০৫. বিজ্ঞানীসমাজ ও হাইড্রোজেন বোমা

বিজ্ঞানীসমাজ ও হাইড্রোজেন বোমা

অধিকাংশ সাধারণ মানুষই মনে করেন পৃথিবীকে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য বৈজ্ঞানিকদেরই নৈতিকভাবে দায়ী করা উচিত। কয়েকজন বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে এই অভিযোগকে আংশিকভাবে সত্য বলে ধরা যেতে পারে। এঁরা হচ্ছেন সেইসব বিজ্ঞানী যারা তাদের স্ব স্ব দেশের সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছেন পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের কাজে অথবা এই অস্ত্র নির্মাণ সংক্রান্ত গবেষণার কাজে! কিন্তু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ প্রতিহত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টার কথা ব্যাপকভাবে প্রচারের কাজে বাধা দিয়েছেন রাজনীতিবিদরা, সংবাদপত্র এবং সাধারণ মানুষ। এই অধ্যায়ে আমি বিজ্ঞানীদের সেই প্রচেষ্টা সম্বন্ধেই কিছু বলার চেষ্টা করব।

আমেরিকার সরকার যখন প্রথম হাইড্রোজেন বোমা বানানোর প্রস্তাব উত্থাপন করে, তখন পরমাণু বোমার নির্মাণকাজের প্রধান সংগঠক ওপেনহাইমার তার বিরোধিতা করেছিলেন। এর ফলে সরকারি কর্তারা রীতিমতো ক্রুদ্ধ হন এবং বারবারই তাঁদের গোচরে থাকা বহু-পুরানো কিছু হঠকারিতার প্রশ্নকে টেনে বার করে ১৯৫৪ সালে ওপেনহাইমারকে নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করার একটি সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিয়ে নেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে গোপনীয় তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন ওপেনহাইমার।

অনেকে মনে করতে পারেন যে পরমাণু বোমা বানানোর ব্যাপারে সম্মতি দেওয়া আর হাইড্রোজেন বোমা বানানোর ব্যাপারে অসম্মত হওয়া, এটা এক ধরনের স্ববিরোধিতা। মনে রাখা দরকার, পরমাণু বোমা তৈরি হয়েছিল যুদ্ধের এমন এক পরিস্থিতিতে যখন সকলেই ধরে নিয়েছিল (ভাবনাটা ভুল ছিল, তবে একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না) আর কিছুদিনের মধ্যেই পরমাণু বোমার নির্মাণকৌশল হাতে পেয়ে যাবে হিটলার। অন্যদিকে, হাইড্রোজেন বোমা বানানোর কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল শান্তির সময়ে এবং তখন এটা নিশ্চিত ছিল যে কাজটা যদি চালিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আমেরিকার প্রায় সমসময়েই সোভিয়েত রাশিয়াও এ বোমা বানিয়ে ফেলতে পারবে, ফলে অস্ত্রটা কোনো পক্ষের কাছেই জয়লাভের উপকরণ হয়ে উঠতে পারবে না।

হাইড্রোজেন বোমার ধ্বংসাত্মক শক্তির যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তার প্রতিক্রিয়ায় সারা পৃথিবীর যে সব বিজ্ঞানীরা তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারি চাকুরে নন তারা প্রায় সকলেই ইতিমধ্যে চূড়ান্ত শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। কাউন্ট বার্নাডোট এর উদ্যোগে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী (সকলেই অবশ্য পশ্চিমী দেশগুলোতে) মেনাউ দ্বীপে সম্মিলিত হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৫ তারিখে নিচে উদ্ধৃত বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেন তারা:

আমরা, অর্থাৎ এই আবেদনের স্বাক্ষরকারীরা, ভিন্ন ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভিন্ন জাতির, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমতের এবং ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসসম্পন্ন বিজ্ঞানী। তবে আমাদের প্রত্যেকেরই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।

বিজ্ঞানের সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে পেরে আমরা আনন্দিত, কারণ আমরা বিশ্বাস করি মানবজাতির পূর্ণতর জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় হলো বিজ্ঞান। কিন্তু বর্তমানে এই বিজ্ঞানই মানুষের হাতে আত্মধ্বংসের উপকরণ তুলে দিচ্ছে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেছি আমরা।

সার্বিক যুদ্ধ শুরু হলে এবং যুদ্ধে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হলে সারা পৃথিবীটাই তেজস্ক্রিয়তায় ছেয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে দেশগুলো-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের পাশাপাশি ধ্বংস হয়ে যাবে নিরপেক্ষ দেশগুলোও।

বৃহৎ শক্তিগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সে যুদ্ধ যে এরকম সর্বনাশা যুদ্ধে পরিণত হবে না, তার কি কোনো নিশ্চিতি আছে? সুতরাং কোনো দেশ সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রকৃতপক্ষে সে তার নিজের ধ্বংসকেই ডেকে আনবে এবং সারা পৃথিবীকে বিপন্ন করে তুলবে।

এইসব ধ্বংসাত্মক অস্ত্রগুলোর ভীতিই যে এই মুহূর্তে পৃথিবীর বুকে শান্তি বজায় রেখেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কোনো দেশের সরকার যদি ধরে নেয় যে এইসব অস্ত্রের ভীতি ভবিষ্যতেও যুদ্ধকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে, তাহলে তাদের ধারণাকে এক ধরনের আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ভীতি ও উত্তেজনা থেকে পৃথিবীতে বহুবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সাবেকি অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যেই এখনও ছোটখাটো বিবাদের ফয়সালা করে নেওয়া যাবে বলে যারা মনে করেন, তারাও এক ধরনের আত্মপ্রতারণারই শিকার হন। চরম বিপদের মুহূর্তে যুদ্ধরত কোনো দেশ বৈজ্ঞানিক প্রকরণলব্ধ কোনো অস্ত্রের ব্যবহার করতে ইতস্তত করবে না।

তাই পৃথিবীর সমস্ত দেশকে স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে শেষ অবলম্বন হিসেবে বলপ্রয়োগের কথা ভাবা এখনই বন্ধ করা দরকার। অন্যথায় পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অসিস্তত্ব বিপন্ন হয়ে উঠবে।

পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ হ্রাস করার পথসন্ধানে যে-সব বিজ্ঞানী সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, লিনাস পাউলিং তাঁদের মধ্যে এক বিশিষ্ট নাম। পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের বিলোপ ঘটানোর লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ করার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদিত হোক-এই মর্মে রাষ্ট্রসংঘের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন পাউলিং। আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন মোট ৯২৩৫ জন বিজ্ঞানী। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে লিঃ হামাজোল্ড-এর হাতে আবেদনপত্রটি তুলে দেন পাউলিং। এই আবেদনপত্রে বলা হয়:

আমরা, এই আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারী বিজ্ঞানীরা, আবেদন জানাচ্ছি নিউক্লিয়ার বোমা পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য এখনই একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করা হোক।

নিউক্লিয়ার বোমার প্রতিটি পরীক্ষার ফলে পৃথিবীর সর্বত্র আরও কিছু তেজস্ক্রিয় উপাদান ছড়িয়ে পড়ে। এই তিজস্ক্রিয়তা সারা পৃথিবীর মানুষদের শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের জননকোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে ভবিষ্যতে বিকৃতাঙ্গ শিশুদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।

যতদিন পর্যন্ত এইসব অস্ত্র শুধুমাত্র তিনটি দেশের হাতেই থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করা খুব-একটা কঠিন ব্যাপার নয়। অস্ত্রপরীক্ষা চলতে থাকলে এবং আরও কিছু দেশ এইসব অস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠলে, কিছু দায়িত্বশীল দেশনেতার বেপরোয়া কাজকর্মের প্রতিক্রিয়ায় সর্বনাশা পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার বিপদ বহুগুণ বেড়ে যাবে।

নিউক্লিয়ার বোমার পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হলে তা সার্বিক নিরস্ত্রীকরণ এবং শেষ পর্যন্ত যাবতীয় নিউক্লিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের বিলোপসাধনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করতে পারে। নিউক্লিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের বিলোপ ঘটানো গেলে নিউক্লিয়ার যুদ্ধের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করা যাবে, যে যুদ্ধ সংঘটিত হলে বিপন্ন হবে গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গলের চিন্তা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে আমাদের। বিজ্ঞানী হিসেবে আমরা জানি ঠিক কী কী বিপদ দেখা দিতে পারে, তাই সেইসব বিপদ সম্বন্ধে সকলকে অবহিত করার বিশেষ এক দায়িত্বও আছে আমাদের। যাবতীয় নিউক্লিয়ার অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করার লক্ষ্যে এক আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য এখনই কোনো ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে বলেই মনে করি আমরা।

সুযোগ্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা লিখিত নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ও তার প্রতিক্রিয়া (Nuclear Explosions and Gther Effects) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারত সরকার। প্রতিবেদনটি ১৯৫৬ সালে দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। প্রতিবেদনটি অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য, কিন্তু ঠিক সেই কারণেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, অতএব চমকপ্রদ সংবাদ পরিবেশনে অভ্যস্ত সাংবাদিকরাও প্রতিবেদনটির মধ্যে কোনো আকর্ষণীয় উপাদান খুঁজে পাননি। ফলে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য কোথাওই প্রতিবেদনটির কথা তেমনভাবে প্রচারিত হয়নি।

১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে লন্ডনে পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন ফর ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট-এর এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সোভিয়েত রাশিয়ার চারজন প্রতিনিধি এবং সমস্ত স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। সভার অংশগ্রহণকারীরা সকলেই যে পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন, এমন নয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞানীরা, সমাজতাত্ত্বিকরা, দার্শনিকরা এবং এই সভার সংগঠন ও আলোচ্যসূচি প্রস্তুতের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরাই। অন্যান্য প্রতিনিধিদের মতো রাশিয়ান প্রতিনিধিরাও বন্ধুত্বমূলক মনোভাব নিয়েই সভায় যোগ দিয়েছিলেন, পাশ্চাত্যের অংশগ্রহণকারীরাও একইরকম বন্ধুত্বমূলকভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন তাদের। আলোচনা চলাকালীন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই ধরনের কোনো সংস্থার হাতে পৃথিবীর বিভিন্ন জরুরি বিষয়ের দায়িত্ব অর্পিত হলে পূর্ব পশ্চিম উত্তেজনা কিছু দিনের মধ্যেই অনেক কমে যাবে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার যে-সব সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না সেইসব সমস্যাকে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের স্বার্থহানি না ঘটিয়েই সমাধান করা যাবে। আলোচনার সূচনায় আমি একটি প্রস্তাব উপস্থাপিত করেছিলাম:

ভবিষ্যতে কোনো বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হবেই আর এই ধরনের অস্ত্রশস্ত্র সভ্য জীবনের অস্তিত্বকে এবং সম্ভবত সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবে। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সব দেশের সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন উপলব্ধি করেন এবং সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন যে বিশ্বযুদ্ধের সাহায্যে তাদের কোনো উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে না। সেই কারণেই আমরা আবেদন জানাচ্ছি সমগ্র মানবজাতির স্বার্থে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অগ্রগতিসমূহের প্রয়োগের ব্যাপারটিকে এখনই খতিয়ে দেখা হোক এবং যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিবাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের প্রচেষ্টা উন্নত করা হোক।

আলোচনার শেষে নিম্নোক্তৃত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়: ভবিষ্যতে কোনো বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের বিপদ আছে বলে এবং এই ধরনের অস্ত্র অপরিমেয় দুর্দশা ও ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আমরা পৃথিবীর সব দেশের সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন উপলব্ধি করেন এবং সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন যে বিশ্বযুদ্ধের সাহায্যে তাঁদের কোনো উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে না। সেই কারণেই আমরা আবেদন জানাচ্ছি সমগ্র মানবজাতির স্বার্থে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অগ্রগতিসমূহের প্রয়োগের ব্যাপারটিকে এখনই খতিয়ে দেখা হোক এবং যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিবাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের প্রচেষ্টা উন্নত করা হোক।

এর সঙ্গে আমি যোগ করি:

যে প্রস্তাবটি এখানে গৃহীত হলো, তা সম্মেলনের শুরুতে আমার দ্বারা উপস্থাপিত প্রস্তাবের সঙ্গে হুবহু এক নয়। দুটি প্রস্তাবের মধ্যে যে পার্থক্যটুকু আছে তা গৃহীত হয়েছে আমাদের বন্ধু সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ফলে। আমি সানন্দে জানাচ্ছি যে তাঁদের সঙ্গে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার পর সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য এই প্রস্তাবের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পেরেছি আমরা। যেহেতু ঐকমত্য ও সর্বসম্মতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেহেতু আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি এই দেখে যে প্রস্তাবটি এমনভাবে রচিত হয়েছে যাতে করে সোভিয়েত বন্ধুরাও তা সমর্থন করতে পারবেন, আবার পাশ্চাত্যের বন্ধুদেরও সমর্থন করতে কোনো অসুবিধা হবে না। এটা এক সহযোগিতার সূচনাবিন্দু। আমি আশা করি এই সহযোগিতা আরও বিস্তৃত, আরও প্রসারিত হয়ে উঠবে, বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে যতদিন না আমাদের মধ্যেকার যাবতীয় বিভাজন দূর হয়ে যায়।

