০১. দৃষ্টি ও স্পর্শ : পৃথিবী এবং নভোমণ্ডল

১. দৃষ্টি ও স্পর্শ : পৃথিবী এবং নভোমণ্ডল

সবাই জানেন আইনস্টাইন বিস্ময়কর একটা কিছু করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কি সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অল্প লোকেরই আছে। ভৌত জগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণায় তিনি বিপ্লব এনেছিলেন–এ তথ্য সাধারণভাবে স্বীকৃত। কিন্তু নতুন ধারণাগুলি গাণিতিক প্রয়োগকৌশলে আবৃত। অপেক্ষবাদ সম্পর্কে সাধারণের জন্য অসংখ্য লেখা রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যেখানে শুরু হয়, ঠিক সেখানেই সেগুলি দুর্বোধ্য। এর জন্য লেখকদের দোষ সামান্য। নতুন ধারণাগুলির অনেকটাই গণিতের ভাষা ছাড়া প্রকাশ করা যায়। কিন্তু তাহলেও তারা কম দুর্বোধ্য নয়। প্রয়োজন আসলে আমাদের বিশ্বসম্পৰ্কীয় কল্পনের পরিবর্তন। এ কল্পন আমরা পেয়েছি আমাদের অতি প্রাচীন পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে যে পূর্ব-পুরুষেরা হয়তো প্রাক-মানবিক–আর শিখেছি আমরা প্রথম শৈশবে। আমাদের চিন্তাজগতের পরিবর্তন সবচাইতে কঠিন বিশেষ করে আমরা যখন আর তরুণ নই তখন। একই ধরনের পরিবর্তনের দাবী ছিল কোপার্নিকাসের। তিনি শিখিয়েছিলেন পৃথিবী নিশ্চয় নয়, নভোমণ্ডল পৃথিবীর চার পাশে দৈনিক একবার ঘুরছে এ কথাও সত্য নয়। আমাদের মনের অভ্যাস সুস্থির হওয়ার আগেই এ তথ্য আমরা শিখেছি। সেইজন্য এই কল্পনে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। যে প্রজন্মের মানুষ আইনস্টাইনের চিন্তাধারার সঙ্গেই বেড়ে উঠবে একই কারণে তাদের কাছে সহজতর হবে এই কল্পন। কিন্তু কল্পনের পুনর্গঠনের চেষ্টায় খানিকটা পরিশ্রম এড়ানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

আবিষ্কারের জন্য ধরাপৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করতে হলে আমরা সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় ব্যবহার করি। বিশেষ করে ব্যবহার করি দর্শন এবং স্পর্শনেন্দ্রিয়। প্রাবৈজ্ঞানিক যুগে দৈর্ঘ্য মাপতে হলে ব্যবহার করা হয় দেহের কোনো একটা অংশ; হাত, বিঘৎ, পা (ফুট) এই ভাবেই সংজ্ঞিত (defined) হয়। দূরত্ব বেশি হলে আমরা বিচার করি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় হেঁটে যেতে কত সময় লাগে। আস্তে আস্তে আমরা চোখের দৃষ্টি দিয়ে দূরত্ব আন্দাজ করতে শিখি কিন্তু নির্ভুল হতে হলে আমরা নির্ভর করি স্পর্শের উপর। তাছাড়া স্পর্শ থেকেই আমাদের বাস্তবতা বোধ আসে। কিছু কিছু জিনিস ছোঁয়া যায় নাঃ রামধনু, আয়নার ছায়া ইত্যাদি। এগুলি দেখে শিশুরা ধাঁধায় পড়ে। আয়নায় দেখা জিনিস বাস্তব নয় এ সংবাদে তাদের অধিবিদ্যক কল্পন’ (metaphysical speculations) বাধা পায়। ম্যাকবেথের ছোরাটা ছিল অবাস্তব, কারণ, দৃষ্টিগোচর হলেও সেটা অনুভূতিগোচর ছিল না। শুধুমাত্র জ্যামিতি এবং পদার্থবিদ্যাই নয় আত্মবহিঃর্ভূত অস্তিত্বের সমগ্র কল্পনের ভিত্তিই স্পর্শবোধ। রূপকেও আমরা এ ধারণা ব্যবহার করি। ভাল বক্তৃতা জমে (solid), মন্দ বক্তৃতা শুধুই গ্যাস (gas), এর কারণ আমাদের বোধে বায়বীয় পদার্থ (গ্যাস) ঠিক বাস্তব নয়।

নভোমণ্ডল পর্যবেক্ষণে আমরা দৃষ্টি ছাড়া কোনো জ্ঞানেন্দ্রিয় ব্যবহার করতে পারি না। সূর্য আমরা স্পর্শ করতে পারি না, পারি না ফুটরুল দিয়ে কৃত্তিকা নক্ষত্র (Pleiades) মাপতে। তা সত্ত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিনা দ্বিধায় জ্যামিতি এবং পদার্থবিদ্যা প্রয়োগ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন ভূ-পৃষ্ঠে এ বিদ্যাগুলি কাজে লাগে। তাছাড়া এগুলির ভিত্তি ছিল বিচরণ ও স্পর্শ। এ রকম কাজ করতে গিয়ে তারা বিপদ ডেকে এনেছেন। অপেক্ষবাদ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সে বিপদ কাটেনি। দেখা গেল, স্পর্শ বোধের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানের অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক সংস্কার। সত্যকারের বিশ্বচিত্র লাভ করতে হলে এ সংস্কার অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।

ধরাপৃষ্ঠে অবস্থিত বস্তুগুলি নিয়ে যার কাজ তার তুলনায় একজন জ্যোতিৰ্বেত্তার (Astronomer) পক্ষে অসম্ভাব্যের পরিমাণ কত বেশি, একটা উদাহরণে সে তথ্য বোঝা যাবে। মনে করা যাক একটা ওষুধ দিয়ে আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান করা হয়েছে। আপনি জেগে উঠবার পর আপনার স্মৃতি নষ্ট হয়েছে কিন্তু যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা যায়নি। আর মনে করা যাক অজ্ঞান অবস্থায় আপনাকে একটা বেলুনে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আপনার জ্ঞান হওয়ার সময়ে বেলুনটা অন্ধকারে হাওয়ায় ভাসছে। আপনি ইংল্যান্ডে থাকলে রাতটা হোক নভেম্বর মাসের পাঁচ তারিখ আর আমেরিকায় থাকলে তোক জুলাইয়ের চার তারিখ*। আপনি দেখতে পাবেন ট্রেন থেকে, অ্যারোপ্লেন থেকে এবং মাটি থেকে বাজি ছাড়া হচ্ছে। বাজিগুলি সবদিকে ছুটছে। বাজি আপনি দেখতে পাবেন, কিন্তু অন্ধকারের জন্য মাটি, অ্যারোপ্লেন কিংবা ট্রেন দেখতে পাবেন না। পৃথিবী সম্পর্কে কি রকম মানসচিত্র তাহলে আপনি গঠন করবেন? আপনি ভাববেন কিছুই স্থায়ী নয়। অস্তিত্ব রয়েছে শুধু ক্ষণস্থায়ী আলোর ঝলকের। ঝলকগুলি তাদের স্বল্পস্থায়ী অস্তিত্বকালে শূন্যস্থানে নানারকম উদ্ভট বক্ররেখা আঁকছে। এই আলোর ঝলক আপনি ছুঁতে পারবেন না, শুধুমাত্র দেখতে পারেন।

আপনার জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা এবং সাধারণ নশ্বর জীবদের জামিতি, পদার্থবিদ্যা এবং অধিবিদ্যায় অনেক পার্থক্য হবে; এ তথ্য স্বতঃপ্রতীয়মান। সাধারণ কোনো নশ্বর জীব আপনার সঙ্গে বেলুনে থাকলে তার ভাষা আপনি বুঝতে পারবেন না। কিন্তু আইনস্টাইন যদি আপনার সঙ্গে থাকতেন তাহলে আপনার পক্ষে তাঁকে বোঝা যে কোনো নশ্বর জীবের আইনস্টাইনকে বোঝার চাইতে অনেক বেশি সহজ হতো। তার কারণ বহু পূর্ব-কল্পন থেকে আপনি মুক্ত থাকতেন। অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রে এই পূর্ব-কল্পনগুলিই (pre-conceptions) আইনস্টাইনকে বোঝার বাধা।

যে ধারণাগুলি ওষুধ খাওয়া বেলুন-আরোহীর কাছে প্রয়োজন নয় অথচ সাধারণ জীবনে প্রয়োজন, অপেক্ষবাদ অনেকটাই নির্ভর করে সেই ধারণাগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার উপর। কম বেশি আকস্মিক কিছু কারণে ধরাপৃষ্ঠের পরিবেশ একাদিক কল্পন নির্দেশ করে। সে কল্পন চিন্তাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হলেও দেখা যায় সেগুলি নির্ভুল নয়। জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরাপৃষ্ঠের অধিকাংশ বস্তুই বেশ অটল এবং প্রায় স্থিতিশীল। ধরাপৃষ্ঠের পরিবেশের ভিতরে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এটাই। ব্যাপারটা এরকম না হলে ভ্রমণ সম্পর্কীয় ধারণা যতটা নিশ্চিত মনে হয়, ততখানি নিশ্চিত মনে হতো না। আপনি যদি কিংস ক্র থেকে এডিনবরা যেতে চান তাহলে আপনার জানা থাকবে চিরকাল যেখানে ছিল, কিংস ক্রস থাকবে সেখানেই। রেললাইনের গতিপথ শেষ বারে যাওয়ার সময় যেমন ছিল তেমনি থাকবে আর এডিনবার ওয়েভার্লি স্টেশনও কেল্লা অবধি হেঁটে যাবে না। আপনি ভাবেন আপনি এডিনবরা গিয়েছেন। বলেনও সেকথা। এডিনবরা আপনার কাছে এসেছে একথা বলেন না! কিন্তু একথাও একই রকম নির্ভুল। সাধারণ বুদ্ধিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির এই সাফল্য এমন কতগুলি জিনিসের উপর নির্ভর করে যেগুলি আসলে অনেকটাই ভাগ্য নির্ভর। অনুমান করা যাক লন্ডনের বাড়িগুলি এক ঝাঁক মৌমাছির মতো অবিরাম চলমান, রেলপথগুলি চলে আর আকার বদলায় হিমবাহের মতো এবং সবশেষে অনুমান করা যাক বাস্তব পদার্থগুলি মোমের মতো অবিরাম গঠিত ও বিগঠিত (dissolution) হয়ে চলেছে। এই সমস্ত অনুমানে অসম্ভব কিছু নেই। কিন্তু যাকে আমি এডিনবরা যাত্রা বলি তার কোনো অর্থ এ জগতে থাকবে না এ তথ্য স্বতঃপ্রতীয়মান। সন্দেহ নেই–সকালে আপনি শুরু করবেন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে, কিংস ক্রসটা আজ সকালে কোথায়?’ স্টেশনে আপনার এডিনবরা সম্পর্কে একই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হবে। কিন্তু টিকিট ঘরের কেরানী আপনাকে উত্তর দেবেন, ‘এডিনবরার কোন অংশ সম্পর্কে বলছেন আপনি? প্রিন্সেস স্ট্রিট গিয়েছে গ্লাসগোতে, কেল্লাটা উঠেছে পাহাড়ে। ওয়েভার্লি স্টেশন রয়েছে ফোর্থ খাড়ির জালের নিচে। তাছাড়া পথে স্টেশনগুলি স্থিরাবস্থায় থাকবে না। কোনোটা চলবে উত্তরে, কোনোটা দক্ষিণে, কোনোটা পূর্বে আবার কোনোটা পশ্চিমে। তাদের বেগ হয়তো ট্রেনের চাইতে বেশি। এ অবস্থায় কোন মুহূর্তে কোথায় আপনার অবস্থান সেটাও আপনি বলতে পারবেন না। আসলে ব্যক্তির অবস্থান কোনো একটি নিশ্চিন্ত স্থানে এই ধারণার কারণ ভাগ্যক্রমে ধরাপৃষ্ঠে অধিকাংশ বৃহৎ বস্তুর অচলাবস্থা। স্থান সম্পর্কীয় ধারণা শুধু একটি মোটামুটি কার্যকর আসন্নতা (rough practical approximation)। এর পিছনে যৌক্তিক প্রয়োজন কিছু নেই এবং এ ধারণাকে সর্বাংশে সঠিক করা সম্ভব নয়।

আমরা যদি ইলেকট্রনের চাইতে বেশি বড় না হতাম তাহলে স্থিরত্ব সম্পর্কীয় এ ধারণা আমাদের থাকত না। এ ধারণার কারণ শুধুমাত্র আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের স্থূলত্ব (grossness)। কিংস ক্রসকে আমাদের মনে হয় ঘনবস্তু (solid)। আমাদের আকার ইলেকট্রনের মতো ছোট হলে কিংস ক্রসূকে ধারণাতীত বড় মনে হতো। দু-একজন উৎকেন্দ্রিক গণিতবিদ (eccentric mathemticians) ছাড়া আর কারো পক্ষে এ সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হতো না। আমাদের দৃষ্টিপথে যেগুলি আসত সেগুলি অতি ক্ষুদ্র বস্তুবিন্দু। পরস্পরের সংস্পর্শে তারা কখনোই আসে না। অকল্পনীয় দ্রুত ব্যালে নাচের মতো তারা পরস্পরের সবদিকে অবিরাম ঘুরছে। এডিনবরার বিভিন্ন অংশ যদি ভিন্ন ভিন্ন দিকে হাঁটা দিত, আমরা ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র হলে আমাদের অভিজ্ঞতা- লব্ধ জগও হতো সেই রকম উন্মত্ত। আমরা যদি বিপরীত প্রান্ত বিচার করি, অর্থাৎ আপনার আকার যদি সূর্যের মতো বড় হতো, আপনার জীবনকাল যদি হতো ঐরকম দীর্ঘ এবং অনুভূতি যদি হতো অনুরূপ মন্থর তাহলে আপনি দেখতেন বিশৃঙ্খল, স্থিরতৃহীন এক মহাবিশ্ব। গ্রহ-তারকা আসত এবং যেত ভোরের কুয়াশার মতো। কোনো বস্তু সাপেক্ষ কোনো বস্তুর স্থির অবস্থান থাকত না। তুলনামূলক স্থিরত্বসম্পর্কীয় ধারণা আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির অংশ। সে দৃষ্টিভঙ্গির কারণ আমাদের আকার এবং এমন একটি গ্রহে বাস যার পৃষ্ঠতল (surface) খুব উত্তপ্ত নয়। তা না হলে প্রাক অপেক্ষবাদ পদার্থবিদ্যা থেকে আমরা বৌদ্ধিক পরিতৃপ্তি পেতাম না। আসলে আমরা এই ধরনের তত্ত্ব আবিষ্কারই করতাম না। হয় আমরা এক লাফে অপেক্ষবাদী পদার্থবিদ্যায় পৌঁছে যেতাম নয়তো আমরা বৈজ্ঞানিক বিধি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যেতাম। আমাদের কপাল ভাল। এই বিকল্পের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়নি। তার কারণ একটি মানুষ, ইউক্লিড, গ্যালিলিও, নিউটন এবং আইনস্টাইনের কাজ করতে পারত : এক এক অসম্ভব কল্পন। অথচ যে বিশ্বে বিজ্ঞান-নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সদা পরিবর্তনশীল ব্ৰহ্মাণ্ড স্বতঃপ্রতীয়মান সে বিশ্বে এই রকম অবিশ্বাস্য প্রতিভা ছাড়া পদার্থবিদ্যা আবিষ্কার প্রায় অসম্ভব হতো।

চন্দ্র, সূর্য, তারকার অস্তিত্ব রয়েছে বছরের পর বছর। তবুও জ্যোতিষীয় জগতের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পার্থক্য অনেক আগেই বলেছি এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু দৃষ্টির উপরেই নির্ভর করি। মহাকাশের বস্তুপিণ্ড স্পর্শ করা, শ্রবণ করা, আঘ্রাণ করা কিংবা আস্বাদন করা সম্ভব নয়। মহাকাশের সব জিনিসই অন্য সব জিনিস সাপেক্ষ চলমান। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবী ঘুরছে। সূর্য হারকিউলিস নক্ষত্রপুঞ্জের (consteillation) একটি বিন্দু অভিমুখে এক্সপ্রেস ট্রেনের চাইতেও অনেক বেশি বেগে ধাবমান। স্থির তারকাগুলি নানা অভিমুখে দ্রুত চলমান। কিংস ক্র কিংবা এডিনবরার মতো কোনো সুচিহ্নিত স্থান মহাকাশে নেই। পৃথিবীতে ভ্রমণের সময় আপনি বলেন, ট্রেন চলছে কিন্তু স্টেশনগুলি চলছে না; তার কারণ স্টেশনগুলি পরস্পরের সঙ্গে এবং পারিপার্শ্বিক স্থানের সঙ্গে সাংস্থানিক (topographical) সম্পর্ক রক্ষা করে। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানে কাকে আপনি ট্রেন বলবেন আর কাকে আপনি স্টেশন বলবেন সেটা যাদৃচ্ছিক (arbitrary)। এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে শুধুমাত্র সুবিধা আর রীতির উপর।

এই প্রসঙ্গে আইনস্টাইন এবং কোপানিকাসের বৈপরীত্য বিচার আকর্ষণীয়। কোপার্নিকাসের আগে লোকে ভাবত পৃথিবী স্থিরভাবে দণ্ডায়মান এবং নভোমণ্ডল তাকে বেষ্টন করে দিনে একবার ঘুরছে। কোপার্নিকাস শেখালেন, আসলে পৃথিবীটাই দৈনিক একবার ঘুরছে এবং সূর্য-তারকার দৈনন্দিন ঘূর্ণন শুধু বাহ্যত প্রতীয়মান (apparent)। গ্যালিলিও এবং নিউটন এবং দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছেন। এ মত প্রমাণ করার জন্য অনেক কিছু চিন্তা করা হয়েছে। উদাহারণ : পৃথিবীর মেরুদুটির চ্যাপ্টা হওয়া, মেরুপ্রদেশের তুলনায় বিষুবরেখায় বস্তুপিণ্ডগুলির ওজন বেশি হওয়া। কিন্তু আধুনিক তত্ত্ব অনুসারে কোপার্নিকাস এবং তাঁর পূর্বতন জ্যোতিবিজ্ঞানীদের ভিতরে উপস্থাপিত প্রশ্ন শুধুমাত্র অসুবিধা সুবিধার ব্যাপার! সমস্ত গতিই আপেক্ষিক। পৃথিবীর দৈনিক একবার চক্রাকারে আবর্তিত হয় এবং নভোমণ্ডল দৈনিক একবার পৃথিবীকে চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করে এই দুটি বিবৃতির ভিতর কোনো পার্থক্য নেই। বিবৃতি দুটি নির্ভুলভাবে একই তথ্য প্রকাশ করে। একটি দৈর্ঘ্যকে ছয় ফুট কিংবা দু’গজ বলার মতোই আগের বিবৃতি দুটিতে প্রকাশিত হয়েছে ঠিক একই তথ্য। দশমিক মুদ্রায় হিসাব রাখা যেরকম সহজ ঠিক

তেমনি পৃথিবীর বদলে সূর্যকে স্থিররূপে গ্রহণ করলে জ্যোতির্বিজ্ঞান সহজতর হয়। কিন্তু কোপার্নিকাস সম্পকে এর বেশি বললে পরম গতি (absolute motion) অনুমান করতে হয়। সে অনুমান অলীক। সমস্ত গতি আপেক্ষিক, একটি বস্তুপিণ্ডকে স্থিররূপে গ্রহণ করা চলিত প্রথা মাত্র। এই রকম সমস্ত প্রথা একই রকম বিধিসম্মত। অবশ্য সমস্ত প্রথা একরকম সুবিধাজনক নয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞান শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তির উপর নির্ভর করে। এই জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে জাগতিক পদার্থবিদ্যার (terrestrial physics) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আর একটি পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ চিন্তাধারা এবং প্রাচীনপন্থী পদার্থবিদ্যা উভয়েই বল (force) সম্পর্কিত ধারণা ব্যবহার করেছে। পরিচিত অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার দরুন মনে হয়েছে এ ধারণা বোধগম্য। হাঁটবার সময় আমাদের মাংসপেশী সম্পর্কিত অনুভূতি হয় কিন্তু বসে থাকলে সে বোধ হয় না। যান্ত্রিক চালিকাশক্তি যখন ছিল না তখনও মানুষ গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করতে পারত। কিন্তু তখনও, মানুষ দৃশ্যত যেরকম বল (force) প্রয়োগ করে, ঘোড়াকেও সেরকম বল (force) প্রয়োগ করতে দেখত। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সকলেই জানত কাকে টানা কিংবা ঠেলা বলে, কাকে বলে আকর্ষিত হওয়া কিংবা ধাক্কা খাওয়া। বল (force) গতিবিদ্যার স্বাভাবিক ভিত্তি হয়েছিল অত্যন্ত পরিচিত এই তথ্যগুলি থেকে। নিউটনীয় মহাকর্ষ বিধি (Newtonian Law of Gravitation) কিন্তু একটি সঙ্কট উপস্থিত করেছিল। দুটি বিলিয়ার্ড বলের অন্তবর্তী বল (fotce) বোঝা যায় কারণ আর একজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে কিরকম লাগে সেটা আমাদের জানা, কিন্তু পৃথিবী এবং সূর্যের দূরত্ব 93 মিলিয়ন মাইল। তাদের অন্তর্বর্তী বল ছিল রহস্যজনক। এই দূরবর্তী ক্রিয়া (action at a distance) নিউটনও অসম্ভব ভাবতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল : এযাবৎ অনাবিস্কৃত এমন কোনো সাধনী (Mechanism) আছে যার সাহায্যে সূর্যের প্রভাব গ্রহগুলিতে প্রেরিত হয়। এরকম কোনো সাধনী (Mechanism) কিন্তু আবিষ্কার হয়নি। সুতরাং মহাকর্ষ (gravitation) ছিল একটি ধাঁধা। আসলে মহাকর্ষীয় দল (grav itational force) সম্পর্কিত সম্পূর্ণ কল্পনই ভুল। অপেক্ষবাদের মহাকর্ষীয় বিধি (Gravitational Law) অনুসারে সূর্য গ্রহগুলির প্রতি কোনো বলই প্রয়োগ করে না। গ্রহদের মনোযোগ শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব সান্নিধ্যের প্রতি! এর কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হবে পরের একটি অধ্যায়ে। আপাতত মহাকর্ষীয় বল’ সম্পর্কিত ধারণা পরিত্যাগের প্রয়োজনীয়তাই আমাদের বিবেচ্য। এ ধারণা আহরণ করা হয়েছিল স্পর্শবোধ থেকে উদ্ভূত ভুল কল্পন থেকে ।

পদার্থবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে ক্রমশঃই বেশি করে দেখা গিয়েছে : পদার্থ সম্পর্কে মূলগত ধারণার উৎস হিসাবে স্পর্শের চাইতে দৃষ্টি, ভূল পথের নিশানা দেয় অনেক কম। বিলিয়ার্ড বলের সংঘর্ষের আপাতদৃষ্ট সারল্য শুধুই মায়া। আসলে দুটি বিলিয়ার্ড বল কখনোই স্পর্শ করে না। যা ঘটে সেটা অকল্পনীয় জটিল, এর সঙ্গে সাধারণ বুদ্ধিকৃত অনুমানের চাইতে ধূমকেতুর সৌরমণ্ডলে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের সময় যা ঘটে তার সাদৃশ্য বেশি।

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যা বলেছি অপেক্ষবাদ আবিষ্কারের আগেই পদার্থবিদরা সে সমস্ত উপলব্ধি করেছিলেন। গতি যে শুধুমাত্র একটি অপেক্ষিক পরিঘটনা ও তথ্য সাধারণত মেনে নেওয়া হতো। অর্থাৎ দুটি বস্তুপিণ্ড যখন তাদের অপেক্ষিক অবস্থান (relative position) পরিবর্তন করে তখন একটি স্থিতিশীল, অপরটি চলমান একথা আমরা বলতে পারি না। কারণ ঘটনাটি শুধুমাত্র তাদের অপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তন। কিন্তু পদার্থবিদ্যার বাস্তব কর্মকান্ডের সঙ্গে এই নতুন বিশ্বাসের সামঞ্জস্য বিধান করতে অনেক পরিশ্রম প্রয়োজন হয়েছিল। মহাকর্ষীয় বল এবং পরম স্থান এবং কাল সম্পর্কীয় ধারণা (absolute space & time) ছিল প্রাচীন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগপদ্ধতির অঙ্গীভূত। প্রয়োজন হয়েছিল প্রাচীন অনুমান থেকে মুক্ত একটি নতুন প্রয়োগবিদ্যার। এ কার্য করতে হলে স্থান (space) এবং কাল (time) সম্পৰ্কীয় প্রাচীন ধারণার মূলগত পরিবর্তন করতে হতো। কিন্তু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার আগে কিছু প্রাথমিক আলোচনা আবশ্যিক। সেই বিষয় নিয়েই এর পরের দুটি অধ্যায়।

——
* নভেম্বরের পাঁচ তারিখের রাত্রে ইংল্যান্ডের আর জুলাইয়ের চার তারিখের রাত্রে আমেরিকায় খুব বাজি পোড়ানো হয়। অনেকটা আমাদের দেওয়ালীর মতো।–অনুবাদক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *