৬. গুটিসুটি মেরে

নোয়েলে ও ক্যাথারিন, এথেন্স, ১৯৪৬

২২.

গুটিসুটি মেরে সে শুয়ে আছে। যাতে বাদুড় তাকে দেখতে না পায়।

একা লোকের গলা শোনা গেল- ওকে আমরা পেয়েছি, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য।

–ও কী আছে তো?

ল্যারির কণ্ঠস্বর। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। শুনতে পাচ্ছে, ঘাতক এসে গেছে। সে মুখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। চোখ দুটো খুলেছে। বাংলোর বেডে। ল্যারি পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে আর একজন লোক।

ল্যারি বলল- ক্যাথারিন।

ক্যাথারিন বলল– আমাকে ছুঁয়ো না। তার কণ্ঠে কাঠিন্য ঝরছে।

 অজানা ভদ্রলোক বললেন– মনে হয় উনি এখনও ভয় পাচ্ছেন। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন।

ল্যারি পাশের ঘরে চলে গেল। হ্যাঁ, যেটা ভালো, সেটা করুন।

ভদ্রলোক সামনে এগিয়ে এলেন। খর্বাকৃতি মোটা চেহারার মানুষ। মুখে সুন্দর হাসি। ধীরে ধীরে ইংরাজিতে বললেন, আমি ডঃ কাজোমিডেস। সময়টা আপনার মোটেই ভালো যাচ্ছে না মিসেস ডগলাস। কিন্তু আপনি ভালো হয়ে উঠবেন, আমি কথা দিচ্ছি কদিন সময় লাগবে। ওই গুহাগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এই বছর এই নিয়ে তিনবারের মতো অ্যাকসিডেন্ট ঘটল।

ক্যাথারিন মাথা নাড়ল। বলল- না, এটা কোনো অ্যাকসিডেন্ট নয়, ও আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

-কে আপনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল?

ক্যাথারিনের গলা শুকিয়ে এসেছে আমার স্বামী।

না।

ক্যাথারিন এটা বিশ্বাস করে না– না, ও আমাকে গুহাতে একা রেখে চলে গিয়েছিল।

এটা সত্যি একটা অ্যাকসিডেন্ট। আমি আপনাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। একটু ঘুমোলে শরীরটা ভালো লাগবে।

একটা অদ্ভুত ভয় জেগেছে ক্যাথারিনের মনের মধ্যে। ক্যাথারিন বলল না, আমি আর কখনও জেগে উঠব না। আমাকে এখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবেন কি?

ভদ্রলোক হাসছেন আমি তো আগেই বলেছি মিসেস ডগলাস, চিন্তা করবেন না। কদিনের মধ্যে আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। একটু ঘুমিয়ে নিন। ঘুম এখন দরকার।

উনি একটা কালো মেডিকেল ব্যাগ বের করলেন। হাইপোডারনিকটা খুঁজছেন।

ক্যাথারিনের মনে হল, সে উঠে বসবে। কিন্তু পারছে না। তার সমস্ত শরীরে ঘাম দেখা দিয়েছে। তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে।

ডাঃ কাজোমিডেস বললেন–ওঠার চেষ্টা করবেন না। এখনও আপনি পরিপূর্ণ সুস্থ হননি। এবার ইনজেকশন দেওয়া হবে। ডাক্তার বললেন, পাশ ফিরে শুয়ে পড়ুন। যখন ঘুম ভাঙবে দেখবেন, আপনি একটা নতুন মানুষ হয়ে গেছেন।

ক্যাথারিন বলল- না, আমি যখন ঘুমিয়ে থাকব, তখন ও আমাকে মেরে ফেলবে।

ডাক্তারের মুখে কঠিন ভাব। তিনি বললেন– পাশ ফিরে শোন, মিসেস ডগলাস।

ক্যাথারিন চোখ বন্ধ করল।

 ভদ্রলোক গাউনটা নামিয়ে দিল। ক্যাথারিনের নিতম্বে ইনজেকশন পুশ করলেন।

–আঃ, আপনি আমাকে মেরে ফেলছেন কেন? ক্যাথারিনের দু-চোখে জল।

 ডাক্তার শান্তভাবে বললেন- আপনি কি জানেন, আপনাকে আমরা কীভাবে পেয়েছি? আপনার স্বামী খবর দিয়েছে।

ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে, ডাক্তার কী বলছে, তা বুঝতেই পারছে না।

-আপনার স্বামী ভুল পথে চলে গিয়েছিলেন। অন্ধকার পথ খুঁজে পাননি। তিনি উন্মাদের মতো হয়ে যান। তিনি পুলিশকে ডেকে আনেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ করতে বেরোই।

ক্যাথারিন বিশ্বাস করতে পারছে না– ল্যারি? ল্যারি এই কাজটা করেছে।

-হ্যাঁ, তার অবস্থা দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য তিনি নিজেকে দায়বদ্ধ করেছেন।

এই নতুন খবরটা পেয়ে ক্যাথারিন সত্যি অবাক হয়েছে। যদি ল্যারি তাকে হত্যা করতে চাইত, তাহলে সে কখনও খোঁজার জন্য পাগল হত না। তার মানে? কী ব্যাপার ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

ডাক্তার বললেন- এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল সকালে দেখা হবে।

যে মানুষটিকে সে এত ভালোবাসে, সে একজন হত্যাকারী? ল্যারির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু তার চোখ বুজে আসছে। যখন আমার ঘুম ভাঙবে, তখন আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আবার সব কিছু একইভাবে শুরু হবে।

.

তার ঘুমটা ভেঙে গেল কী একটা শব্দে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাঁচের জানলার ওপর বৃষ্টির আর্তনাদ। মাঝে মধ্যেই বাজ চমকাচ্ছে, নীল আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত। মনে হচ্ছে, আজ বোধহয় পৃথিবীর শেষের দিন।

ক্যাথারিন এই শব্দেই জেগে উঠে বসে আছে। কটা বাজে? রাত তিনটে। সে একা? ল্যারি নিশ্চয়ই পাশের ঘরে আছে। আমার কথা চিন্তা করছে।

ক্যাথারিন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। পারছে না, ঘুম-ঘুম আচ্ছন্নতা। সে কোনোরকমে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনের দিকে।

ল্যারি কোথায়? কিচেনে আলো জ্বলছে। ল্যারি বোধহয় ওখানেই আছে। পায়ে পায়ে ক্যাথারিন এগিয়ে গেল। একটি মেয়েকে দেখতে পেল।

ল্যারি বলল– ব্যাপারটা তোমার পক্ষে খুবই খারাপ।

 বাকি কথা শোনা গেল না।

–আমি সুনিশ্চিত হবার জন্য এলাম।

–কেউ যদি দেখে ফেলে?

–না, আমি ব্যবস্থা করেছি।

কখন?

–ও যখন ঘুমিয়ে থাকবে।

ক্যাথারিনের দেহ হিমশীতল হয়ে গেছে। সে নড়তে পারছে না। বাকি শব্দগুলো তার কানে এল।

–এটা ঘটিয়েই তাড়াতাড়ি পালাতে হবে।

সেই পুরোনো আতঙ্ক। সমস্ত শরীরে অদ্ভুত যন্ত্রণা। ক্যাথারিন এবার পালাবে। তাকে পালাতেই হবে। পালাতে গিয়ে একটা ল্যাম্প পড়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সেটাকে ধরে ফেলল।

সে বাইরে এল। অন্ধকার রাত। ঘনঘোর বর্ষা। ভীষণ শীত করছে। এখন সে কোথায় যাবে? পাতলা ফিনফিনে নাইট গাউন ছাড়া তার পরনে আর কিছুই নেই। এতে কী বা হবে? তাকে যে করেই হোক পালাতে হবে। হোটেল লবির আলো দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে আরও দূরে। সে কি সেখানে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করবে। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে কি? ডাক্তারের মুখটা মনে পড়ল। না, সে কি পাগল হয়ে গেছে?

পথটা কর্দমাক্ত, হাঁটা যাচ্ছে না।

খালি পায়ে ক্যাথারিন হেঁটে চলেছে। অনির্দেশের যাত্রাপথে। বারবার পড়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সে গ্রামের পথ ধরল। কোথায় ছুটছে কিছুই জানে না। মাথায় এত বৃষ্টি, সেদিকেও তার হুঁশ নেই।

পথটা একটা ফাঁকা রাস্তায় চলে গেছে। গ্রামের প্রান্তসীমায়। সে ভীত পশুর মতো ছুটছে।

শেষ অব্দি সে লেকের ধারে পৌঁছে গেল। তার পাতলা নাইট গাউন ভেদ করে বাতাস, ঢুকে পড়ছে। সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। ঠান্ডা জল তাকে কাঙ্খিত আনন্দ দিল।

ক্যাথারিন সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে ভাবছে। একটা চিন্তা মাথায় এসেছে। যে করেই হোক বিল ফ্রেসারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। বিল ফ্রেসার। তার সুন্দর ম্যানসনে অপেক্ষা করছিলেন। সুন্দর সাজে সেজে। জলের ধারে এসে ক্যাথারিনের মনে পড়ল, বিলের সঙ্গে দেখা করা আর কি যাবে? দেখতে পেল কয়েকটা নৌকো বাধা আছে।

কী করবে বুঝতে পারছে না, পায়ে পায়ে সে নৌকোর ওপর উঠে এল। কোনোরকমে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। নৌকোটা এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতা পেয়েছে। ক্যাথারিন পড়ে গেল পায়ের ওপর। নাঃ, ল্যারি নেই, কে? বিল কি? হা, বিল আমার সাথে দাঁড় বাইছে? আমরা মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে চলেছি? কিন্তু কেন?

নৌকোটা উন্মাদের মতো আচরণ করছে। ক্যাথির পরনে বিয়ের পোশাক। বিল তাকে নিয়ে চার্চে যাচ্ছে। বিলের বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কত কথা হচ্ছে। এক মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ক্যাথারিন আবার সেই গুহার মধ্যে ফিরে এসেছে। ল্যারি দাঁড়িয়ে আছে, তার গাউনে হাত রেখে। ওই ভদ্রমহিলার মুখ, সে জল ছিটোচ্ছে, তাকে ডুবিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। বিলের বাড়ি। না, বিল আর তাকে বিয়ে করতে চাইছে না।

এবার আমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। সেই ঝড়ের রাতে ক্যাথি একেবারে একা। আর্তনাদ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ভয় হারিয়ে গেছে তার মন থেকে। সে ভাবল, আমাকে এখন ঘুমিয়ে পড়তে হবে। হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে কি? আমি জানি না, শেষ অব্দি আমার কী হবে।

তারপর? কী যেন হয়ে গেল। দমকা বাতাস এসে নৌকোটাকে এলোমেলো করে দিল। সেটা উল্টে গেল। এমন একটা হৃদের জলে, যার তল কোথায় আছে কেউ জানে না।

.

তৃতীয় পর্ব

বিচার, এথেন্স ১৯৪৭

২৩.