মস্কো আকাদেমি অব সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক সি.এ. গোলোউনস্কি বলেন: সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা আমাকে জানানোর দায়িত্ব দিয়েছেন যে এই প্রস্তাব তাঁরা সমর্থন করেন। এই সঙ্গেই আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই পরিচালনা কমিটির মধ্যেকার সহযোগিতা ও পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মনোভাবের কথা, যে মনোভাবের ফলেই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হতে পেরেছে। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোর কোনো আইনি জোর নেই। এগুলোর তাৎপর্য পুরোপুরিই নৈতিক চরিত্রের। কিন্তু প্রস্তাবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো– প্রস্তাবটি শুধুমাত্র অধিকাংশের দ্বারাই গৃহীত হয়নি, গৃহীত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে, অর্থাৎ এখানে উপস্থিত প্রত্যেকেরই অনুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে এই প্রস্তাবে। এই প্রস্তাব যে আন্তর্জাতিক শান্তি এবং সারা পৃথিবীর মানুষদের নিরাপত্তাকে সুসংহত করে তোলার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম, ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহে।

সোভিয়েত আকাদেমির বিজ্ঞান বিষয়ক সচিব অধ্যাপক এ.ভি. তোপচিয়েভ তার সমাপ্তি ভাষণে বলেন:

সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এই সম্মেলন নিশ্চিতভাবেই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। পারস্পরিক বোঝাঁপড়া এবং ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর আন্তরিক আকাক্ষার মনোভাব নিয়েই অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সম্মেলনের মূল প্রস্তাব এবং বিভিন্ন আয়োগের সিদ্ধান্তসমূহ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।.. আমাদের এই সম্মেলন দেখিয়ে দিয়েছে যে, সমস্ত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যদি ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থাকে এবং তারা যদি অন্য অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টিকোণকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, তাহলে যে কোনো প্রশ্নেই ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব। … আমাদের এই সম্মেলনের আর একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করা দরকার বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের এই একত্রিত হওয়া এবং তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে উঠার ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক বন্ধন গড়ে তোলা ও তাকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে এবং বিজ্ঞানের আরও আরও সাফল্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা পালন করবে।

আন্তরিকতা আর বিপুল উদ্দীপনার পরিবেশে শেষ হয় সম্মেলন। ১৯৫৫ সালের প্রথম আটটা মাস ছিল আশার পর্যায়। জুন মাসে হেলসিঙ্কিতে বিশ্ব শান্তি সমাবেশ নামে এক বৃহৎ ও অত্যন্ত সফল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কমিউনিস্টরা, কিন্তু অ-কমিউনিস্টরাও এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমি নিজে সেই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে না পারলেও একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম। লেখাটিতে পূর্বপশ্চিম বিবাদের মীমাংসার সম্ভাব্য শর্তাবলির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়কার আশাব্যঞ্জক পরিবেশটি নষ্ট হয়ে যায় পশ্চিমী সরকারগুলোর জন্যই। তাদের নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব সোভিয়েত রাশিয়া অপ্রত্যাশিকভাবে মেনে নিতেই তড়িঘড়ি সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় তারা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষা নিষিদ্ধ করার চুক্তি সম্পাদন বানচাল করার জন্যে এই একই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে সোভিয়েত রাশিয়াও।

যে সংগঠনের সঙ্গে আমি সবথেকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম সেই সংগঠনটি পাগওয়াশ আন্দোলন নামে পরিচিত। বিশিষ্টতম কয়েকজন বিজ্ঞানীর কাছে একটি খসড়া বিবৃতি পাঠিয়েছিলাম আমি এবং সেখান থেকেই সূচনা হয়েছিল এই সংগঠনের। বিবৃতিটি সবার আগে পাঠিয়েছিলাম আইনস্টাইনের কাছে, মৃত্যুর দুদিন আগে বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে এবং সম্ভব হলে পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের বিষয়ে কমিউনিস্ট ও অ-কমিউনিস্ট বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলাই ছিল আমার প্রধান উদ্দেশ্য। আমার মনে হয়েছিল বিশিষ্টতম জনা বারো বিজ্ঞানীরা স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি হয়তো বিভিন্ন দেশের সরকার ও মানুষের ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। যখন মনে হল শুরু করার পক্ষে যথেষ্ট স্বাক্ষর সংগ্রহ করা গেছে, তখন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিবৃতিটি প্রকাশ করি আমি। ১৯৫৫ সালের ৯ জুলাই অবজার্ভার পত্রিকার জনৈক সাংবাদিকের উদ্যোগে এই সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং অবজার্ভার পত্রিকা তাতে প্রভূত সাহায্য করে। ওই সম্মেলনে অধ্যাপক রটব্লাট কে চেয়ারম্যান হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিবৃতিটির বয়ান ছিল-এরকম:

সমগ্র মানবজাতি আজ যে দুঃখজনক পরিস্থিতির সামনে এসে পৌঁছেছে, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা মনে করছি গণহত্যার অস্ত্র নির্মাণজনিত বিপদের মূল্যায়ন করার জন্য এবং এখানে প্রদত্ত খসড়া প্রস্তাবটিতে বিধৃত মনোভাবে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিজ্ঞানীদের একত্রিত হওয়া দরকার।

বিশেষ কোনো জাতি বা মহাদেশ অথবা ধর্মমতের সদস্য হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে, মানবপ্রজাতির সদস্য হিসেবেই নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে চাইছি আমরা, যে প্রজাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব আজ এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সারা পৃথিবী আজ সংঘাত-সমাকীর্ণ এবং অন্য সব ছোটখাটো সংঘাতকে ছাপিয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে কমিউনিজম ও কমিউনিজম-বিরোধিতার মধ্যেকার সংঘাত।

রাজনৈতিকভাবে সচেতন প্রায় প্রতিটি মানুষেরই এরকম এক বা একাধিক বিষয় সম্বন্ধে গভীর আকর্ষণ আছে। কিন্তু আমরা বলছি-সম্ভব হলে এইসব আকর্ষণ দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদেরকে শুধুমাত্র এক জৈবিক প্রজাতির সদস্য হিসেবে মনে করুন, যে প্রজাতির এক উজ্জ্বল ইতিহাস আছে এবং যে প্রজাতির অবলুপ্তি আমাদের কারুরই কাম্য নয়।

কোনো একটি গোষ্ঠীর থেকে অন্য গোষ্ঠীর কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, এমন একটি শব্দও উচ্চারণ না করারই চেষ্টা করব আমরা। সব গোষ্ঠীই আজ সমান বিপন্ন। এই বিপদকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা গেলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাকে প্রতিহত করা একেবারে অসম্ভব নয়।

নতুন পথে চিন্তা করা শিখতে হবে আমাদের। যে গোষ্ঠীকে পছন্দ করি সেই গোষ্ঠীর সামরিক বিজয়ের জন্য কি কি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সে প্রশ্ন নিজেদের সামনে রাখব না আমরা, কারণ এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার অস্তিত্বই নেই আর। তার বদলে নিজেদের আমরা প্রশ্ন করব যে সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব পক্ষকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিহত করার জন্য কি কি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার?

যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হলে কি কি বিপদ দেখা দিতে পারে, তা সাধারণ মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি, এমনকি অনেক সরকারি কর্তাব্যক্তিও এখনও মনে করেন এর ফলে কিছু শহরই শুধু ধ্বংস হবে। এটুকু তারা বুঝেছেন যে নতুন বোমাগুলো পুরনো বোমার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। একটা পরমাণু বোমা একটা হিরোশিমাকে ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু একটা হাইড্রোজেন বোমা ধ্বংস করে দিতে পারে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক আর মস্কোর মতো সবথেকে বড় শহরগুলোকেও।

যুদ্ধে হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহৃত হলে বড় বড় শহরগুলো যে ধ্বংস হবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপর্যয়ের এটা একটা তুচ্ছ দিক মাত্র। লন্ডন, নিউইয়র্ক আর মস্কোর প্রতিটি অধিবাসীও যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলেও কয়েকশো বছরের মধ্যে সে আঘাত সামলে উঠতে পারবে পৃথিবী। কিন্তু আজ আমরা জানি, বিশেষত বিকিনি দ্বীপের পরীক্ষার পর আরও ভালো করে জেনেছি, নিউক্লিয়ার বোমার ধ্বংসলীলা যত দূর পর্যন্ত ছড়াবে বলে মনে করা হয়, বাস্তবে তা ক্রমান্বয়ে আরও অনেক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যে বোমায় হিরোশিমা ধ্বংস হয়েছিল, তার থেকে ২০০ গুণ শক্তিশালী বোমা বানানো এখন সম্ভব। এই ধরনের কোনো বোমা মাটির কাছে বা জলের নিচে বিস্ফোরিত হলে ওপরের বায়ুমণ্ডলে অসংখ্য তেজস্ক্রিয় কণা উৎক্ষিপ্ত হয়। এই কণাগুলো আস্তে আস্তে নামতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণঘাতী ধুলো বা বৃষ্টির আকারে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। এই ধুলোই সংক্রামিত করেছিল সেই জাপানি মৎস্যজীবীদের আর তাদের সংগ্রহীত মাছেদের।

এই ধরনের প্রাণঘাতী তেজস্ক্রিয় কণার দল ঠিক কতটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে, তা কারুরই জানা নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলেছেন যুদ্ধে হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহৃত হলে খুব সম্ভবত সমগ্র মানবজাতির ধ্বংস হয়ে যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুদ্ধে বেশ কিছু সংখ্যক হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহৃত হলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীরই মৃত্যু ঘটবে–কিছুজন মারা যাবে আচম্বিতে, তৎক্ষণাৎ, কিন্তু অধিকাংশ জন মৃত্যুর দিকে এগোবে ধীরে ধীরে, রোগ আর বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে হতে।

বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা এবং সমর-বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। সবথেকে খারাপ ফলটা যে দেখা দেবেই, এমন কথা তারা কেউই বলেননি। তারা শুধু বলেছেন এ ধরনের ফলাফল দেখা দেওয়া সম্ভব এবং তা যে বাস্তবায়িত হবে না এমন কথা বলা যায় না। এই প্রশ্নে বিশেষজ্ঞদের মতামত তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা কোনো কুসংস্কারের দ্বারা কোনোভাবে প্রভাবিত হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনও পর্যন্ত আমাদের নজরে পড়েনি। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে সবক্ষেত্রেই তাদের মতামত নির্ভর করেছে উদিষ্ট বিশেষঞ্জের জ্ঞানের সীমার ওপর, আর কিছু ওপরে নয়। আমরা লক্ষ করেছি, বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিষয়টি সম্বন্ধে যাঁরা সবথেকে বেশি জানেন, তাঁদের বক্তব্যই সবথেকে বেশি হতাশাময়।

সেই অনাবৃত, ভয়ংকর, অনিবার্য প্রশ্নটি আপনাদের সামনে রাখছি আমরা: আমরা কি মানবজাতির অস্তিত্বের বিলোপ ঘটাব, নাকি মানবজাতি যুদ্ধকে পরিত্যাগ করবে? এই দুয়ের মধ্যে থেকে কোনো একটিকে বেছে নিতে বললে লোকে বেশ মুশকিলেই পড়বে, কারণ যুদ্ধকে পরিত্যাগ করা খুব সহজ কাজ নয়।

যুদ্ধকে পরিত্যাগ করতে চাইলে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অনেকটাই সীমাবদ্ধ করতে হবে এবং সেটা কারুরই পছন্দ হওয়ার কথা নয়। তবে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করার ব্যাপারে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি শব্দটিকে একটা অস্পষ্ট ও বিমূর্ত কিছু বলে মনে করার ধারণাটাই। অধিকাংশ মানুষই উপলব্ধি করতে পারে না যে বিপদটা শুধুমাত্র অস্পষ্টভাবে অনুভূত সেই মানবজাতির নয়, বিপদটা তাদের, তাদের ছেলেমেয়েদের, তাদের নাতি নাতনিদের। তারা প্রায় কখনোই বোঝার চেষ্টা করে না যে তারা নিজেরা আর তাদের প্রিয়জনরা এক যন্ত্রণাময় মৃত্যুর আসন্ন বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাই তারা আশা করে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলে যুদ্ধকে চলতে দেওয়া যেতেও পারে।

এ এক অলীক আশা। যুদ্ধে হাইড্রোজেন ব্যবহার না করার ব্যাপারে শান্তির সময়ে যতই চুক্তি রচনা করা হোক না কেন, যুদ্ধ বেধে গেলে এ সব বিধিনিষেধ কেউই মানবে না, যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্রই উভয় পক্ষেই হাইড্রোজেন বোমা তৈরির কাজ শুরু করে দেবে। কারণ যদি এক পক্ষ বোমা তৈরি করে ফেলে এবং অপর পক্ষ না করে, তাহলে যে পক্ষ বোমা তৈরি করে ফেলেছে তাদের জয় অবধারিত হয়ে উঠবে।

যুদ্ধোপকরণের পরিমাণ সার্বিকভাবে হ্রাস করার অঙ্গ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র বর্জন করার কোনো চুক্তি যে চূড়ান্ত সমাধান নয়, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এই চুক্তি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। প্রথমত, উত্তেজনা প্রশমনের জন্য পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সম্পাদিত যে কোনো চুক্তিই শেষ বিচারে মঙ্গলজনক। দ্বিতীয়ত, থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র নির্মাণ যদি নিষিদ্ধ করা হয় এবং উভয় পক্ষই যদি বিশ্বাস করে যে অপর পক্ষ সেই নিষেধাজ্ঞা আন্তরিকভাবে মেনে চলেছে, তাহলে পার্ল হার্বারের কায়দায় অতর্কিত আক্রমণের ভয় অনেকটাই কমে যাবে–যে ভয় এই মুহূর্তে উভয় পক্ষকেই এক নিরস্তর মানসিক চাপের মধ্যে রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের কোন চুক্তিকে অবশ্য স্বাগত জানাব আমরা, তবে শুধুমাত্র প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই।

আমাদের মধ্যে অধিকাংশ জনই অনুভূতির বিচারে ঠিক নিরপেক্ষ নই। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যেকার সদস্যাগুলোকে যদি এমনভাবে সমাধান করতে হয় যা যে কোনো ব্যক্তিকেই অন্তত কিছুটা তৃপ্তি দিতে পারবে তা তিনি কমিউনিস্টই হোন অথবা কমিউনিস্ট বিরোধী, এশিয়ানই হোন বা ইউরোপিয়ান অথবা আমেরিকান, শেতাঙ্গই হোন অথবা কৃষ্ণাঙ্গ-তাহলে এইসব সমস্যাকে কিছুতেই যুদ্ধের পথে সমাধান করার পথে ভাবা চলবে না। আমরা আশা করি এই সত্যটা পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় পক্ষেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

আমরা যদি চাই, তাহলে আমাদের সামনে রয়েছে সুখ, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার পথে নিরন্তর অগ্রগতির ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যতের বদলে আমরা কি মৃত্যুকেই চাইব, যেহেতু আমরা নিজেদের মধ্যেকার বিবাদ-বিসম্বাদের কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না? মানুষ হিসেবে মানুষের কাছে আমরা আবেদন জানাচ্ছি; মনে রাখুন আপনারা মানুষ, ভুলে যান বাকি পরিচয়। তা যদি পারেন, তাহলে এক স্বর্গের পথ খোলা আছে আপনাদের সামনে। আর তা যদি না পারেন, তাহলে আপনাদের সামনে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা।

আলোচনার সময় বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করার প্রস্তাব এসেছিল এবং স্থির হয়েছিল একটি সিদ্ধান্তের ওপর সকলের মতামত নেওয়া হবে। সিদ্ধান্তটি ছিল এ-রকম:

আমরা এই সম্মেলন আহ্বান করেছি এবং এর মধ্যে দিয়ে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের আর সাধারণ মানুষদের আহ্বান করছি নিম্নোদ্ধৃত সিদ্ধান্তটি সমর্থন করার জন্য:

ভবিষ্যতে কোনো বিশ্বযুদ্ধ দেখা দিলে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহৃত হবেই এবং এই ধরনের অস্ত্র মানবজাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবে। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সব দেশের সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানাচিছ তারা যেন এটা উপলব্ধি করেন এবং সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন যে, বিশ্বযুদ্ধের সাহায্যে তাঁদের কোনো উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে না। এইসঙ্গেই আমরা তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন তাদের নিজেদের মধ্যেকার যাবতীয় বিবাদ-বিসম্বাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পথ খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন।

এই সিদ্ধান্তে যে মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে, সেই মনোভাব থেকেই অনুষ্ঠিত হয় পরবর্তী পাগওয়াশ সম্মেলন।

সমগ্র দলিলটির স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন:

অধ্যাপক ম্যাক্স বর্ন (বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও গটিনজেনের তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, এডিনবার্গের প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক, ১৯৩৬–৫৩, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

অধ্যাপক পি. ডব্লিউ ব্রিজম্যান (অধ্যাপক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

অধ্যাপক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

অধ্যাপক এল, ইনফেন্ড (অধ্যাপক, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়, পোলিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের-এর সদস্য, আইনস্টাইন-এর সঙ্গে যুগ্ম লেখক হিসেবে দ্য ইভলিউশন অব ফিজিক্স এবং দ্য প্রবলেম অব মোশন নামে দুটি বই লিখেছেন)।

অধ্যাপক জে. এফ. জোলিও-কুরি (কলেজ দ্য ফ্রান্স-এর অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট এবং অ্যাডেমি অব মেডিসিন-এর সদস্য, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স-এর সভাপতি, রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

অধ্যাপক এইচ. জে. মুলার (মস্কো, ভারত প্রকৃতি স্থানের প্রাক্তন অধ্যাপক, বর্তমানে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শারীরবিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

অধ্যাপক এইচ. জে.মুলার (মস্কো, ভারত প্রকৃতি স্থানের প্রাক্তন অধ্যাপক, বর্তমানে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শরীর বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক।)

অধ্যাপক লিনাস পাউলিং (ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গেটস অ্যান্ড ক্রেলিন ল্যাবরেটারিস-এর পরিচালক, রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

অধ্যাপক সি. এফ. পাওয়েল (অধ্যাপক, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

অধ্যাপক জে. রটব্লাট (লন্ডন বিশ্ববিদ্যায়ের এবং সেন্ট বার্থোলোমিউস হসপিটালের মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক)।

বাট্রার্ল্ড রাসেল।

অধ্যাপক হাইডেকি ইউকাওয়া (অধ্যাপক, কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক)।

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এই বিবৃতিটি পাঠিয়ে দিই আমি, সঙ্গে নিম্নোদ্ধৃত্ত পত্রটিওঃ

প্রিয় …

পারমাণবিক যুদ্ধ সম্পর্কে অভিমত প্রদানের যোগ্যতাসম্পন্ন কয়েকজন বিশিষ্টতম বিজ্ঞানীর স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি পাঠালাম আপনার কাছে। পারমাণবিক যুদ্ধ যে চরম ও অপূরণীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিটিতে, সেই সঙ্গেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিবাদের মীমাংসার জন্য যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো খুঁজে বার করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি বিবৃতিটিতে আলোচিত বিষয়টি প্রসঙ্গে আপনি সর্বসমক্ষে আপনার অভিমত ব্যক্ত করবেন, যে বিষয়টি আজ পর্যন্ত মানবজাতি যত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তার মধ্যে সবথেকে গুরুতর।

আপনার বিশ্বস্ত (স্বাক্ষর)
 বারট্রান্ড রাসেল

বিবৃতিটি প্রচারিত হওয়ার সময় স্বাক্ষরকারী ছিলেন এগারোজন (তাঁদের মধ্যে দুজন বিবৃতিটির দু-একটি জায়গায় সামান্য আপত্তি জানিয়েছিলেন)। এই বিবৃতিতে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য এবং সমস্ত নিরপেক্ষ দেশের বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এ ধরনের একটা সম্মেলন আয়োজন করার প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল আর্থিক সমস্যা, কারণ যাতায়াতের ব্যয়ভার বহন করার সাধ্য অধিকাংশ বিজ্ঞানীরই ছিল না। প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থার কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য না-নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হয় সাইরাস ইটন-এর বদান্যতায়। নোভা স্কটিয়া র পাগওয়াশ-এ অবস্থিত তার নিজস্ব মহলে সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন তিনি, প্রচুর আর্থিক সাহায্যও করেন। বিভিন্ন দেশের এবং বিবিন্ন রাজনৈতিক মতদর্শে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা যখন বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক আদানপ্রদানের পরিবেশে একজোট হলেন, তখন দেখা গেল, সরকারি স্তরের যাবতীয় আলাপ-আলোচনায় যতটুকু ঐক্যমত্যে পৌঁছানো গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ঐকমত্যে পৌঁছানো আদৌ অসম্ভব নয়। অর্থাৎ যা আশা করেছিল ঠিক তাই-ই ঘটল। প্রথম সম্মেলনের পর পরবর্তী সম্মেলনগুলোর আয়োজন করার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে ছোটখাটো সম্মেলনের পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে বড় বড় সম্মেলন আয়োজনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইসঙ্গেই স্থির করা হয় যে শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদেরই নয়, সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ এবং যাদের মতামত মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হবে তাদের সবাইকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে। এখনও পর্যন্ত এ রকম দুটি সম্মেলন। অনুষ্ঠিত হয়েছে। এইসব সম্মেলনে বেশিকিছু প্রতিবেদন গৃহিত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে, একবাক্যে সম্মতি দিয়েছেন কমিউনিস্ট শিবিরের প্রতিনিধিরা এবং নিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হিসেবে ১৯৫৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৃতীয় পাগওয়াশ সম্মেলনে গৃহীত ভিয়েনা ঘোষণাপত্র-এর (The Vienna Declaration) কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি এখানে। বিজ্ঞপ্তিটি গৃহীত হয়েছিল সর্বসম্মতিক্রমেই, শুধু একজন আমেরিকান প্রতিনিধি মতদানে বিরত ছিলেন। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে (অংশবিশেষ):

কিজুবুহেল-এ এবং ভিয়েনায় আমরা মিলিত হয়েছিলাম এমন এক সময়ে যখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে মানুষ ধ্বংস করে দিতে পারে সমগ্র সভ্যতাকে এবং নিজেকেও। ধ্বংসের উপকরণসমূহ দিন দিন আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। যে সব বিজ্ঞানী আমাদের সম্মেলনগুলোতে অংশ নিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই মনে করেন সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী এক নজিরবিহীন বিপর্যয় ডেকে আনবে।

আমাদের মতে, পারমাণবিক অস্ত্রের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করা খুবই কঠিন। প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থার ওপর ভিত্তিহীন বিশ্বাস যুদ্ধকে ত্বরান্বিতও করে তুলতে পারে।

পৃথিবীর অস্ত্রভাণ্ডার থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ও গণহত্যার অন্যান্য অস্ত্র পরিহার করার ব্যাপারে সবদেশ একমত হলেও হতে পারে, কিন্তু এই ধরনের অস্ত্র নির্মাণের জ্ঞানকে তো কোনোভাবেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মানবজাতির সামনে এই জ্ঞান চিরদিনই সম্ভাব্য বিপদের উৎস হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে বড় মাপের কোনো যুদ্ধ দেখা দিলে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশই তৎক্ষণাৎ পারমাণবিক অস্ত্রনির্মাণের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হবে, কারণ যুদ্ধের সময় কোনো দেশের পক্ষেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় তাদের শত্রুরা এ ব্যাপারে কি করছে। এ-রকম পরিস্থিতিতে কোনো বৃহৎ শিল্পোন্নত দেশের পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করে ফেলতে এক বছরেরও কম সময় লাগবে বলেই মনে করি আমরা। অতঃপর যুদ্ধে সেইসব অস্ত্র প্রয়োগ করার সামনে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়াবে ওইসব অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিগুলোই, যে চুক্তিগুলো সম্পাদিত হয়েছিল শান্তির প্রহরে। তবে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রচণ্ড শক্তির ব্যাপারটাই ওই অস্ত্র ব্যবহারের প্রলোভনকে অদম্য করে তুলতে পারে, বিশেষত পরাজয়ের সম্মুখিন হওয়া নেতাদের কাছে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায় ভবিষ্যতে বড় মাপের কোনো যুদ্ধ দেখা দিলে খুব সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ ব্যবহৃত হবে, অতএব তার যাবতীয় ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে পৃথিবীকে।

অনেকের মতে, ছোটখাটো উদ্দেশ্যের জন্য অঞ্চলভিত্তিক কোনো যুদ্ধ এখনও ভয়াবহ বিপর্যয় ছাড়াই হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে আঞ্চলিক সংঘাত থেকে বড় মাপের যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি, আর গণহত্যার অস্ত্রসমৃদ্ধ এই যুগে সে বিপদের ঝুঁকি কিছুতেই নেওয়া যায় না। সুতরাং মানবজাতির কর্তব্য হলো সমস্ত যুদ্ধকেই নির্মূল করা, এমনকি অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধকেও।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক অবিশ্বাসের ফলেই দেখা দিয়েছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং এই প্রতিযোগিতার ফলে অবিশ্বাস আরও বেড়েই চলেছে। অতএব সমদর্শিতার ভিত্তিতে গৃহীত এবং প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণাধীন যেকোনো পদক্ষেপ যদি অস্ত্র-প্রতিযোগিতার তীব্রতা হ্রাস করতে পারে, এমনকি যদি অস্ত্রের পরিমাণ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসংখ্যা কিছুটাও কমাতে পারে, তাহলে সেটুকুও আমাদের কাছে যথেষ্ট বাঞ্ছিত হিসেবেই প্রতিভাত হবে। এই উদ্দেশ্যে গৃহীত যে কোনো ব্যবস্থাকেই স্বাগত জানাই আমরা, বিশেষ করে স্বাগত জানাই পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের আভাস পাওয়ার সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিদের মধ্যে জেনেভায় সম্পাদিত সাম্প্রতিক চুক্তিকে। বিজ্ঞানী হিসেবে আমরা সানন্দে লক্ষ করেছি যে আন্তর্জাতিক স্তরে নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত বেশ কিছু আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের পারস্পরিক বোঝাঁপড়া এবং বাস্তবসম্মত মনোভাবের ফলেই সর্বসম্মতিক্রমে এই চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছে। সানন্দচিত্তেই আমরা লক্ষ করেছি যে আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া ও ব্রিটেনের সরকার এই চুক্তির বিবৃতিকে এবং প্রায়োগিক বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে বিধৃত সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করেছেন। এ এক তাৎপর্যময় সাফল্য। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, তিনটি দেশের সরকারের এই অনুমোদনের পর যাবতীয় পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ করা এবং এক কার্যকরি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শীঘ্রই একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হবে। আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান ঘটানোর পথে সেই চুক্তিই হবে প্রথম পদক্ষেপ।

আমাদের সম্মেলনে উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে ও রচনায় যে বক্তব্য ফুটে উঠেছে, তা যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে আমাদের ধারণাকেই সমর্থন করে। এইসব রচনাপত্র থেকে ঈঙ্গিত পাওয়া যায় যে ভবিষ্যতে কোনো যুদ্ধ শুরু হলে ইতিমধ্যেই নির্মিত পারমাণবিক অস্ত্রসমূহের একটি বড় অংশকেই নিক্ষেপ করা হবে বড় বড় শহরগুলোর উপর, যুদ্ধের অংশীদার দেশগুলোতে সভ্যতার অধিকাংশ কেন্দ্রই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তাদের জনসংখ্যার অধিকাংশই মারা যাবে। ব্যবহৃত বোমাগুলো তাদের শক্তির বেশির ভাগ অংশটা সংযোজন প্রক্রিয়া থেকেই পাক (তথাকথিত পরিচ্ছন্ন বোমা) বা মুখ্যত বিয়োজন প্রক্রিয়া থেকেই পাক (তথাকথিত নোংরা বোমা), তার জন্য ফলাফলের কোনো হেরফের ঘটবে না। আক্রান্ত দেশগুলোর জনবসতি ও শিল্পের মূল কেন্দ্রগুলো তো ধ্বংস হবেই, সেই সঙ্গেই বোমার আঘাতে পরিবহন ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণসমূহ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে সেইসব দেশের অর্থনীতিও ভেঙে পড়বে।

বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো ইতিমধ্যেই প্রচুর পরিমাণ নোংরা পারমাণবিক বোমা পুঞ্জীভূত করেছে এবং এখনও করেই চলেছে। পুরোপুরি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝায় যায়, কিছু কিছু পরিস্থিতিতে নোংরা বোমাগুলোর বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। ফরে বড় মাপের কোনো যুদ্ধে এ ধরনের বোমা ব্যবহারের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিপুল সংখ্যক নোংরা বোমা ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় যে ফল আউট দেখা দেবে, তা আক্রান্ত দেশটির বাসিন্দাদের একটা বড় অংশকেই ঠেলে দেবে মৃত্যুর মুখে। এই ধরনের প্রচুর বোমা বিস্ফোরণের ফলে (যার প্রতিটি বিস্ফোরণই বহু মিলিয়ন টন সাধারণ রাসায়নিক বিস্ফোরকের সমান) শুধু যে আক্রান্ত দেশগুলোতেই তেজস্ক্রিয় ফল-আউট ছড়িয়ে পড়বে তা-ই নয়, বিভিন্ন মাত্রায় তা ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর বাকি অংশেও। তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু তো হবেই, সেইসঙ্গেই প্রাণ হারাবে নিরপেক্ষ দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষও।

এর পাশাপাশি সারা পৃথিবীতেই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তাজনিত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিও ঘটেই চলবে। প্রত্যক্ষ শারীরিক ক্ষতির মধ্যে থাকবে লিউকেমিয়া, হাড়ের ক্যানসার, আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া জিনগত ক্ষতিগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে সঞ্চারিত হবে তাদের বংশধরদের মধ্যে।…

যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ বোমা ব্যবহৃত হবে এবং তার ফলে যে সব শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটবে তা যে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং যুদ্ধকে নির্মূল করার উপযোগী পরিস্থিতি গড়ে তোলাই মানবজাতির আশু কর্তব্য হওয়া উচিত।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা গড়ে তোলার ব্যাপারে বিজ্ঞানী হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করতে পারি আমরা। বিজ্ঞান বরাবরই এক আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড। ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা অনায়াসেই পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার এক সাধারণ ভিত্তি খুঁজে নিতে পারেন। একই ধারণায় ও একই পদ্ধতিতে কাজ করেন তারা। দার্শনিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকলেও মননশীলতার একই লক্ষ্যে পরিচালিত হয় তাদের কাজকর্ম। মানবজাতির জীবনের নানান ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গুরুত্ব দ্রুত বেড়ে চলার ফলে পারস্পরিক বোঝাঁপড়াসম্পন্ন বিজ্ঞানী সমাজের গুরুত্বও অনেক বেড়ে গেছে। পরস্পরকে বোঝা এবং একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের দক্ষতাকে বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার দূরত্ব দূর করার জন্য এবং সার্বজনীন লক্ষ্যের চারপাশে তাদের একত্রিত করার জন্য চমৎকারভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব সে রকম প্রতিটি ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করা গেলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বোঝাঁপড়া গড়ে তোলার ব্যাপারে তা যথেষ্টই সহায়ক হবে বলে মনে করি আমরা। এর ফলে পারস্পরিক বিশ্বাসের এক পরিমণ্ডল গড়ে উঠবে যা বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার রাজনৈতিক সংঘাত সমাধানের জন্য একান্তই জরুরি এবং যা প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণের অত্যাবশ্যক প্রেক্ষাপট। আমরা আশা করি সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তাদের দায়িত্ব উপলব্ধি করবেন, উপলব্ধি করবেন মানবজাতির প্রতি এবং তাঁদের নিজেদের দেশের প্রতি দায়িত্বের কথা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে আরও উন্নত করে তোলার জন্য নিজেদের চিন্তা, সময় ও শক্তিকে কাজে লাগানোর কথা। …

আমরা মনে করি, বিজ্ঞান যদি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো মতবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং যাবতীয় বিষয় সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তাহলেই তার ভূমিকা সবথেকে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে মানবজাতির জীবনে।…

বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং তা থেকে উদ্ভূত সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায় দীর্ণ বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানের যাবতীয় শাখাই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, মনস্তত্ত্ব-সামরিক উন্নয়নের সঙ্গে আরও বেশি বেশি করে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। বহু দেশের সাধারণ মানুষদের চোখে অস্ত্রশস্ত্রের ক্রমোন্নতি আর বিজ্ঞান প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে তাদের অবদানের জন্য বিজ্ঞানীরা হয় সম্মান পান, নয়তো গণহত্যার অস্ত্রশস্ত্র উদ্ভাবনের দ্বারা মানবজাতিকে বিপন্ন করে তোলার জন্য ধিকৃত হন। কোনো দেশের সামরিক শক্তিতে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় তার সাফল্যের মাত্রায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিজ্ঞান এবং মুখ্যত এই ভূমিকার কথা মনে রেখেই বহু দেশ বিজ্ঞানকে প্রভূত বস্তুগত সাহায্য যুগিয়ে চলেছে। এর ফলে বিজ্ঞান সরে যাচ্ছে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে, কারণ বিজ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মানুষের জ্ঞানকে উন্নত করে তোলা এবং সার্বজনীন কল্যাণের জন্য প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব আরও বাড়িয়ে তোলা।

যে সব কারণ এ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে তার জন্য আমরা গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি, সেইসঙ্গেই দীর্ঘস্থায়ী ও সুস্থিত শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য আবেদন জানাচ্ছি পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষ ও সরকারগুলোর কাছে।

যে-অনুচ্ছেদটিতে কোনো মতবাদের প্রভাব থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটির দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই আমি। মনে রাখা দরকার, এই বক্তব্য সমেত সমগ্র ঘোষণাপত্রটিতে সোভিয়েত রাশিয়ার দশজন প্রতিনিধিই স্বাক্ষর করেছেন।

সিনেটের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কমিটি (আমেরিকার সেনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটির একটি সাব কমিটি) সম্প্রতি পাগওয়াশ আন্দোলনের প্রশংসা করেছে। এই কমিটি যে প্রতিবেদন পেশ করেছে তা এক বিস্ময়কর দলিল।

এই প্রতিবেদনে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে পশ্চিমী দুনিয়ার কোনো ব্যক্তি যদি পূর্ব পশ্চিম উত্তেজনা হ্রাস করার পক্ষে কথা বলেন, তাহলে তিনি অবশ্যই কমিউনিস্ট ভাবধারার সমর্থক, একজন কমিউনিস্টের সঙ্গে একজন অ কমিউনিস্টের বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ গড়ে উঠলে কমিউনিস্ট ব্যক্তিটি হাজার যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও এঁটে উঠতে পারবেন না। এই প্রতিবেদন আর বলা হয়েছে যে পাগওয়াশ সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণকারী কোনো কমিউনিস্ট প্রতিনিধি তাঁর নিজের দেশের সরকারের ঘোষিত নীতির বাইরে কিছু বলতে পারেন না, আর, পাগওয়াশের ঘোষণাপত্রসমূহ শান্তির কথা বলা হলেও এবং কমিউনিস্ট প্রতিনিধিরা তাতে স্বাক্ষর করলেও রাশিয়ান সরকার কিন্তু যুদ্ধ বাধানোর জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। প্রতিবেদনটিতে নানারকম বিস্ময়কর চাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমার একটি বিবৃতি উদ্ধৃত করা হয়েছে, আমাদের পছন্দসই শিবিরের সামরিক বিজয়ের জন্য কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক, কারণ এ রকম কোনো ব্যবস্থার অস্তিত্বই আর নেই। বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শেষ অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পলিসি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ১৯৪৮ সালে যা ছিল ১৯৫৯ সালে তা নেই, সেই সঙ্গেই বদান্যচিত্তে জানানো হয়েছে ১৯৪৮ সালে রাসেলের বয়স ছিল মাত্র ছিয়াত্তর বছর, কিন্তু ১৯৫৯ সালে তিনি সাতাশিতে পৌঁছে গেছেন। এখানে উল্লেখ করা হয়নি যে অন্তর্বর্তী বছরগুলোতে আর একটি পরিবর্তনও ঘটে গেছে, যে পরিবর্তনটি আমার ভীমরতিগ্রস্ত হয়ে ওঠার থেকে বোধ হয় কিছুটা বেশিই গুরুত্বপূর্ণ হলো–১৯৪৮ সালে আমেরিকা একাই পরমাণু বোমার অধিকারী হয়ে উঠেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাগওয়াশ সম্মেলনগুলোতে কমিউনিস্টরাও উপস্থিত ছিল। এই বক্তব্য থেকে মনে হয় স্রেফ কমিউনিস্টরা উপস্থিত ছিল বলেই যেন সম্মেলনগুলো খেলো হয়ে গেছে। কমিউনিস্টরা অনুপস্থিত থাকলে পূর্ব-পশ্চিম উত্তেজনা প্রশমনের প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না বলেই মনে করি আমরা এবং আমাদের এই ধারণাকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে উল্লিখিত প্রতিবেদনে। পাউলিং এর আর যুদ্ধ। নয় (No More war) বইটি মস্কোর কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এই স্বীকৃতিকে পাউলিং-এর দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবেই উপস্থাপিত করা হয়েছে উক্ত প্রতিবেদনে। এই বক্তব্যের অনুচ্চারিত অর্থ হলো–কোনো ন্যায়পরায়ণ মানুষ কিছুতেই পারমাণবিক যুদ্ধের বিরোধিতা করতে পারেন না।

তবে এ সব নিতান্তই মামুলি সমালোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। এ থেকে বড়জোর এটুকুই বেরিয়ে আসে-প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হয়েছে–যে পশ্চিমী দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা খুবই সরলমনা, তাঁরা মনে করেন যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের স্বার্থরক্ষার মননশীল আকাক্ষা অথবা নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আগ্রহই ছিল সোভিয়েত অংশগ্রহণকারীদের অনুপ্রেরণার উৎস। সেনেটের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কমিটির শ্যেনচক্ষু পাগওয়াশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের গোপন মতলবের মর্মমূল পর্যন্ত দেখে ফেলেছে। উপরোক্ত প্রতিবেদনের একটি অংশের শিরোনাম রাষ্ট্রদ্রোহী-কার্যকলাপে উস্কানি। এই অংশে অ্যালান নান মে, জুলিয়াস রোজেনবার্গ আর ক্লাস ফুকস্-এর কার্যকলাপের বিবরণ দেওয়া হয়েছে এবং পাঠককে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে এইসব বিশ্বাসঘাতকরা কোনো না কোনোভাবে পাগওয়াশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। অপপ্রচার কতখানি হীন হতে পারে, এটা তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সমগ্র প্রতিবেদনটি মূল সূর হল-বজ্জাত রাশিয়ানরা শান্তির প্রশংসা করে, কিন্তু সমস্ত দেশপ্রেমিক আমেরিকানই যুদ্ধের প্রশংসা করে। পক্ষপাতহীন কোনো পাঠক যদি এই প্রতিবেদনটি পড়েন এবং এর বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নেন, তাহলে অনিবার্যভাবেই তিনি রাশিয়ার সমর্থক হয়ে উঠবেন। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হলো, প্রতিবেদনে পশ্চিমী দুনিয়াকে যতটা নিষ্ঠুর হিসেবে দেখানো হয়েছে, ঠিক ততটা নিষ্ঠুর পশ্চিমী দুনিয়া নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার সেনেট কমিটিগুলোর হাতে নির্যাতন চালানোর প্রভূত ক্ষমতা আছে এবং এই ক্ষমতাকে তারা মূলত কাজে লাগায় সুস্থিরতা অভিমুখি যে কোনো প্রয়াসকে হতোদ্যম ও মর্যাদাচ্যুত করার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *