০৭. বিশ্বসরকারকে অপছন্দ করার কারণ

বিশ্বসরকারকে অপছন্দ করার কারণ

বিশ্বসরকারের পক্ষে প্রধান যুক্তি হল যথাযথভাবে গঠিত হলে এই সরকার যুদ্ধকে প্রতিহত করতে পারবে। বিশ্বসরকার নামে চিহ্নিত কোনো অধিজাতিক সংগঠন গড়ে তোলা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়, তবে সেই সংগঠন যুদ্ধকে কার্যকরিভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না। পৃথিবীর তাবত সৈন্যবাহিনীর যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ যে বিশ্বসরকারের অধীনে থাকবে তাকে যত বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হবে, তত বিরোধিতা এ ধরনের কোনো অধিজাতিক সংগঠনকে সইতে হবে না। পৃথিবীর তাবত সৈন্যবাহিনীর যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্বসরকারের অধীনে থাকাটা যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের অপরিহার্য শর্ত, কাজেই বিশ্বসরকার নামে চিহ্নিত অথচ তার থেকে কম কর্তৃত্বসম্পন্ন কোনো সংস্থার কথা বিবেচনা করতে আমি রাজি নই। পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে প্রকৃত বিশ্বসরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের আপত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই ধরনের আপত্তিগুলো নিয়েই এখানে আলোচনা করব আমি।

সব থেকে জোরদার আপত্তিটা উঠে আসে জাতীয়তাবাদী মনোভাব থেকে। যখন আমরা বলি, ব্রিটেনের বাসিন্দারা কখনও কারুর দাস হতে পারে না, তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে, আর, স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করলেও মনের গভীরে আমরা অনুভব করি যেকোনো মুহূর্তে যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধ সংঘটিত করার অধিকার হারালেই আমরা দাসে পরিণত হব। বিগত দেড়শো বছর ধরে জাতীয় স্বাধীনতার অনুভূতি দ্রুত বেড়ে চলেছে। বিশ্বসরকার গঠন করতে হলে এই অনুভূতির প্রতি অবশ্যই দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে এবং তাকে পরিতৃপ্ত করার যথোচিত ব্যবস্থাও করতে হবে।

অবাধ জাতীয় স্বাধীনতার স্বপক্ষে যারা ওকালতি করেন তারা ভুলে যান যে তাঁদের প্রদর্শিত কারণগুলো অবাধ ব্যক্তি-স্বাধীনতাকেও ন্যায্য প্রতিপন্ন করবে। স্বাধীনতাপ্রীতির ব্যাপারে প্যাট্রিক হেনরি কিংবা অন্য কারুর মতকেই মেনে নিচ্ছি আমি। আমার মতে, এই পৃথিবীতে যদি যথাসম্ভব স্বাধীনতা থাকে, তাহলে অন্যদের স্বাধীনতায় যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করাকে প্রতিহত করার জন্য উপযুক্ত বিধিনিষেধও থাকা দরকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে এই সত্যটা সকলেই মেনে নিয়েছে : পৃথিবীর সর্বত্রই নরহত্যা বেআইনি ঘোষিত হয়েছে। নরহত্যা বিরোধী আইন বাতিল করা হলে একমাত্র হত্যাকারীরা ছাড়া বাকি সকলেরই স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যেত। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারীদের স্বাধীনতাও খুব বেশিদিন স্থায়ী হতো না, কারণ কিছুদিনের মধ্যে তারা নিজেরাও খুন হয়ে যেত। অল্প কয়েকজন নৈরাজ্যবাদী ছাড়া বাকি সকলেই রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা স্বীকার করেন, কিন্তু সারা পৃথিবীর সঙ্গে কোনো রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না।

এটা সত্য যে সেই গ্রোটিয়াসের আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের বহু চেষ্টা হয়েছে। এইসব প্রয়াসকে সম্মান না জানিয়ে কোনো উপায় নেই। আন্তর্জাতিক আইন সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনে শ্রদ্ধা সৃষ্টি করার ব্যাপারেও এইসব প্রয়াসের এক বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু এইসব প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক আইনের ধারাগুলো মানা না মানার ব্যাপারটাকে বিভিন্ন দেশের ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইনকে কার্যকর করার ক্ষমতা না থাকলে সে আইন নিছকই প্রহসন, আর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করার ক্ষমতা কারুরই থাকতে পারে না। বর্তমানে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের মর্জিমাফিক যেকোনো সময়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিবাসীদের হত্যা করার সুবিধা ভোগ করে থাকে, যদিও এই স্বাধীনতাটাকে সত্য ও ন্যায়ের স্বার্থে আত্মত্যাগের বীরোচিত সুবিধার মোড়কেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। দেশপ্রেমিকরা সব সময় দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার কথাই বলে থাকেন, দেশের জন্য হত্যা করার কথা বলেন না।

যুদ্ধ ব্যাপারটা দীর্ঘকাল ধরে মানবজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, ফলে আমাদের অনুভূতি ও কল্পনা দিয়ে আমরা বুঝেই উঠতে পারি না যে বর্তমান নৈরাজ্যময় জাতীয় স্বাধীনতার সম্ভাব্য পরিণতি মৃতদের স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। যুদ্ধকে প্রতিহত করার মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলে বর্তমানে পৃথিবীতে যতটুকু স্বাধীনতা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতার অধিকারী হয়ে উঠব আমরা, ঠিক যেমন ব্যক্তিগত হত্যা নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে আমরা অনেক বেশি স্বাধীনতার অধিকারী হয়েছি।

কিন্তু যতদিন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী মনোভাব এখনকার মতোই জোরদার থেকে যাবে, ততদিন জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর যে কোনো কার্যকরি বিধিনিষেধ বহুজনেরই বিরাগভাজন হবে। ধরা যাক পৃথিবীতে একটি মাত্র নৌবাহিনী আছে এবং বিভিন্ন দেশের থেকে পালাক্রমে সেই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নির্বাচন করা হবে। এ অবস্থায় ব্রিটেনের অধিকাংশ দেশপ্রেমিকই বলে উঠবেন, যে ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে এক সময় গৌরবের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন নেলসন, সেই বাহিনীকে আজ একজন রাশিয়ান পরিচালনা করবে! জাহান্নামে যাক অমন ভাবনা! এই কথা বলার পর সেই দেশপ্রেমিক ব্যক্তিটি আর কোনো যুক্তিতে কানই দেবেন না। তিনি বলবেন–একটা আন্তর্জাতিক বাহিনীকে তাঁর দেশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হতে পারে। অধিকাংশ দেশই কোনো না কোনো সময়ে এমন কিছু কাজ করেছে যেগুলোকে বিশ্বসরকার দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবেই ঘোষণা করত। এই ধরনের কিছু জঘন্যতম অপরাধী কিছু লোকের কাছ থেকে যথেষ্ট মানসম্মানও পেয়েছে, যে সব লোকেরা নিজেদের উদারপন্থি বলে মনে করত। ইতিহাসে এর সব থেকে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো বায়রন ও হাইনের মতো মানুষদের নেপোলিয়নকে শ্রদ্ধা করা। বিশ্বসরকার বাস্তাবায়িত হওয়ার আগে মানুষকে বোঝাতে হবে গণহত্যার অত্যাধুনিক অস্ত্রসমূহ বিদ্যমান থাকতে আন্তর্জাতিক নৈরাজ্য একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কাজটা খুবই দুরূহ, তাছাড়া শক্তিশালী সরকারগুলোর বিরোধিতার ফলে সেটা দুরূহতর হয়ে উঠবে।

বিশ্বসরকারের বিরুদ্ধে আর একটি আপত্তি এই মুহূর্তে অত্যন্ত জোরদার হয়ে উঠেছে, বিশেষত কমিউনিস্ট দেশগুলোতে। আপত্তিটা হলো–বিশ্বসরকার হয়তো বর্তমান অবস্থাকেই পাকাঁপোক্ত করে তুলবে। কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট বিরোধীদের মধ্যেকার বিরোধ যতদিন এখনকার মতোই তীব্র থেকে যাবে, ততদিন এমন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন যে সংস্থা কোনো দেশকে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যেতে বাধা দিতে পারে। এমন একটা বিজ্ঞপ্তি অবশ্য জারি করা যেতেই পারে যে। প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব অর্থনীতিকে যেভাবে খুশি বিন্যস্ত করতে পারবে, তবে এই স্বাধীনতাকে বাস্তবে কতটা মূল্য দেওয়া হবে সে ব্যাপারে সংশয়ের অবকাশ আছে। বিশ্বসরকারকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের সরকারগুলোর পারস্পরিক সহনশীলতা এখনকার চেয়ে অনেক বাড়িয়ে তুলতে হবে। জাতির আত্মম্ভরিতা যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। ঠিক আজকের মতোই তখনও প্রতিটি দেশ মনে করতেই পারে সব ব্যাপারেই অন্য সব দেশের থেকে তারা উন্নত, কিন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সময় আলোচকদের কর্তব্য হবে নিজেদের এই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে প্রকাশ না করে সৌজন্য প্রকাশ করা। জাতীয়তাবাদী মনোভাব যতদিন এখনকার মতোই তীব্র থেকে যাবে, ততদিন এ কাজটা করা খুব সহজ হবে না।

বিশ্বসরকারের বিরুদ্ধে আর একটি যুক্তিও হামেশাই শোনা যায়। অনেকে মনে করেন বিশ্বসরকার গঠিত হলে সামরিক স্বেচ্ছারিতার এক নতুন বিপদ জন্ম নেবে। আন্তর্জাতিক সৈন্যবাহিনী যদি কোন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং নিজেদের সর্বাধিনায়ককে পৃথিবীর অধীশ্বরের পদে বসায়, তাহলে কে তাকে ঠেকাবে? এই যুক্তি যারা দেন তারা উপলব্ধি করতে পারেন না যে এই মুহূর্তে প্রতিটি দেশের নিজেদের মধ্যেও ঠিক একই সমস্যা আছে। সমস্যাটা খুবই বাস্তব। সব থেকে সভ্য দেশগুলোতে না হলেও বহু দেশেই নানারকম অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে সামরিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর প্রধান দেশগুলোতে সৈন্যবাহিনীর ওপর অসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণও যথেষ্ট কার্যকরিভাবেই চালু করা গেছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় উত্তরাঞ্চলের বাহিনীগুলোর জন্য একজন প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন লিঙ্কন। সেই সময় অনেকেই তাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে তাঁর মনোনীত ব্যক্তিটি একনায়কত্ব দাবি করতে পারে। সেই ব্যক্তিটির কাছে লেখা একটি চিঠিতে এই হুঁশিয়ারি কথা উল্লেখ করে লিঙ্কন লিখেছিলেন, একনায়ক হওয়ার উপায় হলো বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করা। সেই জয়ের জন্য আপনার ওপরেই ভরসা রাখছি আমি আর তার জন্য একনায়কত্বের ঝুঁকিটাও গ্রহণ করেছিল। সংস্কার বিলকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ডে যখন সংঘাত দেখা দেয়, তখন ওয়েলিংটন মনোপ্রাণে সংস্কারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু নিজের যাবতীয় খ্যাতি সত্ত্বেও পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রেরণের কথা ভাবেননি তিনি। রাশিয়ায় স্তালিন যখন কয়েকজন সৈন্যাধ্যক্ষের ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন, তখন তাদের প্রাণদণ্ড দিতে কোনো অসুবিধাই হয়নি তার। যে গৃহযুদ্ধের পরিণতিতে রাশিয়ায় সোভিয়েত সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সেই গৃহযুদ্ধের পর থেকেই সোভিয়েত রাশিয়ায় সৈন্যবাহিনীর ওপর সরকারের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজকের দিনের বিভিন্ন দেশের সরকার সৈন্যবাহিনীকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখে, বিশ্বসরকারের পক্ষে সৈন্যবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ রাখাটা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হবে–এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সরকারকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে, কিন্তু এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে সেই বিপদের মোকাবিলার জন্য যে-সব পদ্ধতি উদ্ভাবিত হবে সেগুলো আজকের দিনের বিভিন্ন বড় বড় রাষ্ট্রে অনুসৃত পদ্ধতির থেকে কম ফলপ্রসূ হবে।

বিশ্বসরকারের প্রতি বিশ্বস্ততার ধারণাটা সর্বত্রই ছড়িয়ে দিতে হবে, সব থেকে বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে। পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে যেমন বলা হয়েছে তেমনভাবে সৈন্যবাহিনীর প্রতিটি বৃহৎ ইউনিটকে যদি বিভিন্ন জাতির মানুষের সমন্বয়ে গড়ে তোলা যায়, তাহলে সেই বাহিনীর কোনো অংশের পক্ষে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহী সৃষ্টি করা একেবারে অসম্ভব না হলেও রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠবে।

বিশ্বসরকার প্রতিষ্ঠার পথে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক ধরনের একটা বাধাও আছে। এই সরকার গড়ে উঠলে বহিঃশত্রুর ভীতি বলে আর কিছু থাকবে না, এমনটাই বলা হয়ে থাকে। এখন, সামাজিক সম্মিলনে বা আসঞ্জন ব্যাপারটা যে পর্যন্ত প্রকৃতিগত, সে পর্যন্ত তা গড়ে ওঠে মুখ্যত কোনো সার্বজনীন বিপদ বা সাধারণ শত্রুর ভীতি থেকেই। কোনো বয়স্ক লোকের হাতে একদল অবাধ্য ছেলেমেয়ের ভার অর্পিত হলে এই ব্যাপারটা খুব স্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করা যায়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে মেনে চলার ব্যাপারে বাচ্চাগুলোকে রাজি করানো মুশকিল, কিন্তু ভীতিপ্রদ কিছু ঘটলে, যেমন ধরা যাক প্রচণ্ড শব্দ করে বাজ পড়লে বা হিংস্র ধরনের কোনো কুকুর তেড়ে, এলে, বাচ্চাগুলো তৎক্ষণাৎ নিরাপত্তার আশায় বয়স্ক ব্যক্তিটির কাছে ছুটে আসবে এবং পুরোপুরি বাধ্য হয়ে উঠবে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য, তবে সেটা এত প্রকটভাবে চোখে পড়ে না। শান্তির সময়ের তুলনায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দেশপ্রেম অনেক তীব্র হয়ে ওঠে, এমনকি রীতিমতো কষ্টদায়ক কোনো সরকারি হুকুম জারি করা হলে তা-ও নির্বিবাদে মেনে নেওয়া হয় শান্তির সময় সেই হুকুম জারি করা হলে কিন্তু লোকেরা তা নির্বিবাদে মেনে নেবে না। বিশ্বসরকারের সামনে বাইরের কোনো মানবশত্রু থাকবে না বলে তার পক্ষে নিজের প্রতি বিশ্বস্ততা সৃষ্টি করার জন্য এই ধরনের কোনো পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ থাকবে না। আমার মতে, শিক্ষার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে মানুষকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে বিদ্যমান বিপদসমূহের কথা, যেমন দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও মহামারীর কথা, আর সেই সঙ্গেই তাদের বোঝাতে হবে যে বিশ্বসরকারের প্রতি আনুগত্য ভেঙে পড়লে আবারও দেখা দিতে পারে বিজ্ঞানের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নতুন কোনো যুদ্ধ। অন্য রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণাই সম্ভবত অন্য যাবতীয় কারণের থেকে দ্রুত সামাজিক আসঞ্জন গড়ে তোলে, কিন্তু তাই বলে এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে আরও বেশি ইতিবাচক ও কল্যাণকর কোনো ধারণা তার জায়গা নিতে পারবে না। এই গোটা ব্যাপারটা সব থেকে বেশি করে নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। পরবর্তী একটি পরিচ্ছেদে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করব আমি।

এতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বসরকার গড়ে ওঠার পথে মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলো নিয়েই আলোচনা করেছি আমি। কিন্তু এর পাশাপাশি এ-ও বলা দরকার যে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োগিক উন্নতি পৃথিবীর দেশগুলোর আয়তন বৃদ্ধির স্বপক্ষে প্রভূত কারণ সৃষ্টি করেছে বলে এবং আমাদের এই গ্রহের আয়তন সীমিত বলে এই প্রয়োগিক কারণগুলো সমগ্র পৃথিবীর এক ঐক্যবদ্ধ সরকার গড়ে তোলার দিকেই বারবার অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। অতীতে বিভিন্ন দেশের আয়তন মুখ্যত নির্ধারিত হত দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির ভারসাম্যের সাহায্যে : একদিকে থাকত শাসকের ক্ষমতা প্রীতি, অন্যদিকে শাসিতের স্বাধীনতা প্রীতি। বিকাশের কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ে এই দুটি শক্তি ঠিক কোন বিন্দুতে একটা ভারসাম্য এসে পৌঁছবে,তা নির্ভর করে মূলত বিভিন্ন কলাকৌশলের ওপর। গমনাগমনের গতি বৃদ্ধি এবং অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের ব্যয়বৃদ্ধি-এ দুটো ঘটনাই কোনো সরকারের শাসনাধীন এলাকা বাড়ানোর দাবি করে। যেখানে অস্ত্রশস্ত্র সস্তা, গমনাগমন মন্থর, সেখানে কোনো আঞ্চলিক বিদ্রোহের মুখোমুখি হলে বড় এলাকাভিত্তিক সরকাকে রীতিমতো বেসামাল হয়ে পড়তে হয়। এই কারণেই সভ্যতার অগ্রগতির সময় সাধারণ বিভিন্ন দেশের আয়তন বৃদ্ধির আর সভ্যতার পতনের সময় আয়তন হ্রাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

লিখিত ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকের কিছু ঘটনা থেকে জানা যায়, আগে বৈরীভাবাপন্ন ছিল এমন কিছু সরকার তখন একত্রিত হয়েছিল। শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে নয়, সেই সঙ্গে লিখিত নথি থেকেও সর্বপ্রাচীন যে সভ্যতার কথা জানা যায় তা হলো ইজিপ্টের সভ্যতা। প্রথমে উচ্চ ও নিম্ন ইজিপ্ট পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল, কিন্তু ৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ তারা একই রাজত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ একত্রীকরণ সহজতর হয়ে উঠেছিল নীল নদের সাহায্যে,কারণ নীলনদই ইজিপ্টের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করে দিয়েছিল এবং সেই সময়ের পক্ষে যথেষ্টই দ্রুত করে তুলেছিল। মেসোপটেমিয়াতেও একই ধরনের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে সেখানে দুটি পৃথক ভাগ ছিল: সুমের আর আক্কাদ। এই দুটি ভাগের জাতি, ধর্ম ও ভাষা ছিল একেবারেই আলাদা। অবশেষে সারগন নামক জনৈক বিজেতা অথবা তার ঠিক পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা এই দুটি ভাগকে ঐক্যবদ্ধ করেন। কেম্ব্রিজ এনেস্যেন্ট হিষ্ট্রি-র (খণ্ড ১, পৃঃ ৩৮) বয়ান অনুযায়ী এই ঘটনার সময়কাল ২৮৭২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই একত্রীকরণের ফলে যে-শক্তি বৃদ্ধি ঘটে, তারই সাহায্যে ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য। সেই সময়কার মাপকাঠিতে এই সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল বিশাল, যদিও আধুনিক মাপকাঠিতে তাকে আর বিশাল বলে মনে হবে না। প্রকৃত অর্থেই বিশাল যে-প্রথম সাম্রাজ্যের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় তা হলো পারসিক সাম্রাজ্য। ইজিপ্ট আর মেসোপটেমিয়ার মতোই এই সাম্রাজ্যটিও গড়ে উঠেছিল মেদে ও পার্সিয়ান নামক দুটি বৈরী গোষ্ঠীর একত্রীভবনের ফলে। একটি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সমগ্র এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ব্যাপারটা নির্ভর করত যোগাযোগের রাস্তার ওপর। সে আমলে এবং বস্তুতপক্ষে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ বা মালপত্র বা খবর, কোনো-কিছুই ঘোড়ার থেকে দ্রুত যাতায়াত করতে পারত না। পারসিকরাই প্রথম বড়-বড় সড়ক বানিয়েছিল, বিশেষত সার্দিস থেকে সুজা পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ মাইল দীর্ঘ একটা সড়ক নির্মাণ করেছিল তারা। কোনো অশ্বারোহী বার্তাবাহক এই রাস্তাটা এক মাসে অতিক্রম করতে পারত, কিন্তু লটবহর সমেত কোনো সৈন্যবাহিনীর এই রাস্তাটা পেরোতে সময় লাগাত প্রায় তিন মাস। আইওয়ানিয়ান গ্রিকরা যখন পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখন ঠিক এই কারণেই নিজেদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করার প্রচুর সময় পেয়েছিল তারা। শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার জন্য বিস্তর মেহনত করতে হয়েছিল পারসিকদের। রাস্তাঘাটের ওপর পারসিকদের নির্ভরতার উত্তরাধিকারী হয়ে উঠেছিল ম্যাসিডনীয়রা তবে একে একেবারে নিখুঁত করে তুলেছিল রোমানরাই। পতনের আগে পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য তার প্রজাদের সামনে এমন অনেক সুযোগ সুবিধা এনে দিয়েছিল যা আজ আমার একমাত্র বিশ্বসরকারের কাছ থেকেই পাওয়ার আশা করতে পারি। কোনো সীমান্ত বা শুল্কবিভাগীয় ঝামেলার মুখোমুখি না হয়েই তখন যে-কোনো মানুষ ব্রিটেন থেকে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত চলে যেতে পারত। এই বিশাল এলাকায় গোটা সভ্যতাটাই পুরোপুরি একীভূত ছিল এবং বহু বছরের মধ্যে এমন একবারও মনে হয়নি যে বাইরের কোনো দেশের কাছ থেকে আশঙ্কার কারণ আছে রোমের। তার আগে পর্যন্ত কোনো সভ্যতার অগ্রগতির যে প্রক্রিয়া সুপরিচিত ছিল, তার ঠিক বিপরীত এক প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয় রোমের পতনের পর। ভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধ শাসন ব্যবস্থার বদলে গড়ে ওঠে বেশ কিছু স্বল্পায়তন ও পরস্পরবৈরী রাষ্ট্র। সভ্যতার মান আকস্মিকভাবেই অত্যন্ত নিচু হয়ে যায় আর যে-সড়কগুলোর ওপর নির্ভর করত রোমান সাম্রাজ্য সেই সড়কগুলোকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেওয়া হয়।

তবে উন্নততর সভ্যতার দিকে নতুন এক অগ্রগমনও ক্রমান্বয়ে শুরু হয়ে যায়। যে-ইংল্যান্ডে বেশ কিছু আলাদা-আলাদা রাজা রাজত্ব করতেন, যেখানে বিভিন্ন রাজ্য-যেমন মার্সিয়া আর ওয়েসেক্সে-পরস্পরকে আজকের দিনের রাশিয়া আর আমেরিকার মতোই তীব্রভাবে ঘৃণা করত, সেখানে একত্রীকরণের কাজটি সম্পন্ন। করেন মহান আলফ্রেড। এর ৭০০ বছর পর রাজপরিবারের এক দুর্ঘটনার ফলে ঐক্যবদ্ধ হয় ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড, যে-দুটি দেশ তার আগে বহু শতাব্দী ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। রানি প্রথম এলিজাবেথের সন্তানাদি থাকলে আজও হয়তো আমরা ব্রানকবার্ন আর ফ্লডেন ফিল্ড –এ যুদ্ধ কবে বেড়াতাম।

বারুদের উদ্ভাবন বিভিন্ন রাষ্ট্রের আয়তনই শুধু বাড়িয়ে দেয়নি, প্রতিটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকেও বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। বিভিন্ন সুরক্ষিত দুর্গে সামন্ত-অভিজাতদের অরাজকতার অবসান ঘটেছিল কামান উদ্ভাবনের ফলে। ইংল্যান্ডে সপ্তম হেনরি, ফ্রান্সে রিশলু আর স্পেনে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা নিজেদের সমগ্র রাজত্ব জুড়ে এঁরাই প্রথম আভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। নতুন সামরিক কলাকৌশলের রাজনৈতিক ফলাফল কি হতে পারে, এটা তার এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।

তবে বারুদ উদ্ভাবনের ফলে কোনো সরকারের পক্ষে ফ্রান্স বা স্পেনের মতো বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠলেও বিশ্বসরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক অবস্থা সৃষ্টি করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই যুগে এসে। এর প্রথম অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ ছিল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত খবরাখবর প্রেরণের ব্যবস্থা করা। টেলিগ্রাফ উদ্ভাবনের আগে কোনো রাষ্ট্রদূত প্রয়োজনের খাতিরেই তার নিয়োগকর্তা সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে যথেষ্ট স্বাধীনভাবেই কাজ করতেন, কারণ যে-দেশে তাকে নিয়োগ করা হতো সেই দেশের অবস্থা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হতো তাঁকে এবং তিনি কি করছেন না– করছেন তা তাঁর নিজের দেশের সরকার সেই মুহূর্তে জানতেও পারত না। রেলপথও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নেপোলিয়নের হাতে রেলপথ থাকলে ১৮১২ সালে তিনি রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারতেন–এমন কথা কেউ কেউ ভাবতেও পারেন। কিন্তু আমাদের এই শতাব্দীতে যে সব পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সেগুলো রেলপথ বা টেলিগ্রাফের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক এই পরিবর্তনসমূহের মধ্যে প্রথম হলো মহাকাশ বিজয়, যার ফলে কোনো সৈন্যবাহিনীকে কয়েকদিনের মধ্যেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো সম্ভবপর হয়েছে। মহাকাশ বিজয়ের থেকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল পারমাণবিক অস্ত্র আবিষ্কার। এইসব অস্ত্র যখন ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বারা বাহিত হয়, তখন লক্ষ্যে পৌঁছতে তাদের যেটুকু সময় লাগে তা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না।

এই প্রায়োগিক অগ্রগতিগুলো একদিকে যেমন বর্তমান আন্তর্জাতিক অরাজকতাকে আগে থেকে বহুগুণ বিপজ্জনক করে তুলেছে, অন্যদিকে এগুলোই আবার বিশ্বসরকার প্রতিষ্ঠাকেও প্রায়োগিক দিক থেকে সম্ভবপর করে তুলেছ– এগুলোর সাহায্যেই বিশ্বসরকার সর্বত্র নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে এবং সশস্ত্র প্রতিরোধকে কার্যত অসম্ভব করে তুলতে পারবে। এই নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মূলত তিনটি বৈজ্ঞানিক অভিনবত্নের ফলে: প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা; দ্বিতীয় হলো লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে সেগুলোর বিস্ময়কর দ্রুততা, আর তৃতীয় হলো এইসব অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের সুবিপুল খরচ। এই সবকিছুই কোনো স্থিতিশীল রাষ্ট্রের সম্ভাব্য আয়তনকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। এতদিন পর্যন্ত এই সম্ভাব্য আয়তন পৃথিবীর পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই আয়তন চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহ পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে যেতে পারে।

এইসব সম্ভাবনা আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যে সব রাজনৈতিক ধাঁচকে সেকেলে করে তুলেছে সেইসব ধাচ আঁকড়ে থেকে মানবজাতি যদি নিজেকে ধ্বংস করে না ফেলে, একমাত্র তাহলেই এইসব সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *