• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৬৪. নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলে

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০৬৪. নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলে

নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলেও কত জ্ঞান হয়। পাকা মানুষ, কত অভিজ্ঞতা। আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, কাছাড় থেকে বিহার অবধি কত ঠিকাদারি যে করেছেন একটা জীবনে তার হিসেব নেই। টাকা কামাতেই বটে, কিন্তু কাজটাও বড় ভালবাসেন।

একটু রাতের দিকে নিরঞ্জনবাবুর কাছে এসে বসে নিমাই। কখনও গান শোনায়, কখনও বসে বসে কথা শোনে। আগে সন্ধের পর একটু-আধটু মদ খেতেন, সিগারেটেরও নেশা ছিল। ডাক্তারের বারণ বলে ছেড়েছেন। এত খাটুনিও ডাক্তারের বারণ। এ বারণটা শোনেননি।

সেই কথাই বলছিলেন, এখন কাজকর্ম ছেড়ে যদি ঘর-বসা হয়ে যাই তাহলে আর কদিন বাঁচবো? ডাক্তাররা বুঝতে চায় না, কাজই হল মানুষের আসল ওষুধ। কাজ বন্ধ করলেই আদি-ব্যাধি এসে ধরে।

নিরঞ্জনবাবু চৌকিতে বিছানায় চাদুরমুড়ি দিয়ে বসা। মুখামুখি একখানা টুলে নিমাই। নিমাই মাথা নেড়ে বলে, ডাক্তাররা শরীর চেনে, রোগ চেনে, গোটাগুটি মানুষটাকে তো বুঝে উঠতে পারে না। মনটায় যদি অশান্তি হয়, যদি ছটফট করে তবে কি দেহে শান্তি হয়?

তবেই বোঝে। আমার দুই ছেলে, ছেলেদের মা, বউমারা, মেয়েরা সবাই এমন গাজি গাজি করে ধরল, কিছুতেই কাজে বেরোতে দেবে না। তাদের ধারণা, টাকা রোজগার তো মেলা হল, এবার ঘরের সুখ ভোগ করলেই হয়। ঘরের যে কী সুখ তা তো আমি জানি। ছেলেদের দুটো দোকান করে দিয়েছি। একখানা রং আর হার্ডওয়্যারের, অন্যখানা পাম্পসেট আর ইনজিনিয়ারিং। চলছেও ভাল। টাকার অভাব নেই। কিন্তু বাড়ির মধ্যে দেখবে দিনরাত মাথা গরম, দিনরাত ঝগড়াকাজিয়া। ছোটোখাটো ব্যাপার থেকে কুরুক্ষেত্র হয়ে যায়। আমার যখন প্রথম স্ট্রোকের মতো হল কদিন বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। বাড়ির আবহাওয়ায় আমার ফের স্ট্রোক হওয়ার জোগাড়। শেষে একটা নার্সিংহোম-এ গিয়ে পালিয়ে বাচি। এই বেশ আছি বাবা। কাজ করতে করতেই একদিন ফুটুস করে মরে যাবো, সেই ভাল।

মরার কথা বলেন কেন? সে যখন আসার আসবে। বেঁচে থাকার কথা ভাবাই তো ভাল। বাঁচার ইচ্ছেটা জোরদার থাকলে তার জোরে আয়ুও খানিকটা বেড়ে যায়।

আমিও তাই বলি। চিরকাল মাঠে-ঘাটে কাজ করে করে আমার মনটা কেমন সবসময়ে উড় উড় থাকে। ঘরসংসারের বাঁধা পড়লেই যেন ওসব মরুনে চিন্তা পেয়ে বসতে থাকে। এই যে শখানেক লোকের গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছে, একটা কিছু তৈরি করছি—এ সবের কি আনন্দ নেই?

দুজনেই খানিক চুপ করে থাকে।

নিরঞ্জনবাবু হঠাৎ বলেন, তোমার কথা তো কিছুই খুলে বললে না আমায়? এ কবছর করলেটা কী?

নিমাই একটু হেসে মাথা নিচু করে বলে, সে এক লজ্জার কথা।

কেন, লজ্জার কী?

বিয়ে বসে প্রায় ঘরজামাই হয়েছিলুম। কটা বছর নষ্ট করলুম। না হল সংসার, না কাজকর্ম।

ঘরজামাই ছিলে! সে আবার কেমন?

ঘরজামাই যাকে বলে তা নয় অবিশ্যি। তবে বউয়ের পয়সায় দিন গুজরান হত।

বউ কোথায়?

সে আমাকে ত্যাগ দিয়েছে।

বউকে ত্যাগ করা মহা পাপ, তা জানো?

আমি ত্যাগ করার কে? বউই আমাকে একরকম ঘাড় ধাক্কা দিল যে।

বলো কি! এ তো ঘোর অন্যায়। কেন, তোমাকে তার পছন্দ নয়?

সে জানি না। ছিম তো একই সঙ্গে। তবে অন্য একটা বখেরা জুটল, সেটাই কাল হল।

অন্য কোনও ছেলেছোকরা নাকি?

না। সেটা বলা যাবে না।

যাত্ৰাদলে নেমেছে সেটাও ভাল কথা নয়। যাত্ৰা-থিয়েটার বাইরে থেকেই ভাল, ভিতরে নালী ঘা।

তা বটে।

তুমি চেপে বসে থাকো। ব্যবসাটা বাড়াও! বউ যদি কখনও নিজের ভুল বুঝতে পারে তাহলে নিজেই ফিরবে। জীবনের ভুলগুলো মানুষ যতদিন নিজে না বুঝতে পারে ততদিন তাকে ফেরাতে চেষ্টা করে লাভ হয় না। ওটা হল নিশির ডাকের মতো।

তা বটে। ব্যবসার কথা কিছু ভাবছো? ক্যাটারিংটা ভালই চলছে।

দুর বোকা! ওটুকুতে আটকে থাকলে চলবে কেন? একখানা দোকানঘর দেখ। তোমার ব্যবসার মাথা আছে, রান্নার হাতও খুব ভাল। তার ওপর তোমার স্বভাবখানা নরম। তোমার হবে। শুধু দেখো, বাকি-বকেয়ার ফেরে পড়ে যে না। ধার-বাকির পাল্লায় পড়েই অধিকাংশ দোকান লাটে ওঠে।

যে আজ্ঞে।

দুপাঁচ হাজার টাকা আমার কাছে সব সময়েই পাবে। তোমার কাছে আমার টাকা কখনও মার যাবে না। দুচারটে লোককে যদি মরার আগে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে পারি তাহলেই আমার সুখ।

নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে চোখে জল আসতে চায় নিমাইয়ের। সে মাথা নেড়ে বলে, দোকানই দেবো।

দাও। বেশ গোড়া বেঁধে লেগে যাও। ব্যবসার পিছনে যেন একটু সেবাবুদ্ধি থাকে। বেশির ভাগ ব্যবসাদাররাই চায় লোকের ঘাড় ভেঙে পয়সা লুটতে। ওরকম মন থাকলে হয়ও না ভাল। তোমার মনটা হবে অন্যরকম। ব্যবসার পিছনে লোককে সেবা করার মতলব যদি থাকে, তাহলে দেখো কি থেকে কি হয়ে যাবে। একটু কম লাভ রেখো, আর লাভের অর্ধেক ব্যবসাতেই লাগাবে। তাতে ব্যবসা বাড়বে।

নিমাই এ সব কথা রাত জেগে জেগে বসে ভাবে। নিরনবাবু বড় খাঁটি লোক।

নন্দর বউটা ইদানীং বড় ঘুর ঘুর করছে। লক্ষণ সব চেনে নিমাই। নন্দ বেশি পাত্তা দিচ্ছে না বউকে। ইদানীং ভাতকাপড়ও বন্ধ করেছে। বউটা এখন আতান্তরে। তার এখন একজন পুরুষ চাই। এমন পুরুষ যে রাখবে। রাতের দিকে এসে আজকাল পাশটিতে বসে পড়ে, তারপর রাজ্যের কথা ফাঁদে।

ও নিমাইদাদা, অমন গোমড়া মুখ করে থাকো কেন গো?

মেয়েটার জন্য নিমাইয়ের কষ্ট হয়। সে তো জানে, মনন শরীরের টানে তার কাছে আসে না। আসে পেটের টানে। দুমুঠো ভাত, মাথার ওপর চাল, দুচারখানা কাপড়, কয়েকটা টাকা এই হলেই বাধা মেয়েমানুষ।

নিমাই বলে, ঘরে যা মনো, শুয়ে থাক গে।

ঘুম আসে না বলেই তো আসি। রাতটা যে কাটতে চায় না।

এত রাতে এই যে আসিস, এটা ভাল দেখায় না।

খারাপেরই বা কি বলে? আমাদের তো দুকান কাটা। লজ্জা কাকে? তোমার বউ তোমাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে আর আমার বর আমাকে নেয় না। তো কাকে আর পরোয়া?

ওরকমভাবে বলতে নেই, ভাবতেও নেই।

তুমি বড্ড ভিতু মানুষ গো।

খুব ভিতু। আমাকে দিয়ে তোর কিছু হবে না।

কেন হবে না শুনি? নন্দ নেয় না বলে তো আর পচে যাইনি।

পচতে চাইছিস কেন?

মনো চুপ করে ইটের ওপরে বসে থাকে। মাথা নিচু করে কাঁদেও কিছুক্ষণ। ঘর বলতে সামন্যই একখানা খুপরি। সেখানে তার ছছাট্টো একটা মেয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে তালা দিয়ে মনে চলে আসে রোজ।

দেখ মনো, তোর জন্য আমাকে না এ জায়গা ছাড়তে হয়। যদি জ্বালাতন করি তবে আমি এখানকার পাট তুলে চলে যাবে কিন্তু।

পাঁচটা টাকা দেবে?

পরশু তো দিয়েছি।

পরশুর টাকা আজ অবধি থাকে। পাঁচ টাকায় কী হয় বলো!

এরকম করে যদি রোজ চাস তাহলে আমার চলে কি করে?

তোমার আবার অভাব! দিব্যি তো লুটেপুটে পাচ্ছে। দাও না পাঁচটা টাকা। দোকানে যে আর ধার দেয় না।

কাজে লেগে যা-না।

কাজ কি করি না নাকি? তিন বাড়ি ঝি খাঁটি। তাতে হয়? নন্দ ঘরভাড়া দেওয়া বন্ধ করেছে, হাতে একটা পয়সা দিচ্ছে না।

ও কি কাউকে পুষছে?

তা আবার নয়? পরশু তো তাই নিয়ে কুরুক্ষেত্র হল। আর আসবে না।

সেবা-টেবা ঠিকমতো করতি?

কম করিনি গো। মদের পয়সা কম জুগিয়েছি? নিজের রোজগারের পয়সা ভাঙত নাকি? শুধু ঘরভাড়া দিত আর বাজারটা করত আর মেয়ের খরচটা।

তবে তো মেলাই দিত।

ছাই।

শোন মনো, পুরুষ মানুষকে একটু তোয়াজে রাখলে সে তো পাপোশ। নন্দ লোক খারাপ নয়। ইলেকট্রিকের ভাল কারিগর। একা হাতে নিরঞ্জনবাবুর দুটো গোডাউনের লাইন করেছিল।

তাতে কী হল বলে তো! ভাল কারিগর মানেই কি ভাল মানুষ নাকি?

তা নয়, তবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মতো তো নয়। তু

মি আর ধান ভানতে শিবের গীত গেও না তো! বলতে আসি এক কথা, উনি শোনান আর এক কথা।

কী শুনতে আসিস মনো? যা শুনতে চাস সেই বাক্য তো আমার মুখ দিয়ে বেরোবে না।

তুমি খুব সাধুপুরুষ!

তা নই। তবে ভিতু।

ভয়টা কাকে? আমাকে? না সমাজকে?

সবাইকেই।

ওটা কোনও কথা হল? আমি কি তোমার ক্ষতি করব বলে আসি?

নিমাই চুপ করে থাকে। এ কথার জবাব দিতে গেলে মনো খুব দুঃখ পাবে।

মনো নিজের মনেই বলে, তোমার হোটেলেও তো ঝি লাগে। সেই কাজটাই না হয় দাও আমাকে। তোমার দুটো ভাতও ফুটিয়ে দেবো। আমার ঘরভাড়া আর খোরাকিটা দিয়ে দিও।

মনো, তুই আর কাউকে দেখ।

ইস, আমি যেন ওরকম। একটা না একটা ধরলেই হল বুঝি? তোমার কাছে আসি কি এমনি? ভাল লাগে বলেই না!

আমাকে তোর ভাল লাগে কেন?

লাগলে কি করব?

তোর মাথাটাই গেছে। আমি হলাম একেবারে অপদার্থ লোক। কড়ে আঙুলের মতো মানুষ।

ওই ডাইনি তোমার মাথাটা চিবিয়ে রেখেছে গো! কিছুতেই আর তোমার অন্য দিকে নজর পড়ছে না। তা হ্যাঁ গো, নিমাইদাদা, পুরুষ মানুষের কি একজন নিয়ে চলে? কত পুরুষ দেখলাম।

দেখেছিস। ভাল।

অমন ফাঁকা গলায় কথা কইছে কেন? ওই যে নিরঞ্জনবাবু, কতটা চেনে ওঁকে? যখন আগেরবার এখানে ঠিকাদারি নিয়ে এলেন তখন দেখেছি, রাতে ফুলিয়া বলে একটা কামিনকে রোজ ঘরে নিত।

জানি।

জানো?

জানব না কেন? সবাই জানে। ওটা হল দুপক্ষের বন্দোবস্ত। এরও দরকার, ওরও দরকার।

তোমার বুঝি দরকার নেই?

নিমাই মাথা নাড়ে, না। তুই ঘরে যা।

ঘরে যায় বটে মনো, কিন্তু দুতিন রাত্তির পর ফের আসে।

কয়েকটা টাকা দাও নিমাইদাদা, শোধ দিতে পারব না। অন্য দিকে পুষিয়ে দেবো।

ও সব বলতে নেই রে।

তুমি কী বলো তো!

আমি একটা কিছু না। বুঝতে তোর দেরি হচ্ছে কেন?

তোমার বদনামের ভয় তো! এখানে কে তোমার বদনাম করবে? সবকটাই তো বদমাশ।

সবাই বদমাশ হলে কি চন্দ্ৰ সূৰ্য উঠত? সবাই বদমাশ যদি বা হয় তাতেই কি আমাদেরও সব বাঁধ ভেঙে দিতে হবে?

আচ্ছা লোক তুমি মাইরি।

শুয়ে থাকগে মনো। মাথা ঠাণ্ডা কর গে।

টাকা দেবে না?

শুধবি কি করে?

ঠিক শুধবো।

ও হয় না রে। আমাকে টাকার ফেরে ফেলিস না। আমি বড় গরিব।

মনো কাঁদে। হার মানে। শেষে বলে, মোটে বিশ-বাইশ বছর বয়স আমার, এই বয়সেই সব চলে গেল। তোমার মায়া হয় না।

দুর পাগল! মায়া হবে না কেন? মায়া হলেই কি ঘর করতে হয় নাকি?

মনে চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, মেয়ে হয়ে জন্মালে বুঝতে পারতে কেমন ঘেন্নার জীবন আমাদের। একটা পুরুষ মানুষ না হলে আমাদের সব নেতিয়ে পড়ে। সেই পুরুষ আমাকে পছন্দ করবে কিনা, আমাকে রাখবে কিনা তাই নিয়েই সারাক্ষণ বুকের মধ্যে ধুকুপুকু। মেয়েমানুষের বেঁচে থাকাটাই কত ঘেন্নার কথা।

তুই অমন অস্থির হচ্ছিস কেন? ধৈর্য ধরে দেখ কী হয়।

উপদেশ দিও না গো। সব জানি। আমাদের আবার কী হবে। লেখাপড়া জানি না, রূপ নেই, টাকা নেই। আমাদের মতো মেয়েদের গতি কি হয় জানোনা? শেষ অবধি গিয়ে ভাগাড়ে পড়তে হবে। শেয়াল-শকুনে ছিঁড়ে যাবে। মা গো!

উঃ! ও সব কথা বলিস না মনে। বলব না।

চোখের সামনে যা সব দেখছি।

ব্যথিত, দুঃখিত নিমাই চুপ করে বসে থাকে। সে তো আর অন্ধ নয়। মেয়েমানুষের মাংস নিয়ে ব্যবসা সে কিছু কম দেখেনি।

তুমি লোক বড় ভাল গো, নিমাইদাদা। আমার একটা গতি করে দাও। নইলে কিন্তু কপালে আমার লাইনে নামাই আছে।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনোর গতি সে কি করে করবে বুঝতে পারে না। তার ছোট্টো কারবারে তো বেশি লোক লাগে না। তার চেয়ে বড় কথা, মনো কাছাকাছি থাকলে তার বিপদের ভয়টাও থেকে যাবে।

মনে চলে যাওয়ার পরও নিমাই বসে বসে অনেকক্ষণ মেয়েমানুষ নিয়ে ভাবে। বীণাপাণিও মেয়েমানুষ। যখন বিয়ে হয়ে কিশোরী বীণাপাণি এল তখন ভিতু, ছোটোখাটো, অভিমানী, সোহাগী মেয়েটা যেন নিমাইয়ের অন্ধকার জীবনটাই আলোয় ভরে দিয়েছিল। বীণাপাণি আজও নিমাইয়ের কাছে পুরোনো হয়নি। আজও রোজ, সর্বদা মনের মধ্যে বীণাপাণির যাতায়াত। কিন্তু বীণাপাণি নিমাইয়ের কাছে যা, অন্যের কাছে তো তা নয়। সে যাত্রার নটী, একা, অভিভাবকহীন। সেও

তো লোভী পুরুষের চোখে নারীমাংস ছাড়া আর কিছু নয়।

বুকটা বড় ব্যথিয়ে ওঠে নিমাইয়ের। বুকের মধ্যে যেন এক শূন্য প্ৰান্তরে শুকনো বাতাস হু হু করে বয়ে যায়। আজও বীণা তার খোঁজ নেয়নি। বছর ঘুরতে চলল।

পতিতপাবন দত্ত মশাইয়ের তুলো আর তোশক-বালিশের কারবার উঠে যাচ্ছে। দোকানখানা বন্দোবস্তে নিয়ে ফেলল নিমাই। নিজের টাকাতেই কুলিয়ে গেল। তবে দোকান নিলেই তো হল না। চেয়ার টেবিল, বেসিন, কল, বাসনপত্র নিয়ে মেলা খরচ।

নিরঞ্জনবাবু বললেন, টাকা দিচ্ছি। সব দিক সামলে ভাল করে দোকান দাও। হিসেবটা ঠিকমতো রেখো। হিসেবের ব্যাপারে তোমার গাফিলতি আছে। আর চৌকিদারের চাকরিটাও তোমাকে করতে হবে না। আমি অন্য লোক দেখে নিচ্ছি।

নিমাই হাতজোড় করে বলে, আজ্ঞে না। ওটা ছাড়ব না। বেতন দিতে হবে না, ওটা আমি বেগার খেটে দেবো।

কোন দুঃখে।

ওটা আমার পয়া চাকরি।

নিরঞ্জনবাবু হাসেন, পাগল আর কাকে বলে! রাত জাগলে দোকান করবে কি করে?

আজ্ঞে পারব।

এত খাটলে শরীর ঠিক রাখতে পারবে?

শরীরের কথা ভাবলেই শরীর বেগড়াই করে। ভগবান শরীর দিয়েছেন খাটানোর জন্য, বসিয়ে রাখার জন্য তো নয়।

তাহলে করা। বেতনও পাবে। কলিকালে সৎ আর সাধুদের তো কলকে নেই। তা তোমার যদি এই ঘোর কলিকালে কিছু উন্নতি হয় তবে বুকে বল ভরসা পাবো। সাধু সজ্জনদের আজকাল বড়ই দুর্গতি।

আমাকে সাধু বলবেন না। তাতে সাধুদের অপমান।

খুব খাটুনি গেল দিন কতক। দোকান ঝাড়পপাছ করা, রং লাগানো, সবই নিজের হাতে করতে হল তাকে। মিস্ত্রি মেলা পয়সা চায়। আর নিজের হাতে করলে যে সুখটা হয় তা মিস্ত্রিকে দিয়ে করালে হয় না।

দোকানটা দাঁড়াল মন্দ নয়। সাইনবোর্ডের কথা একবার ভেবেছিল সে। তারপর ভাবল, চেনা বামুনের পৈতে লাগে না।

পালপাড়া থেকে মা-বাপকে আনাল নিমাই। নদেরাদ এল সঙ্গে। পূজো-টুজো দেওয়া হল দোকানে। খাওয়া-দাওয়া হল।

ও নিমাই, এ কি আমাদের হোটেল? সত্যি?

হ্যাঁ মা, এ নির্যস আমাদেরই হোটেল।

সোনার চাঁদ রে, কি করে করলি বাবা? এ যে বিশ্বাসই হয় না। চেয়ার টেবিল আলো দিয়ে এ যে অশৈলী কাণ্ডকারখানা!

মা-বাপের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারা সৌভাগ্যের কথা। কটা ছেলে করতে পারে তা? নিমাইয়ের বুক ভরে উঠল। একখানা লড়াইতে সে হেরে গেছে বটে, কিন্তু ভগবান তাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেননি।

মাকে বলল, আর পালপাড়ায় পড়ে থাকার দরকার কী মা? হোটেলের পিছন দিকে ঘর আছে। সেখানেই থাকতে পারবে।

মা বলে, তা তুই যা বলিস। তবে সেটা নিজেদের বাড়ি তো। এ হল ভাড়ার ঘর।

নদে মাথা নেড়ে বলে, ও কাজ করতে যেও না নিমাইদা। পালপাড়ার ঠেকটা রেখো। আমি বলি কি একটু চাষের জমিও কিনে রাখো গাঁয়ে। জমির মতো জিনিস নেই।

নিমাই দোনামোনা করে বলল, তাহলে তাই হোক।

দিন যায়। ভালই যায়। হোটেল চলছে রমরম করে। সারাটা দিন শ্বাস ফেলার সময় থাকছে না নিমাইয়ের। নানারকম নতুন নতুন খাবারের কথা মাথায় ঘোরে তার। গোটা কয়েক রন্ধনপ্রণালী কিনে ফেলল সে। দুটো বিয়েবাড়ির অর্ডার পেয়ে মোটা লাভ হল তার। নিরঞ্জনবাবুর টাকা শোধ করতে তিন-চার মাসও লাগল না।

কিন্তু মাঝে মাঝে দুপুরের সামান্য ফাঁকে যখন একটু ঘুমিয়ে নিতে যায় নিমাই বা রাত জেগে গুদাম পাহারা দেয় তখন মনে হয়, এই যে তার এত হচ্ছে-টচ্ছে, এ সব তত বীণা দেখছেও না, জানছেও না। আহা বীণা যদি একবার দেখত। তার মুখে যদি একটু অবাক-হাসি আর সোহগের ভাব ফুটত দেখে। এত পরিশ্রম সার্থক হত তাহলে।

কী নিমাইদা! চিনতে পারছো?

নিমাই অবাক হয়ে দেখে ছেলেটাকে। তারপর আহ্রাদের গলায় বলে, পল্টু! আরে এসে এসো।

পর বনগাঁয়ের লটারির দোকানে অনেক বসে থেকেছে নিমাই। ভাল ছেলে।

তোমার দোকানের কথা শুনেছিলাম। এদিকে এসেছিলাম একটা কাজে। বোনের জন্য সম্বন্ধ দেখতে। তাই এখানে একটা ঢুঁ মারলাম।

ভাল করেছ। বোস।

বসব! কোথায় বসব? তোমার দোকানে তো দেখছি গিজগিজ করছে খদ্দের।

তা একটু হয়। ওরে, এখানে কাউন্টারের পাশে একটা চেয়ার দে তো।

পল্টুর জন্য এক প্লেট মাংস আর পরোটার অর্ডার দিয়ে নিমাই বলল, তারপর ওদিককার খবর কী বলো!

বীণাদির খবরও চাও নাকি?

বীণা ভাল আছে?

ভালই তো। বিশ্ববিজয় অপেরার তো এখন খুব নাম। বীণাদিরও হাল ফিরেছে।

থাক। ভাল থাকলেই ভাল। ঘরখানা কি পাকা করেছে?

তা জানি না। তবে পথে-ঘাটে দেখি, চেহারা ভাল হয়েছে।

নিমাই চুপ করে থাকে। বীণা ভালই আছে। তার মানে তাকে ভুলেছে বীণা। মুছে ফেলেছে জীবন থেকে।

কাকা কেমন আছে পল্টু।

আছে, ভালই আছে। সব ঠিক আছে। একবার যেও বনগাঁয়ে। তোমার কথা খুব মনে হয়। এখানে এসে খুব ভাল করেহ নিমাইদা। তোমার অবস্থা তো দেখছি ফিরে গেছে।

ভগবানের দয়া।

গিয়ে বীণাদিকে সব বলবখন। অবশ্য বীণাদিও খবর রাখে।

রাখে?

খুব রাখে। আমাকে একদিন বলছিল, জানো তো সেই নেমকহারাম লোকটা আমাকে ছেড়ে গিয়ে হোটেল খুলেছে!

বলছিল?

কী বলছিল সেটা বড় কথা নয়। বলছিল যে সেটাই বড় কথা।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৬৩. এরা মাটি ভাগ করতে চায়
পরবর্তী:
০৬৫. জ্যোৎস্না রাতে ছাদের রেলিং-এর ধারে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