিন সম্ভব শিশুদিগকে জগতের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে অজ্ঞ রাখাই তাহাদের কামনা। কিন্তু আমি জ্ঞানের অভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত এই ধরনের কাঁচের ঘরে আড়াল করিয়া রাখা গুণের প্রশংসা করিতে পারি না। যখনই ইতিহাস পড়ানো হইবে, সত্য কাহিনীই পড়ানো উচিত। আমরা যে নীতি উপদেশ প্রচার করিতে চাই ঐতিহাসিক ঘটনা যদি তাহার প্রতিকূল হয় তবে বুঝিতে হইবে সে নীতিই ভ্রান্ত এবং উহা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়। ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে অনেকে, এমনকি অনেক ধার্মিক ব্যক্তিও সত্য ঘটনাকে তাঁহাদের মতের পক্ষে অসুবিধাজনক বোধ করেন; ইহা তাহাদের আদর্শের কিছুটা দুর্বলতারই পরিচায়ক। সত্যকারের বলিষ্ঠ নীতিজগতে বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইহা দ্বারাই পুষ্ট। শিশুদিগকে অজ্ঞতার মধ্যে গড়িয়া তুলিলে এই ফল হইতে পারে যে, তাহারা পরে যখন অন্যায়, অনাচার বা কদাচারের সন্তান পাইবে তখন তাহার মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে। এইরূপ ঝুঁকি লওয়া উচিত নহে। নিষ্ঠুরতার প্রতি তাহাদের বিতৃষ্ণা বা বিরূপ মনোভাব জাগাইতে না পারিলে ইহা হইতে শিশুদিগকে নিবৃত্ত করা কঠিন; সমাজে নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান আছে তাহা না জানিলেই বা ইহার প্রতি তাঁহাদের বিরাগ জাগ্রত হইবে কিরূপে?

কিন্তু অন্যায় অত্যাচার সম্বন্ধে শিশুকে ওয়াকিবহাল করার সহজ উপায়টি বাহির করা বড় সহজ নয়। অবশ্য বড় শহরের বস্তিতে যাহারা বাস করে তাহারা মদ্যপানের ফলে মাতলামি, ঝগড়া, মারামারি, স্ত্রীকে প্রহার করা ও এই জাতীয় অনেক প্রকার অনাচার, অত্যাচার দেখিতে পায়, ইহা তাহাদের উপর খুব গভীর প্রভাব বিস্তার করে না। কিন্তু কোনো যত্নশীল পিতা সন্তানকে এইরূপ দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত করাইতে চাহিবেন না। ইহার প্রধান কারণ এই যে, এইসব বীভৎস দৃশ্য শিশুমনে দারুণ ভীতি উৎপাদন করিয়া তাহার সমগ্র জীবনের উপরই গভীর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। অসহায় শিশু যখন প্রথম বুঝিতে পারে যে, শিশুদের উপরও নিষ্ঠুর অত্যাচার হওয়া অসম্ভব নয় তখন সে ভীত না হইয়া পারে না। আমার বয়স যখন চৌদ্দ বৎসর তখন আমি প্রথম ওলিভার-টুইস্ট [Oliver Twist] পড়ি; ইহা আমার মনে এমন ভীতি সঞ্চার করিয়াছিল যে, ইহা অপেক্ষা কম বয়সে পড়িলে আমি হয়তো সহ্যই করিতে পারিতাম না। কিছুটা বয়স বেশি হওয়ার ফলে শিশুর মনে সাহস না জন্মানো পর্যন্ত তাহাকে ভয়ঙ্কর বা ভীতি উৎপাদক কিছু না জানানই ভালো। এইরূপ মানসিক ধৈর্য কোনো শিশুর আগে আসে, কাহারও বা অন্যের তুলনায় পরে আসে। ভীরু বা কল্পনাপ্রবণ শিশুদের মনে ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য যেমন সহজে এবং গভীরভাবে রেখাপাত করিতে পারে, স্বাভাবিক সাহস সম্পন্ন অথবা শিশুদের মনে তেমন সহজে পারে না। শিশু যদি জানে যে তাহার পিতামাতার কল্যাণদৃষ্টি সর্বদা তাহার উপর নিবদ্ধ আছে এবং বিপদে তাহার ভয়ের কোনো কারণ নাই তবে স্বাভাবিকভাবে তাহার মনে নির্ভীকতার ভাব গড়িয়া উঠিবে। ইহা গড়িয়া না উঠা পর্যন্ত শিশুকে বাস্তব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পরিচিত করানো উচিত নয়। কখন এবং কিভাবে এই পরিচয় সাধন করিতে হইবে সে সম্বন্ধে বাধাধরা কোনো নিয়ম নাই; এই বিষয়ে অভিভাবকের দক্ষতা এবং বিচার-বুদ্ধির প্রয়োজন।

শিশুকে নিষ্ঠুরতার সহিত পরিচিত করাইবার উপায় : এ সম্বন্ধে যে কতকগুলি সাধারণ নীতি আছে তাহা পালন করা উচিত। অবাস্তব কাহিনী যেমন, ব্লু বিয়ার্ড ও দানবহত্যাকারী জ্যাকের গল্প, শিশুর মনে সত্যিকারের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে কোনো ভাব জাগায় না। সে এগুলিকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক উদ্ভট মনে করে, বাস্তব জীবনে যে ইহাদের অস্তি আছে তাহা সে মনে করে না। শিশুর ভিতরকার আদিম বন্য-প্রবৃত্তি নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনিয়া পরিতৃপ্ত হয় বলিয়াই সে আনন্দ লাভ করে; এই প্রবৃত্তি নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনিয়া খেলার আবেগরূপে প্রকাশ পায় বলিয়া ইহা দ্বারা কোনো ক্ষতি সাধিত হয় না। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ প্রবৃত্তিও কমিয়া আসে।

শিশুকে যখন বাস্তব নিষ্ঠুরতার সহিত প্রথম পরিচিত করানো হয় তখন বিশেষ যত্নসহকারে এমন সমস্ত ঘটনার কাহিনী নির্বাচন করা উচিত যাহাতে সে অত্যাচারীর পক্ষ সমর্থন না করিয়া নিজেকে নির্যাতিতের দলে মনে করিবে। কোনো গল্পে বর্ণিত অত্যাচারীর সঙ্গে নিজেকে মনে মনে মিশাইয়া দিতে পারিলে শিশুর ভিতরকার বর্বর মানুষটি উল্লসিত হয়। এই ধরনের গল্প শিশুকে সাম্রাজ্যবাদীরূপে গড়িয়া উঠিতে সাহায্য করে। কিন্তু আব্রাহাম কেমন করিয়া আইজ্যাককে বলি দেওয়ার আয়োজন করিয়াছিল অথবা এলিসা কর্তৃক অভিশপ্ত শিশুদিগকে স্ত্রী-ভালুক কেমন করিয়া হত্যা করিয়াছিল এই কাহিনী স্বাভাবিকভাবেই শিশুর মনে নির্যাতিত শিশুর প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। এইসব গল্প যদি বলা হয়, তবে এমনভাবে বলিতে হইবে যেন শিশুরা বুঝিতে পারে বহু যুগ আগে মানুষ কতখানি নিষ্ঠুরতার কাজ করিতে পারিত। বাল্যকালে একবার আমি এক ধর্মযাজককে প্রায় একঘণ্টা ধরিয়া বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছিলাম। তিনি প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিলেন যে এলিসা শিশুদিগকে অভিসম্পাত করিয়া ঠিক কাজই করিয়াছিলেন। সৌভাগ্যবশত আমার বয়স কিছু বেশি থাকায় সে ধর্মযাজককে আমি নেহাত নির্বোধ বলিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলাম, নতুবা ভয়ে হয়তো আমি অভিভূত হইয়া পড়িতাম। আব্রাহাম ও এলিসা নিষ্ঠুরতার কাজ করিয়া ধর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছিলেন, গল্পের মারফত ইহাই যদি প্রমাণ করিতে চেষ্টা করা হয় তবে এগুলি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা উচিত। নতুবা ইহা শিশুর নীতিজ্ঞানের মান নিকৃষ্ট করিয়া ফেলিবে। কিন্তু এইগুলি যদি মানুষের অন্যায় অত্যাচারের ভূমিকারূপে বিবৃত হয় তবে ইহা হইতে বাঞ্ছিত ফল পাওয়া সম্ভব, কারণ কাহিনী হিসাবে এইগুলি জীবন্ত, বহু প্রাচীন এবং ভিত্তিহীন। কিং জন। [King John] পুস্তকে বর্ণিত গল্পে হিউবার্ট কিভাবে বালক আর্থারের চোখ তুলিয়া ফেলিয়াছিল সেই কাহিনীও এই প্রসঙ্গে বলা চলে।

তারপর যুদ্ধ বর্ণনাসহ ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের কাহিনী শুনাইলে প্রথমদিকে শিশুর সহানুভূতি পরাজিতের পক্ষে জাগ্রত করানো দরকার। আমি বরং প্রথমে এমন যুদ্ধের গল্প আরম্ভ করিতে চাই যেখানে শিশু স্বাভাবিকভাবে পরাজিতের প্রতিই সমবেদনা বোধ করিবে–যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইংরাজ বালককে প্রথমে হেস্টিংসের যুদ্ধ কাহিনী শুনাইবে। যুদ্ধের দরুন মানুষের যে দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি হয় তাহার উপরই বেশি জোর দিতে হইবে। পরে ক্রমে ক্রমে শিশুর এমন মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করিতে হইবে যেন সে যুদ্ধের কাহিনী পড়িবার সময় নিজেকে কোনো পক্ষভুক্ত মনে না করে; তাহার মনে যেন এই ধারণা জন্মে যে, উভয়পক্ষের লোকেরাই ছিল নির্বোধ; সাময়িকভাবে তাহাদের মেজাজ চটিয়া গিয়াছিল এবং তাহাদের এমন পরিচারিকার প্রয়োজন ছিল যাহারা তাহাদিগকে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিছানায় শোয়াইয়া রাখিতে পারিত। যুদ্ধকে আমি নার্সারি বা শিশুপালনাগারে শিশুদের ঝগড়ার সমপর্যায়ভুক্ত করিব। আমার বিশ্বাস, শিশুদিগকে এইভাবে যুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ জানানো যায়। ইহা যে নির্বুদ্ধিতার কাজ তখন তাহারা উপলব্ধি করিতে পারিবে।

শিশু যদি নির্দয় আচরণের কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখিতে পায় তবে বয়স্ক ব্যক্তি তাহাকে সে সম্বন্ধে সকল কথা বুঝাইয়া বলিবেন; শিশু যেন মনে মনে এই ধারণা করে যে, নির্দয় ব্যক্তিগণ জীবনের প্রথম হইতে ভালভাবে শিক্ষা পায় নাই। বলিয়াই নিষ্ঠুর আচরণ করিয়া থাকে, তাহাদের হৃদয়ে কোমল সমবেদনা বোধ বিকাশ লাভ করিলে তাহারা এইরূপ আচরণ করিত না। কাল্পনিক গল্প ও ইতিহাসের গল্প শুনিয়া শিশুগণ নিষ্ঠুরতার সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। ইহার পূর্বে তাহাদিগকে কোনোরূপ সত্যকারের নৃশংসতার দৃশ্য দেখানো উচিত নহে। অবাস্তব কাল্পনিক কাহিনী, তাহার পর যুদ্ধবিগ্রহের ঐতিহাসিক গল্প এবং সর্বশেষ পারিপার্শ্বিক বাস্তব জীবনের ঘটনা সম্বন্ধে শিশুকে ধীরে ধীরে অবহিত করাইতে হইবে। সকল ক্ষেত্রেই শিশুর মনে এই অনুভূতি জাগানো আবশ্যক যে, অন্যায় অত্যাচার প্রতিরোধ করা সম্ভবপর এবং কেবল আত্মসংযমের অভাব ও অশিক্ষা হইতেই ইহার উদ্ভব। তাহার মনে অত্যাচারীর প্রতি ক্রোধের উদ্রেক করা উচিত নহে, সে বরং নির্দয় ব্যক্তিকে যেন মনে করে আনাড়ি অপদার্থ লোক যে জানে না কি কাজ করিলে সকলের প্রকৃত সুখ হইতে পারে।

শিশুর ভিতর সহানুভূতির সহজাত বীজ (সুপ্ত) রহিয়াছে; এই প্রবৃত্তিটির যথাযথ বিকাশ ঘটাইয়া ব্যাপক সমবেদনা বোধ জাগ্রত করা প্রধানত বুদ্ধিসুলভ ব্যাপার; ইহা করিতে হইলে যথার্থ দিকে শিশুর মনোযোগে চালিত করা আবশ্যক এবং যুদ্ধলিপ্ত ব্যক্তিগণ ও কর্তৃপক্ষ যে সকল ঘটনা গোপন করিতে চাহেন তাহা শিশুকে উপলব্ধি করানো দরকার। যেমন ধরুন, অস্টারলিজের যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে সকল দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া যে বীভৎস দৃশ্য দেখিয়াছিলেন টলস্টয় তাহার বর্ণনা দিয়াছেন। যুদ্ধের ফলে উভয় পক্ষের লোক যে চরম দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয় তাহার বিবরণ পাঠক ও শ্রোতার মনে বেদনাবোধ জাগ্রত করে। অধিকাংশ ইতিহাসেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থার বর্ণনা থাকে না; যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী বারো ঘণ্টায় যুদ্ধক্ষেত্রের কি শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহা যদি ঐতিহাসিক বর্ণনা করেন তবে যুদ্ধ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অভিনব চিত্র পাঠকের চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে। ইহার জন্য ঘটনা গোপন করার প্রয়োজন নাই, বরং বেশি করিয়া প্রকাশ করা দরকার। যুদ্ধক্ষেত্র সম্বন্ধে যাহা খাটে, অন্য যে-কোনো নিষ্ঠুরতা সম্পর্কেই তাহা প্রযোজ্য। এই সকল ক্ষেত্রে নীতি-উপদেশ প্রদান করা অনাবশ্যক; যথাযথভাবে গল্প বর্ণনাই যথেষ্ট। আপনি নিজে কোনো উপদেশ দিয়া শিশুকে তাহা পালন করিতে বলিবেন না, ঘটনাগুলিকেই শিশুর মনে উপযুক্ত ভাব ও নীতিবোধ উন্মেষ করিতে সুযোগ দিন।

স্নেহ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক। স্নেহ ও সহানুভূতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে; সহানুভূতি-বোধ ব্যাপক, ইহার ক্ষেত্র বিস্তৃত। বহুজনের প্রতি ইহার প্রয়োগ হইতে পারে কিন্তু স্নেহ সকলের জন্য নয়। নির্বাচিত কতকের জন্যই কেবল শিশুর মনে স্নেহ বিদ্যমান সে সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে; এখন সমবয়সীদের মধ্যে স্নেহ সম্বন্ধে কেমন তাহাই বলা হইতেছে।

স্নেহ সৃষ্টি করা যায় না; হৃদয়ের অন্তস্থল হইতে ইহাকে কেবল যুক্ত করা যায়। এক প্রকার স্নেহ আছে যাহার মূল অংশত ভয়ের মধ্যে নিহিত। পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসায় এই ধরনের স্নেহের কিছু মিশ্রণ আছে। পিতামাতা সন্তানকে পালন করেন, বিপদ হইতে রক্ষা করেন। জনক-জননীর স্নেহচ্ছায়া হইতে বঞ্চিত হইলে সন্তান নিশ্চয়ই সুখি হয় না; কাজেই পিতামাতার প্রতি ভালোবাসার মধ্যে কিছু পরিমাণে ভয় মিশ্রিত থাকে। শৈশবেও অন্য শিশুর প্রতি ভালোবাসায় কিন্তু এই ধরনের ভীতির মিশ্রণ দেখিতে পাওয়া যায় না। আমার ছোট মেয়ে তার ভাইয়ের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত, যদিও তাহার জগতে সেই একমাত্র ব্যক্তি যে তাহার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করে না। সমান বয়সীদের মধ্যে ভালোবাসাই সবচেয়ে ভালো; যেখানে সুখ এবং ভীতিশূন্যতা আছে সেখানেই ইহা থাকা সম্ভব। ভয়–তাহা সংজ্ঞাত [Conscious] হউক কিংবা অজ্ঞাতই।

[Unconscious] হউক-ভীত ব্যক্তির মনে তীব্র ঘৃণা ও শত্রু তাহার উদ্রেক করে, কারণ যাহাকে ভয় করা যায়, সর্বদা মনে হয় সে কোনোরূপ ক্ষতি-সাধন করিতে পারে। নিজের ক্ষতির আশঙ্কা ভীত ব্যক্তির মনে আত্মরক্ষার উপায়স্বরূপ ঘৃণা ও শত্রুতা জাগাইয়া রাখে। অধিকাংশ লোকের জীবনে দেখা যায় ঈর্ষা স্নেহ বিস্তারের পক্ষে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। সুখভোগ ব্যতীত ঈর্ষা দমন করার অন্য কোনো উপায় আছে বলিয়া আমি মনে করি না; নৈতিক শৃঙ্খলা ঈর্ষা বোধের অন্তঃপ্রবাহিত ফল্গুধারা রোধ করিতে পারে না। আবার যে সুখ ও স্বস্তিবোধ ঈর্ষাকে প্রতিরোধ করে তাহাই প্রধানত ভয় কর্তৃক দমিত হয়। ভয় অনেক সময় অনেকের উৎফুল্ল জীবনকেও বিষময় করিয়া তোলে। পিতামাতা ও তথাকথিত বন্ধুগণ আনন্দোজ্জ্বল কিশোর-কিশোরীর মনে ভয় সঞ্চার করিয়া বিষাদের ছয়াপাত করেন; নৈতিক কারণেই তাঁহারা এরূপ করেন, মনে ভাবেন; কিন্তু আসলে ঈর্ষা তাহাদিগকে এ কাজে প্ররোচিত করে। বলিতে পারেন–কিসের ঈর্ষা? করিবেই বা কেন? মানব-মনের গহনে নিত্যই নানা ভাবের আলোড়ন চলিতেছে। সকরেই সুখি হইতে চায়, আত্মসুখই প্রধান কাম্য। কিন্তু ইহা যখন সহজলভ্য হয় না তখন অন্যে যে ইহা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করিবে তাহাও মনে সহ্য করিতে পারে না। অপরকে যে নিজের অপেক্ষা বেশি ভাগ্যবান মনে করে তাহার প্রতি ঈর্ষা জাগ্রত হয়, তা সে ব্যক্তি শিশুই হোক কিংবা কিশোরই হউক। ঈর্ষা কিন্তু তখন খাঁটি ঈর্ষার আকারে আত্মপ্রকাশ করে না; ভদ্রতার মুখোেশ পরিয়া, নৈতিক উপদেশের শুভ্র পোশাকে সাজিয়া ইহা ছলনা করিতে বাহির হয়। তরুণ কিশোরগণ যদি যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভীক হয় তবে এই আশঙ্কাবাদীদের কথায় কর্ণপাত করিবে না, নচেৎ তাহাদিগকে ঈর্ষান্বিত নীতি-উপদেষ্টার দলভুক্ত হইয়া দুঃখময় জীবন বরণ করিতে হইবে।

আমরা যে চরিত্রে শিক্ষাদানের পরিকল্পনা করিতেছি তাহার উদ্দেশ্য হইল শিশুর জীবনে সুখ এবং সাহস উৎপাদন করা; এই শিক্ষা শিশুর হৃদয়স্থিত স্নেহের উৎস-মুখ খুলিয়া দেয়। ইহার তুলনায় বেশি কিছু করা সম্ভবপর নয়। প্রথমেই বলা হইয়াছে স্নেহ সৃষ্টি করা যায় না, শুধু ইহার বহির্গমনের পথ করিয়া দেওয়া যায় মাত্র। আপনি যদি শিশুদিগকে স্নেহশীল হইতে উপদেশ দেন, তবে কতকগুলি ভণ্ড ও প্রতারক সৃষ্টি করিতে পারেন কিন্তু তাহাদিগকে যদি মুক্ত পরিবেশে সুখি রাখিতে পারেন, যদি তাহাদিগকে সদয় আচরণে ঘিরিয়া রাখিতে পারেন তবে দেখিতে পাইবেন স্বতঃপ্রবৃত্তভাবেই তাহারা সকলের প্রতি বন্ধুর মতো ব্যবহার করিতেছে। ইহার ফলস্বরূপ প্রায় সকলেই তাহাদের প্রতি প্রীতিপূর্ণ আচরণ করিয়া সদ্ব্যবহারের প্রতিদান দিবে। বিশ্বস্ত এবং প্রীতিস্নিগ্ধ স্বভাবের বিশেষ সার্থকতা আছে; ইহা কিশোর-কিশোরীর চরিত্রে কমনীয় মাধুর্য দান করে এবং অপরের নিকট হইতে যেরূপ স্নেহ-মধুর আচরণ ও সাড়া কামনা করা হয় তাহাই সৃষ্টি করে। যথার্থ চরিত্রগঠনের শিক্ষার ইহা একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় সুফল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *