৫. নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগ : তাদের যথানির্দিষ্ট ক্ষেত্র

বক্তৃতা : পাঁচ
নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগ : তাদের যথানির্দিষ্ট ক্ষেত্র

একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল সমাজের প্রয়োজন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উদ্যোগ : নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নৈরাজ্য অবশ্যম্ভাবী, এবং উদ্যোগ ব্যতিরেকে নিশ্চলতা অনিবার্য। কোন কোন বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন এবং কোনগুলোকে বেসরকারি অথবা আধা-বেসরকারি উদ্যোগকে ছেড়ে দেওয়া উচিত-সে সম্পর্কে এই বক্তৃতায় আমি কিছু সাধারণ সূত্রে পৌঁছাতে চাই। কোন সমাজে যেসব গুণাবলির সন্ধান আমরা চাই, তার কিছু কিছু তাদের নিজস্ব সত্তায় গতিহীন, অন্যগুলো তাদের বৈশিষ্ট্যের সুবাদেই গতিশীল। খুবই সাদামাটাভাবে বলা যায়-আমরা আশা করতে পারি-নিশ্চল গুণগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণের উপযোগী, অন্যদিকে গতিশীল গুণগুলোকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কিন্তু, যদি এসব উদ্যোগকে সম্ভব করে তুলতে হয়, এবং যদি এগুলোকে ধ্বংসাত্মকের পরিবর্তে ফলদায়ী করে তুলতে হয়, তাহলে উপযুক্ত সংস্থার দ্বারা তার পোষিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, এবং সরকারের অন্যতম কাজ হবে এসব সংস্থার সুরক্ষা। এটা স্পষ্ট যে, নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে, বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিজ্ঞান-গবেষণা অথবা পুস্তক-প্রকাশনা, বা এমনকী সমুদ্রতীরবর্তী অবকাশ যাপনের মতো অতিসাধারণ বিষয়েরও অস্তিত্ব থাকে না। আমাদের জটিল পৃথিবীতে সরকার ছাড়া ফলদায়ী উদ্যোগ সম্ভব নয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উদ্যোগ ব্যতিরেকে সরকারের অস্তিত্ব সম্ভবপর।

আমি মনে করি-সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকা উচিত তিনটি-নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও সংরক্ষণ। মানবিক সুখের স্বার্থে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং এগুলো এমন বিষয়, যা একমাত্র সরকারই সংঘটিত করতে পারে। একই সঙ্গে, এগুলোর কোনটিই চরম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নয়। কোন কোন পরিস্থিতিতে, এদের কোন একটির স্বার্থ, সামান্য মাত্রাতেও হয়তো অন্যতর মঙ্গলের স্বার্থে বিসর্জিত হতে পারে। আমি পর্যায়ক্রমে এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কিছু বলবো। জীবন ও সম্পদের সুরক্ষার অর্থে। নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্যরূপে বিবেচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু অন্য নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইন মান্যকারী নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক রাষ্ট্র এটা প্রয়োজনীয় বলে ভাবেনি, যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও এসব মানুষদের সুরক্ষা দেওয়া উচিত। প্রশাসনিক শক্তির জোরে গ্রেপ্তারির ব্যবস্থা এবং যথাযথ আইনীপদ্ধতি বর্জিত শাস্তির ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যত দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক না কেন, বেসরকারি মানুষদের কোন নিরাপত্তা থাকে না এবং এমনকী, আইনের যথাযথ পদ্ধতিকরণের ওপর জোর দেওয়াও যথেষ্ট নয়, যদি না বিচারকেরা প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন থাকতে পারেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ‘প্রজাদের স্বাধীনতা’ অথবা মানুষের অধিকার’ এই ধরনের শ্লোগানের ছত্রচ্ছায়ায় উপরোক্ত ধ্যানধারণার বিন্যাস প্রকাশ্যে এসেছিল। কিন্তু বাঞ্ছিত ‘স্বাধীনতা এবং অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের উদ্যোগেই অর্জিত হতে পারে, এবং একমাত্র তখনই রাষ্ট্রকে স্বাধীন বলে আখ্যাত করা যেতে পারে। একমাত্র পশ্চিমী দেশেই, এ ধরনের স্বাধীনতা ও অধিকার অর্জিত হয়েছে।

বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য দেশসমূহের বাসিন্দার কাছে আর এক ধরনের অধিকতর কৌতূহলোদ্দীপক নিরাপত্তার বিষয়টি হল, উদ্ধত রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রমণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা। এটা একারণেই অধিকতর কৌতূহলোদ্দীপক যে, এটা এখনও অর্জিত হয়নি, এবং বছরের পর বছর যুদ্ধপদ্ধতির ক্রমোন্নতির ফলে এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ধরনের নিরাপত্তা তখনই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে, যখন সব প্রধান যুদ্ধাস্ত্রের একচেটিয়া অধিকারসহ এক অখণ্ড বিশ্বজনীন সরকার গড়ে উঠবে । আমি এই বিষয়টির ওপর বিস্তারিত আলোচনায় যাব না, যেহেতু এটা আমার মূল আলোচ্য থেকে কোন না কোনভাবে অনেকটাই দূরবর্তী । আমি সমস্ত গুরুত্ব দিয়ে শুধু এটাই বলতে চাই-যদি এবং যতদিন পর্যন্ত না মানবজাতি পৃথিবীর একক সরকার নিরাপত্তা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে, ততদিন যে কোন মূল্যের, অথবা যে কোন ধরনের ঘটনাই বিপজ্জনক এবং যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধের দ্বারা তা ধ্বংস হতে পারে ।

আধুনিক ব্রিটিশ বিধানিকতায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে একটি হল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। কর্মহীনতা, রুগ্নতা, বার্ধক্যের দুরবস্থার বিরুদ্ধে বীমাব্যবস্থা বেতনভোগীদের জীবন থেকে তাদের ভবিষ্যতের বেদনাদায়ক অনিশ্চয়তা বহুলাংশে অপসারিত করেছে। ধাপে ধাপে চিকিৎসাসংক্রান্ত নিরাপত্তার উন্নতি ঘটানো হয়েছে, যার ফলে জীবনের গড়ে দৈর্ঘ্য বেড়েছে এবং রোগের প্রকোপ কমেছে, সবমিলিয়ে, পশ্চিমী দেশগুলোতে, যুদ্ধকে বাদ দিলে, অষ্টাদশ শতাব্দীর তুলনায় জীবন এখন অত্যন্ত কমমাত্রায় বিপজ্জনক, এবং পরিবর্তন প্রধানত ঘটেছে বিভিন্ন ধরনের সরকারি নিয়ন্ত্রণের সুবাদে।

নিরাপত্তা সন্দেহাতীতভাবে উত্তম জিনিস হলেও, অতিরিক্ত মাত্রায় চাওয়া হতে পারে, এবং তা ক্রমশ অন্ধ আশাবাদে পরিণত হতে পারে । নিরাপদ জীবনমাত্রই সুখী জীবন নয়; গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমির ফলে গুমোটপূর্ণও হয়ে উঠতে পারে । অনেক মানুষই যুবক অবস্থায় বিপজ্জনক রোমাঞ্চের বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানায়, এবং এমনকী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নীরস নিরাপত্তা থেকে স্বস্তি খোঁজে। নিরাপত্তা, তার নিজস্বতায়, ভয়তাড়িত একটি নেতিবাচক লক্ষ্য; একটি সন্তোষবাদী জীবনের থাকবে আশাবাদে উদ্বুদ্ধ একটি ইতিবাচক লক্ষ্য। এ ধরনের রোমাঞ্চকর আশাবাদের মধ্যে থেকে ঝুঁকি এবং সে কারণেই ভীতি। কিন্তু বাইরে থেকে কোন মানুষের ওপর আরোপিত ভয়ের তুলনায় ইচ্ছাকৃতভাবে মেনে নেওয়া ভয় এরকম কিছু মন্দ জিনিস নয়। সে কারণে, আমরা শুধুমাত্র নিরাপত্তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারি না, অথবা কল্পনা করতে পারি না যে, একমাত্র এটাই নিয়ে আসতে পারে নতুন শতাব্দী এবং এখন ন্যায়বিচারের সম্পর্কে :

ন্যায়বিচার, বিশেষত আর্থিক ন্যায়, খুব সম্প্রতি হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি সরকারি লক্ষ্য। ন্যায়বিচারকে সাম্যের সমীকরণে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। একমাত্র সেসব ক্ষেত্র ছাড়া, যেখানে ব্যতিক্রমী ধরনের মেধাকে মনে করা হয় ব্যতিক্রমী অথচ মাঝারি মানের পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। আমেরিকার বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে লক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে রাজনৈতিক সমদর্শিতা অর্থাৎ গণতন্ত্র, কিন্তু অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার একটা নতুনতর লক্ষ্য, এবং তা অনেক বেশি সরকারি নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীল। আমার মতে, সমাজতন্ত্রীরা সঙ্গত কারণেই এই অভিমত পোষণ করে যে, মূল শিল্পের রাষ্ট্র মালিকানার অন্তর্ভুক্তি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সমাজবাদের বিরোধীরা তর্ক করতে পারেন-অর্থনৈতিক সমদর্শিতা খুব মহার্ঘভাবেই ক্রয় করা যায়, কিন্তু অস্বীকার করতেও পারে না-যদি এই লক্ষ্য পূরণ করতে হয়, তাহলে শিল্প ও অর্থের ওপর বেশ বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক।

তবে এমনকী অত্যুৎসাহী পশ্চিমী প্রবক্তরাও অন্তত নীরবেও স্বীকার করেন অর্থনৈতিক সমদর্শিতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়-পৃথিবীর কম সৌভাগ্যবান অংশের উন্ননের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্যের পথ খুঁজে বের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এর একমাত্র কারণ এই নয় যে, নিরসনের জন্য বিপুল পরিমাণ সুখহীনতা মজুত রয়েছে, বরং আরও কারণ হল-জ্বলন্ত বৈষম্য অব্যাহত থাকলে পৃথিবী সুস্থির ও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু ধীরগতিতে পাশ্চাত্য জাতিসমূহ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সমতা আনার যে কোন প্রচেষ্টাই সমৃদ্ধতর জাতিগুলোকে কম সমৃদ্ধতর জাতির স্তরে টেনে নামাবে-অথচ শেষোক্ত জাতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সুবিধা যুক্ত হবে না।

নিরাপত্তার মতোই, ন্যায়বিচারও-এমনকী বৃহত্তর মাত্রাসহ এমনই একটা আদর্শ যা সীমাবদ্ধতার শর্তে বন্দী । সমদর্শিতা সেখানেও রয়েছে, যেখানে সকলেই সমানভাবে গরিব বা সকলেই সমান ধনী, কিন্তু ধনীকে দরিদ্রতর অবস্থায় পরিণত করা নিষ্ফল মনে হবে, যদি না তার পরিবর্তে গরিবকে কিছুটা ধনী করে তোলা যায়। সমদর্শিতার যুক্তি এমনকী আরও জোরালো হয়ে ওঠে, যদি সমতার নামে, তা দরিদ্রকে পূর্বের তুলনায় আরও দরিদ্র করে তোলার চেষ্টা করে এবং এটা ঘটতে পারে যদি সাধারণভাবে শিক্ষার অবনমন ও ফলদায়ী গবেষণার ক্রমাবনতির ঘটনা ঘটেই চলে। যদি ইজিপ্টে ও ব্যাবিলনে অর্থনৈতিক অবিচারের অবস্থা থাকতো, তাহলে লিখনশৈলীর কখনই আবিষ্কার হতো না। তবে শিল্পোন্নত জাতিদের ক্ষেত্রে সভ্যতার শিল্পকলায় অগ্রগতি ঘটানোর জন্য উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতিসহ অর্থনৈতিক অবিচারের ধারা বহমান রাখার কোন প্রয়োজন নেই। অতীতের মতো নয়-শুধুমাত্র যে আশঙ্কার কথা মনে রাখতে হবে, তা হল-একটি পদ্ধতিতে অসম্ভাব্যতা।

এখন আমি আসি আমার তৃতীয় বিষয়ে-সংরক্ষণ । নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচারের মতোই সংরক্ষণও রাষ্ট্রের তরফ থেকে সক্রিয়তা দাবি করে। সংরক্ষণ’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি না শুধুমাত্র প্রাচীন মিনার এবং সৌন্দর্য স্থান, রাস্তাঘাট ও জনসাধারণের ব্যবহার্য বিভিন্ন অনুষঙ্গের ঠাটবাট রক্ষণাবেক্ষণ । যুদ্ধের সময়ে ছাড়া, বর্তমানে এসব কাজ করা হয়ে থাকে। যা প্রধানত আমার মনে আছে, তা হল-পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ। এটা একটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার প্রতি খুব সামান্যই মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। বিগত একশো পঞ্চাশ বছরে মানবজাতি শিল্পের কাঁচামাল এবং ভূমিকে ব্যবহার করেছে, যার ওপরে কৃষি নির্ভরশীল, এবং প্রাকৃতিক মূলধনের এই অমিত ব্যয় ক্রমবর্ধমান গতিবেগ নিয়ে অব্যাহত থেকেছে। শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হল তেল। পৃথিবীতে উত্তোলনযোগ্য তেলের পরিমাণ অজানা, তবে নিশ্চিতভাবেই তা অসীম নয়; ইতোমধ্যেই তার চাহিদা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনামূলক ঝুঁকি। যখন তেল আর বিশাল পরিমাণে প্রাপ্তিযোগ্য নয়, সে কারণে আমাদের জীবনধারার অনেক কিছুই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমরা যদি আণবিক শক্তিকে বিকল্প রূপে গ্রহণ করার চেষ্টা করি, তার ফলস্বরূপ, শুধুমাত্র ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের প্রাপ্তিযোগ্য সরবরাহই নিঃশেষিত হবে। বর্তমানে শিল্পের যে অবস্থায় অস্তিত্ব রয়েছে, তা আবশ্যিকভাবে প্রাকৃতিক মূলধনের ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল, এবং বর্তমান অমিতব্যয়ী আঙ্গিকে দীর্ঘকাল তা চলতে পারে না।

কোন কোন কর্তৃত্বস্থানীয়দের মতে, আরও গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হল কৃষি সম্পর্কিত পরিস্থিতি যা দারুণভাবে চিত্রিত হয়ে রয়েছে। মিঃ ভোগটের ‘রোড টু সারভাইভ্যাল শীর্ষক রচনায়। কয়েকটি সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকা ছাড়া (যার মধ্যে একটি হল পশ্চিম ইউরোপ), জমিকে চাষ করার বর্তমান পদ্ধতির সূত্রে তার উর্বরতা অতি দ্রুতগতিতে নিঃশেষিত হয়ে যায় । আমেরিকায় ‘ডাস্ট বাওলে’র অগ্রগতি পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে বহমান ধ্বংসাত্মক পদ্ধতির সর্বাধিক জ্ঞাত দৃষ্টান্ত । ইত্যবসরে যেহেতু জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, সেকারণে যদি না চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নিদারুণ খাদ্যসংকট অবশ্যম্ভাবী। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো কৃষির ছাত্রদের জানা, কিন্তু একমাত্র সরকারের তরফেই এগুলো গৃহীত হতে পারে, এবং কেবল তখনই যদি তারা জনপ্রিয়তা হ্রাসের মুখোমুখি হতে ইচ্ছুক ও সমর্থ হয়। এটা এমন একটা সমস্যা, যা খুব সামান্যই মনোযোগ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। এটার সম্মুখীন হতেই হবে তাকে, যে মারাত্মক যুদ্ধবর্জিত একটি স্থিতিশীল পৃথিবীর প্রত্যাশা করে যুদ্ধের মাধ্যমে খাদ্যাভাবের সংকট সমাধান করতে হলে ইতিপূর্বে যে যুদ্ধগুলো আমরা সহ্য করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হতে হবে, কারণ দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়েই পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষিতে একটি সংস্কারের এই প্রশ্ন সম্ভবত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিষেধক ছাড়া, অদূর ভবিষ্যতের সরকারগুলোকে তার সম্মুখীন হতে হবে ।

আমি সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে নিরাপত্তা, সমদর্শিতা এবং সংরক্ষণের কথা বলেছি, কারণ এগুলো হল এমনই বিষয়, যা একমাত্র সরকারই রূপায়িত করতে পারে। আমি বলতে চাইছি না যে, সরকারের আর অন্য কাজ নেই। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের কাজ হওয়া উচিত বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করা এবং সদর্থক পদ্ধতিতে তার অনুশীলনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। সভ্য সমাজের অসহনীয় এরকম নৈরাজ্যবাদীও অপরাধমূলক ধরনের উদ্যোগের অস্তিত্ব দেখা যায় । সকলের কাছে প্রয়োজনীয় রূপে স্বীকৃতিযোগ্য-এরকম সুপ্রতিষ্ঠিত আবিষ্কারকে উদ্যোগের মতো অন্যান্য ধরনের উদ্যোগেরও অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু এক বিশালসংখ্যক মধ্যবর্তী প্রবর্তকের বাস্তবতা রয়েছে, যাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আগাম আঁচ করা যায়। না যে, সেগুলোর ফলাফল ভাল অথবা মন্দ হবে। বিশেষত এই নির্দিষ্ট শ্রেণীর প্রেক্ষিতেই পরীক্ষামূলকভাবে স্বাধীনতার অভীপ্সার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই শ্রেণীর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে মানবিক কৃতিত্বের যাবতীয় সর্বোত্তম বিষয়াদি।

একরূপ হল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক ফলাফল, এবং এই একরূপত্ব কোন কোন ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয়, আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত । মুসোলিনির আগের দিনগুলোতে, শহরের রাস্তাঘাটের নিয়মবিধি ছিল একরকম এবং পারিপার্শ্বিক গ্রামাঞ্চলে এই নিয়ম ছিল বিপরীত। এই ধরনের বৈচিত্র্য ছিল অসুবিধাজনক, কিন্তু সেখানে এমন কোন বিষয় ছিল, যেসব ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ অবদমিত করে রাখতো এক বাঞ্ছনীয় ধরনের বৈচিত্র্য। মতামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পন্থার চিন্তাদর্শনের মধ্যে যদি তীব্র আলোচনার রেওয়াজ থাকে, তবে তা একটি ভাল জিনিস। মানসিকতার জগতে, অস্তিতৃরক্ষার সংগ্রামের অনুকূলে সব কিছুই বলা যায়, যা সৌভাগ্যবাহিত হয়ে, সর্বাপেক্ষা যোগ্যদের টিকে থাকার বিষয়ে উপনীত হয়। কিন্তু যদি মানসিক প্রতিযোগিতার কথা ওঠে, তাহলে প্রয়োগযোগ্য মাধ্যমসমূহের সীমিতকরণের পন্থাও থাকা প্রয়োজন। যুদ্ধের দ্বারা, অথবা হত্যাকাণ্ডের দ্বারা, অথবা নির্দিষ্ট মতবাদ-পোষণকারী ব্যক্তিদের কারাদন্ডের দ্বারা, অথবা অপ্রিয় মতবলম্বীদের জীবিকানির্বাহ নিষিদ্ধকরণের দ্বারা এটা বলবৎ হওয়া উচিত নয় । যেখানে বেসরকারি উদ্যোগের অস্তিত্ব রয়েছে, অথবা নবজাগরণের ইতালিও অষ্টাদশ শতাব্দীর মতো যেখানে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন সম্ভাব্য পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে অন্তত কিছুটা এই শর্তগুলো পূরণ হতো। কিন্তু সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যে ঘটনার প্রবণতা ছিল, সে রকম এক সময়ে যখন রাষ্ট্রগুলো বৃহত্তর হয়ে উঠেছিল এবং বেসরকারি উদ্যোগগুলো ক্ষুদ্রতর, তখন বৌদ্ধিক বৈচিত্র্য অর্জনের প্রথাগত পদ্ধতিগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একমাত্র যে পদ্ধতিটি অবশিষ্ট থাকে, তা হল-রাষ্ট্রের তরফে আংটাটি ধরে রাখতে এবং কুইন্সবেরি নিয়মনীতি ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠিত করা, যার দ্বারা প্রতিযোগিতা পরিচালনা করা সম্ভব হয়।

বর্তমান সময়ে, শিল্পী ও লেখকরা হলেন প্রায় একমাত্র শ্ৰেণী, যারা অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না থেকেও, ভাগ্যের সহায়তায় ব্যক্তি হিসেবে একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ পরিচালনা করতে পারেন। আমি যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করতাম, তখন সেখানে দুইজন পুরুষমানুষ ছিলেন, যারা সেই দেশে বহিরাগত শ্রমিকদের অবস্থা সমগ্র পৃথিবীকে জানাবার উদ্দেশ্যে কাজ করতেন। তাদের মধ্যে একজন, যিনি একজন ঔপন্যাসিক, একটি উপন্যাসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন; অন্যজন যিনি ছিলেন একটি রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একটি সযত্ন শিক্ষামূলক গবেষণা পর্যালোচনা করেছিলেন। ঔপন্যাসিকের কপাল খুলে গিয়েছিল; শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, এবং আসন্ন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার ঝুঁকি বহন করতে হয়েছিল।

কিন্তু লেখকের উদ্যোগ, যা এখনও পর্যন্ত যে অবস্থায় টিকে রয়েছে, তা নানা ধরনের আশঙ্কায় জর্জরিত। যেমনটি রাশিয়ায় রয়েছে, যদি সেই রকমভাবে পুস্তক উৎপাদনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রই সিদ্ধান্ত নিতে পারে-কি প্রকাশ করা হবে, এবং যদি না কোন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার প্রত্যর্পণ ঘটে, তাহলে এরকম সম্ভাবনাও রয়েছে যে, প্রধান রাজনীতিবিদদের সন্তুষ্টিকরণ ছাড়া অন্য কোন ধরনের বই প্রকাশিত হবে না। অবশ্য, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এরকম ক্ষেত্রে, একরূপতৃ হয়ে দাঁড়াবে বিপর্যয়কর, কিন্তু তা অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সমাজবাদের একটি অতিসম্ভাব্য ফলাফল হিসেবেই গণ্য হবে।

আমার তৃতীয় বক্তৃতায় যেখানে আমি চিহ্নিত করেছি-বিজ্ঞানের মানুষরা, পূর্বে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে কাজ করতে পারতেন, যা এখনও লেখকরা পারেন, ক্যাভেন্ডিস ও ফ্যারাডে এবং মেন্ডেল কদাচিৎ প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং ডারইউন সরকারের ওপর শুধুমাত্র বিগ-এ সমুদ্রযাত্রার অংশীদারত্বের ব্যাপারে নির্ভর করেছিলেন। কিন্তু, এই বিচ্ছিন্নতা এখন অতীতের বিষয়। অধিকাংশ গবেষণার জন্য প্রয়োজন হয় খুব দামী যন্ত্রপাতি; কয়েক ধরনের গবেষণার জন্য প্রয়োজন হয়-দুর্গম স্থানে অভিযানের জন্য অর্থসংস্থান। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফের প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা ব্যতিরেকে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেন। এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা করায়ত্ত হতে পারে সেই সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করার শর্তাবলি সেকারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি একমাত্র সেইসব মানুষদের যোগ্যতার ছাড়পত্র দেওয়া হয়, যারা বর্তমান বিতর্কে গোঁড়া হিসেবে পরিচিত, তাহলে অচিরেই বৈজ্ঞানিক প্রগতি স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং এর ফলশ্রুতিতে মধ্যযুগীয় শ্বাসরুদ্ধ বিজ্ঞানের মতো পণ্ডিতাভিমানী কর্তৃত্ববাদের পথ প্রশস্ত করবে।

রাজনীতিতে কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যক্তিউদ্যোগের সমন্বয় অবধারিত ও জরুরি। সাধারণত দুটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি ঘটে: দল এবং নির্বাচকমণ্ডলী। আপনি যদি কোন সংস্কার সাধন করতে চান আপনাকে প্রথমেই দলকে রাজি করাতে হবে সংস্কারের অনুকূলে এবং তারপর নির্বাচকমণ্ডলীকে সম্মত করতে হবে আপনার দলকে গ্রহণ করার জন্য। অবশ্য, আপনি সরাসরি সরকারের ওপর আপনার পরিচালনা আরো করতে পারেন। কিন্তু ব্যাপক জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এটা কদাচিৎ সম্ভব হয়ে থাকে। যখন এটা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তখন উদ্যোগটির মধ্যে এত বেশি উৎসাহ ও সময় জড়িত থাকার ফলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যার ফলে সংস্কারের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিছু প্রার্থীকে পাঁচ বছরের একবার ভোটদান ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ স্থিতাবস্থার অনুকূলে মৌন সম্মতিদানই পছন্দ করে ।

সুসংগঠিত এই পৃথিবীতে একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি-উদ্যোগ মাত্র কয়েকটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যদি না সেই গোষ্ঠীর আকার ছোট হয়। আপনি যদি কোন ছোট কমিটির সদস্য হন, আপনি সঙ্গত কারণেই তার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার আশা করতে পারেন। জাতীয় রাজনীতিতে, সেখানে আপনি কুড়ি মিলিয়ন ভোটারদের মধ্যে একজনমাত্র, সেখানে আপনার প্রভাব তুচ্ছাতিতুচ্ছ, যদি না আপনি ব্যতিক্রমী হন অথবা কোন ব্যতিক্রমী অবস্থানে থাকেন। এটা সত্য যে, সামগ্রিক সরকারের কুড়ি মিলিয়নের এক ভাগের আপনি অংশীদার, কিন্তু আপনার তরফে শুধুই ওই কুড়ি মিলিয়নের এক ভাগ মাত্র। সে কারণে, আপনি শাসন করার চেয়ে শাসিত হওয়ার ব্যাপারেই অনেক বেশি সম্পর্কিত । আপনার ভাবনায় সরকারের ভাবমূর্তি হয়ে দাঁড়ায় এক দূরবর্তী ও অত্যধিক মাত্রায় পরশ্রীকাতর ‘তাহারা’, যারা একগুচ্ছ মানুষ নয়, অন্যান্য সমমনোভাবাপন্নদের আপনিও যাদের পছন্দ করে নিয়েছেন আপনার ইচ্ছা রূপায়ণের জন্য। এরকম পরিস্থিতিতে, আপনার রাজনৈতিক অনুভূতি রূপায়ণের জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজন নেই, বরং একনায়কতন্ত্রের অনেক কাছাকাছি কিছু একটা প্রয়োজন।

গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, এরকম ফলদায়ক সক্ষমতা ও সাহসী রোমাঞ্চময়। উদ্দীপনা তখনই পুনরুজ্জীবিত হতে পারে, যদি ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটানো যায়, সেখানে শুধুমাত্র সদস্য সংখ্যার জোরে ব্যক্তি আচ্ছন্ন না হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য, যদি শুধুমাত্র যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে তা হয়-যে যুক্তির প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে এই বক্তৃতার গোড়াতে।

নির্দিষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থায় ক্ষমতার হস্তান্তর প্রয়োজন-ভৌগোলিক, শিল্পগত, সাংস্কৃতিক। নিজেদের আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা এবং উদ্যমী মানুষদের মধ্যে প্রভাববিস্তারী সন্তোষ-সঞ্চারণে যথেষ্ট ক্ষমতা থাকার প্রয়োজন এসব সংস্থার। তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাদের প্রয়োজন হতে পারে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্থনৈতিক স্ব শাসন। সংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও সহানুভূতিহীন-এমন কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ যখন কোন সযত্নচিন্তিত প্রকল্পকে খারিজ করে দেয়, তখন উদ্যোগের প্রতি এতটা হতাশজনক ও মর্মান্তিক আর কিছুই হতে পারে না। তা সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাধীন ব্রিটেনে এরকম ঘটনা অবিরাম ঘটে চলেছে। যদি সর্বশ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কগুলোকে পক্ষপাতদুষ্ট না হতে দিতে চাই, তাহলে আরও কিছুটা স্থিতিস্থাপক অথচ কম কঠোর কিছু একটা প্রয়োজন এবং যে কোন পরিপুষ্ট ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত- কর্মোৎসাহী মানুষের হাতে যত বেশি সম্ভব ক্ষমতা থাকার ব্যবস্থা।

অবশ্য, বিভিন্ন সংস্থার ক্ষমতা বি-সীমিতকরণের ফলে দেখা দিতে পারে অনেক অসুবিধা। সাধারণ নিয়মটি এমন হওয়া উচিত-যাতে বৃহৎ সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্য পরিপূরণে বাধা দেয় না, এমন ছোট সংস্থাগুলোর হাতে সব কর্মসূচি ছেড়ে দেওয়া যায়। এই মুহূর্তের জন্যে নিজেদের ভৌগোলিক সংস্থায় আবদ্ধ রেখে বিশ্ব সরকার থেকে শুরু করে যাজক পরিষদ পর্যন্ত উচ্চ শ্রেণীবিন্যাস থাকা বাঞ্ছনীয়।

বিশ্বভিত্তিক সরকারের কাজ হবে যুদ্ধ নিবৃত্তি এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার মতো প্রয়োজনীয় ক্ষমতাটুকুই তার থাকা উচিত। এসবের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা হল-সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী পালনের একচেটিয়া অধিকার, চুক্তি-মঞ্জুর ও পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রবিরোধে সিদ্ধান্ত দানের অধিকার । চুক্তিপালনের জন্য প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধান ছাড়া এই বিশ্বরাষ্ট্রের সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা বাঞ্ছনীয় নয়। ঠিক একই পদ্ধতিতে, জাতীয় সরকারের তরফ থেকেও মফস্বল কাউন্সিলে, এবং সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে আবার নগর-পৌরসভা ও যাজক পল্লী-স্তরে সর্বাধিক ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়া প্রয়োজন। কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তো দক্ষতার স্বল্পমেয়াদি লোকসান দেখা যেতে পারে, কিন্তু যদি সহায়ক সংস্থাগুলোর কর্মক্ষমতাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়, তাহলে দক্ষ ব্যক্তিরাও তাদের অধীনে থেকেও সন্তুষ্টি খুঁজে নিতে পারবে, এবং দক্ষতার অস্থায়ী খামতির অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে অল্প সময়ের মধ্যে।

বর্তমানে সাধারণত স্থানীয় সরকারগুলোকে মনে করা হয় সম্পন্ন ও অবসরপ্রাপ্তদের সংস্থা হিসেবে, কারণ যেন শুধু প্রথামাফিক তাদের অবসর সময়টুকুই তারা এখানে দিয়ে থাকেন। যেহেতু, তারা অংশগ্রহণ করতে পারে না, সে কারণে মুষ্টিমেয় যুবক এবং সমর্থ ব্যক্তি এবং মহিলা তাদের স্থানীয় সমাজের কাজকর্মে যথেষ্ট উৎসাহ থাকে। যদি এর সমাধান করতে হয়, তাহলে স্থানীয় সরকারকে হতে হবে একটি বেতনভোগী সংস্থা, এবং এই কারণের সূত্রেই সংসদ সদস্যদের বেতনদানের ব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে।

একটি সংস্থা ভৌগোলিক অথবা সাংস্কৃতিক অথবা আদর্শবাদী যাই হোক না কেন, তার সর্বদা থাকবে দুই ধরনের সম্পর্ক, তার নিজের সদস্যদের প্রতি, দ্বিতীয়ত বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক। কোন সংস্থার তার নিজস্ব সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক যথারীতি সদস্যদের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিতে হবে, যতদিন পর্যন্ত না আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। যদিও সদস্যদের সঙ্গে সংস্থার সম্পর্কের বিষয়টি সদস্যদের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা, গণতন্ত্রের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, এটা আশা করা যায় যে, সদস্যরা কিছু নিয়মনীতি মনে রাখবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি বৃহৎ ব্যবসার কথা ধরা যেতে পারে। ধনতন্ত্রের ওপর সমাজতন্ত্রের আক্রমণের বিষয়টির সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্নের তুলনায় সম্ভবত সর্বাত্মকভাবে যুক্ত থেকেছে আয়ের প্রশ্নটি। যখন, জাতীয়করণের মাধ্যমে একটি শিল্পসংস্থা রাষ্ট্রের হাতে যায়, তখন এরকমও হতে পারে-বেসরকারি পুঁজিবাদের দিনগুলোর মতো তখনও সমান পরিমাণে ক্ষমতার বৈষম্য বিরাজ করছে-একমাত্র যে পরিবর্তনটা ঘটেছে, তা হল-ক্ষমতার অধিকারীরা এখন আর মালিক নয়-এখন তারা পদস্থ কর্মচারী। অবশ্য, এটা অপরিহার্য-যে কোন বৃহৎ সংস্থায় প্রশাসনিক আমলাবৃন্দের থাকা বাঞ্ছনীয়, সাধারণ কর্মচারীদের তুলনায় যারা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হবে, কিন্তু এটাও বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয় যে, ক্ষমতার এই অসমতা চরম প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি হওয়া উচিত নয় এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক উদ্যোগ সংস্থার সব সদস্যদের মধ্যে বণ্টিত হওয়া প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বই হল-জন স্পেডেন লিউসের পার্টনারশিপ ফর অল-এ ৩৪-ইয়ার ওল্ড এক্সপেরিমেন্ট ইন ইন্ডাস্ট্রিয়্যাল ডেমোক্রেসি। বইটির মূল আকর্ষণের দিক হল-এই কাহিনী এমন এক ব্যক্তির দীর্ঘ ও বিস্তৃত বস্তুগত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রচিত, যিনি পরীক্ষামূলক সাহসিকতার সঙ্গে গণউদ্দীপনার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। আর্থিক ক্ষেত্রে, তাঁর সংস্থার সমস্ত শ্রমিককে অংশীদার করেছিলেন, লাভেও যাদের অংশীদারিত্ব থাকতো, কিন্তু এ ধরনের আর্থিক উদ্ভাবন ছাড়াও, তিনি প্রত্যেক কর্মচারীকে এই অনুভূতি প্রদানে সমর্থ হয়েছিলেন যে, সে সামগ্রিক কর্মোদ্যোগ পরিচালনেরও অংশীদার, যদিও আমি সন্দিগ্ধ যে, তাঁর এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিল্পগত গণতন্ত্রের অভিমুখে যতদূর যাওয়া উচিত, ততদূর যাওয়া আদৌ সম্ভব কিনা। সংশ্লিষ্ট কাজকে সবচেয়ে ভালভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর জন্য তিনি একটি কৌশলেরও উদ্ভাবন করেছিলেন। এটাও লক্ষ্য করার বিষয় যে, বেতন-সমতার বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তির ভিত্তি শুধু এই ছিল না যে, যারা শক্ত কাজ করে, তারাই ভাল বেতন পাওয়ার অধিকারী, বরং যুক্তির ভিত্তিটা ছিল এরকম বিপরীতধর্মী যে, ভাল কাজের কারণ হল ভাল বেতন। তিনি বলেছেন, “এরকম কল্পনা করা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত যে, সামর্থ্য ও তা ব্যবহার করার উপযোগী ইচ্ছা-এ দুই-ই হল আমার অভিমতে, গণিতজ্ঞরা যাকে বলে থাকেন ‘ধ্রুবক’ এবং যা পরিবর্তনশীল, তা হল আয়, শ্রমের বিনিময়ে যা পেয়ে থাকে কর্মচারীরা। কেবল আপনার ইচ্ছাই আপনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মদক্ষতা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না, বরং আপনি যা বেতন পান, তার ওপরেই নির্ভর করে আপনার প্রকৃত কর্ম-সার্মথ্য। যারা দক্ষ শুধু সেকারণেই তাদের ভাল বেতন দেওয়া হয়-এটা ঠিক নয়; তাদের ভাল বেতন দেওয়া হয় বলেই তারা দক্ষ।”

মিঃ লিউস-প্রদত্ত এই অভিমতের চেয়ে বিস্তৃততর প্রয়োগ রয়েছে এই নীতির, এবং তার প্রয়োগ শুধুমাত্র বেতনের ক্ষেত্রেই ঘটে না, বরং সম্মান ও পদমর্যাদার ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ ঘটে থাকে। আমি মনে করি-প্রকৃতপক্ষে বেতনবৃদ্ধির প্রধান তাৎপর্য নিহিত থাকে পদমর্যাদার বৃদ্ধির মধ্যে। একজন বিজ্ঞান-কর্মী যার কাজ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, তিনি অন্য কোন ক্ষেত্রে কর্মরত একজন ব্যক্তির বেতনবৃদ্ধি মারফৎ প্রাপ্ত স্বীকৃতিসূত্রে যে উৎসাহ, সেই একই ধরনের উৎসাহ পেতে পারেন। আসলে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল-আশাবাদও এক ধরনের সজীবতা, যে বিষয়টির ঘাটতি রয়েছে ইউরোপে দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসাবে। পুরনো অবাধ নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্যোগের স্বাধীনতার অনুকূলে আর ওকালতি করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু এটা এখনও সর্বাধিক গুরুত্ববাহী যে, এখনও উদ্যোগের স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং সক্ষম মানুষরা যাতে তাদের সামর্থ্য দেখাতে পারেন, সেরকম সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

অবশ্যই, বৃহৎ সংস্থায় কী বাঞ্ছনীয়, এটা হল তার শুধু একটা দিক। অন্য দিকটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং তা হল-যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা রয়েছে, অন্যদের ওপর তাদের অত্যধিক চরম ক্ষমতাধিকার থাকা উচিত নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংস্কারকরা রাজাদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, এবং তারপর তারা পুঁজিবাদীদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এই দ্বিতীয় প্রতিযোগিতা নিষ্ফলা হবে, যদি তা হয়ে দাঁড়ায়, ধনতন্ত্রীদের ক্ষমতার পরিবর্তে পদস্থ আমলাদের ক্ষমতাপ্রাপ্তি। অবশ্য, এসব ক্ষেত্রে বাস্তব অসতুবিধাও রয়েছে, কারণ পদস্থ ব্যক্তিরা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করেই, প্রায়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কিন্তু এরকম সম্ভাবনা থাকাও প্রয়োজন একদিকে গণতান্ত্রিকভাবে নীতি-নির্ধারণের সাধারণ নিয়ম, এবং অন্যদিকে শাস্তিপ্রাপ্তির ভয়বর্জিত প্রেক্ষিতে পদস্থ আমলাদের কার্যকলাপের সমালোচনার অধিকার। যেহেতু, উদ্যমী মানুষদের ক্ষেত্রে ক্ষমতালিপ্সা স্বাভাবিক ঘটনা, সেকারণে এটা ধরেই নেওয়া যায়-বহু ক্ষেত্রেই পদস্থ আমলার তাঁদের প্রাপ্যের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা করায়ত্ত করতে চাইতেন। এসব কারণে, যে কোন বৃহৎ সংস্থার রাজনৈতিক বলয়ে লক্ষণীয় সর্তকতার মতোই, বৃহৎ সংস্থাতেও গণতান্ত্রিক সতর্কতা পালনের একই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ।

বহির্জগতের সঙ্গে কোন সংস্থার সম্পর্কের বিষয়টি আবার অন্যরকম ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র ক্ষমতার পটভূমিতেই তা নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির দরকষাকষির ক্ষমতার ভিত্তিতে নয়, বরং সেখানে বন্ধুত্বমূলক সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসা সম্ভব নয়, সেসব ক্ষেত্রে পাঠানো উচিত কোন নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের কাছে। এই নিয়মনীতির প্রাসঙ্গিকতার কোন ব্যতিক্রম থাকা উচিত নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের পৃথিবীর সামগ্রিকতায় আসতে হয়, যে পৃথিবীর এখনও পর্যন্ত নেই কোন বাহ্যিক রাজনৈতিক সম্পর্ক। যদি কোনদিন আন্তঃবিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা থাকে, তখন আমাদের প্রয়োজন হতে পারে একটি আন্তঃগ্রহ কর্তৃপক্ষের।

বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ, যতদিন পর্যন্ত না তা বৈরিতার জন্ম দেয়, কোনভাবেই দুঃখদায়ক নয়। কোন ভিন্ন দেশে, কিছুদিনের বসবাসের সূত্রে আমরা অবহিত হতে পারি-কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ঘাটতি রয়েছে, এবং যে দেশই আমাদের স্বদেশ হোক না কেন, সবক্ষেত্রেই এ ঘটনা সত্য। একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মতভেদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পেশার সূত্রে জাত ভিন্নধর্মিতার ক্ষেত্রেও, এই একই ঘটনা প্রযোজ্য। চারিত্র্যধর্মের একরূপত্ব ও সংস্কৃতির অভিন্নতা অবশ্যই দুঃখজনক। জৈব বিবর্তন নির্ভরশীল ছিল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সহজাত পার্থক্যের ওপর, এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তন নির্ভর করে থাকে অর্জিত ভিন্নধর্মিতার ওপর। যখন এগুলো অন্তর্হিত হয়, তখন আর নির্বাচনের জন্য অন্য কোন বস্তু অবশিষ্ট থাকে না। আধুনিক পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের অত্যধিক সদৃশতার প্রকৃত বিপদ বিদ্যমান। এই অশুভ প্রবণতার হ্রাসকরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হল বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বশাসনের মাত্রাবৃদ্ধি।

মানসিক পণ্যের তুলনায় বস্তুগত পণ্য অনেক বেশি অধিকারের জিনিস। যে মানুষ একখন্ড খাদ্যদ্রব্য খাচ্ছে, সে অন্যান্য প্রত্যেককেই সেটিতে কামড় বসানোর ক্ষেত্রে বাধা দেবে, কিন্তু যে মানুষ একটি কবিতা লেখে বা তার স্বাদ অনুভব করে, সে ভাল হোক বা মন্দ হোক-অন্য আর একজনকে কবিতা লিখতে বা অনুভব করতে নিষেধ করে না। সে কারণে, বস্তুগত পণ্যের প্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মানসিক পণ্যের ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, তা হল-সুযোগ এবং এমন এক পরিবেশ, যা কৃতিত্ব সম্পর্কিত আশাবাদের যুক্তিগ্রাহ্য হয়। বিশাল ধরনের বস্তুগত পুরস্কার সৃজনক্ষম মানুষকে উৎসাহিত করে না; খুবই অল্পসংখ্যক কবি বা বিজ্ঞানীর অদৃষ্ট খোলে বা তারা সেরকম ইচ্ছা পোষণ করেন। সক্রেটিসকে মৃত্যুবরণে বাধ্য করেছিল কর্তৃপক্ষ, কিন্তু তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তেও পুরোপুরি অবিচল ছিলেন, কারণ তিনি তাঁর কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু তার ওপর যদি সম্মান-পুরস্কারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হতো এবং তার কাজ থেকে তাঁকে বিরত করা হতো, তাহলে সেটা তার কাছে অনেক বড় শাস্তি বলেই মনে হতো। কোন প্রাচীন রাষ্ট্রে, যেখানে কর্তৃত্ববাদ প্রচারের সব পন্থাকেই নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে মৌলিকতায় চিহ্নিত ব্যক্তিকে মন্দ ভাগ্যের শিকার হতে হয়ঃ আইনী শাস্তির প্রকাশ তাকে মানতে হোক বা না হোক, তিনি তাঁর ভাবনাচিন্তা প্রকাশ্যে আনতে ব্যর্থ হন। কোন সমাজে যখন এরকমটা ঘটে, তখন তা মানুষের যৌথজীবনে মূল্যবাহী আর কোন অবদান রাখতে পারে না ।

লোভী ও হিংসাজীবী প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ একান্ত জরুরি এবং সে কারণে, রাষ্ট্রসমূহ ও এমনকী বিশ্বরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমরা মৃত্যুর চেয়ে নিছক বেঁচে থাকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারি না; আমরা সুখে, তীব্রভাবে, সৃজনাত্মকভাবে বেঁচে থাকতে চাই। এর জন্য, রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় শর্তের একটি অংশমাত্রের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু যদি না করে, তাহলে নিরাপত্তার নামে সুপ্রসারিত ও অনিয়ন্ত্রিত আবেগের শ্বাসরোধ করে যে আবেগ থেকে উৎসারিত হয় জীবনের স্বাদ ও তার মূল্য-ব্যক্তিজীবনে এখনও যেগুলোর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, এবং যা বিশাল সংগঠনের নিয়ন্ত্রণের থাবায় সর্বাত্মকভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। আধুনিক প্রয়োগ-কৌশলে সৃষ্ট এই পৃথিবীতে উপরোক্ত বিপদের বিরুদ্ধে সতর্ক প্রহরা খুবই প্রয়োজনীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *