০৬. সৃজন কার্য

ষষ্ঠ অধ্যায় সৃজন কার্য

খেলার আলোচনা প্রসঙ্গে এ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে উল্লিখিত হইয়াছে। এখন কিঞ্চিৎ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইবে।

আমরা দেখিয়াছি, শিশুদের প্রবৃত্তিজাত বাসনাগুলি প্রথমে কোনো নির্দিষ্ট আকারে থাকে না; শিক্ষা এবং সুযোগ তাহাদিগকে বিভিন্ন আকার দিয়া বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। আদি পাপ সম্বন্ধে পুরাতন ধারণা কিংবা স্বভাবতই শিশু নিষ্পাপ এবং সকল গুণের আধার বলিয়া রুশোর বিশ্বাস ইহার কোনোটাই সত্য নয়। কিতক লোকের ধারণা ছিল, শিশু মানুষের পাপ হইতে জাত, তাহার ভিতরেও পাপের বীজ রহিয়াছে এবং কালক্রমে তাহা বিকাশ লাভ করিবে; পাপ হইতে জাত তাহা কখনোই আপনা আপনি ভালো হইতে পারে না। রুশো ঠিক ইহার বিপরীত বিশ্বাস প্রচার করিয়াছেন। তাহার মতে শিশু নিষ্কলুষ এবং সকল গুণের সম্ভাবনা তাহার মধ্যে সুপ্ত রহিয়াছে।] কাঁচামালের মতো শিশুর প্রবৃত্তি নিরপেক্ষ থাকে; পরিবেশের প্রভাবে ইহা ভালো বা মন্দ আকার গ্রহণ করে। এরূপ বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে কতকগুলি অস্বাভাবিক ক্ষেত্র ছাড়া অধিকাংশ লোকের প্রবৃত্তিগুলি এমন থাকে যে তাহাদিগকে ভালোর দিকেই বিকশিত করা যায়; শিশুর অল্প বয়স হইতেই যদি তাহার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন লওয়া যায় তবে মনোরোগীর সংখ্যা খুব অল্পই হইবে। উপযুক্ত শিক্ষার ফলে মানুষ তাহার প্রবৃত্তি অনুসারে আচরণ করিয়া জীবনধারণ করিতে পারে; প্রবৃত্তি হইতে শিশু অমার্জিত নির্দিষ্ট আকারবিহীন, উদ্দাম প্রবৃত্তি লাভ করে। শিক্ষার ফলে ইহাই হয় সুসংযত, সুষ্ঠুভাবে বিকশিত। আদিম ও অসংস্কৃত প্রবৃত্তি দ্বারা নয়, উপযুক্ত শিক্ষার ফলে মানুষের প্রবৃত্তি যখন সুনিয়ন্ত্রিত হয় তখনই ইহা দ্বারা পরিচালিত হইয়া সে ভাবে জীবনযাপন করিতে পারে। কোনো বিষয়ে দক্ষতা বা কৌশল মানুষের প্রবৃত্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে বিকশিত করার একটি প্রধান উপায়, এই কৌশল কোনো নির্দিষ্ট প্রকারের তৃপ্তি দান করে; মানুষকে কোনো যথাযথ রকমের কৌশল শিখাইলে কিংবা কোনো প্রকার কৌশলই না শিখাইলে সে হইবে পাপী। শিশুর প্রবৃত্তিগুলিকে প্রথম অবস্থায় মনে করা যায় কাঁচামালের মতো। শিল্পী যেমন কাঁচামালকে তাহার সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুসারে সুন্দর অথবা অসুন্দর দ্রব্যে পরিণত করে, তেমনই শিশুর প্রবৃত্তিগুলি যেরূপভাবে নিয়ন্ত্রিত ও বিকাশপ্রাপ্ত হয় তাহার উপরই নির্ভর করে শিশু কিরূপ বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইবে।

এই সাধারণ নিয়ম শিশুর ক্ষমতা অর্জনের বাসনার প্রতি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আমরা কোনো কিছু করিতে চাই; এইরূপ কাজের ভিতর দিয়া ক্ষমতার প্রকাশ দেখানই উদ্দেশ্য। কি ধরনের কাজের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রকাশ করা হইবে সে সম্বন্ধে প্রথমে কোনো লক্ষ্য থাকে না। মোটামুটিভাবেই বলা যায়, কাজ যত কঠিন হইবে ইহা সম্পন্ন করার আনন্দও তত বেশি হইবে। মানুষ পাখির মতো ডানা মেলিয়া উড়িতে চায়, কারণ ইহা কঠিন কাজ; শিকারি উপবিষ্ট পাখিকে গুলি করিয়া মারিতে বিশেষ আনন্দ পায় না। কেননা ইহা সহজ কাজ। উদাহরণস্বরূপ ইহাদের কথা উল্লেখ করা হইল। আকাশে ওড়া বা গুলি করিয়া পাখি মারা কাজ সম্পন্ন করিতে যে পদ্ধতি কঠিন বা অসাধারণ তাহাই বেশি আনন্দ দেয়। অন্যত্রও এই নীতি প্রয়োগ করা চলে। জ্যামিতি শেখার আগে পর্যন্ত আমি গণিত পছন্দ করিতাম, বিশ্লেষণমূলক [Analytical Geometry] জ্যামিতি শেখার পূর্বে পর্যন্ত জ্যামিতি ভালো লাগিত। এইভাবে একটি আয়ত্ত করার পর কঠিনটির দিকে ক্রমশ ঔৎসুক্য অগ্রসর হইতে থাকে। শিশু প্রথমে হাঁটিতেই আনন্দ পায়, পরে দৌড়াইতে, তাহার পর লাফাইতে এবং কোনো কিছু বাহিয়া উপরে উঠিতে সে ভালোবাসে। যাহা আমরা সহজে করিতে পারি তাহার মধ্যে আর শক্তির প্রকাশ অনুভব করি না। নূতন কৌশল অথবা যাহা আয়ত্ত করা সম্ভব হইবে কি না সন্দেহ আছে তাহা আয়ত্ত করিতে পারিলে কৃতকার্য হওয়ার তীব্র আনন্দানুভূতি লাভ হয়। কাজেই দেখা যায় ক্ষমতা লাভের বাসনাকে যে-কোনো প্রকার কৌশল আয়ত্ত করার সঙ্গেই খাপ খাওয়াইয়া লওয়া চলে।

কোনো কিছু সৃষ্টি করা এবং কোনো কিছু ভাঙিয়া ফেলা উভয়ই ক্ষমতা প্রকাশের বাসনাকে তৃপ্ত করে কিন্তু ভাঙিয়া ফেলার তুলনায় সৃষ্টি করা কঠিনতর। কাজেই ধ্বংস করা অপেক্ষা সৃষ্টিতে আনন্দ বেশি। সৃজন বা ধ্বংস বলিতে কি বুঝায় তাহার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করিব না।

মনোবিজ্ঞানের কথায় বলা যায় আমরা যখন পূর্বপরিকল্পিত গড়ন অনুযায়ী কিছু তৈয়ার করি তখনই সৃষ্টি করি; নূতন কোনো আকার দিবার পরিকল্পনা না রাখিয়া আমরা যখন কোনও বর্তমান জিনিসের পরিবর্তন সাধন করি তখনই ধ্বংস করা হইল। এ ব্যাখ্যার সম্বন্ধে যাহাই মনে করা হউক না কেন কোনো কাজ গঠনমূলক কি না কার্যক্ষেত্রে তাহা আমরা সকলেই বুঝিতে পারি। তবে ইহারও ব্যতিক্রম আছে; কোনো লোক যখন বলে যে নূতন সৃষ্টির জন্যই সে ধ্বংস করিতেছে তখন তাহার আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকিলে তাহার কাজ সৃষ্টিকার্য কি ধ্বংসকার্য তাহা নির্ণয় করা সত্যই কঠিন।

সৃষ্টি অপেক্ষা ধ্বংস করা সহজ; এ জন্য ধ্বংস করা অর্থাৎ কোনো কিছু ভাঙিয়া ফেলা হইতে শিশুর সূত্রপাত হয়। বালির মধ্যে খেলা করিবার সময় শিশুরা চায় বয়স্ক ব্যক্তিরা কেহ বাটি দিয়া ছোট ছোট পিঠার মতো টিবি তৈয়ার করিয়াদিক; তারপর তাহারা সেইগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে আনন্দ পায়। কিন্তু যখন তাহারা নিজেরা এইরূপ তৈয়ার করিতে শেখে তখন ইহা প্রস্তুত করিতেই তাহাদের আনন্দ; তখন তাহারা কাহাকেও সেইগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে দিতে চায় না। শিশুরা যখন প্রথম ইট লইয়া খেলা করে তখন তাহারা তাহাদের অপেক্ষা বয়সে বড় সঙ্গীদের নির্মিত ইটের খেলার ঘরবাড়ি ভাঙিয়া ফেলিতে ভালোবাসে। কিন্তু তাহারা নিজেরা ইট দিয়া কোনো কিছু তৈয়ার করিতে পারিলে নিজেদের কাজের জন্য রীতিমত গর্ব বোধ করে এবং কেহ যে তাহাদের সাধের সৌধ ভাঙিয়া দিবে তাহা তাহারা সহ্য করিতে পারে না। যে আবেগের ফলে শিশু এই খেলার আনন্দ পায় তাহা ভাঙা এবং গড়া উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিদ্যমান আছে। নূতন কৌশল কেবল খেলার আবেগ পরিতৃপ্ত করার পরিবর্তন আনিয়াছে। ভাঙিতে শিশুর যেইরূপ, গড়িতেও সেইরূপ আনন্দ। গড়িবার কৌশল শিক্ষার পর শিশু ভাঙা অপেক্ষা গড়াই বেশি পছন্দ করে। দেখা যায় যে শিশু পূর্বে কেবল ভাঙিয়া ফেলিয়াই আনন্দ পাইত, সেই পরে গড়িতেই বেশি আনন্দ পাইতেছে।

শিশু যেমন প্রথম সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করে তখন তাহার মধ্যে অনেকগুলি গুণের বিকাশ ঘটানো যায়। শিশু যখন তাহার নিজের তৈরি জিনিস নষ্ট না করিতে অনুরোধ করে তখন তাহাকে সহজেই বুঝাইতে পারেন যে, সে নিজেও যেন অন্যের কোনো জিনিস নষ্ট না করে। এইভাবে আপনি শিশুর মনে অপরের পরিশ্রম দ্বারা উৎপাদিত জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিতে পারেন। পরিশ্রমই ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের পক্ষে সমাজের দিক হইতে একমাত্র নির্দোষ উপায়। সৃজন কার্যের উৎসাহ দান করিতে আপনি শিশুর ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ দিন; এ গুণগুলি ছাড়া সে যতখানি উঁচু চুড়া তৈয়ার করিতে চায় ততখানি পারিবে না। শিশুদের সঙ্গে খেলায় যোগদান করিয়া আপনি এমনভাবে কোনো কিছু তৈয়ার করুন যাহাতে তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়; আপনি কেবল দেখাইয়া দিন কিভাবে তৈয়ার করিতে হয়, তারপর শিশুদের উপরই তৈয়ার করিবার ভার ছাড়িয়া দিন।

শিশুকে বাগানে প্রবেশ করিতে দিলে তাহার সৃষ্টির বাসনাকে নূতন আকারে ভালোভাবে বর্ধিত করা যায়। বাগানে ঢুকিলেই সুন্দর আকর্ষণীয় ফুলগুলি তোলাই হইবে তাহার প্রথম আবেগ। নিষেধ করিয়া তাহাকে নিবৃত্ত করা যায় কিন্তু শিক্ষা হিসাবে শুধু নিষেধই যথেষ্ট নয়, যে শ্রদ্ধাযুক্ত মনোভাবের ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা বাগানের ফুল যথেচ্ছভাবে নষ্ট করে না, সেইরূপ মনোভাব শিশুর মধ্যেও জাগাইয়া তুলিতে হইবে। সুন্দর এবং নয়নানন্দদায়ক কিছু তৈয়ার করিতে কি পরিমাণ পরিশ্রম ও চেষ্টার দরকার তাহা উপলব্ধি করিতে পারে বলিয়াই বয়স্ক ব্যক্তিদের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগে। শিশুর বয়স যখন তিন বৎসর হইবে তখনই তাহাকে বাগানের মধ্যে এক কোণে কিছুটা জায়গায় ফুলগাছের চারা লাগাইতে উৎসাহিত করা যায়। গাছগুলি বড় হইয়া ফুল ফুটিলে তখন সেইগুলি তাহার কাছে অপূর্ব এবং মহামূল্যবান বলিয়া মনে হইবে। তাহার ফুল কেহ নষ্ট করুক ইহা যেমন সে চাহিবে না, তেমনই সে বুঝিতে পারিবে যে তাহার মায়ের ফুলগুলির প্রতিও অনুরূপ যত্ন লওয়া উচিত।

গঠনমূলক কাজ ও জীবন্ত প্রাণীর প্রতি প্রীতি এবং অনুরাগ বৃদ্ধি করিয়া শিশুর নিষ্ঠুরতা দূর করা যায়। প্রায় সকল শিশুই একটু বড় হইলেই মাছি এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গ মারিতে চায়। এই অভ্যাস ক্রমে বড় প্রাণী এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ হত্যা করার অভিলাষ জন্মায়। ইংল্যান্ডে সাধারণ সম্ভ্রান্ত পরিবারে পাখি হত্যা করা বিশেষ প্রশংসনীয় কাজ বলিয়া পরিগণিত; যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ হত্যা তো তাহাদের নিকট একটি মহান কাজ। এই সকল কাজ অসংস্কৃত প্রবৃত্তির প্রেরণাসঞ্জাত। যে সকল লোক কোনো প্রকার গঠনমূলক কৌশল জানে না এবং যাহারা ক্ষমতা প্রকাশের বাসনাকে অন্য কোনো নির্দোষ শান্তিপূর্ণ উপায় পূর্ণ করিতে পারে না, তাহারাই নৃশংস আচরণের ভিতর দিয়া ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া থাকে। তাহারা সুন্দর পাখি হত্যা করিতে পারে, রায়ত প্রজাদিগের উপর অত্যাচার করিতে পারে; প্রয়োজন হইলে তাহারা একটি গণ্ডার অথবা একজন জার্মানকে বিনা দ্বিধায় গুলি করিয়া মারিতে পারে। কিন্তু তাহাদের পিতামাতা ও শিক্ষকগণ শিক্ষা দিয়া তাহাদিগকে শুধু ইংরেজ ভদ্রলোকে পরিণত করিয়াছেন; অন্যান্য অধিকতর প্রয়োজনীয় শিল্পকাজে তাহারা সম্পূর্ণ অপারগ। আমি বিশ্বাস করি না যে জন্মের সময় তাহারা অন্যান্য শিশু অপেক্ষা অধিকতর মূর্খ ছিল; পরবর্তীকালে তাহাদের চরিত্রের ত্রুটিগুলির জন্য একমাত্র কুশিক্ষাই দায়ী। যদি বাল্যকাল হইতে তাহারা প্রাণী পুষিয়া যত্নের সঙ্গে তাহাদের বৃদ্ধি লক্ষ করিত এবং জীবনের মূল্য উপলব্ধি করিত, যদি তাহারা সৃজন কৌশল আয়ত্ত করিত, যদি তাহারা বুঝিত যে কোনো ভালো জিনিস তৈয়ার করিতে কত যত্ন পরিশ্রম এবং অনুরাগ দরকার কিন্তু নষ্ট করা যায় এক মুহূর্তেই, তবে অন্যের উৎপাদিত বা লালিতপালিত কোনো কিছু অনায়াসে ধ্বংস করিতে উদ্যোগী হইত না। যদি অপত্যস্নেহ জাগ্রত হয় পিতৃত্ব এ বিষয়ে বড় শিক্ষকের কাজ করে। [পিতৃ-হৃদয়ে সন্তানের প্রতি স্নেহ সঞ্চার হইলে তাহা মানুষের মন কোমল এবং অপরের সন্তানের প্রতি মমতাশীল করে। অপত্যস্নেহ মানুষের হৃদয়ের কঠোরতা দূর করিয়া করুণা ও ক্ষমা গুণে তাহাকে মহত্তর করে। কিন্তু ধনীদের মধ্যে কদাচিৎ এইরূপ ঘটে কেননা সন্তানের লালন পালনের ভার তাহারা বেতনভূক পরিচারিকাদের হস্তে ছাড়িয়া দেয়। সন্তানকে নিজেদের স্নেহরসে পুষ্ট করিবার বা সন্তানের প্রতি বাৎসল্য-প্রীতি জাগ্রত করার ও প্রয়োগ করার তাহাদের অবসর কোথায়? কাজেই এইরূপ পরিবারের শিশুরা পিতৃত্বে উপনীত হওয়ার পরও যে ধ্বংসমনোবৃত্তি পরিত্যাগ করিবে সেইরূপ আশা নাই। বাল্যকাল হইতেই জীবনের মূল্যবোধ এবং জীবনের প্রতি দরদ সঞ্চার করিয়া শিশুর মন হইতে নিষ্ঠুরতা দূর করিতে হইবে।

যে লেখকের বাড়িতে অশিক্ষিতা পরিচারিকা আছে তিনিই জানেন লেখার পাণ্ডুলিপি দিয়া আগুন জ্বালাইতে ইহারা কেমন উৎসাহী এবং তাহাদিগকে এইকাজ হইতে নিবৃত্ত করা কত কঠিন। এই লেখক যদি অন্য লেখকের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হন তবু তিনি এইরূপ কাজ করিবেন না, কেননা পাণ্ডুলিপির মূল্য তিনি জানেন। তেমনই যে বালকের নিজের বাগান আছে সে অন্যের ফুলের চারাগুলি মাড়াইবে না, যে বালক কোনো পশুপক্ষি পোষে তাহাকে জীবজন্তুর প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে শিখানো যায়। নিজের সন্তানের প্রতি যাহার প্রীতি আছে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিও তাহার দরদ থাকা স্বাভাবিক। যাহাদিগকে সন্তান লালনপালন করিতে প্রত্যক্ষভাবে ঝামেলা পোহাইতে হয়, তাহাদের মধ্যে অপত্যস্নেহ প্রবল আকারে প্রকাশ পায়; যাহারা এই ঝামেলা এড়াইয়া চলে, তাহাদের অপত্যস্নেহ অসাড় হইয়া পড়ে এবং শুধু সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধে পর্যবসিত হয়। বাল্যাবস্থায় শিশুদের গঠনমূলক আবেগ অথবা সৃজন মনোবৃত্তির বিকাশ সাধিত হইলে তাহারা যখন পিতামাতাতে পরিণত হয় তখন তাহারাও সযত্নে সন্তানকে গড়িয়া তোলার চেস্টা করে। এইজন্যও শিশুর চরিত্রের এই দিকটিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক।

সৃজন কার্য বলিতে কেবল বস্তুগত কোনো জিনিস তৈয়ার করার কথাই বুঝাইতেছি না। অভিনয় এবং সমবেত-সংগীত ও সহযোগিতামূলক সৃজনকার্য, যদিও দৃশ্যত বস্তুর সাহায্যে কোনো কিছু প্রস্তুত করা হইল না। এইরূপ কাজ অনেক বালক-বালিকার পক্ষে আনন্দদায়ক। এইরূপ প্রীতিপ্রদ সৃজনকার্যে তাহাদিগকে উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য কিন্তু জোর-জবরদস্তি করিবার প্রয়োজন নাই। যে-কাজে নিছক বুদ্ধিবৃত্তিই প্রধান সেইখানেও সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব থাকিতে পারে। প্রাচীন সাহিত্য-শিক্ষাকে একরকম দোষাগ্রাহী (Critical] বলা চলে। ছাত্র ভুল না করিতে এবং যাহারা ভুল করে তাহাদিগকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা করে। ইহার ফলে নিজেদের শিক্ষণীয় বিষয়টুকু শুদ্ধভাবে শিখিবার ঝোঁক আসে এবং নূতনত্বের পরিবর্তে প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব বৃদ্ধি পায়। বিশুদ্ধ ল্যাটিন ভাষা একেবারেই স্থির হইয়া গিয়াছে–ভার্জিল এবং সিসরোর সাহিত্যই ইহার নিদর্শন; কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতি চিরদিনের মতো স্থির ও রুদ্ধ হইয়া যায় নাই। ইহা প্রতিনিয়তই আগাইয়া চলিয়াছে। যে কোনো সমর্থ যুবক ইহার অগ্রগতিতে সাহায্য করিতে পারে। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে যে মনোভাব গড়িয়া ওঠে তাহা মৃত ভাষা শিক্ষার ফলে উদ্ভূত মনোভাব হইতে বেশি গঠনমূলক। কেবল ভুল না করাই যেখানে শিক্ষার প্রধান কাম্য-লক্ষ্য সেখানে শিক্ষার মধ্যে সজীবতা থাকে না। সকল সুস্থ সবল কিশোর-কিশোরীকে নূতন উদ্যম প্রয়োগ করিয়া নূতন কিছু করিতে অনুপ্রাণিত করা উচিত; শুধু ভুল বাঁচাইয়া কোনরকমে গতানুগতিক পন্থায় চলার মধ্যে প্রাণের গতিবেগ ও নবসৃষ্টির উন্মাদনা নাই। প্রায় মনে করা হয় যে, উচ্চশিক্ষা মানুষকে ভদ্র আচরণ শিখায় মাত্র; যাহাতে সে। ব্যাকরণগত কোনো গুরুতর ভুল না করে সে সম্বন্ধে নেতিবাচক শিক্ষা দেয় মাত্র। এইরূপ শিক্ষায় গঠনকার্য বা সৃজন-প্রচেষ্টা উপেক্ষিত হইয়াছে। ইহার ফলে সৃষ্ট হয় সংকীর্ণচেতা, কর্মপ্রচেষ্টাবিমুখ এবং অনুদার লোক। কোনো কিছু গঠন করা এবং সৃষ্টি করাকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করা হয় তবে এইরূপ কুফলের হাত হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইতে পারে।

শিক্ষার শেষ কয়েক বৎসরে সামাজিক গঠনের জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণা দিতে হইবে। অর্থাৎ সমাজের বর্তমান শক্তিগুলিকে [Forces] অধিকতর ফলপ্রদভাবে প্রয়োগ করিতে কিংবা নূতন শক্তি সৃষ্টি করিতে বুদ্ধিমান যুবকদিগকে উৎসাহ দিতে হইবে। লোক প্লেটোর রিপাবলিক [Republic] পুস্তক পাঠ করে কিন্তু তাহারা বর্তমান রাজনীতিতে কোথাও তাহার নীতি প্রয়োগ করে না। আমি যখন বলিয়াছিলাম যে প্লেটোর রিপাবলিকের যাহা আদর্শ প্রায় ঠিক সেই আদর্শ ছিল ১৯২০ সনে রুশ রাষ্ট্রের, তখন প্লেটোর সমর্থকগণ কিংবা বলশেভিকগণ কোন দল যে বেশি বিস্মিত হইয়াছিল তাহা বলা শক্ত। লোকে যখন প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করে তখন চিন্তা করিয়া দেখে না তখনকার অবস্থা রাম, শ্যাম, যদুর জীবনে কতখানি প্রযোজ্য কোনো লেখক যখন রামরাজ্যের চিত্র পাঠকের সম্মুখে তুলিয়া ধরে তখন সে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে; কেননা বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা হইতে রামরাজ্যে উপনীত হইবার কোনো পথের হদিশ সেরূপ পুস্তকে থাকে না। সমাজ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য কি পন্থা অবলম্বন করা দরকার তাহা বিচারবুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ উদারনীতিকদের এই গুণ ছিল, যদিও তাঁহাদের কাজের শেষ পরিণতি দেখিলে তাহারা স্তম্ভিতই হইতেন।

.

সমাজ-ব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা

ছাঁচ :

মানুষ যখন কিছু গঠন করিতে বা পুরাতনের সংস্কার সাধন করিতে চায় তখন তাহার কাম্য বিষয়ের যে আকৃতি বা রূপ তাহার মনের পটে স্পষ্টভাবে অঙ্কিত থাকে তাহা অনেক সময় অজ্ঞাতসারে তাহার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যাহা আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করেন অনেক দিনের মনন, কল্পনা, অনুরাগ, যুক্তি ও অনুভূতির রঙে রঞ্জিত হওয়ায় তাহা তাঁহাদের মনে স্পষ্ট আকার লাভ করে। তাহারে মনে যে আদর্শ বিশেষ করিয়া আকার গ্রহণ করিয়াছে। পরিকল্পনার সাহায্যে তাহারই বাস্তবরূপ তাহারা সমাজে গড়িয়া তুলিতে চান। সমাজ-ব্যবস্থা গঠনের প্রণালী অনেকভাবে চিন্তা করা যায় এবং সাধারণত ইহাকে তুলনা করা যায় ছাঁচ যন্ত্র এবং গাছের সঙ্গে। ছাঁচে ঢালা সমাজ-ব্যবস্থা বলিতে এমন সমাজ বোঝায় যেখানে কঠোর সামাজিক নিয়মকানুন অচলায়তনের মতো দেশের বুকে চাপিয়া আছে, যেমন ছিল প্রাচীন স্পার্টায় এবং চীনদেশে, যেখানে সমাজবিধি এবং সংস্কারের ছাঁচে ঢালিয়া সকল মানুষকে একই মানসিক আকার দিবার চেষ্টা করা হইত। কঠোর নৈতিক ও সামাজিক রাজনীতির মধ্যে এই ধারণা কিছুটা বিদ্যমান রহিয়াছে। এইরূপ ছাঁচে ঢালা সমাজ-ব্যবস্থা যাহার আদর্শ, তাহার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হয় শক্ত, অনমিত, কঠোর এবং অত্যাচারী।

যন্ত্র :

যে ব্যক্তি সমাজকে একটি যন্ত্র বলিয়া মনে করে তাহাকে অনেকটা আধুনিক বলা চলে। শিল্পপতি এবং কমিউনিস্ট এই শ্রেণিতে পড়ে। তাহাদের নিকট মানব স্বভাব নীরস এবং আকর্ষণবিহীন; মানবজীবনের উদ্দেশ্যও অতি সরল বলিয়া বোধ হয়। তাহারা মনে করে দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধিই মানুষের একমাত্র কাম্য। এই সহজ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করাই তাহাদের সমাজ সংগঠনের লক্ষ্য। কিন্তু অসুবিধা হইল এই যে, সংগঠকগণ যাহা সাধারণ মানুষের বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করেন লোকে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি জিনিস পাওয়ার কামনা করে। সংগঠকগণ পরিকল্পনা করিয়া নির্ধারণ করেন। কি কি জিনিস পাইলেই মানুষের সন্তুষ্ট থাকা উচিত; তাহাদের পরিকল্পনা মতো দ্রব্যের উৎপাদন বাড়াইয়া লোকের অভাব পূরণ করা এবং সকলকে সুখি করাই ইহাদের উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষের বাসনার অন্ত নাই। নূতন সমাজ সংগঠকের তালিকাভুক্ত জিনিস পাইয়া লোকে সন্তুষ্ট হয় না। ইহার ফলে সংগঠককে বাধ্য হইয়া এমন ছাঁচে ঢালা সমাজ গড়িতে চেষ্টা করিতে হয় যেখানে সকলেই তাঁহার আদর্শকে মানিয়া লইয়া তিনি যাহা ভালো মনে করেন তাহাই সানন্দে গ্রহণ করিবে। এই প্রচেষ্টাকে বলা যায় সোজা খাপে বাঁকা তলোয়ার ভরার কসরৎ। ইহা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি করে এবং অবশেষে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করে।

বৃক্ষ :

সমাজ-ব্যবস্থাকে যিনি একটি বৃক্ষের মতো মনে করেন তাঁহার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যের সঙ্গে পার্থক্য থাকে। একটি খারাপ যন্ত্র ভাঙিয়া ফেলিয়া তাহার পরিবর্তে নূতন যন্ত্র স্থাপন করা যায়। কিন্তু একটি গাছ কাটিয়া ফেলিলে সেইরূপ আকার ও শক্তিসম্পন্ন একটি নূতন গাছ জন্মিতে অনেক সময় লাগিবে; যন্ত্র বা ছাঁচ নির্মাতার ইচ্ছামতো তৈয়ার করা যায় কিন্তু বৃক্ষের নিজস্ব স্বভাব আছে। যত্ন পরিচর্যায় সেই নির্দিষ্ট স্বভাবই বিকশিত হইয়া ওঠে। যে-জাতীয় গাছ তাহার বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিয়া ইহাদের বৃদ্ধি কম বেশি করা যায় এইমাত্র; এক জাতীয় গাছকে অন্য জাতীয় গাছে পরিণত করা যায় না। জীবন্ত জিনিস গড়িয়া তোলা আর যন্ত্র তৈয়ার করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। জীবন্ত জিনিস গড়িতে কৌশলের প্রয়োজন বেশি নয়; ইহার জন্য এক প্রকার সহানুভূতির প্রয়োজন। এইজন্য শিশুদিগকে গঠন-কার্য শিক্ষা দিবার সময় কেবল ইট, কাঠ ও যন্ত্রের উপর তাহাদের গঠন-ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে শিখাইলেই চলিবে না, তাজা গাছ, পোষা পশু-পক্ষীর প্রতি যত্ন ও সমবেদনার মনোভাবও গড়িয়া তুলিতে হইবে। নিউটনের সময় হইতে জড়বিজ্ঞান মানুষের মন অধিকার করিয়াছিল, শিল্প বিপ্লবের সময় হইতে ইহার বাস্তব প্রয়োগ চলিতেছে। যন্ত্রশিল্পের উন্নতি ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রতিও যন্ত্রসুলভ মনোভাব ক্রমে বৃদ্ধি পাইয়াছে। জীবের ক্রমবিবর্তনবাদ কতকগুলি নূতন ভাবধারার প্রবর্তন করিয়াছিল কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে এইগুলি কতকটা ম্লান হইয়া পড়ে; সুপ্রজনন, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষা দ্বারা ইহার বিলোপ সাধন করা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সমাজকে বৃক্ষরূপে কল্পনা করা ছাঁচ কিংবা যন্ত্ররূপে কল্পনা করার চেয়ে ভালো কিন্তু ইহাও দোষমুক্ত নয়। মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে লইয়া এই দোষ-ক্রটি দূর করিতে হইবে।

মনোবিজ্ঞানমূলক সংগঠন :

মনোবিজ্ঞানমূলক গঠন (Psychological Constructiveness] নূতন এবং সম্পূর্ণ অভিনব ধরনের। এ পর্যন্ত ইহার বৈশিষ্ট্য এবং উপকারিতা লোকে উপলব্ধি করিতে পারে নাই। শিক্ষাপ্রণালী, রাজনীতি ও সকল মানবীয় ব্যাপারে ইহার একান্ত প্রয়োজন এবং নাগরিক যাহাতে মিথ্যা সাদৃশ্য দেখিয়া বিভ্রান্ত না হয় সেইজন্য তাহাদের কল্পনাক্ষেত্রে ইহাকে একটি বিশেষ স্থান দিতে হইবে। কতক লোক মানুষের ব্যাপারে কোনও কিছু গঠন করিতে ভয় পান; তাহাদের আশঙ্কা আছে তাহাদের মানুষকে প্রাণহীন যন্ত্রে পরিণত করিয়া ফেলেন; মানুষের স্বভাবের উপরই তাঁহারা নির্ভর করেন।

অতএব অরাজকতা এবং তাহার ফলে মানুষের পুনরায় পশুত্বে প্রত্যাবর্তন [Back to nature] ইহার উপরই তাঁহাদের বিশ্বাস। মনোবিজ্ঞানমূলক গঠন ও যন্ত্রের গঠনের মধ্যে কি পার্থক্য তাহা এই পুস্তকে স্কুল উদাহরণ সাহায্যে দেখাইতে চেষ্টা করিতেছি। উচ্চশিক্ষায় এইভাবের কল্পনা-উদ্রেককারী দিকটার সহিত বিদ্যার্থীর পরিচয় ঘটাইতে হইবে। এইরূপ করিতে পারিলে আমার বিশ্বাস এই যে, আমাদের রাজনীতি আর এমন তীব্র ও ধ্বংসমুখি থাকিবে না; ইহার পরিবর্তে রাজনীতি হইবে নমনীয় এবং বিজ্ঞানসম্মত, আর উৎকৃষ্ট নরনারী প্রস্তুত করাই হইবে ইহার উদ্দেশ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *