৫. অধিবেশনে ব্যস্ত

২৪.

পরের দিন সকালবেলা, আটটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ম্যারি একটা অধিবেশনে ব্যস্ত আছেন। ডরোথি স্টোন দরজা খুললেন। বললেন- আপনার ছেলেমেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে।

ম্যারি লাফিয়ে উঠলেন– হায় ঈশ্বর! একী বলছেন?

–লিমুজিন অ্যালার্ম শোনা গেছে। চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে।

ম্যারি ছুটতে ছুটতে করিডর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সকলেই তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল ম্যাককিনিকে দেখা গেল, মাইক্রোফোনে কথা বলছেন।

উনি বললেন আমি অ্যাম্বাসাডরকে জানিয়ে দিয়েছি।

কী হয়েছে? আমার ছেলেমেয়ে কোথায়?

কর্নেল বললেন– তারা ভালোই আছে, ম্যাডাম। একজন অসাবধান বশত এমার্জেন্সি সুইচে হাত দিয়েছিল। আলো জ্বলে উঠেছিল। এস ও এস ঘোষণা করতে শুরু করে, দুঃসংবাদ। ড্রাইভার দুটো ব্লক এগিয়ে যায়। চারটে পুলিশ কার সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণ করতে শুরু করে। সাইরেন বেজে যায়।

ম্যারির মনে হল, হায়, তাহলে এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। ম্যারি বুঝতে পারলেন, ছেলেমেয়েকে তিনি কতখানি ভালোবাসেন।

.

সেই সন্ধ্যায় ম্যারি ছেলেমেয়ের সঙ্গে অনেকদিন পর সময় কাটিয়েছিলেন। এখন থেকে আরও বেশি সময় ওদেরকে দিতেই হবে, এমন একটা শপথ নিলেন তিনি।

তাদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন- সত্যি, এদের কোনো বিপদ আছে। কী? কে বা কারা আমার ক্ষতি করতে চাইছে? এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর তিনি পেলেন না।

.

তিনদিন কেটে গেছে, ম্যারি আরও একবার ডাঃ লুইস ভেসফরগেসের সাথে ডিনার সেরেছেন। এখন সম্পর্ক অনেক সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

কত সুন্দরভাবে তারা পরস্পরকে ছোট্ট নামে ডাকছেন।

তাঁরা রেসিডেন্সে পৌঁছে গেলেন। ম্যারি জানতে চাইলেন- আপনি কি ভেতরে আসবেন?

ভদ্রলোক ভেতরে এলেন। ম্যারি ছেলেমেয়েদের সাথে লুইসের পরিচয় করালেন।

লুইস বেথকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, আমার একটি মেয়ে আছে, তোমার থেকে তিন বছরের মতো ছোটো। আর একটি তোমার মতো। মনে হচ্ছে, তোমরা সকলে একই সঙ্গে সুন্দরী হয়ে উঠবে।

বেথ হেসে বলল- তারা কোথায়?

 ম্যারি বললেন- তোমরা কি হটস চকোলেট খাবে?

ছেলেমেয়েরা লুইসের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছে। ম্যারি অবাক চোখে তাকালেন, এই ভদ্রলোককে বিশ্বাস করা যায়। এক মুহূর্তের মধ্যে পরিবারের বাতাবরণটাকে পালটে দিয়েছেন।

মাঝরাত হয়ে গেছে। ম্যারি ঘড়ির দিকে তাকালেন এবার তোমাদের শুতে যেতে হবে। যাও, সকালে স্কুল আছে।

টিম লুইসের কাছে গিয়ে বলল- কাকু, তুমি আবার আসবে তো?

-হ্যাঁ, তোমার মা ডাকলেই আমি আসব।

টিম ম্যারির দিকে তাকিয়ে বলল- মম, তুমি কবে আবার কাকুকে ডাকবে?

ম্যারি হাসলেন। বললেন– শিগগিরি।

.

ম্যারি লুইসকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। হাতে হাত দিলেন।

–এই সন্ধ্যাটা ভালোই কাটল, ভাষায় বলতে পারব না।

আমিও খুব খুশি হয়েছি।

শুভরাত মারি।

.

সকাল হয়েছে, ম্যারি হেঁটে অফিসে গেলেন। দেখলেন, দেওয়াল রং করে দেওয়া হয়েছে। মাইক শ্লেট দু কাপ কফি নিয়ে বসে আছেন।

শুভ সকাল।

আবার কেউ কি দেওয়ালের ওপর লিখেছিল?

 কী লিখেছিল।

–বলতেই হবে। লেখা ছিল, এখনই চলে যাও, নয়তো মরতে হবে।

 ম্যারি চেয়ারে বসে পড়লেন– আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে এই লেখাগুলো সম্ভব হচ্ছে?

মাইক জবাব দিলেন– মনে হয় কোনো দল এই ষড়যন্ত্রটা করছে।

–কী করে? মেরিনগার্ড সব সময় পাহারা দেয়। সারারাত তাদের পাহারা চলে। অথচ, আততায়ী আসছে কী করে?

-ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। কর্নেল ম্যাককিনিকে সব বলা হয়েছে।

–হ্যাঁ, ওঁনার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

 মাইক শ্লেট অফিস থেকে চলে গেলেন। হঠাৎ ম্যারির মনে হল, মাইকই বোধহয় এই ষড়যন্ত্রের মূলে।

কিন্তু মাইককে অবিশ্বাস করে লাভ কী?

.

কর্নেল ম্যাককিনি বললেন– আমায় বিশ্বাস করুন ম্যাডাম। আমি ঘটনাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেছি। প্রহরীর সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। সারারাত সশস্ত্র পাহারা থাকে।

ম্যারি বুঝতে পারলেন, ভেতরের কেউ এই কাজটা করেছে। কিন্তু কে? বিদ্যুৎ চমকের মতো ম্যারির মনে হল কর্ণেল ম্যাককিনিকেও আমরা ভেতরের লোক বলতে পারি, তাই না?

.

 ম্যারি লুইসকে একটা ছোট্ট ডিনার পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, নিজের রেসিডেন্সে। আরও জনাদশেক অতিথিকে বলা হয়েছে। সকলে চলে গেছেন।

লুইস বললেন- আমি কি একবার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলব?

-ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

–আমি ওদের ঘুম ভাঙাব না। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকব।

ম্যারি লুইসকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে চলে গেলেন। লুইস ঘুমন্ত টিমের মুখের দিকে তাকালেন।

একটু বাদে ম্যারি বললেন– বেথের ঘর এই পাশে।

আর একটা বেডরুম, দরজা খোলা হল। বেথ ঘুমিয়ে আছে। বেডকভারটা কুঁকড়ে গেছে। লুইস একটু একটু করে সামনে এগিয়ে গেলেন। বেডকভারটা ঠিক করে দিলেন। অনেকক্ষণ ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

লুইস বললেন- আহা, ভারি সুন্দর ছেলেমেয়ে দুটি!

তারা সামনে দাঁড়ালেন। একে অন্যের দিকে তাকালেন। বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু কী ঘটতে চলেছে?

তারপর, দুটি শরীর, একে অন্যকে তীব্রভাবে আলিঙ্গন করছে। উন্মুখ দুটি ঠোঁট কাছাকাছি চলে এসেছে।

ডাক্তার বললেন আমি এখানে আর আসব না। না, এভাবে আপনাকে আর জ্বালাতন করব না। আমি জানি না, ভবিষ্যতে কী লেখা আছে।

ম্যারি নিরাসক্তভাবে জবাব দিলেন- আমি জানি লুইস, ভবিষ্যতে কী লেখা আছে।

.

ডেভিড ভিক্টর ম্যারি অফিসে ছুটে এলেন।

খুব খারাপ খবর আছে। প্রেসিডেন্ট আর্জেন্টিনার সঙ্গে একটা চুক্তিপত্রে সই করেছেন। আর্জেন্টিনার সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাজিলের সঙ্গেও সই করা হয়েছে। আমরা এই দুটি চুক্তির ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করেছিলাম।

কীভাবে কথাবার্তা হল?

ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনে টেলেক্স পাঠাতে হবে। আপনার অনুমতি চাই।

–আমি ব্যাপারটা আর একবার ভাবব।

 –প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু কখনও মত পরিবর্তন করবেন না।

–এত সহজে আমি হাল ছাড়ব না।

তারপর ফোনে ডরোথিকে ডাকলেন– ডরোথি, প্রেসিডেন্ট আওনেস্কুর সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

.

আলেকজানড্রোস ম্যারিকে প্যালেসে নিমন্ত্রণ করলেন। লাঞ্চের আসরে।

 ম্যারি ঢুকলেন। প্রেসিডেন্টের চোদ্দো বছরের ছেলে নিকু তাকে অভিনন্দন জানাল।

শুভ সন্ধ্যা, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। আমি নিকু। তোমাকে প্যালেসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

–ধন্যবাদ।

ছেলেটি ভারি ভালো। বয়সের তুলনায় লম্বা, কালো দুটি চোখ, চোখের তারায় দুষ্টুমির ঝিলিক। দেখে মনে হয়, সে বুঝি বড়ো হয়ে গেছে।

–বাবাকে বলছি তুমি এসেছ, কেমন?

ম্যারি এবং আওনেস্কু সামনা সামনি বসেছেন, ডাইনিং রুমে। তারা মাত্র দুজন। ম্যারি ভাবছিলেন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী কোথায়? তাকে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না কেন?

প্রেসিডেন্ট ধীরে ধীরে পান করছেন। তার মনটা বিশেষ ভালো নেই। তিনি সিগারেট ধরালেন।

–ছেলেমেয়েদের নিয়ে এদিক-সেদিক বেড়াতে গেছেন?

রোমানিয়া একটা সাংঘাতিক সুন্দর দেশ। আমরা অনেক কিছু দেখেছি। ভদ্রলোকের মুখে আমন্ত্রণী হাসি আরও অনেক কিছু দেখাব। আমি সঙ্গে যাব। আমি জানি, রোমানিয়ার কোন্ কোন্ জিনিস আপনার ভালো লাগবে?

ম্যারি বললেন মিঃ প্রেসিডেন্ট, আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনা করতে চাইছি।

আওনেস্কু জানেন, কীজন্য ম্যারি এসেছেন। আমেরিকানরা এখানে ভালোেব্যবসা করতে চাইছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে এবার খালি হাতে ফিরতে হবে। খুব খারাপ, আহা, এমন সুন্দরী মহিলা।

–আমি দুই শহরের কথা বলতে চাইছি।

আওনেস্কু জানতে চাইলেন- কী বলতে চাইছেন?

দুই যমজ কন্যা, সানফ্রান্সিসকো আর ওসাকা, লস এঞ্জেলস আর এথেন্স, ওয়াশিংটন আর বেজিং।

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

মিঃ প্রেসিডেন্ট, বুখারেস্টকে আমরা কি আমেরিকার কোনো শহরের যমজ শহর করতে পারি না। ভেবে দেখুন তো, তাহলে সারা পৃথিবীর মানুষের চোখ পড়বে এই শহরের ওপর। এমনকি আমাদের প্রেসিডেন্ট এলিসনও খুশি হবেন। ব্যাপারটা খুবই ভালো হবে। তা-ই নয় কি? একবার ভেবে দেখবেন? এর জন্য হয়তো আপনাকে নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হতে পারে।

আওনেস্কু বসে আছেন। ভাবতেই পারছেন না। এই প্রস্তাবটা কার্যকরী হলে কী হবে?

তিনি বললেন– ভালোই বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শহরের অংশীদার। প্রস্তাবটা খুবই ভালো।

–এতে আপনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাবেন। আপনাকে সবাই জাতীয় বীরের সম্মান দেবে। কানসাস সিটি থেকে একদল আসবেন এই শহর ভ্রমণ করতে।

কানসাস সিটি কেন?

–নিউইয়র্ক অথবা শিকাগো শহরের কথা সবাই জানে। সেখানকার বাণিজ্যিক পরিবেশ আছে। লস এঞ্জেলসের কথা তো আগেই বলেছি। কানসাস সিটি মধ্য আমেরিকায় অবস্থিত। এখানে কৃষকদের সংখ্যা বেশি। এখানকার মানুষ আপনার শহরে আসবে। সাংস্কৃতিক বিনিময় হবে। মিঃ প্রেসিডেন্ট, সকলের মুখে মুখে আপনার নাম ঘুরবে।

 প্রেসিডেন্ট বললেন- আপনার ধারণার মধ্যে সত্যি নতুনত্বের ছোঁয়া আছে। কানসাস সিটি-বুখারেস্ট, আহা, ভারি ভালো একটা সমঝোতা।

-বুখারেস্টকে আমরা বড়দি বলব।

বাঃ, প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে হবে।

আওনেস্কু প্রস্তাবটা ভাবতে থাকলেন। সকলের মুখে মুখে আমার নাম ছড়িয়ে পড়বে! সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাকে সমঝে চলতে বাধ্য হবে!

কিন্তু আমেরিকা যদি ব্যাপারটা নাকচ করে দেয়?

কখনও করবে না। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি।

 কবে থেকে এটা কার্যকরী হবে?

–যখন ঘোষণা হবে তখন থেকে। আপনি এক মহান রাষ্ট্রনেতা, মিঃ প্রেসিডেন্ট, এই ব্যাপারটা বাস্তবায়িত হলে আপনার সম্মান আরও বেড়ে যাবে।

আওনেস্তু অন্য কথা ভাবছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, আমরা দুই যমজ শহরের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে তুলব। বলুন তো, কানসাসে কী কী জিনিস পাওয়া যায়?

–অনান্য জিনিসের সাথে পাওয়া যায় দানাশস্য আর সয়াবিন।

.

ডেভিড ভিক্টর জানতে চাইলেন কী করে এটা সম্ভব হল? কী করে ভদ্রলোককে বোকা বানালেন?

ম্যারি বললেন– না, আওনেস্তু অত্যন্ত চালাক মানুষ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমি কোন্ প্রস্তাব করতে চলেছি। আওনেস্কু এখনই টেলিভিশনে ভাষণ দিচ্ছেন। আপনি কি একবার শুনবেন?

.

স্টানটন আনন্দে ম্যারিকে ফোন করলেন- আপনি তো আলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কী করে করলেন? আমরা ভেবেছিলাম, এবার হেরে যাব।

ম্যারি বললেন– ভদ্রলোকের ইগোতে আঘাত করে।

–প্রেসিডেন্ট জানতে চেয়েছেন, এর অন্তরালে কোন্ রহস্য কাজ করছে?

–স্টান প্রেসিডেন্টকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

–প্রেসিডেন্ট আর আমি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চিন ভ্রমণে যাব। যদি আমাকে দরকার হয়, তাহলে ফোন করতে ভুলবেন না কিন্তু।

আহা, ভ্রমণটা ভালো হোক। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা।

.

সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে। দেখতে দেখতে নৃত্যরত মার্চ মাস কেটে গেল। এবার সমস্ত দেশে বসন্ত এসেছে। এখন আর গরম জামাকাপড়ে শরীর আচ্ছাদিত করতে হবে না। এখন ফিনফিনে পোশাক পরলেই চলবে। গাছে গাছে ফুল ধরেছে। পার্কগুলো চমৎকার দেখাচ্ছে। জুন মাস এসে গেল।

.

বুয়েন্স আয়ার্সে এখন শীতকাল, নেউসা মুজে তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলেন। তখন মধ্যরাত। টেলিফোন চিৎকার করছে। তিনি ফোন ধরে বললেন– কী?

মিস মুনেজ, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কথা বলছি।

–ইয়া।

আমি কি অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে কথা বলব?

অ্যাঞ্জেল এখানে থাকেন না সিনর, আপনি কে?

 কনট্রোলার বললেন- আঃ, এই জাতীয় মেয়ের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে, ভাবতে গেলেই গা-টা ঘিনঘিন করে। হ্যারি লানজের কথা মনে পড়ে গেল।

কনট্রোলার বললেন- অ্যাঞ্জেলকে একটা খবর দেবেন?

–এক মিনিট।

–ফোনটা কেউ ফেলে দিল। শব্দ পাওয়া গেল।

আবার কণ্ঠস্বর- ওকে।

–অ্যাঞ্জেলকে বলুন, বুখারেস্টে একটা কাজ করতে হবে।

–বানডাতে।

–যেসাস! আঃ, এর সাথে কথা বলা মুশকিল।

-বুখারেস্ট, রোমানিয়া। পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের একটা কাজ আছে। এই মাসের শেষের দিকে ওঁনাকে বুখারেস্টে আসতে হবে। একুশ দিন সময় আছে। আপনি কি তা শুনতে পাচ্ছেন?

–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন। আমি সব লিখে নিচ্ছি।

কনট্রোলার সাবধানে অপেক্ষা করলেন।

–ঠিক আছে, পঞ্চাশ লক্ষ ডলারে কটা মাথা কাটতে হবে?

–অনেকগুলো…

.

এমব্যাসির সামনে লম্বা ভিড় ম্যারির মোটেই ভালো লাগে না। মাইক শ্লেটের সঙ্গে তিনি আলোচনা করলেন।

–এই মানুষগুলো মার্কিন দেশে যেতে চাইছেন, আমাদের উচিত সাহায্য করা।

 –আওনেস্তুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

–দেখুন কিছু করা যায় কিনা।

.

ম্যারি ডরোথি স্টোনকে বললেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটা অ্যাপায়মেন্টের ব্যবস্থা করুন।

কিছুক্ষণ কেটে গেল। ম্যারির অফিসে সেক্রেটারি পৌঁছে বললেন– ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, এখন আর দেখা করা যাবে না।

ম্যারি অবাক হয়েছেন কেন?

–আওনেস্কু কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। কেউ তার প্রাসাদের কাছাকাছি আসতে পারছে না।

ম্যারি বসে রইলেন। তার মানে? একটা মস্ত বড়ো ঘোষণা করা হবে? সামরিক অভ্যুত্থান? কিছু একটা ঘটতে চলেছে কী?

তিনি বললেন– ডরোথি আরও একবার চেষ্টা করুন তো।

তার মানে? অন্য কোনো উপায়ে?

–ভাবতে চেষ্টা করুন, সত্যি সত্যি ওখানে কোনো ঘটনা ঘটছে কিনা।

.

এক ঘণ্টা কেটে গেছে। ডরোথি রিপোর্ট দিলেন কিছু একটা ঘটবে।

তার মানে?

–আওনেস্কুর ছেলে মৃত্যুশয্যায়।

–নিকুর কী হয়েছে?

 –তাকে বিষ দিয়ে মারা হচ্ছে।

ম্যারি শান্ত হয়ে জানতে চাইলেন তার মানে? এখনাকার কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি?

–না, ম্যাডাম। আপনি কি শুনেছেন পূর্ব জার্মানিতে একটা মারাত্মক ব্যাধি দেখা দিয়েছিল। নিকু সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল। কেউ তাকে টিনে ভর্তি খাবার দেয় উপহার হিসেবে। গতকাল সেই খাবারটা নিকু খেয়েছিল।

–অ্যান্টিসিরাম পাওয়া যায় না?

–ইউরোপীয় দেশে ওই সিরাম পাওয়া যায় না।

–তাহলে কী হবে?

ডরোথি অফিস থেকে চলে এলেন, ম্যারি অনেকক্ষণ চেয়ারে বসেছিলেন। হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। আহা, নিকুর মুখখানা মনে পড়ল। মাত্র চোদ্দো বছর বয়স, বেথের থেকে এক বছরের বড়ো।

তিনি ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন। বললেন, ডরোথি, এখনই জর্জিয়াতে ফোন লাগান তো। ডিজিজ কনট্রোলের সাথে কথা বলতে হবে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে লাইন পাওয়া গেল।

-ইয়েস ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আমাদের এখানে অ্যান্টিসিরাম আছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা ব্যবহারের দরকার পড়ে না।

ম্যারি বললেন– আমি মার্কিন দেশে নেই। আমি বুখারেস্টে আছি। সিরামটা এখনই চাই।

কিছুক্ষণের নীরবতা পাঠাতে হবে। কিন্তু ওখানে পৌঁছোবার আগেই বোধহয় আর প্রয়োজন হবে না।

–আমি চেষ্টা করছি, সিরামটা তৈরি রাখুন।

.

দশ মিনিট কেটে গেছে, ম্যারি কথা বললেন এয়ারফোর্স জেনারেলের সঙ্গে, ওয়াশিংটনে।

–গুড মর্নিং ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, ব্যাপারটা খুবই অবাক লাগছে। আমি এবং আমার স্ত্রী, আমরা দুজনেই আপনার ফ্যান।

জেনারেল, আমার একটা কাজ করে দেবেন?

কী কাজ বলুন।

–কোন্ বিমানটা খুব তাড়াতাড়ি রোমানিয়াতে পৌঁছোতে পারে?

–কী বলছেন?

 –আমি চাইছি বুখারেস্টে একটা ওষুধ আনতে।

–দেখছি কী করা যায়।

–কত তাড়াতাড়ি খবর পাব?

–এখনই ডিফেন্স সেক্রেটারির অনুমতি পেতে হবে। আরও কিছু কাজ আছে। সেগুলো করতে সময় লাগবে।

–জেনারেল খুব তাড়াতাড়ি করুন। না হলে কিন্তু আর কাজে লাগবে না। একটি ছেলের জীবন শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। সেই ছেলেটি হল রোমানিয়ার প্রেসিডেন্টের সন্তান।

বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি সই করব কী করে?

–জেনারেল, যদি ছেলেটি মারা যায়, তাহলে আমি প্রেস কনফারেন্স ডাকব, আমি বলব, আপনার জন্য ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।

-হোয়াইট হাউসের অনুমতি ছাড়া আমি এটা করতে পারি না।

ম্যারি বললেন- ঠিক আছে সিরামটাকে নিয়ে আটলান্টা এয়ারপোর্টে চলে আসুন। প্রত্যেকটা মুহূর্তের দাম আছে।

ফোনটা রেখে দিলেন ম্যারি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন।

.

জেনারেল জুকরের সহকারি বললেন– এটা কী স্যার?

জেনারেল জুকর বললেন- এস আর-৭১ কে তৈরি রাখতে হবে। সিরাম পাঠাতে হবে রোমানিয়াতে।

–কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

–এক্ষুনি স্টানটন রজার্সের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে জেনারেল প্রেসিডেন্টের বৈদেশিক উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বললেন।

–ওই ব্যাপারটা এখনই করতে হবে স্যার। করা না হলে ক্ষতি হয়ে যাবে।

 স্টানটন রজার্স বললেন- জেনারেল, এস আর-৭১ কতক্ষণের মধ্যে হাতে আসবে?

দশ মিনিটের মধ্যে স্যার।

তাহলে আর দেরি করবেন না।

.

নিকুর স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে বিছানাতে শুয়ে আছে। তার মুখচোখ বিবর্ণ, তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বসে আছেন। সংখ্যায় তিনজন।

প্রেসিডেন্ট আওনেষ্টু ছেলের বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছেন- কী হচ্ছে?—

আমরা ইউরোপের সমস্ত দেশের সাথে কথা বলেছি। কোথাও অ্যান্টিসিরাম নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলা যায় না?

একজন ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–ওখান থেকে সিরাম আনতে অনেক দেরি হবে।

 আওনেস্কু আবার ছেলের কাছে এগিয়ে গেলেন। মাথায় হাত রাখলেন, ঘাম হচ্ছে।

না, চোখের সামনে ছেলে মারা যাবে। আওনেস্কু কেঁদে ফেলেছেন- আমি কিছুই করতে পারব না?

.

আটলান্টার ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট। এয়ারফোর্স লিমুজিন দাঁড়িয়ে ছিল। অ্যান্টিসিরাম আছে বাক্সের মধ্যে, বরফ দিয়ে আচ্ছাদিত। তিন মিনিট, এবার উড়ান পাখি উড়তে শুরু করেছে। এস আর-৭১, এয়ারফোর্সের সবথেকে দ্রুতগামী সুপারসোনিক জেট। শব্দের গতিবেগের চেয়ে তিনগুণ দ্রুত উড়তে পারে। আটলান্টিকের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। চার হাজার মাইল, দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোতে হবে।

জেনারেল ম্যাককিনি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েছিলেন। অতি দ্রুত গাড়ি এগিয়ে চলল প্রেসিডেন্টের প্যালেসের দিকে।

.

ম্যারি সারারাত তার অফিসে বসেছিলেন। প্রতি মুহূর্তে রিপোর্ট নিচ্ছিলেন। শেষ রিপোর্ট এল ভোর ছটার সময়।

কর্নেল ম্যাককিনি বললেন– ছেলেটিকে সিরাম দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলছেন, ছেলেটি বেঁচে গেল।

–হ্যায় ঈশ্বর, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

.

দুদিন কেটে গেছে, ম্যারির অফিসে একটা হীরের নেকলেস পাঠানো হল। লেখা হল– আপনার এই ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। আলেকজানড্রোস আওনেস্কু।

হায় ঈশ্বর, ডরোথি এই নেকলেসটা দেখে অবাক হয়ে গেলেন, ডরোথি বললেন– অন্তত পাঁচ লক্ষ ডলার।

মারি বললেন– অবশ্যই, কিন্তু এখুনি এটা ফেরত পাঠাতে হবে।

.

পরদিন সকালবেলা। প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু ম্যারিকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

 ম্যারি প্রাসাদে গিয়ে বললেন– আমি একবার নিকুর সঙ্গে দেখা কবর।

 নিকু বিছানাতে শুয়ে আছে, বই পড়ছে। ম্যারির দিকে সে তাকাল, গুড মর্নিং ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

–গুড মর্নিং নিকু।

–বাবার মুখে শুনেছি তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।

–না, তুমি চোখের সামনে মারা যাবে আর আমি তা দেখব কী করে? তোমার বয়সি একটা মেয়ে আছে আমার। তার নাম বেথ।

বেথকে একদিন নিয়ে আসবে? তার সঙ্গে গল্প করব।

.

প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু ম্যারির জন্য একতলায় অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বললেন– আপনি আমার উপহার ফেরত পাঠিয়েছেন কেন?

–আপনার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছি। এটাকে আমি বাণিজ্য বলে গ্রহণ করতে চাইছি না।

–আপনি আমার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আপনাকে কিছু একটা তো আমি দেব।

–কিছু দেবার নেই, ও আমার ছেলের মতো।

আওনেস্কু টেবিলে ঘুষি মেরে বললেন আমি আপনার কাছে কেন ঋণী থাকব? কী দিতে হবে বলুন?

ইয়োর এক্সিলেন্সি, আমি কিছু চাইব না। আমার দুটো ছেলেমেয়ে আছে। বুঝতেই পারছেন তো, আপনার ছেলের অসুখের কথা শুনে আমার মনের অবস্থা কী হয়েছিল।

ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে বললেন– নিকু আমার একমাত্র সন্তান। ওর কিছু হলে…

তিনি আর চোখ খুলতে পারলেন না।

–আমি ওপরে গিয়েছি। ছেলেটি ভালোই আছে। ইয়োর এক্সিলেন্সি, এমব্যাসিতে ফিরতে হবে।

অপেক্ষা করুন। আপনি কোনো কিছু নেবেন না তো?

–না, আমি আগেই বলেছি।

–বেশ। ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি অন্য কিছু চাইছেন কী?

না, কিছুই না।

–কিছু একটা আপনাকে নিতেই হবে। বলুন, কী আপনার ইচ্ছে?

ম্যারি উঠে দাঁড়ালেন, ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালেন। শেষ পর্যন্ত বললেন– আমি চাইছি, রোমানিয়া থেকে ইহুদিদের বাইরে বেরোনোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে তা যেন অবিলম্বে বাতিল করা হয়।

আওনেস্কু চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ কথাগুলো ভাবলেন। ডেস্কের ওপর হাত রাখলেন। তারপর বললেন– ঠিক আছে, এই কাজটা করা হবে। আমি ব্যাপারটাকে আরও সহজ করে দেব।

.

সবাইকার কাছে ঘোষণাটা করা হল। ম্যারি একটা টেলিফোন কল পেলেন, প্রেসিডেন্ট এলিসনের কাছ থেকে।

এলিসন বললেন- আপনি তো একের পর এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটাচ্ছেন!

–মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমি খুব ভাগ্যবতী।

–আমি চাই, আমার সব কূটনীতিবিশারদেরা যেন এমনই ভাগ্যবান হয়ে ওঠে। আপনাকে আরও একবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাকে নির্বাচন করে আমি ঠিক পদক্ষেপ নিয়েছি।

–প্রেসিডেন্ট আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

.

হ্যারিয়েট ফুগার ম্যারিকে বলেছিলেন- জুলাই মাস এসে গেল, চার তারিখে আমরা একটা পার্টি দেব। বুখারেস্টে যেসব আমেরিকানরা বসবাস করেন, তারা সকলেই পার্টিতে আসবেন।

–হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুবই ভালো হবে।

–তাহলে ব্যবস্থা শুরু করা যাক। অনেকগুলো পতাকা লাগবে, বেলুন, অর্কেস্ট্রা।

–শুনতে ভালোই লাগছে, আপনাকে ধন্যবাদ হ্যারিয়েট।

রেসিডেন্সটাও সাজাতে হবে। কিন্তু ম্যারি ভাবলেন, স্বাধীনতা দিবসে আমি দেশে থাকব না। ব্যাপারটা ভাবতেই খারাপ লাগছে।

.

ফ্লোরেন্স এবং ডগলাস সিফার ম্যারির বাড়িতে এলেন।

–আমরা রোমে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই।

 ম্যারি জানতে চাইলেন- কী আশ্চর্য, আমি ভাবতেই পারছি না।

–আগামীকাল তোমার কী কাজ?

.

স্যিফাররা যখন অটোপেনি এয়ারপোর্টে এলেন, ম্যারি সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন।

দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।

ফ্লোরেন্স বললেন- তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে। অ্যাম্বাসাডর হয়েছ, কিন্তু সেই আগের মতো রয়ে গেছে।

রেসিডেন্স, ম্যারি চারদিকে তাকিয়ে দেখাচ্ছিলেন। যখন প্রথমে এখানে এসেছিলেন, অবাক হয়েছিলেন। চারমাসে সব কিছু পালটে গেছে। মনে হচ্ছে, এই সব অনন্তকাল থাকবে।

ফ্লোরেন্স জানতে চাইলেন- এখানে তুমি থাকো নাকি?

ফ্লোরেন্স বললেন- ভেতরে সুইমিং পুল আছে, থিয়েটার, এক হাজার ঘর, তোমার নিজস্ব বাগান।

.

বিশাল ডাইনিংরুম, তারা সকলে বসেছিলেন। লাঞ্চ খেতে খেতে গল্প হচ্ছে। জাংশন সিটির প্রতিবেশীদের কথা।

–ওদের কথা মনে পড়ে? ডগলাস জানতে চাইলেন।  

–হ্যাঁ, ম্যারির মনে পড়ে গেল, যখন তিনি বাড়ি আসতেন, চারপাশে কত নীরবতা এবং শান্তি। বন্ধুরা আসতেন। স্বামীর সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। আর এখানে? অফিসে খারাপ কথা লেখা হচ্ছে, হিংসা এবং অন্যায়।

–তুমি কিছু ভাবছ? ফ্লোরেন্স জানতে চাইলেন।

–না, আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি। তোমরা ইউরোপে কী করছ?

আমি রোমে একটা সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছি। ডগলাস বললেন।

ফ্লোরেন্স বললেন- বলে যাও, বলে যাও।

ভাবলাম, এত কাছে যখন এসেছি, তোমার সাথে দেখা করে যাই।

–তোমাদের দেখে আমার খুবই ভালো লাগছে।

ফ্লোরেন্স দীর্ঘশ্বাস ফেললেন– আমি ভাবতে পারিনি, তুমি এত বড়ো নামকরা স্টার হয়ে উঠবে।

ম্যারি হাসলেন– ফ্লোরেন্স আমি একজন সামান্য রাষ্ট্রদূত। এতে স্টার হবার কী হল?

না, আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, তোমার ভবিষ্যতে কী লেখা আছে।

–কী লেখা আছে?

জানতে চাইছ?

হ্যাঁ।

-ম্যারি, টাইম-এ গত সপ্তাহে তোমাকে নিয়ে একটা বিরাট আর্টিকেল বেরিয়েছে। তোমার ছবি আর ছেলেমেয়েদের ছবি ছাপা হয়েছে। স্টানটন রজার্স প্রেস কনফারেন্সে তোমার কথা বাববার বলেছেন। তিনি বলেছেন, তুমি হলে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূত। এমনকি প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত তোমার প্রশংসা করেছেন। বিশ্বাস করো, এখন আমেরিকার সকলের মুখে তোমার নাম।

–হ্যাঁ, হয়তো তাই। কিন্তু কতদিন আমি আমেরিকাতে যাইনি?

স্টানটনের কথা মনে পড়ে গেল। স্টানটন বলেছিলেন প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুসারে আমরা আপনার একটা সুন্দর ভাবমূর্তি তৈরি করছি।

ম্যারি জানতে চাইলেন- এখানে তোমরা কতদিন থাকবে?

–আমি তো বরাবরের জন্য থাকতে চাইছি। কিন্তু তিনদিনের বেশি থাকা হবে না। এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

ডগলাস জানতে চাইলেন– এডওয়ার্ডের কথা মনে পড়ে?

ম্যারি বললেন- প্রত্যেক রাতে এডওয়ার্ডের সাথে কথা বলি আমি। ব্যাপারটা কি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে?

-না-না, কখনোই নয়।

–আমি চেষ্টা করছি, নিজেকে সামলে নেবার, কেমন?

–তারপর? ফ্লোরেন্স জানতে চাইলেন কারোর সঙ্গে কথা হয়েছে? নতুন কেউ?

 ম্যারি হাসলেন–হয়তো, তার সাথে তোমাদের দেখা হবে, আজ রাতে, ডিনারে আসরে।

.

ডাক্তার লুইস ভেসফরগেসের সাথে সিফারদের বন্ধুত্ব হল। তারা শুনেছিলেন ফরাসিরা আত্মসংযমী কিন্তু নীরব স্বভাবের হয়ে থাকেন। কিন্তু লুইসকে দেখে মনে হল, তিনি বড্ড প্রাণবন্ত এবং ফুর্তিবাজ, ওষুধপত্র নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হল। আহা, বুখারেস্টের বুকে কাটানো একটি স্মরণযোগ্য সন্ধ্যা মনে হল আজ সন্ধ্যায় ম্যারি সব দিক থেকেই সুনিশ্চিত এবং আনন্দ মুখরিতা।

রাত এগারোটা বেজেছে। সিফাররা ওপরতলায় চলে গেলেন। তারা গেস্টরুমে যাবেন। ম্যারি নীচের তলায় বসে আছেন। লুইসকে শুভরাত জানাবেন।

লুইস বললেন- আপনার বন্ধুদের খুব ভালো লেগেছে। আবার ওদের সঙ্গে দেখা হবে, কী?

হ্যাঁ, তারা কদিন এখানে থাকবেন। তারপর কানসাসে চলে যাবেন।

–ম্যারি, আপনিও কি চলে যাবেন?

–না, আমি থাকব।

-ঠিক আছে, আমি এই সপ্তাহের শেষে পাহাড় দেখতে যাব। আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে?

-হ্যাঁ, যাব।

 গল্পটা এইভাবে শুরু হয়েছে।

.

রাতের অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে। ম্যারি শুয়ে আছেন, অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে রাতে এডওয়ার্ডের সাথে দেখা হল ম্যারির। ডার্লিং, আমি তোমাকে, সব সময় তোমাকেই ভালোবাসি। কিন্তু তোমাকে বোধহয় আর আমার প্রয়োজন নেই। নতুন একটা জীবন আমি শুরু করতে চলেছি। তুমি আমার এই জীবনের অংশীদার ছিলে, কিন্তু এখানে অন্য একজন এসে গেছে। লুইস, হ্যাঁ, লুইস। লুইস ভালোমানুষ, লুইস শক্তিশালী। লুইসের মনে সাহস আছে। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো এডওয়ার্ড।

আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে…।

ম্যারি অনেকক্ষণ বিছানাতে বসে ছিলেন। তারপর বেডসাইড আলোেটা জ্বেলে দিলেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার অনামিকায় পরা হীরের আংটির দিকে। ধীরে ধীরে আংটিটা আঙুল থেকে খুলে ফেললেন।

এইবার বোধহয়, জীবনের একটি পর্ব শেষ হল, অথবা শুরু হল, কে তা বলতে পারে?

.

স্যিফারদের নিয়ে ম্যারি বুখারেস্টের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন। দেখলেন ওই দম্পতির চোখে লেগেছে ঔৎসুক্য আর আনন্দ। তিনটে দিন অতি দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। স্যিফাররা চলে গেলেন। ম্যারি আবার একা। মনে হল, মন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্না। এই বিদেশে তিনি বোধহয় বিপদগ্রস্তা।

.

সকালে কফি খাচ্ছেন মাইক শ্লেটের সঙ্গে, সারাদিনের কাজ নিয়ে আলোচনা চলেছে।

কফি খাওয়া শেষ হল। মাইক বললেন আমি একটা গুজব শুনতে পাচ্ছি। ম্যা

রি বললেন- আওনেস্তু এবং তাঁর নতুন উপপত্নীর ব্যাপারে। তাই তো?

না, আপনার ব্যাপারে।

কী ধরনের।

 –আপনি ডঃ লুইস ভেসফরগেসের প্রতি অনুরক্ত।

ম্যারির কণ্ঠস্বরে রাগ- এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

–ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, এটা কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে পারে না। আমাদের ওপর একটা নির্দেশনামা জারি করা আছে। বিদেশিদের সাথে আমরা বেশি মেলামেশা করতে পারি না। এই ডাক্তার ভদ্রলোক কিন্তু একজন বিদেশি। শুধু তাই নয়, তিনি শত্রুদের এক এজেন্ট।

ম্যারি কথা বলতে পারছেন না, এটা একেবারে মিথ্যে কথা।

–আপনি কী করে এত খবর রাখলেন?

 মাইক বললেন- আপনিও চোখকান খোলা রাখলে জানতে পারতেন।

–ওই ডাক্তার আপনার থেকে দশগুণ ভালো। উনি আলজিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সন্ত্রাসবাদীরা তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেদের হত্যা করেছে।

মাইক হাসতে হাসতে বললেন- বাঃ, মিথ্যেটা বেশ গুছিয়ে বলতে পারেন তো উনি। আমি যতদূর জানি ডাক্তার কোনোদিনই বিয়ে করেননি। সুতরাং সন্তান হবার সম্ভাবনাই নেই।

.

২৫.

টিমি সোয়ারাতে লাঞ্চ। কার্থেপিয়ান পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সরাইখানার নাম হানটার্স ফ্রাইডে। মধ্যযুগের মদরঙা দেওয়াল।

লুইস বললেন- কেমন লাগছে ম্যারি?

ম্যারির দুচোখে বিস্ময়।

লুইস স্থানীয় মদ নিয়ে বসে আছেন। সাদা ওয়াইন। বাতাসের ভেতর বিশ্বস্ততার সুর ভাসছে। লুইস এবং ম্যারি দুজনেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।

এমব্যাসি থেকে চলে আসার সময় লুইস বলেছিলেন- ব্যাপারটা গোপন রাখতে পারবেন তো? না হলে আবার সাংবাদিকরা আপনাকে অনুসরণ করবেন।

ম্যারি গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন। লুইস ফরাসি দূতাবাসের এক কর্মীর কাছ থেকে গাড়ি নিয়েছেন। কালো-সাদা ডিম আকারের লাইসেন্স প্লেট লাগানো গাড়ি।

ম্যারি জানতেন, এই লাইসেন্স প্লেট থাকলে পুলিশ অযথা গোলমাল করে না। বিদেশিদের এই লাইসেন্স প্লেট দেওয়া হয়, বারো থেকে নম্বরটা শুরু হয়েছে। হলুদ-প্লেট দেওয়া হয় সরকারের আধিকারিকদের জন্য।

লাঞ্চ শেষ হল। গাড়িটা এগিয়ে চলেছে, অসাধারণ পরিবেশ।

লুইস নিজেই চালাচ্ছেন। ম্যারি তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। মাইক শ্লেটের কথাগুলো মনে পড়ছে। উনি শত্ৰু, দেশের এজেন্ট। মাইক সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলেছেন।

মাইক শ্লেটের কোনো কথা ম্যারি বিশ্বাস করেন না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে লুইস কখনোই তার অফিসে ঢুকে পড়তে পারেন না। দেওয়ালে ওই লাল অক্ষরের সংকেতবানী লিখতে পারেন না। অন্য কেউ হয়তো তাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে। না, আমি লুইসকে বিশ্বাস করব। লুইসের মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত আবেগের বিচ্ছুরণ আমি লক্ষ্য করেছি। যখন উনি আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলা করেন, মনে হয় পিতৃসুলভ ভালোবাসা ওঁনার আচরণে জেগে উঠেছে, উনি একজন এতবড়ো অভিনেতা হতেই পারেন না।

বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে, ওক গাছের সারি। শুস এবং ফারও চোখে পড়ল।

সুইস বললেন- আঃ, শিকারের আদর্শ জায়গা। এখানে বুনো শুয়োরের দেখা পাবেন। নেকড়ে এবং অন্য কিছু কিছু বন্যপ্রাণী।

আমি কখনও শিকারে যাইনি।

–একদিন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

 পথ এগিয়ে গেছে, ছবির মতো, সুইস আল্পসের দিকে। পাহাড়ের চুড়োগুলো কুয়াশা এবং মেঘে ঢাকা। রাস্তার দুপাশে সবুজ উপত্যকা। গোরুর দল নিশ্চিন্তে চড়ে বেড়াচ্ছে। মাথার ওপর ইস্পাতরঙা বরফতৃপ্ত মেঘেদের সমাহার। ম্যারির মনে হল, তিনি বোধহয় মেঘের রাজত্বে চলে যাবেন। আহা, তা হলে কতই না ভালো হত।

সন্ধ্যাবেলা তারা গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেলেন। সিওপ্লিয়া- অসাধারণ মাউনটেন রিসর্ট।

দুজনের জন্য ঘর বুক করা হয়েছে। ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো। একটা বেডরুম, বাথরুম, টেরেস। যেখান থেকে পাহাড়ের পুরো ছবিটা চোখের তারায় ধরা পড়ে।

লুইস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- এত সুন্দর প্রকৃতি আমি কখনও দেখিনি।

-সত্যিই তো, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। লুইস ম্যারির দিকে এগিয়ে এলেন যদি আমি শিল্পী হতাম, ক্যানভাসে আপনাকে এঁকে রাখতাম।

 ম্যারি ভাবলেন- বয়সটা কমে গেছে, আমি বোধহয় এক সপ্তদশী, জীবনে প্রথমবার প্রেমিকের সাথে মিলিত হচ্ছি।

ম্যারি লুইসের হাতে হাত রাখলেন। দুটি দেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ঠোঁটের সাথে ঠোঁটের আলাপন। দেহের সর্বত্র নিষ্পেশণ। তারপর বোঝা গেল একটা উখিত পুংদণ্ড ম্যারিকে ধীরে ধীরে স্পর্শ করছে। ম্যারি সবকিছু ভুলে গেলেন। অতীত এবং ভবিষ্যৎ। বর্তমানটাই তার কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে।

যৌনকাতর অবস্থায় একজন নারী কতদিন থাকতে পারে?

এটা তো জীবনের স্বাভাবিক চাহিদা। মনে হল, এই জীবনে আমি আর একা নই, ম্যারি চাইছিলেন, লুইস তার পুংদণ্ডটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিক। ভেতরে, দুটি শরীর এবং মন সব মিলেমিশে যাক।

বিরাট ডবল বেড। নগ্ন শরীর শুয়ে আছে। আহা, এত আনন্দ, এত সুখ। শেষ অব্দি মনে হল, হাজার ফুল ফুটে উঠেছে। একবার-দুবার–অসংখ্যবার।

লুইসকে এক অন্য প্রকৃতির প্রেমিক বলা যেতে পারে। আবেগ সম্পৃক্ত এবং আত্মাভিমানী। ম্যারির প্রতি যত্নবান। অনেক-অনেক দিন বাদে ম্যারি তৃপ্তা হয়েছেন, সম্পূর্ণ। এই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে তারা স্মৃতিচারণ করছিলেন।

লুইস বললেন- রেনে এবং ছেলেমেয়ের মৃত্যুর পর আমি ভেবেছিলাম, জীবনটা একেবারে ধূসর মরুভূমি হয়ে গেল। শেষ অব্দি তোমার দেখা পেলাম।

ম্যারি চোখ বন্ধ করে বললেন- হ্যাঁ, আমারও তাই। আমি কীভাবে জীবন কাটিয়েছি, তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমি এলে, তুমি আমার কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। জানো এডওয়ার্ড আমার মাথায় একটা ছাতা ছিল, যখন বৃষ্টি হত, তখন ওই ছাতাটা সে আমার মাথার ওপর ধরত। আর এখন? এখন আমি ভিজতে ভিজতে নিঃশেষ হয়ে গেছি।

ওঁরা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

আবার ভালোবাসার খেলা। ধীরে ধীরে, কোমলভাবে। আগুন জ্বলে উঠেছে। ভারি চমৎকার পরিবেশ!

ব্যাপারটা ভারি সুন্দর! ম্যারি ভাবলেন। সত্যি কি লুইসের সন্তান আর স্ত্রী ছিল? নাকি সবটাই বানানো।

মাইক শ্লেটের চালাকি ভরা মুখটা মনে পড়ছে।

লুইস জানতে চাইলেন– তুমি কী ভাবছ?

না, কিছুই না ডার্লিং ।

 অন্ধকারের দিকটা কি ধীরে ধীরে আমার সামনে ফুটে উঠছে? কেউ আমাকে অপহরণ করতে চেয়েছিল, কে, সেটা না জানা পর্যন্ত আমার ঘুম হচ্ছে না!

.

রাতের আহার, আউটসাইড টেরেসে তারা চলে এলেন। লুইস স্থানীয় মদ খাচ্ছেন।

শনিবার তারা পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় চলে গিয়েছিলেন। তারা ফিরলেন, ইনডোর পুলে পাশাপাশি সাঁতার কাটলেন। প্রাইভেট সাওনা আছে। এক জার্মান দম্পতির সাথে আলস্যের ব্রিজ খেললেন। সন্ধেবেলা, তারা গেলেন একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে। পাহাড়ের একপাশে অবস্থিত বিশাল ডাইনিংরুম, খোলা জায়গাতে আগুন জ্বলছে। কাঠের তৈরি ঝাড়বাতি, টুংটাং শব্দ হচ্ছে। মোমের আলোয় উদ্ভাস, মধ্যযুগীয় পরিবেশ জানালা দিয়ে তুষার ঢাকা পাহাড়ের ছবি স্পষ্ট চোখে পড়ছে।

.

এবার যাবার সময় হয়েছে।

আবার বাস্তব পৃথিবী, আবার মানুষের লোভ-হিংসা, আবার অপহরণের আশঙ্কা, হয়তো আবারও দেওয়ালে লেখা থাকবে, বিপদ সংকেত।

.

ফিরতি যাত্রাটাও ছিল মনোরম। আনন্দ, শুধু আনন্দ। লুইস পাশে আছে। আর আমার ভয় কী?

শেষ পর্যন্ত তারা বুখারেস্ট শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেলেন। দুপাশে সূর্যমুখী ফুলের সমাহার।

ম্যারি ভাবলেন, এইসব ফুলেরা বোধহয় আমাকেই অভিবাদন জানাচ্ছে।

.

বেথ এবং টিম মায়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল।

বেথ জিজ্ঞাসা করল- মা, তুমি কি লুইসকে বিয়ে করবে?

অযাচিত এবং অভাবিত এই প্রশ্ন।

 ম্যারির জবাব দিলেন– আমি ঠিক জানি না।

লুইস আমাদের ড্যাডির মতো নয়। বেথ ধীরে ধীরে বলল। কিন্তু ওঁনাকে আমাদের ভালো লাগে।

ম্যারি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন আমার মনের কথা তোরা বলেছিস।

.

অনেকগুলো লাল গোলাপ এবং ছোট্ট একটি চিরুকুট- অনেক-অনেক ধন্যবাদ।

ম্যারি কার্ডটা পড়লেন। ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না, কে সত্যি আর কে মিথ্যে? তখনই এডি মালজ ঢুকলেন। সেই সিআইএ এজেন্ট ভদ্রলোক।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আপনার চোখমুখ বলে দিচ্ছে যে, পরিভ্রমণটা চমৎকার ছিল, কী তাই তো?

–অনেক ধন্যবাদ।

তারা বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন।

-কর্নেলের সম্পর্কে বলা যায়, তিনি আমাদের সংস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ আমানত। তার কাজের পদ্ধতি হয়তো আমরা বুঝতে পারব না। কিন্তু তিনি এই কাজে কখনও ব্যর্থ হন না।

–আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ মালজ।

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ ম্যারি বললেন আমি কি একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

–অবশ্যই।

–এটা কিন্তু ব্যক্তিগত।

বলুন না।

–ডঃ লুইস ভেসফরগেসের সম্পর্কে কিছু তথ্য আমায় দিতে পারবেন? ওঁনার সম্পর্কে আপনি কোনো কথা শুনেছেন?

–হ্যাঁ, ম্যাডাম, উনি ফরাসি এমব্যাসির সঙ্গে যুক্ত আছেন। কীধরনের তথ্য?

–আমি জানতে চাইছি, ডাঃ ভেসফরগেসের বিয়ে হয়েছিল কিনা? এটা কি বের করা যাবে?

চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে।

আমাকে ক্ষমা করো লুইস।

.

মাইক শ্লেট ম্যারির অফিসে এলেন– শুভ সকাল।

শুভ সকাল।

কফি খাওয়া শুরু হল। মাইকের আচরণে পরিবর্তন চোখে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে না, তিনি কেন এমন আচরণ করছেন।

আমাদের কিছু সমস্যা আছে। মাইক বললেন।

বাকি সময়টা কেটে গেল সমস্যা সমাধানের আলোচনা করে। রোমানিয়ার কিছু কিছু বাসিন্দা আমেরিকার অভিভাষী হতে চাইছেন। কিন্তু রোমানিয়াতে অথনৈতিক সংকট দেখা। দিয়েছে। একজন প্রহরী এক রোমানিয়া মহিলাকে অন্তসত্ত্বা করে ফেলেছে। আরও অন্যান্য বিষয়।

অধিবেশন শেষ হল। মাইক বললেন– আজ ব্যালে সম্রাজ্ঞী করিনার নাচ আছে।

ম্যারির নামটা মনে পড়ল।

টিকিট আছে, আপনি কি যাবেন?

-না, ধন্যবাদ মাইক। আগেরবার টিকিট দিয়েছিলেন, সেবারই অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল। তাছাড়া আজ সারাদিন ম্যারিকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হবে। চিনা দূতাবাসে ডিনারের আমন্ত্রণ আছে। লুইস আসবেন রেসিডেন্স থেকে। না, আজ আমার দম ফেলার সময় নেই।

.

ডিনারের জন্য ম্যারি পোশাক পরতে ব্যস্ত ছিলেন। ক্লোসেটটা খুললেন, ডিনার গাউন বের করলেন। আঃ, এটা এত নোংরা কেন? কাজের মেয়েটি ভীষণ অসভ্য। সব কাজেই ভুল করে বসে। এটা ছাড়া আমি কোন্টা পরব?

ম্যারি বিছানাতে বসে পড়লেন। আজ রাতে আমার বেরোনো সম্ভব নয়। মিথ্যে কথা বলে শুয়ে থাকতে হবে। কিন্তু ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, কে যেন কানে কানে বলল এই অনুষ্ঠানে আপনাকে যোগ দিতেই হবে। এর সঙ্গে আপনার দেশের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।

কী করা যায়? চিনা প্রতিনিধি অপেক্ষা করবেন। শেষ পর্যন্ত কী হবে, ম্যারি কিছুই বুঝতে পারছেন না।

অনেকক্ষণ কেটে গেল। ডিনার ঘোষিত হল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এখনও আসেননি। ব্যাপারটা অপমানের। চিনা প্রতিনিধিদের মুখ লাল হয়েছে। চিনা প্রতিনিধি তাঁর প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা নোট পাঠিয়ে দেবেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে ফোন করবেন। বলবেন– এটা. কী ধরনের ভদ্রতা?

প্রেসিডেন্ট এলিসন রেগে যাবেন। ব্যাপারটা কোথায় চলে যাবে!

না, আমাকে ওই ডিনারে যেতেই হবে।

.

অনেক পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু কিছুই ভালো লাগল না। ফ্লোরিয়ান ম্যারিকে রেসিডেন্সিতে পৌঁছে দিলেন। ম্যারির মুখ তখনও ঘন মেঘে আচ্ছন্ন।

.

পরের দিন সকালবেলা। ম্যারির মনের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মাথা ধরেছে। শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে।

সিআইএ এজেন্ট এলেন– আপনার অনুরোধ আমরা রক্ষা করেছি। লুইস ভেসফরগেসের বিয়ে হয়েছিল তেরো বছর আগে। স্ত্রীর নাম রেনে। দুটি মেয়ে দশ এবং বারো। নাম ফিলিপা আর জেনেভিয়ে। আলজিরিয়াতে সন্ত্রাসবাদীরা তাদের হত্যা করেছিল। ডাক্তারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে। আর কোনো খবর?

ম্যারি বলললেন- না, ধন্যবাদ।

কফির আসর। ম্যারি এবং মাইক শ্লেট বসে আছেন।

প্রেসিডেন্ট আওনেন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ম্যারি বললেন দেখা যাক কী হয়।

.

সন্ধে হয়েছে, ম্যারির মনের অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়েছে। ম্যারি লুইসকে ফোনে ডাকলেন। ডিনার খেতে আজ আর যাবেন না।

তার মনে হচ্ছে, একজন আমেরিকান ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু কেন?

ডরোথি স্টোন ওষুধ পাঠিয়ে দিলেন। তাতে কোনো কাজ হয়নি।

ম্যারির একান্ত সচিব বললেন- ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আপনি বাড়ি চলে যান। আপনার শরীর ভালো নয় মনে হচ্ছে।

ম্যারি মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করলেন– কে বলেছে? আমি তো ভালোই আছি।

.

এই দিনটা বোধহয় আর শেষ হচ্ছে না। ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে হল। রোমানিও সরকারের আধিকারিক, আমেরিকার এক ব্যাঙ্কার, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আগত একদল প্রতিনিধি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের লোক, ডাচ দূতাবাসে ডিনার পার্টি। শেষ অব্দি ম্যারি বাড়িতে এলেন।

ঘুমোত পারছেন না। জ্বর এসেছে। আচ্ছন্ন অবস্থায় দুঃস্বপ্নের সমাহার।

ঠান্ডা ঘাম বয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর দিয়ে। হায় ঈশ্বর কী হয়েছে? বাকি রাতটুকু ম্যারি জেগে কাটিয়ে দিলেন।

.

পরের দিন সকালবেলা। ম্যারির দিকে তাকিয়ে মাইক বললেন– আপনি ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে যান। সেখানে আমাদের ডাক্তার আছেন।

ম্যারির ঠোঁট শুকনো, তবুও বললেন– না-না, দরকার নেই।

 মাইক কফির কাপ তুলে দিয়ে বললেন- কিছু খবর আছে। এখনই দেব?

দিন শুরু হল, আবার কর্মব্যস্ত প্রহর।

.

কীভাবে দিনটা কেটে গেল। লুইস দুবার ফোন করেছিলেন। ম্যারি বলে দিয়েছেন, তিনি মিটিং-এ ব্যস্ত আছেন।

কিন্তু কেন? লুইসকে এভাবে কেন তিনি এড়িয়ে চলতে চাইছেন।

সন্ধে হয়েছে। ম্যারি বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। সমস্ত শরীর জুড়ে ব্যথা আর যন্ত্রণা। না, আমি আর পারছি না বোধহয়। মনে হচ্ছে, আমি আর বাঁচব না।

কারমেন এগিয়ে এসেছে। সে বলেছে- ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

ম্যারির গলা ভেঙে গেছে- সাবিনাকে বলে ফরাসি দূতাবাসে যেতে। ডঃ ভেসফর গেসকে নিয়ে আসতে হবে।

 ম্যারি চোখ খুললেন। তাকিয়ে থাকলেন। লুইসের শরীরটা অস্পষ্ট। লুইস বিছানার ধারে এসে গেছেন। তিনি ম্যারির মুখের দিকে তাকালেন। হায় ঈশ্বর, তোমার কী হয়েছে?

-আমি জানি না।

 লুইস পাশে বসলেন, ডার্লিং এ ধরনের অবস্থা কতক্ষণ?

কয়েক দিন ধরেই হচ্ছে, মনে হচ্ছে ভাইরাসের আক্রমণ।

আজ তুমি রসুন দিয়ে কিছু খেয়েছ? নিঃশ্বাসের গন্ধ নিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন।

–না, আমি গত দুদিন প্রায় কিছুই খাইনি।

–তোমার কি তেষ্টা পেয়েছে?

–হ্যাঁ, বমি-বমি পাচ্ছে। লুইস, আমার কী হয়েছে?

 –তুমি কি একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?

–আমি দেবার চেষ্টা করব।

 কখন থেকে এই অবস্থা?

–আমরা যখন পাহাড় থেকে ফিরে এলাম, তার পরের দিন থেকে।

 তুমি কিছু খেয়েছিলে? অথবা কিছু পান করেছিলে? যার ফলে এই অবস্থা।

না, মনে পড়ছে না।

 –তুমি রেসিডেন্সে তোমার ছেলেমেয়ের সাথে ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলে?

রোজ তাই করে থাকি।

ছেলেমেয়েরা ভালো আছে তো? লাঞ্চের খবর বলল, লাঞ্চ কোথায় খেয়েছিলে?

–বেশির ভাগ সময় আমি দূতাবাসেই লাঞ্চ খাই। কোনো কোনো সময় রেস্টুরেন্টে চলে যাই।

ম্যারি আর কথা বলতে পারছেন না। ফিসফিস করে বললেন।

–যেখানে রোজ খাও সেখানে গিয়েছিলে, না নতুন কোথাও?

ম্যারি আর এইসব কথাবার্তা চালাতে পারছিলেন না। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেন

ডাক্তার বললেন- ম্যারি, তোমায় জেগে থাকতে হবে। আমার কথা শুনতে হবে।

…তোমার সাথে কে ছিল?

–ঠিক মনে পড়ছে না। কেন এমন করছ? এটা ভাইরাসের আক্রমণ।

ডাক্তার বললেন– না, কেউ তোমাকে বিষ দিয়েছে।

ম্যারির শরীরটা চমকে উঠল– আমি এটা বিশ্বাস করি না!

আমি বেশ বুঝতে পারছি, এটা হল আর্সেনিক বিষ। এই আর্সেনিক তত রোমানিয়াতে পাওয়া যায় না।

ম্যারির চোখেমুখে ভয়– কে? কে আমাকে বিষ দেবে?

–ডার্লিং, তোমাকে চিন্তা করতে হবে। একটু ভেবে দেখো তো, গত কয়েকদিন কী করেছ? কেউ কি তোমাকে কিছু দিয়েছে? কফি অথবা অন্য কিছু?

ম্যারি বাধা দেবার চেষ্টা করলেন।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কফি, তার মানে মাইক শ্লেট? হায় ঈশ্বর!

ম্যারি বলার চেষ্টা করলেন মাইক শ্লেট, রোজ আমার জন্য কফি নিয়ে আসেন।

না, মাইক হতে পারেন না। উনি তোমাকে হত্যা করতে চাইবেন কেন?

উনি হয়তো আমার থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন।

লুইস বললেন- ঠিক আছে আমরা এ ব্যাপারটা নিয়ে পরে কথা বলব। এখনই তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। কিন্তু তোমার দূতাবাস বোধহয় অনুমতি দেবে না। দেখা যাক, কী করতে পারি, আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি।

লুইসের কথাগুলো ম্যারির কানে বাজছে। আর্সেনিক? কে আমাকে আর্সেনিক দিয়েছে? মাইকের মুখটা মনে পড়ল। ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

ম্যারি তখন অচেতন হয়ে গেছে। লুইসের কণ্ঠস্বরে তন্দ্রা ভাঙল ম্যারি?

 ম্যারি চোখ খুলতে বাধ্য হলেন। লুইসের হাতে একটা সিরিঞ্জ।

ম্যারি বললেন- লুইস, তোমাকে দেখে ভালোই লাগছে।

লুইস ইনজেকশন দেওয়া শুরু করলেন। ইনজেকশন দিতে দিতে বলতে থাকলেন এটা আর্সেনিক বিষের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কিন্তু এখনই তোমাকে হাসপাতলে পাঠাতে পারলে ভালো হত।

ম্যারি ঘুমিয়ে পড়লেন।

পরের দিন সকালবেলা। ডাঃ লুইস ভেসফরগেস আবার ম্যারিকে ইনজেকশন দিলেন। বিকেলে আর একটি। ওষুধে কাজ হল অলৌকিকভাবে। সেইসব আচ্ছন্ন করা অনুভূতিগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। পরদিন ম্যারির শরীরের তাপমাত্রা কমে গেল। মনে হল, ম্যারি বোধহয় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন।

লুইস ম্যারির বেডরুমে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে হাইপোডার নিডল।

ম্যারিকে আবার মনে হল অসুস্থ। দীর্ঘ রোগভোগের পর উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এখন আর কোথাও যন্ত্রণা নেই।

–এই নিয়ে দুবার তুমি আমার জীবন বাঁচালে।

–এখন ভাবতে হবে, কে এটা করার চেষ্টা করেছে।

কী করে এই রহস্যের সমাধান করবে?

আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর নেবার চেষ্টা করছি। আর্সেনিক কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র আমেরিকান দূতাবাসের খবরটা আমার হাতে আসেনি। কাল থেকে তুমি কি কাজ করতে পারবে?

–আমাকে অফিসে যেতেই হবে।

–তোমার এমব্যাসির ফার্মেসিতে একবার যেও তো। বোলো, কীটনাশক লাগবে। দেখো, ওরা কী জবাব দেয়। অ্যানট্রোলের কথা বলবে। এই কীটনাশকের মধ্যে আর্সেনিক ভর্তি থাকে।

ম্যারি অবাক হয়ে গেলেন। ভদ্রলোক তখনও বলে চলেছেন মনে হচ্ছে অন্য কোনো জায়গা থেকে ওই বিষ বুখারেস্টে নিয়ে আসা হয়েছে। আর এমব্যাসি ফার্মেসিতে তা রাখা হয়েছে।

.

ম্যারিকে এমব্যাসি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। গানি সঙ্গে সঙ্গে ছিল। ম্যারি দীর্ঘ করিডর পার হয়ে ফার্মেসিতে পৌঁছে গেলেন। একজন নার্স বন্ধ খাঁচার মধ্যে বসে কাজ করছিলেন।

তিনি বললেন- গুড মর্নিং ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আপনি কেমন আছেন? আপনার জন্য কী করতে পারি?

ম্যারি বললেন আমার বাগানের মালি বলেছে, এখুনি কীটনাশক কিনতে হবে। অ্যানট্রোল আছে কী?

–হ্যাঁ, কিছু আনট্রোল আছে, নার্স বললেন। তিনি খোঁজার চেষ্টা করলেন। শিশিটা পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, এই সময় নানা পতঙ্গের উৎপাত হয়।

তিনি ম্যারির হাতে সেটা তুলে দিলেন।

 বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা মুখ ভেসে উঠল মাইক শ্লেট।

.

২৬.

ম্যারি লুইস ভেসফরগেসকে টেলিফোন করার চেষ্টা করেছিলেন। লাইনটা পাওয়া গেল না। মাইক শ্লেটের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ডাঃ ভেসফরগেসের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

লুইস তখন মাইকের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলেন।

লুইস বললেন- আপনার অ্যাম্বাসাডরকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

-কিন্তু কেন?

–কেউ তাকে বিষ দিয়েছে।

–আপনি কী বলছেন?

–আশা করি, আমার কথার আসল মানেটা আপনি বুঝতে পেরেছেন মাইক।

–আপনি আমাকে সন্দেহ করলেন নাকি? শুনুন এভাবে টেলিফোনে কথা বলা উচিত নয়। আপনি আজ রাতে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?

–কখন?

নটা পর্যন্ত আমি ব্যস্ত আছি। নটার কিছুক্ষণ বাদে, বানেসা উডসে? আমি ঝরনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকব। তখন সব ব্যাপারটা আলোচনা করা হবে।

লুইস ইতস্তত করে বললেন– ঠিক আছে, আমি যাবার চেষ্টা করব।

তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। না, মাইক শ্লেট হয়তো এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত নয়।

.

ম্যারি আবার ফোন করার চেষ্টা করলেন। না, লুইস বেরিয়ে গেছেন। লুইস কোথায় গেছেন, কেউ জানে না।

.

রেসিডেন্সে ডিনারের আসর। ম্যারি এবং ছেলেমেয়েরা বসে আছে।

বেথ বলল- মা, আজ তোমাকে অনেকটা ভালো দেখাচ্ছে।

 ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। মনে মনে লুইসকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি।

মাইক শ্লেটের মুখটা মনের ক্যানভাস থেকে কিছুতেই মুছতে পারছেন না। মাইকের খ্যাড়খড়ে কণ্ঠস্বর– এই আপনার কফি, আমি নিজে হাতে তৈরি করেছি।

টিম জিজ্ঞাস করল- মা, তোমার শীত করছে?

না, ডার্লিং, আমার শীত করছে না।

রাতের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ছেলেমেয়েকে আনা উচিত নয়। এদের কি আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেব? ম্যারি ভাবলেন। ওরা পাশের বাড়িতে থাকতে পারে। তারপর ম্যারি ভাবলেন, আমি কি ওদের সঙ্গে চলে যাব? কিন্তু এভাবে পালিয়ে যাব? তাহলে মাইক শ্লেটের জয়গাথা ঘোষিত হবে। নাঃ, একজনের সাহায্য চাইতে হবে।

উনি আর কেউ নন স্টানটন রজার্স।

কিন্তু কীভাবে? অভিযোগ প্রমাণ করব কীভাবে? মাইক প্রত্যেক দিন নিজের হাতে কফি বানিয়ে আমার সামনে ধরেন। তাহলে?

টিম কিছু বলার চেষ্টা করছে- মা, নিকোলাইদের সঙ্গে ক্যাম্পে যাব? আসছে সপ্তাহের শেষের দিকে।

না বাবা, যেও না। তোমরা দুজনেই রেসিডেন্সে থেকো। এটাই আমার একান্ত ইচ্ছে। বেথ জানতে চাইল- মা, স্কুলে যাব না? ম্যারি কিছু বলার চেষ্টা করলেন। এই দুটি ছোটো ছেলেমেয়ে, এরা এখন থেকে বন্দি জীবন যাপন করবে?

–মা, কিছু হয়েছে কী? বেথ জানতে চাইল।

ম্যারি বললেন না, কিছুই হয়নি। তবে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

–আমি জানি না, কিন্তু অনেকে বলেছে……

 না-না, টিম বলল, মার রোমানিয়ার ফ্লু হয়েছিল।

 ব্যাপারটা শুনতে ভালোই লাগল। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া বলা হচ্ছে রোমানিয়ার ফ্লু।

টিম জিজ্ঞাসা করল মা, আমি আজ রাতে একটা সিনেমা দেখব?

ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, দেখা যেতে পারে।

ম্যারি ঠিক করতে পারেননি, দিনটা কীভাবে কাটানো যেতে পারে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের আরও বেশি সময় দিতে হবে।

তাহলে? কেমন করে?

.

মধ্যরাত। ম্যারি কারমেনকে বললেন, একটা ট্যাক্সি ডাকতে।

ফ্লোরিয়ানের সঙ্গে যাবেন না?

 না।

ব্যাপারটা কেমন শোনাল কারমেনের কানে।

ট্যাক্সি এসে গেছে। ম্যারি বললেন- আমেরিকান দূতাবাসে যেতে হবে।

ওটা বন্ধ হয়ে গেছে ম্যাডাম।

তিনি তাকালেন, চিনতে পারলেন ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আমার নিজের যে কী ভালো লাগছে!

পথ চলা শুরু হল।

আমাদের সংবাদপত্রে আপনার ছবি আছে। দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। আপনি তো এক মহান নেত্রীর মতো হয়ে উঠেছেন।

ড্রাইভার তখনও বলে চলেছে- আমেরিকানদের আমি ভালোবাসি। তারা সহৃদয় মনের মানুষ হয়ে থাকে।

এখন আলোচনায় যোগ দেওয়ার ইচ্ছে নেই ম্যারির।

ম্যারি এমব্যাসিতে পৌঁছে গেলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন– আপনি এখানে আধঘণ্টা পরে আসবেন? আমি রেসিডেন্সে ফিরে যাব।

নিশ্চয়ই, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

একজন মেরিন গার্ড এগিয়ে এল। সে ম্যারিকে চিনতে পেরেছে। শুভ সন্ধ্যা, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

–শুভ সন্ধ্যা, ম্যারি বললেন।

 ম্যারি আবার বললেন আমি আমার অফিসে যাচ্ছি, কয়েক মিনিটের জন্য।

ম্যারি আলো জ্বেলে দিলেন। দেওয়ালের দিকে তাকালেন। না, অশ্লীল শব্দগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। তিনি দরজা দিয়ে মাইক শ্লেটের অফিসে ঢুকে গেলেন। ঘরটা অন্ধকারে পরিপূর্ণ। আলো জ্বেলে দিলেন।

ডেস্কে কোনো কাগজের টুকরো নেই। ড্রয়ার খুঁজলেন। সবকিছু ফাঁকা। কিছু বুলেটিন পড়ে আছে। তা হলে? কেন এমন হল? কিছু একটা থাকা উচিত ছিল।

ড্রয়ার খুললেন, কী আছে দেখার চেষ্টা করলেন। সাবধানে। তলার ড্রয়ারটা খুললেন। অনেক কাগজের মধ্যে পাওয়া গেল একটা টিউব। তার মধ্যে লাল রঙের স্প্রে পেন্ট পড়ে আছে!

.

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। ডাঃ লুইস বানেসা উডসে অপেক্ষা করছেন, ঝরনার ধারে। মাইক শ্লেট কখন আসবেন? অন্ধকারে মাইক শ্লেটকে দেখা গেল।

–আসুন, আমরা একটু আলোচনা করি।

ম্যারি অ্যাসলেকে কে বিষ দিতে পারেন, তাই তো?

–আমি জানি, কে ওঁনাকে বিষ দিয়েছে।

আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?

–হুঁ, আপনাকেই সন্দেহ করা উচিত।

–কিন্তু কেন?

 মাইক তার পকেটে হাত দিলেন। পয়েন্ট ৪৭৫ ক্যালিবারের একটা ম্যাগনাম পিস্তল বেরিয়ে এল।

লুইস অবাক হয়েছেন, বললেন– এটা কী হচ্ছে?

মাইক শ্লেট ট্রিগারটা টিপে দিলেন। ফরাসি ভদ্রলোকের বুকে একটুকরো লাল মেঘের করুণ আকুতি।