১৩. বল এর অবলুপ্তি

১৩. বল এর অবলুপ্তি

নিউটনীয় তন্ত্র অনুসারে কোনো বলের ক্রিয়াধীন না হলে বস্তুপিণ্ড ঋজুরেখায় সমরূপ বেগে চলমান থাকে। বস্তুপিণ্ড এভাবে না চললে তাদের গতির পরিবর্তনের কারণ আরোপ করা হয় একটি বলের’ (force) উপর। কিছু কিছু বল আমাদের কল্পনায় বোধগম্য মনে হয় : দড়ি কিংবা তারের প্রয়োগ করা বল, একাধিক বস্তুপিণ্ডের সংঘর্ষ কিংবা যে কোনোরকম স্বতঃপ্রতীয়মান ঠেলা (push)। পূর্বতন একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে আমাদের এই সমস্ত পদ্ধতির আপাতদৃষ্ট কাল্পনিক উপলব্ধি দোষদুষ্ট (fal lacious-হেত্বাভাসমূলক)। আসলে এর একমাত্র অর্থ : গাণিতিক হিসাব ছাড়াই কি হতে যাচ্ছে সেটা অতীত অভিজ্ঞতার সাহায্যে আগে থেকেই আমরা কম বেশি আঁচ করতে পারি। কিন্তু মহাকর্ষের সঙ্গে জড়িত বল’ কিংবা স্বল্প পরিচিত বৈদ্যুতিক ক্রিয়া আমাদের কল্পনার কাছে এরকম স্বাভাবিক মনে হয় না। পৃথিবীটা শূন্যে ভাসতে পারে এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার, স্বাভাবিক অনুমান হওয়া উচিত পৃথিবীটা নিশ্চয়ই পড়ে যাবে। সেইজন্য প্রাচীনকালে যারা দূরকল্পনা করেছেন তাঁদের মতে পৃথিবীকে রাখতে হয়েছে একটা হাতীর উপর, হাতীটাকে রাখতে হয়েছে একটা কচ্ছপের উপর। সুদূরে ক্রিয়া (action at a distance) ছাড়াও নিউটনীয় তত্ত্ব দুটি কল্পনাশক্তিপূর্ণ নতুনত্ব উপস্থাপন করেছিল। প্রথম, মহাকর্ষ সব সময় মূলত নিম্নমুখী অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্রমুখী নয়। দ্বিতীয় : ‘সমরূপে চলমান’ এই শব্দসমষ্টি কোনো বলাধীন নয় এরকম বস্তুপিণ্ডের গতি সম্পর্কে যে অর্থে প্রয়োগ করা হয় সে অর্থে সমরূপ বেগে বারংবার বৃত্তাকারে চলমান একটি বস্তুপিণ্ড সমরূপে চলমান নয়। বস্তুপিণ্ডটি ঋজুরেখা থেকে অবিরত বৃত্তের কেন্দ্রমুখের বিচ্যুত হচ্ছে। এইজন্য প্রয়োজন সেই অভিমুখে আকর্ষণকারী একটি বল। সুতরাং নিউটন এই সিদ্ধান্তে এলেন যে গ্রহগুলি একটি বলের দ্বারা সূর্যের দিকে আকর্ষিত হচ্ছে। এই বলের নাম মহাকর্ষ।

আমরা দেখেছি অপেক্ষবাদ এই দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণটাই বাতিল করেছে। প্রাচীন জ্যামিতিক অর্থে ঋজুরেখার অস্তিত্ব আর নেই। রয়েছে সর্বাপেক্ষা ঋজুরেখা’ কিংবা ধরাকৃতি (geodesic)। কিন্তু এগুলি সঙ্গে স্থান এবং কাল দুটোই জড়িত। ধূমকেতু সৌরতন্ত্রে যে রকম কক্ষ রচনা করে সৌরতন্ত্রের ভিতর দিয়ে চলমান একটি আলোকরশ্মি জ্যামিতিক অর্থে সেই রকম কক্ষ রচনা করে না। ও দুটোই কিন্তু চলে ধরাকৃতিতে। ঐ কল্পনের মানসচিত্র সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। একজন কবি বলতে পারেন, জল নিম্নমুখী তার কারণ জলের আকর্ষণ সমুদ্রের দিকে। কিন্তু একজন পদার্থ বিজ্ঞানী কিংবা একজন নশ্বর মানুষ বলবে প্রতিটি বিন্দুতেই জল যেমন যাওয়ার তেমনি যায়। এর কারণ ঐ বিন্দুতে জমির চরিত্র। সামনে কি আছে জল তা গ্রাহ্য করে না। ঠিক যেমন জলের সমুদ্রের অভিমুখে আসার কারণ সমুদ্র নয় তেমনি গ্রহগুলির সূর্যকে চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করার কারণও সূর্য নয়। গ্রহগুলি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তার কারণ সেটাই সহজতম কাজ। প্রায়োগিক অর্থে (technical sense) এটাই সর্বনিম্ন ক্রিয়া’ (least action)। যে অঞ্চলে তাদের অবস্থান সে অঞ্চলের চরিত্রের জন্য এটাই সহজতম কাজ। সূর্য থেকে নির্গত কোনো প্রভাব এর কারণ নয়।

মহাকর্ষের কারণ সূর্যের প্রতি গ্রহগুলিকে আকর্ষণকারী একটি বল’–এ অনুমানের প্রয়োজনের উদ্ভব যে কোনো মূল্যে ইউক্লিডীয় জ্যামিতিকে রক্ষা করার দৃঢ়সংকল্প থেকে। আমাদের স্থান আসলে ইউক্লিডীয় নয়, তা সত্ত্বেও যদি আমরা অনুমান করি আমাদের স্থান ইউক্লিডীয় তাহলে জ্যামিতির ভুল সংশোধনের জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যাকে ডাকতে হবে। আমরা দেখতে পাই বস্তুপিণ্ডগুলি যে রেখায় চলে সেগুলি ঋজুরেখা নয় অথচ আমরা সেগুলিকে ঋজুরেখা ভাবার জিদ করি তখন আমরা এই আচরণের একটা কারণ দাবী করি। এডিংটন এ ব্যাপারটা প্রশংসা করার মতো স্পষ্টভাবে বলেছেন। পরবর্তী ব্যাখ্যার ভিত্তি তাঁরই দেওয়া একটা ব্যাখ্যা। ধরুন আপনি বিশিষ্ট অপেক্ষবাদে ব্যবহৃত অন্তর (interval) সম্পর্কীয় সঙ্কেত গ্রহণ করেছেন। আপনার স্থান ইউক্লিডীয়–এই নীরব স্বীকৃতি সে সঙ্কেতে রয়েছে। পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে অন্তরগুলিকে তুলনা সম্ভব। আপনি অচিরে আবিষ্কার করবেন আপনার সঙ্কেতের সঙ্গে পরীক্ষাফলের সঙ্গতি রক্ষা করা যায় না। তখন আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। এ সত্ত্বেও যদি আপনি ইউক্লিডীয় সঙ্কেতের সঙ্গে যুক্ত থাকবার জন্য জিদ ধরেন তাহলে সঙ্কেত এবং পর্যবেক্ষণের ভিতরে অসঙ্গতির দায় এমন কোনো প্রভাবের উপর আপনার আরোপ করতে হবে যার অস্তিত্ব বর্তমান এবং যে প্রভাব পরীক্ষার্থ পিণ্ডগুলির (test bodies) আচরণ প্রভাবিত করে। আপনি বাড়তি আর একটি নিমিত্ত উপস্থিত করবেন এবং তার উপর আপনার ভুলের ফলের দায়িত্ব আরোপ করবেন। বলের নিউটনীয় সংজ্ঞা অনুসারে ঋজুরেখায় সমরূপ গতিতে যে নিমিত্ত (agency) বিচ্যুতি সৃষ্টি করে তার নাম বল। সুতরাং অন্তর সম্পর্কীয় ইউক্লিডীয় সঙ্কেতের সপক্ষে আপনার জিদের জন্য যে নিমিত্তকে আপনি ডেকে এনেছেন তাকে বলা হয় বলের ক্ষেত্র’ (field of force)।

‘বল’ সম্পর্কীয় প্রাচীন ধারণা পরিত্যাগ করে মানুষ যদি নতুন ধারায় বিশ্বকে উপলব্ধি করতে শেখে তাহলে শুধু তার ভৌত কল্পন পরিবর্তিত হবে তাই নয় হয়তো পরিবর্তন হবে তাদের নীতি এবং রাজনীতিরও। শেষের অভিক্রিয়াটি বেশ অযৌক্তিক কিন্তু সে জন্য তার সম্ভাবনা কম নয়। সৌরতন্ত্র সাপেক্ষ নিউটনীয় তত্ত্ব অনুসারে সূর্যের আচরণ রাজার মতো–গ্রহগুলি তার আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য। নিউটনীয় বিশ্বের তুলনায় আইনস্টাইনের বিশ্বে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বেশি এবং শাসন কম (less government)। সে বিশ্বে কর্মব্যস্ততাও কম; আমরা দেখেছি আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে মূলগত বিধি আলস্য। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘গতিময় (dynamic) শব্দের অর্থ করা হয়েছে সক্রিয় এবং শক্তিমান’ (energetic & forceful) কিন্তু এর অর্থ যদি হতো ‘গতিবিদ্যার নীতিগুলির দৃষ্টান্ত’ তাহলে এ শব্দমালা প্রয়োগ করা উচিত ছিল এমন লোক সম্পর্কে যে মুখের ভিতরে ফল পড়ার আশায় গাছতলায় বসে থাকে। আমার আশা : ভবিষ্যতে সাংবাদিকরা যখন গতিশীল সক্রিয়া ব্যক্তিত্বের (dynamic personality) কথা বলবেন তখন বোঝাতে চাইবেন এমন ব্যক্তিকে যিনি সেই মুহূর্তে সব চাইতে কম কাজ করেন এবং ভবিষ্যতে কি হবে তা ভাবেন না। এই ফলপ্রাপ্তিতে যদি আমি সাহায্য করতে পারি তাহলে বুঝব আমার লেখা ব্যর্থ হয়নি।

মনে হয় বলের’ অবলুপ্তির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ভৌতকল্পনের উৎস রূপে স্পর্শের স্থলে দৃষ্টিতে প্রতিস্থাপন করা। প্রথম অধ্যায়ে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আয়নাতে যখন একটি প্রতিবিম্বকে নড়তে দেখি তখন সেটাকে কেউ ঠেলেছে বলে আমরা ভাবি না। মুখোমুখি দুটো বড় আয়না থাকলে আপনি হয়তো এই বস্তুর অসংখ্য প্রতিবিম্ব দেখতে পাবেন। আয়না দুটোর মাঝখানে কেউ যদি টুপি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে আপনি প্রতিবিম্বে কুড়ি ত্রিশটি টুপি দেখতে পাবেন। কেউ যদি এসে ডাণ্ডা মেরে টুপিটাকে ফেলে দেয় তাহলে একই মুহূর্তে ঐ কুড়ি ত্রিশটি টুপি নিচে পড়বে। আমরা ভাবি আসল টুপিটা ফেলে দিতে একটা বল প্রয়োজন কিন্তু ভাবি বাকি কুড়ি ত্রিশটা টুপি নিজে নিজে পড়ে যায় কিংবা হয়তো পড়ে যায় শুধুমাত্র নকল করার একটা আবেগের দরুন। ব্যাপারটা একটু বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা যাক।

আয়নায় যখন ছায়া নড়ে তখন কিছু একটা ঘটে এ তথ্য স্বতঃপ্রতীয়মান। দৃষ্টির দিক থেকে ব্যাপারটা এত বাস্তব মনে হয় যেন ঘটনাটা আয়নায় ঘটেইনি। কিন্তু স্পর্শ কিংবা শ্রুতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছুই ঘটেনি। আসল টুপিটা পড়ার সময় একটা শব্দ হয় কিন্তু কুড়ি ত্রিশটা প্রতিবিম্ব পড়ে নিঃশব্দে। টুপিটা আপনার পায়ে পড়লে আপনি অনুভব করেন কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি আয়নায় যে কুড়ি ত্রিশজন লোক রয়েছে টুপিটা তাদের পায়ে পড়লেও তারা অনুভব করে না। জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগৎ সম্পর্কেও কিন্তু এ তথ্য সমভাবে সত্য। কোনো শব্দ হয় না কারণ শূন্যস্থান দিয়ে শব্দ যেতে পারে না। আমরা যতদূর জানি জ্যোতির্বিজ্ঞানেব ঘটনা কোনো ‘বোধ সৃষ্টি করে না কারণ ‘বোধ’ করার মতো কেউ সেখানে নেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগও তাহলে আয়নার জগতের চাইতে এমন কিছু বাস্তব’ কিংবা ‘ঘন’ (solid) নয় এবং সে জগৎকে চালনার জন্য বলের প্রয়োজনও একইরকম অল্প।

পাঠক মনে করতে পারেন আমি অলস কুতর্ক করছি। তিনি বলতে পারেন ‘আয়নার ছায়া একটি কঠিন বস্তুর প্রতিবিম্ব। আয়নার টুপিটা পড়ার কারণ আসল টুপিটার উপর প্রয়োগ করা বল। আয়নার টুপি নিজের খুশিমতো আচরণ করতে পারে না, ওব নকল করতে হবে আসল টুপিটাকে। এতেই বোঝা যায় আয়নার প্রতিবিম্বের সঙ্গে সূর্য আর গ্রহের কতটা পার্থক্য। চিরকাল তারা একটি আদিরূপকে (prototype) নকল করতে বাধ্য নয়। সুতরাং একটি প্রতিবিম্ব এবং অন্তরীক্ষের একটি বস্তুপিণ্ড (heavenly bodies) একই রকম বাস্তব–এ ভড়ং আপনি ছাড়ুন।

এতে খানিকটা সত্য নিশ্চয়ই আছে। বিচার্য বিষয় বিষয় হল : ঠিক কি সত্য? প্রথমত প্রতিবিম্ব ‘কাল্পনিক’ নয়। আপনি প্রতিবিম্ব দেখবার সময় নিঃসন্দেহে কিছু বাস্তব আলোকতরঙ্গ আপনার চোখে পৌঁছায়। আয়নার উপর একটা কাপড় ঝুলিয়ে দিলে এই আলোকতরঙ্গগুলির আর অস্তিত্ব থাকে না। প্রতিবিম্ব এবং বাস্তবের ভিতরে একটা শুদ্ধ আলোকীয় পার্থক্য কিন্তু রয়েছে। আলোকীয় পার্থক্য জড়িত এই অনুকরণের প্রশ্নের সঙ্গে। আয়নায় যখন আপনি কাপড় ঝোলান তখন বাস্তব পদার্থটিতে কোনো পরিবর্তন হয় না কিন্তু বাস্তব পদার্থটি সরিয়ে নিলে প্রতিবিম্বটিও মিলিয়ে যায়। এর ফলে আমরা বলতে পারি : যে আলোকতরঙ্গগুলি প্রতিবিম্ব গঠন করে, সেগুলি আয়নার উপরিতল থেকে প্রতিফলিত এবং সেগুলি আসলে পশ্চাতের কোনো বিন্দু থেকে আসে না; আসে বাস্তব পদার্থটি থেকে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটা সাধারণ নীতির উদাহরণ। বিশ্বের অধিকাংশ ঘটনাই কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। তারা অনেকগুলি সমরূপ ঘটনাগোষ্ঠীর সদস্য। সেগুলি এমন যে, প্রতিটি গোষ্ঠীই আরোপযোগ্যরূপে বিশেষ একটি ক্ষুদ্র স্থান কাল অঞ্চলের সঙ্গে জড়িত। ঐ আলোকতরঙ্গগুলির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এই। এই আলোকতরঙ্গের জন্যই আমরা বস্তু এবং আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই উৎসকেন্দ্র ঐ বস্তুটি। আপনি যদি ঐ বস্তুটিকে ঘিরে একটি বিশেষ দূরত্বে একটি অস্বচ্ছ (opaque) গোলক রাখেন তাহলে গোলকের বাইরে কোনো বিন্দু থেকেই আর ঐ বস্তুটি দৃশ্য হয় না। আমরা দেখেছি। মহাকর্ষকে যদিও এখন দূরে সংঘটিত ক্রিয়ারূপে বিচার করা হয় না তবুও মহাকর্ষ একটি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। এই কেন্দ্রের শিখরের চারপাশে যেন প্রতিসমরূপে (symmetrically) সজ্জিত একটি পাহাড় রয়েছে। আলোচ্য মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত যে সম্ভাব্য বস্তুপিণ্ড আমরা কল্পনা করি তার অবস্থান ঐ শিখরে। সারল্যের জন্য, সাধারণ বুদ্ধিতে ঐ অর্থে এক গোষ্ঠীর সমস্ত ঘটনাই একত্রে পিণ্ডীকৃত হয় (dump together)। দুজন লোক যখন একই বস্তু দেখে, তখন দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ঘটে কিন্তু তারা একই গোষ্ঠীর ঘটনা এবং একই কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। দুটি লোক (আমরা যে রকম বলি) যখন একই গোলমাল শোনে তখনো। একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং, এমন কি আলোকীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও প্রতিবিম্বিত বস্তুটির তুলনায় প্রতিবিম্বটির বাস্তবতা স্বল্পতর। তার কারণ প্রতিবিম্বটি যেখানে রয়েছে বলে মনে হয় সেখান থেকে সমস্ত দিকে আলোক বিস্তৃত হয় না। বিস্তৃত হয় শুধুমাত্র দর্পণের সম্মুখে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিবিম্বিত বস্তুটি স্বস্থানে থাকে। প্রতিবিম্বিত হয় শুধুমাত্র ততক্ষণ পর্যন্ত। এতক্ষণ আমরা যে রকম বলছিলাম, সেই ভাবে একটি কেন্দ্রের চারপাশে সংযুক্ত ঘটনাগুলিকে গোষ্ঠীভুক্ত করার সুবিধার এটা একটা উদাহরণ।

ঐ রকম এক গোষ্ঠী বস্তুর ভিতরে পরিবর্তন পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাই পরিবর্তন দু’রকম : কতগুলি পরিবর্তন ঐ গোষ্ঠীর কয়েকটি মাত্র সদস্যকে প্রভাবিত করে আর কতগুলি পরিবর্তন আসে সংযুক্তভাবে গোষ্ঠীর সমস্ত সদস্যের ভিতরে। একটি আয়নার সামনে একটি মোমবাতি রেখে যদি আপনি আয়নার উপর একটি কালো কাপড় ঝুলিয়ে দেন তাহলে আপনি শুধু মোমবাতির নানা জায়গা থেকে দৃশ্যমান প্রতিফলনের পরিবর্তন করবেন। আপনি যদি চোখ বন্ধ করেন তাহলে নিজ সাপেক্ষ এর দৃষ্টিগোচরতার পরিবর্তন করছেন কিন্তু আপনি যদি এক ফুট দূরত্বে একে বেষ্টন করে একটি লাল গোলক স্থাপন করেন তাহলে এক ফুটের বেশি দূরত্বে যে কোনো জায়গাতে এর রূপের পরিবর্তন করবেন কিন্তু এ ফুটের কম দূরত্বে কোনো পরিবর্তন করবেন না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে মোমবাতির স্বতত কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন না, আসলে আপনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখতে পান একটি ভিন্ন কেন্দ্র কিংবা একাধিক ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত কতগুলি পরিবর্তনের গোষ্ঠী রয়েছে। দৃষ্টান্ত : আপনি যখন চোখ বন্ধ করেন তখন অন্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে আপনার চোখই অন্যরকম দেখায়, মোমবাতিটি নয়। যে পরিবর্তনগুলি ঘটছে তার কেন্দ্র রয়েছে আপনার চোখে। কিন্তু মোমবাতিটা আপনি নিভিয়ে দিলে তার চেহারার পরিবর্তন হয় সর্বত্র। এ ক্ষেত্রে আপনি বলেন পরিবর্তনটা হয়েছে মোমবাতিতে। একটি বস্তুকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগোষ্ঠী থাকে তার সবগুলিকে যে পরিবর্তন প্রভাবিত করে সেটাই ঐ বস্তুতে সংঘটিত পরিবর্তন। এ সমস্তই সাধারণ বুদ্ধির ব্যাখ্যা এবং আয়নার ভিতরকার মোমবাতির প্রতিবিম্ব মোমবাতিটার চাইতে কম বাস্তব এ কথা বলার অর্থ ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। ঐ জায়গার চতুর্দিকে সংশ্লিষ্ট এমন কোনো ঘটনাগোষ্ঠী নেই যেখানে ঐ প্রতিবিম্ব আছে বলে মনে হয়। প্রতিবিম্বের পরিবর্তনগুলির কেন্দ্র আসলে মোমবাতি, আয়নার পিছনের কোনো বিন্দু সে কেন্দ্র নয়। এ থেকে, ‘প্রতিবিম্বটি প্রতিফলন মাত্র এই বিবৃতির নিখুঁত প্রমাণযোগ্য অর্থ পাওয়া যায়। অন্তরীক্ষের বস্তুপিণ্ডগুলি যদিও আমরা স্পর্শ করতে পারি না, শুধুমাত্র দেখতে পারি, তবুও একই সঙ্গে আমরা সেগুলিকে আয়নায় দেখা প্রতিবিম্বের চাইতে বেশি বাস্তব মনে করার সামর্থ্য লাভ করি।

এখন আমরা একটি বস্তুপিণ্ডের উপর অন্য একটি বস্তুপিণ্ডের ক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণ বুদ্ধিজাত ধারণার ব্যাখ্যা শুরু করতে পারি। বলের অবলুপ্তি কথার অর্থ যদি আমরা সত্যিই বুঝতে চাই তাহলে এ ব্যাখ্যা আমাদের অবশ্য প্রয়োজন। ধরুন আপনি একটি অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে ইলেকট্রিক আলোর সুইচ টিপেছেন : ঘরের সব জিনিসপত্রের চেহারা বদলে গিয়েছে। ঘরের প্রতিটি জিনিস দেখা যাচ্ছে তার কারণ সেগুলি থেকে বিদ্যুতের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। এ ব্যাপারটার সঙ্গে আয়নার প্রতিবিম্বের বাস্তব সাদৃশ্য রয়েছে। উদ্ভূত সমস্ত পরিবর্তনের কেন্দ্র বিদ্যুতের আলো এ ক্ষেত্রে আমরা আগে যা বলেছি তাই দিয়েই ‘ক্রিয়া’ ব্যাখ্যা করা যায়। ক্রিয়া একটি গতি হলে ব্যাপারটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন– ব্যাঙ্কের কাজের দিনের ভিড়ের মাঝে আপনি একটা বাঘ ছেড়ে দিয়েছেন। ভিড়ের সবাই ছোটাছুটি করবে। আর তাদের নানারকম গতির কেন্দ্র হবে ঐ বাঘটা। কেউ যদি লোকজন দেখতে পায়, কিন্তু বাঘটা দেখতে না পায় তাহলে সে ভাববে ওখানে বিকর্ষণ করার মতো কিছু রয়েছে। এখানে আমরা বলি বাঘটার লোকগুলির উপর একটা ক্রিয়া আছে আর লোকগুলির উপর বাঘের ক্রিয়াকে আমরা বলতে পারি বিকর্ষণকারী চরিত্রের ক্রিয়া। আমরা কিন্তু জানি, লোকগুলি পালাচ্ছে তার কারণ তাদের প্রতিটি কিছু একটা ঘটছে, শুধু বাঘ পড়েছে বলে তারা পালাচ্ছে তা নয়। তারা পালায় তার কারণ তারা বাঘটাকে দেখতে পায় এবং বাঘের আওয়াজ শুনতে পায়। এর কারণ কতগুলি তরঙ্গ তাদের চোখে আর কানে পৌঁছানো। বাঘ না থাকলেও যদি ঐ তরঙ্গগুলিকে তাদের কাছে পৌঁছানো যেত তাহলেও তারা একই রকম বেগে পালাত। তার কারণ পরিবেশ তাদের কাছে একই রকম অসন্তোষজনক মনে হতো।

এবার একই বিবেচনা প্রয়োগ করা যাক সূর্যের মহাকর্ষের ব্যাপারে। সূর্য যে বল প্রয়োগ করে তার সঙ্গে বাঘের প্রযুক্ত বলের পার্থক্য শুধুমাত্র এই যে বাঘের বল বিকর্ষণ করে আর সূর্যের বল আকর্ষণ করে। সূর্য আলোকতরঙ্গ কিংবা শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে কাজ করে না। সূর্যকে বেষ্টন করে যে স্থান-কাল, তার পরিবর্তনগুলির জন্যই সূর্য তার আপাতদৃষ্ট ক্ষমতা লাভ করে। বাঘের গর্জনের মতোই সেগুলি উৎসের কাছে বেশি তীব্র। আমরা যত দূরে যাই এগুলিও তত কমতে থাকে। স্থান-কালের এই সমস্ত পরিবর্তনের কারণ সূর্য–এ কথা বললে আমাদের কিছু জ্ঞানবৃদ্ধি হয় না। আমরা জানি এই পরিবর্তনগুলি একটা নিয়ম মেনে চলে এবং তারা প্রতিসমরূপে (symmetrically) সূর্যকে কেন্দ্র করে সর্বদিকে গোষ্ঠীভুক্ত (grouped)। কার্যকারণের বাগ্বিধি শুধুমাত্র কিছু অবান্তর কল্পনা যোগ করে ইচ্ছা, মাংসপেশীর টান এই জাতীয় তত্ত্বের সঙ্গে এগুলি যুক্ত। মহাকর্ষ সৃষ্টিকারী পদার্থের উপস্থিতিতে যে সঙ্কেত অনুসারে স্থান-কালের পরিবর্তন হয় সেই সঙ্কেত নির্ণয় করতে পারি মহাকর্ষ সৃষ্টিকারী পদার্থের উপস্থিতি কি রকম স্থান-কাল। যখন বিশেষ একটি অঞ্চলে স্থান-কাল নির্ভুল ইউক্লিডীয় নয় বরং তার একটি অনিউক্লিডীয় চরিত্র রয়েছে এবং একটি বিশেষ কেন্দ্রের যত নিকটতর হওয়া যায় তত সেই অনিউক্লিডীয় চরিত্র বৃদ্ধি পায় এবং যখন ইউক্লিড থেকে বিচ্যুতি একটি বিশেষ বিধি পালন করে তখন এই অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে হলে আমরা বলি : কেন্দ্রে মহাকর্ষ সৃষ্টিকারী পদার্থ রয়েছে। কিন্তু এটা শুধু আমরা যা জানি তার একটি সংক্ষিপ্তসার। মহাকর্ষ সৃষ্টিকারী পদার্থ যে সমস্ত জায়গায় নেই সেই সমস্ত জায়গা সম্পর্কে আমরা জানি। যে সমস্ত জায়গায় রয়েছে সেই সমস্ত জায়গা সম্পর্কে জানি না। কার্যকারণের বাগ্বিধি (‘বল’ সে বাগ্বিধির একটি বিশেষ ক্ষেত্র মাত্র) বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য ব্যবহৃত সুবিধাজনক সংক্ষিপ্ত দ্রুতলিখন পদ্ধতি (short hand) মাত্র। ভৌত বিশ্বে সত্যই যা পাওয়া যায় তার কোনো প্রতিরূপ এ বাগ্বিধি নয়।

আর, পদার্থটা কি ব্যাপার? পদার্থও কি সুবিধাজনক দ্রুতলিখন পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয়? এ প্রশ্নটা খুব বড়। তার জন্য প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *