০১. আধুনিক শিক্ষাতত্ত্ব

প্রথম অধ্যায় আধুনিক শিক্ষাতত্ত্ব

 আগের দিনের লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক রচনা পাঠ করিলেও বোঝা যায় যে বর্তমানের শিক্ষাতত্ত্বের মধ্যে এমন কিছু নূতনত্ব আসিয়াছে যাহা পূর্বেকার প্রামাণিক গ্রন্থের মধ্যেও ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেকার দুইজন বড় শিক্ষা সংস্কারক লক্ [Locke] ও রুশো [Rousseau]। ইহারা উভয়েই খ্যাতির অধিকারী হইয়াছিলেন, কেননা তাহারা তকালে প্রচলিত শিক্ষা-সংক্রান্ত অনেক ভ্রম দূর করিয়াছিলেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদ যতদূর অগ্রসর হইয়াছেন, তাঁহাদের কেহই ততদূর যান নাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাহারা উভয়েই উদারতা ও গণতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিলেন, তথাপি উভয়েই কেবল অভিজাত শিশুর শিক্ষাই বিবেচনা করিয়াছেন। তাঁহাদের পরিকল্পনায় একটি শিশুর শিক্ষার জন্য একজন বয়স্ক ব্যক্তি সর্বক্ষণ নিয়োজিত হইবে। ইহার ফল যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন, আধুনিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কোনো লোকই এ পরিকল্পনা বিবেচনার যোগ্য মনে করিবেন না, কারণ এক-একটি শিশুর জন্য একজন করিয়া সর্বক্ষণস্থায়ী গৃহ-শিক্ষকের ব্যবস্থা করা গাণিতিক দিক দিয়া অসম্ভব। আধুনিক মানুষ নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধার খোঁজ করিতে পারে কিন্তু যে শিক্ষা-ব্যবস্থা সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়, অনন্তপক্ষে যাহাদের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিলে তাহারা উপকৃত হইতে পারে এমন সকলের জন্যও উন্মুক্ত নয়–সে শিক্ষাপ্রণালীকে কেহ শিক্ষা বিস্তার সমস্যার সমাধান করিতে সক্ষম বলিয়া মনে করিবে না। অবশ্য এ কথা আমি বলি না যে, যে সুযোগ-সুবিধা সকলের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয় তাহা সচ্ছল লোকেরাও পরিহার করুক। ইহা করিলে ন্যায়ের কাছে সভ্যতাকে বিসর্জন দিতে হয়। আমি ইহাই বলিতে চাই যে, আমরা ভবিষ্যতের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়িয়া তুলিব যাহা প্রত্যেকটি বালক-বালিকাকে আত্মবিকাশের জন্য পূর্ণ সুযোগ দান করিবে। আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হইতে হইবে, যদিও এ আদর্শ অবস্থা লাভ করা সময় সাপেক্ষ। বর্তমান যুগে এ ব্যবস্থা সকলেই স্বীকার করিবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতেছি। আমি এমন ব্যবস্থাই সমর্থন করিব যাহা সর্বজনীন হইতে পারে, যদিও কেহ ব্যক্তিগতভাবে নিজের সন্তানসন্ততির জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিতে পারিলে আমার আপত্তি করার কোনো হেতু নাই। এইরূপ সঙ্কুচিত গণতান্ত্রিক প্রণালী লক্ ও রুশোর শিক্ষাবিষয়ক রচনাতে নাই। রুশো যদিও আভিজাত্যে বিশ্বাস করিতেন না, তাহার শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে কিন্তু এই বিশ্বাসহীনতার পরিচয় মেলে না।

গণতন্ত্র ও শিক্ষা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। গণতন্ত্র বলিতে যদি ইহাই বুঝায় যে সকলের জন্য একই স্তর সুনির্দিষ্ট থাকিবে, তবে তাহার ফল হইবে মারাত্মক। কতক বালক-বালিকার বুদ্ধি অপরের চেয়ে বেশি এবং তাহারা উচ্চ শিক্ষা হইতে অন্যের তুলনায় অধিকতর সুফল লাভ করিতে পারে। কতক শিক্ষক উৎকৃষ্টতর শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, কাহারও-বা স্বাভাবিক শিক্ষাক্ষমতা অপরের চেয়ে বেশি। কিন্তু সকলের পক্ষেই উত্তম শিক্ষকের নিকট শিক্ষা লাভ করা অসম্ভব। সর্বোচ্চ শিক্ষাও সকলের জন্যই অপপ্রয়োগ করিয়া বলা চলে, যেহেতু উচ্চশিক্ষা লাভ সকলের পক্ষে সম্ভবপর নহে অতএব কাহাকেও ইহা দেওয়া উচিত নয়! এইরূপ নীতি গৃহীত হইলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি রুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং শত বৎসরের জন্য শিক্ষার সাধারণ স্তর নিচে নামিয়া যাইবে। বর্তমান মুহূর্তে Mechanical equality-র বা যান্ত্রিক সমতার জন্য অগ্রগতি ব্যাহত করা উচিত হইবে না। সামাজিক অবিচারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকিলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবান সুফল ও সম্ভাব্যতা যথাসম্ভব কম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকতা আনয়ন করিতে হইবে। অত্যন্ত সতর্কতার সহিত এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।

শিক্ষাব্যবস্থা যদি সর্বজনীন অর্থাৎ সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য না হয়। তবে তাহাকে সন্তোষজনক বলা চলে না। অর্থশালী লোকের ছেলেদের পরিচর্যার জন্য তাহাদের জননী ছাড়া ধাত্রী, পরিচারিকা ও অন্যান্য ভৃত্য থাকিতে পারে। কিন্তু যে কোনো রূপ সমাজব্যবস্থাতেই সকল ছেলেমেয়ের প্রতি এইরূপ যত্ন ও পরিচর্যার বিধান করা অসম্ভব। অতিরিক্ত আদর ও তত্ত্বাবধানের ফলে শিশুকে যে কোনো সামান্য কাজের জন্য পরমুখাপেক্ষী করিলে ইহার ফল ভাল হয় কি না সে বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে। কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি ক্ষীণমনা [Feeble minded] কিংবা অসাধারণ প্রতিভাবান এই দুই শ্রেণির অস্বাভাবিক বালক বালিকা ছাড়া অন্যের জন্য এরূপ পরিচর্যার ব্যবস্থা অনুমোদন করিবেন না। বর্তমান যুগে বিজ্ঞ পিতা তাঁহার ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য সর্বজনীন নয় এমন কোনো শিক্ষণ-পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে অবলম্বন করিতে পারেন। এইরূপ পরীক্ষা সত্যই বাঞ্ছনীয়, তবে ইহা এরূপ হওয়া চাই যাহাতে সে-পদ্ধতি ফলপ্রদ হইলে যেন সকলের জন্য প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয়; ইহা যেন কেবল অল্পসংখ্যক ভাগ্যবানের জন্যই সীমাবদ্ধ না রাখিতে হয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে, বর্তমান যুগের শিক্ষাতত্ত্ব ও প্রণালীর কতক উৎকৃষ্ট উপাদান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হইতে পাওয়া গিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ম্যাডাম মন্তেসরি বস্তি অঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাহার পরীক্ষামূলক কাজ আরম্ভ করিয়াছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ প্রতিভাবান ছাত্রের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করিতেই হইবে কিন্তু যেরূপ শিক্ষা সকল ছাত্রই গ্রহণ করিতে পারে, তাহা হইতে কাহাকেও বঞ্চিত করার কোনো সঙ্গত কারণ থাকিতে পারে না।

আধুনিক শিক্ষার আরও একটি বিতর্কমূলক প্রবণতা আছে; ইহাও গণতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি হইল শিক্ষাকে আলঙ্কারিক করার চেয়ে কার্যকরি করার আন্দোলন। ভেবেলেনের Theory of the Leisure Class পুস্তকে আলঙ্কারিক [Ornamental] শিক্ষার সঙ্গে আভিজাত্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয় সুস্পষ্টভাবে দেখানো হইয়াছে। শিক্ষার উপর এই সম্বন্ধের প্রভাব পড়িয়াছে, শুধু তাহাই আমাদের বিবেচ্য। বালকদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিতর্কের বিষয় হইল প্রাচীন সাহিত্যিক শিক্ষা না আধুনিক কার্যকরি এবং কোনটি গৃহীত হওয়া উচিত? বালিকাদের শিক্ষায় ভদ্রমহিলার আদর্শ এবং বালিকাদিগকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা–এই দুইটির মধ্যে আদর্শগত সংঘর্ষ চলিতেছে। কিন্তু যেখানেই শিক্ষার সঙ্গে বালিকাদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সেখানেই স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সমতা [Sex equal ity] বিধানের চেষ্টা দ্বারা সমগ্র শিক্ষার সমস্যাকে বিকৃত করা হইয়াছে। বালকদিগকে যে শিক্ষা দেওয়া হইতেছে তাহা সন্তোষজনক নয় ইহা বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও বালিকাদিগকেও বালকদের অনুরূপ শিক্ষাদানের চেষ্টা হইতেছে। ফল হইতেছে এই যে, স্ত্রী-শিক্ষাবিদগণ বালকদের শিক্ষার মতো অকেজো শিক্ষাও বালিকাদিগকে দিতে চেষ্টিত এবং বালিকাদের যে মাতৃত্বের জন্য বিশেষ টেকনিক্যাল শিক্ষার দরকার আছে এ ধারণার ঘোরতর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছেন। শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে এইরূপ আন্তঃপ্রবাহী বিপরীতমুখি স্রোত সমস্যাকে জটিলতার করিয়া তুলিয়াছে; তবে একটি শুভ লক্ষণ এই যে দ্রমহিলা তৈয়ারি করা সময়ে স্ত্রী-শিক্ষার যে আদর্শ ছিল তাহা এখন পরিত্যক্ত হইয়াছে। পরস্পরের সঙ্গে জড়াইয়া ফেলিয়া সমস্যাটিকে জটিলতর না করিবার উদ্দেশ্যেই এখন আলোচনা শুধু বালকদের শিক্ষাক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখা হইতেছে।

নানা প্রশ্নসঙ্কুল অনেক বিতর্কমূলক বিষয় বর্তমান প্রশ্নের উপর নির্ভর করিতেছে। বালকেরা কি কেবল প্রাচীন সাহিত্যই অধ্যয়ন করিবে অথবা কেবল বিজ্ঞান অধ্যয়ন করিবে? এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য এই যে, প্রাচীন সাহিত্য আলঙ্কারিক শিক্ষার অঙ্গ এবং বিজ্ঞান প্রয়োজনীয় বিষয়। কোনো ব্যবসা বা বৃত্তি অবলম্বনের জন্য কি যথাশীঘ্র সম্ভব বালককে টেকনিক্যাল শিক্ষা দিতে হইবে? এখানেও প্রয়োজনীয় এবং আলঙ্কারিক শিক্ষার কথা ওঠে। বালকদিগকে কি বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও মনোজ্ঞ আচরণে অভ্যস্ত করিতে হইবে, না এগুলি কেবল আভিজাত্যের চিহ্ন বলিয়া বিবেচিত হইবে? শিল্পী ভিন্ন অন্যের নিকট শিল্পের রসবোধের কোনো মূল্য আছে কি? উচ্চারণ অনুসারে কি ইংরাজি বানান ঠিক করা উচিত? আলঙ্কারিক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্বন্ধে বিতর্কে এইরূপ বহু বিতণ্ডার অবতারণা করা চলে।

তথাপি এই সমগ্র বিতর্কই আমার নিকট অবাস্তব বলিয়া মনে হয়। সংজ্ঞাগুলি নির্ধারণ করিতে গেলেই বিতর্ক হাওয়ায় মিলাইয়া যায়। যদি প্রয়োজনীয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে এবং আলঙ্কারিক শব্দ সংকীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় তবে এক পক্ষ প্রাধান্য লাভ করে, আবার বিপরীতভাবে ব্যাখ্যা করিলে অন্যপক্ষ প্রধান মনে হয়। ব্যাপক এবং প্রকৃত অর্থে একটি কাজ তখনই প্রয়োজনীয় বলা চলে যখন ইহাতে সুফল পাওয়া যায়। এই সুফলগুলি শুধু প্রয়োজনীয় বা কার্যকরি বলিয়াই নয়, অন্যান্য দিক হইতে বিবেচনা করিলেও ভালো বলিয়া বিবেচিত হওয়া চাই। নতুবা ইহার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশ করা যায় না। আমরা এ কথা বলিতে পারি না যে, প্রয়োজনীয় কাজ তাহাকেই বলা চলে যাহার ফল হয় কার্যকরি। কার্যকরি বা প্রয়োজনীয় কাজের সারকথা হইল ইহাই যে, ইহার ফল শুধু কার্যকরিই নয়। শেষ পর্যন্ত কাজের ফল ভাল হইল কি না তাহা জানিবার জন্য পরপর সাজানো কতকগুলি কাজ ও তাহার ফল লক্ষ্য করিতে হইবে। লাঙল প্রয়োজনীয়, কেননা ইহা দ্বারা মাঠ চাষ করা হয়। শুধু মাটি ভাঙার জন্যই চাষ করার কোনো সার্থকতা নাই। ইহা উপকারী এ জন্য যে, ইহার ফলে জমি বীজ বুনিবার যোগ্য হয়। বীজ বপন করা প্রয়োজনীয় কাজ, যেহেতু ইহার ফলে শস্য উৎপন্ন হয়। শস্য প্রয়োজনীয়, কারণ ইহা হইতে প্রস্তুত হয় খাদ্য। খাদ্য প্রয়োজনীয়। কারণ ইহা জীবন রক্ষা করে, কিন্তু জীবনের নিজস্ব মূল্য থাকা উচিত। জীবন যদি কেবল অন্য জীবনের উপায় স্বরূপ হয় তবে ইহাকে মোটেই প্রয়োজনীয় বলা যায় না। অবস্থাভেদে জীবন ভালো এবং মন্দ হইতে পারে; কাজেই ভালো জীবনের উপায়স্বরূপ হইল প্রয়োজনীয় কোন কাজ কি জন্য প্রয়োজনীয় ইহা অনুসরণ করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত একটি স্থানে উপনীত হইতে হয় যেখান হইতে কার্য পরম্পরার সমগ্র শৃঙ্খলটি লম্বিত। প্রয়োজনীয় কথাটিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করিলে শিক্ষা প্রয়োজনীয় মনে করিতে হইবে কি-না সে প্রশ্ন উঠে না। শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজনীয় বিবেচিত হইবে, কেননা শিক্ষাদান ব্যাপারটি কাম্য উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্যলাভের উপায় মাত্র। প্রয়োজনীয় [Useful] বা কার্যকরি শিক্ষার সমর্থকগণ কিন্তু ঠিক এভাবে চিন্তা করিতেছেন না। তাহারা চাহিতেছেন শিক্ষার ফলও কার্যকরি হউক। কথাটিকে স্থূলভাবে প্রকাশ করিলে এইরূপ দাঁড়ায় : তাঁহারা (কার্যকরি শিক্ষার সমর্থকগণ) বলিবেন, যে যন্ত্র তৈরি করিতে পারে সেই শিক্ষিত লোক। যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যন্ত্রের প্রয়োজন কি? উত্তর হইবে ইহা দ্বারা মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এবং দেহের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জিনিসপত্র প্রস্তুত করা যায়–যেমন খাদ্য, বস্ত্র, গৃহ ইত্যাদি। কাজেই দেখা যায় এইরকম কার্যকরি শিক্ষার পক্ষপাতী ব্যক্তি কেবল দেহের সন্তোষ সম্পাদনের উপর মূল্য দেন; যাহা দেহের প্রয়োজন ও অভিলাষ মিটাইতে পারে কেবল তাহাই তাঁহার নিকট প্রয়োজনীয়।

কার্যকরি শিক্ষা বলিতে কেহ যদি এইরূই মনে করেন এবং এই অভিমত প্রচার করেন তবে তাহাকে নিশ্চয়ই ভ্রান্ত বলিতে হইবে। তবে যখন অনাহারে লোক মরিতেছে, তখন রাজনীতিক হিসাবে তাঁহার অভিমত ঠিক হইতে পারে কেননা বর্তমান মূহুর্তে জীবনধারণণাপযোগী জিনিসের প্রয়োজন অন্য যে কোনো জিনিস অপেক্ষা বেশি।

এই বিতর্কের অপর দিক আলোচনা করিতেও অনুরূপ বিস্তৃত দরকার। এই দিকটিকে আলঙ্কারিক বলিলে প্রয়োজনীয় শিক্ষার সমর্থকদিগের অভিমত এই রকম মানিয়া লওয়া হয়। কারণ আলঙ্কারিক বলিতে কমবেশি তুচ্ছ জিনিসকেই বোঝায়। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বলিতে মধ্যযুগীয় ধারণার প্রতি আলঙ্কারিক সংজ্ঞা প্রয়োগ করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ভদ্রলোক বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলিতেন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে কথাপ্রসঙ্গে প্রাচীন সাহিত্য হইতে কোন্ কোন্ অংশ উদ্ধৃত করিতেন, ফ্যাশন করিয়া পোশাক পরিতেন, আদবকায়দা ভালোমতো বুঝিতেন এবং প্রশংসা অর্জনের জন্য কখন দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করা উচিত তাহা জানিতে।

অতি সংকীর্ণ অর্থে তাঁহার শিক্ষা আলঙ্কারিক হইয়াছিল কিন্তু আমাদের যুগে কোনো ধনবান ব্যক্তিই তাঁহার মতো ভব্যতায় সন্তুষ্ট হইবেন না। প্রাচীন অর্থে আলঙ্কারিক শিক্ষার আদর্শ হইল অভিজাত [Aristocratic]। ইহা বলিতে এমন এক শ্রেণির লোক বুঝায় যাহাদের অর্থ আছে প্রচুর, কাজ করার প্রয়োজন নাই। ভদ্রলোক এবং চমৎকার ভদ্রমহিলাদের কাহিনী ইতিহাসের মনোজ্ঞ বিষয়বস্তু বটে; তাদের আত্মচরিত এবং পল্লির বাসভবন আমাদিগকে আনন্দ দান করে অথচ আমরা তাহা আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য রাখিয়া যাইতে পারিলাম না। কিন্তু তাহাদের চমৎকারিত্ব চরম ছিল বলিয়া মনে করিবার কোনো কারণ নাই, তথাপি ইহার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণে খরচ করিতে হইত। হগার্থের Ginlane পুস্তক পাঠে আলঙ্কারিক শিক্ষার জন্য কিরূপ খরচ করিতে হইত যে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। বর্তমান যুগে এই সংকীর্ণ অর্থে কেহই আলঙ্কারিক শিক্ষার সমর্থন করিবেন না।

কিন্তু প্রকৃত সমস্যা তাহা নয়। আসল প্রশ্ন হইলঃ সাক্ষাত্তাবে কার্যকরি হয় এমন জ্ঞানদানই কি আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হইবে, না ছাত্রদিগকে মানসিক সম্পদ দানের চেষ্টা করিতে হইবে? বারো ইঞ্চিতে এক ফুট এবং তিন ফুটে এক গজ ইহা জানা প্রয়োজনীয় কিন্তু এই জ্ঞানের কোনো অন্তঃস্থিত মূল্য [Intrinsic value) নাই। যেখানে মেট্রিক প্রণালী প্রচলিত সেখানে তো তাহা একেবারেই অকেজো। পক্ষান্তরে (কাহারও পক্ষে তাহার খুল্লতাতকে হত্যা করার বিরল ঘটনা ছাড়া) হ্যামলেট নাটকের রস উপলব্ধি করার ক্ষমতা দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের কোনো কাজে লাগিবে না। কিন্তু ইহা মানুষকে এমন মানসিক সম্পদ দান করে যাহা হইতে বঞ্চিত হওয়া তাহার পক্ষে আপসোসের বিষয়। এই মানসিক সম্পদই তাহাকে একজন চমৎকার মানুষে পরিণত করিতে পারে। যিনি মনে করেন কার্যকরি জ্ঞানই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তিনি এই ধরনের মানসিক সম্পদ বা ক্ষমতার পক্ষপাতী।

কার্যকরি শিক্ষার সমর্থক ও তাহাদের বিরুদ্ধপক্ষে বিতর্কের তিনটি মূল সমস্যা জড়িত আছে। প্রথমত, অভিজাত ও গণতন্ত্রবাদীদের মধ্যে বিরোধে অভিজাতগণ মনে করেন যে, অধিকারপ্রাপ্ত [Priviledged] শ্রেণির জন্য শিক্ষা এমন হইবে যেন তাহারা অবসর সময় আরামে বিলাস যাপন করিতে শিক্ষা পায় এবং নিম্নশ্রেণির লোকদিগকে এমন শিক্ষা দিতে হইবে যেন তাহারা অন্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় কাজে তাহাদের দৈহিক শ্রম নিয়োজিত করিতে পারে। এই মতের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রবাদীরা যে অভিমত পোষণ করেন তাহা কতকটা অস্পষ্ট এবং ঘোলাকে। অভিজাতদের পক্ষে অকেজো শিক্ষা তাহারা অপছন্দ করেন কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে, দিনমজুরদের শিক্ষা যেন কেবল কার্যকরি শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা না হয়। কাজেই বিলাতের পাবলিক স্কুলে প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রদত্ত সাহিত্য প্রধান শিক্ষার বিরোধিতা দেখিতে পাই; আবার সেই সঙ্গে এ দাবিও উত্থাপিত হইয়াছে যে, মজুরদের গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষার জন্য যেন সুযোগ দান করা হয়। এই নীতির মধ্যে সামান্য অস্পষ্টতা থাকিলেও মূলে সত্য আছে। গণতন্ত্রবাদীরা সমাজকে একটি প্রয়োজনীয় এবং অন্যটি আলঙ্কারিক বা প্রয়োজনীয় এই দুই ভাগে ভাগ করিতে চান না। কাজেই তাঁহারা আলঙ্কারিক শ্রেণিকে অধিক পরিমাণে কেবল কার্যকরি শিক্ষা এবং এ যাবৎ প্রয়োজনীয় শ্রেণিকে অধিক পরিমাণে কেবল আনন্দদায়ক শিক্ষার দিবার পক্ষপাতী। এই দুইটি উপাদান-কার্যকরি শিক্ষা ও আলঙ্কারিক শিক্ষা–কি পরিমাণে মিশাইতে হইবে গণতন্ত্র তাহা নির্ধারণ করিবে।

দ্বিতীয় সমস্যা হইল দু দল লোকের মধ্যে মতবিরোধ। ইহাদের একদল মনে করেন কেবল সংসারের প্রয়োজন মিটানোই শিক্ষার উদ্দেশ্য, অন্য দল শিক্ষার মারফত কেবল মানসিক আনন্দলাভেই পক্ষপাতী। যদি ধনশালী আধুনিক ইংরাজ ও আমেরিকাবাসীদিগকে কোনো জাদুবিদ্যার সাহায্যে এলিজাবেথের যুগে লইয়া যাওয়া যায় তবে স্যার ফিলিপ সিডনির সমাজ, চিত্তহারী সঙ্গীত এবং স্থাপত্যের সৌন্দর্য বর্তমানকালের বাথরুম, চা, কফি, মোটরগাড়ি এবং অন্যান্য বিলাসের উপকরণের অভাব মিটাইতে পারিবে না। নেহাত গোঁড়া সংস্কারে দ্বারা প্রভাবান্বিত না হইলে এরূপ লোকের অধিকাংশের ধারণা এই যে, উৎপাদিত জিনিসের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য বাড়ানোই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। তাহারা ঔষধ এবং স্বাস্থ্যবিদ্যা শিক্ষার অন্তর্গত করিতে পারেন কিন্তু সাহিত্য, শিল্প বা দর্শন সম্বন্ধে তাহাদের কোনো উৎসাহ নাই। রেনেসাঁ যুগে যে সাহিত্যপ্রধান পাঠ্য তালিকা প্রবর্তিত হইয়াছিল তাহার উপর আক্রমণ চালাইতে এরূপ লোকই অগ্রণী হইয়াছেন।

দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য অপেক্ষা মানসিক সম্পদেরই যে মূল্য বেশি শুধু একথা দ্বারা এ দাবি ঠেকানো যাইবে না। এ কথার ভিতর সত্যতা আছে কিন্তু ইহাই সবখানি সত্য নয়। কারণ দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্যের মূল খুব বেশি না হইলেও ইহার অভাব দেহধারণের জন্য যাহা প্রয়োজন তাহার অভাব–মানুষের মানসিক গুণরাশি নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে। যখন হইতে মানুষ দূরদৃষ্টি লাভ করিয়াছেন, তখন হইতেই খাদ্যাভাব, রোগ এবং ইহাদের চিরজাগরুক ভীতি বহু মানুষের উপর আশঙ্কার ছায়াপাত করিয়াছে। খাদ্যের অভাবে বহু পাখি মরিয়া যায় কিন্তু ইহাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা নাই বলিয়া যখন খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে তখন ইহারা সুখি। যে সকল কৃষক একবার দুর্ভিক্ষ কাটাইয়া উঠিয়াছে তাহারা খাদ্যাভাবের ভীতিজনক-স্মৃতি কিছুতেই মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারে না।

মৃত্যুবরণ করার চেয়ে মানুষ বরং সামান্য অর্থের জন্যও বহুক্ষণ পরিশ্রম করিতে ইচ্ছুক কিন্তু ইতর প্রাণী কোনো সাময়িক সুখের মূল্যস্বরূপ মৃত্যুবরণ করিতে হইলেও ক্ষণস্থায়ী সুখই পছন্দ করে। তাই দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই প্রায় নিরানন্দ জীবন-যাপন করে; কারণ সুখের আশায় অন্য কোনো প্রকারে জীবন-যাপন করিতে গেলে জীবনকাল হইবে সংক্ষিপ্ত। শিল্পবিপ্লবের দৌলতে বর্তমান যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সকল মানুষের জন্য অনন্ত কিছু পরিমাণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান করা সম্ভবপর। আমরা ইচ্ছা করিলে মানুষের দৈহিক দুঃখের কিছুটা লাঘব করিতে পারি। বিজ্ঞানের সাহায্যে এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা দ্বারা পৃথিবীর সকল মানুষের খাদ্য এবং বাসগৃহের বন্দোবস্ত করিয়া বিলাসিতার মধ্যে না হউক, মোটামুটিভাবে বাঁচিবার ব্যবস্থা করা যায়। রোগ নিবারণ করা এবং স্বাস্থ্যহীনতা দূর করা সম্ভব হইতে পারে; জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা রাখিয়া খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেশি করা চলিতে পারে; মানুষের অবচেতন মন হইতে নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার এবং যুদ্ধের ভীতি দূর করা যাইতে পারে। মানুষের জীবনে এ সবের এত প্রয়োজন যে, যে-শিক্ষার দ্বারা ইহা লাভ করা সম্ভবপর তাহার বিরোধিতা করা চলে না। এরূপ শিক্ষার ফলিত বিজ্ঞান প্রাধান্য লাভ করিবে। পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা এবং মনোবিজ্ঞান ছাড়া আমরা নূতন জগৎ গড়িতে পারি না; বরং ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্য দান্তে এবং শেক্সপিয়র, ব্যাক এবং মোজার্ট ছাড়া চলিতে পারে। কার্যকরি শিক্ষার স্বপক্ষে ইহাই একটি বড় যুক্তি। বিশেষভাবে অনুভব করি বলিয়াই আমি ইহা জোরের সঙ্গে উল্লেখ করিতেছি। তথাপি এ প্রশ্নের অন্য একটি দিকও আছে। যদি অবসর এবং স্বাস্থ্য ভালোভাবে কাজে লাগানোর উপায় জানা না থাকে তবে এগুলি অর্জনের সার্থকতা কোথায়? অন্যান্য ক্ষেত্রে যুদ্ধের মতোই মানুষের দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে অভিযান এমন কঠোরভাবে চালানো উচিত নয় যাহাতে শান্তির সময় অবসর বিনোদনের শিক্ষা ব্যাহত হয়, জগতের কল্যাণকর সামর্থ্যটুকু যেন সবখানিই কেবল দুঃখ-কষ্ট জয় করার সংগ্রামে ব্যয়িত না হয়।

আমরা এখন বিতর্কের বিষয়ীভূত তৃতীয় পক্ষে উপনীত হইয়াছি। ইহা কি সত্য যে কেবল অকেজো শিক্ষাই প্রকৃতপক্ষে মূল্যবান? ইহা কি সত্য যে যে কোনো মূল্যবান শিক্ষাই অকেজো? আমার নিজের কথা বলিতে পারি, আমি যৌবনের অনেকখানি সময় ল্যাটিন ও গ্রিক শিক্ষায় অতিবাহিত করিয়াছি। এখন মনে হয় সে-সময়ের অপচয় হইয়াছে। পরবর্তী জীবনে আমি যে-সব সমস্যার সম্মুখিন হইয়াছি গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষা আমাকে তাহা সমাধান করিতে কোনো হায়তা করে নাই। যাহারা প্রাচীন-সাহিত্য পড়ে তাহাদের শতকরা ৯৯ জনের মতোই আমি ওইসব ভাষায় এমন যোগ্যতা অর্জন করি নাই যাহাতে সে-ভাষায় সাহিত্য পাঠ করিয়া আনন্দ লাভ করিতে পারি।

পক্ষান্তরে গণিত ও বিজ্ঞানের যাহা কিছু আমি শিখিয়াছিলাম তাহা কেবল অবশেষ কাজেই লাগে নাই, চিন্তার বিষয়বস্তু এবং এই প্রবঞ্চনাময় সংসারে সত্যের কষ্টিপাথর হিসাবেও তাহাদের মূল্য অপরিসীম। ইহা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত খেয়াল হইতে পারে কিন্তু আমার বিশ্বাস এই যে, প্রাচীন সাহিত্য পাঠ দ্বারা উপকৃত হইতে পারেন এরূপ খেয়ালযুক্ত লোকের সংখ্যা আধুনিকদের মধ্যে খুবই কম। ফ্রান্স ও জার্মানিরও উন্নত সাহিত্য আছে; তাহাদের ভাষা সহজেই শিক্ষা করা যায় এবং অনেক প্রকারে ব্যবহারিক কাজেও লাগে। কাজেই ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্যের চেয়ে ফরাসি ও জার্মানি সাহিত্যের পক্ষে বলিবার অনেক কিছু আছে। যাহা কিছু, সাক্ষাভাবে কার্যকরি নয়, এরূপ শিক্ষার গুরুত্ব না কমাইয়াও দাবি করা চলে যে, বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যদের বেলায় ব্যাকরণের খুঁটিনাটি ও মারপ্যাঁচ বাদ দিয়া শিক্ষা দেওয়া উচিত। মানুষের জ্ঞানের পরিমাণ এবং মানবীয় সমস্যার জটিলতা দিন-দিনই বাড়িতেছে। কাজেই নূতনকে গ্রহণ করিতে হইলে প্রত্যেক প্রজন্মেই [Generation-এ] শিক্ষাব্যবস্থা ঢালিয়া সাজাইতে হইবে। নূতন এবং পুরাতনের মধ্যে বোঝাঁপড়া ও সামঞ্জস্যের সাহায্যে সমতা রক্ষা করিতে হইবে। সাহিত্য সম্বন্ধীয় উপাদান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই থাকিবে তবে তাহাদের জটিলতা কমাইয়া এমন করিতে হইবে যেন আধুনিক যুগ সৃষ্টি করিয়াছে যে-বিজ্ঞান তাহা শিক্ষার জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে।

আমার অভিমত ইহা নয় যে, সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক শিক্ষা কার্যকরি শিক্ষা অপেক্ষা কম মূল্যবান। শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান, বিশ্বের ইতিহাস, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান, কল্পনাশক্তি বাড়াইবার জন্য একান্ত আবশ্যক। কেবল কল্পনাশক্তির সাহায্যেই মানুষ ভবিষ্যতের জগৎ কেমন করিয়া গড়িতে হইবে তাহার পরিকল্পনা করিতে পারে; ইহা বাদ দিলে উন্নতি কেবল যান্ত্রিকভাবে অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানও কল্পনার উদ্রেক করিতে পারে। বাল্যকালে কোনোরকম রস উপলব্ধি করিতে না পারিলেও আমাকে বাধ্য হইয়া ইংল্যান্ড, ফান্স ও জার্মানির অনেক উৎকৃষ্ট সাহিত্য পাঠ করিতে হইয়াছে; কিন্তু ইহার চেয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূতত্ত্বই এ বিষয়ে আমার খোরাক জোগাইয়াছে। ইহা ব্যক্তিগত ব্যাপার; একজন বালক-বালিকা এক বিষয় হইতে অনুপ্রেরণা লাভ করিবে, অন্যে হয়তো অন্য বিষয় হইতে তাহা পাইবে। আমার বক্তব্য এই যে, যাহারা বিশেষজ্ঞ হইতে চায় তাহাদের কথা বাদ দিলে যেখানে কোনো বিষয় জানিতে হইলে কঠিন কৌশল আয়ত্ত করিতে হয় সেখানে শিক্ষণীয় বিষয়টি কার্যকরি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। রেনেসাঁসের যুগে আধুনিক ভাষায় খুব কম সাহিত্য ছিল। এখন হইয়াছে অনেক। যাহারা গ্রিক ভাষা জানে না তাহাদের নিকটও গ্রিক ঐতিহ্য পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়। ল্যাটিন ঐতিহ্যের মূল্য খুব বেশি নয়। কাজেই বালক-বালিকার সাহিত্যের প্রতি বিশেষ ঝোঁক না থাকিলে সেক্ষেত্রে তাদের সংস্কৃতিমূলক শিক্ষা সংক্ষিপ্ত আকারে সহজভাবে দেওয়াই আমার ইচ্ছা; পরবর্তী বয়সে শিক্ষার কঠিন অংশটুকু আমি গণিত ও বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিতে চাই। তবে কাহারও অন্য বিষয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখা গেলে তাহার পক্ষে ওই অবস্থার ব্যতিক্রম করা হইবে। সর্বোপরি, ছাঁচে ঢালা নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থা বর্জন করিতে হইবে! কি ধরনের জ্ঞানদান করিতে হইবে এতক্ষণ আমরা এই আলোচনা করিতেছি। নৈতিক শিক্ষা এবং চরিত্রের শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যা লইয়া এখন আলোচনা শুরু করিব। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সংস্রব নাই, মনোবিদ্যা এবং নীতিতত্ত্বই আমাদের বিবেচ্য। অল্প কিছুদিন পূর্বেও মনোবিদ্যা কেবল পুঁথিগত বিদ্যা বলিয়া বিবেচিত হইত। এ ক্ষেত্রে ইহার কোনো প্রয়োগ ছিল না। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। এখন শিল্প, মনোবিজ্ঞান, রোগীর মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আমাদের বিশেষ বাস্তবক্ষেত্রে কাজে লাগিতেছে। আমরা আশা করিতে পারি যে, অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যায়তনে মনোবিজ্ঞান যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিবে। ইতোমধ্যেই শিক্ষার ক্ষেত্রে অনন্ত ইহা ব্যাপক এবং সুফল দান করিয়াছে।

প্রথমে শৃঙ্খলার প্রশ্নটি বিবেচনা করা যায়। শৃঙ্খলা সম্বন্ধে পুরনো ধারণা ছিল সরল ও সহজ। বালক যাহা অপছন্দ করিত তাহা তাহাকে করিতে হুকুম করা হইত কিংবা সে যাহা ভালোবাসিত তাহা হইতে বিরত হইতে আদেশ দেওয়া হইত। আদেশ অমান্য করিলে দৈহিক শাস্তি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে কেবল জলরুটি দিয়া নির্জন কুঠুরিতে বন্দি করিয়া রাখা হইত। উদাহরণস্বরূপ The Fairchild Family পুস্তকে ছোট বালক হেনরিকে কিভাবে ল্যাটিন শিখানো হইয়াছিল তাহার বিবরণ দেখিতে পারেন। তাহাকে বলা হইয়াছিল ল্যাটিন না শিখিলে কিছুতেই ভালো ধর্মযাজক হইতে পারিবে না। কিন্তু কিছুতেই সে তাহার পিতার আগ্রহ অনুযায়ী মনোযোগ দেয় নাই। ফলে তাহাকে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে আটক করিয়া রাখা হইল। দেওয়া হইল শুধু জল আর রুটি। তাহার ভগিনীদিগের সহিত তাহার কথা বলা নিষিদ্ধ হইল। তাহাদিগকে বলা হইল যে হেনরি ভগবানের নিকট অপরাধী হইয়াছে। ইহা সত্ত্বেও এক ভগিনী হেনরিকে গোপনে খাবার দিয়াছিল। ধরা পড়িয়া সে-ও শান্তি পাইল। কিছুকাল বন্দি থাকার পর নাকি ল্যাটিনের প্রতি হেনরির অনুরাগ জন্মে এবং ইহার পরেও অধ্যবসায় সহকারে কাজ করিতে থাকে।

ইহার বিপরীত একটি গল্প শেহর বলিয়াছেন। তাঁহার কাকা একটি বিড়ালের বাচ্চাকে ইঁদুর ধরা শিখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহারই গল্প। যেখানে বিড়ালের বাচ্চাটি ছিল সেখানে একটি ইঁদুর লইয়া আসা হয়। কিন্তু তখনও বিড়ালের শিকার করার প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় নাই, কাজেই সেই ইঁদুরের দিকে মনোযোগ দেয় না। ইহাতে শেহরের কাকা বিড়াল বাচ্চাটিকে প্রহার করেন। পরের দিন এই একই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইল। ক্রমাগত অনেক কয়দিন এইরূপ চলিতে লাগিল। অবশেষে অধ্যাপক মনে করিলেন বিড়ালটি অত্যন্ত বোকা এবং শিক্ষাদানের সম্পূর্ণ অযোগ্য। পরবর্তীকালে বিড়াল অন্যান্য বিষয়ে স্বাভাবিক হইলেও ইঁদুর দেখিলে ভয়ে কাঁপিতে থাকিত এবং ছুটিয়া পলাইত। শেহর বলিয়াছেন– বিড়াল-বাচ্চাটির মতোই আমারও কাকার নিকট হইতে ল্যাটিন শিখিবার ভাগ্য হইয়াছিল। এই দুইটি গল্প হইতে শাসনের প্রাচীন পদ্ধতি এবং ইহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিচয় পাওয়া যায়।

কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদ শৃঙ্খলা বর্জন করেন না; নূতন প্রণালীর সাহায্যে তিনি ইহা প্রবর্তন করেন। এ সম্বন্ধে যাঁহারা নূতন প্রণালীর বিষয় পড়েন নাই তাঁহারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিতে পারেন। পূর্বে আমার ধারণা ছিল মাদাম মন্তেসরি শৃঙ্খলার বালাই তুলিয়া দিয়াছেন। কিভাবে তিনি ঘরভরা ছেলেমেয়ে লইলা কাজ করেন ভাবিয়া আমি বিস্মিত হইতাম। তাঁহার নিজের লেখা পুস্তক পড়িয়া আমি বুঝিতে পারি শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা তিনি বিসর্জন দেন নাই, ইহা বরং তাঁহার শিক্ষাপ্রণালীর একটি বিশিষ্ট অংশ। আমার তিন বৎসর বয়স্ক ছেলেকে সকালবেলা করিয়া মন্তেসরি স্কুলে পাঠাইয়া বুঝিতে পারিলাম সে অল্প সময়ের মধ্যে নিয়মানুবর্তী হইয়া পড়িয়াছে, স্কুলের নিয়মকানুন সে হৃষ্টচিত্তেই মানিয়া চলিতেছে। ইহার জন্য কোনোরূপ বাহিরে তাগিদ বা তাড়না ছিল না; নিয়মকানুনগুলি খেলার নিয়মের; নিজেরা ইচ্ছা করিয়া কিছু শিখিতে চাহে না, ভয় দেখাইয়া জোর করিয়া তাহাদের শিখাইতে হয়। প্রমাণিত হইয়াছে যে শিক্ষাদান ব্যাপারে কৌশলের অভাবই ইহার কারণ। শিক্ষণীয় বিষয়টিকে যেমন পড়া ও লেখা–কয়েকটি সুবিধাজনক পর্যায়ে ভাগ করিয়া লইয়া প্রত্যেকটি পর্যায় শিশুর নিকট আকর্ষণীয় করা যায়। শিশুরা যখন নিজেদের পছন্দমতো কাজ করিতে সুযোগ পায়, তখন বাহির হইতে শৃঙখলা চাপাইয়া দেওয়া প্রয়োজন হয় না। কয়েকটি সরল নিয়ম সকলেই বুঝিতে পারে এবং ন্যায্য বলিয়া স্বীকার করিয়া মানিয়া চলে ইহা হইল—কোনো শিশু অন্যের খেলায় বা কাজে বাধা দিবে না। কোনো শিশুই এক সঙ্গে এক প্রস্তের বেশি খেলার সরঞ্জাম রাখিবে না। শিশু এইভাবে সদভ্যাসে অভ্যস্ত হয় এবং বুঝিতে পারে যে কোনো ভালো ফল লাভ করিতে হইলে অনেক সময়ে প্রবৃত্তিকে দমন করা আবশ্যক। এইভাবে শিশু আত্মসংযম বা আত্মশৃঙ্খলা অর্জন করে।

সকলেই জানেন যে, খেলার ভিতর দিয়া এইরূপ শৃঙ্খলা আয়ত্ত করা সহজ কিন্তু কেহ অনুমান করিতে পারেন নাই যে, জ্ঞান অর্জন ব্যাপারটিকেই এমন আনন্দপ্রদ করা যায় যে ইহার মধ্যেও সে ভাব সঞ্চারিত হয়। আমরা জানি যে, ইহা সম্ভব এবং কেবল শিশুর শিক্ষার বেলায় সম্ভব নয়, সকল স্তরের শিক্ষাতেই সম্ভব। আমি বলিতে চাই না যে কাজটি সহজ। নূতন প্রণালীর উদ্ভাবন করিতে প্রতিভার প্রয়োজন হইয়াছে কিন্তু সাধারণ শিক্ষকগণই ইহার প্রয়োগ করিতে পারে। ইহার জন্য প্রয়োজন সহানুভূতি, ধৈর্য এবং শিক্ষাদানের জন্য যথোপযুক্ত ট্রেনিং। মূলগত ভাবটি সরলঃ বাহির হইতে তাড়না বা জবরদস্তি করিয়া প্রকৃত শৃঙ্খলা গড়িয়া তোলা যায় না। প্রকৃত শৃঙ্খলা হইল মনের এমন একটি অভ্যাস যাহা স্বভাবতই অবাঞ্ছনীয় কার্যকলাপের দিকে না ঝুঁকিয়া বাঞ্ছনীয় কাজ ও আচরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শিক্ষাদান ব্যাপারে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সত্যিই বিস্ময়কর। ইহার জন্য সবখানি প্রশংসা মাদাম মন্তেসরির প্রাপ্য।

মূল পাপ [Original sin] সম্বন্ধে বিশ্বাস লোপ পাওয়ার ফলে শিক্ষা প্রণালীর বহুলাংশে প্রভাবান্বিত হইয়াছে। পুরাতন ধারণা ছিল শিশুমাত্রই পাপ হইতে উদ্ভূত। এরা স্বভাবতই দুষ্ট; তাহার ভিতর সদগুণের সঞ্চার করিতে ঘন ঘন শাস্তি বিধান করিতে হইবে। আমাদের পূর্বপুরুষের শিক্ষা এই ধারণা দ্বারা কিরূপ প্রভাবিত হইয়াছিল তাহা অধিকাংশ আধুনিকগণ বিশ্বাস করিতে পারিবেন না। ডিন স্ট্যানলি [Dean Stanley] লিখিত Dr. Amold-এর জীবনী হইতে উদ্ধৃত দুইটি অংশ তাহাদের ভ্রম দেখাইয়া দিবে।

ডিন স্ট্যানলি ডক্টর আর্নল্ডের প্রিয় ছাত্র ছিলেন Tom Browns School Days পুস্তকের তিনি সুবোধ বালক আর্থার। তিনি বর্তমান লেখকের খুল্লতাত ভ্রাতা; বাল্যকালে তিনি লেখককে Westminster Abbey ঘুরিয়া দেখাইয়াছিলেন। ডক্টর আর্নল্ড ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলগুলির একজন বড় সংস্কারক। এই স্কুলগুলি ইংল্যান্ডের গৌরব এবং এখনও পর্যন্ত তাহার নীতি অনুসারেই পরিচালিত হইতেছে। কাজেই ডক্টর আর্নল্ডের আলোচনা করিতে গিয়া বহু অতীতের কোনো প্রণালী বর্ণনা করিতেছি না, বর্তমানে উচ্চশ্রেণির ইংরেজদের গড়িয়া তুলিতেছে যে শিক্ষাপ্রণালী তাহারই আলোচনা করিতেছি। ডক্টর আর্নল্ড বেত মারার প্রথা হ্রাস করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবনীকারের কথায় মিথ্যা কথা বলা, পানদোষ এবং স্বভাবত কুঁড়েমির জন্য অল্পবয়স্ক ছেলেদের মধ্যে বেত্রাঘাত প্রথা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলেন। কোনো উদারনৈতিক পত্রিকা যখন মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, বেত্রাঘাত অবনতিকর শাস্তি এবং ইহা একেবারে বন্ধ করা উচিত, তখন ডক্টর আর্নল্ড অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি লিখিতভাবে উত্তর দিয়াছিলেন :

ইহা কোন ভাবের পরিচায়ক তাহা আমি জানি; ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের গর্ববোধ হইতে ইহা উদ্ভূত; ইহা যুক্তিসঙ্গত নয়, কোনো খ্রিস্টানের পক্ষে উপযুক্ত নয়, ইহা একান্তই বর্বর। শিভালরির যুগের অভিসম্পাতসহ ইহা ইউরোপে এক সময় সংক্রামিত হইয়াছিল; এখন জ্যাকোবিনিজিমের অভিসম্পাত স্বরূপ ইহা আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়াছে।

…. যে বয়সে দোষ বা অপরাধের দরুন অপমান বোধ করিবার পুরুষোচিত অনুভূতির সন্ধান পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তখন ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টাকে শিশুর আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর এইরূপ অযৌক্তিক ও হাস্যকর ধারণাকে উৎসাহ দিয়া বাড়াইয়া তোলার মধ্যে জ্ঞানের পরিচয় কোথায়? যুবকের পক্ষে যাহা অলঙ্কারস্বরূপ এবং মনুষ্যত্ব গঠনের সম্ভাবনায় যাহা পূর্ণ সরলতা, সংযম এবং মানসিক নম্রতার পক্ষে ইহার চেয়ে আর কি বেশি অপরাধী এবং প্রতিকূল হইতে পারে?

ভারতের অধিবাসীরা যদি এই মানসিক নম্রতা দেখাইতে না পারে তবে যে ডক্টর আর্নল্ডের শিষ্যের ছাত্ররা তাহাদিগকে ঠেঙাইতে উৎসাহী হইবে তাহাতে অস্বাভাবিকতা নাই।

মিঃ স্ট্রাচি Eminent Victorians পুস্তকে আরও একটি অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেটি উল্লেখ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। ডক্টর আর্নল্ড কোনো হ্রদের তীরে ছুটি যাপন করিতে গিয়াছিলেন। সেখানকার সৌন্দর্য দেখিয়া তাহার মনের আনন্দ কি ভাবের উদ্রেক করিয়াছিল সে সম্বন্ধে তিনি পত্নিকে বলিয়াছিলেন।

আমার চতুর্দিকে মনোরম প্রাকৃতিক শোভা দেখিয়া এবং নৈতিক অপরাধের কথা চিন্তা করিয়া স্তম্ভিত হইতে হয়। মনে হয় স্বর্গ এবং নরক যেন পরস্পর হইতে বহু দূরে নয়; যেন পাশাপাশি আমাদেরই চারিদিকে আসিয়া মিশিয়াছে। সৌন্দর্য দেখিযা মনে যেমন উল্লাস জাগিয়াছে; নৈতিক অপরাধ সম্বন্ধেও তেমনি তীব্র ভাব যদি মনে জাগিত! কেননা অন্য সব কিছুর চেয়ে নৈতিক অপরাধ সম্বন্ধেও তীব্র মনোভাবেই প্রাতকি উদ্ধারকারী ঐশ্বরিক জ্ঞান বিরাজ করে। নৈতিক সদকার্যের প্রশংসা করাই বড় কথা নয়; কিন্তু ঐরূপ কাজ না করিয়াও আমরা প্রশংসা করিতে পারি। আমরা যদি পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করি, বিশেষ করিয়া আমাদের অন্তরস্থিত পাপকে ঘৃণা করি তবেই যিশু এবং ঈশ্বরের অনুভূতি লাভ করিতে পারি ইহাই ঈশ্বরলাভের পন্থা। হায়, ইহা দেখা এবং বলা কত সহজ এবং কাজে পালন করা এবং অনুভব করা কত কঠিন। ইহার যোগ্য কে? যে নিজের অপূর্ণতা সম্বন্ধে সচেতন এবং ইহার জন্য দুঃখ করে সে ছাড়া আর কেহ নয়। ঈশ্বর তোমাকে এবং আমাদের প্রিয় সন্তানদিগকে আশীর্বাদ করুন।

এই সহানুভূতিশীল ভদ্রলোকে আত্মশোচনার কশাঘাতে জর্জরিত হইতে দেখিয়া সত্যই দুঃখ হয়। প্রেমধর্মের নীতি অনুসারেই কাজ করিতেছেন এই ধারণার বশে তিন নির্বিকার চিত্তে শিশুদের উপর বেত্রচালনা করিয়াছেন। এই ভ্রান্ত ব্যক্তির কথা চিন্তা করিলে মনে ব্যথা অনুভব করিতে হয়। কিন্তু নৈতিক অপরাধের প্রতি ঘৃণা জাগাইয়া তুলিয়া তিনি যে কত নির্দয় লোক তৈয়ার করিয়াছিলেন তাহা চিন্তা করিলে মর্মাহত হইতে হয়; মনে রাখিতে হইবে শিশুদের স্বভাবগত আলস্যও তাহার মতে নৈতিক অপরাধের অন্তর্গত। নৈতিক অন্যায়ের শাস্তিবিধানের সদিচ্ছার বশবর্তী হইয়া কত সৎ প্রকৃতির লোক যে যুদ্ধ এবং অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী হইয়াছেন তাহা চিন্তা করিয়া শিহরিয়া উঠিতে হয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে শিক্ষাবিদগণ এখন আর শিশুকে শয়তানের অংশ বলিয়া মনে করেন না। বয়স্ক ব্যক্তি সম্বন্ধে বিশেষত অপরাধীর শাস্তিদানকালে এই ধারণার প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু শিশু-নিকেতন এবং বিদ্যালয় হইতে ইহা প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।

ডক্টর আর্নল্ড যে ভুল করিয়াছিলেন তাহার বিপরীত একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। ইহা কম হানিকর হইলেও বৈজ্ঞানিক দিক হইতে বিচার করিলে ভুল বটেই। ইহা হইল এই ধারণা যে শিশুরা স্বভাবত নিষ্পাপ, তাহারা কেবল তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের পাপাঁচরণ দেখিয়া দূষিত হয়। রুশোর নামের সঙ্গে এই অভিমত জড়িত। হয়তো তিনি ইহা সূত্রাকারে প্রচার করিয়াছিলেন কিন্তু তাহার এমিল [Emole] পাঠ করিলে জানা যায় যে অনেক রকমে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার পর ছাত্রটি আদর্শ শিক্ষা পদ্ধতির অভিপ্রেত সর্বগুণে ভূষিত হয়। প্রকৃত কথা হইল যে, শিশু স্বভাবতই ভালো বা মন্দ নয়। তাহারা কতকগুলি প্রতিবর্তী [Reflex] এবং প্রবৃত্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে। পরিবেশের ফলে ইহা হইতেই স্বভাব গঠিত হয়। স্বভাব [Habit] সুস্থও হইতে পারে, অসুস্থও হইতে পারে। কিরূপ স্বভাব হইবে তাহা প্রধানত নির্ভর করে জননী অথবা ধাত্রীর জ্ঞানের উপর, কারণ শিশুর স্বভাব প্রথম অবস্থায় অত্যন্ত নমনীয় থাকে। অধিকাংশ শিশুর মধ্যেই সৎ নাগরিকের উপাদান থাকে, আবার অপরাধীর উপাদানও থাকে। বৈজ্ঞানিক মনোবিদ্যা প্রমাণ করে যে, সপ্তাহের মধ্যে ছয়দিন চাবুক এবং রবিবারের ধর্মোপদেশ প্রয়োগ করা সগুণ বিকাশের আদর্শ প্রক্রিয়া নয়। কিন্তু ইহা অনুমান করা ঠিক হইবে না যে, গুণ বিকাশের কোনো উপায় বা প্রণালী নাই। পূর্ববর্তী শিক্ষাবিদগণ শিশুদিগের উপর অত্যাচার করিয়া আনন্দ পাইতেন। সামুয়েল বাটলারের এই অভিমত উড়াইয়া দেওয়া যায় না। অন্যথায় তাহাদের অনুষ্ঠিত এইরূপ নিরর্থক অত্যাচারের সার্থকতা দেখা যায় না। একটি সুস্থ শিশুকে সুখি করা কঠিন নয়। দেহ এবং মনের যত্ন লইলে বেশিরভাগ শিশুরই সুখস্বাচ্ছন্দ্য একান্ত আবশ্যক। শিশুর যে স্বভাবগত আলস্যকে ডক্টর আর্নল্ড নৈতিক অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতেন তাহা মোটেই থাকিবে না যদি শিশু বুঝিতে পারে যে যাহা তাহাকে শিখানো হইতেছে তাহা সত্যই এবং যাহারা শিক্ষা দিবেন তাঁহারা যদি হন নিষ্ঠুর অত্যাচারী তবে শিশু স্বভাবতই শহরের বিড়ালছানার মতো আচরণ করিবে। সুস্থ শিশুর হাঁটিবার এবং কথা বলিবার প্রয়াস হইতে বোঝা যায় তাহাদের শেখার জন্য একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা আছে। এই ইচ্ছাটাকে শিক্ষার কাজে লাগাইতে হইবে। চাবুকের স্থলে শিশুর এই স্বাভাবিক ইচ্ছার প্রবর্তন যুগের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি পরিচায়ক।

এই পুস্তকে যে আধুনিক ভাবধারার আলোচনা করিতে চাই তাহার শেষ প্রশ্নে উপনীত হইয়াছি–অধুনা বাল্যকালের উপর অধিকতর মনোযোগ দেওয়া হইতেছে আমি তাহারই উল্লেখ করিতেছি। চরিত্রের শিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পরিবর্তনের সঙ্গে ইহার নিবিড় যোগ আছে। প্রাচীন ধারণা ছিল ইচ্ছার উপর গুণ নির্ভর করে; মনে করা হইত যে শিশুর মন কু-ইচ্ছা দ্বারা পূর্ণ, কেবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সে ইহাদিগকে দমন করিয়া রাখে। সকল কু-ইচ্ছা সমূলে দূর করা অসম্ভব বলিয়া মনে করা হইত; শিশু কেবল ইহাদিগকে সংযত রাখিতে পারে মাত্র। এই অবস্থাকে ঠিক অপরাধী ও পুলিশের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা চলে। ভাবী অপরাধী ছাড়া যে-সমাজ চলিতে পারে তাহা কেহ অনুমান করিতে পারিত না; অধিকাংশ লোক যাহাতে শাস্তির ভয়ে অপরাধ না করে এবং অপরাধীরা ধরা পড়ে এবং শাস্তি পায় এমন গোছের তৎপর পুলিশ দল রাখিতে পারিলেই যথেষ্ট মনে করিত। বর্তমানের মনস্তাত্ত্বিক অপরাধবিজ্ঞানী কিন্তু ইহাতে সন্তুষ্ট নন। তিনি মনে করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষা দ্বারা অপরাধ করার প্রবণতা দূর করা সম্ভবপর। সমাজের পক্ষে যাহা প্রযোজ্য, ব্যক্তির কাছেও তাহা প্রযোজ্য। শিশুরা বিশেষ করিয়া তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সঙ্গীদের প্রশংসা পাইতে ইচ্ছুক হয়; তাহারা যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বাড়িয়া ওঠে সেই পরিবেশ অনুসারে তাহাদের প্রবৃত্তিগুলিকে ভালো বা মন্দ দিকে চালিত করা যায়। অধিকন্তু তাহাদের বয়সে অভ্যাস-গঠন করা সহজ এবং সদভ্যাস দ্বারা অনেক গুণ স্বভাবে পরিণত হইতে পারে। পক্ষান্তরে, মনের শক্তি দ্বারা কু-ইচ্ছা (অসৎ বাসনা) দমন করিয়া অসৎ আচরণ কমাইবার যে প্রক্রিয়া পূর্বে প্রচলিত ছিল তাহা মোটেই সন্তোষজনক নয়। বাঁধ দেওয়া নদীর জলের মতো অসৎ বাসনা ইচ্ছা শক্তির অজ্ঞাতসারে কোনো প্রকারে আত্মপ্রকাশ করে। যৌবনে যে যুবক পিতাকে হত্যা করার বাসনা মনে পোষণ করিত, পুত্রকে নৈতিক অন্যায়ের শাস্তি দিতেছে মনে করিয়া সে তাহাকে বেত্রাঘাত করিয়া তৃপ্তি অনুভব করে। যে সকল মতবাদ নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে তাহাদের মূল অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে, কোনো বাসনা ইচ্ছা শক্তি দ্বারা নিপীড়িত হইয়া লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল কিন্তু অবশেষে ইহাই পাপের প্রতি ঘৃণা কিংবা এমনই কোনো ভদ্র-রূপ ধারণা করিয়া সম্পূর্ণভাবে অচেনারূপে বাহির হইয়াছে। কাজেই ক্ষেত্রবিশেষে ইচ্ছাশক্তি দ্বারা পাপ-ইচ্ছার দমন প্রয়োজনীয় হইলেও গুণবিকাশের প্রণালী হিসাবে ইহা কার্যকরি নয়।

এই প্রসঙ্গ আমাদিগকে মনঃসমীক্ষার ক্ষেত্রে লইয়া আসে। মনঃসমীক্ষার মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যাহা অযৌক্তিক এবং প্রমাণসহ নয়। কিন্তু ইহার সাধারণ প্রণালী আমার নিকট বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে হয়। নৈতিক শিক্ষার সঠিক পদ্ধতি রচনায় ইহা একান্ত আবশ্যক। অনেক মনঃসমীক্ষক শৈশবের প্রথম অবস্থার উপর যতখানি গুরুত্ব আরোপ করেন তাহা আমার নিকট অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়; তাহার অনেক সময়ে বলেন শিশুর বয়স তিন বৎসর হইতে হইতেই তাহার চরিত্র কেমন হইবে তাহা পাকাপাকিভাবে স্থির হইয়া যায়। আমার বিশ্বাস এরূপ কখনও হইতে পারে না। তবে মনঃসমীক্ষকের অভিমতের এই যে মাত্রাধিক্য তাহা ভুল হইলেও যাহা সত্য তাহার দিকেই। অতীতে মনোবিজ্ঞান উপেক্ষিত হইয়াছিল; কার্যত বুদ্ধিবৃত্তি প্রধান [Intellectualist] যে প্রণালী তৎকার্যে প্রচলিত ছিল তাহার কল্যাণে ইহার প্রসার সম্ভবও ছিল না। ঘুমের কথাটি ধরা যাক। সকল মাতাই চান তাহাদের শিশুরা ঘুমাইয়া থাকুক কারণ ইহা তাহাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী এবং মেয়েদের পক্ষেও সুবিধাজনক। ইহার জন্য তাঁহারা এক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করিয়াছিলেন–দোলনায় দোল দেওয়া এবং ঘুমপাড়ানি গান গাওয়া। পুরুষেরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করিয়া আবিষ্কার করিয়াছেন যে, এই প্রণালী আদর্শের দিক দিয়া অপকারী; কারণ কোনো একদিন ইহার ফল পাওয়া গেলেও ইহা খারাপ অভ্যাস গঠন করে। প্রত্যেক শিশুই চায় তাহাকে সবাই খুব সমাদর করুক, কারণ ইহা দ্বারা তাহার অহমিকার ভাব তৃপ্ত হয়। যদি সে বুঝিতে পারে যে, না ঘুমাইলেই সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখন সে এই পন্থাই অবলম্বন করিবে। ইহার ফলে তাহার স্বাস্থ্য ও চরিত্রের পক্ষে হানিকর হইবে। এখানে প্রধান বিষয় হইল অভ্যাস গঠন–বিছানার সঙ্গে ঘুমের সহযোগ [Association] স্থাপন। এই সহযোগ যথার্থভাবে স্থাপিত হইলে রুগ্ন কিংবা যন্ত্রণাবোধ করিতে না থাকিলে শিশু জাগিয়া থাকিবে না। কিন্তু এই সহযোগ স্থাপন করিতে হইলে কিছু শৃঙ্খলাবিধানের প্রয়োজন; কেবল আদর দিয়া ইহা গড়িয়া তোলা যাইবে না; কেননা তাহা জাগিয়া থাকিতেই উৎসাহ দেয়। অন্য ভাল এবং মন্দ অভ্যাস গঠনের ব্যাপারেও এই বিষয়ে বিবেচনা করিতে হইবে। মনোবিজ্ঞানের এই দিকটির এখনও শৈশব অবস্থা কিন্তু ইহার গুরুত্ব ইতোমধ্যে যথেষ্ট বাড়িয়াছে এবং আরও সঙ্গেই আরম্ভ হইবে; ধাত্রী এবং অজ্ঞ জননীদের অনেক কার্যকলাপ এবং অভ্যাসের পরিবর্তন আবশ্যক। ইহাও স্পষ্ট যে, পূর্বে যে-সময়ে শিক্ষাদানের উপযুক্ত কাল বিবেচিত হইত, তাহা অপেক্ষা আগেই শিক্ষা আরম্ভ করা চলে; কারণ এই শিক্ষা আনন্দপ্রদ হইলে শিশুকে মনোযোগ-শক্তির উপর জুলুম করিতে হইবে না। এই বিষয়ে আধুনিক যুগে শিক্ষাতত্ত্বে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে, ইহার যে সুফল পাওয়া গিয়াছে তাহা দিন-দিন বাড়িয়াই চলিবে। কাজেই পরের অধ্যায়ে শিশুর পরবর্তীকালীন শিক্ষা কিরূপ হইবে তাহা আলোচনা করার পূর্বে বাল্যকালে শিশুর চরিত্র গঠনের শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *