০৬. মানুষের টিকে থাকার দীর্ঘমেয়াদি শর্তাবলি

মানুষের টিকে থাকার দীর্ঘমেয়াদি শর্তাবলি

 পাঠকদের আমি অনুরোধ করব এই অধ্যায়টি পড়ার সময় তাঁরা যেন সাম্প্রতিক ইতিহাসের খুঁটিনাটি এবং অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঘটনাবলির কথা কিছুক্ষণের জন্য বিস্মৃত হন। সেই সঙ্গেই আমি অনুরোধ করব তারা যেন তাদের পছন্দ-অপছন্দ, পক্ষপাত-বিরোধিতা এবং ভালো মন্দ সংক্রান্ত নৈতিক বিশ্বাসকেও কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরিয়ে রাখেন। এই অধ্যায়ে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ও পক্ষপাতহীন পদ্ধতিতে আমি আলোচনা করার চেষ্টা করব এই পৃথিবীর বুকে মানুষকে দীর্ঘকাল টিকে থাকতে হলে কি কি শর্ত পুরণ করতে হবে, তা নিয়ে। প্রাকৃতিক অবস্থার দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়– মানবজীবন সহ যাবতীয় সপ্রাণ বস্তুরই এই পৃথিবীর বুকে আরও লক্ষ লক্ষ বছর টিকে না থাকার কোনো কারণ নেই। আসলে বিপদটা মানুষের প্রাকৃতিক বা জীবতাত্ত্বিক পরিমণ্ডল থেকে আসছে না, বিপদটা উঠে আসছে তার নিজের মধ্যে থেকেই। অদ্যাবধি মানুষ অজ্ঞতার সাহায্যেই টিকে থেকেছে। সেই প্রয়োজনীয় অজ্ঞতাটুকু হারিয়ে গেছে আজ। এ অবস্থায় মানুষ এই পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারবে?

কিছুটা অস্থায়ী ধরনের মানুষের টিকে থাকা হয়তো একেবারে অসম্ভব নয়। অদূর ভবিষ্যতে কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হলে যুদ্ধের শেষে অল্প কিছু মানুষ টিকে থাকতেও পারে, তবে তাদের কারুর হাতেই সভ্যতার কোনো উপকরণ থাকবে না। দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে হয়তো শুধু খাদ্য সংগ্রহের কাজেই ব্যস্ত থাকতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে তাদের হয়তো কিছুই থাকবে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেদের জ্ঞান বা কলাকৌশল পৌঁছে দেওয়ারও সামর্থ্য থাকবে না। এই অবস্থায় হয়তো বিগত এক লক্ষ বছরের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করতে হবে মানুষকে, তারপর এক সময় আমাদের বর্তমান প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে আমাদেরই মতো কোনো মূর্খতার শিকার হয়ে নিজেদের ধ্বংসের মুহূর্তকে ত্বরন্বিত করে তুলবে তারা। মানুষের টিকে থাকার এটা এক সম্ভাব্য রূপ ঠিকই, কিন্তু আদৌ স্বস্তিদায়ক রূপ নয়।

যদি ধরে নেওয়া যায় যে মানুষ তার বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল বজায় রাখতে সক্ষম হবে, তাহলে সর্বাত্মক ধ্বংসের হাত থেকে কোনো উপায়ে রক্ষা পেতে পারবে সে? আমাদের প্রশ্নের সীমাটা ছোট হয়ে আসছে, মানুষ টিকে থাকতে পারবে কি না সে প্রশ্ন কিন্তু আমি তুলছি না। নানান কৌশলের সাহায্যে এবং ভাগ্যের সহায়তায় সে হয়তো অনেক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেও টিকে থাকতে সক্ষম হবে। কিন্তু ভাগ্যের সাহায্যে চিরদিন পাওয়া যায় না এবং বিপদের উৎসগুলোকে টিকে থাকতে দেওয়া হলে একদিন না-একদিন তারা স্বমূর্তি ধারণ করবেই।

এইসব কারণেই আমার মনে হয়, বিশ্বব্যাপী নৈরাজ্যের বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে বিজ্ঞাননির্ভর মানুষের পক্ষে আর খুব বেশিদিন টিকে থাকতে না পারা প্রায় নিশ্চিত। যতদিন পর্যন্ত সৈন্যবাহিনী এক একটি দেশের বা একগুচ্ছ দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে অথচ সারা পৃথিবীর ওপর প্রশ্নাতীত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সামর্থ্য তাদের থাকবে না, ততদিন এটা প্রায় নিশ্চিত যে আজ না হয় কাল যুদ্ধ বাধবেই, এবং যতদিন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক করণকৌশল টিকে থাকবে, ততদিন যুদ্ধ ক্রমশই ভয়ংকরতর হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই এমন কিছু সম্ভাবনা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যা এমনকি হাইড্রোজেন বোমার সমর্থকদেরও কিছুটা দমিয়ে দিয়েছে। সবধ্বংসী যন্ত্র, যা আমাদের সকলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, তা নির্মাণ করার সম্ভাবনা এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। আমরা যতদূর জানি তাতে মনে হয় সে যন্ত্র ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েও গেছে। এই ধরনের অস্ত্রের মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রস্তাবিত সবথেকে সস্তা ধরনটি হচ্ছে কোবাল্ট বোমা। এ বোমা ঠিক এখনকার হাইড্রোজেন বোমার মতোই, পার্থক্য শুধু এক জায়গায়, এ বোমার বহিরাবরণে ইউরেনিয়ামের বদলে কোবাল্ট ব্যবহার করা হয়। এ বোমা বিস্ফোরিত হলে কোবাল্টের একটি তেজস্ক্রিয় রূপ চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে এবং তা ক্ষয়প্রাপ্ত হবে অত্যন্ত ধীরে ধীরে। বেশ কিছু কোবাল্ট বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে কয়েক বছরের মধ্যে সারা পৃথিবীতে মানুষের আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। দ্য হিউম্যানিস্ট পত্রিকার মার্চ-এপ্রিল ১৯৬১ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিনাস পাউলিং বলেছেন, ছয় মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর অস্ত্রনির্মাণ খাতে যা ব্যয় হয় তার কুড়ি ভাগের এক ভাগ, খরচ করলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মৃত্যু সুনিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ কোবাল্ট বোমা বানিয়ে ফেলা যাবে।….

আত্মরক্ষার যতরকম ব্যবস্থাই করা হোক না কেন, কোনো মানুষের পক্ষেই জীবিত থাকা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

কোবাল্ট বোমা হচ্ছে ধ্বংসের অনেক পদ্ধতির মধ্যে একটা। আজকের দিনের দক্ষতার সাহায্যে ধ্বংসের আরও অনেক উপকরণ নির্মাণ করা যায়, আর বিভিন্ন দেশের সরকার সেইসব উপকরণ ব্যবহার করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

এইসব কারণেই মনে হয়, বিজ্ঞাননির্ভর মানুষের পক্ষে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে না পারা নিশ্চিত, যদি না যাবতীয় প্রধান প্রধান যুদ্ধাস্ত্র এবং গণহত্যার যাবতীয় উপকরণ একটিমাত্র কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এইসব অস্ত্র ও উপকরণের ওপর একচ্ছত্র অধিকার থাকার ফলে সেই কর্তৃপক্ষের হাতে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতাও থাকবে এবং কেউ তাকে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করলে একমাত্র বিদ্রোহীদের ছাড়া আর কারুর তেমন কোনো ক্ষতি না করে কয়েক দিনের মধ্যেই যে কোনো বিদ্রোহকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে সে। বৈজ্ঞানিক দক্ষতায় সমৃদ্ধ মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এই শর্তটি পূরণ করা একান্তই অপরিহার্য।

এ ধরনের একটি কর্তৃপক্ষ নানানভাবেই গড়ে উঠতে পারে। যতদিন কোনো পক্ষের হাতেই হাইড্রোজেন বোমা ছিল না, ততদিনের মধ্যে কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ বাধলে যে পক্ষ জয়ী হতো সে পক্ষ অন্য সবার ওপর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারত এবং অন্য কারুর পক্ষে তার বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। এই সম্ভাবনাটির আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বর্তমান অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ঠিক কতটা দাঁড়াবে তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় এবং আমরা মনেপ্রাণে চাই তা যেন কোনোদিনই নিশ্চিতভাবে জানতে না হয় আমাদের। ন্যাটো এবং ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হলে সে যুদ্ধের পর নিরপেক্ষ কয়েকটি দেশ হয়তো নিজেদের সামাজিক বন্ধন কিছুটা অটুট রাখতে পারবে, ফলে সেইসব দেশেই হয়তো টিকে থাকবে সভ্যতার অবশেষটুকু। যেমন, এই ধরনের কোনো যুদ্ধে চীন যদি বিচক্ষণের মতো নিরপেক্ষ থাকে এবং যুদ্ধের হাতে-গোনা দিনগুলোতে বায়ুপ্রবাহ যদি পূর্বদিক থেকে বয়, তাহলে সারা বিশ্বের ওপর আধিপত্য করার মতো জায়গায় পৌঁছে যেতেও পারে সে। কিন্তু চীন যদি সে যুদ্ধে অংশ নেয় অথবা বায়ুপ্রবাহ যদি পশ্চিমদিক থেকে বয়, তাহলে খুব সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার একটা জোটই বিশ্বপ্রভৃত্বের অধিকারী হয়ে উঠবে। এ ধরনের যে কোনো ঘটনার পর যে দেশটি অথবা দেশগুলো টিকে থাকবে, তারা ভূতপূর্ব বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর অবশিষ্ট স্বল্পসংখ্যক বাসিন্দাদের বাধ্য করতে পারবে স্বৈরাচারের শাসনাধীন এক পৃথিবীতে বসবাস করতে, যেখানে যুদ্ধের পরেও বিদ্যমান ওই দেশগুলোর শক্তিকে প্রতিহত করা একেবারেই অসম্ভব।

যে সব পন্থায় গোটা পৃথিবী একটি একক শাসনব্যবস্থার আওতায় আসতে পারে, এটা তার মধ্যে একটা পন্থাটা খুব মনোরম নয় এবং আজকের দিনের পারমাণবিক শক্তিধর কোনো দেশই এ পন্থাকে স্বাগত জানাবে না। তবে পারমাণবিক যুদ্ধের পর এ ধরনের কিছু ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আমার ধারণা সে যুদ্ধের পর যুদ্ধের অংশীদার দেশগুলোর পাশাপাশি নিরপেক্ষ দেশগুলোতেও সভ্যতার অস্তিত্ব না থাকাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক।

সমস্ত দেশ যদি তাদরে সশস্ত্র বাহিনীকে একত্রিত করে সর্বস্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় কোনো চুক্তি সম্পাদন করে, তাহলে সেটা বিশ্বশান্তি সুরক্ষিত করার অনেক বেশি কাম্য পন্থা হয়ে উঠতে পারবে। এই মূহুর্তে এই ভাবনাটাকে অত্যন্ত সুদূরপরাহত ও কল্পনাবিলাস বলে মনে হতে পারে, তবে বেশ কিছু বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ কিন্তু ভিন্ন ধারণাই পোষণ করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকার সময় সরকারের তরফ থেকে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে মিঃ ম্যাকমিলান একবার বলেছিলেন, নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপারে আমাদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত সরল এবং আমাদের কাজকর্মের ইতিহাসও নিষ্কলঙ্ক। প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণ সংঘটিত হতে পারে দুটি সরল অথচ গুরুত্বপূর্ণ নীতির ভিত্তিতে। প্রথমত, তাকে অবশ্যই সর্বাঙ্গীন হতে হবে, অর্থাৎ নতুন ও পুরনো, প্রচলিত ও অপ্রচলিত, সব ধরনের অস্ত্রকেই তার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাবতীয় অস্ত্রের ওপর একচ্ছত্র অধিকার থাকবে প্রকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আন্তর্জাতিক বা অধিজাতিক (Supranational) কর্তৃপক্ষের হাতে। মাননীয় সদস্যরা হয়তো বলতে পারেন যে এর ফলে রাষ্ট্রসংঘ বা ওই জাতীয় অন্য কোনো সংস্থা বিশ্বসরকারের স্তরে উন্নতি হয়ে যাবে। ব্যাপারটা সত্যিই তাই, বিশ্বসরকারের স্তরেই উন্নীত হবে সেই কর্তৃপক্ষ। এটাই হলো মানবজাতির টিকে থাকার একমাত্র উপায়।  

আরও কয়েকজনের একই ধরনের মন্তব্যের কথা এখানে উল্লেখ করা যায় যারা কল্পনাবিলাসীও নন অথবা রাজনৈতিক দিক থেকে অনভিজ্ঞও নন। তবে এই মুহূর্তে বিশ্বসরকার গড়ে তোলার বাস্তব সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছি না আমি, আলোচনা করছি সভ্য সমাজের অস্তিত্ব টিকে না থাকার প্রশ্নটি নিয়ে।

বিশ্বশান্তি সুনিশ্চিত না-করেও এক ধরনের বিশ্বসরকার গড়ে তোলা যেতে পারে। যেমন, বিশ্বকর্তৃপক্ষের সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলার কাজে যে সব দেশ সাহায্য করবে, তারা যদি তাদের সৈন্যবাহিনীর কিছু অংশকে ওই কর্তৃপক্ষের হাতে এমনভাবে তুলে দেয় যাতে তাদেরজাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত হবে না এবং দেশের কোনো সংকটের সময় তাদের প্রেরিত আনুগত্য প্রদর্শন করবে, তাহলে বিশ্বশান্তি সুরক্ষিত না–করেও এক ধরনের বিশ্বসরকার গড়ে উঠতে পারে। বিশেষত এই ধরনের বিপদ পরিহার করার উদ্দেশ্যে রচিত সম্ভাব্য বিশ্বসংবিধানের একটি রূপরেখা পাঠকদের সামনে পেশ করা যায়। এই রূপরেখা অবশ্য নিতান্তই অভিমত মাত্র, আদৌ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয় আমি শুধু দেখতে চেয়েছি যুদ্ধকে প্রতিহত করার মতো একটি বিশ্বসংবিধান রচনা করা অসম্ভব কিছু নয়।

কোনো বিশ্বকর্তৃপক্ষকে যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হয়, তাহলে তার একটি বিধানমণ্ডল এবং একটি কার্যকরী ও অপ্রতিরোধ্য সামরিক বাহিনী থাকতেই হবে। অপ্রতিরোধ্য সামরিক বাহিনী হচ্ছে এ ব্যাপারে সবথেকে জরুরি এবং সবথেকে দুরূহ শর্ত। অতএব প্রথমে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করতে চাই আমি।

.

প্রতিটি দেশকে তাদের জাতীয় সৈন্যবাহিনীর সদস্যসংখ্যা কমাতে হবে, আভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার থেকে বেশি সেন্য কোনো দেশের হাতেই থাকবে না। পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র অথবা গণহত্যার অন্য কোনো উপকরণ কোনো দেশের হাতেই রাখতে দেওয়া চলবে না। বিশ্বকর্তৃপক্ষ যে কোনো দেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করতে এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ করতে পারবে। পৃথিবীর সব দেশ অস্ত্রশূন্য হয়ে গেলে বিশ্বকর্তৃপক্ষের সামরিক বাহিনীকে খুব-একটা বড় করার কোনো দরকার হবে না এবং সেই বাহিনীর ব্যয়ভার তার অন্তর্গত বিভিন্ন দেশগুলোর ওপর দুঃসহ বোঝা হয়ে চেপে বসবে না। আন্তর্জাতিক সৈন্যবাহিনীর কোনো অংশই যাতে তাদের নিজস্ব দেশটির অনুগত হয়ে না ওঠে তার জন্য সৈন্যবাহিনীর প্রতিটি বড় ইউনিট গড়ে তুলতে হবে বিভিন্ন দেশের সৈন্যদের নিয়ে। সৈন্যবাহিনীর ইউরোপীয় অংশ, এশীয় অংশ, আফ্রিকান অংশ বা আমেরিকান অংশ বলে কিছু থাকবে না, বরং সর্বত্রই যথাসম্ভব সব জায়গার সৈন্যদের সুষম সংমিশ্রণে সাজাতে হবে বাহিনীকে। উচ্চতর নেতৃত্বের ভার ন্যস্ত করতে হবে বিভিন্ন ছোটখাটো দেশের মানুষদের ওপর, যে সব দেশের পক্ষে বিশ্বপ্রভূত্ব অর্জনের আশা করা একেবারেই অসম্ভব। প্রতিটি দেশ নিরস্ত্রীকরণের শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করার অধিকারও বিশ্বসরকারের হাতে অবশ্যই থাকতে হবে।

বিধান মণ্ডলের গঠনকাঠামো হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাচের। যুদ্ধ বা শান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন যে কোনো বিষয়ের প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে। যে কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত এককগুলো ভিন্ন ভিন্ন। আয়তনের হলে একটা সমস্যা দেখা দেয় প্রতিটি একক সমান ক্ষমতার অধিকারী হবে, নাকি জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নির্ধারিত হবে? আমেরিকা এ ব্যাপারে একটা আপোসমূলক পদ্ধতি উদ্বোধন করে নিয়েছে–ব্যবস্থাপক সভা বা সেনেট পরিচালিত হয় একটি নীতিতে, প্রতিনিধি সভা বা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস পরিচালিত হয় অন্য নীতিটি অনুযায়ী। তবে আমার মতে বিশ্ব বিধানমণ্ডল গঠন করার ব্যাপারে অন্য একটি নীতি আরও বেশি কার্যকরি ভূমিকা নিতে পারে। মোটামুটি সমান জনসংখ্যা বিশিষ্ট বিভিন্ন অধীনস্থ যুক্তরাষ্ট্র থাকাই ভালো বলে মনে করি আমি। এই যুক্তরাষ্ট্রগুলোকে যথাসম্ভব সমপ্রকৃতির কিছু রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের বেশ কিছু সাধারণ স্বার্থ থাকতে হবে। কিছু সংখ্যক রাষ্ট্র এ রকম অধীনস্থ যুক্তরাষ্ট্রে একত্রিত হওয়ার পর বিশ্বকর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র বিভিন্ন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে নাক গলাতে যাবে না–তবে তাদের মধ্যে কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলে বা অসাংবিধানিক কিছু ঘটলে বিশ্বকর্তৃপক্ষ তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

এই যুক্তরাষ্ট্রগুলো কিভাবে গঠন করা হবে তা নির্ভর করছে কাজটা কোন সময়ে করা হচ্ছে তার ওপর। কাজটা যদি এখনই করা হয়, তাহলে বিন্যাসটা এ রকম হতে পারে : (১) চীন, ২) ভারত ও সিংহল, (৩) জাপান ও ইন্দোনেশিয়া, (৪) পাকিস্তান থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম দুনিয়া, (৫) নিরক্ষীয় আফ্রিকা, (৬) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগত দেশসমূহ, (৭) পশ্চিম ইউরোপ, ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড, (৮) আমেরিকা ও কানাডা, (৯) লাতিন আমেরিকা। এই বিভাজনে যে দেশগুলোর নাম উল্লিখিত হলো না, সেগুলোর ব্যাপারে কিছু সমস্যা আছে। যেমন যুগোস্লাভিয়া, ইজরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কোরিয়া। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এই দেশগুলোকে ঠিক কিভাবে বিন্যস্ত করলে সবচেয়ে ভালো হবে, তা আগেভাগে অনুমান করা অসম্ভব। বিশ্ববিধানমণ্ডলে প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্রের কজন করে প্রতিনিধি থাকবে, তা ঠিক হবে তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে। একদিকে থাকবে বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক তত্ত্বাবধান করার জন্য রচিত একটি সংবিধান, অন্যদিকে থাকবে প্রতিটি অধীনস্থ যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধান যা মেনে চলার নিশ্চিত দেবে বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্র। যে কোনো সাংবিধানিক পদক্ষেপের ব্যাপারে অধীনস্থ যুক্তরাষ্ট্র আর তার অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে সমর্থন করবে বিশ্বসরকার। কোনো অধীনস্থ যুক্তরাষ্ট্র অসাংবিধানিক কাজকর্মে লিপ্ত হলে তবেই বিশ্বসরকার তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। কোনো অধীনস্থ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই একই নীতি প্রযোজ্য হবে।

বিশ্ব-বিধানমণ্ডলের হাতে কি কি ক্ষমতা থাকবে? প্রথমত, এই বিধানমণ্ডলের অনুমোদন ছাড়া কোনো চুক্তিই বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে না। নতুন কোনো পরিস্থিতিতে পুরনো কোনো চুক্তির সংশোধন করা আবশ্যক হয়ে উঠলে তা করার অধিকারও থাকবে বিশ্ব-বিধানমণ্ডলের। শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক যে কোনো উগ্রজাতীয়তাবাদী শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর অধিকারও থাকবে তার হাতে।

এছাড়া একই কার্যনিবাহী পরিষদও থাকা দরকার বলে মনে করি আমি। এই পরিষদ তার কাজকর্মের জন্য বিধানমণ্ডলের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। সৈন্যবাহিনীর তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব ছাড়া এই পরিষদের মূল কাজ হবে কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্টগোষ্ঠী বিশ্ব-সংবিধান লঙ্ন করলে তা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করা এবং প্রয়োজনে তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

আর একটি বিষয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি হলো আন্তর্জাতিক আইন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের জোর নিতান্তই অল্প। তাই বিভিন্ন দেশের আদালতগুলোর হাতে যতটা ক্ষমতা থাকে, ততটা ক্ষমতা হেগ কোর্ট-এর মতো কোনো আইনি প্রতিষ্ঠানের হাতে দরকার। কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো অপরাধ করে যা তার নিজের দেশে খুবই জনপ্রিয় ব্যাপার, তাহলে তার বিচার করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি দণ্ডবিধিও থাকা উচিত বলে মনে করি। আমি। নুরেমবার্গ বিচারের যুদ্ধজয়ের ফলস্বরূপ যে শাস্তির রায় দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে আদৌ কোনো ন্যায্যতা ছিল না, তবে অভিযুক্তদের মধ্যে অন্তত কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়ার মতো একটি আইনি পদ্ধতি যে থাকা উচিত তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

যুদ্ধোন্মাদনার মতো তাড়নাগুলোকে সত্যিসত্যিই প্রশমিত করতে হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জীবনযাত্রার মানে অর্থনৈতিক সমতা আনার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষকে। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে ধনী দেশ ও দরিদ্র দেশের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন পর্যন্ত একদিকে থাকবে ঈর্ষা এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক উৎপীড়নের সম্ভাবনা। সুতরাং শান্তিকে সুরক্ষিত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক সমতা গড়ে তোলার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে।

বিশ্বসরকার ব্যাপারটা যে ধরনেরই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু জোরদার আপত্তিও উঠতে শুরু করেছে। পরবর্তী পরিচ্ছেদে সেই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করব আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *