১০. আঞ্চলিক সমস্যা

আঞ্চলিক সমস্যা

শান্তি সুনিশ্চিত করতে হলে প্রথমে কয়েকটি আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান করা দরকার। এ ধরনের সমস্যার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল ফরমোজা, কোরিয়া আর লাওস-এর সমস্যা। এসব ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানসূত্র বাতলানো সহজ নয়। পশ্চিমী দুনিয়া বলে, সকলের আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি মেনে নিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, শুধুমাত্র রাশিয়ার আওতায় থাকা দেশগুলোর ক্ষেত্রেই এ নীতির প্রয়োগ করতে চায় তারা। স্পেন বা পর্তুগালে গণতান্ত্রিক আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিতে তারা রাজি নয়, আর পশ্চিম গোলার্ধের যে সব দেশে কমিউনিস্টরা সংখ্যাগুরু হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে সেইসব দেশে এইসব নীতি কার্যকরি হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য। যে সব আলাপ আলোচনার কথা ভাবা হয়েছে, তার ফল কি হবে বল মুশকিল। একটা ব্যাপারই শুধু নিশ্চিত এ সমস্যার সমাধান আলাপ আলোচনার মারফতই করতে হবে, যুদ্ধের হুমকির মারফত নয়। নিরপেক্ষ কিছু দেশের উপস্থিতিতে পারস্পরিক সমঝোতা মারফত মিটিয়ে নিতে হবে এ সব সমস্যা।

রুশ বিপ্লবের পর থেকেই পশ্চিমী দুনিয়া একটা সেকেলে নীতি আঁকড়ে ধরে আছে। সোভিয়েত সরকারকে দীর্ঘদিন স্বীকৃতি দেয়নি তারা। চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে এখনও স্বীকৃতি দিতে রাজি নয় আমেরিকা আর রাষ্ট্রসংঘ। পূর্ব জার্মানির সরকারকেও স্বীকৃতি দেয়নি পশ্চিমী দুনিয়া কিংবা অডার-নিস সীমান্তের সীমানির্দেশক বৈশিষ্ট্যকেও মেনে নেয়নি। এই শেষোক্ত ব্যাপারটিতে পশ্চিম জার্মানির সরকার এবং সব জায়গায় জার্মানরা রীতিমত ক্ষুব্ধ, কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সংশোধনের ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব। প্রথমত, কমিউনিস্ট শিবির কিছুতেই রাজি হবে না, তবে যুদ্ধে পরাজিত হলে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে পারে। কিন্তু সেই পরাজয় ঘটতে পারে একমাত্র সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধেই, যে যুদ্ধে পশ্চিমী দুনিয়াও একইভাবে পরাজিত হবে এবং খুব সম্ভব পৃথিবীর তাবত সুশৃঙ্খল সরকারই ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, জার্মানির পূর্বতন সীমান্ত ফিরিয়ে আনতে চাইলে সেটা রুশ আর পোল-দের দ্বারা সংঘটিত সেই ভয়াবহ নৃশংসতার বিপরীত পুনরাবৃত্তিকে সুনিশ্চিত করে তুলবে। জার্মানির কিছু অংশ আইনত জার্মানির বাইরে চলে পোল রা, সেই নৃশংসতার কথাই বলছি আমি।

বিদ্যমান কোনো সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে কিন্তু তাকে অনুমোদন করা নয়। স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে বিদ্যমান তথ্যকে স্বীকার করে নেওয়া, আর কিছু নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে এই সত্যটা শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল পশ্চিমী দুনিয়া, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে আজও তারা একটা জিনিস শিখে উঠতে পারেনি। বিশ্বযুদ্ধ না ঘটলে যে সব দেশের সরকারকে উৎখাত করা কিছুতেই সম্ভব নয়, সেইসব দেশের সরকারকে স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রিতা যে কতখানি বুদ্ধিহীনের কাজ- সেটাই তারা শিখে উঠতে পারেনি আজও।

এই মুহূর্তের সব থেকে জটিল ও বিপজ্জনক আঞ্চলিক সমস্যা হচ্ছে জার্মানি আর বার্লিনের সমস্যা। এ সঙ্কট এতই তীব্র হয়ে উঠেছে যে এ প্রসঙ্গে বলা যে কোনো কথা ছাপা হওয়ার আগেই সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। তবু দু-চার কথা বলা দরকার। উভয় পক্ষের শক্তি প্রদর্শনের পথে এর সমাধান করা অসম্ভব, অথচ বাস্তবে ঠিক তা-ই চলছে। যেমন, আমেরিকার নৌ অভিযানের প্রধান অ্যাডমিরাল বার্ক ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যা-ই করুক না কেন, তাকে ধ্বংস করে দেওয়ার শক্তি যতদিন আমাদের আছে ততদিন বড় মাপের কোনো যুদ্ধ বাধবে বলে আমার মনে হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করে দেওয়ার শক্তি এখন আমাদের আছে (দ্য টাইমস, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১০৬১)। ১৯৬১ সালের ৯ জুলাই এক বক্তৃতায় মিঃ ক্রুশ্চেভ-ও একই কথা বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা তার মিত্রদের কেউ আক্রমণ করলে তাকে উপযুক্ত প্রতিফল পেতে হবে। সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ থার্মো-নিউক্লিয়ার অস্ত্র আছে, সেই সঙ্গেই আছে সেগুলোকে নিক্ষেপ করার অত্যুন্নত উপায়–স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার রকেট এবং আন্তমহাদেশীয় রকেট। কেউ যদি ভেবে থাকে দূরে থাকলে বেঁচে যাবে, তাহলে ভুল করছে।

সাম্রাজ্যবাদীরা কোনো যুদ্ধ শুরু করে দিলে সে-যুদ্ধ শেষ হবে সাম্রাজ্যবাদের পরিপূর্ণ পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে। যে ব্যবস্থা লুঠেরাবাজ যুদ্ধের জন্ম দেয়, সেই ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে চিরদিনের মতো (দ্য টাইমস, ১০ জুলাই ১৯৬১)। অ্যাডমিরাল বার্ক এবং মিঃ ক্রুশ্চেভের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমি একমত যে তাদের বাহিনী শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু তারা দুজনেই যা খেয়াল করছেন না তা হল- শত্রুপক্ষও তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এইসব হুমকি দিয়ে কোনো সমাধানের দিকে এগানো যায় না, বরং যুদ্ধের সম্ভাবনাই বাড়ে। এই মুহূর্তের সমস্যা পশ্চিম বার্লিনকে ঘিরে। সকলেরই মনে রাখা দরকার-যুদ্ধ বাধলে পশ্চিম বার্লিনের প্রায় সমস্ত বাসিন্দাই মারা যাবে।

পশ্চিম বার্লিনের সমস্যা খুবই জটিল। অল্পকথায় সমস্যাটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নীতি গৃহীত হয়েছিল, ফলে কোনো শান্তিচুক্তি মারফত যুদ্ধ শেষ হয়নি, শেষ হয়েছিল জার্মানিকে কিভাবে শাসন করা হবে তা নিয়ে বিজেতাদের মধ্যে এক চুক্তি মারফত। চার ভাগে ভাগ করা হয়েছিল জার্মানিকে: আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসি আর রাশিয়ান। যে ভাগটা যার অধীনে, সে ভাগটা সেই দেশই শাসন করবে। বার্লিনের চারপাশে ঘিরে ছিল রাশিয়ান এলাকা। বার্লিনকেও চার ভাগে ভাগ করা হয়েছিল এবং চারটি দেশ চারটি ভাগে সর্বেসর্বা ছিল। এইখানে পশ্চিমী দুনিয়া একটা বোকার মতো কাজ করে-তাদের এলাকা থেকে রাশিয়ানদের এলাকায় যাতায়াতের স্বাধীনতা রাখার কোনো ব্যবস্থা করেনি তারা। এর সুযোগ নিয়ে ১৯৪৮ সালে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয় রাশিয়ান। পশ্চিমী দেশগুলো তখন বিমানে করে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে এবং রাশিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন পশ্চিম বার্লিনে যাওয়া এবং পশ্চিম বার্লিন থেকে বাইরে কোথাও আসার স্বাধীনতা সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে রাশিয়া। পশ্চিমী দুনিয়ার অধিকারভুক্ত জার্মানির তিনটি অংশ ততদিনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক স্বশাসন চালু করে দিয়েছিল। পশ্চিমী দুনিয়ার অধিকারভুক্ত বার্লিনের তিনটি অংশেও গণতান্ত্রিক স্বশাসন চালু করা হয়। জার্মানি বা বার্লিন সংক্রান্ত যাবতীয় আলাপ আলোচনার বৈধতা ইয়ালতা আর পটল্ডাম-এর চুক্তির ওপর নির্ভরশীল। জার্মানির সঙ্গে যতদিন কোনো শান্তিচুক্তি করা না যাচ্ছে, ততদিনের জন্যই এই চুক্তিগুলো করা হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম, এই দুই অংশে জার্মানি বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে এ রকম কোনো শান্তিচুক্তি আজ পর্যন্ত করা যায়নি। রাশিয়ান সরকার এখন ঘোষণা করেছে যে পূর্ব জার্মানির সঙ্গে তারা একটা চুক্তি সম্পাদন করবে যার ফলে যুদ্ধের সময় রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিটি আর কার্যকরী থাকবে না, আর তার ফলস্বরূপ পশ্চিম বার্লিনের বৈধ মর্যাদাও বিলুপ্ত হবে–অবশ্য পশ্চিমী দুনিয়ার ধারণা এ রকম কোনো চুক্তি সম্পাদনে রাজি হবে না পূর্ব জার্মানি, আর সোভিয়েত সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে যে এ রকম কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য পূর্ব জার্মানির ওপর কোনো চাপ দেবে না তারা।

এ সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হলো পশ্চিম বার্লিনের সঙ্গে পশ্চিম জার্মানির অবাধ যোগাযোগের অধিকার। এ-অধিকার না থাকলে পশ্চিম বার্লিন পুরোপুরিভাবে পূর্ব জার্মানির দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আবার যেহেতু পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত সরকারের অধীন, সেহেতু পশ্চিম বার্লিনকেও টিকে থাকতে হলে সোভিয়েত সরকারের যে কোনো শর্ত মেনে নিতে হবে।

এক্ষেত্রে পশ্চিমী দুনিয়ার প্রায় কিছুই করার নেই। পশ্চিম বার্লিনের ব্যাপারে তাদের অধিকার আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এই চুক্তিকে একতরফাভাবে বাতিল করা সম্ভব নয়। সমগ্র জার্মানির সঙ্গে অথবা তার দুটি অংশের সঙ্গেই কোনো সাধারণ শান্তিচুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকরি থাকবে। ক্রুশ্চেভ এ ধরনের চুক্তির পক্ষপাতী, কিন্তু তিনি বলেছেন আমেরিকা তাতে রাজি না হলে রাশিয়া একাই পূর্ব জার্মানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করবে এবং ধরে নেবে সেই চুক্তিবলে পশ্চিম বার্লিনের ওপর পশ্চিমী দুনিয়ার যাবতীয় অধিকারের অবসান ঘটল। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মোটেই বৈধ বলা চলে না।

পারমাণবিক যুদ্ধ পরিহার করতে হলে যা করা দরকার, ক্রুশ্চেভ তা করছেন। যুদ্ধের হুমকি দিয়ে তিনি বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাইছেন, যে পরিবর্তন রাশিয়ার পক্ষে খুবই সুবিধাজনক এবং আমেরিকার পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক হবে। উভয় তরফের পক্ষেই পারমাণবিক যুদ্ধের থেকে বেশি বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না, অতএব বর্তমান অবস্থার যে কোনো পরিবর্তন আলোচনার সাহায্যেই ঘটাতে হবে, যুদ্ধের হুমকি দিয়ে নয়। অনেকে বলতে পারেন, পারমাণবিক যুদ্ধই যেহেতু সব থেকে বিপজ্জনক সম্ভাবনা, সেহেতু এক পক্ষ যুদ্ধের হুমকি দিলে অপর পক্ষের চুপ করে থাকাই উচিত। কিন্তু কোনো দেশই চুপ থাকতে রাজি হবে না। জাতীয় অহমিকা আর সেইসঙ্গে নিজেকে সঠিক বলে মনে করার প্রবণতা-এই দুয়ের প্রভাবে যে কোনো হুমকির জবাবে পাল্টা হুমকি আসতে বাধ্য। ঠিক এই জন্যই যুদ্ধের কাছাকাছি পর্যন্ত এগোনোর নীতিটি এত বিপজ্জনক। এই মুহূর্তে উভয় পক্ষই এই নীতি অনুসরণ করছে এবং বার্লিনের ব্যাপারে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য রাশিয়াই প্রধানত দায়ী।

পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দাদের জীবনকে যন্ত্রণাময় করে তোলার চেষ্টা কেন করছে রাশিয়া তা তারা প্রকাশ্যে বলেনি, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। পূর্ব জার্মানি আর পূর্ব বার্লিন দরিদ্র অঞ্চল, সেখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই তাদের সরকারকে ঘৃণা করে। পশ্চিম জার্মানি আর পশ্চিম বার্লিন সমৃদ্ধিশালী এলাকা, সেখানকার সরকারও জনপ্রিয়। পূর্ব জার্মানির বহু বাসিন্দা পশ্চিম জার্মানিতে চলে গেছে। তবে এভাবে যাওয়া সম্ভব ছিল ততদিনই যতদিন পশ্চিম বার্লিনে যাওয়ার উপায় ছিল তাদের এবং পশ্চিম বার্লিন আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যে যোগাযোগ চালু ছিল। কমিউনিস্ট শিবিরের কাছে এই অবস্থাটা নিতান্তই অপমানজনক। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে এর একমাত্র সমাধান হলো-পশ্চিম বার্লিনকেও পূর্ব বার্লিনের মতো দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত করে তোলা এবং পশ্চিম বার্লিন থেকে পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়ার পথটা বন্ধ করে দেওয়া। মানবিকতাসম্পন্ন কোনো মানুষই এ ধরনের কাজ সমর্থন করতে পারেন না।

তবে বার্লিন সমস্যার ব্যাপারে পশ্চিমী দুনিয়ার ভূমিকাতেও প্রাজ্ঞতার ছাপ নেই। পশ্চিম বার্লিনের অবস্থার ব্যাপারে নিশ্চিত পাওয়া গেলে পূর্ব জার্মান সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ পশ্চিমী দুনিয়ার থাকত না। পূর্ব জার্মানির সরকারকে পশ্চিম বার্লিনের বর্তমান অবস্থান বজায় রাখতে এবং বহির্জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে দিতে রাজি হতো কি না, তা জানার জন্য পশ্চিমী দেশগুলোর চেষ্টা করা উচিত ছিল। এ ব্যাপারে পূর্ব জার্মান সরকার ঠিক কি চায় তা পশ্চিমী দুনিয়া আজও জানে না। অনর্থক সঙ্কট বাড়িয়ে তুলে যুদ্ধ বাধিয়ে তো কোনো লাভ নেই। এখনই পূর্ব জার্মানির সঙ্গে পশ্চিমী দুনিয়ার চুক্তি সম্পাদন করা দরকার। সে চুক্তিতে পূর্ব জার্মানিকে আমরা স্বীকৃতি দেব আর পূর্ব জার্মানি দেবে পশ্চিম বার্লিনের অবস্থার পরিবর্তন না ঘটানোর নিশ্চিত। অনেকে গোটা বার্লিনকে এক মুক্ত শহর-এ পরিণত করার কথা বলছেন। সেটা করা হলে পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে বার্লিনের অবাধ যোগাযোগ সম্ভব হবে কি না তা কেউই বলতে পারছে না, তবে যদি তা সম্ভব হয় তাহলে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করাই যায়। অবাধ যোগাযোগের জন্য টেমপেলহফ-এ পশ্চিম বার্লিনের বর্তমান বিমানবন্দরটি থাকা একান্তই প্রয়োজনীয়, অথচ পূর্ব জার্মানি চায় ওই বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত হোক। টেমপেলহফের এই বিমানবন্দরটির দৌলতেই অবরোধের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল পশ্চিম বার্লিন।

পশ্চিমী দৃষ্টিকোণ অনুসারে পরিস্থিতির জটিলতার মূল কারণ হলো পশ্চিম বার্লিনের স্থানীয় কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে না পারা। চারপাশের পুরো এলাকাটাই রাশিয়ান বাহিনীর সামনে উন্মুক্ত। এ অবস্থায় পশ্চিমী দুনিয়াকে কোনো কার্যকরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ ছাড়া অন্য উপায় নেই। সে যুদ্ধি যদি বাধে, তাহলে পূর্ব বার্লিন আর পশ্চিম বার্লিনের সমস্ত মানুষই মারা যাবে।

পশ্চিমী দুনিয়া বার্লিন সমস্যাটিকে কোনো মধ্যস্থের হাতে ছেড়ে দিতে পারে এবং যেসব দেশ নিজেদের শান্তিকামী দেশ বলে তাদের যুদ্ধ হুমকির বিরুদ্ধে পৃথিবীর তাবত অ-কমিউনিস্ট দেশকে একজোট করতে পারে। মিঃ ডিন রাস্ক সম্প্রতি অনেকটা এই ধরনেরই একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে কোনো পক্ষই এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নেবে কি না, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে।

শুধু বার্লিন নয়, গোটা জার্মানির অবস্থাটাই শান্তির দিকে এগোনোর পথকে জটিল করে তুলছে। প্রায় প্রত্যেক জার্মানই ঐক্যবদ্ধ জার্মানি ফিরে পেতে চান। যতদিন জার্মানির এক অংশ কমিউনিস্ট এবং অন্য অংশটি অ কমিউনিস্ট থেকে যাবে, ততদিন ঐক্যবদ্ধ জার্মানি গড়ে তোলা খুবই দুষ্কর। সম্প্রতি ক্রুশ্চেভ রাপাকি পরিকল্পনার কথা বলেছেন। এই পরিকল্পনার মূল বক্তব্য হল–সমগ্র জার্মানি আর তার পূর্বদিকের আরও কিছু দেশকে নিরস্ত্রীকৃত ও নিরপেক্ষ করতে হবে এবং রাশিয়া ও পশ্চিমী দুনিয়া উভয়ের সম্মতিক্রমে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হবে তাদের। বিশ্বশান্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ এক চমৎকার প্রস্তাব, পশ্চিমী দেশগুলোর উচিত একে সমর্থন করা। কিন্তু পশ্চিমী দেশগুলো তা করবে বলে মনে হয় না। অ্যাডেনয়ের এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছেন, যিনি সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী এক জার্মানি গড়ে তুলতে চান। আমেরিকা, ব্রিটেন আর ফ্রান্সও এর বিরোধিতা করেছে, যারা রাশিয়াকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে জার্মানির সশস্ত্র সহযোগিতার প্রত্যাশী। পশ্চিমী দুনিয়ার কেউই বোধহয় খেয়াল করেননি যে রাপাকি পরিকল্পনায় বেশ কিছু কমিউনিস্ট দেশের, নিরস্ত্রীকরণের কথাও বলা হয়েছে, অতএব পশ্চিম জার্মানির নিরস্ত্রীকরণের ফলে ভারসাম্যের কোনো হেরফের ঘটবে না।

পশ্চিম জার্মানির ওপর পশ্চিমী দেশগুলোর নির্ভরতার কিছু বিপজ্জনক দিককে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়। জার্মান সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বে যে-সব জেনারেলরা আছেন তাদের বহুজনই প্রাক্তন নাৎসি। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান পুনরুত্থান একটা নজির হিসেবে কাজ করতেই পারে। ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে জার্মান সৈন্যবাহিনীর একটা অংশকে ব্রিটেনে রাখা হয়েছে। ১৯৪০ সালে আমরা সবাই যা অনুভব করেছিলাম, কত দ্রুত তা বিস্মৃত হয়েছি আমরা।

সার্বজনীন ও সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণের যে প্রস্তাব ক্রুশ্চেভ দিয়েছিলেন, তা গৃহিত হলে এই মুহূর্তের যাবতীয় সমস্যার সমাধান অনেক সহজেই করা যেত। রাপাকি পরিকল্পনাটি জার্মানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, কারণ দেখা যাচ্ছে এই পরিকল্পনা অনুযায়ী একমাত্র জার্মানি বাদে আর কোনো বৃহৎ শক্তিকে নিরস্ত্রীকৃত করা হবে না। সার্বজনীন নিরস্ত্রীকরণ ঘটলে এ আপত্তি তোলার কোনো সুযোগই থাকত না।

জার্মানি ও বার্লিনের সমস্যার ব্যাপারে পূর্ব এবং পশ্চিমের কোনো বৃহৎ শক্তিই এখনও পর্যন্ত কোনোরকম কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ আরও বেড়ে উঠলে উভয় পক্ষই হয়তো যুদ্ধের কিনারা থেকে সরে আসবে এবং সেখানকার মানুষদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় খুঁজে বার করবে। তবে এটা খুবই সম্ভব যে জাতীয় অহমিকা এবং হুমকির কাছে মাথা না–নোয়ানোর জেদ কোনো পক্ষকেই থামতে দেবে না, ফলে শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক মুগ্ধতায় উভয় পক্ষই ধ্বংস হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *