১০. অপর শিশুর সাহচর্য

দশম অধ্যায় অপর শিশুর সাহচর্য

পিতামাতা এবং শিক্ষক কিভাবে নিজেদের চেষ্টায় শিশুর চরিত্রগঠনে সহায়তা করিতে পারেন, এ পর্যন্ত তাহাই আলোচনা করা হইয়াছে কিন্তু অনেক কিছু আছে যাহা অপর শিশুর সাহায্য ব্যতীত বিকাশ করা যায় না। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীর প্রয়োজনও বাড়িতে থাকে; বাস্তবিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্রের সতীর্থ সঙ্গীর যত প্রয়োজন এমন আর কোনো সময়ে নয়। শিশুর প্রথম বৎসরে প্রথম কয়েক মাসে অন্য শিশুর কোনো প্রয়োজনই হয় না, শেষ তিন মাসে সামান্য সাহায্য করে মাত্র। এই সময় কিঞ্চিৎ অধিক বয়স্ক শিশুরা উপকারে আসে। পরিবারের প্রথম শিশু সাধারণত হাঁটিতে এবং কথা বলিতে শিখিতে বেশি সময় নেয়, কারণ বয়স্ক ব্যক্তিদের কার্যকলাপ ও শক্তি তাহার তুলনায় এত বেশি যে তাহাদিগকে অনুসরণ করা কঠিন। এক বৎসর বয়সের শিশুর কাছে তিন বৎসরের শিশুই বেশি অনুকরণযোগ্য কারণ তিন বৎসরের শিশু যাহা করে ছোট শিশুও তাহা করিতে চায় এবং তাহার শক্তিও অসাধারণ বলিয়া মনে হয় না। শিশুদের নিকট অন্য শিশুরাই বেশি সমগোত্র, বয়স্ক ব্যক্তিরা নয়; অন্য শিশুরাই তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে, কাজে প্রেরণা দেয়। পরিবারেই কেবল ছোট শিশুরা অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের শিশুদের নিকট হইতে এরূপ শিক্ষার সুযোগ পায়। খেলার সময় যদি শিশুকে সঙ্গী নির্বাচন করিতে দেওয়া হয়, তবে সে তাহার অপেক্ষা বেশি বয়সের শিশুকেই সৎসঙ্গীরূপে বাছিয়া লইবে; ইহাতে তাহার অহমিকাবোধ তৃপ্ত হয়, সে যে উপরের স্তরের শিশুদের সমকক্ষ হইতে পারিয়াছে ইহা ভাবিয়া আনন্দ অনুভব করে। কিন্তু বয়স্ক শিশুরা আবার তাহাদের অপেক্ষা বেশি বয়সের ছেলেদের সঙ্গ কামনা করে। তাই দেখা যায় স্কুলে কি বস্তির রাস্তায়, কি অন্যত্র প্রায় সমবয়সী ছেলেরাই একত্রে খেলে, অধিক বয়সের ছেলেরা ছোটদের সঙ্গে খেলিয়া আনন্দ পায় না। এইভাবে দেখা যায় কিঞ্চিৎ বেশি বয়সের শিশুদের সাহচর্যে যে সুবিধা তাহা কেবল গৃহে লাভ করাই সম্ভবপর। কিন্তু ইহার একটি অসুবিধা এই যে, প্রত্যেক পরিবারেই জ্যেষ্ঠ শিশু এই সুযোগ হইতে বঞ্চিত হয়। পরিবার যত ছোট ছোট হয়, বড় শিশুর হারও তত কমিয়া আসে। কাজেই এই অসুবিধা ক্রমে বাড়িয়াই চলে। নার্সারি স্কুলে শিক্ষা দ্বারা শিশুদের অপর শিশুর সাহচর্য লাভের অভাব পূরণ না করিলে ছোট পরিবার শিশুদিগের শিক্ষায় ও আত্মবিকাশে অসুবিধাই সৃষ্টি করে। নার্সারি স্কুলে উপযোগিতা কি এ সম্বন্ধে পরে এক অধ্যায়ে আলোচনা করা হইবে।

বেশি বয়সী শিশুর উপকারিতা : শিশুর ক্রমবিকাশে সহায়তা করার জন্য বেশি বয়সী, কম বয়সী অপর শিশুদের প্রয়োজন আছে। স্কুলে বা অন্যত্র সমবয়সী শিশুরাই একত্র হইয়া খেলাধুলা করে; গৃহেই প্রথমোক্ত দুই প্রকার শিশুর সাহচর্য সীমাবদ্ধ থাকে। বেশি বয়সী শিশুরা ছোটদের সম্মুখে এমন এক আদর্শ তুলিয়া ধরে যাহা তাহাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। শিশুরা যাহাতে তাহাদের বড়দের খেলায় যোগদানের যোগ্য হইতে পারে সেইজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে। বেশি বয়সী শিশুরা ছোটদের সঙ্গে খেলিতে স্বাভাবিকভাবে খেলে, কোনো প্রকার ভান করে না কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিরা সেইরূপ করিতে পারে না। তাহার কারণ বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর শক্তির সমতা নাই; সে নিজের সুখের জন্য শিশুর সঙ্গে খেলে না, শিশুকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই খেলে, কাজেই তাহার পক্ষে ভান না করিয়া উপায় নাই। সে শিশুকে নিজের সমকক্ষ মনে করিতে পারে না, করা উচিতও নয়। শিশু যেমন সহজে ও সানন্দে বড় ভাইবোনের অনুগত হয় তেমন কোনো বয়স্ক ব্যক্তির হয় না; অবশ্য যদি অতিরিক্ত শাসন করা হয় তবে অন্য কথা; এইরূপ ক্ষেত্রে শিশু ক্রীতদাসের মতো বয়স্ক ব্যক্তির অনুগত হয়, ইহাতে শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ থাকে না।

অপরের অনুগত হইয়া কোনো কাজে সহযোগিতা করার অভ্যাস শিশুরা অপর শিশুর নিকট হইতে লাভ করে। বয়স্ক ব্যক্তিরা ইহা শিক্ষা দিতে গেলে দুইটি অসুবিধা দেখা দেয়। প্রথম, তাহারা যদি জোর করিয়া সহযোগিতা আদায় করিতে না চান, তবে শিশুদের মিথ্যা ভানকেই সত্য বলিয়া গ্রহণ করার ভান করিতে হইবে। সহযোগিতা–তাহা সত্য হউক, আর মিথ্যাই হউক তাহার যে কোনো মূল্য নাই বা তাহা যে সর্বদা বর্জনীয় এমন কথা বলিতেছি না। বেশি বয়সী ও কম বয়সী শিশুর মধ্যে যে সহযোগিতা থাকে তাহা যেমন স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত, বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে ছোটদের সহযোগিতায় তেমন সম্ভবপর নয়। এইরূপ অবস্থায় উভয় পক্ষ বহুক্ষণ সানন্দে সহযোগিতা করিতে পারে না।

বাল্য, কৈশোর, যৌবন সকল অবস্থাতেই কম বয়সীদের শিক্ষাদান ব্যাপারে কিছু বেশি বয়সীর যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান থাকে; এই শিক্ষা শ্রেণির পাঠদান হইতে স্বতন্ত্র ইহা কাজের সময়কার বাহিরের শিক্ষা। কিছু বেশি বয়সী ছেলে বা মেয়ে তাহাদের অপেক্ষা কিছু কম বয়সীর উচ্চাকাচ্চা জন্মায় ও কর্ম-প্রেরণা দান করে; ছোটদের কোনো কঠিন সমস্যা তাহারা বয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায়ও ভালোভাবে বুঝাইয়া দিতে পারে, কারণ তাহারা নিজেরাও এ সমস্যার সমাধান করিয়া বিষয়টি অধিগত করিয়াছে এবং সেই জন্যই তাহারা ছোটদের অসুবিধা ভালোভাবে বুঝিতে পারে ও তাহা দূর করিবার উপায় দেখাইতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমি আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে এমন অনেক কিছু শিখিয়াছিলাম যাহা প্রবীণ জ্ঞানবৃদ্ধ অধ্যাপকদিগের নিকট হইতে শিখিতে পারিতাম না। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনে ছাত্রদের বয়সের তারতম্য ভিন্ন ভিন্ন কঠিন স্তর সৃষ্টি করে না, অর্থাৎ বয়সের পার্থক্য থাকিলেও ছাত্রগণ পরস্পরের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেশে এবং ভাবের বিনিময় করে সেইখানেই বেশি বয়সীদের প্রভাব কম বয়সীদের সুফল প্রদান করে কিন্তু যেইখানে বেশি বয়সী ছাত্ররা কম বয়সীদের সঙ্গে মেলামেশাকে মর্যাদাহানিকর মনে করে সেইখানে এইরূপ ফলোভের সম্ভাবনা নাই।

ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বিশেষ করিয়া তিন হইতে ছয় বৎসর বয়স্কদের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাহারা কিঞ্চিৎ বেশি বয়সীদের কতকগুলি নৈতিক গুণবিকাশে সহায়তা করে। শিশু যখন বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকে তখন যে গুণগুলি দুর্বলের সঙ্গে আচরণে বিকাশ লাভ করে, সেইগুলি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায় না। শিশুকে শিখানো দরকার–তাহার ছোট ভাইবোনদের জিনিস কাড়িয়া লইতে নাই, ছোট কেহ হঠাৎ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে তাহার ইটের খেলনা ঘর ভাঙিয়া ফেলে তবে অত্যধিক রাগ দেখাইতে নাই, তাহার অব্যবহৃত খেলনা যদি অন্য কেহ চায় তবে জমাইয়া না রাখিযা দেওয়াই ভালো ইত্যাদি। তাহাকে শিখানো দরকার যে, কচি শিশুকে অসতর্কভাবে বা শক্তভাবে ধরিয়া নাড়াচাড়া করিলে সে ব্যথা পায়। অনিচ্ছায় এইভাবে কোনও শিশুকে ব্যথা দিয়া কাঁদাইলে তাহার নিজেরও মনে কষ্ট অনুভব করা উচিত। এমনই ছোট শিশুকে রক্ষা করিতে বয়স্ক ব্যক্তিদিগকেও শক্ত কথা শুনানো বা ধমক দেওয়া যায় কিন্তু অন্য কোনও কারণে এইরূপ করা শোভন হইবে না; এইরূপ অপ্রত্যাশিত আচরণ ছোটদের মনের উপর দাগ রাখিয়া যায়। এই সবই শিক্ষাপ্রদ কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এইরূপ সৃষ্টি না হইলে অন্য কোনো উপায়ে এই শিক্ষা দেওয়া চলে না।

শিশুকে বস্তুনিরপেক্ষ সাধারণ নৈতিক উপদেশ দান সময়ের অপব্যবহার ও মূর্খতারই পরিচায়ক। শুধু বাস্তব ঘটনাই শিশুর কাছে সত্য, ঘটনাও স্বাভাবিকভাবে ঘটা চাই। বয়স্ক ব্যক্তিরা যাহা মনে করেন নৈতিক উপদেশ, শিশুর নিকট তাহার বিশেষ কোনও আকর্ষণ নাই। শিশু উপদেশ হইতে তেমন শেখে না যেমন শেখে উদাহরণ হইতে। এইজন্যই শিশুর নিকট উপদেশের অপেক্ষা উদাহরণের মূল্য বেশি। মিস্ত্রিকে কাজ করিতে দেখিলে শিশু তাহার কাজ অনুকরণ করে; শিশু তাহার পিতামাতাকে অন্যের সহিত ভদ্র ও সদয় ব্যবহার করিতে দেখিলে নিজেও তাহা অনুকরণ করিতে চেষ্টা করে। উভয়ক্ষেত্রে শিশু যাহা অনুকরণ করিতে চায় তাহা মর্যাদাকর মনে করে। আপনি নিজে যদি ছেলেকে মিস্ত্রির করাত খুব ভালোভাবে ব্যবহার করার উপদেশ দেন কিন্তু যেমন তেমন করিয়া ব্যবহার করেন তবে আপনার উপদেশ কার্যকরি হইবে না। আপনি যদি শিশুকে তাহার ছোটবোনের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে উপদেশ দেন কিন্তু নিজেই তাহার উপর নির্দয় আচরণ করেন তবে আপনার উপদেশ ব্যর্থ হইবে। যদি আপনার কোনো কাজের ফলে ছোট শিশু কাঁদে যেমন নাক পরিষ্কার করিয়া দিতে গেলে কাঁদিতে পারে তবে তাহার তুলনায় বেশি বয়সী শিশুদিগকে এইরূপ দাঁড়াইয়া আপনাকে নির্দয় আচরণ হইতে থামাইতে চেষ্টা করিতে পারে। আপনার আচরণে শিশুর মনে যদি এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ছোট শিশুকে কাঁদাইয়া আপনি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়াছেন, তবে তাহার নিষ্ঠুরতার আবেগকে দমন করা আপনার পক্ষে সম্ভব হইবে না।

সমবয়সীদের উপযোগিতা : বেশি বয়সী ও কম বয়সী শিশুদের প্রয়োজনীয়তা আছে কিন্তু সমবয়সীদের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি, বিশেষত শিশুর চার বৎসর বয়স হইতে আরম্ভ করিয়া বেশির দিকে। সমবয়স্কদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করিতে হয় তাহা শেখা বিশেষ প্রয়োজন। জগতে যত কিছু অসমতা তাহার অধিকাংশই কৃত্রিম; আমাদের আচরণের ভিতর দিয়া এইগুলি দূর করিতে পারিলেই সর্বাপেক্ষা ভালো হইত। ধনীলোকেরা নিজদিগকে তাঁহাদের পাঁচক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করেন এবং সমাজে যেইরূপ আচরণ করেন পাঁচকের সঙ্গে সেইরূপ করেন না। কিন্তু তাহারাই আবার একজন ডিউকের তুলনায় নিজদিগকে নিকৃষ্ট মনে করেন এবং তাহার সঙ্গে আচরণে তাঁহাদের আত্মমর্যাদাবোধের অভাবই পরিলক্ষিত হয়। এই দুই জায়গাতেই তাহারা ভুল করেন; পাঁচক এবং ডিউক উভয়ের প্রতি একইরূপ ভাব পোষণ করা এবং একইরূপ আচরণ করা উচিত। যে যৌবনে বয়সের তারতম্য অনুসারে স্তরভেদ করা হয় তাহা কৃত্রিম নয়; এই জন্যই যে সামাজিক অভ্যাসগুলি পরবর্তিকালে কাজে লাগিবে তাহা সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে অর্জন করা উচিত। সমানে সমানে সকল খেলা এবং স্কুলের প্রতিযোগিতা ভালো জমে। স্কুলে যে সুনাম বা প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহা সে অর্জন করে নিজের চেষ্টায়। সে সকলের প্রশংসা লাভ করিতে পারে অথবা সকলের ঘৃণার পাত্রও হইতে পারে; ইহা নির্ভর করে তাহার চরিত্র ও শক্তির উপর। স্নেহশীল পিতামাতা সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়া আদুরে গোপাল সৃষ্টি করেন, এইরূপ ক্ষেত্রে ছেলে আত্মশক্তি প্রকাশে বিশেষ উৎসাহিত হয় না; সন্তানের প্রতি স্নেহশীল পিতামাতা এমন কঠোর পরিবেশ সৃষ্টি করেন যেখানে শিশুর স্বতঃপ্রবৃত্ততা রুদ্ধ হইয়া যায়। কাজেই দেখা যায় অতিরিক্ত স্নেহ প্রদর্শনের ফলে যে সব শিশুর কর্মশক্তি লোপ পায়, অতিরিক্ত কঠোরতার ফলেও তেমনই তাহার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাজের উৎসাহ ও উদ্যম নষ্ট হইয়া যায়। সমবয়সীরাই কেবল মুক্ত প্রতিযোগিতায় এবং সমানভাবে সহযোগিতার ভিতর দিয়া শিশুদের কাজে স্বতস্ফূর্ত আনিতে পারে। স্বেচ্ছাচারিতা না দেখাইয়াও কিভাবে আত্মসম্মান বজায় রাখা যায়, হীনতা প্রকাশ না করিয়া কিভাবে অন্যের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা যায় সমবয়সীদের সঙ্গে আচরণের মাধ্যমেই তাহা ভালোভাবে শিক্ষা করা যায়। এই জন্য শিশুরা ভালো স্কুলে সদাচরণ শিক্ষার যে সুবিধা পায় পিতামাতা হাজার চেষ্টা করিয়াও বাড়িতে তাহা দিতে পারেন না।

শিশু ও কিশোরের জীবনে সমবয়সীদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলা হইল। আরও কয়েকটি কারণে তাহাদের সঙ্গলাভ একান্ত আবশ্যক। শিশুর দেহ ও মনের সুস্থ বিকাশের জন্য খেলা অত্যাবশ্যক কিন্তু প্রথম বৎসরের পর শিশু অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে না হইলে খেলিয়া আনন্দ পায় না। খেলিতে না পাইলে শিশু হয় দুর্বল; জীবনের আনন্দের আস্বাদ সে পায় না। আনন্দই শিশুর জীবন রসায়ন। ইহা হইতে বঞ্চিত হওয়ায় তাহার মনে উৎকণ্ঠা বাড়িয়া উঠিতে থাকে। অবশ্য শিশুকে তিন বৎসর বয়স হইতেই একটি বিদেশি ভাষা শিকাইতে আরম্ভ করিয়া সকল প্রকার বাল্যসুলভ চপলতা হইতে দূরে সরাইয়া রাখা যায়, যেমন ঘটিয়াছিল জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবনে। কেবল জ্ঞানসঞ্চয় দিক হইতে বিবেচনা করিলে ইহার ফল ভালই হয় বলিতে হইবে কিন্তু সকল দিক বিবেচনা করিয়া এই প্রণালীর প্রশংসা করা যায় না। মিল তাহার আত্মজীবনীতে বলিয়াছেন– কৈশোরের একসময়ে তাহার মনে দারুণ উৎকণ্ঠা উপস্থিত হইয়াছিল এই ভাবিয়া যে, নানা সুরের সংমিশ্রণ কোনো না কোনো সময় শেষ হইয়া যাইবে; তখন তো আর নূতন গান রচনা করা চলিবে না। এই দুশ্চিন্তায় তিন আত্মহত্যা করার উপক্রম করিয়াছিলেন। ইহা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এই ধরনের মানসিক আলোড়ন স্নায়বিক দুর্বলতারই পরিচায়ক। মিলের পিতাও একজন বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন কিন্তু পিতার দার্শনিক মত যে কোথাও ভুল হইতে পারে পুত্র তাহা চিন্তাই করিতে পারিতেন না। তাঁহার মানসিক দাস্যতা এইভাবে তাঁহার বিচার-শক্তির মূল্য অনেক হ্রাস করিয়া দিয়াছিল। সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়া যৌবনে উপনীত হইলে হয়তো মিল আরও বেশি সতেজ বুদ্ধি ও অধিকতর মৌলিকতার অধিকারী হইতেন। আর যাহাই হউক, জীবন উপভোগ করার শক্তি তিনি নিশ্চয় অনেক বেশিমাত্রায় লাভ করিতে পারিতেন। আমি নিজেও ষোলো বৎসর বয়স পর্যন্ত সমবয়সীদের সঙ্গ ও সাধারণ আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইয়া নিঃসঙ্গভাবে লালিত হইয়াছিলাম। মিল যেইরূপ বর্ননা করিয়াছেন, কৈশোরে আমারও ঠিক ওইরূপ অবস্থা মনে আসায় আমিও আত্মহত্যার ইচ্ছা করিয়াছিলাম। আমার মনে হইয়াছিল–গতিবিজ্ঞানের নিয়মানুসারে দেহ চালিত হইতেছে, ইচ্ছা বলিয়া কোনো কিছু নাই; ইহা নিছক ভ্রান্তিমাত্র। এই চিন্তা দুশ্চিন্তার আকার ধারণ করিয়া আমার আত্মহত্যার বাসনা জাগাইয়াছিল। পরে সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করার সময় বুঝিলাম, কাহারও সঙ্গে আমার মতের বনিবনা হয় না। আমার চিন্তা ও ভাবধারার পরিবর্তন হইয়াছে কি না, কতদূরেই বা আমি আগের মতোই আছি তাহা আমার পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়।

সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশার স্বপক্ষে সব রকম যুক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, কতক বালক-বালিকাকে স্কুলে পাঠানো উচিত নয়। ব্যক্তি হিসেবে ইহাদের মধ্যে অসাধারণত্ব থাকিতে পারে। কোনো বালকের যদি দৈহিক দুর্বলতার সঙ্গে অস্বাভাবিক [Abnormal] মানসিক শক্তি থাকে তবে সে সাধারণ সঙ্গীদের সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলিতে নাও পারে; হয়তোবা সঙ্গীরা খেপাইয়া উত্ত্যক্ত করিয়া তাহাকে পাগল করিয়া দিতে পারে। অসাধারণ মানসিক শক্তি অনেক সময় পাগলামির পর্যায়ে পড়ে; এইরূপ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মনীষাসম্পন্ন বালকের জন্য পৃথক ব্যবস্থা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমে বালকের অস্বাভাবিক অনুভূতিশীলতার কারণ অনুমান করিয়া ধৈর্য ও যত্নের সহিত ইহা নিরাময় করার চেষ্টা করিতে হইবে। বালক যাহাতে অত্যাচারিত না। হয় সেইদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা আবশ্যক। আমার মনে হয় শৈশবে শিশুর শিক্ষার ত্রুটির মধ্যে ইহার কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। শৈশবে কুশিক্ষার ফলে পরিপাকক্রিয়ার ব্যাঘাত অথবা স্নায়ুর বিকলতা ঘটা অসম্ভব নয়। শৈশবে যথোপযুক্তভাবে এবং বিজ্ঞতার সহিত লালন-পালন করিলে অধিকাংশ শিশুই সুস্থ, সবল, স্বাভাবিকরূপে বাড়িয়া ওঠে; অন্য শিশুদের সঙ্গ তাহাদের দেহের এবং মনের শক্তিবিকাশে অনুকূল অবস্থাই সৃষ্টি করে। তবু খুব অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম দেখা দিতে পারে, যেমন দেখা যায় প্রতিভাবানদের জীবেন। এইরূপ অবস্থায় অসাধারণ বালককে বরং স্কুলে না পাঠাইয়া নিরিবিলিতে আত্মবিকাশের বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *