০৯. শাস্তি

নবম অধ্যায় শাস্তি

আগেরকার দিনে এবং কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত শিশু এবং বালক-বালিকাদিগকে শাস্তি দেওয়া একটি অতি সাধারণ প্রচলিত ব্যাপার ছিল; শিক্ষার জন্য ইহাকে সর্বজনস্বীকৃত এবং অপরিহার্য মনে করা হইত। বেত্রাঘাত সম্বন্ধে ডক্টর আর্নল্ড কি অভিমত পোষণ করিতেন তাহা সর্বজনবিদিত। তাহার সময়ে ডক্টর আর্নল্ডের অভিমত অতি কোমলতাপূর্ণ বলিয়া বিবেচিত হইত। শিশুকে তাহার নিজের স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে বাড়িয়া উঠিতে দিবার নীতি প্রচার করেন রুশো। তথাপি তিনিও এমিল [Emile] গ্রন্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিদানের অনুকূলে অভিমত দিয়াছেন। একশত বৎসর পূর্বে শিশুর শাস্তি বিধান সম্পর্কে কিরূপ ধারণা ছিল তাহা তখনকার সতর্ককারী একগল্পে বর্ণিত আছে। ছোট্ট একটি মেয়েকে সাদা জামা পরাইয়া দেওয়া হইতেছে কিন্তু সে জেদ ধরিয়াছে ফিকে লাল রঙেরটি পরিবে। তাহার অবাধ্যতার ফল কি হইল?

বহির্বাটি থেকে এসে   বাবা শুনিলে যবে
 খুকুর তর্জন ক্রন্দন;
 তখনই রাগের বশে   ভিতরে ছুটিয়া এসে
বেত্রাঘাতে করে দমন।

The Fair Child Family পুস্তকে বর্ণিত আছে মিঃ ফেয়ার চাইল্ড তাঁহার ছেলেমেয়েদিগকে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া করিতে দেখিলে বেত মারিতেন আর তালে তালে কবিতা আবৃত্তি করিতেন কুকুর মাতুক আনন্দে কামড়ে গর্জনে [Let dogs delight to bark and bite] তারপর ফাঁসির কাষ্ঠের সঙ্গে ঝুলানো মৃতদেহ দেখানোর জন্য লইয়া যাইতেন। বাতাসে মৃতদেহটি নড়িত, শিকলের ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ হইত; ছেলেমেয়েরা ভয়ে জড়ো হইয়া তাহাদিগকে বাড়িতে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে অনুরোধ করিতে থাকিত। কিন্তু মিঃ ফেয়ার চাইল্ড তাহাদিগকে বহুক্ষণ সেই বীভৎস দৃশ্য দেখিতে বাধ্য করিতেন এবং বলিতেন, যাহাদের অন্তরে ঘৃণা আছে তাহাদের এই দশাই হয়। পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ধর্মযাজক করা; এবং এই উদ্দেশ্যেই হয়তো তাহাকে এমন শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল যাহাতে সে পাপীর অপরাধ যে কিরূপ ভীষণ হয় সে সম্বন্ধে পরে প্রত্যক্ষদর্শীর মতো জ্বলন্ত বর্ণনা দিতে পারে। বর্তমান যুগে এইরূপ শাস্তি কেহই সমর্থন করিবে না। কিন্তু ইহার পরিবর্তে কিরূপ শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত সে সম্বন্ধে বহু মতভেদ আছে। কেহ এখনও ভালোমতো শাস্তিদানের পক্ষপাতী আবার কেহ কেহ মনে করেন ইহার কোনও প্রয়োজন নাই। এ দুইটিই চরম অভিমত।

আমার মনে হয় শিক্ষায় শাস্তির প্রয়োজন আছে, তবে ইহার স্থান খুব কম; আর কঠোর শাস্তি মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়, আমার মতে ধমক দেওয়া বা তিরস্কার করাও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। যদি কখনো কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করিতে হয়, তাহার জন্য স্বাভাবিক ক্রোধ প্রকাশই যথেষ্ট হওয়া উচিত। কয়েকবার আমার ছেলে তাহার ছোট বোনের উপর রূঢ় ব্যবহার করিলে তাহার মা রাগিয়া বিরক্তির সঙ্গে জোরে ধমক দেন। ইহাতেই সুফল ফলিল। ছেলে ফেঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল এবং তাহার মা তাহাকে আদর না করা পর্যন্ত সে শান্ত হইল না। পরে ছোট বোনের সঙ্গে তাহার ব্যবহার লক্ষ্য করিয়া দেখা গেল ক্রোধের সুফল তাহার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করিয়াছে। আমরা কোনও জিনিস না চাহিলেও সে যখন ইহার জন্য জেদ করিয়াছি কিংবা তাহার ছোট বোনের খেলায় বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়াছে, তখন তাহাকে মৃদু আকারে শাস্তি দিতে হইয়াছে। এইরূপ ক্ষেত্রে ভালোভাবে বুঝাইলেও কোনো ফল না হইলে আমরা তাহাকে একটি ঘরে একাকী রাখিয়া আসিতাম। ঘরের দরজা খোলা থাকিত; তাহাকে বলা হইত যে ভালো হইলেই যেন ঘর হইতে চলিয়া আসে। কয়েক মিনিট সে খুব জোরে চিৎকার করিয়া কাঁদিত তারপর শান্ত হইয়া বাহির হইয়া আসে এবং ভালো ব্যবহার করিতে থাকে। সে ইহা ভালোভাবেই বুঝিত যে বাহিরে আসায় সে শান্ত আচরণের শর্ত মানিয়া লইয়াছে। আমাদিগকে ইহার চেয়ে কঠোরতর শাস্তি প্রয়োগ করিতে হয় নাই।

যাহারা কঠোর শাস্তি দিয়া শিশুকে শায়েস্তা করিতে চাহিতেন এমন প্রাচীনপন্থি শৃঙ্খলা-বিধানকারী ব্যক্তিদের বই পড়িয়া বোঝা যায় যে, বর্তমান প্রণালীতে শিক্ষিত শিশুদের অপেক্ষা প্রাচীন প্রণালীতে শিক্ষিত শিশুরা অনেক বেশি দুষ্ট ছিল। The Fair Child Family পুস্তকে শিশুদের যেরূপ আচরণের কথা উল্লেখ করা আছে, আমার ছেলে তাহার অর্ধেক খারাপ আচরণ করিলেই আমি স্তম্ভিত হইব। এরূপ ক্ষেত্রে আমি মনে করিব ছেলের পিতামাতার দোষই বেশি। আমি বিশ্বাস করি যে, বিচারবুদ্ধি বিশিষ্ট পিতামাতাই অনুরূপ সন্তান গড়িয়া তুলিতে পারেন। শিশুদের জীবনগঠনের পক্ষে পিতামাতার স্নেহ বিশেষ প্রয়োজনীয়। সন্তানের প্রতি শুষ্ক কর্তব্য ও দায়িত্ব সন্তানগণ বোঝে না তজ্জন্য কৃতজ্ঞও থাকে না। তাহারা চায় জনক-জননীর অন্তর নিঙড়ানো মধুর স্নেহ। শিশুকে ভালোভাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে তাহাকে বুঝিতে দিতে হইবে যে, সে পিতামাতার স্নেহের অধিকারী। ইহা ছাড়া তাহাকে কোনো কাজ বা আচরণ হইতে বিরত থাকিতে বলিলে অথবা কোনও কাজ করিতে নিষেধ করিলে সম্পূর্ণ অসম্ভব না হইলে, ইহার কারণ তাহার নিকট যথাযথভাবে বুঝাইয়া বলা উচিত। খেলাধুলা করিতে গেলে অনেক সময় ছোটখাট আঘাত লাগে, হাত-পা কাটে বা ছাল উঠিয়া যায়; এইরূপ বরং ঘটিতে দেওয়া ভালো, তথাপি শিশুদিগকে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটির খেলা হইতে নিবৃত্ত করা উচিত নয়। এইরূপ কিছু কিছু অভিজ্ঞতা হইতে তাহারা উপলব্ধি করিতে পারে যে নিষেধ মানিয়া চলা বুদ্ধিমানের কাজ। যেখানে প্রথম হইতেই শিশুরা এইরূপ অবস্থার মধ্যে দিয়া শিক্ষা পাইতে থাকে সেখানে গুরুতর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য কোনো কাজ তাহারা করিবে না বলিয়া আমার বিশ্বাস।

শিশু যখন জেদ করিয়া ক্রমাগতই অন্য শিশুদের খেলায় প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে থাকে কিংবা অন্যদের আনন্দে বাধা দেয় তখন শাস্তিস্বরূপ তাহাকে অপর শিশুদের কাছ হইতে পৃথক করিয়া সরাইয়া রাখা উচিত। এইরূপ কোনো শাস্তি দিতেই হইবে, কেননা একজনের দুষ্টামির জন্য অন্য সকলের আনন্দে বিঘ্ন হইতে দেওয়া কর্তব্য নয়। কিন্তু দিবার কোনো প্রয়োজন নাই যাহাতে সে যে বিশেষভাবে দোষী সেই ভাব তাহার মনে হয়। সে যদি বুঝিতে পারে যে অন্যেরা যে আনন্দভোগ করিতেছে সে তাহা হইতে বঞ্চিত তবেই যথেষ্ট। এরূপ ক্ষেত্রের মাডাম মন্তেসরি কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেন, তাহা তিনি বর্ণনা করিয়াছেন :

আমরা অনেক সময় এমন শিশুদের সংস্পর্শে আসিয়াছি যাহারা কোনো রকম সংশোধন বা উপদেশ কর্ণপাত না করিয়া অন্যের আনন্দে উৎপাত সৃষ্টি করিয়াছে। এইরূপ শিশুকে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করান হয়। যখন দেখা যায় যে তাহাদের কোনোরূপ শারীরিক অসুস্থতা নাই,তখন তাহাকে ধরিয়া কোনো ছোট একটি টেবিলে বসাইয়া অন্যের নিকট হইতে দূরে পৃথক করিয়া রাখা হয়। তাহাকে ছোট একটি হাতওয়ালা আরাম চেয়ারে এমনভাবে একটু উঁচুতে বসানো হয় যাহাতে সে অন্য ছেলে মেয়েদের খেলা দেখিতে পারে। যে সব খেলনা সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, তাই তাহাকে খেলিতে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া প্রায় সকল ক্ষেত্রে শিশুকে শান্ত করিয়াছে। পৃথক স্থানে বসিয়া থাকিয়া সে অন্য সাথীদের খেলা দেখিতে পায় এবং তাহা তাহার নিকট বস্তূপাঠ [Object lesson]-এর মতো কাজ করে। শিক্ষাকে মৌখিক উপদেশ অপেক্ষা ইহা বেশি কার্যকরি হয়। ধীরে ধীরে সে অন্য সকলের সঙ্গে মিলিয়া-মিশিয়া খেলার সুবিধা উপলব্ধি করিতে পারে, সে নিজেই সকলের মধ্যে ফিরিয়া যাইতে চায়। এইভাবে যে সব শিশু প্রথমে আমাদের শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিল তাহাদের সকলকেই শৃঙ্খলার মধ্যে আনিতে সক্ষম হইয়াছি। পৃথক করিয়া রাখা শিশুর প্রতি সর্বদা বিশেষ যত্ন লওয়া হইত, যেন সে পীড়িত। আমি নিজে কক্ষে প্রবেশ করিয়াই প্রথমে তাহার কাছে যাইতাম; যেন সে অতি কচি শিশু। তারপর আমি অন্যদের প্রতি দৃষ্টি দিতাম, তাহাদের বেলায় কৌতূহল দেখাইতাম, তাহারা যেন ছোট ছোট বয়স্ক ব্যক্তি এইভাবে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতাম। যাহাদিগকে পৃথক করিয়া রাখিয়া শাস্তি দিতে হইত, তাহাদের মনে কি হইত তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু তাহাদের আচরণের পরিবর্তন হইত স্থায়ী এবং সম্পূর্ণ। কেমন করিয়া কাজ করিতে হয়, কেমন করিয়া অন্যের সঙ্গে ব্যবহার করিতে হয়, ইহা শিখিতে তাহারা রীতিমতো গর্ববোধ করিত। তাহারা অন্য শিক্ষয়িত্রী এবং আমার প্রতি সর্বদা প্রীতির ভাব দেখাইত।

যে যে কারণের জন্য, এই প্রণালীতে সুফল পাওয়া যায়, তাহা আগেকার দিনের স্কুলে ছিল না। কোনোরূপ অসুস্থতার জন্য শিশু খারাপ ব্যবহার করিতে শুরু করিলে এখন তাহাকে সরাইয়া পৃথক করিয়া রাখা হয়। তারপর এ প্রণালী প্রয়োগ করার কৌশল ও নিপুণতা তো আছেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বড় কথা হইল, বেশিরভাগ শিশুর শৃঙ্খলা মানিয়া চলার স্পৃহা। অবাধ্য শিশু একাই যে জগতের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু ইহাকে উপেক্ষা করিতে পারি না। যে স্কুলে শ্রেণির সকল ছাত্রই হইচই করিয়া শৃঙ্খলা অমান্য করিতে উৎসুক সেখানে শিক্ষককে এক সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থার সম্মুখিন হইতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে শিক্ষকের কি প্রণালী অবলম্বন করা উচিত তাহা আলোচনা করিতে চাই না, কেননা প্রথম হইতে শিশুকে উপযুক্তভাবে শিক্ষা দিলে শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে এরূপ বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টিই হইবে না।

তোষামোদ করিয়া শিক্ষাদান : শিশুরা শিক্ষণীয় বিষয় শিখিতে চায় তবে বিষয়টি শিখিবার উপযুক্ত হওয়া চাই এবং উপযুক্তভাবে শিক্ষা দেওয়া চাই। শৈশবে খাওয়ান ও ঘুম পাড়ানোর ব্যাপারে যে ভুল, শিক্ষাদানের ব্যাপারেও সেই ভুল করা হইয়া থাকে। শিশুর পক্ষে যাহা করা উপকারী তাহার জন্য তাহাকে এমন তোষামোদ করা হয় যে সে ভাবে সে বুঝি তদ্বারা বয়স্ক ব্যক্তিদিগকে কৃতার্থ করিতেছে। শিশুদের মনে অতি সহজেই এই ধারণা আসে যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা চাহেন বলিয়াই তাহারা খায় এবং ঘুমায়। আহার ও নিদ্রায় কোনোরূপ ব্যতিক্রম দেখাইলে অভিভাবকগণ ব্যস্ত হইয়া পড়েন, শিশুর অহমিকাবোধ তৃপ্ত হয়। এই অবস্থার বাড়াবাড়ি ঘটিলে শিশুর পরিপাক ক্রিয়া ও নিদ্রা দুই-ই ব্যাহত হয় এবং সে রুগ্ন হইয়া পড়ে। পরিচারিকা আমার ছেলেকে খোশামোদ করিয়া খাওয়ানো অভ্যাস করিয়াছিল, ইহার ফলে ক্রমেই সে জেদি হইয়া উঠিতেছিল। একদিন দুপুরে তাহাকে আহার করিতে ডাকিলে সে পুডিং খাইতে অস্বীকার করিল। কাজেই ইহা রাখিয়া দেওয়া হইল। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেই খাবার চাহিল কিন্তু তখন দেখা গেল পাঁচক তাহা খাইয়া ফেলিয়াছে। ইহাতে সে সংযত হইয়া গেল এবং পরে আর কখনো আমাদের কাছে রাগের ভান করে নাই। শিক্ষা ব্যাপারে ঠিক এইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। যদি কেহ শিক্ষা নিতে না চায় তাহাকে বাদ দেওয়া উচিত। তবে দেখিতে হইবে পাঠদান হইতে সে যতক্ষণ অনুপস্থিত থাকিবে, ততক্ষণ যেন। আনন্দে সময় কাটাইতে না পারে। সে যদি অন্যকে শিখিতে দেখে, তাহা হইলে শীঘ্রই নিজেই শিখিতে আগ্রহ প্রকাশ করিবে। শিক্ষক তখন তাহাকে সাহায্য করিতে পারেন; কাজটি এমনভাবে করিতে হইবে যেন শিশু বুঝিতে পারে যে, সে নিজেই উপকৃত হইতেছে, অপর কাহাকেও কৃতার্থ করিতেছে না। আমি স্কুলে একটি করিয়া বড় খালি কক্ষ রাখার পক্ষপাতী। পাঠে অনিচ্ছুক ছেলেদিগকে সেখানে পাঠানো হইবে। একবার সেখানে যাইলে সে-দিন আর তাহাকে শ্রেণিতে ফিরিতে দেওয়া হইবে না। পাঠের সময় খারাপ ব্যবহার করিলে শাস্তিস্বরূপ তাহাদিগকে শূন্য কক্ষে নির্বাসন করিতে হইবে। সাধারণ নীতি এই যে অপরাধীকে এমন শাস্তি দিতে হইবে যাহা সে পছন্দ করে না। তথাপি ছাত্রের মনে প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি প্রীতি জন্মাইবার উদ্দেশ্যে ওইরূপ পুস্তক হইতে লেখা নকল করার শাস্তি প্রদান করা হইয়া থাকে।

প্রশংসা ও নিন্দা : ছোটখাটো রকমের অপরাধের জন্য (যেমন আচরণের অশোভনতা ইত্যাদি) মৃদু রকমের শাস্তির উপযোগিতা আছে। প্রশংসা ও নিন্দা ছোট শিশুদের এবং বয়স্ক বালক-বালিকাদের পক্ষেও পুরস্কার ও শাস্তি হিসেবে বিশেষ প্রয়োজনীয়। যিনি ছোটদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে পারেন এমন লোক যদি প্রশংসা বা নিন্দা করেন তবে ইহার গুরুত্ব আরও বাড়ে। প্রশংসা ও নিন্দা ব্যতীত শিক্ষাদান কার্য চলে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না, তবে ইহা প্রয়োগ করিতে কিছুটা সতর্কতা আবশ্যক।

প্রথমত, প্রশংসা বা নিন্দা তুলনামূলকভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কোনো শিশুকে বলা ঠিক হইবে না–তুমি অমুকের চেয়ে ভালো করিয়াছ বা অমুকে অমুকে মোটেই খারাপ নয়। প্রথমটির ফলস্বরূপ তাহার মনে অবজ্ঞার ভাব উৎপন্ন হয়, দ্বিতীয় শত্রুতার সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয়ত, প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দার প্রয়োগ কম করা দরকার। শিশু কোনও অশোভন আচরণ করিলে শাস্তিস্বরূপ ইহা প্রয়োগ করিতে হইবে; ফল পাওয়া গেলে উহার প্রয়োগের আবশ্যকতা নাই।

তৃতীয়ত, যে কার্যে বিশেষ কৃতিত্ব নাই, তাহার জন্য প্রশংসা করা অনুচিত। সাহস কিংবা নূতন কৌশল প্রদর্শনের জন্য অথবা নিজের সংবাদের কোনো প্রকার নিঃস্বার্থপরতা দেখাইলে শিশুর নৈতিক শক্তির প্রকাশকে উৎসাহ দিবার জন্য প্রশংসা করিতে হইবে। শিক্ষা ব্যাপারে ছাত্র অনন্য সাধারণ ভাল কিছু করিলে তাহাকে প্রশংসা করা একান্ত আবশ্যক।

কঠিন কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রশংসাপ্রাপ্তি তরুণদের নিকট অতি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা; প্রশংসা লাভের কামনা তাহাদের কাজে প্রেরণা জোগায়, যদিও ইহা প্রধান উদ্দেশ্য নয়। কাজের প্রতি অনুরাগ ও নিষ্ঠাই প্রেরণার মূল উৎস হওয়া উচিত।

নিষ্ঠুরতা : চরিত্রের গুরুতর দোষগুলি, যেমন নিষ্ঠুরতা, শাস্তি দিয়া সংশোধন করা যায়; তাহার জন্য শাস্তি প্রয়োগ করিলেও পরিমাণ খুব কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ছেলেদের মধ্যে কম-বেশি স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়; ইহা প্রতিরোধকরার জন্য যথাসময়ে শিক্ষার প্রয়োজন। আপনি যদি মনে করেন ছেলেকে যখন কোনো প্রাণীর উপর নির্যাতন করিতে দেখিবেন, তখন তাহাকে শাসন করিবেন, তবে ভুল করা হইবে। এরূপ করিলে সে যাহাতে পরে আপনার নজরে না পড়ে সেই চেষ্টা করিবে। শিশুর যে ভাবটি পরে হয়তো নিষ্ঠুরতায় পরিণত হইতে পারে; তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া প্রথম অবস্থাতেই তাহা দূর করা প্রয়োজন। ছেলেকে অপরের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা শিখান; সে যেন আপনাকে কোনো প্রাণী, এমনকি বোলতা বা সাপও হত্যা করিতে না দেখে। যদি তাহা সম্ভবপর না হয়, তবে কোন্ কোন্ প্রাণী হত্যা করা হয় তাহা সহজভাবে শিশুকে বুঝাইয়া দিন। সে যদি অপর ছোট শিশুর প্রতি নির্দয় ব্যবহার করে, আপনিও তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতি সেইরূপ করুন। সে প্রতিবাদ করিবে; আপনি তখন তাহাকে বুঝাইবেন যে, সে যদি ইহা পছন্দ না করে, অন্যের প্রতিও তাহার নিষ্ঠুর আচরণ করা সঙ্গত নহে। এইভাবে অন্যেরও যে তাহার মতোই সুখ-দুঃখের অনুভূতি আছে তাহা সে বুঝিতে পারিবে।

নিষ্ঠুরতা নিবারণের উপায় : শিশু অন্যের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করিলে তাহার উপরও অনুরূপ আচরণ করিয়া যদি তাহার নিষ্ঠুরতার মনোভাব দূর করিতে চান, তবে এ প্রণালী প্রথম হইতেই আরম্ভ করিতে হইবে। ইহার কারণ স্পষ্ট। অন্যের উপর নির্দয়তার প্রতিদানে শিশুর উপর যে অনুরূপ নির্দয় ব্যবহার করিবেন, তাহা তো গুরুতর হওয়া চলিবে না।

যখন নিষ্ঠুরতার প্রতিদানে নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করিবেন শিশু যেন বুঝিতে পারে আপনি রাগিয়া তাহাকে শাস্তি দিতেছেন না, তাহার শিক্ষার জন্যই ওইরূপ ব্যবস্থা করিতেছেন। তাহাকে বলিতে পারেন- দেখ তোমার ছোটবোনকে তুমি এমনিভাবে কষ্ট দিয়েছ। আঘাত পাইয়া ছেলে প্রতিবাদ কিরবে। তখন আপনি বলিবেন–বেশ তোমার যদি ইহা ভালো না লাগে অন্যের উপরেও তো তোমার এরূপ করা উচিত নয়। এইরূপে শিশু যদি সঙ্গে সঙ্গে সহজভাবে শিক্ষা পায়, তবে তাহার এই ধারণা হইবে যে, অন্যের সুখদুঃখ বোধকে মানিয়া চলা উচিত। ইহার ফলে কখনো গুরুতর নিষ্ঠুরতার উদ্ভব হইবে না।

নৈতিক উপদেশ : নৈতিক উপদেশ সকল ঠিক সময়ে এবং বস্তুসাপেক্ষভাবে (concrete) প্রয়োগ করা উচিত। শিশুকে উপদেশ দিবার জন্য আপনি ইচ্ছা করিয়া কোনো ঘটনার অবতারণা করিবেন না। স্বাভাবিকভাবে কোনো ঘটনা ঘটিলে তখন তাহার সুযোগ লইবেন। মনে রাখিতে হইবে, একটিমাত্র সুযোগ অবলম্বন করিয়া ব্যাপকভাবে নানা উপদেশ দিলে কোনো ফল হইবে না। কোনো একটি বিশেষ ঘটনায় শিশু যে উপদেশ পাইবে পরে অনুরূপ কোনো ক্ষেত্রে সে নিজেই উহা প্রয়োগ করিতে পারিবে। কোনগুলি মানুষের সগুণ এবং কিভাবে তাহা প্রকাশ করিতে হয়, সে সম্বন্ধে সাধারণ নীতি জানিয়া তাহা অনুসরণ করা শিশুর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। কোনো বিশেষ অবস্থায় কিরূপ আচরণ করিতে হয় তাহা জানাই বরং তাহার পক্ষে সহজ। পরে অনুরূপ অবস্থা ঘটিলে সে পূর্বের অভিজ্ঞতার সাহায্যে যথাযথ আচরণ করিতে পারিবে।

সাহসী হও, দয়ালু হও, সাধারণভাবে এরূপ উপদেশ দিবেন না; বরং কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে তাহাকে সাহস দেখাইতে উৎসাহ দিন; পরে বলুন–বেশ? এই তো তুমি সাহসী ছেলে, তাহার খেলনাটি তাহার ছোট ভাই বা বোনকে খেলিতে দিতে বলুন। খেলনা পাইয়া শিশু যখন আনন্দে উল্লসিত হইয়া উঠিবে, তখন খোকাকে বলুন–এই তো তুমি ঠিক কাজ করেছ। খোকার বেশ দয়া আছে। নিষ্ঠুরতা নিবারণ করিতেও এই নীতি প্রয়োগ করিতে হইবে। লক্ষ্য রাখিবেন কখনো ইহার সূচনা দেখিতে পান কিনা; নির্দয়তার ভাব বাড়িতে না দিয়া অঙ্কুরে ইহা নিবারণ করিতে হইবে।

সকল রকম চেষ্টা সত্ত্বেও যদি বয়স বাড়িলে শিশুর নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়, তবে রোগের মতো ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে। হাম বা অন্য কোনও প্রকার রোগ হইলে শিশুকে যেমন অপ্রীতিকর অবস্থা ভোগ করিতে হয়, এক্ষেত্রেও তেমনি ভোগ করিতে হইবে; শিশু যে অপরাধী এবং দুষ্ট হইয়াছে, এমন ভাব তাহার মনে জন্মাইবার প্রয়োজন নাই। কিছু সময়ের জন্য তাহাকে অন্যান্য বালক-বালিকা এবং প্রাণীর নিকট হইতে পৃথক করিয়া রাখিতে হইবে; তাহাকে বুঝাইতে হইবে যে, অপরের সঙ্গে তাহাকে মিশিতে দেওয়া নিরাপদ নয়। তাহার প্রতি অন্যে নির্দয় ব্যবহার করিলে তাহার কি দশা হইত তাহাও শিশুকে যথা সম্ভব বুঝান উচিত। তাহাকে ইহা উপলব্ধি করাইতে হইবে যে, নির্দয়তার আবেগ তাঁহার দুর্ভাগ্যের সূচনা করিতেছে এবং তাহার বয়োজ্যেষ্ঠরা তাহাকে ভবিষ্যতে ইহা হইতে রক্ষার চেষ্টাই করিতেছেন। আমার বিশ্বাস, অল্প কিছু মনোরোগ বিশিষ্ট শিশু ছাড়া অন্য সকলের পক্ষেই এ প্রণালী সুফল প্রদান করিবে।

দৈহিক শাস্তির কুফল : দৈহিক শাস্তিদানকে আমি কখনোই যুক্তিযুক্ত বলিয়া বিশ্বাস করি না, তবে মৃদু আকারে দিলে ইহা বিশেষ ক্ষতি করে না, যদিও ভালও কিছু করে না, কঠোর আকারে দিলে ইহা নির্দয়তা সৃষ্টি করে। ইহা সত্য যে, শাস্তিদাতার প্রতি অনেক সময় শিশুর ক্রোধের উদ্রেক হয় না। যেখানে শিশুকে প্রায়ই শাস্তিভোগ করিতে হয়, সেখানে সে ইহাকে স্বাভাবিক মনে করে এবং নিজেকে ইহার সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া নেয়। কিন্তু ইহা তাহার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে যে, কর্তৃত্ব বজায় রাখিবার জন্য এইরূপ দৈহিক শাস্তি প্রদান করা ন্যায়সঙ্গত। যে শিশু বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইয়া কর্তৃত্ব করিবে, তাহার পক্ষে এ শিক্ষা বিপজ্জনক।

তাহা ছাড়া পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যে খোলাখুলি সরল বিশ্বাসের সম্বন্ধ থাকা উচিত শাস্তির কঠোরতা তাহা নষ্ট করিয়া দেয়। আধুনিক পিতা চান তাহার পুত্রকন্যা তাহার উপস্থিতিতে নিঃসংকোচে অবস্থান করুক; তাঁহাকে আসিতে দেখিলে তাহারা যেন খুশি হয়–তিনি ইহা চান। তিনি যতক্ষণ উপস্থিত আছেন ততক্ষণ সবাই মিথ্যা ভয়ে সংকোচে (কাচুমাচু হইয়া) চুপচাপ থাকিবে আর আড়ালে যাইলেই নরকের তাণ্ডব শুরু করিবে ইহা পিতার নিকট বাঞ্ছনীয় নয়। শিশুদের অকৃত্রিম প্রীতি লাভ করা জীবনের যে কোনো বড় আনন্দ লাভের মতই লোভনীয়। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এই আনন্দ কি জানিতেন না, কাজেই তাহারা কি হারাইতেছিলেন তাহাও বুঝিতেন না। তাঁহারা সন্তানদিগকে শিক্ষা দিতেন যে, পিতামাতাকে ভালোবাসা তাহাদের কর্তব্য কিন্তু কার্যত এই কর্তব্য পালন করা এক রকম অসম্ভব করিয়া তুলিতেন। এই অধ্যায়ের প্রথমে কবিতায় যে-মেয়েটির কথা উল্লেখ করা হইয়াছে তাহার পিতা যখন বেত্রাঘাতে তাহাকে দমন করিতে আসিতেন, তখন সে নিশ্চয়ই খুশি হইত না। যতদিন পর্যন্ত লোকে বিশ্বাস করিত যে হুকুম করিয়া ভালবাসা আদায় করা সম্ভব, ততদিন তাহারা শিশুদিগের অকৃত্রিম প্রক্ষোভ [Emotion] হিসাবে স্নেহ প্রীতি লাভ করিতে চেষ্টা করে নাই। ইহার ফলে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ ছিল কঠোর রূঢ় ও নির্দয়। শিশুর শাস্তিবিধান এই সমগ্র মনোভাবের সঙ্গে সংযুক্ত এবং এই মনোভাব দ্বারাই পুষ্ট। ইহাই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, যে সকল লোক কোনো স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে হাত তোলার কথা কল্পনাও করিতে পারিত না, তাহারাই অসহায় অরক্ষিত শিশুর উপর দৈহিক নির্যাতন করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হইত না। সৌভাগ্যের কথা এই যে, গত একশত বৎসরের মধ্যে পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রীতির সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিয়াছে এবং ইহারই ফলে শাস্তির নীতিই আগাগোড়া পাল্টাইয়া গিয়াছে! আমি আশা করি, শিক্ষাক্ষেত্রে যে উন্নতির ভাবধারার প্রবর্তন হইয়াছে তাহা ক্রমে মানুষের অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও প্রসারিত হইবে, কারণ আমাদের শিশুদের সহিত ব্যবহারে যেমন, অন্যত্রও তেমনি উহার বিশেষ প্রয়োজন আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *