০৪. ঘড়ি আর ফুটরুল

৪. ঘড়ি আর ফুটরুল

দুটি ভিন্ন স্থানে দুটি ঘটনা একই কালে ঘটেছে : এ বিবৃতিতে অনিশ্চিত কিছু থাকতে পারে, বিশিষ্ট অপেক্ষবাদের আবির্ভাবের আগে একথা কেউ ভাবেননি। স্থান দুটি যদি পরস্পর সাপেক্ষ বহু দুরস্থিত হয় তাহলে ঘটনা দুটি সত্যিই যুগপৎকিনা সে তথ্য নির্ধারণে অসুবিধা থাকতে পারে : এ কথা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সবাই ভেবেছে এ প্রশ্নের অর্থ সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট নিশ্চিত। কিন্তু দেখা গেল এ ধারণাও ছিল ভুল। ক্রটিশূন্যতা নিশ্চিত করার জন্য যে পর্যবেক্ষকটি সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করেছেন (বিশেষ করে আলোকের বেগ বিচার করেছেন) তাঁর কাছে দুটি ঘটনা যুগপৎ মনে হতে পারে, আবার একই রকম সতর্ক অন্য একজন পর্যবেক্ষকের বিচারে মনে হতে পারে প্রথম ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয়টির আগে এবং তৃতীয় আর এক পর্যবেক্ষকের যদি পরস্পর সাপেক্ষ দ্রুত চলমান হন তাহলে এরকম হতে পারে। একজন নির্ভুল এবং অন্য দুজন ভুল করেছেন ব্যাপারটা এরকম নয়। তারা প্রত্যেকে একই রকম নির্ভুল। ঘটনার কালবিন্যাস (time order) আংশিক পর্যবেক্ষক নির্ভর এবং সব সময় ঘটনাগুলির সঙ্গে স্বতত সম্পূর্ণ অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কযুক্ত নয়। অপেক্ষবাদ দেখিয়েছে : এ দৃষ্টিভঙ্গি শুধু পরিঘটনা ব্যাখ্যা করে তাই নয়– এই দৃষ্টিভঙ্গির হওয়া উচিত ছিল প্রাচীন উপাত্তের ভিত্তিত্তে সতর্ক যুক্তি প্রয়োগের ফলস্বরূপ। আসলে কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় বিষম (odd) ফলগুলি মানুষের যুক্তিকে সজোরে ধাক্কা না দিয়েছে ততদিন পর্যন্ত কেউ অপেক্ষবাদের যৌক্তিক ভিত্তি লক্ষ্য করেনি।

ভিন্ন স্থানের দুটি ঘটনা যুগপৎ কিনা সে সম্পর্কে আমরা স্বাভাবিকভাবে কি করে সিদ্ধান্ত নেব? স্বভাবতই লোকে বলবে নির্ভুলভাবে মধ্যবর্তী কোনো ব্যক্তি যদি ঘটনা দুটি যুগপৎ দেখতে পায় তাহলে সে দুটি ঘটনা যুগপৎ (একই স্থানে দুটি ঘটনার যৌগপত্তায় কোনো অসুবিধা নেই, উদাহরণ : আলো দেখা এবং শব্দ শোনা)। ধরুন দুটি ভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ চমকেছে। অনুমান করুন গ্রীন উইচ মানমন্দির এবং কিউ মানমন্দির (Greenwich Observatory & Kew Observatory)। অনুমান করা যাক সেন্ট পলস্ দুটি মানমন্দিরের মধ্যবর্তী এবং সেন্ট পলসের গম্বুজের উপরের একজন পর্যবেক্ষকের কাছে দুটি চমকই যুগপৎ মনে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কিউয়ের লোক কিউয়ের বিদ্যুৎ চমক প্রথমে দেখবে আর গ্রিনউইচের লোক প্রথম দেখবে গ্রিনউইচের বিদ্যুৎ চমক। এর কারণ অন্তর্বর্তী দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় কাল। আর্দ নির্ভুল পর্যবেক্ষক হলে তিনজনই বিচার করবেন বিদ্যুৎ চমক দুটি ছিল যুগপৎ। কারণ আলোক প্রেরণের জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে তারা স্বীকৃতি দেবেন। (নির্ভুলতার এমন মান আমি অনুমান করছি যা মানুষের পক্ষে অসম্ভব)। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠের ঘটনা নিয়ে আমরা বিচার করছি ততক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীর পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ যুগপত্তার সংজ্ঞা যথেষ্ট কার্যকর হবে। এ সংজ্ঞার প্রদত্ত ফল পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং যে সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা পৃথিবীর গতিকে অগ্রাহ্য করতে পারি সে সমস্ত ক্ষেত্রে পার্থিব পদার্থবিদ্যার সমস্ত সমস্যাঁতেই এ সংজ্ঞা ব্যবহার সম্ভব।

কিন্তু যেখানে দুইদল পর্যবেক্ষক পরস্পর সাপেক্ষ দ্রুত চলমান সেখানে এ সংজ্ঞা অতটা সন্তোষজনক নয়। অনুমান করা যাক, আলোকের স্থলে শব্দকে প্রতিস্থাপন করলে কি হয় আমরা তাই দেখছি এবং দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী কেউ যখন যুগপৎ শুনতে পাচ্ছে তখন আমরা ঘটনা দুটিকে যুগপৎ বলে সংজ্ঞিত করছি। নীতিগতভাবে এতে কোনো পরিবর্তন হয় না কিন্তু শব্দের গতিবেগ তুলনায় অনেক কম হওয়াতে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যায়। অনুমান করা যাক, এক কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রিতে দুজন ডাকাত ট্রেনের গার্ড আর ড্রাইভারকে গুলি করেছে। গার্ড রয়েছে গাড়ির পিছনে, ডাকাতরা লাইনের উপরে এবং তারা নিহতদের গুলি করেছে খুব কাছ থেকে। গাড়ির ঠিক মাঝখানের একজন যাত্রী দুটি গুলির শব্দই যুগপৎ শুনতে পেল। সুতরাং আপনি হয়তো বলবেন দুটি গুলিই ছিল যুগপৎ । কিন্তু একজন স্টেশ মাস্টার ছিলেন দুটো ডাকাতেরই ঠিক মাঝখানে। তিনি প্রথমে শুনতে পেলেন যে গুলিতে গার্ড মরেছে সেই গুলির আওয়াজ। গার্ড এবং ড্রাইভারের (এরা দুজন মাসতুত ভাই) কোটিপতি এক অস্ট্রেলিয়ান মাসী (aunt) তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন গার্ডকে। কিন্তু গার্ড যদি আগে মারা যায় তাহলে সম্পত্তি পাবে ড্রাইভার। কে আগে মারা গিয়েছে সে প্রশ্নের সঙ্গে বিরাট সম্পত্তি জড়িত। মামলা উঠেছে লর্ড সভায়। দু’পক্ষের উকিলরাই অক্সফোর্ডে শিক্ষা নিয়েছেন এবং তারা এ বিষয়ে একমত যে, হয় যাত্রীটি ভুল করেছে নয়তো ভুল করেছে সেই স্টেশন মাস্টার। আসলে দুজনেই কিন্তু একদম সঠিক হতে পারে। গাড়িটা চলেছে গার্ডের প্রতি গুলি থেকে দূরের এবং ড্রাইভারের প্রতি গুলির অভিমুখে। সুতরাং যাত্রীর কাছে পৌঁছাতে ড্রাইভারের অভিমুখে নিক্ষিপ্ত গুলির শব্দের তুলনায় গার্ডের অভিমুখের নিক্ষিপ্ত গুলির শব্দের বেশি সময় লাগবে। সুতরাং যাত্রীটি যখন বলছে সে শব্দ দুটি যুগপৎ শুনেছে, তখন সে ঠিকই বলছে। স্টেশন মাস্টার যখন বলছে সে গার্ডের অভিমুখে নিক্ষিপ্ত গুলির শব্দ আগে শুনেছে তখন সে নিশ্চয়ই ঠিক কথা বলছে।

এরকম ক্ষেত্রে আমরা পৃথিবীবাসীরা একজন ট্রেন যাত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় পৃথিবীতে স্থিতিশীল ব্যক্তির যুগপত্তা সম্পৰ্কীয় দৃষ্টিভঙ্গি বেশি পছন্দ করব। কিন্তু তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় এরকম সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধ সংস্কার অনুমোদনীয় নয়। যুগপত্তা সম্পৰ্কীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে একজন পৃথিবীবাসী পদার্থবিদ্যাবিদের যতটা অধিকার, ধূমকেতুবাসী একজন পদার্থবিদ্যাবিদের অধিকারও ততটাই : অবশ্য ধূমকেতুতে যদি কোনো পদার্থবিদ্যাবিদ থাকেন। তবে আমাদের গুলি এবং ট্রেনের দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল এক্ষেত্রেও তেমনি ফলের পার্থক্য হবে। গতির ব্যাপারে পৃথিবীর তুলনায় ট্রেন এমন কিছু বেশি বাস্তব’ (real) নয়–এ ব্যাপারে কোনো ‘বিশেষ বাস্তবিকতা’-ই নেই। আপনি কল্পনা করতে পারেন : একটি খরগোশ আর একটি জলহস্তী তর্ক করছে মানুষ বাস্তবিকই’ (realy) বৃহৎ জন্তু কিনা। প্রত্যেকেই ভাববে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটাই স্বাভাবিক আর অন্যেরটা শুদ্ধ কল্পনাবিলাস মাত্র। পৃথিবী আর ট্রেনের ভিতরে কোনটা বাস্তবিকই গতিশীল এ তর্কের ভিতরেও সারবস্তু (substance) একইরকম অল্প। সুতরাং দূরে সংঘটিত একাধিক ঘটনার যুগপত্তার সংজ্ঞা নির্ণয়ের সময় মধ্যবর্তী বিন্দু নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন বস্তুপিণ্ডের ভিতর থেকে একটিকে বেছে নেওয়া কিংবা নির্বাচন করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। সমস্ত বস্তুপিণ্ডেরই নির্বাচিত হওয়ার অধিকার সমান। কিন্তু সংজ্ঞা অনুসারে যদি একটি বস্তুপিণ্ড সাপেক্ষ দুটি ঘটনা যুগপৎ হয় তাহলে অন্য বস্তুপিণ্ড থাকবে যেগুলি সাপেক্ষ প্রথম ঘটনা দ্বিতীয়টির পূর্বগামী এবং আরো অন্য বস্তুপিণ্ড থাকবে যেগুলি সাপেক্ষ দ্বিতীয়টি প্রথমটির পূর্বগামী। সুতরাং দূরের দুটি ঘটনা যুগপৎ একথা আমরা নিশ্চিন্তভাবে বলতে পারি না। এরকম বিবৃতির নির্দিষ্ট নিশ্চিত অর্থ শুধুমাত্র হতে পারে নির্দিষ্ট নিশ্চিত পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ। এ বিবৃতি আমাদের ভৌত পরিঘটনা পর্যবেক্ষণের ব্যক্তিনিষ্ঠ অংশ বস্তুনিষ্ঠ অংশ নয়। এই বস্তুনিষ্ঠ অংশই ভৌত বিধির উপাদান।

বিভিন্ন স্থানের কাল বিষয়ক এই প্রশ্নই বোধহয় কল্পনের ক্ষেত্রে অপেক্ষবাদের সবচাইতে কঠিন দিক। সবকিছুরই একটা তারিখ থাকতে পারে : এ ধারণায় আমরা অভ্যস্ত। ৭৭৬ খ্রিস্ট পূর্ব অব্দের ২৭শে আগস্ট চীনে একটি সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল : এ তথ্য ইতিহাসবেত্তারা ব্যবহার করেন। উত্তর চীনের একটি নির্দিষ্ট স্থানে সূর্যগ্রহণ কখন পূর্ণগ্রাসে পরিণত হতে শুরু করেছিল সে তথ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ঘণ্টা মিনিট মেপে নির্ভুলভাবে বলতে পারতেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।*

এ তথ্যও স্পষ্ট প্রতীয়মান যে আমরা নির্দিষ্ট মুহূর্তে গ্রহগুলির অবস্থান বলে দিতে পারি। নিউটনীয় তত্ত্বের সাহায্যে আমরা গ্রিনউইচ ঘড়ি অনুসারে নির্দিষ্টকালে পৃথিবী আর (ধরা যাক) বৃহস্পতি থেকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে কত সময় লাগে। ধরুন আধঘণ্টা লাগে। তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি : এখন। আমরা বৃহস্পতিকে যেখানে দেখছি আধ ঘণ্টা আগে বৃহস্পতি সেখানে ছিল : এ সমস্তই স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু আসলে প্রয়োগক্ষেত্রে এটা কার্যকর কারণ আলোকের গতিবেগের তুলনায় গ্রহগুলির গতিবেগ অত্যন্ত অল্প। আপনার বিচারে যখন বৃহস্পতি গ্রহের একটি ঘটনা এবং পৃথিবীর একটি ঘটনা যুগপৎ ঘটেছে– উদাহরণ : গ্রিনউইচ সময়ের মধ্যরাত্রি বারোটায় বৃহস্পতির একটি চাঁদে গ্রহণ হল– পৃথিবী সাপেক্ষ দ্রুত চলমান কোনো ব্যক্তির বিচারে তখন ব্যাপারটা অন্যরকম হবে। যদি অনুমান করা যায় দুজনেই আলোকের গতিবেগকে সঠিকভাবে হিসাবের ভিতরে নিয়েছেন তা সত্ত্বেও এ পার্থক্য থাকবে। স্বভাবতই যুগপত্তা সম্পর্কীয় মতানৈক্য সময়ের পর্যায়কাল (periods of time) সম্পৰ্কীয় মতানৈক্যের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের বিচারে যদি মনে হয় বৃহস্পতি গ্রহের দুটি ঘটনার অন্তবর্তীকাল চব্বিশ ঘণ্টা, বৃহস্পতি এবং পৃথিবী সাপেক্ষ দ্রুতগামী আর একজনের বিচারে মনে হতে পারে অন্তবর্তীকাল দীর্ঘতর।

সুতরাং যে সর্বৰ্গত ব্রহ্মাণ্ডীয় কালকে (Universal Cosmic Time) মেনে নেওয়া হতো সে কাল আর গ্রহণীয় নয়। প্রতিটি বস্তুপিণ্ড সাপেক্ষ সান্নিধ্যের ঘটনাবলী সম্পর্কে নির্দিষ্ট নিশ্চিত কালবিন্যাস রয়েছে। এর নাম দেওয়া যেতে পারে সেই বস্তুপিণ্ডের বিশিষ্ট কাল (proper time)। আমাদের নিজ দেহের ‘বিশিষ্ট (proper) কাল আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার নিয়ামক, যেহেতু আমরা পৃথিবীর উপরে প্রায় স্থিরভাবে অবস্থান করি সেইজন্য বিভিন্ন মানুষের বিশিষ্ট কালের ভিতরে ঐক্য রয়েছে এবং সেগুলিকে একসঙ্গে বলা যেতে পারে পার্থিব কাল (terrestrial time)। কিন্তু এ কাল শুধুমাত্র পৃথিবীর বৃহৎ’ (large) বস্তুপিণ্ডগুলির উপযুক্ত। ল্যাবরেটরির ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অন্য কাল প্রয়োজন। যেহেতু আমরা নিজস্ব কাল ব্যবহারের জন্য জিদ করি সেই জন্যই আমাদের মনে হয় দ্রুতগতির সঙ্গে সঙ্গে এদের ভর বৃদ্ধি পায়, তাদের দৃষ্টিতে তাদের ভর অপরিবর্তিত থাকে বরং আমরাই হঠাৎ রোগা কিংবা মোটা হয়ে যাই। একজন পদার্থবিদ্যাবিদের ইতিহাস যদি একটি ইলেকট্রন পর্যবেক্ষণ করে তাহলে সে গ্যালিভারের ভ্রমণকাহিনীর সঙ্গে সাদৃশ্য দেখতে পাবে।

এখন প্রশ্ন : ঘড়ি আসলে কি মাপে? অপেক্ষবাদে যখন আমরা ঘড়ির কথা বলি তখন আমরা শুধুমাত্র মানুষের তৈরি ঘড়ির কথাই বলি না–যা কিছু নিয়মিত পর্যাবৃত্ত ক্রিয়া (regular periodic performance) করে তাকেই আমরা ঘড়ি বলি। পৃথিবী তেইশ ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিটে একবার আবর্তিত হয় সুতরাং পৃথিবী একটি ঘড়ি। পরমাণুও ঘড়ি কারণ পরমাণু থেকে অত্যন্ত নির্দিষ্ট নিশ্চিত স্পন্দাঙ্ক (frequency) সম্পন্ন আলোকতরঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়। পরমাণুর বর্ণালীতে এই আলোকতরঙ্গ দেখা দেয় উজ্জ্বল রেখা রূপে। বিশ্ব পূর্ণ রয়েছে পর্যাবৃত্ত ঘটনায় (periodic occurences) এবং পরমাণুর মতো মূলগত ক্রিয়াবিধিগুলির Fundamental mechanism) অসাধারণ সমরূপত্ব দেখা যায় মহাবিশ্বের বিভিন্ন অংশে। এই পর্যাবৃত্ত ঘটনাগুলির যে কোনো একটিকে কাল মাপনের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব। মানুষের তৈরি ঘড়ি পর্যবেক্ষণ করা বিশেষভাবে সুবিধাজনক। এটাই সে ঘড়ির একমাত্র সুবিধা। অন্য অনেক ঘড়ি কিন্তু তার চাইতে নির্ভুল। আজকাল কালের মাপকের ভিত্তি সিসিয়াম পরমাণুর (coesium atom) একটি বিশেষ দোলনের (particular oscilation) স্পন্দাঙ্ক। মাপনের এই ভিত্তি পৃথিবীর আবর্তননির্ভর ভিত্তির চাইতে অনেক বেশি সুষম (uniform)। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় : ব্রহ্মাণ্ডীয় কাল যদি পরিত্যাগ করা হয় তাহলে শব্দটির উপর এক্ষুণি আমরা যে ব্যাপক অর্থ আরোপ করলাম সেই অর্থে ঘড়ি আসলে কি মাপে?

প্রত্যেকটি ঘড়ি তার নিজস্ব বিশিষ্ট (proper) কালের নির্ভুল মাপ প্রদর্শন করে। আমরা এখনই দেখতে পাব এই নির্ভুল মাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌতরাশি (quantity)। কিন্তু একটি ঘড়ি সাপেক্ষ দ্রুত চলমান বস্তুপিণ্ডগুলির সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাবলীর কোনো ভৌত রাশির নির্ভুল মাপন আমরা ঘড়ির সাহায্যে পাই না। ঐ রকম ঘটনাবলীর সঙ্গে সংযুক্ত ভৌতরাশি আবিষ্কারের একটি উপাত্ত (data) আমরা ঘড়ির সাহায্যে পাই কিন্তু আর একটি উপাত্ত প্রয়োজন। সে উপাত্ত আহরণ করতে হবে স্থানে (space) দূরত্ব মাপনের সাহায্যে। স্থানে দূরত্ব (distance in space) কালের পর্যাবৃত্তির মতো, সাধারণত বস্তুনিষ্ঠ কোনো ভৌত (periods of time) তথ্য নয়, এগুলি আংশিকভাবে পর্যবেক্ষক নির্ভর। ব্যাপারটা কি করে হয় এখন অবশ্যই সে ব্যাখ্যা করতে হবে।

প্রথমত আমাদের ভাবতে হবে দুটি ঘটনার দূরত্ব দুটি বস্তুপিণ্ডের দূরত্ব নয়। কাল বিষয়ে আমরা যা জেনেছি তা থেকেই এ তথ্য তৎক্ষণাৎ আহরণ করা যায়। দুটি বস্তুপিণ্ড যদি পরস্পর সাপেক্ষ চলমান হয়–আসলে ব্যাপারটা সব সময় এইরকম হয় তাহলে তাদের পারস্পরিক দূরত্ব সম্ভবত (continuous) পরিবর্তনশীল। সুতরাং তাদের দূরত্ব উল্লেখ করতে হলে একটি বিশেষ কালে দূরত্বই বলতে হয়। আপনি যখন ট্রেনে এডিনবরা চলেছেন তখন এডিনবরা থেকে আপনার দূরত্ব একটি বিশেষ সময়কার দূরত্ব। কিন্তু আগেই আমরা বলেছি এডিনবরার একটি ঘটনা এবং ট্রেনের একটি ঘটনার ‘সমকাল’ (same time) সম্পর্কে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক বিভিন্ন বিচার করবেন। এর ফল : ঠিক যেমন দেখা গিয়েছে কালের মাপন আপেক্ষিক তেমনি দূরত্বের মাপনও আপেক্ষিক। আমরা সাধারণত ভাবি দুটি ঘটনার ভিতরে আলাদা দু’রকম অন্তর (interval) আছে : স্থানের অন্তর এবং কালের অন্তর। আপনার লন্ডন থেকে রওনা হওয়া এবং এডিনবরায় পৌঁছানোর ভিতরে রয়েছে চারশ মাইল আর দশ ঘণ্টা। আমরা আগেই দেখেছি অন্য পর্যবেক্ষকরা সময় বিচার কবেন পৃথকভাবে এবং তারা যে দূরত্বও পৃথকভাবে বিচার করবেন সে তথ্য আরও স্পষ্ট। সূর্যের উপরের একজন পর্যবেক্ষক ট্রেনের গতিকে অত্যন্ত তুচ্ছ মনে করবেন। তার বিচারের আপনার চলার পরিমাণ– পৃথিবীর নিজ কক্ষে ভ্রমণ এবং পৃথিবীর আহ্নিক আবর্তনের পরিমাণের যোগফলের সমান। আবার রেলগাড়ির একটি মাছি ভাববে আপনি স্থানে কোনো চলাচলই করেননি কিন্তু তাকে আপনি কিছুকালের জন্য আনন্দ দান করেছেন। তবে সে কালটা সে গ্রিনউইচ মানমন্দির দিয়ে মাপবে না, মাপবে তার নিজস্ব বিশিষ্ট কাল দিয়ে। আপনি কিংবা সূর্যবাসী কিংবা মাছি কেউ ভুল করেছে বলা চলবে না। প্রত্যেকেরই চিন্তা একই রকম যুক্তিসঙ্গত। একমাত্র ভুল হল– ব্যক্তিনিষ্ঠ মাপনের উপর বস্তুনিষ্ঠ সত্যতা আরোপ করা। সুতরাং দুটি ঘটনার ভিতরের স্থানিক দূরত্ব সন্তত একটি ভৌত ঘটনা (physical fact) নয়। এর পরে কিন্তু আমরা দেখব ভৌত ঘটনা একটি আছে এবং কালিক দূরত্ব আর স্থানিক দূরত্ব থেকে ঘটনা জানা যেতে পারে। একেই বলা হয় স্থান-কাল অন্তর’ (interval)।

ব্রহ্মাণ্ডের (Universe) যে কোনো দুটি ঘটনা বিচার করলে তাদের ভিতরে দুটি পৃথক সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখা যায়। ভৌতভাবে একটি বস্তুপিণ্ডের পক্ষে এমন গতি সম্ভব হতে পারে যে দুটি ঘটনাস্থলেই তার উপস্থিত হওয়া সম্ভব কিংবা সম্ভব নয়। এটা নির্ভর করে এই তথ্যের উপর : কোনো বস্তুপিণ্ডই আলোর মতো দ্রুত চলতে পারে না। উদাহরণ : ধরুন একটি আলোর ঝলক পৃথিবী থেকে চাঁদে প্রেরিত হয়েছে এবং প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে। আলোক প্রেরণ এবং প্রতিফলনের প্রত্যাবর্তনের অন্তবর্তী কাল হবে প্রায় আড়াই সেকেন্ডে। এই আড়াই সেকেন্ডের ভিতরে কোনো এক সময় পৃথিবীতে উপস্থিত থাকা এবং আলোকের চাঁদে পৌঁছানোর মুহূর্তে চাঁদে উপস্থিত থাকার মতো দ্রুতগতি কোনো বস্তুপিণ্ডের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তা করতে হলে বস্তুপিণ্ডটিকে আলোকের চাইতে দ্রুততর গতিতে যেতে হবে, কিন্তু তাত্ত্বিক দিক থেকে একটি বস্তুপিণ্ডের ঐ আড়াই সেকেন্ডের আগে কিংবা পরে যে কোনো সময়ে পৃথিবীতে উপস্থিত থাকা সম্ভব এবং সম্ভব আলোর ঝলক পৌঁছাবার সময় চাঁদে উপস্থিত থাকা। যখন একটি বস্তুপিণ্ডের দুটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার মতো চলন ভৌতভাবে সম্ভব নয় তখন আমরা বলি দুটি ঘটনার ‘অন্তর’** (interval) স্থানানুরূপ (space like); যখন বস্তুপিণ্ডটির দুটি ঘটনাস্থলেই উপস্থিত থাকা ভৌত ভাবে (physically) সম্ভব তখন আমরা বলব দুটি ঘটনার অন্তর কালানুরূপ (time like)। অন্তর যখন স্থানানুরূপ তখন একটি বস্তুপিণ্ডের পক্ষে এমন ভাবে চলা সম্ভব যে তার উপরিস্থিত একজন পর্যবেক্ষকের বিচারে দুটি ঘটনা যুগপৎ হবে। সে ক্ষেত্রে ঐ রকম একজন পর্যবেক্ষকের বিচারে দুটি ঘটনার ‘অন্তর’ হবে স্থানে দুটি ঘটনার দূরত্ব (distance in space)। অন্তর যখন স্থানানুরূপ একটি বস্তুপিণ্ড তখন দুটি ঘটনাস্থলেই উপস্থিত থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বস্তুপিণ্ডের উপরিস্থিত একজন পর্যবেক্ষকের বিচারে দুটি ঘটনার অন্তর হবে তাদের অন্তবর্তীকাল অর্থাৎ সেটাই দুটি ঘটনার অন্তবর্তী বিশিষ্ট কাল। কিন্তু এ দুটির মাঝে একটি সীমক ঘটনা (lim iting case) রয়েছে : যখন দুটি ঘটনা একটি আলোক ঝলকের অংশ কিংবা আমরা বলতে পারি যখন একটি ঘটনা অন্যটির দর্শন (seeing of the other)। সে ক্ষেত্রে দুটি ঘটনার অন্তর হবে শূন্য (zero)।

তাহলে ঘটনা রয়েছে তিনটি। (১) একটি আলোকরশ্মির দুটি ঘটনাস্থলেই উপস্থিত থাকা সম্ভব হতে পারে। এ ব্যাপার ঘটে যখন একটি ঘটনা অন্য ঘটনার দর্শন। এক্ষেত্রে দুটি ঘটনার অন্তর শূন্য (zero)। (২) হতে পারে একটি বস্তুপিণ্ড কোনোক্রমেই একটি ঘটনাস্থল থেকে অন্য ঘটনাস্থলে যেতে পারে না কারণ সে ক্ষেত্রে তার চলন আলোকের চাইতে দ্রুত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটি বস্তুপিণ্ডের সব সময়ই এমন ভাবে চলার ভৌত সম্ভাবনা রয়েছে যে সেই বস্তুপিণ্ডের উপরিস্থিত একজন পর্যবেক্ষকের বিচারে দুটি ঘটনা হবে যুগপৎ। পর্যবেক্ষকের বিচারে দুটি ঘটনার স্থানিক দূরত্ব হবে অন্তর (interval)। এই রকম অন্তরের নাম স্থানানুরূপ। (৩) একটি বস্তুপিণ্ডের পক্ষে এমন চলন ভৌতভাবে সম্ভব হতে পারে যে সে দুটি ঘটনাতেই উপস্থিত থাকবে। সে ক্ষেত্রে ঐরকম বস্তুপিণ্ডের উপরে অবস্থিত একজন পর্যবেক্ষকের বিচারে তাদের অন্তবর্তী কাল হবে তাদের অন্তর। এইরকম অন্তরের নাম কালানুরূপ (time like)।

দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী অন্তর সেগুলি বিষয়ে ভৌত তথ্য। এ তথ্য পর্যবেক্ষকের বিশেষ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল নয়।

অপেক্ষবাদের দুটি অবয়ব (form)–বিশিষ্ট এবং ব্যাপক। পূর্বোক্তটি সাধারণত আসন্নমাত্র (only approximate) কিন্তু মহাকর্ষ সৃষ্টি করে এরকম পদার্থ (gravitating matter) থেকে বহুদূরে থাকলে এ তত্ত্ব প্রায় নির্ভুল হতে পারে। মহাকর্ষ যেখানেই অগ্রাহ্য করা যায়। সেখানেই বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ প্রয়োগ সম্ভব এবং দুটি ঘটনার অন্তবর্তী স্থানিক দূরত্ব এবং কালিক দূরত্ব যদি কোনো পর্যবেক্ষকের গণনা থেকে আমরা জানতে পারি তাহলে দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী অন্তর আমরা গণনা করতে পারি। স্থানিক দূরত্ব যদি আলোক ঐ কালে যতদূর যেতে পারত তার চাইতে বেশি হয়, বিচ্ছিন্নতা (separation) তাহলে স্থানানুরূপ। তাহলে দুটি ঘটনার অন্তর পাওয়া যায় নিম্নলিখিত গঠন থেকে : একটি রেখা AB অঙ্কন করুন। ঐ কালে আলোক যতদূর গমন করতে পারত রেখার দৈর্ঘ্য হবে ততটা। A-কে কেন্দ্র করে এবং স্থানে দুটি ঘটনার দূরত্বকে ব্যাসার্ধ করে একটি বৃত্ত অঙ্কন করুন। B-থেকে BC লম্ব আঁকুন। BC-এর সঙ্গে AB- এর লম্ব সম্পর্ক থাকবে, লম্বটি C-তে এসে বৃত্তের সঙ্গে মিলিত হোক। তাহলে BC হবে দুটি ঘটনার অন্তরের দৈর্ঘ্য ।

দূরত্ব যখন কালানুরূপ

দূরত্ব যখন কালানুরূপ তখন একই চিত্র ব্যবহার করুন। কিন্তু তখন কালে আলোক যে দূরত্ব অতিক্রম করত সেটা হোক AC, এবং AB হবে স্থানে দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী দূরত্ব। এখন তাদের অন্তর হবে BC দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোকের যে সময় লাগে সেই সময় ।

ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ AB এবং AC ভিন্ন হলেও ব্যাপক অপেক্ষবাদকৃত সংশোধন সাপেক্ষ সমস্ত পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রেই BC অভিন্ন। প্রাচীন পদার্থবিদ্যার স্থান এবং কাল বিষয়ক দুটি অন্তরের স্থলে স্থান-কাল’ অন্তর প্রতিস্থাপিত হয়েছে : এটা তারই প্রতিরূপ। আপাতত অন্তর সম্পর্কীয় এই দৃষ্টিভঙ্গি একটু রহস্যজনক মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বোধ কমবে এবং বস্তুর স্বভাবের ব্যাপারে এর যুক্তি ক্রমশ প্রকাশ পাবে।

———
* একটি সমকালীন চীনাগাঁথায় গ্রহণের সাল তারিখ নির্ভুলভাবে উল্লেখ করে লেখা হয়েছে: চাঁদের গ্রহণ একটা সাধারণ ব্যাপার সূর্যও এখন রাহুগ্রস্ত কী যে মন্দ ঘটনা।

** অন্তর শব্দের সংজ্ঞা আমি এখনই দেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *