২. লাস লাভাস ডেল মারকোয়েস

০৬.

লাস লাভাস ডেল মারকোয়েস-স্পেন, ১৯৫০।

তখন সে ছিল পাঁচ বছরের বালিকা। মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় একটা অদ্ভুত স্মৃতি। একটা নগ্ন পুরুষ দেহ, মায়ের খাটে এসে বসেছে। আবছা অন্ধকারে তার মুখ। তার শরীর, সব কিছু মনে পড়ে? একজন কি? নাকি অনেকজন।

মা বুঝিয়ে বলেছিলেন- এরা সবাই তোমার কাকু। তুমি এদের সকলকে ভালোবাসবে। সম্মান দেখাবে কেমন?

এইসব পুরুষেরা বিরাট আকারের। স্নেহ বিতরণ করতে জানে না। তারা রাত্রিতে থাকত, কখনও এক সপ্তাহ, কখনও বা এক মাস। তারপর বাতাসে ভর দিয়ে কোথায় হারিয়ে যেত। যখন তারা চলে যেত, ডলোরেস পিনেরো আবার একজন পুরুষের সন্ধান করতেন।

যৌবনকালে ডলোরেস ছিলেন অসামান্য রূপবতী। গ্রাসিলা মায়ের কাছ থেকে এই রূপের কিছুটা পেয়েছে। ছোটোবেলাতেই গ্রাসিলাকে দেখে অনেকে প্রেম নিবেদন করতে চাইত। আহা, অলিভ ফুলের মতো গায়ের রং, ঘন চকচকে কালো চুল, চোখের পাতার দিকে তাকালে মন কেমন করে। ছোটোবেলাতেই বোঝা গিয়েছিল, ভবিষ্যতে, সে পূর্ণ শশী হয়ে উঠবে। বছর কাটতে থাকে। ডলোরেস পিনেরোর শরীর তখন পৃথুলা হয়ে গেছে। তার সুন্দর মুখের এখানে সেখানে মাংসের ছাপ লেগেছে। সময় এসে কপালে এঁকেছে দীর্ঘ বলিরেখা।

ডলোরেস পিনেরো আর এখন রূপসী নন। কিন্তু সহজে তাকে গ্রহণ করা যায়। ইতিমধ্যেই তিনি এক যৌন আবেদনময়ী শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে সুনাম লাভ করেছেন। অপরিচিত পুরুষের প্রেমে পড়া তার অন্যতম স্বভাব। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই কাজে ব্যস্ত আছেন। এইভাবেই শরীর বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছেন। এটা না হলে আর কী বা করবেন? তাই দেখা গেল, পুরুষ খদ্দেরের সংখ্যা তখনও বিশেষ কমেনি।

এই হল গ্রাসিলার মায়ের জীবনকথা। তিনি চেয়েছিলেন, মেয়েকেও এই পথের পথিক করতে। গ্রাসিলার বাবা ছিলেন এক তরুণ মেকানিক। একসময় তিনি সেদিনের তরুণী ডলোরেসকে ভালোবাসা অর্পণ করেছিলেন। দুজনের মধ্যে জমে উঠেছিল প্রেমের আসর, জানা গেল, বেচারী ডলোরেস গর্ভবর্তী, ভদ্রলোক কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ডলোরেসকে এখন অভিশাপ একাই বহন করতে হবে।

ডলোরেস পিনেরো ছিলেন বদ স্বভাবের মহিলা। তিনি সমস্ত রাগ দুঃখ ঘৃণা ওই নবজাতিকার ওপর বর্ষণ করলেন। গ্রাসিলাকে দেখতে পারতেন না। বলা হত, সে নাকি তার বাবার মতো বোকা।

ছোটোবেলায় গ্রাসিলা এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে পালাতে চেয়েছিল। তার এই প্রয়াস সফল হয়নি। প্রত্যেক সকালে সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করত–ঈশ্বর, আজ মা যেন আমাকে শারীরিক আঘাত না করতে পারে। আজ মাকে তুমি খুশি রেখো। মা যেন আমাকে একটুখানি ভালোবাসে।

যেদিনটা গ্রাসিলার ভালো কাটত, রাতে ভালো ঘুম হত তার। সেদিন মা তার দিকে ফিরেও তাকাতেন না। গ্রাসিলা নিজে ছোটো ছোটো হাতে তার খাবার তৈরি করত। জামাকাপড় পরিষ্কার করত। লাঞ্চের থালা সাজাত নিজেই। স্কুলের টিফিন বক্সে টিফিন ভরত। আর শিক্ষিকাকে বলত– আজ মা আমার জন্য পাউরুটি টোস্ট তৈরি করে দিয়েছে। মা জানে, আমি পাউরুটি খেতে কত ভালোবাসি।

অথবা, আমার পোশাক ছিঁড়ে গেছে। দেখুন ম্যাডাম, মা কীরকম যত্ন করে সেলাই করে দিয়েছে। মা আমার সব ব্যাপারে কত নজর দেয়।

অথবা, কাল আমি মাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব।

এইসব শব্দগুলো শিক্ষয়িত্রীর মন ভেঙে দিত। আভিলার কাছাকাছি একটি ছোট্ট গ্রাম– লাস লাভাস ডেল মারকোয়েস, গ্রামের সবাই সবার হাঁড়ির খবর জানে। ডলোরেস পিনেরোর জীবনধারা গ্রামের আলোচ্য বিষয়। গ্রাসিলার ওপর তার প্রতিফলন পড়েছিল। অন্য কোনো মায়েরা তাদের ছোটো মেয়েদের সাথে গ্রাসিলাকে মিশতে দিতেন না। তারা ভাবতেন, ওই মেয়েটির সংস্পর্শে এলে নৈতিকতার অবমূল্যায়ন ঘটে যাবে। গ্রাসিলা পড়ত প্ল্যাজোলেটা ডেল ক্রিসটো স্কুলে। সেখানে তার কোনো বন্ধু ছিল না। ছিল না কোনো খেলার সাথী। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওই স্কুলে সে ছিল সবথেকে উজ্জ্বল ছাত্রী। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল মোটেই ভালো হত না। কারণ সে কোনো ব্যাপারে মনোযোগ দিতে পারত না। ক্লান্তি এসে সবসময় তাকে অবসন্ন করে রাখত।

শিক্ষিকারা নিন্দা করে বলতেন তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাবে গ্রাসিলা, যাতে ঠিকমতো কাজ করতে পারো।

অথচ গ্রাসিলা কিছুতেই তা করতে পারত না। কারণ তারা একটা ছোট্ট ঘরে থাকত। সে আর তার মা। ছোট্ট ঘরের কোচের ওপর ওই মেয়েটিকে ঘুমোতে হত। পাতলা পর্দা হাওয়াতে উড়ত। ওপাশে বেডরুম। গ্রাসিলা কী করে ঘুমোবে? কী করে মাকে বলবে, জেগে জেগে তাকে অশ্লীল কিছু শব্দ শুনতে হয়। সমস্ত রাত তার চোখের তারায় ঘুম আসে না। শুনতে হয়, তার মা সম্পূর্ণ অপরিচিত এক পুরুষের সাথে ভালোবাসার গল্প বলছেন। বিছানাতে আহ্বান জানাচ্ছেন। শরীর মিলনের জন্য তীব্র আকুতি।

গ্রাসিলা যখন বাড়িতে তার প্রগতি পত্র নিয়ে আসত, মা চিৎকার করে বলতেন– এত কম নম্বর পেলে চলবে কী করে? তুই কি জানিস, তুই কেন এত খারাপ রেজাল্ট করিস? তুই মূর্খ, তুই বোকা। তোর মাথায় গোবর পোরা।

গ্রাসিলা তাই বিশ্বাস করত। তখন দুঃখে-কষ্টে কান্নাও ভুলে গেছে সে।

***

বিকেলবেলা স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, গ্রাসিলা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করত, ছোট্ট রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, দুপাশে একাশিয়া এবং সাইনামোর গাছের সারি। পাথরের ঘর চোখে পড়ছে। কোথায় তার বাবা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করেন। গ্রাসিলার কয়েকজন বন্ধু ছিল, বাস্তবে নয়, কল্পনাতে। তারা সুন্দরী বালিকা, সুন্দর বালক, তারা মাঝে মধ্যে পার্টিতে গ্রাসিলাকে নিমন্ত্রণ করত। সেখানে সুন্দর কেক সরবরাহ করা হত। লোভনীয় আইসক্রিম। কাল্পনিক বন্ধুরা তাকে ভীষণ ভালোবাসত। তাদের সকলের চোখে গ্রাসিলা, আহা, এক বুদ্ধিমতী বালিকা। যখন মা কাছাকাছি থাকতেন না, গ্রাসিলা মনে মনে বন্ধুদের সাথে কথা বলত, মাঝে মধ্যে সে সত্যি সত্যি বানানো কথা বলত।

সে বলত–তোমরা কি আমাকে হোমওয়ার্কে সাহায্য করবে? গ্রাসিলা, আমরা তো জানি না, কীভাবে অঙ্ক করতে হয়। তুমি কত তাড়াতাড়ি যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে পারো।

অথবা কেউ একজন বলত গ্রাসিলা, আজ রাতে আমরা কী করব? আমরা একটা সিনেমায় যাব। আমরা শহরের পথে হাঁটতে হাঁটতে লেমনেট খাব।

অথবা তোমার মা কি তোমাকে অনুমতি দেবেন ডিনারে যোগ দিতে, গ্রাসিলা? সেখানে আমরা অনেক কিছু খাব।

অথবা মনে হচ্ছে, না মায়ের সাথে না থাকলে মা মনে মনে কষ্ট পায়, যদি মা রাজী হয়, তাহলে তোকে আমি নিশ্চয়ই জানাব।

রোববার গ্রাসিলার সকালে ঘুম ভাঙত। শান্তভাবে সে পোশাক পরত। মাকে জাগাত না, কারণ কোনো একজন কাকা তার পাশে শুয়ে আছে। সে একা একা হাঁটতে হাঁটতে সান জুয়ান বাউটিসকা চার্চে চলে যেত। ফাদার পিরেজ জীবনের কথা বলতেন। মৃত্যুর পরবর্তী অনুভূতির কথা। যিশুর জীবনের গল্প। গ্রাসিলা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে চাইত না। সে যিশুকে দেখার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল।

ফাদার পিরেজ, চল্লিশ বছর বয়সের এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ। তিনি গরীব এবং ধনীকে একই চোখে দেখেন। অসুস্থ এবং বলশালীর মধ্যে কোনো তফাত করেন না। তিনি লাস লাভাস ডেল মারকোয়েসে এসেছেন কয়েক বছর আগে। এই শহরের সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন। ফাদার পিরেজ সব বাড়ির খবর জানতেন। তিনি জানতেন, গ্রাসিলা প্রতি রোববার চার্চে আসে। তিনি জানতেন, গ্রাসিলার পারিবারিক পরিস্থিতি কেমন। ডলোরেস পিনেরোর শয্যাসঙ্গিদের আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কেও তিনি খবর রাখতেন। তিনি জানতেন, এমন একটি বাড়ি কিশোরী কন্যা বেড়ে ওঠার পক্ষে মোটেই সুখদায়ক নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে? মাঝে মধ্যে ওই ভদ্রলোক অবাক হতেন। ওই মায়ের এমন মেয়ে? গ্রাসিলা সহজ সরল। শান্ত স্বভাবের। কোনোদিন তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে পাদরির কাছে অভিযোগ করেনি।

পরিষ্কার পোশাক পরে গ্রাসিলা চার্চে আসত। পাদরি সাহেব জানতেন, এই পোশাকটা সে নিজের হাতে পরিষ্কার করে। ফাদার পিরেজ আরও জানতেন, এই মেয়েটি সকলের মধ্যে থেকেও একেবারে আলাদা। তিনি চেষ্টা করলেন, এই মেয়েটিকে আলাদা চোখে দেখতে। রোববারের বিশেষ প্রার্থনা সভার পর গ্রাসিলার জন্য একটু সময় দিতেন। মেয়েটার দুঃখ ভোলানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কখনও কখনও মেয়েটাকে নিয়ে কোনো কাফেতে চলে যেতেন। সামান্য কিছু খাবার। আহা, মহা আনন্দে মেয়েটির মুখ উদ্ভাস হয়ে উঠেছে।

***

শীতকালে গ্রাসিলার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যেত। শীতকালগুলো তার কাছে। একঘেয়ে এবং বিষণ্ণ কাতর বলে মনে হত। লাস লাভাস ডেল মারকোয়েস এমন একটি উপত্যকার ওপর অবস্থিত, যার চারপাশে ক্রাজ ভার্দে পর্বতের অবস্থান। এখানে ছমাস শুধুই শীতের ইশারা। হু-হুঁ করে বয়ে যাচ্ছে কনকনে বাতাস। বরং গরমকালের দিনগুলোে অনেক সহজ সরল। গরমে অনেক ট্যুরিস্ট সেই গ্রামে আসতেন। ওই ছোট্ট গ্রাম অথবা আধা শহরের বাতাসে তখন শুধুই হাসির উতরোল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তরুণ-তরুণীর একান্ত আলাপচারিতা। মনে হত এই প্রাণহীন শহর বুঝি কিছুদিনের জন্য প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ট্যুরিস্টরা মাঝে মধ্যে প্লাজা ডি ম্যানুয়েল এলগাটো ব্যারেটোতে যেতেন। সেখানে একটা সুন্দর ব্যান্ড-স্ট্যান্ড আছে। পাথর দিয়ে তৈরি, তারা অর্কেস্ট্রা তুলতেন। সারদানাতে গিয়ে আঞ্চলিক নাচের আসরে যোগ দিতেন। আহা, কত শতাব্দী ধরে এই লোকনৃত্যের আসর বসেছে। খালি পা, হাতে হাত, তারা এক বর্ণময় বৃত্ত রচনা করছেন।

গ্রাসিলা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত এইসব অচেনা আগন্তুকদের দিকে। তারা ফুটপাথে। বসে কফি পান করছে। যেখানে সেখানে পাগলের মতো জিনিসপত্র কিনছে। মাছের বাজারে গিয়ে দরদাম করছে। অথবা মাঝে মধ্যে তাদের দেখা যাচ্ছে, ওয়েসাইড পাবে। দুপুর একটা বেজেছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে গমগম করছে মানুষ। কেউ মদ পান করছে, কেউ জুয়া খেলছে, কেউ বা সীফুডে মগ্ন, কেউ অলিভের দরদাম করছে, কেউ মুখে চিপ পুরে চুষছে।

গ্রাসিলার কাছে এটাই ছিল সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা। মাঝে মধ্যে সে বিকেলের দিকে তাকিয়ে থাকত। ছেলেমেয়েরা হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলেছে। প্লাজা মেয়রেই তাদের জোড়ায় জোড়ায় দেখা যাচ্ছে। ছেলেরা মেয়েদের অদ্ভুত চোখে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বাবা মায়েরা তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়ছে। বন্ধুরাও। শকুনের মতো চোখ, কাফেতে ভিড়। আহা, এটাই বোধহয় কাছে আসার সময়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এমন ঘটনাই ঘটে আসছে। গ্রাসিলার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে ভাবে, কবে ওই জনসমাগমে যোগ দেবে। কিন্তু মায়ের লাল চোখের ইশারা তার স্বপ্নটাকে মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দেয়।

মা চিৎকার করে বলতে থাকেন ছেলেদের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে। তুমি কি বাজারের বেশ্যা হবে নাকি? ছেলেরা তোমার কাছ থেকে কী চায় বলো তো? ওই শরীরটা। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

মায়ের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ছে তিক্ততা, বিরক্তি এবং বীতরাগ।

***

কখনও কখনও দিনগুলো সহনযোগ্য বলে মনে হত, রাতগুলো পরিপূর্ণ থাকত আর্তনাদে। মাঝে মধ্যে ওই হালকা পর্দাটা সরে যেত। গ্রাসিলার চোখের সামনে ভেসে উঠত নগ্ন দৃশ্যের মিছিল।

গোঙানির শব্দ। শিৎকার। দীর্ঘশ্বাস। আহা, এত অস্থিরতা?

–জোরে আরও জোরে?

–তুমি সুখী তো?

–ঠিক মতো ঢুকছে না?

–আমি কী করতে পারি?

দশ বছরের গ্রাসিলা স্পেনীয় ভাষার সব কটি খিস্তি খেউর শিখে নিল। তারা মাঝে মধ্যে ফিসফিস করে এইসব কথা বলত। গোঙানির শব্দ। শিৎকার। আরও কত কী। গ্রাসিলার মনের মধ্যে তখন একটা অদ্ভুত অবদমনের সৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে কী যেন একটা সত্তা এবার মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। গ্রাসিলা আকাঙ্খী হয়ে উঠল। একটুকরো প্রেম অথবা একবুক তিয়াসের জন্য!

***

গ্রাসিলা তখন চতুর্দশী। মুরের সঙ্গে দেখা হল। এত বড়ো মানুষের সাথে গ্রাসিলার এর আগে কখনও দেখা হয়নি। তার চামড়া ছিল সূর্যদীপ্ত। তার মাথায় এতটুকু চুল নেই। চওড়া দুটি কাঁধ, উপযুক্ত বুক, শক্ত দুটি হাত। মুর এসেছে মধ্যরাতে, গ্রাসিলা তখন ঘুমে অচেতন। ভোরবেলা মুরের সাথে দেখা হয়ে গেছে তার। পর্দা সরে গেছে। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গ্রাসিলার বিছানার দিকে হেঁটে গেছে। তারপর মিলিয়ে গেছে উদ্যানের দিকে। গ্রাসিলা তার দিকে তাকিয়েছে। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করেছে। অসাধারণ পৌরুষের প্রতীক। এই লোকটা আমার মাকে মেরে ফেলবে –গ্রাসিলা ভেবেছে।

মুর তার দিকে তাকিয়েছে–বাঃ-বাঃ, তাহলে? তোমার মতো একটা রত্ন এখানে লুকিয়ে আছে?

ডলোরেস পিনেরো চিৎকার করে উঠেছেন, বিছানায় বসে বসে আমার মেয়ে, সংক্ষেপে বলেছেন তিনি।

গ্রাসিলার সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ। সে মায়ের নগ্ন দেহ দেখে ফেলেছে। মুরের পাশে দেখেছে এবং শিহরিত হয়েছে।

মুর হেসেছে, হাসির মধ্যে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠেছে নাম কী খুকি তোমার?

সামনে নগ্ন পুরুষ দেখে গ্রাসিলার মুখে বেলা শেষের লালিমা। কথা আটকে গেছে তার।

–ও হল গ্রাসিলা, কেমন দেখছ ওকে?

–অসামান্যা রূপবতী। আমার মনে হয় না, তুমিও ওই বয়সে এমন সুন্দরী ছিলে?

–এখনও আমি তরুণী, ডলোরেসের মুখে খিল্লি হাসি, তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছেন –পোশাক পরে নাও, স্কুলের দেরী হবে।

–হ্যাঁ, যাচ্ছি মা।

মুর তখনও একদৃষ্টে গ্রাসিলার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে যেন সব কিছু গিলে খাবে।

এবার প্রবীণা ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন–এসো, বিছানাতে চলে এসো। খেলাটা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি।

মুর বলল –পরে হবে। তখনও সে গ্রাসিলার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

গ্রাসিলার মনে হল, মুরের চোখ থেকে লোভ ঝরে পড়ছে। বিষ তীর হয়ে আক্রমণ করছে বেচারী গ্রাসিলাকে।

***

মুর থেকে গেল। প্রত্যেক দিন যখন গ্রাসিলা স্কুল থেকে ফিরে আসে, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, লোকটার কুৎসিত মুখ যেন না দেখতে হয়। কিন্তু সে জানে না, কেন সে এই পুরুষটিকে ভয় পায়। মুর কিন্তু ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এখনও অব্দি সে অশালীন আচরণ করেনি। কিন্তু মুরের চিন্তাই গ্রাসিলাকে শিহরিতা করে রাখে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে একটা অজানা কম্পন দেখা দেয়।

মায়ের প্রতি মুরের ব্যবহারের মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে। একটা অন্যরকম উদাসীনতা। মুর এই ছোটো বাড়িতে সারাদিন থাকে। প্রচণ্ড মদ খায়, ডলোরেস পিনে রো যে টাকাটা আয় করেন, মুর সবটাই ছিনিয়ে নেয়। মাঝে মধ্যে মাঝরাতে ভালোবাসার খেলা চলতে থাকে। গ্রাসিলা শুনতে পায়, মুর মাকে আঘাত করছে, সকালবেলা ডলোরেস পিনেরো শরীরে নানা চিহ্ন নিয়ে আবির্ভূত হন। বুঝতে পারা যায়, চোখের কোণে কালো দাগ, ঠোঁটের কোণে রক্ত ঝরছে, এসব হল মুরের শারীরিক আক্রমণের ফলশ্রুতি।

একদিন গ্রাসিলা জানতে চেয়েছিল, মা, তুমি ওই লোকটার সঙ্গে থাকো কেন?

মা জবাব দিয়েছিলেন বিষণ্ণভাবে –তুই বুঝতে পারবি না। ও সত্যিকারের পুরুষ। অন্যদের মতো মেনিমার্কা নয়। সে জানে, একজন মহিলাকে কীভাবে সন্তুষ্ট করতে হয়। তাছাড়া ও সত্যি আমাকে ভালোবাসে। এই যে আমার সর্ব অঙ্গে দাগ দেখছিস, এ হল ভালোবাসার দংশন। তুই এখন বুঝবি নারে।

গ্রাসিলা বিশ্বাস করেনি। সে জানে মুর তার মাকে ব্যবহার করে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মা প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। কোনো কোনো সময় সে মায়ের রাগ দেখে অবাক হয়ে যায়। যখন ডলোরেস পিনেরো সত্যি রেগে যান, তার মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনার জন্ম হয়। একবার তিনি গ্রাসিলাকে তাড়া করেছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি ছুরি। কারণ? গ্রাসিলা কী করেছে? সে কাকার জন্য আনা একটি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে। এই হল তার অপরাধ!

***

একদিন সকালবেলা, রবিবার, গ্রাসিলা তাড়াতাড়ি করছে, চার্চে যেতেহবে। মা আরও সকালে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। হাতে সেলাই করা পোশাক খদ্দেরের বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। গ্রাসিলা নাইট গাউন খুলল। পর্দা সরে গেল। মুর সামনে এসে দাঁড়াল। সে সম্পূর্ণ নগ্ন।

–তোমার মা কোথায় খুকি?

মা বাইরে গেছে, কিছু কাজ আছে।

 মুর এক দৃষ্টে গ্রাসিনার উলঙ্গ দেহের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলল–সত্যি, ভগবান তোমাকে কী দিয়ে তৈরি করেছেন।

এই প্রশংসা গ্রাসিলার মুখে লাল আভা এনে দিয়েছে। গ্রাসিলা জানে এখন তাকে কী করতে হবে। এখনই এই নগ্নতা ঢেকে দেওয়া উচিত। স্কার্ট এবং ব্লাউজ পরতে হবে। এখান থেকে চলে যেতে হবে কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সে যেতে পারল না। মনে হল কোনো এক জাদুকর বুঝি তাকে মাটির সঙ্গে আটকে রেখেছে। সে দেখতে পেল, মুরের পৌরুষ ক্রমশ জেগে উঠছে। চোখের তারায় একটা অদ্ভুত দীপ্তি।

শুনতে পাচ্ছে, কানের ভেতর, সেই অদ্ভুত শব্দ, আরও জোরে আরও জোরে, কী হচ্ছে কী? সবটা আমার ভেতর ঢুকিয়ে দাও।

গ্রাসিলা অচৈতন্য হয়ে পড়ল।

মুরের গলা খসখসে তুমি এখন এক বালিকা, পোশাক পরে নাও। এখান থেকে চলে যাও।

গ্রাসিলা নিজেকে ফিরে পেল। পালাতে হবে, এই ভয়ংকর লোকটার হাত থেকে। সে সরে গেল, এগিয়ে গেল, কিন্তু এ কী? কী এক অজানা আকর্ষণ তাকে মুরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সে মুরের কোমরে হাত রাখল। বুঝতে পারল, একটা সবল পুংদণ্ড তাকে আঘাত করছে।

গ্রাসিলা গুঙিয়ে উঠল না, ঈশ্বরের দোহাই, আমি কিন্তু সব বুঝতে পারি। আমি এখন আর খুকিটি নই।

 গ্রাসিলা এ ধরনের অনুভূতি কখনও পায়নি। একটা অচেনা আবেগ, বন্য উত্তেজনা, অসহনীয়। ভালোবাসার আনন্দ, উদ্বেগ, আকুলতা, বাসনা-কামনার আলোড়ন। সে মুরকে জড়িয়ে ধরেছে। আলিঙ্গনে কী সুখ! তার মুখ দিয়ে শিৎকারের শব্দ বেরিয়ে আসছে। মুর এবার শুরু করেছে তার খেলা। তৃপ্তির চরম অবস্থা, গ্রাসিলা ভাবল, তাহলে এই হল আসল জীবন রহস্য। শেষ অব্দি সে সব কিছু জানতে পারল। এটাই হল সৃষ্টির উৎস। এটাই হল জীবনের অঙ্গাঙ্গী অংশ। এই হল এমন একটা আনন্দ, যা লাভ করার জন্য আমরা তৃষিত তাপিত হয়ে অপেক্ষা করে থাকি।

-কী হচ্ছে? তোমরা করছ কী?

 ডলোরেস পিনেরোর কণ্ঠস্বর আর্তনাদ, ভয়ার্ত হাহাকার। এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল সময় যেন তুষারে আবৃত। ডলোরেস পিনেরো তাকিয়ে আছেন, বিছানার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে। ভাবতেও পারছেন না, তার অবর্তমানে মেয়ে এবং মুর শরীরের সেই খেলায় মেতে উঠবে।

গ্রাসিলা মার দিকে তাকাল। ভয় পেয়ে গেছে। মুখে কোনো শব্দ করতে পারছে না। ডলোরেস পিনেরোর চোখে জেগেছে বন্য উত্তেজনা।

কুকুরির বাচ্চা, তুই একটা কুকুরি।

–মা-মা, প্লিজ।

ডলোরেস পিনেরো হাতে তুলে নিয়েছেন লোহার অ্যাশট্রে। সেটাকে ছুঁড়ে দিয়েছেন মেয়ের মাথা লক্ষ্য করে।

এটাই হল শেষ অনুভূতি, যেটা গ্রাসিলার মনে পড়ে, আবছা-আবছা, চেতন এবং অচেতনের মাঝে একটি সরু সুতোর ওপর তা ভাসছে।

***

ঘুম ভেঙেছিল অনেকক্ষণ বাদে। হাসপাতালের শয্যা। অদ্ভুত কষ্ট। পাশাপাশি ছাব্বিশটি বেড সাজানো আছে। প্রত্যেকটি বেডে একজন করে পেশেন্ট। নার্সদের ছুটোছুটি এখানে সেখানে। প্রত্যেক পেশেন্টকে দেখতে হবে।

গ্রাসিলার মাথা ফেটে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা। যতবার সে পাশ ফেরার চেষ্টা করেছে, আগুনে নদী তাকে গ্রাস করেছে। সে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। অন্য রোগীদের আর্তনাদ এবং কান্না শুনেছে।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। গোধূলির অস্তরাগ। অল্পবয়সী এক ডাক্তার তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিরিশ বছর বয়স হয়েছে কি? দেখলে মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত ভার নিয়ে তিনি বুঝি ভারাক্রান্ত। অকালে বুড়িয়ে গেছেন।

–তাহলে তোমার ঘুম ভাঙল?

আমি কোথায়? গ্রাসিলার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল।

–তুমি এখন আভিলার হসপিটাল প্রভিনশিয়ালের চ্যারিটি ওয়ার্ডে আছে। গতকাল তোমাকে এখানে এনে ভর্তি করা হয়েছে। তোমার অবস্থাঁ চোখে দেখা যাচ্ছিল না। তোমার কপালে সেলাই করতে হয়েছে।

ডাক্তার বলে চলেছেন আমাদের চিফ সার্জেন নিজে এই কাজটা করেছেন। তিনি । বলেছেন, তোমার দিকে তাকানো কষ্ট হয়। তুমি এত সুন্দর, ভাবতে খারাপ লাগছে তোমার কপালে একটা দাগ হয়ে গেল।

গ্রাসিলা ভাবল –খারাপ কী হবে? সারাজীবন আমাকে এই কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হবে।

***

দ্বিতীয় দিন ফাদার পিরেজ গ্রাসিলাকে দেখতে এলেন। নার্স চেয়ার এগিয়ে দিলেন। ওই পাদরি সাহেব গ্রাসিলার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। মুখখানা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। চোখের তারায় ধূসর বিষণ্ণতা। গ্রাসিলাকে এই অবস্থায় দেখে তার হৃদয় বিগলিত হয়েছিল। তিনি সব শুনতে পেয়েছেন। লাস লাভাস ডেল মারকোয়েসের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে এই গুজব। গুজব নয়, সত্যি কথা। কিন্তু তিনি কিছুই মনে করছেন না। অথচ, কেউ কেউ এই ঘটনাটাকে চেপে দেবার চেষ্টা করেছে।

যেমন ডলোরেস পিনেরো সকলকে বলে বেড়িয়েছেন– সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মেয়ের মাথা ফেটে গেছে।

এখন ফাদার পিরেজ প্রশ্ন করলেন- গ্রাসিলা, তুমি এখন কেমন বোধ করছো?

 গ্রাসিলা মাথা নাড়ল, সে তাকাল ফাদারের দিকে।

–একটা প্রশ্নের জবাব দেবে? সত্যি কথা বলবে? কী করে এমন ঘটনা ঘটল?

 অনেকক্ষণ নীরবতা। শেষ পর্যন্ত গ্রাসিলা বলল– এটা নেহাতই একটা অ্যাক্সিডেন্ট।

 ফাদার গ্রাসিলার মুখের দিকে তাকাতে পারলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, তাই নাকি?

তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছেন। দুঃখে তাঁর মুখ ভরে উঠেছে। তিনি বললেন–গ্রাসিলা, আমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছি।

গ্রাসিলা বলল– আমি বাড়িতে যাব না, আমার কি যাওয়া উচিত?

না, আমার মনে হচ্ছে তুমি বাড়িতে যেও না। আমরা এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, তিনি এক হাত রাখলেন গ্রাসিলার হাতে। বললেন- কাল তোমাকে দেখতে আসব।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ফাদার।

ফাদার চলে গেলেন, গ্রাসিলা সেখানে অনেকক্ষণ শুয়েছিল, তারপর সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল- ভগবান, তুমি আমকে মেরে ফেলো, আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না।

সে এখন কোথায় যাবে? কোথাও যাবার তো তার জায়গা নেই। সে আর কোনোদিন বাড়িতে ফিরতে পারবে না। সে আর কখনও স্কুলে যেতে পারবে না। সে আর কোনোদিন তার ম্যাডামদের পরিচিত মুখ দেখতে পাবে না।

পৃথিবী এখন একেবারে শূন্য হয়ে গেছে তার কাছে। চারপাশে শুধুই অন্ধকার আর নিরাশা।

একজন নার্স জিজ্ঞাসা করল–তোমার কিছু কি লাগবে?

 গ্রাসিলা নার্সের দিকে তাকাল। মুখে হতাশা। কী বলার আছে? সে নিশ্চুপ হয়ে থাকল।

***

পরের দিন ডাক্তার আবার এলেন।

তিনি বললেন- তোমার জন্য ভালো খবর আছে, তুমি আজ হাসপাতাল ছাড়তে পারবে। এটা একটা মিথ্যে কথা। বাকিটা হয়তো সত্যি। কারণ এই বিছানাটা আমাদের লাগবে। অন্য একজন রোগী এসে গেছে।

গ্রাসিলা বুঝতে পারল, তাকে এখন চলে যেতে হবে। কিন্তু সে কোথায় যাবে?

***

একঘণ্টা বাদে ফাদার পিরেজ আবার এলেন। তার সঙ্গে আরেক জন পাদরি ছিলেন।

–ইনি ফাদার বেরেনডো, আমার এক পুরোনো বন্ধু।

গ্রাসিলা বিষণ্ণ মুখে ওই ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। বলল–ফাদার?

–হ্যাঁ, ফাদার বেরেনডো ভাবলেন, সত্যিই সে অসামান্যা রূপবতী।

গ্রাসিলার কী হয়েছে, ফাদার পিরেজ সংক্ষেপে সব বলেছে। আরও বলেছেন, কীরকম পরিবেশের মধ্যে এই মেয়েটি বড়ো হয়ে উঠেছে। আছে জীবনের তিক্ততা, আছে নিজেকে অপমান করার ইচ্ছা, কিন্তু, মেয়েটির সরল মুখে তার কোনো ছবি নেই।

ফাদার বেরেনো বললেন– তোমার এই অবস্থার জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে তুমি এগিয়ে চলেছ। হয়তো এই শব্দগুলোর আলাদা একটা মানে আছে। বেচারী গ্রাসিলা তা বুঝতে পারেনি।

ফাদার পিরেজ বললেন- গ্রাসিলা, আমি লাস লাভাস ডেলা মারকোয়েসে ফিরে যাব। তোমাকে ফাদার বেরেনডোর হাতে ছেড়ে যাচ্ছি কেমন?

এই কথা শুনে গ্রাসিলার মনের ভেতর উদ্বেগ আকুলতার জন্ম হয়েছিল। মনে হয়েছিল সে বোধহয় বাড়ির সঙ্গে শেষ সম্পর্ক ছিন্ন করল। সে চিৎকার করে বলেছিল–আমাকে এভাবে একলা ফেলে আপনি কোথাও যাবেন না।

ফাদার পিরেজ তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন– আমি বুঝতে পারছি, তুমি এখন নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করছ। কিন্তু তা ভাবছ কেন? আমাকে বিশ্বাস করো, তোমার দুঃখে আমার হৃদয় গলে গেছে। দেখো, ভবিষ্যৎ দিন কিন্তু এত খারাপ থাকবে না।

একজন নার্সকে দেখা গেল, বেডের দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাতে একটি বাণ্ডিল। সে ওই বাণ্ডিলটা গ্রাসিলাকে দিয়ে বলল– এ হল তোমার জামা-কাপড়। এখনই তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।

গ্রাসিলার মনে আরও আতঙ্ক– এখনই?

দুজন পাদরি পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

–তুমি পোশাক পরে নাও, আমাদের সঙ্গে চলে এসো, ফাদার বেরেনডো বললেন– আমরা কথা বলব।

পনেরো মিনিট হয়ে গেছে। ফাদার বেরেনডো গ্রাসিলার হাতে হাত রেখেছেন। গ্রাসিলা হাসপাতালের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। উজ্জ্বল সূর্যের আলোে, সামনে একটা সুন্দর বাগান। আহা, রং-বেরঙের ফুল ফুটেছে। কিন্তু গ্রাসিলার মন এতই ভারাক্রান্ত যে, ফুলের সৌন্দর্য তাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করতে পারল না।

***

এবার অফিসে তারা পৌঁছে গেছেন। ফাদার বেরেনডো বললেন ফাদার পিরেজ আমাকে সব বলেছেন, এই পৃথিবীতে তোমার থাকার কোনো জায়গা নেই।

গ্রাসিলা মাথা নাড়ল।

–কোনো আত্মীয়?

না, মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

–মাদার পিরেজ বলেছেন, তুমি নাকি প্রতি রোববার চার্চে যেতে?

-হ্যাঁ, যেতাম আমি। কী সুন্দর ছিল রবিবারের ওই সকালগুলো। চার্চের পরিবেশ খুবই ভালো লাগত। সে যিশুর সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব চিত্তে অপেক্ষা করত ক্ষণকালের জন্য ভুলে যেত জীবন যন্ত্রণা।

গ্রাসিলা, তুমি কখনও কনভেন্টে থাকার কথা ভেবেছ? না, এই চিন্তাধারা কখনও গ্রাসিলাকে আক্রান্ত করেনি।

.

–আভিলাতে একটা কনভেন্ট আছে, মিশনারীদের কনভেন্ট। তুমি সেখানে থাকতে পারো। নিরাপত্তার অভাব হবে না।

চিন্তাটা আতঙ্কঘন জানি না, কনভেন্ট সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।

কনভেন্ট সকলের জন্য। ফাদার বেরেনডো বলেছিলেন, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। সেখানে গেলে অনেক কঠিন অনুশাসন পালন করতে হয়। একবার তুমি যদি গেট দিয়ে ওখানে প্রবেশ করো, আর শপথ গ্রহণ করো, তাহলে তুমি আর কখনও কনভেন্ট থেকে বাইরের পৃথিবীতে আসতে পারবে না। কারণ তোমাকে ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে হবে। এই শপথ ভাঙা যায় না।

গ্রাসিলা সেখানে বসে ছিল। তার মনে পরস্পর বিরোধী ভাবনার অনুরণন। সে জানলা দিয়ে আকাশ দেখছিল। পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে? বন্দী জীবন কাটাবে? এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে সে? পৃথিবীতে কোথাও তার জন্য এক টুকরো নিরাপদ আশ্রয় আছে কী? যন্ত্রণা এবং অবিশ্বাস। অসহনীয় এবং দুঃখজনক। মাঝে মধ্যে সে আত্মহননের কথা চিন্তা করে। কিন্তু কনভেন্টের জীবন তাকে নতুন আশা দেবে। হতে পারে বন্দী জীবন, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাকে তো রিক্ত বিবিক্ত হতে হবে না।

ফাদার বেরেনডো বললেন আমি বুঝতে পারছি, তুমি এখন কী চিন্তা করছে। যদি তুমি রাজী থাকো, আমি তোমাকে মহতী মাদার প্রাওরেসের সঙ্গে দেখা করাব।

.

গ্রাসিলা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়েছিল- ঠিক আছে আমি রাজী।

***

মাদার একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন এই কিশোরী কন্যার মুখের দিকে। অনেক অনেক দিন আগে তিনি দৈববাণী শুনেছিলেন– এক কিশোরী কন্যা আসবে তোমার কাছে। তুমি তাকে নিরাপত্তা দিও।

-তোমার বয়স কত?

–চোদ্দো। ।

 মেয়েটি যথেষ্ট বড়ো হয়েছে, কতদিন আগে মহামান্য পোপ ঘোষণা করেছিলেন, বারো বছর হয়ে যাবার পর কোনো কিশোরী কন্যাকে আর সেবিকা হতে দেওয়া হবে না।

গ্রাসিলা মাদার বেটিনাকে বলেছিলেন- আমার ভীষণ ভয় করছে।

***

এই শব্দগুলো বেটিনার মনে প্রতিধ্বনি তুলেছে আমার ভীষণ ভয় করছে।

কত কত বছর হয়ে গেল। তিনি জানেন না, কোথায় এই ডাক? ফাদার? আমি ভীতা সস্তা।

বেটিনা, ঈশ্বরের সঙ্গে তোমার প্রথম সংযোগ কখন হবে? যখন তুমি বিপদের মধ্যে পড়বে।

বেটিনা ভাবছিলেন, আমার ডাক কি এসেছে? এই মেয়েটিকে আমি কি করে সাহায্য করব?

ধর্ম সম্বন্ধে তার কি ধারণা ছিল? ছোটোবেলায় তিনি রবিবার চার্চে যেতেন না। মনে পড়ে যায় কিশোরী বেলার কথা। ভালোম পোশাক পরতেন, ছেলে বন্ধু ছিল অগুণতি। মাদ্রিদ শহরের একাধিক ছেলে তখন তাকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া। কিন্তু কেন? এই জীবন কী করে এল? অনেক কিছু ভাবতে থাকেন তিনি। কখনও তিনি এই সন্ন্যাসিনী জীবনের কথা ভাবেননি। উনিশ বছর বয়স, এমন একটা ঘটনা ঘটল, জীবনটা একেবারে পালটে গেল।

তিনি বিছানাতে শুয়ে ছিলেন, ঘুমিয়ে ছিলেন, একটা কণ্ঠস্বর তাকে বলল, বেটিনা, ওঠো জাগো, বাইরে যাও।

তিনি চোখ মেলে দিলেন, উঠে বসলেন, ভয় পেয়েছেন। আলো জ্বেলে দিলেন, বেডসাইড ল্যাম্প। তিনি একা, কী অদ্ভুত স্বপ্ন।

কিন্তু ওই শব্দটা তিনি শুনেছেন। তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুমের রাজত্বে পা দিতে পারলেন না।

বেটিনা উঠে বাইরে যাও। এটা আমার অবচেতন মন, উনি ভাবলেন। আমি এখন মধ্যরাতে বাইরে গিয়ে কী করবো?

তিনি আলো নিভিয়ে দিলেন। আবার আলো জ্বালালেন।

 ড্রেসিং গাউন পরলেন। স্লিপার পরলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে আছে।

কিচেনের দরজা খুলে দিলেন। একটা অদ্ভুত ভয়ের অনুভূতি তাকে আক্রমণ করেছে। তিনি বুঝতে পারছেন, তাকে এখন পেছনের দরজা দিয়ে বেরোতে হবে। তিনি অন্ধকারের দিকে তাকালেন। তার চোখ পড়ল চাঁদের ধূসর আলোর দিকে। দেখা গেল একটা পুরোনো রেফ্রিজারেটার দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এখন ভাঙা জিনিসপত্র রাখা হয়।

বেটিনা জানতে পারলেন, কেন তিনি এখানে এসেছেন। তিনি ওই রেফ্রিজারেটারের দিকে এগিয়ে চলেছেন। মনে হল কেউ যেন তাকে সম্মোহিত করেছে। আহা, তিনি রেফ্রিজারেটারের ঢাকনা খুললেন। তিন বছরের ভাইকে সেখানে পাওয়া গেল, অজ্ঞান হয়ে গেছে।

এটাই হল প্রথম ঘটনা। কোনো কোনো সময় বেটিনা এই ঘটনাটিকে বোঝবার চেষ্টা করেন। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ভাবেন। আমি শুনেছিলাম, কে যেন আমাকে ডাকছে। আমি জানতাম পুরোনো রেফ্রিজারেটারটা ওখানেই আছে। আমি জানতাম এর ঢাকনা এখুনিই খুলতে হবে।

পরবর্তী অভিজ্ঞতাটা খুব সহজে বলা যায় না। একমাস পরের ঘটনা।

 ঘুমন্ত অবস্থায় বেটিনা আবার শুনতে পেয়েছেন দৈববাণী– আগুনটা নিভিয়ে দাও।

বেটিনা উঠে পড়লেন, ঘুম ভেঙে গেছে। নাড়ির গতি দ্রুত হয়েছে। আবার, আবার কী তিনি ঘুমোতে পারবেন? তিনি ড্রেসিং গাউন পরলেন, স্লীপার পায়ে গলিয়ে দিলেন। চলে গেলেন বাইরে, কোনো ধোঁয়া নেই, কোনো আগুন নেই। তিনি মা-বাবার বেডরুমের দরজা খুললেন। সবকিছু ঠিক আছে। ভাইয়ের বেডরুম? আগুনের শিখা আছে কি? সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন। প্রত্যেকটা ঘর ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। কোথাও আগুনের চিহ্ন নেই।

বেটিনা ভাবলেন, আমি একটা বোকা, এটা নেহাতই একটা স্বপ্ন।

তিনি বিছানাতে ফিরে গেলেন। আর তখনই বাড়িতে একটা বিস্ফোরণ হল। প্রচণ্ড শব্দ, ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে পড়েছে। তিনি এবং তার পরিবারের সকলে পালাতে পেরেছিলেন। কোনোভাবে ফায়ার ব্রিগেডের মানুষরা এসে আগুন নিভিয়ে দিয়েছিল।

একজন ফায়ারম্যান ব্যাপারটা ব্যাখা করলেন- বেসমেন্টেই আগুনের ফুলকি দেখা যায়, বয়লার ফেটে যায়।

পরবর্তী ঘটনা ঘটল তিন সপ্তাহ বাদে। এটা কিন্তু কোনো স্বপ্ন নয়।

বেটিনা পড়ার ঘরে বসেছিলেন, পড়ছিলেন, মনে হল কে যেন হেঁটে চলেছে বাগান দিয়ে। ভদ্রলোক বেটিনার দিকে তাকালেন। কী আশ্চর্য? এ কে? বেটিনা ওই মানুষটির ছবি কখনও মন থেকে মুছতে পারেনি।

তিনদিন কেটে গেছে, বেটিনা একটা অফিস ঘরে বসে আছেন, বাইরে এলেন, লিফটের জন্য অপেক্ষা করছেন। লিফট এসে গেল। দরজা খুলে গেল। বেটিনা ভেতরে পা দিতে যাবেন, হঠাৎ তাকালেন লিফট অপারেটারের মুখের দিকে। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এই মুখটি তিনি বাগানে দেখেছেন। বেটিনা ভয় পেয়ে পেছন দিকে ফিরে এলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। লিফট ওপরে উঠে গেল। এক মুহূর্ত পরে লিফট হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। সকলেই মারা গেল।

পরের দিন রোববার, বেটিনা চার্চে গেলেন।

হে ঈশ্বর, আমি জানি না কেন আমাকেই এইসব অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাকে কী করতে হবে? অনুগ্রহ করে সঠিক পথ বাতলে দিন। বলুন কোথায় গেলে আমি শান্তি পাবো।

উত্তর ভেসে এলো মধ্যরাতে, ঘুমন্ত বেটিনার কানে কানে কে যেন বলে দিল– আরও, আরও বেশি ত্যাগ, আরও তিতিক্ষা এবং ধ্যান।

বেটিনা ভাবলেন সমস্ত রাত্রি ধরে, সকাল হল, তিনি যাজকের কাছে গেলেন। ভদ্রলোক মন দিয়ে বেটিনার সব কথা শুনেছিলেন।

–ও, তুমি সেই ভাগ্যবতীদের একজন, তোমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।

–কী জন্য?

–তুমি কি ঈশ্বরের জন্য তোমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করতে চাও?

 –আমি জানি না, আমার ভয় করছে।

 শেষ পর্যন্ত তিনি কনভেন্টে যোগ দিয়েছিলেন।

আমি আমার জীবনের সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছি। মহতী মাদার বেটিনা চিন্তা করলেন, এত আনন্দ, আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না।

***

এখন এই চতুর্দশী কিশোরী কন্যাটি বলছে– আমি ভয় পেয়েছি।

মহতী মাদার গ্রাসিলার হাতে হাত দিলেন– সময় নাও গ্রাসিলা, ভগবান তোমার সঙ্গে আছেন। তুমি ভেবো না, তুমি একা। পৃথিবীর সর্বত্র তিনি ছড়িয়ে আছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে চোখে দেখতে পাই না।

কী চিন্তা? আমি আছি, আমি সবখানে আছি। গ্রাসিলা ভাবল। তারপর? নীরবতা, নৈঃশব্দ, আমি বিচ্ছিরি শব্দ শুনেছি। গ্রাসিলা মাদারের মুখের দিকে তাকাল। বলল- হ্যাঁ, এবার আমি নীরবতার জগতে প্রবেশ করব।

***

সতেরো বছর কেটে গেছে, তখন থেকে গ্রাসিলা এক অনাস্বাদিত আনন্দের সম্মুখীন হয়েছেন। জীবনে প্রথম তিনি এই আনন্দের সন্ধান পেলেন। তার জীবনটাকে ভগবানের চরণতলে উৎসর্গ করেছেন। অতীতের দৃশ্য আর কোনোভাবে তাকে তাড়িত করতে পারে না। সেই আতঙ্কঘন মুহূর্তগুলোকে তিনি ভুলে গেছেন। তিনি এখন যিশুর পরম প্রিয়াতে পরিণত হয়েছেন। জীবন যখন শেষ হয়ে যাবে, তিনি যিশুতেই মিলে যাবেন।

বছর এগিয়ে গেছে নীরবতার মধ্যে, মাঝে মধ্যে নৈশকালীন দুঃস্বপ্ন। ভয়ংকর শব্দ, এছাড়া, আর কোনো স্মৃতি নেই। গ্রাসিলা জানেন, ধীরে ধীরে ওই অতীতটা একেবারে মরে যাবে।

.

সিস্টার গ্রাসিলাকে অনেক কাজ দেওয়া হল। বাগানের কাজ করতে হল। বাগানের কাজ করতে তিনি ভালোবাসেন। আহা, ঈশ্বরের, এই অসাধারণ সৃষ্টি। ছোটো ছোটো ফুলগুলি। কোনো পাপ করতে জানে না। চারপাশে উঁচু পাঁচিল। বাইরের পৃথিবীর শব্দ এখানে আসে না। মনে হয়, এটা বুঝি পাথরের তৈরি পাহাড়। গ্রাসিলার কখনও একা মনে হয় না, মনে হয় তিনি বোধহয় এই জগতে নিজেই রানী হয়ে বসে আছেন।

***

কনভেন্টের জীবন শান্তি এবং স্তব্ধতায় ভরা। হঠাৎ আবার সেই দুঃস্বপ্নের রাত ফিরে এসেছে। দুঃস্বপ্ন বাস্তব হয়ে উঠেছে। পৃথিবীটা বর্বর জাতিতে ভরে গেছে। তারা গ্রাসিলাকে এই অঞ্চল থেকে বাইরে নিয়ে আসবে। যে পৃথিবী থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন, আবার তাকে সেই পৃথিবীতে নিয়ে আসা হবে। সমস্ত পাপগুলো ফিরে এসেছে, আতঙ্কঘন পরিবেশ। মুর ফিরে এসেছে। মুরের মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন। মুরের সাথে লড়াই করে তিনি পারবেন কি? গ্রাসিলা চোখ খুললেন। আহা, লোকটি তার ভেতর নিজেকে প্রবেশ করাচ্ছে। পৌরুষের দ্বন্দ্ব। সে বলছে– আমার সাথে লড়াই কোরো না সিস্টার, এটাকে ভালোবাসার চেষ্টা করো। দেখবে, তুমি এমন আনন্দ পাবে, বাকি জীবন ভুলতে পারবে না।

গ্রাসিলা চিৎকার করলেন মা, মা, আমাকে সাহায্য করো!

.

০৭.

লুসিয়া কারমাইনের মনের ভেতর একটা অদ্ভুত ধারণা। তিনি এগিয়ে চলেছেন রাস্তা দিয়ে। মেগান এবং থেরেসার সঙ্গে। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। আহা, কতদিন বাদে চলার সাথে সিল্কের খসখসানি শব্দ। তিনি অন্য দুজনের দিকে তাকালেন। তাদের আচরণের মধ্যে একধরনের স্নায়বিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। নতুন পোশাক তারা মোটেই পছন্দ করছেন না। অনভ্যস্তের মতো হাঁটছেন। আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন। বুঝতে পারা যাচ্ছে, এই স্কার্ট এবং মোজা পরে তাদের খুবই অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা বোধহয় ভিনগ্রহের বাসিন্দা। তাঁরা এই পৃথিবীর কেউ নন। লুসিয়া ভাবলেন, বোধহয় তাদের আচরণের ভেতর একটি মাত্র আবেগের অনুরণন আমাদের ধরে ফেলল।

সিস্টার থেরেসাকে সব থেকে খারাপ অবস্থায় মনে হচ্ছে। ত্রিশ বছর কেটে গেছে, কনভেন্টের মধ্যে, একধরনের শালীনতা বোধের জন্ম হয়েছে তার আচরণের মধ্যে, এখন সেই শালীনতাবোধ ভেঙে যাচ্ছে খান খান হয়ে। ব্যাপারটা তিনি মোটেই পছন্দ করছেন না। এখন তাকে যে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয়েছে, সেই পৃথিবীর ঘটনাবলীর সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারছেন না। কনভেন্টের সব কিছুই তার কাছে চরম বাস্তব। তিনি আবার একটি কনভেন্টে ফিরতে চাইছেন। নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ঢুকতে চাইছেন।

মেগান চারপাশের মানুষজন সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। সকলে চোখ দিয়ে তাকে গিলে খাচ্ছে। তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন। মুখে লজ্জার আভা লেগেছে। তিনি এমন একটি জগতে বাস করেছেন, যেখানে শুধুই মেয়েদের একাধিপত্য। পুরুষ মানুষ কেমন দেখতে তা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন এত পুরুষ দেখে মনটা তার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিজনক, আবার উত্তেজকও বটে। চারপাশের মানুষরা মেগানকে দেখে কী ভাবছেন? কবরের অন্ধকার থেকে তিনি উঠে এসেছেন? অনেক বছর বাদে তিনি তার নারীত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠলেন।

তাঁরা পার্কে চলে গেলেন। আবার উত্তেজক কথাবার্তা শোনা গেল। রাম এবং গানের আন্দোলন। কারিলো কী করছে? রক অ্যান্ড রোল? হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন। তরুণ তরুণীরা এই গানের তালে তালে নাচতে ভালোবাসে। ব্যাপারটা আমাদের আকৃষ্ট করবে কী?

মেগানের মনে হল, সত্যিই তো, এর মধ্যে জীবন আছে, যৌবনের উন্মাদনা আছে। ওঁরা একটা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে গেলেন। ওই পাদ্রীসাহেব বলেছিলেন কি ধরনের সিনেমা এখন দেখানো হচ্ছে। ভাবলে অবাক হতে হয়। এই সিনেমাকে কি আমি একটি পর্ণগ্রাফি বলতে পারি? জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ছবিগুলোকে সকলের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।

মেগানের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়েছে। কারিলো গত কুড়ি বছর ধরে একটি মনাস্ট্রিতে জীবন কাটাচ্ছেন? তা হলে? তা হলে তিনি রক গান সম্পর্কে এত কথা কোথায় জানলেন? এই সিনেমাতে কী দেখানো হয় তাই বা কী করে জানলেন? কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

তিনি লুসিয়ার দিকে তাকালেন। থেরেসার দিকেও তাকালেন। বললেন- এখুনি দোকানে ফিরতে হবে।

তারা এগিয়ে গেলেন। মেগান ছুটতে শুরু করেছেন, খুব তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি ওই বন্ধ দরজার ভেতর পৌঁছোতেই হবে।

***

গ্রাসিলাকে মেঝের ওপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রাসিলা তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিজের নারীত্ব বাঁচানোর জন্য। কারিলোকে আঁচড়ে কামড়ে দেবার চেষ্টা করছেন।

-কী হচ্ছে? এরকম করলে আমি তোমাকে মেরে ফেলব।

কারিলোর মুখে নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি।

সে একটা শব্দ শুনতে পেল। তার মাথার ভেতর বিস্ফোরণ। সে দেখতে পেল হিলতলা একটা জুতো দ্রুত ছুটে আসছে মাথার কাছে। তারপর? এটাই বোধহয় শেষ ঘটনা যেটা সে মনে রেখেছিল।

মেগান ইতিমধ্যেই শিহরিত গ্রাসিলাকে টেনে নিয়েছেন। তাকে জড়িয়ে ধরেছেন–ঠিক আছে, আমরা এসে গেছি। শয়তান আপনার খুব ক্ষতি করতে পারেনি তো?

বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে, গ্রাসিলা কোনোরকমে বলেছেন- ওঃ, ওঃ, ভাগ্যিস আপনি এসেছেন, তা না হলে কী যে হত? লুসিয়া ও থেরেসাও ওই দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। ব্যাপারটা কী ঘটেছে লুসিয়া এক লহমাতে বুঝে নিয়েছেন।

বেজন্মার বাচ্চা!

তিনি অচেতন অর্ধনগ্ন ওই মূর্তিটার দিকে তাকালেন। গ্রাসিলা মেঝেতে শুয়ে আছে। অন্যরাও ভালোভাবে দেখলেন। লুসিয়া এককোণ থেকে বেল্ট নিয়ে এলেন। মেগান কারিলোর হাত দুটি বেঁধে দিলেন পিছমোড়া করে। তারপর বললেন- থুঃ থুঃ, তিনি বললেন মেগানকে, ভালোভাবে বাঁধুন তো। মেগান কাজ করতে লেগে গেলেন।

শেষ পর্যন্ত লুসিয়া খুশি হলেন। ঠিক আছে, বিকেলবেলা দোকান খুলবে, তখন এই লোকটি বলবে এখানে সে কী করছিল?

লুসিয়া গ্রাসিলার দিকে তাকিয়ে বললেন– আপনি ঠিক আছেন তো?

গ্রাসিলা হাসার চেষ্টা করছিলেন- হ্যাঁ।

–এখন এখান থেকে যেতে হবে, মেগান বললেন, পোশাক পরে নিন তাড়াতাড়ি।

যখন তারা বেরোতে যাবেন, লুসিয়া হঠাৎ বললেন- এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।

তিনি ক্যাশ লিস্টারের দিকে চলে গেলেন। একটা চাবি হাতে পেলেন। পাওয়া গেল, কয়েকশো পেস্টার, ভেতরে ছিল। তিনি অতি দ্রুত সেগুলো তুলে নিলেন। কাউন্টার থেকে একটা পার্স নিলেন। টাকাটা ওই পার্সের মধ্যে পুরে দিলেন। দেখা গেল, এই কাজটা থেরেসা মানতে পারছেন না। তাঁর মুখ রাগে থমথম করছে।

লুসিয়া বললেন- ব্যাপারটা এইভাবে ভাবুন সিস্টার, ভগবান আমাদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন। যদি তিনি সাহায্য না করতেন, তাহলে আমরা এই পেস্টার সন্ধান পেতাম কি?

***

তারা কাফেতে বসে আছেন। সংক্ষেপে আলোচনা করছেন।

সিস্টার থেরেসা বলছেনপ্রথমে এই পার্সটা মেনডাভিয়া কনভেন্টে দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সেখানে গেলে আমরা সবাই আবার নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারব।

লুসিয়া ভাবছেন, না, আমি কখনওই কোনো কনভেন্টে যাব না। আমার নিরাপত্তা লুকিয়ে আছে সুইস ব্যাঙ্কের মধ্যে। আগের কাজ আগে করতে হবে। দেখা যাক কীভাবে এই পার্সটা হাতাতে পারি।

–এখান থেকে কোন দিকে গেলে মেনডাভিয়াতে পৌঁছোব? উত্তর দিকে তো?

 –হ্যাঁ।

–ওই শয়তানগুলো সর্বত্র আমাদের অনুসন্ধান করছে। আজ রাতে পাহাড়ের ওপর থাকাটাই ভালো।

মনে হচ্ছে, কেউ বোধহয় লুসিয়ার কথা শুনছেন না।

একজন ওয়েট্রেস এল, টেবিলের ওপর মেনুকার্ড রাখল।

সিস্টাররা মেনুকার্ড ভালোভাবে দেখলেন। তাদের আচরণের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাব জেগেছে। লুসিয়া বুঝতে পারলেন, কী খাওয়া যেতে পারে? অনেক দিন বাদে তারা মেনুকার্ড দেখছেন। কনভেন্টে তাদের সাধারণ খাবার দেওয়া হত। সেখানে বাছ বিচারের কোনো ব্যাপার ছিল না। এখন তারা অচেনা অপরিচিত খাদ্য তালিকা দেখে অবাক হয়েছেন।

সিস্টার থেরেসা বললেন আমি কফি খাব, দু-তিন টুকরো পাউরুটি তাতেই হবে। সিস্টার গ্রাসিলা বললেন আমিও তাই নেবো।

মেগান বললেন–অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। আরও বেশি কিছু খেলে ভাল হয়, ডিম খাওয়াটাই ভাল।

 লুসিয়া নতুন চোখে তাকালেন, আহা, লুসিয়া ভাবলেন, সিস্টার মেগান ঠিকই বলেছেন, আপনারাও তাই খান। সত্যি, আবার কখন খাওয়া জুটবে কে জানে।

তিনি কমলালেবুর টুকরো অর্ডার দিলেন। দিলেন শুয়োরের মাংস, হট রোল, জ্যাম এবং কফি।

তিনি বললেন ওয়েট্রেসকে আমাদের খুব খিদে পেয়েছে।

বিকেল চারটে ত্রিশ। সিয়েস্টা শেষ হয়ে গেছে। ঘুমন্ত শহরের ঘুম ভাঙছে। তিনি চাইলেন, এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে।

কারিলোর অর্ধনগ্ন অচেতন শরীর আবিষ্কৃত হবার আগে।

খাবার এসে গেছে। সিস্টাররা তাকিয়ে আছেন।

লুসিয়া বলতে থাকেন- তাড়াতাড়ি শুরু করুন।

খাওয়া শুরু হয়ে যায়, প্রথমে ইতস্ততভাবে, তারপর অত্যন্ত দ্রুত। বোঝা গেল, তাঁরা ক্ষুধার্ত। মনের ভেতর অপরাধ প্রবণতা। সেটাকে জয় করতে হবে।

সিস্টার থেরেসার একটা সমস্যা আছে। তিনি এক টুকরো খাবার মুখে দিলেন। তারপর বললেন, না না, এভাবে বসে আমি খেতে পারব না। সবাই ড্যাবড্যাব করে দেখছে।

মেগান বোঝাবার চেষ্টা করলেন–সিস্টার, আপনি কি কনভেন্টে ফেরত যাবেন, তা হলে? হারানো শক্তি সঞ্চয় করুন। তা হলে এতটা পথ হাঁটবেন কী করে।

সিস্টার থেরেসা শান্তভাবে বললেন, ঠিক আছে, আমি খাচ্ছি, কিন্তু এই খাবার খেতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না।

লুসিয়ার মুখের ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি। লুসিয়া বললেন সিস্টার, খাবারগুলো কিন্তু সত্যিই সুস্বাদু।

খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। লুসিয়া বিল দিলেন। দ্য হিলস্টার থেকে যে টাকা পাওয়া গেছে, তার কিছুটা খরচ হল। তারা এখন উত্তপ্ত সূর্যালোকের মধ্যে হেঁটে চলেছেন। রাস্তাগুলোতে প্রাণস্পন্দন ফিরে এসেছে। দোকানগুলো খুলে গেছে। এখন বোধহয় মিগুয়েল কারিলোর দেহটা আবিষ্কৃত হয়েছে। লুসিয়া ভাবলেন।

লুসিয়া এবং থেরেসা শহর থেকে বাইরে যাবার জন্য উদ্বেগে আকুল হয়ে উঠেছিলেন। গ্রাসিলা এবং মেগান শান্তভাবে হাঁটছেন। তারা চারপাশের দৃশ্য দেখছেন। শহরের নানা গন্ধ নাকে ঢুকছে।

শেষ পর্যন্ত তারা শহরের বাইরে পৌঁছে গেলেন। এবার পাহাড়ের দিকে পথ এগিয়ে গেছে। সেখানে পৌঁছে লুসিয়া একটু নিরাপদ বোধ করলেন। তারা উত্তর দিকে এগিয়ে চলেছেন। পথ ক্রমশ খাড়াই হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, উচ্চতা খুব একটা কম নয়। লসিয়া সিস্টার থেরেসাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কি ওই প্যাকেটটা বইবেন? নাকি তার হাতে প্যাকেটটা দেওয়া হবে। আহা আপনার বয়েস হয়েছে, এতটা পথ আপনি প্যাকেটটা বইছেন। কষ্ট হচ্ছে না তো?

শেষ পর্যন্ত হাইল্যান্ড চোখে পড়ল। চারপাশে গাছের সমারোহ। লুসিয়া বললেন, আজ রাতে এখানে থাকতে হবে। সকালবেলা আমরা মেনডাভিয়া কনভেন্টের দিকে এগিয়ে যাব।

লুসিয়ার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে বাকি তিনজন সায় দিলেন।

.

নীল আকাশে সূর্য, ধীরে ধীরে চারপাশ শান্ত হয়ে আসছে, গরমকাল, একটা অদ্ভুত শব্দ তারপর? রাত্রি এসে গেল।

সবুজ ঘাসের ওপর মেয়েরা শুয়ে পড়েছেন।

লুসিয়া শুয়েছেন, ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আরও–আরও ঘন নিরাপত্তা চাই। নীরবতা এবং নৈঃশব্দ্য। যখন তিনজন সিস্টারের চোখের তারায় ঘুম নামবে, তখন লুসিয়াকে কাজ করতে হবে।

সিস্টার থেরেসা কিন্তু ঘুমোতে পারছেন না। যখনই ঘুমোতে যাচ্ছেন, অনেকের কথা মনে পড়ছে। আকাশের তারা গুনছেন। পাশে আরও সিস্টাররা শুয়ে আছেন, এতদিন কেউ কাউকে চিনতেন না। আজ সকলের নাম জেনেছেন, সকলের মুখ চোখে পড়ছে। তিনি ভাবছেন, ভগবান তাকে নিশ্চয়ই শাস্তি দেবেন, তিনি কনভেন্টের নিয়মনীতি ভেঙেছেন। নিজেকে হারিয়ে ফেললেন তিনি।

সিস্টার মেগান, তার চোখেও ঘুম আসছে না। সারাদিন যে ঘটনা ঘটে গেছে, সেই ঘটনাগুলো তাকে উত্তেজিত করে তুলেছে। আমি কী করে জানব, পাদ্রী বেশে আসা ওই লোকটা একটা শয়তান। তিনি ভাবলেন। আবার ভাবলেন, সিস্টার গ্রাসিলাকে রক্ষা করার মতো সাহস আমি কোথায় পেলাম। ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি। তিনি জানেন না, কতখানি খুশি হয়েছেন, আহা, এটা একটা পাপ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন সিস্টারের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

গ্রাসিলা ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারা দিনের ঘটনা তাকে ক্লান্ত করেছে। তিনি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন। এমন স্বপ্ন যার কোনো আদি নেই অন্ত নেই, যে স্বপ্নটা অন্ধকার লম্বা শেষহীন করিডর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

লুসিয়া কারমাইন তখনও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন শিকারী বিড়ালীর মতো। দুঘণ্টা কেটে গেল, তারপর? তিনি অন্ধকারের দিকে তাকালেন। সিস্টার থেরেসার দিকে তাকালেন। এবার ওই প্যাকেটটা নিতে হবে। এখান থেকে অদৃশ্য হতে হবে।

ধীরে ধীরে তিনি সিস্টার থেরেসার কাছে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, ওই মহিলা এখনও জেগে আছেন। হায় ভাগ্য, লুসিয়া তাড়াতাড়ি আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলেন।

লুসিয়া শুয়ে পড়লেন। ঘুমোবার ভান করলেন। আহা, থাকার চেষ্টা করলেন। সিস্টার থেরেসা সমস্ত রাত ধরে কী প্রার্থনা করতে পারবেন, একসময় তার চোখের তারায় ঘুম আসবে। তখনই সুবর্ণ সুযোগ।

লুসিয়া ভাবলেন– ক্যাশ ফ্রিজটা থেকে যে টাকা ছিনিয়ে নিয়েছেন, সেটা দিয়ে তিনি টিকিট কাটবেন, ট্রেন অথবা বাসে করে মাদ্রিদ শহরে পৌঁছোবেন। একবার সেখানে পৌঁছতে পারলে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আহা, হাতে ওই সোনার ক্রশটা থাকলে আমাকে আর পায় কে? কোথায় এটা বিক্রি করা যেতে পারে? এমন কোনো দোকান আছে কি? হয়তো কেউ ভাববে এটা চুরি করে আনা হয়েছে? আরে তাতে আমার কী যায় আসে। অনেককেই পাওয়া যাবে, যারা এটি কিনতে আগ্রহী। কার সঙ্গে দেখা করব? পরিচিত কোনো দালাল তো নেই!

এটার জন্য আমি তোমাকে এক হাজার পেস্তা দেব।

–আহা, এক হাজার, কাউন্টার থেকে আপনি এটা নিয়ে নেবেন। তারপর? নিজেকে বিক্রি করবেন।

কত পাওয়া যাবে? মাত্র পঞ্চাশ হাজার পেস্তা।

–আমি এটাকে গলাবার চেষ্টা করব, তারপর? আর কী?

 দু লক্ষ পেস্তা? এই আমার শেষ আদেশ।

আপনি কি আমাকে চোর ভেবেছেন? ঠিক আছে আমি এটা নিয়ে নিচ্ছি।

 দালাল বলবে।

না, একটা শর্ত আছে।

কী? আমার পাসপোর্ট তৈরি করতে হবে। আপনি কি জানেন যে আমাকে একটা নকল পাশপোর্ট বানিয়ে দেবে?

আহা, তখনও আমি হাত দিয়ে আগলে রাখব ওই সোনার ক্রশটিকে।

দালাল ইতস্তত করবে। তারপর বলবে– হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু আছে যে এই কাজে পারদর্শী।

ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল। এবার আমি এগিয়ে চলেছি সুইজারল্যান্ডের দিকে, ওখানে গেলেই স্বাধীনতা আমার মুঠোবন্দী হবে। পিতার কথা মনে পড়ল– মাঝে মধ্যে টাকা তোমার জীবনসীমা দশগুণ বাড়িয়ে দেবে।

চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আহা, অর্ধ অচেতন অবস্থা। মনে হয়, কোথায় যেন চার্চে ঘন্টা ধ্বনি বেজে উঠেছে। দূরবর্তী কোনো একটি গ্রামের মধ্যে। স্মৃতি, স্মৃতির সমুদ্রে তোলপাড়, অন্য কোনো একটা জায়গা, অন্য একটা সময়…

.

০৮.

টারমিনা, সিসিলি ১৯৬৮

রোজ সকালে চার্চ অফ সান ডেমিংগোর শব্দে তার ঘুম ভাঙত। ঘণ্টা বেজে উঠেছে। এই চার্চের অবস্থান পেলোভিটানির মাথার ওপর। আহা, তিনি একটা বিড়ালিনীর মতো হেঁটে যেতেন, ধীরে ধীরে। তিনি চোখ বন্ধ করতেন, তিনি জানতেন, ভালো কিছু দেখতে হবে চোখের সামনে। এখন কী? এই প্রশ্নটা সব সময় তার মনকে উদ্বিগ্ন করে রাখত। তিনি এদিক ওদিক তাকাতেন। কোন্ দিকে যাবেন বুঝতে পারতেন না। হঠাৎ তার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। তিনি লুসিয়া মারিয়া কারমাইন, অ্যানজেলো কারমাইনের কন্যা। পৃথিবীতে সমস্ত লোককে সুখী করাই অ্যানজোলার জীবনের একমাত্র কাজ।

তারা একটা মস্তবড় ভিলায় বাস করতেন। এতজন চাকর বাকর, পঞ্চদশী লুসিয়া গুনে শেষ করতে পারতেন না। একজন বডিগার্ড তাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। রোজ সকালবেলা। একটা সুন্দর লিমুজিনে করে। তিনি সবথেকে সুন্দর পোশাক পরতে ভালোবাসতেন। সিসিলির সবথেকে দামী খেলনা নিয়ে অবহেলায় খেলতেন। স্কুলের সহেলীরা তার দিকে ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন।

 কিন্তু? বাবাকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনা আবর্তিত। তার চোখে বাবা ছিলেন পৃথিবীর সবথেকে সুপুরুষ, তাঁর মতো ধনী এবং প্রভাব প্রতিপত্তিশালী মানুষ আর কেউ ছিলেন না। তিনি খর্বাকৃতি, সুন্দর চেহারা, শক্তিশালী, চোখ দুটি বাদামী, সবসময় শরীর থেকে একটা অদ্ভুত শক্তি বিকিরিত হচ্ছে। লুসিয়া ছাড়াও দুজন পুত্র সন্তান ছিল তার আরমালডো এবং ভিক্টর। কিন্তু কন্যাকেই বেশি ভালোবাসতেন অ্যানজেলো কারমাইন। লুসিয়া পিতাকে ঈশ্বরের মতো সেবা করতেন, চার্চে পাদরি সাহেব মাঝে মধ্যে ভগবানের কথা বলতেন। তখন লুসিয়ার মনে পড়ত বাবার পরিচ্ছন্ন মুখখানি।

সকালবেলা বাবা বিছানার পাশে আসতেন। বলতেন, ওঠো, ওঠো আমার ছোট্ট পরী, স্কুলে যাবার সময় হয়েছে।

সবসময় অবশ্য লুসিয়া স্কুলে যেতেন না। আর লুসিয়াকে দেখতে কেমন ছিল? না, খুব একটা সুন্দরী তিনি ছিলেন না। অবশ্য তার মধ্যে একটা আলগা চটক ছিল। মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়াতেন। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। হ্যাঁ, তাকে রূপসী বলা যেতে  পারে। একটি কিশোরী কন্যা ধীরে ধীরে যুবতী হয়ে উঠেছে। ডিমের মতো মুখ, উজ্জ্বল চকচকে ত্বক, আর সাদা দাঁত, সুন্দর সাজানো চিবুক। দেখলে মনে হয়, যৌন আবেদনময়ী, ঠোঁট দুটিতে অনেক লাস্য। কালো চোখের তারা। মনে হয়, তার মুখখানি শুধু সুন্দর নয়, তার শরীরটা যথেষ্ট সুন্দর। পনেরো বছর, লুসিয়া ইতিমধ্যেই এক যুবতী হয়ে উঠেছেন। স্তন দুটি তার সুগঠিত আকার ধারণ করেছে, কোমর ক্রমশ সরু হচ্ছে। পশ্চাৎদেশে মাংস জমেছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তরঙ্গের হিল্লোল।

–আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে দেব, বাবা পেছনে লেগেছেন– তুমি তোমার মনের মতন মানুষকে নিয়ে যাবে এগিয়ে জীবন পথে।

-বাবা, আমি তোমার মতো কাউকে বিয়ে করব। কিন্তু আমার দুভার্গ্য, এই পৃথিবীতে তোমার মতো পুরুষ একটিও নেই।

বাবা হাসছেন- ঠিক আছে, তোমার জন্য এক রাজকুমার খুঁজে আনব। তুমি যখন জন্মেছিলে, আকাশে শুভ নক্ষত্র দেখা গিয়েছিল। তুমি একদিন জানতে পারবে, কীভাবে এক পুরুষকে আলিঙ্গন করতে হয়। কীভাবে তাকে জীবনের সব ভালোবাসা উজাড় করতে হয়।

লুসিয়ার গালে রক্তিম আভা- হ্যাঁ বাবা আমি তা জানব।

তখনও পর্যন্ত লুসিয়া ভালোবাসা সম্পর্কে কোনো অনুভূতি জাগাতে পারেন নি। গত বারো ঘণ্টা কেটে গেছে, বেনিটো পাটাস, তার একজন বডিগার্ড, সবসময় তার কাছে চলে আসে, যখন বাবা বাড়িতে থাকেন না। বেনিটোকে ভালোবাসলে কেমন হয়? অসাধারণ উন্মাদনা, লুসিয়া জানতেন, বাবার কানে এখবর পৌঁছোল বাবা দুজনকেই হত্যা করবেন। বাবা ভীষণ একরোখা স্বভাবের মানুষ।

***

বেনিটোর বয়স কত? সবে মাত্র ত্রিশে পা দিয়েছে। তার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অ্যানজেলো কারমাইনের এই অসামান্য কিশোরী কন্যাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা।

-তুমি কি এটা ভেবেছিলে? প্রথমবার শয্যাতে শুয়ে বেনিটো জানতে চেয়েছিল।

–আঃ ভালো লাগছে, লুসিয়া জবাব দিয়েছিলেন।

লুসিয়া ভেবেছিলেন–মারিওর মতো সে হয়তো এত সুন্দর নয়, টনি কিংবা এনরিকোর মতো। তবে রবারটো কিংবা লিওর থেকে সে অনেক শক্তিশালী তা আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি। বাকি নামগুলো তিনি আর মনে রাখতে পারেননি।

তেরো বছর বয়েস, লুসিয়ার মনে হল, এখনও পর্যন্ত তিনি কুমারী রয়ে গেছেন। চারপাশে তিনি তাকালেন, দেখলেন, অনেক ভালো ভালো ছেলের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমেই পাওলো কসটেলো, অ্যানজেলো কারমাইনের ডাক্তারের ছেলে, সতেরো বছর বয়েস, লম্বা এবং সুপুরুষ, স্কুলের এক বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়। লুসিয়া তাকেই ভালোবাসলেন। পাওলোর সাথে প্রথম দর্শনেই প্রেম। মাঝেমধ্যে তার সাথে বেড়াতে বেরোতেন। পাওলো ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিয়েছিলেন। তিনি অ্যানজেলো কারমাইনের এই সুন্দরী কিশোরী কন্যাকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। আগস্টের একটি নিদাঘতপ্ত দিন, লুসিয়া ঠিক করলেন, তিনি আর অপেক্ষা করবেন না। তিনি পাওলোকে ফোন করলেন।

-পাওলো, আমি লুসিয়া কারমাইন বলছি। আমার বাবা তোমার সঙ্গে কোনো একটা বিষয়ে আলোচনা করতে চান। তুমি কি তার সাথে আমাদের পুড হাউসের পেছনে দেখা করবে?

এই কথা শুনে পাওলল অবাক হয়েছিলেন। অহংকারীও হয়ে উঠেছিলেন। তিনি জানতেন, অ্যানজেলে কারমাইনের মেজাজ কেমন। তিনি জানতেন না, মা ফিওসের মতো একজনও এই ব্যাপারটা জানতেন। পাওলো বলেছিলেন– আমি খুশি হলাম, কখন যাব বলো?

–বিকেল তিনটে।

সিয়েস্টার সময়, সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে। পুড হাউসের অবস্থান একেবারে বাইরে। বিশাল সম্পত্তির এক কোণে। বাবা সেখানে ছিলেন না। ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল না।

পাওলো এসেছিলেন ঠিক সময়। দরজাটা খোলাই ছিল, পাওলো ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন, পুড হাউসে পৌঁছে গেলেন। দরজাটা বন্ধ ছিল, তিনি শব্দ করলেন- সিনেট্রা কারমাইন? আমি কী ভেতরে ঢুকব?

–কোনো শব্দ নেই। পাওলো ঘড়ি দেখলেন। সাবধানে দরজা খুললেন। ভেতরে ঢুকলেন। ঘরটা অন্ধকার।

–সিনেট্রা কারমাইন?

একটা আবছা ছায়া শরীর সরে গেল। পাওলো?

তিনি লুসিয়াকে চিনতে পারলেন। লুসিয়ার কণ্ঠস্বর বুঝতে পারলেন।

–লুসিয়া, তোমার বাবা কোথায়? উনি কি এখানে আছেন?

 লুসিয়া আরও কাছে চলে এসেছেন। পাওলো অবাক হয়ে দেখলেন, লুসিয়া সম্পূর্ণ নগ্ন।

–হ্যায় ঈশ্বর, পাওলো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কী করছ তুমি?

আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসব। তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দেবে না পাওলো?

–এমন ছেলেমানুষী করো না, তুমি একটা ছোট্ট বালিকা। আর আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।

পাওলো বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন।

–তুমি যাও, আমি আমার বাবাকে বলব তুমি আমাকে ধর্ষণ করেছ।

না, তা তুমি কোরো না।

না, তুমি যেও না। পাওলো থমকে থেমে গেলেন। লুসিয়া যদি সত্যি সত্যি এই কথাটা বলে দেয় তাহলে কী হবে? পাওলো জানেন তাহলে তার ভাগ্য কেমন হবে।

তিনি ভেতরে এলেন, লুসিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। লুসিয়া প্রিয়তমা আমার, শোনো এভাবে অবুঝের মতো কাজ করো না।

–তুমি কখন আমাকে আদর দেবে?

না লুসিয়া, ব্যাপারটা ভয়ংকর। যদি বাবাকে একথা বলো তাহলে তিনি আমাকে মেরে ফেলবেন।

আমি জানি।

পাওলো আমতা আমতা করতে থাকেন আমার বাবাও অখুশি হবেন। আমার সমস্ত পরিবারের কী অবস্থা হবে বলো তো?

–আমি জানি।

আশা শেষ হয়ে গেছে।

তুমি কী চাইছ?

 –তুমি আমার সাথে সঙ্গমের খেলা খেল।

না, এটা অসম্ভব। তোমার বাবা জানতে পারলে আমাকে মেরে ফেলবেন।

আর যদি তুমি এখান থেকে চলে যাও, তাহলেও তোমাকে মরতে হবে। তোমার কাছে এখন আর কোনো সুযোগে নেই পাওলো। তুমি আমার ফাঁদে পা দিয়েছ।

পাওলো তাকালেন, আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর আমাকে তুমি কেন এভাবে ফাসালে লুসিয়া?

–আমি তোমাকে ভালোবাসি পাওলো।

লুসিয়া পাওলোর হাতে হাত রাখলেন। তার পায়ের ওপর সেই হাত বোলাতে লাগলেন। দেখো, দেখো, আমি একটা পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?

আবছা আলোয় পাওলো দেখতে পেলেন, দুটি স্তনবৃন্ত, বাদামী বৃন্ত দুটি শক্ত হয়ে উঠেছে। তারপর? দুটি পায়ের ফাঁকে ঘন চুলের আবরণ।

–হ্যায় যিশু, পাওলো ভাবলেন, এখন আমি কি করব?

 মেয়েটি কৌচে শুয়ে পড়েছেন, ধীরে ধীরে ছেলেটিকে উন্মুক্ত করে দিলেন। ট্রাউজারস– এবং শার্ট খুলে দিলেন। তারপর? তিনি হাঁটু মুড়ে বসলেন। পুংদণ্ডটি মুখের ভেতর নিলেন। ধীরে ধীরে চুষতে থাকলেন। পাওলো ভাবলেন- মেয়েটি অভীজ্ঞা, ব্যাপারটা এত সুন্দর করছে। তারপর? মেয়েটির অবস্থান নীচে, ছেলেটি ওপরে, ইতিমধ্যে পুংদণ্ড ঢুকে গেছে, যোনির অভ্যন্তরে। হাত দুটো নিতম্বদেশে খিমচি কাটছে। নিতম্বদেশ এত লোভনীয় হয়ে উঠেছে। শুরু হয়ে গেছে সেই খেলা। পাওলো মনে মনে ভাবলেন- হায় ঈশ্বর, মেয়েটি এত যৌনবতী?

লুসিয়া তখন স্বর্গে পৌঁছে গেছেন। তিনি ভাবছেন– এই ঘটনা কেন বার বার ঘটে না। তিনি জানেন কীভাবে একজন পুরুষকে খুশি করতে হয়। তার সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলছে। মনে হচ্ছে, তিনি যেন ধীরে ধীরে সেই সর্বোচ্চ অবস্থানের দিকে চলে যাচ্ছেন। আঃ, আরও উঁচুতে, আরও উঁচুতে। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটা ঘটে গেল। তিনি শিকার করলেন। সেই শিৎকারের মধ্যে আনন্দ আর স্বৈরিনীর অনুভূতি। তারপর? তারা দুজন নগ্ন হয়ে পাশাপাশি শুয়ে রইলেন।

লুসিয়া শেষ পর্যন্ত কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন– পাওলো, আবার এসো, এইখানে ঠিক এইসময়ে কেমন!

লুসিয়া তখন ষোড়শী। অ্যানজেলো কারমাইন ঠিক করলেন, মেয়েকে নিয়ে পৃথিবী দর্শনে বেরোবেন। কোথায় যাওয়া যেতে পারে? বৃদ্ধা আন্ট রোজার কাছে? লুসিয়া ক্যাপরি আর ইসচিয়াতে তার স্কুল জীবনের ছুটির প্রহরগুলি কাটিয়েছিলেন। কখনও ভেনিস কখনও রোম। আরও অনেক ভালো ভালো জায়গায়।

–তোমাকে আরও সহবত শিখতে হবে। গেঁয়ো মেয়ে হয়ে থাকলে চলবে না। তোমার বাবার মতো। পৃথিবীর নানা জায়গায় যেতে হবে। ক্যাপরিতে যাও, আন্ট রোজা সেখানে থাকে। তার সাথে কারথুসিয়ান মনাস্ট্রিরিতে যাবে। সেন্ট জেমসে। চ্যাপেল অফ সান মাইকেলে যেও। প্যালজা এ মেয়ারে।

–হ্যাঁ বাবা।

–ভেনিসে গেলে সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকা যাবে ডাগস প্যালেস। চার্চ অফ সান জরজিও, অ্যাকাভেমিয়া মিউজিয়াম।

–হ্যাঁ বাবা, যাব।

রোমকে আমরা পৃথিবীর অসাধারণ শহর বলতে পারি। রোমে গিয়ে তুমি সিটা ভ্যাটিক্যানোতে যেও, ব্যাসিলিক অফ সামটা ম্যারিয়া ম্যাগোরি, গ্যালেরিয়া বরগিজ অবশ্যই যাবে।

নিশ্চয়ই যাব।

–মিলানো, সেখানে গিয়ে কনজারভাটোরিওতে যেও। আমি লা স্কালার টিকিটের ব্যবস্থা করে রাখছি। তুমি এবং তোমার আন্ট রোজা, তোমরা মিউনিসিপ্যাল মিউজিয়াম অফ হাফে যাবে। এই শহরে আরও অনেক চার্চ এবং মিউজিয়াম আছে।

বাবা, নিশ্চয়ই যাব। এইভাবে সুন্দর একটা পরিকল্পনা করা হল। লুসিয়া এইসব জায়গাতে যায়নি, কাকি রোজা সিয়েস্টারে যেতেন। প্রত্যেকদিন বিকেলে। তার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত।

–তুমি বিশ্রাম করো।

হা, কাকি রোজা।

রোজা ঘুমিয়ে পড়তেন, লুসিয়া কুইমিনাইন ক্যাপরিতে নাচের আসরে যোগ দিতেন। একা একা কোথায় চলে যেতেন। একদল কলেজ ছাত্রের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল, মারিনা পিনাকোলোতে, বাগমিতে পিকনিক করতে গেলেন। অ্যানাপাপরি থেকে ঘুরে এলেন। সেখানে ফরাসী যুবকদের সাথে, ভাব জমালেন। পিয়াজা উমারটলে গিয়ে মদ খেলেন।

ভেনিসে দেখা হয়েছিল এক ছেলের সঙ্গে, ডিসকোতে, জনৈক ছেলের হাত ধরে চলে গেলেন চিগোগিয়াতে। তখনও আন্ট রোজা ঘুমিয়ে আছেন।

রোমে গিয়ে অন্য অভিজ্ঞতা। অ্যাপুলাতে মদ্য পান, আহা, ম্যারটে এবং র‍্যানিডারির মতো রেস্টুরেন্ট বসে খাওয়া।

যেখানে তিনি যেতেন, লুসিয়া নতুন আনন্দ খুঁজে পেতেন। ছোটো ছোটো বার এবং নাইটক্লাবে দেখা হত রোমান্টিক স্বভাবের পুরুষদের সঙ্গে। তিনি ভাবতেন, বাবা ঠিকই বলেছিলেন, দেশ ভ্রমণ না করলে আমাদের পড়াশোনা শেষ হয় না।

বিছানাতে শুয়ে শুয়ে তিনি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতেন। তিনি ভাবতেন, আহা, এই বয়সে আমি কত অভীজ্ঞা হয়ে উঠেছে।

লুসিয়া আবার টারমিনাতে ফিরে এলেন। প্রিয়তম সহেলীদের বলেছিলেন– আমি নেপলসে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়েছিলাম, আর সালেরমোতে প্রস্তর প্রতিমা হয়ে যাই। ডুরামডসে আমার খিদে পেয়েছিল, লুক্কাতে আমি পিঁপড়ে হয়েছিলাম!

লুসিয়ার বান্ধবীরা জানে, এই মেয়েটির কথা বলার মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই।

 সিসিলিকে আমরা এক অসাধারণ জায়গা বলতে পারি। এখানে গ্রেসিয়ান যুগের মন্দির আছে, আছে রোমান বাইজানটাইন অ্যাম্ফি থিয়েটার, চ্যাপেল, আরব দেশের পানাগার এবং সোয়াবিয়ান ক্যাসেল। লুসিয়া কালেরমোকে অত্যন্ত জীবন্ত অবস্থায় পেয়েছিলেন। কালসাতে ঘুরে বেড়ালেন। পুরোনো আরব কোয়ার্টারে গেলেন। অপেরা ডেই পুপিতে গেলেন। পুতুল নাচের আসর। টারমিনা, যেখানে তিনি জন্মেছিলেন, তখনও তাকে আকর্ষণ করত। মনে হত, আয়ত্তমিয়োর সমুদ্রের পাশে এ বুঝি এক স্বপ্নের শহর। পর্বত আছে, আছে বিশুদ্ধ বাতাস। এই শহরে এতগুলো ড্রেসের দোকান, গয়নার দোকান, বার এবং ছোটো ছোটো স্কোয়ার। বর্ণ রঙীন হোটেল, এক্সলেয়ার প্যালেস, সান ডোমেনিকো।

নেকোসেকসিকো, ছোটো ছোটো পট, লুসিয়া কারমাইনকে তাঁর পঞ্চদশ জন্মদিনে একটা গাড়ি দেওয়া হল। তিনি ট্রাফিক নিয়ম নীতি মেনে চলছেন। কখনও কোথাও থামছেন, না। শেষ অবধি তিনি অ্যানজেলো কারমাইনের সত্যিকারের সুখী কন্যাতে পরিণত হয়েছিলেন।

এবার আমরা অনুসন্ধান করব, অ্যানজেলো কারমাইনের ব্যবসা, তিনি সম্পত্তিরো নিয়ে ব্যবসা করেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, কারমাইনের পরিবার টারমিনাতে একটা বিরাট ভিলা পেয়েছিলেন। লেক কোমোতে ছিল আরেকটি বাড়ি। গেস্টাডে একটি লজ। রোমেতে একটি অ্যাপার্টমেন্ট। রোমে একটা মস্ত বড়ো ফার্ম ছিল। অ্যানজেলো কারমাইন আরও কয়েকটি অন্য ব্যবসা করেছিলেন। তিনি একডজন ওয়্যার হাউসের মালিক ছিলেন। দুটি জুয়া খেলার ক্যাসিনোতেও ছিল তার মালিকানা। ছটি জাহাজ ছিল। কলম্বিয়াতে ছিল কোকেন চাষের আসর। আবার ধার দেওয়ার ব্যবসা করতেন। অ্যানজেলো কারমাইনকে আমরা অন্যতম ধনী মানুষ বলতে পারি। তার জীবনটা ছিল উত্তেজনায় ভরা। তিনি বলেছিলেন, একজন গরীব সিসিলিয়ান চাষী কীভাবে জীবনে বাঁচবে। প্রত্যেকটি আশায় দিন চলতে হবে। অর্থ ছাড়া এ জীবনে আর কিছুই থাকে না।

অ্যানজেলো কারমাইন দুষ্টু ছেলে হিসেবে তার জীবন শুরু করেন। বারো বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। পনেরো বছর বয়সের মধ্যে জগতকে দেখে ফেলেন, ষোলো বছর বয়সে প্রথম হত্যাকাণ্ডে হাত পাকান। ধীরে ধীরে আরও সাহসী হয়ে ওঠেন। লুসিয়ার মায়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, অ্যানা, পরবর্তী বছরগুলোতে অ্যানজেলো কারমাইন অতিদ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে গেছেন। বিশ্বাসঘাতক সেজেছেন। একদল মৃত অন্ধ শত্রুর জন্ম দিয়েছেন। বয়েস বেড়েছে। অ্যানা তখনও পর্যন্ত এক সহজ সরল অশিক্ষিতা গ্রাম্য কন্যাই। থেকে গেছেন। তিন তিনবার সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু অ্যানজেলোর জীবনে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি জানতেন, এই পরিবার তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তিনি মারা গেলেন। তার মৃত্যু পরিবেশকে শোকাবহ করতে পারেনি।

আরনালডো এবং ভিক্টর বাবার সাথে ব্যবসায় যোগ দিলেন। তখন লুসিয়ার বয়স খুবই কম। তিনি বাবা এবং ভাইদের মধ্যে ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা শুনতেন। কীভাবে তারা শত্রুদের হারিয়ে দিয়েছেন সেই কৃতিত্বের গল্প শুনতেন। বুদ্ধির লড়াইতে জয়, লুসিয়া আনন্দে নেচে উঠতেন। লুসিয়ার কাছে বাবা ছিলেন মধ্যযুগীয় এক নাইট, যার হাতে উজ্জ্বল অস্ত্রের সমাহার। বাবা এবং ভাইদের এই কাজে তিনি খারাপ কিছু দেখতেন না। বরং তারা অনেক মানুষের মুখে অন্নের সংস্থান করছেন, এই ব্যাপারটা লুসিয়াকে খুশি করত।

মানুষ যদি জুয়া খেলার আসরে যোগ দিতে চায়, আমি কেন সেখানে বাধার সৃষ্টি করব। মানুষ যদি টাকা দিয়ে নারী মাংস কিনতে চায়, কেন তাকে সাহায্য করব না। বাবা এবং ভাইয়েরা চড়া সুদে মানুষদের হাতে টাকা তুলে দেন, এটাও তো ভালো কাজ, তা না হলে মানুষ যাবে কোথায়? লুসিয়ার কাছে তার বাবা এবং ভাইয়েরা ছিলেন আদর্শ নাগরিক। বাবার বন্ধুদের সাথেও মাঝে মধ্যে দেখা হত। প্রতি সপ্তাহে অ্যানজেলো কারমাইন বাড়িতে একটা বিশাল ডিনার পার্টির ব্যবস্থা করতেন। কারমাইনের টেবিলে কারা আসতেন? মাঝে মধ্যে শহরের মেয়র আসতেন, কয়েকজন অলডারম্যান ছিল নিয়মিত অতিথি। মাননীয় বিচারপতিরা আসতেন। পাশাপাশি বসে থাকতেন চিত্রাভিনেত্রীরা। অপেরা নায়িকারা দেখা করত, কোনো কোনো সময় পুলিশের প্রধান আসতেন। একবার গভর্ণরও সেখানে এসেছিলেন। একবার না, বেশ কয়েকবার।

এইভাবে লুসিয়া অভিজাত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। জীবনটা পার্টিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। দামী দামী জামাকাপড়, হীরে মুক্তোর অলংকার, একটির পর একটি বাড়ি গাড়ি, চারপাশে চাকর ঝিদের ভিড়। শক্তিশালী বন্ধু বান্ধবদের দল। ফেব্রুয়ারী মাস, তেইশ বছরের জন্মদিন, সবকিছু হঠাৎ শেষ হয়ে গেল।

অথচ কোথাও কোনো বিপদ সংকেত ছিল না। দুজন ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছিলেন। জুদাতে, একজন তাদের পুরোনো বন্ধু। পুলিশ প্রধান, অন্যজন তার লেফটেন্যান্ট।

আমাকে ক্ষমা করবেন, পুলিশ প্রধান বলেছিলেন, এটা হল নেহাতই একটা রুটিনের ব্যাপার, কমিশনার আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি কি দয়া করে আমার সঙ্গে যাবেন পুলিশ স্টেশনে? সেখানে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আমি দেখব যাতে আপনি যথাসময়ে ফিরে এসে আপনার মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে যোগ দিতে পারেন।

অ্যানজেলো কারমাইন হাসতে হাসতে বলেছিলেন– কোনো সমস্যা নেই, আমি তো বেশ বুঝতে পারছি, আপনারা সরকারের চাকরী করেন। দায়িত্ব পালন তো করতেই হবে। এই নতুন কমিশনারকে বোধহয় প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেছেন তাই না? উনি কাজ দেখাতে চাইছেন তাই তো?

–আমার তাই মনে হচ্ছে, পুলিশ প্রধান দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই, খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে ফিরিয়ে আনব। আমি কথা দিচ্ছি।

অ্যানজেলো কারমাইন আর সেদিন পার্টিতে ফিরে আসতে পারেননি। পরের দিনও নয়। আসলে তিনি আর কখনো তার বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। সরকার তার বিরুদ্ধে একশোটা মারাত্মক অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি অনেককে হত্যা করেছেন। ড্রাগের ব্যবসা করেন। বেশ্যাবৃত্তিতে মেয়ে ভাড়া খাটান। খুন জখম রাহাজানি আরও কত অভিযোগ। বেল দেওয়া হল না। কারমাইনের একটা বিরাট সংগঠন আছে, নিষিদ্ধ সংগঠন। তাকে বলা হল, তিনি সিসিলিতে মাফিয়াদের সঙ্গে যুক্ত, নিয়ে যাওয়া হল রোমে, আটকে রাখা হল রেজিনা কোয়ালিতে, প্রিন্স অফ হেডেন নামে একটি বন্দীশালায়। ছোট্ট একটি সেলুলার কক্ষে তার দিন কাটত।

এখানে বন্ধ জানলা আছে, আছে একটা রেডিওটার, ছোট্ট খাট, একটি টয়লেট, জীবন অধৈর্য হয়ে উঠল।

প্রথম দিকে অ্যানজেলো কারমাইন ভাবতেন, তার উকিল টম নাচোস কমটনো তাকে সাহায্য করবেন। আজ অথবা আগামীকাল তিনি এই কারাকক্ষ থেকে মুক্তি পাবেন।

কমটনো তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। গুরুমের অতিথি ঘরে বসে থাকতেন। কারমাইন মাঝেমধ্যে রাগে ফেটে পড়তেন– কী হচ্ছে? আমার সব ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ এত খবর জানল কী করে? কিছু একটা করুন। দেখুন তো, কে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আছে।

কমটনো বলতেন– আমরা বের করব, আপনার শত্রুকে চিহ্নিত করবো। আপনি এত ভেঙে পড়বেন না।

ধীরে ধীরে আশার আলো নিভে গেল। দেখা গেল, সরকার পক্ষ আরো উঁদে উকিল নিয়োগ করেছে। শুরু হল বিচার। একে একে সাক্ষী এসে দাঁড়াতে লাগল। ভয়ে অ্যানজেলোর মুখ শুকিয়ে গেল।

বিচার শুরু হবার দুদিন আগে অ্যানজেলো কারমাইন এবং মাফিয়া দলের সকলকে অন্য জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানে নিরাপত্তার দারুণ বাড়াবাড়ি। রোম শহর থেকে বারো মাইল দূরে। একশো সাতজন মাফিয়া সদস্যকে সেখানে রাখা হয়েছে। তাদের মাটির তলার টানেলে রাখা হয়। হাত এবং পায়ে চেন বাঁধা হত। ছোটো ছোটো খাঁচার মধ্যে তাদের ঢুকিয়ে রাখা হয়। খাঁচাগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরী। বুলেট নিরোধক গ্লাসের আচ্ছাদন। সশস্ত্র প্রহরী আছে চারপাশে, যাতে কোনো সমস্যা না হয়।

অ্যানজেলো কারমাইনকে কোর্টরুমে নিয়ে আসা হল। তার মন আনন্দে ভরে উঠেছে। আহা, জজের আসনে কে বসেছেন? জিওভানি বাসকেট্রা, গত পনেরো বছর ধরে কারমাইনের সাথে তার সুন্দর সম্পর্ক। কারমাইনের সান্ধ্য আসরে তিনি কতবার যোগ দিয়েছেন। অ্যানজেলো কারমাইন জানেন, শেষ পর্যন্ত তিনি সুবিচার পাবেন।

বিচার শুরু হল। অ্যানাজেলো কারমাইন প্রথমদিকে খুবই আনন্দে ছিলেন। তাকে শপথ নিতে হল। ধীরে ধীরে আনন্দ পালটে গেল। দেখা গেল, সরকার পক্ষে যিনি প্রধান সাক্ষী হিসেবে এসেছেন, তিনি হলেন বেনিটো পাটাস, বডিগার্ড। বেনিটো পাটাসের সাথে কারমাইন পরিবারের অনেক দিন ধরে ওঠাবসা। কারমাইন তাকে খুবই বিশ্বাস করতেন। মাঝেমধ্যে ওই ভদ্রলোক শোবার ঘরে ঢুকে পড়তেন। এখানে ব্যবসার গোপন আলোচনা হত। ব্যবসাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। পুলিশের চোখে, জাতির চোখে। পাটাস একটি একটি করে সব সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। এখন সবকিছু উগরে দিয়েছেন। পুলিশ পাটাসকে নানা প্রশ্ন করেছে। পাটাস বলেছেন, কীভাবে কারমাইন ঠান্ডা মাথায় মানুষকে হত্যা করেছেন। কীভাবে তিনি একটির পর একটি মেয়েকে বেশ্যাতে পরিণত করেছেন। নানারকম ভয় দেখিয়ে, মানুষের মুখ চাপা দেবার চেষ্টা করেছেন। পাটাস আরও অনেক গোপন খবর দিয়েছিলেন। অ্যানজেলো কারমাইনের অবিশ্বাস তখন আকাশ ছুঁয়েছে। নিয়ম মতো তাকে কোর্টরুমে আসতে হচ্ছে। তিনি শুনতে পাচ্ছেন। পাটাস কীভাবে তার দুর্নীতির ছবিগুলো তুলে ধরেছেন।

প্রত্যেক দিন লুসিয়া কোর্টে আসতেন, একজনের সওয়াল জবাব শুনতেন। সেই মানুষটিকে তিনি মোটেই ভালোবাসতেন না। যিনি তাঁর পিতা এবং ভাইদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছেন।

বেনিটো পাটাসের কথাগুলো বন্যার উন্মুক্ত জলতরঙ্গের মতো ভেসে এল। কমিশনারের অনুসন্ধান শুরু হল। আরও অনেক মানুষ এসে দাঁড়ালেন। সকলেই অ্যানজেলো কারমাইনের বিরুদ্ধে বিষ উদগার করছেন। কীভাবে অ্যানজেলোর গুণ্ডারা তাদের জীবন দুর্বিসহ করেছে, সবিস্তারে তা বর্ণনা করছেন। মাফিয়ারা সমাজের ক্ষতচিহ্ন, তারা কালো পথের পথিক, তারা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। তারা সাধারণ মেয়েকে পথের বেশ্যা বানায়। প্রিয়তমকে হত্যা করে। মেরে পঙ্গু করে দেয়। শিশুদের ড্রাগ আসক্ত করে তোলে। আতঙ্কের শেষ নেই। অপরাধ মিছিল করে এগিয়ে চলেছে।

শেষ অবধি বোঝা গেল, অ্যানজেলো কারমাইন বোধহয় আর ছাড়া পাবেন না।

 লুসিয়া তখন বাবার সঙ্গে দেখা করছেন, কারাকক্ষের অন্ধকারে।

প্রথমদিকে বাবা লুসিয়াকে আনন্দের সঙ্গে আহ্বান জানাতেন- লুসিয়া, ভয় পাস না, বিচারক আমার খুবই পরিচিত। তিনি হলেন আমার তুরুপের তাস। তিনি আইনের মারপ্যাঁচ জানেন। তিনি জানেন, কীভাবে একজন দোষীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হয়। তুই কিছু ভাবিস না, আমরা শীগগিরি ছাড়া পাব।

অ্যানজেলো কারমাইন তখনও জানতেন না, তার ভাগ্যে কী লেখা আছে।

 জনমানসে ব্যাপক বীত-রাগের সৃষ্টি হয়েছে। মাফিয়ার অত্যাচারে সকলেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। শেষ পর্যন্ত বিচার শেষ হল। জিওভানি তার রায় দিলেন, তিনি মাফিয়া সদস্যদের দীর্ঘদিন কারাদণ্ড দিলেন। অ্যানজেলো কারমাইন এবং তার দুই সন্তানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। আঠাশ বছর তাদের রুদ্ধকারার অন্তরালে থাকতে হবে।

অ্যানজেলো কারমাইনের কাছে এটা মৃত্যুদণ্ডের সামিল।

 ইতালির মানুষজন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত সুবিচার কথা বলেছে। লুসিয়ার কাছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তার ভাগ্যে এই বিপর্যয় ঘটে যাবে। যে তিনজন পুরুষকে তিনি সবথেকে বেশি ভালোবাসতেন, তারা এখন নরকের বাসিন্দা হয়ে গেলেন।

আরও একবার লুসিয়াকে অনুমতি দেওয়া হল, বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন নির্জন কারাকক্ষে। এক রাতের মধ্যে বাবা একেবারে পাল্টে গেছেন। মাত্র কয়েকটা দিন, বাবার বয়স একলাফে বেড়ে গেছে। তার চেহারা ভেঙে গেছে, আহা, কোথায় হারিয়ে গেছে সেই উজ্জ্বলতা।

–ওরা আমাকে নষ্ট করে ফেলল, আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল, উনি গুঙিয়ে উঠলেন- ওরা সকলে, এমন কি স্বয়ং বিচারক পর্যন্ত, লুসিয়া, আমি ভদ্রলোককে কত টাকা দিয়েছি তুই কি জানিস? উনি এইভাবে আমার সাথে প্রতিশোধের খেলা খেললেন? পাটাস, পাটাস আমার কাছে ছিল নিজের সন্তানের মতো। সারা পৃথিবীর কাছে মুখ দেখাতে পারব না। কী হল আমার বল তো?

লুসিয়া বাবার মুখের দিকে তাকালেন। নীচু কণ্ঠস্বরে বললেন- বাবা, প্রতিশোধ নিতেই হবে, আমি শপথ নিচ্ছি, আমি এর প্রতিশোধ নেবই।

–আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। বাবা বললেন, কিন্তু তোর সামনে বিশাল জীবন পড়ে আছে। আমার জুরিখে ব্যাংক অ্যাকউন্ট আছে, ব্যাংক লিউতে। এই টাকাটা পেলে তুই দশটা জীবন পায়ের ওপর পা রেখে কাটাতে পারবি।

তিনি কানে কানে গোপন সংখ্যাটা বলে দিয়েছিলেন–ইতালি ছেড়ে চলে যা। টাকাটা তুলে নে। জীবনের দিনগুলো আনন্দে থাকিস।

লুসিয়া বলেছিলেন- বাবা।

আর কিছু তিনি বলতে পারেননি। আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে।

যদি কোনো বন্ধুর দরকার হয়, ডোমিনিক ডায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করিস। আমরা দুই ভাইয়ের মতো ছিলাম। ডোমিনিক ফরাসী দেশের বেরিকে একটা বাড়ি করেছে। স্প্যানিশ সীমান্তের কাছে।

-মনে রাখব।

–ইতালি ছেড়ে চলে যাস মা, কেমন?

–হ্যাঁ বাবা, যাব। যাবার আগে কিছু একটা করবো।

এইভাবে আগুন জ্বলে উঠল, প্রতিশোধের আগুন। কী করে এই কাজে সফল হবেন তিনি? লুসিয়া তখন একা, কাজটা করা খুব একটা সহজ না। একটা ইতালীয় প্রবাদ তাঁর। মনে পড়ে গেল- আস্তে আস্তে এগোতে হবে। তবেই আমরা পথের শেষপ্রান্তে পৌঁছোতে পারবো।

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, বাবা এবং ভাইদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের জন্য। লুসিয়া কারমাইন জজসাহেবের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। জজসাহেব নিজেই দরজা খুলে দিলেন।

তিনি অবাক চোখে লুসিয়ার দিকে তাকালেন। কারমাইনের বাড়িতে যখন তিনি আসতেন, শনিবারের সান্ধ্য আসরে, তখন এই মেয়েটি কত সময় সামনে আসত। কিন্তু এই মেয়েটির সাথে খুব একটা বেশি পরিচিত হননি তিনি।

লুসিয়া কারমাইন? তুমি এখানে কী করছ? তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি।

–আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি।

 জজসাহেব সন্দিহান চোখে তাকালেন কীজন্য ধন্যবাদ?

লুসিয়া তার চোখের তারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন আমার বাবা এবং ভাইদের আসল চেহারাটা আপনি জগৎবাসীর সামনে খুলে ধরেছেন। আমি সরল জীবন কাটিয়েছি। এই বাড়িতে আতঙ্কঘন পরিবেশের মধ্যে বড়ো হয়ে উঠেছি। আমি জানতাম না জীবন্ত দৈত্য কেমন হয়।

লুসিয়া ভেঙে পড়লেন, কান্নাতে তার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেছে।

বিচারক ভদ্রলোক ভেবে পাচ্ছেন না এখন কী করবেন। তিনি লুসিয়ার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন–এসো এসো, চা খাবে কি?

-না না, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 তারা ভেতরে ঢুকলেন, লিভিংরুমে বসলেন। জজসাহেব বললেন– আমি জানি না বাবা সম্পর্কে তোমার কী মনোভাব। কিন্তু তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারছি, তুমি বাবাকে খুবই ভালোবাসতে তাই তো?

–হ, আমি তো জানতাম না বাবা এবং ভাইয়েরা কোন অসামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। যখন আসল সত্যাটা আমি জানতে পারলাম- লুসিয়া কথা শেষ করতে পারলেন না।

–এখন বাবাকে আমি ঘেন্না করি। লুসিয়া বললেন, আমি এখান থেকে চলে যাব, কিন্তু কীভাবে যাব?

ভদ্রলোক বললেন- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি কি তোমাকে ভুল বুঝেছি?

–আমি বাবাকে ভয় পাই,

লুসিয়ার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে এসেছে।

জজসাহেব বুঝতে পারলেন, আহা, কী সুন্দরী এই কন্যাটি। কালো পোশাক পরেছে, তার কামনাময়ী শরীরের অনেকখানি প্রকাশিত হয়েছে, ভদ্রলোক অবাক চোখে লুসিয়ার প্রস্ফুটিত দুটি উন্নত স্তনের দিকে তাকালেন, আরেকটু বড়ো হলে মেয়েটি আরও যৌনবতী হয়ে উঠবে, বিচারক সাহেব ভাবলেন।

ভারী ভালো লাগল, বিচারক সাহেব ভাবছেন, অ্যানজেলল কারমাইনের কন্যার সাথে। শুলে কেমন হয়? এখন অ্যানজেলো কিছুই করতে পারবে না, সে তো জেলের অন্ধকারে পচে মরছে। বুড়ো বেজন্মার এমনই হয়েছে। আমি এখন কী করব? মনে হচ্ছে লুসিয়া এখনও কুমারী, অস্পর্শিতা, আমি ইচ্ছে করলে এখনই তাকে বিছানাতে নিয়ে যাব। এমন শিক্ষা দেব, যা সে কখনও ভুলতে পারবে না।

এক বৃদ্ধ পরিচারক এসে দাঁড়াল, ট্রেতে চায়ের কাপ এবং বিস্কুট। সে টেবিলের ওপর ট্রেটা রাখলল। বলল, স্যার, আমি কি ঢেলে দেব?

লুসিয়া বলল- না, আমি ঢেলে দিচ্ছি।

তার কণ্ঠস্বরে উষ্ণতা ফুটেছে, আর কিছু আনুগত্য।

জজসাহেব লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তুমি পারবে? তাহলে তুমি চলে যাও।

পরিচারিকা চলে গেল।

-হ্যাঁ, আমি পারব স্যার।

লুসিয়া ছোট্ট টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে চা ঢেলে দিলেন। তারপর জজসাহেবের হাতে একটি কাপ তুলে দিলেন। নিজে একটি নিলেন।

–আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি না কি লুসিয়া?

জিওভানি বাসকেট্রা জানতে চেয়েছিলেন।

লুসিয়ার ঠোঁটে আমন্ত্রণী হাসির ইশারা- হ্যাঁ, যদি আপনি অনুমতি করেন।

–বসো।

জিওভানি, লুসিয়া হাতে কাপখানি তুললেন, তারপর? আসুন আমরা ওই শয়তানদের মৃত্যু কামনায় পান করি।

হাসিমুখে বাসট্রো কাপ তুলে নিলেন। আবার উচ্চারণ করলেন– ওই শয়তানদের মৃত্যু।

তিনি ধীরে ধীরে পান করলেন, আঃ, চাটা তেতো লাগছে কেন?

-বড্ড তেতো?

—না না আমার তো ভালো লাগছে।

লুসিয়া আবার কাপ তুললেন আমাদের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।

তিনি আবার চায়ে চুমুক দিলেন।

বিচারক সাহেব খাচ্ছেন।

বাসকেট্রা কিন্তু টোস্টে কামড় শেষ করতে পারেননি। সমস্ত শরীরে একটা উত্তেজনা। মনে হল, কে যেন ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে তার বুকের মধ্যে। তিনি বুকে হাত দিয়ে পড়ে গেলেন। এখুনি ডাক্তারকে ডাকতে হবে।

লুসিয়া সেখানে বসেছিলেন। ধীরে ধীরে চা খেলেন। দেখলেন, কীভাবে জজসাহেবের মৃত্যু হল। একটু বাদে শরীরটা নিস্পন্দ হয়ে গেল।

তারপর? লুসিয়া চোখ বন্ধ করলেন? বললেন–বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো? আমি কীভাবে আমার প্রথম অভিযানটা শেষ করলাম!

লুসিয়ার ঠোঁটে তখন শয়তানির হাসি খেলা করছিল।

বেনিটো পাটাস, আনন্দে উদ্বেল, জেলার সাহেব বললেন একজন আগন্তুক এসেছেন দেখা করতে।

বেনিটো, তাকে এক ইনফরমার হিসেবে বেশ খাতির করা হচ্ছে। তাকে অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যখন তখন কেউ এসে তার সাথে দেখা করতে পারে। পাটাসের অন্তত জনা ছয়েক বান্ধবী ছিল। মাঝেমধ্যেই তারা আসে। পাটাস জানেন না, আজ কার পালা।

তিনি আয়নাতে মুখ দেখলেন। মাথায় খানিকটা কমেট মেখে নিলেন। তারপর? প্রহরীকে অনুসরণ করলেন। ছোট্ট করিডর, প্রাইভেট পথ পাশাপাশি।

প্রহরী তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। পাটাস ঘরে গিয়ে বসলেন। মনে প্রশ্ন, কে এসেছে?

লুসিয়া, হায় ঈশ্বর, তুমি এখানে কেন এসেছ? তুমি এলে কী করে?

লুসিয়া হাসতে হাসতে বললেন- বেনিটো, আমি ওদের বলেছি, আমি তোমার বাগদত্তা।

অসাধারণ রূপবতী দেখাচ্ছে লুসিয়াকে। রক্ত লাল সিল্ক ড্রেস তার পরনে। শরীরের খাজগুলো স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।

বেনিটো পাটাস বললেন- বেরিয়ে যাও।

যদি আপনি চান, কিন্তু আপনার জন্য কিছু ভালো খবর আছে। যখন আপনাকে আমি স্ট্যান্ডে ডেকেছিলাম, আমার বাবা এবং ভাইদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, আপনাকে আমি ঘৃণা করেছিলাম। আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম।

লুসিয়া আরেকটু কাছে এগিয়ে এলেন, বেনিটো পাটাস এবার প্রসাধনের গন্ধ পাচ্ছেন কিন্তু যখন দেখলাম আপনি সাহসের কাজ করেছেন, আপনি সত্যের জয়পতাকা উর্বে তুলেছেন, আমার বাবা এবং ভাইয়েরা অত্যন্ত খারাপ মানুষ, আপনি তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন

–বিশ্বাস করো লুসিয়া, বেনিটো বললেন পুলিশ আমাকে একথা বলতে বাধ্য করেছে।

না না, আপনাকে আর ভালোভাবে বলতে হবে না। লুসিয়া বললেন আমাকে, আমরা ভালোবাসতে পারি না কি? আমার মনে হচ্ছে, আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ভবিষ্যতে আমি আপনার অনুগত থাকব।

লুসিয়া, আমি তো বুঝতে পারছি না এখন আমার কী করা উচিত।

–যা ঘটে গেছে তা ভুলে যান। এখন আপনি আর আমি বেঁচে আছি। আমাদের সম্পর্ক বেঁচে থাকবে।

লুসিয়া আরেকটু কাছে এলেন। তাঁ, ঘাম মেশানো প্রসাধনের গন্ধ। কেমন একটা ঘোর ঘোর অনুভূতি। বেনিটো অবাক হয়ে গেছেন। তিনি আমতা আমতা করতে থাকেন– তুমি কী বলছ?

আমরা জীবনটা একসঙ্গে কাটাব। আপনি কি জানেন আমি কেন এখানে আজ এসেছি? শুধু একথা বলতে, আমি আপনাকে ভালোবাসি। এটা কিন্তু কথার কথা নয়।

লুসিয়ার আঙুল খেলা করছে, ধীরে ধীরে তিনি নিজের মনকে প্রস্তুত করলেন। এবার নাটকের চরম দৃশ্যটা অভিনীত হবে। একমুহূর্তের মধ্যে অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটে গেল। বেনিটোর অবাক চোখের তারায় তখন লুসিয়ার নগ্ন মূর্তি। স্বপ্ন, না সত্যি? তিনি দেখলেন, সত্যি সত্যি লুসিয়ার পোশাক মাটিতে পড়ে গেছে। লুসিয়া একেবারে নগ্না। লুসিয়া বললেন- আপনি কি এখন আমাকে বিশ্বাস করছেন?

হায় ঈশ্বর, মেয়েটি এত সুন্দরী। হ্যাঁ আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি। বেনিটো নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই চিনতে পারলেন না।

লুসিয়া অতি দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এসেছেন। দুটি শরীর মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। লুসিয়া ফিসফিসিয়ে বললেন– তাড়াতাড়ি করুন, খুব তাড়াতাড়ি, আপনাকে এখনই উলঙ্গ হতে হবে। হাতে কিন্তু খুব একটা বেশি সময় নেই।

পাটাস পোশাক খুললেন, লুসিয়া সন্তর্পণে তাকিয়ে থাকলেন। পাটাস এখন সম্পূর্ণ নগ্ন। পাটাস লুসিয়ার হাতে হাত রাখলেন। ঘাড়ে একটা ছোট্ট খাঁজ রয়েছে। পাটাসের মন এখন দুঃসাহসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একমুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। লুসিয়া নীচে এবং পাটাস ওপরে। লুসিয়ার পা-দুটোকে জোড় করে ফাঁক করে দিলেন। তারপর, তারপর অহংকারের পুংদণ্ড ঢুকে গেল ধীরে ধীরে। পাটাসের মুখে বন্য হাসির টুকরো।

পাটাস বললেন– মনে হচ্ছে আগের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে, তাই না লুসিয়া? তুমি কি সেইসব সুখী সম্পৃক্ত মুহূর্তগুলিকে ভুলতে পারছ না?

লুসিয়া কানের কাছে মুখ এনে বললেন- না, আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। আমি কি আপনাকে ভুলতে পারি?

-না, আমাকে সত্যি করে বলো তো?

আমি একজন সিসিলিয়ান, আমার বাবার মতো।

ইতিমধ্যে লুসিয়ার একটি হাত মাথায় পৌঁছে গেছে। তিনি দীর্ঘ তীক্ষ্ণ কাঁটাটা মাথার চুল থেকে বের করেছেন।

বেনি পাটাসের মনে হল, কে যেন বুকের ভেতর কী বিঁধিয়ে দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা, রক্তের রেখা, তিনি আর্তনাদ করার জন্য মুখ খোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। কারণ, কারণ লুসিয়ার আগ্রাসী দুটি ঠোঁট তখন তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। বেনিটো কথা বলতে পারছেন না। একটু বাদে শরীরটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। তারপর? লুসিয়া ঠিক তখনই চরম রতির প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন।

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে, লুসিয়া চট করে পোশাক পরে নিলেন। আততায়ী পিনটাকে যথাস্থানে রেখে দেওয়া হল। বেনিটোর শরীরটা ঢেকে দেওয়া হল কম্বল দিয়ে। বেনিটোর চোখ দুটো বন্ধ। লুসিয়া দরজায় আঘাত করলেন। দরজা খুলে গেল। প্রহরীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন– ও এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

প্রহরী অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে এই সুন্দরী মেয়েটির দিকে তাকাল। তার মুখে হাসি। মনে হচ্ছে তুমি ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছ, তাই না সুন্দরী?

লুসিয়া ঘাড় নেড়ে বললেন- হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।

দু-দুখানা দুঃসাহসিক হত্যা, ইতালিতে ঝড় তুলেছে। কারমাইনের সুন্দরী কন্যা এইভাবে পিতা এবং দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছেন। ইটালির কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ খুবই খুশি হয়েছে। তারা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে, আততায়ী মেয়েটা যেন নিরাপদে এই দেশ থেকে পালাতে পারে। সঙ্গত কারণে পুলিশ আরও তৎপর হয়ে উঠেছেন। পালিয়ে যাবার সবকটি জায়গাতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। লুসিয়া কারমাইন এক মাননীয় বিচারপতিকে হত্যা করেছেন। আর জেলখানায় গিয়ে কারাকক্ষের মধ্যে আরও একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। পুলিশ কর্তারা অবাক হয়ে গেছেন। এমন দু-দুটি দুঃসাহসী, হত্যাকাণ্ড কী করে ঘটল? পুলিশ এবং প্রশাসনকে বোকা বানিয়ে! খবরের কাগজের পাতায় বড়ো বড়ো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

পুলিশ কমিশনার তার ডেপুটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেছেন মেয়েটাকে যে করেই হোক ধরতে হবে আজকের মধ্যে। আমি কোনো ওজর আপত্তি শুনব না।

শুরু হল অনুসন্ধান। কে কোথায় আছে সব দেখা হল। পুলিশকে আরও তৎপর করা হল। ইতিমধ্যে লুসিয়া পৌঁছে গেছেন বাবার প্রিয় সহকর্মী সালভাডোরের কাছে। এই ভদ্রলোক পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বজায় রাখতে পেরেছেন। তাঁর সাহসের প্রশংসা করতেই হবে। প্রথমদিকে লুসিয়া ভেবেছিলেন কী করে ওই অন্যায় অবিচারের প্রতিশোধ নেওয়া যায়। এখন তাঁর মনে অন্য চিন্তা। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এর জন্য ধরা পড়তে হয় তাহলেও পরোয়া নেই। তিনি আত্মবলিদানের জন্য মনকে প্রস্তুত করেছিলেন। তাই নির্ভয়ে নির্ভীক চিত্তে জেলখানায় হেঁটে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এই মুহূর্তে তার মনে অন্যতর চিন্তাধারা, এখন বাঁচতে হবে, হ্যাঁ, পৃথিবীটাকে অন্য চোখে দেখতে হবে। কিন্তু কী করে? জীবনটা আগের মতো দামী হয়ে উঠেছে। না, আগের থেকে আরও বেশি দামী, আমি কখনই ওদের হাতে ধরা পড়ব না, লুসিয়া নিজেকে নিজেই বোঝাবার চেষ্টা করলেন। না, কখনওই নয়।

সালভাডোর এবং তার স্ত্রী সম্ভব মতো চেষ্টা করলেন, লুসিয়াকে ছদ্মবেশে লুকিয়ে রাখতে। তার চুলের রং পালটে দেওয়া হল। দাঁতের ওপর হালকা কালো ছোপ দেওয়া হল। বাজার থেকে মস্ত বড় চশমা কিনে আনা হল। ছেঁড়া ফুটি ফাটা পোশাক পরানো হল তার শরীরে। সালভাডোর এই সুচারু শিল্পকর্মের দিকে ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।

তিনি বললেন, খুব একটা খারাপ নয়, কিন্তু আরেকটু কিছু করতে হবে। তোমাকে এখনই ইতালি থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেব। বিশ্বের যে কোন জায়গায় তুমি চলে যেও, কিন্তু দেখো, তোমার ছবি যেন কোনোদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা না হয়। কয়েক মাস কোনো একটা জায়গায় লুকিয়ে থাকতে হবে। এমন একটা জায়গা যেখানে গোয়েন্দারা কখনও হানা দেবে না।

লুসিয়ার মনে পড়ল তোমার যদি কোনো বন্ধুর দরকার হয়, তুমি ডোমিনিক ডারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমরা ভাইয়ের মতো। সে ফরাসী দেশের সীমান্তের কাছে বেডিয়াসে একটা বাড়িতে থাকে।

–আমি জানি কোথায় আমি যাব, লুসিয়া বলেছিলেন, আমার শুধু একটা পাসপোর্ট দরকার।

আমি তার ব্যবস্থা করছি।

.

চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে, লুসিয়া রোমান নামে একটি পাসপোর্ট, নতুন ছদ্মবেশে লুসিয়ার ছবি সেখানে সাটানো আছে।

-তুমি কোথায় যাবে?

ফরাসী দেশে আমার বাবার একজন বন্ধু আছেন, তিনি আমাকে সাহায্য করবেন।

 সালভাডোর বললেন- তুমি কি চাও আমি তোমাকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেব?

ওঁরা দুজনেই জানেন ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার নয়। যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ার আশঙ্কা। সালভাডোর এক ঘৃণিত অপরাধী।

লুসিয়া তাই বললেন না সালভাডোর, আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। বাকিটুকু আমাকে এবার একলাই করতে হবে। পরের দিন সকালবেলা, সালভাডোর একটি ফিয়াট ভাড়া করলেন লুসিয়া রোমান নামে। লুসিয়ার হাতে চাবি তুলে দিলেন।

তিনি বললেন–সাবধানে যেও কিন্তু। তুমি নিরাপদে বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত আমার মন দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে।

–ভাববেন না, আমি যখন জন্মেছিলাম, আকাশে তখন নতুন একটা তারার জন্ম হয়েছিল। আপনি কি তা জানেন?

হ্যাঁ, বাবা তো আমাকে একথাই বলেছিল। জানি না বাবার কথার কতটা সত্যি।

ইটালি ও ফরাসী সীমান্ত। গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা লাইন পড়ে গেছে। প্রত্যেকটা গাড়িকে ভালোভাবে পরীক্ষা করা হবে। বৈধ কাগজপত্র আছে কিনা দেখা হবে। তবেই সীমান্ত পার হওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হবে। লুসিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন অফিসের দিকে। অত্যন্ত স্নায়ুকাতর হয়ে উঠেছেন তিনি। মনের ভেতর অজানা আতঙ্কের শিহরণ। শেষ পর্যন্ত আমি ধরা পড়ে যাব নাকি? দুদুটো হত্যাকাণ্ড? বিচারে আমার ফাঁসি তো হবেই, তা হলে? তা হলে ওদের মুখে বিধ্বংসী হাসি লেগে থাকবে। না, আমি কখনওই তা হতে দেব না। লুসিয়া জানেন, এই দেশ থেকে বেরোবার সবকটি পথের ওপর পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি আছে। তারপর? না, এমন ঘটনা ঘটলে আমি নিজেকে হত্যা করব। লুসিয়া ভাবলেন। এটাই ছিল তার অন্তিম ভাবনা।

তিনি এগিয়ে গেলেন অফিসারের দিকে।

–পাসপোর্ট ম্যাডাম?

 লুসিয়া তার কালো পাসপোর্টটি গাড়ির জানলা দিয়ে বের করে দেখালেন। অফিসার পাসপোর্টটি হাতে নিলেন। তিনি লুসিয়ার দিকে তাকালেন। অন্তর্ভেদী চাহনি। লুসিয়ার হৃদয় শুকিয়ে গেছে। জল পিপাসা পেয়েছে। তিনি দেখলেন, ওই ভদ্রলোকের চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি। ভদ্রলোক পাসপোর্টের দিকে তাকালেন, আবার লুসিয়ার মুখের দিকে তাকালেন। এবার অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, আপনি লুসিয়া কারমাইন, তাই নয় কি?

.

০৯. লুসিয়া কারমাইন

লুসিয়া চিৎকার করে বলেছিলেন না, সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হয়েছে। তখন– তিনি পালাবার পথের সন্ধান করছিলেন। না কোনো পথ নেই। হঠাৎ মনে হল, এ কি, প্রহরীর মুখে হাসি কেন? তিনি লুসিয়ার দিকে এগিয়ে এলেন। হাতটা নীচু করলেন, ফিসফিস করে বললেন– সিনোরিয়া, আপনার বাবা আমাদের পরিবারকে অনেক করেছেন। আপনি চলে যান, সৌভাগ্য আপনার সঙ্গে থাকুক।

লুসিয়া হতভম্বের মতো বলেছিলেন আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

লুসিয়া একসিলেটরের ওপর উঠে গেলেন। এবার পঁচিশ গজ দূরবর্তী ফরাসী সীমান্ত দেখা যাচ্ছে। ফরাসী অফিসার আবার পরীক্ষার মেজাজে বসে আছেন। এখনও পর্যন্ত কোন সুন্দরী মহিলার সাক্ষাৎ তিনি পাননি। যারা ইতিমধ্যে সীমান্ত পার হয়েছে, তাদের কুৎসিত বলা যেতে পারে। ভদ্রমহিলার মাথায় একরাশ চুল, চোখে কালো চশমা, দাঁতে ছোপ ছোপ দাগ, না, পোশাকটাও মোটেই ভালো নয়।

ইতালীয় মহিলারা কেন ফরাসী দেশের মহিলাদের মতো সুন্দরী নয়। উনি মনে মনে ভাবলেন। উনি লুসিয়ার পাসপোর্টের ওপর স্ট্যাম্প মেরে দিলেন। পথ দেখিয়ে দিলেন।

কয়েক ঘণ্টা পড়ে লুসিয়া বেডিয়াসে এসে অবতরণ করলেন।

***

প্রথমবার শব্দ হতেই ফোনটা কে যেন ধরেছেন। পুরুষ কণ্ঠস্বর– হ্যালো।

ডোমিনিক ডারেল?

 আমি ডোমিনিক ডারেল বলছি, কে কথা বলছেন জানতে পারি কি?

লুসিয়া কারমাইন, আমার বাবা বলেছেন

লুসিয়া, সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বরে উষ্ণতা এবং স্বাগত সম্ভাষণ–আমি তোমার ফোনের জন্যই বসে আছি।

–আমি আপনার সাহায্য চাইছি।

–তুমি আমার ওপর পুরো বিশ্বাস করতে পারো।

লুসিয়ার মনের ভেতর আশার আলো জ্বলে উঠল। অনেক দিন বাদে তিনি একটা ভালো খবর শুনলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এখন তার মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে।

–আমাকে এমন একটা জায়গার সন্ধান দিতে পারেন যেখানে আমি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারব?

–কোনো সমস্যা নেই। আমি এবং আমার বউ দুজনে মিলে একটা পরিকল্পনা ঠিক করেছি। আমরা তোমাকে এমন একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখব, যেখানে পুলিশের বাবাও ঢুকতে পারবে না।

ব্যাপারটা ভাবতে লুসিয়ার ভীষণ ভালো লেগেছিল।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

–তুমি এখন কোথায় আছো লুসিয়া?

 –আমি…।

 তখনই লুসিয়ার মনে হল, একটা খরখরে শব্দ ভেসে আসছে। তা হলে? পুলিশ কি এখানেও আমার ওপর নজর রেখেছে নাকি? নাকি সর্টেড রেডিওর শব্দ।

ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে তিনি কেটে দিলেন।

লুসিয়া?

 মাথার ভেতর অসংখ্য ঘণ্টার ধ্বনি।

লুসিয়া?

তুমি এখন কোথায়? আমি তোমাকে নিতে আসছি।

 উনি কেন বাড়িতে একটা রেডিও রেখেছেন? এটা তো পুলিশের ব্যবহার করা রেডিও।

তার মানে? টেলিফোনটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে উনি ধরেছেন। ব্যাপারগুলো মিলে যাচ্ছে। তার মানে? উনি বোধ হয় আমার ফোনের অপেক্ষায় বসেছিলেন।

লুসিয়া তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?

 লুসিয়া জানেন, জানেন কেন, এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন, ওই ভদ্রলোক আর কেউ নন, উনি হলেন একজন ছদ্মবেশী পুলিশ। তাহলে? এখানে থাকাটা আর উচিত হবে না। এখুনি পুলিশ এখানে আসতে পারে।

লুসিয়া? লুসিয়া রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। অতি দ্রুত টেলিফোন বুথ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

পরক্ষণেই মনে মনে তিনি ভাবলেন, না, এখনই আমাকে ফ্রান্স দেশকে গুডবাই জানিয়ে অন্য কোথাও যেতে হবে।

লুসিয়া তাঁর গাড়িতে এসে বসলেন। গ্লোব কমপার্টমেন্ট থেকে একটি ম্যাপ কিনে আনলেন। কিছু দূরেই ট্রেনের সীমান্ত। তিনি ম্যাপটা যথাস্থানে রেখে দিলেন, গাড়ি চালানো শুরু হল। দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছেন, ফ্রান্স সেবাসতিয়ান তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

স্পেনীয় সীমান্তে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাগুলো আয়ত্তের বাইরে চলে গেল।

***

–অনুগ্রহ করে পাসপোর্ট দেখাবেন?

লুসিয়া স্পেনীয় অফিসারের হাতে তার পাসপোর্ট তুলে দিলেন। তিনি ভালোভাবে পাসপোর্টটা পরীক্ষা করলেন। কিন্তু কেমন একটা অনিশ্চয়তার ভাব ফুটে উঠেছে তার আচরণে। তিনি লুসিয়ার দিকে আবার তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের ভাব পালটে গেল।

এক মুহূর্তের মধ্যে লুসিয়ার মনে হল, উনি বোধহয় আমাকে চিনতে পেরেছেন। এখন কী করা যায়? তিনি দেখতে পেলেন, ভদ্রলোক ছোটো অফিস কিয়সের দিকে এগিয়ে চলেছেন। পাসপোর্টটি তিনি আর একজন অফিসারকে দেখালেন। দুজন উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। এখনই পালাতে হবে, লুসিয়া ভাবলেন। তিনি ড্রাইভারের দিকের দরজা খুললেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন। একদল জার্মান ট্যুরিস্ট মনের আনন্দে হৈ চৈ করছে। এইমাত্র তাদের হাতে কাস্টমসের ছাড়পত্র মিলে গেছে। তারা লুসিয়ার গাড়ির পাশে একটি ভ্যানে গিয়ে উঠবে। সামনে লেখা আছে মাদ্রিদ।

গাইড হাসিমুখে ডাকছেন চলে আসুন, চলে আসুন, এবার যাবার সময় হয়েছে।

 লুসিয়া সেদিকে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

উঠে পড়লেন ওই ভ্যানের মধ্যে। তারপর? সীমান্ত পার হয়ে ভ্যান এগিয়ে চলেছে মাদ্রিদের পথে।

***

জার্মান ট্যুরিস্টরা মনের আনন্দে গান ধরছেন। ধরবেন নাই বা কেন? তাদের কারোর মাথায় তো আর লুসিয়ার মতো বিপদ নেই। পুলিশ তো ওদের কাউকে তাড়া করছে না। ওরা এখন আনন্দে গান তো গাইবেই।

লুসিয়া মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেন। দুটি দৃশ্য ফুটে উঠল তার মনের ক্যানভাসে। ওই হলেন বিচারক, তার সঙ্গে কাটানো সংক্ষিপ্ত প্রহর। উনি বলেছিলেন লুসিয়া, সব বিবাদ ভুলে এসো, আমরা ভালো বন্ধু হই। তারপর? তারপর নীরব মৃত্যুর ছায়া।

এবং বেনিটো পাটাস- এসো, এসো লুসিয়া, পুরোনো দিনের মতো আবার শুরু করা যাক।

আর একটি মৃত্যু।

বাস এগিয়ে চলেছে।

গাইড বলল এবার আমরা কিছুক্ষণের জন্য বিরতি দেব। আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে আসুন। মিনিট পনেরো এখানে থাকব।

লুসিয়া ভাবলেন, মাদ্রিদে পৌঁছোনোর পর ঠিক করব, আমি কোথায় যাব।

***

এটি হল প্রাচীর ঢাকা শহর আভিলা। সবাই নেমে গেছে। লুসিয়া কিন্তু সিটে বসেছিলেন। তিনি যাবেন কোথায়?

গাইড বললেন-ফয়েলিন, আপনি যাবেন না?

লুসিয়া ইতস্তত করছেন। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছুক ভাবে উঠলেন। দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

গাইডের দুচোখে বিস্ময়–ফয়েলিন, আপনি তো এই দলভুক্ত নন।

লুসিয়া হাসলেন উষ্ণতার হাসি না, আমার গাড়িটা ভেঙে গেছে, সান সেবাস তিয়ানে। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি মাদ্রিদে যেতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে…

-না-না, তা হবে না। এটা একটা প্রাইভেট টুর।

লুসিয়া বললেন দেখুন আমি জানি, আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন—

–আপনি মিউনিখে গিয়ে কোম্পানির হেড কোয়াটারের সঙ্গে কথা বলুন।

–এখন কী করে যোগাযোগ করব? বলেছি তো, আমার খুব তাড়া আছে।

না-না, আপনি আমাকে সমস্যায় ফেললেন। এখনই বাস থেকে নেমে যান, না হলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।

লুসিয়া কোনো কথা বলতে পারলেন না। কুড়ি মিনিট কেটে গেল। লুসিয়ার বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে বাস সামনের দিকে এগিয়ে গেল। লুসিয়া সেখানে পড়ে রইলেন, একা, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। কোথায় যাওয়া যায়? স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেলেন। বিরাট বড়ড়া বাড়ি, পাথরের তৈরি প্রাচীর, এক-একটা জানালাতে এক-একটা শহরের নাম লেখা আছে। পাশেই কাফেটেরিয়া। কত কিছু জিনিস বিক্রি হচ্ছে। ধূমায়িত কফি কাপের দিকে তাকিয়ে লুসিয়ার মনে হল, অনেকক্ষণ তার পেটে কিছু পড়েনি। কিন্তু হাতে গোনা মাত্র কটি পয়সা আছে মানিব্যাগের মধ্যে। এখন তিনি কিছু কিনবেন না। বাসের টিকিটের দাম কত তাও দেখতে হবে।

মাদ্রিদ লেখা জানলার দিকে লুসিয়া এগিয়ে গেলেন। ইউনিফর্ম পরা দুজন পুলিশ ছুটো ছুটি করছে। একজনের হাতে একটি ফটোগ্রাফ। এক দরজা থেকে অন্য দরজার দিকে তারা চলেছে।

লুসিয়ার মনে হল, ওরা বোধহয় আমাকেই খুঁজছে। তার মানে? বাস ড্রাইভার সব কথা বলে দিয়েছে?

এসপ্লাটরের ওপর একদল মানুষ হেঁটে চলেছে। একটি পরিবার। লুসিয়া তাদের মধ্যে মিশে গেলেন। তারপর আভিলার রাজপথে এসে দাঁড়ালেন। ধীরে সুস্থে হাঁটছেন যাতে কারোর সন্দেহ না হয়। ক্যালে ডে লা মাদ্রে সোলোভের দিকে গেলেন। গ্রানাইট পাথরে তৈরি বাড়ি। রট আয়রনের ব্যালকনি। পৌঁছে গেলেন প্লাজা ডে লা সানটাতে। পার্কের দিকে তাকালেন। কয়েকজন মহিলা পার্কে বসে আছে। দম্পতিরা গল্প করছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটি দিনের অবসান।

লুসিয়া বসলেন, পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়েছে। দুজন পুলিশ নেমে এল। তারা একলা বসে থাকা একটি মহিলাকে প্রশ্ন করছে।

লুসিয়ার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়েছে।

তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। দূর থেকে আরও দূরে চলে যাবার চেষ্টা করলেন। পরবর্তী রাস্তাটার নাম কী? লুসিয়া অবাক হলেন। এই রাস্তার নাম হল স্ট্রিট অফ লাইফ অ্যান্ড ডেথ। লুসিয়া ভাবলেন, জানি না আমার ভাগ্যে কী লেখা আছে?

হঠাৎ ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল। চার্চ থেকে ভেসে আসছে। তিনি সামনের দিকে তাকালেন। পাহাড়ের ওপর একটা মঠ চোখে পড়ছে কি? লুসিয়ার চোখের তারায় বিস্ময় এবং সামান্য কিছু উদ্বিগ্নতা।

***

তুমি কেন এখানে এসেছ? মাদার বেটিনা জানতে চাইলেন।

আমার কোনো আশ্রয় নেই মাদার।

 –তুমি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় নেবে?

ঠিকই বলেছেন, লুসিয়া বলার চেষ্টা করলেন। ছোটো থেকেই আমার মনে হয়েছে, এই জীবনটা আমি ঈশ্বরকে দান করব।

-কে বলতে পারে, কখন কোন্ নির্দেশ আমাদের কাছে আসে, তাই না কন্যা?

যিশু, সত্যি সত্যি তুমি কি আছে? লুসিয়া ভাবলেন।

মাদার বললেন তোমাকে মনে রাখতে হবে, এখানকার বিধি নিষেধ খুবই কড়া। এখানে প্রবেশ করার পর বাইরের পৃথিবীর দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।

মাদারের মুখ থেকে ছিটকে আসা এই কথাগুলো লুসিয়ার মনে বাজনা বাজিয়ে দিয়েছে।

চার দেওয়ালের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে তুমি কিন্তু আর বাইরে বেরোতে পারবে না। আমার মনে হয়, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। শান্ত মনে সবকিছু চিন্তা করো। কাল না হয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো।

লুসিয়ার মনে হল, সুসময়টা হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। তিনি অধৈর্য হয়ে বললেন– না, মাদার। আমি সব চিন্তা করেছি। আমি এই বন্দী জীবন কাটাতে চাই।

মাদার অবাক হয়ে গেছেন। এই তরুণীর হাবভাবের মধ্যে কেমন একটা চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন মানসিক দিক থেকে সুস্থ নয়।

উনি জানতে চাইলেন- তুমি কি ক্যাথোলিক?

–হ্যাঁ।

উনি একটা পুরোনো আমলের পেন হাতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নাম কী মেয়ে?

-আমার নাম লুসিয়া কার রোমা।

–তোমার মা-বাবা বেঁচে আছেন?

–আমার মা-বাবা

 বেঁচে আছেন।

উনি কী করেন?

–উনি একজন ব্যবসাদার। এখন ব্যবসা থেকে ছুটি নিয়েছেন।

এক মুহূর্তের মধ্যে বাবার বিবর্ণ শুকনো মুখখানি মনে পড়ে গেল।

–তোমার কোনো ভাইবোন আছে?

দুটি ভাই।

–তারা কী করে?

লুসিয়া বললেন –ওরা ধর্মযাজক।

-বাঃ, চমৎকার।

তিন ঘণ্টা ধরে নানা অনুষ্ঠান চলল। সব কিছু শেষ হয়ে গেল। মাদার বেটিনা বললেন রাতে তুমি এইখানে শুয়ে থাকবে? সকালবেলা তোমাকে একদফা নির্দেশ দেব। তারপর, তুমি এখানকার বাসিন্দা হয়ে যাবে। আমি আবার বলছি, এই পথ কিন্তু সহজ নয়, মনে থাকে যেন।

লুসিয়া বলেছিলেন বিশ্বাস করুন, এছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।

***

রাতের বাতাস নরম হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে কাদের ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। লুসিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন একটা সুন্দর ভিলায় একটা পার্টিতে উপস্থিত হয়েছেন। বাবার উজ্জ্বল মুখখানা দেখা যাচ্ছে। ভাইয়েরা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। আহা, এমন সুসময়, সেই ঘরের মধ্যে কে যেন ঢুকে পড়ল। বলল– সমস্ত আলোগুলো নিভিয়ে দাও। শুধু একটি ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল লুসিয়ার মুখের ওপর। লুসিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। এই আলো তাকে অন্ধ করেছে।

জনা ছয়েক মানুষ ঘোরাঘুরি করছে। কারা এরা?

একজন জানতে চাইল আপনারা কে? তার কণ্ঠস্বর কর্কশ।

লুসিয়ার মন সতর্ক হয়ে উঠেছে। তাহলে? শেষ পর্যন্ত আমরা ফাঁদে পড়লাম? কিন্তু যদি এরা পুলিশের লোক হয়ে থাকেন, তাহলে তো এদের জানা উচিত, আমাদের পরিচয়। অন্ধকার অরণ্যে এরা কী করছে?

লুসিয়া একটা সুযোগ নেবার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন- আমরা আভিলা কনভেন্টের সিস্টার। সরকারের তরফ থেকে ওই কনভেন্ট আক্রমণ করা হয়েছে।

ওই ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন আমরা ওই ঘটনাটা শুনেছি।

বাকি দুজন সিস্টারের ঘুম ভেঙে গেছে, তারা উত্তেজনায় ছটফট করছেন। ভয়ের অভিব্যক্তি জেগেছে মুখের তারায়।

মেগান জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা কে? আপনারা কে?

–আমি হলাম জাইমে মিরো।

***

সব শুদ্ধ ওরা ছিলেন সংখ্যায় ছজন। ফুটিফাটা ট্রাউজার্স পরনে, চামড়ার তৈরি জ্যাকেট। ছিঁড়ে গেছে এমন সোয়েটার। ক্যানভাসের তৈরি জুতো। মাথায় আছে তেরচা টুপি। ওঁদের হাতে অস্ত্রচাঁদের নিষ্প্রভ আলোয় ওদের মুখের কঠিন অভিব্যক্তি চোখে পড়ল। দুজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাদের নির্মমভাবে আঘাত করা হয়েছে।

যে ভদ্রলোক নিজেকে জাইমে মিরো বলে পরিচয় দিলেন, তিনি লম্বা এবং শীর্ণ। কালো দুটি চোখে লাল আগুন জ্বলছে।,

–ওরা আমাদের অনুসরণ করতে পারে। এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

লুসিয়া বুঝতে পারলেন। কোনো এক মহিলা উত্তর দিলেন। লুসিয়া দূরের জঙ্গলের দিকে তাকালেন।

রিকার্ডো মেলাডো জানতে চাইলেন, এদের নিয়ে কী করব?

জাইমে মিরো বললেন- ওদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা এখান থেকে এখনই চলে যাব।

একজন বলেছিলেন –জাইমে, এঁরা হলেন যিশুর লিটল সিস্টার।

–যিশু এদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেবেন। আমাদের হাতে অনেক কাজ আছে।

সেবিকারা উঠে দাঁড়িয়েছেন। অপেক্ষা করছেন। জাইমে এখনও কথা বলছেন।

–আপনি তো জানেন আকোকা কী ধরনের মানুষ। এঁদের এভাবে ফেলে যাওয়া উচিত কি?

–একটা কথা মনে রেখো, পুলিশ কিন্তু আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

 –আমরা সাহায্য না করলে সিস্টাররা কিন্তু বাঁচবেন না।

জাইমে মিরো শান্তভাবে জবাব দিলেন না, ওদের জন্য আমরা আমাদের জীবনে বিপদ ডেকে আনব না। নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে হবে।

একজন লেফটেন্যান্ট, ফেলিক্স কারপিও বললেন, আমরা কিছু দূর যদি ওঁদের সঙ্গ দিই? তাহলে কী হবে?

–আপনারা কোথায় যাবেন। থেরেসা কথা বললেন। তিনি বললেন আমি একটা মহৎ উদ্দেশ্যে এসেছি। মেনডাভিয়াতে একটি কনভেন্ট আছে। আমরা সেখানে পৌঁছোতে চাইছি।

ফেলিক্স কারপিও জাইমে মিরোকে বললেন চলুন, এদের মেনডাভিয়া পর্যন্ত নিয়ে যাই। আমরা তো সান সিবাসটিয়ানে যাব, পথেই মেনডাভিয়া পড়বে।

জাইমে মিরো রেগে গেছেন –তুমি বোকার মতো কথা বলো না। তুমি কেন সকলকে বলছ আমি কোথায় যাব।

-না, আমি বলতে চেয়েছিলাম…

হতাশা ঝরে পড়ছে জাইমে মিরোর কণ্ঠস্বরে এখন আর কোনো উপায় নেই। যদি আকোকা এদের ধরে ফেলে, তাহলে এরা কথা বলতে বাধ্য হবে। সুতরাং বিপদ যা হবার তা হয়েই গেছে।

লুসিয়া কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলেন। কী হবে? সোনার তৈরি ক্রশটা হাতের বাইরে চলে গেল তাহলে?

-ঠিক আছে। জাইমে মিরো শেষ পর্যন্ত বললেন চল, যাত্রা শুরু করা যাক। কনভেন্টের কাছাকাছি আমরা পৌঁছে যাই। তারপরেই এই সার্কাসটা শেষ করতে হবে।

তিনি সিস্টারদের দিকে তাকালেন। রাগত কণ্ঠস্বরে বললেন আপনাদের কেউ কি জানেন, মেনডাভিয়া কোন দিকে?

সিস্টাররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

গ্রাসিলা বললেন না, আমি ঠিক জানি না।

–তাহলে? সেখানে গিয়ে আপনারা কী করবেন? যাবেন কী করে?

সিস্টার থেরেসা বললেন ভগবান আমাদের সাহায্য করবেন।

রুবিও আরজিনো নামে আর একজন সহকারী বললেন এখনও ভাগ্যে বিশ্বাস করেন? তিনি জাইমের কাছে এসে বললেন, চলুন, এবার যাত্রা শুরু করি।

জাইমে বললেন আমরা তিনটে বিভিন্ন পথ ধরব।

তিনি একটা ম্যাপ খুলে ধরলেন। ম্যাপের ওপর ফ্ল্যাশ লাইটের আলো পড়ল।

–মেনডাভিয়া কনভেন্ট এখানে অবস্থিত, গ্রোনোর দক্ষিণ পূর্বদিকে। আমি উত্তর দিকে এগিয়ে যাব, ভালো ডোলডের মধ্যে দিয়ে। তারপর বারগোজের পথ ধরব।

তিনি রুবিওর দিকে তাকালেন, লম্বা ওই ভদ্রলোক।

–আপনি অল মেডোর দিকে যাবেন। সেখান থেকে পেনাফিয়েল।

–ঠিক আছে। জাইমে মিরো আবার মানচিত্রের দিকে তাকালেন। এবার রিকার্ডো মেলাডোকে লক্ষ্য করলেন। মেলাডোর মুখে ধূসরতা রিকার্ডো, আপনার গন্তব্য সেভোগিয়া। পার্বত্য পথ ধরে আপনি কারিজোডি আবনৈর দিকে যাবেন। তারপর সোরিয়া। আমাদের দেখা হবে লগ্রোনোতে, কেমন?

এখান থেকে লগ্রোনো ২১০ কি.মি দূরে অবস্থিত। মনে মনে তিনি কী একটা হিসাব করলেন সাতদিন বাদে আমরা সেখানে দেখা করব, কেমন? প্রধান রাস্তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবেন।

ফেলিক্স জানতে চাইলেন লগ্রোনোর কোথায় আমাদের দেখা হবে?

 রিকার্ডো বললেন ফিরলো জাপানে। তাই তো?

হ্যাঁ, এই ব্যবস্থা পাকা রইল।

দাড়িওয়ালা ফেলিক্স কারপিও বললেন– এই সিস্টারদের সঙ্গে কে যাবেন?

ওনাদের নানা ভাগে ভাগ করতে হবে।

লুসিয়া চিন্তা করলেন, এখানেই প্রতিবাদ করা দরকার। আমার মনে হচ্ছে, সিনর আমাদের একা যাওয়াই উচিত। কারণ যদি সৈন্যরা আপনাদের অনুসন্ধান করে, তাহলে বিপদ হতে পারে।

জাইমে বললেন সিস্টার, এখন আর তা হয় না। কারণ আপনারা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন।

রুবিও নামে মানুষটি বললেন –কোনো সুযোগ দেওয়া যায় না। আমরা এই দেশটার সব কিছু জানি। উত্তরের বাসিন্দারা আমাদের বন্ধু। তারা আমাদের লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। আপনারা কখনওই একা-একা মেনডাভিয়াতে পৌঁছোতে পারবেন না।

লুসিয়া কী জবাব দেবেন, বুঝতে পারলেন না।

জাইমে মিরো বলতে থাকেন–ঠিক আছে, এখান থেকে যাত্রা শুরু হোক, ভোর হবার আগে বেশ কিছুটা পথ পার হতে হবে।

সিস্টার মেগান চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যে ভদ্রলোক কথা বলছেন, তার স্বভাব কেমন উদ্ধত। জাইমে মিরো থেরেসার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন- এই দুজন আপনাদের দায়িত্ব নেবেন।

তিনি টমাস সানজুরো এবং রুবিওর দিকে তাকালেন।

সিস্টার থেরেসা বললেন ভগবান আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন।

জাইমে শুকনো কণ্ঠে বললেন ওসব কথা পরে ভাববেন, আগে এখান থেকে বাইরে যাবার চেষ্টা করুন।

রুবিও থেরেসার দিকে এগিয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন সিস্টার, আপনাদের কী বলে ডাকব?

–আমি সিস্টার থেরেসা।

 লুসিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, আমি সিস্টার থেরেসার সঙ্গে যাব।

 লুসিয়া জানেন, সিস্টার থেরেসার হাতেই সোনার ওই ক্ৰশটা আছে।

জাইমে মিরো বললেন- ঠিক আছে। তিনি গ্রাসিলার দিকে তাকালেন রিকার্ডো, আপনি এদের দায়িত্ব নিন।

একজন মহিলা এসে গ্রাসিলার দায়িত্ব নিলেন।

জাইমে মেগানের দিকে তাকালেন সিস্টার আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

মেগান এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখন আর ভাববার সময় নেই। ওই ভদ্রমহিলা এবার এগিয়ে এলেন। তিনি মেগানকে বললেন আমি অ্যামপারা জিরন। মুখ বন্ধ রাখবেন। সিস্টার, মুখ খুললেই কিন্তু সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অন্ধকারের মধ্যে মেগান তাকালেন ওই ভদ্রমহিলার মুখের দিকে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে, একটা লাল ক্ষতচিহ্ন আছে কোথাও, কিন্তু শরীরের ভেতর একটা আবেদন। অন্ধকারের ভেতরেও তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

 যাত্রা শুরু হল। সিস্টার থেরেসা এবং রুরিও আরজনন ইতিমধ্যেই অনেকটা এগিয়ে গেছেন। লুসিয়া দ্রুত তাদের অনুসরণ করতে থাকলেন।

তারপর? নতুন এক অভিযাত্রা।

.

১০.

মিগুয়েল খুবই ভয় পেয়েছিল। কেন? কে তাকে দেখে ফেলেছে? মালিকের স্ত্রী। এক বয়স্কা মহিলা, দেখলেই বোঝা যায় খুবই রাগী স্বভাবের। তিনি চিৎকার করে বললেন

-তুমি কে? ঢুকলে কী করে? এখানে কী করছ?

মিগুয়েল হাসার চেষ্টা করল। হাসি ফুটছে না তার ঠোঁটে। ভয়ের একটা স্রোত।

সে বলল আমাকে এখানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেখতেই তো পাচ্ছেন। আমি কি একবার ফোন করতে পারব? পুলিশকে ডাকতে পারব।

–এখনও তুমি আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দাওনি।

 মিগুয়েল ভালোভাবে বসার চেষ্টা করছিল। সে বলল– ম্যাডাম উত্তরটা খুবই সহজ। আমি. গঞ্জালেস, আমি মাদ্রিদের কাছাকাছি একটা মঠ থেকে এখানে এসেছি। আমি আপনার সুন্দর দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দুজন অল্পবয়সী ছোকরা দোকানটা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছিল। আমি ভেবেছিলাম, তাদের বাধা দেওয়া উচিত। বাধা দিতে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। তারা আমাকে কাবু করে ফেলে। হাত-পা বেঁধে এইভাবে রেখে পালিয়ে যায়। এখন যদি আপনি একটু সাহায্য করেন।

ভদ্রমহিলা এই কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছেন, কি?

তারপর তিনি বললেন- তুমি পৃথিবীর সব থেকে বড়ো মিথ্যেবাদী দেখছি। এগুলো কী?

উনি এগিয়ে গেলেন, সিস্টারদের আলখাল্লা নিয়ে ফিরে এলেন। জানতে চাইলেন– এগুলো কী?

–যে দুটি ছেলে এখানে ঢুকেছিল, তারা ছদ্মবেশ ধারণের জন্য এই পোশাক পরেছিল।

চারটে আলখাল্লা পড়ে আছে। তুমি বলছ দুজন এসেছে।

–পরে দুজন, আবার যোগ দেয়।

ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে

এগিয়ে গেলেন ফোন করবেন বলে।

–আপনি কী করছেন? –পুলিশকে ডাকব।

–তার কোন দরকার নেই। আপনি আমার বাঁধন খুলে দিন। আমি নিজেই পুলিশ স্টেশনে যাব, সেখানে গিয়ে পুরো ঘটনা বলব।

ভদ্রমহিলা তাকালেন। বললেন- ফ্রায়ার। বাঁধন খুলে দেওয়া হল।

***

কারিলোকে প্রশ্ন করা হচ্ছে এসব ব্যাপার খুলে বলল। বুঝতেই তো পারছ, তোমার সামনে এখন বিপদ অপেক্ষা করছে।

কারিলো আমতা আমতা করতে থাকে। ভয়ংকর মুখের এক ভদ্রলোক সেখানে এসে প্রবেশ করলেন।

–শুভ সন্ধ্যা কর্নেল আকোকা।

এই কি সেই লোকটি?

-হ্যাঁ, কর্নেল। সিস্টারদের আলখাল্লা পাওয়া গেছে। লোকটিকেও আমরা দোকানের মধ্যে পেয়েছি। আপনি কি নিজে প্রশ্ন করবেন?

কর্নেল র‍্যামন আকোকা কারিলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন হ্যাঁ, আমি নিজেই প্রশ্ন করব।

মিগুয়েল হাসি দিয়ে অভিবাদন জানাবার চেষ্টা করেছিল। সে বলল কর্নেল, আপনাকে দেখে ভালো লাগল। আমি চার্চের কাজে বাইরে এসেছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে বার্সিলোনাতে পৌঁছোতে হবে। সব কথা এদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি। ঘটনার আবর্তে আমাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

কর্নেল আকোকা হাসি মুখে বললেন ঠিক আছে, আপনার তাড়া আছে। তাই তো? আমি বেশি সময় নষ্ট করব না।

মিগুয়েল জবাব দিল –আপনাকে ধন্যবাদ কর্নেল।

–আপনাকে কয়েকটা অতি সাধারণ প্রশ্ন করব, যদি উত্তর শুনে আমি সন্তুষ্ট হই, তাহলে আপনাকে এখনই ছেড়ে দেব। আর যদি আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করেন বা মিথ্যে কথা বলেন, তাহলে ফল কিন্তু ভালো হবে না।

তিনি হাতে কিছু একটা নিলেন। মিগুয়েল আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলতে গেল ঈশ্বরের সেবকরা কখনও মিথ্যে বলে না।

ঠিক আছে, এই শব্দগুলো আবার আপনার মুখ থেকে শুনব। ওই চারজন সিস্টার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলুন তো।

আমি কিছু জানি না, কর্নেল।

একটা ঘুষি, সজোরে এসেছে বা চোয়ালের ওপর। রক্ত ছিটকে এসেছে। এতক্ষণ বাদে কারিলো বুঝতে পেরেছে, হাতে যে আংটি আছে, সেখানে চকচকে একটি তীক্ষ্ণ ধার আছে।

কারিলো থতমত খেয়ে গেল হায় ঈশ্বর, আপনি কী করছেন?

কর্নেল আকোকা আবার জানতে চাইলেন ওই চারজন সম্পর্কে গুছিয়ে বলুন।

–আমি জানি না।

আবার মুখের ওপর একটা ঘুষি, দাঁত ভেঙে গেছে।

মিগুয়েল রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে সে। আকোকার কণ্ঠস্বর হঠাৎ নরম হয়ে উঠেছে। আর একটা ঘুষি। শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য হল কারিলো।

সে গড়গড় করে বলে গেল ওরা কনভেন্ট থেকে পালাচ্ছিল। আমাকে আর আঘাত করবেন না?

বলতে থাকুন, বলতে থাকুন।

আমি ওদের সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। ওরা পোশাক পালটেছিল।

–তাই আপনি কাঁচের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েন, তাই তো?

-হ্যাঁ, আমি কয়েকটা পোশাক চুরি করেছিলাম। তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আমাকে একা রেখে চলে যায়।

–ওরা কোনদিকে যাচ্ছে, কিছু বলেছিল?

কারিলো বলল না। সে মেলডাভিয়ার নাম করেনি। কারিলো জানে, একথা বলে কোনো লাভ নেই। ইতিমধ্যে কর্নেল ঘুষি মেরে তার মুখটা ভেঙে দিয়েছেন। এখন আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কী হবে?

***

লুসিয়া, সিস্টার থেরেসা, রুবিও আরজিনো এবং টমাস সানজুরো উত্তর-পূর্বদিকে হাঁটছিলেন। অলমেডা তাদের লক্ষ্য। প্রধান রাস্তা এড়িয়ে তারা চলছিলেন। ঘাসের বুকে পা রেখে রেখে। আহা, প্রকৃতি এখানে নির্ভার। কত সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।

রুবিও আরজিনো বললেন আমরা অলমেডার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। রাত হওয়া অব্দি এখানে অপেক্ষা করব। দেখা যাক ঘুমোনোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

সিস্টার থেরেসা শারীরিকভাবে আর পারছেন না। কিন্তু তার মাথা এখনও কাজ করছে। এখনও তিনি ওই মূল্যবান বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।

কোথায় যাব? কিছুই জানি না। শেষ অব্দি পথ পরিষ্কার হবে তো?