৪. লকহীডের পাইলট

১৬.

লকহীডের পাইলট চিন্তিত হয়েছেন।

তিনি তার কো-পাইলটের দিকে তাকিয়ে বললেন- ভালোভাবে প্লেনটা চালাতে হবে কিন্তু।

তিনি ককপিট ছেড়ে কেবিনে চলে গেলেন। পাইলট আর কো-পাইলট ছাড়া এই প্লেনে আরও পাঁচজন ছিলেন। বাইরন স্কট, স্কট ইন্ডাসট্রির সর্বময় কর্তা, তার আকর্ষণীয়া স্ত্রী সুসান, তাদের এক বছরের কন্যা প্যাট্রিসিয়া, বাইরন স্কটের ছোটো ভাই মাইলো স্কট, মাইলো স্কটের স্ত্রী এলেন স্কট। তারা কোম্পানির নিজস্ব বিমানে প্যারিস থেকে মাদ্রিদ অভিমুখে চলেছিলেন। ছোটো মেয়েকে সঙ্গে আনার কথা ভাবা হয়নি। কিন্তু সুসান মেয়েটিকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না। তাই শেষ মুহূর্তে তাঁকে তোলা হয়েছে।

সুসান স্বামীকে বলেছিলেন- মেয়েকে ছেড়ে এতদিন আমি থাকতে পারব না।

স্বামী বলেছেন- ঠিক আছে, ওকেও সঙ্গে নেব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। স্কট ইন্ডাসট্রি ইওরোপের নানা জায়গাতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। বাইরন স্কট মাদ্রিদে যাচ্ছেন, সেখানে নতুন ফ্যাক্টরি খুলতে হবে সেই ব্যাপারটাই তদন্ত করবেন। চারপাশ নিরীক্ষণ করবেন।

পাইলট তার কাছে এলেন- আমায় ক্ষমা করবেন স্যার। আমরা খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। আকাশটা পরিষ্কার নয়, আমরা কি ফিরে যাব?

বাইরন স্কট ছোট্ট জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বেশ বুঝতে পারছেন তিনি, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ভেতর দিয়ে উড়ানপাখি উড়ে চলেছে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে।

তিনি বললেন- আজ ভোরে মাদ্রিদে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। আমরা কি ঝড়ের মধ্যে দিয়ে এগোতে পারব না?

–আমি চেষ্টা করছি, যদি না পারি, তাহলে ফিরতে হবে কিন্তু।

বাইরন স্কট বলেছিলেন- ঠিক আছে।

–সিটবেল্ট ভালো করে বেঁধে নেবেন কিন্তু।

 পাইলট ককপিটে ফিরে গেলেন।

সুসান স্কট এই কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলেন। ভাবলেন, আহা, মেয়েটিকে না আনলেই বোধহয় ভালো হত।

ঝড়টা এসে গেল।

প্লেনটা তখন অসহায়ের মতো দুলছে, বাতাসের আন্দোলনে আন্দোলিত হচ্ছে। ঝড়ের গতি ক্রমশ বাড়ছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টির আঘাত। কিছু দেখা যাচ্ছে না। যাত্রীদের মনে হল, তাঁরা বুঝি সমুদ্রের জলে পড়ে গেছেন।

বাইরন স্কট ইন্টারকমের সুইচ জ্বেলে দিলেন ব্লেক, কী হচ্ছে?

–আমরা এখন মাদ্রিদ শহরের উত্তরে এসে গেছি। মাদ্রিদ এখান থেকে একশো কিলোমিটার দূরে। নীচেই আভিলা শহর। বাইরন স্কট জানালা দিয়ে তাকাবার চেষ্টা করলেন– আজ মাদ্রিদের কথা ভুলে যান। এখান থেকে এখনই বেরোতে হবে

হয়তো একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। পাইলট চেষ্টা করেছিলেন, প্লেনটিকে ঠিক মতো নামিয়ে আনার। সামনেই পাহাড়ের চূড়া দেখতে পেলেন। সংঘর্ষটা অনিবার্য ছিল। তারপর? মনে হল আকাশের বুকে আগুন জ্বলে উঠেছে। প্লেনটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গেল। পাহাড়ের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। দেখা গেল, সর্বত্র দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠেছে।

তারপর? অনেকক্ষণের নীরবতা। মনে হল, এ বুঝি চিরন্তন। শান্তি সুখ সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

.

–এলেন?

এলেন স্কট চোখ খুললেন। তিনি একটা গাছের তলায় শুয়ে আছেন। স্বামীকে দেখতে পেলেন। মুখে হাত দিচ্ছেন, তার মানে? আমরা এখনও বেঁচে আছি।

এলেন উঠে বসলেন, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীরের প্রতিটি অংশ ব্যথায় টনটন করছে। চারপাশে ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি।

ওরা কোথায়? এলেন জানতে চেয়েছিলেন।

 –ওরা মারা গেছে।

 এলেন স্বামীর দিকে তাকালেন- হায় ঈশ্বর, এ কী শুনছি?

স্বামী ঘাড় নাড়লেন– বাইরন, সুসান, মেয়েটি, পাইলট, সবাই।

এলেন চোখ বন্ধ করলেন। প্রার্থনার ভঙ্গিতে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। মাইলো আর আমি এখন কোথায় যাব? কার কাছে সাহায্য নেব? ওরা মারা গেছে, ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগছে না।

একটু আগে আমরা সকলে জীবনের উন্মাদনা পান করছিলাম।

–তুমি কি দাঁড়াতে পারবে?

মনে হচ্ছে পারব।

 মাইলো সাহায্য করলেন। চারপাশে কেমন ঘনীভূত অন্ধকার।

মাইলো ধ্বংসপ্রাপ্ত উড়ান পাখির দিকে তাকালেন। আগুনের শিখা আকাশ ছোঁবার চেষ্টা। করছে।

মাইলো বললেন– এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে। যে কোনো মুহূর্তে আবার বিস্ফোরণ হতে পারে।

ওঁরা অতি দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে যাবার চেষ্টা করলেন। একটু বাদেই আবার বিস্ফোরণ চোখে পড়ল। গ্যাসট্যাঙ্কে আগুন ধরে গেছে। দাউদাউ আগুন শিখা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

মাইলোস্কট বললেন- আমি ভাবতেই পারছি না, এভাবে মৃত্যুর উপত্যকা থেকে ফিরে আসব।

সত্যি এটা একটা অলৌকিক ঘটনা।

এলেন স্কট জ্বলন্ত এরোপ্লেনের দিকে তাকালেন। কিছু একটা তার মনে হল, স্কট ইন্ডাসট্রির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

তিনি বললেন- মাইলো?

–হ, মাইলো কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছেন না।

–এটাই হল ভাগ্য।

কী?

–স্কট ইন্ডাসট্রি… এখন তুমি এর রাজা।

তাই তো?

না, আমি এভাবে চাইনি।

 –মাইলো, ঈশ্বর তোমাকে এটা দিয়েছেন।

এলেনের কণ্ঠস্বরে তীব্র উজ্জ্বলতা– তুমি সারাজীবন তোমার ভাইয়ের ছায়ায় বেঁচে থাকতে। এটা কি ভালো হত?

ব্যথা-যন্ত্রণা সব কিছু এলেন ভুলে গেছেন। মনের ভেতর অনেক কথা গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে। উনি বললেন- কুড়ি বছর ধরে তুমি বাইরনের হয়ে কাজ করেছ, তিল তিল পরিশ্রম করে বিরাট কোম্পানি তৈরি করেছ। কোম্পানির সাফল্যের অন্তরালে তোমার অবদান কেউ কি স্বীকার করে? উনি তোমায় কী দিয়েছেন? উনি সব সময় বলেছেন, এটা ওনার নিজস্ব কোম্পানি। ওনার সফলতা, ওনার অর্থ। এখন? শেষ পর্যন্ত তুমি সব কিছুর রাজা হলে, তাই তো?

মাইলো তাকালেন স্ত্রীর দিকে এলেন, ওই মৃতদেহগুলো পড়ে আছে, কীভাবে সৎকার করব বলো তো?

–আমি জানি, কিন্তু আমরা তো ওদের হত্যা করিনি। শেষ অব্দি আমরা সবকিছু বুঝে পেয়েছি। কেউ এসে কোনো কিছু দাবি করবে না। এটা আমার ওটা আমার, এটা আমাদের।

একটা শিশুর কান্না শোনা গেল। এলেন আর মাইলো পরস্পরের দিকে তাকালেন, অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে।

–প্যাট্রিসিয়া, ও বেঁচে আছে, হায় ঈশ্বর।

চোখের আড়ালে শিশুটি শুয়ে ছিল। অলৌকিকভাবে সে বেঁচে গেছে। তার শরীরের কোথাও আঘাত লাগেনি।

মাইলো স্কট মেয়েটিকে তুলে নিলেন ভালো আছে, ডার্লিং, উনি বললেন, সব কিছু ঠিক আছে।

এলেন তাকালেন স্বামীর মুখের দিকে। মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছে হতাশা– তুমি বলেছিলে মেয়েটিও মারা গেছে।

–ও বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।

 এলেন স্কট অনেকক্ষণ ওই শিশুটির দিকে তাকালেন। মেয়েটা মরে গেলেই হত।

ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠস্বরে এলেন বলেছিলেন।

 মাইলো অবাক হয়ে গেছেন- তুমি কী বলছ?

বাইরন সব কিছু প্যাট্রিসিয়াকে দিয়ে গেছেন। আগামী কুড়ি বছর ধরে তোমাকে অভিভাবকের ভূমিকায় থাকতে হবে। তারপর মেয়েটি বড়ো হবে। সে তোমাকে তাড়িয়ে দেবে। বলে রাখছি আমি, দেখো আমার কথা একদিন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে।

 মাইলো নিশ্চুপ।

–এ ধরনের ঘটনা কখনওই ঘটতে দেওয়া হবে না। এলেনের চোখে মুখে বন্যতা ফুটে উঠেছে। তিনি মাইলোর দিকে তাকালেন।

এলেন কী করতে চাইছেন?

এলেনের মন উন্মাদ আচরণে পরিপূর্ণ।

–দোহাই এলেন বলল, তুমি কী করতে চাইছ?

এলেন দীর্ঘক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চোখে ফুটে উঠেছে বন্য উন্মাদনা– আমি জানি না।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।

এলেন বললেন–একে আমরা কোথাও ছেড়ে দেব মাইলো। পাইলট বলেছিলেন আমরা আভিলা শহরের কাছাকাছি এসে গেছি। এখানেই শিশুটিকে ছেড়ে যেতে হবে। ওকে আমরা সঙ্গে নেব না।

মাইলো মাথা নাড়লেন– তা কী করে সম্ভব?

–কেন নয়? ওকে আমরা একটা ফার্ম হাউসের ধারে ফেলে দেব। নিশ্চয়ই কেউ ওকে পালন করবে। মেয়েটা বেঁচে যাবে। আর আমাদেরও কোনো সমস্যা থাকবে না।

মাইলো মাথা নেড়েছিলেন– না না, আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না।

 যদি তুমি আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে তোমাকে তা করতেই হবে। তোমাকে এখন বেছে নিতে হবে মাইলো, হয় তুমি আমাকে পাবে। কিংবা সারা জীবন তোমার দাদার মেয়ের চাকর হয়ে কাটাবে।

–আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো।

–তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?

আমার জীবনের থেকে বেশি।

–তা হলে সেই ভালোবাসার প্রমাণ দাও।

 পাহাড়ি পথ চলে গেছে শহরের দিকে। ঝোড়ো হাওয়া বইছে।

মৃত্যুর উপত্যকা থেকে জীবনের উদ্যান। তিন ঘণ্টা কেটে গেছে। তারা এখন আভিলা শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছেন। এলেন এবং মাইলো একটা ছোট্ট ফার্ম হাউসের কাছে পৌঁছে গেলেন। তখনও সকাল হয়নি।

এলেন ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন- আমরা ওকে এখানে রেখে যাব।

শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন মাইলোএলেন, অন্যভাবে ভাববার চেষ্টা করলে কেমন হয়?

–এটা তোমায় এখনই করতে হবে।

এলেনের কণ্ঠস্বরে একধরনের আভিজাত্য।

কোনো কথা না বলে মাইলো মেয়েটিকে ফার্ম হাউসের দরজার সামনে শুইয়ে দিলেন। তার পরনে একটা গোলাপি রঙের নাইট গাউন। ছোট্ট কম্বলে ঢাকা সজীব দেহ। মাইলো স্কট অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন প্যাট্রিসিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে। তার দুচোখে জল এসেছিল। তিনি অতি দ্রুত ওই স্থান থেকে চলে গেলেন। মনে মনে তিনি বললেন, ডার্লিং, আগামী জীবন যেন সুখে সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে।

মোরাসেস ভাবছিলেন, ছাগল ডাকছে, কিংবা ভেড়া। কী হল? চোখ রগড়ালেন। ঘুম ভেঙে গেল। উষ্ণ বিছানা থেকে উঠে এলেন। পুরোনো দিনের ড্রেসিং গাউন। দরজার দিকে এগিয়ে এলেন।

দেখলেন, এক জীবন্ত শিশু। উনি চিৎকার করলেন, স্বামীকে ডাকলেন। শি

শুটিকে ভেতরে আনা হল। মেয়েটা চিৎকার করছে।–ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

আর একটা কম্বল আনা হল। নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালের দিকে। করিডরে অনেকক্ষণ ওঁরা বসেছিলেন। তিরিশ মিনিট কেটে গেল। ডাক্তারের কাছে দেখানো হল।

ডাক্তার বললেন, মেয়েটির নিউমোনিয়া হয়েছে।

–ও বাঁচবে তো।

 ডাক্তার হতাশভাবে কাঁধে ঝাঁকানি দিলেন।

মাইলো এবং এলেন আভিলার পুলিশ স্টেশনে এসে হাজির হলেন।

 ডেক সার্জেন জানতে চাইলেন– কীভাবে আপনাদের সাহায্য করব।

ভয়ংকর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মাইলো বললেন, আমাদের প্লেনটা পাহাড়ের ওপর ধ্বংস হয়ে গেছে।

এক ঘণ্টা কেটে গেছে, উদ্ধারকারীর দল পাহাড়ের দিকে যাত্রা করেছে। তারা দেখল, কিছুই নেই, পড়ে আছে একটা উড়ান পাখির জ্বলন্ত মৃতদেহ। ছড়ানো ছেটানো কিছু স্মৃতি, হাড়-মাংসের টুকরো। তখনও দাউদাউ আগুন জ্বলছে।

তদন্ত শুরু হল। এটা একটা সরকারী তদন্ত।

বলা হল, পাইলটের উচিত ছিল ঝড়টাকে এড়িয়ে সামনের দিকে পৌঁছে যাওয়া। এই অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে পাইলটের ভুলের জন্য।

কাউকে দোষারোপ করা সম্ভব নয়, ব্যাপারটা সবাই ভুলে গেল। জীবন আবার তার নিয়মিত খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করল।

মাইলো এবং এলেন একটা প্রাইভেট মেমোরিয়াল সারকিটে এলেন। বাইরন স্কট, তার স্ত্রী সুসান এবং তাদের ছোট্ট মেয়ে প্যাট্রিসিয়ার জন্য প্রার্থনা করতে হবে। তারা নিউইয়র্কে। ফিরে এলেন। আর একটি শোক সভার আয়োজন করা হল। স্কট পরিবারের অনেকে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীর দল।

সকলেই বলেছিলেন- সাংঘাতিক, ব্যাপারটা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। আহা, ছোট্ট প্যাট্রিসিয়া!

এলেন স্কট বলেছিলেন– ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গিয়েছে এটাই ভালো ব্যাপার। কাউকে আহত অবস্থায় বেঁচে থাকতে হয়নি।

ব্যবসায়ী মহল ভেঙে পড়েছিল। স্কট ইন্ডাসট্রির স্টকের দাম হু হু করে পড়ে গেল। তখনও এলেন স্থির হয়ে বসেছিলেন। তিনি জানতেন, একদিন অবস্থার পরিবর্তন হবে। তিনি স্বামীকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন- সব কিছু আবার নতুনভাবে শুরু করতে হবে। মাইলো, তুমি পেছন দিকে তাকিও না। অতীতটা মরে গেছে। তুমি এখন সামনের দিকে এগিয়ে চলল।

মাইলো স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে জানতে চেয়েছিলেন প্রিয়তমা, কোথা থেকে শুরু করব বলো তো? আমার মাথায় কিছু আসছে না।

এলেন হেসেছিলেন এবার আমরা একটা স্বপ্নের পৃথিবী তৈরি করব। আমি তোেমাকে সাহায্য করব।

ভাবতেই পারা যায় না, গ্যারি শহরের সেই গরীব পোলিশ কন্যাটি আজ বিশ্বের অন্যতম ধনী রমণীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এলেন ডুড্যাস কোথায় হারিয়ে গেছে। তারপর…

ছোট্ট মেয়েটি দশদিন কাটিয়ে ছিল হাসপাতালের শয্যাতে, জীবনের জন্য লড়াই করতে হয়েছিল তাকে। শেষ পর্যন্ত অবস্থটা পাল্টে গেল। ফাদার বেরেনডো ওই চাষী আর তার বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।

উনি বললেন– তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে। মেয়েটা বেঁচে গেছে।

 চাষীর চোখে বিপদের ছায়া। বলল- কিন্তু? ও কি আমাদের কাছে ঈশ্বরের অবদান?

ফাদার বেরেনডো তাই বলেছিলেন।

 চাষী-বউ বলেছিল– ভগবান কত করুণাময়। তিনিই তো মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমরা ওকে মানুষ করব কী করে?

ফাদার বেরেনডো আবার বলেছিলেন– মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী।

–হ্যাঁ, তা স্বীকার করছি। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে, শরীর অশক্ত। আগের মতো কাজ করতে পারি না। না, এই বয়সে আমরা আর শিশু পালনের দায়িত্ব নিতে পারব না। ভগবান যেন অনুগ্রহ করে তার উপহার ফেরত নেন।

 তাহলে? মেয়েটির স্থান কোথায় হবে? আভিলার ওই অনাথ আশ্রম ছাড়া আর কোথায় সে থাকতে পারে!

.

বাইরন স্কটের অ্যাটর্নি অফিস। এবার উইলটা পড়া হবে। লইয়ার বসে আছেন। মাইলো এবং এলেনকেও দেখা যাচ্ছে। এলেনের মনে উত্তেজনা জমেছে। কাগজটা পড়া হল। কী আশ্চর্য! আমরা কত কিছু কিনব। সাউদাম্পটনে একটা সম্পত্তি। ফরাসি দেশে একটা ক্যাসেল। এভাবেই শুরু হবে।

ভদ্রলোক বলার চেষ্টা করলেন। এলেন দম বন্ধ করে বসে আছেন। কয়েক মাস আগে তিনি বাইরন স্কটের অফিসে এই উইলের কপি দেখেছিলেন। তখন থেকেই তার মনে উত্তেজনা।

বলা হয়েছে, যদি কোনো কারণে আমি এবং আমার স্ত্রী, দুজনেই মারা যাই, তাহলে স্কট ইন্ডাসট্রির সবকিছু আমার কন্যা প্যাট্রিসিয়াকে দেওয়া হবে। আমার ভাই মাইলোকে আমি তার অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করলাম। উপযুক্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত মাইলোই সবকিছু দেখাশুনা করবে।

এসব এখন পাল্টাতে হবে, এলেন ভেবেছিলেন।

লরেন্স গ্রে, শান্তভাবে বললেন- এটা আমাদের সকলের কাছে এক দুঃসংবাদ। আমি জানি, আপনি দাদাকে কতখানি ভালোবাসতেন।

..মাইলো, তিনি মাথা নাড়লেন, জীবনতো চলবেই। পরবর্তীকালে আপনার ভাই এই উইলটা পাল্টেছিলেন। আমি তার সারাংশটুকু পড়ছি। তিনি বলেছিলেন- প্যাট্রিসিয়া সারা জীবন পঞ্চাশ লক্ষ ডলার পাবে, প্রত্যেক বছর ব্যবসার লাভ থেকে একটা অংশ পাবে, স্কট ইন্ডাসট্রির যত শেয়ার আছে, আমি এবং আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তা সবই মাইলো পাবে। দীর্ঘদিন ধরে সে আমার কাছে কাজ করেছে, তার সততা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা আমাকে অবাক করে দিয়েছে। এটা হল আমার তরফ থেকে তার প্রতি উপহার।

মাইলো স্কটের মনে হল, এখনই এই ঘর থেকে বাইরে বেরোতে পারলে ভালো হয়।

 মিঃ গ্রে তাকালেন। বললেন- ঠিক আছে?

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। হা ঈশ্বর, আমরা কী করলাম? আমরা মেয়েটিকে হত্যা করলাম। এর কোনো দরকার ছিল না। এখন তাকে ফিরিয়ে আনা যায়?

তিনি এলেনের দিকে তাকালেন, এলেনের চোখ বন্ধ। ঘরের ভেতর নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে।

এলেন, আমরা কিছু একটা করতে পারি কি? যেখানে প্যাট্রিসিয়াকে রেখে এসেছি, সেখানে একবার যাব?

ফিফথ এভিনিউ অ্যাপার্টমেন্ট। একটুবাদে ট্যারিটারি নাচ শুরু হবে।

এলেন বলেছিলেন– এখনও তাই করতে হবে। কিন্তু তুমি কী করে মেয়েটিকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে? একদিন সে বড়ো হবে, তখন?

এই প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না মাইলোর কাছে। তিনি চিন্তা করলেন– ঠিক আছে, আমরা প্রতি মাসে তার জন্য টাকা পাঠাব।

–বোকার মতো কথা বলো না মাইলো। কীভাবে পাঠাবে? পুলিশ তখন তদন্ত করতে শুরু করবে। আমাদেরকে ধরে ফেলবে। যদি তোমার বিবেক এতখানি দংশন করে, তাহলে কোম্পানির লাভ থেকে কিছু অংশ দান করে দাও। ওই মেয়েটাকে ভুলে যাও। মাইলো, সমাজের চোখে সে মৃত। আমার এই কথাটা যেন মনে থাকে।

মনে রেখ–মনে রেখো… শব্দগুলো আঘাত করল মাইলোকে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।

অ্যাসটোরিয়ার বলরুম জনাকীর্ণ। আবার সম্মাননা জানানো হচ্ছে।

এলেন ভাবলেন, আপনারা এক মৃতা মহিলার জন্য এত আয়োজন করেছেন?

সেই রাতে ভূতের দল আবার ফিরে এসেছিল। অনেকদিন আগে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এলেনের। প্রথমদিকে তারা প্রায়ই আসত। মনে হত, কতকগুলো অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি শয্যার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফিসফিস কণ্ঠস্বর। এলেনের ঘুম ভেঙে যেত। উঠে বসতেন তিনি। কিন্তু কেউ নেই। কোনো দিন তিনি একথা মাইলোকে জানাননি। মাইলো দুর্বল স্বভাবের মানুষ। তিনি হয়তো এই কথা শুনে আরও ভয় পাবেন। কোম্পানির ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন না। যদি সত্যিটা কোনোদিন প্রকাশিত হয়, এই কলঙ্ক স্কট ইন্ডাসট্রিকে ধ্বংস করবে। এলেন স্কট এই ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সব কিছু মনের মধ্যে চেপে রাখতে হবে। তাই তিনি নীরবতার মধ্যেই ভয়কে বরণ করলেন। শেষ অব্দি ভূতেরা চলে গেল। তিনি আবার শান্তিতে ঘুমোত পারলেন।

ব্যাঙ্কোয়েটের হলে তারা ফিরে গেছেন। তিনি শয্যায় উঠে বসলেন। ঘরটা ফাঁকা। তারা কোথায়? তারা কি কিছু বলার চেষ্টা করছে। বলতে চাইছে, আর বেশি দিন নয়, এলেন, তুমিও আর কিছু দিন বাদে এই জগতের বাসিন্দা হবে।

এলেন স্কট উঠলেন। বিরাট ড্রয়িংরুমে গিয়ে দাঁড়ালেন। চারপাশে অ্যান্টিক চিহ্ন। এইখানে কত স্মৃতি আছে। ভাবলেন মাইলল, ভাববার চিন্তা কোথায়? ভাইয়ের মৃত্যুর পর কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনার পর হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এলেন স্কট তখন থেকেই এই কোম্পানির কত্রী। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে কোম্পানিকে পরিচালনা করছেন। স্কট ইন্ডাসট্রি আজ সারা বিশ্বে তার নাম ছড়িয়ে দিয়েছে।

এই কোম্পানিটা স্কট পরিবারের। তিনি ভাবলেন, তাহলে অযথা আমি ওই ভূতগুলোকে ভয় পাব কেন?

বাইরন আর সুসানের একমাত্র কন্যার কথা মনে পড়ে গেল। তার হাতেই তো এই বিরাট সাম্রাজ্যের দায়িত্ব ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত। এই চিন্তার মধ্যে একটা ভয় আছে। মৃত্যুর ছায়া কি তিনি দেখতে পাচ্ছেন?

এলেন স্কট ড্রয়িংরুমে বসে থাকলেন, বাকি রাতটুকু। কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। কতদিন হয়ে গেল। আঠাশ বছর, প্যাট্রিসিয়া এখন এক পরিপূর্ণ যুবতী। আশা করি এখনও সে বেঁচে আছে। কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে? এক কৃষককে বিয়ে করেছে? অথবা গ্রামের কোনো ব্যবসায়ীকে? ছেলে মেয়ে হয়েছে কি? ও কি এখন আভিলাতেই থাকে? নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে।

শেষ পর্যন্ত এলেন স্কট ভাবলেন- ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। যদি প্যাট্রিসিয়া এখনও বেঁচে থাকে, আমি তার সঙ্গে কথা বলব। তার মুখোমুখি বসব। অর্থ দিয়ে মিথ্যাও সত্যি হয়ে যায়। সত্য মিথ্যা হয়। আমি দেখব, এই সমস্যার সমাধান করা যায় কিনা। ওকে জানতে দেব না, সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল।

পরের দিন সকাল হয়েছে। এলেন স্কট ইন্ডাসট্রির সিকিউরিটি চিফকে ডেকে পাঠালেন। অ্যালান টাকার, প্রাক্তন গোয়েন্দা। মধ্যচল্লিশ, পাতলা চেহারা। মাথার চুল কমতে শুরু করেছে। মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। ভীষণ পরিশ্রম করতে ভালোবাসেন।

–আপনাকে আমার জন্য একটা কাজ করতে হবে।

–বলুন মিসেস স্কট।

এলেন তাকালেন– কতটা বলা যায়। অথবা কিছুই বলব না। যতদিন আমি বেঁচে আছি, আমি এই কোম্পানিটাকে ধ্বংস হতে দেব না। দেখা যাক প্যাট্রিসিয়াকে পাওয়া যায় কিনা। তারপর সমস্যাটার আমিই সমাধান করব।

উনি সামনের দিকে ঝুঁকলেন–আঠাশ বছর আগে, আভিলার এক ফার্ম হাউসের বাইরে একটি অনাথ কন্যাকে রেখে আসা হয়েছিল। স্পেনে। আমি চাইছি, ওই কন্যাটির হাল হকিকৎ খুঁজে বার করুন। তাকে আমার কাছে আনতে হবে।

এলেন তাকালেন। মুখ অভিব্যক্তি শূন্য। উৎকট আবেগ অথবা অনুভূতি কিছুই নেই। সেখানে।

–ঠিক আছে। আমি কালই যাত্রা করছি।

.

১৭.

কর্নেল র‍্যামন আকোকো, মনটা তার ভালো নেই। শেষ অব্দি ঘটনা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।

কর্নেল হোস্টেলে এসেছেন। কথাবার্তা বলতে হবে। দুজনে কথা হল। কীভাবে কাজ শুরু করা যায়। হোস্টেলের হাতে অনেক গোপন খবর আছে। আকোকা জানেন, তাই তিনি এই লোকটিকে বিশ্বাস করেন।

আকোকা বললেন- জাইমে মিরোর সাথে চারজন সিস্টার আছে।

কী বললেন?

–হ্যাঁ, আমি ঠিক বলছি। চারজন সিস্টার জাইমো মিরো আর তার মানুষদের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। সিস্টারদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়েছে।

–এত খবর কোথায় পেলেন?

র‍্যামন বললেন- আপনি কি দাবা খেলতে জানেন?

-না।

আপনাকে দেখে খুবই খারাপ লাগছে আমার। দাবা খেলা মানুষকে অনেক শিক্ষা দেয়। ভালো খেলতে হলে কী করতে হয় বলুন তো? উল্টোদিকে যে বসে আছে তার মনটাকে জানতে হয়। জাইমে মিরো আর আমি পরস্পরের সঙ্গে দাবা খেলছি।

সোসটেলো অবাক হয়ে তাকালেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

না, আক্ষরিক অর্থে বলছি না কর্নেল, আমরা সত্যি সত্যি দাবার দুপাশে বসে নেই। আমরা আমাদের মনের শক্তিকে ব্যবহার করছি। আমি জাইমে মিরো সম্পর্কে অনেক খবর আপনাকে দেব, পৃথিবীর কেউ সে খবর দিতে পারবে না। আমি জানি, কীভাবে তার মন কাজ করে। আমি জানি তিনি এখন কী করবেন। তিনি উয়েন্টা লা রায়নার ক্যাম্প ভেঙে দেবার চেষ্টা করবেন। ইতিমধ্যেই ওনার দুজন সহচরকে আমরা ধরে ফেলেছি। ভাগ্যের জোরে জাইমে পালাতে পেরেছেন, আর সে সুযোগ তিনি পাবেন না।

র‍্যামন আকোকা কাঁধ ঝাকনি দিলেন। আর কোথাও এ সুযোগ পাওয়া যাবে না। ষাঁড়ের আসরে দুর্ঘটনা, না, এটা বার বার ঘটবে না।

–আপনি সত্যি বলছেন?

–হ্যাঁ, উনি আমার শত্রু, কিন্তু ওনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এক অসাধারণ মন আছে। আছে দূরদর্শিতা।

–মিরো কোন দিকে চলেছেন?

–উনি চলেছেন উত্তরদিকে। আগামী তিনদিনের মধ্যে আমি ওনাকে ধরে ফেলব। কর্নেল সোসটেলো মাথা নাড়লেন- শেষ অব্দি আমরা জিতব তো?

কর্নেল আকোকা জাইমে মিরো সম্পর্কে অনেক খবর সংগ্রহ করেছেন দীর্ঘ পরিশ্রম এবং উদ্যমে।

শেষ অব্দি তিনি বললেন- হা, মিরো একজন সন্ত্রাসবাদী। আমাদের ইনফরমারের কাজ করছে। সুতরাং…

শেষটুকু তিনি বললেন না, তার দুটি চোখে তখন জেগেছে জান্তব জিঘাংসা।

রুবিও, টমাস এবং দুজন সিস্টার বড়ো রাস্তার ধারে এসে পড়েছেন। পাশের পথ চলে গেছে সুদুরের দিকে। ছোটো ছোটো গ্রাম তারা পার হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে রাখাল বালকেরা মনের সুখে রেডিও শুনছে। আহা, অসাধারণ দৃশ্যপট। লুসিয়ার মনে এখন অন্য চিন্তা।

তিনি সিস্টার থেরেসার পাশাপাশি হাঁটছেন। কীভাবে এই ক্ৰশটা নিয়ে পালানো যেতে পারে, এই চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করেছে। দুজন সবসময় পাশাপাশি হাঁটছেন। রুবিওকে এদের মধ্যে বেশি চালাক-চতুর বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু, মনটা বোধহয় সরল, অন্তত লুসিয়ার তাই মনে হচ্ছে।

টমাস সানজুরো, ভদ্রলোকের দৃষ্টি আছে, সন্তপর্ণে চারদিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে দোকানের কর্মচারী বলে মনে হয়। তিনিও কিনা এই সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

তাঁরা আভিলার উত্তর সমতলে এসে পড়লেন। রাত হয়েছে। স্তেপ অঞ্চল থেকে শীতল বাতাস ছুটে আসছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। গমের ক্ষেত ভরে উঠেছে। অলিভ গাছ দেখা গেল। আঙুর ক্ষেত আর মেচ। কিছু আলুর ক্ষেত আর লেটুস গাছ চোখে পড়ল। আরও কত কি।

রুবিও মন্তব্য করলেন গোটা স্পেন জুড়ে এমন শস্য ফলেছে।

টমাস হাসতে হাসতে বললেন– যে কেউ তা নিতে পারে।

 ইতিমধ্যে তারা বেশ কিছু খাবারের সন্ধান পেয়েছেন। চাষীদের ক্ষেত থেকে।

সিস্টার থেরেসা হতভম্ব হয়ে গেছেন। কত তাড়াতাড়ি মেনডাভিয়াতে পৌঁছোনো যেতে পারে, এটাই তার সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করেছে।

লুসিয়া কথা বলার চেষ্টা করলেন। সিস্টার থেরেসা জবাব দিচ্ছেন না। লুসিয়া শান্ত দৃষ্টিতে সিস্টারকে পর্যবেক্ষণ করলেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই প্রবীণা মহিলা এখন চিন্তিত।

লুসিয়া ক্যানভাস জ্যাকেটের দিকে হাত দিলেন। বললেন– এটা খুব ভারী, তাই তো? আপনি কি এটা আমার হাতে তুলে দেবেন?

সিস্টার থেরেসার মুখে ভয়। তিনি বললেন- না, যিশু কিন্তু এর থেকেও বেশি বোঝ বহন করেছিলেন। আমি যিশুর নাম স্মরণ করে এটাকে বয়ে নিয়ে চলব।

–আপনি ঠিক আছেন তো সিস্টার?

–হ্যাঁ, আমার কোনো কষ্ট নেই।

সিস্টার সত্যি ভালো নেই, তিনি ঘুমোতে পারছেন না। তাঁর মনে নানা চিন্তার বিচ্ছুরণ। তিনি হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। সিস্টার বেটিনা তাহলে আমাকে বকবেন। বেটিনা কোথায়? কে কোথায় কোনো খবর নেই।

রুবিও কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। সিস্টার থেরেসার সঙ্গে। তিনি কিন্তু জবাব দেননি।

 জানতে চেয়েছিলেন সিস্টার, আপনি কনভেন্টে কত দিন আছেন?

তিরিশ বছর।

অনেক দিন। আপনি কোথা থেকে আসছেন?

–ইজে।

–ইজে? আমি সেখানে একবার গিয়েছিলাম। ছুটির সময়। সুন্দর শহর। আমার অনেক কিছু মনে আছে।

কী মনে আছে, আপনি কি রাউলকে চেনেন? রাউল কি তাকে পাঠিয়েছেন? বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা আশঙ্কা। হতে পারে, এই সন্ত্রাসবাদীরা কি আমাকে আবার ইজে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। রাউল জিরাডটের কাছে? আমাকে কিডন্যাপ করবে? আমি মনিকার শিশু সন্তানকে অবহেলা করেছি সেই অপরাধে? কিছুই মাথায় আসছে না।

হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।

রুবিওর মনে হল, সিস্টার সেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আপনার শরীর খারাপ সিস্টার।

না।

সিস্টার লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলেন। মনে হল, কোথায় একটা গোলমাল হচ্ছে। না, আমাকে আর একটু চালাক হতে হবে।

সমতল ভূমির ওপর দিয়ে এই দলটা এগিয়ে চলেছে। তারা একটা ছোট্ট গ্রামে এসে পৌঁছোলেন। চাষী বউরা কাজ করছে। কর্মচঞ্চলতা জেগেছে।

এত সুন্দর দৃশ্য, রুবিওর মনে পড়ল, স্পেন শহরের সব জায়গায় প্রকৃতি এত উদার। আমরা কি কখনও শান্তির জগতে ফিরে যাব না?

অলিভ গাছের সারবন্দি সমারোহ, নিদাঘ দিনের বাতাস ভরে উঠেছে আঙুরের গন্ধে, কমলা ফুল ফুটেছে। বাগানে কত না ফুলের ছড়াছড়ি। চেরি গাছের পাশে তাল গাছ। মুরগির কোঁকর-কোঁ শব্দ, শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত, ছাগলের বাবা। ধীর পদক্ষেপে তারা এগিয়ে চলেছেন। রুবিও এবং টমাস পরস্পরের মধ্যে কথা বলছেন। চকিতে সিস্টার থেরেসার মনে হল, ওঁরা বোধহয় আমার বিষয়ে আলোচনা করছেন।

কত টাকা দেওয়া হবে? কিছুই জানা যাচ্ছে না। ওরা দুজন হেসে উঠলেন।

সিস্টার থেরেসার মনে ভয় বদ্ধমূল হয়েছে। তার মানে? এরা রাউলের গুপ্তচর। এখন কী হবে? আমি সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।

কী করা যায়? রাউল এগিয়ে এসেছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমাকে চুমু দিচ্ছে। বলছে আমি এখনও তার স্ত্রী হতে পারি। কিন্তু আমি তো এখন স্বয়ং যিশুর বউ। আমি তো রাউলের কাছে ফিরতে পারি না।

লুসিয়া তাকিয়ে আছেন ভালোভাবে। সিস্টার থেরেসা নিজের সাথে নিজেই কথা বলছেন। এখনই চমক ভাঙাতে হবে।

নাকি আর একটু অপেক্ষা করব? কখন? কখন ওই মহার্ঘ্য সোনার খনি আমার দ্বারা অধিকৃত হবে?

অন্ধকার ঘনিয়ে এল। দুরে অলমেডো শহরর দৃশ্যপট দেখা যাচ্ছে।

 রুবিও বললেন- শহরে সৈন্যরা আছে। আমরা পাহাড়ের পথ ধরব। শহরটাকে এড়িয়ে যেতে হবে।

তারা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। পাহাড়ের খাড়াই শুরু হল। সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। শেষ রশ্মি পাহাড়ের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে।

আরও কয়েক মাইল যেতে হবে। তারপর আমরা বিশ্রাম নেব।

তারা একটা পাহাড়ের মাথায় এসে দাঁড়িয়েছেন। টমাস সানজুরো বললেন– তাড়াতাড়ি করো।

রুবিও তাকালেন, দূরের উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। বোঝা গেল, সেখানে সৈন্যরা তবু ফেলেছে।

রুবিও বললেন- ওটা প্লাটুন আছে। না, আমাদের এখানে থাকা উচিত হবে না। সকাল হলেই ওরা তল্লাশি করতে শুরু করবে। উনি লুসিয়া এবং সিস্টার থেরেসার দিকে তাকালেন। বললেন- সারারাত আমাদের কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। সৈন্যদের দেখা গেছে। আমাদের আরও বেশি সাবধান হতে হবে।

লুসিয়ার কানে তখন এই শব্দগুলি বাজছে। আহা, এটাই তো সঠিক সময়। রাতের অন্ধকারে আমি সোনার ক্রশটা নিয়ে পালিয়ে যাব। ওরা আমাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে না। অনুসরণে ভয় আছে। 

সিস্টার থেরেসার কাছে এই সংবাদটা অন্য মানে নিয়ে এসেছিল। তার মনে হল, কর্নেল আকোকা নামে কেউ একজন তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আকোকা একজন শত্রু। কিন্তু উনি আমার বন্ধু। উনি আমাকে উদ্ধার করবেন।

দীর্ঘদেহী রুবিও বললেন- সিস্টার, বুঝতে পেরেছেন, শান্ত হয়ে থাকতে হবে।

–হ্যাঁ, আমি সব বুঝতে পারছি।

থেরেসা জবাব দিলেন।

টমাস বললেন– বুঝতে পারছি, আপনারা একটা অসহনীয় অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছেন। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের আমি সাবধানে কনভেন্টে পৌঁছে দেব।

আঃ, আর সময় কাটছে না। দুজন শ্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শোবার চেষ্টা করলেন।

আমাদের একটু ঘুম দরকার।

দুই সিস্টারকেও এবার শুতে হবে। রাতের আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে। আকাশের প্রেক্ষাপটে তারার ঝিকিমিকি। লুসিয়া চারপাশে তাকালেন। আর মাত্র কয়েকটি ঘণ্টা। স্বাধীনতার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। ওরা কখন ঘুমিয়ে পড়বে?

চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এবার, এবার উঠতে হবে।

সিস্টার থেরেসা লুসিয়ার পাশেই ছিলেন। একেবারে জেগে, চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। আত্মার ক্রন্দন ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। আমাকে ঠিক মতো পৌঁছোতে হবে। আমি তার সাথে মিলিত হব। না, সংসার জীবনের মধ্যে প্রবেশ করব না।

ভোর চারটে, সিস্টার থেরেসা উঠে বসলেন। টমাস শুয়ে আছেন, কয়েক ফুট দূরে। রুবিও দাঁড়িয়ে আছেন, সিস্টারের দিকে পিছন ঘুরে। সিলুট ছবির মতো দেখাচ্ছে তাকে।

শান্ত পরিবেশ। থেরেসা উঠলেন। কী একটা চিন্তা করলেন। ক্রশের কথা ভাবলেন, এটাকে কি আমি বহন করব? নাকি এখানে ফিরে আসব খুবই তাড়াতাড়ি। কিন্তু এটা কোথায় রাখব? তিনি তাকালেন সিস্টার লুসিয়ার দিকে। আহা, মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। এখানে রাখা যাক। থেরেসা ভাবলেন।

তিনি শ্লিপিং ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওই প্যাকেটটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। লুসিয়া কোনো শব্দ করলেন না। সিস্টার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। রুবিও আরজানোর চোখের বাইরে। তারপর এগিয়ে গেলেন সৈন্যদের তাবুর দিকে। রাস্তাটা খুব একটা ভালো নয়। শিশির পড়েছে। পথ পিছল। ভগবান তাকে ডানা দিয়েছেন। তিনি খুব দ্রুত এগিয়ে। চলেছেন।

অন্ধকারের মধ্যে একজনের মুখ ভেসে উঠল– কে? কে চলেছে?

–আমি সিস্টার থেরেসা।

সিস্টার বেরিয়ে এলেন। সৈন্যের পোশাক পরা একজন। হাতে রাইফেল। চিৎকার করছেন আপনি কোথা থেকে আসছেন?

থেরেসার সোনালি চোখে আভা– ভগবান আমাকে পাঠিয়েছেন।

সান্ত্রী অবাক ঠিক বলুন।

–আমি কর্নেল আকোকার সঙ্গে দেখা করব।

 সান্ত্রী মাথা নাড়ল- আপনি কি পাগল?

–আমি অ্যাবে সিস্টারসিয়ান থেকে আসছি। আমি সিস্টার থেরেসা। আমাকে জাইমে মিনোর লোকেরা বন্দী করেছে।

–আপনি কনভেন্ট থেকে আসছেন?

–হ্যাঁ।

–আভিলার কনভেন্ট?

–হ্যাঁ, থেরেসা অধৈর্যভাবে বলতে থাকলেন। এবার সৈন্যের মুখ পাল্টে গেল– কর্নেল সোসটেলো আছেন। আমি কি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাব?

উনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?

–হ্যাঁ, আমার মনে হয় উনি পারবেন। আপনি আমাকে অনুসরণ করুন।

এই শুভ সংবাদটা বেচারী বিশ্বাস করতে পারছেন না। কর্নেল সোসটেলো কত সৈন্যকে চারপাশে পাঠিয়েছেন। চারজন সেবিকাকে খুঁজে বের করতে হবে। এখনও পর্যন্ত তারা কেউ এই কাজে সফল হয়নি। আহা, এই খবরটা পেলে কর্নেল কত না খুশি হবেন।

তারা টেন্টে পৌঁছে গেলেন। কর্নেল সাসটেলো এবং তার কম্যান্ড একটি মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে পড়েছিলেন। সেনট্রি প্রবেশ করল, সঙ্গে একজন বৃদ্ধা মহিলা।

কর্নেল, ইনি হলেন সিস্টার থেরেসা। সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট থেকে এসেছেন।

 কর্নেল সোসটেলো অবাক হলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। গত তিনদিন ধরে তারা জাইমে মিরো আর ওই চার সেবিকার সন্ধানে কত অর্থ ব্যয় করেছেন। কত সৈন্যকে চারপাশে পাঠিয়েছেন। আর আজ তাদের একজন কিনা নিজেই এসেছেন।

-সিস্টার বলুন।

–এখন আর সময় নেই। সিস্টার থেরেসা ভাবলেন। আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওরা আমাকে ইজে নিয়ে যাবে। তার মাথায় তখন বিচিত্র চিন্তার অনুরণন।

কর্নেল জানতে চাইলেন কারা?

–জাইমে মিরোর লোকেরা।

 উনি লাফিয়ে উঠলেন– সিস্টার, আপনি কি সত্যি বলছেন?

 সিস্টার থেরেসা অধৈর্যভাবে বললেন–, ওরা পাহাড়ের ওধারে লুকিয়ে আছে।

.

১৮.

অ্যালান টাকার আভিলাতে নামলেন। কথাবার্তা বলার পরের দিন। দীর্ঘ আকাশ যাত্রা। টাকার হয়তো ক্লান্ত। কিন্তু উত্তেজনা জেগেছে তার মনের মধ্যে। এলেন স্কট খামখেয়ালের বশে কোনো কিছু করেন না। তিনি যখন পাঠিয়েছেন, কোনো একটা উদ্দেশ্য আছে।

তিনি উঠলেন বসটারস হোটেলে। ক্লার্ককে বললেন, কাছাকাছি কোনো খবরের কাগজের অফিস আছে?

রাস্তার ওপর, বাঁ দিকে, দুটো ব্লক পরে।

–ঠিক আছে।

 মেন স্ট্রিট। বিকেল হয়েছে। শহর প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কেন এই রহস্যময় অভিযান? তিনি এলেন স্কটের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন। যদি মেয়েটি বেঁচে থাকে, তাকে এখানে নিয়ে আসবেন। অন্য কারো সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবেন না।

মেয়েটিকে আমি কী বলব?

–ওকে বলবেন, তার বাবার একজন বন্ধু তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। এই কথা শুনলে ও এখানে চলে আসবে।

টাকার খবরের কাগজের অফিসে চলে গেলেন। অনেকে কাজ করছেন। অনুগ্রহ করে আমাকে ম্যানেজিং এডিটরের কাছে নিয়ে যাবেন?

একজন বললেন- উনি ওখানে আছেন।

টাকার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ভেতরে গেলেন। মধ্য বয়স্ক একজন মানুষ, ডেস্কের উল্টোদিকে বসে আছেন। ব্যস্তভাবে কিছু একটা লিখছেন।

–আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি কি একমুহূর্ত আপনার সঙ্গে কথা বলব?

বলুন। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

–আমি একটি মেয়েকে খুঁজছি।

কী নাম?

–তাকে একটা ফার্ম হাউসের পাশে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তখন সে ছিল একেবারেই শিশু।

মুখের হাসি মিলিয়ে গেল সে কি নিঃসঙ্গ?

-হ্যাঁ।

–আপনি তাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন?

–হ্যাঁ।

কত বছর আগের ঘটনা।

 –আঠাশ বছর।

. ওই ভদ্রলোক মাথা আঁকালেন তখন আমি এখানে যোগ দিইনি।

ব্যাপারটা অত সহজে হবে না টাকার বুঝতে পারলেন।

আপনি কি কারও নাম বলবেন, যিনি এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারেন?

 সম্পাদক বললেন আমি বলি কি আপনি ফাদার বেরেনডোর সঙ্গে দেখা করুন। উনি এই ব্যাপারে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন।

ফাদার বেরেনডো তার স্টাডিতে বসেছিলেন। এই আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

 অ্যালান টাকারের কথা বলা শেষ হল।

ফাদার বেরেনডো বললেন আপনি কেন এই ব্যাপারটা জানতে চাইছেন বলুন তো? ঘটনাটা অনেক দিন আগে ঘটেছিল। আপনাকে কে পাঠিয়েছে জানতে পারি কি?

টাকার ইতস্তত করছেন সাবধানে শব্দ চয়ন করলেন– আমি সব কিছু বলতে পারছি না। তবে আমি কথা দিচ্ছি মেয়েটির কোনো ক্ষতি করব না। শুধু আপনি কি বলবেন কোথায় তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল?

–কোন ফার্ম হাউস?

স্মৃতির সমুদ্রে আলোড়ন। হ্যাঁ, অনেক দিন আগে মোরাসেস এমনই একটি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল।

মেয়েটি তখন মৃত্যু শয্যায়। মোরাসেস জানতে চেয়েছিল, ফাদার, আমরা কী করব?

 ফাদার কথা বলেছিলেন তার বন্ধু পুলিশ প্রধান ডন মোরাগোর সাথে।

–আমার মনে হচ্ছে কোনো ট্যুরিস্ট দম্পতি একে ফেলে গেছে। তুমি হোটেলগুলোতে খোঁজ করো। দেখো তো, এমন কোনো খবর আছে কিনা।

খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 শেষ পর্যন্ত ডন মোরাগো বলেছিলেন–মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে মেয়েটি খসে পড়েছে।

তারপর? রহস্যটা থেকেই গেছে। আজ পর্যন্ত সমাধান হয়নি।

ফাদার বেরেনডো ওই শিশুটিকে অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছিলেন। মার্সিডেজ অ্যাঞ্জেলস জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মেয়েটির কোনো নাম দেওয়া হয়েছে কি?

–আমি জানি না।

 –কিছু একটা নাম তো দিতে হবে।

মার্সিডেজ অ্যাঞ্জেলস নাম লিখেছিলেন– মেগান। চোদ্দো বছর কেটে গেছে। ফাদার বেরেনভো মেগানকে নিয়ে গেছেন সিস্টারসিয়ান অ্যাবেতে।

.

এত বছর বাদে এই ভদ্রলোক খোঁজ করতে এসেছেন? জীবনের সব কিছু কি বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে? ফাদার বেরেনডো ভাবলেন। মেগান কোথায়? না, এটা তো তার আসল নাম নয়। এ নামটা দেওয়া হয়েছিল।

ফাদার বেরেনডো বললেন- আপনি বসুন, আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে।

গল্প শুরু হল। ভদ্রলোকের কথা শেষ হয়ে গেছে। অ্যালান টাকার চুপ করে বসে আছেন। তার মন ছুটে চলেছে। এলেন স্কট এ ব্যাপারে এত উৎসাহ দেখাচ্ছেন কেন? আঠাশ বছর আগের ঘটনা, একটি মহিলা, মেগান, তার ব্যাপারে এত আলোড়ন? .

বলতে হবে বাবার বন্ধু তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। প্রতিটি কথার মধ্যে রহস্য।

বাইরন স্কট এবং তার স্ত্রী ও কন্যার মৃত্যু হয়েছিল অনেক বছর আগে। স্পেনের কোনো একটা অঞ্চলে। এই দুটো ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্রতা আছে কি? অ্যালান উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

–ফাদার, আমি কি একবার ওই কনভেন্টে যেতে পারি? ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পাদরি সাহেব মাথা নাড়লেন। না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুদিন আগে সরকারের একদল এজেন্ট ওই কনভেন্ট আক্রমণ করে। সিস্টাররা কে কোথায় ছিটকে গেছেন কেউ জানে না।

অ্যালান অবাক হয়ে বললেন- সে কী? সিস্টারদের কী হয়েছে?

তাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মাদ্রিদে।

অ্যালান উঠে দাঁড়ালেন– থ্যাঙ্ক ইউ, ফাদার। তাকে এখন মাদ্রিদ যেতে হবে।

 ফাদার বললেন- চারজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। সিস্টার মেগান তাঁদেরই একজন।

ব্যাপারটা গোলমাল হয়ে গেল। উনি এখন কোথায় আছেন?

–কেউ জানে না। পুলিশ এবং মিলিটারির লোকেরা হন্যে হয়ে ওঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

–আমি দেখছি। অ্যালান টাকার অন্য সময় হলে এলেন স্কটকে ফোন করতেন। বলতেন, আমি একটা সম্ভাবনাশূন্য পরিণতিতে পৌঁছে গেছি। কিন্তু এখন তার গোয়েন্দা মন বলল, এবার অন্যভাবে ব্যাপারটার তদন্ত শুরু করতে হবে।

এলেন স্কটকে ফোন করা হল–একটু জটিলতা আছে মিসেস স্কট।

তিনি সব কিছু বললেন।

কিছুক্ষণের নীরবতা।

মেয়েটি এখন কোথায়? কেউ জানে না?

–সে বোধহয় পালিয়ে গেছে। কোথাও লুকিয়ে আছে। পুলিশ চেষ্টা করছে। স্প্যানিশ আর্মিরাও পথে নেমেছে। একদিন তারা ধরা পড়বে।

আবার নীরবতা ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

-ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করছি মিসেস স্কট।

.

অ্যালান টাকার ফিরে এলেন সংবাদপত্র অফিসে। ওটা এখনও খোলা আছে।

তিনি সম্পাদককে বললেন-অনুগ্রহ করে আপনি পুরোনো ফাইলগুলো আমাকে দেবেন কি?

–আপনি কী দেখতে চাইছেন?

–এখানে একটা প্লেন দুর্ঘটনা হয়েছিল।

কত বছর আগে?

 –আঠাশ বছর আগে, ১৯৪৮

 অ্যালানটাকারের পনেরো মিনিট সময় লাগল, খবরটা দেখতে পেলেন।

লেখা আছে–১ অক্টোবর ১৯৪৮। স্কট ইন্ডাসট্রির প্রেসিডেন্ট বাইরন স্কট, তাঁর স্ত্রী সুসান এবং তাঁদের এক বছরের কন্যা প্যাট্রিসিয়ার মৃত্যু হয়েছে প্লেন দুর্ঘটনায়।

তাহলে? এটাই হল জ্যাকপট। গোয়েন্দার রক্ত ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। আমি মন্ত বড়োলোক হব, এমন বড়োলোক যে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারছি না।

.

১৯.

তিনি বিছানাতে শুয়ে ছিলেন। একেবারে নগ্ন হয়ে। তিনি বুঝতে পারছেন বেনিটো পাটাস তার উথিত পুংদণ্ডটা দিয়ে তাকে আঘাত করছে। বেনিটোর শরীর, আহা পৌরুষের প্রতীক। সে আরও কাছে এগিয়ে এল। তার নিতম্ব দেশ সামনে এনেছে। সে এবার আঘাত করবে। সামনে এবং পিছনে এগিয়ে যাবে। কিন্তু, এটা কেন হল, আমি কেন তাকে হত্যা করলাম? তিনি ভাবলেন।

লুসিয়া চোখ খুললেন। কঁপছেন, চারপাশে তাকালেন। বেনিটো এখানে নেই। তিনি একটা অরণ্যে, শিপিং ব্যাগের মধ্যে। কিছু তাকে আঘাত করছে। কী? লুসিয়া ভাবতে পারলেন না।

তিনি ওঠার চেষ্টা করলেন। এটা কী? পুংদণ্ডের মতো শক্ত? শেষ অব্দি এটা তার হাতের মুঠোয় এল। এ কী? তিনি অবাক হলেন। সিস্টার থেরেসা কোথায়? উনি চলে গেছেন। লুসিয়া অন্ধকারে তাকালেন। মনে হল, টমাস সানজুরো এখনও জেগে আছেন, একটু দূরে। রুবিও কোথায়? ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে।

এবার পালাতে হবে।

তখনই? তখনই কী যেন ঘটে গেল। মনে হল পৃথিবী যেন ভেঙে পড়েছে।

কর্নেল সোসটেলোর সাথে কথা বলা শেষ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে আদেশ দিয়েছেন, এখনই র‍্যামন আকোকা এখানে চলে আসবেন। জাইমে মিরো এবং তার চার সিস্টারকে পাওয়া গেছে। ঈশ্বর পরম করুণাময়। এবার শুরু হবে আমার আসল কাজ। কিন্তু আমি একাই সব সফলতা অর্জন করব। কর্নেল সোসটেলো ভাবলেন, আকোকা নাম কিনবেন, আমি চেয়ে চেয়ে দেখব। না, এটা আর হতে দেব না।

তিনি তার অধীনস্থ কর্মচারীদের আদেশ দিলেন। বললেন- কাউকে বন্দী করে এখানে আনবে না। মনে রেখো তোমরা, সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে লড়াইতে নেমেছ। দরকার হলে গুলি করে দিও।

মেজর পেনটে বললেন– কর্নেল, মিরোর সাথে কয়েকজন সেবিকা আছেন। আমরা কি তাদেরও হত্যা করব?

-হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কোনো সুযোগ দিও না।

কার্ল সোসটেলো বাবোজনকে নির্বাচিত করলেন। এক্ষুনি অভিযান শুরু হবে। সকলের হাতে আধুনিক অস্ত্র। অন্ধকারের বুকে তারা এগিয়ে চলেছেন। কোনো শব্দ করছেন না। পাহাড়ি পথ ধরে। চাঁদ হারিয়ে গেছে, মেঘের আড়ালে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমরা কীভাবে দেখব।

কর্নেল সোসটেলো চিৎকার করলেন এবার অস্ত্র ফেলে দাও। তোমরা ধরা পড়ে গেছে।

আওয়াজ শোনা গেল বুলেট বর্ষণ শুরু হোক।

একডজন অটোমেটিক অস্ত্র চিৎকার করল।

টমাস সানজুরো কখনও সুযোগ নেন না। মেশিনগান থেকে বুলেট ছুটে এসেছে। তাঁকে আঘাত করেছে। তিনি গড়িয়ে গেলেন। রুবিও আরজানো বসেছিলেন এককোণে। সানজুরোকে পড়তে দেখলেন। বুঝতে পারলেন, এবার কিছু একটা করতে হবে। তিনি দেখলেন, লুসিয়া ছ ফুট দূরে।

সিস্টার থেরেসা কোথায়? উনি জানতে চাইলেন

উনি চলে গেছেন।

 রুবিও বললেন- এখানে থাকুন।

লুসিয়ার হাত ধরলেন। অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে গেলেন। দূর থেকে আরও দুরে। একটির পর একটি বুলেট বর্ষণ। আলোর ঝলকানি। কিছুক্ষণ বাদে লুসিয়া এবং রুবিও ঘন অরণ্যে প্রবেশ করলেন। তখনও তারা উর্বশ্বাসে ছুটছেন।

-সিস্টার, আমাকে শক্ত করে ধরে থাকুন।

পেছনে সৈন্যরা ছুটে আসছে, বুনো কুকুরের মতো। শব্দ মরে গেল। এখন বোধহয় আর কেউ আসতে পারবে না। চাপ চাপ অন্ধকার।

লুসিয়া থেমে গেলেন। রুবিও থেমে গেছেন।

–আমরা বোধহয় নিরাপদ আশ্রয়ে এসেছি। কিন্তু এখনও ছুটতে হবে।

লুসিয়ার নিঃশ্বাস ঘন হয়েছে।

–আপনি কি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেবেন?

লুসিয়া বললেন না। তাঁর সব শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তবে মন বলছে পালাতে হবে। তিনি বললেন, আমি ভালোই আছি, আগে এখান থেকে পালাই।

.

কর্নেল সোসটেলোকে এবার অপমানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। একজন সন্ত্রাসবাদী মরে গেছে, কিন্তু কেউ জানে না কজন পালিয়েছে। জাইমে মিরোকে ধরা সম্ভব হয়নি। একজন মাত্র সিস্টার ধরা পড়েছেন। ধরা পড়েছেন নয়, তিনি নিজেই এসেছেন। কর্নেল আকোকার কাছে এই খবর গেলে কী হবে? না, ভাবতে কিছুই ভালো লাগছে না।

.

অ্যালান টাকারের ফোন, এলেন স্কটকে। আগের থেকে আরও বিরক্তিকর।

–আমি একটা খবর পেয়েছি, খবরের কাগজের ফাইল দেখতে দেখতে। এই খবরটা শুনলে আপনি অবাক হবেন কি?

-কী খবর?

 টাকার বললেন– যখন প্লেন দুর্ঘটনা হয়েছিল, তখন থেকেই এই মেয়েটি নিখোঁজ, তাই তো?

ওদিকে নীরবতা।

উনি বলতে থাকেন যে প্লেন দুর্ঘটনায় আপনার ভাসুর মারা যান, তার স্ত্রী এবং প্যাট্রিসিয়া নামের মেয়েটি।

আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা হচ্ছে।

এলেন স্কট বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এটা বলা উচিত ছিল। আপনি ফিরে এলে আমি সব কথা বলব। আপনি কি মেয়েটির সম্পর্কে আর কোনো খবর পেয়েছেন?

না, কিন্তু আশা করি সে আর বেশি দিন আমার চোখের আড়ালে থাকতে পারবে না। সমস্ত দেশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।

–তার কোনো খবর পেলেই আমাকে জানাবেন, কেমন।

লাইনটা মরে গেল। অ্যালান টাকার অনেকক্ষণ বসে রইলেন। মৃত টেলিফোনটার দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলা খুবই শান্ত স্বভাবের। তিনি ভাবলেন। তা হলে? আমি যদি ওনার পার্টনার হই, তাহলে কেমন হয়?

এলেন স্কট ভাবলেন লোকটাকে না পাঠালেই ভালো হত। এখন যে করেই হোক ওকে বারণ করতে হবে। কী করা যায়? মেয়েটির এখন কী হয়েছে? একজন সিস্টার?

ইনটারকম শব্দ করল।

মিসেস স্কট, আপনাকে এখনই বোর্ড রুমে আসতে হবে।

আমি এখনই আসছি।

.

লুসিয়া এবং রুবিও অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ ছুটছিলেন। এদিক-ওদিক করে। গাছের আড়াল দিয়ে।

শেষ পর্যন্ত রুবিও বললেন– এবার আমরা থামতে পারি। ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না।

পাহাড়ের অনেকটা উঁচুতে ওঁরা চলে এসেছেন। ঘন অরণ্য। লুসিয়া মাটিতে বসে পড়লেন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। এখনও মনের ভেতর চিন্তা। কী করবেন? ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। লুসিয়া ভাবলেন, এখনও তিনি বেঁচে আছেন, কারণ পাশে এই রুবিও আছেন।

লুসিয়ার দিকে তাকালেন রুবিও। বললেন– সিস্টার, বাকি রাতটুকু এখানেই কাটাতে হবে।

লুসিয়া বোধহয় তাই চাইছিলেন। এখন একটু বিশ্রাম দরকার।

রুবিও বললেন- ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার দৌড় শুরু করতে হবে।

হঠাৎ লুসিয়ার মনে হল, পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

রুবিও বললেন আপনার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। দেখা যাক কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা। আপনি কি এখানে একা থাকতে পারবেন?

–হ্যাঁ, থাকতে পারব।

বড়ো চেহারার মানুষটা অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।

–ভয় পাবেন না, আমি জানি, এত বছর কনভেন্টে থাকার পর বাইরে এলে আপনার কেমন লাগবে। সব কিছু অবাক বলে মনে হবে।

লুসিয়া বললেন– আমি ভালো থাকার চেষ্টা করব। আমার জন্য চিন্তা করবেন না।

রুবিও মন্তব্য করেছিলেন আপনি খুবই সাহসী কন্যা সিস্টার। আমি এখনই আসছি।

রুবিওর শরীরটা গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল। এখনই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুটোর মধ্যে যে কোনো একটা হয় পালাতে হবে, কাছাকাছি শহরে পৌঁছোতে হবে। ওই সোনার ক্রশটা বেচতে হবে। পাশপোর্ট তৈরি করতে হবে। যথেষ্ট টাকা হাতে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। অথবা? এই লোকটার সঙ্গে থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত লুসিয়া ভাবলেন, দ্বিতীয় পন্থাটাই গ্রহণ করা উচিত।

অরণ্যের মধ্যে আর্তনাদ। মানুষের, নাকি অন্য কারোর? একটা শব্দ, দেখা গেল রুবিও আরজানো, কত কী নিয়ে এসেছেন তিনি। তা হলে? টমেটো, আঙুর ফল, আপেল।

 রাতের খাবার, খুব একটা খারাপ নয় বলুন? অন্ধকারের মধ্যে রান্নার ঝামেলা নিতে হচ্ছে না।

লুসিয়া তাকালেন সত্যি সত্যি ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার।

.

খাওয়া শেষ হয়ে গেল। তারা গাছের তলায় বসলেন। রুবিও কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। লুসিয়া শুনছিলেন। তাঁর মন তখন চিন্তাচ্ছন্ন।

–সিস্টার, দশ বছর ধরে আপনি কনভেন্টে আছেন।

–কী বলছেন?

দশ বছর?

–হ্যাঁ।

–তাহলে বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে সে সম্বন্ধে কিছুই জানেন না!

–না।

দশ বছরে পৃথিবী অনেকটা পাল্টে গেছে।

–সত্যি!

 –গত বছর ফ্রাঙ্কো মারা গেছেন।

–আমি বিশ্বাস করি না।

 –বিশ্বাস করুন। দুজন মানুষ চাঁদের বুকে পদার্পণ করেছেন।

 লুসিয়া অবাক হবার ভান করলেন– কী যেন নাম? নীল আর্মস্ট্রং, আর কে একজন?

–তারা দুজনেই উত্তর আমেরিকার। শব্দের থেকে বেশি জোরে ছুটতে পারে এমন ট্রেন আবিষ্কৃত হয়েছে।

–অবিশ্বাস্য। আমি কনকর্ড বিমানে চড়ব, লুসিয়া ভাবলেন।

রুবিওর মনে তখন শিশুর কৌতূহল। তিনি সবকথা গড়গড় করে বলে চলেছেন।

–পোর্তুগালে বিপ্লব হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকসনের সাথে একটা কলঙ্ক জড়িয়ে গেছে। তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

লুসিয়া ভাবলেন, রুবিও লোকটা সত্যি চমৎকার।

 রুবিও ডুকাডো সিগারেটে আগুন দিলেন। স্পেন দেশের বিখ্যাত তামাক।

–আপনার সামনে আমি সিগারেট খাচ্ছি, আপনি এতে কিছু মনে করছেন না তো সিস্টার?

লুসিয়া বললেন- না-, মনে করার কী আছে।

আলো জ্বলে উঠেছে। সিগারেট খাবার জন্য মনটা আকুল হয়ে উঠল।

–আমি একটা সিগারেট খেলে কি আপনি আপত্তি করবেন?

অবাক হয়ে রুবিও তার দিকে তাকালেন– সত্যি আপনি সিগারেট খাবেন?

-দেখব কেমন খেতে? লুসিয়া জবাব দিলেন।

 –আচ্ছা, আমি একটা দিচ্ছি।

 প্যাকেটটা সামনের দিকে এগিয়ে দিলেন। লুসিয়া একটা সিগারেট বের করলেন। ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন। রুবিও আগুন জ্বেলে দিলেন। লুসিয়া অনেকক্ষণ ধরে স্বাদ গ্রহণ করলেন। আহা, ভালো লাগছে।

রুবিও অবাক হয়েছেন। ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছেন।

 লুসিয়ার কাশি এল। ইচ্ছে করেই কাশতে হচ্ছে তাকে।

–এই হল সিগারেট, তাই তো?

–এটা আপনার ভালো লাগছে?

–ভালো লাগছে না। তবে কেমন একটা ঝিমঝিমে অনুভূতি।

আর একবার সিগারেট টানলেন তিনি। হায় ঈশ্বর, কতদিন এই বস্তুটার সন্ধান পাইনি আমি। কিন্তু এখন আমাকে আরও ভালো অভিনয় করতে হবে। যাতে রুবিওর মনে কোনো সন্দেহ না জাগে। তিনি আগুন নিভিয়ে দিলেন। তারপর? কত কথাই মনে পড়ে গেল তার। সত্যি পৃথিবীটা দ্রুত পালটাচ্ছে। তিনি জানেন না মেগান আর গ্রাসিলা এখন কী করছেন? সিস্টার থেরেসার কী হয়েছে? তাকে কি সৈন্যরা ধরে নিয়েছে?

লুসিয়ার চোখে আগুন জ্বলে উঠল মনে হচ্ছে, একটু ঘুমোলে ভালো হত।

–আপনি ঘুমোন, আমি পাহারা দেব।

–অনেক ধন্যবাদ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লুসিয়া ঘুমিয়ে পড়লেন।

 রুবিও তার পাশে বসে ভাবছেন– এমন মহিলার সাথে কখনও দেখা হয়নি। জীবনটাকে উনি ভগবানের চরণে উৎসর্গ করেছেন, আবার ওনার মধ্যে এত পার্থিব অনুভূতি। এই রাতে উনি সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। নানা, উনি একজন বিশেষ মহিলা, রুবিও ভাবলেন। আহা, লিটল সিস্টার অফ জেসাস!

.

২০.

কর্নেল সোসটেলো দশ নম্বর সিগারেটটি ধরালেন। তিনি আর অপেক্ষা করতে পারছেন না। খারাপ খবর বাতাসের বুকে ভর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

বেশ কয়েক বার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। র‍্যামন আকোকাকে টেলিফোনে পাওয়া গিয়েছিল। র‍্যামন বলেছিলেন, কর্নেল গত রাতে টেরারিস্ট ক্যাম্পের ওপর আঘাত হানা হয়েছিল। আমি জানি, ওখানে জাইমে মিরোও ছিলেন। আপনিও নিশ্চয়ই খবরটা জানতেন।

ভয়ংকর নীরবতা।

জাইমেকে ধরা কি সম্ভব হয়েছে?

–না।

–আপনি বুঝতে পারছেন, আমার সাথে আলোচনা না করে কেন এই অপারেশনটা করলেন?

হাতে সময় ছিল না।

–কিন্তু জাইমে তো পালিয়ে গেলেন।

র‍্যামন আকোকার কণ্ঠস্বরে রাগ এবং বিরক্তির সংমিশ্রণ কে আপনাকে এইভাবে কাজটা করতে বলল?

কর্নেল সোসটেলো আমতা আমতা করতে থাকেন আমরা একটা নানকে ধরে ফেলেছি। তিনি পথ দেখিয়ে চলেছিলেন। একজন সন্ত্রাসবাদীর মৃত্যু হয়েছে।

–বাকিরা তো পালিয়ে গেছে?

–হ্যাঁ, কর্নেল।

–ওই ভদ্রমহিলা এখন কোথায় আছেন? ওনাকেও কি আপনারা ছেড়ে দিয়েছেন, নাকি?

কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ আভাস।

না, কর্নেল। সোসটেলো জবাব দিলেন। তাকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা তাকে নানা প্রশ্ন করছি।

–না, এখন কোন প্রশ্ন করবেন না। আমি যাচ্ছি, একঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।

 রিসিভার নামিয়ে রাখা হল।

.

ঠিক এক ঘণ্টা বাদে কর্নেল র‍্যামন আকোকা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলেন। সিস্টার থেরেসা সেখানে বসেছিলেন। তার চারপাশে অনেক পুলিশ এবং গোয়েন্দার ভিড়।

কর্নেল আকোকা আদেশ দিলেন- এখুনি ওই সিস্টারকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।

সিস্টারকে হেডকোয়াটার টেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। কর্নেল আকোকা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেল হেসে অভ্যর্থনা জানালেন।

–আমি কর্নেল আকোকা।

যাক শেষ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে দেখা হল। ভগবান এ কথাই বলেছেন।

ঘাড় নেড়ে কর্নেল জানতে চাইলেন- ভগবান? বসুন সিস্টার।

সিস্টার বলতে পারছেন না, উত্তেজনা এবং উৎসাহে থরথর করে কাঁপছেন। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন তো?

–হ্যাঁ, আমরা দুজনেই দুজনকে সাহায্য করব। কর্নেল আশ্বস্ত করলেন, আপনি আভিলার অ্যাবে সিস্টারসিয়ান থেকে পালিয়ে এসেছেন। তাই তো? আমি কি সত্যি বলছি?

হ্যাঁ, ঘটনাটা সাংঘাতিক। তারা আমাদের আক্রমণ করেছিল।

আবার সেই গল্প, অন্য কথা বলতে হবে।

সিস্টার, আপনি এখানে কী করে এলেন?

ভগবান আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি আমাকে নানাভাবে পরীক্ষা করতে চাইছেন।

আকোকা শান্তভাবে বললেন কেউ কি আপনাকে এখানে এনেছে সিস্টার?

–হ্যাঁ, ওরা আমাকে অপহরণ করেছিল, আমি ওদের খপ্পর থেকে পালিয়ে এসেছি।

–আপনি কর্নেল সোসটেলোকে বলেছেন সবকিছু। তাই তো?

–হ্যাঁ। এইসব ঘটনার অন্তরালে রাউল আছে। সে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল।

–আমরা জাইমে মিরো নামে একজন সন্ত্রাসবাদীকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আপনি কি তাকে দেখেছেন?

সিস্টার কেঁপে উঠলেন– হ্যাঁ, তার সঙ্গে…

 কর্নেল সামনে ঝুঁকে পড়লেন এখন বলুন, কোথায় গেলে তাকে পাওয়া যাবে?

মনে হচ্ছে তারা ইজের অভিমুখে চলেছেন।

আকোকা অবাক হয়ে গেলেন– ইজে? সেটা তো ফ্রান্সে?

এবার থেরেসার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতা–হ্যাঁ, মনিকা রাউলকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। রাউল আমাকে কিডন্যাপ করার জন্য তোক পাঠিয়েছে। ওই বাচ্চাটার জন্য।

অধৈর্য ক্রমশ বাড়ছে মিরো এবং তার লোকেরা উত্তর দিকে চলেছে। ইজে হল পুবে।

–আপনি আমাকে রাউলের কাছে নিয়ে যাবেন না। আমি তার মুখ দেখতে চাইছি না। আমি কী বলছি বুঝতে পারছেন তো?

কর্নেল আকোকা বলে উঠলেন- কোন্ হতচ্ছাড়া রাউলের কথা আপনি বলছেন? আমি জাইমে মিরো সম্পর্কে আগ্রহী।

আমি তো আপনাকে বলেছি, তিনি এখন ইজে আছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

–আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আমার মনে হচ্ছে আপনি মিরোকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। আমি আপনাকে আঘাত করব না। কিন্তু আবার বলছি, বলুন জাইমে মিরো কোথায়?

সিস্টার থেরেসা অসহায়ের মত তাকালেন- আমি জানি না, তিনি ফিসফিস করে বললেন, সত্যি আমি জানি না।

একটু আগে আপনি বললেন, উনি ইজে আছেন।

কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য।

–হ্যাঁ, ভগবান আমাকে তাই বলেছেন।

–অনেক হয়েছে, এই ভদ্রমহিলা হয় মিথ্যে কথা বলছেন, অথবা বোকা গবেট।

তিনি প্যাট্রিসিওর দিকে তাকালেন। বললেন- এই সিস্টারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এনাকে এখনই কোয়াটার মাস্টারের টেন্টে নিয়ে যাও। দেখো তো, তোমরা আসল কথাটা বের করতে পারো কিনা।

–আমরা এখনই যাচ্ছি কর্নেল।

প্যাট্রিসিও কাজ করতে শুরু করলেন। কনভেন্ট আভিলাতে তিনি গিয়েছিলেন। মনে মনে অনুতপ্ত, তার একটু ভুলের জন্য চারজন সিস্টার পালাতে পেরেছিলেন। এখন সেই ভুলটা শোধরাতে হবে। প্যাট্রিসিও ভাবলেন।

তিনি সিস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন আমার সঙ্গে আসুন সিস্টার।

–ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। আমরা কি এখান থেকে চলে যাব? তুমি আমাকে ইজে পৌঁছে দেবে না তো?

–না, আপনি ইজে যাবেন না।

 কর্নেল ঠিক কথা বলেছেন- এই মেয়েটি আমাদের সাথে বুদ্ধিমানের খেলা খেলতে চাইছে। ঠিক আছে আমরা ওকে নতুন খেলা শেখাব।

কোয়াটার মাস্টারের টেন্টে সকলে পৌঁছে গেলেন।

প্যাট্রিসিও বললেন- সিস্টার, আপনি এদের সঙ্গে যান, ওরা আপনাকে স্বর্গের পথ দেখাবে।

চারপাশে পোশাক পরা সৈনিকের দল। একজন বলল, সিস্টার, সত্যিই কি আপনি ধর্ম্যাজিকা, আপনাকে তো ডার্লিং বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।

ডার্লিং? রাউল আমাকে এইভাবে সম্বোধন করতো, তার মানে? এ কী রাউল নাকি?

দুজন সৈন্য জোর করে সিস্টারকে খাটে শুইয়ে দিয়েছে। একজন হাসতে হাসতে বলল, সিস্টার, ওপর থেকে দেখে আপনাকে মোটেই সুন্দরী বলে মনে হয় না। তবে আপনার পোশাক খুবই সুন্দর, দেখি তো ল্যাংটো করলে আপনাকে কেমন দেখায়।

সিস্টার থেরেসা বাধা দিতে পারলেন না। তিনি একমনে ভগবানকে ডাকছেন। ফালা ফালা করে ছিঁড়ে দেওয়া হল তার ওপরের পোশাক। অন্তর্বাসও খুলে ফেলে দেওয়া হল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে উনি খাটে শুয়ে আছেন। একজনের পর একজন এসে তার পুংদণ্ড • ঢুকিয়ে দিচ্ছে। যন্ত্রণায় সিস্টার চিৎকার করছেন। কিন্তু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তার কেবলই মনে হয়েছিল, এখনই বোধহয় আকাশ থেকে বজ্রপাত হবে। ভূকম্পনে পৃথিবী কেঁপে উঠবে। শয়তানদের মৃত্যু হবে। বাস্তবে তার কিছুই হল না।

তবে শেষ পর্যন্ত সিস্টার উঠেছিলেন, অরক্ষিত একটি পিস্তল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। শুয়ে থাকা অবস্থাতে, কোনোমতে, তারপর? এলোপাথারি কিছু গুলি, কয়েকজনের মৃত্যু হল। সৈন্যরা চেষ্টা করেছিল সিস্টারকে গুলি করে মেরে ফেলতে। সম্ভব ছিল না। কারণ তখনও সিস্টারের ওপর এক উন্মত্ত সৈনিক চেপে বসেছে। ধর্ষণ করছে ইচ্ছে মতো।

 শেষ পর্যন্ত সিস্টার এবং ওই ধর্ষক দুজনের মৃত্যু হল, পাশাপাশি শুয়ে থাকলেন তাঁরা দুজন!