নোয়েলে পেজ এবং ল্যারি ডগলাসের বিরুদ্ধে আনা মামলা শুরু হচ্ছে। কোর্টহাউস, এথেন্স, ৩৩ নং রুম। অনেক মানুষের ভিড়। একটা ধূসর রঙের বাড়ি। ইউনিভারসিটি স্ট্রিট জুড়ে তার অবস্থান। ১৩ নং ঘর, এখানে ক্রিমিনাল ট্রায়ালই হয়ে থাকে। এই ঘরটা বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ এটা সব থেকে বড়ো।

পুলিশ প্রধান সকোরি, নিরাপত্তার ব্যাপারটা দেখছেন। আলোকচিত্রীরা এসে গেছেন। মাঝে মধ্যেই ক্যামেরা ঝলসে উঠছে। পাঁচজন বিচারপতি হাজির হয়েছেন। দুপাশে অনেক উৎসাহী মানুষকে দেখা যাচ্ছে।

কিছুদিন পরে এই মামলাটা শুরু হয়েছে। কোর্টরুমের সামনে ছ ফুট লম্বা একটা মেহগিনির পার্টিশন আছে। চামড়ার চেয়ার আছে।

একদিকে আছে সাক্ষ্য দেবার জায়গা। প্রাচীনকালের কারুকাজ করা।

থমথমে নীরবতা। আমেরিকান কাগজে প্রকাশিত হয়েছে ওই ঘটনাটা নোয়েলে পেজ এখনও জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা যেতে পারে, কেউ তা বিশ্বাস করতে চাইছে না। মনে হচ্ছে মারি আতোনিয়ার বোধহয় তার শেষ বিচার দেখতে চলেছে।

এখানে নোয়েলে পেজই কিন্তু একমাত্র ব্যক্তি নয়। ল্যারি ডগলাসকেও দেখা যাচ্ছে। রাগে তার সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। সুন্দর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। কদিনেই যথেষ্ট ওজন হারিয়েছে সে।

দেখা গেল, সাক্ষ্যদানের আসরে নোয়েলে পেজকে। এখনও যথেষ্ট সুন্দরী। তার মধুর মতো গায়ের রং, অবশ্য একটুখানি খারাপ হয়ে গেছে। আরও কতজন এখানে বসে আছে ইসরায়েল কাটজ, বিখ্যাত ফরাসি সার্জন, আর এক মহান মানুষ। আছেন সোরেল, আরমান্দ গটিয়ার।

উইলিয়াম ফ্রেসার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী। ফ্রেসারের পাশে আছেন কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস।

 এবার বোধহয় সওয়াল জবাব শুরু হবে। দেখা গেল নেপোলিয়ান ছোটাসকে। সারা পৃথিবীতে তার মতো তুখোর ক্রিমিনাল আইনজীবী আর একটাও নেই। ডেমিরিসের ব্যক্তিগত অনুরোধে তিনি নোয়েলে পেজের মামলাটা নিতে রাজী হয়েছেন। যখন এই খরবটা সকলের কানে পৌঁছে যায়, দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে ছিল। কেননা নোয়েলে পেজ কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে প্রতরণা করেছে। তাকে বাঁচাবার জন্য তিনি এত আগ্রহী কেন?

.

মামলা শুরু হবার তিন মাস আগের ঘটনা। একদিন ওয়ার্ডেন নোয়েলের সেলে এসে উপস্থিত হল। বলল, কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস দেখা করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছেন।

নোয়েলে অবাক হয়ে গেছে। গ্রেপ্তার হবার পর ডেমিরিস চুপচাপ ছিলেন। নীরবতা ভেঙে এই প্রথম তার প্রবেশ।

নোয়েলে অনেক দিন ধরে ডেমিরিসের পরিচিত, নোয়েলে জানে, বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া ডেমিরিস কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে চান না। এখন উদ্দেশ্যটা কী, বুঝতে পারা যাচ্ছে না। প্রতিশোধের পালা? না, দেখাই যাক কী হয়।

ডেমিরিস, তাকে এবং ল্যারিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। নোয়েলে এই ব্যাপারটা ভালোভাবেই জানে। এখন ডেমিরিস নিশ্চয়ই চাইবেন, দুজনের ফাঁসি হোক। তাহলেই প্রতিশোধের পালাটা সম্পূর্ণ হবে।

নোয়েলে সবকটা সম্ভাবনা বিবেচনা করল। খেলাটা কোনদিকে এগোচ্ছে, সে ঠিক বুঝতে পারছে না। অথবা কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস চাইতে পারেন, ল্যারি মরে যাক, সে বেঁচে থাকুক। চিরজীবন বন্দিনী হয়ে, অথবা তার অধীনে। এইভাবেই হয়তো প্রতিশোধটাকে দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে।

তাই কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের আসার খবর শুনে নোয়েলে খুবই অবাক হয়ে গেল।

.

নোয়েলে এসেছে ওয়ার্ডেনের প্রাইভেট অফিসে। মেকাপ কেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।, মেকাপ করে কী লাভ? সে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। তিন মাসের মধ্যে এই প্রথম আকাশের মুখ দেখতে পেল সে। তাকে সেন্ট নিকো ডিমোসট্রিট প্রিজন থেকে আরকায়ারসাকিয়নে নিয়ে আসা হত, কোর্ট হাউসে। মাঝে মধ্যে বন্ধ করে আনা হত একটা প্রিজন ভ্যানের মধ্যে। ভ্যানটা বেসমেন্টে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। সেখানে একটা খাঁচা আছে। সেই খাঁচা তাকে তিনতলার করিডরে নিয়ে যেত। হিয়ারিং শুরু হত। তাকে ওই বিচার শোনার জন্য বসে থাকতে হত। আবার বন্দীশালায় ফিরে যাওয়া।

এখন নোয়েলে জানলা দিয়ে তাকাল। ইউনিভারসিটি স্ট্রিট দিয়ে ট্রাফিক চলেছে। মানুষজন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত। এই প্রথম নোয়েলে ভীষণ ভয় পেল। সে জানে, বিচারে কী হবে? খবরের কাগজের পাতায় সে সবকিছু পড়েছে। হ্যাঁ, সকলের চোখে তারা এখন অপরাধী। গ্রিকরা ঘৃণা প্রদর্শন করছে। সে বিয়ে নামের একটা পবিত্র বন্ধনকে অগ্রাহ্য করেছে।

এর আগে নোয়েলে জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট উদাসীন ছিল। উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়েছে। কোনো দিন বিপদ আসতে পারে, ভেবেও দেখেনি। এখন সে যেন কেমন হয়ে গেছে। সে দেখল, কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েক মাসে বয়স তার দশ বছর বেড়ে গেছে। তার শরীরে বিবর্ণতা, চোখের মধ্যে বিষণ্ণতা। কেন? নোয়েলে জানে না।

সেকেন্ডের ক্ষণভগ্নাংশে নোয়েলে ভাবল, এটা কি কোনো একটা ছলনা?

সে বলল– আমি দুঃখিত কোস্টা।

ডেমিরিস সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন আমি তোমাকে মেরে ফেলতাম, সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল।

-কেন তা করোনি?

 শান্ত উত্তর– তুমি আমাকে হত্যা করেছ। আমার সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছ। এত কষ্ট আমি কখনও পাইনি।

–কোস্টা

–আমাকে শেষ করতে দাও। আমি ক্ষমাশীল মানুষ নই। বিশ্বাস করো। আমি আর থাকতে পারছি না নোয়েলে। তোমাকে ফিরে পাব না?

ভেতরে কী উন্মাদনা, নোয়েলে বাইরে তা প্রকাশ করবে কী করে? সে বলল- না, আর তো কোনো সম্ভবনা নেই। আছে কি?

–তোমাকে যদি আমি স্বাধীন করি, কথা দাও তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। আমার সঙ্গে থাকবে?

সঙ্গে থাকা? অনেকগুলো ছবি ফুটে উঠল। ল্যারির সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। ল্যারিকে স্পর্শ করতে পারবে না। নোয়েলের কাছে এখন আর কোনো বিকল্প নেই, জীবন তা হলে কেমন হবে? যতদিন বেঁচে থাকবে, একটা সুযোগ তো থাকবে। সে ডেমিরিসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল- হ্যাঁ, কোস্টা, আমি শুধু তোমারই হব।

ডেমিরিস তাকালেন। আবেগে ভরে গেছে তার কণ্ঠস্বর। তিনি বললেন- ধন্যবাদ। অতীতকে আমরা ভুলে যাব। যেটা মরে গেছে, আমাদের সম্পর্কে সেটা প্রভাব ফেলবে কেন? আমরা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করব। আমি একজন অ্যাটর্নিকে তোমার জন্য নিযুক্ত করেছি।

কে?

–নেপোলিয়ান ছোটাস।

এই নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নোয়েলের মনে হল, অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে। হাজার আলো জ্বলে উঠেছে।

.

নেপোলিয়ান ছোটাস বসেছিলেন আইনজীবীদের টেবিলের একেবারে কোণে। একটু বাদে যে মহাযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, তার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছিলেন। ছোটাস জানেন, যদি এই সওয়াল জবাবটা আওনিয়াতে হত, তাহলে ভালো হত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। কারণ গ্রিক আইন অনুসারে যে জেলাতে অপরাধ সংঘটিত হয়, সেখানে এই বিচার অনুষ্ঠিত হতে পারে না। ছোটাস আরও জানেন যে, নোয়েলে পেজ যে অপরাধী এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারটা তার কাছে কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করে না। তিনি অন্য সব লইয়ারদের মতো অপরাধ নিয়ে চিন্তা করেন না। সকলেই সুবিচার পাবে। এমন একটা ধারণা পোষণ করেন।

বিচার এবার শুরু হতে চলেছে। তবে এবারে লড়াইটা একেবারে অন্যরকম। এই প্রথম নেপোলিয়ান ছোটাস তার মক্কেলের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। সত্যি সত্যি তিনি নোয়েলে পেজকে ভালোবাসেন। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ব্যক্তিগত আগ্রহে এই মামলাটা লড়তে রাজী হয়েছেন। তিনি জানেন, নোয়েলে পেজের জনপ্রিয়তা কতখানি। তিনি আরও জানেন, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর সাংবাদিকদের তীক্ষ্ণ নজর থাকবে। নোয়েলে, বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিমতী রমণী। সৌন্দর্যের প্রতীক। হ্যাঁ, এমন মেয়ে দেখলে প্রেমে পাগল হতে ইচ্ছে করে। ছোটাস আনন্দিত, নোয়েলের পাশে বসতে পেরেছেন।

প্রথমে ছোটাস ভেবেছিলেন, এই মেয়েটি বোধহয় শুধুই সুন্দরী, মাথায় বুদ্ধি নেই। নোয়েলের সঙ্গে কথা বলার পর তার সেই ধারণা পাল্টে গেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, মেয়েটি বুদ্ধিমতী। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ঠিক মেয়েকেই রক্ষিতা রেখেছিলেন। কিন্তু ল্যারি ডগলাসের সাথে নোয়েলের ভাব ভালোবাসা ব্যাপারটা ছোটাসের বোধগম্য হয়নি। অবশ্য পৃথিবীতে এমন ঘটনা অনেক সময় ঘটে। দুই নারী-পুরুষের মধ্যে তীব্র শারীরিক আকুতি দেখা যায়। অথচ যাদের মধ্যে অনেক ব্যবধান।

ডেমিরিসের সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তটাও ছোটাসের মনে হল। অনেক বছর ধরেই তারা একে অন্যকে চেনেন। কিন্তু ছোটাসের যে আইন সংস্থা আছে, তা ডেমিরিসকে কোনোদিন সাহায্য করেনি। শেষ পর্যন্ত ডেমিরিস ছোটাসকে তার বাড়িতে আসতে বললেন। ভূমিকা ছাড়াই ডেমিরিস বললেন

আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এই বিচারের ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে। মিস পেজ, আমার জীবনের একমাত্র মহিলা, যাকে আমি সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলাম।

তারা দুজন ছ ঘন্টা আলোচনা করেছিলেন। ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা নিয়ে খুঁটিনাটি পর্যালোচনা। নোয়েলের সপক্ষে দাঁড়াতেই হবে। যখন ছোটাস ওঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, একটা শর্ত স্থাপিত হল। বলা হল, ছোটাসকে দ্বিগুণ টাকা দেওয়া হবে। এরপর থেকে কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সমস্ত কাজে ছোটাসের আইন সংস্থা যুক্ত থাকবে।

ডেমিরিস বলেছিলেন- আপনার ওপর সবকিছু স্থাপন করলাম। আশা করি আপনি বাঁচাবেন।

ছোটাস এই প্রস্তাবটা মেনে নিয়েছিলেন। শুরু হল তার প্রবল পরিশ্রম। শেষ পর্যন্ত তিনি ভাবলেন, এই যুদ্ধে আমাকে জিততেই হবে।

দুজন বিচারক এসে প্রবেশ করলেন। তৃতীয় জজ কোর্টের প্রেসিডেন্ট, তিনি এলেন। তিনি মাঝের চেয়ারে বসলেন।

তিনি শুরু করলেন বিচার শুরু হোক।

.

পিটার ডেমোনিডাস, রাজ্যের হয়ে যিনি মামলা লড়ছেন, তিনি প্রথম কথা বলবেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন প্রসিকিউটর। এর আগেও নেপোলিয়ান ছোটাসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রত্যেক মামলায় একই ফলাফল হয়েছে। ওই বুড়ো বেজন্মাকে হারানো যাচ্ছে না। কেন? উনি জানেন না, কী এক অদ্ভুত কায়দায় ছোটাস একটির পর একটি মামলা জিতে যান।

দুজনের মধ্যে দারুণ বৈরীতা।

ডেমোনিডাস এবার কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি প্রথম আইনের কথা বললেন। তিনি দুজন নারী পুরুষের মানবিক বিকলনের কথাও উচ্চারণ করলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, এই বিচার শেষ হবার আগে রাষ্ট্র প্রমাণ করবে যে, এরা দুজন ঠান্ডা মাথায় ক্যাথারিন ডগলাসকে হত্যা করেছেন। ক্যাথারিনের একমাত্র দোষ কী? তিনি তার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসতেন? ভালোবাসার জন্য তাকে মরতে হল। ওই দুই অভিযুক্ত ভেবে-চিন্তে মৃত্যুর প্লটটা সাজিয়ে ছিলেন।

এটাই হল একমাত্র উদ্দেশ্য, এর মধ্যে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

ডেমোনিডাসের কথা বলা শেষ হয়ে গেছে। এবার নেপোলিয়ান ছোটাসের পালা। তিনি কাগজপত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি তার উদ্বোধনী ভাষণ শুরু করলেন। ধীরে ধীরে তিনি জুরিদের কাছে এগিয়ে এলেন। চারপাশে তাকালেন।

উইলিয়াম ফ্রেসারের দিকে তাকালেন। কতগুলো কথা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি বললেন- এই ভদ্রমহিলাকে এখানে কেন আনা হয়েছে? তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? তিনি কি সত্যি হত্যা করেছেন? মহামান্য আইন বিশারদ কী বলবেন? না, আমার মনে হয় হত্যার অপরাধ আনা উচিত নয়।

কথা বলতে বলতে ছোটাস চুপ করে গেলেন। মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন আমার মক্কেলকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, তিনি একটা আইন ভেঙেছেন। এমন একটা আইন যা কোথাও লেখা থাকে না। তিনি অন্য একজন মহিলার স্বামীর সঙ্গে অবৈধ সংসর্গে যুক্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে ওই ভালোবাসার কথা প্রকাশিত হয়েছে। জনগণের চোখে তিনি অপরাধী। সকলেই চাইছেন, তাঁকে যেন শাস্তি দেওয়া হয়।

ছোটাস চুপ করলেন, একটা সাদা বড়ো রুমাল বের করলেন। মুখ মুছলেন। তারপর তাকে ঝাড়লেন। ওই রুমালটা পকেটের ভেতর পুরে দিলেন।

সত্যি কথা, যদি উনি আইন ভেঙে থাকেন, ওনাকে আমরা শাস্তি দেব। কিন্তু হত্যার অপরাধ, যে হত্যা কোনদিনই হয়নি। তার জন্য কেন আমরা অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করব। নোয়েলে পেজ একজনের উপপত্নী, উনি থামলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তার নাম এখানে বলতে পারছি না। যে কোনো খবরের কাগজের পাতায় আপনারা সেই নামটা দেখতে পাবেন।

দর্শকদের মধ্যে থেকে হাসির হুল্লোড়।

আগস্টে ল্যাঙ্কনকে দেখা গেল দর্শকবৃন্দের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছোটো ছোটো চোখ রাগে জ্বলে উঠেছে। কী আশ্চর্য? নোয়েলের প্রতি এই অপমান? ডেমিরিস হয়তো কিছুই জানেন না। তা সত্ত্বেও? এমন হয় কী করে?

বলা হচ্ছে মিস পেজ এবং মিঃ লরেন্স ডগলাস শ্রীযুক্ত ডগলাসের স্ত্রীকে হত্যা করেছেন। যাতে তারা একে অন্যকে বিয়ে করতে পারেন। তাই তো? অনুগ্রহ করে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে দেখুন।

ছোটাস নোয়েলে এবং ল্যারির দিকে তাকালেন। কোর্টরুমে উপস্থিত সকলের চোখ সেদিকে পড়েছে।

সত্যি কি তারা পরস্পরকে ভালোবাসেন? হয়তো সত্যি? তার মানে কি তারা হত্যাকারী? না, আমি প্রমাণ করব, এখানে কেউই হত্যাকারী নয়। আমি লরেন্স ডগলাসের হয়ে কাজ করছি না। ওনার নিজস্ব আইনজীবী আছে। তিনিও যথেষ্ট বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান। কী আশ্চর্য, রাষ্ট্র বলছে এই দুজন মানুষ একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছেন। তারা একসঙ্গে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। একজন যদি অপরাধী হয়ে থাকেন, অন্য জনও হবেন। আমি প্রমাণ করব, তারা দুজনেই সম্পূর্ণ নিরপরাধ। কোনো কিছুই আমার মনেকে পরিবর্তন করতে পারবে না।

 ছোটাস বলছেন–ক্যাথারিন ডগলাস বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন সে সম্পর্কে আমার ক্লায়েন্টের কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি কী করে জানবেন? তিনি তো ক্যাথারিনের সঙ্গে দেখা করেননি। ভাবুন তো, এটা কি হওয়া সম্ভব? যে মানুষটির সাথে আপনার জীবনে কখনও দেখা হয়নি, আপনি তাকে মারবেন কী করে? এব্যাপারে অনেকগুলো তথ্য আছে।এক এক করে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করব। যে তথ্যটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে, তা হল ক্যাথারিনের স্বামী এবং মিস পেজের মধ্যে গভীর গোপন ভালোবাসা ছিল। তাদের মধ্যে হৃদয়ের আর্তি ছিল। ভয় ছিল না। প্রিয় ভদ্রমহোদয়রা, ভেবে দেখুন, ব্যাপারটা খুবই সহজ। এক সরল সাদা প্রেমিকার সাথে প্রেমিকের আলাপন।

ল্যারি ডগলাসের অ্যাটর্নি হলেন ফ্রেডরিক স্টাভরস। তিনি নিঃশ্বাস ফেললেন। কদিন ধরে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখছেন। তার কেবলই মনে হচ্ছে, নোয়েলে পেজকে বোধহয় ছেড়ে দেওয়া হবে, আর তার মক্কেলকে ফাঁসি দেওয়া হবে। এটা হলে সকলের কাছে তিনি হাস্যাস্পদ হবেন। ফ্রেডরিক নেপোলিয়ান ছোটাসের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, ছোটাস তার চোখে এক মহান তারকা। এখন শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। দুজন অপরাধীকে তিনি একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। শুধু নিজের ক্লায়েন্টেকে বাঁচাবার জন্য উদগ্রীব নন, এই বিচারসভায় জিততে পারলে ফ্রেডরিকের গোটা ভাগ্যটা পাল্টে যাবে। তিনি যা চাইছেন, সবকিছু মুঠোবন্দী করতে পারবেন। বুড়ো মানুষটার জন্য অনেক শ্রদ্ধা উথলে উঠল। স্টাভরস ছোটাসের দিকে তাকালেন। প্রতিটি শব্দ শোনার চেষ্টা করছেন।

ছোটাস বলছেন- এটা এমন এক মহিলার গল্পকথা, যিনি জীবনে সব কিছু পেয়েছেন, সবকিছু ছেড়েও দিয়েছেন। এর মধ্যে ঘাতিকার চিহ্ন কোথায়?

ছোটাসের কথা বলা এগিয়ে চলেছে। নোয়েলে পেজ উদাস চোখে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে ছোটাস নোয়েলে সম্পর্কে একটা সুন্দর বাতাবরণ সৃষ্টি করতে চলেছেন।

তিনি বলছেন– এই মহিলা পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সমস্ত জীবনটা উনি অর্থের মধ্যে কাটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কপর্দকহীন এক পাইলটকে ভালোবেসেছেন।

ছোটাস আবেগ সম্পৃক্ত ভাবনার সৃষ্টি করতে চাইছেন। জনগণের মধ্যে অনুভূতির সঞ্চারণ।

.

ল্যারি ডগলাস উইটনেস বক্সে বসে আছেন। ছোটাসের প্রত্যেকটা শব্দ শোনার চেষ্টা করছেন। তার কেবলই মনে হচ্ছে, হয়তো শেষ পর্যন্ত তিনিও বেঁচে যাবেন। তারপর? তারপর কী হবে? বছর কুড়ি বয়সের এক তরুণী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো কিছু বলতে চাইছে সে। ল্যারি বুঝতে পারল, সে হল এক সাংবাদিক। সে মিষ্টি করে হাসল। তরুণীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

.

পিটার ডেমোনিডাস এবার সওয়াল জবাব শুরু করবেন। তিনি বললেন- আপনার নাম কী?

–আলেকটিস মাইনস।

–আপনার পেশা কী?

–আমি একজন অ্যাটর্নি।

-দেখুন তো, এই দুই অভিযুক্তকে আপনি চিনতে পারছেন কি না? আপনি কি কখনও ওদের দেখেছেন? ওদের কাউকে?

-ইয়েস স্যার। একজনকে।

কাকে?

–ওই পুরুষকে।

মিঃ লরেন্স ডগলাস?

–হ্যাঁ।

কীভাবে আপনার সঙ্গে ডগলাসের দেখা হয়েছে?

ছমাস আগে উনি আমার অফিসে এসেছিলেন?

 কী জন্য?

–পেশার ব্যাপারে আলোচনা করতে।

কী ধরনের সাহায্য উনি চেয়েছিলেন?

 বলব কি?

–হ্যাঁ, ভালো করে বলুন।

–উনি ডিভোর্স কেস করার জন্য আলোচনা করেছিলেন।

–উনি এর জন্য আপনাকে লাগিয়ে ছিলেন কি?

-না, যখন উনি সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বললেন, আমি বললাম, উনি গ্রিসে কখনওই ডিভোর্স পাবেন না।

–তখন কী হয়েছিল?

-প্রথমে উনি বলেছিলেন যে, এই ব্যাপারটা জানাজানি হলে অসুবিধা হবে। তারপর উনি বলেছিলেন, ওনার বউ কিছুতেই ডিভোর্স দিতে চাইছেন না।

–তার মানে উনি ডিভোর্সের কথা বলেন আর বউ সেটা অস্বীকার করেন, এই তো?

হ্যাঁ, একথাই উনি বলেছিলেন।

–আপনি ওনাকে সাহায্য করতে পারবেন না, একথা বলেছিলেন কি? যদি ওনার স্ত্রী স্বেচ্ছায় ডিভোর্স না দেন, তাহলে এটা পাওয়া যাবে না, একথাও বলেছিলেন?

–হ্যাঁ, আমি তা বলেছিলাম।

তারপর কী হয়েছে?

–আমি বাধা দিয়েছি।

 কথা এগিয়ে চলল।

.

ছোটাস চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন– আপনি কি একজন অ্যাটর্নি, মিঃ মাইনস?

-হ্যাঁ।

বাঃ, দেখা যাচ্ছে আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান মানুষ। আমি আইনের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করি। আপনি কি করপোরেট লিটিকেশন নিয়ে কাজ করেন?

না, আমি এ ব্যাপারটা জানি না।

ট্যাক্সের ব্যাপার?

–আমি ট্যাক্স লইয়ার নই।

মাইনসের মুখ রাগে থমথম করছে। ছোটাস মাথা চুলকোচ্ছেন তাহলে কী ধরনের কাজ আপনি করেন?

–শুধুমাত্র ডিভোর্সের কেস আমি করে থাকি।

ছোটাসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মিঃ ডেমোনিডাস একজন এক্সপার্ট কি এখানে  পাঠিয়েছেন।

অ্যালেক্স মাইনস বললেন- হ্যাঁ, ধন্যবাদ।

ছোটাস বললেন– আমি কখনও ডিভোর্সের ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি। আমি এ ব্যাপারে আপনার ওপর নির্ভর করব। আমি জানি, এর জন্য নিশ্চয়ই আপনাকে ব্যস্ত থাকতে হয়।

-হ্যাঁ, আমার হাতে অনেকগুলি কেস আছে। যতগুলো আমি ব্যবস্থা করতে পারি তত গুলো।

–অনেকগুলো নিশ্চয়ই?

 –হ্যাঁ, তা তো বটেই।

পিটার ডেমোনিডাস ছোটাসের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী ঘটনা ঘটবে তিনি বুঝতেই পারছেন না।

ছোটাস বললেন– আমি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছি না মিঃ মাইনস। কিন্তু আমার পেশাগত কারণে জানতে চাইছি, সারা বছরে আপনার কাছে এধরনের কতজন ক্লায়েন্ট আসেন?

–ঠিক মতো বলতে পারব না।

–মোটামুটি বলুন।

মনে হচ্ছে দুশো। এটা আমার ধারণা এবং অনুমান।

–দুশো জন আসেন ডিভোর্স করতে। অনেক কাজ করতে হয় আপনাকে, কাগজপত্র সামলাতে হয়, তাই তো?

না, ঠিক দুশো হয় না।

ছোটাস অবাক হয়ে গেছেন কেন?

সব কটা তো আর ডিভোর্সের ব্যাপার নয়।

ছোটাসের মুখে ধাঁধাঁ- আপনি যে এইমাত্র বললেন, ডিভোর্স ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপার নিয়ে আপনি আলোচনা করেন না।

-হ্যাঁ, মাইনসের গলা বসে গেছে।

বলুন, ভালো করে বলুন। ছোটাস বোধহয় অবাক।

–তারা সকলেই আর শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদে জয়যুক্ত হন না।

–তাহলে তারা কেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে আসেন?

–অনেক কারণ থাকে, অনেক সময় তাদের মন পরিবর্তিত হয়ে যায় নানা কারণে।

 ছোটাস মাথা নাড়লেন- আহা, আবার মিলন হয়ে যায় তাই তো?

-ঠিকই বলেছেন।

–তা হলে? কতজন শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সে লেগে থাকেন? দশ শতাংশের বেশি হবে কি?

মাইনস চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন- আর একটু বেশি হবে।

কত বেশি? পনেরো শতাংশ? কুড়ি শতাংশ।

–চল্লিশ শতাংশ।

 নেপোলিয়ান ছোটাস অবাক হয়ে গেছেন- মিঃ মাইনস, আপনি বলছেন, যতজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তার প্রায় অর্ধেকই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সটা চায় না?

–হ্যাঁ।

মাইনসের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তিনি পিটার ডেমোনিডাসের দিকে তাকালেন। ডেমোনিডাস মাটির একটা ফাটলের দিকে চেয়ে আছেন।

তার মানে? ওরা কি আপনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন না?

 মাইনস নিজেকে বাঁচানোর জন্য বললেন- কখনওই নয়। তাদের মধ্যে হঠাৎ বিক্ষোভ দেখা দেয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। তারা পরস্পরকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। ভাবেন এখনই বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে। পরে আবার শান্তির বাতাবরণ। মন পরিবর্তিত।

তার কথা বলা শেষ হয়ে গেল। ছোটাস শান্তভাবে বললেন– ধন্যবাদ। আপনি আমাকে আরও সাহায্য করবেন ভবিষ্যতে আশা করি। আপনি আমার কাজটা সহজ করে দিয়েছেন।

পিটার ডেমোনিডাস এবার সাক্ষ্যের সাথে কথা বলবেন।

–আপনার নাম প্লিজ?

কাস্টা, আইরিন কাস্টা।

–মিস অথবা মিসেস?

আমি একজন বিধবা।

–আপনার পেশা কী শ্রীমতী কাস্টা।

–আমি হাউসকিপার। বাড়ি দেখাশোনা করি।

–আপনি কোথায় কাজ করেন?

রাফিনাতে এক ধনীর পরিবারে।

-সেটা বোধহয় সমুদ্রের ধারে একটা গ্রাম, তাই তো? এথেন্স থেকে একশো কিলোমিটার উত্তরে, তাই তো?

হা।

–আপনি ওই দুই অভিযুক্তের দিকে তাকান তো। ওদের কোথাও দেখেছেন?

–হ্যাঁ, অনেক বার।

কী ধরনের অবস্থায়?

–আমি যে ভিলাতে কাজ করি, তার পাশের ভিলাতে ওঁরা এসে থাকতেন। অনেক সময় ওঁদের আমি সমুদ্র সৈকতে বসে থাকতে দেখেছি। একেবারে উলঙ্গ অবস্থায়।

দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল।

পিটার ডেমোনিডাস ছোটাসের দিকে তাকালেন। ছোটাস হয়তো বাধা দেবার চেষ্টা করবেন তিনি ভেবেছিলেন। বুড়ো আইনজ্ঞ চুপচাপ বসে আছেন। তার মুখে দুয়ে হাসি। এই হাসিটাই ডেমোনিডাসকে বারবার অকেজো করে দেয়।

তিনি আবার সাক্ষীর দিকে এগিয়ে গেলেন।

–আপনি ঠিক বলছেন, এই দুজনকে দেখেছেন? আপনি কিন্তু শপথ নিয়েছেন। সত্যি কথা বলছেন তো?

-হ্যাঁ, আমি কোনো মিথ্যে বলছি না।

–যখন তারা সমুদ্র সৈকতে বসে থাকতেন, তখন কী মনে হত? তাদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা হয়েছে?

-হ্যাঁ, তারা ভাইবোনের মতো আচরণ করতেন না।

আবার দর্শকদের মধ্যে হাসির হুল্লোড়।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ শ্রীমতী কাস্টা। ডেমোনিডাস এবার ছোটাসের দিকে তাকিয়ে বললেন– আপনি প্রশ্ন করবেন?

ছোটাস উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ওই ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে গেলেন।

কত দিন ধরে আপনি ওই ভিলাতে কাজ করছেন মিসেস কাস্টা।

সাত বছর ধরে।

–সাত বছর, আপনি নিশ্চয়ই ভালভাবে কাজ করেন। তাই তো?

–হ্যাঁ, আমার কাজে কোনো ত্রুটি পাবেন না।

–আপনি কি আমার জন্য একজন ভালো হাউসকিপারের সন্ধান করবেন? আমি রাফিনাতে সমুদ্রের ধারে একটা বাগানবাড়ি কিনব। আমার সমস্যা কী বলুন তো? এমন একটা গোপন জায়গা দরকার যেখানে আমি ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পারি। আমার মনে হয় ওখানে অনেকগুলো ভিলা আছে, তাই না? পরস্পর সংলগ্ন?

-না, স্যার। প্রত্যেকটা ভিলার পাশে একটা বিরাট দেওয়াল আছে।

বাঃ, ভালো বলেছেন তো। তাহলে একটা ভিলা থেকে আর একটা ভিলার দূরত্ব কত হবে?

স্যার, অন্তত একশো গজ তো হবেই। আমি জানি, একটা ভিলা বিক্রির জন্য আছে, সেখানে আপনি সবরকম নিরাপত্তা পাবেন। আমার বোনকে আমি দেব, সে দেখাশোনা করতে পারবে। সে রান্নাও জানে।

–অনেক ধন্যবাদ মিসেস কাস্টা। ব্যাপারটা ভালোই শোনাচ্ছে। আজ বিকেলবেলা আমি ওনাকে ডেকে পাঠাব।

-না, আজ সে ব্যস্ত আছে। সে ছটার পরে বাড়িতে ফিরবে।

–এখান কটা বাজে?

–আমি তো সঙ্গে ঘড়ি আনিনি।

 –ওই দেওয়াল ঘড়ি ঝুলছে। কী বলছে?

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা তো ওই দিকে আছে।

 –এখন থেকে ঘড়িটা কতদূর হবে?

–পঞ্চাশ ফুট।

তেইশ ফুট দূরে মিসেস কাস্টা। আমি আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন করব না।

.

ট্রায়ালের পঞ্চম দিন। ডঃ ইসরায়েল কাটজের পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। যখন তিনি অপারেশন করেন, তখন তাকে ওই কৃত্রিম পায়ের ওপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে কোনো অসুবিধা হয় না। বসার সময় কেমন যেন হয়ে যায়। সমস্ত শরীরে একটা অসহ্য যন্ত্রণা। তিনি প্রতিদিন বিচারসভায় গেছেন। নেপোলিয়ান ছোটাসের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবকিছু বোঝার চেষ্টা করেছেন। নোয়েলেকে বলেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। তিনি জানেন, ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে চলেছে।

ইসরায়েল কাটজ, নোয়েলেকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। নোয়েলে না থাকলে আজ পৃথিবীটা। অন্যরকম হয়ে যেত। এখন ছোটাসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শাস্তি অথবা মুক্তি কী হবে? যদি নোয়েলে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে? তাহলে সে স্বাধীন হবে। আর তা না হলে…

.

–আপনার নাম?

–ক্রিস্টিয়ান বারবেড।

–আপনি কি ফরাসি নাগরিক?

–হ্যাঁ।

–আপনি থাকেন কোথায়?

প্যারিসে।

–আপনি কি কোর্টকে বলবেন, আপনার কী পেশা?

–আমি একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিক।

 –এই এজেন্সিটা কোথায়?

–এটা প্যারিসে অবস্থিত।

কী ধরনের কাজ আপনি করেন?

–সব করমের। বাণিজ্যিক কাজকর্ম, কেউ হারিয়ে গেছে, তাকে খুঁজে নিয়ে আসা। কারোর ওপর কঠিন নজর রাখা। স্বামী স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে অনুসন্ধান করা।

-মঁসিয়ে বারবেড, এই কোর্টঘরের চারদিকে তাকান তো, বলুন তো কেউ কোনোদিন আপনার ক্লায়েন্ট হিসেবে গিয়েছিল কিনা?

তিনি বললেন- হ্যাঁ, স্যার।

কে?

–ওই ভদ্রমহিলা। মিস নোয়েলে পেজ।

দর্শকদের মধ্যে আবার গুঞ্জন।

–মিস নোয়েলে পেজ আপনাকে ভাড়া করেছিলেন? কী কারণে?

–তিনি ল্যারি ডগলাস সম্বন্ধে আগ্রহী ছিলেন। ল্যারি ডগলাসের কার্যকলাপের রিপোর্ট তাকে দিতে হত।

-দেখুন তো ওই ল্যারি ডগলাস এখানে আছেন কিনা?

–হ্যাঁ, স্যার।

 –এর জন্য মিস পেজ কি আপনাকে টাকা দিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, স্যার।

–আমার হাতে এই কাগজগুলো আছে। দেখুন তো, এই রেকর্ডগুলোর জন্য আপনাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল কিনা?

-হ্যাঁ, স্যার।

–মঁসিয়ে বারবেড, কীভাবে আপনি মিঃ ডগলাস সম্পর্কে এত খবর সংগ্রহ করতেন?

–এটা বলা খুবই শক্ত। আমি ফ্রান্সে থাকতাম। ডগলাস থাকতেন ইংল্যান্ডে। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তারপর আবার ফ্রান্সে চলে আসেন। ফ্রান্স তখন জার্মানিদের অধিকৃত।

কী বলছেন? আমি বলছি, ফ্রান্সের বেশ কিছুটা তখন জার্মানদের দখলে ছিল।

–এক মুহূর্ত, আপনি কী বলছেন মঁসিয়ে বারবেড? এই মাত্র মিস পেজের অ্যাটর্নি জানালেন যে, পেজ এবং ল্যারি ডগলাসের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছে। আর আপনি বলছেন, অনেক বছর আগে তারা একে অপরকে ভালোবাসতেন? কত বছর আগে?

–অন্তত ছবছর হবে।

আবার জনগণের মধ্যে থেকে নানা মন্তব্য ভেসে এল। ডেমোনিডাস ছোটাসের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি কিছু বলবেন?

নেপোলিয়ান চোখ বন্ধ করলেন। উইটনেস বক্সের দিকে এগিয়ে গেলেন। উনি বললেন, মিঃ বারবেড, আমি আপনাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখব না। আমি জানি, আপনি ফ্রান্সে ফিরতে আগ্রহী। সেখানে আপনার পরিবারের সকলে আছেন, তাই তো?

-হ্যাঁ, আপনি বলুন, আমি কিছু মনে করছি না মঁসিয়ে।

ধন্যবাদ। ব্যাপারটা কিছুটা ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে। এই স্যুটটা পরে আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে মিঃ বারবেড।

আপনাকে আবার ধন্যবাদ মঁসিয়ে।

–এটা কি প্যারিসে তৈরি?

–হ্যাঁ।

–এটা খুব ভালো মানিয়েছে আপনাকে। আমার স্যুটগুলো একদম ভালো হয় না। আপনি কখনও ইংল্যান্ডের দরজিদের কাছে যান না কেন? তারা তো সুন্দর স্যুট বানায়।

–না, মঁসিয়ে।

–আপনি ইংল্যান্ডে অনেক বার গেছেন?

–হ্যাঁ, বা না।

না, স্যার।

—আমেরিকা?

-না, স্যার।

কখনও নয়?

–না, স্যার।

–আপনি কখনও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে গেছেন?

–না, স্যার।

–তাহলে আপনি বলুন, আপনি কেমন ডিটেকটিভ। আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতেই হবে। এই সব রিপোর্টগুলো এসেছে ইংল্যান্ড থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে। আর আপনি বলছেন, আপনি কখনও সেখানে যাননি। আপনি কি পাগল?

–মঁসিয়ে, আমি ঠিক কথা বলছি। আমাকে কোনো জায়গায় যেতে হয় না। সব জায়গাতে আমার প্রতিনিধি আছে। ইংল্যান্ডে আছে, আমেরিকাতে আছে।

–আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করবেন না। আপনি কি জানেন, ওই লোকগুলো মিঃ ডগলাসের সম্পর্কে সত্যি কথা বলেছেন?

-অবশ্যই।

মিঃ ডগলাসের কাজকর্ম সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত ধারণা ছিল না, তাই তো?

–না, স্যার।

–তাহলে এইসব খরবগুলো এসেছে অন্য সূত্র থেকে।

 –হ্যাঁ।

ছোটাস এবার বিচারপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন– পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখতে হবে। মাননীয় বিচারপতিরা, সবটাই গুজবের ওপর নির্ভর করছে।

পিটার ডেমোনিডাস বললেন, আমি বাধা দেবার চেষ্টা করছি। নোয়েলে পেজ মিঃ বারবেডকে ভাড়া করেছিলেন। ল্যারি ডগলাস সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করার জন্য। এর মধ্যে গুজব কোথা থেকে আসছে।

আমার মহামান্য আইনজীবী এই ব্যাপারে কতগুলো সাক্ষ্য দাখিল করেছেন। ছোটাস বলতে থাকেন, আমি সেগুলোকে গ্রহণ করব। কিন্তু যে সমস্ত মানুষেরা ডগলাস সম্পর্কে এই খবরগুলো দিয়েছে, তাদের সকলকে আদালত চত্বরে হাজির করতে হবে। যদি তা করা না সম্ভব হয়, তাহলে আমি বলব, এইসব সাক্ষ্য প্রমাণের কোনো দরকারই হবে না। আমি এগুলোকে গ্রহণ করতে পারব না।

কোর্টের প্রেসিডেন্ট ডেমোনিডাসের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি কি ওইসব সাক্ষীদের কোর্টে আনতে পারবেন?

–এটা অসম্ভব? পিটার ডেমোনিডাস বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। মিঃ ছোটাস জানেন যে, অনেক সপ্তাহ লেগে যাবে তাদেরকে ধরতে।

প্রেসিডেন্ট ছোটাসের দিকে তাকিয়ে বললেন– আপনার আবেদন মঞ্জুর হল।

.

পিটার ডেমোনিডাস এবার জেরা করবেন।

–আপনার নাম কী?

 –জর্জ মসন।

–আপনি কী করেন?

 –আমি আয়োনিয়ার প্যালেস হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক।

–দেখুন তো ওই দুই অভিযুক্তের দিকে তাকিয়ে। ওঁদের কখনও কোথাও আগে দেখেছেন কি?

–ওই ভদ্রলোককে আমি দেখেছি। গত আগস্ট মাসে তিনি আমাদের হোটেলের গেসট ছিলেন।

উনি কি মিঃ লরেন্স ডগলাস?

–হ্যাঁ, স্যার।

উনি কি একা ছিলেন? যখন ঢোকেন?

–না, স্যার।

 –ওনার সঙ্গে কে ছিলেন?

—ওনার স্ত্রী।

ক্যাথারিন ডগলাস?

–হ্যাঁ, স্যার।

–তারা মিঃ এবং মিসেস ডগলাস, এই নাম লেখেছিলেন?

 –হ্যাঁ, স্যার।

–আপনি এবং মিঃ ডগলাস কি কখনও তেরামার গুহা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন?

–হ্যাঁ, স্যার।

–আপনি নিজে থেকে এই ব্যাপারটা বলেন, নাকি মিঃ ডগলাস জানতে চেয়েছেন?

–যত দূর মনে পড়ছে উনি জানতে চেয়েছিলেন। উনি ওই গুহা সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ওনার স্ত্রী নাকি ওই গুহায় যাবার জন্য উদগ্রীব। তিনি গুহাতে যেতে ভালোবাসেন। এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব অদ্ভুত লেগেছিল।

তারপর কী হল?

সাধারণ মেয়েরা এইসব জায়গায় যেতে চায় না।

 শ্ৰীমতী ডগলাসের সঙ্গে আপনার এবিষয়ে আলোচনা হয়েছিল কি?

 না, স্যার। শুধুমাত্র শ্রী ডগলাসের সাথে।

–আপনি কী বলেছিলেন?

–আমি বলেছিলাম, ওখানে যাওয়া উচিত নয়। বিপদ ঘনাতে পারে।

আপনি কি গাইড নেবার কথা বলেছিলেন?

 –হ্যাঁ, স্যার। আমি বলেছিলাম যে, একজন গাইডকে সঙ্গে নেওয়া দরকার।

–আর কোনো প্রশ্ন আমি করব না। এবার আপনি কথা বলুন মিঃ ছোটাস।

.

–আপনি কতদিন ধরে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন মিঃ মসন?

–কুড়ি বছরের বেশি।

এর আগে আপনি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট ছিলেন, তাই তো?

–আমি, না, স্যার।

একজন মনোস্তত্ত্ববিদ হয়তো?

–না, স্যার।

–তাহলে আপনি কী করে মেয়েদের মন সম্পর্কে এত খবর রাখেন?

–আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট নই, কিন্তু হোটেলে থাকতে গেলে মেয়েদের অনেক খবর জানতে হয়।

–আপনি ওসা জনসনের নাম শুনেছেন?

–ওসা? তিনি কে?

–তিনি এক বিখ্যাত অভিযাত্রী। আপনি অ্যামিলিয়া আর হার্টের নাম শুনেছেন?

না, স্যার।

–মার্গারেট স্মিথ?

–না, স্যার।

–আপনার কি বিয়ে হয়েছে মিঃ মসন?

–এখনও হয়নি, কিন্তু আগে আমার তিনবার বিয়ে হয়েছিল। এইভাবে আমি মেয়েদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছি।

–আমি বলতে চাইছি, মিঃ মসন, সত্যি সত্যি যদি আপনি মেয়েদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠতে চান, তাহলে একটা বিয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করুন। আমি আপনাকে আর বেশি প্রশ্ন করতে চাইছি না।

.

আপনার নাম প্লিজ?

 ক্রিস্টোফার।

 –আপনি কী করেন?

 আমি তেরামার গুহার গাইড।

কতদিন ধরে এই কাজ করছেন?

দশ বছর।

ব্যাপারটা ভালই।

–খুবই ভালো। হাজার হাজার মানুষ গুহাগুলো দেখতে আসে।

–দেখুন তো, এই মানুষটিকে আপনি আগে দেখেছেন কিনা? মিঃ ডগলাসকে।

–হ্যাঁ, স্যার, উনি আগস্ট মাসে গুহা পরিদর্শনে এসেছিলেন।

–আপনি ঠিক বলছেন?

–হ্যাঁ।

–এই ব্যাপারটা আমাকে অবাক করছে ক্রিস্টোফার। এত জন গুহা দেখতে আসেন, অথচ আপনি একজনকে চিনলেন কেমন করে?

-কেন আমি ওনাকে ভুলতে পারিনি তা কি বলব?

–হ্যাঁ, বলুন।

উনি গাইডের সাহায্য চাননি।

সমস্ত দর্শকরাই কি গাইডের সাহায্য চান?

জার্মান এবং ফরাসিরা এ ব্যাপারে উদাসীন। আমেরিকানরা সকলেই গাইড নিয়ে ঘুরতে ভালোবাসেন।

হাসির হুল্লোড়।

–দেখছি, আর কোনো কারণ আছে কি?

-হ্যাঁ, আর একটা কারণ আছে। যখন গাইডের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল, ওনার সঙ্গে যে ভদ্রমহিলা ছিলেন, তিনি কেমন যেন আচরণ করলেন। উনি বললেন, গাইড লাগবে, ভদ্রমহিলা বারবার বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। এক ঘণ্টা বাদে আমি দেখলাম, তিনি অত্যন্ত দ্রুত বেরিয়ে আসছেন। উনি একা, কোনো একটা ঘটনাতে ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। আমি ভাবলাম ওই মহিলার হয়তো কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমি ওনার কাছে ছুটে যাই। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, ওই মহিলা ঠিক আছেন কিনা? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন মহিলা?

…আমি বললাম, যে মহিলাকে নিয়ে আপনি এই গুহার মধ্যে ঢুকেছিলেন। ওনার মুখ। সাদা হয়ে গেল। উনি আমাকে মারতে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি, আমার সাহায্য চাই।উনি কাঁদতে শুরু করলেন।

–কিন্তু উনি কি সাহায্য চেয়েছিলেন? আপনি জিজ্ঞাসা করার আগে পর্যন্ত।

–এটা ঠিকই বলেছেন।

তারপর কী হল?

–আমি অন্য গাইডদের ডেকে পাঠালাম। খোঁজাখুঁজি শুরু হল। কেউ কেউ নতুন অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। এই অঞ্চলটা সাধারণের জন্যে ভোলা হয় না। সেখানেই আমরা ওই ভদ্রমহিলাকে পেয়েছিলাম। তিন ঘণ্টা বাদে। তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

–একটা শেষ প্রশ্ন করব, ভালোভাবে উত্তর দেবেন। ডগলাস যখন প্রথম ওই গুহা থেকে বেরিয়ে আসেন, তিনি কি কারও দিকে তাকিয়ে ছিলেন? সাহায্যের জন্য? নাকি তিনি চলে যাবার চেষ্টা করছিলেন?

উনি চলে যাবার চেষ্টা করছিলেন।

নেপোলিয়ান ছোটাসের গলা অত্যন্ত শান্ত। তিনি বললেন- আপনি কি একজন মনোস্তত্ত্ববিদ?

না, স্যার। আমি একজন গাইড।

আপনি কি মানসিক রোগি?

না।

–আমি একথা কেন জিজ্ঞাসা করছি, বলুন তো? গত সপ্তাহে আমরা হোটেল ক্লার্কের সঙ্গে কথা বললাম, যিনি নিজেকে মানব মনের বিশারদ বলে পরিচয় দিলেন। তারপর আরও একজন মানুষের সঙ্গে কথা বললাম, যার চোখের দৃষ্টি খুবই অস্পষ্ট এবং আবছা। এবার দেখছি আপনি এসে দাঁড়িয়েছেন। আপনি একজন পর্যটককে আলাদাভাবে মনে রেখেছেন। আপনি তার মনের ভাষা পড়তে পারছেন। আপনি কী করে জানলেন যে, ওই ভদ্রলোক কারো সাহায্য চাইছিলেন না?

তাকে দেখে মনে হচ্ছিল।

 কী মনে হচ্ছিল?

আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না।

 –আপনার চোখ খুব ভালো। আপনি এই কোর্ট ঘরের চারদিকে তাকান তো? এখানে এমন কেউ কি আছে যাকে আপনি আগে দেখেছেন?

–ওই অভিযুক্ত।

–আর কেউ? ভালো করে ভেবে বলুন তো।

না।

তার মানে? যদি দেখে থাকতেন, তাহলে আপনার নিশ্চয়ই মনে থাকত।

অবশ্যই।

 –আপনি কি আমাকে আগে দেখেননি?

না, স্যার।

–এই কাগজের দিকে তাকান তো। বলুন তো এটা কী?

–এটা টিকিট।

–কীসের টিকিট?

–তেরামার গুহার ছাড়পত্র।

–কোন্ দিন লেখা আছে?

 –সোমবার, তিন সপ্তাহ আগে।

 –হ্যাঁ, এই টিকিটটা আমি কিনেছিলাম এবং আমি ব্যবহার করি। মিঃ গাইড, আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন ছিলেন। আপনি আমার গাইড ছিলেন। আমি আর কোনো প্রশ্ন করতে চাইছি না।

.

–তোমার পেশা কী?

–আমি আয়োনিয়ার প্যালেস হোটেলের একজন বলবয়।

–দেখো তো, ওই অভিযুক্তকে তুমি চিনতে পারছ কিনা?

–হ্যাঁ, আমি ছবিতে দেখেছি।

–ওনাকে সামনা-সামনি কি কখনও দেখেছ?

-হ্যাঁ, উনি আমাদের হোটেলে এসেছিলেন। উনি জানতে চেয়েছিলেন, মিঃ ডগলাস কোন্ ঘরে বাস করছেন? আমি ঘরটা বলে দিয়েছিলাম।

–এটা কবে ঘটেছিল?

—আগস্টের প্রথম তারিখে।

 –সেই মহিলাই তো ইনি?

–আমি ওনাকে কী করে ভুলে যাব? উনি আমাকে দুশো ডাকমা বকসিস দিয়েছিলেন।

.

দেখতে দেখতে চার সপ্তাহ গড়িয়ে গেল। সকলেই বুঝতে পারছে যে, নেপোলিয়ান ছোটাস অসাধারণ ভাষণ দিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও বোধহয় শেষ পর্যন্ত তিনি বাঁচতে পারবেন না।

.

পিটার ডেমোনিডাস দুই প্রেমিক-প্রেমিকার ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। একে অন্যকে পাবার জন্য আকুল। তারা বিয়ে করে সুখী হতে চায়। ক্যাথারিন ডগলাস তাদের মাঝে কাঁটা। দিন এগিয়ে যাচ্ছে। ডেমোনিডাস এই পরিকল্পনাটাকে পরিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছেন।

ল্যারি ডগলাসের অ্যাটর্নি ফ্রেডারিক স্টাভরস নেপোলিয়ান ছোটাসের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন। এখন স্টাভরসের মনে হচ্ছে, অলৌকিক কিছু না ঘটলে, এই মামলায়, তার মক্কেল শাস্তি পাবেই। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস যদি কলকাঠি নাড়েন, তা হলে কী হবে? যদি নোয়েলে পেজকে অভিযুক্ত করা হয় তাহলে ওই গ্রিক টাইফুন বোধহয় সামনে আসতে চাইবেন না। এটা তার নিজস্ব পরাজয়। আর যদি মনে হয় যে, নোয়েলের মুক্তি পাবার সামান্যতম সম্ভাবনা আছে, তাহলে উনি আবার স্বমূর্তি ধারণ করবেন।

.

শনিবার বিকেলবেলা। এবার শেষ দৃশ্যের উন্মোচন হবে।

–আপনি আপনার নাম বলবেন?

–ডঃ কাজোমিডেস।

 মিস্টার অথবা মিসেস ডগলাসের সাথে আপনার দেখা হয়েছে?

 দুজনের সাথে।

–কেন?

–আমার কাছে একটা খবর এল, আমাকে এখনই তেরামার গুহাতে যেতে হবে। একজন মহিলা সেখানে হারিয়ে গেছেন। খুঁজতে খুঁজতে তাকে পাওয়া গেছে, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।

-তার শরীরে আঘাত ছিল?

-হ্যাঁ, হাত পা কেটে গেছে। চিবুকে কাটা দাগ। পাথরে আঘাত লেগেছে। তিনি পাথর থেকে পড়ে গেছেন। মাথা ফেটে গেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে মরফিন দিয়েছিলাম, যন্ত্রণা উপশমের জন্য। বলেছিলাম, স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

–তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়?

না, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

আপনি ঠিক করে বলুন তো?

–স্বামী জেদাজেদি করাতে তাকে আবার প্যালেস হোটেলের বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হয়।

ব্যাপারটা আপনার কাছে অবাক লাগেনি ডাক্তার?

–হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন, নিজের স্ত্রীর দেখাশোনা উনিই করবেন।

মিসেস ডগলাসকে সোজাসুজি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। আপনি কি সঙ্গে ছিলেন?

-হ্যাঁ, আমি ওনার সাথে বাংলোয় যেতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, ওনার যখন ঘুম ভাঙবে, তখন যেন আমাকে দেখেন।

যখন ওনার ঘুম ভাঙে, তখন আপনি ছিলেন?

–হ্যাঁ।

মিসেস ডগলাস আপনাকে কী বলেছিলেন?

 –তিনি কিছু কথা বলেছিলেন অত্যন্ত গোপনীয়।

আপনি কি কোর্টের কাছে সেই কথা বলবেন?

–উনি বলেছিলেন যে, স্বামী ওনাকে মারতে চাইছে।

এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কোর্টরুমে দারুণ হৈ-হট্টগোল শুরু হল। পাঁচ মিনিট ধরে কোনো কথা শোনা গেল না। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বারবার হাতুড়ি ঠুকে জনগণকে শান্ত করলেন।

নেপোলিয়ান ছোটাস এবার এগিয়ে যাচ্ছেন। তাকে নোয়েলে পেজের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। এই প্রথম নোয়েলেকে খুবই ভেঙে পড়া অবস্থায় মনে হল।

ডেমোনিডাস প্রশ্ন করেই চলেছেন– ডাক্তার, আপনি বলছেন শ্রীমতী ডগলাসের মনের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। যখন তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছিলেন, তখন কি প্রকৃতস্থ ছিলেন?

-হ্যাঁ, স্যার। আমি তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলাম। তখন উনি অনেক শান্ত হয়ে গেছেন। আমি আর একটা ঘুমের ওষুধ দেবার চেষ্টা করছিলাম। তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন।

কোর্টের প্রেসিডেন্ট মাথা নীচু করে বললেন- কেন রেগে গিয়েছিলেন তা বলেছিলেন?

-হ্যাঁ, মহামান্য স্যার। তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর স্বামী তাকে হত্যা করতে চাইছেন। তিনি যখন ঘুমিয়ে পড়বেন, তখন স্বামী ওই জঘন্য কাজটি করবেন।

প্রেসিডেন্ট কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলেন। তিনি পিটার ডেমোনিডাসকে বললেন আপনি আরও কথা বলুন।

–ডঃ কাজোমিডেস, আপনি মিসেস ডগলাসকে দ্বিতীয় ওষুধটা দিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ।

–এটা আপনি কী করে দিয়েছিলেন?

হাইপোডারমিকের সাহায্যে পেছন দিকে।

যখন আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন উনি ঘুমিয়ে ছিলেন?

–হ্যাঁ।

 –মিসেস ডগলাস কি কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে পারতেন? বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতে পারতেন? কারও সাহায্য চাইতে পারতেন? পোশাক পরতে পারতেন? বাড়ির বাইরে বেরোতে পারতেন?

-এই অবস্থায়, না, কোনো মতেই সম্ভব নয়। তখন তিনি ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন।

ডাক্তার, আপনাকে ধন্যবাদ। আর কিছু আমি বলব না।

জুরিরা নোয়েলে পেজ এবং ল্যারি ডগলাসের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের মুখ থমথম করছে। একজন অপরিচিত কেউ হয়তো কোর্টরুমে ঢুকে পড়েছেন, তিনি এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী।

বিল ফ্রেসারের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ডাঃ কাজোমিডেসের ব্যাপার শেষ হয়ে গেছে। এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, ল্যারি ডগলাস আর নোয়েলে পেজই ক্যাথারিনকে হত্যা করেছে। নেপোলিয়ান ছোটাস এখন কিছুই করতে পারবেন না। জুরিদের মন পাল্টানো অত সহজ নয়।

ফ্রেডরিক স্টাভরসের মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তিনি এতদিন নেপোলিয়ান ছোটাসকে তারিফ করছিলেন। তার ওপর অন্ধবিশ্বাস ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ছোটাস অলৌকিক উপায়ে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দেবেন। এবার বোঝা গেল, কিছুতেই তিনি জিততে পারবেন না। স্টাভরস সামনের দিকে তাকালেন। অন্ধকার শুধুই অন্ধকার।

এখন কী হবে? সকলের কাছে তিনি কেমন করে মুখ দেখাবেন? নেপোলিয়ান ছোটাস উঠলেন। তিনি বললেন- মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমি ওই সাক্ষীর সাথে কথা বলতে চাইছি। আদালত অনুমতি দিলে আমি কিছু প্রশ্ন করব। আমি ক্যামেরার সাহায্য নেব। পোসিকিউটিং অ্যাটর্নিরও সাহায্য নিতে হবে।

কোর্টের প্রেসিডেন্ট বললেন- মিঃ ডেমোনিডাস?

ডেমোনিডাস বললেন আমার কোনো আপত্তি নেই।

কোর্ট বন্ধ হয়ে গেল। কেউ কিন্তু চেয়ার থেকে ওঠেননি।

.

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। নেপোলিয়ান ছোটাস আবার কোর্টে ফিরে এসেছে।

সকলে বুঝতে পারছে, এবার সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটবে।

ছোটাস ধীরে ধীরে সাক্ষ্যদানের বাক্সের কাছে চলে গেলেন। তিনি নোয়েলের দিকে তাকালেন। নোয়েলের মুখে, চোখে উদ্বিগ্নতা। আইন বিশারদের ঠোঁটের কোণে হাসি। তিনি জানেন, এত ভয় পাবার কিছু নেই।

ছোটাস সাধারণ গলায় নোয়েলেকে বললেন- কোর্টের প্রেসিডেন্ট অনুমতি দিয়েছেন, আপনি তার সাথে চেম্বারে কথা বলতে পারবেন।

উনি ফ্রেডরিক স্টাভরসের দিকে তাকালেন। অনিশ্চয়তার আবরণে মুখ ঢেকে স্টাভরস বসে আছেন। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না।

যদি মনে করেন, আপনি আপনার ক্লায়েন্টকে নিয়ে আসতে পারেন।

স্টাভস বললেন- অবশ্যই আসব।

তাড়াতাড়িতে চেয়ারটা ফেলে দিচ্ছিলেন।

দুজন বেলিফকে দেখা গেল, তারা প্রেসিডেন্টের ফাঁকা চেম্বারে ঢুকে পড়েছেন। বেলিফরা চলে গেলেন। এখন তারা সেখানে বসে আছেন। ছোটাস ফ্রেডারিক স্টাভরসের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি কী বলব? আমি আমার ক্লায়েন্টকে সাহায্য করতে চাইছি। আপনার ক্লায়েন্টও যাতে একই রকম সুযোগ পায় সেটা আমাকে দেখতে হবে।

নোয়েলে জানতে চাইল- কী বলতে হবে?

ছোটাস নোয়েলের দিকে তাকালেন। আস্তে আস্তে বললেন–আমি এই মাত্র বিচারকদের সাথে একটা কনফারেন্স করেছি। তারা বুঝতে পারছেন, এই ব্যাপারটা আপনার বিরুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু তিনি একটু থামলেন, আমি তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি। আপনাকে শাস্তি দিলেই সুবিচার হবে না।

–তাহলে, কী হবে? স্টারস অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।

ছোটাসের মুখে সন্তুষ্টির চিহ্ন– যদি অভিযুক্তরা মত প্রকাশ করেন, তাহলে হয়তো পাঁচ বছরের জেল হতে পারে। উনি হাসলেন, চার বছর তো কেটেই গেছে। তার মানে? ছ মাসের বেশি থাকতে হবে না।

উনি ল্যারির দিকে ফিরলেন- আপনি আমেরিকান। আপনি চলে যেতে পারবেন। আপনি কখনও গ্রিসে ফিরে আসতে পারবেন না।

ল্যারি মাথা নাড়ল, মনে আনন্দ।

ছোটাস এবার নোয়েলের দিকে তাকালেন সেটা খুব একটা সহজ নয়। আমি সব কিছু শুনেই বলছি। খুব শক্ত একটা পরীক্ষা। দেখা যাক কী হয়। শেষে কী আছে আমি বুঝতে পারছি না।

নোয়েলে বলল- আমি বুঝেছি।

নেপোলিয়ান ছোটাস বললেন- একটা শর্ত আছে।

কী?

–আপনার পাশপোর্ট কেড়ে নেওয়া হবে। আপনি কখনও গ্রিস ত্যাগ করতে পারবেন। সব সময় বন্ধুর অধীনে থাকবেন।

তার মানে? ব্যাপারটা তাই হতে চলেছে।

 এটা বোধহয় কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের একটা খেলা, নোয়েলে ভাবল, বিচারককে তা হলে কিনে নেওয়া যায়।

ডেমিরিসের কাছে আমাকে থাকতে হবে? ল্যারির সঙ্গে কোনো দিন দেখা হবে না। ল্যারির দিকে নোয়েলে তাকাল। হ্যাঁ, ল্যারির মুখে সন্তুষ্টির ছাপ। সে স্বাধীন হবে। আহা, কত বছর বাদে।

ছোটাসের দিকে তাকিয়ে নোয়েলে বলল ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে। 

ছোটাস নোয়েলের দিকে তাকালেন, ছোটাসের চোখে বিষণ্ণতা। পাশাপাশি সন্তুষ্টি। নোয়েলে আমাকে বুঝতে পেরেছে।

ব্যাপারটা ভাবতেই পারছি না, ফ্রেডরিক বললেন।

সত্যি কথা বলতে কী, স্টাভরসের কাছে এটা অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

 ল্যারি বলল– একটাই ব্যাপার, আমরা কিন্তু খুনটা করিনি। কে কার কথা শুনবে।

ফ্রেডরিক রেগে গেলেন- এসব কথা বলে কী লাভ? আমরা বাঁচাবার একটা পথ খোঁজার চেষ্টা করছি।

তিনি চট করে ছোটাসের দিকে তাকালেন। আমার কথাটা শুনে ছোটাস আবার রেগে যাবেন না তো?

ছোটাস স্টাভরসকে বললেন- আমি আমার ক্লায়েন্টকে উপদেশ দিচ্ছি। আপনার ক্লায়েন্টকে কিন্তু কিছু বলতে চাইছি না। উনি যা ইচ্ছে করতে পারেন।

ল্যারি বলল- আর কী বা হবে?

এবার জুরিরা আসবেন।

.

পনেরো মিনিট কেটে গেছে, দুজন অভিযুক্ত জজের বেঞ্চে বসে আছে। প্রেসিডেন্ট বসে আছেন মধ্যের চেয়ারে। দুপাশে দুজন বিচারক। নেপোলিয়ান ছোটাস নোয়েলে পেজের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ফ্রেডরিক স্টারস দাঁড়িয়ে আছেন ল্যারি ডগলাসের পাশে। টানটান উত্তেজনা। কখন কী হয়।

প্রেসিডেন্ট মাথা নীচু করলেন, ছোটাসের দিকে তাকালেন। তার কাছ থেকেই বোধহয় সংবাদটা প্রথম শুনতে চাইছেন।

নোয়েলে ভাবল ডেমিরিস কীভাবে ব্যাপারটা গুছিয়ে নিয়েছেন? ভাবতে গেলে অবাক লাগে।

–আপনি কি আপনার অপরাধের ভাবধারা পরিবর্তন করবেন?

নোয়েলে বলল- হ্যাঁ, করতে রাজী আছি।

ফ্রেডরিক এবার কথা বলার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন মাননীয় বিচারপতি, আমার ক্লায়েন্টও এই কথা বলতে চাইছেন। তিনি নিজেকে আর অপরাধী নয় একথা বলবেন না, তিনি অপরাধ স্বীকার করবেন।

প্রেসিডেন্ট ল্যারির দিকে তাকালেন- আপনিও কি আপনার এই বক্তব্যের পরিবর্তন করতে চাইছেন?

ল্যারি ফ্রেডরিকের দিকে তাকালেন। বললেন- হ্যাঁ।

প্রেসিডেন্ট দুজন অভিযুক্তর দিকে তাকালেন। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন- আপনারা কি জানেন যে অপরাধ স্বীকার করলে গ্রিক আইন অনুসারে ফাঁসি হতে পারে।

-হ্যাঁ, আমি জানি, নোয়েলের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার।

প্রেসিডেন্ট এবার ল্যারির দিকে তাকালেন।

ল্যারি একই জবাব দিল। জজেরা নিজেদের মধ্যে সামান্য আলোচনা করলেন। প্রেসিডেন্ট ডেমিরিসের দিকে তাকিয়ে বললেন- এই ব্যাপারে আপনার কোনো বক্তব্য আছে?

ডেমিরিস অনেকক্ষণ প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন কোনো বক্তব্য নেই।

 নোয়েলের মনে হল, এবার বোধহয় সত্যিই মুক্তি, নাকি আমি আরও গভীর সংকটে পড়ে গেলাম।

প্রেসিডেন্ট বললেন– আমরা এই বক্তব্য গ্রহণ করতে বাধ্য। তিনি জুরীদের দিকে তাকালেন, ভদ্রমহোদয়গণ, এই মামলার ব্যাপারে একটা নতুন ব্যাপার দেখা দিয়েছে। আপনারা এখন আর জুরী হিসাবে থাকতে পারবেন না। বিচারটা শেষ হয়ে গেল। এবার আদালত শাস্তি দেবে। ধন্যবাদ, আপনারা যেভাবে সাহায্য করেছেন। এখন দুঘণ্টার জন্য কোর্ট বন্ধ থাকবে।

সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা ভিড় করতে শুরু করেছেন। টেলিফোন বেজে চলেছে। টেলিপ্রিন্ট মেশিনগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নোয়েলে পেজ এবং ল্যারি ডগলাসের মামলা এক নতুন বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। দু ঘন্টা কেটে গেছে। অনেক মানুষের ভিড়। নোয়েলে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। কী ঘটে-কী ঘটে এমন একটা ব্যাপার।

অভিযুক্তরা উঠে দাঁড়াবেন, বেঞ্চের দিকে এগিয়ে চলুন।

নোয়েলে উঠে দাঁড়াল। সে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। তার পাশে ছোটাস দাঁড়িয়ে আছেন। ল্যারিও এগিয়ে আসছে।

প্রেসিডেন্ট বললেন- এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিচার। এখানে নানা সন্দেহ থাকে। দেখতে হয় অপরাধী যেন কোনো মতেই ছাড়া না পায়। এই বিচারের বেলাতেও এমন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়েছে। উনি নেপোলিয়ান ছোটাসের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি গ্রিক আইনগুলো সম্পর্কে ভালো কথা বলেছেন। যখন কোনো হত্যাকাণ্ড সঠিকভাবে প্রমাণিত হয় না, তখন আমরা অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারি না।

নোয়েলে এই কথা শুনে কেমন যেন হয়ে গেল। বিপদের গন্ধ কি ভাসছে?

প্রেসিডেন্ট বলে চলেছেন- আমি এবং আমার সহযোগী বিচারকেরা অবাক হয়েছি, কেন এই অভিযুক্তরা বক্তব্য পরিবর্তন করতে রাজি হয়েছে? যখন বিচার চলছে সেই অবস্থায়?

এবার নোয়েলের পেটে যন্ত্রণা শুরু হল। সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারছে না। ল্যারিও অবাক চোখে বিচারকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

–কোর্টের সামনে এবং বিচারকের সামনে অভিযুক্তরা তাদের অপরাধ স্বীকার করছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত বিবেকের দংশনে তারা দংশিত হচ্ছিল। এক অসহায়া মহিলাকে কী নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

নোয়েলে বোধহয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কী হবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ছোটাস কি এতবড় একটা সর্বনাশ করতে পারেন? ছোটাস কি এইভাবে নোয়েলেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন? নোয়েলে ছোটাসের দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রেসিডেন্ট তখনও বলে চলেছেন আমাদের হাতে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, আমি সেই ক্ষমতা অনুসারে ঘোষণা করছি, নোয়েলে পেজ এবং লরেন্স ডগলাসকে ভয়ংকর শাস্তি দিতে হবে। গুলি করে তাদের হত্যা করতে হবে। আজ থেকে নব্বই দিনের মধ্যে যেন এই আদেশ কার্যকরী হয়।

কোর্টে দারুণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। নোয়েলে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সব কটা দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বসে আছেন, দাঁড়ি কামিয়েছেন, চুল কেটেছেন। নীল রঙের সিল্কের স্যুট পরেছেন। সুন্দরভাবে তৈরি করা।

হয়তো দেখতে এসেছেন নোয়েলের ভেঙে পড়া।

দাবা খেলাটা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল।

.

ল্যারি প্রেসিডেন্টের শেষ কথাগুলো শুনছিল। বিশ্বাস করতে পারছিল না। একজন পুলিশ তার দিকে এগিয়ে গেল। হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। ল্যারি কিছু একটা বলতে চাইছিল। সে বলল, আমি ওকে মারিনি, এভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হল। আরেকজন বেলিফ এসে তাকে ধরে নিয়েছে।

ল্যারি বলল- আমার কথা শোনার চেষ্টা করুন।

 না, কেউ তার কথা শুনছে না।

.

নোয়েলে তার হাতে কার হাতের পরশ পেল। মেট্রন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কোর্টরুম থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। মেট্রন বলল- মিস পেজ, এবার চলুন।

এটা কি থিয়েটারের দল? ওরা সকলে তার জন্য বসে আছে। সময় পাল্টে গেছে। আর কেউ তাকে সংলাপ উচ্চারণ করতে বলবে না। পরাজয়, শুধুই পরাজয়। অনেকগুলো মুখ সে দেখতে পাচ্ছে। ফিলিপ্পে সোরেল, ইজরায়েল কাটজ, আরও কত কে? আগস্টেস ম্যানটন, একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আমেরিকান ভদ্রলোক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাত নাড়ছেন। মেট্রন আবার বলল চলে আসুন, চলে আসুন মিস পেজ।

চারপাশের অবস্থার বর্ণনা করা যাচ্ছে না। একটা সুচতুর পরিকল্পনা, প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করে কি লাভ? ছোটাস এইভাবে ফাঁসিয়ে দিলেন? কী করে আর কার ওপর বিশ্বাস রাখবেন?

ফ্রেডরিক প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন। এখন তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। শেষ অব্দি তিনি বলার চেষ্টা করেছিলেন স্যার, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাইছি।

গ্রিক আইন অনুসারে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা ঘটবে অ্যাজিনা দ্বীপে। পাইরস দ্বীপের কাছে। এর জন্য বিশেষ নৌকোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই নৌকা করে অভিযুক্ত আসামীদের ওই দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে। চারিদিকে পুলিশ প্রহরা থাকবে।

.

 সকাল চারটে, শনিবার, আর দুঘণ্টা বাদে নোয়েলের ফাঁসি হবে।

নোয়েলেকে একটা পরিচিত প্রিয় পোশাক পরতে দেওয়া হয়েছে। মদ রঙা, ফুলের তৈরি, তার সঙ্গে লাল জুতো পরেছে সে। নতুন সিল্কের কারুকাজ করা রিংগারি।

বেলিজিয়ান সুন্দরীর মতো তাকে দেখাচ্ছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস নোয়েলের কাছে হেয়ার ড্রেসার পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবার মনে হচ্ছে নোয়েলে বোধহয় কোনো একটা পার্টিতে যাবে। এখন আর অনুশোচনা করে কোনো লাভ নেই। তবুও সে ভাবছে, ডেমিরিস হয়তো শেষ পর্যন্ত অলৌকিক খেলা খেলে তাকে বাঁচিয়ে দেবেন।একটা টেলিফোন, একটা শব্দ? সোনালী হাতের একটা পরশ, না, সময় দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু হবে কি?

আরও দুঘণ্টা সময় আছে।

 নোয়েলে তাকিয়ে থাকল, কোনো কিছু ভাবতে পারছে না সে।

.

ল্যারি ডগলাসকে বন্দীশালার অন্যত্র রাখা হয়েছে। বিচার পর্বে সে খুবই চিন্তিত ছিল। অনেক চিঠি এসেছে তার কাছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। মেয়েরা লিখেছে। ওয়ার্ডেনরা, কেউ কেউ ল্যারির আচরণে দুঃখ পেয়েছে।

পেজের সঙ্গে দেখা হলে খুশি হত, কিন্তু দেখা হবে কী করে? প্রথমে সে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর শান্ত হয়ে যায়।

পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ওয়ার্ডেন এগিয়ে এল। চারজন গার্ডও এসেছে। তারা ল্যারি ডগলাসের সেলে এসে হাজির হয়েছে। ল্যারি বাংকে বসে আছে। শান্ত এবং সমাহিত। ওয়ার্ডেনরা দুবার তার নাম ধরে ডাকল। ল্যারি চোখ মেলে তাকাল। স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। কি?

করিডোর দিয়ে সে হেঁটে চলেছে। ছোট্ট একটা শোভাযাত্রা। একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। বাইরে কি ঠান্ডা? আকাশে পূর্ণ চাঁদের জোছনা? আকাশের প্রেক্ষাপটে নক্ষত্রের মেলা? আহা, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সেই দ্বীপপুঞ্জের কথা মনে পড়ে গেল। গ্রিকদের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি। সে যেন সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেল। না, এসবই আজ ভগ্ন অতীত হয়ে গেছে।

কারোর ওপর তার কোনো রাগ নেই। ঝিমঝিমে অনুভূতি। একটা অনুশোচনা। এবার তাকে পিস্তলের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। হ্যাঁ, সেই ঘটনাটা ঘটতে চলেছে, সে দেখতে পেল, চারদিকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।

এবার কী হবে? তার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল হোত বয়ে গেল।

..নোয়েলের কক্ষ, হেয়ারড্রেসার দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বিদ্যুতের চমক। একবার নয়, পরপর তিনবার। নোয়েলে প্রশ্ন করল বাইরে কি বৃষ্টি পড়ছে? হেয়ার ড্রেসার বলল-না, আকাশটা পরিষ্কার।

নোয়েলে বুঝতে পারল এবার তার পালা।

.

পাঁচটা ত্রিশ, আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকি আছে। কার পায়ের শব্দ? হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। ডেমিরিস কি এসেছেন? এত সুন্দরী একটি মেয়ে, আহা, শেষ যখন দেখা হয়েছিল। করিডোরটা একেবারে ফাঁকা। গার্ড এসে সেলের দরজা খুলে দিল। নার্স প্রবেশ করল। নোয়েলে তাকাল, বিশ্বাস করতে পারছে না। নোয়েলে প্রশ্ন করল, এই বোধহয় সময় হল আমার।

ওয়ার্ডেন বলল- মিস পেজ, এই নার্স এসেছেন আপনাকে কিছু ওষুধ দেবার জন্য।

নার্স তাকাল, নোয়েলে বলল- আমার ওষুধ চাই না।

তারপর? নোয়েলে বুঝতে পারল, ভয় তাড়ানোর ওষুধ। কিন্তু ভয় পেয়ে কী হবে?

নার্স বলল- এই সুন্দর পোশাকটা নষ্ট করে কী লাভ? এটা খুলে ফেলা যাক। এক মিনিটের তো ব্যাপার।

নার্স কাজ করতে শুরু করেছে। নোয়েলে কিছুই বুঝতে পারছে না।

মনে হচ্ছে, সে বুঝি বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। বাবা বলছে- মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখো, কত সুন্দরী হয়ে উঠেছে সে।

একজন যাজক এসে ঘরে প্রবেশ করেছেন, তিনি বললেন- তুমি কি ঈশ্বরের কাছে স্বীকারোক্তি করবে? নোয়েলে মাথা ঝাঁকালো। কে যেন বলেছিল, তুমি এক রাজকুমারী, এটাই তোমার সাম্রাজ্য। যখন তুমি বড়ো হবে, তখন এক রাজকুমারের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, তুমি একটা মস্ত বড় প্রাসাদের বাসিন্দা হবে।

নোয়েলে লম্বা করিডোর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কে যেন দরজাটা খুলে দিল। এ সেই দরজা, যেখানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে, জানলাতে ঝুলছে।

সব কাজ শেষ হয়ে গেল, এই জাহাজগুলো কার? এই রাজকুমারীর? এসব তো তোমারই। তোমার হাতের স্পর্শে সব কিছু তো সোনা হয়ে উঠবে।

একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা। মূল্যবান কিছু যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। না না, আমার মুখটা ঢেকে দিও না। বাবার মুখটা আমাকে একবার দেখতে দাও।

না, তখন চারপাশে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।

.

শেষ পর্ব

সিস্টার থেরেসা বলল- আপনি আবার আসবেন। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?

কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বললেন- সিস্টার, শুধু আপনার অনুগ্রহ চাই।

সিস্টার জানেন, এই ভদ্রলোক না থাকলে এই মঠ কবেই বন্ধ হয়ে যেত। সেটা বোধহয় ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তিনি ডেমিরিসকে ধন্যবাদ জানালেন। ডেমিরিস ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসছেন। এই সমাধিক্ষেত্র, কত মানুষ এখানে শুয়ে আছেন।

সিস্টার থেরেসা বললেন- এখানে ও শুয়ে আছে, ওর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন।

ডেমিরিস তাকিয়ে থাকলেন, সিস্টার থেরেসার চোখে জল। শান্তভাবে উনি বললেন এবার আমি আসি। কিন্তু, আমি যেটা নিয়ে এসেছি আপনি রাখবেন না।

ছোট্ট একটা জুয়েলারীর বাক্স, সিস্টার তাকিয়ে আছেন।

সেই বাক্সটা নিয়ে ডেমিরিস হেঁটে চলেছেন। ভেতরে কি আছে? সুন্দর একটা সোনার পাখি, রক্ত রুবির চোখ। এক্ষুনি বুঝি উড়বে। ডেমিরিস তাকিয়ে আছেন, ওই ভদ্রমহিলা বাক্স থেকে পাখিটাকে বের করলেন। সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। রুবির চোখে দ্যুতি, আহা, রামধনুর সাতটি রং।

–আপনার সাথে আবার দেখা হবে। আপনি ভয় পাবেন না। কেউ আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বদমায়েশ লোকেরা মারা গেছে। কথাগুলো বলতে বলতে ডেমিরিস কেমন যেন হয়ে গেল, মনে হল কেউ বুঝি তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

তাকে এখন শান্তভাবে পাহাড় পার হতে হবে। অনেক দূরের পথ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তার লিমুজিন এখন যাবে এথেন্সে, এথেন্স থেকে শিকাগো, সেখান থেকে লন্ডন, প্যারিস, ইওনিয়া এবং শেষ পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেস।

উনি জানেন, পৃথিবীর কোথাও গিয়ে আর এক মুহূর্ত শান্তি পাবেন না।