৪. অটোপেনি এয়ারপোর্ট

তৃতীয় পর্ব

১৮.

অটোপেনি এয়ারপোর্ট, বুখারেস্ট শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে পঁচিশ মাইল দূরে অবস্থিত। একটি আধুনিক এয়ারপোর্ট। আশেপাশের দেশ থেকে অনেক পর্যটক রোমানিয়াতে আসেন। তবে এখনও পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ থেকে খুব একটা বেশি টুরিস্ট এখানে আসেননি।

টারমিনালের মধ্যে বাদামি ইউনিফর্ম পরা সৈন্যদের দেখা গেল। রাইফেল এবং পিস্তল হাতে সুসজ্জিত। মনে হচ্ছে, এই পরিবেশের সর্বত্র শীতলতা বিরাজ করছে। তাপমাত্রা বেশ কম। টিম এবং বেথ ম্যারির কাছে সরে এল। নিরাপত্তাহীনতা?

দুজন মানুষ এগিয়ে আসছেন। একজন রোগা, অ্যাথলেটের মতো চেহারা, দেখলেই বোঝা যায়, উনি মার্কিনদেশের বাসিন্দা। অন্যজনের বয়স হয়েছে, পোশাকটা মোটেই মানাচ্ছে না।

আমেরিকান বললেন মাদাম অ্যাম্বাসাডর, রোমানিয়াতে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমার নাম জেরি ডেভিস। আমি আপনার পাবলিক অ্যাফেয়ার কনসালট্যান্ট। ইনি টিউডর কসটাসে, রোমানিয়ার চিফ পোটোকল।

-আপনাকে এবং আপনার ছেলেমেয়েকে এই দেশে স্বাগত জানাচ্ছি। কসটাসে বললেন।

ম্যারি ভাবলেন, আগামী কয়েক বছর এই দেশই হবে আমার ঠিকানা। রোমানিয়া ভাষায় ধন্যবাদ দিলেন তিনি।

কসটাসে অবাক হয়ে গেছেন। চিৎকার করে তিনি বললেন– ম্যাডাম, আপনি এই ভাষাটা জানেন?

ম্যারি বললেন– কয়েকটা শব্দ শিখেছি। এবার ভালোভাবে শিখে ফেলব।

টিমও এই সুযোগে ভাষা শিখে নিয়েছে। ম্যারির এত আনন্দ, মনে হল, এই আনন্দে তিনি বুঝি ফেটে পড়বেন। টিম এবং বেথের সঙ্গে সকলের পরিচয় করানো হল।

জেরি বললেন- আপনাদের লিমুজিন অপেক্ষা করছে। কর্নেল ম্যাককিনি বাইরেই আছেন।

কর্নেল ম্যাককিনি এবং মাইক শ্লেট– এই দুটো নাম তিনি মোটেই সহ্য করতে পারেন না। তার মানে শ্লেট এখানে এসে গেছেন!

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল, কাস্টমসের ঝামেলা মিটে গেল। ম্যারি এবং ছেলেমেয়েরা বাইরে এলেন। রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফাররা অপেক্ষা করছেন। ম্যারি এর আগে এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। তিনি জানেন কীভাবে কথা বলতে হবে।

কর্নেল ম্যাককিনিকে দেখা গেল, আর্মি ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়ির সামনে। তিনি বললেন- শুভ সকাল ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। আশা করি, এই উড়ানটা আপনার ভালোই লেগেছে।

–অনেক ধন্যবাদ।

মাইক শ্লেট এখানে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দরকারি কাজ থাকায় আসতে পারেন নি।

লম্বা কালো লিমুজিন, মার্কিন পতাকা উড়ছে। ড্রাইভারের পোশাক পরা হাসিমুখের একটি ছেলে।

এ হল ফ্লোরিয়ান।

 ঝকঝকে সাদা দাঁত ওয়েলকাম ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, মাস্টার টিম-বেথ, আপনাদের সকলকে সেবা করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি।

ম্যারি বললেন- ধন্যবাদ।

–ফ্লোরিয়ান চব্বিশ ঘণ্টা আপনাদের সেবা করবে। আপনি কি সোজা এখন আপনার বাড়িতে যাবেন? কিছুটা সময় বিশ্রাম নিন। তারপর আপনাকে শহরে আসতে হবে। এখন সকালবেলা। ফ্লোরিয়ান আপনাকে আমেরিকান এমব্যাসিতে নিয়ে যাবে।

গাড়ির যাত্রা শুরু হল। শহরটা চমৎকার। দু রাস্তার হাইওয়ে। গাড়ি চলেছে, লরি চোখে পড়ল। ছোটো ছোটো জিপসি গাড়িও দেখা গেল। রাস্তার ওপর দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। হাইওয়েতে নতুন ফ্যাক্টরি, তারই পাশে পুরোনো দিনের কুটির।

নাঃ, দেশটাকে ভালোই লাগছে।

বুখারেস্টের স্থানীয় এয়ারপোর্ট বানিসিয়া। তার পাশে আর একটা বড়ো হাইওয়ে। দোতলা একটি বাড়ি। বেশ আভিজাত্যের ছাপ আছে।

ম্যারি জানতে চাইলেন–এটা কী?

ফ্লোরিয়ান জবাব দিলেন–এটা আইভান জেলখানা। রোমানিয়া সরকারের সাথে যাদের মতপার্থক্য দেখা দেয়, তাদের এখানে বন্দি রাখা হয়।

কর্নেল ম্যাককিনি একটা চাবি দেখিয়ে বললেন- এটা হল এমারজেন্সি সুইচ। কোন অসুবিধা হলে, ধরুন সন্ত্রাসবাদীরা আপনাকে আক্রমণ করেছে, এই বোতামটা টিপবেন। এটি সঙ্গে সঙ্গে রেডিয়ো ট্রান্সমিটারকে স্বয়ংক্রিয় করে তুলবে। গাড়ির মাথায় লাল আলো জ্বলে উঠবে। আমরা এক মুহূর্তের মধ্যে জানতে পারব, আপনি কোথায় আছেন।

ম্যারি ভয়ে ভয়ে বললেন- তেমন পরিস্থিতি যেন কখনও না হয়।

-আমারও সেটাই আশা, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

.

বুখারেস্ট শহরটা চমৎকার। অসংখ্য উদ্যান এবং স্মৃতির স্মারক। কোথাও কোথাও উদ্বেলিত ঝরনা চোখে পড়ছে। মনে পড়ল, ঠাকুরদা বলতেন বুখারেস্ট হল ছোট্ট প্যারিস। এমনকি তুমি আইফেল টাওয়ারের একটা অনুকরণও দেখতে পাবে।

সত্যি সেন্টটা ওয়ারটাও চোখে পড়ল। ম্যারির মনে হল, তিনি যেন ঠাকুরদার রাজ্যে ফিরে গেছেন।

রাস্তাঘাটে অনেক মানুষের ভিড়। বাস চলেছে, স্ট্রিট কার। লিমুজিন রাজকীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে। পথচারীরা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

কর্নেল বললেন- এই রাস্তাটার নাম এক রাশিয়ান জেনারেলের নামে দেওয়া হয়েছে, আইরোনিক, আপনার রেসিডেন্সের কাছেই।

অ্যাম্বাসাডরের থাকার বাড়িটি বিরাট, পুরোনো দিনের তিনতলা বাড়ি, এক একরের চমৎকার বাগান আছে।

রেসিডেন্সের বাইরে কর্মীরা অপেক্ষা করছিলেন। ম্যারি ভেতরে ঢুকলেন। জেরি ডেভিস একে একে সকলের পরিচয় দিলেন।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। মিহাই আপনার বাটলার। সাবিনা আপনার সোশ্যাল সেক্রেটারি। রশিকা হাউজকিপার। কসমা শেফ। ডেলিয়া আর কারমেন আপনার পরিচারিকা।

ফুলের তোড়া তুলে দেওয়া হল। সকলে বলল, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আমরা আপনাকে পেয়ে আনন্দিত এবং গর্বিত।

ম্যারি ভাবতে পারছেন না, জীবনটা কীভাবে পালটে গেছে! তাকে খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। অসাধারণ খাবার। সুস্বাদু এবং লোভনীয়।

কিন্তু এখন ম্যারির খিদে পায়নি। ম্যারি বললেন- ঠিক আছে, একটু বাড়িটা ঘুরে দেখি, তারপর কিচেনে আসব।

রেসিডেন্স একটা সুন্দর বাড়ি। দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। লম্বা টেরেস আছে, বিরাট একটা পার্কও আছে।

টিম চিৎকার করল– এ কী একটা সুইমিং পুল দেখছি! আমি কি সাঁতার কাটতে যাব?

–এখনই দুষ্টুমি কোরো না, পরে তো সব কিছু হবে।

জেরি ডেভিস বললেন- এই হলে পার্টি দেওয়া হয়, এমব্যাসির লোকেরা এখানে আসেন।

জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা হয়েছে, এবার বোধহয় একটু বিশ্রাম নিতে হবে।

.

প্রথম রাতে ম্যারির ঘুম হয়নি। অদ্ভুত একাকিত্ব বোধ। উত্তেজনা। নতুন কাজে যোগ দেবার আনন্দ এবং আকুতি।

মাইক শ্লেটের কথা মনে পড়ল– আমি অ্যামেচারদের ঘেন্না করি। অ্যামেচারদের দিয়ে কোনো কাজ হয় না।

মুখটা কঠিন হল, উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

.

বুখারেস্টের মার্কিন এমব্যাসি একটা সেমিগথিক বাড়ি, দোতলা, সামনে লোহার গেট আছে, ইউনিফর্ম পরা অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

ভেতরে একটা লবি, মার্বেলের মেঝে। দুটি ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। ড্রাগনের ছবি আঁকা করিডরে বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের তৈলচিত্র।

মেরিন অপেক্ষা করছিল ম্যারির জন্য। ম্যারি প্রবেশ করলেন। মেরিন গার্ড বলল আমি সার্জেন্ট হিউজেস। আমাকে গানি নামে ডাকা হয়। সকলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

ম্যারি এগিয়ে চললেন, ওপরে গেলেন। রিসেপশন রুমে এক মধ্যবয়সিনী ভদ্রমহিলা ডেস্কের ওধারে বসেছিলেন। তিনি বললেন আমি ডরোথি স্টোন, আপনার সেক্রেটারি। আপনার জন্য অনেকে অপেক্ষা করছেন।

উনি অফিসের দরজাটা খুলে দিলেন। ম্যারি ভেতরে প্রবেশ করলেন। বিরাট কনফারেন্স টেবিল। যাঁরা বসেছিলেন, তারা সম্মান দেখানোর জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ম্যারির মনে অসাধারণ চঞ্চলতা। মাইক শ্লেটের দিকে নজর পড়ে গেল।

মাইক বললেন- তাহলে নিরাপদে ম্যাডাম আসতে পেরেছেন? সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

এক-এক করে পরিচয়ের পালা শেষ হল। এবার বোধহয় ফাইল নিয়ে আলোচনা হবে।

মাইক বললেন আমরা সকলেই আপনার কথা মত চলব। আপনি আমাদের যে কোনো ব্যক্তিকে যখন-তখন কাজ থেকে ছুটি দিতে পারেন। অন্য কাউকে আনতে পারেন।

ম্যারি বুঝতে পারলেন, এটা মিথ্যে কথা। কিন্তু তিনি ভাবলেন, আপনাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করব।

.

পনেরো মিনিট ধরে মিটিংটা চলেছিল। নানা বিষয়ে আলোচনা হল। শেষ অব্দি মাইক শ্লেট বললেন- ডরোথি আপনার জন্য পরবর্তী মিটিং-এর ব্যবস্থা করবেন।

ম্যারি বুঝতে পারলেন- এখন থেকে বোধহয় মাইককে সমঝে চলতে হবে।

মাইক শ্লেট এবং ম্যারি এখন একা বসে আছেন অফিস ঘরে। ম্যারি জানতে চাইলেন এঁদের মধ্যে কে সিআইএ-র এজেন্ট?

মাইক তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন– চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

মাইক অফিসের বাইরে বেরিয়ে এলেন। ম্যারি এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। তারপর মাইককে অনুসরণ করলেন।

লম্বা করিডর। শেষে একটা বড় দরজা আছে। মেরিন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। মাইক দরজাটা খুললেন।

ম্যারি ভেতরে ঢুকলেন। অসাধারণ একটি ঘর, ধাতু ও কাঁচ দিয়ে তৈরি। মাইক দরজাটা বন্ধ করলেন।

এটি হল বাবলরুম, প্রত্যেক এমব্যাসিতে এমন একটা লৌহ আবরণ আচ্ছাদিত ঘর থাকে। এই ঘরে কেউ কখনও ঢুকতে পারে না। ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, বুঝতেই পারছেন, এই ঘরের নিরাপত্তা আকাশছোঁয়া। কারণ মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু একটা কমিউনিস্ট দেশে এসেছেন। সেখানে সকলেই আপনার শত্রু।

ম্যারি একটি চেয়ারে বসলেন, জানতে চাইলেন– আমি কি কারও সঙ্গে স্বাধীনভাবে। কথা বলব না?

না, বুঝেসুঝে কথা বলতে হবে। এখানে গুপ্তচররা ঘোরাফেরা করে।

রোমানিয়ানদের কেন আমরা এমব্যাসিতে কাজ করার অনুমতি দিই?

–এটাই হল তাদের প্লে-গ্রাউন্ড। তাদের আমরা হোমটিম বলতে পারি। তাদের নিয়মানুসারে আমাদের চলতে হবে। তাই তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবার বলুন, আপনি কী জানতে চাইছেন?

–সিআইএর এজেন্ট কে?

–এডি, আপনার পলিটিক্যাল কনসুলার।

 এডির মুখখানা কেমন, ম্যারি ভাববার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ল, ধূসর চুল, চেহারাটা মোটা। নানা, তিনি তো কৃষি উপদেষ্টা এডি মালজ– মধ্যবয়সি, ভীষণ রোগা, মুখে কেমন চালাকির উদ্ভাস।

বোঝা গেল, আরও অনেক কিছু শিখতে হবে।

.

রোমানিয়া সরকারের প্রধান দপ্তর। অসংখ্য ব্লকের সমারোহ। বালি পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে। চারপাশে ইস্পাতের তৈরি পাঁচিল। সশস্ত্র পাহারা রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট আলেকজানড্রোস আওনেস্তু ম্যারিকে সংবর্ধনা জানালেন। হাতে হাত রাখলেন।

ম্যারি বললেন- আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এখানে এসেছি।

প্রেসিডেন্ট বললেন- বললেন, ফটোগ্রাফের থেকে আপনাকে দেখতে আরও অনেক সুন্দর।

–এই আমার মেয়ে বেথ আর ছেলে টিম।

বাঃ, ওদেরও ভারি সুন্দর দেখতে!

ম্যারি তার পার্শ খুললেন। প্রেসিডেন্ট এলিসন যে চিঠিখানা দিয়েছিলেন, সেটা রোমানিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিলেন। আলেকজানড্রোস একবার তার দিকে তাকালেন।

ধন্যবাদ, আমি আপনাকে রোমানিও সরকারের তরফ থেকে গ্রহণ করছি। আপনি হলেন আমাদের দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি রাষ্ট্রদূত।

কিছু কথাবার্তা হল। সময় এগিয়ে গেল। বোঝা গেল, পরে এখানে আবার আসতে হবে।

.

ছেলেমেয়েদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। সারাদিন ম্যারি এমব্যাসিতে ব্যস্ত ছিলেন। একটির পর একটি মিটিং সারতে হল। কত রকম সমস্যা, সকলের সঙ্গে শান্তভাবে কথা বলতে হচ্ছে। দিন এগিয়ে গেছে, সন্ধ্যা এসেছে। শেষ অব্দি অ্যাম্বাসাডর অ্যাসলের মাথা ঘুরে গেল। নাঃ, আজ আর পারা যাচ্ছে না।

.

সারা সন্ধে কেটে গেছে নানা অভিযোগ শুনতে শুনতে। প্রত্যেকেই নিজের কাজে অসুখী। প্রত্যেকেই অসংখ্য প্রশ্নের বিষতীর ছুঁড়ে দিয়েছেন। এত সমস্যার সমাধান করা কি সম্ভব? ম্যারি ভাবতে থাকেন। সকলের অভিযোগের অন্তরালে সত্যি লুকিয়ে আছে। এখানকার কাজের পরিবেশটা আরও উন্নত করতে হবে। কিন্তু আমার একার পক্ষে তা করা সম্ভব কী? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যারি শূন্য চোখে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকেন। আত্মপ্রত্যয় ফিরে পাবার চেষ্টা করেন। দায়িত্ব যখন পেয়েছি, দেখাই যাক না, কাজটা করতে পারি কিনা।

রোমানিয়া স্টেট প্যালেসে ককটেল পার্টি। পূর্ব জার্মানি থেকে একদল প্রতিনিধি এসেছেন।

ম্যারি প্রবেশ করলেন। প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু এগিয়ে এলেন। তিনি ম্যারির হাতে চুম্বন : দিয়ে বললেন- আপনাকে আবার দেখতে পেয়েছি বলে ভালো লাগছে।

–আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ম্যারির মনে হল, ওই ভদ্রলোক প্রচণ্ড মদ পান করেছেন। তাই বোধহয় কথা জড়িয়ে গেছে।

আওনেস্কু ম্যারির হাতে হাত রাখলেন। তাকে একটা কোণে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন- রোমানিওদের মধ্যে আপনি প্রাণস্পন্দন পাবেন। আমরা প্রচণ্ড কামনা সম্পৃক্ত মানুষ।

তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ম্যারির হাতে চাপ দিলেন। ম্যারির মুখের দিকে তাকালেন, কোনো অভিব্যক্তি আছে কী?

তিনি বললেন- আমরা হলাম প্রাচীন ডাসিয়ানসের বংশধর। যদি আপনি দু হাজার বছর আগের ইতিহাসে ফিরে যান, তাহলে দেখবেন, আমাদের ইতিহাস কত ঐতিহ্যসম্পন্ন। হ্ণ, মোঙ্গল সকলেই আমাদের দেশে পা রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রোমানিয়াকে তারা কেউ কাবু করতে পারেনি। এই জাতির আমি নেতা, তারা আমার নেতৃত্বে বিশ্বাস করে।

ম্যারি বুঝতে পারলেন, ভদ্রলোক এখন অনেক কথা বলবেন। কিন্তু সব কথা আমি শুনব কেন?

আওনেস্কু কথা বলে চলেছেন, ম্যারি চারপাশে তাকালেন। অন্তত শ-দুয়েক মানুষ এসেছেন। তিনি সকলের সঙ্গে দেখা করবেন।

সময় এগিয়ে গেল। এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে প্রেসিডেন্টের কানে কানে কিছু একটা বলল। প্রেসিডেন্টের মুখ ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি রোমানিও ভাষায় জবাব দিলেন।

ম্যারির দিকে তাকিয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন- এবার আপনাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। পরে আশা করি আবার দেখা হবে।

.

১৯.

দিন শুরু হয় কর্মব্যস্ততার মধ্যে। সারাদিন কেটে যায় এমব্যাসিতে। প্রতিবেদন পড়তে হয়। সংবাদ পাঠাতে হয়। রেসিডেন্সে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।

সেদিন ম্যারি করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন মাইক, শ্লেটের অফিসের সামনে দিয়ে, তিনি অবাক হয়ে গেলেন। মাইক শ্লেট এক মনে কাজ করে চলেছেন। দাড়ি কামানো হয়নি।

ম্যারি বললেন আপনি এখনই এসে গেছেন?

–শুভ সকাল। আপনার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আপনার অফিসে আমি যাব। কিছু ঘটনা ঘটেছে।

–আমি জানি।

–সত্যি সত্যি যখন গতরাতে আমরা চলে গিয়েছিলাম, আপনি কিছু কাগজ আপনার ডেস্কের ওপর রেখে গিয়েছিলেন। সেই কাগজগুলোকে ফটোকপি করে নেওয়া হয়েছে। মস্কোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

–হ্যায় ঈশ্বর, আমি ভুলে গেছি! কোন্ কাগজ?

–কিছু কসমেটিকসের তালিকা, টয়লেট পেপার, ব্যক্তিগত জিনিস। আপনি বোধহয় কিনতে চেয়েছেন। কিন্তু এদের কাছে সব কাগজই মূল্যবান। (

ম্যারি ঠান্ডাভাবে জিজ্ঞাসা করলেন তাহলে কী করতে হবে?

-আপনাকে আরও সংযত হতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার গতিবিধির ওপর ওদের তীক্ষ্ণ নজর আছে।

মাইক শ্লেটের কথার ভেতর সত্যতা লুকিয়ে আছে হায়, আমি কী বোকা!

ম্যারি অনেকক্ষণ হতভম্বের মতো বসেছিলেন। হা, ভবিষ্যতে আমাকে আরও সতর্ক হতে হবে।

মাইক ফিরে এলেন। ধূমায়িত কফি নিয়ে।

–এখানে আমেরিকান স্কুল আছে? বেথ আর টিমের পড়াশোনা শুরু করতে হবে। ম্যারি জানতে চাইলেন।

–আমি তার ব্যবস্থা করেছি। ফ্লোরিয়ান সকালে নিয়ে যাবে, বিকেলে ফেরত দিয়ে যাবে।

ধন্যবাদ।

–ছোট্ট স্কুল, একশোর মতো ছাত্র, কিন্তু স্কুলটা খারাপ নয়। নানা প্রান্ত থেকে ছাত্ররা এসেছে। কানাডা, ইজরায়েল, নাইজেরিয়া থেকে। মাস্টারমশাইরা চমৎকার।

মাইক তখনও কফি খাচ্ছেন। বললেন– দেখবেন, ভবিষ্যতে আমি কিন্তু আপনার ভালো বন্ধু হতে পারি। গতরাতে আমাদের নেতার সাথে ভালোই আলোচনা হয়েছে, তাই তো?

প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু? হা, তাঁকে খুব ভদ্র স্বভাবের বলে মনে হল।

-হ্যাঁ, তিনি ভালোমানুষ। কিন্তু কারও প্রতি বিরক্ত হলেই সর্বনাশ। তাহলে তিনি রেগে গিয়ে মাথাটা কেটে ফেলবেন।

ম্যারি ভয়ে ভয়ে বললেন- বাবল রুমে বসে এসব কথা আলোচনা করা উচিত কী?

–ঠিকই বলেছেন, তবে সব সময় নয়। যখন পরিষ্কার করার লোকগুলো আসে, তারা কান খাড়া করে রাখে। কে জি বি-র গুপ্তচররা সজাগ, পুলিশও সতর্ক নজর রেখেছে।

ম্যারির মনে হল, তার শরীরের ভেতর শীতল শিহরণ।

–আপনি কি জানেন, একজন রোমানিওকে যে-কোনো সময় আটক করা যেতে পারে? যদি তিনি কোনো পিটিশন দেন তাহলে সেটা মস্ত বড়ো অপরাধ। সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা– না, ভাবাই যায় না।

ম্যারি এর আগে খবরের কাগজে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়েছেন। তিনি জানেন সাম্যবাদী দেশে এটাই ব্যবস্থা।

ম্যারি বললেন- এখানে আইনের শাসন নেই?

–না, লোক দেখানো আইনি বিচার চলে বটে, কিন্তু কী হবে, তা সবাই জানে।

ম্যারি আবার জানতে চাইলেন- পালিয়ে যাবার রাস্তা নেই?

–না।

সত্যিই মাইক এ ব্যাপারে কত কিছু জানেন!

মাইক বললেন– টাইপরাইটার ডিক্রির কথা শুনেছেন। এটা হল আওনেস্কুর সর্বশেষ অস্ত্র। তিনি এই দেশের সমস্ত টাইপরাইটারকে নিবন্ধভুক্ত করতে চাইছেন। যে মুহূর্তে টাইপরাইটারকে নিয়ে যাওয়া হয় নিবন্ধকরণ করার জন্য, সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করা হয়। অর্থাৎ এখন এই দেশে তথ্য সরবরাহের ব্যাপারটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আওনেস্কু মানুষের মনের ভেতর আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চলেছেন।

মাইক শ্লেট ম্যারির দিকে তাকালেন- এর মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে, কেমন?

.

নতুন কয়েকটি কেবল এসেছে, ওয়াশিংটন থেকে। মাইক শ্লেটের কথা মনে পড়ছে। উত্তেজক এবং উদ্ধত। কিন্তু আমার ছেলেমেয়ের জন্য কত চিন্তিত। একটা মানুষের মধ্যে এতগুলো সত্তা? জানি না, কিন্তু এখানে মাইক শ্লেটকে বিশ্বাস করতেই হবে।

.

ম্যারি জানতে পারলেন, তার অবর্তমানে বেশ কিছু মিটিং অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিনি রোমানিও কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে লাঞ্চ করতে গিয়েছিলেন, যখন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পৌঁছোলেন, শুনলেন প্রেসিডেন্ট তাকে ডেকেছেন। তিনি ভাবলেন, এমব্যাসিতে ফিরে আসবেন। সেক্রেটারিকে বললেন- আমি তিনজনের সঙ্গে কথা বলব, লুকাস, ডেভিড আর এডি। ওঁদের তৈরি থাকতে বলুন।

ডরোথি স্টোন ইতস্তত করে জবাব দিলেন– ওঁরা তো এখন কনফারেন্সে ব্যস্ত আছেন ম্যাডাম।

কাদের সঙ্গে?

অন্য সেক্রেটারিদের সঙ্গে।

–আমাকে ছাড়া স্টাফেদের মিটিং হচ্ছে?

–হ্যাঁ, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

–এটাই কি প্রথমবার?

না, আগেও হয়েছে।

ডরোথি বুঝতে পারলেন, এবার ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে যাবে।

তিনি বললেন- আপনার সেক্রেটারিরা আপনার সম্মতি ছাড়া অনেক সময় কেবল পাঠিয়ে থাকেন।

তার মানে?

রোমানিয়াতে যা হচ্ছে হোক, ম্যারি ভাবলেন, এমন হলে আমি এখানে আর থাকব না।

তিনি বললেন– তিনটের সময় সবাইকে ডেকে পাঠাবেন। ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

.

ম্যারি টেবিলের এককোণে বসলেন। দেখলেন, সকলে এসেছে কিনা।

–শুভ বিকেল, ম্যারি বললেন, আমি বেশিক্ষণ সময় নেব না। আমি জানি, আপনারা সকলেই খুব ব্যস্ত। আমি জানতে পেরেছি, আমার সম্মতি ছাড়াই মাঝে মধ্যে আপনাদের মধ্যে আলোচনাসভা হয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারছি না, এটা কী করে সম্ভব?

পিনপতন নীরবতা। তারপর এক একজন করে উঠে দাঁড়ালেন। তারা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত মাইক।

ম্যারি আর ডরোথি স্টোন তখন এই ঘরে একদম একা।

 ম্যারি বললেন– আপনি কী চিন্তা করছেন?

ডরোথি জবাব দিলেন– বুঝতে পারছি, কোথাও একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে।

-ঠিক আছে, এবার আমার কাজ শুরু হবে।

নানা এমব্যাসি থেকে খবর এসেছে, বিশেষ ধরনের টাইপরাইটারে টাইপ করা হয়েছে। ম্যারি বুঝতে পারছেন, এবার নিজের লোকেদের সঙ্গে লড়াই বোধহয় শুরু হল। তিনি জানেন, সিআইএ-র ওপরেও নজর রাখা উচিত। সিআইএ অন্তরালে নেই তো?

সেই রাতে সারাদিন কী কী ঘটে গেল, ম্যারি ভাবতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেন? আমার ওপর নজর রাখা হয়েছে কেন? আমার বাসস্থান রেসিডেন্স সেখানে সতর্ক দৃষ্টি! এতজন গুপ্তচরের নজর! ম্যারি ভাবতে থাকলেন।

সকাল হয়েছে। প্রাতরাশের আসর, বেথ আর টিম ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ম্যারির কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে- রোমানিয়ানরা অত্যন্ত ভদ্র। মনে হয়, তাদের মধ্যে জ্বলন্ত দেশপ্রেম আছে।

বেথ আর টিম পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে।

ম্যারির কণ্ঠস্বর তখনও চড়া আমি শেখাব রোমানিয়ানদের, কীভাবে সুসভ্য হয়ে উঠতে হয়।

.

পরের দিন সকালবেলা।

জেরি ডেভিস বললেন আমি জানি না কী করে এটা করতে হবে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আমাদের এবার নিজের ঘর গোছাতে হবে।

ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, আপনি সে কাজটাই শুরু করুন।

.

স্টাফ মিটিং শেষ হয়ে গেল। মাইক শ্লেট বললেন আপনি আজ থেকেই তৎপর হোন ম্যাডাম। না হলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।

ম্যারির কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন– হ্যাঁ, এবার সকলের দিকে নজর দিতে হবে।

মাইক তখন বললেন- আপনি কাজের ধারা ভাগ করে দিন। সবথেকে আগে

রাশিয়ান এমব্যাসির সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাই তো?

–হ্যাঁ, কিন্তু আমি আপনাকে বলছি… ।

–মিঃ শ্লেট, যদি আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হয়, আমি জানাব কেমন?

মাইক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং উঠে দাঁড়িয়ে বললেন- ঠিক আছে, আপনার যেমন অভিরুচি ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

.

ম্যারি রাশিয়ান এমব্যাসিতে গেলেন। অনেকের সাথে ইন্টারভিউ নেবার কথা ছিল। নিউইয়র্ক থেকে একজন সেনেটর এসেছিলেন। তিনি বিদ্রোহীদের সম্পর্কে সবশেষ তথ্য চেয়েছেন। নতুন সেনেটরের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ম্যারি অফিসে যেতে উদ্যত হলেন, ডরোথি স্টোন বললেন– ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, জেমস স্টিকলি ওয়াশিংটন থেকে ফোন করেছেন।

ম্যারি ফোন তুললেন- হ্যালো মিঃ স্টিকলি।

 স্টিকলির কণ্ঠস্বর আগুনের মতো আপনি কী করছেন?

-কেন?

–আপনি কি জানেন, আপনার খামখেয়ালিপনায় কত ক্ষতি হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে সেক্রেটারি অফ স্টেট একটা অভিযোগপত্র পেয়েছেন। ড্যাবনের রাষ্ট্রদূত আপনার ব্যবহারে অত্যন্ত রেগে গেছেন।

এক মিনিট, ম্যারি বললেন, কোথাও বোধহয় ভুল হচ্ছে, আমি ড্যাবনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলিনি।

–হ্যাঁ, সেটাই আপনার ভুল। স্টিকলির কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কিন্তু আপনি সোভিয়েত ইউনিয়ানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন।

–হ্যাঁ, আমি সকালে সেখানে গিয়েছিলাম।

আপনি কি জানেন না, কীভাবে এই দূতাবাসগুলির মধ্যে মর্যদা বণ্টন করা হয়েছে?  আপনাকে জানিয়ে রাখা উচিত, রোমানিয়াতে ড্যাবনের দূতাবাস সবথেকে আগে স্থাপিত হয়েছিল। সবথেকে শেষে এসকোনিয়ার দূতাবাস। এখানে ৭০টি দেশের দূতাবাস আছে। আপনাকে সেই মতোই যেতে হবে, বুঝলেন? আর কোনো প্রশ্ন নয়।

–না, স্যার, আমি অত্যন্ত দুঃখিত।

 –দেখবেন ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা কখনও না ঘটে।

.

মাইক শ্লেটের কানে খবরটা পৌঁছে গেল। তিনি ম্যারির অফিসে এলেন এবং বললেন– আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম।

মিঃ শ্লেট,…

–ব্যাপারটা কিন্তু খুবই খারাপ হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, এই ধরনের ঘটনা কখনোই অভিপ্রেত নয়। ১৬৬১ সালে এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছিল। আমি বলি কী, আপনি এক্ষুনি ক্ষমা প্রার্থনা করে একখানা চিঠি লিখুন।

.

একটির পর একটি খারাপ খবর আসছে। একদিন ছেলেমেয়ে বলল–মম, কাগজে তোমার সম্পর্কে খবর বেরিয়েছে।

মধ্যরাত। ম্যারি স্টানটন রজার্সকে ফোন করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরলেন– আমার প্রিয় অ্যাম্বাসাডর, খবর কী?

–আমি ভালো, আপনি কেমন আছেন স্টান?

-এখন আটচল্লিশ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে প্রতিদিন। আমি কালকে অভিযোগ জানাব। তবে কাজের প্রত্যেকটা মুহূর্তকে আমি উপভোগ করছি। আপনি কেমন আছেন? কোন সমস্যা? আমার সাহায্য লাগবে?

এটা কোনো সমস্যা নয়, আমি একটা ব্যাপার জানতে চাইছি, আপনি ভোগ পত্রিকার গত সপ্তাহের সংখ্যায় আমার ফটোগ্রাফ দেখেছেন? ছেলেমেয়েদের ছবিও ছাপা হয়েছিল।

স্টানটন বললেন- হ্যাঁ, এটা চমৎকার।

–আমি যতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি, অন্য কোনো রাষ্ট্রদূত এতটা পায়?

-সত্যি কথা বলব? অন্য কেউ এতটা জনপ্রিয়তা পায় না। আসলে আপনি হলেন আমাদের মুকুট। প্রেসিডেন্ট এলিসন এইভাবেই বিরুদ্ধবাদীকে স্তব্ধ করতে চাইছেন। তাই আমরা আপনার ভাবমূর্তিকে আকাশ ছোঁয়া করে দিতে চাইছি।

–এতে আমি খুবই খুশি হব কী?

ভালোভাবে কাজ করুন।

কিছু কথাবার্তা। তারপর গুডবাই।

তাহলে? মাননীয় প্রেসিডেন্ট এইসব প্রচারের অন্তরালে আছেন? ম্যারি ভাবলেন। ঠিক আছে, দেখাই যাক না শেষ কোথায়।

.

ইভান্স স্টেলিয়ান প্রিজন। বাইরের লোকের কাছে নিষিদ্ধ জগৎ। সরু অলিন্দ পথ, বিষণ্ণতার ছাপ। এখানে এলেই মনে হয়, নরকের হাতছানি। একজন রক্ষী এসে ম্যারিকে ছোট্ট অতিথিকক্ষে নিয়ে গেল।

-সে ওখানে আছে, আপনাকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হকে।

-ধন্যবাদ, ম্যারি ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। হানা মারফি বসেছিল একটা ছোট্ট টেবিলের ওপর। তার হাতে শেকল। তাকে বন্দি করা হয়েছে।

এডি মালজ বলেছেন- ও হল উনিশ বছরের এক সুন্দরী ছাত্রী, তাকে দেখলে মনে হয়, সে বুঝি আরও দশ বছর বেশি বয়সের। তার মুখ বিবর্ণ এবং গম্ভীর। তার চোখ লাল ও কান্নাভেজা। তার চুল চিরুনিবিহীন।

ম্যারি বলল– আমি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত।

 হানা মারফি তাকাল। তারপর কুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

 ম্যারি তার মাথায় হাত রাখলেন- আমি দেখছি কী করা যায়?

না-না, আমাকে আসছে সপ্তাহে শাস্তি দেওয়া হবে। আমাকে যদি এই নরকে থাকতে হয়, তা হলে আমি মরে যাব। পাঁচ বছর

টেনে টেনে সে বলল।

 ম্যারি জানতে চাইলেন- ঠিক আছে, কী হয়েছে বলো তো?

হানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে আমি একজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। সে রোমানিয়ার বাসিন্দা। আমি ছিলাম একা। আমরা পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলি। আমার এক বান্ধবী আমাকে মারিজোয়ানার বড়ি দিয়েছিল। তার সঙ্গে বসে টেনেছিলাম। আমরা আবার ভালোবাসার খেলা খেলি। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন সকাল হল, ঘুম ভাঙল, তার চিহ্ন মাত্র নেই। পুলিশ এসে গেছে। আমি সম্পূর্ণ নগ্ন। তারা আমাকে পোশাক পরতে বলল। এখানে নিয়ে এল। বলেছে, আমার নাকি পাঁচ বছরের জেল হবে।

না, আমি দেখছি কী করতে পারি।

ম্যারি ভাবলেন, লুকাসের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু আমি কি কিছু করতে পারব? অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিছুই করা যায়নি। এখানে এই ব্যাপারে আইন খুবই শক্ত। মেয়েটি যদি রোমানিয়ার নাগরিক হত, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।

ম্যারি হানার মুখের দিকে তাকালেন আমার ক্ষমতা বলে যতটা করা সম্ভব আমি তাই করব।

ম্যারি হানা মারফির গ্রেপ্তার সংক্রান্ত পুলিশ প্রতিবেদন পড়লেন। এটি সই করেছেন ক্যাপটেন আউরেন। তিনি হলেন সিকিউরিটি বাহিনীর প্রধান। নাঃ, অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। নামটা খুবই চেনা-চেনা লাগছে। জেমস স্টিকলির সঙ্গে কথা হল। ওয়াশিংটনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হল। না, কোনো রাস্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত পরের দিন সকালে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মোলাকাতের ব্যবস্থা হল।

 মাইক শ্লেট রুক্ষ্মভাবে বলেছিলেন- আপনি মিথ্যে সময় নষ্ট করছেন। উনি হলেন এক পর্বতের মতো। ওঁনাকে নড়ানো সম্ভব নয়।

.

আউরেনকে এক ছোটোখাটো চেহারার মানুষ বলা যায়। মুখ ভাবলেশহীন। মাথায় চকচক করছে টাক। নাকে কলঙ্কের ছাপ। কোনো সময় কেউ তার নাক ভেঙে দিয়েছিল, এখনও জায়গাটা ফুলে আছে। আউরেন এমব্যাসিতে বিকেলবেলা এলেন। নতুন আমেরিকান অ্যাম্বাসাডর সম্পর্কে তিনি কৌতূহলী।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক?

–হ্যাঁ, আমি হানা মারফির কেসটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি।

–হ্যাঁ, ও তো ড্রাগ চালানকারী। রোমানিয়াতে এই সম্পর্কে আইন খুবই কড়া।

ঠিক আছে, আমি তা জানি। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে পারি। সেখানে এই সংক্রান্ত আইন আরও কড়া।

ক্যাপ্টেন বললেন– তাহলে? আপনি এব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত হবেন তো?

–হ্যাঁ, কেউ যদি নিষিদ্ধ ড্রাগ কেনাবেচা করে, তাহলে তার জেল হওয়াই উচিত। কিন্তু হানা মারফির ব্যাপারটা একদম আলাদা। সে তো ড্রাগ বিক্রি করেনি। তাকে কেউ মারিজোয়ানা দিয়েছিল। বেচারি প্রেমিকের সঙ্গে ভাগ করে ড্রাগ টেনেছিল।

ব্যাপারটা একই।

না ক্যাপ্টেন, তার প্রেমিক হল আপনাদের পুলিশ ফোর্সের একজন লেফটেন্যান্ট। সে নিয়মিত মারিজোয়ানা সেবন করে। তাকে কি শাস্তি দেওয়া হয়েছে?

–কিন্তু সে কে? কোনো প্রমাণ আছে?

–এই লেফটেন্যান্টের স্ত্রী এবং তিনটি সন্তান আছে।

ক্যাপ্টেন অবাক হয়ে তাকালেন– ওই আমেরিকান মেয়েটি কি তার শয্যাসঙ্গিনী ছিল?

ক্যাপ্টেন, হানা মারফি উনিশ বছরের এক তরুণী ছাত্রী। আর লেফটেন্যান্টের বয়স পঁয়তাল্লিশ। তাহলে দেখুন কে কাকে প্রতারিত করেছে?

এক্ষেত্রে বয়সটা কোনো ব্যাপার নয়।

–লেফটেন্যান্টের স্ত্রী কি এইসব ব্যাপার সম্পর্কে জানেন?

ক্যাপ্টেন তাকালেন কী করে জানবেন?

–আমি বেশ বুঝতে পারছি, এটা একটা ফাঁদ। পুরো ব্যাপারটা ভালো করে চিন্তা করার চেষ্টা করুন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কিন্তু আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

এখন মনে হয় আলোচনা করার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

এবার তুরূপের শেষ তাস– কারণ ওই লেফটেন্যান্ট হলেন আপনার জামাই। তাই তো?

ক্যাপ্টেন রেগে গেছেন– কখনোই তা নয়, আমি সবসময় সুবিচারের চেষ্টা করি।

–আমিও তাই চাই। ম্যারি বললেন।

 রেকর্ড দেখা গেছে, ওই লেফটেন্যান্ট ভদ্রলোকের বিচ্ছিরি স্বভাব। তিনি তরুণ-তরুণী পর্যটকদের কাছে আসার চেষ্টা করেন। তাদের সাথে বন্ধুত্ব করেন। তাদের দিয়ে অন্যায় কাজ করিয়ে নেন। তারপর পুলিশের হাতে জমা দেন। এর বিনিময়ে মোটা টাকা পেয়ে থাকেন।

ম্যারি বললেন– আপনার কন্যা বোধহয় স্বামীর এই অন্যায় আচরণ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আপনি কীভাবে ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছেন? আমার মনে হয়, হানা মারফিকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। সে যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাপ্টেন, আপনি এ ব্যাপারে কী বলবেন?

ক্যাপ্টেন বললেন- আপনি খুব আকর্ষণীয় চরিত্রের মহিলা। না, আপনার মতো বুদ্ধিমতীর সঙ্গে এর আগে আমার কখনও টক্কর হয়নি।

–আপনিও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। আমি আজ বিকেলে মিস মারফিকে আমার অফিসে দেখতে চাইছি। বুখারেস্ট থেকে ওয়াশিংটনগামী আগামী উড়ানে সে এক যাত্রী হবে।

–আমার যেটুকু প্রভাব আছে, আমি তা খাটাবার চেষ্টা করব।

–আমি জানি, আপনি কতটা প্রভাবশালী।

ধন্যবাদ।

.

পরের দিন সকাল। কৃতজ্ঞ হানা মারফিকে দেখা গেল হাসি মুখে বসে থাকতে।

.

মাইক শ্লেট জানতে চেয়েছিলেন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে এটা কী করে করলেন?

–আমি আপনার উপদেশ মেনেছিলাম, আমি ওঁনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছি।

.

২০.

বেথ এবং টিমের স্কুল এগিয়ে চলেছে। ম্যারি এখন কাজে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

স্কুলের ব্যাপারে খোঁজখবর নেবার সময় বিশেষ হয় না তার। জানতে পেরেছেন স্কুলে ইংরেজি শেখানো হয়। কিন্তু এখানকার উচ্চারণটা একেবারে অন্যরকম। আমেরিকার ছেলেমেয়েদের শিখতে খুবই অসুবিধা হয়। কিন্তু কী আর করা যাবে? এসব ব্যাপারের সঙ্গে এখন আপস করতেই হবে।

.

পরের দিন সকালবেলা, মাইক ম্যারির অফিসে এলেন।

মারি বললেন- বেথ আর টিমের স্কুলের ব্যাপারে কিছু আলোচনা আছে।

মাথা নেড়ে মাইক বলেছিলেন– বিদেশে এসে মানিয়ে নেওয়া খুব একটা সহজ নয়। কিন্তু আপনার ছেলেমেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আশা করি তারা এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবে।

মাইকের কি কোনো সন্তান আছে? ম্যারির হঠাৎ মনে হল। মাইকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। দেখা যাক, এটা আমি জানতে পারি কিনা।

শুরু হল অন্য এক অভিযান।

.

শনিবার বিকেলবেলা ম্যারি তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক ক্লাবে গিয়েছিলেন। সেখানে বিভিন্ন কূটনীতিকরা আসেন। আলাপ-আলোচনা হয়। ছোটোখাটো বিনোদন, ইন্ডোর গেমস, আরও কত কী!

মাইক শ্লেটের সঙ্গে এক মহিলা বসে ড্রিঙ্ক করছিলেন। ম্যারি চিনতে পারলেন, ডরোথি স্টোন। ম্যারি অবাক হয়ে গেলেন– কী আশ্চর্য? আমার একান্ত সচিব কিনা শত্রুর সাথে হাত মিলিয়েছেন? তিনি বুঝতে পারলেন, ডরোথি এবং মাইক একে অন্যের প্রতি অনুরক্ত। তার মানে, ডরোথির ওপর বেশি বিশ্বাস করা উচিত নয়।

একটি টেবিলে হ্যারিয়েট বসেছিলেন। ম্যারি সেখানে গিয়ে বললেন- আমি এলে কি আপনি দুঃখ পাবেন?

হ্যারিয়েট বললেন না-না, সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, চলতে পারে।

ধন্যবাদ, আমি স্মোক করি না।

–এদেশে বাস করতে গেলে আপনাকে কিছু না কিছু নেশা করতেই হবে। হ্যারিয়েটের উত্তর।

–কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!

–এটা সম্পূর্ণ বিদেশ, নেশা ছাড়া আপনি এখানে কী করবেন? যদি আপনি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে চান, নার্সকে সিগারেট দিতে হবে। এখানে সব কাজের জন্যই কিছু না কিছু ঘুষ লাগে। আর সিগারেট হল সহজ পথে লক্ষ্যে পৌঁছোনোর ছাড়পত্র।

-কিন্তু কেন?

হ্যারিয়েট বললেন– এই দেশে সবকিছুরই অভাব। এটাই হল সাম্যবাদী দেশের সমস্যা। মানুষের চাহিদা বেশি, কিন্তু জোগান সে তুলনায় কম।

হতে পারে, ম্যারি ভাবলেন। তাকিয়ে দেখলেন, আড়চোখে, মাইক এবং ডরোথি কোনো একটা আনন্দের খবরে হেসে উঠেছেন। একটু বাদে তারা দুজন ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলেন। ম্যারি ভাবলেন, ওরা এবার কোথায় চলেছেন?

বাড়ি ফিরতে রাত হল। সারাদিন এমব্যাসিতে কর্মব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেছে। ম্যারি ভাবলেন, এবার স্নানঘরে ঢুকবেন। পোশাক পালটাবেন। দিনটাকে গুডবাই বলবেন।

এমব্যাসিতে প্রত্যেকটা মিনিট তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। নিজের বলতে সময় পাওয়া যায় না। রেসিডেন্টে এলে মনে হয় জীবন কত কল্লোলময়।

একবার মধ্যরাতে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। রাত দুটো বেজেছে। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে কিচেনে চলে গিয়েছিলেন। রেফ্রিজারেটর খুললেন। শব্দ পাওয়া গেল। মিহাই, বাটলার, পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। রসিকা, ডেলিয়া, এবং কারমানকেও দেখা গেল।

মিহাই জিজ্ঞাসা করলো- ম্যাডাম, এত রাতে?

-এমনি। আমি কোনো একটা খাবার খুঁজছিলাম।

 শেফ মা বললো– ম্যাডাম, আমাকে বলতে পারতেন তো। আমি তৈরি করতাম।

ম্যারি বুঝতে পারলেন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ছোটোখাটো ইচ্ছেগুলোকে এখন থেকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে।

পরদিন গল্পটা ছেলেমেয়েকে করেছিলেন। তারা হোহোহা করে হেসে উঠেছিল। সত্যিই তো, এই অস্বস্তিকর পরিবেশ, একটু সময় লাগবে মানিয়ে নিতে।

.

ম্যারি তাড়াতাড়ি অফিসে এসেছেন। মাইকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অলিন্দপথে। মাইকের মুখ ভার।

–কোনো দুর্ঘটনা? ম্যারি জানতে চাইলেন।

–আমাদের একজন কর্মী খুবই অসুস্থ।

–কে?

মেরিন।

কী হয়েছে?

মনে হচ্ছে পেটের কোনো অপারেশন করতে হবে।

–তাহলে এখনই তো হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত?

 –এখানে নয়, ওকে বোম কিংবা জুরিখে নিয়ে যেতে হবে।

–কেন?

–আমেরিকান এমব্যাসির কোনো কর্মী এই দেশের হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় না। তারা সবসময় ভয় পায়। এখানে চিকিৎসার পদ্ধতি খুব একটা ভালো নয়। এটাই হল হোম ডিপার্টমেন্টের গোপন রুল। ওঁকে উড়িয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব।

–এমব্যাসিতে একজন ডাক্তার থাকা উচিত।

না, আমরা তৃতীয় শ্রেণির দূতাবাস। আমাদের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তাতে ডাক্তারের ফি ধরা হয় না। তাই আমরা এই ব্যবস্থাটাই চালু রেখেছি।

ম্যারি কাগজে সই করলেন। মেরিনকে দেখতে গেলেন। তার মাথায় হাত রেখে বললেন- তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।

দু-ঘণ্টা কেটে গেছে, মেরিন জুরিখগামী প্লেনে উঠে বসেছে।

পরের দিন সকালে ম্যারি মাইকের কাছে জানতে চাইলেন মেরিনের অবস্থা কেমন?

–অপারেশন হয়ে গেছে। সুস্থ হতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে।

ম্যারি ভাবলেন, সত্যি, মাইক, একেবারে ঠান্ডা মাথার মানুষ। কোনো বিপদ তাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে না।

.

২১.

রোজ সকালে সময় মতো ম্যারি এমব্যাসিতে আসেন। মাইক শ্লেট তারও আগে পৌঁছে যান। এমব্যাসির পার্টিতে মাইককে খুব একটা দেখা যায় না। ম্যারির কেবলই মনে হয়, মাইক নিশ্চয়ই প্রতি রাতে ব্যক্তিগত বিনোদনের আসরে যোগ দেন।

মাইকের চরিত্রের প্রতিটি ঘটনা রহস্যাবৃত। এক বিকেলবেলা বেথ এবং টিমকে নিয়ে ম্যারি ফ্লোরেজেন পার্কে গেলেন। এর জন্য ম্যারি একটু আগেই বেরিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন মাইক ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছেন। তারা তিনজন স্কেটিং-এর আসরে মেতে উঠেছেন। মাইক সাবধানে শেখাচ্ছেন কীভাবে স্কেট খেলায় অংশ নিতে হয়।

ম্যারি ভাবলেন, ছেলেমেয়েদের সতর্ক করবেন। কিন্তু কীভাবে?

.

পরের দিন সকাল। ম্যারি অফিসে এসেছেন।

মাইক বললেন কিছুক্ষণের মধ্যে একদল প্রতিনিধি আসবেন। দু ঘণ্টার মধ্যে।

-কোথা থেকে?

–চারজন সেনেটর আসছেন, আমেরিকা থেকে, সঙ্গে স্ত্রী এবং রক্ষীরাও থাকবেন। তারা সকলে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি প্রেসিডেন্ট আওনেস্কুর সাথেও একটা সময় ঠিক করে রেখেছি। হ্যারিয়েটের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হ্যারিয়েট সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবে।

–অনেক ধন্যবাদ।

–কফি আনব নাকি?

–আনলে ভালো হয়।

এই ভদ্রলোককে দেখে ম্যারি অবাক হয়ে যাচ্ছেন। কফিটা চমৎকার! ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না, এই লোকটির আসল উদ্দেশ্য কী?

.

লা বোকা। অ্যাঞ্জেল আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দেখা হল জলের ধারে। আবেদনময়ী পোশাক পরা মেয়েটি। শরীরের সাথে খাপ খেয়ে গেছে এমন ব্লাউজ। জিনস, যার অনেকখানি উন্মুক্ত। বয়স বছর পনেরো বেড়ে গেছে বুঝি। মেয়েটি সুন্দরী নয়, কিন্তু তাতে অ্যাঞ্জেলের কিছু যায়-আসে না।

–এসো আমরা প্রেমের খেলায় মেতে উঠি।

 বুঝতে পারা যাচ্ছে, মেয়েটি সস্তার অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। ছোট্ট একটা ঘর। সবখান জুড়ে বিছানা। দুটো চেয়ার, একটা আলোলা। আর কিছু নেই।

তাড়াতাড়ি করো। আমি এখনই তোমাকে উলঙ্গ দেখতে চাই।

মেয়েটি কিন্তু কিন্তু করছিল। অ্যাঞ্জেল সম্পর্কে সে যা শুনেছে, তাতে ভয় তো জাগতেই পারে। কিন্তু দিনটা মোটেই ভালো নয়। আজ টাকা আনতেই হবে। না হলে তাকে মার খেতে হবে। তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে পোশাক খুলতে শুরু করল মেয়েটি।

অ্যাঞ্জেল তাকিয়েছিলেন। প্রথমে ব্লাউজ, তারপর জিনস, ভেতরে কিছু নেই। কিন্তু শরীরটা, রক্তাল্পতা এবং পাতলা।

জুতো পরে থাকো। এখানে এসো, হাঁটু মুড়ে বসো।

মেয়েটি তাই করল।

–এবার? এবার আমি যা বলব তাই করবে তো?

মেয়েটি আবার কিন্তু কিন্তু ভাব দেখিয়েছে। চোখের তারায় আতঙ্ক না, আমি কি তাই পারব?

অ্যাঞ্জেল সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আঘাত করলেন। মেয়েটি মাটির ওপর পড়ে গেল। একটা কান্না ভেসে আসছে। অ্যাঞ্জেল তার চুলের মুঠি ধরেছেন। তাকে বিছানাতে ফেলে দিলেন। মেয়েটি আর্তনাদ করছে। অ্যাঞ্জেল তখনও নির্দয়ভাবে প্রহার করছেন।

অ্যাঞ্জেল বললেন- তোমার এই আর্তনাদের শব্দটা আমাকে উত্তেজিত করে তুলবে।

 ভীষণ ঘুষির আঘাত। নাকটা ভেঙে গেল। তি

রিশ মিনিট কেটে গেছে। মেয়েটি অচেতন, বিছানাতে পড়ে আছে।

অ্যাঞ্জেল হাসলেন, তারপর কিছু পয়সা ছুঁড়ে দিলেন বিছানার ওপর। ঘর থেকে বেরিয়ে। এলেন। পরমুহূর্তে রাস্তায় তাকে দেখা গেল।

.

প্রতিটি মুহূর্তকে ম্যারি কাজে লাগাতে চাইছেন। তারই মধ্যে কিছুটা সময় পেলেই ছেলেমেয়ের সঙ্গে থাকেন। অনেক জায়গায় ঘুরে আসা হল। কতগুলো জাদুঘর, পুরোনো চার্চ, একদিন ড্রাকুলার ক্যাসেল থেকেও ঘুরে এলেন। ওটা ট্রানসিলভেনিয়াতে অবস্থিত। বুখারেস্ট থেকে একশো মাইল দূরের পথ।

ফ্লোরিয়ান বলতে চেষ্টা করেছিলেন কাউন্টের কোনো দোষ নেই। তিনি ছিলেন এক মহান নেতা, তুর্কিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

টিম বলেছিল– আমি শুনেছিলাম, সে খালি মানুষের রক্ত চুষে খায়। আর মানুষকে হত্যা করে।

ফ্লোরিয়ান বলেছিলেন– না, এটাই দুর্ভাগ্য। তাকে আত্মারা আচ্ছন্ন করেছিল। তিনি স্বৈরতান্ত্রিক শাসকে পরিণত হন। তাই বোধহয় এত উপকথার জন্ম হয়েছে। তিনি কিন্তু ভ্যাম্পায়ার ছিলেন না। আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা ব্রামস্টোকার তাকে নিয়ে গল্প লিখেছেন উপকথার ওপর ভিত্তি করে। ছোট্ট একটা বই, কিন্তু তাতেই উনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। এই জন্যই কত মানুষ জায়গাটা দেখতে আসে।

ব্রাম ক্যাসেল মস্ত বড়ো পাথরের দুর্গ, পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের চিহ্ন আঁকা। তবুও গেলে গা ছমছম করে।

এখানে কাউন্ট ড্রাকুলা তার শিকারদের হত্যা করতেন। রক্ত চুষে খেতেন।

গাইডের কণ্ঠস্বরে রহস্য।

ঘরটায় বাতাস ঢোকে না, সূর্যের আলোও ঢোকে না। দেখা গেল, টিমের মুখে ভয় এবং আতঙ্ক।

কখন এখান থেকে বাইরে যাব?

ভীত সন্ত্রস্ত টিম জানতে চেয়েছিল।

.

ছ সপ্তাহ অন্তর আমেরিকান এয়ারফোর্সের সি-১১ প্লেন বুখারেস্টের উপকণ্ঠে একটি ছোট্ট অবতরণ ক্ষেত্রে নেমে আসে। এই প্লেনে খাবার থাকে। থাকে এমন কিছু জিনিস যা বুখারেস্টে পাওয়া যায় না। আমেরিকান এমব্যাসিতে যাঁরা চাকরি করেন না, তাদের সুখ-সুবিধার জন্যই এমনটি করা হয়।

একদিন সকালবেলা, ম্যারি এবং মাইক কফি খাচ্ছিলেন।

মাইক বললেন- আজ আমাদের প্লেন আসবে। চলুন আমি এয়ারপোর্টে যাব। আপনি সঙ্গে যাবেন কী?

ম্যারি যেতে চাইছিলেন না। আজ সারাদিন অনেক কাজ আছে। এভাবে সময় নষ্ট করে কী হয়? কিন্তু মাইক তো কখনও অকাজে মেতে ওঠেন না। তাহলে?

–আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

গাড়ি এগিয়ে চলল এয়ারফিল্ডের দিকে। পথে যেতে যেতে ভঁরা নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন।

যখন তারা এয়ারপোর্টে পৌঁছোলেন একটা গেট খুলে দেওয়া হল। লিমুজিন ভেতরে ঢুকে গেল। আরও দশ মিনিট কেটে গেল। সি-১১ ধীরে ধীরে ল্যান্ড করছে।

অনেক রোমানিও এসে জমা হয়েছেন। তারা তাকিয়ে আছেন ওই উড়ানপাখির দিকে।

–এইসব মানুষ কেন এসেছে?

–স্বপ্ন দেখতে। তারা এমন কিছু জিনিস দেখবে, যা জীবনে কখনও দেখতে পাবে না। প্রত্যেক বার এমন ঘটনাই ঘটে। যখন প্লেন আসে, এভাবেই উৎসাহী মানুষ চারপাশে ভিড় করে।

ম্যারি তাকালেন ওই সমস্ত মানুষের মুখের দিকে। তার মুখে কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা ।

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য!

–এই প্লেনটা ওদের কাছে আশার প্রতীক। এটা কিন্তু কারগো বিমান নয়, এটা একটা স্বাধীন দেশকে প্রতীকায়িত করছে। যে দেশের স্বপ্ন এরা সকলেই দেখে থাকে।

–আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?

–আমি আপনাকে আসল রোমানিয়ার ছবিটা দেখাব বলেই এখানে এনেছি। এখানে এলে তবেই আপনি বুঝতে পারবেন, প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু যা বলেন, তার সবটাই মিথ্যে শুধু মিথ্যে।

.

প্রত্যেক দিন সকালে ম্যারি যখন কাজে আসেন, তিনি দেখতে পান, বিভিন্ন জায়গাতে মানুষের ভিড়। বিশেষ করে এমব্যাসির সামনে। নানা সমস্যা নিয়ে মানুষ এখানে আসেন। ছোটো ছোটো সমস্যা, একজন কনসাল হয়তো তার সমাধান সূত্র জানেন। কিন্তু একদিন সকালে তিনি দেখলেন, অনেক মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।

তিনি দ্রুত মাইকের ঘরে চলে গেলেন। জিজ্ঞাসু চোখে জানতে চাইলেন মাইক, এত মানুষের ভিড় কেন?

মাইক জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যভাবে বললেন- এঁরা রোমানিয়ার ইহুদি। এঁরা ভিসার জন্য আবেদন করেছেন।

বুখারেস্টে ইজরায়েলের এমব্যাসি আছে। এঁরা ওখানে কেন যাচ্ছেন না?

–দুটো কারণ। প্রথমত, তারা ভাবছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলে আরও ভালোভাবে বাঁচার ঠিকানা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, তারা ভাবছেন যে, এখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাড়পত্র পাওয়া সোজা।

ব্যাপারটা আমাকে অবাক করেছে!

 –আরও অনেক দৃশ্য দেখলে আপনি সত্যি সত্যি অবাক হবেন।

ম্যারি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাকিয়ে দেখলেন, লোকগুলোর মুখের অসহায়তা। হায় ঈশ্বর, এই পৃথিবীতে কত সমস্যাই যে আছে।

.

রোজই কোনো-না-কোনো সমস্যা। আবার তার সমাধান। এছাড়া আর একটা বিষয় মনে রাখতে হয়, তা হল, সময়ের ব্যাপারটা। ওয়াশিংটনে যখন প্রখর সূর্যালোক, তখন বুখারেস্টে মধ্যরাত। মাঝে মধ্যে রাত দুটোর সময় টেলিগ্রাম আসে। টেলিফোন শব্দ করে বেজে ওঠে। ম্যারির ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারেন, সময়ের ব্যবধানের জন্য এমনটি হয়েছে।

কোনো কোনো সময় এডওয়ার্ডের কথা মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করে ম্যারি প্রার্থনা করেন। এডওয়ার্ড, তুমি দেখো, আমি চেষ্টা করছি। আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত জিততে পারব কিনা। তুমি কোথায় আছো? আমি কেন তোমাকে দেখতে পাই না? তুমি কি আমার গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছো?

.

সকালের কফি দিয়ে দিন শুরু হয়ে গেছে।

 মাইক শ্লেট বললেন একটা সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা?

রোমানিয়ান চার্চের আধিকারিকরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। উটার একটি চার্চ আপনাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু জানি না, রোমানিয়া সরকার এই ব্যাপারে সম্মতি দেবে কিনা?

–কেন?

রোমানিয়দের দেশের বাইরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না। এই ব্যাপারে একটা সুন্দর প্রবাদ আছে। আওনেস্তু একদিন তার প্রাসাদদুর্গ থেকে সূর্যকে সম্বোধন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শুভ সকাল, কমরেড সূর্য। সূর্য জবাব দিয়েছিল- আপনার আমলে রোমানিয়াতে সবাই সুখী।

সেদিন সন্ধেবেলা তিনি আবার পশ্চিমদিকে চলে গেলেন। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। তিনি বললেন, শুভ সন্ধ্যা, কমরেড সূর্য। সূর্য উত্তর দিল না।

কেন? সকালবেলা আপনি এত সুন্দরভাবে আমার সঙ্গে কথা বললেন, আর সারাদিন কথাই বললেন না। আমি তো এখন পশ্চিম দিগন্তে।

আওনেস্কু ভয় পেলেন।

 চার্চ অফিসারদের অবস্থাও এখন একই রকম। তাদের বাইরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না।

–আমি বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।

 –না, এতে আপনি সফল হবেন না।

মাইক জানতে চাইলেন– আপনি কি লোকনৃত্য পছন্দ করেন?

-কেন?

–আজকে একটা নতুন লোকনৃত্যের কোম্পানি তাদের অভিযান শুরু করছে। খুব একটা খারাপ নয়, আপনি একবার দেখে আসতে পারেন।

অবাক লাগছে, ক্রমশ অবাক লাগছে, মাইকের এই ব্যক্তিত্ব, এই পরিহাসপ্রিয়তা। না, মাইক এক উজ্জ্বল চরিত্র।

-তাহলে? ফ্লোরিয়ানকে বলব, আটটার সময় আপনাকে তুলে নিতে, কেমন?

.

বেথ আর টিম থিয়েটারে যাবার জন্য আগ্রহী নয়। বেথ তার স্কুলের এক বান্ধবীকে রাতের খাবার আসরে নিমন্ত্রণ করেছে।

বেথ বলল- আমার ইতালীয় বান্ধবী আসবে, আমি কী করে যাব?

টিমও বলল– আমি লোকনৃত্য দেখতে ভালোবাসি না।

ম্যারি হাসলেন– তাহলে ঠিক আছে, আমি না হয় একাই যাব।

কাউকে সঙ্গে নেওয়া যায় কী? অনেকগুলো নাম মনে পড়ল। না, আমাকে একাই যেতে হবে।

ফ্লোরিয়ান নীচে অপেক্ষা করছিলেন। ম্যারি বেরিয়ে এলেন।

—শুভ সন্ধ্যা, ম্যাডাম আম্বাসাডর।

–তোমাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে ফ্লোরিয়ান।

 –আমি সব সময় এমনটি থাকতে ভালোবাসি ম্যাডাম।

দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

ম্যারি জানতে চাইলেন ফ্লোরিয়ান সত্যি বলো তো, এই কাজটা করে তুমি খুশি?

ফ্লোরিয়ান আয়না দিয়ে ম্যারির মুখ দেখলেন– আমি কি মনের কথা বলব? নাকি বানানো উত্তর।

মনের কথা বলো, প্লিজ।

–একটা কথা আছে, রোমানিয়ার কোনো বাসিন্দাই মনে মনে সুখী নয়। শুধু বিদেশিরা। আপনারা যেখানে খুশি যেতে পারেন, যা ইচ্ছে তাই ভাবতে পারেন। আমরা বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছি।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে। দোকানে অসংখ্য মানুষের ভিড়।

ফ্লোরিয়ান বলতে থাকে- দেখুন, কী প্রচণ্ড ভিড়। দু-টুকরো মাংস কেনার জন্য তিন চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। অনেক মানুষকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়। সব জায়গায় একই ঘটনা। কেন বলুন তো? এর উত্তরটা আমি জানি না। কিন্তু আপনি যেন এইসব কথা কাউকে বলবেন না।

না, আমি কাউকে বলব না।

আমার স্ত্রীর বয়স কম, সে একজন ইহুদি। এখানে জাতিগত বিদ্বেষটা প্রবল।

ম্যারি সে ব্যাপারটা মেনেছেন।

কিন্তু, এই দেশটা সম্পর্কে আরও জানতে হবে।

এদেশের অনেকে ভেবে থাকে, ইহুদিরা বুঝি জন্মসূত্রে একটু বেশি সুখী। তাদের হাতে সব ভালো জিনিস তুলে দেওয়া হয়, আর স্থানীয় বাসিন্দা, তাদের প্রতি পদে অপমানিত হতে হয়।

.

রাপসোডিয়া রোমানা। জনাকীর্ণ রাস্তা। কিছু মানুষকে ফুল বিক্রি করতে দেখা গেল। প্লাস্টিকের চটি, ব্লাউজ এবং সস্তার কলম। থিয়েটারটা ছোটো। অনেক মানুষের ভিড়। একটু পরেই অনুষ্ঠানটা শুরু হবে। ম্যারি দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভেতরে ঢুকলেন। বেশ কিছুক্ষণ দেখলেন, রাতের বাতাস, পবিত্র এবং পরিষ্কার। ফ্লোরিয়ান থিয়েটারের সামনে লিমুজিন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর আমার মনে হচ্ছে, একটু সময় লাগবে। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে এখানে আসব। আপনি কি গাড়ির জন্য অপেক্ষা করবেন?

ম্যারি আকাশের দিকে তাকালেন। পূর্ণ চাঁদের আলো। সন্ধ্যাটা চমৎকার। কতদিন বুখারেস্টের রাস্তায় হাঁটেননি। একবারও কি সময় ও সুযোগ হয়েছে? তিনি হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।

–আমি একাই রেসিডেন্সে ফিরে যাব।

–হ্যাঁ, হাঁটার পক্ষে রাস্তাটা চমৎকার।

 ম্যারি তাকালেন, সেন্ট্রাল স্কোয়ারের দিকে। বুখারেস্ট এক জীবন্ত শহর। তিনি এভিনিউর দিকে হেঁটে গেলেন। তারপর পিয়াটা রোসেট্টি। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। কিন্তু পথ চিনতে পারছেন কী? চারপাশ কেমন গোলমাল হয়ে গেছে। কোন্ দিকে যাবেন?

একজনের কাছে জানতে চাইলেন– অনুগ্রহ করে বলবেন, কোন্ পথে গেলে আমি…

সব কিছু ভুলে গেছেন ম্যারি। ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। একটা ট্যাক্সি পাওয়া যাবে? গম্ভীর পায়ের শব্দ। কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। ম্যারি আরও দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছিলেন। বিশাল আকৃতির এক ভদ্রলোক, ওভারকোট পরা।

–আমি জানতে চাইছি, আপনি কি পথ হারিয়েছেন?

ম্যারির মনে আনন্দের ঝংকার। ওই ভদ্রলোক বোধহয় পুলিশে চাকরি করে।

না, আমি ফিরে যাব।

হঠাৎ একটা মোটরগাড়ির গর্জন। আর একটা গাড়ি ছুটে আসছে। গাড়িটা সামনে এসে থেমে গেল। ওই ওভারকোট পরা মানুষটি ম্যারিকে চেপে ধরেছে। ম্যারি তার নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেয়েছেন। বুঝতে পারছেন, ভদ্রলোক দৈত্যের মতো তার কোমর চেপে ধরেছে। জোর করে তাকে গাড়িতে তুলে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ম্যারি নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন।

লোকটা বলছে– এখনই গাড়িতে গিয়ে বসো।

ম্যারির চিৎকার।

একজন ভদ্রলেক ছুটে এলেন। অজানা আগন্তুক।

মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। হঠাৎ ম্যারি নিজেকে মুক্ত করলেন। ওই ভদ্রলোক ঠিক সময়ে এসেছেন। উনি প্রশ্ন করলেন– আপনি কি ঠিক আছেন? কী হয়েছিল?

ম্যারি তখনও ভয়ে কাঁপছেন। কোনোরকমে বললেন– ওরা আমাকে অপহরণ করার চেষ্টা করছিল। যদি আপনি না আসতেন…

ইউনিফর্ম পরা দুজন পুলিশ, যাক, এ যাত্রায় বোধহয় আমি প্রাণে বেঁচে গেছি।

.

২২.

সমস্ত রাত ম্যারি জেগে ছিলেন। দু চোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না। পায়ের শব্দ, আর্তনাদ, সব মিলেমিশে একাকার। কিন্তু? কে বা কারা আছে এই ষড়যন্ত্রের অন্তরালে? এটা কি নেহাত ছিঁচকে চোরেদের কাজ? দামি পোশাক অথবা দামি ব্যাগ? নাকি এর অন্তরালে অন্য কিছু আছে?

.

পরের দিন সকাল। ম্যারি অফিসে এলেন। মাইক তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার হাতে দুকাপ কফি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন থিয়েটার কেমন লাগল?

–খুবই ভালো লেগেছে। ইচ্ছে করেই ম্যারি কিডন্যাপের গল্পটা বললেন না।

–আপনার কি আঘাত লেগেছে? 

ম্যারির চোখে বিস্ময়– কী বলছেন?

যারা আপনাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল, ওরা কি আপনাকে আঘাত করেছে?

–আপনি কী করে জানলেন?

 কণ্ঠস্বরে কৌতুক ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, রোমানিয়াতে সব খবর অতি দ্রুত বাতাসের বুকে ভর দিয়ে উড়ে যায়। আপনি কাউকে না জানিয়ে এখানে চানও করতে পারবেন না।

তাই নাকি! আমি কথা দিচ্ছি, আমার বোকামির জন্য এটা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আর হবে না।

–ওরা কি আপনার কাছ থেকে কিছু ছিনতাই করার চেষ্টা করেছে?

–না।

মাইকের ভ্রূভঙ্গিতে বিস্ময় ব্যাপারটা অবাক লাগছে! আমি তো ভেবেছিলাম ছিঁচকে চোরের কাজ। অথচ আপনি বলছেন…

–আমায় কে উদ্ধার করেছে, কিছু জানেন?

না, ঠিক জানি না তো।

–কী মনে হয়, আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা কেন, করা হয়েছে?

–হয়তো এটা কারও ষড়যন্ত্র। আওনেস্কুর বিরুদ্ধবাদীরা। তারা চায় না, আমেরিকার সঙ্গে রোমানিয়ার ভালো সম্পর্ক থাকুক।

-না-না, ছিঁচকে চোরের কাজ না তো?

না, এদেশে তেমন চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে না। এখানে চোরেদের চুরি করার অপরাধে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। কোনো বিচার হয় না। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়।

তাই নাকি!

–একটা উপদেশ দেব, শুনবেন?

 মাইক শ্লেট বললেন– আপনি পদত্যাগ পত্র জমা দিন। ছেলেমেয়েকে নিয়ে জাংশনে চলে যান। সেখানেই নিরাপদে থাকতে পারবেন।

ম্যারির মুখ রাগে থমথম করছে।

–মিঃ শ্লেট, আমি একটা ভুল করেছি, ভবিষ্যতে এমন ভুল আর কখনও হবে না। আমি আপনাকে মনে করাতে চাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ইচ্ছেতে আমি এখানে এসেছি। যতক্ষণ তিনি আমাকে এই পদে বহাল রাখবেন, আমি এই কাজ করব। ভবিষ্যতে আমাকে এমন উপদেশ কখনও দেবেন না।

..আমি চাই, দূতাবাসের লোকেরা আমাকে সাহায্য করবেন। আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। আর যদি ইচ্ছে হয়, আপনি বরং দেশে ফিরে যান, কেমন?

ম্যারির সমস্ত শরীর রাগে কাঁপছে।

মাইক শ্লেট উঠে দাঁড়ালেন ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, সকালের রিপোর্ট আপনার ডেস্কে রেখে গেলাম।

.

এমব্যাসিতে সকলের মুখে এই কিডন্যাপিং-এর গল্প। এত দ্রুত খবরটা এল কী করে? ম্যারি তার উদ্ধারকর্তার নাম জানতে চাইছিলেন। একবার ধন্যবাদ জানাতে হবে। চোখ বন্ধ করলেই তিনি ওই মানুষটির মুখ দেখতে পান। কতই বা বয়স হবে? হয়তো সবেমাত্র চারের কোঠায় পা রেখেছেন। মুখের উচ্চারণ বলে দিচ্ছে, উনি হয়তো ফরাসি দেশের বাসিন্দা। হয়তো একজন টুরিস্ট, ইতিমধ্যে রোমানিয়া থেকে চলে গেছেন।

.

সমস্ত রাত ধরে ম্যারি চিন্তা করলেন। ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না, কীভাবে এই ঘটনাটা ঘটল। মাইক শ্লেটের কোনো ষড়যন্ত্র নয় তো? মাইক থিয়েটারের টিকিট দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, আমি কোথায় থাকব। না, এই সম্ভাবনাটা বাতিল করা যাচ্ছে না।

ছেলেমেয়ের কাছে এই কিডন্যাপিং-এর গল্প করা উচিত কী? অনেক ভাবতে ভাবতে ম্যারি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন না, এইভাবে ওদের ভয় দেখিয়ে লাভ কী!

.

ফ্রেঞ্চ এমব্যাসিতে ককটেল পার্টি। ফরাসি দেশ থেকে এক কনসার্ট পিয়ানিস্ট আসবেন। ম্যারি ভেবেছিলেন, এই পার্টিতে যোগ দেবেন না, অত্যন্ত ক্লান্ত তিনি। কিন্তু তাকে যেতেই হল।

ম্যারি সযত্নে স্নান করলেন, ইভেনিং গাউন পরে নিলেন। জুতো পরার সময় অবাক হয়ে দেখলেন, ধ্বস্তাধ্বস্তিতে হিলটা খসে পড়েছে।

এখুনি সারাতে দিতে হবে। পরিচারককে ডাক দিলেন। কাজটা মুহূর্তের মধ্যে হবে, ম্যারি সেটা জানেন।

.

ম্যারি ফরাসি এমব্যাসিতে এসে পৌঁছোলেন। সম্মানিত অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। গেটের মুখে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সচিব দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর আগে ম্যারি তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন। বললেন– শুভ সন্ধ্যা, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। আপনি আসাতে আমরা খুবই খুশি হয়েছি।

–আপনারা নিমন্ত্রণ করাতে আমি গৌরবান্বিত।

তারা হলের মধ্যে চলে গেলেন। ফরাসি অ্যাম্বাসাডরের সঙ্গে কথা হল। ম্যারি অবাক হয়ে দেখলেন, এক কোণে ওই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। যিনি গতকাল পরিত্রাতা হিসেবে তাকে বাঁচিয়েছিলেন।

ভদ্রলোক কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। কথার শেষ শব্দগুলো ভেসে এল প্যারিসকে প্রতি মুহূর্তে আমি অনুভব করি, হয়তো আসছে বছর…

ম্যারিকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি পায়ে পায়ে সামনের দিকে হেঁটে চললেন।

–ও বিষন্না রমণী, কেমন আছেন?

ইতালীয় রাষ্ট্রদূত অবাক হয়ে জানতে চাইলেন– আপনারা পরস্পরকে চেনেন?

ম্যারি বললেন– আমরা কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হয়নি।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, উনি হলেন ডাঃ লুইস ভেসফরগেস।

 ফরাসি ভদ্রলোকের মুখের চেহারা পালটে গেল– ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর? আমায় ক্ষমা করবেন, আমার কোনো ধারণাই ছিল না।

একটু পরে তিনি আবার বললেন- অবশ্য চারিদিকে আপনার যা ছবি ছাপা হয়, আপনাকে আমার চেনা উচিত ছিল।

ম্যারির ঠোঁটে হাসি– আপনি অনেক ভালো কাজ করেছেন। আপনি না থাকলে যে আমার কী অবস্থা হত?

ইতালীয় রাষ্ট্রদূত ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন- ও, আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। তারপর ম্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনার ওই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটার কথা শুনেছি।

না, ডাঃ ভেসফরগেস ঠিক সময়ে এসেছিলেন। তা না হলে ঘটনাটা সত্যি খারাপের দিকে এগিয়ে যেত।

লুইস ভেসফরগেস হেসে বললেন ঠিক সময়ে আপনার কাছে পৌঁছোতে পেরেছি বলে নিজেকে আনন্দিত বোধ করছি।

এক ব্রিটিশ দম্পতি এগিয়ে এসেছেন।

ইতালির অ্যাম্বাসাডর বললেন- আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি, কেমন?

–পুলিশ আসার পরে আপনি চলে গেলেন কেন? ম্যারি জানতে চাইলেন।

ভদ্রলোক জবাব দিলেন রোমানিও পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে কী লাভ? তারা যে-কোনো মানুষকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই খুশি।

কথা এগিয়ে চলেছে। অনেক বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে দেখা হল। রাতের বয়স বাড়তে থাকল।

অতিথিরা একে একে হলঘর পূর্ণ করছেন।

.

এডওয়ার্ড, তোমার কথা মনে পড়ছে। ওই ফরাসি ডাক্তারের সাথে তোমার চরিত্রের মিল আছে। উনি আমার জন্য যা করেছেন, আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এখানে বড় একা লাগে। মাইক শ্লেট আমাকে আরও সমস্যায় ফেলতে চাইছেন। উনি চাইছেন, আমি যেন স্বদেশভূমিতে ফিরে যাই। কিন্তু এই কঠিন চ্যালেঞ্জটা আমাকে গ্রহণ করতেই হবে। তোমার সাহায্য সব সময় দরকার। শুভ রাত্রি, প্রিয়তম আমার।

.

পরের দিন সকালবেলা। ম্যারি স্টানটন রজার্সকে ফোন করলেন। স্টানের গলা পেয়ে ভালো লাগল তার।

–আপনার জন্য ভালো খবর আছে, স্টানটন রজার্স জবাব দিলেন। হানা মারফির ব্যাপারটা এখানে সব খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। আপনি একটা দারুণ কাজ করেছেন।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্টান।

–ম্যারি, অপহরণের ব্যাপারটা বলবেন কী?

–আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারা পুলিশপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।

-মাইক শ্লেট কি এ ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করেনি?

–মাইক শ্লেট? হ্যাঁ, উনি আমাকে বারণ করেছিলেন।

কিন্তু মাইক শ্লেট আমাকে আমেরিকাতে ফিরতে বলেছেন। এ কথাটা আমি জানাব কী? পরক্ষণেই ম্যারির মনে হল, না, এ ব্যাপারটা আগে নিজেকেই সমাধান করতে হবে।

মনে রাখবেন, আমি সব সময় আপনাকে সাহায্য করার জন্য উদগ্রীব।

ম্যারি বললেন আমি তা জানি বন্ধু।

 টেলিফোন সম্ভাষণ শেষ হয়ে গেল।

.

আমাদের একটা সমস্যা হচ্ছে, এমব্যাসি থেকে সব খবর বেরিয়ে যাচ্ছে। ম্যারি এবং মাইক শ্লেট কফির টেবিলে বসে আলোচনা করছিলেন।

ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

–হ্যাঁ, আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টার সাথে রোমানীয় বাণিজ্য মন্ত্রীর গোপন বৈঠক হয়েছে।– আমি জানি, এব্যাপারটা গত সপ্তাহে আলোচনা করেছিলাম।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, আমাদের বাণিজ্য সচিব কোনো ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। আপনি এ সমস্যার সমাধান কী করে করবেন?

–এই মুহূর্তে কিছুই বুঝতে পারছি না। ভবিষ্যতে ভাবতে হবে।

হা, নতুন কিছু প্রস্তাব দেবার চেষ্টা করুন। না হলে কিন্তু আরও বেশি সমস্যা হবে।

ম্যারি একমুহূর্ত ভেবে বললেন আমার মনে হয়, কোনো একজন সদস্য এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন, কিন্তু কে তিনি?

একজন নয়, একাধিক জন, শেষ অধিবেশনটা বাবল রুমে হয়েছিল। সেখান থেকে খবর বাইরে বেরোনো সম্ভব নয়।

ম্যারি অবাক হয়ে তাকালেন। আটজন মানুষকে ওই আলোচনা সভায় যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা সকলেই এমব্যাসির বিশিষ্ট পদাধিকারী।

–কারও সঙ্গে হয়তো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ছিল। হয়তো একটা টেপরেকর্ডার। আপনি বাবল রুমে আর একটা অধিবেশন ডাকুন। আজই সকালবেলা। ওই আটজনকে আবার ডাকা হবে। তখনই আমরা দেখব কে দোষী মানুষ।

আটজন হাজির হয়েছেন বাবল রুমে। ছিলেন এডি মালজ, তিনি হলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা, সিআইএ-র এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। যোগ দিয়েছেন প্যাট্রিসিয়া হ্যাটফিল্ড, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। জেরি ডেভিস, যিনি জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেন। ডেভিস ভিক্টর, বাণিজ্য উপদেষ্টা। লুকাস জাংক্ল, প্রশাসনিক উপদেষ্টা এবং কর্নেল উইলিয়াম ম্যাককিনি।

ম্যারি টেবিলের একদিকে বসে আছেন। মাইক শ্লেট উলটোদিকে।

ম্যারি ডেভিড ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন– ভিক্টর, রোমানীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কেমন বৈঠক হল?

বাণিজ্য উপদেষ্টা মাথা নেড়ে বললেন- না, ব্যাপারটা খুব একটা ভালো হয়নি। আমি নতুন প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই প্রস্তাবগুলি মানা হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

মাইক বললেন- হয়তো মানা হবে।

–আপনি কী বলতে চাইছেন?

–আমি এই ঘরে উপস্থিত কোনো মানুষের মন পড়তে পারছি।

 তিনি একটা লাল টেলিফোন টেবিলের ওপর রাখলেন।

একটু বাদে দরজাটা খুলে গেল, সাদা পোশাক পরা এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। তার হাতে একটি কালো রঙের বাক্স আছে।

এডি মালজ বললেন– এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন। এখানে কাউকে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় না।

ম্যারি জবাব দিলেন–আমাদের একটা সমস্যা হয়েছে। ওই ভদ্রলোক সমস্যার সমাধান করবেন।

–হ্যাঁ, আপনারা কেউ উঠবেন না। যে যেখানে আছেন, বসে থাকবেন। ওই ভদ্রলোক বললেন।

তিনি মাইক শ্লেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাইক শ্লেটের কাছে বাক্সটা ধরলেন। বাক্সতে । একটা তীর চিহ্ন শূন্যে পৌঁছে গেল। তিনি এলেন প্যাট্রিসিয়া হ্যাটফিল্ডের কাছে। সূচকটা স্থির হয়ে আছে। পরবর্তী গন্তব্য এডি মালজ, তারপর জেরি ডেভিস এবং লুকাস জাং। কাটাটা একদম নড়ছে না। এবারে এলেন ডেভিস ভিক্টরের কাছে। অবশেষে কর্নেল ম্যাককিনি। কোনো জায়গাতেই কাটাটা সামান্যতম নড়ল না।

শেষ পর্যন্ত ম্যারি, তার কাছে আসা মাত্র কাটাটা অতি দ্রুত সঞ্চালিত হতে শুরু করল।

মাইক শ্লেট বললেন বুঝতে পারছি না। তিনি ম্যারির কাছে এগিয়ে এলেন। টেকনিসিয়ানের কাছে জানতে চাইলেন- আপনি কি ঠিক বলছেন?

ম্যারি অবাক হয়ে গেছেন।

মাইক অনুরোধ করলেন– এখনই এই অধিবেশনটা ভেঙে দিতে হবে।

ম্যারি সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন- আজকের মতো ধন্যবাদ, কেমন? মাইক

ওই টেকনিসিয়ানকে বললেন, আপনি এখানে থাকুন।

সকলে ঘর থেকে চলে গেছেন। মাইক জানতে চাইলেন- আপনি কি আসল বস্তুটা বের করতে পারবেন।

অবশ্যই, আমি পারব।

কালো বাক্সটা নিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে এলেন। ম্যারির শরীরের থেকে কয়েক ইঞ্চি দুরে। ধীরে ধীরে ম্যারির পায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। দেখা গেল ওই সূচকটা অত্যন্ত দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে।

ভদ্রলোক বললেন আপনার জুতোর মধ্যে।

ম্যারি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন আপনার ভুল হচ্ছে। এই জুতো দুটো আমি ওয়াশিংটন থেকে কিনেছি।

মাইক বললেন– জুতোগুলো খুলবেন কী?

–আমি,.. গোটা ব্যাপারটা কেমন হাস্যস্পদ বলে মনে হচ্ছে। কেউ হয়তো আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। অথবা এটা কি মাইক শ্লেটের কোনো একটা ষড়যন্ত্র? মাইক শ্লেট হয়তো ওয়াশিংটনের কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন যে, ম্যারি স্পাইয়ের কাজ করছেন। সমস্ত খবর শত্রু শিবিরে পোঁছে দিচ্ছেন।

জুতো খোলা হল। মাইকের হাতে তুলে দেওয়া হল।

–এটা কি একটা নতুন হিল?

না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কারমানকে উনি বলেছিলেন, তুমি কি এই জুতোটা একজন মুচির কাছে নিয়ে যাবে? জুতোটা সারাতে হবে।

মাইক হিলটা ভেঙে দিলেন। একটা ছোট্ট টেপরেকর্ডার পাওয়া গেল।

–আমরা আমাদের স্পাইকে ধরতে পেরেছি। মাইক শুকনো মুখে বললেন।

–এই হিলটা কোথা থেকে এনেছেন?

–আমি জানি না, এই ব্যাপারটা আমি আমার পরিচারকের ওপর তুলে দিয়েছিলাম। মাইক হাসতে হাসতে বললেন- ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, খুব ভালো উত্তর দিয়েছেন।

.

ম্যারির জন্য একটা টেলেক্স আমাদের বৈদেশিক দপ্তর আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। আগামীকাল সরকারি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। অনেক ধন্যবাদ। স্টানটন রজার্স।

মাইক টেলেক্সটা পড়লেন।

–খবরটা ভালো। এবার আমরা আসল জায়গায় পৌঁছোতে পারব। নেগুলেসকোর সাথে কথা বলতে হবে। নেগুলোসকো হলেন রোমানিয়ার অর্থমন্ত্রী।

কালকের আগে এই ঘোষণাটা হবে না। ম্যারি বললেন, তিনি বসে থাকলেন। মাথায় নানা চিন্তা। বুঝতে পারছেন না, এখন কী করবেন।

.

দু ঘণ্টা কেটে গেছে। ম্যারি পৌঁছে গেছেন রোমানিয়ার অর্থমন্ত্রীর অফিসে।

–আমাদের জন্য ভালো খবর আছে কী?

 –ঠিক বুঝতে পারছি না।

–কেন? আমি তো জানি একটা ভালো খবর আসছে।

 ম্যারির দীর্ঘশ্বাস– আমিও তাই জানি মাননীয় মন্ত্রী।

কী হয়েছে? খারাপ কিছু?

ম্যারি কাঁধ ঝকানি দিয়ে বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমি আমাদের প্রেসিডেন্টের কাছে শপথ করেছি, ভদ্রলোক বলতে বলতে থেমে গেলেন। তিনি ম্যারির দিকে তাকালেন। কঠিন কণ্ঠস্বরে বললেন– প্রেসিডেন্ট আওনেস্কু কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করবেন না।

ম্যারি জবাব দিলেন আমি আপনাকে নিরাশ করতে চাইছি মাননীয় মন্ত্রী। সেনেটররা বোধহয় এই ব্যাপারটা নিয়ে আর উৎসাহী নন, বিশেষ করে সেনেটর মরমোন।

নেগুলেসকোর কণ্ঠস্বরে হতাশা– তিনি বললেন তার মানে? অর্থমন্ত্রীর সাহায্য পাব না? কিন্তু ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, রোমানিয়াকে এই সাহায্যটা করতেই হবে। এখানে চার্চের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এখানে আমরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করি। তবে আমরা চার্চকে ভালোবাসি।

তিনি আবার বললেন- ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। আপনি অনুগ্রহ করে এটা করার চেষ্টা করুন। টাকাটা আমাদের খুবই দরকার।

ম্যারি তাকালেন তার চোখের দিকে এবং বললেন– মিনিস্টার নেগুলেসকো, আমি বলতে পারছি না, আজ বিকেলে জানতে পারব।

.

ম্যারি ডেস্কে বসেছিলেন। ফোনের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। দুটো বেজে তিরিশ মিনিটে নেগুলেসকো ফোন করলেন ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, সাংঘাতিক ভালো খবর। চার্চ আমাদের ওপর কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়েছে। আপনি কি কোনো ভালো খবর শোনাবেন?

.

ম্যারি আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে বললেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে এইমাত্র একটা টেলেক্স এসেছে। আপনাদের টাকাটা মঞ্জুর করা হয়েছে।

.

২৩.

ডাঃ লুইস ভেসফরগেসকে ম্যারির মনে পড়ছে– ভদ্রলোক আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। কিন্তু তারপর কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আর দেখা হচ্ছে না কেন?

ম্যারি আমেরিকান ডলার শপে গেলেন। রূপোর একটা পাত্র কিনলেন। সেটা ফরাসি । দূতাবাসে পাঠিয়ে দিলেন। বলা হল, এটি যেন ডাঃ ভেসফরগেসকে দেওয়া হয়।

সেই সন্ধেবেলা ডরোথি স্টোন ফোন করলেন– ডাঃ ভেসফরগেস নামে এক ভদ্রলোক। আপনাকে চাইছেন। আপনি কি কথা বলবেন?

ম্যারি হেসে বললেন- হ্যাঁ, তারপর বললেন, শুভ সন্ধ্যা।

শুভ সন্ধ্যা ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, আপনার অসাধারণ উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

–না, এটা আর কী এমন অসাধারণ?

দুজনের মধ্যে কিছু অন্তরঙ্গ কথাবার্তা হল। তারপর? ডিনারের নিমন্ত্রণ। কখন? দারু রেস্টুরেন্টে।

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন– আপনি ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসবেন তো?

না, শনিবার রাতে ওরা ব্যস্ত থাকবে।

ফোনটা নামিয়ে রাখতে রাখতে ম্যারি ভাবলেন, এত ছোট্ট ব্যাপারে আমি মিথ্যে কথা বললাম কেন?

.

সুইজ দূতাবাসে ককটেল পার্টি। প্রসিডেন্ট আলেকজানড্রোস নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ম্যারিকে দেখে তিনি কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন– শুভ সন্ধ্যা, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর। হাতে হাত রাখলেন, তারপর বললেন, আপনার দেশ টাকাটা মঞ্জুর করেছে। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

–আপনাদের চার্চের দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিভ্রমণ করবে। ব্যাপারটা খুবই ভালো, তাই নয় কী?

রোমানিয়ার বাসিন্দারা বন্দি নন। তারা যেখানে খুশি যেতে পারেন। আমার দেশকে আপনি সামাজিক সুরক্ষা এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রতীক ধরতে পারেন।

ম্যারির হঠাৎ মনে পড়ে গেল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের বিষণ্ণ মুখের মিছিলের কথা। এয়ারপোর্টে অসংখ্য মানুষের ভিড়। কত উদ্বাস্তু দেশ ছাড়তে চাইছে।

এখানকার সমস্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে দেওয়া হয়েছে।

ম্যারির মনে পড়ে গেল, রোমানিয়াতে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে বিদেশিদের ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় না।

ম্যারি বললেন- আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি মিঃ প্রেসিডেন্ট, হাজার হাজার ইহুদি রোমানিয়া ছাড়তে চাইছেন। কিন্তু সরকার তাদের ভিসা দিচ্ছেন না।

–ওঁরা হলেন বিক্ষুব্ধবাদী, ওঁরা সব সময় গোলমাল করার চেষ্টা করেন। তাই ওঁদের ওপর কড়া নজর রাখতে হয়েছে। তিনি আরও বলতে থাকলেন, ১৯৬৭ সালে আরব ইজরায়েলের যুদ্ধ হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো ইজরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কিন্তু আমরাই একমাত্র ওই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছি।

ম্যারি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে মিঃ প্রেসিডেন্ট বললেন আপনি এই মদিরাটা পান করতে পারেন, আপনাকে এটা আনন্দ এবং উদ্দীপনা দেবে।

.

 ডঃ লুইস ম্যারিকে তুলে নেবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ম্যারি চাইলেন ফ্লোরিয়েনকে সঙ্গী করে দারু রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যাবেন। ফোন করে জানালেন, একটু দেরি হতে পারে।

ম্যারিকে এমব্যাসিতে ফিরতে হল। প্রেসিডেন্টের সাথে যে কথা বলেছিলেন, সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করলেন।

কিন্তু অফিসে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। মনে হল, কেউ বোধহয় তার মুখের ওপর লাল রং ছড়িয়ে দিয়েছে। ছুটে এলেন রিসেপশন ডেস্কের কাছে।

প্রহরীকে ডেকে বললেন- গানি, আমার অফিসে বাইরের কেউ ঢুকেছিল?

–না, ম্যাডাম। কেউ তো ঢোকেনি?

–দেখি তোমার রোজকার শিটটা।

–দেখুন।

প্রহরী আগন্তুকদের তালিকাটা ম্যারির হাতে তুলে দিলেন। সব কিছু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন ম্যারি। সাড়ে পাঁচটার সময় ম্যারি অফিস থেকে চলে গিয়েছিলেন। অনেকগুলো নাম রয়েছে।

ম্যারি মেরিন গার্ডের মুখের দিকে তাকালেন– সকলকে কি ঠিক মতো দেখাশোনা করা হয়েছে?

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, সঙ্গে প্রহরী না থাকলে কাউকে ওপরে ওঠার অনুমতি দেওয়া হয় না। কিছু ভুল হয়েছে কী?

ম্যারি বললেন- তুমি তাড়াতাড়ি আমার অফিসে কাউকে পাঠাও। দেখবে, লাল অক্ষরে কী লেখা আছে। লেখা আছে, যদি মরতে না চাও, তাহলে এখনই দেশে ফিরে যাও!

.

লুইস ম্যারির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ম্যারি এলেন এবং বললেন, দেরি হওয়ার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।

–ঠিকই আছে, আপনার সংবাদ আমি পেয়েছি।

এবার ডিনার শুরু হবে।

 ডাক্তারবাবু জানতে চাইলেন ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, সবকিছু ঠিক আছে তো?

ম্যারি কষ্টের হাসি হেসে বললেন- হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। চোখ বন্ধ করলেন, মনে পড়ে গেল- মরতে যদি না চাও তাহলে দেশে ফিরে যাও।

স্কচে ঠোঁট ছোঁয়ালেন তিনি। মনে হল, শরীর এবং মন, দুই-ই বোধহয় শান্ত হবে।

ডাক্তার একটির পর একটি পেগের অর্ডার দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন একজন অ্যাম্বাসাডরের জীবনে কত ঝা এবং সংকট। আপনি কীভাবে সব সামলাচ্ছেন?

ম্যারি বললেন- আপনার কথা বলুন?

–আমি আর কী বলব?

 –আপনি আলজিরিয়াতে ছিলেন? যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

-হ্যাঁ, প্রত্যেকের জীবনে এমন কিছু সময় আসে। ওখানে সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

এই ভদ্রলোকের সাথে এডওয়ার্ডের অনেক মিল আছে। ম্যারি ভাবলেন, এডওয়ার্ড নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থাকতে ভালোবাসতেন।

ভদ্রলোক বলেই চলেছেন যাদের সঙ্গে আমরা লড়াই করতাম, তাদেরও বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান আছে। খারাপ লাগত, কিন্তু কী করব?

এক বোতল ওয়াইন আনা হল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছে। লাল লেখাটার কথা ম্যারি ভুলেই গেছেন। ভদ্রলোকের কথার মধ্যে কৌতুক আছে। ম্যারির মনে হল, তিনি বোধহয় কানসাসের শহরে ফিরে গেছেন। কিন্তু এই ভদ্রলোক যেখানে জন্মেছিলেন, সেখান থেকে কানসাসের দূরত্ব কম করে পাঁচ হাজার মাইল। তবে আমাদের পটভূমি এত এক কেন? ডাক্তারবাবুর বাবা ছিলেন একজন কৃষক।তিনি লুইসকে প্যারিসের মেডিকেল স্কুলে পাঠিয়ে ছিলেন।

আমার বাবার কথা খুবই মনে পড়ে ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

–ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর বলে আমায় ডাকবেন না তো।

–মিসেস অ্যাসলে?

 না, শুধু ম্যারি।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ম্যারি।

মুখে হাসি– স্বাগতম লুইস।

 ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কথা হল। ফেলে আসা দিনযাপনের স্মৃতি।

ডাক্তারবাবু জানালেন- আমাকে যখন সুযোগ দেওয়া হল, ভাবলাম, রোমানিয়া ঘুরে আসি। এই দেশ সম্পর্কে আমার খুব একটা ভালো ধারণা ছিল না।

-কেন?

–না, এখানকার বাসিন্দারা খুবই ভালো। কিন্তু সরকার বড় কড়া, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার পর্যন্ত দেওয়া হয় না। এখানকার মানুষ ক্রীতদাসের জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। সারা দিন কাজ করতে হয়। কিন্তু বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। আমি তাই ফ্রান্সে ফেরার জন্য উদগ্রীব।

ম্যারি বললেন- অনেকে চাইছেন, আমি দেশে ফিরে যাই।

-কেন?

 ম্যারি সব কথা বলেছিলেন, এমন কি লাল সাবধানবাণী।

 লুইস বললেন- সে কী! কে করেছে এ সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে?

–না।

লুইস বললেন– আমি একটা কথা বলব? আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে বলে বলছি। আসলে কী হয়েছে…এখানে আপনি এমন একটা বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন, যাতে মনে হতেই পারে, আপনার দেশটা খুবই সুন্দর। আপনি থাকবেন, ভয় পাবেন না। কেমন?

ম্যারির মনে হল, উনি এডওয়ার্ডের মতো কথা বলেছেন।

.

ম্যারি বিছানাতে শুয়ে আছেন, ঘুমোতে পারছেন না। লুইসের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু ম্যারি কি সত্যি এদেশে থাকতে পারবেন?

অন্ধকারের মধ্যে ম্যারি খোলা চোখে তাকিয়ে থাকলেন। ভীতা এবং সন্ত্রস্ত হয়ে।

.

পরের দিন সকালবেলা, মাইক শ্লেট হিসেব করে দু কাপ কফি নিয়ে এসেছেন। দেওয়ালটা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।

–আমি শুনেছি, আপনার দেওয়ালে কিছু লেখা ছিল। কে লিখেছে ধরতে পারছেন

না, আমি অতিথিদের তালিকা দেখেছি। সকলেরই পরিচয় আছে।

–তাহলে? লুকিয়ে এখানে কেউ ঢুকেছিল?

 –হ্যাঁ, প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে।

–এটা কি বিশ্বাস করতে হবে? বিশ্বাস না করে উপায় কী?

–লেখাটা আসলে কী?

মরতে না চাইলে দেশে ফিরে যাও। কে বা কারা আমাকে হত্যা করতে চাইছে?

–আমি কিছুই বলতে পারছি না।

মিঃ শ্লেট, একটা কথা বলবেন, সত্যি আমার কোনো বিপদ হবে কী?

–ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, ওরা আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যা করেছিল, জন কেনেডি, রবার্ট কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, মারিন গ্রোজা- সবাইকেই মেরে ফেলা হয়েছে। সুতরাং আপনার জীবনটাও খুব একটা নিরাপদ নয়।

কিন্তু, তুমি কোথাও যেও না, ভয় পেও না, ডাক্তারের এই শব্দগুলো ম্যারিকে তখন আশ্বস্ত করেছে।