৩. ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ভূমিকা

বক্তৃতা : তিন
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ভূমিকা

এই বক্তৃতায় আমি, কোন একটি সমাজের সকলের নয়, বরং কিছু সদস্যের মঙ্গলা-মঙ্গলের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেরণা ও অভিলাষের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চাই। প্রত্যন্ত আদিম সমাজে এসব প্রেরণা ও ইচ্ছাসমূহ নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ভূমিকা পালন করে। শিকার ও যুদ্ধবিগ্রহে একজন মানুষ অন্যজনের চেয়ে অধিকতর সফল হতে পারে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সকলেরই একটি সাধারণ উদ্দেশ্যে থাকে। যতদিন পর্যন্ত সম্প্রদায়ভুক্ত সমস্ত মানুষের অনুমোদন ও অংশগ্রহণ সাপেক্ষে একজন মানুষের কর্মধারা স্বতঃস্ফুর্ত থাকে, ততদিন সেই সম্প্রদায়ের অন্য কারও দ্বারা তার কর্মোদ্যোগ কদাচিৎ বাধাপ্রাপ্ত হয়, এবং এমনকী তার সর্বাধিক স্বতঃস্ফূর্ত কার্যবলীও সমাজ-স্বীকৃত আচরণবিধির সঙ্গে সামঞ্জপূর্ণ হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ যখন ক্রমশ আরও সভ্য হয়ে উঠতে থাকে, তখন একজন মানুষের কর্মধারার সঙ্গে অন্যজনের কর্মধারার পার্থক্য বাড়তেই থাকে, এবং সমৃদ্ধিকামী কোন সমাজে এমন একগুচ্ছ মানুষের প্রয়োজন রয়েছে, যারা সর্বাংশে সাধারণ ধারার অন্তর্ভুক্ত নয়। বস্তুত, শৈল্পিক, নৈতিক এবং বৌদ্ধিক-সব ধরনের প্রগতিই নির্ভর করেছিল এই বিশেষ ধরনের ব্যক্তি-মানুষের ওপর, যারা বর্বরতা থেকে সভ্যতার যুগে পর্বান্তর-প্রক্রিয়ায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যদি কোন সমাজ অগ্রগতি-অভিলাষী হয়, তার এমন সব ব্যতিক্রমী ব্যক্তির প্রয়োজন, যাঁদের কর্মধারা আবশ্যকীয় হলেও এমন ধারার হওয়া উচিত নয়, যা সাধারণ বলে গণ্য হতে পারে। কোন সুসংগঠিত সমাজব্যবস্থায় সর্বদাই এই ধরনের মানুষের কর্মোদ্যোগকে অযথা বাধা দেওয়ার প্রবণতা থাকে, আবার অন্যদিকে, সমাজ যদি কোন নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ না করে, তাহলে ওই একই ধরনের ব্যক্তি-উদ্যোগ যেমন মূল্যবান আবিষ্কারের উগাতা হতে পারে, তা-ই আবার কোন অপরাধীরও জন্ম দিতে পারে। আমাদের সংশ্লিষ্ট অন্য সব কিছুর মতোই আসল সমস্যা হল ভারসাম্যের সমস্যা। মাত্রাতিরিক্ত কম স্বাধীনতা নিয়ে আসে স্থবিরতা, আর মাত্রাতিরিক্ত বেশি স্বাধীনতা থেকে জন্ম নেয় বিশৃঙ্খলা ।

নিজ দলের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে থেকে ও ব্যক্তিবিশেষের নিজেকে স্বতন্ত্র রাখার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সে ব্যতিক্রমীভাবে হতে পারে নৈরাজ্যবাদী অথবা সমাজবিরোধী; সে বিরল শিল্প-প্রতিভার অধিকারী হতে পারে; ধর্ম ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে কালের প্রবাহে আগত নতুন ‘জ্ঞান’ রূপে স্বীকৃতিযোগ্য বস্তুর অধিকারী হতে পারে সে এবং তার থাকতে পারে অসাধারণ বৌদ্ধিক ক্ষমতা। এটা মনে হতে পারে-মানব-ইতিহাসের একেবারে ঊষালগ্ন থেকে ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রেও নিশ্চিতভাবে ছিল কম-বেশি ভিন্নধর্মিতা। প্রত্নপ্রস্তর যুগীয় মানুষের আঁকা পিরেনিজের গুহাচিত্রের মধ্যে খুবই উঁচু স্তরের শিল্পোঙ্কর্ষের ছাপ রয়েছে এবং এই ঘটনা থেকে এরকম কেউ ভাবে না যে, সেই যুগের সব মানুষই এ ধরনের প্রশংসনীয় কাজে সমর্থ ছিল বরং মনে হয়, এরকম সম্ভাবনাই অনেক বেশি ছিল যে, যাদের মধ্যে শিল্পপ্রতিভা ছিল তাদের এসব শিল্পবস্তু তৈরি করার জন্য মাঝে মাঝে বাড়িতে থাকার অনুমতি দেওয়া হতো, সেই সময়ে গোষ্ঠীর বাকি সদস্যরা শিকারে ব্যস্ত থাকতো। প্রকৃতি অথবা কল্পিত মহত্ত্বের জন্য, সেই প্রাচীন আমলের একেবারে গোড়ার দিক থেকেই, প্রধান অথবা পুরোহিতকে মনোনীত করা হতো। ভেষজ-সম্পর্কিত মানুষেরা ভোজবাজির মতো ক্রিয়াকলাপ দেখাতে পারতো এবং গোষ্ঠী-প্রধানের মধ্যে গোষ্ঠীসত্তা যেন অনেকাংশে রক্তমাংসের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। সেই প্রাচীনতম যুগ থেকে এই ধরনের ক্রিয়াকলাপের প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল। গোষ্ঠীপাতিত্ব বংশানুক্রমিক হল, ভেষজসংক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত হলেন এবং স্বীকৃত চারণ কবিরা কবিশ্রেষ্ঠ রূপে পরিচিত হলেন। ব্যতিক্রমী অবদান যাদের কাছ থেকে আসতে পারে, সেই রকম ব্যক্তিমানুষের প্রয়োজনের ধরন-ধারণ চিহ্নিত করা সমাজের পক্ষে বরাবরই একটা কঠিন কাজ; দৃষ্টান্তস্বরূপ যা আমার মনে আসছে, তা হল-বন্যতা, গোষ্ঠী থেকে স্বাতন্ত্র, সকলের কাছে সর্বদা অপরিহার্য নয়, এমন ধরনের বিরলপ্রবৃত্তির দ্বারা প্রভুত্ব-এসবেরই বিবিধ উপকরণ।

এই বক্তৃতায় আমি অতীতে ও বর্তমানে সমাজের সঙ্গে ব্যতিক্রমী মানুষের সম্পর্ক, এবং তার অ-প্রথাগত মেধার সামাজিকভাবে ফলদায়ী হওয়ার শর্তাবলি সম্পর্কে আলোচনা করতে ইচ্ছুক। প্রথমে আমি শিল্পের প্রেক্ষিতে সমস্যাটিকে নিয়ে বিশ্লেষণ করবো, তারপর ধর্ম ও নৈতিকতায়, এবং অবশেষে বিজ্ঞানে।

অতীতে বিভিন্ন যুগে শিল্পীরা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন, আমাদের আমলের শিল্পীদের ভূমিকা তার কাছাকাছি নয়। আমাদের আমলে সভাকবিকে অবজ্ঞার চোখে দেখার প্রবণতা রয়েছে, এবং এরকম ভাবারও প্রবণতা রয়েছে যে, একজন কবির নিঃসঙ্গ থাকা উচিত, কারণ ব্যস্ত বৈষয়িক মানুষেরা কবির কথা শুনতে চায় না। ঐতিহাসিকভাবে কিন্তু ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরি অন্যরকম; হোমর, ভার্জিল এবং সেক্সপিয়র সভাকবি ছিলেন, তাঁরা নিজেদের গোষ্ঠীর গৌরবগাথা ও মহান ঐতিহ্যের প্রচার করতেন (সেক্সপিয়র সম্পর্কে আমি অবশ্যই স্বীকার করবো, এই ঘটনা আংশিকভাবে সত্য, কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলোর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য)। ছন্নছাড়া চারণকবিরা রাজা আর্থারের গরিমাকে সজীব রেখেছিল; এবং ইংরেজ ও ফরাসি কবিরা এই গৌরবগাথাকে আরও মহিমান্বিত করে তুলেছিলেন, রাজা দ্বিতীয় হেনরি সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে তাদের উৎসাহিত করতেন। পার্থেনন ও মধ্যযুগীয় চার্চের গৌরব জনসাধারণের লক্ষ্যের সঙ্গে অন্বিত ছিল। সঙ্গীত, যদিও তা প্রণয়-কর্মে ভূমিকা পালন করতে পারতো, তা যুদ্ধে সাহস ও উদ্দীপনা সঞ্চারিত করার জন্য প্রাথমিক অস্তি ত্ব বজায় রেখেছিল-এটা এমন একটা উদ্দেশ্যে, যা প্লেটোর মতে আইনবন্দী থাকা উচিত। শিল্পীদের এসব প্রাচীন গৌরবগাথার মধ্যে পার্বত্য সেনাবাহিনীর প্রতি বংশীবাদন ছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে অতি সামান্যই অবশিষ্ট রয়েছে। আজও আমরা শিল্পীকে সম্মান করি, তবে তাকে বিচ্ছিন্ন রাখি; আমরা শিল্পকে স্বতন্ত্র কিছু বলে মনে করি, যা সমাজের মানুষদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। শুধু স্থপতি তার উপযোগিতাপূর্ণ কাজের জন্য শিল্পীর প্রাচীন সম্মানের সামান্য কিছু ধরে রাখতে পেরেছেন।

আমাদের যুগে শিল্পের অবক্ষয়ের একমাত্র কারণ এই নয় যে, শিল্পীর সামাজিক কাজকর্ম প্রাচীন দিনগুলোর মতো আজ আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং অন্যতর কারণটি হল–উপভোগ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ রূপে আর তা স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের অনুভূতি নয়। তুলনামূলকভাবে বলা যায়-অমার্জিত জনসাধারণের মধ্যে লোকনৃত্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত ধারার সূরণ আজও অব্যাহত রয়েছে, এবং অনেক মানুষের মধ্যে কবিসুলভ উপাদানের অস্তিত্বও রয়েছে। কিন্তু শিল্পোৎপাদনে মানুষের মতো অগ্রগতি ও সংঘবদ্ধতা ঘটলো, শিশুদের মধ্যে যে ধরনের আনন্দের সূরণ দেখা যায়, তা বয়স্কদের ক্ষেত্রে অবাস্তব হয়ে দাঁড়ালো, কারণ বয়স্কদের সর্বদা পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য চিন্তামগ্ন থাকতে হয় এবং সেই মূহূর্তে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়ার সময় তাদের নেই । আমাদের কল্পনাময় মনোজগতের অন্য যে কোন অভ্যাসের চেয়ে পরবর্তী কার্যক্রম’ সক্রান্ত চিন্তার এই অভ্যাস যে কোন নান্দনিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিপজ্জনক, এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থে, শিল্পকে যদি টিকে থাকতে হয়, তাহলে প্রথাগত শিক্ষানুরাগীদের দ্বারা তা সম্ভব নয়, বরং সর্বাত্মক আনন্দ-বেদনার ধারণক্ষমতাকে পুনরধিকার করেই তা সম্ভব, যা বিচক্ষণতা ও দুরদর্শিতার পথ ধরে ইতোমধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

মানবজাতির মধ্যে প্রথাগতভাবে শ্রেষ্ঠ মানুষ রূপে যারা স্বীকৃতি লাভ করেছেন, তাঁরা ছিলেন ধর্ম ও নৈতিকতার প্রবর্তক । পরবর্তী যুগ তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও জীবিত কালে তাঁদের অধিকাংশের সঙ্গেই নিজ নিজ সমাজের ছিল কম-বেশি সংঘাতের সম্পর্ক। মূলত, নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মানবিক সহানুভূতির সীমানা-সম্প্রসারণ-এই দুটি উপকরণ নিয়ে গঠিত হয়েছে নৈতিক প্রগতি। পূর্ণ ঐতিহাসিক নবযুগারম্ভে গ্রিকদের মধ্যে মানবিক বলিপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছিল। সুখে দুঃখে নির্বিকার আদর্শবাদীরা শিখিয়েছিলেন, শুধু স্বাধীন গ্রিকদের জন্যই নয়, বরং বর্বর ও দাসদের জন্যেও সহানুভূতি থাকা উচিত, এবং প্রকৃতপক্ষে তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই থাকা প্রয়োজন। বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিস্টধর্মও কাছে-দূরে একই ধরনের মতবাদ প্রচার করেছিল। ধর্ম মূলত ছিল গোষ্ঠীগত আবঞ্জন-প্রক্রিয়ার অংশ, যা সমপরিমাণ আন্ত কঃসহযোগিতার তুলনায় সংঘাতই বাড়িয়ে তুলেছিল, কালক্রমে এই ধর্ম অধিকতর সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করলো এবং এভাবে তা আদিম নৈতিকতা-নির্ধারিত সংকীর্ণ সীমানা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনাও আশ্চর্যের নয় যে, তাদের নিজেদের আমলেই ধর্মপ্রবর্তকদের অভিশাপ কুড়োতে হয়েছিল, কারণ তারা মানুষের যুদ্ধের আনন্দও প্রতিশোধের বীভৎস পুলক লুণ্ঠন করার চেষ্টা করেছিলেন। আদিম হিংস্রতা যা এতকাল গুণ হিসেবে বিবেচিত হতো, তা এখন থেকে পাপ রূপে অভিহিত হতে লাগলো এবং নীতিবোধও মানবিকতার দৃঢ় আবেগসম্পন্ন মানুষদের শেখানো নৈতিকতার সঙ্গে নিজস্ব গোষ্ঠীবহির্ভূত সহানুভূতিহীন মানুষদের পছন্দসই নীতিবোধের দ্বন্দ্ব ।

ধর্ম ও নৈতিকতার প্রবর্তকদের বিশাল প্রভাব ছিল মানুষের জীবনের ওপর, তবে স্বীকার করা প্রয়োজন সর্বদা বাঞ্ছিত প্রভাব নয়, বরং সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব । এটা সত্য-বর্তমান শতাব্দীতে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আমরা দেখেছি নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষয়, যে মূল্যবোধগুলোকে আমরা নিরাপদ বলেই মনে করতাম, কিন্তু আমরা নৈতিকতার প্রবর্তকদের কাছে ঋণী, যারা সর্বপ্রথম চেষ্টা করেছিলেন নীতিবোধকে নিছক গোষ্ঠীগত বিষয় হিসেবে নয়, বরং একটি সর্বজনীন বিষয়রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এই সত্যকেও যে, দাসপ্রথা বাতিলের সময় এসেছে, যুদ্ধবন্দীদের প্রতি কর্তব্যবোধ, পতি ও পিতাদের ক্ষমতার সীমিতকরণ এবং বিজেতাদের উপকারের জন্য বিজিত জাতির উপর নিছক নিপীড়ন অনুচিত-যত অসম্পূর্ণতাই থাক, এই মতের স্বীকৃতি। স্বীকার করতেই হবে, প্রাচীন হিংস্রতার পুনরাগমনের ফলে এসব নৈতিকলাভ বিপন্ন হয়ে পড়েছে, কিন্তু আমি মনে করি না-যে নৈতিক প্রগতির প্রতিনিধিত্ব তারা করেছেন, মানবজাতির কাছে তা হারিয়ে যাবে।

যেসব ধর্মগুরু ঋষিরা এসব নৈতিক প্রগতির সূচনা করেছিলেন-তাদের আমলের অধিকাংশ সময় জুড়ে সম্মানলাভ না করলেও তাদের নিজেদের কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়নি। বর্তমান সময়ের কোন চরম মতবাদসম্পন্ন রাষ্ট্র খ্রিস্ট বা সক্রেটিসের আমলের চেয়েও খারাপ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। কোন চরমমতবাদী রাষ্ট্রে সরকার যে প্রচারকের মতবাদ পছন্দ করে না, তাকে শুধুমাত্র হত্যা করাই হয় না, কারণ মৃত্যুর সামনে যে কোন সাহসী মানুষই নির্বিকার থাকেন-কিন্তু তাঁর মতবাদ প্রকাশের পথে সর্বাত্মকভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়। এ রকম সমাজে নবমতবাদ-প্রবর্তন শুধুমাত্র সরকারের মাধ্যমেই ঘটতে পারে এবং অতীতের মতোই বর্তমান কালের কোন সরকারের তরফে নিজের তাৎক্ষণিক স্বার্থবিরোধী কোনকিছু অনুমোদনের সম্ভাবনা থাকে না। এরকম চরম মতাবলম্বী রাষ্ট্রে বৌদ্ধধর্ম বা খ্রিস্টধর্মের উত্থানের মতো ঘটনা কদাচিৎ সম্ভব, এবং এমনকী সর্বাধিক বীরত্বের সুবাদেও একজন নীতিবাদী সংস্কারকও কোন প্রভাব অর্জন করতে পারেন না। মানুষের ইতিহাসে এটা একটা নতুন ঘটনা, এবং এটা সম্ভব হয়েছে ব্যক্তিমানুষের ওপর বহুগুণবর্ধিত নিয়ন্ত্রণের কারণেই এবং এই নিয়ন্ত্রণ আবার সম্ভবপর হয়েছে ব্যক্তিমানুষের ওপর বহুগুণবর্ধিত নিয়ন্ত্রণের কারণেই এবং এই নিয়ন্ত্রণ আবার সম্ভবপর হয়েছে সরকারের আধুনিক কৌশলের কল্যাণে। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয় কিভাবে চরম মতাবলম্বী রাজত্ব যে কোন ধরনের নৈতিক প্রগতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

শিল্পে অথবা ধমীয় ও নৈতিক সংস্কারবাদে নিবেদিত প্রাণ কোন ব্যক্তি আমাদের নিজেদের যুগে পূর্বতন আমলের মতো ততটা বিরাট অগ্রগতি অথবা সামাজিক প্রভাব কদাচিৎ আশা করতে পারে। অবশ্য, এখনও তার সামনে চারটি পথ খোলা আছে-তিনি লেনিনের মতো একজন বড়োসড়ো রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন; তিনি রকফেলারের মতো সুবিশাল শিল্পপতির ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন; পরমাণু বিজ্ঞানীরা যেমন করে চলেছেন, তেমনি তিনি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে ফেলতে পারেন; অথবা সবশেষে এই তিনটি পথের কোনটির উপযোগী দক্ষতা যদি তাঁর না থাকে, অথবা যদি সুযোগ-বঞ্চিত হন, তাহলে অন্যান্য নির্গম-পথের অভাবে তাঁর উদ্যোগে তাঁকে অপরাধজগতে টেনে আনতে পারে। আইনী অর্থে, ইতিহাসের গতিচক্রের উপর অপরাধীদের কদাচিৎ প্রভূত প্রভাব থাকে, এবং সে কারণে অতি মাত্রায় উচ্চাশার মানুষকে তার সামনে উন্মুক্ত অন্য কোন পথকেই বেছে নিতে হবে।

রাষ্ট্রপরিধির মধ্যে, দারুণ উল্লেখযোগ্যভাবে বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট মানুষদের উত্থান একটি আধুনিক প্রবণতা, অন্যান্য প্রবর্তকদের মতোই বিজ্ঞানীদেরও স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞানীই বিতাড়িত হয়েছিলেন। অনেককেই পুড়িয়ে মারা হয়েছিল; কাউকে কাউকে অন্ধকার কারাকক্ষে বন্দী রাখা হয়েছিল; আর অন্যান্যরা শুধুমাত্র তাঁদের বইগুলোই পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু, কালক্রমে এই উপলব্ধি ঘটলো যে, তাঁরাও রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা যোগান দিতে পারে। ল্যাভোয়েশিয়কে গিলোটিনে ভুলক্রমে হত্যা করার পরে ফরাসি বিপ্লবীরা তাঁর জীবিত সতীর্থদের বিস্ফোরক দ্রব্য উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করেছিল। বর্তমান যুগের যুদ্ধ-বিগ্রহে সমস্ত সভ্য সরকারই বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নাগরিকের স্বীকৃতি দেন, অবশ্য এই শর্তসাপেক্ষ যে, তাঁদের এমনভাবে বশে রাখা যাবে ও প্রণোদিত করা যাবে যে, তাদের পরিষেবা যেন সমগ্র মানবজাতির পরিবর্তে মাত্র একটি সরকারের সম্পূর্ণ পরিষেবায় নিয়োজিত হয় ।

ভাল ও মন্দ যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই পূর্বসূরীদের থেকে আমাদের যুগকে পৃথক করেছে বিজ্ঞান। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের রয়েছে বৈদ্যুতিক আলো এবং রেডিও ও চলচ্চিত্র। শিল্পক্ষেত্রে আমরা যন্ত্র ও শক্তিকে কাজে লাগিয়েছি, যার জন্য আমরা বিজ্ঞানের কাছে ঋণী, শ্রমের বর্ধিত উৎপাদন শক্তির কল্যাণে, পূর্বে যা সম্ভব ছিল, তার তুলনায় বর্তমানে আমাদের অনেক বেশি উদ্যমকে যুদ্ধ এবং যুদ্ধপ্রস্তুতির কাজে নিয়োগ করতে সমর্থ এবং পূর্বের তুলনায় বর্তমানে দীর্ঘতর সময় ধরে তারুণ্যকে বিদ্যালয়-বন্দী রাখতেও সমর্থ । বিজ্ঞানের সুবাদে আমরা সংবাদমাধ্যম ও বেতারের মাধ্যমে বস্তুত সকলের কাছেই তথ্য ও ভুলতথ্য সম্প্রচারে সক্ষম হয়েছি। সরকারের অপছন্দের লোকজনের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া যথেষ্ট কঠিনতর কাজ হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানের প্রভাবেই । আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও সামাজিক সংগঠনের সামগ্রিকতার মূলে রয়েছে এই বিজ্ঞান। এই সুবিশাল অগ্রগতির সমগ্র প্রক্রিয়াটিকেই আজকাল মদত দেয় সরকার, কিন্তু প্রাথমিকভাবে এই বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধিতার ফলশ্রুতিতেই, এবং কোথাও কোথাও, যেমন রাশিয়ায় রাষ্ট্র-পূর্ব অবস্থাতেই প্রত্যাবর্তন করেছে, পুরনো বিরোধিতার চিত্র আবার ফিরে আসতে পারে, যদি না পূর্বতন যুগে স্বৈরাচারীদের কল্পনাবহির্ভূত মাত্রায় রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান রূপ ধারণ করে।

অতীতে বিজ্ঞানের বিরোধিতা কোনভাবেই বিস্ময়ের বিষয় ছিল না। সকলেই যা বিশ্বাস করতো, বিজ্ঞানীরা তার বিরোধী তত্ত্ব-বিষয়াদিকে প্রমাণসিদ্ধ করতেন। পূর্বকল্পিত ধ্যানধারণার ওলটপালট ঘটিয়ে দিতেন তারা এবং সেকারণে তাদের অবিশ্বাসী ও ভক্তিহীন বলে মনে করা হতো। অ্যানাক্সাগোরাস শিখিয়েছিলেন যে, সূর্য একটি লোহিত তপ্ত প্রস্তর এবং চাঁদ তৈরি হয়েছে মাটি দিয়ে। এহেন অধামির্কতার জন্য তাঁকে এথেন্স থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, কারণ একথা কে না জানে যে, সূর্য একজন দেবতা এবং চাঁদ একজন দেবী? প্রাকৃতিক শক্তির উপর বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রক শক্তির সুবাদে বৈজ্ঞানিকদের ধীরে ধীরে সহ্য করে নেওয়া হচ্ছিল, এবং এমনকী এই প্রক্রিয়াও ছিল খুবই মন্থর, কারণ সর্বপ্রথম তাঁদের ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটেছিল ইন্দ্রজালে ।

এটা আদৌ বিস্ময়কর হবে না, যদি বর্তমান সময়ে পরমাণু বোমা থেকে উদ্ভূত এবং জীবাণু যুদ্ধের সম্ভাব্য বিপদের প্রতিবাদস্বরূপ একটি শক্তিশালী বিজ্ঞানী-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু, এসব ভয়াবহতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যা-ই ভাবুক না কেন, যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, ততদিন তারা বিজ্ঞানের মানুষদের বিরুদ্ধে যাবে না, কারণ যদি একপক্ষ বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা সুসজ্জিত থাকে আর অন্যপক্ষ যদি বৈজ্ঞানিকহীন হয়, তাহলে বৈজ্ঞানিকপক্ষের জয় প্রায় সুনিশ্চিত।

বিজ্ঞান, যতক্ষণ পর্যন্ত তা জ্ঞান-প্রভাবিত, ততক্ষণ পর্যন্ত তা মূল্যবান, কিন্তু যখনই বিজ্ঞান প্রযুক্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে, তখন তা প্রশংসিত বা নিন্দিত হবে কিনা, তা নির্ভর করে প্রযুক্তিগত ব্যবহারের উপর । নিজস্বতায় বিজ্ঞানের চরিত্র নিরপেক্ষ, ভালও নয়, মন্দও নয়, কিন্তু তার সম্পর্কে কোন চরম অভিমত প্রকাশ হলে, তার উৎস হবে বিজ্ঞানের বাইরে অন্য কোন বিষয় ।

আধুনিক জীবনের ওপর গভীর প্রভাব সত্ত্বেও বিজ্ঞানের মানুষেরা কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের চেয়ে কম শক্তিশালী। মানুষের ইতিহাসে যে কোন পূর্ববর্তী পর্বের রাজনীতিবিদদের তুলনায় বর্তমায়ের রাজনীতিবিদেরা অনেক বেশি প্রভাবশালী। বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট মানুষদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ধরনটা আরব্যরজনীর জাদুকরের সঙ্গে তার সহচরের মতো, যে তার হুকুম তামিল করে। জাদু-সহচর অত্যাশ্চর্য সব ভেলকি দেখায় তার সাহায্য ছাড়া জাদুকর কিছুই করতে সক্ষম নয়, কিন্তু এটি তার নিজস্ব পেরণা নয় বরং ওইরকম করতে বলা হয়েছে বলেই সে হুবহু তাই করে। আমাদের সময়কার পরমাণু বিজ্ঞানীদের অবস্থাটাও ঠিক এইরকম; কোন কোন সরকার তাদের স্বগৃহে অথবা দূরবর্তী সমুদ্রে বন্দী রাখে। তারপর, তাদের বন্দীত্বের ভাগ্য অনুসারে, তাদের কাজকর্ম শুরু হয়-একপক্ষ বা অন্যপক্ষের ক্রীতদাসত্বের বিনিময়ে। রাজনীতিবিদ, যদি সে সফল হয়, তাহলে সে এ ধরনের দমনে লিপ্ত হয় না। আমাদের সময়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ অগ্রগতির দৃষ্টান্ত রেখেছেন লেনিন। জার সরকার কর্তৃক তার ভাই নিহত হওয়ার পরে, তিনি বছরের পর বছর কাটিয়েছিলেন দারিদ্র্যে ও নির্বাসনে, এবং তারপর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তার উত্থান ঘটেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রের অধিনায়করূপে এবং এই অধিনায়কত্ব জারক্সেস বা সিজারের মতো ছিল না, যারা শুধুমাত্র বিলাস ও চাটুকারিতার কারবারি ছিলেন, কিন্তু লেনিনের ক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তি হয়তো উপভোক্তা ছিল। এটা এমনই একটা ক্ষমতা যার উদ্দেশ্য ছিল নিজস্ব মানসিকতা-প্রসূত এক বিশেষ আঙ্গিকে একটা সুবিশাল দেশের ছাঁচ বদলে দেওয়া-প্রতিটি শ্রমিক, প্রতিটি কৃষক ও প্রত্যেক মধ্যবিত্তের জীবনধারার পরিবর্তন ঘটানো; এক নতুন ধরনের সংগঠনের প্রবর্তন এবং সমগ্র পৃথিবীতে এক নতুন বিন্যাসের প্রতীকস্বরূপ আত্মপরিচয়-ঘোষণা, যা কারও কারও মুখে প্রশংসিত হয়েছিল, আবার অনেকের কাছ থেকে অভিশাপও কুড়িয়েছিল, কিন্তু কেউ উপেক্ষা করতে পারেনি। কোন মাত্রাছাড়া আত্মম্ভরীর স্বপ্নও এরচেয়ে ভয়ঙ্কর হতে পারে না। নেপোলিয়ন দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন-তুমি বন্দুক দিয়ে সবকিছুই করতে পারো, শুধু তার ওপর চেপে বসতে পারোনা; লেনিন এই ব্যতিক্রমকেও অসার প্রতিপন্ন করেছিলেন।

যেসব মহান পুরুষ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন, তাঁরা আংশিকভাবে মানবজাতির উপকার এবং আংশিকভাবে ঠিক এর উল্টো। বিখ্যাত ধর্মীয় ও নীতিবোধের প্রবর্তকদের মতো কেউ কেউ তাদের অন্তলীন ক্ষমতার সাহায্যে মানুষে মানুষে পারস্পরিক হিংসা কমানো ও সহানুভূতির সীমিতকরণের কাজ করেছেন; বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট মানুষদের মতো অনেকেই আমাদের দিয়েছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত জ্ঞান ও উপলব্ধি, যা বিভিন্ন অপব্যবহার সত্ত্বেও তার নিজস্ব সত্তায় একটি অত্যুজ্জ্বল জিনিস হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। মহান কবি এবং সরকার ও চিত্রকরের মতো অনেকেই এই পৃথিবীকে দিয়েছেন সৌন্দর্য ও অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি, যা উৎসাহহীনতার সময়ে মানবিক নিয়তির প্রতিচ্ছবিকে সহজসাধ্য করে তোলে। কিন্তু, তাদের নিজ নিজ পথে সমানভাবে সমর্থ, সমানভাবে কার্যকরী অন্যেরা সম্পূর্ণ উল্টোটাই করে চলেছেন। আমি ভাবতে পারি না চেঙ্গিজ খানের অস্তিত্বের সূত্রে মানবজাতির কোন্ উপকার হয়েছে! আমি জানি না রোবসৃপিয়ের আমাদের কী মঙ্গল করেছেন, এবং আমার তরফ থেকে লেনিনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকারও কোন কারণ খুঁজে পাই না। কিন্তু, ভাল ও মন্দ এসব মানুষের একটা গুণ ছিল, আমি চাই না যে গুণ পৃথিবী থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাক-উৎসাহ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ, মনের স্বাধীনতা এবং কল্পনাপ্রবণ দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কিত গুণ। এসব গুণের অধিকারী মানুষ খুব ভাল অথবা ক্ষতিকর কাজ করতে সমর্থ এবং মানবজাতি যদি স্থবিরতার মধ্যে নিমজ্জিত হতে না চায়, তাহলে এসব ব্যতিক্রমী মানুষ নিশ্চিতভাবে সুযোগ খুঁজে নেবে, যদি যে কেউ এই আশা করতে পারে যে, যে সুযোগ তারা অনুসন্ধান করবেন, তা যেন মানবজাতির কল্যাণমুখী হয়। মাঝে মাঝে আমরা যা মনে করি, তার তুলনায় অনেক কম পার্থক্য থাকতে পারে একজন জাদরেল অপরাধী ও একজন মহান প্রবক্তার মধ্যে। এরকমটাও হতে পারে-যদি কোন জাদুকর জন্মলগ্নেই ক্যাপ্টেন কিড ও মহামতি আলেকজান্ডারকে পারস্পরিকভাবে বদলে দিতেন, তাহলেও এই দুইজনের পারস্পরিক কৃতিত্ব সমানভাবেই পরিপূরণ হতো। কয়েকজন শিল্পী সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। বেনভেনুতে সেলিনির স্মৃতিকথা থেকে আমরা এমন একজন মানুষেরও প্রতিচ্ছবি পাই না, যার আইনের প্রতি কোন নিরপেক্ষ শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। আধুনিক পৃথিবীতে, একজন ব্যক্তির পক্ষে গুরুত্ববাহী কীর্তি সম্ভব নয় বা সম্ভবপর হবে না, যদি না তিনি কোন বিশাল সংগঠনের প্রভুত্ব করতে পারেন। যদি তিনি নিজেকে লেনিনের মতো রাষ্ট্রপ্রধান, অথবা রকফেলারের মতো এক বিশাল শিল্পের একচেটিয়া সম্রাট, অথবা জৌষ্ঠতর পিয়ের পন্ট মর্গ্যানের মতো ঋণ-নিয়ন্ত্রকরূপে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তিনি পৃথিবীতে প্রভূত প্রভাব রাখতে পারবেন । ঠিক সেভাবেই, যদি তিনি বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট মানুষ হন, তাহলে তিনি কোন সরকারকে বিশ্বাস করাতে পারেন যে, তাঁর কাজ যুদ্ধের পক্ষে প্রয়োজনীয় হতে পারে । কিন্তু কোন হিব্রু ধর্মগুরু, একজন কবি, অথবা স্পিনোজার মতো কোন নিঃসঙ্গ দার্শনিক যদি সংগঠনের সাহায্য ব্যতিরেকেই কাজ করেন, তাহলে তিনি পুরনো দিনগুলোতে যে ধরনের গুরুত্ব পেতেন, সেরকম গুরুত্ব আর আশা করতে পারেন না । এই পরিবর্তনের বিষয়টি যেমন বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে খাটে, তেমনি অন্য ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও খাটে। অতীতের বিজ্ঞানীরা ব্যক্তি হিসেবেই ব্যাপকভাবে তাঁদের কাজ করতেন, কিন্তু আমাদের আমলের বিজ্ঞানীর প্রচুরসংখ্যক ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ও অনেক সহকারীসহ এক গবেষণাগারের প্রয়োজন হয়। তিনি এসব সরকারি আনুকূল্যে, অথবা আমেরিকায় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে করতে পারেন। এভাবে তিনি আর স্বাধীন কর্মী হয়ে থাকতে পারেন না, বরং অবশিষ্টভাবে কোন বিশাল সংগঠনের অচ্ছেদ্য রূপে পরিচিত হন। এই পরিবর্তন খুবই দুর্ভাগ্যজনক, কারণ একজন বিখ্যাত মানুষ উপরোক্ত ক্ষমতার সাহায্যে যা করতে পারেন, তার তুলনায় তিনি একক ও স্বতন্ত্রভাবে যা করতে পারেন, তা অধিকতর মঙ্গলদায়ী হওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন ক্রীতদাস বা একজন স্বৈরাচারীর ভূমিকা ছাড়া, মানবিক বিষয়াদি প্রভাবিত করতে ইচ্ছুক কোন মানুষের সফল হওয়া খুবই দুরূহ একজন রাজনীতিবিদরূপে তিনি নিজেকে একটি রাষ্ট্রের প্রধানরূপে তৈরি করতে পারেন, অথবা একজন বিজ্ঞানীরূপে তিনি সরকারের কাছে তার শ্রম বিক্রয় করতেও পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁকে তাঁর নিজের নয়, সরকারের উদ্দশ্যেই পূরণ করতে হবে।

এবং, শুধুমাত্র বিরল ও ব্যতিক্রমী খ্যাতিসম্পন্ন মানুষদের ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিস্তৃততর পরিসরের প্রতিভার ক্ষেত্রেও এটা খাটে। যেসব আমলে বিখ্যাত কবিরা ছিলেন, সেই একই আমলে বহুসংখ্যক ছোটখাটো কবিও ছিলেন এবং যখন খ্যাতিমান চিত্রকররা ছিলেন, তখনও ছোটমাপের শিল্পীরাও ছিলেন। বিখ্যাত সব জার্মান সুরকারদের এমন একটা লোকবৃত্তে উত্থান ঘটেছিল, যেখানে সঙ্গীতের মর্যাদা ছিল, এবং যেখানে কমসংখ্যক মানুষ সুযোগ খুঁজে নিতেন। সেই সব দিনগুলোতে কবিতা, চিত্রকলা এবং সঙ্গীত ছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-এখন যেমন খেলাধুলা । কোন বড় মাপের ধর্মগুরুর উত্থান ঘটতো একদল ছোটখাটো ধর্মগুরুদের মধ্যে থেকে। এসবক্ষেত্রে আমাদের যুগের হীনতাভাব ছিল এই ঘটনার অনিবার্য ফল যে, সমাজ আজ এতটাই কেন্দ্রীভূত ও সংগঠিত যে, ব্যক্তি-উদ্যোগের অবনমন ঘটেছে, একেবারে ন্যূনতম স্তরে। অতীতে যেখানে শিল্পকলা পল্লবিত হয়েছে, তখন তা ছোটখাটো গোষ্ঠীর মধ্যে নিয়মমাফিক ঘটেছে এবং যেসব গোষ্ঠীর মধ্যে ছিল প্রতিবেশীসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা-যেমন, গ্রিসের নগররাষ্ট্র, ইতালীয় নবজাগরণের অতিক্ষুদ্র রাজত্ব এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান শাসকদের ক্ষুদ্র রাজসভা। এসব শাসকদের তরফে একজন সঙ্গীতবিদকে রাখতেই হতো, এবং একবার এইভাবে ছিলেন সেবাস্টিয়ান বাখ, কিন্তু এমনকী তিনি যদি নাও থাকতেন, শ্রেষ্ঠ দক্ষতা প্রদর্শনে তাঁর অবাধ স্বাধীনতা ছিল । এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়, স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে এমন কিছুও রয়েছে । এমনকী গির্জার প্রাসাদেও এমন ধরনের রেষারেষির অস্তিত্ব ছিল, কারণ প্রত্যেক খ্রিস্ট যাজক চাইতেন, প্রতিবেশী গির্জার চেয়ে একটি সুন্দরতর গির্জার অধিকারী হতে। ব্যাপারটা খুব ভাল হতো, যদি নগরগুলোর মাধ্যমে কোন শিল্পগত গরিমা প্রস্ফুটিত হতো, যার ফলশ্রুতিতে অনিবার্য ছিল পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, এবং যদি প্রত্যেকের থাকতো তার নিজের সঙ্গীত ও শিল্পকলার স্কুল, অবশ্যই তার মধ্যে থাকা জরুরি ছিল পরবর্তী নগরের স্কুলের প্রতি তীব্র অবজ্ঞা। তবে, সাম্রাজ্যশাসিত ও অবাধ গতিশীলতার জগতে এই ধরনের স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতার সুবাদে তাৎক্ষণিক সমৃদ্ধি ঘটতো না। একজন কোরিনথিয়ার মানুষের প্রতি একজন এথেনীয়, অথবা একজন ভেনিসবাসীর প্রতি একজন ফ্লোরেন্সের মানুষের যে অনুভূতি রয়েছে, একজন ম্যানচেস্টারবাসীর সেরকম কোন তাৎক্ষণিক অনুভূতি থাকতে পারে না শেফিল্ডের কোন মানুষের প্রতি। কিন্তু, এসব অসুবিধা সত্ত্বেও, আমি মনে করি-স্থানিকতার প্রতি এ ধরনের গুরুত্বদানের বিষয়টির মোকাবিলা করতে হবে, যদি মানুষের জীবন ক্রমশ নীরস ও একঘেঁয়ে না হয়ে উঠতে চায়।

একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর সদস্যভুক্তি সত্ত্বেও আদিম মানুষ এমন জীবন অতিবাহিত করতো সেখানে গোষ্ঠী কর্তৃক তার উদ্যোগ খুব বেশি বাধাপ্রাপ্ত হতো না। শিকার ও যুদ্ধের মতো প্রায়শই যেসব বিষয়ে সে আত্মনিয়োজিত হয়ে থাকতে চাইত, তার প্রতিবেশীও ওই একই ধরনের কর্মব্যস্ততা চাইত, এবং যদি সে ভেষজ-ব্যক্তিত্বের প্রতি ঝোঁক অনুভব করতো, তাহলে তাকে শুধুমাত্র নিজেকে এমন কোন ব্যক্তির অনুগ্রহভাজন হতে হতো, যিনি ইতোমধ্যেই ওই পেশায় খ্যাতিঅর্জন করেছেন, এবং এভাবে যথাসময়ে তাঁর জাদুশক্তির সাহায্যে সাফল্য ঘটতো। যদি তার থাকতো বিরল জাতের প্রতিভা, তাহলে সে অস্ত্রশৈলীতে কোন উন্নতি অথবা শিকারকর্মে নতুনতর দক্ষতা উদ্ভাবনে সক্ষম হতো। এসবের ফলে তাকে গোষ্ঠীর কোন বিরোধিতার মুখে পড়তে হতো না, বরং তাকে স্বাগতই জানানো হতো। আধুনিক মানুষকে খুবই জটিল ধরনের জীবনযাপন করতে হয়। যদি সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান করে, তাহলে ধরে নেওয়া হবে, সে একজন মাতাল; যদি সে নাচে, তাহলে কোন পুলিশ যান-চলাচলে বিঘ্ন ঘটানোর দায়ে তাকে ভর্ৎসনা করবে। যদি না সে ব্যতিক্রমীভাবে ভাগ্যবান হয়, তার কাজের দিনগুলো হয় সম্পূর্ণ একঘেঁয়ে, এই একঘেঁয়েমির কারণ হল-সে যে কাজ করে থাকে, তা অ্যাকিলিসের ঢালের মতো সুন্দর কর্মসৌষ্ঠবের নিদর্শন রূপে মূল্যবান নয়, বরং তার উৎপাদিত পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল এর উপযোগিতা। যখন, তার কাজ শেষ হয়, সে মিল্টনের মেষপালকের মতো উপত্যকার কাঁটাগাছের তলদেশে তার গল্প বলতে পারে না, কারণ সে যেখানে বসবাস করে, প্রায়শই তার ধারে কাছে কোন উপত্যকা থাকে না, আর যদিও বা থাকে, তা শুধু রাংতায় মোড়া এবং আমাদের প্রতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে সে সর্বদা মানসিকভাবে আচ্ছন্ন থাকে আগামী দিনের চিন্তায়। খ্রিস্টের উপদেশাবলির তাবৎ নীতি-নির্দেশের মধ্যে খ্রিস্টানরা সর্বাধিক অবহেলা করেছেন যেটি, তা হল-আগামী দিনের জন্য কোন চিন্তাকে প্রশয় না দেওয়ার বাইবেল-নির্দেশিত বিধান। যদি সে দূরদর্শী হয়ে থাকে, তাহলে আগামী দিনের চিন্তা তাকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করবে; যদি সে অদূরদর্শী হয়, তাহলে সে সহজেই বুঝতে পারবে যে, ঋণপরিশোধে যে সক্ষম নয়। দুটি ক্ষেত্রের প্রত্যেকটিতেই, প্রতিটি মুহূর্তেই তার স্বাদ হারায়।

প্রতিটি ঘটনাই সংগঠিত, কোন কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত নয় । নাৎসীরা সংগঠিত করেছিল ‘আনন্দের মধ্যে দিয়ে শক্তি, কিন্তু সরকার-নির্ধারিত আনন্দের খুব বেশি আনন্দদায়ক না হওয়ারই সম্ভাবনা। আর, যাদের মধ্যে সারগর্ভ উচ্চাশা রয়েছে, সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীভবনের প্রভাব হল-অত্যধিক সংখ্যক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের টেনে আনা, এবং অন্যান্য সমরুচির বলয়ে থাকতে বাধ্য করা। আপনি যদি একজন চিত্রশিল্পী হতে ইচ্ছা করেন, তাহলে আপনি কখনই আপনার নিজের শহরের একই ইচ্ছাসম্পন্ন মানুষদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে পারবেন না। আপনি কোন মহানগরীর কোন চিত্রকলার স্কুলে যাবেন এবং সেখানে আপনি সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন যে, আপনি খুবই গড়পড়তা ধরনের, এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আপনি এতটাই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তে পারেন যে আপনি আপনার আঁকার ব্রাশ ইত্যাদি ছুঁড়ে ফেলতে চাইবেন এবং তারপর, আপনি টাকা কামানোর ধান্দায় বা মদ্যপানেও নেমে পড়তে পারেন, কারণ কোন কাজে সাফল্যের জন্য এক নির্দিষ্ট মাত্রার আত্মবিশ্বাস খুবই জরুরি। নবজাগরণের ইতালিতে আপনি সিয়েনার সেরা চিত্রশিল্পী হওয়ার বাসনা লালন করে থাকতে পারেন, এবং এই অবস্থান নিশ্চিতভাবেই যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু, এখন আপনি একটি ছোট্ট শহরে সমস্ত প্রশিক্ষণ অর্জন করে আপনার প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন না। আমরা অনেক বেশি জানি এবং অনেক কম অনুভব করি। অন্ততপক্ষে, আমরা সেসব সৃজনমূলক আবেগকে কদাচিৎ অনুভব করি, যেগুলো থেকে একটা উত্তম জীবন উৎসারিত হয়। যা গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে আমরা নিষ্ক্রিয়; যেখানে আমরা সক্রিয়, সেই ক্ষেত্রটি হল-তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়াদি শুধুমাত্র বিপর্যয়ের সূত্রে প্রাপ্ত একঘেঁয়েমি থেকে যদি জীবনকে বাঁচাতে হয়, তাহলে ব্যক্তি-উদ্যোগের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমেই উপায় খুঁজে বের করতে হবে, কেবলমাত্র তুচ্ছ বিষয়-ঘটনার মধ্য দিয়ে নয়, বরং কার্যকারিতাসম্পন্ন জিনিসের মধ্য দিয়েও তা করতে হবে। বিশাল জনসংখ্যার বাস্তব অস্তিত্ব যার ওপর নির্ভর করছে, সেরকম আধুনিক সংগঠনের সংশ্লিষ্ট প্রত্যঙ্গগুলোকে ধ্বংস করা উচিত-আমি তা মনে করি না। কিন্তু আমি বলতে চাই আমাদের চিন্তা ও অনুভূতির তাল রাখতে অক্ষম, এরকম অসহনীয় দ্রুত বৃদ্ধি ও কেন্দ্রীভবনের তুলনায় ওই ধরনের সংগঠনের আরও নমনীয় হওয়া প্রয়োজন, তার নৈর্ব্যক্তিক বিশালতার মাধ্যমে মানবিক উদ্দীপনার প্রতি কম নিপীড়ক হওয়াও একান্তভাবে বাঞ্ছনীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *